হিকরি ডিকরি ডক (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
০১.
ভ্রুকুটি করলো পোয়ারো, মিস লেমন।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে পোয়ারো?
এই চিঠিতে তিন-তিনটি ভুল আছে।
তার কণ্ঠস্বরে অবিশ্বাসের সুর শোনা গেল। অথচ মিস্ লেমনের স্বপক্ষে বলা যায় ভীষণই সচেতন ও দক্ষ মহিলা, ভুল সে কখনো করেনি। আদৌ সে মহিলা নয়, সে যেন একটা মেশিন–নিখুঁত সেক্রেটারি যে এমনভাবে চালিয়ে নিয়ে এসেছে, তার কাজের ধারা, পদ্ধতিও মেশিনের মতো হয়ে গেছে। পোয়ারোর দক্ষ পুরুষ পরিচায়ক জর্জ এবং ততোধিক দক্ষ সেক্রেটারি মিস্ লেমন তার জীবনে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে আসছে।
তবু তা সত্ত্বেও আজ সকালে একটা সহজ সাধারণ চিঠি টাইপ করতে গিয়ে তিন-তিনটি ভুল করে বসে আছে মিস্ লেমন।
সেই ত্রুটিপূর্ণ চিঠিটা মিস্ লেমনের সামনে মেলে ধরলো এরকুল পোয়ারো, রাগ করেনি সে, তবে কেবল হতভম্ব হয়ে গেছে সে। এটা এমনি একটা ব্যাপার যা ঘটা উচিত নয়–কিন্তু সেটা ঘটেছে, চিঠিটা তার হাত থেকে নিয়ে দেখলে মিস্ লেমন, পোয়ারো তার জীবনে এই প্রথম মিস্ লেমনের মুখ লাল হয়ে উঠতে দেখলো লজ্জায়।
ওহো, প্রিয়, বললো সে, চিন্তা করতে পারি না, কি করেই বা অন্তত, হা হা, এখন বুঝতে পারছি, কারণ আমার বোনের জন্য
তোমার বোন?
আর একটা ধাক্কা, মিস্ লেমনের যে বোন আছে, আগে জানতো না সে, তোমার বোন? পুনরাবৃত্তি করলো এরকুল পোয়ারো। তার কণ্ঠস্বরে অবিশ্বাসের ছোঁয়া।
হ্যাঁ, মাথা নাড়লো সে। মনে হয় না তার কথা আমি তোমার কাছে কখনো উল্লেখ করেছি। বস্তুতঃ তার সারাটা জীবন কেটেছে সিঙ্গাপুরে, তার স্বামীর রাবারের ব্যবসা ছিলো সেখানে। এরকুল পোয়ারো মাথা নেড়ে জানিয়েছিলো, বুঝেছে সে। মিস লেমনের মতো মেয়েদের বোনেদের। বিয়ে হয় সিঙ্গাপুরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যাতে করে এ জগতের মিস্ লেমনেরা যান্ত্রিক দক্ষতা নিয়ে তাদের নিয়োগ কর্তাদের কাজকর্ম মেশিনের মতো সুষ্ঠু ভাবে শেষ করতে পারে (সেই সঙ্গে অবশ্যই তাদের অবসর মুহূর্তে ফাইল ব্যবস্থার নতুনত্ব আবিষ্কারও থাকবে)।
আমি উপলব্ধি করি, বললো লেমন, এগিয়ে যাও, মিস্ লেমন আবার বলতে শুরু করলো।
বছর চারেক আগে বিধবা হয়। সন্তানহীনা। উপযুক্ত ভাড়ায় তাকে আমি একটা ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিই, কিন্তু সত্যিকথা হল সে খুবই একা। কখনো ইংল্যান্ডে থাকেনি সে। তার পরিচিত কিংবা অন্তরঙ্গ বন্ধু বলতে কেউ নেই এখানে। তার হাতে প্রচুর সময়, যাই হোক ছয় মাস আগে ও আমাকে বলে এই চাকরিটা নেওয়ার কথা ভাবছে ও।
চাকরি?
ওয়ারডেন আমার ধারণা ঐরকমই বলে যাকে তারা কিংবা মেট্রন-ছাত্রদের একটা হোস্টেলের, মালকিন একজন আংশিক গ্রীক মহিলা হোস্টেল পরিচালনার জন্য তিনি একজন প্রার্থী খুঁজছিলেন। হিকরি রোডের উপর পুরনো আমলের বাড়ি। সেখানে আমার বোনের শয়নকক্ষ, বসবার ঘর, বাথরুম ও রান্নাঘর সহ একটা সুন্দর বাসস্থান পাওয়ার কথা।
মিস্ লেমন থামলো এখানে। এ অব্দি সে যা যা বললো তাতে বিপর্যয়ের নাম গন্ধ কোথাও নেই। উৎসাহ বোধ করলো পোয়ারো।
দুটো হাত এক করে আমি কখনো ওকে এক দণ্ড বসে থাকতে দেখিনি। বাস্তববাদী মহিলা, এবং ভালোভাবেই কাজ চালাতে পারে, তবে তাই বলে এই নয় যে, এই হোস্টেলে টাকা ঢালতে চায় সে, বা সেরকম কিছু। একেবারে বেতনভোগী ও মাইনে খুব বেশি নয়। তবে টাকার দরকার নেই ওর, তাছাড়া খুব একটা খাটুনির কাজও নয়। সব সময়েই তরুণরা ওর প্রিয় এবং তাদের সঙ্গে ওর ব্যবহারটাও ভালো, বহুদিন প্রাচ্যে ছিলো জাতিগত পার্থক্য এবং মানুষের সমর্থ উপলব্ধি করতে পারে ও। এই হোস্টেলের ছাত্ররা সব জাতি সম্প্রদায়ের, বেশিরভাগই ইংরাজ, তবে তাদের মধ্যে আসলে কিছু কালো চামড়ার মানুষ আছে বলে আমার বিশ্বাস।
স্বভাবতই, বললো এরকুল পোয়ারো।
এমন আমাদের হাসপাতালগুলো অর্ধেক নার্সই কালো চামড়ার, একটু দ্বিধা করে বললো মিস লেমন, আর আমি এও জেনেছি ইংরাজ নার্সদের থেকে তারা অনেক, অনেক বেশি কর্তব্যপরায়ণ ও মনোযোগী। যাহোক, সে প্রসঙ্গ এখানে আসে না। একটা পরিকল্পনা নিয়ে আমরা আলোচনা করি এবং শেষ পর্যন্ত আমরা এগিয়েও যাই। আমি কিংবা আমার বোন হোস্টেলের মালকিন মিসেস নিকোলেটিসকে খুব বেশি পাত্তা দিই না। ভদ্রমহিলা খিটখিটে স্বভাবের। কখনো তার ব্যবহার চমৎকার, আবার কখনো বা দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, একেবারে উল্টো যাকে অবাস্তব বলা যেতে পারে, তিনি যদি সম্পূর্ণ যোগ্যব্যক্তি হতেন, আমার তো মনে হয় তার কোনো সহকারীর দরকার হতো না।
সুতরাং তোমার বোন চাকরিটা নিল? জিজ্ঞেস করলো পোয়ারা।
হ্যাঁ, প্রায় মাস ছয়েক আগে ২৬ নং হিকরি রোডে চলে যায় ও। সবদিক থেকে সেখানকার কাজ ওর খুবই পছন্দসই হয় এবং উৎসাহ বোধ করে।
মন দিয়ে শুনলো এরকুল পোয়ারো, এখনো পর্যন্ত মিস্ লেমনের বোনের অভিমান পর্বটুকু যেটুকু শুনেছি অতি সাদামাটা নীরব বলেই মনে হলো তা কিছুদিন হলো খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছে
ও, চিন্তিত কেন?
দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, হোস্টেলে এমন যা সব ঘটনা ঘটছে, যা একেবারেই পছন্দ নয় ওর।
কেন ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে থাকে নাকি সেখানে? জানতে চাইলো পোয়ারো।
ওহো, তা নয় মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি সেরকম কিছু বলতে চাইনি, আসলে ব্যাপারটা হলো হোটেল থেকে জিনিসপত্র উধাও হয়ে যাচ্ছে।
উধাও হয়ে যাচ্ছে?
হ্যাঁ, উধাও হওয়া জিনিসগুলো অত্যন্ত মামুলি–আর সবই অস্বাভাবিক ভাবে।
তুমি বলছো, জিনিসগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে, তার মানে চুরি হয়ে যাচ্ছে বলো?
হা, ঠিক তাই।
তা, পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে।
না, এখনো দেওয়া হয়নি। আমার বোনের আশা তার আর দরকার হবে না। কিছু তরুণ ছাত্র ওর খুব প্রিয়–মনে হয় সেই জন্যেই, পুলিশ তাদের জ্বালাতন করবে; তা ও চায় না, তাছাড়া ব্যাপারটা ও নিজেই সমাধান করতে চায়।
হা, চিন্তিত ভাবে বললো পোয়ারো। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি যদি বলি, তোমার নিজের উদ্বেগ যা তোমার বোনের উদ্বেগের প্রতিফলন বলে আমি মনে করতে পারি, কিন্তু সেটা তো বোঝাচ্ছে না।
আমি ঠিক এই পরিস্থিতি পছন্দ করি না। আদৌ আমি এসব পছন্দ করি না। আমি চিন্তাই করতে পারি না কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে যা আমি বুঝতে পারছি না।
চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিলো পোয়ারো, সাধারণ চুরি নয়? ক্রেমাটোম্যানিয়াল? মানে চুরি করার জন্য উদ্দাম সেরকম কিছু?
না, আমি তা মনে করি না, এ বিষয়ে আমি লেখাপড়া করেছি, মিস্ লেমন যথেষ্ট সচেতন, এনসাইক্লোপেডিয়া আর মেডিক্যাল জার্নাল আমার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি, কিংবা বলতে পারো আমার মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারেনি।
প্রায় মিনিট খানেকের উপর নীরবে কি যেন ভাবলো পোয়ারো, বহুভাষিক হোস্টেলকে কেন্দ্র করে মিস্ লেমনের বোনের এই ঝামেলায় সেকি জড়িয়ে পড়বে? কিন্তু মিস্ লেমনের ভুল চিঠি টাইপ করাটা অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং অসুবিধাজনক। এই ঝামেলায় তাকে যদি জড়িয়ে পড়তে হয়, নিজের মনে বললো সে, সেটা একটা কারণ হতে পারে।
সৌজন্য প্রকাশের জন্য পোয়ারো তার মাথা নত করে বললো, আচ্ছা মিস লেমন বিকেলে চায়ের বৈঠকে তোমার বোনকে আমন্ত্রণ জানালে কি রকম হয়? হয়তো আমি তাকে একটুআধটু সাহায্য করতে পারি।
সে ত তোমার অসীম দয়া মঁসিয়ে পোয়ারো। সত্যি তোমার অসীম দয়া। বিকেলে সব সময়েই আমার বোনের অখণ্ড অবসর।
তাহলে আগামীকালই হোক, তা তুমি এর ব্যবস্থা করতে পারবে?
মাথা নেড়ে সায় দিলো মিস লেমন, আর সেই সময়ে বিশ্বস্ত জর্জকে খাবার ও দামি সুগন্ধি চায়ের ব্যবস্থা করতে বলা হলো।
.
০২.
মিস লেমনের বোন মিসেস হার্বার্ডের সঙ্গে তার বোন-এর অবশ্যই মিল আছে। গায়ের রং হলুদ, গোলগাল মুখ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, তবে বোনের মতো অতো চটপটে নয়। কিন্তু বোনের মতো তার চোখের চাহনিও তীক্ষ্ণ।
মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার মতো অমন ব্যস্ত মানুষ আমার জন্য কষ্ট করছেন, এ আপনার বদান্যতারই পরিচয়, বললো সে। আর এমন চমৎকার উৎকৃষ্ট চা ঠিক আপনার স্বভাবের মতোই সুন্দর। জানেন, ফেলিসিটির বর্ণনা মতো মনে মনে আমি আপনার যে ছবি এঁকেছিলাম, আপনি ঠিক সেইরকম।
ফেলিসিটি, সেটা যে মিস্ লেমনের খ্রিস্টান নাম, সেটা মনে পড়তেই পোয়ারোর অবাক হওয়া ভাবটা তার মুখ থেকে মিলিয়ে গেলো। পোয়ারো তাকে বলে তার আশা, মিস্ লেমনের থেকেও তার দক্ষতা যেন কোনো অংশে কম না হয়।
নিশ্চয়ই, অন্যমনস্ক ভাবে মিসেস হার্বার্ড বলে উঠলো, মানুষজনের ব্যাপারে ফেলিসিটি কখনো তেমন যত্ন নেয়নি, কিন্তু আমি নিয়ে থাকি, আর সেই কারণে আমি চিন্তিত।
তা তোমার চিন্তার কারণটা ঠিক কি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারবে?
হ্যাঁ আমি পারি; চুরির কেস, টাকা গহনা হলেও তবু বলা যেতো নির্ভীক চোর সে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিপরীত তবে ক্রেমাটোম্যানিয়া কিংবা অসৎ কাজ বলা যেতে পারে। উধাও হওয়া জিনিসগুলো তালিকা পরে শোনাচ্ছি। সে তার হাতব্যাগ থেকে ছোট্ট নোটবই বার করল।
সান্ধ্যজুতো (নতুন একপাটি)
ব্রেসলেট (কস্টিউম জুয়েলারি)
হীরের আংটি (সুপের প্লেটে পাওয়া গেছে)। পাউডার, লিপস্টিক, স্টেথোস্কোপ, কানের দুল, সিগারেট, লাইটার, পুরানো ফ্লানেলের ট্রাউজার, ইলেকট্রিক লাইট বাল্ব, চকোলেট বাক্স, স্লিকস্কাফ (টুকরো টুকরো করা অবস্থায় পাওয়া গেছে) ঝোলাব্যাগ (টুকরো টুকরো করা) বোরিক পাউডার, বাথ সল্ট, রান্নার বই।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো এরকুল পোয়ারো, উল্লেখযোগ্য বটে, বললো সে, আর একেবারে মনোরম, মিসেস হার্বার্ডের দিকে তাকিয়ে বললো সে, আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
কিন্তু কেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
এমন একটা অদ্বিতীয় আর চমৎকার সমস্যা উপস্থাপন করার জন্য অভিন্দন জানাচ্ছি।
মঁসিয়ে পোয়ারো মনে হচ্ছে সমস্যাটা আপনি বুঝতে পেরেছেন!
