অর্জুন এবার বাংলাদেশে (২০১৫)
অর্জুন সমগ্র ৬ – সমরেশ মজুমদার
অমল সোম এখন মানেভঞ্জনে। ঘুম স্টেশন থেকে সান্দাকফু যাওয়ার পথে যে ছোট্ট পাহাড়ি শহর পড়ে তার নাম মানেভঞ্জন। দার্জিলিং থেকে বাসে চেপে এককালে মানেভঞ্জন পর্যন্ত যাওয়া যেত, এখন তো গাড়ি সান্দাকফুতে পৌঁছে যাচ্ছে।
বয়স বাড়ার পরে অমল সোমের একটা পরিবর্তন হয়েছে। ইদানীং তিনি তার শিষ্য অর্জুনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় বাড়িতে থাকেন বড়জোর দু’মাস। বাকি দশ মাস পাহাড়ে পাহাড়ে কাটিয়ে দেন, কয়েক মাস হল আছেন মানেভঞ্জনে। কিছুদিন আগে ফোন করে বলেছিলেন, একবার ঘুরে যেতে পারো, জলপাইগুড়ি থেকে তো বেশি দূরে নয়।
এখন অর্জুনের পশার বেড়েছে। উত্তরবঙ্গে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অপরাধীদের সংখ্যাও বাড়ছে। ব্যস্ততা থাকছে সারা মাস। তবু মা বললেন, বড় মুখ করে বললেন, যা ঘুরে আয়। আজ তুই যা করছিস তা তো উনিই তোকে শিখিয়েছেন। একসময় মা চাইতেন অর্জুন চাকরি করুক। সত্যসন্ধান করে কেউ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে বলে তার মনে হত না। কিন্তু ক্রমশ এই বিষয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রায় উলটো সুর তার গলায়, রোজগার যখন ভালই করছিস তখন আর আমি একা থাকি কেন? এবার বিয়ে কর।
অর্জুন হেসেছিল, আমার প্রফেশনে কেউ বিয়ে করে না। ফেলুদা, কাকাবাবু, জেমস বন্ড কি বিয়ে করেছেন? যে বউ হয়ে আসবে সে শান্তি পাবে না।
মা দমবার পাত্রী নন, বললেন, কেন? ব্যোমকেশ বক্সী বিয়ে করেননি? সত্যবতীর কথা ভুলে গেলি? সে কি অশান্তিতে ছিল?
সময় পালটে গেছে মা!
বা রে। সময় যদি পালটে গিয়ে থাকে তা হলে ব্যোমকেশের কাহিনি নিয়ে একের পর এক ছবি হচ্ছে কী করে! ঠিক আছে, আমিও তোর সাথে মানেভঞ্জনে যাব। তোর গুরুকে জিজ্ঞাসা করব। দেখি তিনি কী বলেন? মা ঘোষণা করলেন।
বাড়িতে মাত্র দু’জন লোক। খালি বাড়ি তালাবন্ধ করে বাইরে যাওয়ার কথা মা এতদিন ভাবতেই পারতেন না, অথচ এখন পাহারাদার জোগাড় করে ফেললেন। আজ গিয়ে পরশু ফেরার শর্তে অর্জুনকে রাজি করিয়ে সকাল সকাল রওনা হলেন। মায়ের ইচ্ছে ছিল কদমতলার মোড় থেকে বাসে উঠে ঘুমে নেমে আবার বাস বদলাবেন। কিন্তু অর্জুন গাড়ি ভাড়া করল। মালিক এবং ড্রাইভার তার পরিচিত।
জলপাইগুড়ি ছাড়াতেই অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ঘোমটা দিয়েছ কেন?
মা হেসে ফেললেন, অনেককাল পরে বের হলাম তো। কখন পৌঁছাব রে!
বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা দেওয়ার কী সম্পর্ক অর্জুন বুঝতে পারল না।
ঘণ্টা পাঁচেক লাগার কথা। অর্জুন মায়ের দিকে তাকাল, কেমন লাগছে তোমার?
খুব ভাল। কতদিন পরে এইসব মাঠ, রাস্তা দেখছি। তোর বাবার সঙ্গে তো একবারই দার্জিলিঙে গিয়েছিলাম। তখন তুই ক্লাস ওয়ানে পড়তিস!
মায়ের কথা শুনে অর্জুনের মনে হল তার উচিত মাঝে মাঝে মায়ের জন্যে সময় দেওয়া। একটি মানুষ সারাজীবন ঘরে থেকে তার জন্যে শুধুই করে যাবে আর সে বাইরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, এটা ঠিক নয়।
সুকনা ছাড়াবার কিছু পর থেকেই পাহাড় শুরু হয়েছিল। সেই পাহাড় বড় হতে হতে যখন পর্বত হয়ে গেল তখন ঘুম-সুখিয়াপোখরি হয়ে মানেভঞ্জনে পৌঁছে গেল অর্জুনের গাড়ি। এখন দুপুর দুটো। অমল সোম বলেছিলেন মানেভঞ্জনের পোস্টঅফিসের পোস্টমাস্টার নৃপেন্দ্র তামাংকে জিজ্ঞাসা করলেই তার বাড়ির পথ জানা যাবে। পোস্টঅফিসে পৌঁছে তামাং সাহেবের সঙ্গে দেখা করে অমল সোমের কথা বলতে তিনি বেরিয়ে এলেন। বললেন, এখান থেকে এক মাইল দূরে উনি থাকেন। আপনাদের ড্রাইভারকে আমি রাস্তা বুঝিয়ে দিচ্ছি।
রাস্তা বুঝে নিয়ে জমজমাট এলাকা ছেড়ে সুরকি বিছানো পথ ধরল গাড়ি। একপাশে খাদ, অন্যপাশে পাহাড়। মাঝে মাঝে বাড়ি। ইতিমধ্যে ঠান্ডা বেড়ে যাওয়ায় অর্জুন নীল পুলওভার পরে নিয়েছে, মায়ের গায়ে শাল। ক্রমশ পথটা অত্যন্ত নির্জন হয়ে গেল। মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। একসময় ড্রাইভার বলল, ওই যে বাংলো।
দেখে মুগ্ধ হল অর্জুন। রাস্তায় গা ঘেঁষে সিঁড়ি উঠে গেছে কয়েক ধাপ, তার ওপর চাতাল। চাতালের ওপাশে ছবির মতো বাড়ি। সিঁড়ির একপাশে খানিকটা খোলা জায়গা দেখে সেখানে গাড়ি পার্ক করল ড্রাইভার।
গাড়ি থেকে নেমে মা বললেন, কী সুন্দর জায়গা। আমার তো স্বর্গ মনে হচ্ছে!
ঠান্ডা লাগছে না তো!
না। এই শালটা তোর বাবা দার্জিলিং থেকে কিনে দিয়েছিল। মা বললেন।
অবাক হয়ে গেল অর্জুন। অন্তত একুশ বছরের পুরনো শাল। কোনওদিন মাকে ব্যবহার করতে দেখেনি সে। অথচ এমন যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন যে মনে হচ্ছে একেবারে নতুন।
ওপরের দরজা খুলে একটা নেপালি ছেলে দৌড়ে নেমে এল। তারপর অমল সোমের গলার স্বর কানে এল, সুস্বাগতম। হোয়াট এ সারপ্রাইজ। আপনি এসেছেন, আমার কী সৌভাগ্য।
অমল সোম হাতজোড় করে নমস্কার করতেই মা নমস্কার করলেন।
অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
একদম না। আপনি কেমন আছেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
আমি তো কখনও খারাপ থাকি না। আসুন ওপরে আসুন। অমল সোম এগোলেন।
.
এই বাংলোয় চারটে বেডরুম। ওদের দুজনকে দুটো দেওয়া হল। বড় বড় কাঁচের জানলার বাইরে পাহাড়, দুরে সাদাটে পাহাড়ের চূড়ো। অমল সোম বললেন, আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন। লাঞ্চ তৈরি আছে। অর্জুন, তুমি কাল একবারও বলোনি মাকে নিয়ে আসছি!
