লোকটাকে আমি ভীষণ ভীষণ ঘেন্না করি।
কেন?
লোকটা একটা নরপশু।
ধারণাটা হল কেন?
কেন আবার! অভিজ্ঞতা থেকে জানি।
আপনার সঙ্গে ওর বিবাহিত জীবন কতদিনের?
মাত্র সাত দিনের।
মাত্ৰ সাত দিন বাদেই আপনি চলে আসেন?
বিয়ের, মানে ফুলশয্যার পরদিন সকালেই চলে আসার কথা। আসিনি। লোকলজ্জা বাধা হয়েছিল।
লোকটা আপনার ওপর ফিজিক্যাল টর্চার করেছিল কি?
মানে মারধর?
হ্যাঁ।
মারধরের চেয়ে অনেক বেশি।
আপনি কি বলতে চান লোকটার সেক্স একটু বেশি?
একটু বেশি? একটু বেশি বললে কিছুই বলা হয় না।
তা হলে খুব বেশি?
আমি আর কিছু বলতে চাই না। লজ্জার কথা এভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে লোকটা নরপশু, জেনে রাখুন।
বুঝলাম, আপনি তার দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন।
হ্যাঁ। আমাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল।
এটা কতদিন আগেকার ঘটনা?
দেড় বছর।
এই দেড় বছরের মধ্যে আর কোনও যোগাযোগ হয়নি?
ওর সঙ্গে নয়। তবে ওর বাড়ির কেউ কেউ আমার কাছে আজও আসে, খোঁজখবর নেয়। তারা আমার জন্য দুঃখিত।
লোকটির সঙ্গে আপনার শেষ দেখা তা হলে দেড় বছর আগে?
হ্যাঁ।
আপনি ডিভোর্সের মামলা করেননি?
না।
কেন?
ডিভোর্স করেই বা কী হবে বলুন। আমি তো আর বিয়ে করতে যাচ্ছি না।
তাই বা কেন?
একবারের অভিজ্ঞতায় আমি এত আতঙ্কিত যে আর ও কথা ভাবতেও ইচ্ছে করে না।
আপনি কি ভজনবাবুর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পান?
হ্যাঁ পাই। ওর বাড়ির লোকেরা খারাপ নয়, তারাই একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মাসে মাসে টাকা দিয়ে যায়।
ভজনবাবু নিজেই আসেন টাকা দিতে?
না না। তার অত সাহস নেই। আসে ওর ছোটভাই পূজন।।
আপনি তো চাকরি করেন।
করি।
কোথায়?
আলফা নেটওয়ার্ক-এর মার্কেটিং ডিভিশনে।
সেটা কেমন চাকরি?
ভালই। আমি একজন একজিকিউটিভ।
তা হলে ভজনবাবুর সাহায্য না হলেও চলে?
কেন চলবে না?
আপনার বাপের বাড়ির অবস্থাও তো ভালই দেখছি।
খারাপ নয়। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার, সুরেন্কা ইন্ডাস্ট্রিজের ওয়ার্কস ডিরেক্টর। আমার দাদা আমেরিকায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
ভজনবাবুর সাহায্য তবু আপনি নেন?
কেন নেব না? সে আমার জীবনটাকে নষ্ট করেছে। তার কিছু ক্ষতিপূরণ তো ওকে করতে হবে।
তা তো বটেই। এবার একটা ডেলিকেট প্রশ্ন।
বলুন।
ইজ হি ক্যাপেবল অফ মার্ডার?
তা কী করে বলব? আমার সঙ্গে পরিচয় তো সামান্য।
আপনি তো ওকে নরপশু বললেন।
তা তো বলেইছি।
আপনার কি মনে হয় লোকটা খুব হিংস্ৰ?
অন্তত একটা ব্যাপারে তো তাই।
একটা ব্যাপার থেকেও তো কিছু আন্দাজ করা যায়।
এবার আমাকে একটু মুশকিলে ফেলেছেন।
কেন বলুন তো।
লোকটাকে কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে খুব নিরীহ মনে হয়।
সেটা কেমন?
এমনিতে চুপচাপ, মাথা নিচু করে থাকে।
তাতে কি নিরীহ বলে প্ৰমাণ হয়?
না। তা হয় না।
তা হলে?
ফুলশয্যার পরদিন সকালে আমার অবস্থা দেখে ওর এক বোন সব কথা বাড়ির লোককে বলে দেয়। ওর বাড়ির লোক ওকে খুব বকাঝকা করেছিল। লোকটা খুব যেন অপরাধবোধে কাতর হয়েছিল। তবে সেটা অভিনয়ও হতে পারে।
আমার জানা দরকার লোকটা খুনটুন করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে কি না।
তা জানি না।
এবার একটা কথা বলি।
বলুন।
খুন সবাই করতে পারে না। খুন করার জন্য একটু আলাদা এলেম দরকার হয়। এক ধরনের মানসিকতার।
তা হবে।
এ লোকটার সেই মানসিকতা আছে কি না। আমি সেইটে জানার চেষ্টা করছি।
বলেছি তো, লোকটাকে আমি ভাল করে চিনি না।
একটা কথা।
বলুন।
আপনি একজন শিক্ষিতা মহিলা, আপনার পরিবারও বেশ কালচার্ড। আপনি ভজনবাবুর মতো একজন গ্যারেজ মালিককে বিয়ে করলেন কেন?
