জাঙ্গল বুক (উপন্যাস) – ময়ূখ চৌধুরী
মূল : রুডিয়ার্ড কিপলিং
ভাষান্তর/অলংকরণ : ময়ূখ চৌধুরী
সাঁঝের আকাশে চিলের ডানায়
দিন হল অবসান
বাদুড়ের ডাকে রাতের হাওয়ায়
অন্ধকারের গান
শুরু হয়;-তাই কুটিরে কুটিরে অর্গল
আর গোয়ালে দুয়ার রুদ্ধ
ব্যর্থ শ্বাপদ হানা দিয়ে ফেরে
রাতের শিকারী ক্রুদ্ধ।
দিনের আইন অচল এখন
রাতের কানুন চলবে
আঁধার বনের ঝোপেঝাড়ে তাই
শিকারীর চোখ জ্বলবে।
[অরণ্যে নৈশ সঙ্গীত]
.
১. মানুষের খোকা জঙ্গলে
ভারতের এক অখ্যাত অরণ্য। চারদিকে শুধু বনজঙ্গল আর পাহাড়। সিওনী পাহাড়ের গুহার মধ্যে দিবানিদ্রা সাঙ্গ করে বাবা-নেকড়ে যখন উঠে বসল, দিনের আলোকে মুছে ফেলে পৃথিবীর বুকে তখন নামছে রাত্রির অন্ধকার। বাবা-নেকড়ে সারা শরীর চুলকে নিল, মস্ত একটা হাই তুলল, তারপর চারটে থাবা টান-টান করে ছড়িয়ে শরীর থেকে নিদ্রার আলস্য ঝেড়ে ফেলল। মা-নেকড়ে তার লম্বা নাক দিয়ে বাচ্চাদের স্পর্শ করল। চারটি বাচ্চা তার গায়ের কাছেই জড়াজড়ি করে পড়েছিল, তাদের গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল অস্ফুট আওয়াজ। যে গুহাটায় নেকড়ে-পরিবার বাস করত সেই গুহার মুখে উঁকি দিল চাঁদের। আলোকধারা। বাবা-নেকড়ে উঠে দাঁড়াল, এইবার শিকারে যাওয়ার সময় হয়েছে। সে পাহাড় থেকে নামার উদ্যোগ করল, আর ঠিক সেই সময়ে গুহার মুখ পেরিয়ে ভিতরে এসে দাঁড়াল একটা ছোটো জানোয়ার। জন্তুটা ভয়ে ভয়ে বলল, হে মহান নেকড়ে-দলপতি! তুমি দেখছি শিকারের সন্ধানে যাত্রা করছ। তুমি নিশ্চয়ই ভালো শিকার পাবে। তোমার বাচ্চারাও ভালোভাবেই বেড়ে উঠবে, ওদের দাঁতগুলো সাদা ঝকঝকে আর মজবুত হবে– ওরা যেন তখন ওদের চারপাশের ক্ষুধার্ত প্রাণীদের কথা ভুলে না যায়।
জন্তুটা হচ্ছে একটি শেয়াল, নাম তাবাকুই! সে গ্রামের সীমানার কাছে ঘোরাঘুরি করে, মানুষরা যেসব আবর্জনা ফেলে দেয়, সেইখান থেকেই খাদ্য-হিসাবে বেছে নেয় বিভিন্ন বস্তু যেসব জিনিস জঙ্গলের অন্যান্য জন্তুর কাছে নিতান্তই অখাদ্য। তাছাড়া অন্যভাবেও জীবনধারণের উপযোগী খাদ্য সংগ্রহ করে সে। শিকারি জানোয়ার শিকারের মাংস খেয়ে চলে যাওয়ার পর অবশিষ্ট হাড়-মাংস খেয়ে জীবনধারণ করে তাবাকুই। হরিণ বা বুনো শুয়োরের মতো বড়ো জানোয়ারদের ঘায়েল করার ক্ষমতা তার নেই, তাই শিকারি জানোয়ারের ভুক্তাবশেষ উচ্ছিষ্ট হাড়-মাংস চিবিয়ে বেঁচে থাকে সে। নেকড়েরা তাবাকুইকে ঘৃণা করে। জন্তুটার স্বভাব ভালো নয়, সামনে ভালো ব্যবহার করলেও সুযোগ বুঝে অন্য জানোয়ারদের ক্ষতি করতে সে ছাড়ে না। কিন্তু তাবাকুই ছোটো আর দুর্বল হলেও নেকড়েরা তাকে ভয় করে। তাদের ভীতি নিতান্ত অকারণ নয়– তাবাকুই যখন পাগল হয়ে যায় তখন সে কাউকে ভয় পায় না। সে তখন যাকে সামনে পায় তাকেই কামড়ায়। ক্ষ্যাপা শেয়ালকে বাঘও ভয় করে। কারণ, ক্ষ্যাপা শেয়ালের কামড় খেলে যে-কোনো জন্তুই পাগল হয়ে মারা যায়। আমরা রোগটাকে বলি হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক- জন্তুদের ভাষায় দিওয়ানী বা পাগলামি।
বাবা-নেকড়ে কঠোর স্বরে বলল, তুমি ভিতরে ঢুকে দেখতে পারো। তবে আগেই বলছি, এখানে একটুও খাবার নেই।
নেকড়ের উপযুক্ত খাদ্য নেই, একথা সত্যি, তাবাকুই বলল, তবে আমার মতন নগণ্য ও তুচ্ছ জানোয়ারের উপযোগী খাদ্য নিশ্চয়ই আছে।
তাবাকুই গুহার পিছনে মেঝের উপর পড়ে-থাকা একটি হাড় তুলে নিল। পরিত্যক্ত ওই হরিণের হাড়টিতে সামান্য একটু মাংস লেগেছিল– তাবাকুই মহানন্দে সেই হাড়টিকে ভেঙে সশব্দে আহার শুরু করল।
এই চমৎকার ভোজের জন্য তোমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তাবাকুই বলল, এইবার তোমাদের একটা দরকারি খবর দিচ্ছি। শেরখান তার শিকারের জায়গা বদলে ফেলেছে। শেরখান নিজের মুখেই আমায় জানিয়েছে, পুরোনো শিকারের জায়গা বদল করে এখন থেকে সে এই পাহাড়ি এলাকাতেই শিকার করবে।
শেরখান হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড বাঘ– পূর্বোক্ত পাহাড়ি এলাকা থেকে বিশ মাইল দুরে ওয়েনগঙ্গা নামক নদীর কাছেই ছিল তার বাসস্থান।
আগে কোনো খবর না দিয়ে হঠাৎ এমনভাবে শিকারের জায়গা বদল করা উচিত নয়, বাবা-নেকড়ে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, দশ মাইলের মধ্যে যত শিকার আছে, তারা সবাই ভয় পেয়ে সতর্ক হবে আমার পক্ষে তখন শিকার জোটানো মুশকিল হয়ে পড়বে।
জন্তুটার মা ওর নাম রেখেছিল ল্যাংড়া, মা-নেকড়ে বলল, জন্ম থেকেই শেরখানের একটা পা ছিল খোঁড়া। সেইজন্য বুনো জানোয়ার ধরতে তার অসুবিধা হয়। মানুষের পোষা গরু-মোষ মেরে সে পেটের খিদে মেটায়। ওয়েনগঙ্গার কাছে গ্রামের মানুষ তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, তাই শেরখান আমাদের এলাকায় হানা দিতে এসেছে। এখানকার গ্রামবাসী মানুষও একদিন শেরখানের অত্যাচারে ক্রুদ্ধ হয়ে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে তাকে খুজবে;–কিন্তু হতভাগা খোঁড়া জানোয়ারটা আগুন লাগানোর আগেই অনেক দূরে মানুষের নাগালের বাইরে পালিয়ে যাবে। বিপদে পড়ব আমরা, বাচ্চাদের নিয়ে জ্বলন্ত ঘাস থেকে প্রাণ বাঁচাতে আমাদের সবাইকে ছুটোছুটি করতে হবে। বাঃ! চমৎকার! শেরখানের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
খুব বিনীতভাবে তাবাকুই বলল, তোমার এই কৃতজ্ঞতার কথা কি আমি শেরখানকে জানাব?
