মহাজাতি সদনে বিশ্বখ্যাত জাদুকর পি সি সরকারের তাকলাগানো ইন্দ্রজাল দেখতে গিয়েছিলাম। শো ভাঙল রাত দশটা নাগাদ। গেট পেরিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটছি, কেউ সম্ভাষণ করলেন–হ্যাল্লো মিঃ চৌধুরি!
জাদুর ঘোরে তখনও মাথা ভেভো করছে। তা ছাড়া রাস্তায় আলো কম। বললাম–আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না?
-কী আশ্চর্য! এই তো কিছুদিন আগে বোম্বেতে আমার ইন্টারভিউ নিলেন আপনাদের দৈনিক সত্যসেবকের জন্য। ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন।–অবশ্য আপনারা সাংবাদিক। প্রতিদিনই কত রথী মহারথীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়। ইন্টারভিউ নেন। আমি নেহাত এক ছন্নছাড়া ভবঘুরে। তবে আমার স্মৃতিশক্তি অত ঠুনকো নয়। দেখামাত্র চিনতে পেরেছি।
চলমান একটা গাড়ির এক ঝলক আলোয় চোখে পড়ল শক্তসমর্থ গড়নের লোকটি। চিবুকে তেকোনো দাড়ি। পরনে ফিকে লাল শার্ট এবং জিনস। বয়স পঁয়তিরিশ থেকে চল্লিশের মাঝামাঝি। বেশ স্মার্ট চেহারা। ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলে বললাম-থ্যাংকস। আজকাল সিগারেট খেলে বড্ড কাশি হয়। তো আপনাকে
–আশা করি এবার মনে পড়েছে?
–নাহ।
–আমি ইন্দ্রজিৎ রায়। গাল ওয়রের ধাক্কায় বাগদাদ থেকে জর্ডন হয়ে প্রথম যে ইন্ডিয়ান টিমটি দেশে ফিরেছিল, তাদের লিডার ছিলাম আমি। এই বঙ্গসন্তান। এবার পড়েছে?
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। দৈনিক সত্যসেবকে খুব ফলাও করে ছাপা হয়েছিল ইন্দ্রজিৎ রায়ের বিবরণ। মরুভূমি পেরিয়ে পালিয়ে আসা দলটির নেতৃত্বে ছিলেন একজন বাঙালি। বড় রোমাঞ্চকর সেই অভিযান। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকারা পাঠকরা খুব খেয়েছিল প্রতিবেদনের সাক্ষাৎকারটি। বলা উচিত, খানিকটা রঙ চড়িয়েই লিখেছিলাম। ইন্দ্রজিৎ রায় অবশ্য কতটা রঙ চড়িয়ে ছিলেন, বলা কঠিন। কয়েকটা ফোটোও দিয়েছিলেন মরুভূমি আর ট্যাংকবাহিনীর। তবে মোদ্দা কথাটা হল আমাদের কাগজের চড়া বাঙালিয়ানা। কর্তৃপক্ষ আমাকে বোম্বে পাঠিয়েছিলেন। ঝটপট হ্যান্ডসেক করে সহাস্যে বললাম–সরি মিঃ রায়! আসলে ইন্দ্রজাল দেখে বোধবুদ্ধি ঘুলিয়ে গিয়েছিল আর কি! আপনি বোম্বে থেকে কবে এলেন?
ইন্দ্রজিৎ বললেন–গতকাল। দিন দুয়ের জন্য এসেছিলাম। আগামীকাল মর্নিংফ্লাইটে ফিরে যাব। গালফ ওয়র তো চুপসে গেছে। আবার আরব মুল্লুকে পাড়ি জমাতে হবে। তবে বাগদাদে যাওয়া আর আপাতত সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। অথচ দেখুন, আমার সর্বস্ব সেখানেই রয়ে গেছে। দেখা যাক্।
গাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বললাম-কলকাতায় উঠেছেন কোথায়?
–এন্টালি এরিয়ার আমার এক আত্মীয় থাকেন। বৃদ্ধ মানুষ। বিশাল বাড়িতে যখ হয়ে পাহারা দিচ্ছেন। ইন্দ্রজিৎ একচোট হাসলেন।-হানাবাড়ি মশাই! সম্পর্কে আমার জ্যাঠামশাই হন। ছেলেরা সব য়ুরোপ-আমেরিকায় সে করেছে। মেয়েরা দিল্লি বোম্বে-বাঙ্গালোরে স্বামীদের ঘরকন্না করছে। যাক্ গে ও সব ফালতু কথা। ম্যাজিক কেমন দেখলেন বলুন?