কিন্তু না, এখনো পর্যন্ত আমি কিছুই বুঝিনি, এ প্রসঙ্গে খ্রিস্টমাসের সময় আমার কয়েকজন তরুণ বন্ধুর এক ধরনের খেলার কথা মনে করিয়ে দেয় আমাকে, তিনজন মহিলা লেডি, প্রতিটি মহিলার সুযোগ এলে তারা একটা প্রবাদ উচ্চারণ করতো। আমি প্যারিসে গিয়েছিলাম সেখানে আমি একটা জিনিস ক্রয় করি। জিনিসের নাম যে যার প্রয়োজন মতো বসিয়ে দেয় তাদের লেখার মধ্যে। পরবর্তী ব্যক্তি একইভাবে সেই প্রবাদের পুনরাবৃত্তি করে এবং আর একটা জিনিসের নাম বসিয়ে দেয়। এই খেলার উদ্দেশ্য হলো, তাদের বর্ণিত জিনিসগুলো ঠিক ঠিক মনে রাখা, এ এক ধরনের অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর ধরনের খেলা বলে আমি মনে করি। একখণ্ড সাবান, একটা সাদা হাতি, একটা টেবিল আর একটা রাশিয়ান পাতিহাঁস, এমন জিনিসগুলোই কেবল মনে করতে পারি। অবশ্যই মনে রাখার অসুবিধার কারণ হলো একটা জিনিসের সঙ্গে অপর জিনিসের কোনো যোগ নেই-বলা যেতে পারে পরিণতির অভাব, যেমন এইমাত্র যে তালিকাটা আমাকে দেখালেন, বারোটা জিনিস সঠিক ভাবে সাজানো অসম্ভব ব্যাপার, ব্যর্থ হলে একটা কাগজের শিঙা প্রতিযোগীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সে নারী কিংবা পুরুষই হোক তাকে পরবর্তী সময়ে আবৃত্তি চালিয়ে যেতে এই শর্তে আমি একজন শিঙাওয়ালা মহিলা প্যারিসে গিয়েছিলাম ইত্যাদি, তিনটি শিঙা সংগৃহীত হলে তার অবসর নেওয়াটা বাধ্যতামূলক, এক্ষেত্রে শেষ জন বিজয়ী হবে।
মঁসিয়ে পোয়ারো, তুমিই যে বিজয়ী, আমি নিশ্চিত, অনুগত কর্মিণীর বিশ্বাস নিয়ে বললো মিস লেমন।
পোয়ারোর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো।
হ্যাঁ, এটাই ঘটনা, বললো সে, এমনকি ভীষণভাবে এলোমেলো জিনিসগুলোও ঠিক ঠিক ভাবে সাজানো যেতে পারে–তবে উদ্ভাবনী দক্ষতা ও পরিণতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। যেমন একজন নিজেই নিজেকে বলে, টেবিলের উপর রাখা একটা বিরাট মার্বেল পাথরের সাদা হাতির ময়লা আমি একখণ্ড সাবান দিয়ে পরিষ্কার করি–এইরকম আর কি?
প্রথার সাথে মিসেস হার্বার্ড বলে উঠলো, তাহলে সম্ভবত যে তালিকাটি আমি আপনাকে দিয়েছি সেটা দিয়ে একই জিনিস আপনি করতে পারেন।
নিঃসন্দেহে আমি করতে পারি। একজন মহিলা তার ডানপায়ে জুতো পরে, বাঁ হাতে ব্রেসলেট পরলেন, তারপর তিনি মুখে পাউডার ও ঠোঁটে লিপিস্টিক লাগিয়ে নিচে নৈশভোজের জন্য নেমে আসেন এবং তার আংটিটা স্যুপের মধ্যে ফেলে দেন-এই রকম আরকি। সুতরাং আপনার তালিকা থেকে এইভাবে আমি মনে করতে পারি কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, এটাই আমাদের কার্য। কথা হচ্ছে এলোমেলোভাবে জিনিসগুলো কেন চুরি করা হলো? এর পিছনে কোনো রীতি বা নিয়ম আছে? কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কিংবা সেরকম কিছু এখানে প্রাথমিক বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রথম কাজ হবে জিনিসগুলোর তালিকা সতর্কতার সঙ্গে অনুধাবন করা।
একটা নীরবতা নেমে আসে। পোয়ারো নিজেই অনুধাবন করতে থাকে, বাচ্ছা ছেলে মেয়েকে দেখার মতো পোয়ারোকে নিবিষ্ট মনে নিরীক্ষণ করতে থাকে মিসেস হার্বার্ড, সবশেযে পোয়ারো মুখ খুলতেই লাফিয়ে উঠলো মিসেস হার্বার্ড।
প্রথম যে জিনিসটা আমার মনে দাগ কেটেছে সেটা হলো, বললো পোয়ারো, উধাও হয়ে যাওয়া জিনিসগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কম দামের, ব্যতিক্রম শুধু দুটি ক্ষেত্রে স্টেথোস্কোপ আর হীরের আংটি। একমুহূর্তের জন্য স্টেথোস্কোপটা আলাদা করে সরিয়ে রেখে আংটিটার উপর আমি মনোনিবেশ করতে চাই, আপনি বলেছেন এটা দামি জিনিস–তা এর দাম কতো হতে পারে?
ঠিক কতো যে আমি তা বলতে পারবো না আঁসিয়ে পোয়ারো। সেটা ছিল একটা কাটা হীরে, ওটা মিস্ লেমনের মায়ের বাগদানের চিহ্ন স্বরূপ আংটি, ওটা পাওয়া যাচ্ছে না শুনে তিনি মুষড়ে পড়েন। সেই দিনই সন্ধ্যায় মিস্ জনহাউসের স্যুপের প্লেটের ভেতর থেকে সেটা পাওয়া যেতেই আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম
সুতরাং এরকমই কিছু একটা ঘটে থাকবে, কিন্তু আমি মনে করি, জিনিসগুলো চুরি যাওয়া আর ফিরে পাওয়া অর্থপূর্ণ, ধরুন যদি লিপস্টিক, পাউডার কিংবা বই হারাতো সেক্ষেত্রে আপনাদের পুলিশকে খবর না দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি। কিন্তু দামি হীরের আংটিটা স্বতন্ত্র। পুলিশ যে আসবে সে সম্ভাবনা সব সময়েই থাকতে পারে। তাই আংটিটা ফিরিয়ে বেতন্ত্র পুলিশ যে আসদেওয়াটা যুক্তিযুক্ত পাউডার কিংবা বই
কিন্তু যেই নিক না কেন, ফেরত যে দিতে হবে তা জেনেও কেনই বা সেই আংটিটা নিতে গেলো?
ভ্রুকুটি করলো মিস লেমন।
তবু কেন? বললো পোয়ারো, সে প্রশ্নে আমি পরে আসছি, আমি এইসব জিনিস চুরির শ্রেণিবিভাগ করতে ব্যস্ত, প্রথমে সেই হীরের আংটির কথাই ধরা যাক। কে এই মিস যেমন, যার কাছ থেকে আংটিটা চুরি যায়? যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে নিশ্চয়ই?
ওহো না, তার নিজস্ব অর্থ বলতে যৎসামান্যই, তবে সবসময়ই খুবই সতর্ক সে। যে আংটিটার কথা আমি বলছি সেটা ছিলো না। সম্প্রতি ধূমপানও বন্ধ করে দিয়েছিলো সে।
তাহলে তার পছন্দ কি? তোমার নিজের ভাষায় মেয়েটির সম্পর্কে কিছু তো।
বেশ তাহলে শুনুন। নেহাতই সাদামাটা দেখতে, নারী সুলভ চেহারা কিন্তু তার মধ্যে খুব বেশি দীপ্তভাবে কিংবা জীবনবোধ বলতে কিছু নেই। কি বলবেন তাকে–তবে হ্যাঁ তার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব নেই।
তার আংটি আবার মিস জনহাউসের স্যুপের প্লেট থেকে ফেরৎ পাওয়া যায়। তা কে এই মিস জনহাউস?
ভ্যালেরি জনহাউস। চতুর মেয়ে সে, ময়লা রং, ব্যঙ্গে ভরা তার কথাবার্তা। একটা বিউটি পার্লারে কাজ করে সে। ম্যানরি না মোয়ার–নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই, এই দুটি মেয়ে পরস্পরের বন্ধু।
কি যেন চিন্তা করলো মিস হার্বার্ড। তারপর বললো সে, হ্যাঁ আমি বলবো সেইরকমই। পরস্পরের মধ্যে তাদের কিছু করার ছিলো না। আমি বলবো প্রত্যেকেরই সঙ্গেই প্যাট্রিসিয়ার ভাব ছিলো। কিন্তু ভ্যালেরি জনহাউসের অনেক শত্রু তার ওই ধরনের বাঁকা বাঁকা কথার জন্যই হয়তো…সেটা সে জানতোই বটে, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।
মনে হয় জানি, বললো পোয়ারো।
সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে চমৎকার মেয়ে এই প্যাট্রিসিয়া, কিন্তু একটু অনুজ্জ্বল, নিষ্প্রভ যাকে বলে আর কি, তবে ভ্যালেরি জনহাউসের ব্যক্তিত্ব আছে, পোয়ারো চুরি যাওয়া তালিকার উপর আবার মনোনিবেশ করলো অতঃপর।
তা কিসের জন্য এত ষড়যন্ত্র? এখানে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জিনিস চুরি গেছে। জিনিসগুলো খুবই সামান্য প্রকৃতির। এই জিনিসগুলো কেবল জীবনে ব্যর্থ মেয়েদেরই প্রলোভিত করতে পারে। যেমন ধরা যাক সম্ভবত লিপস্টিক, কস্টিউম জুয়েলারি, পাউডার, বাথ সল্ট, চকোলেটের বাক্স। তারপর স্টেথোস্কোপের প্রসঙ্গে আসা যাক : কোথায় এটা বিক্রি করা যায় কিংবা বন্ধকী রাখা যায় চোর সে কথা বেশ ভালো ভাবেই জানে। এর মালিক কে?
মিঃ বেটসন-দারুণ বন্ধুসুলভ তরুণ সে।
মেডিক্যাল ছাত্র?
হ্যাঁ।
সে কি খুবই ক্রুদ্ধ?
জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, ছেলেটি একেবারে নীরস, রগচটা–মুহূর্তে যা খুশি বলে দেবে, তবে অচিরেই তার রাগ পড়ে যায়। কোনো জিনিস চুরি গেলে নির্বিকার চিত্তে সে মেনে নেবে সেরকম প্রকৃতির মানুষ সে নয়।
তা সেরকম প্রকৃতির মানুষ এখানে আছে নাকি?
হা আছে–মিঃ গোপালরাম, আমাদের ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে একজন। সব ব্যাপারেই তার মুখে হাসি লেগেই থাকে, হাত নেড়ে সে বলে থাকে, কে কোনো জিনিসের মালিক, ওটা কোনো ব্যাপরই নয়।
তার কোনো জিনিস চুরি গেছে?
না।
আহ! আচ্ছা ফ্লানেলের ট্রাউজারটা কার?
মিঃ ম্যাকনারের, বহু পুরানো ট্রাউজার। অন্য কেউ হলে বলতো, পুরানো জিনিস চুরি গেছে তো কি হয়েছে। কিন্তু মিঃ ম্যাকনারের আবার পুরানো জিনিসের উপর ভীষণ টান, কোনো কিছুই ফেলে না সে।
তাহলে এখন আমরা মনে করতে পারি–চুরি যাওয়া জিনিসগুলো যেন মূল্যবান ছিলো না–পুরানো ফ্লানেলের ট্রাউজার, ইলেকট্রিক লাইটবাক্স, বোরিক বাউডার, বাথ সল্ট, রান্নার বই। ভুলবশতঃ বোরিক পাউডার সরানো হয়েছে; কেউ হয়তো নতুন বাল্ব বদলানোর জন্য বাতিল অকেজো বাল্বটা সরিয়ে থাকবে, কিন্তু পরে ভুলে গেছে রান্নার বইটা কেউ হয়তো ধার করে নিয়ে গেছে, কিন্তু আর ফেরৎ দেয়নি। আর ট্রাউজারটা কোনো ঠিকা ঝি নিয়ে গিয়ে থাকবে।
সাফাই-এর কাজের জন্য দুটি মেয়েকে রেখেছি। তাদের সম্পর্কে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, না জানিয়ে তারা এ কাজ করবে না।
তোমার ধারণাই হয়তো ঠিক। যাই হোক এরপর সান্ধ্য জুতোর কথায় আসা যাক। নতুন জুতাজোড়ার এক পাটি। কার সেটা?
সেলী ফিঞ্চের, আমেরিকান মেয়ে এখানে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছে সে।
সেটা যে কোথাও স্রেফ ভুল করে রেখে দেওয়া হয়েছে, অথচ জায়গাটার কথা কেউ মনে করতে পারছে না, এ ব্যাপারে তুমি কি নিশ্চিত? কারণ একপাটি জুতো কারোর কাজে লাগতে পারে না বলেই এ কথা বলছি।
না মঁসিয়ে পোয়ারো, ভুল করে কোথাও রাখা হয়নি সেটা, আমরা সবাই তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও পাইনি। মিস ফিঞ্চের একটা পার্টিতে যাওয়ার কথা ছিলো। সান্ধ্যপার্টি আমরা যাকে বলি ফর্মাল ড্রেস–পোশাকের সঙ্গে জুতোও মানিয়ে পড়তে হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন সান্ধ্য জুতোটা তার কাছে কতোই না জরুরী ছিলো।
তাহলে তার নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা হয়েছিল–সেই সঙ্গে বিরক্তও হয়ে থাকবে সে।
-হা-হা। আমার আশঙ্কা, সম্ভবত এক্ষেত্রে জুতোেচুরির ব্যাপারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক জড়িয়ে থাকলেও থাকতে পারে–একটু সময়ের জন্য নীরব থাকে সে, এরপর আরো দুটো জিনিস বাকি থাকে-টুকরো টুকরো করে কাটা একটা ঝোলা, আর একই ভাবে কেটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা একটা সিল্কের স্কার্ফ, এ দুটি অস্বাভাবিক কাজের ব্যাপারে আমরা বলতে পারি, এর পিছনে কোনো অসার দম্ভ কিংবা লোভের সম্পর্ক নেই। বরং বলা যেতে পারে ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রতিহিংসা নেওয়ার একটা প্রবণতা থেকে যায়। ঝোলাটা কার?
প্রায় সব ছাত্রছাত্রীদেরই একটাই দোকান থেকে কেনা। তাই সেটা যে আসলে কার নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, তবে মনে হয় সেটা লিওনার্ড বেটসন কিংবা কলিন ম্যাকনারের হতে পারে।
আর সিল্কের স্কার্ফটা কার?