গ্যারেজ মালিক হলেও ভজন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। একসময়ে ভাল মোটর তৈরির কারখানায় কাজ করত। তারপর নিজে স্বাধীনভাবে ব্যাবসা শুরু করে। শুনেছি। ওর গ্যারেজে নতুন ডিজাইনের দু-তিনটে গাড়ি তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করেছে।
শুধু সেই কারণ?
আমার বাবা স্বাধীনচিত্ত পুরুষকে খুব পছন্দ করেন।
শুধু প্রফেশনের দিকটা ছাড়া আপনারা আর কিছু দেখেননি?
এটা নেগোসিয়েটেড ম্যারেজ ছিল। আমি বাবার মতে মত দিয়েছিলাম মাত্র। লোকটার যেসব বিবরণ পেয়েছিলাম তাতে খারাপ লাগেনি।
বিয়ের আগে আপনারা পরস্পরকে দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনার পছন্দ হয়েছিল?
চেহারাটা খারাপ লাগেনি। বিনয়ী ভাবাটাও তো ভালই মনে হয়েছিল।
ওঁর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ উঠেছে সে তো জানেন।…
হ্যাঁ।
আপনি ওঁর মোটর গ্যারেজে কখনও গেছেন?
না। যাওয়ার মতো সময় তো পাইনি। বিয়ের পরই তো চলে এলাম।
কারখানাটা কোথায় তা জানেন?
শুনেছি, কলকাতার বাইরে বারাসাতের কাছে কোথায় যেন।
হ্যাঁ। খুনের ডিটেলসটা জানেন কি?
না। শুনেছি। একটি মেয়ে খুন হয়েছে।
হ্যাঁ। তার আগে একটা প্রশ্ন।
বলুন।
আপনি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসার পর পুলিশে ভজনবাবুর বিরুদ্ধে একটা ডায়েরি করেন।
হ্যাঁ, রাগের মাথায় করেছিলাম।
তাতে কি ওর সেক্সচুয়াল ব্রুটালিটির উল্লেখ ছিল?
ছিল। কিন্তু রাগে অন্ধ হয়ে ডায়েরি করেছিলাম। পরে কেলেঙ্কারির ভয়ে উইথড্র করি।
হ্যাঁ, আমরা তা জানি। পুলিশ ভজনবাবুকে ধরেও আপনার বাবার অনুরোধে এক রাত্তির পরেই ছেড়ে দেয়।
আমরা পারিবারিক দুর্নামের ভয়ে এটা করি।
এই খুনের ঘটনার পর কি আপনার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আপনার কাছে এসেছিল?
না!
খুনটা হয়েছে সাত দিন আগে। এর মধ্যে কেউ আসেনি?
পূজন মাঝে মাঝে আসে, কিন্তু ঘনঘন নয়। গত সাত দিনে কেউ আসেনি।
এবার একটা সেনসিটিভ প্রশ্ন।
বলুন।
লজ্জা পাবেন না তো!
লজ্জা পেলে জবাব দেব না।
ভেরি গুড।
প্রশ্নটা কী?
ভজনবাবু যে সেক্সচুয়াল ব্যাপারে স্যাডিস্ট গোছের মানুষ তা আপনার কথা থেকেই স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন, যার সেক্সচুয়াল আর্জ এত বেশি সে তো নিশ্চয়ই প্রস কোয়ার্টারে যায়।
এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।
সমস্যা হল এরকম মানুষেরা নিজেদের সামলে সংযত রাখতে পারে না।
প্রস কোয়ার্টারে গেলে হয়তো যায়। আমি কী করে জানব বলুন।
কোনও হিন্ট পাননি?
ন।
সমস্যা হল, পুলিশ এই অ্যাঙ্গেলটা ভাল করে দেখেছে, কিন্তু ওঁর প্রস কোয়ার্টারে যাওয়ার কোনও প্ৰমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
প্রস কোয়ার্টারে গেলে ভজনবাবুর বিরুদ্ধে কেসটা আরও শক্ত হত। উনি যে স্যাডিস্ট তা প্ৰমাণ করার সুযোগ থাকত।
আমি তো বলেইছি লোকটাকে ভাল করে চেনার কোনও সুযোগ আমার হয়নি। যে মেয়েটা খুন হয় সে কি প্রস?
না।
তা হলে এ প্রসঙ্গ কেন?
মেয়েটিকে খুন করার আগে ব্রুটালি রেপ করা হয়।
ওঃ।
ইজ ইট জাস্ট লাইক ভজনবাবু?
কী করে বলব বলুন। আমাকে তো খুন করেনি।
মারধর বা হাত মুচড়ে দেওয়া, গালাগাল করা, এসব?
আমাকে প্লিজ, এসব প্রশ্ন করবেন না। আমার পক্ষে ডিটেলস বলা সম্ভব নয়। রুচিতে বাধে।
সরি। কিন্তু এটা তো জানেন যে, এটা মার্ডার কেস।
হ্যাঁ। কিন্তু আমার পক্ষে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু কোর্টে যে আপনাকে এসব অস্বস্তিকর প্রশ্ন করা হবে।
কোর্টে! কোর্টে কেন আমি যাব?