অর্জুন হাসল, আমার ওপর সেইরকম নির্দেশ ছিল।
অ। কিন্তু ওঁর খাওয়াদাওয়ার ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে কি না জানি না।
মা বললেন, মানতে পারিনি। ছেলের জেদের কাছে হার মেনেছি। ও বলেছিল আমি মাছ-মাংস না খেলে ও খাবে না।
ঠিক করেছে। এদেশের স্ত্রীরা গত হলে ক’টা স্বামী মাছ-মাংস ছেড়ে দেয়? ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে নিন আপনারা। তবে প্রথমদিন, বেলাও হয়ে গেছে, স্নান করবেন না। আমি ডাইনিং রুমে অপেক্ষা করছি। বেরিয়ে গেলেন অমল সোম।
ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারি আর রুই মাছের কালিয়া। খেতে শুরু করে মা জিজ্ঞাসা করলেন, কে বেঁধেছে?
শ্যাম। আমার যাবতীয় সাংসারিক কাজকর্ম ওই করে। অমল সোম বললেন।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এই বাংলো কি আপনি ভাড়া নিয়েছেন?
না না। আমার এক বন্ধু জয়বাহাদুর থাপার বাংলো এটা। কয়েক মাস থাকতে চেয়েছিলাম ভাড়ার বিনিময়ে। শুনে ভদ্রলোক খুব আহত হয়েছেন। বহু বছর আগে উনি আমার দ্বারা সামান্য উপকৃত হয়েছিলেন এবং সেটা ভুলে যাননি। অমল সোম বললেন।
খাওয়া শেষ হলে অমল সোম অর্জুনের মাকে বললেন, আপনি বিশ্রাম নিন। যদি বৃষ্টি না আসে তা হলে বিকেলে একটু বেড়িয়ে আসতে পারেন। এই জায়গাটা সন্ধের আগে একদম নিরাপদ।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, সন্ধের পরে নয়?
তেমন কোনও ঘটনা গত দুইমাস ঘটেনি। তবে শ্যাম বলে মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে নেকড়েরা নেমে আসে। কিন্তু তারা বাড়ির ভেতর কখনওই ঢোকে না। এসো অর্জুন।
বসার ঘরে ওরা বসল। জানলাগুলো ভোলা। এখনও পাহাড়ের গায়ে রোদ। আকাশ পরিষ্কার। কিন্তু নীলচে রং, খুব হালকা হলেও, সেই আকাশ থেকে নেমে এসেছে।
অমল সোম বললেন, আজ এসে খুব ভাল করেছ। আমার এই বাংলোতে একজন গেস্ট এসেছেন। সকালে দার্জিলিং-এ গিয়েছেন, একটু পরেই ফিরে আসবেন।
আপনার কোনও বন্ধু?
না। তবে পরিচিত। ভদ্রলোকের নাম ফয়েজুর রহমান। উনি বাংলাদেশের একজন বড় ব্যাবসাদার। ইম্পোর্ট এবং এক্সপোর্টের ব্যাবসা করেন। ওঁর ছোট মেয়ে দার্জিলিং-এ পড়াশোনা করে। তাকে দেখতেই তিনি সেখানে গিয়েছেন। অমল সোম বললেন।
ও। আপনার সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল?
শিলিগুড়ির ব্যাবসাদার সৈকত আলির একটি সমস্যার সমাধান করেছিলাম। তারপর সৈকত আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলত। একবার তার সঙ্গে বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন সৈকত আমাকে নিয়ে এই ফয়েজুরভাইয়ের বাড়িতে উঠেছিল। খুব অমায়িক ভদ্রলোক। ওঁর বড় মেয়ে বিয়ের পর থেকে আমেরিকায় থাকে। ছোটমেয়েকে দার্জিলিং-এ পড়াচ্ছেন। মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে মাঝে মাঝেই আসেন। আমি এখানে আছি জেনে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে এখানে থাকতে অনুরোধ করেছিলাম। উনি আসায় জানতে পারলাম ভদ্রলোক এখন খুব বিপদের মধ্যে আছেন। অমল সোম বললেন।
কী বিপদ?
সেটা উনি যদি তোমাকে বলতে ইচ্ছুক হন তা হলে ওঁর মুখ থেকেই শুনবে। এখন বলো, এই জায়গাটাকে তোমার কীরকম লাগছে?
খুব ভাল। তবে বড় নির্জন। নিরাপত্তা আছে তো?
গত দুই মাস কোনও বিপদ ঘটেনি। মোবাইলে সবসময় টাওয়ার থাকে। থানায় ফোন করলে দশ মিনিটে পুলিশ চলে আসতে পারে। তা ছাড়া এখানকার মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়, বিনয়ী। আমার সঙ্গে অনেকের আলাপও হয়ে গেছে।
যে পথ দিয়ে এলাম সেটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে?
একটু গেলেই পাহাড়ি বস্তি। সেখানেই শেষ। কয়েকটা দোকান আছে। বাজারও বসে। টুকটাক কেনাকাটা শ্যাম ওখান থেকেই করে। এই শীতটা আমি এখানেই থাকব। শুনেছি এখানে প্রচণ্ড শীত পড়ে। দেখা যাক। অমল সোম হাসলেন।
অমলদা, আপনার তো বয়স হয়েছে–! মানে, প্রচণ্ড ঠান্ডায় থাকা কি ঠিক হবে?
হো হো করে হাসলেন অমল সোম। তারপর বললেন, শীতটাকে চলে যেতে দাও, তারপর তোমার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব।
.
বিকেলে ওঁরা হাঁটতে বের হলেন। কিন্তু কিছুটা যেতেই অমল সোম বললেন, না হে, আজ থাক। দেখো, ওই পাহাড়ের পেছনে মেঘ জমেছে। যদি ওই মেঘ বড় হয় তা হলে এদিকে খুব ঝড়জল হবে। তারপর অর্জুনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, সকালটা এখানে খুব পরিষ্কার থাকে। যদি দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস না থাকে তা হলে কাল বের হতে পারেন।
না না, ঠিক আছে। মা বললেন।
বাংলোয় ফিরে এসে বোঝা গেল অমল সোমের অনুমান ভুল নয়। খুব দ্রুত আকাশ গিলে ফেলছে মেঘ। একটুখানি থেকে বিশাল চেহারা নিয়ে ফেলেছে এরই মধ্যে। অমল সোম ঘড়ি দেখছিলেন। তাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল। কিন্তু তখনই গাড়িটা হেডলাইট জ্বালিয়ে বাংলোর সামনে এসে থামল। অমল সোম বললেন, থ্যাঙ্ক গড। উনি এসে গিয়েছেন। টেনশন হচ্ছিল। পাহাড়ে বৃষ্টি নামলে সবকিছু আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে যায়।
দরজা খুলে অমল সোম বাইরে পা রাখলে অর্জুন অনুসরণ করল। গাড়ি থেকে নামলেন একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। বেশ মোটাসোটা, কালো চুল। ওদের দেখে হাত তুললেন। তারপর গাড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, নেমে এসো।
এবার বেরিয়ে এল বছর ষোলো-সতেরোর একটি মেয়ে। এই অন্ধকার হয়ে আসা মেঘের সন্ধেবেলায় অর্জুনের মনে হল জায়গাটা যেন আলোকিত হয়ে গেল। খুব ফরসা, অত্যন্ত সুন্দরী জিনস আর জ্যাকেট-পরা মেয়েটি ফঁপানো চুলে হাত বুলিয়ে উপরে উঠে এল। ফয়েজুর রহমান বললেন, কাল ছুটি আছে বলে মেয়ে আজ আমার সঙ্গে থাকতে চাইল। আপনার অনুমতি না নিয়েই চলে এলাম।
আশ্চর্য! ও আসবে বলে অনুমতি নিতে হবে নাকি। এসো মা। কী নাম?
দিয়া। দিয়া রহমান। মেয়েটি হেসে বলল। তারপর এগিয়ে এসে অমল সোমের পা স্পর্শ করল।
ড্রাইভার ততক্ষণে একটা সুটকেস নামিয়ে গাড়ি ফিরিয়ে চলে গেছে।
ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে শ্যাম সুটকেসটা ঘরে নিয়ে যেতেই প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা নেমে এল। দ্রুত ভিতরে ঢুকে অমল সোম সবাইকে বসতে বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ফয়েজুর রহমান বললেন, আচ্ছা! আপনি অর্জুন! আপনার কথা দাদার কাছে অনেক শুনেছি। ভাগ্যচক্রে দেখা হয়ে গেল।
মা বললেন, তোমার নামটি খুব মিষ্টি। কে রেখেছিল?
