১. মন্দিরের বাঘ
০১.
হিমালয়ের উচ্চভূমিতে যাঁরা কখনো বসবাস করেন নি, তাঁদের পক্ষে এই বিরল জনবসতির বাসিন্দাদের ওপর কুসংস্কারের প্রভাব সম্পর্কে অবগতি অসম্ভব। সুউচ্চ পাহাড়ী অঞ্চলের সরল অশিক্ষিত মানুষের কুসংস্কার এবং নিম্নভূমির মার্জিত শিক্ষিত জনের বিশ্বাসের ভেদরেখা এতই সূক্ষ্ম যে একের প্রারম্ভ ও অন্যের সমাপ্তির চিহ্নিতকরণ কঠিন। এই কারণেই বর্তমানে আমি যে কাহিনীর অবতারণা করছি, তার চরিত্রদের সারল্যে আপনাদের হাসি পেতে পারে, কিন্তু আমার বক্তব্য, এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে, আমার গল্পে উল্লেখিত কুসংস্কার এবং আপনাদের সংস্কারে বিশ্বাসের মধ্যেকার তফাতটি বুঝতে চেষ্টা করুন।
কাইজারের যুদ্ধের সামান্যকাল পরেই রবার্ট বেলেআর্স আর আমি কুমায়ুনের অভ্যন্তরে শিকার করতে যাই এবং সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় ত্রিশুলের পাদদেশে তাঁবু ফেলি; এসে জানলাম, এখানে প্রত্যেক বছর ত্রিশুলের দৈত্যের উদ্দেশে আট শত ছাগল উৎসর্গ করা হয়। আমাদের সঙ্গে আছে পনর জন কুশলী ও খুশিমনের পাহাড়ী যুবক, যাদের তুল্য খুব কম মানুষের সঙ্গই আমি শিকারকালে পেয়েছি। এদের মধ্যে একজনের নাম বালা সিং, জাতে গাড়োয়ালী, অনেক বছর ধরেই সে আমার সঙ্গে আছে আর বহু অভিযানেও সঙ্গী হয়েছে। শিকারে যাবার সময়ে আমার সব চেয়ে ভারি মোটটা বেছে মাথায় তুলে নিয়ে, লম্বা পা ফেলে সকলের আগে এগিয়ে চলাতেই ছিল তার আনন্দ আর গর্ব। ঘুমুতে যাবার আগে তাঁবুর সামনের জ্বালানো আগুনের চারধারে গোল হয়ে বসে একসঙ্গে গান গাওয়াই রীতি; এবং প্রথম রাত্রে ত্রিশূলের পাদদেশে, হাততালি, হুল্লোড় আর টিনের কৌটো বাজিয়ে এই গানের আসর চলেছিল দীর্ঘক্ষণ।
আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল যে এখানেই তাঁবুর বাসস্থান অক্ষুণ্ণ রেখে চারপাশের অঞ্চলটায় আমরা ‘বড়াল’ ও ‘থর’-এর অনুসন্ধান চালাব; কিন্তু পরদিন সকালে প্রাতরাশের সময়েই, আমার লোকদের তাবু গোটাবার আয়োজন দেখে খানিক অবাকই হলাম। কারণ অনুসন্ধানে জানলাম যে জায়গাটা নাকি তাঁবু রাখার পক্ষে সুবিধাজনক নয়; স্যাঁতসেঁতে; পানীয় জল দূষিত; এখানে জ্বালানির সংগ্রহ কষ্টসাধ্য এবং সর্বোপরি মাত্র দু’মাইল দূরেই একটা বাসযোগ্য সুন্দর সমভূমি বর্তমান।
মোট বইবার জন্যে আমার ছিল ছ’জন গাড়োয়ালী, কিন্তু দেখলাম মোট বাঁধা হয়েছে পাঁচটি আর অদূরে মাথার ওপর দিয়ে সর্বাঙ্গে কম্বল জড়িয়ে তাঁবুর জ্বালানো-আগুনের ধারে বসে আছে বালা সিং। প্রাতরাশের পর আমি তার কাছে গেলাম এবং লক্ষ করলাম, অন্য সকলে কাজ থামিয়ে গভীর মনোযোগে লক্ষ করছে আমি কি করি। বালা সিং আমাকে তার দিকে এগোতে দেখেও আমাকে সেলাম করছে না; এটা খুবই অস্বাভাবিক। আর আমার সমস্ত প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে সে একটাই উত্তর দিল যে, সে অসুস্থ নয়। সেদিন নিঃশব্দে আমরা দু’মাইল পথ পেরোলাম; সারাটা পথ পেছন পেছন বালা সিং এল, যেন কোনো ঘুমন্ত মানুষ অথবা সে ওষুধের ক্রিয়ায় বাহ্যজ্ঞান শূন্য।
এখন অবশ্য এটা স্পষ্ট যে বালা সিং-এর যাই ঘটুক না কেন, বাকি চোদ্দ জনের ওপর তার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট; স্বাভাবিক উচ্ছলতা হারিয়ে তারা যেন নিতান্ত কর্তব্যকর্ম করে যাচ্ছে আর তাদের মুখের ওপর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ভীতির লক্ষণ। এই জন্যেই যখন রবার্ট এবং আমার থাকবার চল্লিশ পাউন্ড ওজনের তাবুটা খাটানো হচ্ছিল, তখন আমি আমার পঁচিশ বছরের পুরনো গাড়োয়ালী চাকর মতি সিংকে এক কোণে ডেকে নিয়ে বালা সিং-এর এমন অবস্থা বিষয়ে প্রশ্নাদি করি। নানাপ্রকার অস্পষ্ট ও ঘোরপ্যাঁচ উত্তরের মধ্যে থেকে মতি সিং-এর কাছ থেকে যে কাহিনী জানা গেল, তা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং স্বার্থহীন। গত রাত্রে যখন আমরা তাবুর সামনের আগুনের ধারে গোল হয়ে বসে গান গাইছিলাম, মতি সিং বলল, ‘ত্রিশূলের দানো তখন বালা সিং-এর মুখের মধ্যে ঢুকে যায় এবং সেও তাকে গিলে ফেলে। মতি সিং আরো বলে যে, তখন তারা চিৎকার করে টিনের কৌটো বাজিয়ে সেই দানোটাকে বালা সিং-এর শরীরের মধ্যে থেকে বের করার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই পারে নি, এবং এখন এ-ব্যাপারে আর কিছুই করার নেই।
একটু দূরেই বসে ছিল বালা সিং; কম্বলটা এখনও তেমনি মাথা ঢেকে জড়ানো। তার সঙ্গে কথা বললে অন্যেরা শুনতে পাবে না এমন দূরত্বে সে বসে থাকায়, আমি তার কাছে গিয়ে সরাসরি গতরাত্রের ঘটনার বিশদ জানতে চাইলাম। বেশ কয়েক মিনিট ধরে বালা সিং বেদনার্ত দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হতাশ গলায় বলল : ‘এখন আর সে কথায় কি লাভ সাহেব; অবশ্য গত রাত্রের ঘটনা আপনাকে আমার জানানো কর্তব্য কিন্তু আপনি তা বিশ্বাস করবেন না। সে কি, জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কি তোমাকে কখনও অবিশ্বাস করেছি? না, না, সে বলে উঠল, ‘কোনোদিন, আপনি আমাকে অবিশ্বাস করেন নি, কিন্তু এটা এমন একটা ঘটনা : যা বোঝা আপনার পক্ষে অসম্ভব। বললাম, আমি বুঝি বা না-বুঝি, তোমার মুখ থেকে সত্যি ঘটনাটা শুনতে চাই। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বালা সিং বলল : ঠিক আছে, সাহেব, যা ঘটেছিল বলছি। আপনি জানেন যে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী পাহাড়ী গানে একজনই মূল গানটি গায় এবং অন্যেরা সমস্বরে তার দোহার টানে। গত রাত্রে আমি যখন এই রকম একটা মূল গান গাইছিলাম, তখনই ত্রিশূলের দানো আমার মুখের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে আর অনেক বাধা দেওয়া সত্ত্বেও সে সড়াৎ করে আমার গলা বেয়ে পাকস্থলীতে চলে যায়। আগুনের উজ্জ্বল আলোয় অন্যেরা দানোর সঙ্গে আমার লড়াইটা দেখেছিল তাই তারা প্রাণপণে চিৎকার করে, টিন বাজিয়ে তাকে তাড়াবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু, সে কান্না ভেজা গলায় বলে চলে, ‘দানোটাকে তাড়ানো গেল না। এখন সেই দানোটা কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম। পেটে, ওপর হাত রেখে গম্ভীর গলায় বালা সিং জবাব দিল, এখানে সাহেব, এখানে। আমি পরিষ্কার অনুভব করতে পারছি, ও আমার পেটের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রবার্ট সারাটা দিন আমাদের তাবুর পশ্চিমের মাঠে ঘুরে ঘুরে সম্ভাব্য শিকারক্ষেত্র দেখল তারপর অনেকগুলি ‘থরের দেখা পাওয়ায় একটিকে গুলি করে মারে। নৈশভোজন শেষ করে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা পরিস্থিতি বিষয়ে পর্যালোচনা করলাম। বহু মাস ধরে আমরা এই শিকারের পরিকল্পনা করেছি আর প্রতীক্ষায় দিন গুনেছি। এই শিকারক্ষেত্রে পৌঁছতে রবার্টের লেগেছে সাত দিনের আর আমার লেগেছে দশ দিনের প্রাণান্তকর পথ হাঁটার শ্রম আর আমাদের পৌঁছবার সেই রাত্রেই বালা সিং গিলে বসল ত্রিশূলের দানোকে। এ-বিষয়ে আমাদের নিজস্ব মতামত যাই হ’ক না কেন, আসলে সমস্যা হল সঙ্গের প্রত্যেকেই তখন বিশ্বাস করে বসে আছে যে– বালা সিং-এর পেটে দানোটা বসবাস করছে এবং সে কারণেই সকলে তার সঙ্গ এড়িয়ে চলছে। এ অবস্থায় একমাস ধরে শিকার চালিয়ে যাবার পরিকল্পনায় স্থির থাকা অসম্ভব এবং রবার্টের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে আমার সঙ্গে সেখানে একমত হল যে, সে এখানে একাকী শিকার করতে থাকবে আর আমি বালা সিংকে সঙ্গে নিয়ে নৈনিতালে ফিরে যাব। সুতরাং পরদিন সকালেই জিনিসপত্র গুছিয়ে, রবার্টের সঙ্গে একটু আগেই প্রাতরাশ সেরে নৈনিতালে ফেরার দশ দিনের হাঁটা পথ ধরলাম।
তিরিশ বছরের যৌবনের সার্থক প্রতিরূপ বালা সিং নৈনিতাল ছাড়বার সময়ে ছিল আনন্দোজ্জ্বল; আর আজ সে ফিরছে মূক, চোখে ভাষাহীন দৃষ্টি, আর সমস্ত দেহে। জীবনের প্রতি অনাসক্তির লক্ষণ। আমার বোনেরা, তাদের মধ্যে একজন ছিল মেডিক্যাল মিশনারী, তার জন্যে যা কিছু করার সবই করল। নিকট এবং দূরের বন্ধুরা তার সঙ্গে দেখা করতে আসত কিন্তু সে নীরবে তার বাড়ির দরজায় বসে থাকত এবং কেউ কিছু জিজ্ঞাসা না করলে কোনো কথা বলত না। আমাদের পরিবারের বিশেষ বন্ধু নৈনিতালের সিভিল সার্জন কর্নেল কুক আমার অনুরোধে বালা সিংকে দেখতে এলেন। দীর্ঘ কষ্টকর পরীক্ষা চালিয়ে অবশেষে তিনি সিদ্ধান্তে এলেন যে শারীরিকভাবে বালা সিং সম্পূর্ণ সুস্থ এবং তার এই মানসিক অবস্থার আপাত অবনতির কোনো কারণ নির্দেশ তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
কয়েকদিন পরে আমার মাথায় একটা মতলব এল। সে-সময়ে নৈনিতালে একজন প্রখ্যাত ভারতীয় ডাক্তার ছিলেন; ভাবলাম, যদি তাঁকে দিয়ে বালা সিংকে পরীক্ষা করাতে পারি এবং তারপর তাঁকে দানো বিষয়ে জানিয়ে দিয়ে, তাকে দিয়েই বালা সিংকে তার পেটে কোনো দানো নেই বলে আশ্বস্ত করতে পারি, তবে সে হয়ত সুস্থ হয়ে উঠবে; তার ওপর এই ডাক্তারবাবু যে কেবল হিন্দু ছিলেন তাই নয়, তিনি নিজেও ছিলেন পাহাড়ী। অবশ্য আমি বৃথাই আশা করেছিলাম; আমার মতলবটা কোনো কাজেই লাগল না। কারণ ডাক্তার রোগীকে দেখামাত্রই সন্দিহান হয়ে উঠলেন এবং নানাবিধ চতুর প্রশ্নের উত্তরে তিনি যখনই বালা সিং-এর কাছ থেকে জানতে পারলেন যে ত্রিশূলের দানো তার পাকস্থলীতে প্রবেশ করেছে, তৎক্ষণাৎ তিনি কাছ থেকে দ্রুত পায়ে সরে এসে আমাকে বললেন, আপনি আমাকে ডেকেছেন বটে, কিন্তু দুঃখিত, আমি এই লোকটির জন্যে কিছুই করতে পারলাম না।
বালা সিং-এর গ্রামের দুজন লোক ছিল নৈনিতালে। পরদিন আমি তাদের ডেকে পাঠালাম। তারা জানত যে বালা সিং-এর কি হয়েছে, কারণ তারা ইতিপূর্বে কয়েকবার তাকে দেখতে এসেছে; এবং আমার অনুরোধে তারা তাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে রাজী হল। পয়সাকড়ি নিয়ে পরদিন সকালে তিনজন লোক তাদের আটদিনের যাত্রাপথে পাড়ি দিল। তিন সপ্তাহ পরে দুজন ফিরে এসে আমাকে সমস্ত খবর জানাল।
পথে বালা সিং কোনো প্রকার অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে নি। কিন্তু যেদিন সে ঘরে ফেরে সেদিন রাতেই যখন তার স্বজন ও বন্ধুরা তার চারপাশে সমবেত হল তখনই অকস্মাৎ সে বলে ওঠে যে দানোটা ত্রিশূলে ফিরে যাবার জন্যে তার কাছ থেকে মুক্তি চাইছে আর তা দিতে হলে তার আপন মৃত্যুই একমাত্র উপায়। সুতরাং, আমার সংবাদদাতারা বক্তব্য শেষ করল, ‘বালা সিং শুয়ে পড়ে এবং মারা যায়; পরদিন সকালে আমরা তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সহায়তা করি।
আমি নিশ্চিত যে কুসংস্কার হামের মতই একটা ব্যাধি, যার দ্বারা কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা সমগ্র সম্প্রদায়ই আক্রান্ত হতে পারে কিন্তু অনাক্রান্তদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রতিরোধক্ষমতা। কার্যত এ কারণেই হিমালয়ের উচ্চভূমির বাসিন্দা বালা সিং যে ভীষণ রকমের কুসংস্কারগ্রস্ত হয়ে মারা যায়, আর কাছে থেকে আমি যে অনাক্ৰান্তই থেকে যাই, তাতে আমার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যদিও কুসংস্কারগ্রস্ত নই বলেই আমি দাবি করি, তথাপি চম্পাবতের বাঘ শিকারের সময়ে বাংলোতে এবং জনশূন্য এক গ্রাম থেকে ভেসে আসা আর্তনাদে, আমার যে অভিজ্ঞতালাভ, তার ব্যাখ্যাদান আমার পক্ষে অসম্ভব। এবং অসম্ভব, কেন আমি সেই আশ্চর্য বাঘটি মারতে বারংবার ব্যর্থ হয়েছি, তার ব্যাখ্যা করা; এখানে সেই কাহিনীই আমি বিবৃত করব।
.