ভ্যালেরি জনহাউসের, সেটা সে খ্রিস্টমাসের উপহার হিসাবে পেয়েছিল। পান্নার মতো সবুজ রঙ-সত্যি সেটা খুবই উৎকৃষ্ট ছিলো।
মিসেস হার্বার্ড তোমার জন্য শুভ কখন চুরি যায় বলোতোসিয়ে পোয়ারো।
মিস জনহাউসের তাই বুঝি!
চোখ বন্ধ করলো পোয়ারো, মনে মনে একটা দূরবীন উপলব্ধি করেছিল সে। সে যেন সেই দূরবীন দিয়ে লক্ষ্য করছিল, ঝোলা ও স্কার্ফের কাটা টুকরো টুকরো অংশ, রান্নার বই, লিপস্টিক, বাথ সল্ট নখ আর বুড়ো আঙুলের নখগুলো অনেক পুরানো ছাত্রীদের কথাই মনে করিয়ে দেয়? কেন কোথাও এগুলো একত্র করার সঙ্গত কারণ নেই। একটার সঙ্গে আর একটা ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। লোকেরা চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পোয়ারো বেশ ভালোভাবেই জানে যেভাবেই হোক আর কোথাও না কোথাও এসবের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ ঠিক আছে। সম্ভবত অনেক উদাহরণ। সম্ভবত প্রত্যেক সময়ে দুর্দিনে বিভিন্ন নিদর্শন পরিলক্ষিত হতে পারে। কিন্তু সেইসব নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটাই সঠিক–তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে শুরু করা যায়–
চোখ মেলে তাকাল সে।
এ ব্যাপারে আরো কিছু প্রতিফলন দরকার। ভালোরকম প্রতিফলন মানে বিশ্লেষণ।
ওহো, নিশ্চয়ই মঁসিয়ে পোয়ারো, আগ্রহ সহকারে জোর দিয়ে বললো মিসেস হার্বার্ড, আপনাকে আমি কষ্ট দিচ্ছি না তো
না, না একটুও নয়। আমাদের এখন বাস্তব দিকটার কথা ভাবতে হবে। এবার তাহলে শুরু করা যাক–সেই জুতো, সান্ধ্যজুতোহা মিস্ লেমন সেখান থেকেই আমরা শুরু করতে পারি।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে পোয়ারো। মিস্ লেমন লেখার প্যাড আর পেন্সিল নিয়ে লিখতে বসে গেলো।
সম্ভবত মিসেস হার্বার্ড তোমার জন্য অপর জুতোর পাটিটা সংগ্রহ করবে। তারপর বেকার স্ট্রিটে হারানো সম্পত্তির বিভাগে যাবে। আচ্ছা কখন চুরি যায় বলোতো?
একটু সময় চিন্তা করে বললো মিসেস হার্বার্ড, হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে মাঁসিয়ে পোয়ারো। সম্ভবত মাস দুই আগে হবে? ঠিক কোনো দিন এখুনি সেটা বলতে পারছি না, তবে সান্ধ্য পার্টির তারিখটা মিস্ সেলী ফিঞ্চ-এর কাছ থেকে জেনে বলতে পারি।
হ্যাঁ, সেই ভালো–আর একবার মিস্ লেমনের দিকে ফিরলো সে, এ ব্যাপারে তোমাকে একটু লুকোচুরি খেলা খেলতে হবে। তুমি বলবে, আর একপাটি জুতো ইনার সার্কল ট্রেনে ফেলে এসেছ–এরকম ঘটা স্বাভাবিক–কিংবা অন্য কোনো ট্রেনে ফেলে আসার কথাও বলতে পারো। আমরা বাসে, আচ্ছা হিকরি রোডে কতগুলো চলাচল করে?
মাত্র দুটি মঁসিয়ে পোয়ারো।
ভালো, বেকার স্ট্রিট থেকে সাড়া না পেলে এখন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে চেষ্টা করে দেখতে পারো, আর তাদের বলো একপাটি জুতো ট্যাক্সিতে ফেলে এসেছে।
কিন্তু আপনি কেন ভাবছেন–মিসেস হার্বার্ড শুরু করতে চায়। পোয়ারো বাধা দিলো তাকে।
ফলাফলটা কি হয় আগে দেখা যাক, তারপর সেগুলো যদি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক হয়, তখন তুমি, আমি আর মিসেস হার্বার্ড অবশ্যই আবার আলোচনায় বসবো। এখন তুমি বলো কোনো কোনো জিনিস যা আমার জানা একান্ত প্রয়োজন।
সত্যি কথা বলতে কি আমার মনে হয়, আমি সব কিছুই বলেছি।
না, না, আমি তোমার সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারছি না, এখানে আমরা বিভিন্ন যুবক যুবতাঁকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে দেখেছি, যাদের মেজাজ একজনের থেকে আর একজনের একেবারে বিপরীত। ব্যাপারটা এইভাবে সাজানো যেতে পারে–এ ভালোবাসে বিকে, কিন্তু বি ভালোবাসে সিকে আর সম্ভবত ঐজন্য ডি ও ই ছোরা জাতীয় অস্ত্র উঁচিয়ে আছে, এসব খবরই আমাকে জানতে হবে, পারস্পরিক মানবিক ভাবপ্রবণতা, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা-বন্ধুত্ব, অশুভ কামনা বা অপকারের ইচ্ছা এবং সবরকম নির্মমতা।
কিন্তু আমি নিশ্চিত, অস্বস্তিবোধ করলো মিসেস হার্বার্ড, এসব ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ আমি জানি না। আর আমি তাদের সঙ্গে তেমনভাবে মেলামেশাও করি না, হোস্টেলটা আমি পরিচালনা করি মাত্র, আর ক্যাটারিং-এর দেখাশোনা করে থাকি। ব্যস এই অব্দি।
কিন্তু মানুষজনদের ব্যাপারে তুমি আগ্রহী। তুমি আমাকে সেইরকম বলেছো। তুমি তরুণদের ভালোবাসো। এই কাজটা তুমি অতো টাকা রোজগারের জন্য নয় মানুষের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার জন্য, কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের তুমি পছন্দ করে থাকো, আবার কেউ কেউ তোমার পছন্দের তালিকায় পড়ে না। এ ব্যাপারে তুমি আমাকে বলবে হ্যাঁ, তোমাকে বলতই হবে। কারণ তুমি চিন্তিত-তাই বলে যা ঘটেছে তার জন্য নয়–তা হলে তুমি অনেক আগেই পুলিশের শরণাপন্ন হতে
হোস্টেলে পুলিশ প্রবেশ করুক মিসেস নিকোলেটিস তা চান না, একথা আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি।
না, তুমি এমন একজনের জন্য চিন্তিত–যাকে তুমি মনে করো এসবের জন্য দায়ী সে কিংবা অন্তত এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছে সে। কেউ একজন, সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, তাকে তুমি পছন্দ করে থাকো।
সত্যি মঁসিয়ে পোয়ারো?
হ্যাঁ সত্যিই তাই, আর আমি মনে করি, তোমার সেই উদ্বেগ যথার্থ, সেই সিল্কের স্কার্ফটা টুকরো টুকরো হওয়া ভালো নয়। আর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া সেই ঝোলাটা, সেটাও ভালা ব্যাপার নয়। বাকি ঘটনাগুলো ছেলেমানুষি–তবু আমি এখনো নিশ্চিত নই। না, আমি একেবারই নিশ্চিত নই।
.
০৩.
একটু দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে এলো মিসেস হার্বার্ড। ২৬এ, হিকরি রোডে তার দরজা খুলে দাঁড়াতেই পিছন থেকে একজন বড় মাপের লালচুলের যুবক বলে উঠলো : হ্যালো মা-লিওনার্ড বেটসন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই সম্বাধন করেছিল, তার হৃদয়টা বন্ধু সুলভ এবং তার স্বভাবে হীনমন্যতা কিংবা কোনো রকম জটিলতার স্থান নেই। হৈ-চৈ করতে বেরিয়েছিলেন বুঝি?
মিঃ বেটসন, মনে রেখো আমি চা পান করতে বেরিয়েছিলাম। একেই আমার দেরি হয়ে গেছে, এখন আর আমার দেরি করো না।
জানেন, আজ আমি একটা সুন্দর মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করেছি, বললো লিও। একেবারে টুকরো টুকরো করে কেটেছি যাকে বলে।
বেয়ারা ছেলে, ওরকম ভয়ঙ্কর হয়ো না। চমৎকার মৃতদেহ, তাই নাকি? আমাকে একেবারে খুঁতখুঁতে ভেবো না।
শব্দ করে হাসলো বেটসন। হা-হা-হা শব্দটা সারা হলে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরলো।
মেলিয়ার কাছে কিছুই নয় ভেবেছিলাম, বললো সে, ডিসপেনসারিতে গিয়েছিলাম, একটা মৃতদেহ সম্পর্কে তোমাকে বলতে এসেছিলাম। আমি বলি, হঠাৎ তার মুখটা সাদা কাগজের মতো হয়ে গেলো। আমি তো ভাবলাম বুঝি বা মারা গেলো সে, আচ্ছা মা হার্বার্ড, এ ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন? আশ্চর্য হননি।
এতে আমি বিন্দুমাত্র অবাক হইনি, মিসেস হার্বার্ড বলে, সম্ভবত মেলিয়া ভেবেছিল তুমি সত্যিকারের মৃতদেহের কথা বলছো তাকে।
কি বলতে চান আপনি, সত্যিকারের মৃতদেহ নয়? মৃতদেহগুলো কি বলে মনে করেন আপনি? সিন্থেটিকের?
অবিন্যস্ত চুলের একটি পাতলা রোগাটে যুবক ডানদিকের ঘর থেকে বেরিয়ে চলতি পথে বলে উঠলো, ওহো, তুমি? আমি তো ভেবেছিলাম, কোনো যণ্ডামার্কা লোক বুঝি, কণ্ঠস্বর তো একজনের, কিন্তু গলার জোর শুনে মনে হয়েছিল বুঝি দশটা লোক একসাথে কথা বলছে।
আশা করি, তাতে তোমার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েনি নিশ্চয়?
স্বাভাবিকের বেশি কিছু নয়? বললো নিজেল চ্যাপম্যান, এবং ফিরে চললো আবার।
বেচারা! আমাদের মৌসুমী ফুল, বিদ্রূপ করে বললো বেটসন অপসৃয়মাণ চ্যাপমানের দিকে তাকিয়ে।
দেখো লিও, তোমার দুটো বদ স্বভাব পাল্টাতে হবে, বললো মিসেস হার্বার্ড। মেজাজটা ভালো করতে হবে, যা আমি পছন্দ করি, আর দেওয়া নেওয়ার মনোভাব নিতে হবে তোমাকে।
মিসেস হার্বার্ডের স্নেহভরা কথা শুনে অমন বড় মাপের তরুণ লিওনার্ডের মাথাটা শ্রদ্ধায় নেমে পড়লো, জানো মা, আমাদের নিজেকে আমি পর ভাবি না। সেই সময়, একটি মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল, চিৎকার করে বলে উঠলো সে, ওহো মিসেস হার্বার্ড আপনি এসে গেছেন। মিসেস নিকোলেটিস তার ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাড়াতাড়ি যান।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিসেস হার্বার্ড, তারপরেই উপরতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো সে।
উপরে কি হয়েছে ভ্যালেরি? যথা সময়ে হার্বার্ড মার কাছে আমাদের স্বভাবের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো বুঝি পাঠিয়ে দেওয়া হবে?
মেয়েটি তার সুন্দর কাঁধ ঝাঁকিয়ে হলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে বলে উঠলো, দিনকে দিন এই বাড়িটা পাগলাগারদের মতো হয়ে উঠছে, তারপর সে আর মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ালো না সেখানে।
ছাব্বিশ নং হিকরি রোড আসলে দুটো বাড়ির সমন্বয়, ২৪ এবং ২৫ নং পাশাপাশি। একেবারে নিচের তলাটা একই বাড়ির মতোন। সেখানে দুটো বাড়ির বসবার ঘর, ডাইনিংরুম এবং দুটো ক্লোকরুম, বাড়ির পিছন দিকে একটা ছোট্ট অফিস ঘর। তবে দুটি আলাদা সিঁড়ি বাড়ির ওপর তলায় যাওয়ার পথ। বাড়ির ডানদিকের ঘরগুলো মেয়েদের অধিকারে এবং অন্যদিকে ২৪ নং বাড়িতে ছেলেরা থাকে। মিসেস নিকোলেটিসের ঘরের দরজায় মৃদু টোকা মেরে ঢুকলো মিসেস হার্বার্ড।
মিসেস নিকোলেটিসের বসবার ঘরটা বড় গরম। বড় বৈদ্যুতিক চুল্লিটা সবসময়ই জ্বালা থাকে, জানালাটা সবসময়ই আঁট করে বন্ধ; ময়লা সিল্ক এবং ভেলভেটের কুশানে মোড়া সোফার উপর বসে ধূমপান করছিলেন মিসেস নিকোলেটিস। কালো বড়মাপের চেহারা তার; তা সত্ত্বেও এখনো তাকে দেখতে পেশ ভালোই লাগে। অবশ্য মুখ দেখলে বদমেজাজী বলেই মনে হয়। চোখ দুটো বাদামী রং-এর।
আচ্ছা, তাহলে তুমি এসে গেছ। মিসেস নিকোলেটিসের কণ্ঠস্বরে একটা প্রচ্ছন্ন অভিযোগের সুর যেন শোনা গেল।
সত্যিকারের লেমন রক্তের মানুষ মিসেস হার্বার্ড অবিচলিত। হ্যাঁ, তীক্ষ্ণস্বরে বললো সে, আমি এসে গেছি। শুনলাম, আপনি নাকি আমাকে বিশেষভাবে ডেকে পাঠিয়েছেন?
হ্যাঁ অবশ্যই, এটা বিস্ময়কর, অস্বাভাবিকের থেকে কিছু কম নয়।
বিস্ময়কর কিসের?
এই বিলগুলো। তোমার হিসেব, সফল যাদুকরের মতো কুশনের নিচ থেকে কতকগুলো কাগজ বার করে তার সামনে মেলে ধরে তিনি বললেন, এই সব হতভাগ্য ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে আমরা কি খেতে দিচ্ছি? দিনকে দিন নিস্তেজ হয়ে পড়ত তারা। এই সব ছাত্রছাত্রীরা কে, তাদের কথা কে চিন্তা করবে?