আবু। দিয়া মিষ্টি হাসল।
হস্টেলে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? সবাইকে ছেড়ে আছ, মন খারাপ হয় না?
আগে খুব হত। এখন সয়ে গিয়েছে। দিয়া বলল।
বাঃ। তুমি আমার ঘরে থাকবে? বড় খাট, আমরা গল্প করতে পারব। মা বললেন।
ফয়েজুর রহমান বললেন, বাঃ, এ তো খুব ভাল কথা। যাও মা, চেঞ্জ করে নাও।
এই সময় বৃষ্টি নামল। ভয়ংকর শব্দ বাজছে বাংলোর ছাদে, গাছের পাতায়। ঘন অন্ধকারে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির আওয়াজ মিশে যাওয়ায় মনে হচ্ছে প্রলয় এসে গেছে।
অমল সোম বললেন, এই যে বৃষ্টি শুরু হল ভোরের আগে থামবে বলে মনে হয় না। আপনাদের যদি কিছুর দরকার হয় তা হলে বেল বাজাবেন, শ্যাম ঠিক পৌঁছে যাবে। অর্জুন, দিয়ার সুটকেসটা তোমার মায়ের ঘরে রেখে দিয়ে এসো।
দিয়া অর্জুনের দিকে তাকিয়ে হাসল, থ্যাঙ্ক ইউ!
অর্জুন বুঝতে পারল এই ধনী পরিবারের মেয়েটি পরিশ্রম না করাতেই অভ্যস্ত। কেউ না কেউ ওর কাজ করে দিয়ে থাকে। জলপাইগুড়ির যে কোনও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হলে বলত, থাক থাক, আমি নিজেই নিয়ে যেতে পারব। দিয়া বলল না। চুপচাপ মায়ের ঘরে সুটকেস পৌঁছে দিয়ে ফিরে এল অর্জুন।
বৃষ্টির শব্দ আরও বেড়েছে। সোফায় বসে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এখানে ধস নামে না?
পাহাড়ে ধস নামা তো স্বাভাবিক ঘটনা। তবে ইদানীং নেমেছে কি না জানি না। কেউ বলেনি! ফয়েজুর রহমানের দিকে তাকালেন অমল সোম, আপনাদের ওখানে এই বৃষ্টি কয়েকদিন হলে বন্যা হয়ে যেত, তাই না?
ফয়েজুর রহমান বললেন, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে আগের মতো বন্যা হচ্ছে না। তবে এইরকম বৃষ্টি হলে দেশের বাড়িতে গিয়ে থাকার কথা ভাবতাম না।
জলের জন্যে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
ফয়েজুর রহমান মাথা নাড়লেন, যার অর্থ না। মুখে কিছু বললেন না।
অমল সোম বললেন, অর্জুনকে বলছিলাম আপনি বেশ সমস্যায় আছেন। কী সমস্যা তা বলিনি। আপনি ইচ্ছে করলে বলতে পারেন।
ফয়েজুর রহমান অর্জুনের দিকে তাকালেন, ভাই, খুব সমস্যায় আছি। আপনার দাদার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। কিন্তু বয়সের দোহাই দিয়ে উনি যেতে রাজি হননি। যখন দেশের বাইরে চলে আসি তখন মনে হয় সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু ফিরে গেলেই আতঙ্ক বেড়ে যায়। মুশকিল হল, এবার ইন্ডিয়াতে এসেও স্বস্তি পাচ্ছি না। এই যে মেয়েকে নিয়ে দার্জিলিং থেকে ফিরছিলাম, যেই আকাশে মেঘ দেখলাম, চারধারের আলো কমে আসতে লাগল, অমনি মনে হল এই পাহাড়ি পথে গাড়ি খারাপ হলে কী করব! ফয়েজুর বললেন, কতবার এদেশে এসেছি, কখনও এইরকম বোধ। হয়নি। আসলে ওখানে যে আতঙ্ক আমাকে তাড়া করে বেড়ায় তা মনের জোর অনেক কমিয়ে দিয়েছে।
বাজ পড়ল। কাঁচের জানলার ওপাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। ফয়েজুর উদ্বিগ্ন মুখে সেদিকে তাকালেন। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি আতঙ্কের কথা বলছেন, একথা পুলিশকে জানিয়েছেন?
আমার এক বন্ধু পুলিশের উপরতলার অফিসার। শুনে বলেছে আমার নাকি একজন ভাল মনস্তাত্ত্বিকের কাছে যাওয়া উচিত। থানায় গেলে আমাকে পাগল ভাববে। ফয়েজুর রহমান বললেন।
অর্জুন অমল সোমের দিকে তাকাল। অমল সোম বললেন, ফয়েজুরভাই ব্যাবসার কাজের সুবিধের জন্যে ঢাকায় বনানীতে থাকেন। ওখানে তার তিনতলা বাগানঘেরা বাড়ি, বিদেশি দামি গাড়ি, কাজের লোকজন আছে। স্ত্রী গত হওয়ার পর থেকেই দুটি মেয়েকে ঘিরেই ওঁর সাংসারিক জগৎ। বড়জন আমেরিকায় থাকে। দিয়াকে দশ বছর বয়স থেকেই উনি দার্জিলিং-এ ভরতি করে দিয়েছেন। ছুটির সময় সে দিদির কাছে বেড়াতে যায়। ওকে দেশে নিয়ে যেতে চান না ওই আতঙ্কের জন্যে।
আতঙ্ক কী জন্যে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
ফয়েজুর রহমান বললেন, আমি বলছি। তার আগে জিজ্ঞাসা করব, আপনি ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন? তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কি আপনার সন্দেহ আছে?
অর্জুন হেসে ফেলল।
আপনি হাসছেন কেন? ফয়েজুর প্রশ্ন করলেন।
হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এই প্রশ্ন করে গেছে। বিজ্ঞান বাতিল করে দিলেও পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। উলটে যুক্তি দেখিয়েছে, ভূত যদি না থাকে তা হলে ভগবানও নেই, ভূতকে দেখা যায় না, শোনা যায় কেউ ভূত দেখেছে। যে দেখেছে তাকে জেরা করলে বোঝা যায় সে কল্পনা করেছে। ভগবানকেও কেউ দেখেনি। যাঁরা মনে করেন ভগবান আছেন তারা অনুভবে তাকে দেখে থাকেন। অতএব, এই ধাঁধার উত্তরটা জানি না, অর্জুন বলল।
ঠিকই বলেছেন, আমিও কখনও ভূত দেখিনি কিন্তু অনুভব করেছি। আর সেই অনুভব আমার নার্ভকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এই কারণে আমি দেশের বাড়িতে যেতে চাই না। কিন্তু আমার বনানীর বাড়িতে বসেও আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি না। ফয়েজুর রহমান চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নিলেন।
দেশের বাড়িতে ঠিক কী হয় যা আপনার কাছে আতঙ্কের? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
ম্লান হাসলেন ফয়েজুর রহমান। সব কথা আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। একটা কিছু যা অনুভব করেছি তা বললে আপনার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমি মিস্টার সোমকে অনুরোধ করেছিলাম আমার দেশের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু উনি এখন অন্য জগতে বাস করছেন। আর আগের মতো সত্যসন্ধান করতে চান না।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি ঠিক কী চাইছেন?
খুব সাধারণ চাওয়া। আমার দেশের বাড়িটিতে আগের মতো সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই। আর এই কাজটির জন্যে আমি যথেষ্টই সম্মানদক্ষিণা দিতে রাজি। আমার মেয়েদের নিয়ে আমি পিতৃপুরুষের বাড়িতে বাস করতে পারছি না। এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কী থাকতে পারে?
কে আপনাকে বাধা দিচ্ছে?
