স্টারস সাইন ডাউন / নিলাজ নক্ষত্রের আলো
নান্দীমুখ : এ হল এক অসামান্যা সুন্দরী রমণী এবং তার তিন পুরুষ প্রেমিকের রহস্য রোমাঞ্চে ভরা গল্প। মেয়েটির নাম লারা ক্যামেরন। নিন্দুকেরা বলে থাকে, শুধু রূপের মহিমা দিয়ে সে যে কোনো চতুর পুরুষের মন ভোলাতে পারে।
জীবনে চলার পথে তিন তিনজন পুরুষের ঘনিষ্ট সংস্পর্শে সে আসে।
তার প্রথম প্রেমিকের নাম সিন ম্যাক অ্যালিস্টার। এরপর পল মার্টিন, সবশেষে ফিলিপ অ্যাডলার।
তিন পুরুষ স্ব-ক্ষেত্রে সম্রাট হয়ে বিচরণ করেছে এই পৃথিবীর বুকে। এদের নিয়ে ভালোবাসার আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে বেচারী লারাকে।
শেষপর্যন্ত প্রেম কি নিঃশব্দ চরণে এসেছিল তার জীবনে? আরও একজন পুরুষ গোপনে ভাললাবেসেছিল লারাকে। অথচ কি অবাক, মনের এই ভাবনার কথা মুখের ভাষায় প্রকাশ করেনি সে কখনও।
কে সেই চতুর্থ পুরুষ? সে হল হাওয়ার্ড কেলার।
তারপর? তার আর পর নেই–আছে এক মহান থ্রিলার লেখকের অসাধারণ শব্দলহরী। আসুন চোখ বন্ধ করে আমরা এই চক্রবুহে প্রবেশ করি, যেখানে ঢুকলে বেরিয়ে আসার পথ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
.
প্রথম পর্ব। প্রথম অধ্যায়।
১০ই সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৯২, রাত ৮টা।
বোয়িং ৭২৭ হারিয়ে গেছে পুঞ্জপুঞ্জ মেঘের আড়ালে। রূপালী পালক বুঝি ভেসে চলেছে মহাশূন্যের মধ্যে দিয়ে। পাইলটের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল মিস ক্যামেরন, আপনার সিটবেল্ট ঠিকমতো বাঁধা আছে তো?
মিস ক্যামেরন এতক্ষণ স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছিলেন। হঠাৎ সেই স্বপ্নটা তার ভেঙ্গে গেল। তিনি জানতে চাইলেন কি হয়েছে?
মন হারিয়ে গেছে কোথায় কেউ জানে না। এত সুখময় মুহূর্ত বোধহয় এর আগে আসেনি তার জীবনে।
লাউড স্পীকারে কণ্ঠস্বর শোনা গেল মিস ক্যামেরন, আমরা ঝড়ের মুখে পড়েছি, আপনি ঠিক আছেন তো?
আচ্ছন্নের মতো জবাব দিলেন মিস ক্যামেরন–ভয় নেই, আপনাকে অযথা চিন্তা করতে হবে না মিঃ পাইলট, আমি ভালো আছি।
ঝড়? তার মানে? প্লেনটা কি হঠাৎ ভেঙে পড়বে নাকি? ভাবতে কিছু আর ভালো লাগছে না মিস ক্যামেরনের। একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে।
অতীতের বছরগুলো এত দ্রুত কেটে গেছে, মনে হয় চলচ্চিত্রের এক একটি দৃশ্যপট। এমন কিছু ঘটনা যা ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। শেষপর্যন্ত বিরাট ঝুঁকির সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। বিপদের মোকাবিলা করতে হয়েছে একা একা। তারপর?
হঠাৎ ককপিটের দরজাটা খুলে গেল। পাইলট ঢুকে পড়ল কেবিনের মধ্যে। তাকাল লারার মুখের দিকে। আঃ, ভদ্রমহিলা এত সুন্দরী? উজ্জ্বল কালো চুল নেমে গেছে কাঁধের দুপাশে। চোখ দুটিতে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা জ্বলজ্বল করছে। রেনো থেকে প্লেন ছাড়ার আগে ওই ভদ্রমহিলা একবার পোশাক বদলেছিলেন। এখন তার শরীরে সাদা রঙের গাউন, কাঁধের দিকটা উন্মুক্ত, নরম কামনামদির শরীরের বাঁকে বাঁকে প্রলোভনের হাতছানি। গলাতে হীরে আর চুনীর নেকলেস।
বিপদের প্রাক মুহূর্তে উনি এমন শান্ত আছেন কি করে? গত কয়েক মাস ধরে ওকে নানাধরনের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। খবরের কাগজওয়ালারা লারার গভীর গোপন জীবনের দিকে বিষ তীর ছুঁড়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও উনি একইরকম নির্বিকার চিত্তে সব প্রতিকূল অবস্থা সামলে নিয়েছেন।
মিস ক্যামেরন পাইলটকে বললেন–ফোনটা ঠিকঠাক কাজ করছে তো?
-নাহ, মনে হচ্ছে সেটা ঠিক নেই।
মিস ক্যামেরনের মনের মধ্যে আবার অন্য একটা ভাবনার উদয় হল। জন্মদিনের পার্টি কখন শুরু হবে? নিমন্ত্রিত অতিথিরা নিশ্চয়ই সেখানে এসে গেছেন।
প্রচুর গণ্যমান্য অতিথি আসবেন, আসবেন ইউনাইটেড স্টেটসের ভাইস প্রেসিডেন্ট, নিউ ইয়র্কের গভর্ণর এবং মেয়র, হলিউডের বিখ্যাত বাসিন্দারা, অ্যাথলিট এবং গোটা ছয়েক রাষ্ট্রের ধনী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা।
মিস ক্যামেরন প্রত্যেকের নামে চোখ বুলিয়ে তবে অনুমতি দিয়েছেন। মেঘের ভেতর দিয়ে প্লেনটা এগিয়ে চলেছে। ক্যামেরন প্লাজার সেই গ্র্যান্ড বলরুমটা চোখে ভেসে উঠল মিস ক্যামেরনের। আহা, ঝাড়বাতির আলোয় উদ্ভাস চারপাশ। কুড়িটা টেবিলে ২০০ জন অতিথির বসার জায়গা। প্রত্যেকটা টেবিল সুন্দর করে সাজানো। খাওয়া দাওয়ার এলাহি আয়োজন, মিস ক্যামেরনের চল্লিশতম জন্মদিন। ডিনারের প্রতিটি পদ তিনি নিজে হাতে পরীক্ষা করে দেখেছেন।
লা গার্ডিয়াসে যখন প্লেনটা নামলো তখন দেড় ঘন্টা দেরী হয়ে গেছে। এই প্লেনটা লারার একান্ত নিজস্ব। পাইলটের দিকে তাকিয়ে লারা বললেন, রজাক, আজই আমরা রেনোতে ফিরে যাব।
রজাক জবাব দিল–আমি এখানেই থাকবো। লারার একটা দামী লিমুজিন দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার সেটা নিয়ে অপেক্ষা করছে। লারাকে দেখে ড্রাইভার বললো, আপনার জন্য চিন্তায় ছিলাম।
–হ্যাঁ, ঝড়ের মুখে পড়েছিল প্লেনটা। তাড়াতাড়ি চল।
লিমুজিনে স্টার্ট দিল ড্রাইভার। জেরী টাউনসেন্ডের নম্বরে ডায়াল করলেন। এই পার্টির র দায় দায়িত্ব জেরীর ওপর দেওয়া হয়েছে। রিসিভারটা কিছুক্ষণ ধরে রইল লারা। ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। জেরী তাহলে বলরুমে আছে কি?
লারা বললেন তাড়াতাড়ি চল ম্যাক। লিমুজিন দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। হোটেল ক্যামেরন প্লাজার চারদিকের দৃশ্যাবলী লারাকে সবসময় মুগ্ধ করে। মুখমন্ডলে ফুটে ওঠে পরিতৃপ্তির আমেজ। কিন্তু এখন তার মনের ভেতর উদ্বেগের নানা উত্তেজনা। গ্র্যান্ড বলরুমে সবাই বোধহয় এসে গেছেন।
হোটেলের ভেতর ঢুকে প্রকাণ্ড লবি। তারা হাঁটছিলেন, কিছুদূর যেতেই অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার কালোস এগিয়ে এসে বলল ক্যামেরন…
–একটু দেরী হয়ে গেছে।
লারা বুঝি অনুতপ্ত। গ্র্যান্ড বলরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভাবলেন এখনই
সকলের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু এ কী? চারপাশে এমন অন্ধকার কেন? আলো জ্বলে উঠলো লারার নরম আঙুলের ছোঁয়ায়। লারা অবাক হয়ে দেখলেন একজন মানুষ কোথাও নেই। নির্জন বলরুমে তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন পাথরের মূর্তির মতো।
তাহলে? কোথাও কোনো ভুল হয়েছে কি? আমন্ত্রণের কার্ডে রাত ৮টা লেখা ছিল। এখন প্রায় ১০টা বেজেছে। এইটুকু দেরী হয়েছে আর সকলে বাতাসে মিলিয়ে গেছেন? চোখ বন্ধ করলেন লারা, গত বছরের ছবি ভেসে উঠলো। ঠিক এই সময় হাসিতে গানে শুভেচ্ছা বার্তায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল এই বিশাল হলখানি। আর আজ…
.
দ্বিতীয় অধ্যায়
গত বছর আগে থেকেই অনুষ্ঠান সূচী ঠিক করা ছিল, লারা নিজে লিস্ট দেখে অনুমোদন করেছিলেন–কখন কি হবে সবকিছু।
ভোর থেকে লারা ট্রেনারের অপেক্ষাতে তৈরি ছিলেন। ট্রেনারের আসতে একটু দেরী হয়েছিল। তারা বললেন তুমি রেডি করেছ?
–দুঃখিত মিস ক্যামেরন, আমার ঘড়িটা…।
–ঠিক আছে, আজকের দিনটা আমি খুবই ব্যস্ত।
ট্রেনার কেন-এর সাহচর্যে লারার ট্রেনিং শুরু হল। ট্রেনার ওর দেহের গঠনশৈলী দেখে খুবই মুগ্ধ। লারাকে দেখে মনে হয় না এতগুলো বসন্ত তিনি অতিক্রম করেছেন। কেন লারাকে শুধু যে শরীরের দিক থেকে ভালোবাসে তা নয়। লারার প্রচণ্ড আকর্ষণ সে এড়াতে পারে না। আজ লারার জন্মদিন, কিছুক্ষণ বাদে ট্রেনিং শেষ হল, বলল–আমি আপনার প্রোগ্রাম দেখতে যাচ্ছি।
লারা জানতে চাইলেন কীসের প্রোগ্রাম?
–কেন মর্নিং আমেরিকা!
–ওঃ একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।
লারা তখন জাপানী ব্যাঙ্কারের সঙ্গে আলোচনার বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলেন।
কেন বলল–এখন চলি কেমন?
লারা ব্রেকফাস্ট সেরে নিলেন। স্টাডি রুমে এলেন। সেক্রেটারীকে ফোন করলেন আমি অফিস থেকে ওভারসীজ কল করতে চাই–একটু পরে বললেন ৭টার সময় এবি তে থাকবো। ম্যাক্স যেন গাড়ি গিয়ে আসে।
মর্নিং আমেরিকার বিভিন্ন অংশ ভালোভাবেই শেষ হয়েছিল। ইন্টারভিউ নিয়েছিল জোহান লান্ডেড। লারা ক্যামেরসর আকাচুম্বী অট্টালিকা কত বছরের মধ্যে শেষে হয়ে যাবে লারা সেটা জানিয়েছিলেন। এমনকি কিভাবে তিনি তার তনুবাহারকে এত সুন্দর ঝকঝকে রেখেছেন, সেই গোপন খবরটাও বলে দিয়েছিলেন।
রিয়েল এস্টেটের ডেভলেপার হিসাবে লারা অসাধারণ সাফল্য পেয়েছেন। এ বিষয়ে তাকে কিছু বলতে হল। তারপর জাপানী ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছিল। শেষপর্যন্ত লারা সিক্সথ এ্যাভিনিউতে ক্যামেরন সেন্টারে পৌঁছে গেলেন। এখানে একটা হোটেল কমপ্লেক্স তৈরি হতে চলেছে, জাপানী বিয়োগকারীরা ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে রাজী হয়েছেন।
লারা এলেন জেরী টাউনসেন্ড-এর সঙ্গে কথা বলার জন্য। জেরী ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজের জনসংযোগ অফিসার। লম্বা ছিমছাম চেহারা, একসময় হলিউডের ফিল্ম দুনিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন।
জেরী লারাকে অভ্যর্থনা জানাল। মর্নিং আমেরিকার ইন্টারভিউটা খুবই ইন্টারেস্টিং হয়েছে বলল।
ক্যামেরন টাওয়ার্সের ব্যাপারে বেশি মনোযোগ দিতে বললেন লারা। প্রতিটি সংবাদপত্র এবং সাময়িক পত্রিকাতে এ বিষয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। কারণ এটি হতে চলেছে পৃথিবীতে সব থেকে উঁচু বাড়ি। লারা চাইছেন জনসাধারণ এই ব্যাপারে তাদের মতামৃত পেশ করুক। তিনি সবকিছু ভোলাখুলিভাবে বলবেন। তিনি চাইছেন জনগণ যেন অ্যাপার্টমেন্টটা শপের জন্য আবেদন করে।
ইতিমধ্যে একজিকিউটিভ অ্যাসিন্ট্যান্ট ক্যাথি এসে হাজির হল। বয়স ত্রিশের কম। কালো চামড়ার সঙ্গে শারীরিক সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ক্যাথিকে নিয়ে লারা ক্যামেরন রিপোর্টারের সঙ্গে আলোচনায় বসে গেলেন। কথা এগিয়ে চলল। একটির পর একটি ঘটনা কেমনভাবে ঘটে চলবে, লারা চোখ বন্ধ করে তা দেখতে চাইলেন। রোমিং কমিশনের লোকজনদের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে, মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় আছে বিকেল ৫টাতে, তারপর? তারপর লারার জন্মদিনের অনুষ্ঠান। লারা বুঝতে পারলেন তার ওপর খুবই চাপ পড়বে।
লারা ক্যামেরনের অনুমতি নিয়ে ক্যাথি বেরিয়ে এল। লারার সঙ্গে তার একটা সুন্দর সম্পর্ক। যখন সে প্রথম ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজে চাকরি করতে এসেছিল তখন অনেকেই তাকে সাবধান করে দিয়েছিল। তারা বলেছিল লারা বুদ্ধিমতী ভয়ংকরী। ও যে কোনো মানুষকে জীবিত অবস্থায় চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এখানে এসে লারার সংস্পর্শে কেমন যেন পাল্টে গেছে ক্যাথি। লারা তার কাছে ভালোবাসার প্রতীক ছাড়া আর কিছুই। নয়।
লারা ক্যামেরনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারটা বেশ মনে পড়ে ক্যাথির, গোটা দুয়েক ম্যাগাজিনে লারা ক্যামেরনের ছবি সে দেখেছিল। ভদ্রমহিলা যে আসাধারণ সুন্দরী সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। লারা বলেছিলেন–বোসো, তুমি এখনও কিন্তু কিন্তু করছো কেন? তুমি কি জানো তোমার কি করতে হবে? আমার আরও অনেক সেক্রেটারী আছে, তাদের মধ্যে দুজন সম্প্রতি ছেড়ে দিয়েছে, তাই তোমার ওপর একটু বেশি কাজের চাপ পড়বে। তুমি পারবে তো?
ক্যাথি জবাব দিয়েছিল–হ্যাঁ, আমি পারবো।
লারা বলেছিলেন–এবার মনে হয় আর কোনো প্রশ্ন নেই, তুমি কাল থেকেই জয়েন্ট করতে পারো। তবে তোমাকে এক সপ্তাহ ট্রায়ালে রাখা হবে। আর তোমাকে একটা ফর্মে। সই করতে হবে, আমার সঙ্গে পরামর্শ করে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। বই পড়া বা অন্য কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হলেও আমার পারমিশন নিতে হবে। আশা করি তুমি বুঝতে পারছো?
–বুঝেছি, ক্যাথি জবাব দিয়েছিলেন।
–ঠিক আছে, লারা নিষ্ঠুর ভাবে বলেছিলেন। ক্যাথি বেরিয়ে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। সেটা পাঁচ বছর আগের ঘটনা। এরপর থেকে লারার সঙ্গে ক্যাথির সম্পর্কটা একটা অদ্ভুত কুহক মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। পাঁচ বছরের মধ্যে ক্যাথি লারার অসম্ভব অনুগত হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে স্বামীকে সে লারার কথা বলে। তারা দেখতে অসম্ভব সুন্দরী, যেকোনো মানুষের থেকে বেশি পরিশ্রম করতে পারেন। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন লারা ক্যামেরন কখন ঘুমোত যান।
অনেক কাজ বাকি আছে ক্যাথির, কয়েকটা ওভরসীজ কল আর ফ্যাক্স বাকি ছিল। সেগুলো শেষ হল, এবার লারা ইন্টারকমে চার্লি হান্টারকে ডাকলেন।
চার্লির বয়স কম। উচ্চাকাঙ্খী যুবক, এ্যাকাউন্টসের কাজে আছে। সে এসে বলল, কিছু বলছেন মিস ক্যামেরন?
–নিউইয়র্ক টাইমসে তুমি যে ইন্টারভিউ দিয়েছে সেটা আমি পড়েছি, লারা বললেন। চার্লির চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
–আমি এখনও দেখিনি কেমন হয়েছে?
–তুমি ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজের কিছু সমস্যা সম্পর্কে বলেছে?
এই কথা শুনে চার্লির চোখ কুঁচকে গেল। সে বলল, আপনি তো জানেন ম্যাডাম, সাংবাদিকরা ইচ্ছে করে কতো কিছু লেখে।
–তুমি উত্তেজিত হয়েছে?
–আমি! চার্লি তোতলাতে থাকে।
লারা নির্বিকার ভঙ্গীতে বলে উঠলেন–তোমাকে আমি একটা শর্তাবলীর কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিলাম, আশাকরি তুমি তা ভুলে যাওনি, অনেকগুলি শর্তের মধ্যে একটি লেখা ছিল তা হল তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে কাউকে সাক্ষাৎকার দিতে পারবে না।
চার্লি দাঁড়িয়ে রইল। লারা বললেন–আমি আশা করব তুমি সকালবেলা এখান থেকে চলে যাবে।
–আমি…আমার জায়গায় কে আসবে?
লারা বললেন–আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
চার্লি হান্টার লারাকে একবার দেখলো, নিঃশব্দে মাথা নিচু করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। |||||||||| —
লাঞ্চও প্রায় শেষ হবার মুখে। ফরচুন পত্রিকার রিপোর্টার হিউজ থমসন চারদিকে তাকাচ্ছিল। বাদামী চোখ জোড়ার ওপরে শৌখিন চশমা। একটু থেমে সে বলল, দারুন লাঞ্চ, সব ডিশগুলিই আমার প্রিয়, ধন্যবাদ।
লারা বললেন–আমার দেওয়া লাঞ্চ আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমি খুবই আনন্দিত।
–আপনি আমার জন্য এত কষ্ট করলেন কেন?