তরুণ ছাত্রছাত্রীদের খিদে মেটানোর জন্য, বললো মিসেস হার্বার্ড, ভালা প্রাতঃরাশ আর রাতে সুন্দর নৈশভোজের ব্যবস্থা থাকে। এ সবই মিতব্যয়িতার সাথে করা হয়। একটুও বাড়তি খরচ হয় না।
মিতব্যয়িতার সাথে? একটুও বাজে খরচা হয় না? একথা তুমি আমাকে বলতে পারলে? বিশেষ করে আমি যখন শেষ হয়ে যাচ্ছি?
কেন, এখান থেকে আপনি তো বেশ ভালো লাভই করেছেন মিসেস নিকোলেটিস। ছাত্রছাত্রীদের কাছে দরটা একটু বেশিই বলতে হয়। সে যাই হোক, তরুণ ছাত্রছাত্রীদের ঠিক মতো খাবারের যোগান দিতে হবে।
বাঃ এই বিলগুলোর মোট খরচের অঙ্কটা স্ক্যান্ডালে ভরা। এর জন্য দায়ী ওই ইতালীয় বাঁধুনী আর তার স্বামী। খাবারের ব্যাপারে তারা তোমাকে প্রতারণা করছে।
ওহো, না তারা একাজ করতেই পারে না মিসেস নিকোলেটিস। আমি আপনাকে আশ্বাস দিতে পারি, কোনো বিদেশীই আমার ঘাড়ে এ রকম দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারে না।
তাহলে তুমি, হ্যাঁ তুমিই আমাকে ঠকাচ্ছো।
আগের মতো তেমনি অবিচলিত রইলো মিসেস হার্বার্ড–আমি আপনাকে এ ধরনের কথা বলার অনুমতি দিতে পারি না। মিসেস হার্বার্ড এমন ভাষায় কথা বললেন, যেন সাবেকি আমলের দিদিমা তার নাতনীকে নিষ্ঠুরভাবে দোষারোপ করছে। এটা কোনো ভালো কাজ নয়, বিশেষ করে আজকের দিনে, আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, এভাবে চললে আপনাকে অসুবিধায় পড়তে হবে।
আচ্ছা, নাটকীয় ভাবে বিলগুলো শূন্যে ছুঁড়ে ফেললেন মিসেস নিকোলেটিস। মেঝের উপর যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়লো সেগুলো, নিচু হয়ে সেগুলো নীরবে কুড়োতে থাকলো মিসেস হার্বার্ড। আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন, উত্তেজিত করে তুলছেন, তার নিয়োগকর্তী চিৎকার করে উঠলেন।
আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, থাকতে না পেরে এবার বলে উঠলো মিসেস হার্বার্ড, কিন্তু আপনার পক্ষে এটা খারাপ, ব্লাডপ্রেসারের ক্ষেত্রে উত্তেজিত হওয়া খুবই খারাপ।
তুমি স্বীকার করছে গত সপ্তাহের চেয়ে এ সপ্তাহের খরচ অনেক বেশি?
অবশ্যই। এখন ল্যাম্পসন স্টোর্সের সব জিনিসের দামই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখবেন আগামী সপ্তাহের খরচ অনেক কমে যাবে। গোমড়া মুখ করে তাকালেন মিসেস নিকোলেটিস।
আপাতদৃষ্টিতে সব কিছুই তুমি বেশ ন্যায়সঙ্গত ভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে। আপনার আর কিছু বলার আছে?
আমেরিকান মেয়ে সেলী ফিঞ্চ বলছিল এখান থেকে চলে যাবে সে, আমি তাকে যেতে দিতে চাই না। সে একজন ফালব্রাইট স্কলার। অন্য ফালব্রাইট স্কলারদের এখানে নিয়ে আসতে পারে সে। তাই দেখতে হবে সে যেন এখান থেকে চলে না যায়।
তা তার চলে যাওয়ার কারণ?
মিসেস নিকোলেটিস পাহাড় সমান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, আমি কি করে মনে রাখবো? তাছাড়া কারণটা আসলও নয়, যেকথা আমি বলতে পারতাম।
চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লো মিসেস হার্বার্ড। এ প্রসঙ্গে মিসেস নিকোলেটিসের কথা বিশ্বাস করতে অপারগ সে।
আমাকে তো সেলী কোনো কথা বলেনি? বললো সে, কিন্তু তার সঙ্গে তোমাকে কথা তো বলতেই হবে?
হ্যাঁ অবশ্যই।
আর যদি এইসব কালো চামড়ার ছাত্রছাত্রীরা–এইসব ভারতীয়রা, এইসব নিগ্রোরা তার চলে যাওয়ার কারণ হয়, তাহলে তারা বরং সবাই এখান থেকে চলে যেতে পারে বুঝলে? এই বর্ণবৈষম্যের ঝামেলায় আমি আমেরিকানদের পক্ষে। এক অদ্ভুত নাটকীয় ভঙ্গিমা করলেন তিনি।
আমি যতদিন দায়িত্বে আছি তা হতে দেবো না, শান্তস্বরে বললো মিসেস হার্বার্ড। সে যাই হোক, আপনার পথ ভুল। এখানে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেরকম মনোভাব নেই। আর আমার বিশ্বাস, সব ব্যর্থ, সেলীও সেরকম ধরনের মেয়ে নয়। সে আর মিঃ অ্যাকিমবোকে প্রায়ই একই সাথে মধ্যাহ্নভোজ সেরে থাকে, আর তার থেকে বেশি অন্য কেউ কালো চামড়ার পুরুষ হতে পারে না।
তারপর কমিউনিস্টদের প্রসঙ্গও আছে–তুমি তো জানো কমিউনিস্টদের সম্পর্কে আমেরিকানদের কিরকম ধারণা, নিজেল চ্যাপম্যান এখন একজন কমিউনিস্ট।
এতে আমার সন্দেহ আছে।
হা, হা, সেদিন সন্ধ্যায় কি বলেছিল তোমার শোনা উচিত ছিলো। লোকেদের বিরক্ত করার জন্য নিজেল যা খুশি বলতে পারে। সেদিক থেকে খুবই ক্লান্ত সে।
তুমি ওদের বেশ ভালো করেই জানো, প্রিয় মিসেস হার্বার্ড। সত্যিই তুমি বড় চমৎকার মেয়ে। আমি বার বার নিজেকে বলে থাকি-মিসেস হার্বার্ড ছাড়া আমি কি করবো? আমি ভয়ঙ্করভাবে তোমাকে বিশ্বাস করি।
তার মানে পাউডার দেওয়ার পর জ্যাম, ব্যঙ্গ করে বললো মিসেস হার্বার্ড।
সে আবার কি?
কিছু নয়। চিন্তা করবেন না, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। এরপরেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো মিসেস হার্বার্ড। উৎসাহের সঙ্গে তার ধন্যবাদ জ্ঞাপনের নকল ভাবাবেগটা এড়ানোই কারণ হতে পারে, নিজের মনে বললো সে : মিথ্যে আমার সময় নষ্ট করা–কি রকম পাগল করা মহিলা উনি। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে তার বসবার ঘরে এসে ঢুকলো।
কিন্তু মিসেস হার্বার্ডের জন্য শান্তি এখনো বিলম্বিত। ঘরে সে প্রবেশ করা মাত্র দীর্ঘদেহী একজন নারী উঠে দাঁড়াল। আমি আপনার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলতে চাই। দয়া করে আপনি যদি
নিশ্চয়ই, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমি তোমার কথা শুনবো এলিজাবেথ, দারুণ বিস্মিত মিসেস হার্বার্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেয়ে এই এলিজাবেথ জনস্টন আইনের ছাত্রী, উচ্চাভিলাষী এবং কঠোর পরিশ্রমী সে। চৌখস এবং যোগ্য মেয়ে সে, হোস্টেলে সফল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন সে, এইজন্যই মিসেস হার্বার্ড সবসময় তাকে শ্রদ্ধা জানায়।
এখন সে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তার কথার মধ্যে একটা তোতলানো ভাব লক্ষ্য করলো মিসেস হার্বার্ড! তবে তার কালো চেহারাটা যেন অনুভূতিহীন। কোনো ব্যাপার-ট্যাপার আছে নাকি?
হা, দয়া করে আপনি আমার ঘরে আসবেন? প্লিজ যদি একটু দয়া করেন। এক মিনিট। মিসেস হার্বার্ড তার গা থেকে কোট এবং হাতের দস্তানা খুলে ফেলল। তারপর ঘরের বাইরে এসে অনুসরণ করলো মেয়েটিকে। একেবারে টপ ফ্লোরে মেয়েটির ঘর।
এই হলো আমার কাজের নোট, ঘরে ঢুকে মেয়েটি বললো, এতো : নোট লিখতে মাসের পর মাস লেগে গেছে। এ এক কঠিন অধ্যবসায়, আর দেখুন আমার সেই পরিশ্রমের কি হাল করা হয়েছে।
মিসেস হার্বার্ডের চোখ কপালে উঠলো, হা করে শ্বাস নিলো।
লেখার টেবিলের উপর কালি ছড়িয়ে রয়েছে। মোর্টের উপর সব কাগজগুলোর উপরেই কালি ছড়িয়ে পড়েছে। কালিসিক্ত কাগজগুলোর উপর হাত বোলালো, তখনো ভিজে ছিলো।
জেনেশুনে বোকার মতো প্রশ্ন করলো সে, তুমি নিজে কালি ছিটিয়ে দাওনি তো?
না, আমি নিজে কাগজে কালি ছিটাতে যাব কেন? আমার অসাক্ষাতে এই জঘন্য কাজটা করা হয়েছে।
তুমি কি মিসেস বিগসকে–
সাফাইয়ে কাজ করে মিসেস বিগস। একেবারে উপরতলার শয়নকক্ষের তদারকি করার ভার তার উপর।
না, মিসেস বিগস নয়। এমনকি আমার নিজের কালিও নয়, আমার কালি বিছানার উপর সেলফে রয়েছে–স্পর্শও করা হয়নি সেটা। বাইরের কেউ কালি নিয়ে এসে ইচ্ছা করে এ কাজ করেছে।
মিসেস হার্বার্ড মর্মাহত। খুবই জঘন্য কাজ এবং কাজটা অতি নিষ্ঠুরও বলা যেতে পারে। এখানে একটু থেমে সে আবার বললো, বলার মতো ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না এলিজাবেথ। আমি মর্মাহত, ভীষণভাবে মর্মাহত, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, এই শয়তানকে আমি ঠিক খুঁজে বার করবো, তবে এ ব্যাপারে তোমার কি ধারণা বলো।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো মেয়েটি। আপনি তো দেখেছেন, কালিটা সবুজ। সচরাচর সবুজ কালি কেউ ব্যবহার করে না। তবে একজনকে আমি এই কালি ব্যবহার করতে দেখেছি–তার নাম নিজেল চ্যাপম্যান।
নিজেল? একাজ ও করেছে বলে তুমি মনে করো? যাহোক অনেক প্রশ্ন আমাকে করতে হবে। এ বাড়িতে এমন একটা ঘটনা ঘটার জন্যে আমি দুঃখিত এলিজাবেথ। তবে আমি তোমাকে বলতে পারি, এর গোড়া উপড়ে দেওয়ার চেষ্টা আমি করবো।
ধন্যবাদ মিসেস হার্বার্ড।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মিসেস হার্বার্ড। কিন্তু নিচে আসার জন্য সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। কি ভেবে চলতে চলতে করিডোরের একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে হাজির হলো সে।
চমৎকার ঘর। আরো চমৎকার ঘরের অধিকারিণী সেলী ফিঞ্চ নিজে। সেলী তখন লিখছিল। তার ঘরে ঢুকে বললো মিসেস হার্বার্ড, এলিজাবেথ জনসনের কি হয়েছে শুনেছো?
তা ব্ল্যাক বেকের কি হয়েছে?
ছদ্মনামটা খুবই আদরের। মেয়েটি নিজেও সেটা গ্রহণ করেছে। অতঃপর কি ঘটেছে তার আনুপূর্বিক ব্যাখ্যা করে গেলো মিসেস হার্বার্ড। রাগের মধ্যে দিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করলো সেলী। এ এক জঘন্য কাজ। কেউ করতে পারে বলে তো আমার বিশ্বাস হয় না। বিশেষ করে আমাদের বেকের মতো মেয়ের ক্ষতি। সবাই তাকে পছন্দ করে। তবে আমার ধারণা একজনই তাকে অপছন্দ করে। তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে এনে ভারাক্রান্ত গলায় বললো সেলী, আর এই কারণেই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। মিসেস নিক আপনাকে বলেছেন?
হ্যাঁ, তিনি খুব মুষড়ে পড়েছেন। মনে হয় তোমার চলে যাওয়ার আসল কারণটা যে কি তা তুমি বলোনি।
বলিনি ঠিক কথা, তাকে ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলাটা কোনো কাজের কথা নয় বলেই বলিনি। আপনিতো জানেন তিনি কি পছন্দ করেন, হ্যাঁ সেটাই আমার না বলার কারণ। এখানে যা যা সব ঘটেছে আমার একেবারেই পছন্দ নয়। আমার একপাটি জুতো হারানো, ভ্যালেরির স্কার্ফ টুকরো টুকরো করে ফেলা আর লেন-এর ঝোলা ব্যাগটার এইরকম হাল করা এ সবই অদ্ভুত ব্যাপার–এমন ভালো নয়। এক মুহূর্তের জন্য কী হলো যে, তারপর হঠাৎ দাঁত বার করে হাসলো সে। অ্যাকিমবোকে ভীত বললো সে, তাকে সবসময়েই শ্রেষ্ঠ এবং সভ্য বলে মনে হয়–কিন্তু সেকেলে ওয়েস্ট আফ্রিকানরা আবার বশীকরণ বা যাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী, এইসব অন্ধ কুসংস্কার। যতোসব অজ্ঞানতার পরিচয়।
আমার শোনার ধৈর্য নেই। কিছু সাধারণ লোক নিজেদের মধ্যে এরকম নোংরা কাজ করে থাকে।
দাঁত বার করে বাঁকা হাসি হাসলো সেলী। আপনি সাধারণ লোকের উপর জোর দিচ্ছেন, আমার ধারণা, এই বাড়িতেই এরকম একজন আছে সে মোটেই সাধারণ লোক নয়।
আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো মিসেস হার্বার্ড। এক তলায় ছাত্রদের কমনরুমে প্রবেশ করলো সে। মাত্র চারজন ছাত্রছাত্রী ছিলো সেখানে তখন। ভ্যালেরি জনহাউস তার সুন্দর দেহটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে বসে আছে, নিজেল চ্যাপম্যান একটা টেবিলের সামনে বসে আছে। টেবিলের উপর একটা ঢাউস বই খোলা রয়েছে, ম্যান্টলপীসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে প্যাট্রিসিয়া লেন এবং বর্ষাতি গায়ে একটি মেয়ে সবেমাত্র তখন কমনরুমে এসে প্রবেশ করেছিল। মিসেস হার্বার্ডকে দেখা মাত্র সে তার মাথা থেকে উলিক্যাপটা সরিয়ে দিল। মেয়েটি দেখতে বেশ ভালো, তার বাদামী চোখ দুটো বিস্ফারিত। যেন দারুণ অবাক হয়ে গেছে সে তাকে দেখে।
মুখ থেকে সিগারেটটা সরিয়ে ধীরে ধীরে অলস ভঙ্গিতে বলে উঠলো ভ্যালেরি, হ্যালো মা, আপনি কি আমাদের শ্রদ্ধেয় মালকিনকে মিষ্টি সিরাপ খাইয়ে এলেন?