ও, আপনাকে তো বলেছি, ঘটনাস্থলে না গেলে এই প্রশ্নের উত্তর জানা সম্ভব নয়। ফয়েজুর রহমানের কথা শেষ হতেই ভয়ংকর শব্দে মেঘের গর্জন হল, বাজ পড়ল কাছাকাছি। এক পলকের জন্যে বাইরের পৃথিবীটা সাদা হয়ে গিয়েই আরও বেশি কালো হয়ে গেল। ঠিক তখনই মা দিয়াকে নিয়ে বসার ঘরে এলেন।
অমল সোম বললেন, এসো, আসুন। কেমন লাগছে?
মা বললেন, এত জোরে শব্দ হচ্ছে যে–! ঠান্ডাটাও বেড়ে গেল!
দিয়া বলল, দার্জিলিং-এর থেকে বেশি ঠান্ডা এখানে!
শ্যাম এসে দাঁড়াল, চা রেডি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। চলুন, একটু চা সেবন করা যাক।
ডাইনিং রুমের বড় টেবিলের চারধারে বসার পরে মা জিজ্ঞাসা করলেন, দিয়া, তুমি কি চা খাও? আজকাল শুনি অল্পবয়সিরা চা খেতে চায় না!
আমি গরমকালে চা খাই না। আমেরিকায় গেলে তো নয়ই।
ওমা, কেন? মা অবাক।
ওখানে টিব্যাগ ব্যবহার করে, আমার একটুও পছন্দ নয়।
চায়ের সঙ্গে প্যাটিস, খেতে ভালই লাগছিল অর্জুনের। অমল সোম বললেন, রাত্রে ঠান্ডা আরও বাড়বে। শ্যাম, ডিনার একটু তাড়াতাড়ি দিয়ো।
দিয়া অর্জনের দিকে তাকাল, আন্টির কাছে আপনার কথা শুনছিলাম। আপনি ডিটেকটিভ? আমি জানতাম ডিটেকটিভরা একটু বয়স্ক হয়!
যেমন? অমল সোম হাসলেন।
শার্লক হোমস, এরাকুল পোয়ারো, জেমস বন্ড–! দিয়া বলল।
জেমস বন্ড কি ডিটেকটিভ চরিত্র? নিশ্চয়ই না!
মাথা নাড়ল দিয়া, ও। হ্যাঁ, তাই তো!
অমল সোম মায়ের দিকে তাকালেন, অর্জুন যদি বাংলাদেশে যায় তা। হলে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি হবে না!
ওমা, আপত্তি হবে কেন? আর আপনি যদি যেতে বলেন তা হলে আমার তো আপত্তি করার কোনও কারণই থাকবে না। কী রে, যাচ্ছিস নাকি?
অর্জুন চোখ বড় করল, আমি এই প্রথমবার শুনলাম। দিয়া হাসল, ঢাকার রাস্তায় খুব ট্র্যাফিক জ্যাম হয় কিন্তু আমাদের বাড়ি যেখানে সেখানে হয় না। গেলে আপনার খুব ভাল লাগবে।
অমল সোম বললেন, অর্জুন, ফয়েজুরভাই যখন বলছেন তখন তুমি একবার ঘুরে এসো। আর কিছু না হোক, নতুন দেশ দেখা হবে। মনে রেখো, বাংলাদেশের বাঙালিরাই বিদেশিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা এনেছেন। আজকের বাঙালিদের যত কৃতী পুরুষ, যাদের নিয়ে গর্ব করা যায় তাদের অধিকাংশের পূর্বপুরুষরা পূর্ববঙ্গে থাকতেন। সেই পূর্ববঙ্গই এখনকার বাংলাদেশ। আর গিয়ে যদি ফয়েজুরভাইয়ের উপকার করতে পারো তা হলে তো কথাই নেই।
ফয়েজুরভাই বললেন, এরপর কি আমি আশা করতে পারি আপনি আমার ওখানে আসছেন?
অর্জুন একটু ভাবল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?
ঢাকা থেকে দু’ঘণ্টা লাগে গাড়িতে। মেঘনা নদীর পাশে আমার বাড়ি। শেষবার গিয়েছি মাস তিনেক আগে। রাত্রে থাকতে পারিনি।
অর্জুন অমল সোমকে বলল, আপনিও চলুন না। বেড়িয়ে আসবেন!
মাথা নাড়লেন, না হে। এখন আর ছুটাছুটি করতে একদম ভাল লাগে না। আমি তো আছি। তোমার প্রয়োজন দেখলে নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকব না।
.
ব্রেকফাস্ট খেয়ে দিয়াকে দার্জিলিং পৌঁছে দিতে গেলেন ফয়েজুর রহমান। সেখান থেকে সোজা বাগডোগরায় গিয়ে কলকাতার প্লেন ধরবেন। আজই। দমদম থেকে ঢাকায় ফিরে যাবেন সন্ধের ফ্লাইটে। গাড়িতে ওঠার সময় অর্জুনের হাত ধরে বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে আসুন। আমি অপেক্ষা করব।
অমল সোম বললেন, নর্থবেঙ্গল দিয়ে বাইরোড যাওয়া যায়। কিন্তু বেশ সময় লেগে যাবে। এমনভাবে টিকিট কাটতে হবে যাতে দুপুরের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ফ্লাইট ধরা যায়।
ফয়েজুর রহমান বললেন, টিকিট নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনার মেইল নাম্বারটা দিন, আমি পাঠিয়ে দেব।
অর্জুন প্রতিটি অক্ষর আলাদা করে বলল, অর্জুনজল ইয়াহু ডটকম।
জল কেন? পাশ থেকে দিয়া জানতে চাইল।
আমি জলপাইগুড়িতে থাকি, তাই। অর্জুন হাসল।
.
জলপাইগুড়িতে কিছু কাজ ছিল। সেগুলো শেষ করতে না করতেই ফয়েজুর রহমানের মেল এসে গেল। অর্জুনের মোবাইলে ইন্টারনেট আছে। সেখান থেকে প্রিন্ট আউট নেওয়া যায় না। কদমতলার সাইবার কাফে থেকে প্রিন্ট আউট বের করে সে দেখল বাগডোগরা থেকে দমদম, দমদম থেকে ঢাকার টিকিট পাঠিয়েছেন ভদ্রলোক। ফেরার টিকিট নয়। সকাল দশটায় বাগডোগরা থেকে উড়ে দমদম হয়ে বিকেল আড়াইটের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে পারবে। ঠিক তিনদিন পরে যাত্রা। টিকিটের সঙ্গে একটা চিঠি। এয়ারপোর্টে গাড়ি থাকবে। ফেরার দিন এখনই ঠিক করা যাচ্ছে না বলে টিকিট পাঠালাম না। তবে এর জন্যে চিন্তা করবেন না। ফয়েজুর। অর্জুন একমত হল। সে যে জন্যে যাচ্ছে তার কিছুই ভাল করে জানে না। সেই কাজ কবে শেষ হবে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না। তাই ফেরার টিকিট কাটার কথা নয়।
কদমতলার মোড়ে জগুদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন ছোটখাটো চেহারার মানুষটি। বললেন, এই যে, সাইবার কাফেতে ঢুকলে দেখলাম। সত্য অন্বেষণ করতে?
অর্জুন হাসল, না। টিকিট বের করতে। আপনি কেমন আছেন জগুদা?
আমি তো কখনও খারাপ থাকি না। কোথাও যাচ্ছ?
হ্যাঁ। ঢাকায় যাচ্ছি।
শাবাশ! জগুদার মুখ চোখ উজ্জ্বল হল, কী আনন্দ। কবে যাচ্ছ?
এই তো, তিনদিন পরে!
খুব ভাল খবর ভাই। আমাদের বাড়ি ছিল একেবারে বুড়িগঙ্গার গায়ে। যখন চলে আসি তখন আমি খুবই ছোট। তবু মনে আছে সব। ফিরে এলে গল্প শুনব তোমার কাছে।
.