লারা হেসে জবাব দিলেন–এতে তো আমার কোনো সমস্যা হয়নি। তারপর আরো বললেন–আমার বাবা বলতেন কোনো মানুষের পাকস্থলীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে আমরা অত্যন্ত সহজ উপায়ে তার হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাব।
হিউজ থমসন এবার হাসল। বলল–ম্যাডাম তাহলে ইন্টারভিউ-এর আগেই আপনি আমায় হৃদয় পেতে চান।
লারা বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন।
–আপনার কোম্পানীর আসল সমস্যা ঠিক কতখানি?
এই কথা শুনে লারার মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। তারা বললেন, আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মিঃ ইন্টারভিউয়ার।
হিউজ থমসম বলল–আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন, ব্যাপারটা আর গোপন রাখতে পারবেন না। অনেকেই জানে আপনার সম্পত্তি এখন চলে যাবার মুখে। বাজারে অনেক দেনা হয়েছে, মার্কেটের অবস্থা এই মুহূর্তে ভালো নয়। ক্যামেরন এন্টারপ্রাইজের ভবিষ্যৎ ঘন অন্ধকারে ছাওয়া–একথা কি অস্বীকার করা যায়?
হিউজের এই কথা শুনে লারা হেসে উঠলেন। তিনি বললেন–এ সমস্ত কথা তাহলে এখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে? মিঃ থমসন, আমি ভেবেছিলাম আপনি বুদ্ধিমান। এসব গুজবে বিশ্বাস করছেন কেন? আমি আপনাকে সব বলব। আমার ফিনান্সিয়াল সব রেকর্ডও। আপনাকে দেখাবো।
–আচ্ছা মিস ক্যামেরন, নতুন হোটেলটা উদ্বোধনের সময় আপনার স্বামীকে কোথাও দেখলাম না কেন?
লারা এবার যেন লজ্জায় পড়লেন। বললেন, ফিলিপের থাকার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ওকে কনট্রাক্ট ট্যুরে যেতে হল তাই।
–আচ্ছা আমি বছর তিনেক আগে একবার পোগাম দেখেছিলাম, দিব্যি চমৎকার লেগেছিল। ওঁর মধ্যে অনেক প্রতিভা লুকোনো আছে। আচ্ছা লারা, একবছর আগে আপনি ওকে বিয়ে করেছেন তাই তো?
লারা বললেন–হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, আমার জীবনের সবথেকে আনন্দের সেই মুহূর্তটি। আমি খুবই সৌভাগ্যবতী, বিভিন্ন জায়গাতে আমাকে যেতে হয়, ফিলিপকেও যেতে হয়। কিন্তু যখন আমরা দুজন একসঙ্গে থাকি না তখন আমি ওর রেকর্ডিং শুনি। আমি যেখানেই যাই না কেন, ওর রেকর্ড আমার সঙ্গে থাকে।
থমসন হেসে উঠল। বলল, ঠিক বলেছেন ক্যামেরন, উনিও যখন যেখানে থাকেন তখন আপনার তৈরি করা বিল্ডিংগুলো ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাই তো?
হিউজের কথায় লারা হেসে উঠলেন। বললেন–এবার আপনি আমার প্রশংসা করতে শুরু করেছেন কিন্তু।
–তা কেন? বিভিন্ন জায়গাতে আপনার হাতে তৈরী বিল্ডিং আছে। অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস, হোটেল আরও কত কি। আপনি কেমন করে সব বিল্ডিংগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
লারা জবাব দিলেন–আয়নার মাধ্যমে।
–আপনি কিছুটা বিহ্বল হয়ে গেছেন।
–তাই নাকি?
–এই মুহূর্তে নিউইয়র্কে আপনি সবথেকে সফলতম এস্টেট বিল্ডার। এই শহরে অর্ধেক রিয়েল এস্টেটে আপনার নাম খোদাই করা আছে। পৃথিবীর সব থেকে উঁচু স্কাইক্যাপারটা আপনারই তৈরি। আপনার প্রতিযোগীরা আপনার কি নামকরণ করেছেন তা জানেন কী?
লারার মুখের দিকে তাকিয়ে হিউজ বলল–লোহার প্রজাপতি। পুরুষরা যে পথে পা দিতে তিনবার চিন্তা করেন, নারী হয়ে আপনি অনায়াসে সেই পথে হাঁটেন কি করে?
–এটাই কি আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে মিঃ থমসন?
–মোটেই না, মিস ক্যামেরন, লোককে সম্পূর্ণ বুঝে ওঠার আগে পর্যন্ত আমি অস্বস্তিতে : থাকি না। আমি জানি আপনি একজন সুদক্ষ এবং বুদ্ধিমতী ব্যবসায়ী। আপনাকে এখনও পর্যন্ত তেমন সংকটে পড়তে হয়নি। এ লাইনে যারা আছেন তারা অন্ধকার জগতের লোক। আপনি কিভাবে তাদের কাজে লাগাচ্ছেন?
মিস ক্যামেরন বললেন–সিরিয়াসলি বলছি, আমার এই কাজের জন্য যাকে যোগ্যতম বলে মনে করি তাকেই নিয়ে নিই। তাছাড়া আমি খুব ভালো বেতনও দিয়ে থাকি।
থমসন মনে মনে ভাবল, এত কঠিন বিষয়টাকে মিস ক্যামেরন কত সহজ করে নিলেন। আসল কথা তিনি বোধহয় বলতে চাইছেন না। থমসন এবার প্রসঙ্গ পাল্টাবে। সে বলল, আমি যতগুলো ম্যাগাজিন দেখেছি, প্রত্যেকটিতে আপনার সাফল্য বড়ো বড়ো করে লেখা হয়েছে। কিন্তু আমি জানি এর আড়ালে কিছু অন্ধকার দিক আছে। দোহাই লারা, আপনি কি আপনার ফেলে আসা দিনযাপনের সহজ সরল স্বীকারোক্তি আমার সামনে রাখবেন? আপনার ব্যক্তিগত কাহিনী আমি শুনতে চাই, আপনার অতীত সম্পর্কে বিশেষ লেখা কোথাও হয়নি।
লারা বললেন–আমার অতীত নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।
–তা ভালো! আমাকে সেই ব্যাপার কিছু বলুন। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাতে আপনি কি করে এলেন?
লারার হাসিটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়লো। বাচ্চা মেয়ের মতো দেখাচ্ছিল তাকে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন আপনার জিন? লারা জিন তুলে দিলেন হিউজের হাতে।
তারপর পিছনের একটা ছবির দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। দেওয়ালে টাঙানো আছে ওয়েলপেন্টিংটা। সুন্দর দেখতে এক পুরুষের ছবি। মাথার চুলটা রূপালী, চোখ মুখে প্রত্যয়ের ছাপ। লারা বললেন–উনি হচ্ছেন আমার বাবা জেমস হিউজ ক্যামেরন। আমার সাফল্যের জন্য তিনি সব থেকে বেশি দায়ী। আমি তার একমাত্র সন্তান। আমার যখন খুবই কম বয়স অর্থাৎ আমি চোদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী তখন আমার মায়ের মৃত্যু হয়। বাবা যদি তখন মায়ের স্নেহ দিয়ে আমাকে বড়ো করে না তুলতেন তাহলে আমি আজ এই চেয়ারটায় বসতে পারতাম না। আমার পুরো পরিবারের লোকজন অনেক আগেই স্কটল্যান্ড থেকে চলে এসেছিলেন। আমার বাবা উদ্বাস্তু হিসাবে এসেছিলেন নিউ স্কটল্যান্ডের নোভাসকটিয়া অঞ্চল থেকে। জায়গাটির নাম গ্রেস বে।
হিউজ থমসন জিজ্ঞাসা করলেন। |||||||||| -গ্রেস বে?
লারা বললেন, কেপ্টরেটর্নের উত্তর-পূর্বদিকের একটা গ্রাম। সেখানে মূলতঃ জেলেরা বসবাস করে। আটলান্টিকের উপকূলে। জায়গাটার নাম ফরাসী আবিষ্কারকের দেওয়া। এর অর্থ হল আইস বে। আপনি কি একটু কফি খাবেন?
–না ধন্যবাদ। সংক্ষেপে জবাব দিল হিউজ।
–আমার দাদু স্কটল্যান্ডে অনেকটা জমি কিনেছিলেন। আমার বাবা সেটাকে আরও বাড়িয়েছেন, তিনি ছিলেন বেশ ধনী। নামদ্রি বলে একটা জায়গা আছে সেখানে আমার বাবা একটা ক্যাসেল তৈরি করেছিলেন। আমি যখন মাত্র আট বছরের বালিকা তখন আমার একটা নিজের ঘোড়া ছিল। আমার পোশাক-আশাক আসতো লন্ডন থেকে। বিরাট বড়ো অট্টালিকাতে আমি থাকতাম। অসংখ্য চাকর বাকর ছিল আমার সেবাযত্ন করার জন্য। যে কোনো একজন বালিকার পক্ষে এই জীবনযাপন বোধহয় রূপকথার গল্প।
লারা ক্যামেরনকে দেখে মনে হল যে তিনি সত্যি সত্যি অতীতে ডুব দিয়েছেন। চোখ দুটোতে কেমন একটা আচ্ছন্ন ভাব জেগেছে। ধীরে ধীরে লারা বলতে লাগলেন শীতকালে আমরা আইস্কেটিং করতে যেতাম। আইস হকি দেখতাম, গ্রীষ্মে গ্রেস বে-তে গিয়ে সাঁতার কাটতাম সবাই মিলে। প্রত্যেক শনিবার সন্ধ্যেবেলায় নাচের আসর বসতো।
লারা বলে যাচ্ছেন, মিঃ থমসন নোট নিচ্ছেন। লারা বলতে লাগলেন–এডমন্টেরোতে আমার বাবা একটা বাড়ি করেছিলেন। ক্যালগ্যোরি এবং ওনটারিতেও বাড়ি তৈরি হয়েছিল। বাবার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ছিল। পরে এই ব্যবসাতে তিনি খুব একটা মনযোগ দিতেন না। তার কাছে এই ব্যবসাটা ছিল জুয়া খেলার মতো। শেষপর্যন্ত উনি এই ব্যবসাটাকে ভালোবেসেছিলেন। আমি যখন একটু বড় হলাম, তখন উনি আমার মাথার ভেতরে ব্যবসার পোকা ঢুকিয়ে দেন। ধীরে ধীরে আমি এই ব্যবসাটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি, এখন আমার অতীত ভবিষ্যত সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই ব্যবসাটি।
লারার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে। লারা বললেন–আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন মিঃ থমসন, আমি মানুষের মাথার ওপর ছাদের আড়াল দিতে চাইছি। বিভিন্ন জায়গাতে আমি তাই করছি। সকলে যাতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে এবং নিশ্চিন্তে কাজকর্ম করতে পারে সেটা করাই আমার এই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই ব্যাপারটা আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি বলে মনে হয়।
হিউজ বলল–আচ্ছা মিস ক্যামেরন, আপনার সব থেকে প্রথম রিয়েল এস্টেটটা কোথায় তা আপনার মনে আছে কি?
লারা বললেন–নিশ্চয়ই, সেটা ছিল আঠারোতম জন্মদিন। আমার বাবা জিজ্ঞাসা করেছিলেন কি ধরনের উপহার আমার পছন্দ। তখন গ্রেস বে-তে অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটেছিল। পুরো জায়গা জুড়ে ক্রমশ ভীড় বাড়ছিল। আমার মনে হয়েছিল সকলের জন্য আরামপ্রদ ছোট একটা বাসস্থান চাই। আমি বাবাকে বলেছিলাম উপহার হিসাবে আমি একটা ছোটো অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি করতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করেছিলেন। সবটাই জন্মদিনের উপহার হিসাবে। দুবছর বাদে আমি আমার বাবাকে পুরো টাকাটা ফেরত দিতে সমর্থ হয়েছিলাম।
একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন লারা ক্যামেরন। এরপর বললেন–এবার আমি দ্বিতীয় বিল্ডিং তৈরিতে হাত দিলাম। ব্যাঙ্ক থেকে অর্থ ধার করেছি। যখন আমার বয়স একুশ তখন আমি তিন তিনটে বিল্ডিং তৈরি করে ফেলেছি। প্রত্যেকটা বিল্ডিং থেকে বহু লাভ হয়েছে।
–হুঁ, থমসন বলল, আপনার বাবা নিশ্চয়ই এর জন্য গর্ববোধ করেছিলেন।
লারা হেসে উঠলেন, নিশ্চয়ই, উনি আমার নাম রেখেছিলেন লারা, এটা একটা পুরনো স্কটিশ শব্দ। এর উৎস ল্যাটিন শব্দ, এর অর্থ হল বিখ্যাত, আমি যখন কিশোরী তখন আমার বাবা ভবিষ্যৎবাণী করে বলতেন–আমি একদিন খুব বিখ্যাত হব।
হঠাৎ থেমে গেলেন লারা ক্যামেরন। মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে উঠল। তিনি বললেন এরপর আমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হল। অত্যন্ত কম বয়েসে ওর মৃত্যু হয়। প্রত্যেক বছর স্কটল্যান্ডে ওর সমাধিস্থলে যাই। বাবাকে ছাড়া ওখানে থাকাটা কোনমতেই সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি চিকাগোতে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়েকটা বুটিক হোটেল খুলবো এমন একটা ইচ্ছা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। একজনকে পাকড়াও করলাম, প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় হয়ে গেল, সফল হলাম ওই ব্যবসায়।
এবার থেমে গেলেন লারা। হিউজের মুখের দিকে তাকালেন। লারা বলতে লাগলেন–আমি আমার একার জন্য এতকিছু করেছি। যত জন পুরুষকে এযাবৎ দেখেছি তার মধ্যে জেমস ক্যামেরন অর্থাৎ আমার বাবা ছিলেন খুবই আশ্চর্যজনক ব্যক্তি। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আমি এই কাজটা করেছি।
–আপনি নিশ্চয়ই আপনার বাবাকে খুবই ভালোবাসতেন?
–হ্যাঁ, তিনিও আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
লারা মৃদু হাসলেন, বললেন–আমি যেদিন জন্মেছিলাম আমার বাবা গ্রেস বের। প্রত্যেকটি মানুষকে পানভোজনের নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
হিউজের গলায় তখন বিনয়ের সুর-গ্রেস বে-তে সবকিছু আরম্ভ হয়েছে?
–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, লারা মৃদু স্বরে বললেন, গ্রেস বে-তে সবকিছু আরম্ভ হয়েছে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে।
.
তৃতীয় অধ্যায়
গ্রেস বে, নোভাসকটিয়া।
১০ সেপ্টেম্বর ১৯৫২।
একটা গণিকালয়ে বসে জেমস ক্যামেরন মদ খাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়, অর্থাৎ সেই রাতে তার স্ত্রীর গর্ভে একটি পুত্র এবং একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
জেমস আরাম করছিলেন, মুখের ভেতর স্যান্ডুউইচের টুকরো। তখনই ওই লাল আলোর ম্যাডাম ক্রিস্টি দরজার কাছে এসে সুরেলা গলায় ডাকলেন-জেমস ভেতরে আসবো?
ক্রিস্টি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ঠিক তখনই জেমস খেঁকিয়ে উঠলেন–কোথাও কি একটুও গোপনীয়তা রাখা যাবে না?
–তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত জেমস। আসলে তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে এসেছি।
গর্জন করে উঠলেন জেমস ক্যামেরন–আঃ, আমাকে বিরক্ত কোরো না।
জেমস ক্যামেরনের কথা শেষ হল না, ক্রিস্টি হাসি মুখে বলল–তোমার স্ত্রী তোমার সন্তানের মা হয়েছে।
–তাতে আর নতুন খবর কি? এর জন্য আমার মুডটা নষ্ট কোরো না তো। ক্রিস্টি বলল–আমি এসেছি অন্য কারণে।
–কারণটা কি?
–ডাক্তার তোমাকে ডেকেছে, তোমার স্ত্রীর শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তুমি এখন একবার যাও।
এই কথা শুনে জেমস ক্যামেরনের আচরণের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিল। চোখ দুটো হঠাৎ ঘোলাটে হয়ে উঠলো। তিনি বললেন–আঃ, আমাকে এতটুকু শান্তিতে থাকতে দেবে না।
ক্রিস্টির দিকে তাকালেন জেমস। বললেন, ঠিক আছে যাব।
পাশেই শুয়েছিল তার নগ্ন সঙ্গিনী। জেমস তার দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি কিন্তু এক পয়সা খরচা করবো না।
–ঠিক আছে, এখন তুমি এসো।
ক্রিস্টি তাকালো সেই মেয়েটির দিকে। বলল–তুই আমার সঙ্গে চল।
জেমস ক্যামেরন উঠে বসলেন। মেয়েটি পোশাক পরে চলে গেল তার মায়ের সঙ্গে। এবার জেমসকে বোধহয় যেতে হবে।
জেমস ক্যামেরনকে দেখতে খুবই সুন্দর, প্রকৃত বয়স থেকে তাকে একটু বেশি দেখায়। তখন তার বয়স ত্রিশ বছর, একটা বোর্ডিং হাউসের ম্যানেজার। হাউসের মালিকের নাম সিন ম্যাক অ্যালিস্টার। তিনি একজন ব্যাঙ্কার।
গ্রেস বে-তে তিনি একজন ধনী ব্যক্তি। জেমসের ওপর অনেক কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন। এত কাজ করতে করতে জেমস মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েছেন।
জেমসের ব্যবহার মোটেই ভালো নয়। মাঝেমধ্যে খিটখিটে মেজাজটা প্রকাশিত হয়। ব্যর্থতাকেও যে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যেতে পারে, জেমস সেই মন্ত্র সযত্নে শিখেছেন।
নিজেকে শহীদের পর্যায় ফেললেন। যখন পুরো পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল স্কটল্যান্ডের গ্রেস কেতে, তখন কিছুই ছিল না। শুরু হয়েছিল অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। চোদ্দ বছর বয়সে জেমসকে একটা খনির কাজে লেগে পড়তে হয়েছিল। ষোলো বছর বয়সে সেখানে কাজ করতে করতে ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন জেমস। এরপর ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মা বাবা দুজনের মৃত্যু হয়। তখন থেকেই জেমস একা একা মানুষ হতে থাকেন। ভাগ্যের প্রতিকূলতার জন্যই হয়তো তার ওই অবস্থা, সবকিছু তখন বিপক্ষে চলে গেছে। কিন্তু ক্যামেরনের দুটি মূল্যবান সম্পদ ছিল। প্রথমত চমৎকার আকর্ষণীয় চেহারা, দ্বিতীয়ত নিজের আকর্ষণী শক্তি।
এই সময়ে সিডনিতে এক সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে তার দেখা হয়। মেয়েটি মার্কিন দেশের, নাম পেগি ম্যাক্সওয়েল। পরিচয় থেকে হলো প্রণয়। তারপর একদিন জেমস ভাবী শ্বশুরের বিরোধিতা সত্ত্বেও পেগিকে বিয়ে করলেন। পেগির বাবা পাঁচ হাজার ডলার যৌতুক দিয়েছিলেন। বলেছিলেন রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাতে নামতে। পরামর্শ দিয়েছিলেন–পাঁচ বছরের টাকাটা দ্বিগুণ হবে।
জেমস কিন্তু পাঁচবছর অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন না। তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপ ব্যবসায় নেমে পড়লেন। একধরনের তেলের ব্যবসা। মাস দুয়েক বাদে, সব অর্থ ডুবে গেল। শ্বশুর মশাই এই খবর শুনে খুবই ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন ভবিষ্যতে আর এক কানাকড়িও জামাইকে দেবেন না। এর ফলে জেমসের ভাগ্য আরও খারাপ হল। কিন্তু এই দুঃখ যন্ত্রণার দিনেও স্ত্রী পেগি সবসময় স্বামীকে সাহায্য করে গেছে।
এই সময় জেমসের সঙ্গে হঠাৎ সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের দেখা হয়ে যায়। তার হাতে হাত রেখে জেমস উঠে আসেন অন্ধকার গর্ত থেকে। বছর পঞ্চাশের মতো বয়স সিন ম্যাকের। থলথলে চেহারা, সর্বত্র শিথিলতার ছাপ। তিনিও ভাগ্যান্বেষণে এখানে এসেছিলেন। শহরের বিভিন্ন জায়গাতে হোটেল আর বোর্ডিং হাউস খুলেছেন। এইসব বাপারগুলো দেখাশোনার ভার দিলেন জেমস ক্যামেরনকে। জেমস ম্যানেজারি করতে শুরু করলেন। এই কাজে অসম্ভব দক্ষ ছিলেন তিনি।
কয়েক বছরের মধ্যে আরও ভালো কাজের সুযোগ এল জেমসের কাছে। জেমস কিন্তু । মালিকের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন না। এই ব্যর্থতার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চাইলেন। তিনি অদ্ভুত একটা মতবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি ব্যবসা বা চাকরির পরিবর্তনের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করতেন না। তারপর? তারপর জেমসের জীবনে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। পেগির ওপর আর আশা নেই জেমসের। তিরিক্ষি মেজাজে একদিন জেমস হাজির হয়েছিলেন নিউ অ্যাবরডিন-এর বোর্ডিং হাউসে। গ্রেস বের সবথেকে গরীব মানুষেরা ঘেঁষাঘেঁষি করে এখানে বসবাস করে।
একজন বলেছিল–আপনি শীগগিরি স্ত্রীর একটা ব্যবস্থা করুন। ডাক্তার আনা হয়েছে।
জেমস দ্রুত ওপরে উঠতে লাগলেন। যখন গিয়ে হাজির হলেন দেখলেন স্ত্রী দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে। বিছানার ওপর তার ফ্যাকাসে শরীরটা পড়ে আছে।
ডাক্তার ডানকান বিরক্ত হয়ে বললেন–এতক্ষণে নবাবের আসার সময় হল। বাঁচাতে পারলাম না তোমার স্ত্রীকে। তোমার যমজ সন্তানের মধ্যে ছেলেটা বাঁচলো না। সৌভাগ্যের কথা মেয়েটা ভালো আছে।
জেমস অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন–আঃ, আবার সেই ভাগ্য!