আপনাকে পুলিশ সাক্ষী হিসেবে ডাকবে।
সে আমি পারব না।
ভয় পাচ্ছেন?
ভয় নয়। এসব বিচ্ছিরি ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আমি কিন্তু কিছু বলতে পারব না।
সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আপনার সাক্ষ্যের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
কী নির্ভর করছে?
মোটিভ অফ মার্ডার।
আমার ওপর নির্ভর করবে কেন? আমার সঙ্গে লোকটার তো কোনও সম্পর্কই নেই।
সম্পর্ক যে নেই তার কারণটাই তো আমাদের দরকার। ভজনবাবু যে একজন স্যাডিস্ট সেটা প্রমাণ করতে পারলে পুলিশের কাজ সহজ হয়ে যায়।
প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন। খুন যদি ও করে থাকে তো সেটা পুলিশ প্রমাণ করুক। আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?
পুলিশ তার কাজ করবে। পুলিশকে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। মেয়েটা কে?
ভাল প্রশ্ন। এ প্রশ্ন অনেক আগেই আপনি করতে পারতেন।
আপনি আমাকে এত প্রশ্ন করছেন যে, আমি প্রশ্ন করার সুযোগই পাচ্ছি না।
সরি ম্যাডাম। এসব ঘটনা ঘটলে লোককে বিরক্ত না করে উপায় থাকে না কিনা।
বুঝেছি। এবার বলুন মেয়েটা কে?
একজন টিনএজার। ষোলো-সতেরোর বেশি বয়স নয়। খুব চঞ্চল আর একটু ডানপিটে গোছের মেয়ে। ভজনবাবুর গ্যারেজের পর একটা খেলার মাঠ। মেয়েটার বাড়ি ওই মাঠটা পেরিয়ে। মেয়েটার নাম রিঙ্কু। খুব মড মেয়ে। তার বাবার চিংড়ি মাছের ব্যাবসা আছে। মোটামুটি পয়সাওলা লোক। মেয়েটা একটা সাইকেলে চড়ে পাড়ায় চক্কর দিয়ে বেড়াত। পোশাকও পরত। খুব উগ্র। কখনও শর্টস আর কামিজ। কখনও জিনস আর টি-শার্ট।
কেমন মেয়ে?
যেটুকু জানা যায়, বখাটে টাইপের মেয়ে। বাবা ডিভোর্সি। মা আবার কাকে বিয়ে করে বাইরে কোথাও থাকে। মেয়েটা বাবার কাছে থাকত।
একমাত্র মেয়ে?
হ্যাঁ। বোধহয় খুব আদরেরও দেখতেও খারাপ ছিল না। সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে, মেয়েটার বেশ অ্যাট্রাকটিভ চেহারা ছিল এবং যথারীতি পাড়া-বেপাড়ার ছেলেরা তার পিছনে ঘুরঘুর করত। রিঙ্কুর বদনাম ছিল, সে ছেলেদের সঙ্গে ফ্রিলি মেলামেশা করে। বাবার কোনও শাসন ছিল না। ভদ্রলোক নিজের কাজ নিয়ে হিমশিম খেতেন, মেয়ের দিকে নজর দেওয়ার সময় ছিল না।
বাড়িতে আর কেউ নেই?
রিঙ্কুর ঠাকুমা আর দাদু ও বাড়িতে থাকেন। তঁদের থাকা নিয়েই রিঙ্কুর মা আর বাবার মধ্যে বনিবনার অভাব দেখা দেয়। তারপর অশান্তি বেড়ে বেড়ে শেষ অবধি ডিভোর্স।
রিঙ্কুর বাবা আর বিয়ে করেননি?
না। তিনিও আপনার মতোই। বিয়ের অভিজ্ঞতা তিক্ত হয়েছিল বলে আর বিয়ে করেননি। তা বলে তার বিয়ের বয়স যায়নি। হি ইজ ওনলি ফর্টিফোর।
এবার আমার করণীয় কী বলুন। সাক্ষী দিতে হবে শুনে আমার ভীষণ ভয় করছে।
ভয় কীসের?
সাক্ষীটাক্ষি দিলে তো পাবলিসিটি হবে। পুরনো কথা উঠবে।
তা উঠবে।
সেইটেই ভয় পাচ্ছি। এ ঘটনার সঙ্গে তো আমার কোনও সম্পর্কই নেই। তবু কেন যে আপনারা আমাকে ইনভলভড করতে চাইছেন।
উপায় নেই বলে।
লোকটা কি এখন জেলে?
পুলিশ কাস্টডিতে। আপনি চাইলে ওর সঙ্গে দেখা করতে পারেন!
দেখা করব? সে কী কথা! আমি ওর সঙ্গে দেখা করব কেন?
