বিপজ্জনক খেলা – তিন গোয়েন্দা ভলিউম ২৮
প্রথম প্রকাশ: মে ১৯৯৮
০১.
মনটা খারাপ হয়ে গেছে ওদের। হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আন্ট জোয়ালিন। অথচ রকি বীচ থেকে যখন রওনা দিয়েছিলেন, তখন দিব্যি সুস্থ। রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে পেটব্যথা শুরু হলো। শোরটাউনে পৌঁছতে পৌঁছতে একেবারে কাহিল। তার বোন মিস কিশোর থ্রিলার ভায়োলার বাড়িতে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ডাক্তার ডাকা হয়েছে। এসে ওষুধপত্র দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, আগামীদিনের আগে ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
মিস ভায়োলার বাড়িতে অবশ্য এমনিতেও উঠত ওরা–আন্ট জোয়ালিন, তিন গোয়েন্দা এবং কোরি ড্রিম। এখানে থেমে গোস্ট আইল্যান্ডে যাওয়ার অপেক্ষা করত। প্রতিদিন একবার করে দ্বীপে যায় লঞ্চটা। ধরতে না পারলে পরের দিনের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
কোরি ড্রিম তিন গোয়েন্দার বান্ধবী, এক স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। আন্ট জোয়ালিন কোরির খালা। গরমের ছুটিতে গোস্ট আইল্যান্ডে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছিলেন ওদের। তিন গোয়েন্দার ওখানে যাওয়ার দুটো কারণ–ছুটি কাটানো এবং ভূত দেখা। কোরির দৃঢ় বিশ্বাস, গোস্ট আইল্যান্ডের একমাত্র হোটেল নাইট শ্যাডো-তে ভূত আছেই। যেমন নাম দ্বীপের, তেমনি হোটেলের। কৌতূহল ঠেকাতে পারেনি গোয়েন্দারা। যেতে রাজি হয়ে গেছে।
ভাল রোদ ঝলমলে দিন দেখে রওনা হয়েছে ওরা। পথে যে এ রকম একটা অঘটন ঘটবে কে ভাবতে পেরেছিল?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিরাশ হতে হলো না। সেদিনই সন্ধ্যার লঞ্চ ধরতে ওদের রাজি করালেন আন্ট জোয়ালিন। বললেন, তোরা চলে যা। কাল শরীর ভাল হয়ে গেলে আমিও যাব। না পারলে পরশু।
অহেতুক আন্ট ভায়োলার বাড়িতে বসে থাকার মানে হয় না। শোরটাউনে দেখার কিছু নেই। সুতরাং কোরিকে নিয়ে লঞ্চঘাটে রওনা হলো। তিন গোয়েন্দা।
ট্যাক্সি নিয়ে ছোট্ট শহরের সরু রাস্তা ধরে লঞ্চঘাটে পৌঁছল ওরা। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। যা আছে, বেশির ভাগই টুরিস্ট। ডকের শেষ মাথায় একধারে একটা ছোট কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা: গোস্ট আইল্যান্ড টুরস। নিচে তীরচিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে কোন ঘাট থেকে দ্বীপে যাওয়ার লঞ্চ ছাড়ে।
সেদিকে এগিয়ে গেল ওরা।
ছোট একটা বোট থেকে লাফিয়ে নেমে এল হাসিখুসি এক তরুণ। হেসে জিজ্ঞেস করল, গোস্ট আইল্যান্ডে যাবে?
কিশোর জবাব দিল, হ্যাঁ।
আমি এই লঞ্চের সারেং। এসো।
ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে লঞ্চে উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা। হাত ধরে কোরিকে উঠতে সাহায্য করল সারেং। শুধু ওরাই। আর কোন যাত্রী দেখল না। অবাক লাগল কিশোরের।
সামনের দিকে এগিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। সরু কাঠের বেঞ্চের নিচে ঢুকিয়ে দিল ব্যাগগুলো। সবজে-ধূসর ঢেউ লঞ্চের কিনারে বাড়ি মারছে ছলাৎ ছল ছলাৎছল। খানিক দুরে সৈকতের বালিতে ফেলে দেয়া আবর্জনায় খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে চার-পাঁচটা সী গাল।
ওরা উঠতেই আর দেরি করল না সারেং। ডকের সঙ্গে বাঁধা লঞ্চের দড়িটা খুলে দিয়ে এঞ্জিন স্টার্ট দিল। বিকট গর্জন করে উঠল পুরানো এঞ্জিন। জেটির কাছ থেকে সরে যেতে শুরু করল লঞ্চ।
কেবিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে কিশোর। বাতাস ভেজা ভেজা। ঠাণ্ডা।
আচমকা ভীষণ দুলে উঠল লঞ্চ। জেটি থেকে সরে আসতেই বিশাল ঢেউ ধাক্কা মেরেছে। সীটে বসেও প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল যাত্রীরা। সাংঘাতিক দুলুনি।
মজা পেয়ে হেসে উঠল কোরি। হাসিটা সংক্রামিত হলো অন্য তিনজনের মাঝে।
ভয় পাচ্ছ? হেসে জিজ্ঞেস করল সারেং। আজ অতিরিক্ত ঢেউ।
দারুণ! মুসা বলল। মনে হচ্ছে নাগরদোলায় চড়ছি।
রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়াল কোরি। আধ মিনিটেই অর্ধেক কাপড় ভিজিয়ে সরে চলে এল। বৃষ্টির ছাটের মত এসে গায়ে লাগে পানির কণা।
শোরটাউন থেকে বেশি দূরে না দ্বীপটা। বেশিক্ষণ লাগল না পৌঁছতে। তীরের দিকে তাকিয়ে ডকের এপাশ ওপাশ খুঁজল মুসা, কই? আমাদের না নিতে আমার কথা? কেউ তে এল না।
কোরি বলল, বুঝতে পারছি না। হয়তো দেরি দেখে ফিরে গেছে।
সারেঙের দিকে ফিরল কিশোর, আসতে দেরি করেছি নাকি?