দূর হয়ে যাও, গর্জে উঠল বাবা-নেকড়ে, তুমি তোমার প্রভু শেরখানের সঙ্গে মিলিত হয়ে শিকার করো। কিন্তু এখান থেকে চলে যাও। একরাতের মধ্যেই তুমি যথেষ্ট ক্ষতি করেছ।
আমি চললাম, তাবাকুই বলল, নীচের ঝোপ থেকে শেরখানের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। তোমরা নিশ্চয়ই ওই শব্দ শুনতে পেয়েছ। শেরখানের খবরটা তোমাদের কানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কষ্ট করে আমার এখানে আসার কোনো দরকার ছিল না।
বাবা-নেকড়ে কান খাড়া করে শুনল- নিম্নভূমিতে অবস্থিত নদীর কাছাকাছি উপত্যকা থেকে ভেসে আসছে বাঘের চাপা গর্জন। শিকার ফসকে গেছে বলেই ওইভাবে চাপা গর্জনে ক্রোধ প্রকাশ করছে ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র।
মূর্খ! নিরেট মুখ! বাবা-নেকড়ে বলে উঠল, সারা জঙ্গলে যত শিকার আছে, বাঘের গলার আওয়াজ পেয়ে তারা সবাই সাবধান হয়ে যাবে। বোকা জানোয়ারটা কী ভেবেছে? ওয়েনগঙ্গার কাছে মানুষের পোষা গরু-মোষের মতো এই জঙ্গলের হরিণগুলো নির্বোধ নয়। আজ রাতে আমাদের শিকার জোটার আশা রইল না।
গরু, মোষ বা হরিণের দিকে আজ বাঘের নজর নেই। মা-নেকড়ে বলল, শেরখান আজ মানুষ মারতে চাইছে।
বলো কী! মানুষ! বাবা-নেকড়ের দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল, জঙ্গলের ডোবাগুলোতে কি ব্যাঙ বা পোকা-মাকড়ের অভাব ঘটেছে যে, বাঘ আজ মানুষ খেতে চাইছে? আর আমাদেরই ডেরার মধ্যে এই দুষ্কর্মটি করতে চায় সে? আর কোনো জায়গা খুঁজে পেল না হতভাগা খোঁড়া বাঘ?
জঙ্গলের আইন অনুসারে নরমাংস ভক্ষণ এক ভয়াবহ অপরাধ- বনবাসী প্রত্যেকটি জন্তু ওই আইন সম্পর্কে সচেতন। শুধু একটি বিষয়ে আইনের শাসন শিথিল– যখন কোনো জানোয়ার তার বাচ্চাদের শিকারের কৌশল শেখায়, তখনই কেবল পূর্বোক্ত আইন নরহত্যার অনুমতি দেয়। কিন্তু সেখানেও একটি শর্ত আছে, শিকারি জন্তুরা যে-এলাকার মধ্যে শিকার করে, সেই এলাকার ভিতর মানুষ মারা চলবে না মানুষ মারতে হবে ওই এলাকার বাইরে। জঙ্গলের আইন-কানুন অকারণে তৈরি হয়নি– জানোয়ারের কবলে মানুষ মরলে কয়েকদিনের মধ্যেই অকুস্থলে ঘটবে শিকারির আবির্ভাব। তারপর জ্বলন্ত মশাল হাতে জঙ্গল ঘিরে ফেলবে শত শত মানুষ– ফাটবে পটকা, কান-ফাটানো আওয়াজ তুলে বেজে উঠবে কাড়া-নাকাড়া ঢাক-ঢোল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র এবং হাতির পিঠে সুযোগের অপেক্ষা করবে বন্দুকধারী শ্বেতাঙ্গ শিকারি। তাড়া খেয়ে ঘন জঙ্গলের আশ্রয় ছেড়ে ফাঁকা জায়গায় জানোয়ার বেরিয়ে এলেই হাতির পিঠ থেকে তাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসবে বন্দুকের গুলি। তখন একটি বা দুটি মানুষের হত্যাকাণ্ড উপলক্ষ করে প্রাণ দেয় বহু নিরপরাধ জানোয়ার। আরও একটি কারণে অরণ্যের আইনে নরমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ জন্তুরা মনে করে নরখাদক পশুর চর্মরোগ হয় এবং অসময়ে তাদের দাঁতগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
পাহাড়ের তলদেশে নিম্নভূমি থেকে শ্বাপদকণ্ঠের অবরুদ্ধ গর্জনধ্বনি ক্রমশঃ উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়ে অকস্মাৎ প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ল, আহররর! আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঘের রণ-হুঁঙ্কার!
পরক্ষণেই থেমে গেল গর্জিত আস্ফালন, জেগে উঠল ব্যাঘ্রকণ্ঠে কাতর আর্তনাদ।
শেরখানের শিকার ফসকে গেছে, মা-নেকড়ে বলে উঠল, কিন্তু ব্যাপারটা কী? জন্তুটা হঠাৎ আর্তচিৎকার করল কেন?
কয়েক পা এগিয়ে পাহাড়ের উপর থেকেই বাবা-নেকড়ে দেখতে পেল, গরগর শব্দে বিরক্তি প্রকাশ করে একটা ঝোপের মধ্যে গা-ঢাকা দিল শেরখান।
বোকা জন্তুটা কাঠুরের আস্তানায় জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছিল, তাই ওর পা ঝলসে গেছে, বাবা-নেকড়ে বলল, তাবাকুই ওর সঙ্গে ছিল।
কেউ যেন পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে, মা-নেকড়ে বলল, তুমি তৈরি থাক। মনে হচ্ছে কোনো শত্রু আমাদের উপর হামলা করতে আসছে।
সামনের ঝোপটা দুলে উঠল, বাবা-নেকড়েও লাফ দেওয়ার জন্য তৈরি, আর হঠাৎ সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল– ঝোপ ঠেলে দেখা দিল একটি মনষ্যশিশু।
মানুষ! বাবা-নেকড়ে সবিস্ময়ে বলে উঠল, দ্যাখো গিন্নি, দ্যাখো, একটা মানুষের বাচ্চা!
ওটা কি সত্যিই মানুষের বাচ্চা? মা-নেকড়ে বলল, আমি কখনো বাচ্চা-মানুষ দেখিনি, ওটাকে আমার সামনে নিয়ে এস।
নেকড়ের চোয়ালে ভীষণ জোর, সে চোখের নিমেষে একটা মোটা হাড় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে কিন্তু যখন সে বাচ্চাকে দাঁতে কামড়ে তুলে নিয়ে যায় তখন নেকড়েশিশুর শরীরে একটু আঁচড়ও পড়ে না। ওইভাবে মানুষের খোকাটিকে তুলে নিয়ে মা-নেকড়ের সামনে রেখে দিল বাবা-নেকড়ে।
আহ-হা! কত ছোটো, কিন্তু কেমন সাহসী, মা-নেকড়ে বলল, ও একটুও ভয় পায়নি।
মানুষের খোকা ততক্ষণে মা-নেকড়ের গায়ের উপর এসে পড়েছে এবং নেকড়েশিশুদের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে মা-নেকড়ের বুক থেকে দুগ্ধ পান করতে শুরু করেছে।
দেখেছ! দেখেছ! মা-নেকড়ে বলে উঠল, মানুষের বাচ্চাটা আমার বাচ্চাদের সঙ্গে আমার দুধ খাচ্ছে! এমন আশ্চর্য ঘটনা কোনো নেকড়ের জীবনে ঘটেছে কি?
আমি অবশ্য এই রকম ঘটনার কথা শুনেছি, বাবা-নেকড়ে বলল, তবে আমাদের দলে এই ধরনের কিছু কখনো ঘটেনি; আর আমিও নিজের চোখে কখনো নেকড়ের আস্তানায় মানুষের বাচ্চাকে বাস করতে দেখিনি।
হঠাৎ গুহার ভিতরটা অন্ধকার হয়ে গেল, বন্ধ হয়ে গেল চাঁদের আলোর প্রবেশপথ– গুহামখে তখন দেখা দিয়েছে শেরখানের প্রকাণ্ড মাথা! সে ভিতরে ঢুকতে পারছে না, গুহার সংকীর্ণ প্রবেশপথ জুড়ে রয়েছে তার মাথা আর কঁধ, ওই ছোটো গর্তের ভিতর দিয়ে তার শরীরের বাকি অংশ গলে যেতে পারছে না। শেরখানের পিছন থেকে ভেসে এল তাবাকুই-এর কণ্ঠস্বর, প্রভু, ওটা ওইখানেই ঢুকেছে।
শেরখান নেকড়েদের গুহাতে উপস্থিত হওয়ায় আমরা সম্মানিত বোধ করছি, বাবা-নেকড়ে সৌজন্য দেখিয়ে বলল, কিন্তু তার দুই চোখে ফুটল দুরন্ত ক্রোধ, কিন্তু শেরখান এখানে কী চায়?