সঙ্গে সঙ্গে প্যাট্রিসিয়া লেনও বলে উঠলো, তিনি কি মুগ্ধদেহীং মনোভাব অবলম্বন করেছেন?
দেখো এখানে একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে, বললো মিসেস হার্বার্ড, আর নিজেল, আমি চাই এ ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করো।
মা আমি? বইটা বন্ধ করে তার দিকে তাকাল নিজেল। হঠাৎ একটা বদ মতলবে তার মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। কিন্তু পরক্ষণেই অবাক হওয়ার মতোই তার মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেলো। কেন, আমি কি করেছি?
আশাকরি কিছুই নয়। বললো মিসেস হার্বার্ড। কিন্তু এলিজাবেথ জনস্টনের নোটের উপর ইচ্ছাকৃত ভাবে বিশ্রী করে কালি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুমি তো সবুজ কালি দিয়ে লিখে থাকো নিজে, স্থির চোখে তাকাল সে। তার মুখের উপর থেকে একটু আগের সেই হাসিটা উধাও হয়ে গেলো। হ্যাঁ সবুজ কালি দিয়েই আমি লিখি। ভয়ঙ্কর জিনিস, বললো প্যাট্রিসিয়া। নিজেল আমার বিশ্বাস, তুমি একাজ নিশ্চয়ই করোনি। আমার মনে হয়, আমি তোমাকে সবসময়েই বলে থাকি তুমি তোমার কাজের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে।
হা জড়িয়ে পড়তেই ভালোবাসি। অকপটে স্বীকার করলো নিজেল। আমার মনে হয় নীল কালি ব্যবহার করলেই ভালো ছিলো সবাই যা করে থাকে। কিন্তু মাম আপনি কি এ ব্যাপারে খুবই সজাগ? মানে আমি বলতে চাই এই অন্তর্ঘাতমূলক কাজের জন্য।
হা, নিজেল সত্য করে বলো তো, একাজ কি তোমার?
না অবশ্যই নয়। আপনি তো জানেন লোককে বিরক্ত করতে আমি ভালোবাসি। কিন্তু এমন একটা জঘন্য কাজ, না কখখনো নয়। আর অবশ্যই ব্ল্যাক বেকের কোনো ক্ষতি আমি কখনোই চাইবো না। আচ্ছা আমার সেই কালিটা কোথায়? মনে আছে গতকাল সন্ধ্যায় আমি আমার পেনে কালি ভর্তি করেছিলাম। ঐখানে ঐ সেলফ-এর উপর আমি সাধারণত রেখে থাকি। লাফিয়ে উঠে সেদিকে ছুটে গেলো সে। হা ওই তো সেটা এখানেই রয়েছে। কালির বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে শিষ দিয়ে উঠলো সে। আপনি ঠিকই বলছেন। বোতল প্রায় শূন্য। অথচ এটা প্রায় ভর্তি থাকার কথা। বর্ষাতি গায়ে চাপানো মেয়েটি একটু হাঁ করে তাকাল। ওহে প্রিয়, বলে উঠলো মেয়েটি, ওহে প্রিয়, আমি এটা অপছন্দ করি
মেয়েটিকে অভিযুক্ত করে বলে উঠলো নিজেল। তোমার কোনো এ্যালিবাই আছে সিলিয়া?
না, না, একাজ আমি করিনি। সত্যি এ কাজ আমি করিনি। যাহোক আমি বলতে পারি, সারাদিন আমি হাসপাতালে ছিলাম। একাজ আমি করতে পারি না
নিজেল এখন তুমি, তাদের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে মিসেস হার্বার্ড বললো, সিলিয়াকে বিরক্ত করো না।
ওদিকে রাগতস্বরে প্যাট্রিসিয়া বলে উঠলো, আমি বুঝতে পারছি না, নিজেকে কেন সন্দেহ করা হচ্ছে? তার কালি ব্যবহার করা হয়েছিল বলে
হ্যাঁ ঠিক তাই প্রিয়তমা, বললো ভ্যালেরি, তোমার বন্ধুর হয়ে লড়ে যাও।
কিন্তু এটা তো অন্যায়
কিন্তু আমি সত্যিই এ ব্যাপারে কিছু করিনি, আন্তরিকভাবে প্রতিবাদ করলো সিলিয়া।
কাজটা তুমি করেছে, একথা কেউ চিন্তাও করে না, অধৈর্য হয়ে বললো ভ্যালেরি, আর তুমিও তো জানো, মিসেস হার্বার্ডের সাথে তার দৃষ্টি বিনিময় হলো, এসবই ঠাট্টা-ইয়ার্কির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে কিছু একটা করতে হবে।
কিছু একটা করতে যাওয়া হচ্ছে, কঠিন সুরে বললো মিসেস হার্বার্ড।
.
০৪.
একটা ছোট্ট বাদামী রং-এর কাগজের মোড়ক পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দিয়ে মিস্ লেমন বললো, মঁসিয়ে পোয়ারো, এই নাও তোমার সেই ইঙ্গিত জিনিসটা।
মোড়কের উপর থেকে কাগজটা সরাতে চোখ দুটো উজ্জ্বল হলো উঠলো পোয়াবোর, সত্যি তারিফ করবার মতন–সুন্দর ডিজাইনের রুপালী রং-এর সান্ধ্যজুতো।
তুমি যেমন বলেছিলে, এটা বেকার স্ট্রিট থেকে পাওয়া গেছে।
আমাদের খাটুনি অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে, বললো পোয়ারো, সেই সঙ্গে আমার অনুমানের স্বীকৃতিও পাওয়া গেল।
হা, তা তো বটেই, বললো মিস্ লেমন। তবে মঁসিয়ে পোয়ারো, যদি না তোমাকে খুব বেশি অসুবিধায় পড়তে হয়। আমার বোনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। নতুন করে সেখানে আর একটা ঘটনা ঘটেছে। তুমি অনুমতি দিলে চিঠিটা পড়তে পারি?
চিঠিটা তার হাতে তুলে দিলে পোয়ারো পড়ার পর মিস লেমনকে ফোনে তার বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললো, একটু পরেই মিস্ লেমন ইশারা করলো, লাইন পেয়েছে।
তার হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে পোয়ারো বললো, মিসেস হার্বার্ড?
ও হ্যাঁ, মাঁসিয়ে পোয়ারো। এতো তাড়াতাড়ি ফোন করলেন? সত্যিই আপনি কি দয়ালু, সত্যি আমি অত্যন্ত।
কোথা থেকে ফোন করছো? মানে আমি বলতে চাইছি কেউ আমাদের আলোচনা শুনে ফেলবে না তো?
না, সব ছাত্রছাত্রীরাই এখন বাইরে বেরিয়ে গেছে। রাধুনী এখন বাজারে, আর তার স্বামী ইংরেজি খুব কমই বুঝতে পারে। ধোবিনী বাড়িতে আছে বটে, তবে সে কালা, কানে শুনতে পায় না। আমি নিশ্চিত আমাদের আলোচনার কথা শোনার মতো আপাতত বাড়িতে কেউ নেই।
খুব ভালো, স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারবো। সন্ধ্যায় বক্তৃতা কিংবা ফিল্ম দেখানোর ব্যবস্থা আছে তোমাদের ওখানে? কিংবা প্রমোদরঞ্জনের সেরকম কিছু?
হ্যাঁ আছে বৈকি! এইতো সেদিন মিস বালট্রাউট তার আবিষ্কারের অভিযানের উপর দীর্ঘ একটা বক্তৃতা দিয়ে গেলো। সেদিন খুব কম ছাত্র-ছাত্রীই বাইরে গিয়েছিল।
আচ্ছা, তাহলে সবাইকে জানিয়ে দাও আজ সন্ধ্যায় তোমার বোনের নিয়োগ কর্তা মাসিয়ে এরকুল পোয়ারো আসছে, সে তার এক আকর্ষণীয় কেসের উপর বক্তৃতা দেবে তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে।
আমি নিশ্চিত, খুবই ভালো হবে সেটা, কিন্তু আপনি কি মনে করেন?
মনে করাকরির কিছু নেই। আমি নিশ্চিত।
সেদিন সন্ধ্যায় কমনরুমে নোটিশ বোর্ডে একটা নোটিশ টাঙ্গানো থাকতে দেখলো ছাত্র-ছাত্রীরা :
প্রখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ মঁসিয়ে পোয়ালরা আজ সন্ধ্যায় এখানে তার এক সফল বিখ্যাত ক্রিমিন্যাল কেসের তদন্তের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য দয়া করে তার
সম্মতি দিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরা এ ব্যাপারে নানান মন্তব্য করতে ছাড়লো না। কে এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ? তার কথাতো কখনো শুনিনি। ওহো আমি শুনেছি। একজন ঠিকা ঝি-কে হত্যার অপরাধে এক ব্যক্তির মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রায় কার্যকর হতে যাচ্ছিল। ঠিক সময়ে এই লোকটি উপস্থিত হয়ে তার নিখুঁত তদন্তের রিপোর্ট পুলিশ স্টেশনে জমা দিলে সেই খুনের আসামীকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয় কাণ তিনি তখন প্রকৃত খুনীকে ধরে ফেলেছিলেন। আমার কাছে শুধুই আলুভাতে মনে হচ্ছে। আমার মনে হয়, এটা নেহাতই কৌতুক। অবশ্য কলিন উপভোগ করতে পারে। অপরাধ মনস্তত্বের ব্যাপারে সে খুবই আগ্রহী বরং পাগলা বলা যেতে পারে। আমি কিন্তু ওকে এতো গুরুত্ব দিতে পারছি না। তবে অস্বীকার করবো না, যে লোকটার সঙ্গে অপাধীদের গোপন যোগাযোগ আছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে হয়তো রোমাঞ্চ অনুভব করা যেতে পারে। টেবিলে নৈশভোজ পরিবেশিত। আর অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরা যার যার আসনে বসে গিয়েছিল। এমন সময় মিসেস হার্বার্ড তার বসবার ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এলেন। তাকে অনুসরণ করছিল ছোট মাপের চেহারার একজন ভদ্রলোক। তার কালো চুলগুলো সন্দেহজনক, গোফটা ভয়ঙ্কর।
মঁসিয়ে পোয়ারো এরা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন। মিসেস হার্বার্ড পরিচয় করিয়ে দেয়। আর ইনি হলেন মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। নৈশভোজের পর উনি আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
সম্ভাষণ বিনিময়ের পর মিসেস হার্বার্ডের অনুরোধে হঠাৎ তার ডান পাশ থেকে একটি মেয়ে বলে উঠলো, সত্যিই কি মিসেস হার্বার্ডের বোন আপনার হয়ে কাজ করেন।
তার দিকে ফিরে তাকাল পোয়ারো, হ্যাঁ অবশ্যই। অনেক বছর ধরে মিস্ লেমন আমার সেক্রেটারী। অত্যন্ত দক্ষ সে, তার জন্য এক এক সময় আমার আশঙ্কা হয়।
তাই বুঝি। আমি অবাক হচ্ছি
মাদমোয়াজেল, আপনার অবাক হওয়ার কারণ? পোয়ারো তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় হাসলো। মেয়েটির সম্পর্কে মনে মনে অনুধাবন করলো, যেমন সে করে থাকে। বেশ চিন্তিত, মনের দিক থেকে খুব একটা দ্রুত নয়। বুঝি বা একটু ভীতও বটে–তারপর নিজের থেকেই সে আবার জিজ্ঞেস করলো। আপনার নাম আর কি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন জানতে পারি?
সিলিয়া অস্টিন। পড়াশোনা করি না। আমি একজন ওষুধ প্রস্তুতকারক। সেন্ট ক্যাথেরিন হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত।
আহ সে তো খুব আকর্ষণীয় কাজ? পোয়ারো এবার অন্যদের প্রসঙ্গ তুললো, আর এঁরা সব? এঁদের সম্পর্কে আপনি আমাকে কিছু বলতে পারেন? আমি জেনেছি, এখানে বহু বিদেশী ছাত্র-ছাত্রী থাকে কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে তো বেশির ভাগই ইংরেজ। ব্যাপার হলো বেশ কিছু বিদেশী ছাত্র-ছাত্রী এখন বাড়ির বাইরে। যেমন মিঃ চন্দ্রলাল আর মিঃ গোপালরাম–ওরা ভারতীয় আর মিস রেনজীর ডাচ মহিলা আর একজন হলো মিঃ আহমেদ আলি–ইজিপসিয়ান। ভয়ঙ্কর ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে যে।
আর যারা এখানে আছেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
বেশ তাহলে শুনুন, মিসেস হার্বার্ডের বাঁ-পাশে বসে আছে নিজেল চ্যাপম্যান, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইতালীয় ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছে সে। তারপরে তার ঠিক পাশের মেয়েটি প্যাট্রিসিয়া লেন, গামা কোসে–প্রত্নতত্ত্ববিদ্যায় ডিপ্লোমা নিতে যাচ্ছে। বড়মাপের লাল চুলওয়ালা ছেলেটি লিও বেটসন, মেডিক্যাল ছাত্র। আর ওই কালো চেহারার মেয়েটি ভ্যালেরি জনহাউস-একটন বিউটি পপের সঙ্গে যুক্ত। তার ঠিক পাশের মেয়েটি, কলিন ম্যাকনার–মানসিক রোগের চিকিৎসায় পোস্টগ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী।
কলিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বরে সামান্য একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো। নিবিষ্ট মনে তাকে লক্ষ্য করলো পোয়ারো এবং দেখলো তার মুখে ফিকে রঙ লেগেছে। নিজের মনে বললো সে, সুতরাং মেয়েটি তার প্রেমে পড়েছে এবং সহজে সেটা সে লুকাতে পারলো না, আর একটা জিনিষ লক্ষ্য করলো সে-তরুণ ম্যাকনার মেয়েটির দিকে একটুও তাকাল না বরং সে তার পাশে উপবিষ্ট লালচুলের মেয়েটির সঙ্গে বেশ হেসে হেসে কথা বলছিল। আর সেই মেয়েটি হলো সেলী ফিঞ্চ। আমেরিকান-এখানে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছে। তাদের পাশের মেয়েটি জেনেভিভ মারিকত-ইংরেজিতে অধ্যয়ন করছে; তার মতো বেনি হ্যাঁলিত তার পাশেই বসেছিল, সে সুন্দরী মেয়ে জিন টমকিনসন সেন্ট ক্যাথেরিনের সঙ্গে যুক্ত। সে একজন সাইকোথেরাপিস্ট। কালো চামড়ার মানুষ অ্যাকিমবোকে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে এসেছে ভয়ঙ্কর কালো লোক সে। তারপর এলিজাবেথ জনস্টন, জামাইকার মেয়ে আইন পড়ছে, আমার ডানদিকের ওরা দুজন তুর্কী ছাত্র, সপ্তাহখানেক আগে এসেছে এখানে, তারা সামান্যই ইংরেজি জানে।
ধন্যবাদ, আপনারা সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকেন, নাকি আপনাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে।
পোয়াবোর হাল্কা কথার সুরে একটা গাম্ভীর্যের ভাব লুকিয়ে ছিল। উত্তরে সিলিয়া বললো, ওহো আমরা সবাই ঝগড়া করতে ব্যস্ত থাকি। যদিও–
যদিও কি মিস অস্টিন।
বলছি–ঐ যে নিজেল, মিসেস হার্বাডের পাশেই যে বসে আছে দেখছেন, লোককে ক্ষেপাতে ওস্তাদ সে। আর লেন বেটসন একটুকুতেই রেগে যায়। এক এক সময় তার বন্য রাগ দেখার মতন। তবে সত্যিই খুব মিষ্টি স্বভাবের ছেলে সে।
আর কলিন ম্যাকনার–সেকি খুব বিরক্তবোধ করে থাকে?