আর দিনের চেয়ে কিছুটা তো দেরিই।
হু, কোরির দিকে তাকাল কিলোর। তারমানে মেলবয়েস লোক পাঠিয়েছিলেন ঠিকই। লঞ্চ না দেখে ফিরে গেছে।
ডকে ভিড়ল লঞ্চ। লাফ দিয়ে দিয়ে নামল ওরা। সারেং নামল না। ওপর থেকে ওদের ব্যাগ-সুটকেসগুলো বাড়িয়ে দিল এক এক করে।
দমকা বাতাসে ওদের দুই পাশে ধুলোর ঘূর্ণি উড়ল।
দ্বীপ বটে একখান! আনমনে বিড়বিড় করল সারেং
চারপাশে তাকাল কিশোর। শেষ বিকেলের রোদে এত সুন্দর লাগছে জায়গাটাকে, বাস্তব মনে হয় না। আকাশের গোলাপী রঙ রাঙিয়ে দিয়েছে সাগরের পানিকে। ঢেউ আছড়ে পড়ছে সাদা বালিতে। ডকের দুদিকে বহুদূর লম্বা হয়ে ছড়িয়ে গেছে সৈকতটা।
সরু একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে ঢুকে গেছে। পাইনবনের ভেতর। ওপর দিকে তাকালে বন ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
হোটেলটা কই? জানতে চাইল কিশোর।
শেষ ব্যাগটা মুসার হাতে তুলে দিল সারেং। শার্টের আস্তিন দিয়ে কপালের ঘাম আর নোনা পানি মুছল। হাত তুলে বনের দিকে দেখিয়ে বলল, ওখানে।
বনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে? ঘাবড়ে গেল মুসা। ভূতের ভয় তার ষোলো আনা। আসার ইচ্ছেও ছিল, আবার না-ও। ভুতকে ভয় পায়, এদিকে দেখার কৌতূহলও সামলাতে পারেনি।
হ্যাঁ, সারেং বলল। এই রাস্তা ধরে চলে যাবে। লঞ্চের দড়ি খুলতে আরম্ভ করল সে। একটা গেটহাউস দেখতে পাবে। হোটেলটার চারপাশ, ঘিরে বেড়া দেয়া। যাও, পেয়ে যাবে গেট।
দড়ির খোলা মাথাটা ডেকে ফেলে দিয়ে এঞ্জিন স্টার্ট দিল সে। দ্রুত সরিয়ে নিতে শুরু করল ডকের কাছ থেকে। ওর এই তাড়াহুড়াটা ভাল লাগল না মুসার। বনের দিকে তাকাল। যাব কি করে? শাটলবাস আছে?
তার কথার জবাব দিল না সারেং। অনেক সরে গেছে। বিকট শব্দ করছে। এঞ্জিন। ওদের দিকে একবার হাত নেড়ে লঞ্চের নাক ঘুরিয়ে দিল সে। একটিবারের জন্যেও আর ফিরে তাকাল না।
.
০২.
লোকজন তো কাউকেই দেখছি না, নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়েও আবার নামিয়ে রাখল কিশোর।
আমাদের কথা ভুলেই গেল কিনা কে জানে, কোরি বলল।
দাঁড়িয়ে না থেকে চলো হাঁটি।
একটা জিনিস অবাক লাগেনি তোমাদের? রবিন বলল, লঞ্চে আমরা ছাড়া আর কোন যাত্রী ছিল না। একজন টুরিস্টও এল না কেন?
সমুদ্রের অবস্থা খারাপ দেখে সাহস পায়নি হয়তো, অনুমান করল। মুসা।
মনে হচ্ছিল সাগরটা যেন ইচ্ছে করে ঠেলে আসতে চেয়েছে আমাদের। দিকে, কালো ছায়া পড়ল কোরির মুখে! এখানে আসতে বাধা দিচ্ছিল আমাদের।
খাইছে! গলা কেপে উঠল মুসার। ওরকম করে বোলো না। আমার ভয় লাগছে।
আরে কি সব ফালতু কথা শুরু করলে, বনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিশোর। কেউ আসে কিনা দেখছে।
ফালতু দেখলে কোথায়? তর্ক শুরু করল কোরি। সুস্থ মানুষ, হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেলেন আন্ট জোয়ালিন। সাগরের ঢেউ ঠেলে এসেছে। আমাদের দিকে। এসবই খারাপ লক্ষণ : নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল। গলার লকেটটার কাছে। আঙুলগুলো চেপে ধরল কাচের তৈরি মানুষের খুলির। মত দেখতে রঙিন লকেটটা। রকি বীচের এক অ্যানটিক শপ থেকে জোগাড় করেছে সে। দোকানদার বলেছে, বহু পুরানো জিনিস। প্রাচীন একটা কবরে পাওয়া গেছে। এটা যার গলায় পরা থাকবে. ড্রাকুলার মত সাংঘাতিক ভূতও। তার কিছু করতে পারবে না।
উফফ, বিরক্ত হয়ে বলল কিশোর, এক মুসার যন্ত্রণাতেই বাঁচি না, আরও একজন যুক্ত হলো। অই কোরি, তোমার ওই ভুত, অশুভ লক্ষণ, এসব নিয়ে লেকচার থামাবে?