লোকটা আপনার কাছে হয়তো কিছু বলতে পারে।
প্লিজ, আমাকে এসব কাজে জড়াবেন না। আমি ওরা ছায়াও মাড়াতে চাই না।
ম্যাডাম, কাজটা অপ্রীতিকর হলেও আমার কিছু কৌতূহল আছে।
আমি পারব না। মাপ করবেন।
আগে একটু শুনুন। দিন সাতেক আগে ঘটনাটা ঘটে। ভজনবাবুর মোটর গ্যারেজের পাশের মাঠে মেয়েটির ডেডবডি পাওয়া যায় সকালবেলা। মাঠটায় কিছু আগাছার জঙ্গল আছে, তার মধ্যে। মেয়েটি বাড়ি না ফেরায় সারা রাত লোকজন এবং পুলিশও তাকে অনেক খুঁজেছিল। পায়নি।
শুনতেই আমার খারাপ লাগছে। ডেডবডি কথাটা শুনেই আমার মনটা কেমন করে উঠল। আহা, ওইটুকু একটা মেয়েকে মারে কেউ?
মানুষের ভিতরে একটা পশু তো থাকেই। আর সেই পশুটাকে ধরার জন্যই আপনার সাহায্য প্রয়োজন।
পশুটা কি ওই ভজন?
তাই মনে হচ্ছে।
আপনাদের হাতে প্ৰমাণ নেই?
একেবারে প্রমাণ ছাড়া তো ভজনকে ধরা হয়নি।
প্ৰমাণই যদি থাকে তা হলে ওকে শাস্তি দিলেই তো হয়। আমার সাহায্যে কী দরকার?
প্ৰমাণ আছে, আবার নেইও।
সে আবার কী?
ভজনবাবুর গ্যারেজটা একটু নির্জন জায়গায়। প্ৰায় এক বিঘা জমি নিয়ে গ্যারেজ। অনেক সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতি আছে। ডিজাইনার গাড়ি তৈরি করার জন্য ভজনবাবু কিছু অর্ডার পাচ্ছিলেন। দেশি-বিদেশি গাড়ির মোটর নিয়েও বোধহয় এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন। গ্যারেজটা আরও বড় করার জন্য পাশের মাঠটা কেনারাও চেষ্টা করছিলেন।
আমি এতসব জানি না। তবে পুজন বলেছিল ওর গ্যারেজ বড় হচ্ছে।
হ্যাঁ, বেশ বড় গ্যারেজ।
ওর কি অনেক টাকা?
হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে ওরা ছাড়াছাড়ি তো দেড় বছরের?
এক বছর আট মাস।
গত দেড় বছরের মধ্যেই ভজনবাবু অনেক টাকা করেছেন। আর বোধহয় সেই কারণেই লোকটার পিছনে ওখানকার ক্লাব এবং মস্তানেরা লেগে গিয়েছিল। তারা টাকা চাইত, উনি দিতেন না।
এসব আমার জানা ছিল না।
আপনার জানার কথা নয়। তবে মাস ছয়েক আগে ভজনববুর ওপর হামলা হয় এবং উনি কয়েকটা গুন্ডা ছেলের হাতে মার খান!
হ্যাঁ, এরকম একটা কী যেন পূজনের কাছে শুনেছিলাম। বেশি মাথা ঘামাইনি।
ভজনবাবু লোকটি খুব বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাবসাদার নন। তা যদি হতেন তা হলে গুন্ডা মস্তানদের কিছু চান্দা দিয়ে হাতে রাখতে পারতেন। সে পথে না গিয়ে উনি কনফ্রন্টেশনের পন্থা নিয়েছিলেন। এমনিতে নিরীহ হলেও বেশ একগুয়ে আর জেদি। তাই না?
তা তো বটেই।
যাইহোক, এই ঘটনার পর গ্যারেজটা প্রায় উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়। ভজনবাবু আপসরিফা করতে রাজি হননি, টাকাও দেননি। উনি পুলিশকেও হাত করার চেষ্টা করেননি বলে প্রোটেকশনও পাননি।
এতসব জেনে আমার কী হবে?
লোকটার চারিত্রিক আউটলাইনটা আপনার সম্পূৰ্ণ জানা নেই বলেই বলছি।
তা হলে বলুন।
লোকটা বিপদের ঝুকি নিয়েই ওখানে গ্যারেজ চালাতে লাগলেন। ভজনবাবু একটা রিভলভার কিনেছিলেন। লাইসেন্সও ছিল। আর ওঁর গ্যারেজের কর্মচারীরা–কী জানি কেন–ওঁর খুবই অনুগত। তারাও ওঁকে প্রোটেকশন দিতে লাগল। ফলে গ্যারেজের সঙ্গে লোকালিটির একটা শক্ৰতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। গ্যারাজে। বার কয়েক বোমা পড়েছে, আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, জনসাধারণকে খেপিয়ে তুলে অবরোধের চেষ্টাও হয়েছে, তার চেয়ে বড় কথা পলিটিক্যাল প্ৰেশারও ওর বিরুদ্ধে ছিল। জনসাধারণের অভিযোগ ওই গ্যারেজে চোলাই তৈরি হয়, সমাজবিরোধী কাজ হয় ইত্যাদি।
সত্যিই হত নাকি?
বোধহয় না।
তা হলে আপনি কী বলতে চাইছেন?