অসাধারণ।
–হ্যাঁ। তবে জুনিয়র সরকারের ওই কথাটা আমার বড্ড মনে ধরেছে। আজ যা ম্যাজিক, কাল তা সায়েন্স। দারুণ বলেছেন না? সত্যি বলতে কী, এই প্রথম ওঁর ম্যাজিক দেখার চান্স পেলাম। জ্যাঠামশাই বলছিলেন, কলকাতা নাকি ভূতের শহর হয়ে যাচ্ছে। কে জানে! দশ-বারো বছর পরে ফিরে এসে আমারও বড্ড খারাপ লাগছিল জানেন? কিন্তু ইন্দ্রজাল দেখার পর মনে হল, কলকাতা সত্যিই একটা জাদুনগরী।
ইন্দ্রজিৎ রায়ের কথাবার্তার ঢঙটি চমৎকার। মিঠে অন্তরঙ্গ হাবভাব আকৃষ্ট করে। বোম্বেতে ওঁকে কেন যেন বাঁচাল মনে হয়েছিল। তবে তখন ওর ভূমিকা নিউজভ্যালুর দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই নিছক ব্যক্তি হিসেবে ওঁকে বিচার করার সুযোগ ছিল না। এতদিন পরে কলকাতায় শেষ মার্চের এক রাত্রে, ভদ্রলোককে ব্যক্তিগতভাবে জানার খেয়াল চাপল। নিজেকে ছন্নছাড়া ভবঘুরে বললেন এবং আরব্যরজনীর সেই রহস্যময় বাগদাদ শহরে ছিলেন। সব মিলিয়ে ওঁর প্রতি একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছিলাম। বললাম–চলুন মিঃ রায়। আপনাকে পৌঁছে দিই!
ইন্দ্রজিৎ কি তা-ই চাইছিলেন? অবশ্য এ কথাটা অনেক পরে মনে হয়েছিল। আসলে কোনও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আগেকার বহু ছোটখাটো ঘটনা চোখের সামনে বড় হয়ে আসে। ধরা পড়ে কতগুলো পারম্পর্য। যাই হোক, উনি ঝটপট আমার গাড়িতে ঢুকে পড়লেন। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কিছুটা এগিয়েছি, তখন বললেন–আপনি নিশ্চয় সাউথে, নাকি এন্টালি এরিয়ায় থাকেন?
–না। সল্ট লেকে।
–কী সর্বনাশ! তা হলে মিছিমিছি আপনাকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া ফুয়েলের যা দাম এখন!
–ও কিছু নয়। আমার বরং সুবিধেই হল। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে ইস্টার্ন বাইপাস ধরব। জ্যাম থেকে বাঁচা যাবে।
ইন্দ্রজিৎ হাসলেন। কলকাতার জ্যামের চরিত্রই আলাদা। বিদেশের বেশ কিছু বড় শহরে আমি গেছি। জ্যাম হয়। তবে তা এমন বিশৃঙ্খল নয়।
-বাগদাদে জ্যাম হয় না?
–হয়। আফটার অল প্রাচ্যের শহর। বিশৃঙ্খলা আছে। কিন্তু আইন খুব কড়া।
–আপনি কী করে বাগদাদ গেলেন জানতে ইচ্ছে করছে।
ইন্দ্রজিৎ একটু চুপ করে থেকে আস্তে শ্বাস ছেড়ে বললেন–দৈবাৎ একটা চান্স পেয়েছিলাম। আমার কমার্সের একটা ডিগ্রি ছিল। বোম্বেতে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম ইরাকে কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল। তাদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে বাগদাদে গিয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ কিছুকালের জন্য বাহারিনের রাজধানী মানামায় বদলি করেছিল। কোথায় ইরাক, কোথায় বাহারিন! ইরাক মশাই মর্ডানাইজড দেশ। আর বাহারিন কট্টর শেখদের রাজত্ব। একদিকে চূড়ান্ত ঐশ্বর্য, অন্যদিকে চূড়ান্ত দারিদ্র। জানেন তো? বাহারিন শুধু তেলের দেশ নয়, মুক্তোরও দেশ। পৃথিবীর সেরা মুক্তো পাওয়া যায় ওখানে। মুক্তো আর প্রবাল। সমুদ্রের খাড়িতে অঢেল ন্যাচারাল পার্ল পাওয়া যায়।
আপনি বাগদাদের কথা বলুন। আরব্যরজনীর সেই বাগদাদ এখন কেমন হয়েছে?
ইন্দ্রজিৎ একচোট হেসে বললেন–সেই বাগদাদ কোথায়? এখন একেবারে আধুনিক শহর। মধ্য দিয়ে তাইগ্রিস বয়ে যাচ্ছে। হাজার বছর আগে বাগদাদ ছিল তাইগ্রিসের পূর্ব তীরে।
আচ্ছা মিঃ রায়, বাগদাদের মেয়েরা দেখতে খুব সুন্দর না?