০২.
‘দেবগিরি’র চূড়ায় নির্মিত রেস্ট হাউস থেকে যে প্রকৃতি-প্রেমিক নিসর্গ দৃশ্যাবলী পর্যবেক্ষণ করেছেন, তিনি কখনও দাবিধূরাকে ভুলতে পারেন না। তিনঘরের এই বাড়িটির বারান্দা থেকে খাড়া পাহাড় নেমে গেছে পানার নদীর উপত্যকায়। আর এই উপত্যকার পরেই পাহাড়টা উঁচু হয়েছে ধাপে ধাপে, যতক্ষণ না ঢেকেছে চিরতুষারের আবরণে; বিমান আবিষ্কারের পূর্বকাল পর্যন্ত এই অনতিক্রম্য ব্যবধানের পাঁচিল ভারতকে তার উত্তরাঞ্চলীয় ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীর হাত থেকে রক্ষা করেছে।
কুমায়ুনের প্রশাসনিক সদর দপ্তর নৈনিতাল থেকে পূর্ব সীমান্তের মহকুমা শহর লোহারঘাট পর্যন্ত রাস্তাটা দাবিধূরা অতিক্রমকরে গেছে আর তারই একটা শাখা রাস্তা দাবিধূরা ও আলমোড়াকে সংযুক্ত করেছে। শেষোক্ত রাস্তার ধারে আমি যখন পানারের মানুষখেকো বাঘ মারছিলাম–অবশ্য এ গল্পে পরে আসছি-সেকালে জনৈক রোড ওভারসিঅহ্ আলমোড়া যাবার পথে আমাকে জানান যে দাবিধূরাতে একটা চিতা একজন লোককে মেরেছে। সুতরাং আমি দাবিধূরাতে গিয়ে পৌঁছলাম।
দাবিধূরা যাবার পশ্চিম দিকের রাস্তাটা কুমায়ুনের দুর্গমতম পথ হিসাবে চিহ্নিত। যিনি এই পথের নকশা করেন, সম্ভবত তাঁর পরিকল্পনা ছিল সর্বাপেক্ষা সংক্ষিপ্ত পথে চূড়ায় ওঠার ব্যবস্থা করা, এবং সেকারণেই যেন রাস্তাটা বাকবিহীনভাবে পাহাড়ের গা বেয়ে খাড়াই উঠে গেছে আট হাজার ফুট। এপ্রিলের এক উত্তপ্ত বিকেলে এই রাস্তাটা অতিক্রম করে এসে যখন রেস্ট হাউসের বারান্দায় এসে গ্যালন গ্যালন চা পান আর নিসর্গশোভা উপভোগ করছিলাম, তখন দাবিধূরার এক পুরোহিত আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। দুবছর আগে আমি যখন চম্পাবতের মানুষখেকোকে শিকার করছিলাম, তখন এই অতিশীর্ণ বৃদ্ধের সঙ্গেও বন্ধুতা গড়ে ওঠে; দাবিধূরার বৃহৎ শিলাখণ্ডের ছায়ার মধ্যে যে ছোট মন্দিরটির অবস্থিতি, এ-বৃদ্ধ সেখানে পুরোহিতের, কাজ করেন এবং উক্ত মন্দিরটির জন্যেই স্থানটির তীর্থস্থানের মর্যাদা; ভাবতে আশ্চর্য লাগে কি করে এখানে ওটি নির্মিত হল। কয়েক মিনিট আগে ওই মন্দিরের সামনে দিয়ে আসবার সময় আমি যথারীতি প্রণাম করেছিলাম আর প্রার্থনারত বৃদ্ধ পূজারীও আমাকে মাথা নেড়ে প্রণম্যের স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। পূজার্চনা সমাপ্ত করে পূজারী এক সময়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে চলে এলেন রেস্ট হাউসের বারান্দায়, তারপর আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লেন কিছুক্ষণ গল্প করবার জন্যে। সহৃদয় বৃদ্ধ মানুষটির হাতে ছিল অনন্ত সময় আর দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত আমিও চাইছিলাম বিশ্রাম; অতএব সারাটা সন্ধ্যে আমরা কাটালাম গল্পে আর সিগারেট পুড়িয়ে।
এই পুরোহিতের কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে রোড ওভারসিঅরের কাছে দাবিধূরার মানুষখেকোর হাতে লোকটি নিহত বলে যে সংবাদ পেয়েছিলাম, তা যথার্থ নয়। নিহত বলে কথিত উক্ত লোকটি একজন পশুপালক; আলমোড়া থেকে দাবিধূরার দক্ষিণে গ্রামে যাবার পথে গত রাত্রে সে উক্ত পুরোহিতেরই আতিথ্য গ্রহণ করে। রাত্রে খাওয়া সেরে সে পুরোহিতের কথা অগ্রাহ্য করেই মন্দিরের চাতালে ঘুমুতে যায়। প্রায় মধ্যরাত্রে, যখন পাথরের ছায়ায় ঢেকেছে মন্দির, তখনই মানুষখেকোটা গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এসে লোকটার পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরে তাকে চাতাল থেকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। আর্তনাদ করে জেগে উঠে লোকটি কাছের অগ্নিকুণ্ড থেকে একটা কাঠ তুলে নিয়ে চিতাটাকে মারতে থাকে। তার আর্তনাদে ইতিমধ্যেই বেরিয়ে আসে পুরোহিত এবং অন্য লোকেরা আর সমবেত প্রচেষ্টায় চিতাটাকে তাড়াতে সমর্থ হয়। লোকটির ক্ষত গুরুতর হয় নি; মন্দিরের নিকটস্থ দোকানী ‘বেনের’ সামান্য চিকিৎসাতেই সে সুস্থ বোধ করে এবং আবার গ্রামের দিকে হাঁটার শক্তি পায়।
পুরোহিতের বক্তব্যে ভরসা রেখেই আমি দাবিধূরাতে থাকা স্থির করলাম। চারপাশের গ্রাম থেকে লোকেরা প্রত্যহ বেনের দোকানে এবং মন্দির দর্শনে আসত। এই লোকেরাই সর্বত্র জানিয়ে দেবে আমার আগমন সংবাদ এবং বর্তমান অবস্থিতি, যাতে করে এ-অঞ্চলে কোনো মানুষ বা পশুহত্যার খবর আমার কাছে যত শিগগীর সম্ভব পৌঁছে যায়।
সেদিন সন্ধেয় যখন বৃদ্ধ পুরোহিত যাবার জন্যে উঠলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ-এলাকায় কোনো শিকার পাওয়া সম্ভব কিনা, কারণ আমার লোকেরা অনেকদিন মাংস খেতে পারে নি, তাছাড়া এখানে দাবিধূরাতে তো সেটা কেনাও সম্ভব নয়। হ্যাঁ, তার জবাব এল, ‘মন্দিরের বাঘটা আছে। তার বাঘ মারবার কোনো উৎসাহ আমার নেই, এই আশ্বাসবাণীর উত্তরে তিনি হাসিতে ফেটে পড়লেন, ‘সাহেব, তোমার ও বাঘ মারতে চেষ্টা করায় আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তুমি বা অন্য কেউ কখনই ও বাঘ মারতে পারবে না। আর এভাবেই আমি পেলাম দাবিধূরা মন্দিরের বাঘের খবর, যা আমার শিকার জীবনের অভিজ্ঞতায় এক আশ্চর্যতম সংযোজন।
.
০৩.
দাবিধূরায় পৌঁছাবার পরদিন সকালেই আমি মানুষখেকোর সন্ধানে নিচে লোহারঘাট রোডে নেমে গেলাম; অথবা তার সম্পর্কে এখানে যদি কিছু সংবাদ মেলে, কারণ মন্দিরের লোকটিকে আক্রমণ করবার পর চিতাটি এ-পথেই গেছে বলেই জানা গিয়েছিল। একটু দেরিতে রেস্ট হাউসে দুপুরবেলার আহারের জন্যে ফিরে দেখতে পেলাম একজন লোক আমার চাকরের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। লোকটি বলল যে সে মন্দিরের পুরোহিতদের কাছে খবর পেয়েছে যে আমরা কিছু শিকারে আগ্রহী; এবং আমরা রাজী হলে সে আমাদের একটা জারাও-এর (সম্বরের পাহাড়ী নাম) সন্ধান দিতে পারে; এর সিংগুলি ওকগাছের বড় শাখার মত। পাহাড়ী সম্বরদের ক্কচিৎ সুন্দর সিং হয়; কিছুকাল আগে কুমায়ুনে সাতচল্লিশ ইঞ্চি শিংওয়ালা সম্বর গুলি করে মারা হয়; তার ওপর এই বিরাট প্রাণটি থেকে কেবলমাত্র আমার লোকেদেরই মাংসের ব্যবস্থা হবে না, সেই সঙ্গে দাবিধূরার সমস্ত মানুষের মাংসের যোগান দেওয়া যাবে। লোকটিকে জানালাম যে দুপুরের খাওয়া সেরেই আমি তার সঙ্গে বেরুব।
কয়েকমাস আগে আমি সামান্য কয়েকদিনের জন্যে কলকাতায় যাই এবং এক সকালে হাঁটতে হাঁটতে আমি বন্দুক বিক্রেতা ম্যান্টনের দোকানে ঢুকে পড়ি। দরজার ধারেই কাঁচের শো-কেসে একটা রাইফেল ছিল। আমি যখন এই অস্ত্রটা দেখছিলাম, তখন আমার পুরনো বন্ধু, এই দোকনের ম্যানেজার এসে উপস্থিত হলেন। তিনি জানালেন যে এই রাইফেলটি ওয়েস্টলী রিচার্ডস-এর ২৭৫-এর নতুন মডেল; ভারতে পাহাড়ী অঞ্চলে শিকারের জন্য কোম্পানী এগুলি চালাতে আগ্রহী। রাইফেলটি অতীব পছন্দসই এবং ম্যানেজারের ওটিকে আমাকে গছাতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না, এবং যদি এটি আমার কাজের উপযোগী বোধ না হয় তবে তিনি এটা ফেরত নিতে রাজী ছিলেন। সুতরাং নতুন রাইফেলটি নিয়ে আমার গ্রামীণ বন্ধুর সঙ্গে বিরাট ওক ডালের মতো শিংওয়ালা জারাটিকে মারবার জন্যে সেই সন্ধেবেলা বেরিয়ে পড়লাম।
উত্তরের তুলনায় দাবিধূরার পাহাড়ের খাড়াই অনেক কম; স্বভাবতই আমরা এই পথে ওকবন আর ঝোঁপজঙ্গল পেরিয়ে প্রায় দু’মাইল হেঁটে এসে পৌঁছলাম ঘাসের আস্তরণে ঢাকা স্থানে; এখান থেকে অদূরে উপত্যকায় দিগন্তবিস্তৃত দৃশ্যাবলী স্পষ্ট। উপত্যকার বাঁদিকে ঘন জঙ্গলে ঢাকা। সবুজ একখণ্ড খোলা জমি দেখিয়ে আমার পথপ্রদর্শক আমাকে জানাল যে এখানে জারাও সকাল ও সন্ধ্যায় ঘাস খায়। তা ছাড়াও সে জানাল যে এই উপত্যকার দক্ষিণ দিকে একটা রাস্তা আছে এবং দাবিধূরা থেকে যাওয়া-আসার পথেই সে ওখানে জারাও দেখে। আমি যে রাইফেলটি সঙ্গে এনেছি তা পাঁচশো গজের নির্ভুল নিশানার উপযোগী, কিন্তু রাস্তা থেকে জারাও-এর বিচরণক্ষেত্রের দূরত্ব মাত্র তিনশো গজ; সুতরাং রাস্তা ধরে নেমে গিয়ে ওটাকে মারবার জন্যে অপেক্ষা করাই আমি স্থির করি।
আমরা যখন কথা বলছিলাম, দেখলাম আমাদের বাঁদিকের আকাশে কয়েকটি শকুন পাক খাচ্ছে। আমার সঙ্গীর দৃষ্টি ওদিকে আকর্ষণ করতেই ও জানাল যে ওদিকে পাহাড়ের ভাঁজে একটা ছোট গ্রাম আছে; সম্ভবত ওখানে কোনো গৃহপালিত পশু মারা যাওয়াতে শকুনগুলোর নজর পড়েছে। যা হ’ক সে বলল, আমরা শীগগিরই জানতে পারছি পাখিদের আকর্ষণের কারণ, কেননা ও-পথেই তো আমাদের ফিরতে হবে। একটা ঘাসে ছাওয়া ঘর, একটা গরু-ভেড়া রাখবার চালা, আর প্রায় তিন বিঘাখানেক সদ্য ফসল কাটা ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া খেত, এই হল ‘গ্রাম’। কুঁড়েঘর আর চালা থেকে দশ ফুট চওড়া বৃষ্টির জলের নালা দিয়ে আলাদা করা একটা জমির ওপরে পড়ে থাকা একটা জানোয়ারের দেহ থেকে শকুন মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে। কুঁড়েঘরটার কাছে পৌঁছতে, একজন লোক বেরিয়ে এসে আমাদের নমস্কার জানিয়ে, আমরা কোথা থেকে আর কখন এসেছি জিজ্ঞেস করল। মানুষখেকো চিতা মারবার জন্যে আমি নৈনিতাল থেকে মাত্র গতকাল দাবিধূরায় এসে পৌঁছেছি, এ-কথা তাকে জানাতে, সে দুঃখ করতে লাগলো কেন যে আগে জানতে পারল না আমার পৌঁছবার কথা। তাহলে ত আপনি’ সে বলল, “যে বাঘটা আমার গরুটাকে মেরেছে সেটাকেই মারতে পারতেন। সে বলে চলে, এখন যে মাঠটায় গরুর হাড় নিয়ে শকুনেরা কামড়াকামড়ি করছে, কালও সে মাঠে জমিতে সারের প্রয়োজনে চরতে ছেড়েছে পনেরটা গরুকে, তার একটাকে রাত্রে বাঘে মেরেছে। তার নিজের কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই আর কাছাকাছি এমন কেউ নেই যাকে সে বাঘটা মারবার জন্যে অনুরোধ জানাতে পারে; তাই সে গিয়েছিল নিকটবর্তী গ্রামের একজনের কাছে, যার কাজই হল সেই এলাকায় চামড়া সংগ্রহ করা। সেই লোকটাই আমার আসবার দু-ঘন্টা আগে গরুটার চামড়া ছুলে ফেলেছে আর এখন চলেছে শকুনদের মহোৎসব। যখন লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম যে সে কি জানত না যে সে এলাকায় বাঘ আছে আর তা জেনেশুনে কেন রাত্রে গরুগুলোকে চরতে পাঠাল; উত্তরে সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো যে দাবিধূরা পাহাড়ে চিরকালই বাঘ আছে কিন্তু এর আগে কখনও কোনো গরু-ভেড়া মারা পড়ে নি।
কুঁড়েঘরটা পেরিয়ে এগোতেই লোকটা প্রশ্ন করে কোথায় যাব আমি তার উত্তরে যখন জানালাম যে আমি উপত্যকার অন্য প্রান্তে জারাও মারতে যাচ্ছি, তখনও সে বিনীত অনুরোধ জানাল যে, এখনকার মত জারাও না মেরে আমি যেন বাঘ শিকারে মন দিই। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, আমার জমির পরিমাণ সামান্য, আর তেমন উর্বরাও নয়; এ অবস্থায় যদি বাঘ আমার গরুগুলোকে মারতে শুরু করে তাহলে আমি কি করে বাঁচব; আমার সমগ্র পরিবার যে অনাহারে মরবে।
আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন মাথায় এক ঘড়া জল নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে এল একটি নারী; তার পেছনে একটু পরে মাথায় এক বোঝা সবুজ ঘাসের ভার নিয়ে এল একটা মেয়ে আর একটা ছোট ছেলে মাথায় বয়ে আনল এক আঁটি শুকনো লড়ি। প্রায় তিন বিঘার মতো স্বল্প-ফসলী জমি আর মাত্র কয়েক সের দুধ, তার ওপর পাহাড়ী গরুর দুধও কম হয়, দাবিধূরায় বেনের কাছে বিক্রি করে চলে চারজনের সাংসারিক দিনগুজরান। সুতরাং এ লোকটি যে আমার বাঘ মারার ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হবে, তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে!