সাতসকালে জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়িতে। বাসে। কাল মা সুটকেস গুছিয়ে রেখেছিলেন। সকালে চা-বিস্কুট খেয়েই রওনা হয়েছিল অর্জুন। শিলিগুড়ি থেকে অটো ধরে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে গিয়েছিল। ভয় ছিল প্লেন যদি ঠিক সময়ে না ছাড়ে, যদি বেশি দেরি করে তা হলে দমদমের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস এয়ারপোর্ট পৌঁছে হয়তো দেখবে ঢাকার প্লেন চলে গেছে। কিন্তু কখনও কখনও সবকিছু ঠিকঠাক চলে। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ইমিগ্রেশনের এলাকা পেরিয়ে কাস্টমসে পরীক্ষা দিয়ে অর্জুন যখন প্লেনে উঠে বসল তখন তার বেশ মজা লাগল। আমেরিকায় যখন গিয়েছিল তখন প্লেনের ভিতরটাকে একটা বিশাল হলঘর বলে মনে হয়েছিল। এমনকী বাগডোগরা থেকে আসার সময় যে প্লেনে বসেছিল তার আয়তন এটির চেয়ে দ্বিগুণ ছিল। এত ছোট প্লেন কী করে আকাশে এত মানুষ, মালপত্র নিয়ে উড়ে যাবে?
কিন্তু ওড়ার পরে যখন বিমানবালিকারা বাংলায় ঘোষণা করতে লাগলেন তখন খুব ভাল লাগল। প্লেন ভরতি। অর্জুনের পাশে এক প্রবীণ ভদ্রলোক যাঁর দাড়ি সাদা, বসেছিলেন। প্লেন ছাড়ামাত্র ভদ্রলোক বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার বোধহয় খেয়াল হল যে পাশের যাত্রী চুপচাপ বসে আছে। তিনি প্রার্থনা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মুসলমান না হিন্দু?
অর্জুন হেসে ফেলল, কেন বলুন তো?
প্রার্থনা করুন। হয় আল্লাকে ডাকুন নয় ভগবানকে। প্রৌঢ় বললেন।
এখন ডাকতে যাব কেন?
দেখছেন না প্লেনটা কীরকম কাঁপছে। এই রে, ওপর থেকে এক ফোঁটা পানি পড়ল। এইজন্যে আমি প্লেনে উঠতে চাই না। ট্রেন বা বাস অনেক ভাল। ছেলে জোর করে প্লেনের টিকিট কেটে দিল। এখন আল্লাই ভরসা। বৃদ্ধ আবার চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা শুরু করলেন।
ধীরে ধীরে নীচে ঢাকা শহরটাকে দেখতে পেল অর্জুন। দেখে মনে হল এই শহর তার একদম অপরিচিত নয়। প্রচুর গাছগাছালি, জল, বাড়ির ওপর দিয়ে পাক খেয়ে প্লেন মাটিতে নেমে অনেকটা এগিয়ে থেমে গেল। তারপর ইমিগ্রেশনের কাউন্টারে পাসপোর্ট দেখিয়ে সুটকেস নেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করার সময় মনে মনে সন্টুদাকে ধন্যবাদ দিল। জলপাইগুড়ির সন্টুদা মাত্র দু’দিনের জন্যে কলকাতায় গিয়েছিলেন। তার কাছে ভিসা ফর্ম ছিল। অর্জুনকে দিয়ে সেই ফর্ম ভরতি করিয়ে ছবি-সহ নিয়ে গিয়েছিলেন। পরের দিন সকালে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে জমা দিয়ে বিকেলে ভিসার ছাপ দেওয়া অর্জুনের পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছিলেন। সন্টুদা এই উপকার না করলে আজ তার বাংলাদেশে আসা সম্ভব হত না।
কাস্টমসের অফিসাররা কোনও প্রশ্ন করলেন না। সুটকেস টেনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে অর্জুন দেখল প্রচুর মানুষ অপেক্ষা করছে তাদের পরিচিতদের জন্যে। কারও কারও হাতে নাম লেখা কার্ড। অর্জুন ভাল করে দেখল কিন্তু ফয়েজুর রহমানকে খুঁজে পেল না। হঠাৎ তার খেয়াল হল। আসবার সময় ডলার অথবা বাংলাদেশের টাকা নিয়ে আসা হয়নি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় পাঁচ হাজার ভারতীয় টাকা পকেটে রেখেছিল। ভেবেছিল দমদমে এসে বিদেশি মুদ্রার কাউন্টার থেকে ওগুলো বাংলাদেশের টাকায় পরিবর্তন করে নেবে। কিন্তু ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে। এই এয়ারপোর্টের ভেতরে নিশ্চয়ই ওইরকম কাউন্টার আছে। অর্জুন আবার ঢুকতে চাইলে দ্বাররক্ষী জানালেন, একবার বেরিয়ে গেলে আর ঢোকা চলবে না। ভিজিটার্স টিকিটে ভেতরে যাওয়া যাবে কিন্তু সেখানে এক্সচেঞ্জ কাউন্টার নেই।
অর্জুনের আচমকা শীতশীত করতে লাগল। ফয়েজুর রহমান তো অসুস্থ হতে পারেন অথবা খুব জরুরি কাজে আটকেও যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে অর্জুন কী করবে? কোথাও যেতে হলে ট্যাক্সিওয়ালাকে ভাড়া দিতে হবে। ট্যাক্সিওয়ালা কি ভারতীয় টাকা নেবে? সেটা তো বেআইনি। তার ওপর ফয়েজুর রহমানের মেইল নাম্বার তার কাছে আছে কিন্তু বাড়ির ঠিকানা অথবা ফোনের নাম্বার নেই। এক্ষেত্রে তার পক্ষে শুধু বনানী নামের জায়গায় যাওয়া সম্ভব কিন্তু বনানীতে গিয়ে ভদ্রলোকের বাড়ি খুঁজে বের করবে কী। করে? তার নিজের মোবাইল ফোন এখানে কাজ করবে না বলে সঙ্গে নিয়ে আসেনি। অর্জুন আবার বাইরে এসে দাঁড়াল। এর মধ্যে অপেক্ষারত ভিড় হালকা হয়ে গেল। ঠিক এই সময় একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির সামনের আসন থেকে একজন যুবতী নেমে এসে চিৎকার করতে লাগলেন, মিস্টার অর্জুন, আর ইউ হিয়ার? মিস্টার অর্জুন? একটু থেমে আবার চেঁচিয়ে একই প্রশ্ন করতে লাগলেন।
অর্জুন সুটকেস নিয়ে এগিয়ে গেল। যুবতীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি অর্জুন।
অ্যাঁ? বেশ অবাক হয়ে গেলেন যুবতী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললেন, আপনি অর্জুন? ইন্ডিয়ার কোথা থেকে এসেছেন।
হ্যাঁ, জলপাইগুড়ি থেকে সোজা এখানে।
ওয়েলকাম, ওয়েলকাম স্যর। আমার এয়ারপোর্ট পৌঁছোতে একটু দেরি হয়ে গেল। আসুন আসুন। যুবতীর কথার মধ্যেই ড্রাইভার নেমে এসেছিল। সুটকেসটা সে গাড়ির ডিকিতে রেখে পেছনের দরজা খুলে দিল।
বিশাল গাড়ি। খুবই দামি। ভিতরটায় চমৎকার ঠান্ডা। আসনে বসামাত্র মনে হল কী আরাম! যুবতী ইতিমধ্যে ড্রাইভারের পাশের আসনে উঠে বসেছেন। ড্রাইভার ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করল, প্রথমে কোথায় যাব?
সাহেবের বাড়িতে। লাঞ্চের পরে অফিসে। যুবতী ঘুরে বললেন, আমার নাম জোনাকি। ফয়েজুর রহমান সাহেবের এক্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করি।
ও, নমস্কার। অর্জুন মাথা নাড়ল।
আপনার কাছে একটা ফেবার চাইতে পারি?
বলুন!
আপনার কাছে পৌঁছোতে দেরি হয়েছে জানলে সাহেব খুব বিরক্ত হবেন। আমার রেকর্ড খারাপ হবে। তাই–।
ঠিক আছে–!
থ্যাঙ্ক ইউ স্যর। দোষ আমারই। ট্র্যাফিকের কথা ভেবে আমার একটু আগেই বের হওয়া উচিত ছিল। ওহো, সাহেব এটা আপনাকে দিতে বলেছেন! ব্যাগ থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে এগিয়ে দিলেন জোনাকি, এখন থেকে আপনি এটাই ব্যবহার করবেন।
ধন্যবাদ। ফোন অন করে বোতাম ঘোরাতেই ফয়েজুর রহমানের নাম এবং নাম্বার দেখতে পেল অর্জুন। সে বোতামে চাপ দিতেই ওপারে রিং হল। তারপরেই গলা শুনতে পেল সে, স্বাগতম অর্জুন! আপনি এসে গেছেন। বলে আমার খুব ভাল লাগছে। আমি নিজে এয়ারপোর্টে যেতে পারিনি বলে কিছু মনে করবেন না। কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
না, কোনও অসুবিধে হয়নি। অর্জুন বলল।
বেশ। যে মেয়েটি আপনাকে রিসিভ করেছে সে ঠিক সময়ে পৌঁছেছিল?