–বুঝতে পারছি, অ্যারাবিয়ান নাইটস আপনাকে হন্ট করছে। মিঃ চৌধুরি, ক্যালকাটান নাইটসের মধ্যে আমি কিন্তু অ্যারাবিয়ান নাইটসকে ফিরতে দেখেছি। আগে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি, যখন কলকাতায় ছিলাম। দশবছর পরে ফিরে এসে এই বোধটা জেগেছে। রাতের কলকাতায় চেয়ে রহস্যময় শহর কোথাও নেই।
কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলাম, যতবার আমি ওঁকে বাগদাদের গল্প করতে বলছি, উনি পাশ কাটিয়ে কলকাতাকে এনে ফেলেছেন। তাই চুপ করে থাকলাম।
মৌলালি সি আই টি রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে উনি একখানে হঠাৎ বললেন–ব্যস! এখানেই নামিয়ে দিন। ডানদিকে মাত্র কয়েক মিনিট হাঁটলে আমার সেই জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আচ্ছা, চলি। নমস্কার!
কিন্তু ইন্দ্রজিৎ রায় গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে নামলেন না। উইন্ডোর কাঁচ নামিয়ে উঁকি মেরে এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে বললেন কলকাতাকে রহস্যনগরী বলছিলাম। তার একটা কারণ লোডশেডিং। সঙ্গে টর্চ নিয়ে বেরুনো উচিত ছিল। মিঃ চৌধুরি, যদি কিছু মনে না করেন, কাইন্ডলি আর মাত্র একটুখানি পথ–ওই গলি রাস্তায় গাড়ি ঢোকার অসুবিধে নেই। আসলে গলিটা যেমন নির্জন আর অন্ধকার, বাড়িটাও তেমনি ভূতুড়ে। যদি প্লিজ
হেঁ হেঁ করে অদ্ভুত হাসলেন ইন্দ্রজিৎ। বললাম-না, না। কোনও দ্বিধার কারণ নেই।
গাড়ির সামনের ক্রসিং দিয়ে আইল্যান্ডের ওপারে নিয়ে গেলাম। বাঁদিকে একটা গলিরাস্তা। হেড-লাইটে দুধারে জরাজীর্ণ পুরনো বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। একটু এগিয়ে বাঁক নিয়েছে গলিটা। বাঁকের মুখে বনেদি একটা বাড়ির গেট। ভেতরে বাগান-টাগান আছে। ইন্দ্রজিৎ বললেন–এই যে। এসে গেছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মিঃ চৌধুরি।
বলে চড়া গলায় ডাকলেন–মধু! মধু!
গেট খুলে মধ্যবয়সি একজন লোক বেরুল। তার হাতে একটা টর্চ। ইন্দ্রজিৎ গাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি ঢুকে গেলেন। মধু বলল–গাড়ি ঘোরানোর জায়গা আছে স্যার! ওই দেখুন! টর্চের আলোয় সামনে একটুখানি পোড়ো জমি দেখা গেল। সেখানে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার সি আই টি রোডে পৌঁছলাম। যেতে যেতে একবার মনে হল, ইন্দ্রজিৎ রায় কি কোন কারণে হঠাৎ ভয় পেয়েছেন? ভয়টা কি এই অন্ধকার গলিটার জন্য? তাছাড়া গাড়ি থেকে নেমেই বিনা সম্ভাষণে অন্তর্ধান!
কিন্তু এ নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে হয় না। আগামীকাল দুপুরে প্রেস ক্লাবে দলত্যাগী এক রাজনৈতিক নেতা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছেন। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ, কভারেজ দিতে হবে কাগজে। তবে ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধাঁচে। আজকাল রাজনীতিতে এমন সব লোক এসে জুটেছে, যাদের পাত্তা দেওয়াই বিপদ, না দেওয়াও বিপদ। কে কখন পাওয়ারে যাবে, কাগজের অর্থনৈতিক মানদণ্ড তার সঙ্গে বাঁধা।
সল্টলেকের ফ্ল্যাটে ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেল। খেয়েদেয়ে গড়াতে যাচ্ছি, টেলিফোন বাজল। এ মুহূর্তে টেলিফোনের শব্দ বিরক্তিকর। অভ্যাসমতো ফোন তুলে বললাম–রং নাম্বার।
–রাইট নাম্বার, ডার্লিং?
এ পৃথিবীতে সস্নেহে নারীপুরুষ নির্বিচারে ডার্লিং সম্ভাষণ করতে মানুষ একজনই আছেন। তিনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। দ্রুত বললাম–সর্বনাশ!
–কারও সর্বনাশ কারও পৌষ মাস বলে একটা অনবদ্য প্রবচন আছে, জয়ন্ত। হা–পৌষ মাসটা তোমারই। সর্বনাশটা অবশ্য অন্যের।
ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করুন প্লিজ! এত রাত্রে ফোন মানেই
–মানেই সর্বনাশ! যাই হোক, কাল সকাল আটটায় চলে এস। তোমার কাগজের জন্য একটা এক্সক্লুসিভ স্টোরি পেয়ে যাবে।
-কিসের স্টোরি?