শকুনগুলো মড়িটাকে শেষ করে ফেলেছে। অবশ্য এতে কিছুই এসে যায় না, কেননা আশেপাশে এমন কোনো ঝোঁপঝাড়ের আস্তানা নেই, যেখানে থাবা এলিয়ে বাঘটা শকুনগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখতে পারত; সুতরাং নিশ্চিত যে সে ফিরে আসবে কারণ গতরাত্রেও তার খাওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটে নি। জারাও-এর চেয়ে বাঘ শিকারেই আমার পথপ্রদর্শকেরও আগ্রহ লক্ষিত হল বেশি; সুতরাং দুজনকেই বসে থাকতে বলে, বাঘটা কোনদিকে গেছে সেটা খুঁজতে বেরুলাম; কারণ মাঠের কাছাকাছি এমন কোনো গাছ ছিল না, যেখানে বসে আমি বাঘটার গতিবিধি লক্ষ করতে পারি; তার উপর আমার ইচ্ছা ছিল ফেরার পথেই বাঘটার মুখোমুখি হব। পাহাড়ের এদিকে সেদিকে গৃহপালিত পশুদের যাতায়াতের পথ কিন্তু মাটিটা এতই শক্ত যে কোনো পায়ের ছাপ পড়ে না; এ কারণেই গ্রামটা বার দুয়েক ঘুরে দেখে নিয়ে বৃষ্টির জলের খালটা ধরে এগোলাম। এখানকার নরম ভেজা মাটিতেই আবিষ্কার করলাম একটা বড় পুরুষ বাঘের থাবার ছাপ। এই খাবার চিহ্নতেই বোঝা গেল যে বাঘটা খাওয়া সেরে এ-পথেই ওপরের দিকে উঠে গেছে; সুতরাং এটাই যুক্তিগ্রাহ্য যে সে এ-পথেই ফিরবে। কুঁড়েঘরটা খালটার যে পারে, সেই পারেই প্রায় তিরিশ গজ দূরত্বে, খালপাড়েই একটা খর্বকায়, সর্বাঙ্গে বুনো গোলাপের লতায় ঢাকা একটা ওকগাছ। রাইফেলটা নিচে রেখে, খালটার ওপর ঝুঁকে পড়া ওকগাছটায় উঠে পড়লাম; এবং লতা-ঝোপে আচ্ছন্ন মোটামুটি সুবিধাজনক বসবার জায়গাও মিলে গেল।
কুঁড়েঘরটায় ফিরে এসে অপেক্ষমান লোকদুটোকে বললাম যে আমি এখন রেস্টহাউসে ফিরে যাচ্ছি, উন্নতধরনের বারুদভরা কার্তুজের ব্যবহারোপযোগী আমার ভারী দোনলা ৫০০ এক্সপ্রেস রাইফেলটা নিয়ে আসতে। আমার পথপ্রদর্শক অবশ্য মনের খুশিতেই আমাকে সে কষ্টের হাত থেকে বাঁচাল; সুতরাং তাকে বিষয়টা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে এসে গ্রামীণ মানুষটার সঙ্গে তার দোরগোড়ায় বসে পড়লাম; আর শুনতে থাকলাম এক দরিদ্র অথচ শঙ্কাহীন মানুষের শুধুমাত্র মাথার ওপরে ঘাসের আচ্ছাদনটুকু টিকিয়ে রাখবার জন্যে প্রকৃতি ও বন্যজন্তুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনী। জানতে চাইলাম কেন সে এই নির্জন জায়গা ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বসবাস ও জীবিকার্জনের চেষ্টা করছে না; উত্তরে সে অত্যন্ত শান্তভাবে বলল, এটাই যে আমার বাড়ি।
সূর্য তখন প্রায় অস্তমিত, দেখলাম পাহাড় বেয়ে দুজন লোক নেমে আসছে। কুঁড়েঘরের দিকেই। কারো হাতেই রাইফেল নেই, কিন্তু বালা সিং, গাড়োয়ালীদের মধ্যে যার মত শ্রেষ্ঠ মানুষ বিরল, এবং কয়েক বছর পরে যার বেদনাদায়ক মৃত্যুর ঘটনার কথা পূর্বেই আমি বলেছি, হাতে একটি লণ্ঠন ঝুলিয়ে আসছে। বালা সিং পৌঁছে জানালো যে সে আমার ভারি রাইফেলটা আনে নি, কারণ কাতুর্জগুলো আমার সুটকেসেই তালাবন্ধ রয়েছে আর আমি চাবিটা পাঠাতেও ভুলেছি। ফলে,আমার নতুন রাইফেলটা দিয়েই বাঘটাকে মারতে হবে আর এটার পক্ষে এর চেয়ে ভাল বউনি আর কি।
গাছের ওপরে আসন নেবার আগে কুঁড়েঘরের মালিককে বললাম যে তোমার দুই বাচ্চা, আট বছরের মেয়ে আর ছ’ বছরের ছেলেটাকে শান্ত করে রাখার ওপরেই আমার সার্থকতা নির্ভর করছে এবং তোমার স্ত্রী যেন আমার বাঘটাকে গুলি করা বা বাঘটা আর আসবে না এরকম সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত সন্ধের রান্নাটা না চড়ায়। বালা চি’কে নির্দেশ রইল সে যেন কুঁড়েঘরের বাসিন্দাদের চুপ করিয়ে রাখে, আমি শিস্ দিলে আলো জ্বালায় এবং আমার পরবর্তী নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করে।
পাহাড়ের ওপর থেকে অস্তগামী সূর্যের লাল আভা মিলিয়ে যেতেই উপত্যকার শত শহস্র পাখিদের কলগুঞ্জন ক্ষীণতর হয়ে এল। গোধূলির অন্ধকার ঘন হয়ে এল, মাথার ওপরে পাহাড়ে হুতুম প্যাচার চিৎকার। চাঁদ ওঠবার আগে পর্যন্ত কিছুকালের জন্যে চতুর্দিক থাকবে প্রায়ান্ধকার। সময় আসন্ন আর কুঁড়েঘরের বাসিন্দারা মৃত্যুর মত নিস্তব্ধ। আমার রাইফেলটাকে শক্ত করে ধরে, নিচের মাঠের দিকে স্থির চোখ রেখে বসে আছি; বাঘটা তখন আমার গাছের নিচের পথটা এড়িয়ে সেই মড়িটার কাছে পৌঁছে গেছে আর সেটার অবস্থা দেখে ভয়ংকর ক্রুদ্ধ। চাপা গর্জনে সে শকুনদের অভিশাপ দিতে থাকল, যদিও দু’ঘণ্টা আগেই তারা উড়ে গেছে, কেবলমাত্র জায়গাটাতে রেখে গেছে তাদের সৌগন্ধ। সম্ভবত দু’ তিন বা চার মিনিট ধরে সে নিজের মনেই গর্জাল আর তারপরেই নৈঃশব্দ্য। ক্রমশই আলো ফুটছে। আর কয়েক মিনিট পরেই আমার ভূবন আলোর বন্যায় ভরিয়ে দিয়ে পাহাড়ের গায়ে চাঁদ উঠল। শকুনেরা চেঁছেমুছে খেয়ে যাওয়ায় এখন হাড়গুলো চাঁদের আলোয় শুভ্রতর দেখাচ্ছে। কিন্তু কোথাও বাঘটার চিহ্নমাত্র নেই। উত্তেজনায় শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে নিচু গলায় শিস্ দিলাম। বালা সিং সজাগই ছিল; শুনতে পেলাম সে কুঁড়েঘরের মালিককে উনুন থেকে আগুন জ্বালিয়ে আনতে বলছে। ঘাসের কুঁড়ের দেওয়ালের ফাঁকে যে অল্প আলোর আভাস দেখতে পাচ্ছিলাম, এখন লণ্ঠনটা জ্বালতেই তা স্পষ্টতর হল। আলোটা কুঁড়ের এধার থেকে ওধারে আনা হল, তারপর দরজা খুলে আলো হাতে মুখটাতে দাঁড়িয়ে আমার আদেশের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল। ওই একটি চাপা শিস্ দেওয়া ছাড়া গাছের ওপরে ওঠার পর আমি কোনো শব্দ বা গা-নড়াচড়া করি নি। এবং এখনই নিচে তাকিয়ে সুস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখলাম, আমার ঠিক নিচেই বাঘটা দাঁড়িয়ে তার ডান কাঁধের ওপর দিয়ে বালা সিংকে দেখছে। আমার রাইফেলের মুখটা তখন বাঘের মাথাটা থেকে মাত্র পাঁচ ফুট দূরত্বে; কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, এই কার্তুজে হয়তো বাঘের লোমগুলো পুড়ে যাবে। আমার রাইফেলের হাতির দাঁতের মাছিটি বাঘের হৃৎপিণ্ডকে নির্দেশ করে আছে, জানি আমার বুলেট মুহূর্তেই তার মৃত্যু ঘটাবে; আমি শান্তভাবে ট্রিগার টিপলাম। চাপে ট্রিগার নেমে এল কিন্তু কিছুই হল না।
হা ঈশ্বর! কি অসহ্য অসাবধানী আমি। স্পষ্ট মনে আছে গাছে আসন নেবার আগে আমি ম্যাগজিন থেকে পাঁচাট গুলির একটা ক্লিপ ভরেছিলাম রাইফেলের চেম্বারে কিন্তু নিশ্চয়ই ম্যাগাজিন থেকে কার্তুজটা চেম্বারে বসেছে কিনা, তা দেখে নিতে ভুলেছি। রাইফেলটা যদি পুরনো আর বহু ব্যবহৃত হয়, তবে এ ভুলটা শুধরে নেওয়া সম্ভব হত। কিন্তু রাইফেলটা নতুন; এবং যে মুহূর্তে বোল্টটা পেছনে টানবার। জন্যে লিভারটা তুলেছি তখনই ক্লিক করে একটা ধাতব শব্দে এক লাফে বাঘটা খাল পেরিয়ে অদৃশ্য হল। বালা সিং-এর প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্যে পেছনে তাকাতে দেখলাম সে কুঁড়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করেছে।
নৈঃশব্দের এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই; আমাকে গাছ থেকে নামতে সাহায্য করার জন্যে বালা সিং আমারই ডাকে এগিয়ে এসেছে। ম্যাগাজিনটা খালি করার জন্যে রাইফেলের বোল্টটাকে আমি পেছনের দিকে টানলাম তখনই দেখলাম যে বোল্টের শেষের দিকে একটা কার্তুজ রয়েছে। তাহলে তো রাইফেলটায় গুলি ভরা ছিল আর সেফটি ক্যাচও খোলা ছিল। তবে কেন আমার ঘোড়া টেপা সত্ত্বেও রাইফেল থেকে গুলি বেরুল না? কারণটা জেনেছিলাম অনেক পরে। ম্যান্টনের ম্যানেজার রাইফেলটা দেখবার সময়েই আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে এর ঘোড়াটা দুবার টানতে হয়। তথাকথিত এ-ধরনের উন্নত প্রকারের রাইফেল ইতিপূর্বে ব্যবহার না করায় আমার জানা ছিল না যে ঘোড়াটা প্রথমে সামান্য টানলে ওটার ঢিলা ভাবটা কাটে এবং পরের টানে স্ট্রাইকারটা কার্তুজে লাগে। আমার ব্যর্থতার এহেন কারণটা বালা সিংকে ব্যাখ্যা করলে, সে নিজেকেই দোষারোপ করে বলে, আমি যদি আপনার ভারি রাইফেল আর সুটকেসটা আনতাম, তবে এরকমটি ঘটত না। সে-সময়ে আমারও ওইরকমই মনে হয়েছিল, কিন্তু যতই দিন গিয়েছে মনে হয়েছে, আমার হাতে ভারি রাইফেলটা থাকলেও হয়তো সে সন্ধ্যায় আমি বাঘটাকে মারতে পারতাম না।
.
০৪.