আমার শিকার, একটা মানুষের বাচ্চা এখানে এসেছে, শেরখান বলল, ওর বাবা-মা পালিয়ে গেছে। ওটা আমার শিকার, ওটা আমাকে দাও।
বাবা-নেকড়ে একটু আগে যা বলেছিল, তা সত্যি কাঠুরেদের আক্রমণ করতে গিয়ে তাদের জ্বালানো আগুনের কুণ্ডে পা পুড়িয়ে ফেলেছিল শেরখান- অগ্নিদাহের যন্ত্রণা এবং শিকার ফসকে যাওয়ার ক্ষোভ তাকে ভয়ংকর করে তুলেছে। কিন্তু বাবা-নেকড়ে জানত তারা এখানে নিরাপদ যতই ক্রুদ্ধ হোক, এই সংকীর্ণ গুহার ভিতর তার মস্ত শরীর নিয়ে ঢুকতে পারবে না শেরখান। এখন সে যেখানে রয়েছে, সেখানেও তার কাধ আর সামনের দুই থাবা আড়ষ্ট, নড়ার জায়গা নেই। একটা মস্ত নলের ভিতর ঢুকে কোনো মানুষ যদি লড়াই করার চেষ্টা করে, তাহলে তার যে দুরবস্থা ঘটবে, শেরখানের অবস্থা হয়েছে তথৈবচ।
নেকড়েরা স্বাধীন জীব, বাবা-নেকড়ে বলল, তারা শুধু তাদের দলপতির হুকুম মেনে চলে। কোনো ডোরাকাটা গোখাদক জন্তুর পরোয়া তারা করে না। মানুষের বাচ্চাটা আমাদের; –তাকে মারব কি রাখব, সেটা আমাদের খুশির উপর নির্ভর করছে।
তোমাদের খুশির উপর কিছুই নির্ভর করে না। আমার প্রাপ্য শিকার আমাকে ফিরিয়ে দিতে তোমরা বাধ্য। তোমাদের এই কুকুরের গর্তে নাক ঢুকিয়ে বসে থাকতে আমি রাজি নই। মনে রেখো, আমার নাম শেরখান।
বজ্রপাতের মতো গম্ভীর ব্যাঘ্রগর্জনে কেঁপে উঠল সংকীর্ণ গুহা। মা-নেকড়ে তার বাচ্চাদের ছেড়ে একলাফে এগিয়ে এল, অন্ধকারের মধ্যে জ্বলে উঠল তার দুই চোখ- শেরখানের জ্বলন্ত চোখের উপর চোখ রেখে সে বলে উঠল, তুমিও মনে রেখো, কার সামনে এসে তুমি কথা বলছ। আমার নাম রাক্ষসী, আমি তোমার কথার উত্তর দিচ্ছি। এই মানুষের বাচ্চাটা আমাদের সঙ্গে থাকবে। ও নেকড়ের দলের মধ্যেই বড়ো হবে, তাদের সঙ্গেই শিকার করবে। ওরে ল্যাংড়া জানোয়ার–ওরে ব্যাঙ আর মাছখেকো পশু তুই আজ একটা অসহায় বাচ্চাকে মারতে এসেছিস, কিন্তু আমার কাছে শুনে রাখ- এই ছোট্ট বাচ্চা একদিন তোকে শিকার করবে। হতভাগা, খোঁড়া জানোয়ার দূর হয়ে যা এখান থেকে।
বেউ-এর কথা শুনে অবাক হয়ে গেল বাবা-নেকড়ে। পুরোনো দিনের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। এখন তার মনে পড়ল, বহুদিন আগে পাঁচ-পাঁচটি প্রতিদ্বন্দ্বীকে যুদ্ধে হারিয়ে যেদিন সে মা-নেকড়েকে ঘরে এনেছিল– সেইদিন সে মা হয়নি, কিন্তু তার ভয়ংকর স্বভাবের জন্য দলের মধ্যে তার নামকরণ হয়েছিল রাক্ষসী। শেরখান হয়তো বাবা-নেকড়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত, কিন্তু মা-নেকড়েকে সে চটাতে সাহস পেল না। শেরখান জানত ওই ছোটো সংকীর্ণ জায়গায় সে ভালোভাবে লড়াই করতে পারবে না, কিন্তু মা-নেকড়ে তার ছোটো শরীর নিয়ে জায়গাটার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে এবং যুদ্ধ করবে মরিয়া হয়ে। সুতরাং ক্রুদ্ধ চাপা গর্জনে অসন্তোষ জানিয়ে সে গুহার মুখ থেকে পিছিয়ে এল, তারপর চিৎকার করে বলল, সব কুকুরই তার নিজের গর্তের ভিতর বীরত্ব দেখায়। দেখা যাবে নেকড়েসমাজ এই মানুষের বাচ্চাটার সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নেয়। আমি বলছি বাচ্চাটা আমার শিকার, ওকে আমি পাব। ওরে হতভাগা চোরের দল জেনে রাখিস, মানুষের বাচ্চাটা আমার দাঁতের মধ্যেই মরবে।
মা-নেকড়ে তার বাচ্চাদের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ল। দারুণ উত্তেজনায় সে তখন জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। বাবা-নেকড়ে বউকে উদ্দেশ করে বলল, শেরখান কথাটা ভুল বলেনি। মানুষের বাচ্চাটাকে দলের সামনে উপস্থিত করতেই হবে। তুমি কি বাচ্চাটাকে রাখবে?
নিশ্চয়ই রাখব, মা-নেকড়ে বলল, বাচ্চাটা রাত্রিতে এসেছে ক্ষুধার্ত হয়ে। একটুও ভয় পায়নি ও। দ্যাখো, আমাদের একটা বাচ্চাকে মানুষের খোকাটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে। হতভাগা ল্যাংড়া কসাইটা এই অসহায় বাচ্চাটাকে মেরে সরে পড়ত তার পুরোনো আস্তানা ওয়েনগঙ্গার ধারে- আর প্রতিশোধ নিতে এখানকার গ্রামের মানুষ জঙ্গলে হানা দিয়ে আমাদের আস্তানাগুলো ভেঙে চুরমার করত। সেই সময় আমাদের মধ্যে অনেকেই মারা পড়ত। তুমি আবার জিজ্ঞাসা করছ ওকে রাখব কিনা? নিশ্চয়ই রাখব। …এই খোকা, ন্যাংটো ব্যাঙ, চুপচাপ শুয়ে থাক। হ্যাঁ, আমি ওর নাম রাখলাম মোগলি, আমাদের অর্থাৎ নেকড়ের ভাষায় ব্যাঙ। এই মোগলির হাতেই একদিন প্রাণ হারাবে শেরখান। আজ যে শিকারি, কাল সে-ই হবে শিকার।
কিন্তু আমাদের দল কী বলবে? বাবা-নেকড়ে বলল।
জঙ্গলের আইন অনুসারে কোনো নেকড়ে যখন বিয়ে করে, তখন সে বউ নিয়ে দলের বাইরে চলে যেতে পারে কিন্তু তার বাচ্চারা যখন চার পায়ে খাড়া হয়ে চলার মতন বড়ো হয়, তখনই তাদের দলের মন্ত্রণাসভায় এনে উপস্থিত করতে হয়। প্রত্যেক মাসে আকাশে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হলেই পূর্বোক্ত মন্ত্রণাসভার বৈঠক বসে। সেই বৈঠকে সকলের সঙ্গে বাচ্চাদের পরিচয় হওয়ার পর তারা খুশিমতো ঘুরে বেড়াতে পারে। যতদিন পর্যন্ত তারা শিকার করতে সমর্থ না হয়, ততদিন পর্যন্ত পূর্ণবয়স্ক নেকড়েদের কাছে ওই বাচ্চারা অবধ্য। জঙ্গলের ওই আইন অমান্য করে যদি কোনো নেকড়ে পূর্বোক্ত নাবালক নেকড়েশিশুদের কাউকে হত্যা করে, তাহলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। হত্যাকারী পালিয়েও নিস্তার পাবে না, নেকড়ের দল তাকে খুঁজে বার করবেই করবে এবং মিলিত আক্রমণে খুনির দেহ হয়ে যাবে ছিন্নভিন্ন।
বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করল বাবা-নেকড়ে। ওই সময়ের মধ্যে তার চারটি বাচ্চা ছুটোছুটি করার মতো বড়ো হয়ে উঠল। তখন বউ আর বাচ্চাদের সঙ্গে মানুষের খোকা মোগলিকে নিয়ে মন্ত্রণাসভায় উপস্থিত হল বাবা-নেকড়ে।
পাথরে-ঢাকা একটি পাহাড়ের চূড়া ছিল নেকড়েবাহিনীর মন্ত্রণাসভার আসর। সেখানে অন্তত একশো নেকড়ে জমায়েত হতে পারত। সেই রাতে ওই পাহাড়ের চূড়ার উপর টান হয়ে শুয়েছিল নেকড়েদের দলপতি আকেলা। যে পাথরটার উপর সে শয্যাগ্রহণ করেছিল, তার তলায় অপেক্ষা করছিল চল্লিশ বা তার চেয়ে কিছু বেশি সংখ্যক নেকড়ে। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন ধরনের জন্তু ছিল ওই নেকড়ের দলে। তাদের মধ্যে ছিল অভিজ্ঞ ও প্রাচীন শিকারির দল, যারা কারো সাহায্য না নিয়ে একক চেষ্টাতেই একটা বলিষ্ঠ হরিণকে ঘায়েল করতে পারে— আবার তিন বছর বয়সের ছোকরা জন্তুরাও ছিল, যাদের ক্ষমতা নিতান্তই সীমাবদ্ধ–কিন্তু তারা মনে করত প্রবীণ শিকারিদের সঙ্গে তাদের কোনোই তফাৎ নেই। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন ধরনের জন্তুকে নিয়ে তৈরি ওই দলটাকে চালনা করত আলো নামক দলপতি। মানুষের আচার-ব্যবহার রীতি-নীতি সম্পর্কে উক্ত দলপতি ছিল জন্তুর মতো ওয়াকিবহাল।
সেই রাত্রে মন্ত্রণাসভায় বিশেষ কথাবার্তা কেউ বলছিল না। যে মস্ত পাথরটার উপর মন্ত্রণাসভার অধিবেশন বসেছিল, সেইখানে সকলের মাঝখানে হুটোপাটি করে খেলছিল নেকড়েশিশুর দল। মাঝে মাঝে একটি বয়স্ক নেকড়ে নিঃশব্দে এগিয়ে এসে বাচ্চাদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আবার নীরবে ফিরে আসছিল নিজের জায়গায়। কখনো বা কোনো নেকড়ে-মা তার বাচ্চাকে চাঁদের আলোর ভিতর খোলা জায়গায় ঠেলে দিচ্ছিল, যাতে দলের সব নেকড়ে বাচ্চাটাকে ভালো করে দেখতে পায়। আকেলা তখন চিৎকার করে বলছিল, ওহে নেকড়ের দল! তোমরা আইন জানো– ভালো করে দেখে নাও বাচ্চাদের।
অবশেষে মোগলির পালা–মা-নেকড়ের ঘাড়ের লোম উত্তেজনায় খাড়া হয়ে উঠল, যখন মোগলিকে সকলের চোখের সামনে ঠেলে দিল বাবা-নেকড়ে। মোগলি তখন নেকড়েদের বৃত্তের মাঝখানে ছোটো ছোটো নুড়ি-পাথর নিয়ে খেলছে আর হাসছে।
আকেলা মাথা তুলল না, সে একঘেয়েভাবে ঘোষণা করে চলল, ভালো করে দেখে নাও, ভালো করে দেখে নাও।
মন্ত্রণাসভার মস্ত পাথরটার পিছন থেকে ভেসে এল শেরখানের গর্জিত কণ্ঠ, বাচ্চাটা আমার। ওকে আমায় দাও। নেকড়েরা স্বাধীন জীব; মানুষের বাচ্চা নিয়ে তারা কী করবে?