–এখন যার বাজারদর তুঙ্গে। মানে, খবরের কাগজের বাজারের কথা বলছি।
–ইলেকশন সংক্রান্ত তা হলে!
নাহ। সকাল আটটায় অবশ্যই এসো। নৈলে পস্তাবে।
–হাই ওল্ড বস! জাস্ট একটু হিন্ট না দিলে ঘুম আসবে না।
কর্নেলের চাপা হাসি শোনা গেল।
–ডার্লিং! তুমি যার লেজটা ধরেছিলে, তারই মাথাটা এবার ধরতে পারবে।
–ওঃ কর্নেল! প্লিজ নো হেঁয়ালি।
–আহা, বললাম তো! এনিওয়ে ছাড়ছি। হ্যাভ আ নাইস স্লিপ। গুডনাইট।
কর্নেল ফোন ছেড়ে দিলেন। অবশ্য এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। রহস্যভেদী বৃদ্ধ নিশ্চয় কোনও জমজমাট রহস্য হাতে পেয়েছেন। কিন্তু আমি তার লেজ ধরেছিলাম মানে?
বিছানায় শুলাম বটে, ব্যাপারটা মাথার ভেতর মাছির মতো ভনভন করতে লাগল। অগত্যা আমার প্রিয় লেখক জর্জ সিমনের গোয়েন্দা অমনিবাস পড়তে মন দিলাম টেবিলবাতির আলোয়।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল প্রায় পৌনে আটটায়। কর্নেলের কথা মনে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ঝটপট বাথরুম সেরে যেমনতেমন একটা ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে। ঘড়িতে তখন আটটা দশ বাজে। ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুলাম সাড়ে আটটায়। আধঘণ্টা দেরি করে ফেলেছি। যে গতিতে গাড়ি চালিয়ে এসেছি, দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।
ঘণ্টা বাজতেই ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে মুচকি হেসে চাপা গলায় বলল–বাবামশাইয়ের কাছে কে যেন এয়েছে দাদাবাবু! কেমন যেন চেহারা। ফকিরবাদের মতো নকশা ডেরেস। মাথায় কাপড়ের সঙ্গে দড়ি বাঁধা।
ড্রয়িং রুমে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। সোফায় বসে আছেন দুজন ভদ্রলোক। তাদের একজন আরব–সেটা পোশাকেই বোঝা যাচ্ছে। বাঁকা বাজপাখি নাক। চিবুকে দাড়ি। অন্য ভদ্রলোককে বাঙালি বলে মনে হল। বেঁটে গাব্দাগোব্দা চেহারা। পরনে টাই-স্যুট।
কর্নেল ইংরেজিতে আলাপ করিয়ে দিলেন–শেখ জুবাইর আল-সাবা। বাহারিন থেকে এসেছেন। আর ইনি মিঃ হরনাথ চন্দ্র। প্রখ্যাত জুয়েলার চন্দ্র ব্রাদার্সের অন্যতম স্বত্বাধিকারী। জয়ন্তের কথা তো আপনাদের আগেই বলেছি। বসো, জয়ন্ত!
শেখ সায়েব তার মাতৃভাষায় কী স্বগতোক্তি করে একটা ব্রিফ কেস খুললেন। তারপর একটা ফোটো বের করলেন। হরনাথবাবু তার হাত থেকে সেটা নিয়ে আমাকে দিলেন। বললেন–দেখুন তো জয়ন্তবাবু, একে চিনতে পারেন নাকি?
ফোটো দেখে আমি একটু অবাক হয়ে বললাম–হ্যাঁ। চিনি। কিন্তু
হরনাথবাবু মুচকি হেসে বললেন–আপনাদের কাগজে এই লোকটার ছবি বেরিয়েছিল। এই দেখুন! বলে উনি ভাঁজ করে রাখা দৈনিক সত্যসেবকের পাতা খুললেন। আরও অবাক হয়ে বললাম–হ্যাঁ। ইন্দ্রজিৎ রায়। কিন্তু ব্যাপারটা কী বলুন তো?