অর্জুন একটু থেমে বলল, হ্যাঁ।
ওর নাম জোনাকি। এখন থেকে জোনাকি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবে। যা যা দরকার তা ওকে বললেই হবে। আপনাকে জোনাকি আমার বাড়িতে লাঞ্চ খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে আপনি আসবেন। ফয়েজুর বললেন।
অর্জুন বলল, এখন লাঞ্চ না খেলেও চলবে। আপনার অফিসে নিশ্চয়ই চা-কফি পাওয়া যাবে।
নিশ্চয়ই। ফয়েজুর রহমান বললেন, আপনি জোনাকিকে বলুন যে সোজা অফিসে আসবেন।
কথাটা জোনাকিকে জানিয়ে বাইরে তাকাল অর্জুন। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চওড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি ভালই চলছিল কিন্তু এখন গতি কমেছে। দূরে ফ্লাইওভার দেখা গেলেও রাস্তায় গাড়ির ভিড় জমেছে। দামি দামি বিদেশি গাড়ির পাশাপাশি অটো রিকশা, সাইকেল রিকশা যেন জট পাকিয়ে চলছে। অটোর পেছনে নায়ক-নায়িকার ছবি আঁকা যা জলপাইগুড়িতে দেখা যায় না। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ওই অটোগুলো কি মিটারে চলে?
জোনাকি হাসলেন, আমরা ওগুলোকে সিএনজি বলি। যার যেমন ইচ্ছে তেমন চালায়।
খানিক বাদে অদ্ভুত দৃশ্য দেখল অর্জুন। পাশে যে গাড়িটা জ্যামের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনের সিটে বসে এক ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে কিছু বলছেন আর সামনে বসা আর একজন সেটা লিখে নিচ্ছে। জোনাকিও দেখতে পেয়েছিলেন। বললেন, বস ডিক্টেশন দিচ্ছেন আর স্টেনোগ্রাফার তা শর্টহ্যান্ডে লিখে নিচ্ছে। সময় নষ্ট না করে গাড়ির মধ্যেই ওদের অফিস চলছে। অনেকে এইসময় ল্যাপটপেও কাজ করে।
যে পথটা চল্লিশ মিনিটে আসা যায় সেই পথ ওরা দু’ঘণ্টায় এল।
ফয়েজুর রহমানের অফিস সাত তলায়। বেশ বড় অফিস। অনেকেই কাজ করছেন। তাকে ওঁর চেম্বারে পৌঁছে দিল জোনাকি। ফয়েজুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন, আসুন, আসুন। বসুন।
অর্জুন উলটো দিকের চেয়ারে বসলে জিজ্ঞাসা করলেন, ঢাকা কেমন লাগছে?
অর্জুন বলল, এখন অবধি শুধু রাস্তাই দেখতে পেয়েছি।
ট্রাফিকের অবস্থা ভাল নয়। আগে খুব খারাপ ছিল। কয়েকটা ফ্লাইওভার হওয়ার পরে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বাকিগুলো হয়ে গেলে আর অসুবিধে থাকবে না।
এইসময় বেয়ারা চিকেন স্যান্ডউইচ, মিষ্টি, জল এবং কফি নিয়ে এল। প্লেনের খাবার মোটেই ভাল ছিল না। স্যান্ডউইচ দেখে খিদে পেয়ে গেল অর্জুনের। খেতে খেতে বলল, আমি যে জন্যে এসেছি তার সম্পর্কে বিশদে জানতে চাই।
নিশ্চয়ই। আজ এলেন, বিশ্রাম নিন। কাল সকালে আপনাকে নিয়ে যাব।
আজ যাওয়া যাবে না?
ঘড়ি দেখলেন ফয়েজুর রহমান। তারপর বললেন, আমি আপনাকে সাজেস্ট করব ওই বাড়িতে আজ না যেতে। কারণ যেতে যেতেই আলো ফুরিয়ে যাবে। বাড়িটাকে না দেখে ওখানে থাকা ঠিক হবে না।
বেশ, একবার আপনার গ্রামটাকে ঘুরে দেখে আসতে তো পারি। আপনি বলেছিলেন যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। গাড়িতে একবার পাক দিয়ে চলে আসতে চাই। চোখের দেখা তো হবে।
ফয়েজুর রহমান মাথা নাড়লেন, কয়েক মাস আগে যদি আসতেন তা হলে বলতাম এটা সম্ভব হবে না। রাস্তায় এত জ্যাম যে পৌঁছোতেই ঘণ্টা আড়াই লেগে যেত। কিন্তু এখন ফ্লাইওভার হওয়ায় প্রায় অর্ধেক সময় লাগছে। কিন্তু অর্জুন, আমি ভেবেছিলাম, আগামীকাল আপনার সঙ্গে যাব। তাই আজ খুব জরুরি মিটিং রেখেছিলাম–!
না না। আজ আপনাকে যেতে হবে না। আমি একাই ঘুরে আসছি। জায়গাটা যখন শহরের বাইরে তখন এই সুযোগে শহরতলিও দেখা হয়ে যাবে। অর্জুন বলল।
ঠিক আছে। ঢাকায় থাকার জন্যে আমি আপনার নামে ঢাকা ক্লাবে ঘর বুক করে রেখেছি। খুব ভাল জায়গা। ইচ্ছে করলে আপনি আমার বাসায় থাকতে পারেন।
হেসে ফেলল অর্জুন, আপনি যা বলবেন। তবে একা থাকলে বেশি স্বস্তি পাব।
ভাল।
.
মিনিট সাতেক পরে অর্জুনকে নিয়ে গাড়ি বের হল। সেই একই ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। তার পাশে বসেছেন জোনাকি! তিনি মাঝে মাঝে যে জায়গা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে তার নাম বলে যাচ্ছিলেন। সেইভাবেই ঢাকা ক্লাবের গেট দেখল অর্জুন। জোনাকি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি এখন চেক-ইন করে ফ্রেশ হয়ে যাবেন?
না। ওসব ফিরে এসে হবে। আমি সন্ধের আগেই সোনার গাঁ-তে পৌঁছাতে চাই। তার কাছাকাছি নিশ্চয়ই ফয়েজুর সাহেবের গ্রামের বাড়ি?
আমি একবারই দেখেছিলাম। হানিফভাই, সোনার গাঁ থেকে কতদূরে? জোনাকি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন।
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে জবাব দিলেন, দশ মাইল দূরে।
তা হলে তো ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। জোনাকি, আপনি ইচ্ছে করলে নাও যেতে পারেন। ড্রাইভার আছেন, আমার কোনও অসুবিধে হবে না।
জোনাকি মাথা নাড়লেন, না স্যর, আমি খুব লাকি তাই আপনার সঙ্গে যেতে পারছি। বাসায় ফোন করে দিয়েছি যে স্যরের গ্রামে যাচ্ছি, ফিরতে একটু রাত হবে। ওহো, এই জায়গাটার নাম সায়াদাবাদ। এখান থেকেই। যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার শুরু। আগে এখানে ভয়ানক জ্যাম হত। কয়েকমাস আগে এই ফ্লাইওভার চালু হওয়ার পর সেটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। যাওয়া আসার সময় অনেক কমে গেছে।
গাড়ি চলছিল। তারপর একটা নদীর ওপর ব্রিজে উঠতেই জোনাকি হানিফকে একটু থামাতে বলল। এই নদীর নাম মেঘনা।
অর্জুন দেখল যন্ত্রচালিত কিছু নৌকা মালপত্র নিয়ে যাওয়া-আসা করছে। কিন্তু নদীর জল খুব কালো এবং একটু ঘন বলে মনে হল। প্রশ্নটা করতেই জোনাকি বললেন, দু’পাশে অনেক ফ্যাক্টরি আছে। তারা ব্যবহার করা কেমিক্যাল নদীতে ফেলে বলে পানির রং কালো হয়ে গিয়েছে। এই পানি কেউ খায় না। নদীতে মাছও নেই। এটা যাতে বন্ধ করা যায় তার উপায়। সরকার ভাবছে।
সর্বনাশ! শব্দটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল অর্জুনের।
জোনাকি মাথা নাড়লেন, একদম সত্যি কথা।
সোনার গাঁ-তে ওরা পৌঁছে গেল দেড়ঘণ্টার মধ্যে। হানিফ বলল, রাতে এই রাস্তা এক-সোওয়া ঘণ্টায় চলে আসি।
সোনার গাঁ পার হতেই আলো কমে আসছিল। আরও দশ মাইল যেতে অন্তত পনেরো মিনিট লাগবে। সে জিজ্ঞাসা করল, সামনের জায়গাটার নাম কী?