ওহো না সে কেবল তার ভ্র তুলে থাকে আর তাকে বেশ খুশি খুশি দেখায়।
তাই বুঝি। আর ঐ তরুণীটি ওর সঙ্গে আপনার কখনো ঝগড়া হয়?
ওহো না, আমরা সবাই খুব মিশুকে। এক এক সময়ে জেনেভিভের একটু যা ভাবান্তর ঘটে থাকে, আমার মনে হয় ফরাসীরা একটু স্পর্শকাতর–ওহো মানে আমি–আমি দুঃখিত–এরপর চুপ হলো মেয়েটি।
আর আমি একজন বেলজিয়ান, গদগদ হয়ে বললো পোয়ারো। সিলিয়া সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার আগেই দ্রুত জিজ্ঞেস করলো পোয়ারো, মিস্ অস্টিন একটু আগে আপনি বললেন আপনি অবাক হচ্ছেন–কিসের জন্য?
স্নায়ু দুর্বলতায় মেয়েটি তার রুটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললো। ওহো, ওটা কিছু নয়, সত্যি কিছু নয়, স্রেফ একটা ঠাট্টা মাত্র। আমি ভেবেছিলাম মিসেস হার্বার্ড–কিন্তু সত্যি সেটা লজ্জার কথা, আমি কিছু বোঝাতে চাইনি।
পোয়ারো তাকে আর চাপ দিলো না। মিসেস হার্বার্ডের দিকে ফিরে তাকাল সে। মিসেস হার্বার্ড এবং নিজেল চ্যাপম্যান তিনজনে মিলে আলোচনায় রত হলো। অচিরেই চ্যাপম্যান একটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়লো, তার বক্তব্য হলো অপরাধ একটা শিল্প–এবং সমাজের সব থেকে অযোগ্য হলো পুলিশ, যারা পুলিশের চাকরীতে ঢোকে তারা তাদের গোপন যৌন বিকৃতি চরিতার্থ করার জন্য। পোয়ারো তার পাশে বসা চশমা পরিহিত তরুণ-যুবতীর উদ্বেগ লক্ষ্য করে কৌতুক বোধ করছিল। মেয়েটি বেপরোয়া ভাবে নিজেলের মন্তব্য নস্যাৎ করার চেষ্টা করছিল। যাই হোক, তার দিকে একেবারেই তাকাল না, কিংবা বলা যেতে পারে ভ্রূক্ষেপই করলো না। সদয় চিত্তে কৌতুক বোধ করলো মিসেস হার্বার্ড।
তোমরা সব তরুণেরা আজকাল রাজনীতি আর মনস্তত্ব ছাড়া কিছুই বোঝে না। বললো মিসেস হার্বার্ড। ছেলেবেলায় আমি হাল্কা মেজাজে থাকতে ভালোবাসতাম। নাচতাম, গলা চড়িয়ে গান গাইতাম। এখনো কমনরুমের মেঝেটা বিরাট, নাচের উপযোগী কিন্তু তোমরা কখনো কি নাচ করেছে?
হাসলো সিলিয়া এবং গাঢ় স্বরে বলে উঠলো, নিজেল তুমি কিন্তু নাচতে। একবার আমি তোমার সাথে নাচ করেছিলাম। তবে আমার মনে হয় না তুমি মনে রেখেছে।
তুমি আমার সঙ্গে নেচেছিলে? বিশ্বাস করতে চাইল না নিজেল। কোথায়? কোথায় নেচেছিলে?
কেন কেমব্রিজ–মে দিবসে।
ওঃ মে দিবসে। তারুণ্যের বোকামো বুঝতে পারলো নিজেল। ঐ বয়সে সবাই অমন ছেলেমানুষি করে থাকে। বয়স হলেই ভুলে যায়।
নিজেলের বয়স এখন পঁচিশের বেশি নয়। পোয়ারো গোঁফের ফাঁকে তার হাসিটা চাপবার চেষ্টা করল।
ওদিকে পোয়ারো উঠে দাঁড়াল এবং তার স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বক্তৃতা দিতে শুরু করলো। নিজের গলার স্বর বেশ ভালোই লাগে তার কাছে। তিনি ৪৪ বছর ধরে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনা দেওয়ার পর বললো, তাহলে আপনারা দেখলেন অপরাধ জগৎটা কেমন। অপরাধী আর পুলিশের সম্পর্কটাই বা কেমন। এই শহরের একজন ভদ্রলোককে আমি বলেছিলাম, একজন সাবান প্রস্তুতকারককে আমি চিনি, সে তার সুন্দরী স্বর্ণকেশী সেক্রেটারীকে বিয়ে করার জন্য তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিল, হাল্কা চালেই গল্পটা শুরু করেছিলাম তার কাছে। কিন্তু সেই সঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম তার মধ্যে। সেই মাত্র তার চুরি যাওয়া টাকা ফেরৎ পাওয়ার জন্য সে আমাকে চাপ দিতে থাকে। তাকে কেমন কৃশ দেখায়, ভয়ার্ত দুটি চোখ, এ টাকা আমি উপযুক্ত চ্যারিটি ট্রাস্টে দেবো, আমি তাকে বলি, টাকাটা নিয়ে আপনি যা খুশি করতে পারেন, উত্তরে সে বললো, তখন আমি তাকে বলি খুবই অর্থপূর্ণভাবে। মঁসিয়ে, আমার উপদেশ হলো, খুব সাবধান, নীরবে মাথা নাড়ল সে, তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে পিছন ফিরে তাকাতে দেখি যে, তার কপালের ঘাম মুছছে। যদিও সে তার স্বর্ণকেশী সেক্রেটারীর মোহাচ্ছন্ন মনে হয় আমার সেই উপদেশ শোনার পর সে আর বেশিদূর এগোবে না, কিংবা তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার মতন বোকামো করবে না। নিরাময়ের থেকে প্রতিরোধ সবসময়ই ভালো। আমরা হত্যা প্রতিরোধ করতে চাই–হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা আমরা করি না।
মাথা নুইয়ে সে এবার বলে, আমি বোধহয় আপনাদের দীর্ঘক্ষণ চিন্তায় ফেলে রেখেছিলাম।
প্রচণ্ড ভাবে হাততালি দিয়ে উঠলো ছাত্রছাত্রীরা। পোয়ারো মাথা নুইয়ে তাদের অভিবাদন গ্রহণ করলো। তারপর সে যখন প্রায় তার আসনে বসতে যাচ্ছে ম্যাকনার হঠাৎ বলে উঠলো, আর এখন সম্ভবত এখানে আপনি যেজন্য এসেছেন সে ব্যাপারে কিছু বলবেন।
মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো। তারপর অভ্যর্থনা করে উঠলো প্যাট্রিসিয়া কলিন।
ভালো কথা, আমরা এখন সবাই আন্দাজ করতে পারি, পারি না? চারিদিক তাকিয়ে দেখে নিলো সে, তার চোখে মুঠো মুঠো ঘৃণা। মঁসিয়ে পোয়ারো বেশ মজার মজার গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। কিন্তু এর জন্য তিনি এখানে আসেননি। তিনি একটা বিশেষ কাজে এসেছেন। মঁসিয়ে পোয়ারো সত্যি করে বলুন তো এরকম একটা ধারণা করে নেওয়াটা আমাদের ন্যায়সঙ্গত নয়?
হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, পোয়ারো বললো, মিসেস হার্বার্ড আমাকে গোপনে বলেছেন, এখানকার কয়েকটা ঘটনা তার উদবেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে–
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো লেন বেটসন। তার মুখটা থমথম এবং হিংস্র দেখাচ্ছিল। দেখুন! তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠলো, এসব কি হচ্ছে? আমাদের জড়ানোর জন্যই কি এই পরিকল্পনা?
এবার দৃঢ়তার সঙ্গে বলে উঠলো মিসেস হার্বার্ড।
মঁসিয়ে পোয়ারোকে কিছু বলার জন্য আমি অনুরোধ করেছিলাম সেই সঙ্গে এখানে সম্প্রতি যে সব ঘটনাগুলো ঘটে গেছে সে ব্যাপারে ওর উপদেশ চেয়েছিলাম, কিছু একটা করতে হবে। আমার মনে হয়েছে, এর একমাত্র বিকল্প হলো পুলিশ।
সঙ্গে সঙ্গে সবাই নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক জুড়ে দিলো। উত্তেজনায় ফেটে পড়লো জেনেভিভ। ফরাসী ভাষায় উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো সে, পুলিশের কাছে যাওয়া অপমানের, লজ্জার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অনেকেই মরিয়া হয়ে উঠলো। শেষ অব্দি লিওনার্ড বেটসনের চড়া গলা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো।
আমাদের গণ্ডগোলের ব্যাপারে মঁসিয়ে পোয়ারোর বক্তব্য শোনা যাক। পোয়ারো কিছু বলার আগে মিসেস হাবার্ড বলে উঠলো, সমস্ত ঘটনার কথা আমি মঁসিয়ে পোয়ারোকে বলেছি, তিনি যদি কোনো প্রশ্ন করতে চান আমি নিশ্চিত, তোমরা কেউ আপত্তি করবে না।
মাথা নিচু করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো পোয়ারো। ধন্যবাদ, তারপর যাদুকরের মতো একটা কাগজের মোড়ক খুলে একজোড়া সান্ধ্যজুতো সেলী ফিঞ্চের হাতে তুলে দিলো। মাদমোয়াজেল, আপনার জুতোজোড়া।
দু পাটি কেন? হারানো পাটিটা কোথা থেকে এলো?
বেকার স্ট্রিট স্টেশনে লস্ট প্রপারটি অফিস থেকে। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি চিন্তা করলেন কি করে সেটা সেখানে থাকতে পারে?
অত্যন্ত সহজ অনুমানের ভিত্তিতে। আপনার ঘর থেকে কেউ একজন একপাটি জুতো নিয়ে থাকবে? কিন্তু কেন? পড়বার জন্য বা বিক্রি করবার জন্যও নয়, যেহেতু সবাই বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করবে, সেই কারণে জুতোটা নষ্ট করা অতো সহজ নয়। সবথেকে সহজ উপায় হলো জুতোটা কাগজের মোড়কে করে বাসে কিংবা ট্রেনে নিয়ে ভীড়ের সময় আসনের উপর ফেলে রাখা, এটাই আমার প্রথম অনুমান এবং সেটা যে ঠিক তার প্রমাণ পাওয়া গেলো।
এখানে একটু থেমে পোয়ারো আবার বলতে শুরু করল। আমার অবস্থাটা খুবই দুর্বল। আমি এখানে একজন অতিথি। মিসেস হার্বার্ডের আমন্ত্রণে সুন্দর সন্ধ্যেটা কাটানোর জন্য এসেছি–ব্যস এই পর্যন্ত। অবশ্য সেই সঙ্গে মাদমোয়াজেলকে সুন্দর একজোড়া সান্ধ্যজুতো ফেরত দেওয়ার জন্যও বটে। আর কিছু-একটু থেমে সে আবার বললো মঁসিয়ে বেটসন, হা বেটসন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই গণ্ডগোলের ব্যাপারে আমি কি চিন্তা করছি। কিন্তু একজন নয়, আপনারা সবাই মিলে আমাকে আহ্বান না করলে এ ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
মিঃ অ্যাকিমবো তার কোকড়ানো চুলের মাথাটা ঘনঘন দুলিয়ে বলে উঠলো, হ্যাঁ সেটাই হবে সঠিক পন্থা। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পন্থা হলো সবার উপস্থিতিতে এ ব্যাপারে ভোট নেওয়া।
অধৈৰ্য্য হয়ে সেলী ফিঞ্চ বলে উঠল, ওহো, তুমি বড় হতাশ করে দাও। অ্যাকিমবোকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বললো সে। আজকের এই সমাবেশ একটা পার্টির মতোই, আমরা সব বন্ধুরা একত্রে মিলিত হয়েছি। আর কোনো হৈ-চৈ না করে মঁসিয়ে পোয়ারো কি উপদেশ দেন শোনা যাক।
সেলী আমি তোমার সঙ্গে আর একমত হতে পারছি না। প্রতিবাদ করে নিজেল।
মাথা নত করলো পোয়ারো।
খুব ভালো কথা বললো সে, এই প্রশ্নটা আপনারা সবাই আমাকে করেছেন। উত্তরে আমার উপদেশ খুবই সহজ সরল, মিসেস হার্বার্ড কিংবা মিসেস নিকোলেটিসের উচিত এখনি পুলিশে খবর দেওয়া, আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করা উচিত নয়।
.
০৫.