হরনাথবাবু বললেন–এই লোকটা বাহারিনের মানামা শহরে শেখ সায়েবের জুয়েলারি কোম্পানির প্রায় দশ লাখ ডলারের দামের মুক্তো চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিল। শেখ সায়েবের সঙ্গে আমার বহু বছরের কারবার। এদিকে লোকটাও বাঙালি। তাই শেখ সায়েব কলকাতায় এসেছেন গতকাল। কথায় কথায় হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সত্যসেবক পত্রিকায় আরব মুল্লুক থেকে পালিয়ে আসা লোকজনের ছবি আর খবর বেরিয়েছিল। তবে আপনি বললেন, লোকটার নাম ইন্দ্রজিৎ রায়। না জয়ন্তবাবু! ওর নাম শংকর হাজরা। তবে সে-ও আসল নাম কি না বলা যায়। তবে শংকর হাজরা নামেই শেখ সায়েবের কোম্পানিতে ঢুকেছিল।
শেখ জুবাইর আল-সাবা মাতৃভাষায় কী একটা বলে চাপা হুঙ্কার দিলেন।
রত্নব্যবসায়ী হরনাথ চন্দ্রের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। কর্নেল একটু হেসে বললেন-এ কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুলো বলে একটা কথা আছে। কাজেই জয়ন্তের পক্ষে অবাক হওয়া স্বাভাবিক। ওর কাগজে যাকে হিরো করেছিল, সে এখন ভিলেন। ধাক্কাটা সামলানো কঠিন।
উত্তেজনায় নড়ে উঠলাম এবার। বললাম–কাল রাতে ইন্দ্রজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।
হরনাথ বললেন–কোথায়? কোথায়?
–মহাজাতি সদনে জুনিয়র পি সি সরকারের ইন্দ্রজাল দেখে ফেরার সময়। তাকে আমি আমার গাড়ি করে এন্টালি এলাকায় একটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছি। আজ মর্নিং ফ্লাইটে তার বোম্বে ফিরে যাওয়ার কথা আছে।
বোম্বে ফ্লাইট? হরনাথ ঘড়ি দেখে হতাশ মুখে বললেন–তা হলে পাখি উড়ে গেছে।
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম–ওই বাড়িতে গেলে তার বোম্বের ঠিকানা পাওয়া যেতেও পারে। তার এক জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি ওটা। বলে কাল রাতে যা ঘটেছিল, তার বিবরণ দিলাম।
হরনাথ ইংরেজিতে শেখ সাহেবকে কথাগুলো বলতেই উনিও উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁত কিড়মিড় করে গর্জালেন–গিশ! সারিক! কনাব!
বুঝলাম, আরবি ভাষায় মুণ্ডপাত করছেন ইন্দ্রজিৎ রায় ওরফে শংকর হাজরার। বললাম–কর্নেল! আপনিও সঙ্গে চলুন।
হরনাথও বললেন–প্লিজ কর্নেল! আমি তো আপনারই সাহায্য নিতে যোগাযোগ করেছিলাম। জয়ন্তবাবুর সঙ্গে আপনার পরিচয়ের কথা জানতাম না। আপনি সেবার আমার হারানো হিরের নেকলেস উদ্ধার করে দিয়েছিলেন। সেই ঋণ জীবনে শোধ হওয়ার নয়। তবে এবারকার এই কেস আমার আরব বন্ধুর হলেও আপনার সাহায্য চাইছি। ইনি বাংলা বোঝেন না বলেই এভাবে বলছি, ইনি বড্ড জেদি মানুষ। এঁদের দেশের লোকের স্বভাবচরিত্র অন্যরকম। উল্টো বুঝে ওই অঞ্চলে আমার কারবারি যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারেন। বিশেষ করে ওখানকার শাসকপরিবারের দূরসম্পর্কের আত্মীয় উনি। খুব প্রভাবশালী লোক।
শেখ সাহেব ইংরেজিতে বললেন–আমার বন্ধু মিঃ চন্দ্র বলেছে, আপনি ফি নেন না। আপনি যোদ্ধা ছিলেন। যোদ্ধাদের প্রতি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধা আছে। আমরা আরবরা যোদ্ধার জাত। তবে বাণিজ্য আর যুদ্ধের সম্পর্ক আছে।
কর্নেল হাসলেন। ধন্যবাদ! বলে হরনাথের উদ্দেশে বাংলায় বললেন–এক। মিনিট মিঃ চন্দ্র। দমদম এয়ারপোর্টে আমার স্নেহভাজন এক অফিসার আছেন। আগে জেনে নিই, ইন্দ্রজিৎ রায় বোম্বে ফ্লাইটের যাত্রী-তালিকায় কেউ আছে কি না।
কর্নেল টেলিফোন ডায়াল করতে ব্যস্ত হলেন। আমরা দাঁড়িয়েই রইলাম। আমার তর সইছিল না। একটু পরে কর্নেল চাপা স্বরে তার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। একটা কথা কানে এল–একা এবং বাঙালি নামের কেউ… উনি ফোন কানে রেখে আমাদের দিকে ঘুরে ফের বললেন–এক মিনিট!
কিছুক্ষণ পরে সাড়া দিলেন।–হ্যাঁ….আচ্ছা। ঠিক আছে। থ্যাংকস্ ডার্লিং। না, তেমন কিছু নয়। রাখছি।
হরনাথ বললেন–ইন্দ্রজিৎ রায়ের নাম আছে লিস্টে?