মানুষখেকোটার সন্ধানে পরদিন সকালে আবার অনেকটা হাঁটলাম। এবং অবশেষে রেস্ট হাউসে ফিরে আসতেই জনৈক উত্তেজিত মানুষ আমাকে সেলাম জানিয়ে বললে যে বাঘটা সদ্য তার একটা গরুকে মেরেছে। বিগত সন্ধ্যায় আমি যে উপত্যকায় বসেছিলাম তারই অন্য ধারে লোকটি যখন গরু চরাচ্ছিল, তখনই বাঘটা এসে তার সেই লাল গরুটাকে মারে, কদিন আগে যেটার বাচ্চা হয়েছিল। আর এখন’, লোকটা জানাল, ‘বাছুরটা মরবে দুধের অভাবে; দুধেল গাই তো আর একটাও আমার নেই।
গত সন্ধ্যায় বাঘটার ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন, কিন্তু ভাগ্য তাকে চিরকাল অনুগ্রহ দেখাবে না; আর এই গরু মারার অপরাধেই তাকে মরতে হবে, কারণ পাহাড়ী অঞ্চলে একে গরুর সংখ্যা নগণ্য, তদুপরি একজন গরিব মানুষের দুধেল গাই হত্যা আরো সাংঘাতিক। ফেলে আসা অন্য গরুগুলোর জন্যে লোকটার ভাবনা ছিল না, কারণ প্রাণভয়ে ইতিমধ্যেই তারা ছুটে পালিয়েছে গ্রামের দিকে; সুতরাং আমার খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করায় আগ্রহী ছিল। বেলা একটায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম, লোকটা আমার পথপ্রদর্শক। আমি ওর পেছনে পেছনে চলেছি আর আমার পেছনে মাচান বাঁধবার সরঞ্জাম নিয়ে আমার দুজন লোক।
পাহাড়ের পাশের একটুকরো খোলা জমিতে দাঁড়িয়ে আমার পথপ্রদর্শক আমাকে জায়গাটার অবস্থান বিষয়ে বুঝিয়ে দিল। পাহাড়ের ওপর থেকে সিকি মাইল নিচে একখণ্ড সবুজ জমিতে যখন তার গরুগুলো চরছিল, তখন উপত্যকার দিক থেকে বাঘটা বেরিয়ে এসে তার গরুটাকে মারে। বাকি গরুগুলো ভীত হয়ে পাহাড় পেরিয়ে ছুটে অন্য প্রান্তে তাদের গ্রামে পৌঁছেছে। আমাদের গ্রামে পৌঁছবার সহজ উপায় হল উপত্যকা পার হয়ে যাওয়া, কিন্তু যেহেতু বাঘটাকে আমি বিরক্ত করতে চাই নি, সেকারণেই আমরা উপত্যকার মাথার ওপর দিয়ে ঘুরে গরুটাকে যেখানে মারা হয়েছে, সেখানে নেমে এলাম। যে শৈলশিরার ওপর দিয়ে শঙ্কিত গরুগুলো ছুটে পালিয়েছে আর যেখানে তারা চরছিল, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানটায় ফাঁকা ফাঁকা বৃক্ষের জঙ্গল। দৌড়ে ছোটা পশুগুলোর পায়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে দো-আঁশ মাটির ওপরে আর এই ছাপ ধরে এগিয়ে অনায়াসে পৌঁছনো গেল, যেখানে এই দৌড়ের শুরু। এখানে জমে আছে চাপ চাপ রক্ত আর টেনে নিয়ে যাবার দাগের সূত্রপাত এখান থেকেই। পাহাড় অতিক্রম করে এই দাগটা চলে গিয়েছে দুশো গজ দূরের এক গভীর জঙ্গলাবৃত গিরিখাত পর্যন্ত; এখানে একটি ছোট জলধারাও বর্তমান। এই খাতের পথ দিয়েই বাঘ তার শিকারকে ওপরে নিয়ে গেছে।
ফাঁকা মাঠের ওপরে সকাল দশটা নাগাদ গরুটাকে মারা হয়েছে আর তারপরেই বাঘটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় সরিয়ে নিয়ে লুকিয়ে রাখার জন্যে। অতএব সেইমত সে ওটাকে গিরিখাত দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে, লুকিয়ে রেখেছে তারই কোনো সংগোপনে, আর তারপর গেছে খাদ ধরে নিচের উপত্যকার দিকে, থাবার ছাপে এর চিহ্ন স্পষ্ট। যে অঞ্চলে মানুষ এবং গৃহপালিত পশুরা চলাফেরা করে, সেখানে বাঘটার অবস্থান বিষয়ে ঠিকঠাক বলতে যাওয়া বোকামি, কারণ সামান্য বিরক্ত বোধ করলেই সে স্থান ত্যাগ করবে। সুতরাং যদিও থাবার ছাপ খাত ধরে নিচে নেমে গেছে, তবুও তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত সাবধানতায় আমি খাতের পথ ধরে এগোলাম।
শৈলশিরা থেকে দুশো গজ নিচে আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি, বৃষ্টির জলের ধারাপাতে পাহাড়ের পাশে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে একটা বড় গর্ত; এখান থেকেই গিরিখাতের শুরু। গর্তটার ওপরের দিকে, যেখান থেকে পনের ফুট খাড়াই নেমে গেছে, সেখানটা বহু আগে সৃষ্ট, আর এখন সেখানে দশ থেকে বারো ফুট লম্বা ওক আর মানদানী গাছ বেড়ে উঠেছে। এই কচি গাছের অরণ্য এবং পনের ফুট খাড়াইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত খোলা জায়গায় বাঘটা তার শিকার এনে রেখেছে। গরুর মালিক যখন অশ্রুসজল চোখে বলল যে, এই যে পশুটা সামনে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে সেটাকে সে কেবলমাত্র ছোট থেকে বড়ই করে নি, সে ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়, তখন আমি গভীর সমবেদনা বোধ করেছিলাম। পশুটার কোনো অংশ তখনো ছোঁয়া হয় নি, বাঘটা ওটাকে টেনে এনে রেখেছে পরে সময়মত খাবে বলে।
এখন একটা বসবার জায়গা খুঁজে বার করতে হবে। কয়েকটা বড় ওক গাছ আছে। খাতের ওপারে কিন্তু কোনোটা থেকেই মড়িটাকে দেখা যায় না আর ও-গাছে চড়াও কঠিন। মড়িটা থেকে তিরিশ গজ নিচে এবং খাতের বাঁ দিকে একটা ছোট শক্ত হলি গাছ। তার ডালগুলো গুঁড়ি থেকে সমকোণে বেরিয়ে এসেছে, আর মাটি থেকে ছ’ফুট উঁচুতে বেশ একটা ডাল, সেখানে বসা যায় আর অন্য যে একটি ডাল সেটাতে পা রেখে আমি আমার পাকে বিশ্রাম দিতে পারি। কিন্তু মাটির অত কাছে বসতে চাওয়াতে আমার তিনজন সঙ্গীই প্রবলভাবে আপত্তি জানাল; যাই হক, বসার উপযুক্ত অন্য দ্বিতীয় গাছ খুঁজে পেলাম না, সুতরাং হলি গাছটাই সম্বল। লোকদের সরিয়ে দেবার আগেই বলে দিলাম যে গত সন্ধ্যায় আমি যে কুঁড়েতে ছিলাম, না ডাকা পর্যন্ত অথবা আমি যতক্ষণ না যাই, ততক্ষণ সেখানেই তাদের অপেক্ষা করতে। উপত্যকার আড়াআড়ি এর দূরত্ব হল প্রায় আধমাইল আর ওরা আমাকে বা মড়িটাকে দেখতে পাবে না; অবশ্য হলি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কুঁড়েটা আমি ঠিকই দেখতে পাব।
বিকেল চারটেয় আমার লোকজনেরা চলে গেল আর আমি দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে হলি গাছের শাখায় বসে গেলাম; কারণ পাহাড়টা পশ্চিমমুখো, আর সূর্যাস্তের আগে সম্ভবত বাঘটা আসবেই না। বাঁ দিকে হলি গাছের ফাঁক দিয়ে গিরিখাতের পঞ্চাশ গজ পর্যন্ত আমার দৃষ্টিসীমায়; সামনে প্রায় দশ ফুট গভীর ও কুড়ি ফুট চওড়া গিড়িখাত আমার চোখে স্পষ্ট আর সামনের পাহাড়টায় কেবল পাথর আর পাথর, কোনো গাছ নেই। দক্ষিণে আমার প্রসারিত দৃষ্টিতে শৈলশিরা স্পষ্টতর কিন্তু মড়িটা একেবারেই দেখা যাচ্ছে না, ঢাকা পড়ে আছে ঘন কচি গাছের অরণ্যে। আমার পেছনে রিংগালের ঘন বন গাছ পর্যন্ত ছড়িয়ে মড়িটাকে আমার চোখের আড়াল করেছে। জলধারা সৃষ্ট গর্তে মড়িটাকে রেখে বাঘটা খাত ধরে নেমে গেছে এবং এ অনুমানের যুক্তি আছে যে সে ফেরবার সময় ওই পথেই ফিরবে। এ কারণেই খাতের দিকেই আমার মনোযোগ বিধে রেখেছিলাম, যাতে করে বাঘটার ওপর সরাসরি গুলি চালাতে পারি। অত্যন্ত কাছে থেকেই যে আমি তাকে মারতে পারব, এ বিষয়ে, আমি ছিলাম নিঃসন্দেহ আর অধিকতর নিশ্চিত হবার জন্যে, যদি প্রয়োজন হয়, তবে দ্বিতীয়বারও যাতে গুলি চালাতে পারি, তাই আমার রাইফেলের দুটো ঘোড়াই তৈরি রেখেছিলাম।
এখানে জঙ্গলে আছে সম্বর, কাকার ও লাঙ্গুর আর মনাল, পাহাড়ী নীল হাঁড়িচাছা, ছাতারে, দামা ও নীলকণ্ঠ; যেহেতু এরা সকলেই বিড়াল পরিবারের একজনকে দেখলে আওয়াজ করে ডাকবে, সে কারণেই ভেবেছিলাম যে বাঘটা আসবার জানান আমি পেয়ে যাব। কিন্তু ভুলই ভেবেছিলাম; কোনো রকম সতর্কতার সংকেতের আগেই অকস্মাৎ বাঘটার মড়িটার কাছে পৌঁছে যাবার পায়ের শব্দ পেলাম। খাত ধরে বাঘটা সম্ভবত জলপানের জন্যে নিচে নেমেছিল, তারপর রিংগালের অরণ্যানী ঘুরে, আমাকে না পার হয়েই সে পৌঁছেছে মড়িটার কাছে। এতে আমি কোনো অকারণ দুশ্চিন্তা বোধ করি নি, কারণ দিনের আলোয় বাঘেরা মড়ির কাছে কখনো সুস্থিরতা বোধ করে না; এবং নিশ্চিন্ত ছিলাম যে হয় এখুনি অথবা সামান্যকাল পরে বাঘটাকে আমার সামনের খোলা মাঠে দেখা যাবেই। মাংসের বড় বড় টুকরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাঘটা প্রায় মিনিট পনের ধরে খাচ্ছিল, এমন সময় দেখতে পেলাম একটা ভাল্লুক পাহাড়ের গা ধরে বাঁ থেকে ডান দিকে আসছে। এটা ছিল হিমালয়ের বেশ বড় জাতের কাল ভাল্লুক; গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল সে, যেন এখান থেকে ওখানে যাবার জন্যে যত সময়ই লাগুক, তাতে তার কিছুই এসে যায় না। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের নিচের দিকে মুখ ফেরাল তারপর শুয়ে পড়ল। এক-দুমিনিট পরে মাথাটা তুলে বাতাসে গন্ধ শুকল, তারপর আবার শুয়ে পড়ল। দিনের আলোয় যেহেতু পাহাড়ে বাতাস নিচু থেকে উঁচু দিকে বয়ে চলে, সেহেতু ভাল্লুকটা মাংস এবং রক্তের গন্ধ পাচ্ছিল আর তার সঙ্গে মেশানো ছিল বাঘের গায়ের আঘ্রাণ। আমি ছিলাম মড়িটার সামান্য ডাইনে, সেকারণেই সে আমার গন্ধ পায় নি। এরপরেই সে উঠে দাঁড়াল এবং হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে বাঘটার দিকে এগুতে থাকল।
কোনো ভাল্লুক এভাবে গুঁড়ি মেরে পাহাড় থেকে নেমে আসছে, এ দৃশ্য আমার কাছে বিস্ময়কর। তাকে ওইভাবে যেতে হবে দু’শো গজ আর যদিও বাঘ বা চিতার মত গুঁড়ি মেরে এগোবার মত শরীর তার নয়, তবু সে জায়গাটা পেরুল সাপের মত স্বচ্ছন্দে আর ছায়ার মত নিঃশব্দে। আর যতই সে কাছে এগুচ্ছিল, ততই যেন তার সাবধানতা স্পষ্ট হচ্ছিল। গর্তটার ওপরে যে পনের ফুট খাড়াই, তার ধারটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আর জায়গাটার কয়েক ফুট কাছাকাছির মধ্যে এসেই সে পেটে হেঁচড়ে এগুতে থাকল। গর্তের ওপর থেকে মাথা উঁচু করে ভাল্লুকটা একবার দেখে নিল যে বাঘটা তখন পরমানন্দে ভোজনে ব্যস্ত। তারপর নিচের দিকে দেখে নিয়ে মাথাটা আস্তে পিছিয়ে নিল। আমার উত্তেজনা তখন চূড়ান্তে পৌঁছে সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়েছে আর মুখ-গলা শুকিয়ে কাঠ।
হিমালয়ের ভাল্লুককে আমি দু’বার বাঘের মড়ি নিয়ে উধাও হতে দেখেছি। বাঘ অবশ্য কোনো বারেই সামনে ছিল না। আর দু’বার দেখেছি চিতাকে তাড়িয়ে ভাল্লুককে তার মড়ি কেড়ে নিয়ে চলে যেতে। কিন্তু এবারে বাঘ, এবং বিরাটকায় পুরুষ-বাঘ তার মড়ির সামনে এবং চিতার মত তাড়িয়ে দেবার জন্তু সে নয়। মনে মনে ভাবছিলাম, জঙ্গলের রাজাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টায় মেতে ওঠার মত বোকামো নিশ্চয়ই ভাল্লুকটা করবে না। কিন্তু ভাল্লুকটা যেন সেটার বাসনাতেই ছিল আর বাঘটা যখন একটা হাড় চিবোতে ব্যস্ত তখনই তার সে সুযোগ এল। জানি না, ভাল্লুকটা ঠিক এই মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষা করছিল কি না; যা হ’ক বাঘটার এই হাড় চিবোবার ব্যস্ততার সুযোগে ভাল্লুকটা নিজেকে গর্তের কিনারে টেনে আনলে তারপর পা দুটো জড়ো করে এক ভয়ংকর চিৎকারের সঙ্গে নিজেকে গর্তের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। মনে হয়, সে চিৎকার করেছিল বাঘটাকে হতচকিত করবার জন্যে, কিন্তু দেখে মনে হল তার সে চেষ্টায় ফল হয় নি; কারণ ভালুকের ভয়ংকর চিৎকারের উত্তরে তখন বাঘটার আরো ভয়ংকর গর্জন শোনা গেল।