আকেলা তখনও অবিচলিত, তার কানের ডগাটুকুও নড়ল না, নেকড়ের দল। ভালো করে দেখে নাও! এই বাচ্চাটা নেকড়ের বাচ্চা নয়- এর সম্বন্ধে তোমরা কী সিদ্ধান্ত নিতে চাও?
অনেকগুলো কণ্ঠের মিলিত গর্জন জাগল, একটি কিশোর নেকড়ে শেরখানের প্রশ্নটাই ছুঁড়ে দিল দলপতির উদ্দেশ্যে, আমরা স্বাধীন জীব; মানুষের বাচ্চা নিয়ে আমরা কী করব?
জঙ্গলের আইন বলছে কোনো বাচ্চাকে দলে গ্রহণ করার বিষয়ে বিতর্ক উপস্থিত হলে, দলের মধ্যে অন্তত দু-জন যদি বাচ্চার পক্ষে মত প্রকাশ করে, তাহলে তাকে দলভুক্ত করা যায়। অবশ্য ওই দু-জন বাচ্চার মা আর বাবা হলে চলবে না।
বাচ্চার হয়ে কে কথা বলবে? আকেলা জানতে চাইল, স্বাধীন জনগণের মধ্যে কারা দাঁড়াতে চাও বাচ্চার হয়ে?
কোনো উত্তর এল না। মা-নেকড়ে লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হল, যদিও সে জানত সত্যিই যদি লড়াই বাধে, তাহলে এই লড়াইটা হবে তার শেষ লড়াই।
সেই চরম মুহূর্তে নেকড়েদের মাঝখানে আত্মপ্রকাশ করল বালু নামক অরণ্যচারী বৃদ্ধ ভাল্লুক। নেকড়েবাহিনীর মন্ত্রণাসভায় একমাত্র বালুরই ছিল মতপ্রকাশের অধিকার। কারণ, নেকড়েশিশুদের জঙ্গলের আইন শেখানোর ভার নিয়েছিল ওই বালু।
মানুষের বাচ্চা? পিছনের দুই পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল বালু, আমি ওই মানুষের বাচ্চার হয়ে কথা বলছি। ওই বাচ্চাটাকে নেকডের সঙ্গে মিশতে দাও, তাদের সঙ্গেই ও বড়ো হয়ে উঠুক। ও নেকড়েদের ক্ষতি করবে না। আমি নিজে ওকে বনের আইন-কানুন শেখাব।
আরও একজন দরকার, আকেলা ঘোষণা করল, বালু বাচ্চার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কে সমর্থন করবে বালুকে?
নেকড়েবাহিনীর মধ্যে নিঃশব্দে নেমে এল একটি কালো ছায়া নাম তার বাঘিরা। সে একটি কালো চিতা। সমস্ত শরীর কুচকুচে কালো। তবে সূর্যের আলো পড়লে তার কালো শরীরের আরও কালো চক্রাকার চিহ্নগুলি দেখা যায়। জঙ্গলের বাসিন্দারা সকলেই বাঘিরাকে সমীহ করে সে তাবাকুই নামক শেয়ালের মতো ধূর্ত, বন্য মহিষের মতো সাহসী এবং আহত হস্তীর মতো বেপরোয়া ও ভয়ংকর। কিন্তু ওই ভয়ংকর শ্বাপদের গলার স্বর কর্কশ নয়, মধুর মতন মোলায়েম ও স্নিগ্ধ।
আকেলা ও স্বাধীন জনগণ, বাঘিরা বলল, তোমাদের সভায় কথা বলার অধিকার আমার নেই। কিন্তু জঙ্গলের আইন বলছে, বাচ্চার জীবন দাম দিয়ে কিনে নেওয়া যায়; এবং সেই দাম কে দিতে পারে আর কে দিতে পারে না, সেবিষয়ে আইনের কোনো নির্দেশ নেই। কী, ঠিক বলেছি?
ঠিক, ঠিক, কয়েকটা ছোকরা নেকড়ে বলে উঠল, বাঘিরা ঠিক বলেছে। উপযুক্ত দাম দিয়ে বাচ্চার জীবন কিনে নেওয়া যায়। জঙ্গলের আইন সেই নির্দেশ দিচ্ছে।
আমি জানি এখানে কথা বলার অধিকার আমার নেই, বাঘিরা আবার বলল, তাই দলের কাছে আমি কথা বলার অনুমতি চাইছি।
বলো! বলো! একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল অনেকগুলো কণ্ঠ।
একটি অসহায় শিশুকে হত্যা করা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। বালু ওই মানুষের বাচ্চার পক্ষে মত দিয়েছে। বালুকে সমর্থন করে একটি ষাঁড়কে আমি ওই শিশুর জীবনের মূল্য হিসাবে দান করছি। ষাঁড়টি বেশ নধর, একটু আগেই আমি তাকে শিকার করেছি। এখান থেকে ওই ষাঁড়ের মৃতদেহের দূরত্ব হবে আধ মাইলেরও কম। এখন তোমরা ষাঁড়টিকে মূল্য হিসাবে গ্রহণ করে মানুষের বাচ্চাটিকে দলে নিতে রাজি আছ কি?
মোগলিকে দলে নিতে আর কেউ আপত্তি করল না। সকলেই ছুটল মৃত ষণ্ডের সন্ধানে। অকুস্থলে রইল আকেলা, বালু, বাঘিরা, মোগলি আর মোগলি যে পরিবারের অন্তর্গত সেই নেকড়ে পরিবার। সেই রাতে শেরখানের ক্রুদ্ধ গর্জনে বন কাঁপতে লাগল, মোগলিকে তার কবলে ছেড়ে দেওয়া হয়নি বলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সে।
হ্যাঁ, প্রাণ খুলে গর্জন কর, বাঘিরা বলল, একদিন এই মানুষের খোকা তোমার গর্জনের সুর পালটে দেবে। যা বললাম তা যদি না হয়, তাহলে মানুষ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।
ভালোই হয়েছে, আকেলা বলল, মানুষ আর তার বাচ্চারা জ্ঞানী আর বুদ্ধিমান হয়। আজ আমরা যাকে বাঁচিয়েছি, একদিন হয়তো সে আমাদের বাঁচাবে।
কথাটা সত্যি, বাঘিরা বলল, একদিন এই বাচ্চা খোকার সাহায্য তোমার প্রয়োজন হবে। কারণ, কোনো দলপতিই চিরকাল দলের নেতৃত্ব দিতে পারে না।
আলো নীরব রইল। সে চিন্তা করছিল- প্রত্যেক দলের প্রত্যেক দলপতিই একদিন বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে পড়ে, আর তখনই দলের জোয়ান নেকড়েদের আক্রমণে তার মৃত্যু হয় দলের ভিতর থেকে উঠে আসে নতুন দলপতি, আবার পুরোনো দলপতির মতো নির্দিষ্ট নিয়মে নিহত হওয়ার জন্য।
ওকে নিয়ে যাও, বাবা-নেকড়ের উদ্দেশ্যে বলল আকেলা, স্বাধীন জনগণের উপযুক্ত শিক্ষায় ওকে শিক্ষিত করো।
ওইভাবেই সিওনী নেকড়েবাহিনীর দলে আসার ছাড়পত্র পেল মোগলি বৃদ্ধ ভাল্লুক বালুর কথায় এবং কালো চিতা বাঘিরার উপহার মৃত ষণ্ডের বিনিময়ে….