নারানগঞ্জ। ড্রাইভার জবাব দিল।
এই নামটা অর্জুন শুনেছে। তাদের পাশের বাড়ির দাদু বলেন যে তার দেশ ছিল নারানগঞ্জে। অবশ্য সেই নারানগঞ্জ আর এই নারানগঞ্জ এক নাও হতে পারে। বাংলাদেশে হয়তো একই নামের দুটো জায়গা আছে। একটা শহরের ভেতর দিয়ে গাড়ি করে নদীর গায়ে পৌঁছে গেল। হানিফ বলল, স্যর, এটা মেঘনা নদী।
বেশ চওড়া নদীর বুকে অনেকখানি চর। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, মেঘনা নদী তো অনেক পেছনে ফেলে এসেছি।
হানিফ বলল, ওই নদী ঘুরে ঘুরে এসেছে।
নদীর তীরে নৌকো বাঁধছিল একজন মাঝি। আগ বাড়িয়ে তার বাচনভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল, যাবেন কোথায়?
জোনাকি বলল, আপনি কি ফয়েজুর রহমান সাহেবের নাম জানেন।
জানব না? এটা কী বললেন! তাঁরা তো কেউ এখানে থাকেন না। এই নদীর ধারের রাস্তা বরাবর দশ মিনিট হাঁটলেই তাঁর প্রাসাদ দেখতে পাবেন। তবে আপনারা নতুন লোক, তাই পরামর্শ দিই, এই সময় ওদিকে যাবেন না।
গাড়িতে বসেই অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এ কথা কেন বলছেন?
পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে লোকটা বলল, কথায় আছে, ঠেকে শেখে, দেখে শেখে, আর শুনে শেখে। এর বেশি আর বলতে পারব না। কথাগুলো বলে লোকটা চলে গেল।
জোনাকি জিজ্ঞাসা করল, কী করবেন? সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
অর্জুন বলল, হানিফভাই, বেশি দূরে তো নয়। চলুন বাড়িটাকে একবার দেখে আসি।
হানিফ গাড়ি চালাল। এপাশে বাড়িঘর নেই। গাছগাছালি আর গুল্মভরা মাঠ। তারপর রাস্তাটা বাঁক নিতেই আবছা বাড়িটাকে দেখতে পেল অর্জুন। দোতলা বাড়ি। প্রাসাদই বলা যায়। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তালা বন্ধ গেট। বাড়ির দোতলাটা দেখা যাচ্ছে রাস্তা থেকে, কোনও আলো জ্বলছে না। রাস্তার এপাশে মেঘনার বন্যা আটকাতে ছোট্ট বাঁধ দেওয়া আছে। নদীর চর থেকে হুহু বাতাস ছুটে আসছে। বাড়িটার দিকে তাকালেই ছমছমে অনুভূতি হয়।
স্যর! গাড়ি ঘোরাই? হানিফ জিজ্ঞাসা করল।
অর্জুনের ইচ্ছে হচ্ছিল হেঁটে বাড়ির চারপাশ দেখে। কিন্তু আবছা অন্ধকারে এর বেশি কিছু দেখা যাবে বলে মনে হচ্ছিল না। বাড়ির দু’পাশে যে লতাপাতার জঙ্গল সেখানে এখন পা রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সে বলল, ঘোরান।
গাড়ি ঘুরলে জোনাকি মুখ ফিরিয়ে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ।
ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
বাড়িটার দিকে তাকাতেই বুকে চাপ লাগছিল। স্যর নিশ্চয়ই ওই বাড়িতে রাত্রে থাকেন না। তাই আপনি চলে আসতে আপত্তি না করায় ধন্যবাদ দিলাম। জোনাকি সামনের দিকে ঘুরে বসলেন।
খানিকটা পথ যাওয়ার পর, নদীর ঘাট পার হয়ে হানিফ বলল, ওই দোকানে ভাল চা করে। ইচ্ছে হলে খেতে পারেন।
জোনাকি জিজ্ঞাসা করলেন, চা খাবেন স্যর?
বাড়িটা নিয়ে ভাবছিল অর্জুন। অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ঠিক আছে।
গাড়ি থামতেই তার খেয়াল হল। বলল, আমি একটা গোলমাল করে ফেলেছি জোনাকি। আসার সময় ভারতের টাকা ভাঙিয়ে বাংলাদেশের টাকা আনিনি।
ছি ছি স্যর। এ আপনি কী বলছেন? আপনি আমাদের মেহমান। আমরা আপনাকে সামান্য চা খাওয়াতে পারি না। গাড়িতে বসে খাবেন না নীচে নামবেন? জোনাকি জিজ্ঞাসা করলেন।
চলুন, নামাই যাক।
হানিফ এগিয়ে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিল। রাস্তার ধারের দোকান। খুঁটির ওপর তক্তা পেতে বেঞ্চি করা হয়েছে। অর্জুন বলল, আসুন ওখানে বসি।
বেঞ্চিতে বসে জোনাকি বললেন, একটা অনুরোধ করব? আপনি আমাকে তুমি করেই কথা বলুন!
অর্জুন তাকাল, ওটা তা হলে দু’জনকেই বলতে হবে।
না স্যর। এখানে সাহেব বা সাহেবের বন্ধুদের তুমি বলার চল নেই।
প্রথমত আমি সাহেবের বন্ধু নই। উনি বয়সে অনেক বড় আর দ্বিতীয়ত আমি এখানকার লোক নই। তাই ওই অচল ব্যাপারটা আমার ক্ষেত্রে চলতে পারে। অজুন হেসে বলল।
শুনশান রাস্তার ধারের দোকানে ইলেকট্রিক আলো থাকলেও তার তেজ সাধারণ হারিকেনের চেয়ে বেশি নয়। হানিফ দোকানের ওপাশে জঙ্গলের গায়ে চলে গিয়েছিল প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে। চাওয়ালা ওদের দুই গ্লাস চা দিয়ে গেল। অর্জুন চায়ে চুমুক দিতে প্রচণ্ড শব্দ কানে এল। চমকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে হতভম্ব হয়ে গেল। একটা ছোট লরি দুরন্ত গতিতে চলে গেল নদীর দিকে। হানিফ হায় হায় করতে করতে ছুটে গেল তার গাড়ির দিকে। সংবিৎ পেতেই অর্জুন এবং জোনাকি দৌড়ে গিয়ে আধা অন্ধকারের দৃশ্যটা দেখতে পেল। গাড়ির যেদিকটা রাস্তার ধারে ছিল তার অনেকটাই ভেতরে ঢুকে গেছে। ডানদিকের বনেটটাও ভেঙে ঝুলছে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হানিফ তখন সব ভুলে গিয়ে লরির ড্রাইভারের উদ্দেশে গালাগাল দিচ্ছে। চাওয়ালা এবং তার কয়েকজন খদ্দের গাড়ির কাছে চলে এসেছিল। একজন বলল, আপনাদের কপাল ভাল তাই গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলেন, নইলে–! লোকটা কথা শেষ করল না।
লরিটার নম্বর কেউ দেখেনি। কারও খেয়াল ছিল না। তা ছাড়া যেরকম ঝড়ের মতো উলটোদিক দিয়ে রাস্তা পার হয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে। তাতে আগে থেকে সজাগ না থাকলে নম্বর বোঝাও সম্ভব নয়। অর্জুন চাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল, ওই লরিটা কার তা নিশ্চয়ই আপনারা জানেন?