ভূত দেখতেই কিন্তু এখানে এসেছ তোমরা।
ও একটা কথার কথা। আমি এসেছি আসলে বেড়াতে। ভুত যদি থাকেই, মুসাকে নিয়ে দেখিয়ে দিয়ে। পরে এখন চলো যাওয়া যাক
কেন, শাটলবাসের জন্যে অপেক্ষা করবে না মুসার দিকে আড়চোখে তাকাল রবিন।
শাটলবাস না, কচু আসবে এখানে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল কোরি। তার চেয়ে বরং হাত নাড়ো, ট্যাক্সি চলে আসুক।
ঠাট্টা করছ নাকি? মনে হচ্ছে যেন মোড়ের কাছে বসে তোমার অপেক্ষা করছে গাড়িওয়ালা, কিশোর বলল এখানকার সুবিধা-অসুবিধা আন্ট জোয়ালিন তো সবই বলে দিয়েছেন। এখন বিরক্ত হও কেন?
কিন্তু ডকের কিনার থেকেই যে খাড়া পাহাড়ে চড়তে হবে একথা বলেনি. বিশাল দুটো সুটকেসে জিনিসপত্র ভরে নিয়ে এসেছে কোরি। এরকম বোঝা বইতে হবে জানলে আনত না বিরক্তমুখে নিচু হয়ে দুহাতে তুলে নিল দুটো সুটকেস।
নিজের ক্যানভাসের ব্যাগটা কাঁধের ওপর ফেলল মুসা। হাত বাড়াল কোরির দিকে, একটা দাও আমাকে। তুমি দুটো নিতে পারবে না।
কিন্তু দিল না কোরি। বলল, না, পারব।
চাপাচাপি করল না মুসা ঠিক আছে, না পারলে দিয়ে দিয়ে।
রাস্তা ধরে উঠতে শুরু করল, ওরা ঢুকে পড়ল পাইনবনে। কিছুদূর এগোতে পাথরের একটা গেটহাউজ দেখা গেল দুপাশ থেকে উঁচু লোহার শিকের বেড়া চলে গেছে দুদিকে। সারেং বলেছে হোটেলের পুরো সীমানাই ঘিরে রেখেছে ওটা। গেটহাউজে কোন লোক পড়ল না। বেড়ার গায়ে সাইনবোর্ডে বড় বড় ইংরেজিতে অক্ষরে লেখা–
হোটেল নাইট শ্যাডো
প্রাইভেট প্রপার্টি
গেটে তালা থাকলেই হয় এখন, রবিন বলল, ঢুকতে আর হবে না।
কি যে বলো না, অস্বস্তি চাপা দিতে পারল না কোরি, তালা থাকবে কেন?
আছে কিনা দেখলেই তো হয়, লম্বা পা ফেলে আগে আগে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াল মুসা। ঠেলা দিল পাল্লায়।
নড়ল না ওটা।
একপাশের পুরানো আমলের হাতল দেখিয়ে বলল রবিন, ওটা ঘোরাও। খুলে যাবে।
ঘুরিয়ে আবার ঠেলা দিল মুসা। খুলল না গেট।
তালা দেয়া! নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত থেকে সুটকেস দুটো ছেড়ে দিল। কোরি। আমি জানতাম, এমন কোন কিছুই ঘটবে।
আরে এত অধৈর্য হচ্ছ কেন? গেটহাউজের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখে বলল কিশোর, ফোন আছে। হোটেলে ফোন করে তালা খুলে দিতে বলব।
আকাশের দিকে তাকাল কোরি। এত তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে কেন?
অন্ধকার হচ্ছে না। গাছপালার ছায়ার জন্যে অন্ধকার লাগছে। আলো ঢুকতে পারছে না ঠিকমত, দেখছ না?
সরু কাচের দরজা ঠেলে খুলে গেটহাউজে ঢুকল কিশোর। ফোন তুলে নিল। কুঁচকে ফেলল ভুরু।
দরজায় মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে মুসা। কি হয়েছে?
ডায়াল টোন নেই।
ইন্টারকম ফোন হতে পারে। হোটেলের রিসিভারে সরাসরি লাইন দেয়া।
তাতে কি? ডায়াল টোন তো থাকবে। রিসিভার রেখে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল কিশোর।
তারমানে বাইরেই আটকা পড়লাম, মুসার গলায় অস্বস্তি।
পড়লে পড়ব, দুষ্টু হাসি খেলে গেল কিশোরের মুখে। আজকের রাতটা নাহয় সৈকতেই কাটাব। বেড়াতেই তো এলাম।
ভাল হবে! উত্তেজনায় চকচক করে উঠল কোরির চোখ।
তা তো হবেই, মুখ গোমড়া করে ফেলেছে মুসা। খাব কি?
অ্যাই, গেট খোলা যাবে, বলে উঠল রবিন।
ঝট করে ফিরে তাকাল কিশোর, কি করে বুঝলে?