-নাহ। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন।–সিঙ্গল সিটের যাত্রীদের নামে কোনও কমন বাঙালি নাম নেই। তবে বলা কঠিন। নিছক নাম দেখে কেউ বাঙালি কি না জানা অসম্ভব। আসলে আমি জানতে চাইছিলাম ইন্দ্রজিৎ রায় নামটা লিস্টে আছে কি না। কিংবা নামের আদ্যাক্ষর আই এবং পদবি রায় আছে কি না। নেই।
বললাম-তা হলে ছদ্মনামে গেছে।
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–যাই হোক। মিঃ চন্দ্র, আপনি আর শেখ সায়েব এখানে অপেক্ষা করুন। জয়ন্ত একা যা ওই বাড়িতে। আপনি এবং বিশেষ করে শেখ সায়েব গেলে আপনাদের দেখে প্রতিবেশীদের কৌতূহল জাগতে পারে। সেই জ্যাঠামশাই ভদ্রলোকও ভড়কে যেতে পারেন। গত রাতে জয়ন্ত ইন্দ্রজিৎ রায়কে পৌঁছে দিয়েছে। মধু নামে যে লোকটির কথা বলল, সে ওকে চিনতে পারবে। কাজেই জয়ন্তের একা যাওয়াই উচিত। চিয়ার আপ জয়ন্ত! এটা তোমারই কেস কিন্তু। তোমারই হিরো ইন্দ্রজিৎ রায়। তুমিই কাগজে তার কথা লিখেছিলে তার জ্যাঠামশাই নিশ্চয় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার পাঠক। আঞ্চলিক ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক।
কর্নেল স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হাসলেন। হরনাথ বললেন–ঠিক ঠিক। আপনিই যান জয়ন্তবাবু! কর্নেলের কথায় যুক্তি আছে। আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।
উনি শেষ সায়েবকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন ইংরেজিতে। শেখ সায়েব মাতৃভাষায় বলে উঠলেন–নামা! নামা! মাসা! মাসা! যেতে আপত্তি করছেন ভেবে ইতস্ততঃ করছিলাম। শেখ সায়েব বললেন–দ্যাটস রাইট। গো! গো!
একা যেতে অস্বস্তি হচ্ছিল বটে, কিন্তু আমার কাগজের পক্ষে একটা অসাধারণ স্কুপ নিউজ এটা। কারণ ইন্দ্রজিৎ রায়ের খবর দেশের বড়-বড় ইংরেজি কাগজেও বেরিয়েছিল, যদিও আমার স্টোরিটা ছিল সাক্ষাৎকার ভিত্তিক এবং এক্সক্লসিভ বলা হয় যাকে। এবার হিরোকে ভিলেন বানিয়ে চমকে দেবার চান্স এসে গেছে হাতে।
অন্ধকার রাতের লোডশেডিংয়ে দেখা জায়গাটা দিনের আলোয় খুঁজে বের করতে সময় লাগল। দুবার দুটো গলিরাস্তায় ঢুকে হন্যে হলাম। তৃতীয়বার সেই গলিরাস্তাটা খুঁজে পাওয়া গেল। বাঁদিকে বাঁকে মুখেই পুরনো বিশাল বাড়ি, সামনে গেট এবং ভেতরটা দেখেছি। এই গলিটাই বটে।
কিন্তু গলিতে ঢুকতে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। মুখে-মুখে উত্তেজনা। এবং পুলিশ।
একদঙ্গল ছেলেছোকরা আমার গাড়ির কাছে এসে বলল–গাড়ি যাবে না দাদু! গাড়ি ব্যাক করুন।
মুখ বাড়িয়ে বললাম–কী হয়েছে? এত লোক কেন?
-একটা বডি পড়েছে দাদু!
–বডি পুড়েছে তার মানে?
ওরা দাঁত বের করে হেসে অস্থির হল। একজন একটু ভদ্রভাবে বলল–সুইসাইড কেস স্যার! ওই যে বিল্ডিং দেখছেন। ওই বিল্ডিংয়ের দোতলায় বাথরুমে একটা লোক সুইসাইড করেছে। পাড়ার লোক নয় স্যার, আউটসাইডার।
চমকে উঠে বললাম–ওই গেটওলা বাড়িটায় নাকি?
-হ্যাঁ স্যার!
গাড়ি ব্যাক করে বড় রাস্তায় গেলাম। তারপর গাড়ি পার্ক করে চাবি এঁটে গলিতে ফিরে এলাম। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি, অ্যাম্বুলেন্সে লাশটা সবে ঢোকানো হচ্ছে। চাদরে ঢাকা। পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে ভিড় হটাচ্ছে। একজন পুলিশ অফিসারকে আমার আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে বললাম–কে সুইসাইড করেছে?