ইতিমধ্যে তোয়ালে জড়ানো একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে নার্স ঘরে ঢুকল। জেমসের। কাছে গিয়ে বলল–মিঃ ক্যামেরন, এই দেখুন আপনার মেয়ে।
নরপিশাচ আমার মেয়ে, মেয়ের সম্পর্কে বাবার এটাই ছিল প্রথম মন্তব্য। কয়েক মুহূর্ত বাদে জেমস মেয়ের দিকে তাকালেন। একেবারে নিস্পৃহ দৃষ্টি। মনের ভেতর ক্ষীণ আশা ছিল, এই মেয়েটা হয়ত আগামীকাল মরে যাবে। মরে যাওয়াটাই মঙ্গল।
তিনটি সপ্তাহ ছোট্ট মেয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছিল। শেষপর্যন্ত ডাক্তার ডানকান আশ্বাস দিলেন, তোমার মেয়েটা বেঁচে গেল বোধহয়।
জেমস মনে মনে এমনটি চাইছিলেন না, কিন্তু তাই হল। নির্বিকারভাবে তিনি বললেন আপনি কি ঠিক বলছেন?
নার্সের দেওয়া নামানুসারে জেমস ক্যামেরন মেয়ের নাম রাখলেন লারা ক্যামেরন।
ছোট্ট মেয়েটার প্রতি কিছুমাত্র যত্ন ছিল না বাবার। দেখাশোনার জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। শেষপর্যন্ত অবশ্য একটা সুরাহা হল। পেগির মৃত্যুর পর বার্থা বলে একজন মহিলাকে আনা হয়েছিল, সে রান্না বান্না এবং অমান্য কাজকর্ম করতো। লারার দেখাশোনার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হল।
মেয়েটার প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা ছিল না জেমসের। হতাশা ভুলতে মাঝেমধ্যে তিনি মদে আসক্ত হতেন। হুইস্কি গলায় ঢালার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে চিৎকার করতেন। অশ্লীল গালিগালাজ করতেন। জীবিত কন্যাকে অভিশাপ দিতেন, জেমসের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল, তা হল স্ত্রী আর পুত্রের মৃত্যুর জন্য ওই ছোট্ট মেয়েটাই দায়ী।
ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে লারা বড়ো হতে লাগল। গ্রেস বে-তে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মানুষ যাতায়াত করত, আসতো ফ্রান্স, চীন, ইতালী প্রভৃতি দেশের মানুষেরা। এদের মধ্যে নানা পেশার লোকজন ছিল। তাদের সকলেরই একটা লক্ষ্য, যে করেই হোক অনেক টাকা কামাতে হবে।
এখানকার প্রকৃতি অদ্ভুত ধরনের। শীতের সময় প্রচুর বরফ পড়তো। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত একটানা ঠান্ডা পড়তো, আবার শুরু হয়ে যেত বৃষ্টি। শহরে ১৮ টার মতো বোর্ডিং হাউস আছে। কোনোটাতে ৭২ জনের মতো থাকতো। জেমস যে বোর্ডিং হাউসের ম্যানেজার ছিলেন। সেটাতে ৪০ জনের মতো বোর্ডারের বাস। এদের বেশির ভাগ এসেছে স্কটল্যান্ড থেকে।
লারা যতই বড়ো হচ্ছিল তার খিদে ততই বাড়ছিল। কিন্তু এই খিদেটা যে কীসের লারা বুঝতে পারছিল না। খেলবার মতো খেলনা তার ছিল না, পৃথিবীতে আপনজন বলতে একমাত্র বাবা। লারা বাবাকে ভীষণভাবে কাছে পেতে চাইতো। কিন্তু জেমস এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাতেন না।
পাঁচ বছর বয়সে লারা জানতে পারলো তার একটা ভাই মারা গেছে। এই ভাইয়ের ওপর বাবার খুব আশা ছিল। এই মতবাদ লারাকে বিষণ্ণ করে দেয়। সেই রাতে ঘুমোতে যাবার আগে লারা খুব কেঁদেছিল, কান্নার পরে বাবার প্রতি ওর একটা অদ্ভুত ঘৃণা আসে।
লারা ছবছরে পা দিল। তখন তার মুখখানি সর্বদাই বিষণ্ণ, শরীরে শীর্ণতার ছাপ। এই সময়ে বোর্ডিং-এ একজন নতুন বোর্ডার এল। তার নাম মাংগো ম্যাককুইন। মাংগো একটা অদ্ভুত ধরনের আকর্ষণ বোধ করল লারার প্রতি।
শেষপর্যন্ত মাংগোর উৎসাহে লারাকে স্কুলে ভর্তি করা হল। শুরু হল লারার নতুন জীবন। জেমসের একটাই সান্ত্বনা ছিল, কিছুক্ষণের জন্য লারা চোখের বাইরে থাকবে।
সেন্ট অ্যান স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস আমিন ছিলেন ভারিক্কি চালের মহিলা। বয়স খুব একটা বেশি নয়, বিধবা এবং তিনটি সন্তানের জননী। লারাকে স্নেহবশত অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। লারা স্কুলে থাকতে চাইতো না, কিন্তু কান্নাকাটি করেনি। ধীরে ধীরে স্কুল জীবনের সাথে নিজেকে জমিয়ে নিল সে।
অক্ষর দিয়ে শব্দ খেলার ক্লাসে লারা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলো। একদিন শিক্ষিকা এফ দিয়ে একটি শব্দ বানাতে বলেছিলেন।
দুটি মেয়ে এই কাজে ব্যর্থ হয়, লারা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়–ফাক।
অবাক হয়ে শিক্ষিকা লারার দিকে তাকিয়েছিলেন। ক্লাসে বোম পড়লেও বোধহয় তিনি এতটা অবাক হতেন না। যত ছাত্রী ক্লাসে ছিল, তাদের মধ্যে লারার বয়স হয়তো সবার থেকে কম, কিন্তু ইতিমধ্যেই সে যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে উঠেছে।
একদিন ওই শিক্ষিকা কথা প্রসঙ্গে প্রিন্সিপালকে বলেছিলেন, মিসেস আমিন, আমার মনে হচ্ছে লারা এখনই বেশ পেকে উঠেছে, শুধু লম্বা হওয়ার অপেক্ষা।
মিসেস আমিন এই কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। এবার ওই ঘটনাটা বললেন শিক্ষিকা। আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। মেয়েরা সবাই টিফিন এনেছিল। লারাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মিস চার্চেল অর্থাৎ ওই শিক্ষিকা জিজ্ঞাসা করলেন কি ব্যাপার তুমি টিফিন আনোনি কেন?
–আমার খিদে পায়নি, সকালবেলা পেট ভরে খেয়ে এসেছি।
মিস বুঝতে পারলেন, লারা মিথ্যা কথা বলাতে বেশ রপ্ত হয়েছে।
অন্য মেয়েদের স্কুলের পোশাক ছিল, কিন্তু লারার ছিল না, বাবাকে এ ব্যাপারে আবদার করেছিল, বাবা সেই আবদারে কর্ণপাত করেন নি। বরং বলেছিলেন শ্যালভেসন আর্মির কোয়ার্টার থেকে জোগাড় করতে।
লারা গম্ভীর হয়ে বলেছিল–ভিক্ষের পোশাক?
মেয়ের এই কথায় জেমসের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়ের গালে থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিলেন। লারা গুম হয়ে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল অনেকক্ষণ।
লারা আরও অভীজ্ঞা হয়ে উঠল কয়েক মাসের মধ্যে। সব মেয়ের মা আর বাবারা কত সুন্দর। জন্মদিনে পার্টি দেয়, মেয়েকে আদর করে, লারার মনে হল এই জীবনে সে একেবারে একা।
বোর্ডিং হাউসের পরিবেশ একেবারে আলাদা, এই হাউসকে একটা ছোট্ট পৃথিবী বলা যেতে পারে। বিভিন্ন দেশের লোক এক জায়গাতে মিলিত হয়েছে। স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স, পোল্যান্ড থেকে আসা মানুষ। বিভিন্ন পেশা তাদের, ডাইনিং রুমে নির্দিষ্ট সময়ে খাবার জন্য হাজির। হতো। তখন এক বিচিত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। লারা কারো কথা বুঝতে পারতো না। কেউ আবার এমন কথা বলতে যা লারার অবাক লাগতো। কেউ কেউ বলতো, লারা তুমি এসব কথার অর্থ বুঝতে পারবে না। আরেকটু বড় হও, তখন সব বুঝতে পারবে। বিয়েটা তো হয়ে যাক।
লারা জবাব দিতনাহ আমি কোনো দিন বিয়ে করবো না!
পনেরোতে পা দিল লারা, ভর্তি হল সেন্ট মিশেল হাইস্কুলে। ইতিমধ্যে ও অনেক বুদ্ধিমতী আর স্মার্ট হয়ে উঠেছে। অন্য মেয়েদের থেকে আরও অনেক অভীজ্ঞা। কারও কারও মনে । হতো লারা অত্যন্ত কুৎসিত, কিন্তু অন্য কারো চোখে সে ছিল যথেষ্ঠ সুন্দরী।
জেমসের চোখে লারার কোনো রূপ সৌন্দর্য ধরা পড়েনি। এই সময় জেমস ক্যামেরন মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। মেয়েকে এই প্রসঙ্গে একদিন জিজ্ঞাসা করা হল, কথাটা কানে গেল ম্যাককুইনের। তিনি এসে বললেন–তুমি এরই মধ্যে মেয়েটাকে তাড়াতে চাইছো কেন?
রেগে গিয়ে জেমস বলেছিলেন–তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, তুমি আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না।
ম্যাককুইন বলেছিলেন–তুমি সত্যি মদমাতাল লোক।
–তাতে কি হয়েছে? মেয়ে মানুষের মতো আমার বুদ্ধি নয়। অন্যায়টা কি হয়েছে?
ম্যাককুইন লারার কাছে সরে গেলেন। ও তখন রান্নাঘরে ডিশগুলো ধুচ্ছিল। ম্যাককুইন বলল–তুই কিছু মনে করিস নারে, তোর বাবা তোকে ঘেন্না করে।
আর কোনো কথা বলবার মতো ছিল না ম্যাককুইনের।
একবার গরমকালে গ্রেস বে-তে অসংখ্য ট্যুরিস্ট এসে হাজির হয়েছিল। প্রত্যেকের পরনে দামী পোশাক, সত্যিকারের অবসর বিনোদন বলতে কি বোঝায় লারা বুঝতে পেরেছিল। গরমকাল কেটে গেল, ট্যুরিস্টরা চলে গেল। তাদের শূন্য তাবুর দিকে তাকিয়ে লারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে সে ট্যুরিস্টদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল।
লারা তার দাদু ম্যাক্সওয়েলের কাহিনী শুনেছিল। গল্প শুনে শুনে দাদুর প্রতি একটা
অজানা আকর্ষণ বোধ করতে সে। এই ব্যাপারটা বাবা জেমসের পছন্দ ছিল না।
দাদুকে সে কোনোদিন দেখতে পাবে না, সারাটা জীবন গ্রেস বে শহরে কেটে যাবে? এর থেকে খারাপ আর কি হতে পারে?
.
চতুর্থ অধ্যায়
গ্রেস বে ইদানীং খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বয়ঃসন্ধিতে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের খেলাধূলার নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফুটবল, হকি, সাঁতারের পাশাপাশি দু-দুটো মুভি থিয়েটার, নাচের আসর আর ফুলের সৌন্দর্যে ঘেরা বাগান।
লারা অবশ্য এইসব উপভোগ করার মতো সময় অথবা সুযোগ কোনোটাই পায় না। ভোরবেলা উঠেই তাকে কাজে নেমে পড়তে হয়। বোর্ডারদের ব্রেকফাস্টের জন্য বার্থার সঙ্গে রান্নঘরে গিয়ে কাজ করতে হয়। স্কুলে যাবার আগে বিছানাপত্র পরিষ্কার করতে হয়। বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে আসার পরেও বার্থাকে সহযোগিতা করতে হয়। বোর্ডারদের খাওয়া শেষে হলে টেবিল পরিষ্কার করে সে। বাসনপত্র ধোয়ার কাজও নিজের হাতে করতে হয়। তাই লারার কাছে জীবন গতানুগতিকতায় ভরা।
বোর্ডিং হাউসের সিটিং রুমে একটা পিয়ানো আছে। সন্ধ্যের সময় অনেক বোর্ডার সেখানে জড়ো হয়। পিয়ানো বাজিয়ে তারা চিৎকার করে নিজেদের পছন্দ মতো গান গায়। এইভাবে গ্রেস বে-এর জীবন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেক বছর এখানে খুব বড়ো আকারের একটা প্যারেড হয়। ব্যাক পাইপ বাজিয়ে একধরনের ঘাঘড়া পড়ে স্কটিশরা মিছিল করে রাস্তা পরিক্রমা করে। মাংগোকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল লারা–পুরুষরা সব মেয়েদের ঘাঘড়া পড়েছে কেন?
মাংগো জবাব দিয়েছিল–আরে ওগুলো পুরুষদেরই পোশাক, অনেক কাল আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই ধরনের পোশাক পড়তো। শীতের প্রকোপের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই ধরনের পোশাকের পরিকল্পনা। পায়ের দিকটা খোলা থাকে, যাতে অনায়াসে ছোটাছুটি করা যায়। রাতের বেলা আবার পোশাক খুলে ভালো ভালো বিছানাতে শুয়ে পড়তো।
মাংগোর কথায় লারা ঘাড় নাড়লো। কবিতার বইতে লারা অনেকগুলো শহরের নাম পড়েছে। এভাবেই তার অভিজ্ঞতা তখন ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। প্রত্যেকদিন রাতে খাবার টেবিলে আলেচনা হতো। স্কটিশরা তর্ক-বিতর্ক করতে খুবই ভালোবাসে। নিজেদের সম্প্রদায় ভুক্ত লোকেরা অসম্ভব অনুরক্ত। নিজেদের পুরনো ইতিহাসকে সযত্নে রক্ষা করে চলেছে। লারা ওদের উত্তপ্ত আলোচনা শুনে অবাক হতো। লারার মনে হতো এখনই বোধহয় হাতাহাতি শুরু হবে। মাংগো অবশ্য লারাকে আগেই বলেছে, স্কটিশদের স্বভাবই এইরকম। ফাঁকা ঘরে একজন স্কটিশ নিজের সঙ্গে কথার লড়াই চালাবে। ইদানিং লারা কবিতা পড়তে খুবই ভালোবাসে। স্যার ওয়ালটার স্কোপের একটা কবিতা ওর খুবই প্রিয়। কবিতার বিষয়বস্তু হল কিভাবে একজন যুবক তার প্রেমিককে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা করেছিল। তাকে অন্য একজনের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
এই কবিতাটা বার বার আবৃত্তি করে লারা। মনে মনে কল্পনা করে, একদিন এক সুদর্শন যুবক এসে সত্যি সত্যি ওকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। ওই অচেনা যুবকের মুখটা কেমন হবে? স্বপ্নে বার বার ভেসে ওঠে, সেই মুহূর্তে লারা অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে যায়। যে পৃথিবীটাকে ও স্বপ্নের মধ্যে দেখতে ভালোবাসে।
একদিন লারা রান্নাঘরে কাজ করছিল। হঠাৎ ম্যাগাজিনের একটা বিজ্ঞাপনের দিকে ওর চোখ পড়ে গেল। সুন্দর সোনালী চুলওয়ালা যুবকের ছবি। মুখে হাসি, পরনে রাজকীয় পোশাক, লারার মনে হল এই বোধহয় আমার স্বপ্নের রাজকুমার। এই সুপুরুষ যুবক আমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করবে।
ফ্রিজ পরিষ্কার করতে করতে পারার মনে হল ওই যুবক বোধহয় পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলছে–আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
তখনই বার্থা সেখানে হাজির হল। লারাকে এই অবস্থায় দেখে বার্থা খুবই রেগে গিয়েছিল। লারাকে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসতে হল। স্বর্গ তখন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
ডিনারে বোর্ডিং–এর লোকেরা নানা বিষয়ে গল্পগুজব করতো। অবাক হয়ে ওদের গল্প শুনতো লারা। খুব একটা বুঝতে পারতো তা নয়, কিন্তু শুনতে ভীষণ আগ্রহ ছিল তার।
কোনো এক জুলাই মাসের সন্ধ্যেবেলা। ক্রিস্টির বেশ্যালয়ে এক সুন্দরী বেশ্যার সঙ্গে এক বিছানাতে শুয়েছিলেন জেমস ক্যামেরন। একটু আগে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। পাশেই শুয়ে আছে নগ্নিকা ওই মেয়েটি। তার সাথে মিলিত হয়েছিলেন জেমস। এখন ওর দেহটা শীর্ণ ঝড়া পাতার মতো বিছানাতে পড়ে আছে। চোখ দুটো বোজা, মেয়েটি বলে উঠল, জেমস এবার ওঠো, উঠে পড়ো, আমার অন্য কাস্টমার আসার সময় হয়েছে।
জেমসের দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। কোনোরকমে বললেন, শোনো তুমি বরং একটা ডাক্তার ডাকো। আমার শরীরটা কেমন করছে, শিগগির ডাক।
ঠিক আছে মেয়েটি পোশাক পরে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ বাদে অ্যাম্বুলেন্স এসে জেমসকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার ডানকান জেমসকে ভালোভাবে দেখলেন। লারাকে খবর পাঠালেন। কাঁদতে কাঁদতে লারা প্রশ্ন করলে, বাবার কি হয়েছে? বাবা বেঁচে আছে তো?