বন্যদের মধ্যে লড়াই হয় কদাচিৎ; এবং আমার জ্ঞানত এই দ্বিতীয়বার আমি দুই ভিন্নজাতের পশুদের মধ্যে লড়াই দেখছি, যে লড়াই শুধু লড়াইয়ের জন্যে, খাদ্য-খাদক সম্পর্কের সূত্রে নয়। এ-লড়াই আমি চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম না এবং এর কারণটা আমি আগেই বলেছি, কিন্তু শব্দের প্রত্যেকটি অনুরণনে ঘটনাটি স্পষ্টতর। গর্তের ছোট সীমায় ঘটনাটি ঘটার ফলে এই শব্দ ছিল ভয়াবহ এবং আমার সৌভাগ্য যে, লড়াইটা চলছিল সরাসরি আর এমন দু’পক্ষের মধ্যে যারা নিজেদের প্রতিরক্ষায় সমর্থ এবং তৃতীয় পক্ষরূপে আমি এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ি নি। উত্তেজনায় হৃদস্পন্দনের গতি দ্রুততর হওয়ায় রক্তের বেগও বেড়েছিল এবং মনে হচ্ছিল সময় যেন থমকে আছে। লড়াইটা চলে মিনিট তিনেক বা তার বেশিও হতে পারে। যা হক, যখনই বাঘটা বুঝল যে প্রতিপক্ষকে যথেষ্ট শায়েস্তা করা হয়েছে, তখনই সে রণে ভঙ্গ দিয়ে এক লাফে আমার সামনের খোলা মাঠে এসে দাঁড়াল আর তারই পেছনে পেছনে চিৎকার করতে করতে এল ভাল্লুকটা। রাইফেলটা এদিকে যে-মুহূর্তে বাঘের বাঁ-কাঁধে লক্ষ স্থির করেছি, তৎক্ষণাৎ সে বাঁ-দিক ঘুরে এক লাফে কুড়ি ফুট লম্বা খাতটা পার হয়ে আমার পায়ের নিচে এসে পড়ল। সে যখন শূন্যে তখনই আমি রাইফেলটা ঘুরিয়ে গুলি ছুঁড়েছিলাম, এবং আমার উদ্দেশ্যমতই সেটা লেগেছিল তার পিঠে। গুলির প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল তার ক্রুদ্ধ গর্জনে আর তারপরে সশব্দে গিয়ে পড়ল আমার পেছনের রিংগাল বনে। শোনা গেল তার কয়েকগজ এগিয়ে যাবার শব্দ এবং এর পরেই নীরবতা। ভাবলাম, গুলিটা তার হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ করেছে এবং তাতেই তার মৃত্যু ঘটেছে।
পয়েন্ট পাঁচশো বোরের কর্ডাইট রাইফেল যে-কোনো জায়গায় ছুঁড়লেই আওয়াজটা হয় জোর, কিন্তু এখানে, এই খাতে সেটা শোনাল কামান গর্জনের মত। কিন্তু উন্মত্ত ভাল্লুকটার এ-শব্দে কিছুই হল না। বাঘটার পেছনে পেছনে এসেও সে বাঘের মতো লাফিয়ে খাত পার হবার চেষ্টা না করে পাড় বেয়ে নেমে এসে সোজা আমার দিকে এগিয়ে এল। এমন একটা জানোয়ার, যে বাঘকে তার মড়ি থেকে হটিয়ে দেবার সাহস রাখে, তাকে মারবার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না কিন্তু ওই সগর্জন ভয়াবহতাকে কাছে আসতে দেওয়া পাগলামিরই নামান্তর; সুতরাং সে যখন আমার থেকে কয়েক ফুট দূরত্বের ব্যবধানে, তখনই আমার রাইফেলের বাঁ-নলের বুলেটটা তার কপাল লক্ষ করে ছুঁড়লাম। উপুড় হয়ে পড়ে আস্তে আস্তে সে পিছলে নেমে যেতে থাকল যতক্ষণ না তার কোমরটা অপর পাড়ে আটকাল।
এক মুহূর্ত আগে জঙ্গলে যেখানে ক্রুদ্ধ গর্জন আর ভারি রাইফেলের আওয়াজে উচ্চকিত ছিল, এখন সেখানে গভীর নৈশব্দ্য; আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল, সিগারেট খাবার কথা মনে হল। দু’হাঁটুর ওপর আড়াআড়িভাবে রাইফেলটা রেখে সিগারেট আর দেশলাইয়ের জন্যে দু’হাত দু’পকেটে ঢোকালাম। আর সেইক্ষণেই আমার ডানদিকে কোন চলার শব্দ হল; মাথাটা ঘুরিয়ে দেখলাম, দু-এক মিনিট আগে বাঘটা যে খোলা মাঠটা লাফিয়ে পার হয়ে এসেছিল, এখন সেখান দিয়েই ধীরপদে হাঁটছে আর তাকাচ্ছে তার মৃত শত্রুর দিকে; আমার দিকে নয়।
জানি, ঘটনাগুলো যেমনভাবে ঘটেছে, অবিকল তা বলে গেলে শিকারীরা আমাকে লক্ষ্যভেদে উৎকর্ষতার অভাব ও মারাত্মক অসাবধানীরূপে চিহ্নিত করবেন। লক্ষ্যভেদের উৎকর্ষতা বিষয়ে অভিযোগের বিরুদ্ধে আমার স্বপক্ষে বলার কিছু নেই কিন্তু অসাবধানতার অপরাধ, আমি স্বীকার করতে রাজী নই। যখন বাঘের পিঠ লক্ষ করে গুলি ছুঁড়েছিলাম, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, তাকে মারাত্মক আঘাত করা হয়েছে, আর প্রতিক্রিয়ায় ক্রুদ্ধ গর্জনের পর উন্মাদের মত ছুটে যাওয়ায় এবং অকস্মাৎ সমস্ত শব্দ বন্ধ হওয়ায়, মৃত্যুটা বাঘটার তরফেই ঘটেছে, এমন ধরে নেওয়াই যুক্তিসংগত। আমার দ্বিতীয় গুলিতে ভাল্লুকটা সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল, এ-রকম দেখে, আমি যখন গাছের ওপরে ছিলাম, তখনই রাইফেলটা হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি রাখবার আগে দ্বিতীয়বার গুলি ভর্তি করবার প্রয়োজন বোধ করি নি।
বাঘটাকে জীবন্ত ও আহত অবস্থায় দেখে আমি বিমূঢ় হয়ে দু-এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করলাম আর তারপরেই দ্রুত ব্যবস্থা নিলাম। রাইফেলটা ছিল আন্ডার লেভেল মডেলের; লিভারটা ট্রিগার-গার্ডের সঙ্গে দুটি লাগ দিয়ে জোড়া। ফলে চটপট গুলি ভরা শক্ত আর তার উপর বাকি গুলিগুলো ছিল আমার প্যান্টের পকেটে; দাঁড়ানো অবস্থায় সেখান থেকে গুলি বের করা সহজ কিন্তু একটা সরু ডালের ওপর বসে তা তত সহজ ছিল না। ভাল্লুকটা মৃত, সেটা বাঘের জানা ছিল না, অথবা অকস্মাৎ কোনো আক্রমণ এড়াবার জন্যে সে চোখ রেখেছিল কিনা, এসকলই আমার অজ্ঞাত। যা হ’ক সে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে ধীরপদে এগিয়ে পৌঁছল চল্লিশ গজ দূরের একটা জায়গায়, রাইফেল-তাকের দিকে থেকে যাকে সবচেয়ে ভাল বর্ণনায় বলতে পারি, ইলেন ও-ক্লক (ঘড়ির কাঁটা এগারটার দিকে নির্দেশ করলে যেমন ঈষৎ বাঁয়ে হেলে থাকে, তেমনই); এবং যখন একটা বড় পাথরের চাঙরের ওপর দিয়ে সে চলছিল, তখন মাত্র একটা নলেই গুলি ভরে রাইফেলটা তুলে ধরে গুলি ছুঁড়লাম। গুলিতে সে পিছু হটে এক পাশে কাত হয়ে পড়ে গেল অত্যন্ত বেকায়দায়, তারপরেই হাঁচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়িয়ে শৈলশিখরের পাশ দিয়ে ঘুরপাক খেয়ে লেজ তুলে ছুটে পালাল। নিকেলের আধারে ভরা নরম-মাথা বুলেটটির গোড়াটা ছিল ইস্পাতের; সেটা বাঘটার মুখের কয়েক ইঞ্চি দূরে একটা পাথরে লেগে ফিরে এসে ওর মুখে লাগে আর তাতেই তার ভারসাম্য নষ্ট হয় কিন্তু কোনো ক্ষতি তাতে তার হয় নি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ধূমপান করে আমি হলি গাছটা থেকে নেমে ভাল্লুকটাকে দেখতে গেলাম; আমি প্রথমে এটাকে যত বড় ভেবেছিলাম, আসলে তার চেয়েও বড়। বাঘের সঙ্গে তার স্বেচ্ছাকৃত লড়াই যে সাংঘাতিকই হয়েছে তা বোঝা গেল তার গলার ও অন্যান্য জায়গায় মোটা লোমের আবরণ ভেদ করে বেয়ে পড়া রক্তধারায় আর মাথার খুলির অনেক জায়গাতেই নখের ঘায়ে হাড় পর্যন্ত ছেঁড়াখোঁড়া। ভাল্লুকের মত শক্ত জীবের পক্ষে এ ধরনের আঘাত সামলে নেওয়া কঠিন নয়, কিন্তু নাকের ওপর যে জখমটা হয়েছিল সেটাই ছিল তার পক্ষে চিন্তা এবং রাগের কারণ। সব মরদই নাকের ওপর আঘাত পেলে ক্ষুব্দ হয়; আর ভাল্লুকটা কেবলমাত্র সেই নরম জায়গাটাতে আঘাত পায় নি, তার নাকটা প্রায় দুফালা হয়ে গেছে, জখমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপমানের বেদনা। সুতরাং হত্যার উদগ্র বাসনা চোখে নিয়ে বাঘটার পিছনে ধাওয়া করায় তার পক্ষে আমার ভারি রাইফেলের গুলি ছোঁড়ার শব্দ না পাওয়াই স্বাভাবিক।
ভাল্লুকটার ছাল ছাড়িয়ে নেবার জন্যে আমার লোকজনদের ডেকে পাঠাবার মত যথেষ্ট সময় আমার হাতে ছিল না সুতরাং কুঁড়ে থেকে তাদের ডেকে নিয়ে রাত নামবার আগেই রেস্ট হাউসে ফিরলাম, কারণ মানুষখেকোটা এই অঞ্চলেই আছে। আমার লোকেরা, গ্রামের জানাবার বা তার বেশি লোকজন সেই কুঁড়ে ঘরে জড়ো হয়েছিল; একাগ্রভাবে অপেক্ষা করছিল আমার আসা-পথ চেয়ে এবং যখন আমি তাদের মধ্যে গিয়ে পৌঁছুলাম, তখন তারা বিস্ময়ে নির্বাক। সমবেত লোকগুলো আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে আছে যেন আমি সদ্য মৃত্যুর হাত থেকে ফিরছি; বালা সিং-এর মুখেই প্রথম কথা ফুটল, আর তার মুখ থেকে সব শুনে আমি কিছুমাত্র অবাক হই নি তা ‘কেন’ বলে। আমরা আপনাকে আগেই অনুরোধ করেছিলাম, বালা সিং বলল, ‘মাটির অত কাছাকাছি না বসতে; যখন প্রথম আমরা আপনার চিৎকার শুনলাম এবং পরমুহূর্তে কানে এল বাঘের গর্জন, তখন স্বভাবতই ধরে নিয়েছিলাম যে বাঘটা আপনাকে গাছ থেকে টেনে নামিয়েছে এবং আপনি নিজেকে বাঁচাবার জন্যে বাঘের সঙ্গে লড়ছেন। তারপর যখন বাঘের গর্জন থেমে গেল আর আপনার চিৎকার শোনা যেতে থাকল, তখন ভাবলাম বাঘটা আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পরে আমরা আপনার রাইফেলের দুটো গুলির শব্দ পেলাম এবং পরে তৃতীয়টার; তখন তা আমাদের কাছে বিরাট রহস্যই মনে হল, কারণ একজনকে যখন বাঘ টেনে নিয়ে যাচ্ছে তখন সে কি করে রাইফেল চালাতে পারে তা কিছুতেই আমাদের মাথায় ঢোকে নি। আর যখন আমরা উপস্থিত লোকদের সঙ্গে আমাদের কর্তব্য স্থির করতে ব্যস্ত ছিলাম তখনই আপনি হঠাৎ এসে পড়ে আমাদের মুখ বন্ধ করে দেন। বাঘ মারবার সমস্ত আয়োজনের বিষয় জেনে যারা তার শব্দ সংকেত পাবার জন্যে কান পেতে অপেক্ষা করছে, তাদের পক্ষে সে-উৎকণ্ঠার মধ্যে ভাল্লুকের চিৎকারকে মানুষের চিৎকার ভেবে ভুল করা খুবই সম্ভব কারণ উভয়ের মিলও যথেষ্ট এবং বিশেষ করে দূর থেকে এটির থেকে ওটিকে তফাত করা অসম্ভবই।
আমি যখন লোকদের, তারা যা শুনেছে, সে সমস্ত ঘটনা ও ভাল্লুক মারার কথা বলছিলাম, ততক্ষণে বালা সিং আমার জন্যে এক কাপ চা তৈরি করে ফেলেছে। ভাল্লুকের চর্বি বাতের ওষুধ হিসেবে মহার্ঘ এবং তারা যখন জানল, যে ওটা আমি চাই না আর তারা তা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে পারে, তখন তারা মহাখুশি। পরদিন সকালে আমি যখন ভাল্লুকের ছালটার জন্যে যাত্রা করলাম, তখন আমার সঙ্গে অনেক লোক; তারা কেবলমাত্র চর্বিতেই আগ্রহী নয়, সেই সঙ্গে যে জানোয়ারটা বাঘের সঙ্গে লড়েছে তাকেও দেখতে চায়। আমি কখনও ভাল্লুককে মেপে বা ওজন করে দেখি নি, তবে ওরকম চোখেও পড়েছে কদাচিৎ আর সেদিন সকালে যেটার ছাল ছাড়িয়েছিলাম, সেটার মত বড় এবং মোটা হিমালয়ের ভাল্লুক আমি কখনো দেখি নি। ভাল্লুকের চর্বি আর মূল্যবান অঙ্গগুলো ভাগ হয়ে যেতে সকলেই আনন্দের সঙ্গে দাবিধূরায় ফিরে চলল এবং আমার কাছ থেকে চামড়াটা পেয়ে সবচেয়ে খুশি ও সকলের ঈর্ষার পাত্র হয়ে উঠল বালা সিং; পিঠে সেটাকে বেঁধে গর্বের গর্বিত পদক্ষেপে সেও পা মেলাল।
বাঘটা আর ফিরে আসে নি তার অর্ধসমাপ্ত ভুক্তাবশেষের কাছে; সন্ধ্যার মধ্যেই শকুনের পাল গরু আর ভাল্লুকের হাড়গুলো পরিষ্কার করে ফেলেছিল।
.
০৫.