অতিবাহিত হয়েছে দীর্ঘ এগারো বৎসর, মোগলি এখন আর নিতান্ত অসহায় নয়। সে গাছে উঠতে পারে বাঁদরের মতন চটপট, জঙ্গলের মধ্যে ডোবা আর জলাশয়ে সাঁতার কাটতে পারে ঘন্টার পর ঘণ্টা এবং নেকড়ের দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতেও তার অসুবিধা হয় না কিছুমাত্র। এর মধ্যে অনেকবারই নেকড়েদের মন্ত্রণাসভায় সে যোগ দিয়েছে। সেখানে সে নিজের একটি আশ্চর্য ক্ষমতা আবিষ্কার করে চমৎকৃত হয়েছে কোনো নেকড়ে তার চোখে চোখ রাখতে পারে না, তার চোখের দিকে তাকিয়েই নেকড়েরা চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পূর্বোক্ত তথ্য জানার পর সে অনেক সময় মজা করার জন্যই নেকড়েদের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকত– ফল হত সর্বদাই একরকম–নেকড়েরা তাদের দৃষ্টি সরিয়ে নতনেত্র হত অথবা দৃষ্টিস্থাপন করত অন্যদিকে। অনেক সময় বন্ধুদের পায়ের তলা থেকে কাটা তুলে যন্ত্রণা থেকে তাদের মুক্তি দিত সে। নেকড়েরা প্রায়ই কাটা ফুটে কষ্টভোগ করত। স্বজাতি মানুষ সম্বন্ধে ছিল তার অবিশ্বাস ও ভীতি। বাঘিরা তাকে জঙ্গলের ভিতর একটা বাক্স দেখিয়ে বলেছিল, ওটা একটা ফাঁদ, ওর মধ্যে ঢুকলে আর বেরিয়ে আসা যায় না। জন্তুদের বিপদে ফেলার জন্য ওই ধরনের ফাঁদ পেতে রাখে মানুষ। সেকথা জানার পর মানুষকে ভয় পেতে আর এড়িয়ে চলতে শিখেছে মোগলি। জঙ্গলের আইন সম্পর্কে এখন সে জন্তুর মতো সচেতন। শিকারের জন্য যে-কোনো জন্তুকেই মারার অধিকার আছে তার কিন্তু গরু-বাছুর-ষাঁড় সে মারতে পারে না। কারণ, একটি ষাঁড়ের বিনিময়ে তার প্রাণরক্ষা করেছিল বাঘিরা। এসব কথা বাঘিরার কাছে সে শুনেছে এবং অরণ্যে প্রচলিত আইনকে মান্য করেছে সুবোধ বালকের মতন।
মা-নেকড়ে কখনো কখনো মোগলিকে শেরখান সম্পর্কে সাবধান করে দিত। কিন্তু মোগলি সেই সতর্কবাণী মনে রাখত না।
আলোর শরীরে বয়সের ভার নেমে তাকে দুর্বল করে ফেলেছিল। তার দলের অল্পবয়সী নেকড়েদের সঙ্গে খোঁড়া বাঘটার বন্ধুত্ব জমে উঠছিল ধীরে ধীরে। শেরখান মাঝে মাঝে তার নেকড়ে-বন্ধুদের উদ্দেশ করে বলত, একটা বুড়ো মুমূর্ষ নেকড়ে আর একটা মানুষের বাচ্চার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তাদের মতো পাকা শিকারিরা কেমন করে চলছে! সে আরো বলত, শুনেছি মন্ত্রণাসভায় তোমরা কেউ সাহস করে তার চোখের দিকে তাকাতে পার না।
শেরখানের কথা শুনে ছোকরা নেকড়েদের ঘাড়ের নোম ফুলে উঠত, গলা দিয়ে বেরিয়ে আসত রুদ্ধ রোষের চাপা গর্জন। বাঘিরার চোখ আর কান ছিল সর্বদাই সজাগ, সে মোগলিকে সতর্ক করে দিয়ে বলত, শেরখান সম্পর্কে তার সাবধান থাকা উচিত– সুযোগ পেলে খোঁড়া বাঘটা তাকে হত্যা করতে পারে।
মোগলি বাঘিরার কথা হেসে উড়িয়ে দিত, নেকড়ের দল আমার পক্ষে আছে। তুমি আর বালু সর্বদা আমাকে রক্ষা করতে প্রস্তুত। শেরখানকে আমি ভয় করব কেন?
বাঘিরা বলল, ছোট্ট ভাইটি, কতবার তোমায় বলব যে, শেরখান তোমার শত্রু?
অনেকবার বলেছ, মোগলি বলল, এখন আমার ঘুম পাচ্ছে। এখন আমি ঘুমাব।
এখন ঘুমানোর সময় নয়। জঙ্গলের সব জানোয়ারই জানে সেকথা। এমনকী তাবাকুইও জানে।
হো! হো! হেসে উঠল মোগলি, কয়েকদিন আগে তাবাকুই আমার কাছে এসে খুব আজে-বাজে কথা কইছিল। সে বলছিল আমি নাকি একটা মানুষের বাচ্চা, জঙ্গলে থাকার উপযুক্ত নই। আমি মুখে তার জবাব দিইনি, তার ল্যাজ ধরে একটা গাছের গায়ে আছাড় মেরে বুঝিয়ে দিয়েছি ভালো ব্যবহার না করলে ওইভাবে শাস্তি পেতে হবে।
কাজটা ভালো হয়নি মোগলি। অবশ্য তাবাকুই খুব পাজি জানোয়ার। তোমাকে অপমান না করে সে তোমায় কয়েকটা দরকারি কথা জানাতে পারত। চোখ খুলে তাকাও, এখন ঘুমাতে হবে না। শোনো, ছোট্ট ভাইটি, এই জঙ্গলে শেরখান তোমাকে হত্যা করতে সাহস পাবে না। কিন্তু মনে রেখো–আকেলা বুড়ো হচ্ছে, একদিন সে হরিণ শিকার করতে ব্যর্থ হবে, আর সঙ্গে সঙ্গে নেকড়েবাহিনীর দলপতির পদ থেকে তাকে বিদায় নিতে হবে। মন্ত্রণাসভায় যে-সব নেকড়ের উপস্থিতিতে তোমাকে নেকড়েসমাজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, সেই সব নেকড়ে আজ খুবই বুড়ো হয়ে পড়েছে। দলের জোয়ান নেকড়েগুলো আজ শেখানের সঙ্গে জুটেছে, তারাও মনে করে তুমি আর নেকড়ের দলে থাকার উপযুক্ত নও। কারণ, এখন আর তোমাকে বাচ্চা বলা চলে না, খুব অল্পদিনের মধ্যেই তুমি সম্পূর্ণ পরিণত একটি মানুষ হয়ে উঠবে।
তাতে কী হয়েছে? এই জঙ্গলে আমি জন্মেছি, জঙ্গলের আইন সর্বদা মেনে চলি। দলে এমন কোনো নেকড়ে নেই, যার পা থেকে কাটা তুলে দিইনি আমি। তারা নিশ্চয়ই আমাকে ভাই বলে স্বীকার করবে। তারা আমার ক্ষতি করবে না কখনোই।
বাঘিরা শরীরটাকে টান করে দিল, তারপর বলল, ছোট্ট ভাইটি, আমার চোয়ালের তলায় হাত দাও।
নির্দিষ্ট স্থানে হাত দিয়ে মোগলি অনুভব করল সেই জায়গাটায় লোম উঠে চামড়া বেরিয়ে পড়েছে।
জঙ্গলের কেউ জানে না যে, আমার গলায় বগলসের দাগ আছে। জন্মেছি মানুষের বন্দিশালায়, উদয়পুর রাজ্যে। খাঁচার মধ্যে আমি থাকতাম, একটা লোহার পাত্রে আমায় খাবার দেওয়া হত। একদিন অনুভব করলাম আমি বাঘিরা, কালো চিতা- মানুষের খেলার পুতুল নই– সেইদিনই খাঁচার তুচ্ছ থালাটাকে থাবার এক আঘাতে ভেঙে ফেলে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু বহুদিন মানুষের সঙ্গে থাকার ফলে আমি মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি তাই আজ আমি শেরখানের চাইতেও ভয়ংকর জঙ্গলের তাবৎ জানোয়ার আমাকে বাঘের চাইতে বেশি ভয় করে। বল, ঠিক কিনা?
ঠিক কথা। সারা জঙ্গলের সমস্ত জানোয়ার বাঘিরাকে ভয় করে। কিন্তু আমি তাকে ভয় করি না।
আরে, তুমি তো মানুষের বাচ্চা, বাঘিরা বলল, আমি যেমন আমার স্বস্থানে অর্থাৎ জঙ্গলে ফিরে এসেছি, তুমিও একদিন তোমার নিজের জায়গায় তোমার স্বজাতি মানুষের কাছে ফিরে যাবে। মানুষ তোমার জাতভাই, তোমার আপনজন— অবশ্য তার আগেই হয়তো। মন্ত্রণাসভায় তোমাকে হত্যা করা হবে।
কিন্তু কেন? আমার নেকড়ে-ভাইরা আমাকে হত্যা করতে চাইবে কেন?