ওই যে, হুড়কো। ওটা সরালেই হয়। কারও অপেক্ষা না করে নিজেই হুড়কোটা সরিয়ে দিল রবিন। খুলে ফেলল পাল্লা।
চলো চলো, ঢুকে পড়ি! চিৎকার করে তাড়াতাড়ি সুটকেস দুটো তুলে নিল কোরি। দেরি করলে যেন আবার বন্ধ হয়ে যাবে গেট।
সৈকতে রাত কাটানো আর হলো না তাহলে আমাদের, কিশোরের কণ্ঠে কৃত্রিম হতাশা।
সারা গ্রীষ্মকালই পড়ে আছে সামনে, গেটটা খুলতে পেরে খুব খুশি রবিন, যত ইচ্ছে সৈকতে রাত কাটাতে পারব।
ঢাল বেয়ে উঠে চলল ওরা। দুধারে গাছপালা। মাথার ওপর পাখির কলরব। সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল একটা খরগোশ।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল হোটেলটা।
দারুণ তো! বলে উঠল রবিন।
দাঁড়িয়ে গেল সবাই। তাকিয়ে আছে। বিশাল পুরানো আমলের বাড়ি। সাদা দেয়াল। ঢালু লাল টিনের চাল। সাজানো লন। মূল বাড়ি থেকে দুটো শাখা বেরিয়ে উঠে গেছে দুদিকের পাহাড় চূড়ায়। বড় লাল সদর দরজাটার দুদিকে দুটো পর্দা টানা বারান্দা। দুই সারি করে চেয়ার পাতা।
আরও কাছে এগিয়ে হোটেলের পেছনে উপসাগরটা চোখে পড়ল ওদের। কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে সৈকতে। ছোট ডকে কয়েকটা নৌকা বাধা।
খাইছে! দারুণ একটা সৈকত, চোখ বড় বড় করে বলল মুসা।
হ্যাঁ, কিশোর বলল, খুব সুন্দর।
আন্ট জোয়ালিন যতটা বলেছে, তারচেয়ে সুন্দর, হাঁ করে তাকিয়ে আছে কোরি।
ওই দেখো একটা নুইমিং পুল, হাত তুলল রবিন। কত্তবড় দেখেছ! পেছনের ওটা কি? পুলহাউজ নাকি?
কিন্তু লোকজন তো কাউকে দেখছি না, নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর।
সামনে বিছিয়ে থাকা রাজকীয় হোটেলটার দিকে তাকিয়ে আছে কোরি। তাই তো!
পুলেও কেউ নেই।
ডিনারে বসেছে হয়তো, মুসা বলল। আমারও এখন ওখানেই বসার ইচ্ছে।
কিন্তু আলো কই? ঘরে আলো নেই। বারান্দায় কেউ নেই। সৈকতে কেউ হাঁটছে না। হোটেলের সামনেও নেই কেউ। অস্বাভাবিক লাগছে না?
তাই তো! বলল কোরি।
মুখ দেখে মনে হলো চিন্তায় পড়ে গেছে কিশোর।
দামী পাথরে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে লাল দরজাটার কাছে উঠে গেল ওরা। ডাবল ডোর। বিশাল কাঠামো। দরজা খোলার চেষ্টা করল কোরি। খুলল না। বেল বাজাল শেষে।
বাড়ির ভেতরে ঘণ্টা বাজল কোনখানে।
দুই মিনিট অপেক্ষা করল কোরি। তারপর আবার বাজাল।
কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হলো পাল্লা। ফ্যাকাসে চেহারার এক প্রৌঢ়কে উঁকি দিতে দেখা গেল। উষ্কখুষ্ক চুল। বিরক্তমুখে ওদের দিকে তাকিয়ে খড়খড়ে শুকনো গলায় বলল, যাও এখন। হোটেল বন্ধ।
দরজাটা টেনে আবার লাগিয়ে দিল সে।
.
০৩.
চিন্তিত ভঙ্গিতে লাল দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।
রবিন বলল, ভুল হোটেলে চলে এলাম তো?
দরজার পাশে দেয়ালে গাঁথা ব্রোঞ্জের, চকচকে প্লেটটা দেখাল কিশোর। তাতে লেখা:
হোটেল নাইটশ্যাডো।
এসটাবলিশড ১৮৫৫
এক নামের দুটো হোটেল আছে তাহলে, বলল রবিন। চলো, আমাদেরটা খুঁজে বের করি।
হাত নেড়ে মুসা বলল, আরে নাহ, এত ছোট দ্বীপ। আর হোটেল তুলবে কোথায়? তা-ও আবার এক নামে দুটো। এটাই।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের সুটকেসে লাথি মারল কোরি, নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না। কোন রকম ফাঁক রাখেননি আন্ট জোয়ালিন। ফোনে কয়েকবার করে কথা বলেছেন হোটেলের মালিকের সঙ্গে…
কিন্তু এখানে তো লোকই নেই, মুসা বলল। খালি হোটেল। বোর্ডার নেই। হোটেল বন্ধ। লোকটা ঠিকই বলেছে।
আর কি কর্কশ গলা লোকটার, নাক কুঁচকাল রবিন। আরেকটু ভাল করে বলতে পারল না?
আমার কি মনে হয় জানো? কোরি বলল। লোকটা নিশ্চয় মাটির নিচের ঘরে কোন দানব বানাচ্ছে। আজ রাতে প্রাণ সঞ্চার করবে ওটাতে। তাই কারও নাক গলানো পছন্দ করছে না।
চমকে গেল মুসা। খাইছে! ফ্রাঙ্কেনস্টাইন! লোকটাকে লাগলও কিন্তু ডক্টর
আরে দূর, থামো তো! হাত নেড়ে থামিয়ে দিল ওকে কিশোর। কিসের মধ্যে কি। জ্বালাবে তোমরা, বুঝতে পারছি।
ওদেরকে অবাক করে আবার হাঁ হয়ে গেল দরজাটা। লম্বা, সুদর্শন চেহারার একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা এলোমেলো চুল, সাদা গোফ। গায়ে সাদা সাফারি শার্ট, পরনে সাদা প্যান্ট। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। চোখের কালো মণি দুটো ঝিলমিল করে উঠল তারার মত।
গুড ইভনিং, ভারী গমগমে কণ্ঠস্বর। হাসিটা মোছেনি মুখ থেকে। ওদের দিকে তাকিয়ে পরিচিত কাউকে খুঁজলেন যেন।
কথা বলতে গেল কোরি। ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি, আমার চাকর উলফের ব্যবহারে কিছু মনে কোরো না। তোমাদের বয়েসী ছেলেমেয়েদের ও পছন্দ করে না। কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের এখানে একা দেখে আমারও অবাক লাগছে। জোয়ালিন এল না? ওরও তো আসার কথা ছিল।
হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল, জবাব দিল কোরি। শোরটাউনে– ছোটখালার বাড়িতে আছে। আমাদের চলে আসতে বলল। কাল শরীর ভাল হলে আন্টি আসবে। আপনাকে ফোন করে বলেনি কিছু?