চর্বিভর্তি একটা ভাল্লুকের ছাল ছাড়ানো খুবই নোংরা কাজ; তাই আমি গরম জলে স্নান সেরে কিছু প্রাতরাশের আকাঙ্ক্ষায় যখন রেস্ট হাউসে ফিরছিলাম, তখনই একজন উত্তেজিত বনরক্ষকের সঙ্গে দেখা; এর সদর দপ্তর দাবিধূরায়। গতরাতে তাকে দূরে টহলে যেতে হয়েছিল; সেখান থেকে দাবিধূরায় ফিরে আজ সকালেই বেনের দোকানে সে শুনেছে আমার ভাল্লুক মারার কথা। তার বাবা কিছুদিন যাবৎ বাতে শয্যাশায়ী, সে কারণেই খানিকটা ভাল্লুকের চর্বির তার ভীষণ প্রয়োজন আর এজন্যেই যখন সে তার একটু ভাগ পাবার আশায় ছুটে আসছিল তখন একপাল ছুটন্ত গরুর মধ্যে গিয়ে পড়ে। এর পেছনে ছুটে আসছিল একটা ছেলে; সে জানাল যে তার একটা গরুকে বাঘে মেরেছে। বাঘ যখন আক্রমণ করে তখন গরুটা যেখানে চরছিল, সে জায়গাটা সম্পর্কে বনরক্ষকের মোটামুটি একটা ধারণা আছে। সুতরাং বালা সিং ও অন্যান্যরা দাবিধূরার দিকে এগিয়ে গেল আর আমি তার সঙ্গে মড়িটাকে খুঁজে বার করবার জন্য যাত্রা করলাম। দুমাইল বা কিছু বেশি চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা এলাম এক ছোট উপত্যকায়। বনরক্ষকটির ধারণা এই উপত্যকাতেই গরুটা মারা পড়েছে।
কিছুদিন আগে আলমোড়ায় গুখা ডিপোতে কিছু অকেজো মালপত্র নিলামে বিক্রি হয় এবং আমার এই সঙ্গীটি সেখান থেকে পায়ের চেয়ে অনেক বড় এক জোড়া আর্মি বুট কিনেছে। ওই গুরুভার পরেই পা টানতে টানতে সে উপত্যকার মুখ পয়ন্ত আমার আগেই এসে পৌঁছেছে। এখানেই আমি তাকে জুতোটা ভোলালাম আর তার পায়ের অবস্থা দেখে আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে, যে লোকটা সমস্ত জীবন খালি পায়ে চলেছে, সে কেবল মাত্র মিথ্যা অহমিকার জন্যে এত কষ্ট সহ্য করেছে। আমি জুতোটা বড়ই কিনেছিলাম’, সে বলে ফেলল, ‘ভেবেছিলাম জুতোটা কুকড়ে ছোট হয়ে যাবে।
বিঘা পনের জায়গা জুড়ে এই নৌকাকৃতির ছোট উপত্যকাটি, মাঝে মাঝে বিরাট ওক গাছ, সব মিলিয়ে একটা চমৎকার পার্কের মত। আমি যেদিকটা দিয়ে নেমেছিলাম, সেদিকটা ধীরে ঢালু হয়ে নেমেছে এবং কোনো ঝোপঝাড় নেই, আর উল্টো দিকটা খাড়া উঠে গেছে ওপরের দিকে, এবং সেখানে রয়েছে কিছু কিছু ঝোপঝাড়। উপত্যকার মুখে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট ধরে সমস্ত জায়গাটা আঁতিপাতি করে দেখে নিলাম এবং কোনোরকম সন্দেহজনক কিছুই না পেয়ে আমি ঢালু ঘাসে ঢাকা পথ ধরে নিচে নামতে থাকলাম আর আমার পেছনে এখন খালি পায়ে আসছে। বনরক্ষকটি। উপত্যকার তলদেশের সমতল ভূমিতে দেখতে পেলাম অনেকখানি জায়গা থেকে শুকনো পাতা আর ডালপালা আঁচড়ে আঁচড়ে একজায়গায় এনে জড়ো করে একটা বড় ঢিবি করা হয়েছে। যদিও এখানে গরুটার শরীরের কোনো অংশই দেখা যাচ্ছিল না, তথাপি আমি জানতাম যে, ওই মরা পাতা ডালের তূপের নিচে বাঘ মড়িটাকে লুকিয়ে রেখেছে এবং আমি খুবই নির্বোধের মত ঘটনাটা আমার সঙ্গীকে জানতে দিলাম না; পরে সে আমায় জানিয়েছিল যে বাঘেদের এই মড়ি লুকিয়ে রাখার ব্যাপারটি তার জানাশোনার বাইরে। যখন বাঘ এভাবে তার মড়ি লুকিয়ে রাখে তখন সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায় যে সে তার কাছাকাছি কোথাও নেই; কিন্তু সর্বদা এরকম ধরে নেওয়া নিরাপদ নয়। একারণেই এ-উপত্যকায় নামার আগে জায়গাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলাম। এখন আরো একবার দেখে নেবার জন্যে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম।
স্তূপীকৃত পাতা ও ডালপালার অদূরে পাহাড়টা উঠে গেছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ রচনা করে আর চল্লিশ গজ ওপরে পাহাড়ের গায়ে গাছগাছড়ার ছোট ঝোঁপজঙ্গল। এটার দিকে তাকাতেই আমার চোখে পড়ল বাঘটা; একটুকরো চাতাল জমির ওপরে সে শুয়েছিল, পা দুটো আমার দিকে রেখে; এখন সে ঘুরে বসাতে পেছন দিকটা আমার সামনে। আমি তার মাথার একটা অংশ এবং ঘাড় থেকে পেছনের পা পর্যন্ত তিন ইঞ্চি চওড়া ডোরা দাগ দেখতে পাচ্ছিলাম। মাথায় গুলি করবার প্রশ্নই ওঠে না আর গায়ে গুলি করলে একমাত্র ক্ষত ছাড়া কোনোই লাভ হবে না। আমার হাতে এখনো পুরো বিকেল আর সন্ধেটা রয়েছে আর বাঘটাকে এখন বা একটু পরে যখনই হ’ক উঠে দাঁড়াতেই হবে; সুতরাং বসে থেকে অপেক্ষা করাই স্থির করলাম। এই সিদ্ধান্তে আসবার পরমুহূর্তেই আমি আমার বাঁ-দিকে একটা চলাফেরার শব্দ পেলাম; মাথা ফিরিয়েই দেখলাম একটা ভাল্লুক তার দুটো ছোট বাচ্চাকে নিয়ে নিঃশব্দে পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে মড়িটার দিকে। ভাল্লুকটা নিশ্চয়ই বাঘের গরু মারার ঘটনাটা জানতে পেরেছে আর সেকারণে যেমন আমিও দিয়ে থাকি বাঘটাকে নিশ্চিন্ত হবার মত কিছু সময় দিয়ে, সে এখন এসেছে ব্যাপারটা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে; অন্যথায় বিশেষ কারণ ছাড়া ভরদুপুরে ভালুকরা চলাফেরা করে না। যদি আমি মড়িটার কয়েক ফুটের মধ্যে না থেকে উপত্যকার মুখটায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, আমি নিশ্চিত যে, তাহলে এক অতি চমৎকার দৃশ্য দেখতে পেতাম; কারণ গন্ধের আশ্চর্য বোধে ভাল্লুকরা অনায়াসেই সন্ধান পেয়ে যেত মড়িটার আর সেটাকে টেনে বের করেও ফেলত। আর এরই ফলে বাঘটাও জেগে উঠত এবং কল্পনা করাও যায় না যে, বিনা লড়াইয়ে সে মড়িটাকে ছেড়ে দিত; সুতরাং লড়াইটা হত দেখার মত।
বনরক্ষক এতক্ষণ নিজের পায়ের তলার মাটির দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিল, এখন হঠাৎ ভাল্লুকটাকে দেখে সে বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল, ‘দেখো সাহিব, ভালু, ভালু’। বাঘটা উঠে দাঁড়িয়ে নিমেষে সরে গেল; কিন্তু তাকে প্রায় কুড়ি গজ খোলা মাঠের ওপর দিয়ে যেতে হবে; তাই আমার রাইফেলের নিশানার মধ্যে সে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রিগার টিপলাম, কিন্তু সেই মুহূর্তেই বনরক্ষকটি আমি ভুল নিশানা করেছি এই ধারণা থেকে আমার হাত জড়িয়ে ধরে একটা প্রবল ঝকানি দিল আর তারই ফলে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তা থেকে কয়েক গজ দূরে একটা গাছে গিয়ে বুলেটটা বিঁধল। রেগে গিয়ে কোথাও কোনো লাভ হয় না, বিশেষ করে জঙ্গলে। বনরক্ষক জানত না যে ওই উঁচু করা পাতার ঢিবিটার অর্থ কি, আর সে বাঘটাকেও দেখে নি, সুতরাং সে তখনও ধারণায় বদ্ধমূল ছিল যে ভয়াবহ ভালুকগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে আমার প্রাণরক্ষা করেছে; অতএব বলার কিছুই নেই। আমার গুলিতে ভয় পেয়ে ভালুকগুলো যখন পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন সঙ্গীটি আমাকে ধরা গলায় উৎসাহিত করছিল, ‘মারো, মারো, মারো’ বলে।
বনরক্ষকটি যখন অত্যন্ত মনমরা হয়ে দাবিধূরায় ফিরছিল, তখন তাকে কিঞ্চিৎ উৎসাহিত করবার জন্যে আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে এখানে কোথাও ঘুরাল’ মারতে পারা যায় কিনা, কারণ আমার লোকজনদের এখনো মাংস জোটে নি। এই ছোট্ট মানুষটি কেবল যে সে-সংবাদই রাখত তাই নয়, সেই সঙ্গে সে তার পায়ের ফোস্কাজনিত কষ্ট সহ্য করেও আমাকে নিয়ে যেতে রাজী হল। অতএব এক কাপ চা খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল, সঙ্গে দুজন লোক; বনরক্ষকের কথামত থলে বয়ে আনবার জনে এদের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য।
রেস্ট হাউসের বারান্দা থেকেই পাহাড়টা খাড়া নেমে গেছে। বনরক্ষকের নেতৃত্বে এই পাহাড় বেয়ে কয়েকশো গজ নেমে যেতেই পাহাড়ের মুখোমুখি ফুট খানেক চওড়া ‘ঘুরালে’র যাতায়াতের পথের ওপরে পৌঁছালাম। এখন আমিই আগে আগে চলতে থাকলাম আর এভাবে প্রায় আধমাইল দক্ষিণে চলার পর এক শৈলশিরায় উঠে আড়াআড়িভাবে এক গভীর গিরিখাতের দিকে তাকিয়ে একটা ‘ঘুরাল’কে দেখলাম; খাতের অন্যপাশে একটা খাড়াই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে আছে; এই অভ্যেসটা ছাগল জাতীয় প্রাণী যথা থর, আইবেক্স এবং মারকর সবারই আছে। গলার সাদা চক্করের মতো দাগ দেখেই মনে হল যে এটা পুরুষ ‘ঘুরাল। আমাদের মধ্যে দূরত্বের ব্যবধান দু’শো গজেরও কিছু বেশি। এখন আমি কেবলমাত্র আমার লোকজনদের জন্যে মাংস নেব তাই নয়, সেই সঙ্গে আমার নতুন রাইফেলটার, কার্যক্ষমতাও পরীক্ষিত হবে। সুতরাং শুয়ে পড়ে, দু’শো গজের নিশানা ঠিক করে, ঠিকমত নির্দিষ্ট লক্ষে গুলি ছুড়লাম। গুলি লেগে ঘুরালটা যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়েছিল সেখানেই পড়ে গেল; সৌভাগ্য যে ঠিক নিচেকার কয়েকশো ফুট গভীর খাতে পড়ে নি। অন্য একটা ‘ঘুরাল’, যাকে এতক্ষণ দেখতে পাই নি, তখুনি খাতের অন্য দিক থেকে একটা ছোট বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে এল, তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কয়েকবার দেখে নিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলে গেল।
বনরক্ষক এবং আমি সিগারেট ধরিয়ে সঙ্গের, দুজনকে পাঠালাম থলিটায় শিকার। ভরে আনতে। ভাল্লুকের চর্বির ভাগ থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও বনরক্ষককে ‘ঘুরালে’র চামড়া ও কিছুটা মাংস দেওয়া হবে জেনে সে বেশ খুশি হল; সে বলল যে, চামড়া দিয়ে সে তার বাবার জন্যে একটা আসন করে দেবে, কারণ বার্ধক্য আর বাতের জন্যে তাকে সারাদিন রোদে পড়ে থাকতে হয়।
.
০৬.
পরদিন ভোরে উপত্যকায় পৌঁছে আমার সন্দেহই সত্য তার প্রমাণ পেলাম; বাঘটা আর তার মড়ির কাছে ফিরে আসবে না। কিন্তু আসবে ভাল্লুকরা। তিনটে ভাল্লুক মিলে কয়েকটা হাড় ছাড়া কিছুই ফেলে যায় নি; আর সেই ভুক্তাবশেষের মধ্যেও একাকী রাজা শকুন সযত্নে খুঁজছে আহার্য।
তখনো বেলা বাড়ে নি; বাঘটা যে পথে আগের দিন গেছে, সেই পথে পাহাড়ে উঠে, শৈলশিরা ধরে এগিয়ে লোহারঘাট রোড বরাবর নেমে গেলাম, মানুষখেকো চিতাটা কোন পথে গেছে তার অনুসন্ধানে। দুপুরে রেস্ট হাউসে ফিরতেই বাঘের অন্য একটা শিকারের খবর পেলাম। আমার সংবাদদাতা একজন বুদ্ধিমান যুবক; সে আলমোড়ায় একটা মামলার হাজিরা দেবার জন্যে যাচ্ছিল এবং তার হাতে সময় না থাকায়, বাঘটাকে যেখানে গরু মারতে দেখেছিল, সেখানে আমার সঙ্গে যেতে পারল না; বারান্দায় মেঝেতে কাঠকয়লা দিয়ে এঁকে জায়গাটা কোথায়, তা বুঝিয়ে দিয়ে গেল। সকালের আর দুপুরের খাওয়া একসঙ্গে সেরে আমি মড়িটাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। যুবকটির আঁকা স্কেচটা যদি ঠিক ঠিক হয়, তবে গতকাল আমি যেখানে বাঘটাকে গুলি করেছিলাম, এ-জায়গাটা তা থেকে মাইল পাঁচেকের মধ্যেই হবে। সেখানে পৌঁছে দেখলাম যে বাঘটা মূল উপত্যকা বরাবর নদী ধরে এসে নদীর ধারে যে গরুগুলো চরছিল, তাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে; নরম মাটির অবস্থা দেখে বোঝা যায় বাঘটা যে গরুটা বাছাই করেছিল তাকে কাবু করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। একটা ছ’শো থেকে সাতশো পাউন্ড ওজনের বিরাট ও শক্তিশালী জন্তুকে মারা খুবই কষ্টসাধ্য আর বাঘকে এই জাতীয় পরিশ্রমের পর দম নিতে হয়। এবারে অবশ্য, বাঘটা, মারবার পরই গরুটাকে তুলে নিয়ে গেছে; রক্তের চিহ্ন না থাকায় তাই বুঝিয়ে দিচ্ছে এবং নদী পার হয়ে ও পাহাড়ের নিচে গভীর জঙ্গলে ঢুকেছে।
গতকাল বাঘটা যেখানে মেরেছিল, সেখানেই তার মড়িটাকে ঢেকে রেখেছিল; কিন্তু আজ দেখা গেল মড়িটাকে মারবার জায়গা থেকে যতদূর সম্ভব দূরে সরিয়ে নেওয়াই হল তার উদ্দেশ্য। গরুটাকে যে পথে টেনে নিয়ে গেছে তারই অনুসরণে আমি প্রায় দু’মাইল বা তারও বেশি ঘন বনের মধ্যে দিয়ে খাড়াই পাহাড় বেয়ে উঠে গেলাম। পাহাড়ের মাথায় প্রায় দুশো গজ নিচে দুটো ওক গাছের চারার মধ্যে গরুটার পেছনের একটা পা দেখি আটকে আছে; পা-টা দুটো গাছের মধ্যে আটকানো অবস্থায় ফেলে গেছে। পাহাড়ের মাথাটায়, যেখানে বাঘটা তার মড়ি নিয়ে উঠে এসেছে, সেই সমতলে দু বা তিন ফুট জায়গা জুড়ে বেড়ে উঠেছে ওকের বনানী। এই গাছগুলোর নিচে কোনো ঝোপঝাড় বা লুকোবার জায়গা নেই; বাঘটা কোনো রকম লুকোবার চেষ্টা না করেই এখানে মড়িটাকে ফেলে রেখে গেছে।