আমার দিকে তাকাও, বাঘিরা বলল।
মোগলি বাঘিরার চোখের উপর দৃষ্টি স্থাপন করল, আধ মিনিট পর্যন্ত চোখে চোখ রেখে স্থির হয়ে রইল তারা– তারপর হঠাৎ কালো চিতা তার মাথা সরিয়ে নিয়ে দৃষ্টিকে চালিত করল অন্যদিকে।
এইজন্যেই তোমায় নেকড়েরা হত্যা করতে চাইবে, বাঘিরা বলল, আমি বাঘিরা সারা বনের মূর্তিমান আতঙ্ক- কিন্তু আমিও তোমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে পারি না, যদিও তোমায় আমি ভালোবাসি। নেকড়েরা তোমায় ঘৃণা করে। কারণ, তারাও তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। পায়ে কাটা ফুটলে তুমি টেনে বার করতে পার, তারা পারে না। তাদের এই অক্ষমতার জন্যই তারা তোমায় ঘৃণা করে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, তুমি একটি মানুষ তাই জোয়ান নেকড়েরা আজ তোমায় সহ্য করতে পারছে না।
মোগলির ভ্রু কুঞ্চিত হল, আমি এতসব কথা জানতাম না।
বাঘিরা বলল, আমি বুঝতে পারছি তোমার বিপদ ঘনিয়ে আসছে। আকেলা বুড়ো হচ্ছে, একদিন-না-একদিন তার শিকার ফসকে যাবে। সঙ্গেসঙ্গে নেকড়ের দল তার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবে। তাদের লক্ষ্য শুধু আকেলা নয়, তুমিও বটে। তারা মস্ত পাথরের চাইটার উপর মন্ত্রণাসভা ডাকবে আর হা! হয়েছে, হয়েছে
বাঘিরা লাফিয়ে উঠল, তোমার জীবনরক্ষার উপায় রয়েছে তোমারই হাতে। মানুষের কুটির থেকে নিয়ে এস লাল ফুল। বাঘিরা, বালু আর তোমার পক্ষপাতী কয়েকটি নেকড়ের চাইতে অনেক বেশি শক্তিমান ওই লাল ফুল। বিপদে পড়লে ওই লাল ফুলই তোমাকে বাঁচাতে পারবে।
লাল ফুল বলতে বনের পশুরা আগুনকেই বোঝায়। তারা সকলেই আগুনকে ভয় পায়।
লাল ফুল? মোগলি বলল, সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে এলেই মানুষের ঘরে ওই ফুল ফোটে। আমি ওটাকে নিয়ে আসব।
মানুষেরা বাচ্চা তো! মানুষের মতোই কথা বলেছ তুমি, বাঘিরা বলল, তবে মনে রেখো, ওই ফুল জন্মায় ছোটো ছোটো পাত্রের ভিতর। লাল ফুল ভর্তি একটা পাত্র মানুষের ঘর থেকে নিয়ে আসবে, দরকার মতন ব্যবহার করার জন্য সেটা রেখে দেবে নিজের কাছে।
আমি তাহলে যাচ্ছি, মোগলি বলল, কিন্তু বাঘিরা, শেরখান কি সত্যিই আমার বিরুদ্ধে দল পাকাচ্ছে? তুমি ঠিক জান?
–হ্যাঁ, ছোট্ট ভাইটি; আমি ঠিক জানি।
-তাহলে আমিও বলে রাখছি, শেরখানকে আমি উচিত শিক্ষা দেব। বাঘিরাকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলে গেল মোগলি।
এই হচ্ছে মানুষ, বাঘিরা আবার শুয়ে পড়ে আপনমনে বিড় বিড় করে বলল, শেরখান দশ বছর আগে একটা অসহায় শিশুকে তাড়া করে যে পাপ করেছে, আজ সেই পাপের জন্য তার শাস্তি পাওয়ার সময় এসেছে।
নেকড়ে-পরিবারের গুহায় উপস্থিত হল মোগলি। তার নেকড়ে-ভাইরা সেখানে না থাকলেও মা-নেকড়েকে গুহার ভিতরেই সে দেখতে পেল। মোগলিকে দেখেই মা-নেকড়ে বুঝতে পারল তার পালিত পুত্রটির উত্তেজিত হওয়ার মতো কোনো কারণ ঘটেছে।
মা-নেকড়ে বলল, এই ছেলে, বল তোর কী হয়েছে?
শেরখান সম্পর্কে কয়েকটা উড়ো কথা শুনলাম, মোগলি বলল, এখন আমি যাচ্ছি। আজ রাতে আমি মানুষদের আস্তানায় যাব। পাহাড় থেকে দ্রুত নামতে নামতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে, তার কানে এসেছে নেকড়েবাহিনীর উল্লাসধ্বনি আর শম্বর হরিণের ভয়ার্ত চিৎকার। একটু পরেই ভেসে এল তীব্র নাসিকাধ্বনি। মোগলি বুঝল, নেকড়ে দল আর শম্বর হরিণের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন কোণঠাসা শম্বর যখন রুখে দাঁড়ায়, তখনই তার নাক থেকে বেরিয়ে আসে ওইরকম কর্কশ আওয়াজ। এবার শোনা গেল জোয়ান নেকড়েদের মিলিত কণ্ঠস্বর, আকেলা! আকেলা! এখন তোমার ক্ষমতা দেখাও। মাটিতে পেড়ে ফেল শিকারকে। লাফাও। আকেলা, লাফাও!
আলো নিশ্চয়ই শিকার লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল, লক্ষ্যভ্রষ্ট দুই দাঁতালো চোয়ালের সংঘর্ষের শব্দ শুনতে পেল মোগলি। পরক্ষণেই এক যাতনাকাতর আর্তনাদ মোগলিকে জানিয়ে দিল শিকারির লক্ষ্য ফসকে গেলেও শিকারের নিশানা ব্যর্থ হয়নি শম্বরের পায়ের লাথি আততায়ীকে ছিটকে ফেলে দিয়েছে।
মোগলি আর কিছু দেখা বা শোনার জন্য অপেক্ষা করল না, ছুটে চলল গ্রামের দিকে। তার পিছনে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল নেকড়েদের চিৎকার….
বাঘিরা ঠিকই বলেছে, একটা কুঁড়েঘরের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সে নিজের মনেই বলল, কালই জীবন-মরণের পরীক্ষা– আমার এবং আলোর।
জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে সে ঘরের ভিতর মেঝেতে বসানো জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডটা দেখতে পেল। রাত্রি গম্ভীর হলে বাড়ির গহিনী বিছানা ছেড়ে উঠে কালো কালো কয়েকটা জিনিস (আমরা জানি ওগুলো কয়লা) আগুনের মধ্যে ফেলে দিল। সকাল হল- বাড়ির ছোটো খোকা একটা হাঁড়ি মাটিতে ভর্তি করে তার মধ্যে জ্বলন্ত কয়লা রাখল, তারপর রওনা দিল গোয়ালঘরের দিকে।
কিন্তু ছেলেটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর আগেই মোগলি ঝড়ের মতো ছুটে এসে আগুনভরা হাঁড়িটাকে ছিনিয়ে নিল তার হাত থেকে এবং চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই অদৃশ্য হয়ে গেল ঘনীভূত কুয়াশার অন্তরালে। ছেলেটি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
হাঁড়ির মধ্যে ঘন ঘন ফুঁ দিচ্ছিল মোগলি, সে দেখেছে ঘরের মধ্যে মেয়েমানুষটিও ওইভাবে ফুঁ দিচ্ছিল। কিছু খেতে না দিলে লাল ফুলটা মরে যাবে- বলেই কয়েকটা শুকনো ডালপালা আগুনের খাদ্য হিসাবে হাঁড়ির ভিতর ফেলে দিল মোগলি। পাহাড় বেয়ে ওঠার সময়ে মাঝপথেই তার সঙ্গে বাঘিরার দেখা হয়ে গেল। বাঘিরার শিশির-ভেজা কালো চামড়ার উপর জুলছিল সকালের নরম আলো।
আকেলা শিকার ফসকেছে, কালো চিতা বলল, কাল রাতেই ওরা আলোকে খুন করত! কিন্তু ওরা তোমাকেও চায়। তোমার জন্যই ওরা অপেক্ষা করছে পাহাড়ের উপর।
আমি মানুষের আস্তানায় গিয়েছিলাম। মোগলি আগুনভরা হাঁড়িটা তুলে ধরল, দেখেছ? আমিও তৈরি আছি।
বাঃ! চমৎকার! বাঘিরা বলল, আমি দেখেছি লাল ফুলের মধ্যে মানুষরা গাছের শুকনো ডাল ফেলে দেয়, আর লাল ফুলটা তখন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আচ্ছা, তোমার ভয় করেনি?