ও, তুমি নিশ্চয় কোরি, কোরির প্রশ্নের জবাব দিলেন না তিনি। লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরে ঝাঁকালেন। চেহারায় অনেক মিল আছে।
থ্যাংক ইউ, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে কোনমতে হাতটা ছাড়িয়ে নিল কোরি।
এক্সকিউজ মী। আমিও তো উলফের মত অভদ্র হয়ে গেলাম দেখি। ঢুকতেই দিচ্ছি না তোমাদের, বলে তাড়াতাড়ি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। নিজের পরিচয়টা দিয়েই ফেলি। আমি ব্যারন রোজার সাইমন ডি মেলবয়েস। মেলবয়েস দি থার্ড। এই হোটেলের মালিক।
রোজার সাইমন মেলবয়েস? ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন। ব্ল্যাক ফরেস্ট টাউনের গোস্ট লেনে আমাদের একটা বাড়ি আছে। সেখানে পথের মাথায়। একটা অনেক বড় পোড়া বাড়ি…
ওটা ছিল আমার দাদার ভাইয়ের, মেলবয়েস বললেন। রহস্যময় একজন মানুষ ছিলেন তিনি, নিশ্চয় শুনেছ। ব্ল্যাক ফরেস্টে বহুদিন যাই না। এখানেই থাকি এখন। অনেক বদলে গেছে নাকি ব্ল্যাক ফরেস্ট?
খুব একটা না।
ব্ল্যাক ফরেস্ট গোরস্থানের লাশেরা সব এখনও কফিনেই রয়েছে তো? মাথা পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে, চোখ বুজে হেসে উঠলেন মেলবয়েস। কেন এ প্রশ্ন করলাম নিশ্চয় বুঝতে পারছ। ওখানকার লাশ মাঝে মাঝেই ভূত হয়ে কফিন থেকে বেরিয়ে আসার বদনাম আছে তো।
পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর কোরি। চোখে অস্বস্তি।
সামনের লবিতে ঢুকল সবাই। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। বিশাল লবি। প্রচুর আসবাবপত্র। ডার্ক উডের দেয়াল। কাঠের তৈরি বড় বড় কড়িবরগা। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে অনেকগুলো চেয়ার-টেবিল। ডার্ক উড, নরম মখমল আর চামড়ার গদির ছড়াছড়ি। হোটেলটাকে গ্রীবাস না বলে হান্টিং লজ বললেই মানায় ভাল।
ব্যাগ-সুটকেসগুলো এখানেই রেখে দাও, মেলবয়েস বললেন। তোমাদের ঘর গোছাচ্ছে উলফ। গুছিয়ে এসে এগুলো নিয়ে যাবে।
বোর্ডাররা কই? জানতে চাইল কোরি।
নেই। হোটেল বন্ধ। গোফের এককোণ ধরে টানতে টানতে কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন মেলবয়েস। বোঝার চেষ্টা করলেন ওর কি প্রতিক্রিয়া হয়। তোমার আন্টি আমার চিঠি পায়নি?
চিঠি?
হ্যাঁ। গত সপ্তা থেকে ফোন খারাপ। সেজন্যে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। হোটেলের ডাইনিং রূম আর ওল্ড উইঙের কয়েকটা ঘর মেরামত করতে হচ্ছে আমাদের। নতুন করে আসবাব দেব ঘরে ঘরে, জোয়ালিন জানে। এতদিনে শেষ হয়ে যেত কাজ। কিন্তু কাজের মাঝখানে হঠাৎ করে চলে গেল ওরা। জোয়ালিনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম, আরও দুতিন সপ্তা পরে আসে যেন তোমাদের নিয়ে। ততদিনে কাজ শেষ হয়ে যাবে আমাদের। হোটেল চালু করে ফেলব।
তারমানে চিঠিটা পায়নি আন্টি, হতাশ কণ্ঠে বলল কোরি। শুধু শুধুই কষ্ট করে এলাম আমরা এতটা পথ।
অত দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, মেলবয়েস বললেন। কাল বিকেলে লঞ্চ না আসা পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকো। উলফ খুব ভাল রান্না করতে পারে। খাওয়ার অসুবিধে হবে না তোমাদের। ইচ্ছে করলে সুইমিং পুল আর সৈকতে সাঁতারও কাটতে পারবে।
কিন্তু মন ভাল হলো না কোরির। কত কিছুই না করবে ভেবে রেখেছিল। সৈকতে রাত কাটানো, চিংড়ি ধরে কয়লার আগুনে ঝলসে খাওয়া, অনেক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হই-চই করে পার্টি দেয়া, সাগরে সাঁতার কাটা, আরও কত কি। কিন্তু সব গেল। গরমের ছুটিটাই মাটি।
তোমরা খেয়ে বেরিয়েছ? জানতে চাইলেন মেলবয়েস।