অফিসার হাসলেন।–আপনারা কাগজের লোকেরা কি মশাই বাতাসে গন্ধ শুঁকে টের পান? তবে অফিসিয়ালি আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।
–আমি শুধু নামটা জানতে চাইছি।
–কে এক ইন্দ্রজিৎ রায়। শুধু এটুকুই বলতে পারি।
–ইন্দ্রজিৎ রায় সুইসাইড করেছেন? আমার গলা কেঁপে গেল কথাটা বলতে। অফিসার ভুরু কুঁচকে তাকালেন।–চিনতেন?
নামটা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন শুনেছি। মানে, আমরা নিউজম্যান। কাজেই
তা আপনি মশাই খবর পেলেন কী করে? অফিসারের কণ্ঠস্বরে সন্দিগ্ধতার সুর শোনা গেল।
দ্রুত বললাম মেইন রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম। এই গলিতে ভিড় দেখে চলে এলাম। আমি নিউজম্যান। বলে হাসবার চেষ্টা করলাম। জানেন তো? লজ্জা ঘেন্না ভয়, এই তিন থাকতে নয় আমাদের বেলায় যতটা খাটে অন্যত্র নয়।
অফিসার অদ্ভুত হেসে বললেন-নেহাত সুইসাইড কেস মশাই! লোকটা নাকি বাউণ্ডুলে প্রকৃতির ছিল। আউট অব ফ্রাস্ট্রেশন গলায় দড়ি বেঁধে বাথরুমে ঝুলে পড়েছে। এ কোনও নিউজ নয়। রোজই একটা না একটা হচ্ছে। নানারকম টেনশন, ঝগড়াঝাটি, চূড়ান্ত হতাশা অ্যান্ড সো অন।
উনি জিপে গিয়ে বসলেন। কাছে গিয়ে বললাম–একটা কথা। কোনও সুইসাইডাল নোট পাওয়া যায়নি?
-পরে লালবাজারে যোগাযোগ করবেন। যা জানাবার ওরাই জানাবে।
জিপ এবং অ্যাম্বুলেন্স চলে গেল। গেট বন্ধ। একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলাম। কর্নেলের বাড়ির দিকে যখন ফিরে চলেছি, তখন মাথার ভেতরটা খালি লাগছে। কাল রাতের দৃশ্যগুলো ভেসে এসে আবার দূরে সরে যাচ্ছে। কাল রাতে ইন্দ্রজিৎ কেন যেন ভয় পেয়েছেন মনে হয়েছিল। কিন্তু সুইসাইড করে বসলেন কেন? রাতেই কি কিছু ঘটেছিল? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, গাড়িতে বসে থেকেই মধুকে ডাকছিলেন এবং মধু বেরুনোমাত্র গাড়ি থেকে বেরিয়ে সটান ঢুকে গেলেন বাড়ির ভেতরে। বিদায় সম্ভাষণ করার স্বাভাবিক ভদ্রতাটুকুও দেখালেন না!
এতক্ষণে মনে হচ্ছে, কেউ বা কারা কি ওঁকে অনুসরণ করছিল মহাজাতি সদন থেকে? কিন্তু তারপর সুইসাইডের ঘটনা কেমন যেন খাপছাড়া।
কর্নেলের ড্রয়িং রুমে ঢুকে ধপাস করে বসে পড়লাম। হরনাথ ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন–বোম্বের ঠিকানা জোগাড় করতে পারলেন?
–গতরাতে ইন্দ্রজিৎ রায় সুইসাইড করেছে।
–সুইসাইড? বলেন কী? সর্বনাশ!
–হা পুলিশ এইমাত্র বডি নিয়ে গেল।
কর্নেল আস্তে বললেন–কী ভাবে সুইসাইড করেছে?
-জানি না। বাথরুমে নাকি বডি পাওয়া গেছে। পুলিশ ডিটেলস কিছু বলতে চাইল না। আমি গিয়ে দেখি গলিতে ভিড়। অ্যাম্বুলেন্সে কাপড়ে ঢাকা বডি ঢোকানো হচ্ছে।
–তুমি বাড়িতে ঢুকেছিলে? মধুকে মিট করেছ?
–পুলিশ চলে গেলে গেট বন্ধ হয়ে গেল।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথা বলোনি?
-নাহ্। আমি ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছিলাম।
–আশ্চর্য! ইন্দ্রজিতের জ্যাঠামশাইয়ের নাম জেনেছ?
–নাহ। বলছি তো! আমি ভীষণ আপসেট।
কর্নেল হাসলেন।–সাংবাদিক হিসেবে তুমি একেবারে অযোগ্য। তুমি ঘটনাস্থলে গেলে। কিন্তু কার বাড়ি, এটুকুও জেনে এলে না। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে কথা বললে না। আপসেট হয়ে ফিলে এলে! আশ্চর্য!