নিঃসন্দেহে পোয়ারোর মন্তব্য অভাবনীয়। প্রতিবাদ কিংবা পাল্টা মন্তব্য করা যায় না। কিন্তু একটা অস্বস্তিকর নীরবতার মধ্যে ডুবে রইলো সান্ধ্য বৈঠক এবং বৈঠকের সদস্যরা। সেই অস্বস্তিকর নীরবতার মধ্যে থেকে পোয়ারোকে উদ্ধার করলো মিসেস হার্বার্ড তার বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে। তোমাদের সবাইকে শুভরাত্রি–
তারপর নিজের বসবার ঘরে পোয়ারোর মুখোমুখি বসে মিসেস হার্বার্ড। একটু ইতস্তত করে বললো, জোর দিয়েই আমি বলবো, আপনিই ঠিক মঁসিয়ে পোয়ারো। সম্ভবত পুলিশে আমাদের খবর দেওয়াই উচিত, বিশেষ করে অমন বিশ্রী কালি ছিটানোর ঘটনার পর। কিন্তু, সেইসাথে আমি বলবো, অমন স্পষ্ট করে সবার সামনে আপনার বলা উচিত হয়নি।
আহ! পোয়ারো তার নিজস্ব ব্র্যান্ডের একটা সিগারেটের ধোঁয়া উদগীরণ করে বললো, তুমি কি মনে কর ব্যাপারটা আমার গোপন করা উচিত ছিলো–
আমার মনে হয়, চুপচাপ থাকলে ভালো ছিলো, তারপর একজন পুলিশ অফিসারকে আহ্বান করে গোপনে ঘটনাটা তার কাছে ব্যাখ্যা করলে ভালো হতো। মানে আমি বলতে চাইছি; যেই এই নোংরা কাজ করে থাকুক না কেন, এখন তাকে সতর্ক করে ছেড়ে দিলেই চলতো।
সম্ভবত হা।
তারপর মিসেস নিকোলেটিস রয়েছেন, জানি না পুলিশের কথা শুনলে তার মনোভাব কেমন হবে। তার মনে কি আছে কেউ জানে না।
সেটা জানা খুবই কৌতূহলের ব্যাপার।
তাই স্বভাবতঃই আমরা পুলিশকে এখানে আসতে দিতে পারি না। আগে তাঁকে রাজি করাতে হবে, তারপরও কে আবার এলো?
দ্রুত টোকা পড়তে থাকে দরজায়। মিসেস হার্বার্ড বলতে যাচ্ছিল ভেতরে এসে, কিন্তু তার বলবার আগেই দরজা খুলে গেলো এবং কলিন ম্যাকনার ঘরে এসে ঢুকলো, উদ্ভ্রান্ত চেহারা, ঝাপসা চোখ। আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন, কলিন বলে। কিন্তু না এসেও পারলাম না। আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন, মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।
আমার সঙ্গে? তার দিকে ফিরে তাকাল পোয়ারো অবাক চোখে।
হ্যাঁ, গম্ভীর স্বরে বললো কলিন, আপনার সঙ্গেই।
কাঁপা কাঁপা হাতে চেয়ার টেনে পোয়ারোর সামনে বসলো। আজ রাতে আপনি আমাদের সঙ্গে কথা বলে যথেষ্ট আনন্দ দিয়েছেন। আমি স্বীকার করছি আপনার অভিজ্ঞতা প্রচুর আর বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা সব, কিন্তু আপনার কাজের পদ্ধতি আর ধারণা দুটো সেকেলে ধরনের। আমার এই কথা বলার ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমা করবেন।
কলিন, সত্যিই তুমি ভীষণ অভদ্র, মুখ কালো করে বলে উঠলো মিসেস হার্বার্ড।
আমি ওঁকে অপমান করার জন্য একথা বলিনি, তবে ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্যই বলেছি। মঁসিয়ে পোয়ারো অপরাধ এবং শাস্তি–যতদূর সম্ভব আপনার দিগন্ত বিস্তৃত, যার কিনারা পাওয়া যায় না।
ওগুলো আমার কাছে স্বাভাবিক পরিণতি বলেই মনে হয়, বললো পোয়ারো।
আইনটাকে আপনি সংকীর্ণ ভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তাছাড়া আমার ধারাগুলো অত্যন্ত পুরানো, সেকেলে, অথচ আজকাল আইন অনেক বেশি উদার–অনেক নতুন বিবেচনা প্রস্তুত অপরাধতত্ত্বের নতুন নতুন ব্যাখ্যা আছে। অপরাধীকে শাস্তি দিতে গেলে নতুন নতুন অনেক আইন ঘাঁটতে হয়। এই হলো আমার বলার কারণ এবং সেটা আমি জরুরী বলে মনে করি মঁসিয়ে পোয়ারো।
কিন্তু আপনার ঐ নতুন ফ্যাসানের আইনের কচকচি শুনতে আমি চাই না। আমি আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না।
তাহলে এই বাড়িতে যা যা ঘটে যাচ্ছে, তার কারণগুলো আপনাকে অবশ্যই বিচার করে দেখতে হবে। আপনাকে খুঁজে বার করতে হবে–কেন, কেন এসব ঘটছে।
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে অবশ্যই একমত, আর এটা খুব জরুরীও বটে। কারণ সব ব্যাপারেই একটা না একটা কারণ থাকবেই। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে ভালোরকম কারণই থাকতে পারে।
প্রস্তাবটা মনমতো হলো না মিসেস হার্বার্ডের। তাই সে চুপ করে থাকতে পারলো না। অধৈৰ্য্য হয়ে বলেই ফেললো, যতো সব রাবিশ।
এই এখানেই আপনি ভুল করছেন : তার দিকে ঈষৎ ঘুরে বসে কলিন বললো, মনস্তাত্ত্বিক পশ্চাৎপটটা আপনাকে বিবেচনা করে দেখতেই হবে।
মনস্তাত্ত্বিক প্রলাপ? ব্যঙ্গ করে বললো মিসেস হার্বার্ড। এ ধরনের আজেবাজে কথা শোনার মতো ধৈৰ্য্য আমার নেই।
কারণ আপনি এসবের কিছুই জানেন না। তিরস্কারের মতো করে বলে কলিন এবার পোয়ারোর দিকে ফিরলো।
জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো আমি কিন্তু এ বিষয়ে খুবই আগ্রহী, আমি এখন সাইকোলজির পোস্টগ্র্যাজুয়েটের ছাত্র। মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার এতো সব কথা বলার কারণ হলো, আইন অনুযায়ী অপরাধীকে আপনি সালাম দিতে পারেন না। গণ্ডগোলের আসল উৎস আপনাকে বুঝতে হবে। আজকের তরুণদের বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য এটা খুবই জরুরী। আপনাদের সময় এ ধরনের ধারণা কেউ জানতো না শুধু নয়, আমার একটুও সন্দেহ নেই, সেগুলো মেনে নিতে আপনারা খুব কষ্ট পেতেন।
চোরের ওপর বাটপারি। কঠোর ভাষায় বললো মিসেস হার্বার্ড।
অধৈৰ্য ভাবে ভ্রুকুটি করলো কলিন।
পোয়ারোর কথায় নম্রতার সুর : নিঃসন্দেহে আমার ধারণাগুলো সেকেলে ধরনের। কিন্তু মিঃ ম্যাকনার আপনার কথা শুনতে আমি প্রস্তুত।
বিস্ময়ভরা চোখে তার দিকে তাকাল কলিন। আপনি বেশ ভালো কথাই বলেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। এখন আমি আপনাকে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিতে চাই।
ধন্যবাদ, নম্রভাবে বললো পোয়ারো।
সুবিধার জন্য আজ রাতে আপনার নিয়ে আসা জুতোজোড়া দিয়েই শুরু করবো। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, একপাটিই জুতো চুরি গেছিল; মাত্র একপাটি। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলতে থাকে কলিন ম্যাকনার। কিন্তু এর গুরুত্ব হয়তো আপনি বুঝতে পারেননি। এ একটা চমৎকার আর সন্তুষ্ট করার মতো উদাহরণ বটে। সিনড্রেলা রূপকথার কাহিনীর সঙ্গে আপনি হয়তো পরিচিত আছেন।
মূল ফরাসী গল্প :–উঞ্ছবৃত্তি করেও পারিশ্রমিক পেতো না সিনড্রেলা। বেচারী মনের দুঃখে আগুনের পাশে বসেছিল, তার বোনেরা সুন্দর কার্যকার্য করা পোষাকে তাকেও সেই প্রিন্সেস বল-এ পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। মাঝ রাতে তার সেই সুন্দর পোষাক ছেঁড়া নেকড়ায় পরিণত হওয়া মাত্র তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে এলো সে, একপাটি চটি সেখানে ফেলে রেখে। এখানেই আমরা সেই সিনড্রেলার সাথে কাউকে তুলনা করতে পারি। (অবশ্যই অবচেতন মনে) এখানে কারোর হতাশ, পরশ্রীকাতর এবং হীনম্মন্যতার পরিচয়ই পাই। হ্যাঁ আমি এখানে সেই মেয়েটির কথাই বলছি যে কিনা সান্ধ্যজুতো চুরি করেছিল। কেন? সম্ভবত সে নিজেই জানতো না কে যে একাজ করতে গেলো। কিন্তু তার মনের ইচ্ছাটা এখানে পরিষ্কার, রাজকুমারী হওয়ার বাসনা জেগেছিল তার মনে, রাজকুমারীর মন জয় করতে চেয়েছিল সে, আর সে চেয়েছিল রাজকুমার তাকে দাবী করুক। আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, এমন একজন আকর্ষণীয়া সুন্দরী মেয়ের সান্ধ্যজুতো যে চুরি করে, সে মেয়েটিরও সেই পার্টিতে যাওয়ার কথা।
কলিনের পাইপের তামাক শেষ হয়ে গিয়েছিল, প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে সে আবার বলতে লাগল; এখন আমরা আরো কিছু ঘটনার প্রসঙ্গে আসছি। চুরি যাওয়া জিনিসগুলো সামান্যই; সবই মেয়েদের ব্যবহৃত জিনিস–পাউডার, লিপস্টিক, কানের দুল, ব্রেসলেট, আংটি-এর দুটি উদাহরণ আছে। মেয়েটি নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে চেয়েছিল। এমনকি শাস্তিও পেতে চেয়েছিল সে,-যেমন আজকাল প্রায়ই তরুণদের মধ্যে একধরনের অপরাধ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এগুলো সাধারণ অপরাধমূলক চুরির কেস বলে মনে হয় না। তেমন মূল্যবান জিনিযও নয়। ডিপার্টমেন্ট স্টোরস-এ গিয়ে যে কোনো উচ্চমধ্যবিত্ত, কিংবা মধ্যবিত্ত মহিলা এ সব জিনিষ চুরি করতে পারে, যদিও তার দাম দেওয়ার মতো ক্ষমতা তাদের আছে।
ননসেন্স, রাগত স্বরে বলে উঠলো মিসেস হার্বার্ড। সে সব কিছু অসৎ লোকের কাজ। অর্থের লোভ, এখানে সে সুযোগ কোথায়?
ভুলে যেও না, চুরি যাওয়া জিনিষগুলোর মধ্যে একটা দামী হীরের আংটিও ছিল, মিসেস হার্বার্ডের আপত্তি সত্ত্বেও পোয়ারো বললো।
কিন্তু সেটা তো ফেরত দেওয়া হয়েছে।
আর মিঃ ম্যাকনার, আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না স্টেথিস্কোপটা মোহময়ী পর্যায়ে পড়ে?
এর মধ্যে একটা গূঢ় অর্থ আছে। যে সব নীরব নারীসুলভ আকর্ষণে ঘাটতি থাকে, তারা তখন জীবনের উন্নতি করার পথ ধরে থাকে। তাই মনে হয় স্টেথিস্কোপটা সেই অবলম্বন
আর সেই রান্নার বইটা?
ওটা সেই পারিবারিক জীবনের ছবি, স্বামী ও পরিবার।
আর বোরিক পাউডার?
কলিন এবার খিঁচিয়ে উঠল : প্রিয় মঁসিয়ে পোয়ারো, বোরিক পাউডার কেউ চুরি করে না কেনই তারা করবে?
ঠিক এই প্রশ্নটাই আমি নিজেকে করছি। আমি স্বীকার করছি মঁসিয়ে ম্যাকনার, মনে হচ্ছে, এ সব প্রশ্নের উত্তর আপনার জানা আছে। তাই যদি হয় তাহলে আপনার পুরানো ফ্লানেল ট্রাউজার চুরির ব্যাপারে কি ব্যাখ্যা করবেন বলুন।
এই প্রথম হোঁচট খেতে হল কলিনকে। গলা পরিষ্কার করে বললো সে, এর ব্যাখ্যা আমি করতে পারি–কিন্তু তাতে কারো জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, সে এক অস্বস্তিকর ব্যাপার।
আর অন্য এক ছাত্রীর নোটের উপর কালি ছিটিয়ে দেওয়া, একজনের স্কার্ফ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা? এসব কি আপনাকে উদ্বিগ্ন করে না?
কলিনের মুখের স্বাভাবিক ভাবটা হঠাৎ বদলে যায়। পোয়ারোর দৃষ্টি এড়ায় না।
হা, করে বৈকি, বললো সে, বিশ্বাস করুন অবশ্যই আমাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ দুটি ঘটনা সাংঘাতিক। অবশ্যই মেয়েটির চিকিৎসার প্রয়োজন এবং এখনি। এটা পুলিশ কেস নয়। বেচারী খুদে শয়তান জানেও না, এসবের অর্থ কি, কি ব্যাপার? হাত-পা কাটা অবস্থার মতো সে, আমি যদি–বাধা দিল পোয়ারো।
তার মানে আপনি জানেন মেয়েটি কে?