না, সারারাত না খেয়ে থাকার ভয়ে তাড়াতাড়ি জবাব দিল মুসা।
ওর ভঙ্গি দেখে হেসে উঠল রবিন আর কিশোর। কোরিও হেসে ফেলল।
এসো, ডাইনিং রূমে, বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে জমিদারি চালে হাঁটতে শুরু করলেন মেলবয়েস। উলফকে বলি কিছু রান্না করে দিতে।
অনেক বড় কার্পেট বিছানো একটা ঘরে ঢুকলেন তিনি। সুইচ টিপে কয়েকটা ঝাড়বাতি জ্বেলে দিলেন। ঘরের একধারে বড় জানালার পাশে দুটো লম্বা টেবিল পাতা। টেবিলকুথে ঢাকা। চীনামাটি আর রূপায় তৈরি প্রচুর কাপ প্লেট, গ্লাস-বাটি সাজিয়ে রাখা। ঘরে আরও অনেকগুলো টেবিল আছে। ওগুলোর দুই ধারে যেসব চেয়ার ছিল, সব উল্টে রাখা হয়েছে। বায়ের দেয়ালের কাছে বাঁশ বাধা। কাঠের মঞ্চ। দাগ লাগা ক্যানভাসের কাপড় ঝুলে আছে। দেয়ালের কাগজ ছেঁড়া। ছাতের খানিকটা জায়গার প্লাস্টার খসানো। রাজমিস্ত্রিরা কাজ শেষ না করেই চলে গেছে বোঝা যায়।
সেদিকে দেখিয়ে গজগজ করে বললেন মেলবয়েস, আর সপ্তা দুই কাজ করলেই হয়ে যেত। কিন্তু বেশি পয়সার লোভ দেখিয়ে শোরটাউনের এক শয়তান লোক বিল্ডিং মেরামতের জন্যে ডেকে নিয়ে গেছে ওদের। কবে যে ফিরে আসবে এখন, কোন ঠিক নেই।
ডাইনিং রূমের পেছনের দেয়ালে বিশাল এক জানালা। সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। আরিব্বাবা, কি দেখা যাচ্ছে!
সূর্য ডুবছে। পেছনের আঙিনায় ছড়ানো অসংখ্য ডেক চেয়ার, টেবিল আর বড় বড় ছাতা। তার ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে সৈকত। কালো হয়ে আসা আকাশের পটভূমিতে রূপালী-ধূসর। তারও পরে উপসাগরের জল যেন জল নয়, শিল্পীর তুলিতে আঁকা বিচিত্র রঙের ছবি।
এত সুন্দর! পাশ থেকে বলে উঠল রবিন।
মুসা আর কোরিও দেখছে অপরূপ সূর্যাস্ত।
পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন মেলবয়েস, কোরি, তোমার আন্টির শরীর কি খুব বেশি খারাপ?
কি জানি! ডাক্তার ডাকতে তো কোনমতেই রাজি হলো না। একটা ফোন করতে পারলে জানা যেত।
পারবে। কাল সকালে। লাইন ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু হোটেলের সুইচবোর্ড নষ্ট। পাইরেট আইল্যান্ড থেকে কাল লোক এসে ঠিক করে দিয়ে যাবার কথা।
কাশতে কাশতে ঘরে ঢুকল উলফ। সাদা রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছল। জানালার কাছে দাঁড়িয়েই ওর দিকে ফিরে তাকাল সবাই।
বেঁটে, রোগাপাতলা একজন মানুষ। কড়া মাড় দিয়ে ইস্তিরি করা খাটো হাতা সাদা শার্ট গায়ে, পরনে কালো প্যান্ট। কালো চুলের ডগা এমন করে মাথার দুই পাশে ছড়িয়ে আছে, যেন কতদিন ধরে আঁচড়ায় না। চোখা চেহারা, ছোট ছোট ধূসর চোখ, খাড়া নাক। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে আছে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আশপাশে যা কিছু দেখছে সব কিছুতেই তার বিরক্তি।
ও আমাদের উলফ, হেসে পরিচয় করিয়ে দিলেন মেলবয়েস, আগেই তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সাক্ষাঙ্কারটা নিশ্চয় পছন্দ হয়নি তোমাদের?
লাল হয়ে গেল উলফ। কিন্তু তার চেহারার ভাব বদল হলো না।
উলফ, মেলবয়েস বললেন, আমাদের মেহমানদের খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরে কি আছে?
মুরগীর মাংস, অনেকটা চি-চি করে পাতলা গলায় কথা বলে, মনিবের ভারী গলার ঠিক উল্টো। সালাদও বানিয়ে দেয়া যায়। এমন ভঙ্গিতে শেষ কথাটা বলল সে, যেন বানানো না লাগলেই খুশি হত।
খুব ভাল, উলফের ইচ্ছার পরোয়া করলেন না ব্যারন। বিশাল হাত নেড়ে প্রায় মুরগী খেদানোর মত করে ওকে তাড়ালেন ঘর থেকে।
মাথা নিচু করে কোনদিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের বড় দরজাটার দিকে চলে গেল উলফ।
.
০৪.