–বেঁচে আছেন, হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। লারা কোনো জবাব দিল না। একটু বাদে বলল–আমি কি বাবাকে একবার দেখতে পারি?
–এখন নয় কাল সকালে নার্সিংহোমে এসো।
–ঠিক আছে, লারা মনে মনে ভাবলো, যদিও বাবা তাকে কোনোদিন ভালোবাসে নি, কিন্তু সে রাতে বাবার প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ করল লারা। চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল, হে ভগবান, তুমি আমার বাবাকে সারিয়ে তোলে।
বাড়ি ফিরতেই বার্থা জেমসের খবর জানতে চাইল। সবশুনে কেমন যেন হয়ে গেল সে। একটু বাদে বলল–আজ শুক্রবার, ভাড়া তুলতে যেতে হবে। সিন ম্যাক অ্যালিস্টার কঠোর স্বভাবের মানুষ। একটু বেচাল হলেই লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে।
লারা এসব নিয়ে মোটেই ভাবছে না। এর আগে মাতাল বাবা তাকে এই কাজে অনেকবার পাঠিয়েছে। তারা বিভিন্ন বোর্ডারের কাছ থেকে টাকা এনে বাবার হাতে তুলে দিতো।
বার্থা বলল–লারা এখন কি করা উচিত বলো তো?
লারা ভাবতে লাগল এখন কি করবে। বার্থাকে বলল–চিন্তার কি আছে, করতে তো বসে ছিলেন লারা হাজির হায্যের হাত বা কিছু একটা হবেই।
তখনকার মতো তারা দুজন বোর্ডিং হাউসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সন্ধ্যেবেলা বোর্ডাররা ডাইনিং রুমে জড় হয়েছিল। লারা ওদের সামনে গিয়ে বলল আপনারা একটু শুনবেন আমার কথা?
বোর্ডাররা চুপ করে গেলেন। সবাই তাকালো লারার মুখের দিকে। একজন বলল কী হয়েছে?
–আমার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। যতদিন না আমার বাবা সুস্থ হচ্ছেন, আমি আপনাদের কাছ থেকে ভাড়া নেব। খাওয়া শেষ হলে আপনাদের জন্য পার্লারে অপেক্ষা করবো।
একজন জিজ্ঞাসা করলেন–উনি ঠিক হয়ে যাবেন তো?
লারা কণ্ঠে জোর আনার চেষ্টা করল, বলল, হ্যাঁ, গুরুতর কিছু ঘটেনি। আরও বলল সে, এখন চলি, আমি কিন্তু পার্লারে থাকবে।
খাওয়া শেষ হল, সবাই এসে হাজির হল পার্লারে। সপ্তাহিক ভাড়া দিতেই হবে। লারা সেগুলো সংগ্রহ করে বার্থার কাছে গিয়ে হাজির হল। বলল–আমি অন্য বোর্ডিংগুলো থেকে ভাড়া আদায় করে নিয়ে আসি। তুমি খাবার ডিশগুলো ধুয়ে ফেল।
লারা চলে গেল, তার অনেক কাজ বাকি আছে।
লারা যেমনটি ভেবেছিল, কাজটা তার থেকে সহজ হল। বেশিরভাগ বোর্ডার লারাকে খুবই ভালবাসে। প্রত্যেকে ওর কথা শুনে ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। পরের দিন ভোরবেলা সংগৃহীত সব টাকা নিয়ে লারা হাজির হল সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের কাছে। সিন ম্যাক নিজস্ব অফিসে বসে ছিলেন। লারা সেক্রেটারীকে খবর দিল।
সিন সামনে দাঁড়ানো বাড়িটার দিকে তাকালেন, বললেন–তুমি তো জেমসের মেয়ে তাইতো?
-হ্যাঁ।
–তোমার কি নাম সারা?
–না, আমার নাম লারা।
–তোমার বাবা তো অসুস্থ শুনলাম, খুব খারাপ লাগছে, তুমি ভালো আছো?
–হ্যাঁ স্যার।
এবার সিন ম্যাক অ্যালিস্টার-এর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। মুখে আর সহানুভূতির চিহ্ন মাত্র নেই। তিনি বললেন–আমাকে তো অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। জেমস খুবই অসুস্থ, সে তো আর টাকা তুলতে পারবে না।
লারা বলল–না স্যার, আমি আমার বাবার হয়ে সব কাজ করে দেব, আমি সেই কাজ শুরু করে দিয়েছি।
সিন ম্যাক অ্যালিস্টার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন তুমি পারবে?
–আমি পারবো স্যার, আপনার কোনো চিন্তা নেই। এই বলে সে সংগৃহীত অর্থের খামটাকে টেবিলের ওপর রাখলো, বলল–এটা আমাদের বোর্ডিং-এর সবটাই ভরা।
ম্যাক অ্যালিস্টার অবাক হলেন লারার এই কাজে। বললেন তিনি সবার টাকা এতে আছে?
–হ্যাঁ স্যার, লারা বলল।
–তুমি আদায় করেছো লারা? ভদ্রলোকের কণ্ঠে এখনও বিস্ময়ের সুর।
–হ্যাঁ, যদি না বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন তাহলে আমি ভাড়া আদায় করবো।
গুম হয়ে বসে থাকলেন সিন, ভাবতেই পারলেন না লারা এত সহজে কাজটা করল কি করে? খামটা নিয়ে তার ভেতর থেকে অর্থ বের করে গুনতে শুরু করলেন। সেটা একটা ড্রয়ারে রেখে সবুজ রঙের লেজার র্যাক থেকে পড়লেন। তারপর পাতা ওল্টাতে লাগলেন। লারা সামনে থেকে সবই দেখছিল।
সিন ম্যাক অ্যালিস্টার জেমসের অনেকগুলো স্বভাব মোটেই পছন্দ করতেন না। জেমস যে সারাদিন মদ খায় এ ব্যাপারটা তার অপছন্দের। জেমস যে মাঝেমধ্যে বেশ্যালয়ে যায়, এই ব্যাপারটাকেও তিনি কখনই মানতে পারেননি। মাঝেমধ্যে তিনি ভেবেছিলেন যে জেমসকে আর রাখবেন না, কিন্তু এখন লারাকে দেখে তার সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন। এই বাচ্চা মেয়েটার ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েটা পারবে তো?
যদি পারে, তাহলে কেল্লা ফতে, জেমসকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আবার থমকে গেলেন। বাচ্চা এই মেয়েটাকে কাজে বহাল করে জেমসকে তাড়িয়ে দিলে কেমন হয়? বেশ খানিকক্ষণ নিজের সঙ্গে লড়াই করলেন তিনি। তারপর বললেন–দেখো লারা, তোমাকে আমি এক মাস সুযোগ দেব। তারপর তুমি অন্য কোথাও কাজ দেখে নিও। আশা করি আমার কথার অর্থ বুঝতে পারছো?
–ধন্যবাদ স্যার, আপনি আমার একটা দুশ্চিন্তা দূর করলেন। খুশি মাখা স্বরে লারা বলল–এখন চলি স্যার।
–একটু দাঁড়াও।
–পঁচিশ ডলার লারার হাতে তুলে দিলেন উনি। বললেন–এটা তোমার প্রাপ্য।
লারা পঁচিশ ডলার হাতে নিল। ঠিক তখনই ওর মনে হল ও যেন একটু একটু করে মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে। এই প্রথম লারা কোনো কাজ করে টাকা নিয়েছে।
সিন ম্যাক অ্যালিস্টারকে ধন্যবাদ জানিয়ে লারা বেরিয়ে এল।
প্রথমে গেল ব্যাঙ্কে, তারপর সেখান থেকে হাসপাতাল। ডাক্তার ডানকানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে লারা জিজ্ঞাসা করল–ডাক্তারবাবু আমার বাবা কেমন আছেন?
ডঃ ডানকান জবাব দিলেন–তোমার বাবা ভালই আছেন, ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছেন। কয়েকদিনের মধ্যে বাড়িতে যাওয়ার ছাড়পত্র পাবেন।
লারা বলল–আমি বাবাকে একবার দেখবো?
–হ্যাঁ যাও, তবে বেশিক্ষণ কথা বলবে না। লারা কেবিনে হাজির হল। বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, জেমসকে ভারী অসহায় দেখাচ্ছে। লারার মনে হল এই কদিনে বাবার বয়স যেন একলাফে অনেক বেড়ে গেছে। লারার বুকে কেমন একটা মায়া হল। লারা ভাবল এটাই বোধহয় ভগবানের দেওয়া মস্ত বড় সুযোগ। যদি সে স্নেহত্ন মমতায় বাবাকে সারিয়ে তুলতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই বাবার স্বভাবে একটা পরিবর্তন দেখা দেবে।
মধুর গলায় সে বলল–বাবা? কোনো রকমে চোখ খুললেন জেমস ক্যামেরন। বুকের ভেতর থেকে একটা ঘরঘরে শব্দ বেরিয়ে এল।
বাবা বললেন–তুমি এখানে কি করতে এসেছো? যাও বোর্ডিং-এ যাও। সেখানে অনেক কাজ আছে।
লারা বুঝতে পারলো, অসহ্য একটা যন্ত্রণাকে বাবা চেপে রাখার চেষ্টা করছেন।
লারা আমতা আমতা করে বলে উঠল–আমি একটা কথা বলার জন্য এসেছি। আরও বলতে থাকে সে–আমি মিঃ ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে দেখা করেছি। ওকে বলেছি যত দিন না তুমি সুস্থ হয়ে উঠছে, ততদিন আমি ভাড়া আদায় করবো।
মেয়ের এই প্রস্তাব শুনে অসুস্থতার মধ্যেও জেমস হেসে ওঠার চেষ্টা করলেন। বললেন–তুমি আদায় করবে? আমি তো…
কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। তার সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত কাপুনি দেখা দিল। একটু বাদে আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। দুর্বল গলায় জেমস বললেন–সবই আমার ভাগ্য! মনে হচ্ছে এবার আমাকে রাস্তায় সময় কাটাতে হবে।
লারার কি হবে এই ব্যাপারে জেমসের বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই। লারা বেশ কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকল অবাক বিস্ময়ে। তারপর ধীরে ধীরে কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।
লারার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস পাক খেয়ে উঠছে। হায়, বাবা এখনও আমাকে এতটুকু ভালোবাসে না? কিন্তু কেন?
তিনদিন বাদে জেমসকে হাসপাতাল থেকে বোর্ডিং হাউসে নিয়ে আসা হল। ডাক্তার ডানকান বললেন–তুমি আরও কয়েক সপ্তাহ বিছানা থেকে উঠবে না। আমি সপ্তাহে দুদিন তোমাকে দেখে যাব।
জেমস বললেন–আমি ব্যাস্ত মানুষ ডাক্তারবাবু, না উঠলে খাব কি? আমার অনেক কাজ আছে।
ডাক্তার ডানকান কঠিন চোখে জেমসকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললেন–আমার উপদেশ শোনা অথবা না শোনা তোমার ব্যাপার জেমস। হয় বিছানায় শুয়ে ভালো হয়ে ওঠো কিংবা এখনই হাঁটাচলা করে জীবনটা শেষ করে দাও। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, তোমার বয়স হয়েছে, এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলবো না।
ডাক্তার চলে গেলেন, জেমস ক্যামেরনের চারপাশে তখন বিরাট শূন্যতা ঘনিয়ে এসেছে।
ম্যাক অ্যালিস্টারের বোর্ডিং হাউসের লোকেরা একজন কিশোরী মেয়ের এই কর্তব্যপরায়ণতা দেখে অবাক হয়ে গেছেন। প্রত্যেকের ভাড়া লারা হিসেব মতো তুলছে। আবার অনেকের কাছ থেকে বেশ বাধা পেয়েছে। কেউ আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, তার ছেলে এখনও বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়নি। কেউ আবার অসুস্থতার ভান করেছে। বেশির ভাগ বোর্ডারই কোনো না কোনো অজুহাতে লারাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এতে লারা বেশ অসুবিধায় পড়ে গেল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ও চিন্তা করলো লড়াইটা আমাকে চালিয়ে যেতে হবে। অবশেষে একটা প্ল্যান ঠিক করলে। পরের দিন প্রত্যেকটি বোর্ডারের কাছেও গিয়ে বললে, তার কথা মিঃ ম্যাক অ্যালিস্টারকে জানিয়েছিল। কিন্তু ভাড়া দিতে না পারলে ঘর খালি করে দিতে হবে এমন কথাই বলেছেন মিঃ ম্যাক। এতে কাজ হল, কড়া ডোজের ওষুধ আর কী।
কেউ কেউ আবার লারাকে অভিশাপ দিতে থাকলো। বাবার থেকে সে নাকি এক কাঠি ওপরে দাঁড়িয়ে আছে।
লারা ভেবেছিল অসুস্থ বাবার কাছাকাছি সে পৌঁছাতে পারবে, কিন্তু শেষপর্যন্ত তার ভাবনাটা ভুল বলে প্রমাণিত হল। দিন এগিয়ে যাচ্ছে, বাবার আচরণ ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।
লারা প্রত্যেকদিন ফুল নিয়ে আসতো। একদিন বাবা ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় বললেন–তুই কেন এসব নিয়ে আসিস?
এই কথা বলে দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন জেমস। লারার মনে এবার ঘৃণাবোধ জন্মাল। মনে মনে সে বলল–বাবা, আমি কিন্তু তোমাকে ঘেন্না করি!
কান্না ভেজা জ্বলন্ত চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লারা। মাস শেষ হল। খাম ভর্তি ভাড়ার অর্থ নিয়ে লারা হাজির হল সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের অফিসে। গোনা শেষ করে ম্যাক বললেন–লারা, তোমার কাজে আমি খুবই খুশী। তোমাকে আমি বুঝতে পারিনি। বাবার থেকেও তুমি অনেক চটপট কাজ করছো?
এই প্রশংসাতে লারা খুবই খুশী হয়েছে। সে বলল–ধন্যবাদ স্যার।
–আসলে প্রথম মাস তো, সেজন্য ঠিক সময় সবাই টাকাটা দিয়েছে। ম্যাক অ্যালিস্টারের কথার পর লারা জানতে চাইল–স্যার, আমি আর বাবা এই বোর্ডিং হাউসে থাকতে পারব তো?
ম্যাক অ্যালিস্টার বললেন–থাকতে পারো, তুমি তোমার বাবাকে খুব ভালোবাসা, তাই না?
লারা আর কোনো কথা বলল না। সে ধীরে ধীরে ঘর থেকে চলে গেল। ম্যাক অ্যালিস্টার বুঝতে পারলেন, ভবিষ্যতে লারা তাঁর যোগ্য সহকারিণী হয়ে উঠবে।
.
পঞ্চম অধ্যায়
লারা এখন সতেরো বসন্তের তরুণী, স্কটিশ মুখের ছাঁচ পেয়েছে সে। ধূসর চোখদুটিতে যেন শত শতাব্দীর রহস্য আর রোমাঞ্চের হাতছানি। একরাশ কালো চুল যখন উথাল পাথাল বাতাসে উড়তে থাকে, তখন লারাকে সত্যি সুন্দরী বলে মনে হয়। কিন্তু ওর সমস্ত শরীরের মধ্যে কী একটা অদ্ভুত বিষাদের ছায়াছবি। এর উৎস কোথায় কেউ জানে না। হয়তো জীবন যুদ্ধে একক সংগ্রাম করতে হচ্ছে বলেই লারা এমন বিষণ্ণবতী হয়ে গেছে।
বেশীর ভাগ বোর্ডারের সঙ্গে কোনো মহিলা নেই। তাই অনেকে নিয়মিত বারবনিতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। কাছাকাছি বেশ্যালয় বলতে মাদাম ক্রিস্টির ওই বিনোদন জগত। কেউ আবার অন্য জায়গাতে যেত। সকলের লক্ষ্য ছিল সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গ উপভোগ করা। কিন্তু লারা যুবতী হওয়া মাত্র বোর্ডারদের নজর পড়ল তার দিকে। লারার মতো এক ভদ্রস্বভাবের সুন্দরী মেয়েকে কুক্ষিগত করার ব্যাপারটা খুব একটা সহজ নয়।
একদিন এক বোর্ডারের ঘর পরিষ্কার করছিল লারা। সে হঠাৎ লারাকে বলল–লারা, তুমি খুব ভালো মেয়ে। যদি কোনো কিছুর দরকার থাকে, আমাকে বলতে পারো।
লারা হাসল। ইতিমধ্যে সে পুরুষের চোখের ভাষা পড়তে পারে। সে বলল–তাই নাকি? না, এখন আমার কিছুই দরকার নেই।
গায়ে পড়া বোর্ডার জানতে চাইল–তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?
কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে লারা বলল–নাঃ বয়ফ্রেন্ড নেই তো আমার।
–পরের সপ্তাহে আমি ক্যানসাস সিটিতে যাচ্ছি। তুমি কী আমার সঙ্গে যাবে নাকি? ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। লারা একটুখানি চুপ করে থেকে বলল–না, আমি এখন খুবই ব্যস্ত এই প্রস্তাব দেবার জন্য ধন্যবাদ।
লারা বেশ বুঝতে পারছে, এখন তাকে আরো কঠিন কঠোর সংগ্রামের জন্য তৈরী হতে হবে। প্রত্যেক বোর্ডারই তাকে ঠারে-ঠারে ইঙ্গিতে শয্যা সঙ্গিনী হবার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এমনকী লারার বাবাও তাকে সন্দেহ করছে। বিছানাতে অসহায়ভাবে শুয়ে আছেন তিনি। কিন্তু মেয়ের প্রতি মনোভাব এতটুকু পাল্টায় নি তার।
একদিন জেমস বললেন–তোমার চালচলন আমার ঠিক ভালো ঠেকছে না। বোর্ডারদের সাথে এত ঢলাঢলি করছো কেন?