ভয় করবে কেন? মোগলি বলল, এখন আমার মনে পড়ছে অনেক, অনেক দিন আগে, যখন আমি নেকড়ের দলে আসিনি সেই সময় আমি লাল ফুলের কাছে শুয়ে থাকতাম। জিনিসটা বেশ গরম, ঠাণ্ডার সময় আরাম দেয়।
সারাদিন গুহার ভিতর আগুনের হাঁড়ি নিয়ে বসে রইল মোগলি। মাঝে মাঝে শুকনো ডালপালা দিয়ে আগুনটাকে সে বাঁচিয়ে রাখল। সন্ধ্যার সময়ে তাবাকুই এসে রূঢ়ভাবে জানাল মন্ত্রণাসভায় মোগলির ডাক পড়েছে। মোগলি হো হো শব্দে হেসে উঠতেই সভয়ে ছুটে পালাল তাবাকুই। হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়াল মোগলি- যখন সে মন্ত্রণাসভায় পৌঁছাল, তখনও তার মুখের হাসি মুছে যায়নি।
…পাথরটার একপাশে শুয়ে আছে নিঃসঙ্গ নেকড়ে আকেলা; কাছেই শেরখান তার উচ্ছিষ্টভোজী নেকড়েদের নিয়ে পায়চারি করছে সগর্বে। মোগলির পাশে রয়েছে বাঘিরা। দুই হাঁটুর মাঝখানে আগুনের হাঁড়ি নিয়ে বসে আছে মোগলি। সকলে এক জায়গায় এসে সমবেত হওয়ার পর শেরখান কথা বলতে শুরু করল। আকেলা যখন দলপতি ছিল, তখন নেকড়েদের সভায় কখনো মুখ খুলতে সাহস পায়নি শেরখান।
বাঘিরা ফিস ফিস করে বলল, ছোট্ট ভাইটি, এখানে শেরখানের কথা বলার অধিকার নেই। তুমি সেকথা জানিয়ে দাও। ও তাহলে ভয় পাবে।
মোগলি লাফিয়ে উঠে সমবেত নেকড়েদের সম্বোধন করে বলল, স্বাধীন জনগণ! আমি তোমাদের কাছে জানতে চাইছি শেরখান কি নেকডেবাহিনীকে চালনা করে? নেকড়েদের দলপতি নির্বাচন করার বিষয়ে একটা বাঘ কথা বলতে আসে কোন সাহসে?
নেতৃত্বের জন্য লড়াই যখন আসন্ন, আর আমায় যখন কথা বলতে অনুরোধ করা হয়েছে
শেরখানের বাক্যম্রোতে বাধা দিয়ে মোগলি বলে উঠল, কে অনুরোধ করেছে? আমরা কি সকলেই শেয়াল হয়ে গেছি যে, এই গোখাদক কসাইটার কথা কান পেতে শুনব? নেকড়েদের দলপতি নির্বাচন করবে শুধু নেকড়েরাই।
অনেকগুলো কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, চুপ কর! মানুষের বাচ্চা, চুপ কর। শেরখান আমাদের আইন ভঙ্গ করেনি, ওকে কথা বলতে দাও।
অবশেষে দলের কয়েকটি প্রবীণ ও অভিজ্ঞ যোদ্ধা মতপ্রকাশ করল, এইবার মৃত নেকড়েকে কথা বলতে দাও।
যখন কোনো নেকড়ে-দলপতি শিকার করতে ব্যর্থ হয়, তখন ওই দলপতিকে মৃত নেকড়ে বলে উল্লেখ করা হয়, যতদিন বা যতক্ষণ সে বেঁচে থাকে। অবশ্য বেঁচে থাকা ব্যাপারটা খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
আকেলা মাথা তুলল, স্বাধীন জনগণ ও শেরখানের উচ্ছিষ্টভোজী শেয়ালের দল-বারো বৎসর ধরে আমি তোমাদের নেতৃত্ব দিয়েছি, ওই সময়ের মধ্যে তোমাদের মধ্যে কেউ আহত হয়নি বা ফাঁদে পড়ে বিপন্ন হয়নি। আজ আমি শিকার ফসকে ব্যর্থ হয়েছি। তোমরা যারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছ, তারা ভালো করেই জানো ব্যাপারটা কী ঘটেছে। দুর্দান্ত হরিণটাকে ক্লান্ত না করেই তাকে ঘেরাও করেছ, তারপর আমাকে বলেছ তাকে ঘায়েল করতে। ফঁদটা সাজিয়েছ ভালোই। যাই হোক, আমি যখন ব্যর্থ হয়েছি, তখন মন্ত্রণাসভার এই পাথরটার উপর আমাকে হত্যা করার অধিকার তোমাদের নিশ্চয়ই আছে। এখন আমি জানতে চাই আমাকে নিঃসঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি দিতে প্রথম কে এগিয়ে আসবে? জঙ্গলের আইন অনুযায়ী তোমরা একে একে আমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামবে। সকলে মিলে একসঙ্গে আক্রমণ করার নিয়ম নেই।
চারদিক স্তব্ধ, নীরব। কারো মুখে কথা নেই। আলোর সঙ্গে মৃত্যুপণ দ্বৈরথে জীবন বিপন্ন করতে কেউ রাজি নয়। অনেকক্ষণ পরে নীরবতা ভঙ্গ করে গর্জে উঠল শেরখান, ওই বুড়ো নির্বোধটাকে নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। ও তো একটা মড়া আজ হোক আর কাল হোক, ওকে মরতেই হবে। এখন আমাদের মানুষের বাচ্চাটা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। বাচ্চাটা অনেকদিন বেঁচেছে স্বাধীন জনগণ, এইবার ওকে আমার মুখে ছেড়ে দাও। প্রথম থেকেই ও ছিল আমার শিকার। দশটি বছর ধরে জঙ্গলকে ও নোরা করেছে। এখন যদি আমার মুখে ওকে ছেড়ে না দাও, তাহলে আমি এই জায়গাতেই বরাবর শিকার করব এবং তোমাদের কাউকে একটি হাড়ও দেব না। মানুষের বাচ্চাকে আমি ঘৃণা করি। আমি অনেকদিন ওর জন্য অপেক্ষা করেছি, আজ আমি ওকে শেষ করতে চাই।
শেরখানের বক্তৃতা শেষ হতে-না-হতেই সমবেত দলের অধিকাংশ নেকড়ে চিৎকার করে উঠল, মানুষ! মানুষ নেকড়েদের সঙ্গে মানুষ থাকবে কেন? ও চলে যাক ওর জাতভাইদের কাছে।
মানুষের বাচ্চাটা এখানে থেকে চলে গিয়ে গ্রামের মানুষগুলোকে লেলিয়ে দেবে আমাদের উপর, দল বেঁধে তারা আক্রমণ করবে আমাদের, শেরখান ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, না, ওকে যেতে দেওয়া হবে না। ওকে আমার কাছে ছেড়ে দাও। ও একটা ঘৃণ্য মানুষ, আমরা কেউ ওর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকতে পারি না।
আকেলা আবার মাথা তুলল, মানুষের বাচ্চাটা আমাদের সঙ্গে উঠেছে, বসেছে, খেয়েছে, ঘুমিয়েছে। আমাদের জন্য শিকার তাড়িয়ে এনেছে। জঙ্গলের কোনো আইন সে ভাঙেনি।
তার জীবনের মূল্য হিসাবে আমিও একটা ষাঁড় দিয়েছিলাম, সেইজন্যই তাকে দলে গ্রহণ করা হয়েছিল, বাঘিরা খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, একটা ষাঁড় এমন কিছু মূল্যবান বস্তু নয়, কিন্তু আমার সম্মানের মূল্য আছে। সেই সম্মান ক্ষুণ্ণ হলে আমাকে বোধ হয় লড়াইতে নামতে হবে।
দশ বছর আগের মরা ষাঁড়! অনেকগুলো নেকড়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, দশ বছরের পুরোনো হাড় দিয়ে আমরা কী করব?
পুরোনো প্রতিশ্রুতির মূল্য তোমাদের কাছে নেই? বাঘিরার কালো মুখে সাদা দাঁতগুলো হিংস্র ক্রোধে আত্মপ্রকাশ করল, তোমাদের স্বাধীন জনগণ বলে কোন্ মূর্খ?