বসো তোমরা, একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন ব্যারন। কথা বলতে ভাল লাগছে। বোর্ডাররা চলে যাওয়ার পর খুব নির্জন হয়ে পড়েছে জায়গাটা। হোটেলে যখন লোক গমগম করে, দারুণ ভাল লাগে আমার।
চেয়ার টেনে বসল কিশোর। ব্যারনের দিকে তাকাল।
জুলাইয়ের শেষ দিকে আশা করি আবার চালু করে ফেলতে পারব, বললেন তিনি। যদি ঠিকমত ফিরে আসে শ্রমিকরা। আমি আর আমার ভাই। মিলারের ধারণা ছিল, মার্চে কাজ ধরলে গরমের ট্যুরিস্ট সীজনের আগেই সেরে ফেলতে পারব। কিন্তু ভুল হয়ে গেছে। ব্যাটারা যে টাকার লোভে এভাবে আমাদের ডুবিয়ে দিয়ে পালাবে ভাবতেই পারিনি।
এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকালেন তিনি। আমার ভাই মিলার খুব মেজাজী মানুষ। সব সময় বিষণ্ণতায় ভোগে। কালো হয়ে গেল তার মুখ। তা ছাড়া রোগটা ইদানীং অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। বেশি মানুষ থাকলে নিচেই নামে না। অনেকটা সেকারণে, তাকে কিছুটা শান্তি দেয়ার জন্যেই বলতে পারো হোটেলটা কিছু দিনের জন্যে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই সুযোগে মেরামতটা সেরে ফেলব। এভাবে বন্ধ করলে ব্যবসার বিরাট ক্ষতি। কিন্তু কি করব? ভাই আগে না টাকা…
ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এল উলফ।
একটা প্লেটে বড় এক টুকরো মাংস তুলে নিল মুসা। আমরা আপনাদের সাহায্য করতে পারি। দেয়াল মেরামতের কিছু কিছু কাজ করে দিতে পারব।
হ্যাঁ, সালাদের বাটি থেকে চামচ দিয়ে নিজের প্লেটে সালাদ তুলে নিতে লাগল রবিন। আন্ট জোয়ালিন আমাদের বলেছেন, হোটেলের মালিকের সঙ্গে, অর্থাৎ আপনার সঙ্গে নাকি কথা হয়েছে তাঁর–গরমকালটা হোটেলে পার্ট টাইম চাকরি দেয়া হবে আমাদের। তাতে থাকাখাওয়ার জন্যে আর ভাবনা থাকবে না। পকেট থেকে নগদ পয়সা খরচ করতে হবে না।
বলেছি হয়তো। ঠিক মনে করতে পারছি না, ব্যারন বললেন। যাই। হোক, তোমাদের প্রস্তাবটা কিন্তু মন্দ না।
কিন্তু আমার কাছে মন্দই লাগছে, মুখ নিচু করে বলল উলফ। যার কাজ তাকেই সাজে। অপেশাদার দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ হয় না।
কাজটা তো কঠিন কিছু নয়, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ব্যারন। দেয়াল থেকে কিছু কাগজ ছিঁড়তে হবে…আরও কিছু টুকটাক.. আমার তো ধারণা ওই পয়সালোভী চামার শ্রমিকগুলোর চেয়ে ভাল পারবে এরা।
শক্ত হয়ে গেল উলফের চোয়াল। কাজটা নিরাপদ নয় মোটেও, কোরির দিকে তাকাল সে।
চমকে গেল কোরি। কি বলতে চায় লোকটা? মিস্ত্রির কাজে নিরাপত্তার প্রশ্ন কেন উঠছে?
পরের লঞ্চে ওদের ফিরে যাওয়াটাই ভাল মনে করি আমি, উলফ বলল।
কিন্তু আমি মনে করি না, তর্ক শুরু করলেন ব্যারন। কয়েকটা ছেলেমেয়েকে কাজ করতে দেখলে খুশিই হবে মিলার। জানালা দিয়ে বাইরের কালো হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। হাসি হাসি ভঙ্গিটা চলে গেছে তার।
না। চলে যাওয়াই ভাল, থেমে থেমে একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করল উলফ। যেন কোন ছোট্ট ছেলেকে বোঝাচ্ছে।
না। ভাল নয়। বরং কয়েকটা ছেলেমেয়েকে এখানে কাজ করতে দেখলেই আমার ভাল লাগবে, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হলো না ব্যারনের।
কান খাড়া করে ফেলল কিশোর। ব্যারন একবার বললেন মিলারের ভাল লাগবে। এখন বলছেন আমার ভাল লাগবে। কথাবার্তাগুলো কেমন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে।
সব কিছু মেরামত করে আবার যখন হোটেল খুলব আমরা, উলফ বলল, অনেক ছেলেমেয়ে আসবে তখন। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠ। অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না মুসার। এসেছে যখন, কয়েকদিন থেকে যেতে পারলে ভাল হত। ব্যারনকে রাজি করানোর জন্যে বলল, আমাদের মধ্যে কিন্তু কোন ফাঁকি পাবেন না। আন্তরিক ভাবে খাটব। আমরা।
রবিনেরও ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আমাদের কাজ দেখে আপনি খুশি হবেন, কথা দিতে পারি।
ঠিক আছে তাহলে, গোঁফের কোণ ধরে এক টান মারলেন ব্যারন। উলফের দিকে তাকালেন, ওরা থাকছে। কাঠমিস্ত্রির কাজ করবে। আমি ওদের বহাল করলাম।
কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্যে উলফের দিকে তাকাল কিশোর।
কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। ভাবলেশহীন চেহারা। খুদে খুদে ধূসর চোখে শূন্য দৃষ্টি। একটা মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল খালি ট্রে-টা। চি-চি করে বলল, ঠিক আছে, আমি যাই।
খুশি হয়ে উঠল মুসা আর রবিন। কোরির মুখেও হাসি। একসঙ্গে কলরব। শুরু করল তিনজনে। কিশোর তাকিয়ে আছে ব্যারনের দিকে। একটা হাত তুললেন তিনি। হাসিমুখে বললেন, আমি আশা করব আন্তরিক ভাবেই খাটবে তোমরা। তবে তোমাদের সময় সবটুকু কেড়ে নিতে চাই না আমি। কাজের সময় কাজ। বাকি সময়টা পুলে সাঁতার কেটে, সৈকতে বেড়িয়ে কাটাতে পারবে, বাধা নেই। ফুর্তি করার জন্যেই তো এসেছ তোমরা, তাই না?