লারা গম্ভীরভাবে জবাব দিল-বাবা, তুমি ভুল করছে। আমাকে এখানকার সব বোর্ডার পছন্দ করে, ওদের সকলের সঙ্গে আমার সুন্দর সম্পর্ক।
লারা চলে গেল। বাবার চোখের সামনে সে বেশীক্ষণ দাঁড়াতে চায় না। তার কেবলই মনে হয়, বাবা বুঝি দুটি অন্তর্ভেদী চোখের দৃষ্টিতে তার সর্বাঙ্গ পর্যবেক্ষণ করছে।
এল বসন্তকাল। তখনই লারার জীবনে একটা বিরাট ছন্দ পতন ঘটে গেল। একদিন সকালে জেমস ক্যামেরনকে বিছানাতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। গ্রিনউড সমাধিস্থলে বাবাকে শেষ বিদায় জানাল লারা। বাথা সবসময় তার পাশে পাশে ছিল। লারার চোখে বিন্দুমাত্র জল ছিল না। শুধু কী একটা অদ্ভুত আক্রোশে তার হৃদয়ের কোথায় যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল।
বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। লারা এখন খুবই স্বাভাবিক। তখন একজন নতুন বোর্ডার এল এই বোর্ডিং হাউসে। সত্তর বছর বয়স। জাতে মার্কিনী, নাম বিল রজার্স। কথা বলতে খুবই ভালোবাসে। একদিন খাওয়ার পর লারার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল সে।
রজার্স বলল–তুমি কেন এই ছোট্ট শহরে পড়ে আছো? তোমার যা রূপ আর প্রতিভা তোমার তো চিকাগো কিংবা নিউইয়র্কে চলে যাওয়া উচিত। এখনো তোমার বয়স আছে। নতুন করে জীবনটা শুরু করতে পারো।
–যাব নিশ্চয়ই।
–তোমার সামনে পুরো জীবনটা পড়ে আছে লারা। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, ওখানে গেলে তোমার প্রতিভার সঠিক বিস্ফোরণ হবে।
এই প্রথম লারা ভাবল, অন্ধকূপে বন্দিনী থেকে কি লাভ? জীবনে অনেক কিছু করতে হবে তাকে। এত বছর সে শুধু দারিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করেছে।
শেষে অব্দি রজার্সের কথাতে নিমরাজি হল লারা।
রজার্স বলতে থাকে–এক সময় আমি রিয়েল এস্টেটে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।
লারা বলল–তাই নাকি?
বিল রজার্স বলল–পশ্চিম এলাকাতে অনেকগুলো বিল্ডিং আমার ছিল। তাছাড়া অনেক ভালো ভালো হোটেলও আমি তৈরী করেছিলাম।
–সেগুলো কী হল?
বিল রজার্সের চোখ দুটিতে হারানো দিনের প্রতিচ্ছবি। সে অনেক দিন আগের স্মৃতিতে ফিরে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল–আমি কিছুটা লোভী হয়ে পড়েছিলাম। সব কিছু আমার চলে গেছে। বলতে পারো, নিজের হাতে আমি সব নষ্ট করেছি।
–আপনার কাছ থেকে তা হলে সবটা শুনতে চাই।
এরপর শুরু হল এক অদ্ভুত গল্পকথা। প্রত্যেক রাতে বিল রজার্স তার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা সম্পর্কে লারাকে গল্প বলতে লাগল। এই ব্যবসা কীভাবে করতে হয়, এই ব্যবসা করতে গেলে কোন্ কোন্ বাধার সম্মুখীন হতে হয়, কীভাবে সেই বাধাগুলিকে অতিক্রম করতে হয়। বিল রজার্স সবকিছুই গুছিয়ে বলল।
বিল রজার্স বলল–রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার প্রথম নিয়ম হল ও. পি. এম.। এটা কখনোই ভুলবে না।
–এর অর্থ কী? জিজ্ঞসু দৃষ্টিতে লারা জানতে চাইল।
–আদার পিপলস মানি। অর্থাৎ অন্যের অর্থ, এটা সব সময় মনে রাখবে। রিয়েল এস্টেটে ব্যবসায় যখন তোমার লাভ হবে, তখন সরকার ইন্টারেস্ট আর ডেপ্রিসিয়েসন, দুটোই কাটতে শুরু করবে। অবশ্য তখন থেকেই তোমার সম্পদ ধীরে ধীরে বাড়বে। এটাই একটা মজার ব্যাপার।
–আরো একটা বিষয় মনে রাখবে। তা হল, এই ব্যবসার লোকেসন হল আসল ব্যাপার। পাহাড়ের ওপর যদি একটা চমৎকার বিল্ডিং তৈরী হয়, তাহলে সেটা সময় আর অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু যদি শহরতলিতে তুমি একটা সুন্দর বাড়ি তৈরী করো, সেই বাড়িটা তোমাকে ধনী করে দেবে।
এবার ধীরে ধীরে বিল রজার্স মর্টগেজ, রিফাইনার, ব্যাঙ্ক লোনের ব্যবহার সবকিছু ভালো করে বোঝাল। লারার মন অনেকটা স্পঞ্জের মতো। যে কোনো কথা সে চট করে মনে রাখতে পারে।
শেষ অব্দি রজার্স বলল–গ্রেস বে-তে গৃহ সমস্যা ভয়ংকর। এই ব্যবসায় নামার পথে এটাই হল আদর্শ জায়গা। আমার বয়সটা যদি আরো কুড়ি বছর কম হত, তাহলে আমি এখানে ওই ব্যবসায় নেমে পড়তাম।
সেই মুহূর্তে লারার যেন নবজন্ম ঘটে গেল। এতদিন পর্যন্ত গ্রেস বে-কে সে যে দৃষ্টিতে দেখে এসেছিল, সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা একেবারে পাল্টে গেল। চোখ বন্ধ করল লারা। কল্পনার জগতে ভেসে উঠল ওর হাতে তৈরী করা অসংখ্য বাড়ির ছবি। এক-একটি ওর কৃতিত্বকে মাথায় নিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে। লারা প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা হতাশাবোধ তার সমস্ত সত্তাকে গ্রাস করল। হায় ঈশ্বর! রিয়েল এস্টেট-এর ব্যবসা করতে গেলে যে প্রভূত পরিমাণ অর্থ দরকার–তা আমি কোথায় পাব?
বিল রজার্স একদিন চলে গেল। যাবার সময় স্নেহমাখা কণ্ঠস্বরে বলল–মনে রেখো, আদারস পিপলস মানি, ও. পি. এম.। আশা করি এই তিনটি শব্দ তুমি সারা জীবন ধরে মনে রাখবে কেমন?
লারার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল। সত্তর বছর বয়সী এই লোকটা মাত্র কদিনে তার খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। রজার্স চলে যেতে লারার চোখে সত্যি জলের রেখা দেখা দিল।
এরপর সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে। চার্লস কোহন নামে বছর ষাট বয়সের ছোটোখাটো চেহারার এক মানুষ এসে হাজির হয়েছে বোর্ডিং হাউসে। নিজস্ব কথাবার্তা খুবই কম বোধহয় তার। সবসময় চুপচাপ খাওয়া দাওয়া করে। লারা যখন তার কাছে আসত, সে লারাকে দেখে অমায়িকভাবে হাসত।
একদিন লারা জিজ্ঞাসা করল–কোহন, তুমি এখানে কতদিন থাকবে?
–ঠিক বলতে পারছি না। আসলে আমার জীবনটাই একটা ধাঁধার মতো। কাল সকালে কী হবে, আমি তা জানি না।
কোহনের এই কথা শুনে লারা হেসে উঠেছিল। লারার কাছে কোহন বোধহয় একটা জীবন্ত হেয়ালি। কোহনকে বোঝার চেষ্টা সে অনেকবার করেছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি। কোহন লোকটা অদ্ভুত স্বভাবের। অন্য কারো সাথে একেবারেই মেলামেশা করে না। ব্যবসায়ী কি? তা তো মনে হয় না। কেমন যেন বিজ্ঞ ধরনের, নিজেকে কেউকেটা বলে ভাবতে ভালোবাসে। প্রথমে অন্য কোথাও উঠেছিল, সেখানকার পরিবেশ ভালো না লাগায় এখানে এসে জুটেছে।
আর একটা ব্যাপার লারা লক্ষ্য করল, অন্য বোর্ডাররা হাউ হাউ করে খেতে ভালোবাসে, চার্লস কিন্তু খুবই কম খায়।
একদিন লারাকে চার্লস বলল–সামান্য ফল কিংবা সজি হলে খুব ভালো হয়।
লারা জিজ্ঞাসা করল–তুমি কি স্পেশ্যাল কোনো খাবার পছন্দ করো?
–আমি নিয়ম মেনে খাওয়া-দাওয়া করতে ভালোবাসি। অর্থাৎ স্বাস্থ্য সম্মত খাবার বলতে পারো।
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা লারা ডিশের ওপর খানিকটা মাংসের কিমা নিয়ে চার্লস কোহনের কাছে হাজির হল।
চার্লস এই খাবার দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল–এটা কি দিয়েছো? এ তো আমি খাই না।
–কেন এটা তো স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। লারা হেসে বলল–ভেড়ার মাংস তোমার মতো লোকেরাই খায়। এমনিতে তুমি তো খুব কম খাও। এই পদটা খেয়ে দেখতে পারো।
লারার উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে কোহন খুবই খুশী হল।
এবার ধীরে ধীরে সে নিজেকে ভাঙতে শুরু করল। সে কন্টিনেন্টাল সাপ্লাই বিজনেসে একজন এগজিকিউটিভ। এখানে লোকেসান খুঁজতে এসেছে। একটা নতুন স্টোর হাউস তৈরী হবে।
লারার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। হ্যাঁ, এখান থেকে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করলে কেমন হয়।
স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে লারা। সেদিন রাতে তার ভালো করে ঘুম হল না। ভোর তিনটের সময় ঘুম ভেঙে গেল তার। বিছানাতে উঠে বসল লারা। মনটা খুবই উত্তেজিত।
পরদিন সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট টেবিলে চার্লস কোহন চুপ-চাপ বসেছিল। অন্য বোর্ডাররা খাওয়া শেষ করে চলে গেছে। টেবিলে সে।
লারা বলল–মিস্টার কোহন, একটা কথা বলব?
–কী কথা?
–তুমি কি লোকেসান পেয়েছো?
–আমি তো পাইনি।
–মিস্টার কোহন, যদি তোমার জায়গাটা পছন্দ হয়, তা হলে বিল্ডিংটা আমি তৈরী করব। পাঁচ বছরের জন্য তুমি সেটা আমার কাছ থেকে লিজ নেবে। কি রাজী তো আমার এই প্রস্তাবে তা অনুমানের বিষয় আছে?
–সবই তো অনুমানের বিষয়। তুমি বিল্ডিং তৈরীর কী জানো? তাছাড়া আইনের জটিল নিয়ম কানুন কি তোমার জানা আছে?
লারা হেসে ফেলল, ইতিমধ্যে অনেক ব্যাপার সে জেনে নিয়েছে। যা একবার শোনে তা কখনো ভোলে না। তবু সে নিজেকে জাহির না করে বলল–আমি না জানলেই বা কী দোষ? একজন আর্কিটেক তো জানবে। তাছাড়া ভালো কনস্ট্রাকশন ফার্মকে নিয়ে কাজ করাব।
চার্লস কোহন বলল–কোথায় তোমার সেই চমৎকার লোকেন?
–মিস্টার কোহন, আমি বলছি, লোকেসনটা দেখলে তুমি পছন্দ করবেই।
খাওয়া দাওয়া শেষ করার কিছুক্ষণ বাদে চার্লস কোহনকে নিয়ে লারা শহরতলিতে গেল। গ্রেস বে-তে একেবারে মাঝখানে দুটি রাস্তার সংযোগ স্থলে খানিকটা ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। লারা বলল–এই জায়গাটাই আমার মনের মতো।
চার্লস লারার এই নির্বাচনে খুবই খুশী হয়েছে। জায়গাটা সত্যি চমৎকার। শহরের একেবার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাতে।
লারার মন খুশীতে ভরপুর। তাহলে? দেখার মতো চোখ পেয়েছে সে। চার্লস যখন প্রশংসা করেছে, তখন আর কীই-বা বলার থাকতে পারে।
আরো অনুসন্ধান করে চার্লস জানতে পারল, ওই জায়গাটা সিন ম্যাক অ্যালিস্টার নামে একজন ধনী ব্যাঙ্কারের। চার্লস, কোহনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, প্রথম লোকেসন ঠিক করতে হবে। তারপর কাউকে দিয়ে বাড়িটা তৈরী করাতে হবে। লিজ হিসাবে অফিসের জন্য বাড়িটা নিতে হবে।
চার্লস ভাবল, এই বাড়ি কোনো একজন পেশাদার লোকের মাধ্যমে তৈরী করাটাই ভালো। লারাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল সে। লারার বয়স কম হতে পারে, কিন্তু আচরণের মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা আছে। কোনো ব্যাপার সে অযথা লুকিয়ে রাখে না। বুদ্ধি আছে, আন্তরিকতার অভাব নেই। মনে মনে চার্লস বলল, লারা, তোমার চিন্তা নেই, তোমার বানানো বাড়িটা আমি দশ বছরের জন্য লিজ নেব।
লারা তখন শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছিল।
সেদিন বিকেল বেলা লারা সোজা হাজির হল সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের কাছে। তাকে দেখে সিন অবাক হলেন। প্রশ্ন করলেন–কী ব্যাপার লারা, এত তাড়াতাড়ি এসেছো কেন? আজ তো সবেমাত্র বুধবার।
লারা বলল–না স্যার, একটু অন্য কারণে এসেছি।
এই প্রথম সিন লারার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকালেন। উদ্ভিন্ন যৌবনা এক মোহময়ী নারী, পোশাকের ভেতর থেকে উদ্ধত স্তন দুটি যেন আমন্ত্রণ করছে।
তিনি বললেন–বসো, বলল তোমার জন্য আমি কী করতে পারি?
লারা বলা-স্যার, আমি কি আপনার কাছ থেকে লোন পেতে পারি?
এবার সিন অবাক হলেন। কী জন্য টাকার দরকার সস্নেহে জানতে চাইলেন তিনি।
–পোশাক আশাক কিনতে চাও কি? তাহলে অ্যাডভান্স নাও।
লারা এবার সোজাসুজি সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল–আমি দুশো হাজার ডলার লোন হিসাবে আপনার কাছে চাই। ।
এই কথা শুনে ম্যাকের মুখের হাসি শুকিয়ে গেল। তিনি বললেন–এত টাকা নিয়ে তুমি কী করবে লারা? আমি তো মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি আমার সঙ্গে রঙ্গরসিকতা করছো নাকি?
না স্যার, সে স্পর্ধা আমার নেই। এই শহরে একটা খালি জায়গা আছে। আমি সেখানে একটা বাড়ি তৈরী করতে চাই। আমার কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ ভাড়াটিয়া আছে, যে দশবছরের জন্য ওই বাড়িটা লিজ নেবে। ওটাই হল আমার গ্যারান্টি। আপনার বাড়ি এবং জমির খরচ উঠে আসবে।
সিন ম্যাক অ্যালিস্টার রীতিমতো অবাক হলেন। চোখ দুটো কুঁচকে গেছে তার। তিনি বললেন–তুমি জমির মালিকের সঙ্গে কথা বলেছো?
এখনই এই চেয়ারে বসে বলছি। লারা তখনো পর্যন্ত রহস্যটা ভাঙেনি।
সিন আরো অবাক হলেন। তিনি বললেন–তার মানে জমিটা আমার?
–হ্যাঁ স্যার, শহরের মাঝখানে ওই দুটো বড়ো রাস্তা যেখানে এসে মিলেছে, তারই ঠিক মধ্যেখানে একটা ফাঁকা জায়গা আছে।
লারা থেমে গেল। সিন বললেন–তুমি আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আমারই জমি কিনতে চাইছো?
লারা বলল–স্যার, আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, জমিটার দাম কুড়ি হাজার ডলারের বেশী হবে না। আমি আপনাকে তিরিশ হাজার ডলার দেব। অর্থাৎ জমি বিক্রি করেই আপনি দশ হাজার ডলার পারেন। এছাড়া বাড়ি তৈরী করার জন্য যে দুশো হাজার ডলারের লোনটা দেবেন, তার সুদও আমি আপনাকে দেব।
–আমি যে তোমাকে বাড়ি তৈরী করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দেব, সেটা ফেরত পাবো যে তার সম্ভাবনা কোথায়? তোমার কি কোনো সিকিউরিটি আছে?
লারা এখানেই থমকে গেল। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। বলল–স্যার, আমার কথা শুনুন, বাড়ি আর জমি আপনার কাছে বন্ধক থাকবে। ওই ঋণের টাকা সম্পূর্ণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত আমি তা হাতে নেব না। আর আমি ইতিমধ্যেই ভাড়াটে পেয়ে গেছি স্যার, আমি আবার বলছি, আমার এই প্রস্তাবে আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না।
লারার কথা শুনে ম্যাক আরো অবাক হয়ে গেলেন। লারা ইতিমধ্যে এত গুছিয়ে কথা বলতে শিখল কী করে? তাছাড়া রিয়েল এস্টেট ব্যবসার খুঁটিনাটি বিষয় যেন তার নখদর্পণে।
শেষ পর্যন্ত উনি বললেন–তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস কি এই প্রস্তাব অনুমোদন করবে?
লারা বলল–আপনার কোনো বোর্ড অফ ডাইরেক্টরস নেই। আপনার কথাই শেষ কথা তাই না স্যার?
লারার এই সাহসে আরো অবাক হয়ে গেলেন সিন। এবার তিনি হেসে ফেললেন। বললেন–ঠিকই বলেছো, তুমি বুদ্ধিমতী লারা।
লারা এবার আরো একটু ঝুঁকে বসল। লোকাট ব্লাউজের আড়াল থেকে ওর স্তন দুটো যেন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ও ইচ্ছে করেই সে দুটো টেবিলের কিনারার সাথে ঠেকিয়ে রাখল। সিন একবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেদিকে তাকালেন। লারা মুখের কোণে একটা অদ্ভুত আমন্ত্রণ হাসির টুকরো এনে বলল–স্যার, আপনি ঠকবেন না। আমি শপথ করে বলছি।
ম্যাক অ্যালিস্টারের চোখ দুটো বুঝি আটকে গেছে। তিনি বললেন–তুমি একেবারে অন্যরকম, তাই না? তোমার বাবার সঙ্গে তোমার চরিত্রের অনেক অমিল আছে।
লারা বলল–হ্যাঁ, স্যার, আপনি ঠিকই ধরেছেন। বাবার থেকে আমি অনেক বেশী বাস্তববাদী। আসলে পারিপার্শ্বিকতা আজ আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
বললেন–তোমাকে লোন দেবার ব্যাপারটা ভাবছি। কিন্তু ভাড়াটিয়া কে?
–চার্লস কোহন, কন্টিনেন্টাল সাপ্লাই কোম্পানীর এগজিকিউটিভ।
–ওদের চেন কি বিখ্যাত?
–হ্যাঁ স্যার।
এবার সত্যি সত্যি ম্যাক অ্যালিস্টার আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
লারা বলে চলল–এখানে ওরা একটা মস্ত বড়ো স্টোর করতে চায়।
শেষ পর্যন্ত ম্যাক বললেন–আগামীকাল সকালে এসো, ব্যাপারটা নিয়ে ভালোভাবে আলোচনা করতে হবে।
বেরিয়ে এল লারা, মনটা খুশীতে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। সে জানে, ম্যাক অ্যালিস্টারকে রাজী হতেই হবে। ভদ্রলোকের চোখে একটা লোভের ছায়া দেখতে পেল লারা।
সেদিন বিকেল বেলায় চার্লস কোহনের সঙ্গে দেখা করলেন সিন ম্যাক অ্যালিস্টার। নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি যে ওই বোর্ডিং হাউসের মালিক তাও জানালেন।
দুজনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল। সিন বললেন–আমার জমির ওপর বিল্ডিং করে তা আপনারা লিজ নিতে চান, কথাটা কি সত্যি?