শুধুমাত্র আমার রাইফেলটা আর সামান্য কয়েকটা কার্তুজ সঙ্গে নিয়ে আমি আস্তে আস্তে, হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবার দাগ অনুসরণ করে এসেছি। তা সত্ত্বেও যখন আমি পাহাড়টার মাথায় পৌঁছালাম তখন আমার জামা ভিজে গেছে ঘামে আর গলা শুকনো। এ-কারণেই আমি অনুমান করতে পারি যে বাঘটার কি পরিমাণ তেষ্টা পেয়েছিল এবং তা মেটাতে আগ্রহ জেগেছিল। আমার নিজেরও তেষ্টা মেটাবার প্রয়োজন, তাই কাছাকাছি কোথাও জলের সন্ধানে বেরুলাম, জানতাম, সেখানে বাঘের সন্ধান পাবার সম্ভাবনা আছে। যে খাতে আমি ভাল্লুক মেরেছিলাম, সেটা ডানদিকে আধ মাইল দূরের আর সেখানে জলও আছে; কিন্তু বাঁ-দিকে কাছাকাছি আর একটা খাত আছে, সেখানেই প্রথম চেষ্টা করা স্থির করলাম।
আমি খালটা ধরে আধমাইলেরও বেশি নেমে গিয়ে যে জায়গায় এলাম, সেখানে খাদটা সরু হয়ে দুধারে খাড়াই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। একটা প্রকাণ্ড শিলাখণ্ড ঘুরে যেতেই দেখি আমার সামনেই বিশ গজ দূরে বাঘটা শুয়ে আছে। এখানে একটা ছোট জলা বর্তমান এবং ওই জলা ও দক্ষিণদিকের পাড়ের মাঝখানে সংকীর্ণ বালির চড়ার ওপরে ছিল বাঘটা। খাদটা এখানে সরাসরি ডান দিকে বেঁকে গেছে, এবং বাঘটার একাংশ ছিল আমার দিকের বাঁকে আর অন্য অংশ ওধারে বেঁকে। জলাটার দিকে পেছন ফিরে সে বাঁ কাতে শুয়েছিল; আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তার লেজ ও পেছনের পায়ের অংশবিশেষ। আমার আর ঘুমন্ত জানোয়ারের মধ্যে, পড়ে আছে একগাদা শুকনো ডালপালা। কিছুদিন আগে মোষকে খাওয়াবার জন্যে ওপরের গাছ থেকে এগুলো পাড়া হয়েছিল। কোনো শব্দ না করে এই বাধা অতিক্রম করে যাওয়া যেমন দুঃসাধ্য, নুড়ি পাথরের ছোট ছোট ধস না নামিয়ে দুধারের কোনো একটা খাড়াই ধরে যাওয়া তেমনি অসম্ভব। সুতরাং বাঘটা যতক্ষণ না আমাকে গুলি করতে সুযোগ দেয় ততক্ষণ বসে থাকাই ছিল একমাত্র পন্থা।
কঠিন পরিশ্রমের পর প্রাণভরে জল খেয়ে বাঘটা নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল আর আধঘণ্টার মধ্যে সে কিছুমাত্র নড়াচড়া করে নি। তারপর সে ডানদিকে ফিরে শুতেই তার পায়ের আরো খানিকটা অংশ নজরে আসে। এইভাবেই কয়েকমিনিট শুয়ে থেকে সে উঠে দাঁড়াল আর বাঁকটা থেকে সরে গেল। ট্রিগারে আঙুল লাগিয়ে আমি সে আবার দেখা দেবে বলে বসে রইলাম, কারণ তার মড়িটা রয়েছে আমারই পেছনে পাহাড়ের ওপরে। মিনিট খানেক কেটে যেতেই শুনলাম প্রায় একশো গজ দুরে একটা কাকার পরিত্রাহি চিৎকারে পাহাড় কাঁপিয়ে চলে গেল আর তার কিছু পরেই একটা সম্বর উঠল ডেকে। বাঘটা চলে গিয়েছিল; কিন্তু কেন জানি না; কারণ একটা বাঘের যতটা দৈহিক পরিশ্রমের প্রয়োজন, ততটা সে করেছে আর আমার গন্ধ যে পেয়েছিল, তাও নয়, কারণ বাঘের কোনো ঘ্রাণশক্তি থাকে না। যা হক, এটা নিয়ে এখন ভাবার কারণ নেই, কারণ বাঘটা যখন তার মড়িকে পাহাড়ের মাথায় টেনে তুলতে এত কষ্ট করেছে, তখন সে মড়ির কাছে ফিরবেই আর আমি তাকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে সেখানে হাজির থাকব। বাঘটা যে জলা থেকে জল পান করেছিল তা বরফ ঠাণ্ডা; আর আমিও তৃষ্ণা মিটিয়ে, অনেকক্ষণ থামিয়ে রাখা ধূমপানের আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছিলাম।
মড়িটার দক্ষিণে, দশ গজ পূবে একটা ওক গাছের ওপর আমি যখন আরামে বসলাম তখন সূর্য প্রায় অস্তাচলে। বাঘটা পশ্চিম দিক থেকে পাহাড়ে উঠে আসবে এবং বাঘ ও আমার মাঝখানে সরাসরি মড়িটাকে রাখা সুবিবেচনার পরিচয় নয় কারণ বাঘের দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। গাছের ওপরে আমার বসবার জায়গাটা থেকে পরিষ্কারভাবে আমি উপত্যকাটা দেখতে পাচ্ছিলাম এবং ওপারে পাহাড়টাও। আর যখন আগুনের গোলার মত অস্তগামী সূর্য পৃথিবীর কিনারায় বসে পৃথিবীকে রক্তরঙে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল ঠিক তখনই একটা সম্বর আমার নিচে উপত্যকার দিক থেকে ডেকে উঠল। বাঘটা এবার চলতে শুরু করেছিল; মড়ির কাছে পৌঁছতে তার অনেকটা সময় লাগবে আর তখনো নির্ভুলভাবে গুলি করবার মত যথেষ্ট আলো থাকবে।
অগ্নিগোলক দিকচক্রবালের নিচে নেমে গেল; পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল আভা; গোধূলি ছেড়ে দিল অন্ধকারের জন্যে পথ; আর নিস্তব্ধ হয়ে গেল জঙ্গলের সমস্ত কিছু। চাঁদ ছিল তৃতীয় কলায়, কিন্তু হিমালয়ে যেহেতু তারার আলো সর্বাধিক উজ্জ্বল, সেহেতু অজস্র আলোয় মড়ির সাদা রংও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। মড়ির মাথাটা ছিল আমার দিকে; এখন যদি বাঘটা আসে আর পায়ের দিক থেকে খেতে আরম্ভ করে, আমি তাকে দেখতে পাব না; কিন্তু আমি যদি সাদা গরুটার দিকে কাত হয়ে বন্দুক তুলে ট্রিগার টিপি, যেহেতু মড়িটা আমার দৃষ্টির অগোচর, সেকারণেই বাঘের গায়ে গুলি লাগবার সম্ভাবনা আধাআধি। কিন্তু এটা কোনো নরখাদক নয় যে, যে-কোনো অবস্থাতেই গুলি করা যায়। এই মন্দিরের বাঘটি কোনো মানুষকে জখম করে নি; আর যদিও সে পরপর চারদিন চারটে গরু মেরেছে, তবু জঙ্গলের আইনের রীতিবিরুদ্ধ কোনো অপরাধই সে করে নি। বাঘটাকে একেবারে খতম করে ফেললে, যাদের গরু নিহত হয়েছে তারা হয়তো উপকৃত হবে; কিন্তু রাত্রে অনিশ্চিতভাবে গুলি চালালে তার আহত হবার সম্ভাবনাই থাকে শুধু। আহতকে ফেলে রেখে আসতে হয় আর সে যন্ত্রণা ভোগ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যদি বে-তল্লাসী ছেড়ে আসা হয়, পরিণামে সে ‘মানুষখেকো হয়, তাই কোনো পরিস্থিতিতেই এ কাজ ন্যায়সংগত হয় না।
পূবে আলো ফুটছিল, কেননা গাছের গুঁড়িগুলো অস্পষ্ট ছায়া ছড়াতে শুরু করছিল আর তারপর, উন্মুক্ত অরণ্য খণ্ডগুলিতে জ্যোৎস্নার বান ডাকিয়ে চাঁদ উঠল। তখন, সেই সময়ে বাঘ এল। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু জানছিলাম বাঘ এসেছে কেননা আঁচ করতে পারছিলাম, অনুভবে জানছিলাম তার উপস্থিতি। পাহাড়ের মাথার কিনারার ওপরে শুধু চোখ দুটি আর মাথার ওপরটা জাগিয়ে মড়ির ওপাশে দুরে গুঁড়ি মেরে বসে ও কি আমাকে লক্ষ করছে? না, তা সম্ভব নয়। কেননা যখন থেকে স্ব-স্থানে আরাম করে গুছিয়ে বসেছি, তখন থেকেই আমি গাছের সঙ্গে এক হয়ে আছি আর জঙ্গলে বাঘরা যে গাছের কাছে যায়, কোনো কারণ না থাকলে তার প্রতিটি খুঁটিয়ে দেখে না। আর তবুও বাঘটা এখন এখানে, আমার দিকে চেয়ে আছে।
আমার স্পষ্ট দেখার মত যথেষ্ট আলো এখন ফুটেছে, এবং অত্যন্ত হুঁশিয়ার হয়ে আমার সামনের জমিটি খুঁটিয়ে দেখলাম। তারপর, পেছনে চেয়ে দেখব বলে যেমন ডানদিকে মাথা ফিরিয়েছি, দেখলাম বাঘ। মড়ির মুখোমুখি এক খণ্ড চাঁদের আলোয় বসে আছে ও দাবনায় ভর দিয়ে, মাথা ফিরিয়ে, আমার দিকে চেয়ে। আমি নিচে ওর দিকে চেয়ে আছি দেখল যখন, ও কানদুটো ছড়াল। যখন আমি আর নড়াচড়া করলাম না, কানদুটো আগের মত খাড়া হয়ে গেল। আমি কল্পনা করতে পারলাম ওর স্বগতোক্তি ‘বেশ, এখন তো আমাকে দেখে ফেলেছ। এখন কি করতে চাও সে বিষয়ে?’ অতি সামান্যই সাধ্য ছিল আমার কেননা গুলি ছুঁড়তে হলেও আমাকে অর্ধচক্রাকারে ঘুরে যেতে হয় এবং বাঘটিকে ঘাবড়ে না দিলে তা করা সম্ভব নয়, ও পনের ফুট তফাত পাল্লা থেকে আমার দিকে চেয়ে আছে। তবে আমার বাঁ কাঁধ থেকে একটি গুলি মারবার একটি সম্ভাব্য সুযোগ মাত্র আছে এবং তাই করাই স্থির করলাম আমি। রাইফেলটা রাখা ছিল আমার হাঁটুতে, নলের মুখ ছিল বাঁ দিকে তাক-করা। যেমন ওটা তুলে ডানদিকে ঘোরাতে শুরু করেছি, বাঘটা মাথা নামিয়ে নিয়ে আবার কান দুটো ছড়াল। আমি যতক্ষণ নিশ্চল থাকলাম, ও ওই ভাবেই থেকে গেল কিন্তু যে মুহূর্তে আবার আমি রাইফেল ঘোরাতে শুরু করেছি, ও উঠে পড়ল, পেছনের ছায়ায় ঢুকে গেল।
বাস্ এই তো ঘটনা, বাঘটা আর একবার নিশ্চিতভাবে জিতে গেল। যতক্ষণ আমি গাছে বসে থাকব, সে আর আসবে না, কিন্তু যদি আমি চলে যাই সে হয়তো ফিরে মড়িটাকে সরিয়ে নিতে পারে; আর পুরো গরুটাকে যখন সে একরাতে শেষ করতে পারবে না, তখন পরের দিন হয়তো আর একটা সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।
এখন আমার সামনে প্রশ্ন হল রাতটা কোথায় কাটাই। ইতিমধ্যে এই দিনে আমি কুড়ি মাইলের মত রাস্তা হেঁটেছি; এখন আবার বনের মধ্যে দিয়ে কুড়ি মাইল হেঁটে রেস্ট হাউসে পৌঁছবার চিন্তা আমাকে উৎসাহিত করল না। অন্য কোনো জায়গা হলে আমি মড়ি থেকে দু’তিনশো গজ দূরে চলে গিয়ে নিশ্চিন্তে মাটিতে ঘুমোতে পারতাম; কিন্তু এই অঞ্চলটাতে রয়েছে একটা মানুষখেকো চিতা এবং মানুষখেকো চিতারা রাত্রেই শিকার করে। সন্ধেবেলায় গাছের ওপরে বসে থাকার সময়েই দূর থেকে ভেসে আসা গরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজ পেয়েছিলাম; হয় কোনো গ্রাম বা কোনো বাথান থেকে সে শব্দটা আসছিল। আমি শব্দটার সঠিক হদিশ রেখেছিলাম; এখন কোথা থেকে তা আসছিল তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। হিমালয়-অঞ্চলে গরুচুরির ব্যাপারটা অজানা, এবং কুমায়ুনের সর্বত্র গরুচরাবার মাঠের কাছেই জঙ্গল থাকে সার্বজনীন বাথান। শ্রুত ঘণ্টাধ্বনির অনুসন্ধানে আমি এরকম একটা বাথানই পেয়ে গেলাম; একটা ভোলা জায়গার চারপাশে শক্ত বেড়া দিয়ে ঘিরে শ’খানেক গরু রাখা। জঙ্গলের গভীরে এরকম একটা অরক্ষিত বাথান পাহাড়ী মানুষদের সতোরই প্রমাণ দেয়। তাছাড়া এটিও প্রমাণ হয়ে গেছে যে আমি আসার আগে পর্যন্ত দাবিধূরা এলাকায় গরু কখনো বাঘের হাতে উৎপীড়িত হয় নি।
রাত্রে জঙ্গলের সমস্ত পশুই সন্দেহপ্রবণ, আর যদি আমি রাত্রে এই বাথানের বাসিন্দাদের আশ্রয়ে রাত কাটাতে চাই, তবে তাদের সহজাত সন্দেহকে কাটাতে হবে। কালাধুঙ্গিতে আমাদের গাঁয়ের প্রজারা প্রায় ন’শ গরু-মোষ রাখত, আর খুব ছোটবেলা থেকে সেই গরু-মোষের কাছাকাছি থাকায়, তারা কি ভাষা বোঝে আমি জানি। ধীরপদে হাঁটতে হাঁটতে এবং পশুদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি বাথানের দিকে এগোলাম, আর বেড়ার ধারে পৌঁছে সেদিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে পড়লাম ধূমপানের জন্যে। আমি যে-জায়গাটায় বসেছিলাম, তার কাছেই কতকগুলো গরু দাঁড়িয়ে ছিল; তার মধ্যে থেকে একটা এগিয়ে এসে খুঁটোর ঘেরের বেড়ার মধ্যে দিয়ে মাথাটা বের করে আমার মাথার পেছনটা চাটতে আরম্ভ করল। আচরণটি বন্ধুজনোচিত, তবে তা ভিজিয়ে দিচ্ছেও বটে আর এখানে এই আট হাজার ফুট উচ্চতায় রাত্রিগুলি তুহিন। আমার সিগারেট শেষ করে রাইফেলের তার নামালাম আর সেটা খড়ে ঢেকে বেড়া টপকালাম।
সাবধানে ঘুমোবার জায়গা বাছাইকরা দরকার হয়েছিল, কেন না রাতে যদি কোনো বিপদ ঘটে আর জন্তুগুলো হুড়োহুড়ি করতে শুরু করে, সে অবস্থায় বাথানের মধ্যে মাটিতে শুয়ে থাকা বিপজ্জনক হবে। বাথানের চালার প্রায় মাঝামাঝি, যেটা দিয়ে প্রয়োজনে আমি উপরে উঠে যেতে পারি, এমন একটা খুঁটির কাছেই, দুটো ঘুমন্ত গরুর মাঝখানে একটু খালি জায়গা ছিল। কাত হয়ে শুয়ে থাকা পশুগুলোকো ডিঙিয়ে এবং দাঁড়ানো গরুগুলোর মাথা সরিয়ে পেরিয়ে এসে, পরস্পর পেছনে দিকে ফিরে শুয়ে থাকা দুটোর মাঝখানে শুয়ে পড়লাম। সমস্ত রাত কোনো বিপদের আভাস ছিল না, সুতরাং খুঁটি বেয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তার কথাই ওঠে না; গরুগুলোর গরম শরীর রাত্রের ঠান্ডা আটকাল, আর স্বাস্থ্যবান দলটির স্নিগ্ধ মধুর গন্ধে আমি ঘুমোলাম পৃথিবীতে অপার শান্তি নিয়ে; বাঘ এবং মানুষখেকো চিতাও তার বহির্ভূত নয়।