হ্যাঁ, হ্যাঁ! সমস্বরে চিৎকার করে উঠল মুসা, রবিন আর কোরি।
কিশোরের দিকে তাকালেন ব্যারন, তুমি কিছু বলছ না কেন?
অ্যাঁ!..হ্যাঁ, আমারও ভাল লাগবে।
লাগারই কথা। এখানে তোমাদের বয়েসী যারা বেড়াতে আসে, সবারই ভাল লাগে।
মুখের হাসিটা বজায় রেখে পেছনে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন ব্যারন। লম্বা, সাদা চুলে আঙুল চালালেন। কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল। তোমার আন্টির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। ও না আসাতে খারাপই লাগছে।
কালকে নাগাদ চলে আসতে পারে। ভায়োলা আন্টি খুব ভাল নার্স।
ট্রে রেখে এঁটো বাসন-পেয়ালা নিয়ে যেতে ফিরে আসছে উলফ। তাকে বললেন ব্যারন, শোনো, ওদের ঘর দেখিয়ে দাও।
জবাব না দিয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল উলফ। বাসন-পেয়ালাগুলো জড়ো করতে গিয়ে ইচ্ছে করে আছড়ে ফেলতে লাগল একটার ওপর আরেকটা।
নিউ সেকশনে ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছ নাকি? জানতে চাইলেন ব্যারন।
নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল উলফ, না, ওল্ড উইং।
পলকের জন্যে হাসিটা চলে গেল ব্যারনের মুখ থেকে। পরক্ষণে ফিরে এল আবার। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাতটা গিয়ে সেঁটে ঘুম। দাও। কাল সকালে দেখা হবে। তখন কাজের কথা বলব।
তাকে ধন্যবাদ জানাল ছেলেমেয়েরা। তারপর কথা বলতে বলতে উলফের পেছনে চলল একটা করিডর ধরে। আলো খুব কম এখানে। কীটনাশক তার একধরনের বদ্ধ ভাপসা গন্ধ বাতাসে।
পুরানো বাড়িতে এ রকম গন্ধ থাকে, জানে মুসা। আর ওগুলোই হয় ভূতের আস্তানা।
কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে চলেছে উলফ। একটা মোড় ঘুরল। আরেকটা লম্বা করিডর পেরোল। দুই ধারে সারি সারি বদ্ধ দরজা। আবার একটা মোড় ঘুরল। থামল না।
অবাক লাগছে মুসার। কোথায় ওদের নিয়ে চলেছে লোকটা?
অবশেষে একটা খোলা দরজার সামনে থামল উলফ। দরজায় ব্রোঞ্জের প্লেটে নম্বর লেখা রয়েছে: ১৩২-সি।
বাইরে থেকে যতটা মনে হয়, মুসা বলল, ভেতরটা তারচেয়ে অনেক বড়।
তার মন্তব্যের জবাব দিল না উলফ। এখান থেকে চারটা ঘর তোমাদের জন্যে রেডি করেছি। কে কোনটাতে থাকবে নিজেরাই ঠিক করে নাও।
থ্যাংক ইউ, মোলায়েম স্বরে বলল কোরি।
দেখো, তোমাদের এখানে থাকাটা আমার ভাল লাগছে না, উলফ বলল।
কি?
এখানে থাকা তোমাদের জন্যে বিপজ্জনক।
কি বলতে চান? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ছুতোর মিস্ত্রির কাজ, কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল উলফ, খুব কঠিন। মিস্টার মেলবয়েস বুঝতে পারছেন না।
কিন্তু খাটতে তো আমাদের আপত্তি নেই, মুসা বলল, যত কঠিনই হোক, আমরা করব।
এখানে থাকতে ভাল লাগবে না তোমাদের, কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে উলফ। খালি থাকলে সাংঘাতিক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এই বাড়ি। পুরানো তো। পুরানো বাড়ি সব সময়ই খারাপ।
আপনারা থাকতে পারলে আমরাও পারব, কোন অসুবিধে হবে না, কোরি বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি নানানা রকম ব্যাপার ঘটে এখানে, বিশেষ করে হোটেলের গেস্টদের বেলায় এমন সব ব্যাপার যা তোমাদের বলতে পারছি না, কণ্ঠস্বর খাদে নেমে এল উলফের।
জায়গাটাতে কোন সমস্যা আছে নাকি? জানতে চাইল কোরি। ভূতের উপদ্রব?
তাকিয়ে রইল উলফ কোরির দিকে। কতটা বলা যায় ওদের চিন্তা করছে। যেন। দেখো, আমি তোমাদের সাবধান করছি…
আসল কথা বলছেন না কেন? ভুত আছে? দেখেছেন?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল উলফ। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল, অদ্ভুত অনেক কিছুই দেখতে হয় আমাকে, রহস্যময়, শীতল শোনাল ওর কণ্ঠ। বিচিত্র হাসি ফুটল পাতলা ঠোঁটে। ভূত বিশ্বাস করো নাকি তোমরা?
কিশোর বা রবিন কিছু বলে ফেলার আগেই তাড়াতাড়ি বলল মুসা, করি।
কোরি বলল, প্লীজ, বলুন না, কি দেখেছেন?
বাঁচতে চাইলে এখান থেকে চলে যাও, কোরির প্রশ্নের জবাব দিল না। উলফ। কালই।
ছায়ায়, ঢাকা পড়েছে ওর মুখের বেশির ভাগ অংশ। চেহারা দেখে মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। তবে ওর কণ্ঠস্বরই বলে দিল, মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে না সে। আচমকা ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। আর একটা কথাও না বলে যেন নিঃশব্দে ভেসে চলে গেল অন্ধকার, শূন্য করিডর ধরে।