ভাল করে দেখার আগেই তো মিলিয়ে গেল! চাওয়ালা বলল।
আপনাদের এলাকায় কার কার ওইরকম লরি আছে? অর্জুন জানতে চাইল।
একজন বলল, এখানে কয়েকজনের গাড়ি আছে বটে কিন্তু কারও লরি নেই। ট্রাক-লরি ছিল ফয়েজুরভাইয়ের। তা সেসব তো অনেক কাল বসে গেছে।
ওপাশ থেকে হানিফ চিৎকার করল, দরজা খোলা যাচ্ছে না। বসে গেছে।
জোনাকি ততক্ষণে ফোনে ফয়েজুর রহমান সাহেবকে বলছে, স্যর, আমরা তিনজন অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি। সে সংক্ষেপে ঘটনাটা জানাল। ওপাশের কথা শোনার পর জোনাকি বলল, না স্যর। উনি ঠিক আছেন। তারপর খানিকটা শুনে বলল, ঠিক আছে স্যর, চায়ের দোকানের নাম টিফিন’।
ফোন অফ করে জোনাকি বলল, সাহেব থানায় খবর দিচ্ছেন। আর এখনই সোনার গাঁ থেকে আমাদের নিয়ে যেতে গাড়ি আসছে।
হানিফ বিড়বিড় করল, বহুৎ টাকা খরচ হয়ে যাবে। ওরা স্যর, ইচ্ছে করেই গাড়ি নষ্ট করেছে। আমরা রাস্তার এদিকে সাইড করে গাড়ি দাঁড় করিয়েছি। ওরা উলটো দিক দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তা পেরিয়ে এই গাড়িকে ধাক্কা মারবে কেন?
জোনাকি বলল, ব্রেক ফেল যদি করে থাকে?
করেনি। করলে ওই স্পিডে বেরিয়ে যেত না। হানিফ বলল।
হ্যাঁ, মতলব করেই মেরেছে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো একজন বলল, ওই গাড়িতে কোনও আলো জ্বলছিল না। না হেডলাইট, না ব্যাকলাইট।
চাওয়ালা বলল, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আসুন, চা খেয়ে নিন।
হানিফ খেপে গেল, তুমি কী হে? লাখ টাকার লোকসান হয়ে গেল আর তুমি আমাদের চা খেতে বলছ। ভয় নেই, না খেলেও দামটা দিয়েই যাব।
ভিড় সরে গেলে অর্জুন জোনাকিকে বলল, আপনার জন্যে প্রাণে বেঁচে গেলাম।
আমার জন্যে?
হ্যাঁ। আপনি চা খেতে গাড়ি থেকে নামতে না বললে এখন আমার কী হত ভাবলেই শিউরে উঠছি। আপনি আমার প্রাণ বাঁচালেন।
সেটা তো আমিও বলতে পারি। আপনি গাড়ি থেকে নামতে না চাইলে আমাকেও বসে থাকতে হত। কিন্তু লরিটা আমাদের মারতে চাইছিল কেন?
.
পুলিশ অফিসার একই কথা জিজ্ঞাসা করলেন। পুলিশের গাড়ি চায়ের দোকান থেকে ওদের তুলে নিয়ে এসেছিল থানায়। এখন হানিফের গাড়িটাকে টেনে নিয়ে আসার কাজ চলছে। যে সাব-ইন্সপেক্টার তাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনারা এই এলাকার মানুষ নন। এদিকে যে আসছেন তা কেউ জানত না বলছেন, তা হলে একটা লরির ড্রাইভার আপনাদের মারতে যাবে কেন? সে কী করে জানবে ওই সময় আপনারা ওখানে আছেন?
অর্জুন বলল, এর উত্তর আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি, চা খেতে আমরা দোকানে গিয়ে বসেছিলাম যখন তখন লরির ড্রাইভার জেনে শুনে আমাদের মারার জন্যে গাড়িটাকে চুরমার করেছে।
আপনারা এদিকে এসেছিলেন কেন? উদ্দেশ্য কী ছিল? অর্জুন বলল, বেড়াতে, মেঘনা দেখতে।
জোনাকিকে দেখিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের সম্পর্ক?
জোনাকি উত্তর দিতে চাইছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে অর্জুন বলল, সহকর্মী।
অ। একসঙ্গে কাজ করেন। একটা কাজের দিনে মহিলা সহকর্মীকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন। গাড়িটা আপনার? ইনশিয়োরেন্স করা আছে?
গাড়িটা আমার নয়। নিশ্চয়ই ইনশিয়োরেন্স করা আছে!
আপনার ঠিকানা? কাগজ-কলম টেনে নিলেন সাব-ইন্সপেক্টর।
অর্জুন, কদমতলা, জলপাইগুড়ি, পশ্চিমবাংলা, ভারতবর্ষ।
সর্বনাশ! ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন, আপনি ইন্ডিয়ান?
হ্যাঁ। পাসপোর্ট বের করে এগিয়ে দিল অর্জুন।
ছবি দেখে মিলিয়ে নিয়ে ভিসা এবং অ্যারাইভাল স্ট্যাম্প দেখলেন ভদ্রলোক। আপনি আজই বাংলাদেশে এসেছেন। আজই এখানে বেড়াতে এলেন এবং আজই কেউ আপনাকে মারার জন্যে টার্গেট করল! আপনার কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে ভাই। এই মহিলাও কি তা হলে ইন্ডিয়ান! দেখি পাসপোর্ট! হাত বাড়ালেন সাব-ইন্সপেক্টর।
জোনাকি বলল, আমি বাংলাদেশের নাগরিক।
উনি যে বললেন আপনি ওঁর সহকর্মী?
উনি এখানে এসেছেন, আমি ওঁকে সাহায্য করছি। তাই সহকর্মী।
এইসময় ফোন বেজে উঠল। ভদ্রলোক রিসিভার তুলে গম্ভীর গলায় বললেন, এসআই আহমেদ বলছি। তারপরেই গলার স্বর বদলে গেল তার, হ্যাঁ স্যর, ওঁরা আমার সামনেই বসে আছেন। ওঁরা আমাকে আপনার কথা বলেননি। ও, তাই? ঠিক আছে, আমি লরির ড্রাইভারকে যেভাবেই পারি অ্যারেস্ট করব। মুশকিল হল, কেউ গাড়ির নাম্বার নোট করেনি, ড্রাইভারকেও দেখেনি। ওকে স্যর।
রিসিভার রেখে ভদ্রলোক বিনীত গলায় বললেন, হে হে, আপনি যে ভিআইপি একথা আগে বলবেন তো! ছি ছি ছি। চা বলি?
অর্জুন মাথা নাড়ল, না। শুনুন, লরিটা যখন নদীর দিকে গেল তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে ওটা এদিকের গাড়ি। আপনারা চার চাকার ছোট লরির খোঁজ করুন। যেভাবে ধাক্কা মেরেছে তাতে ওই লরির ক্ষতি হওয়া স্বাভাবিক। দেখলেই চেনা যাবে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।।
এই সময় একজন সেপাই এসে জানাল যে অর্জুনবাবুর জন্যে গাড়ি এসেছে সোনার গাঁ থেকে। সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, দাঁড়াতে বলো।
তারপর দ্রুত একটা লম্বা খাতায় অনেকটা লিখে ফেলে বললেন, স্যর। এখানে সই করে দিন। আপনাদের গাড়ির নাম্বারের জায়গা ব্ল্যাঙ্ক রেখে, ওটা লিখে দিন।
জোনাকি নাম্বার বললে সেটা লিখে সই করে দিল অর্জুন। তারপর উঠে দাঁড়াল, আমরা এখন যেতে পারি।
নিশ্চয়ই। চলুন এগিয়ে দিচ্ছি।
বাইরে তখন হানিফ দাঁড়িয়ে আছে। সোনার গাঁ থেকে আসা গাড়িতে ওদের তুলে দিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু মনে করবেন না স্যর, ইন্ডিয়াতে আপনি কী করেন?
অর্জুন হেসে ফেলল। তারপর বলল, সত্যসন্ধান।