পরদিন সকালে তখন সবে সূর্য উঠছে; গলার স্বর শুনে জেগে উঠে দেখলাম তিনজন লোক, হাতে তাদের দুধ দুইবার বালতি, বেড়ার খুঁটির ফাঁক দিয়ে আমার দিকে বিস্ময়ে চেয়ে আছে। গতকাল প্রাতরাশের পর একমাত্র বাঘের জলার জলপান ছাড়া অন্য কিছুই আমার গলা দিয়ে নামে নি; গরুগুলির মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে আবিষ্কার করার বিস্ময়টা কেটে যেতেই লোকগুলো আমাকে গরম দুধ খেতে দিল আর আমি তা সাদরে গ্রহণ করলাম। তাদের সঙ্গে তাদের গ্রামে গিয়ে খাওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে, বাসস্থান ও পানীয়ের জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে, স্নান ও আহারের জন্যে রেস্ট হাউসে ফিরে যাওয়ার আগে, মড়িটাকে বাঘটা কোথায় নিয়ে গেল দেখতে বেরুলাম। সবিস্ময়ে দেখলাম, আমি যেখানে ফেলে গিয়েছিলাম, মড়িটা সেখানেই রয়েছে; শকুন ও সোনালী মাথা ঈগলদের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যে আমি সেটাকে ডালপালা দিয়ে ঢাকা দিয়ে, রেস্ট হাউসে ফিরে গেলাম।
মনে হয়, ভারতে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও ভৃত্যেরা তাদের প্রভুদের খেয়ালীপনাকে এ-পরিমাণ সহ্য করে না। চব্বিশ ঘন্টার পরে যখন রেস্ট হাউসে ফিরলাম, কোনো বিস্ময় বা কোনো প্রশ্ন উচ্চারিত হল না। স্নানের গরম জল তৈরি, পরিষ্কার জামাকাপড় বের করে রাখা; আর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমি পরিজ, ডিমের স্ক্র্যাম্বেল, গরম চাপাটি ও মধু এবং এক পেয়ালা চা নিয়ে প্রাতরাশে বসে পড়লাম; মধুটি বৃদ্ধ পুরোহিতের.উপহার। প্রাতরাশ শেষ করে আমি রেস্ট হাউসের সামনের ঘাসের ওপর বসে পড়লাম অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ এবং পরিকল্পনা করতে। নৈনিতালে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে আর সেই একটিমাত্র উদ্দেশ্য হল চিতাটাকে মারতে চেষ্টা করা; আর মন্দিরের চাতাল থেকে যে-রাত্রে সে রাখালটাকে টেনে নেবার চেষ্টা করেছিল, তারপর থেকে তার সম্পর্কে আর কিছুই শোনা যায় নি। পুরোহিত, বেনিয়া আর নিকট ও দূরের গ্রামের সমস্ত লোককে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি যে কখনও কখনও দীর্ঘকাল মানুষখেকোটা যেন পৃথিবী থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর তাদের ধারণায় এখন এসেছে সেই কাল কিন্তু কেউই বলতে পারে নি যে কতদিন এইকাল স্থায়ী হবে। যে-এলাকায় এই মানুষখেকোটা বিচরণ করত, সেটা বিস্তীর্ণ এবং সম্ভবত এখানে আরো দশ-কুড়িটা চিতা বর্তমান। সেই এলাকায় একটি বিশেষ চিতাকে, যে মানুষ মারা বন্ধ করেছে, কোথায় খুঁজতে হবে না জেনে, খুঁজে বার করে গুলি করার আশা অত্যন্ত কম।
মানুষখেকো প্রসঙ্গে আমার অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল; দাবিধুরায় আমি আরো বেশি দিন থাকলে কোনো প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। মন্দিরের বাঘের প্রশ্নটি থেকেই গেল। এই বাঘটিকে মারবার বিন্দুমাত্র দায়িত্ব আমার আছে বলে আমি মনে করি না; কিন্তু ভাবি এবং বেশ গভীরভাবেই ভেবেছিলাম যে আমার তাকে অনুসরণই, তাকে বেশি করে গরু মারতে উস্কানি দিয়েছিল, অন্যথায় সে এটা করত না। আমার দাবিধূরায় পদার্পণের দিনই কেন একটা পুরুষ বাঘ গরু মারতে আরম্ভ করেছিল তা বলা সম্ভব নয় আর আমি চলে গেলে সে থামবে কিনা তাও দেখা দরকার। যাই হক, তাকে মারবার চেষ্টা আমি সর্বান্তকরণে করেছিলাম; তার কৃত ক্ষয়-ক্ষতির জন্যে, আমার আর্থিক সামর্থ্যানুযায়ী ক্ষতিপূরণও দিয়েছি; আর সে আমাকে দিয়েছে সব চেয়ে চিত্তাকর্ষক এক জঙ্গলের অভিজ্ঞতা, যা আমার ইতিপূর্বে ছিল না। সুতরাং গত চারদিনে আমরা যে উত্তেজনায় খেলা খেলেছি এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রে আমার পরাজয় ঘটেছে, তার জন্যে তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। এই চারদিন আমার চুড়ান্ত পরিশ্রমে কেটেছে; সুতরাং আজ বিশ্রাম নিয়ে কাল সকাল সকালই নৈনিতালে ফেরার পথে রওনা হব। সবেমাত্র এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, এমন সময় শুনলাম পেছন থেকে এক কণ্ঠস্বর, ‘সেলাম সাহেব, কাল বাঘটা আমার একটা গরু মেরেছে, এই খবরটা তোমাকে দিতে এলাম। বাঘটা মারবার আর একটা সুযোগ, কিন্তু আমি সার্থক হই বা না হই, কাল সকালে আমার যাত্রার পরিকল্পনায় স্থিরই রইলাম।
.
০৭.
মানুষ আর ভাল্লুকের হস্তক্ষেপে বিরক্ত হয়ে বাঘটা ঠাই বদল করেছে; গতকাল সন্ধ্যায় আমি তার জন্যে যেখানে বসেছিলাম, সেখান থেকে কয়েক মাইল দূরে দাবিধুরা পর্বতের পূর্বদিকে এই শেষ হত্যাটি সংঘটিত হয়েছে। জমিটা এখানে অসমান, মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়, এলোমেলো ছড়ানো কয়েকটা গাছ; চুকরদের (পাহাড়ী চড়াই পাখি) পক্ষে আদর্শ স্থান, কিন্তু বাঘের খোঁজ পাওয়া এখানে, আমার ধারণা, একেবারেই অকল্পনীয়।
পাহাড়ের মুখে আড়াআড়িভাবে রয়েছে একটা অগভীর নাবাল জমি। ঘন ঝোঁপঝাড়ের সার আর জায়গায় জায়গায় ছোট ঘাসের টুকরো রয়েছে এই জমিটায়। এইগুলোর মধ্যে একটা ঝোপের কিনারে গরুটাকে মারা হয়েছে, তারপর ঝোপের দিকে কয়েক গজ টেনে নিয়ে গিয়ে ভোলা জায়গায় ফেলে রাখা আছে। বিপরীত দিকে অথবা মড়িটার মাঠের ধারের পাহাড়ের ঢালুতে একটা বড় ওক গাছ দাঁড়িয়ে। চারিদিকের একশো গজের মধ্যে ওই একটি মাত্র গাছ; ঠিক করলাম এটাতেই বসব।
আমার লোকেরা যখন চায়ের জন্যে জল গরম করছিল, আমি তখন ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, যদি পথেই বাঘটাকে গুলি করার সুযোগ মেলে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এই নাবাল জমির কোথাও বাঘটা শুয়ে আছে কিন্তু প্রায় এক ঘণ্টা ধরে প্রত্যেক ফুট খুঁজেও তার চিহ্নমাত্র পেলাম না।
যে গাছটা আমাকে বসবার জায়গা দেবে সেটা ছিল মাঠের দিকে ঝুঁকে পড়া। প্রায়ই ডাল কাটার জন্যে গাছের গুঁড়ির ওপর অনেকগুলো ছোট ছোট ডালপালা হয়েছে, এতে করে যদিও গাছে ওঠা সহজ হল কিন্তু গাছের গুঁড়িটা অনেকখানি নজর আটকে দিল। কুড়ি ফুট ওপরে একটি মাত্র বড় ডাল মাঠের ওপরে এগিয়ে ছিল, গাছের ওপরে আমার একমাত্র বসবার আসন হিসাবে কিন্তু না সেটা আরামপ্রদ, না সেখানে ওঠা সহজ। বিকেল চারটের সময়ে পাহাড়ের আরো ওপরে একটা গ্রামে যাবার নির্দেশ দিয়ে আমার লোকদের পাঠিয়ে দিলাম; কারণ সূর্য ডুবে যাবার পর আর আমার বসার ইচ্ছা ছিল না।
আমি আগেই বলেছি, মড়িটা আমার থেকে দশ গজ দূরে খোলা জায়গায় পড়ে ছিল, আর তার পেছন দিকটা একটা ঘন ঝোঁপ থেকে প্রায় গজখানেক দূরে। একঘণ্টা ধরে তাক করে আমি অনড়ভাবে বসেছিলাম আর আমার ডানদিকের আসেলু ঝোঁপ থেকে কতকগুলো লাল ঝুঁটি বুলবুলি পাখিকে ফল খেতে দেখছিলাম; দৃষ্টি ফিরিয়ে মড়িটার দিকে তাকাতেই দেখলাম ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে থেকে বাঘের মাথাটা দেখা দিয়েছে। সে শুয়ে ছিল নিশ্চয়ই কারণ তার মাথাটা ছিল মাটিতে ছোঁয়ানো আর দৃষ্টি ছিল আমারই দিকে নিবদ্ধ। এখন তার একটা থাবা এগিয়ে এল, পরে অন্যটি, এবং এরপরই অত্যন্ত ধীরে মাটিতে পেট ঠেকিয়ে বাঘটা নিজেকে মড়ির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। এখানে সে কয়েক মিনিট নিঃসাড়ে পড়ে রইল। তারপর আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মুখ দিয়ে সে মড়িটার লেজের একটা টুকরো কামড়ে নিল এবং তা একপাশে রেখে খেতে শুরু করল। তিনদিন আগে ভাল্লুকের সঙ্গে লড়াইয়ের পর থেকে কিছু না খাওয়ায় সে ক্ষুধার্ত ছিল, এবং মানুষ যেমন করে আপেল খায় তেমন করে চামড়া বাদ না দিয়েই মড়িটার পেছনের দিক থেকে বড় বড় কামড়ে মাংস খেতে থাকল।
আমার রাইফেলটার মুখ বাঘের দিকে, ওটা হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি রাখা। এখন ওটাকে কাঁধে তুলে নেওয়া আমার কাজ। এক মুহূর্তের জন্যে যখনই সে আমার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নেবে, তখনই আমি তা করার সুযোগ পেতে পারি। কিন্তু বাঘটা, মনে হল তার বিপদ সম্পর্কে সচেতন, কারণ আমার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে স্থিরভাবে কোনো ব্যস্ততা না দেখিয়ে খেয়ে যাচ্ছিল। যখন সে প্রায় পনর কুড়ি পাউন্ড মাংস পেটে পুরেছে, যখন বুলবুল পাখিরা আসেলু ঝোঁপ পরিত্যাগ করেছে আর দুটো কালোকণ্ঠী নীলকণ্ঠ এসে মিলেছে তাদের সঙ্গে এবং সকলে মিলে তার পেছনে কিচিরমিচির শুরু করেছে, আমি ভাবলাম, এই হল যথার্থ সময়। আমি যদি আস্তে আস্তে রাইফেলটা তুলি তাহলে সম্ভবত সে এটা লক্ষ করবে না; সুতরাং পাখিরা যখন কিচিরমিচির চরমে তুলল, আমি কাজ শুরু করলাম। আমি নলটা সম্ভবত ইঞ্চি ছয়েকের মত তুলেছি অমনি বাঘটা যেন জোরাল স্প্রিং-এর টানে পিছিয়ে গেল। রাইফেলটা কাঁধে ঠেকিয়ে কনুইটা হাঁটুর ওপরে রেখে আমি এখন, বাঘটা দ্বিতীয়বার মাথা বের করবে বলে অপেক্ষা করতে থাকলাম এবং নিশ্চিত ভেবেছিলাম যে সে সেটা করবেই। কয়েক মিনিট কাটার পরেই আমি বাঘের শব্দ পেলাম। সে ঝোপটা ঘুরে আমার পেছন দিয়ে এসে আমার গাছটাকে আঁচড়াতে শুরু করল আর ওদিকের গুঁড়িতে ছোট ছোট ডালপালা. ঘন হয়ে জন্মাবার ফলে তাকে দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব হল। আনন্দের প্রবল উল্লাসে বাঘটা বারংবার গাছটা আঁচড়ে চলেছে আপন শক্তিমত্তায় আর আমি তখন গাছের ডালে বসে নিঃশব্দে দুলে দুলে হাসতে থাকলাম।
আমি জানি যে কাক ও বাঁদরদের কৌতুকবোধ আছে, কিন্তু সেদিনের আগে পর্যন্ত জানতে পারি নি যে বাঘও উক্তবোধ সম্পন্ন। ওই বিশেষ বাঘটার যে বরাতজোর আর বেহায়াপনা দেখলাম, তা কোনো জানোয়ারের থাকে বলে জানতাম না। পাঁচ দিনে সে পাঁচটা গরু মেরেছে, যার মধ্যে চারটেই প্রকাশ্য দিবালোকে। এই পাঁচ দিনে আমি তাকে দেখেছিলাম আটবার আর চারটে সুযোগে আমি তার ওপর গুলি চালিয়েছিলাম। আর এখন, আমার দিকে আধঘণ্টা তাকিয়ে থেকে, আর সে অবস্থায় খেয়ে নিয়ে গরগর শব্দ করে আমাকে অবজ্ঞা দেখাবার জন্যেই আমি যে গাছটায় বসে ছিলাম সেটা আঁচড়াচ্ছে।
বাঘটা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বৃদ্ধ পুরোহিত আমাকে বলেছিলেন : “আপনি বাঘটাকে মারতে চেষ্টা করতে পারেন সাহেব আমার কিছু আপত্তি নেই, কিন্তু আপনি বা অন্য যে কেউই হক না কেউই মারতে সমর্থ হবেন না। বাঘটা এখন, নিজেও, পুরোহিত যা বলেছিলেন তাকেই অনুমোদন করছে। যাই হক আমাদের একজনও চোট খেল না, উত্তেজক এই খেলার শেষ চালটা চালল বাঘটা কিন্তু আমি ওকে শেষ হাসিটা হাসবার আমোদটা পেতে দিতে চাচ্ছি না। রাইফেলটাকে শুইয়ে রেখে হাতদুটো মুঠো করে আমি তার আঁচড়ানো না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রইলাম এবং তার পরে গলা ছেড়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলাম, আর তা প্রতিধ্বনিত হল পাহাড়ে পাহাড়ে, ফলে তাকে ছুটতে হল পাহাড় বেয়ে নিচের দিকে। নিচের গ্রাম থেকে আমার লোকদের নিয়ে এল ছুটিয়ে। আমরা বাঘটাকে ল্যাজ উঁচু করে দৌড়ে যেতে দেখেছি’ পৌঁছে লোকেরা বলল, “আর দেখুন, সে গাছটার কি অবস্থা করেছে।
পরদিন সকালে দাবিধূরায় আমার বন্ধুদের বিদায় সম্ভাষণ জানালাম আর আশ্বস্ত করলাম যে যদি কখনও মানুষখেকো আবার ক্রিয়াকলাপ চালায় আমি ফিরে আসব।
মানুষখেকো বাঘ মারতে আমি পর পর কয়েকবার দাবিধূরায় গেছি, এবং কখনো শুনি নি মন্দিরের বাঘটাকে কেউ মারতে পেরেছে বলে। সুতরাং ধারণা যে, কালের পূর্ণতার এই বৃদ্ধ যোদ্ধা একজন বুড়ো সৈনিকের মতই মুছে গেছে।