বলতে চাইছি ভজনবাবুর শত্রুর অভাব নেই।
সে তো হতেই পারে।
আর শক্ৰতা ছিল বলেই ভজনবাবু ইদানীং গ্যারেজেই থাকা শুরু করেছিলেন। গ্যারেজের ভিতরদিকে ওঁর যে অফিসঘরটা আছে সেখানে চৌকি পেতে বিছানা করে নিয়েছিলেন। রান্নাবান্নাও নিজেই করে নিতেন। ওঁর জবানবন্দি অনুসারে গ্যারেজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওঁর গ্যারেজে থাকাটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। লোকটাকে সাহসী বলতে হয়। কী বলেন?
আমি কী বলব বলুন। আপনার মনে হলে হতে পারে।
গ্যারেজে দু’জন কর্মচারী রাতে পাহারা দিত। আর ভজনবাবুতো সপ্তাহে চার-পাঁচ দিনই থাকতেন। যেদিন ঘটনােটা ঘটে সেদিনও ভজনবাবু গ্যারেজে ছিলেন।
গার্ডরাও ছিল তো!
দুঃখের বিষয় সেদিন দিবাকর নামে যে কৰ্মচারীটির গার্ড দেওয়ার কথা ছিল তার মায়ের অসুখ বলে সে আসেনি। ছিল রতন নামে দ্বিতীয় গার্ডটি।
মেয়েটির সঙ্গে কি ভজনের আলাপ ছিল?
ছিল। মেয়েটা প্রায়ই নাকি গ্যারেজে হানা দিত। সে ভজনবাবুকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিতে বলত। এবং ভজনবাবু মাঝেমাঝে রিঙ্কুকে গাড়ি চালানো শেখাতেনও। শোনা যায়, রিঙ্কু ভাল গাড়ি চালাতে শিখে গিয়েছিল।
বাঃ, তা হলে আর সন্দেহ কী?
সন্দেহের অবকাশ বিশেষ নেই। কারণ ঘটনার দিন সন্ধেবেলা গ্যারেজের উলটোদিকের বাড়ির সনাতন মল্লিক দেখেছেন যে, রিঙ্কুর সাইকেলটা গ্যারেজের ফটকের কাছে দাঁড় করানো।
তা হলে তো মিলেই যাচ্ছে।
যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটা সন্ধেবেলা ঘটেনি। ঘটেছে একটু বেশি রাতে। অন্তত পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলে।
আপনি বড্ড ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলেন শবরবাবু।
হ্যাঁ, ওইটে আমার দোষ। তবে আসল ঘটনা বের করার জন্য ব্যাকগ্রাউন্ডটা ভাল করে। বুঝিয়ে বলা দরকার মিসেস আচার্য।
আমাকে প্লিজ, মিসেস আচাৰ্য বলবেন না। আমার নাম বিভাবরী ভট্টাচাৰ্য।
জানি। ডিভোর্স করেননি বলে মিসেস আচাৰ্য বলে ফেলেছিলাম।
কোর্টের ডিভোর্স না হলেই কী? আমি মনে মনে তো কবেই। ওকে পরিত্যাগ করেছি।
তা বটে। ডিভোর্সের প্ল্যান আছে কি?
এসব শুনে মনে হচ্ছে, ডিভোর্সটা করে রাখলেই ভাল হত।
তা ঠিক। তবে ডিভোর্স হয়ে থাকলেও আমরা আপনাকে সাক্ষী মানতাম।
উঃ, কী যে মুশকিল!
সরি ম্যাডাম।
আপনি আমার প্রবলেমটা বুঝতে পারছেন তো শবরবাবু?
পারছি বিভাবেরী দেবী। কিন্তু প্রবলেমটা আমাদের সকলেরই। আপনি এক্সপোজারকে ভয় পাচ্ছেন, কোটিকাছারিতে যেতে অপছন্দ করছেন, কিন্তু আমাদের যে উপায় নেই।
ঠিক আছে বলুন।
রিকুর সাইকেলটা খুব দামি এবং রেসিং মডেলের। ওরকম দামি সাইকেল ওই অঞ্চলে কারও নেই। সুতরাং ওই লাল রঙের সাইকেলটা সহজেই চোখে পড়ত। বুঝতে পারছেন?
পারছি। সন্ধেবেলা গ্যারেজে সাইকেলটা দাঁড় করানো ছিল।
হ্যাঁ।
তা হলে তো প্ৰমাণই হয়ে গেল যে, রিঙ্কু ভিতরে ছিল।
আপাতদৃষ্টিতে তাই।
আবার আপাতদৃষ্টি কেন?