–জায়গাটা চমৎকার। আমি ইতিমধ্যেই কথা বলে ঠিক করে রেখেছি। লারা মেয়েটি খুবই বুদ্ধিমতী, সে যদি বাড়িটা তৈরী করে তা হলে আপনি লাভবান হবেন।
–কিন্তু আমি তো জমিটা লারাকে বিক্রি করব না।
–তাহলে অন্য কোথাও বাড়ি তৈরী করাব। আরো তিনটে লোকেসন আমার দেখা হয়েছে, যে করেই হোক অফিসটা আমাকে করতেই হবে।
–আপনি কি সত্যি সত্যি এই কথা বলছেন।
–আমি কথার খেলাপ করি না ম্যাক অ্যালিস্টার।
–লারা কিন্তু বাড়ি তৈরীর বিষয়ে খুঁটিনাটি কিছুই জানে না।
–তা হলেও আমি চাইছি, কাজটা ও যেন পায়। ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত আন্তরিকতা আছে।
–ঠিক আছে মিস্টার কোহন, আমাকে একটু ভাবার সময় দিন।
–ঠিক আছে।
সিন ম্যাক অ্যালিস্টার ওখান থেকে চলে এলেন। চার্লস কোহনের মুখে মৃদু হাসি।
একটু বাদে লারা সেখানে এসে হাজির হল। সিনের সঙ্গে চার্লসের যা কথাবার্তা হয়েছে তাও সে শুনল, লারা বেশ কিছুটা ঘাবড়ে গেল।
–তাহলে কী হবে? দুরু দুরু বুকে লারা জানতে চাইল।
–চিন্তার কিছু নেই লারা, উনি শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গেই চুক্তি করবেন।
–তুমি ঠিক বলছো?
–নিশ্চয়ই, উনি একজন ব্যাঙ্কার, লাভ না দেখলে কখনো এই পথের পথিক হতেন না।
লারা এবার প্রশ্ন করল–আচ্ছা, কোহন, তোমার সঙ্গে আমার মাত্র কদিনের পরিচয় তুমি আমার জন্য এতটা চিন্তা করছো কেন?
সত্যিই তো, চার্লস কোহন নিজের এই আচরণে একেবারে অবাক হয়ে গেল। সে একজন পেশাদার মানুষ, কোম্পানীর উন্নতি সাধনই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এই প্রথম সে বোধহয় কোথাও তার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। এই প্রশ্নের কোনো জবাব কি আছে তার কাছে? আছে। তা হল, লারা সত্যি সুন্দরী, তাছাড়া তার বয়স কম, অনেকটা মেয়ের মতো সে।
মুখে চার্লস এসব কিছুই বলল না। সে বলল–লারা, আমার কিছুই হারাবার নেই। ইচ্ছে করলে আমি অন্য জায়গা দেখতে পারি। কিন্তু তুমি যখন এতটা চাইছো, আমি আন্তরিকভাবে ভাবছি ওই জায়গায় অফিস করলেই বোধহয় ভালো হয়। আমি কার সঙ্গে কী চুক্তি করছি, এ বিষয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তুমি যদি লোন পাও, তাহলে তোমাকেই আমি বিল্ডার হিসাবে নিযুক্ত করর।
লারার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। কোনোরকমে সে বলল–তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না। আমি আবার সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে দেখা করব।
চার্লস বলল–লারা, একটা পরামর্শ শুনবে। তুমি এখনই দেখা করতে যেও না। আমার মন বলছে, কদিন বাদে উনি নিজেই আসবেন তোমার কাছে।
–যদি না আসেন?
–আসবেন। কোহন হাসল। ছাপানো কাগজ বের করে লারার হাতে দিয়ে বলল এটা হচ্ছে, দশ বছরের লিজ নেওয়ার প্রিন্টেড পেপার। আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্র।
একগুচ্ছ ব্লুপ্রিন্ট লারার হাতে তুলে দিল সে। বলল–বাড়ি তৈরী করার যাবতীয় সব কিছু এখানে আছে।
সমস্ত রাত্রি ধরে লারা সব কিছু ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করল, বোঝার চেষ্টা করল। শেষ রাতে গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল যে।
পরদিন সকাল হয়েছে, সিন লারাকে ফোন করলেন। বললেন–এখন তুমি একবার আসতে পারবে?
এই কথা শুনে লারার হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠল। সে বলল স্যার, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি।
ফোনে ম্যাক বললেন–আমি তোমার ব্যাপারটা ভেবেছি, মিস্টার কোহনের কাছ থেকে দশ বছরের লিজের সই করা চুক্তিপত্রটা আমাকে একবার দেখতে হবে।
–সেটা আমি পেয়ে গেছি স্যার। ওই চুক্তিপত্রটা আমার হতেই আছে।
–এসো।
কুড়ি মিনিটের মধ্যে লারা হাজির হল ম্যাক অ্যালিস্টারের অফিসে। এগ্রিমেন্টের কপিগুলো দেখাল। নির্দেশনামা ভালোভাবে পড়লেন সিন।
লারা বলল স্যার, আমরা কি ব্যবসা আরম্ভ করতে পারি?
–না, ঘাড় নাড়লেন সিন।
এই কথা শুনে লারার মুখটা আবার ফ্যাকাশে হয়ে গেল, এই হল তার ভাগ্যের অদ্ভুত পরিহাস। হঠাৎ কখন হাজার আলোর ঝলকানি। পর মুহূর্তে শত শতাব্দীর ঘন অন্ধকার।
লারার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে সিন বললেন–সত্যি কথা বলতে কী লারা, জমিটা আমি বিক্রি করার কথা ভাবছি না। ওটার দাম যখন পরে আরো বাড়বে তখন ভাবব।
–কিন্তু অপনি তো?
–তোমার অনুরোধটা আমি ভেবেছি। তোমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবুও একটা শর্তে তোমাকে আমি লোন দিতে রাজী আছি।
–কী শর্ত? লারা আবার ঘাবড়ে গেল। কোনো কিছু বন্ধক রাখার কথা বলবেন নাকি উনি?
সিন বললেন–তোমার কোনো প্রেমিক আছে লারা?
এই মুহূর্তে এমন একটা প্রশ্ন শুনে লারা সত্যি সত্যি অবাক হয়ে গেল।
আমতা আমতা করে সে বলতে থাকে-না, কিন্তু এখন এসব কথা উঠছে কেন স্যার?
ম্যাক অ্যালিস্টার এবার কিছুটা ঝুঁকে এলেন লারার দিকে, বললেন–লারা শোনো, তোমাকে একটা কথা অনেক দিন ধরেই বলব-বলব করছিলাম কিন্তু কথাটা আমার ঠোঁটের গোড়ায় এসে আটকে গেছে। তুমি অসম্ভব সুন্দরী এবং আবেদনময়ী, কোনো পুরুষই তোমার আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারে না।
এ প্রশংসা শুনলে কোন মেয়ে না খুশী হয়?
লারা বলল–আপনি ঠিকই বলেছেন।
ম্যাক অ্যালিস্টার হাসলেন। এবার লারার চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি সোজাসুজি বললেন লারা আমি তোমাকে আমার শয্যাসঙ্গিনী করতে চাই। আশা করি, এতে তোমার আপত্তি নেই?
গম্ভীর হয়ে গেল লারা, সে বলল–আপনি এ কী বলছেন?
কাটা কাটা শব্দে সিন বললেন–শোনো লারা, পৃথিবীটা এইভাবে লেনদেনের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমি তোমাকে অতগুলো টাকা দেব, আর বিনিময়ে কিছু পাব না, তা কেমন করে হবে। কিছু পেতে গেলে তোমাকেও তো এগোতে হবে। তুমি তোমার আচরণের মাধ্যমে প্রমাণ করো যে, বাবার সঙ্গে তোমার অনেক তফাত আছে।
লারার মনে তখন দোলাচল তৈরী হয়েছে। কী আছে এই শরীরে, যার জন্য সব পুরুষরা তার দিকে লোভী চোখে তাকিয়ে থাকে? শরীর কি এঁটো হয়? ধুয়ে নিলে আবার সব আগের মতো পরিশুদ্ধ। তাই নয় কি?
সিন বললেন লারা, এই সুযোগ তোমার জীবনে দ্বিতীয় বার আসবে না। তুমি ভেবে। দেখো, এই একটা সুযোগ তোমার জীবনের গতি প্রকৃতিকে একেবারে পাল্টে দিতে পারে। তোমাকে আমি সময় দিচ্ছি।
লারা বলল–না, আমি সময় নেব না। আমি এখনই বলছি। আমি রাজী আছি।
তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সতীত্ব বিক্রি করে সে অনেক ডলার হাতে। পাবে। ধীরে ধীরে তার স্বপ্ন সফল করবে। এটাই তো তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, তাই নয় কি?
সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের চোখ দুটো তখন জ্বলে উঠেছে। তিনি লারার হাতে হাত দিলেন। চাপ দেবার চেষ্টা করলেন। তারা আহত অভিমানে বলল–না স্যার, এখনই নয়, আগে বিজনেস কনট্রাক্টটা সই হোক, তারপর।
কিশোরী মেয়ের এহেন বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে সিন অবাক হয়ে গেছেন। হ্যাঁ, এমন মেয়ের সাথেই পাঞ্জা লড়া সম্ভব।
.
পরের দিন সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের কাছ থেকে ব্যাঙ্ক লোনের চুক্তি পেয়ে গেল লারা। সিন বুঝিয়ে বললেন, শর্তটা খুবই সোজা, দশ বছরে শতকরা আট পারসেন্ট ইন্টারেস্ট। তোমাকে আমি দুশো হাজার ডলার লোন দিলাম। তুমি কনট্রাক্টের একেবার শেষ পাতায় একটা সই করে দাও।
লারা হাতে নিয়ে বলল–স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, আমি এটা ভালোভাবে দেখতে চাই।…এখন সময় নেই। আমি কি এটা নিয়ে যাব? কাল সকালে আপনাকে ফেরত দেব। আপনি রাজী তো?
সিন বললেন–ঠিক আছে, তারপর কণ্ঠস্বরটা নামিয়ে বললেন, আগামী শনিবার হ্যাঁলিফ্যাক্সে যাচ্ছি। আমি চাই, তুমি আমার সফর সঙ্গিনী হবে।
লারার সমস্ত শরীরে কেমন একটা শিহরণ, ঠোঁটে শুকনো হাসি এনে সে বলল ঠিক আছে, আমি যাব।
–তুমি কাল কনট্রাক্ট সই করে আমাকে ফেরত দিয়ে যেও। এরপর আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর ব্যবসায়িক সম্পর্ক চালু হবে। আমি তোমাকে একটা ভালো বিল্ডার দেব। নোভাসকটিয়া কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর নাম শুনেছো কি?
লারার চোখ দুটো জ্বলে উঠল–সে বলল, ওখনকার এক ফোরম্যান আমার চেনা। তার নাম বার্জ স্টিল।
–গ্রেস বে-তে বেশ কিছু বড়ো বড়ো বাড়ির সঙ্গে এই সংস্থা যুক্ত। আমি একটা কন্ট্রাক্ট করে দেব। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।
লারা বেরিয়ে এল। এই মুহূর্তে সে অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে। ফেলে আসা অতীতটাকে মন থেকে ভুলে যেতে হবে। এখন সে শুধু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করবে। কনট্রাক্ট নিয়ে লারা হাজির হল চার্লস কোহনের কাছে। সব কিছুই বলল। তবে একটা বিষয় বলতে পারল না। তা হল সিনের সঙ্গে তার যে গোপন চুক্তিটা হয়েছে, সেটা।
চার্লস ভালোভাবে কনট্রাক্টটা পড়ল। লারার হাতে ফেরত দিল। বলল–লারা, আমার পরামর্শ যদি শোনন, তাহলে তুমি এটাতে সই করো না।
লারা অবাক হয়ে বলল–কেন?
–কনট্রাক্টে একটা সাংঘাতিক শর্ত আছে। বলা হয়েছে একত্রিশে ডিসেম্বরের মধ্যে যদি তুমি বাড়িটা তৈরী করতে না পারো তাহলে তার মালিকানা ব্যাঙ্কের হাতে চলে যাবে। অর্থাৎ আমার কোম্পানী ম্যাক অ্যালিস্টারের ভাড়াটিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু ইন্টারেস্ট এবং লোনের পুরো অর্থ তোমাকে দিতে হবে। তুমি বলো, এই শর্তটা পাল্টাতে।
লারার বুক থেকে একট গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তার কেবলই মনে হল, লোভী নেকড়েদের মধ্যে সে বোধহয় এক অসহায় হরিণী।
সে বলল–যদি এই শর্তটা না বদলায়?
–তাহলে ব্যাপারটা বেশ ঝুঁকির হয়ে যাবে লারা। সময় মতে শেষ করতে না পারলে তুমি ওই বিরাট ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। তখন সারাটা জীবন হয়তো তোমাকে… কথা শেষ করল না কোহন।
লারা বললযদি ঠিক সময়ে বাড়িটা আমি তৈরী করতে পারি?
–অত সহজ নয়। তুমি এব্যাপারে একেবারে অনভিজ্ঞ, তুমি জানো না একটা বাড়ি তৈরী করতে গেলে প্রতি পদক্ষেপে কত বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সব ব্যাপারটা তো অন্যের ওপর নির্ভরশীল।
লারা বলল–সিডনিতে একটা নামকরা কনস্ট্রাকশন কোম্পানী আছে। আমি ওদের ফোরম্যানকে চিনি, যদি তিনি আমাকে আশ্বাস দেন, তাহলে আমি এগিয়ে যাব।
লারার মধ্যে একটা মরিয়া ভাব আছে দেখে কোহন আর কোনো কথা বলল না। সে বলল–ঠিক আছে, তুমি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারো।
সিডনিতে একটা ছতলা বাড়ি তৈরী হয়েছিল। সেখানেই বার্জ স্টিলকে পাওয়া গেল। বছর চল্লিশেক বয়স, পেটানো চেহারা, লারাকে ভালোভাবেই অভ্যর্থনা করলেন তিনি।
লারা সোজাসুজি বলল–আপনাকে একটা বাড়ি তৈরীর দায়িত্ব নিতে হবে মিস্টার স্টিল।
–তুমি তৈরী করাবে? পুতুল খেলার বাড়ি নাকি?
–না স্যার, এবার লারা চার্লসের দেওয়া ব্লুপ্রিন্টটা তার ফাইল থেকে বের করল। মিস্টার স্টিলের হাতে দিয়ে বলল, এই বাড়িটার নকশা।
বার্জ স্টিল নকশাটা ভালোভাবে দেখলেন। অবাক হলেন রীতিমতো। বললেন–এটা তো একটা বিরাট কাজ, তুমি এটা পেলে কোথা থেকে?
–সে কথা থাক, আমি আর আপনি দুজনে মিলে বাড়িটা তৈরী করব। এটা কিন্তু আমার বাড়ি।
–তাই নাকি? স্টিলের কণ্ঠস্বর বেশ মোলায়েম। লারা বলল–বাড়িটা কিন্তু একত্রিশে ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে হবে। বাড়ি তৈরীর খরচ এক লক্ষ সত্তর হাজার ডলারের বেশী হবে না।
বার্জ স্টিল কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন–ডিসেম্বর একত্রিশ। অর্থাৎ দশ মাস বাকি?
–আমি জানি, এর মধ্যে তৈরী করতে হবে।
বার্জ স্টিল ড্রইংটা দেখতে আরম্ভ করলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন–যদি এখনই কাজটা শুরু করতে পারো, তাহলে একত্রিশে ডিসেম্বরের মধ্যে বাড়িটা তৈরী হবে।
–করব। তার আগে আমাদের মধ্যে চুক্তিগুলো সেরে ফেলা দরকার।
দুজনে হাত মেলাল। বার্জ স্টিল বললেন–এতদিন পর্যন্ত যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, সত্যি কথা বলতে কী, তারা সবাই ছিল নীরস ব্যক্তিত্বের মানুষ। তুমি আমার সবথেকে আকর্ষণীয়া বস হতে চলেছে।
–ধন্যবাদ স্যার, কত তাড়াতাড়ি কাজটা আরম্ভ করতে পারবেন?
–আমি কালই গ্রেস বে-তে যাচ্ছি। আমি জায়গাটা দেখব। তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। একটা কথা বলতে পারি, বিল্ডিংটা গোটা শহরের গর্ব হয়ে উঠবে।
লারা বাইরে এল। মনে হল সে যেন ভারমুক্ত পাখির মতো আকাশে দুটি ডানা মেলে দিয়েছে।
গ্রেস বে-তে ফিরে চার্লস কোহনকে সমস্ত ব্যাপারটা বলল। চার্লস একটু গম্ভীর ভাবে জানতে চাইল–লারা, তুমি কি নিশ্চিত ওরা খুব বিশ্বাসযোগ্য কোম্পানী?
–হ্যাঁ, হ্যাঁলিভারস আর সিডনিতে ওরা অনেকগুলো বাড়ি তৈরী করেছে।
এবার আসল লড়াই শুরু হবে। সিন অ্যালিস্টারের পাথর কঠিন মূর্তিটা হঠাৎ লারার চোখে সামনে ভেসে উঠল। একটা অদৃশ্য কণ্ঠস্বর গমগমিয়ে উঠল চার পাশে। আগামী শনিবার আমরা একসঙ্গে হ্যাঁলিফ্যাক্সে যাচ্ছি।
আজ বুধবার। শনিবার হতে আর মাত্র দুটি দিন বাকি।
পরের দিন সকালবেলা লারা কনট্রাক্ট ফর্মে সই করল। সিন একভাবে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে, লারা চলে যাবার পর সিনের ঠোঁটের কোণে পরিতৃপ্তির হাসির রেখা ফুটে উঠল। ভাবলেন, যাক শেষপর্যন্ত ওই সুন্দরী মেয়েটকে তিনি সম্পূর্ণভাবে কজায় আনতে পেরেছেন। বাড়ি তৈরীর ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু লারাকে দেওয়া টাকাটা দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসবে, এব্যাপারে উনি সুনিশ্চিত।
সিন চোখ বন্ধ করলেন, লারার আবেদীন চেহারাটা তার চোখের তারায় ফুটে উঠল। আর মাত্র কিছুটা সময়, তারপর? তারপর যা ঘটবে তা ভাবতে ভাবতে সিনের সমস্ত পৌরুষ তখন আরও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে। দুধসাদা বিছানাতে দুটি নগ্ন শরীর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, এর থেকে আনন্দের মুহূর্ত আর কখনও আসবে কি?