বনের বাসিন্দাদের সঙ্গে মানুষ থাকতে পারে না, শেরখান চিৎকার করে বলল, ওকে আমার মুখে ছেড়ে দাও।
রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও সে আমাদের ভাই, আকেলা বলল, তাকে আজ তোমরা খুন করতে চাইছ? আমি জানি তোমাদের মধ্যে অনেকেই মানুষের পোষা গরু-মোষের মাংস খাও। শেরখানের পরামর্শে কেউ কেউ রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষের কুঁড়েঘর থেকে ছোটো ছেলেমেয়ে তুলে নিয়ে আসে, সেই খবরও আমার কানে এসেছে। আমি জানি তোমরা ভীরু, কাপুরুষ, কিন্তু নেকড়েদের সম্মান আমি বাঁচাতে চাই। মোগলিকে খুন করলে সেটা হবে সমগ্র নেকড়েজাতির পক্ষে লজ্জার বিষয়। তাই আমি প্রস্তাব রাখছি, তোমরা যদি মোগলিকে নিরাপদে চলে যেতে দাও, তাহলে বিনাযুদ্ধেই তোমাদের কবলে আমি মৃত্যুবরণ করব। আমি লড়াই করলে অন্তত তিনজনকে মেরে মরতাম, আমার শর্ত মানলে তিনটি প্রাণ রক্ষা পাবে। আমার প্রস্তাবে রাজি হলে তোমরা ভ্রাতৃহত্যার দায় থেকে মুক্তি পাবে– যে-ভাই কোনো দিন কোনো অন্যায় করেনি, তাকে হত্যা করার নিদারুণ লজ্জা থেকেও তোমরা বাঁচবে।
ও হচ্ছে মানুষ-মানুষ-মানুষ! দন্ত বিস্তার করে গর্জে উঠল নেকড়ের দল। কয়েকটা নেকড়ে শেরখানকে ঘিরে দাঁড়াল। দারুণ উত্তেজনায় ঘন ঘন আন্দোলিত হল শেরখানের দীর্ঘ লাঙ্গুল।
আমরা এখন শুধু লড়াই করতে পারি। আর কিছু করার সাধ্য আমাদের নেই, বাঘিরা বলল, ছোট্ট ভাইটি, এখন তুমি যদি কিছু করতে পার তো কর।
আগুনভরা হাঁড়ি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মোগলি, সে তখন ক্রোধে ক্ষিপ্ত, তোমরা সবাই শোনো। এতক্ষণ ধরে কুকুরের মতন ঘেউ ঘেউ করার দরকার ছিল না। আজ রাতে তোমরা বার বার বলেছ আমি মানুষ। হ্যাঁ, আমিও বুঝতে পারছি তোমরা সত্যি কথাই বলেছ সত্যিই আমি মানুষ। তাই তোমাদের আজ আর ভাই বলে ডাকব না, বলব একপাল নোংরা কুকুর। তোমরা কী করবে, আর কী করবে না- সেটা তোমাদের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে আমার উপর। সমস্ত বিষয়টা ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে আমি লাল ফুল নিয়ে এসেছি, যে লাল ফুলকে তোমরা অর্থাৎ কুকুররা ভয় করো।
মোগলি আগুনভরা হাঁড়ি মাটিতে ফেলে দিল, কয়েকটা জ্বলন্ত কয়লা ছিটকে পড়ল শুকনো ঘাসের উপর, সঙ্গেসঙ্গে দপ করে জ্বলে উঠল আগুন- মন্ত্রণাসভার সদস্যরা অগ্নিশিখার সেই অতর্কিত আবির্ভাবে চমকে উঠে পিছিয়ে গেল।
মোগলি যে লম্বা গাছের ডালটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, সেটা আগুনের মধ্যে ঠেসে ধরল… কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শুকনো ডালের উপর সশব্দে লাফিয়ে উঠল লেলিহান অগ্নিশিখা জ্বলন্ত বৃক্ষশাখা মাথার উপর তুলে ঘোরাতে লাগল মোগলি, সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল নেকড়ের দল।
ধীরে ধীরে সমগ্র নেকড়ের দলটাকে পর্যবেক্ষণ করল মোগলি, তারপর বলল, আমি আজ বুঝতে পারছি তোমরা স্বাধীন জনগণ নও, তোমাদের ওই নাম দেওয়া ঠিক হয়নি তোমরা হলে একপাল কুকুর। আমি তোমাদের কাছ থেকে চলে যাব আমার জাতভাইদের কাছে। জঙ্গলের আস্তানা যখন আমার কাছে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন আমিও তোমাদের কথা ভুলে যাব। তবে তোমরা আমার সঙ্গে যেমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছ, আমি তোমাদের সঙ্গে তেমন ব্যবহার করব না। আমি মানুষের সমাজে যোগ দেব বটে, কিন্তু তাদের নিয়ে তোমাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করব না কখনোই।
সে পায়ের কাছে জ্বলন্ত ঘাসের উপর লাথি মারতেই আগুনের ফুলকি ছিটকে উঠল, নেকড়েদের সঙ্গে আমার বিরোধ নেই। কিন্তু এখানে আমার কিছু ঋণ আছে, যাওয়ার আগে সেই ঋণ আমি শোধ করে যাব।
জ্বলন্ত বৃক্ষশাখা হাতে নিয়ে শেরখানের দিকে অগ্রসর হল মোগলি। হঠাৎ যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাই তাকে অনুসরণ করল সদাসতর্ক বাঘিরা।
.
উঠে দাঁড়াও, মোগলি চেঁচিয়ে উঠল, মানুষ যখন কথা বলে, তখন উঠে দাঁড়াতে হয়… ওঠো বলছি! কথা না শুনলে তোমার চামড়ায় লাল ফুল ফেলে দেব।
শেরখানের কান দুটি চ্যাপটা হয়ে মিশে গেল মাথার খুলির উপর এবং বুজে গেল তার দুই চোখ জ্বলন্ত গাছের ডালটা বড়ো কাছে এসে পড়েছে।
এই গোখাদক কসাইটা আমায় মন্ত্রণাসভার মধ্যেই খুন করতে চাইছে। ওরে ল্যাংড়া –আমরা কুকুরদের কেমন করে ঠ্যাঙাই, দেখে নে। খবরদার! যদি তোর একটা গোঁফও নড়তে দেখি তাহলে এই জ্বলন্ত গাছের ডালটা তোর গলার মধ্যে ঢুকিয়ে দেব- বুঝেছিস ল্যাংড়া?
মোগলি জ্বলন্ত গাছের ডাল দিয়ে শেরখানের মাথায় আঘাত করল, অগ্নিদাহের যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল বাঘ।
ওরে জংলি বেড়াল, তোকে আমি পুড়িয়ে দিয়েছি, এবার পালা এখান থেকে। তোমরা সকলে শুনে রাখ, আবার যেদিন আমি মন্ত্রণাসভার পাথরের উপর এসে দাঁড়াব, সেইদিন আমার মাথার উপর থাকবে শেরখানের চামড়া। আরও একটা কথা জেনে রাখো আলোর উপর কেউ হামলা করলে তাকে আমি শাস্তি দেব। আচ্ছা, এখন আর মন্ত্রণাসভায় তোমাদের থাকা দরকার আছে বলে মনে করি না- জিভ বার করে বসে তোমরা কি নিজেদের মান্যগণ্য মাতব্বর বলে জাহির করতে চাও? তোমাদের আমি কুকুর বলেই মনে করি আর কুকুরের মতোই ব্যবহার করতে চাই তোমাদের সঙ্গে যাও! ভাগো এখান থেকে!
মোগলির হাতে শুকনো ডালের ডগায় তখন আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। সেই জ্বলন্ত ডালটা নিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পিছনে ঘুরে ঘুরে নেকড়ের দলটাকে প্রহার করতে লাগল মোগলি। চিৎকারে বন কাঁপিয়ে নেকড়েরা পালাতে লাগল, তাদের চামড়া ঝলসে গেছে আগুনের ছোঁয়া লেগে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল– অকুস্থলে রইল কেবল আকেলা, বাঘিরা আর দশটি নেকড়ে, যারা মোগলিকে সমর্থন করেছিল।
হঠাৎ একটা যন্ত্রণা অনুভব করল মোগলি, তার শ্বাসকষ্ট হতে লাগল, সে ফোঁপাতে শুরু করল এবং তার দুই চোখ থেকে ঝরতে লাগল জলধারা গাল আর মুখের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল সেই চোখের জল।
এটা কী? মোগলি বাঘিরাকে জিজ্ঞাসা করল, এটা কী ব্যাপার হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমি কি মরে যাচ্ছি?
না, ছোট্ট ভাইটি, বাঘিরা বলল, ওটা হচ্ছে চোখের জল। দুঃখ হলে মানুষের চোখ দিয়ে জল পড়ে। ওটা নিয়ে চিন্তা করো না, ওটাকে পড়তে দাও।
মোগলি অনেকক্ষণ ধরে কাদল; মনে হল তার বুকটা বুঝি ফেটে চুরমার হয়ে যাবে। তারপর শান্ত হয়ে সে বলল, আমি মানুষদের কাছে যাব। কিন্তু তার আগে মায়ের সঙ্গে একবার দেখা করব।
নেকড়েদের গুহায় সে বিদায় নিতে গেল। মা-নেকড়েকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ নীরবে চোখের জল ফেলল সে। তার দুধ-ভাই মা-নেকড়ের চারটি বাচ্চা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তারা সত্যিই ভালোবেসেছিল তাদের মানুষ-ভাইকে।
তোমরা আমাকে ভুলবে না তো? মোগলি জিজ্ঞাসা করল।
কখনোই না, বাচ্চারা সমবেত কণ্ঠে জানাল, তুমি পাহাড়ের তলায় এলেই আমাদের সঙ্গে দেখা হবে। রাত হলে চষা ক্ষেতের উপর আমরা তোমার সঙ্গে খেলা করব।
আবার এসো, বাবা-নেকড়ে বলল, আমি আর তোমার মা বুড়ো হয়েছি, একথাটা মনে রেখো।
হ্যাঁ, আবার এসো, মা-নেকড়ে বলল, খুব বেশি দেরি করো না ফিরে আসতে। আমার ছোট্ট মানুষ-খোকা, তোমাকে আমি আমার বাচ্চাদের চাইতেও বেশি ভালোবাসি।
আমি নিশ্চয়ই আসব, মোগলি বলল, মন্ত্রণাসভার পাথরটার চাতালে শেরখানের চামড়া বিছিয়ে দিতে আমি ফিরে আসব। আমাকে ভুলে যেও না। জঙ্গলের বন্ধুদের বলে দিও তারা যেন আমায় ভুলে না যায়।
…ভোরের আলো যখন ফুটছে, সেইসময় পাহাড় থেকে নেমে জঙ্গল ভেঙে এগিয়ে চলেছে মোগলি, সেই রহস্যময় প্রাণীর আস্তানায় বনের বাসিন্দারা যাকে বলে মানুষ!