পুলিশের মনটা বড্ড খুঁতখুতে। এই যে ধরুন না। আমার মোটরবাইকটা এখন আপনাদের বাড়ির সামনে দাঁড় করানো আছে, আর আমি ভিতরে বসে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। মোটরবাইকটা যে চেনে সে ওটা দেখে বলতেই পারে যে, শবর দাশগুপ্ত এখন বিভাবরী ভট্টাচার্যের বাড়িতে বসে আছে। কিন্তু এমন তো হতেই পারে যে, মোটরবাইকটা আর কেউ টেনে এনে রেখেছে বা আমিই ওটা রেখে দিয়ে বাসে উঠে বাড়ি চলে গেছি। সুতরাং এটাকে ফুল প্রািফ বলে ধরা যায় না।
আপনারা সোজা জিনিসটাকে প্যাচালো করতে ভালবাসেন।
তা নয়। আসলে দুনিয়ায় সহজ সরলভাবে কিছুই ঘটে না। তা যদি ঘটত তা হলে আমাদের কত পরিশ্রম বেঁচে যেত বলুন।
তা বটে। একটু চা খাবেন? অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলছেন।
কফি হলে হত। বেশিরভাগ বাড়িতেই চা-টা ভাল হয় না।
আপনি ভীষণ ঠোঁটকাটা তো!
খারাপ চা খাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই ঠোঁটকাটা হতে হয়েছে।
আচ্ছা, কফিই করে আনছি।
আনুন।
বিভাবরী উঠে যাওয়ার পর শবর ঘরটা আবার দেখল। সচ্ছল পরিবারের বৈঠকখানা যেমন হয় তেমনই সাজানো। সোফাসেট, সেন্টার টেবিল, নিচু বুক কেস, দেয়ালে কিছু ওয়াল ডেকোরেশন। বুক কেসের ওপর কাঠের তৈরি বাঁকুড়ার ঘোড়া। তার পাশে দুটো স্টিল ফ্রেমের ছবি। একটা ছবি বিভাবরীর মা আর বাবার। অন্যটা বোধহয় কম বয়সে বিভাবরী আর তার দাদার।
বিভাবরী কফি এনে বলল, শুধু দুধের কফি। চলবে তো!
শবর একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাঃ।। চিনিটা খুব পারফেক্ট হয়েছে তো। চিনিতেই গণ্ডগোলটা বেশি হয়।
বিভাবরী একটু হেসে বলল, রিঙ্কুর সাইকেলের গল্প কিন্তু এখনও শেষ হয়নি।
শবর বিভাবরীর দিকে তাকাল। মেয়েটির চেহারা খুবই ভাল। খুব লম্বা নয়, তেমন ফরাসাও বলা যায় না, কিন্তু মুখখানা খুব ঢলঢলে। চোখ দু’খানা টানা এবং দৃষ্টিটা মায়ায় মাখানো। অ্যাট্রাকটিভ। হ্যাঁ ভেরি অ্যাট্রাকটিভ।
কী দেখছেন?
ভাবছি আপনার মতো একজন সুন্দরী মহিলার ভাগ্যটা সুন্দর হল না কেন। কী যেন কথায় আছে, অতি বড় সুন্দরী না পায় বর–না। কী যেন!
বিভাবরী একটু লজ্জার হাসি হেসে বলল, আমি সুন্দরী হলে বলতে হয় আপনি সুন্দরী কথাটার মানেই জানেন না।
তা হতে পারে। তবে যা চোখের পক্ষে স্নিগ্ধকর, তাই আমার সুন্দর বলে মনে হয়। যাকগে।
হ্যাঁ, খুব আনইজি সাবজেক্ট।
যা বলছিলাম। রিঙ্কুর সাইকেল। গ্যারেজে রিঙ্কুর সাইকেলটা সন্ধে থেকেই ছিল। বা তারও আগে থেকে। অন্তত সন্ধে থেকে যে ছিলই তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
রিঙ্কুকে কেউ গ্যারেজে ঢুকতে দেখেনি?
খুব ভাল প্রশ্ন। না, আমরা এখনও পর্যন্ত কোনও প্রত্যক্ষদশীকে পাইনি যে রিঙ্কুকে গ্যারেজে ঢুকতে দেখেছে। জায়গাটা একটু নির্জন। উলটোদিকে মল্লিকবাবুর বাড়ি, আশেপাশে আর বাড়ি নেই। একাধারে ডোবা, অন্য ধারে একটা বাড়ির ভিত হয়ে পড়ে আছে। লোকজন বিশেষ চলাচল করে না। ভজনবাবুর গ্যারেজেই যা লোকের যাতায়াত। সেদিন রবিবার গ্যারেজ বন্ধ থাকায় লোকজনও ছিল না।
রতন না। কী যেন নাম–সে কী বলে?
রতন ডিউটিতে এসেছিল রাত ন’টা নাগাদ।
সে সাইকেলটা দেখেনি?
দেখেছে। তবে রিঙ্কু ভিতরে ছিল কি না সে জানে না।
কেন, তার তো খোঁজ করা উচিত ছিল।
সে যা বলেছে তা মোটামুটি এরকম, সে রাত ন’টার কিছু পরে গার্ড দিতে আসে। ফটক খোলাইছিল। একটা বাতি মাত্ৰ জ্বলছিল বলে জায়গাটায় আলো আঁধারি ছিল। সে ফটকের কাছে একটা পুরনো গাড়িতে বসে ছিল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ সাইকেলটা তার নজরে পড়ে। ওদিকে ভজনবাবুর ঘরের দরজা তখন বন্ধ। তার ধারণা হয়েছিল রিঙ্কু ভজনবাবুর ঘরে বসে গল্পটল্প করছে।
ইস লোকটা যদি তখন গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিত তা হলে বোধহয় মেয়েটা বেঁচে যেত।
ধাক্কা না দিলেও সে পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে দাড়িয়েছিল।
ওঃ। তারপর?