এর আগে লারা দুবার হ্যাঁলিফ্যাক্সে এসেছে। গ্রেস বে শহরের সঙ্গে এই শহরের অনেক তফাৎ আছে। এই শহরটা ক্রমশ চারদিকে আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। রাস্তা পার হওয়া। খুব সমস্যা। দুপাশে অসংখ্য দোকান। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। শহরের এক প্রান্তে হোটেলে গিয়ে হাজির হলেন সিন ম্যাক অ্যালিস্টার। সঙ্গে লারা। সিনের গাড়িটা একেবারে আধুনিক মডেলের। মাঝমধ্যে তিনি গাড়ির মডেল পাল্টান। হোটেলের কিছুটা দূরে গাড়িটাকে পার্ক করে সিন বললেন, তুমি একটুখানি অপেক্ষা কর। আমি আসছি, তুমি গাড়িতেই বসে। থাকবে কিন্তু।
লারা গাড়ির মধ্যে বসেছিল। মনের মধ্যে একটা আতঙ্কের ছাপ, শেষপর্যন্ত নিজেকে সমর্থন করে বিড়বিড় করে বলে ওঠে–আমার উচ্চাকাঙ্খ পরিতৃপ্ত করতে আমি আমার শরীরকে বিক্রি করছি। এর মধ্যে অন্যায় কোথায়?
পরের মুহূর্তে তার মনে অন্য একটা অপরাধবোধ জেগে উঠল। পথচলতি বেশ্যার সঙ্গে তার কোনো তফাৎ আছে কি? কিন্তু? যে করেই হোক দুশশা হাজার ডলার তার চাই। তার বাবা এত বিশাল অর্থ জীবনে দেখেনি। ছোটো থেকে সে কি পেয়েছে? সকলের কাছ থেকে সীমাহীন অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। এখন যদি সে তার শরীরটা বিক্রি করে ভাগ্যের চাকাটা পাল্টাতে চায়, তাতে দোষের কিছু আছে কি?
চিন্তায় ছেদ পড়ে গেল, হাসি মুখে সিন দাঁড়িয়ে আছে। বললেন–নেমে এসো লারা, রুম পেয়ে গেছি।
লারার হঠাৎ মনে হল নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার, হৃদস্পন্দনের শব্দ সে বুঝি। শুনতে পাচ্ছে। তার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। লারার এই অভাবিত পরিবর্তনে সিন অবাক হলেন, অভিজ্ঞ মানুষ তিনি, বললেন–লারা তোমার কষ্ট হচ্ছে কি?
–না ঠিকই আছি, মুখে একটা সুস্মিত হাসির টুকরো আনার ব্যর্থ চেষ্টা করল। মনে মনে ভাবল, আমি মরে যাচ্ছি, আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। আমি পবিত্র শরীরে মরতে চাই। আমি বারবনিতা হতে চাই না!
শেষ পর্যন্ত লারা গাড়ি থেকে নেমে এল। সিনের সঙ্গে হাজির হল একটা কেবিনে।
বেশ বুঝতে পারল সে, এবার তার জীবনে কোন্ ঘটনাটা ঘটতে চলেছে। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করল সে। বুঝতে পারল একটা দুধসাদা বিছানা ঝড় তোলার। অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে একটা ড্রেসিং টেবিল, ছোট্ট একটা বাথরুম। দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক পেয়ে বসল লারাকে। মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বিছানাতে কোনোরকমে বসল।
ম্যাক অ্যালিস্টার চেয়ারে বসে বললেন, এই বোধহয় তোমার প্রথমবার তাই না লারা?
–হ্যাঁ। লারার মনে ভেসে উঠল পুরনো একটা ছবি। স্মৃতি বড্ড বেশি টানছে তাকে এখন। কিশোরী বয়সে স্কুলের একটা ছেলে ওর বুকে একবার চুমু খেয়েছিল। উরুর সন্ধিস্থলে হাত রেখেছিল। কিন্তু সেটা তো হঠাৎ আচমকা ঘটে গেছে। আজ? আজ ও নিজে থেকেই ধর্ষিতা হতে এসেছে!
লারার পিঠে হাত রাখলেন ম্যাক অ্যালিস্টার। তিনি বললেন–ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই, এই ব্যাপারটা খুবই সাধারণ। দেখবে পরে তোমার সব অভ্যেস হয়ে যাবে।
লারা অবাক চোখে তাকাল সিনের দিকে। সিন তখন পোশাক খুলতে ব্যস্ত। লারার দিকে তাকিয়ে তিনি জানতে চাইলেন–কি ব্যাপার? তুমি এখনও এভাবে বসে আছো কেন?
সিনের পরনে সংক্ষিপ্ত একটা পোশাক। লারা নিজেকে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত করতে থাকে। প্যান্টি আর ব্রা ছাড়া কিছু রইল না তার আবেদনময়ী শরীরে। তাকে এই অবস্থায় দেখে সিন একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। এত কামনা জেগে আছে ওর শরীরের খাঁজে খাঁজে।
অ্যালিস্টার আর স্থির থাকতে পারলেন না। উন্মাদের মতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন লারার নরম শরীরের ওপর। প্রথম মিলন, লারার দেহ মনে এক টুকরো সুখ নিয়ে এল না। সর্বগ্রাসী এক অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে লারা তখন এগিয়ে চলেছে, স্থির লক্ষ্যে অবিচল, যে করেই হোক ওই স্বপ্নের চাবিকাঠি তাকে মুঠোবন্দী করতেই হবে।
.
ষষ্ঠ অধ্যায়
চার্লস কোহন নোভাসকটিয়া কনস্ট্রাকশন কোম্পানীর তৈরী পাঁচটা বিল্ডিং দেখেছে। লারাকে সে বলল–লারা তুমি সঠিক লোককে নির্বাচন করেছে, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ওরা ভালোবেসে কাজটা করে। তুমি মিঃ স্টিলকে জায়গাটা দেখিয়ে দাও।
লারা মুচকি হেসে বলল ঠিক আছে।
চার্লস কোহন আর বার্জ স্টিলকে নিয়ে লারা ঠিক জায়গাতে গেল। সাইটটা পছন্দ হয়েছে মিঃ স্টিলের। তিনি বললেন–বাঃ, এটা চমৎকার! আগে থেকেই মাপজোক করা ছিল।
চার্লস কোহন তবু জিজ্ঞাসা করল–৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যে করেই হোক কাজটা কিন্তু শেষ করতে হবে।
মেয়েটাকে যেমন করেই হোক বাঁচাতে হবে, সিন ভীষণ চালাক, কায়দা করে শর্তের মধ্যে এমন একটা অসম্ভর ইঙ্গিত ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
বার্জ স্টিল বললেন–সম্ভবত তার আগেই হয়ে যাবে।
লারা অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করল–মিঃ স্টিল, আপনি কবে থেকে কাজ করতে পারবেন?
–পরের সপ্তাহের মাঝামাঝি। লারা বলল, আপনি একটু তাড়াতাড়ি করবেন কি?
লারার মুখে মৃদু হাসি, স্বপ্ন শেষপর্যন্ত বাস্তবের সরণী দিয়ে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলেছে।
নতুন বিল্ডিং লারাকে একটা অন্য জগতে নিয়ে যাবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রত্যেকদিনই সে একবার করে সাইটে আসে। যতদিন যাচ্ছে ততই সে আরও বেশি অভিজ্ঞা হয়ে ওঠে। লারার স্বপ্নে এবং জাগরণে এখন শুধু ওই বাড়িটা। শুধু ওইটা নয়, একদিন সে শখানেক বাড়ি তুলবে শহরের বিভিন্ন জায়গাতে। মনের এই কথাটা বলল চার্লসকে। চার্লস তার কথা শুনে একেবারে অবাক হয়ে গেছে। চার্লস জানে, লারা যেভাবে এগিয়ে চলেছে, আজ অথবা আগামীকাল তার এই আপাত অসম্ভব স্বপ্নটা সফল হবে।
দুদিনের মধ্যে জমি মাপার কাজ শেষ হয়ে গেল, তিনদিনের দিন সকালবেলা আর্ট মোবিন রিক্রুইটমেন্ট বোল্ডার এসে গেল। সার্ভেটার ভালই ছিল, বার্জ সাইটে ছিলেন। তদারকির কাজ শুরু হয়ে গেল। বাড়ি তৈরীর প্রথম পর্যায়ের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।
বোর্ডিং হাউসের লোকেরা ব্যাপারটা ভালোভাবে জেনে গেছে। লারার মুখে সাফল্যের হাসি, তারা লারার এই ভাগ্যের পরিবর্তনে খুবই উল্লাসিত। ডিনারের আসরে সবার মুখে মুখে এই কথা ফিরতে থাকে। তারা সকলে লারার কাছ থেকে খুঁটিনাটি বিষয় জানতে ইচ্ছুক। বাড়ি তৈরীর ব্যাপারে যে যতটা অভিজ্ঞ, অবিরতভাবে সেই অভিজ্ঞতা দান করছে লারাকে। প্রত্যেকটা দিন লারার কাছে একটা নতুন সূর্য সঙ্গে নিয়ে আসে। দেখতে দেখতে দুসপ্তাহ কেটে গেল। তারপর লারার চোখের সামনে দেখা দিল স্বপ্নের ওই বাড়িটা, লারা বিশ্বাস করতে পারছে না। এই বাড়িটা তারই মালিকাধীন থাকবে। এমন একটা অসম্ভব স্বপ্ন তাহলে সফল হচ্ছে?
অনেকের চোখে এই বাড়ি প্রাণহীন ইট কাঠ পাথরের সমাবেশমাত্র। কিন্তু লারার চোখে এটি ছিল স্বপ্নের একটা মন্দির। প্রত্যেকদিন সকাল এবং সন্ধ্যেবেলা নিয়ম করে সে ওই বাড়িটাতে যেত। মনে মনে ভাবতো এটা একেবারে আমার।
এর পাশাপাশি অবশ্য একটা দুঃখ কাটার মতো খচখচ করতে তার মনের ভেতর। ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের পর প্রতি মুহূর্তে তার আশঙ্কা ছিল সে হয়তো গর্ভবতী হয়ে উঠবে। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ তা হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। লারা নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস ফেলল।
সিন ভাড়াগুলো যথারীতি তুললেন। তখন লারার থাকার ব্যাপারটা খুবই জরুরী হয়েছে। ম্যাক অ্যালিস্টারের মুখোমুখি হতে সে চাইছে না। কৃত্রিম গাম্ভীর্য বজায় রেখে লারা দেখা করল ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে। ম্যাক লারাকে দেখে খুবই খুশি হলেন। বললেন–লারা আমরা আরও একবার হ্যাঁলিফ্যাক্সে যাব তাই নয় কি?
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, লারা এখন অতি সহজেই কামুক পুরুষের চোখের ভাষা পড়তে পারে। কিন্তু অ্যালিস্টারকে চটিয়ে লাভ নেই। দুকূলে নৌকা ভেড়ানোর চেষ্টা করে সে বলল–আমি তো এখন বাড়ি তৈরীর কাজে খুবই ব্যস্ত। কথাটা ঠিক, বাড়ি তৈরীর ব্যাপারটা শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। সিটমিটার লাগানোর কাজ বাকি আছে, ছাদ জানলা এসব হয়নি। লারা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল, শুনে সিন আর যাবার জন্য চাপ দিলেন না। যাক বাবা। আপাতত বাঁচা গেছে, লারা ভাবল। চার্লস কোহন বোর্ডিং হাউস থেকে চলে গেছে। তবে প্রত্যেক সপ্তাহে সে ফোন করে বাড়িটা কতদূর এগোচ্ছে সে বিষয়ে খবর নিত। লারার সবথেকে আনন্দ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাড়িটা তৈরী হয়ে যাবে। চার্লসকে সে একথা জানিয়ে দিয়েছে। চার্লস জানিয়েছে লারা যে শেষপর্যন্ত একটা অসম্ভব স্বপ্নকে বাস্তব করেছে তাই চার্লস খুবই খুশি।
লারার সঙ্গে সিন ম্যাক অ্যালিস্টার একাধিকবার বিল্ডিং সাইটে হাজির হয়েছেন। তিনিও ভাবতে পারেন নি এত সহজে লারা সবকিছু সামাল দিতে পারবে। তিনি বললেন, তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে আমি পারছি না।
তিনি আন্তরিকভাবে খুশি হয়েছেন, অন্তত লারার তাই মনে হল। চার্লস ম্যাক অ্যালিস্টারের ব্যাপারে একটু বেশি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সিন এখনও পর্যন্ত এমন কোনো কাজ করেননি যাতে লারার মনে হতে পারে যে তিনি সন্দেহ পরায়ণ। তিনি লারার দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না।
.
নভেম্বর শেষ হয়ে এল, বাড়িটা শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। জানলা আর দরজা বসানোর কাজ একেবারে শেষে। বাইরের দেওয়াল তৈরী হয়ে গেছে, এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের সোমবারে কাজের গতি সামান্য কমে গেল। লারা সঙ্গে সঙ্গে সাইটে হাজির হল। সকাল বেলা মাত্র দুজন লোকে রয়েছে। তারাও খুব ধীরে ধীরে কাজ করছে। লারা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার, হঠাৎ কাজের গতি কমে গেল কেন?
একজন বলল–সব লোকেরা অন্য জায়গাতে কাজ করতে গেছে, কাল ফিরে আসবে।
পরের দিন আরো শোচনীয় অবস্থা, লারা গিয়ে দেখল একজনও আসেনি। ব্যাপারটা লারার কাছে মোটেই ভালো বলে মনে হল না। সে বুঝতে পারল কোথাও একটা ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে। তবে কি অ্যালিস্টারের কালো হাত? কিন্তু কেন? লারা তো তার কথা মতো সবকিছু করেছে। পবিত্র শরীরটাকে অপবিত্র করেছে। বাসে চড়ে এসে হাজির হল সে হ্যাঁলিফ্যাক্সের বাস ডিপোর কাছে। মিঃ স্টিল অফিসেই ছিলেন, তিনি লারাকে দেখে বললেন–এসো লারা, ভেতরে এসো।
লারা জানতে চাইল–কি হয়েছে, কাজ বন্ধ কেন?
মিঃ স্টিল হেসে বললেন–এত চিন্তার কি আছে? আমরা অন্য একটা কাজ হঠাৎ পেয়ে গেছি। সে জন্য ওখানকার কাজে একটু ঢিলে দিতে হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই।
–কবে কাজ আরম্ভ হবে?
–পরের সপ্তাহে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তোমার কাজটা শেষ করবো। তুমি এব্যাপারে একদম চিন্তা কোরো না।
–আপনি কি জানেন মিঃ স্টিল, একেকটা দিন আমার কাছে এক একটা বছরের সমান।
–নিশ্চয়ই আমি জানি।
লারা আবার বলে উঠল–আপনি তো জানেন চুক্তিপত্রে লেখা আছে ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে বাড়িটা তৈরী না হলে আমি সবকিছু হারিয়ে ফেলবো। জীবনটা আমার একেবারে শেষ হয়ে যাবে। তাই আশা করি আপনি আমার কথার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন।
বার্জ স্টিলকে দেখে মনে হল তিনি যেন একেবারে মোমের মানুষ। তিনি মোলায়েমভাবে হেসে বললেন–না, চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমি কথা দিচ্ছি এ ঘটনা কখনই ঘটবে না।
লারা বোর্ডিং-এ ফিরে এল। দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। পরের সপ্তাহে লারা দেখল কাজ এতটুকু এগোেয় নি। শ্রমিক কর্মচারীরা কোনো অজ্ঞাত কারণে । কাজে আসছে না। লারা হ্যাঁলিফ্যাক্সে গেল বার্জ স্টিলের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু মিঃ স্টিল ছিলেন না। সেক্রেটারীকে জিজ্ঞাসা করা হল উনি কোথায় গেছেন।
সেক্রেটারী জবাব দিলদুঃখিত মিঃ স্টিল এখানে নেই, বিশেষ একটা কাজে উনি বাইরে গেছেন। এখন কদিন আসবেন না।
এই প্রথম লারার মনে হল চারপাশ যেন অন্ধকারে ভরে গেছে। সাফল্যের কাছাকাছি, এসে এইভাবে সে পা হড়কে পড়ে যাবে নাকি? লারা বার বার বলতে লাগল—আমার কাছে এখন জীবন মরণের সমস্যা। মিঃ স্টিল যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটা শেষ করতে না পারেন তাহলে আমি একেবার পথের ভিখারী হয়ে যাব। লারাকে এইভাবে অসহায় আর্তনাদ করতে দেখে সেক্রেটারী হেসে ফেলল। তারপর বলল–মিস ক্যামেরন, আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনি জানেন না আমাদের বস কি ধরনের মানুষ। তিনি কখনও কথার খেলাপ করেন না।
লারা ধরা গলায় বলল–কিন্তু কাজ তো এখনও আরম্ভই হয়নি!
–অত ভাবছেন কেন? আপনি মিঃ স্টিলের অ্যাসিস্ট্যান্টের সঙ্গে দেখা করুন, উনি সব ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
–নাম কি ভদ্রলোকের?
–এরিকসেন, সেক্রেটারী বলল। লারা তার কাছে হাজির হল। উনি মোটা সোটা চেহারার বেঁটে মানুষ।
লারা তার কাছে হাজির হতে তিনি বললেন–আমি জানি আপনি এখানে কেন এসেছেন। কিন্তু চিন্তার কোনো কারণ নেই। মিঃ স্টিল আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। আমরা আপনার প্রজেক্টের কাজ সামান্য থামিয়ে রেখেছি। আবার শুরু করবো। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের আগে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আপনার বিল্ডিং শেষ হতে আর মাত্র একুশ দিন লাগবে।
–কিন্তু এখনও অনেকখানি কাজ বাকি আছে।
–আবার বলছি, ভাবনার কিছু নেই, আপনি মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করছেন। লারা বলল–ধন্যবাদ মিঃ এরিকসেন, আপনাকে বিব্রত করার জন্য আমি ভীষণভাবে দুঃখিত। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি এখন কি মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে সময় কাটাচ্ছি। আমার খুবই নার্ভাস লাগছে। আসলে এটা তো আমার কাছে একটা বাড়ি শুধু নয়, আমার জীবন মরণের ব্যাপার।
লারার কণ্ঠস্বর ভেঙে গেছে। মিঃ এরিকসেন লারাকে আশ্বস্ত করে বললেন–চিন্তার কোনো কারণ নেই, আপনি এখনই বাড়ি ফিরে যান। সব ঠিকমতো হয়ে যাবে।
লারা মিঃ এরিকসেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরে এল। তখনও পর্যন্ত আশঙ্কাটা । রয়ে গেছে ওর মনের মধ্যে।
লারা শুনেছিল পরের সোমবার আবার কাজ আরম্ভ হবে। কিন্তু সোমবার ভোরবেলা লারা সাইটে গিয়ে দেখল কাজ শুরু হয়নি। একজনও শ্রমিক কাজে আসেনি। লারার তখন উন্মাদের মতো অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে চার্লস কোহনকে সে ফোন করল। চার্লসের কণ্ঠস্বর ভেসে এল–কি ব্যাপার লারা? তোমার গলা এত শুকনো লাগছে কেন? এনি প্রবলেম?
লারা বলল–জানো চার্লস, ওরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে বার বার আশ্বাস দিচ্ছে, কিন্তু প্রত্যেকবার সেই আশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে।
–ব্যাপারটা বেশ ভাববার তো, চালর্স বলল–শোনো লারা, ওদের কোম্পানীটার নাম যেন কি? নোসকটিয়া কনস্ট্রাকশন তাই তো?