হ্যাঁ, তার উপর আমার দারুণ সন্দেহ আছে।
এই সেই মেয়ে, যে কিনা পুরুষের মন জয় করতে ব্যর্থ। লাজুক মেয়ে। স্নেহ বৎসল মেয়ে। এই সেই মেয়ে যে নিজেকে নিঃসঙ্গ বলে মনে করে, হতাশায় ভুগছে। সেই মেয়ে
এই সময় দরজায় আবার টোকা পড়লো। নীরব হলো পোয়ারো। দরজায় টোকা আবারও পড়ল।
ভেতরে এসো–বলল মিসেস হার্বার্ড।
দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সিলিয়া অস্টিনকে প্রবেশ করতে দেখা গেল।
আহ্, মাথা নেড়ে পোয়ারো বলে উঠল, ঠিক এই মুহূর্তে মিস্ সিলিয়া অস্টিনকেই আমি অনুমান করেছিলাম।
কলিনের দিকে তাকাল সিলিয়া। তার চোখে আগুন ঝরে পড়ছিলো।
আমি জানতাম না, তুমি এখানে, এক নিঃশ্বাসে সে বললো, আমি এসেছিলাম–আমি এসেছিলাম এখানে–
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে হার্বার্ডের কাছে ছুটে গেল।
দয়া করে পুলিশে খবর দেবেন না। আমি, হ্যাঁ আমিই জিনিষগুলো নিয়েছি। জানি না কেন। চিন্তাও করতে পারি না কেন নিয়েছি। এমন কি আমি চাইওনি। সেগুলো, আপনা থেকেই আমার কাছে চলে এসেছে। তারপর কলিনের দিকে ফিরে মেয়েটি বললো, তাহলে তুমি এখন জেনে গেছ, আমি কি ধরনের মেয়ে আমার ধারণা, তুমি আমার সঙ্গে আর কখনো কথা বলবে না। আমি জানি, আমি ভয়ঙ্কর
ওহো! তুমি নিজে যা ভাবছ তা একেবারেই নয়। বন্ধুভাবে কলিন বললো, তোমার অসুস্থতার জন্য তুমি একাজ করেছ, ভালো করে দেখলে কি জিনিষগুলো! তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস কর তাহলে আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি সুস্থ করে তুলব।
ওঃ কলিন, সত্যি বলছ তুমি?
তার দিকে তাকাল সিলিয়া, তার প্রতি শ্রদ্ধা ও আবেগ গোপন করতে পারলো না সিলিয়া।
তোমার ব্যাপারে আমি বেশ চিন্তিত ছিলাম। গুরুজনদের মতো স্নেহভরে সিলিয়ার হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে কলিন উঠে দাঁড়িয়ে মিসেস হার্বার্ডের দিকে ফিরে বললো, আশা করি এখন পুলিশে খবর দেবার মতো বোকামো করার দরকার নেই। তেমন মূল্যবান কোনো জিনিষ চুরি যায়নি। তাছাড়া যে জিনিষগুলো সিলিয়া নিয়েছে ও ফেরত দেবে।
ব্রেসলেট ও পাউডার আমি ফেরত দিতে পারব না, উদ্বিগ্ন হয়ে বললো সিলিয়া। ওগুলো আমি ফেলে দিয়েছি। তবে নতুন কিনে দেব।
আর স্টেথিস্কোপটা? জিজ্ঞাসা করলো পোয়ারো, সেটা আপনি কোথায় রেখেছেন?
সিলিয়ার চোখ ঝলসে উঠল।
আমি কখনো কোনো স্টেথিস্কোপ নেইনি। পুরানো একটা স্টেথিস্কোপ আমার কি কাজে লাগবে? তার দৃষ্টি গম্ভীর হল। আর এলিজাবেথের নোটের ওপর আমি কালি ছিটাইনি। এরকম কাজ আমি করি না।
মাদমোয়াজেল, মিস জনহাউসের স্কার্ফ টুকরো টুকরো করার ব্যাপারটা আপনি অস্বীকার করতে পারেন না।
আমি মনে করি ওটা একটা অন্য ব্যাপার। অস্বস্তি ও কতকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে বললো, আমার মনে হয় ভ্যালেরি কিছু মনে করবে না।
আর পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা।
ওহো, ও কাজ আমি করিনি। ওটা কোনো বদমেজাজী লোকের কাজ।
মিস হার্বার্ডের নোটবুক থেকে টাইপ করা হারানো জিনিসের তালিকাটা বার করে সিলিয়ার উদ্দেশ্যে পোয়ারো বললো, এখন সত্যি করে বলুন তো, এসব ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনো কোনো ঘটনার সঙ্গে আপনি জড়িত, আর কোনোটার সঙ্গেই বা না।
তালিকাটা দেখামাত্র সিলিয়ার উত্তর পাওয়া গেল।
ঝোলা ব্যাগ, ইলেকট্রিক বাল্ব কিংবা বোরিক পাউডার কিংবা বাথ সল্ট, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তবে আংটিটা ভুল করে নিয়েছিলাম, সেটা বোঝা মাত্র ফিরিয়ে দিয়েছি। আর একটাই কারণ, আমি অসৎ হতে চাইনি। সেটা কেবল
কেবল কি সেটা?
সিলিয়ার চোখে অনিশ্চিত অস্থিরতা থিক থিক করছিল, জানি না, আমি সত্যিই জানি না, সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
কলিন কোনো যুক্তিতর্ক মানতে চায় না, এমনি ভাব দেখিয়ে বলল, আপনি যদি ওকে প্রশ্নবাণে আর জর্জরিত না করেন তবে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হব। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ভবিষ্যতে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, এখন থেকে আমি ওর সব কাজের জন্য দায়ী থাকব।
ওঃ কলিন, তুমি আমার কত যে ভালো।
সিলিয়া এখন তোমার সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবে? যেমন তোমার আগের পারিবারিক জীবনের কথা–তোমার বাবা মা একসাথে ভালোভাবে মিলেমিশে থেকে ছিলেন তো?
ওহো না। বাড়িতে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ
ওদের কথার মাঝে বাধা দিলেন মিসেস হার্বার্ড।
ওসব কথা থাক, তুমি এসে তোমার দোষ স্বীকার করার জন্য আমি খুবই খুশী। এত সব দুশ্চিন্তার কারণ, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। তবে একথাও বলবো, তুমি যে ইচ্ছা করে এলিজাবেথের নোটের ওপর কালি ছেটাওনি, তোমার কথা আমি মেনে নিচ্ছি। এখন তুমি ও কলিন যেতে পারো।
তারা চলে যাওয়ার পর মিসেস হার্বার্ড একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
ভালো কথা, পোয়ারোর উদ্দেশে বললো সে, এ ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন?
পোয়ারোর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আমার মনে হয় একটা প্রেমের দৃশ্যে আমরা সাহায্য করছি-একেবারে আধুনিক স্টাইলে প্রেম যাকে বলে।
আমাদের সময়কার প্রেমের ধারা এখন কতই না বদলে গেছে? মিসেস হার্বার্ড দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার বললেন, সিলিয়ার যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন ওর বাবা মারা যান। ওর ছেলেবেলা ভালোই কাটে তবে ওর নির্বোধ মা
আহ, মেয়েটি কিন্তু খুবই বুদ্ধিমতী। নিজের থেকে ও কিছু বলবে না। যতটুকু সে শুনতে চায় ঠিক ততটুকুই ও বলবে। মেয়েটি তাকে খুবই ভালোবাসে।
এসব যুক্তি আপনি বিশ্বাস করেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
সিলিয়ার মনে যে সিনড্রেলার জটিলতা ছিল, এ আমি বিশ্বাস করি না। আর জিনিষগুলোর চুরির সময় ও বলেছে যে ও কেন একাজ করেছে ও জানত না, এ যুক্তিও আমি মানতে পারছি না। আমার মনে হয় অখ্যাত জিনিষগুলি চুরির ঝুঁকি ও নিয়ে থাকবে ওর প্রেমিক কলিনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য–এ ব্যাপারে ও সফল। ও যদি সাধারণ লাজুক মেয়ের মতো হত তাহলে কলিন ওর দিকে তাকাই না। আমার মতে, পোয়ারো বলল, মেয়েটি সব মনের মানুষকে পাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সমস্ত ব্যাপারটাই পাখির বাসা বাঁধতে চাওয়ার মতো।
সত্যি মঁসিয়ে পোয়ারো, এ ব্যাপারে অযথা সময় নষ্ট করার জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যাহোক যার শেষ ভালো তার সব ভালো।
না, না, পোয়ারো মাথা নাড়লো। আমার তো মনে হয় না, এ সব ঘটনার শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি। যাহোক হয়তো আমরা এই জটিল কেসের রাস্তা পরিষ্কার করেছি, কিন্তু এখনো কিছু ব্যাপার ঠিক পরিষ্কার হয়নি। আমার মনে হয় এখনো কিছু সংকট রয়ে গেছে–সত্যি অত্যন্ত সংকটজনক কিছু।
মিসেস হার্বার্ডের ফর্সা মুখখানি আবার কালো হয়ে গেল। ওঃ মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি সত্যিই তাই মনে করেন?
এটা আমার ধারণা, ম্যাডাম আমার আশঙ্কা, প্যাট্রিসিয়া লেনের সঙ্গে একবার কথা বলার সুযোগ পাব কিনা। আমি সেই চুরি যাওয়া হীরের আংটিটা দেখতে চাই।
কেন পাবেন না সঁসিয়ে পোয়ারো। আমি এখুনি নিচে গিয়ে ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমিও লিও বেটসনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
একটু পরে প্যাট্রিসিয়া লেন ঘরে ঢুকলেন। মুখে হাজারো প্রশ্ন।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত মিস্ লেন।
ও কিছু নয়। মিসেস হার্বার্ড বললেন আপনি আমার হীরের আংটিটা দেখতে চান। আংটিটা আঙুল থেকে খুলে পোয়ারোর হাতে দিল মিস্ লেন।
সত্যি খুব বড় মাপের হীরের আংটি। তবে আমার ধারণা সেকেলে।
মিস লেন বললেন–আমার মায়ের বাগদানের আংটি।
আপনার মা কি এখনো জীবিত?
না, বাবা ও মা দুজনেই মৃত।
বড় দুঃখের কথা।
হ্যাঁ, আমার দুঃখ আমি তাদের বড় একটা ঘনিষ্ঠভাবে পাইনি। তারপর আমি প্রতুবিদ্যায় পোস্টগ্র্যাজুয়েট হচ্ছি বলে মা খুব নিরাশ হন।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পোয়ারো ভাবল : তার অনুমান মেয়েটির বয়স সবে তিরিশ পেরিয়েছে। ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক ছাড়া অন্য কোনো প্রসাধন নেই। চশমার আড়ালের ওর গভীর নীল চোখে গাম্ভীর্যের ছাপ। মেয়েটির আচরণে কোনো দম্ভ নেই, কোনো অহঙ্কার নেই, পোষাকে ফ্যাশন বলতে কিছু নেই, সাদামাটা পোশাক। তবে বুদ্ধিমতী ও শিক্ষিত মেয়ে ও, নিজের মনে পোয়ারো বললো, কিন্তু খুব শিগগীর বুড়িয়ে যাবে ও। সেই মুহূর্তে মেয়েটির কথা ভাবতে গিয়ে তার কাউন্টেস ভেরা রসকোফের কথা মনে পড়ে গেলো তার। কিরকম চমৎকার দেখতে ছিল সে, অথচ আজকের দিনে প্যাট্রিসিয়ার মতো মেয়েরা
তবে এই কারণে আমিও যেন বুড়িয়ে যাচ্ছি। আপন মনে বললো পোয়ারো, এমন কি এই চমৎকার মেয়েটিই হয়তো কোনো পুরুষের কাছে খেয়াল হিসাবে আবির্ভূত হবে। তবে তাতে সন্দেহ আছে।
প্যাট্রিসিয়া তখন বলছিল : মিস জনস্টনের যা ঘটেছে তার জন্য আমি সত্যিই মর্মাহত সবুজ কালি ব্যবহার করার ফলে হয়তো মনে হতে পারে যে, নিজেল ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা বিদ্বেষপরায়ণ কাজ করেছে, কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো আমি আপনাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি, এ কাজ সে কিছুতেই করতে পারে না।
আঃ মেয়েটির দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাল পোরে।
নিজেলকে সহজে বোঝা যায় না। মেয়েটি আন্তরিকভাবে বলল-দেখুন ওর ছেলেবেলায় পারিবারিক জীবনটা খুবই কষ্টের ছিল।
আর এক প্রেম কাহিনি। নিজের মনে বলে ফেললো।
কি বললেন?
না কিছু না। হ্যাঁ আপনি কি বলছিলেন যেন
নিজেলের ব্যাপারে। তাকে বোঝা কষ্টকর। ভালো বা মন্দ যা হোক সবসময়েই সবকিছুর বিরোধিতা করার প্রবণতা আছে তার মধ্যে। তবে সে সত্যি চালাক ও মেধাবী। তবে স্বীকার করতে হবে মাঝে মাঝে তার ব্যবহার দুর্ভাগ্যজনক হয়ে ওঠে। তখন সে নিজের প্রতিরোধের কথা ভুলে যায়, ভুলে যায় কোনো কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা করতে। সবাই যখন সবুজ কালির প্রতিবাদ করতে ব্যস্ত, তখন সে ঠিকভাবে প্রতিবাদ করতে পারেনি। তার বক্তব্য ছিল একটাই–তারা যদি তাই মনে করতে চায়, তাদের তাই ভাবতে দিন। তার এই মনোভাব মূর্খতারই পরিচয়।
এতে অবশ্যই ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলো; আপনি তো ওকে অনেক বছর ধরে জানেন।
না, মাত্র একবছরের আলাপ আমাদের। গত বছর বেড়াতে যাওয়ার সময় ওর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সেখানে ওর প্রথমে ফ্লু হয়। তারপর নিউমোনিয়া। তখন আমি ওর শুশ্রূষা করি। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে একদমই যত্ন নেয় না। শিশুর মতো ওর যত্ন নেওয়া উচিত। সত্যি ওকে দেখাশুনা করার জন্য কাউকে ওর প্রয়োজন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো পোয়ারো। হঠাৎ তার মনে হল প্রেমের ক্ষেত্রে খুবই ক্লান্ত সে–প্রথমে সিলিয়া, ওর চোখে ভয়ঙ্কর প্রেমের আকুতি। আর এখন প্যাট্রিসিয়া ম্যাডোনার মতো আন্তরিক ভাবে তাকিয়ে আছে। স্বীকার করতেই হবে একজোড়া যুবক-যুবতী পরস্পরের কাছে এলে তাদের মধ্যে অবশ্যই ভালোবাসার জন্ম হতে পারে। তাদের করুণার চোখে দেখলো পোয়ারো। তারপর উঠে দাঁড়াল সে।
মাদমোয়াজেল, যদি অনুমতি করেন তো এই আংটিটা আপাতত আমার কাছে রেখে দিচ্ছি। আগামীকাল অবশ্যই ফেরত পাঠাব।
নিশ্চয়ই, একটু অবাক হয়ে পাট্রিসিয়া বললো–আপনার ইচ্ছে হলে নিশ্চয়ই নেবেন।
আপনি অত্যন্ত দয়ালু। তাই বলছি মাদমোয়াজেল এইরকম নরম মন নিয়ে একটু সাবধানে থাকবেন।
সাবধানে? কিরকম সাবধানে বলুন তো?
আমার ইচ্ছা আমি জানি, বললো এরকুল পোয়ারো। তখন সে চিন্তিত।