বিরক্ত হয়ে বললাম–পাড়ার ছেলেরা বলল কি এক আউটসাইডার। তারা চেনে না।
হরনাথ ইতিমধ্যে শেখসায়েবকে ঘটনাটা জানিয়ে দিয়েছেন। শেখসায়েব মাতৃভাষায় বিড়বিড় করে কী সব বলছেন। চোখেমুখে আগুন জ্বলছে। দুটো শব্দ কানে আসছিল-লুলু! লুলু!
হরনাথ কর্নেলকে বললেন-শেখসায়েব বলছেন ওঁর লুলু অর্থাৎ মুক্তোগুলো নিশ্চয় ওই বাড়িতে পাওয়া যাবে। কর্নেল! প্লিজ আপনি পুলিশকে এবার বলে দিন ঘটনাটা। শেখসায়েবকে নিয়ে আমি তাহলে এন্টালি থানায় গিয়ে কেস ডায়রি লেখানোর ব্যবস্থা করি। কারণ এখন আসামির খোঁজ পাওয়া গেছে, যদিও সে ডেড। তার চেয়ে বড় কথা, শেখসায়েবকে দিয়ে বডি শনাক্ত করানোও দরকার।
কর্নেল চোখ বুজে দাড়ি টানছিলেন। বললেন–তার আগে আপনার বন্ধু শেখসায়েবের মতামত জেনে নিন মিঃ চন্দ্র! ওঁর কথায় আঁচ করেছি, উনি পুলিশকে এড়িয়ে চুরি যাওয়া মুক্তো উদ্ধার করতে এসেছেন।
–তা ঠিক। কারণ কেসটা গভর্নমেন্টের হাতে পড়লে মাল ফেরত পেতে অনেক ঝুটঝামেলা হবে। ফাইল চালাচালি আর ডিপ্লোম্যাটিক লেবেলে যোগাযোগ এ সব মস্ত ব্যাপার তা তো জানেন! এতে অনেক বেশি সময় লেগে যাবে। এদিকে ওঁর ব্যবসারও ক্ষতি হবে। গালফ ওয়রের ক্রাইসিস এখনও তো মেটেনি। এ সব কারণেই উনি পুলিশকে এড়িয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে।
–হুঁ! তবু ওঁর মত জেনে নিন।
হরনাথ ইংরেজিতে শেখসায়েবকে কথাটা বললেন। অমনি শেখসায়েব দুহাত নেড়ে বলে উঠলেন–লা! লা! নো! নো! আই ডোন্ট লাইক দা পোলিস্। এভরিহোয়্যার ইন দা ওয়র্ল্ড ট্রাবল। লা! লা! আই লাইক দা প্রাইভেট আই!
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–উনি প্রাইভেট আই অর্থাৎ বেসরকারি গোয়েন্দার সাহায্য চান। তবে দুঃখের কথা, আমি তো পেশাদার প্রাইভেট ডিটেকডিভ নই–সে আপনি ভালই জানেন বরং ডিটেকটিভ কথাটা আমি অত্যন্ত পছন্দ করি। কারণ টিকটিকি তারই বাংলা সংস্করণ। তবে হ্যাঁ, রহস্যের প্রতি আমার আকর্ষণ আছে।
-এই কেসে রহস্য আছে কর্নেল!
–আছে। কারণ আপনার বন্ধু পুলিশের কাছে যেতে চান না। হরনাথ হতাশ মুখে বললেন–কিন্তু ওঁকে সাহায্য না করলে আমার কারবারের ক্ষতি হবে।
বরং আপনাকে একজন বিচক্ষণ প্রাইভেট ডিটেকটিভের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার কে কে হালদার। গণেশ অ্যাভেনিউতে ওঁর ডিটেকটিভ এজেন্সি। এখনই চলে যান। আমি ফোনে বলে দিচ্ছি। ওঁর ঠিকানাটা লিখে দিচ্ছি। কর্নেল কিছুক্ষণ টেলিফোন ডায়াল করে বললেন–পাচ্ছি না। ঠিকানা দিচ্ছি। এখনই চলে যান।
ঠিকানা নিয়ে হরনাথ চন্দ্র এবং শেখ জুবাইল আল-সাবাহ হন্তদন্ত বেরিয়ে গেলেন। বললাম–হালদার-মশাইকে এই সাংঘাতিক কেস দিলেন? কেলেংকারি হয়ে যাবে কিন্তু। উনি যা হঠকারী মানুষ!
কর্নেল হঠাৎ গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন–বসো। আরেক পেয়ালা কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করো। তারপর আমরা বেরুব। ইন্দ্রজিৎ রায় ওরফে শংকর হাজরার সুইসাইড করার ব্যাপারটা আমার গোলমেলে মনে হচ্ছে।