সে শুনতে পায়, ভিতরে একটি মেয়ে বা মহিলার সঙ্গে ভজনবাবুর কথা হচ্ছে। কথা বা তর্কাতর্কি।
তর্কাতর্কি?
হ্যাঁ। অন্তত রতন তাই বলছে।
মেয়েটার গলা তো নিশ্চয়ই তার চেনা।
না চেনার কথা নয়। তবে সেটা যে রিঙ্কুরই গলা এটা সে হলফ করে বলতে পারছে না।
এর পরও কি কোনও সন্দেহ আছে। শবরবাবু?
না, সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু সন্দেহ তো প্ৰমাণ নয়।
সারকামস্টিয়াল এভিডেন্স বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।
আছে। আর সেটাই আমাদের তুরুপের তাস।
রতন মেয়েটাকে দেখেনি, ভাল কথা। কিন্তু রেপ এবং খুনের পর লাশটা যখন মাঠে নিয়ে ফেলা হল, তখন তো তার চোখ বুজে থাকার কথা নয়।
বলছি ম্যাডাম। কথাটা খুবই সত্যি। রতন জানিয়েছে, রাত দশটার কিছু পরে ভজনবাবু দরজা খুলে বেরিয়ে তাকে ডাকেন। রতন খুব কাছাকাছি যাওয়ার আগেই ভজনবাবু তাকে কোকাকোলার ক্যান আনতে পাঠান। ধারে কাছে কোৰ কোলার ক্যান পাওয়া যায় না। তাকে বেশ কিছুটা দুরে যেতে হয়েছিল। প্রায় চল্লিশ মনিট পরে সে ফিরে এসে ভজনবাবুর দরজায় নক করে। ভজনবাবু দরজা খুলে ক্যানগুলো নেন। তখন ঘরে কেউ धिक्ल ना।
তার মানে কী দাঁড়াল?
দুইয়ে দুইয়ে যোগ করলে চারই হয় ম্যাডাম। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ওই চল্লিশ মিনিটের মধ্যে খুন এবং গুম দুটোই হয়েছিল।
উঃ মাগো! কী সাংঘাতিক লোক।
হ্যাঁ, খুবই সাংঘাতিক লোক। আর এই কথাটাই আপনাকে আদালতে দাড়িয়ে বলতে হবে।
আমাকে না হলেও তো হয়। রতনই তো সাক্ষী আছে।
রতন আমাদের খুব ইস্পার্ট্যান্ট সাক্ষী। কিন্তু তার একটা কথা গোলমেলে।
কোন কথাটা?
যে-মেয়েটার কণ্ঠস্বর সে ভজনবাবুর ঘরের ভিতর শুনতে পেয়েছিল সেটা রিঙ্কুর কি না এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়।
ওটা তো সামান্য ব্যাপার। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল, হয়তো তাই গলাটা ভাল শুনতে পায়নি।
সেটা খুব সম্ভব।
ভজনের সঙ্গে রিঙ্কুর কী কথা হচ্ছিল?
শবর একটু হেসে বলে, শুনতে চান? এসব টপ সিক্রেট কি আপনার শোনা উচিত?
উচিত না হলে বলবেন না।
আরে রাগ করছেন কেন? রতন শুনতে পায় মেয়েটা বেশ চিৎকার করেই বলছে, কেন আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না? আপনাকে করতেই হবে। জবাবে ভজনবাবু বেশ উত্তেজিত গলায় বলছিলেন, এসব কী বলছি পাগলের মতো? তোমাকে আমি ওভাবে কখনও ভাবিইনি! তুমি বাড়ি যাও, আমাকে এভাবে বিরক্ত কোরো না। জবাবে মেয়েটা বলছিল, আপনি একটা কাপুরুষ, নপুংসক, আপনার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই, ইত্যাদি। ডিটেলস পুলিশের খাতায় লেখা আছে।
ও বাবা! রিঙ্কু আবার ওকে বিয়েও করতে চেয়েছিল?
চাইতেই পারে। ভজনবাবুর বয়স বোধহয় আঠাশ-উনত্রিশ, তাই না?
ওরকমই।
বয়সের একটু তফাত হত, কিন্তু বিয়ে হতেই পারে।
তা পারে, বিয়েই না হয় করত, মারাল কেন?
সেটাই প্রশ্ন। আপনি বলতে পারেন কেন মারল?
না। কিন্তু ভজন কী বলছে?
ওঁর মুখ থেকে খুব বেশি কথা বের করা যায়নি। উনি বলছেন, সেইদিন সন্ধেবোলা ওঁর ঘরে যে-মেয়েটি ছিল সে রিঙ্কু নয়।
তবে কে?
তা উনি বলতে রাজি নন।
বলবে কী করে? সত্যি কথা বললে তো প্ৰমাণই হয়ে গেল।
আমাদেরও সন্দেহ মেয়েটা রিঙ্কুই।
এখনও সন্দেহ?
নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণিত না হলে সন্দেহ কথাটাই ব্যবহার করা ভাল।
সে আপনারা করুন। আমি জানি মেয়েটা রিঙ্কুই।
শবর একটু হাসল, তারপর বলল, ভজনবাবুকে ফাঁসিতে লটকানোর জন্য আপনি যে একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দেখছি।
হব না! একটা মেয়েকে রেপ করে যে খুন করেছে তার কি ফাঁসি হওয়া উচিত নয়?
ফাঁসি বা যাবজ্জীবন যাইহোক, সব সন্দেহের সম্পূর্ণ নিরসন না করতে পারলে জজ তো আর সেই হুকুম দেবেন না।
আপনি রিঙ্কুর সাইকেলের কথাটা কি ভুলে যাচ্ছেন?
না, আমি কিছুই ভুলি না, রিফুর সাইকেলটাও একটা মস্ত এভিডেন্স। কিন্তু ভজনবাবু বলছেন, সাইকেলটা যে ওখানে ছিল তা তিনি জানতেন না। সে ব্যাপারে কিছু বলতেও পারেন না।
বেশ কথা তো!
হ্যাঁ। পুলিশ কেস সাজালে ভজনবাবু যে বিপদে পড়বেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেস সাজানোর ব্যাপারে আমাদের ফুল প্রফ হওয়া দরকার।
ফুল প্রফ হওয়ার জন্য আর কী কী দরকার?
ভাল হত। একজন আই উইটনেস পেলে।
গ্যারেজের উলটোদিকে যে-লোকটা থাকে সে কিছু দেখেনি?
না। আরও একটা কথা।
কী কথা?
পুলিশের কুকুর কিন্তু ভজনবাবুর গ্যারেজের দিকে যায়নি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, তবে বর্ষাকাল তো এবং সেদিন রাত্রেও বৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই গন্ধের ট্রেলটা মুছে যেতেই পারে।
সে তো পারেই। আমার যেন মনে হচ্ছে আপনি ঘটনাটা সম্পর্কে তেমন নিশ্চিত নন।
আমাকে বলতে পারেন সন্দেহা-পিচাশ।
তাই দেখছি, পুলিশ কি এইরকমই?
না। আমি এইরকম।
তা হলে আপনি ক্রিমিনালদের ধরবেন কী করে?
সবসময়ে যে ক্রিমিনালদের ধরা যায় এমন নয়, অনেক ফাঁকফোকর দিয়ে তারা রেহাই পেয়ে যায়। ওই ফাঁকফোকারগুলোই ভরাট করার চেষ্টা করছি।
আমার তো মনে হচ্ছে, ওটা ওপেন অ্যান্ড শাট কেস।
শবর মৃদু হেসে বলল, হলে তো ভালই হত। এবার একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, একটু ভেবে জবাব দেবেন।
নিশ্চয়ই। আমি তো এতক্ষণ কো-অপারেটই করেছি।
হ্যাঁ। আপনি নার্ভাস হননি।
এবার প্রশ্ন করুন।
ফুলশয্যার রাতে ভজনবাবুর যে পরিচয় আপনি পেয়েছিলেন তা খুবই খারাপ এবং ভয়ংকর।
হ্যাঁ।
কিন্তু তারপরও আপনি আরও সাতদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন।
হ্যাঁ।
আপনি কি ভজনবাবুর ঘরেই রাতে থাকতেন? আই মিন, একসঙ্গে?
পাগল নাকি? আমি ওর ঘরে শুতাম। কিন্তু ও চলে যেত ওর ভাই পুজনের ঘরে। বাড়ির লোকেরাই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
এই সাতদিনের কথা কিছু মনে আছে?
কেন থাকবে না? মাত্র তো দেড়-পৌনে দুই বছরের ঘটনা।
সেই অভিজ্ঞতোটা কীরকম? মানে রিগার্ডিং ভজনবাবু।
ও কিন্তু কখনও আমার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেনি, এমনকী লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতও না।
ওই সাতদিনে আপনার সঙ্গে ভজনবাবুর কথা হত কি?
না। আমার কাছাকাছি আসত না।
আপনি এই সাতদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন কেন? মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে?
না। প্রবলেমটা মানিয়ে নেওয়ার মতো ছিল না। সাতদিন ছিলাম, শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অনুরোধে। ওর ভাই পূজন। আর বোন দেবারতি আমাকে খুবই ভালবাসত। শ্বশুরমশাই অসুস্থ মানুষ, শয্যাশায়ী ছিলেন। কিন্তু শাশুড়ি খারাপ ছিলেন না। খুব ভালমানুষ গোছের।
এই সাতদিনে ভজনবাবুর বিশেষ কোনও গুণ বা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েছে কি?
না।
ভাল করে ভেবে দেখুন। দেয়ার মে বি এ ভাইটাল ফ্যাক্ট।
কিছু মনে পড়ছে না তেমন। তবে
তবে কী? থামলেন কেন?
ও সকালবেলা রোজ পাড়ার কুকুরদের পাউরুটি খাওয়াত।
বাঃ, এই তো একটা কথা জানা গেল। আর কী?
নাঃ, আর কিছু নয়।