–হ্যাঁ, বলল লারা।
ফোনে কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ঠিক আছে, সবকিছু খতিয়ে দেখে তোমাকে ফোন করছি।
লারা রিসিভার নামিয়ে রাখল। এই প্রথম তার শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের একটা শিহরণ প্রবাহিত হল। বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুকের ভেতর থেকে। সে শুয়ে পড়ল বিছানাতে। কেন এই ঘটনা ঘটছে কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না। দু-ঘন্টা বাদে রিসিভার বেজে উঠল। চার্লসের ফোন। চার্লস কোহন লারাকে জিজ্ঞাসা করল–আচ্ছা এই কোম্পানীর নাম কে তোমাকে রেকমেন্ড করেছে? কার প্রস্তাব বলো তো?
–প্রস্তাবটা সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের ছিল।
এবার চার্লসের কণ্ঠস্বর ভেসে এল–আমি অবাক হইনি, এই কোম্পানীটা উনিই কিনেছেন।
খবরটা শুনে লারার মনে হল তার পায়ের নীচ থেকে মাটি বুঝি সরে গেছে। পৃথিবীর ভেতর সে ঢুকে যাচ্ছে। ঘোর লাগা স্বরে সে বলল–তাহলে উনি কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। যাতে ঠিক সময় মতো কাজটা শেষ হতে না পারে, তাই তো?
চার্লসের কণ্ঠস্বর ভেসে এল–আমারও তাই ধারণা।
–হায় ভগবান, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লারা।
চার্লস তখনও বলে চলেছে-শোনো লারা, সিন ম্যাক অ্যালিস্টার লোকটা মোটেই ভালো নয়। মুখে ভালো ব্যবহার করেন, অন্তরে বিষ, উনি একটা কেউটে সাপের মতো।
আবার লারাকে সে বলল–আর ভেবো না, চাকা ঘুরে তোমার দিকে যাবে, তোমার, স্বপ্ন বাস্তব হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে এ যাত্রা বোধহয় তোমাকে সমস্যায় পড়তে হবে।
–আমি যে তাহলে পাগল হয়ে যাব।
চার্লস কোহন আর কি বলবে? নিজেকেই ভীষণ অসহায় বলে মনে হল তার। লারাকে অন্তত সতর্ক করে দিতে পেরেছে, সেটাই তার সবথেকে বড় সান্ত্বনা। সিন ম্যাক অ্যালিস্টার কোনো কথাই শুনবেন না, চার্লস তবু বলল–আমি আবার তোমাকে ফোন করবো, এখন এত ভেঙে পড়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।
লারা মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে লাগল। একটা অনিশ্চয়তার সামনে তাকে দাঁড়াতে হয়েছে। সমস্ত রাত্রি লারার চোখের তারায় ঘুম আসতে পারল না। এলোমেলো নানা চিন্তা ওর মনকে আক্রমণ করেছে। সত্যি সত্যি যদি ঠিক সময় মতো বাড়িটা তৈরী না হয় তাহলে কি হবে? তাহলে ওকে এমন দেনার মুখে পড়তে হবে যে দেনা ও সারাজীবনে শোধ : করতে পারবে না। এর থেকে কঠিন শান্তি আর কল্পনা করা যায় না। লারার চোখে জল এসে গেল। অসহায় লাগছে নিজেকে। অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে লারা ভাবল, পৃথিবীর সব লোক এত বেইমান কেন? ·
কাঁদতে কাঁদতে শেষপর্যন্ত তারা যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বেচারী নিজেই জানে না। ঘুম ভাঙতে তার মনে হল এখুনি সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের কাছে যেতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সে সিনের কাছে গিয়ে হাজির হল। সিন বোধহয় এই অপেক্ষাতেই বসেছিলেন। তিনি বললেন–বাঃ লারা, তোমাকে তো দারুণ সুন্দরী লাগছে আজকে। আজ তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি ব্যাপার সুন্দরী, এই সাত সকালে আমার কাছে কি মনে করে?
–আমি আপনার কাছে এসেছি একমাস সময় নিতে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে ৩১ শে ডিসেম্বর সোমবারের মধ্যে কাজটা শেষ করতে পারা যাবে না।
লারার কথা শুনে ম্যাক অ্যালিস্টারের মুখমন্ডল লাল বর্ণ ধারণ করল। উনি ভুরুটা কুঁচকালেন। বিরক্তির ছাপ সুস্পষ্ট। তিনি বললেন–খবরটা খুবই খারাপ।
–আমি আরও একটা মাস সময় চাই।
ম্যাক অ্যালিস্টার বললেন আমার তো মনে হচ্ছে তা সম্ভব নয়। তুমি কি জানো লারা, কনট্রাক্টে তুমি সই করেছে। এ ব্যাপারে আমি কোনো দর কষাকষি করতে ভালোবাসি না। এটা একটা ব্যবসা সেটা আশাকরি মনে রাখবে।
–কিন্তু।
–দুঃখিত লারা, ৩১ তারিখে এটা ব্যাঙ্কের হাতে চলে যাবে। আমার কিছু করার নেই। লারা প্রতিবাদ করতে পারল না, সে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল।
বোর্ডিং হাউসের সকলের কানে এই অশুভ সংবাদটা পৌঁছে গেছে, তারাও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছে। তারা রাগে ফেটে পড়ল। কেউ কেউ ম্যাক অ্যালিস্টারকে গালগাল দিতে শুরু করল। লারা তখন শরীর ও মনের দিক থেকে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বোর্ডারদের একজন বলল–হারামজাদা এটা কিছুতেই করতে পারে না।
–কিন্তু করেছে, লারা বুক চাপড়ে বলে আমার সব শেষ হয়ে গেল, আমি এখন কিভাবে দিন কাটাবো বুঝতে পারছি না।
একজন বোর্ডার বলল–আমরা সবাই মিলে যদি ওঁর কাছে যাই তাহলে কি কিছু হবে?
লারা বলল–আর কিই বা হবে? মাত্র আড়াই সপ্তাহ বাকি আছে।
একজন বোর্ডার বলল–আচ্ছা, একবার সাইটে গিয়ে বিল্ডিংটা দেখে আসবো কি?
সবাই সাইটে গেল, সত্যিই তো, বাড়িটা শেষ হতে অনেক টুকিটাকি কাজ বাকি আছে। ডিসেম্বরের ঠান্ডায় সকলে ঠকঠক করে কাঁপছিল, সেসব উপেক্ষা করে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল, কিন্তু সমস্যা সমাধানের কোনো পথ বের করা গেল না। লারার তখন কথা বলার মতো অবস্থা নেই। তার পরিচিত একজন বোর্ডার বলল–তোমার লোকটা সত্যিই খুব ধূর্ত ব্যাঙ্কার। বাড়ি তো প্রায়ই শেষ হয়ে এসেছে। এখন সে পাল্টা চাল খেলে তোমাকে হারাবার চেষ্টা করছে। তবে…।
–তবে কি?
বোর্ডাররা বলল–আড়াই সপ্তাহ বাকি আছে। আমি বলছি বাড়িটা এখন যে অবস্থায় আছে, সকলে মিলে চেষ্টা করলে আড়াই সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
বাকি সকলে সমস্বরে সায় দিল, লারা তখনও পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছে না কিভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। সে আমতা আমতা করে বলল–তোমরা কেউ ঠিকমতো বুঝতে পারছে না কেন? আমার সমস্যাটা যে কত গভীর? মিস্ত্রীরা কাজে না এলে আমি কি করবো?
–শোনো লারা, এই বাড়িটার কিছু কাজ এখনও বাকি। জল, গ্যাস এসবের পাইপ বসানা হবে। ইলেট্রিকের কাজ আর কিছু কাঠের কাজ। ওরা না এলেও ক্ষতি নেই। আমাদের বেশ কিছু লোকজন এখানে আছে যারা এসব কাজ করতে পারে। তারা অনায়াসে এসব কাজগুলো করতে পারবে।
লারা তখন একেবারে ভেঙে পড়েছে, সে অসহায় হয়ে বলল–আমি তোমাদের কোনো পয়সা দিতে পারবো না। ম্যাক অ্যালিস্টার আমাকে খরচের অর্থ দেবেন না। কারণ…
–আমরা দেবো, বোর্ডাররা সমস্বরে বলল, মনে করো এটা আমাদের ক্রিসমাসের উপহার।
খবরটা একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে গেল। গ্রেস বে শহরের সকলের কানে পৌঁছে গেল এই শুভ সংবাদ। অন্যান্য জায়গার কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কাররা এসে বাড়িটা দেখতে লাগল। তাদের মধ্যে অর্ধেকই লারাকে পছন্দ করে। বাকি অর্ধেক ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, কিন্তু ম্যাক অ্যালিস্টারকে কেউ ভালোবাসে না। থেমে থাকা কাজ আবার জোর কদমে শুরু হল।
সকলেই ম্যাক অ্যালিস্টারকে গালগাল দিচ্ছিল। এতদিন নিস্তব্ধ জায়গাটা আবার শ্রমিকদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠল। কাজের নেশা সবাইকে পেয়ে বসেছে। এটা ওদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। নির্দিষ্ট সময়ের আগে বাড়িটা শেষ করতেই হবে। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের কানে গেল। রাগে চিৎকার করতে করতে তিনি সাইটে, এলেন। তখন কাজ চলছিল। তিনি চিৎকার করে বললেন–এসব কি হচ্ছে? এরা তো কেউ আমার লোক নয়।
লারা দাঁড়িয়েছিল, লারা বলল ঠিকই বলেছেন, এরা আমার লোকজন, কনট্রাক্টে এমন
কোনো শর্ত নেই যা আপনার লোক দিয়েই বাড়িটা শেষ করতে হবে।
–ঠিক আছে, কিন্তু আমি দেখে নেবো সবকিছু ঠিকমতো হয়েছে কিনা, একটা বাজে বাড়ি কিন্তু আমি কখনই নেবো না।
–তাই করবেন, লারা দৃঢ়স্বরে বলল।
সিন প্রচণ্ড রেগে গেছেন, কিন্তু মনের ক্ষোভ আর রাগকে চেপে রাখতে বাধ্য হলেন তিনি। বাড়িটা শেষ পর্যন্ত শেষ হচ্ছে, এই ঘটনাটাকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
শেষ পর্যন্ত কাজটা শেষ হয়ে গেল। গর্বিতা রূপসীর মতো আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলো ওই স্বপ্নের মানসকন্যা। লারার দুচোখে তখন মুগ্ধতা এসেছে। মুখে কোন কথা বলতে পারছে না সে।
সেই রাতে সমস্ত বোর্ডারকে নিয়ে একটা সুন্দর পার্টি দিয়েছিল লারা। শুধু বোর্ডাররা নয়, যে সমস্ত মিস্ত্রী মজুররা কাজ করেছে, সকলকেই সে পার্টিতে আমন্ত্রণ জানালো। এটা লারা ক্যামেরনের তৈরি প্রথম বাড়ি। লারা এই প্রথম বুঝতে পারল এই শহরের লোকজন তাকে কতখানি ভালোবাসে। কিন্তু বিপদের মুখে না পড়লে আমরা এসব অনুভূতিগুলো উপলব্ধি করতে পারি না। লারা বুঝতে পারল, এবার সে দৃঢ় পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এতবড় বাধাকে অতিক্রম করতে পেরেছ, ভবিষ্যতে আর কোনো সমস্যা তাকে থামাতে পারবে না।
.
এরপর থেকে সত্যি সত্যি লারাকে আর থামতে হল না। ওর মনের ভেতর নানারকম পরিকল্পনা ভেসে উঠেছে। চালর্স কোহনের সঙ্গে দেখা করল ও। চার্লস তো আনন্দে অভিভূত। এইভাবে যে ব্যাপারটা শেষ হবে চার্লস তা ভাবতে পারেনি।
লারা বলল–চার্লস তোমার নতুন কর্মচারীদের একটা বাসস্থানের প্রয়োজন আছে এই শহরে। আমি ওদের জন্য একটা বাড়ি তৈরি করতে চাই, তোমার আপত্তি নেই তো?
–না না, তোমার কাজে আমি খুব উৎসাহী। চার্লস কোহন তার সবথেকে কাছের বন্ধু, লারা সেই গোপন সত্যটা বুঝে গেছে। লারা সিডনিতে একজন ব্যাঙ্কারের সঙ্গে দেখা করল। নতুন একটি প্রজেক্ট নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করল। প্রয়োজন মাফিক অর্থ পেতে এখন লারার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ তার তৈরি করা ওই বাড়িটার গর্বগাথা সকলেই জেনে গেছে। একটির পর একটি বাড়ি তৈরি হবার পর তারা একদিন চার্লসকে বলল–চার্লস, তুমি বলতে পারো এই শহরে আর বাড়ি তৈরি করতে হবে?
চার্লস বলল–এখানে গরমকালে অনেক ট্যুরিস্ট আসে মাছের জন্য। আমরা যদি খাঁড়ির কাছে একটা সুন্দর ট্যুরিস্ট হোম তৈরি করি তাহলে কেমন হবে? তাহলে মনে হয় তোমার দুপকেট উপচে পড়বে।
প্রস্তাবটা লোভনীয় এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরের তিন বছরের মধ্যে লারা আরেকটি অফিস বিল্ডিং তৈরি করল, সমুদ্র সৈকতের ধারে বেশ কয়েকটি কটেজ আর একটা শপিং ম্যাল। অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশি সাহায্য করল সিডনি আর হ্যাঁলিফ্যাক্সের ব্যাঙ্কগুলো। তারাও খুশি লারার মতো এক তরুণী কন্যার এই অভাবনীয় উদ্যমে।
এরপর দু-বছর কেটে গেছে, তারা এখন রিয়েল এস্টেটের পুরো বিল্ডিংটা কিনে নিয়েছে। ইতিমধ্যে সে তিন মিলিয়ন ডলারের মালিক। তার বয়স এখন একুশ বছর।
হঠাৎ একদিন সকালে গ্রেস বে-কে বিদায় জানিয়ে লারা রওনা হল চিকাগোর উদ্দেশ্যে।
.
সপ্তম অধ্যায়
চিকাগো একটি আনন্দ উজ্জ্বল শহর। প্রবাদ আছে এই শহরের সূর্য কখনও অস্ত যায় না। লারা এই জীবনে যে কটা শহর দেখেছে তার মধ্যে হ্যাঁলিফ্যাক্স সবথেকে বড় শহর। তবে হ্যাঁলিফ্যাক্সের সঙ্গে চিকাগোর কোনো তুলনা হয় না। চিকাগোর সঙ্গে একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা স্তরীভূত হয়ে আছে। শহরের লোকজনেরা হৈ-চৈ করতে এমনিতে খুবই ভালোবাসে, কিন্তু হঠাৎ তারা চুপ হয়ে যায়। সেখানে মলিন রাত নামে অন্ধকারের ঘোমটা মুখে লাগিয়ে।
লারা সেখানকার স্টিভোস হোটেলে হাজির হল। লবিতে এক সুসজ্জিত এবং স্মার্ট মহিলার সঙ্গে দেখা হল। লারা বুঝতে পারলো এই মহিলার খুবই আত্মবিশ্বাস। পোশাক আশাক খুবই জমকালো। |||||||||| -লারা অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়াল নিজের ইচ্ছে মতো। পোশাকের ডিজাইন জুতো গয়না সবকিছুই পছন্দ হল তার। কিনেও ফেলল কিছুটা। শেষপর্যন্ত ভাড়া করা স্যুইটে ফিরে এল।
টেলিফোন গাইড থেকে রিয়েল এস্টেটের ব্রোকারদের নাম খুঁজল। একটা নাম বার বার ওর চোখে ভেসে উঠল। পার্কার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। লারা টেলিফোন করে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে ও প্রান্তে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল–কাকে চাই?
–আমি কি মিঃ পার্কারের সঙ্গে কথা বলতে পারি?
লারা মোলায়েম কণ্ঠস্বর ভাসিয়ে দিল।
ওপ্রান্তে শোনা গেল–ওকে আমি কি নাম বলব?
–লারা ক্যামেরন।
কয়েক মিনিট পরে একটা ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এল আমি ব্রুস পার্কার কথা বলছি। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?
–আমি এখানে একটা চমৎকার লোকেসন খুঁজছি, সেখানে নতুন ধরনের হোটেল করতে চাইছি।
–বেশ তো, আমরা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ মিস ক্যামেরন।
–ঠিক আছে, তাহলে কখন দেখা করা যাবে?
মাঝপথে মিঃ পার্কার বললেন, আমি আপনাকে কিছু ভালো জমির সন্ধান দিতে পারি। আপনি জানান কি ধরনের জমি আপনার পছন্দ। কতটা পরিমাণ অর্থ আপনি খরচ করতে পারবেন।
লারা বলল, তিন মিলয়ন ডলার।
ওপ্রান্তে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর প্রশ্ন–তিন মিলিয়ন?।
–হ্যাঁ।
–আপনি কি এখন নতুন ধরনের হোটেল করতে চলেছেন?
–হ্যাঁ।
আবার নীরবতা, তারপর পার্কারের ভরাট কণ্ঠস্বর শোনা গেল–শহরের ভেতরের দিকে কোনো বাড়ি বা জমি হলে চলবে কি?
লারা বলল–না, আমি ঠিক তার উল্টোটাই ভেবেছি। আমি একটা ভালো জায়গায় হোটেল করতে চাই। সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের।
–তিন মিলিয়ন ডলারে, মিস ক্যামেরন, এব্যাপারে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না।
লারা রিসিভারটা রেখে দিল, সম্ভবত কোনো ভুল ব্রোকারকে ও ফোন করেছে। আবার গোটা ছয়েক নাম ঠিক করল। সবাইকে ফোন করে ও বাস্তব একটা ছবি আঁকল ওর মনের ক্যানভাসে। কেউ তিন মিলিয়ন ডলারে কাজ করতে রাজি নয়। মাঝেমধ্যে অনেকে লারাকে উল্টোপাল্টা পরামর্শ দিল। অর্থাৎ এই টাকায় কেন ওরা রাজি হচ্ছে না? লারার কেবলই মনে হচ্ছে, আরও সস্তায় সুন্দর একটা হোটেল তৈরি করা সম্ভব। অনেক ভেবেচিন্তে লারা ঠিক করল ও আবার গ্রেস বে-তেই ফিরে যাবে। মাসের পর মাস লারা কেবল একটা স্বপ্ন দেখে চলেছে, শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে একটির পর একটি বাড়ি তৈরি করবে। এবার তার স্বপ্ন অত্যন্ত দ্রুত সফলতার পথে এগিয়ে চলেছে। একটা ভালো প্রবাদ আছে সেটা হল a real home away from home. নিবাস থেকে দূরে অতিথি নিবাসের ব্যাপারটা কি লারা তা জানে। কি কি ব্যবস্থা থাকলে একজন মানুষ বিদেশে গিয়েও নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে, সেই ব্যাপারটাও লারা শিখে নিয়েছে। এমনকি একটা বাড়িতে কোথায় পিয়ানো রাখতে হবে, তাও লারা জানে। এবার লারা নিজের নামে শখানেক কার্ড ছাপালো, তাতে লেখা আছে মিস লারা ক্যামেরন। তার নিচে নিজের পরিচয় দিয়েছে ডেভলপার। সন্ধ্যেবেলা লারা ছাপানো কার্ডগুলো পেয়ে গেল। এবার থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ ফেলতে হবে। মিচিগান এ্যাভিনিউ সমেত আরও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দোকান থেকে চিকাগো বিষয়ে একটা বই কিনলো। এই শহরে যাদের বড় বড় বাড়ি আছে, তাদের নাম ঠিকানা লেখা আছে ওই বই-এর মধ্যে, লারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নামগুলি দেখল। বিভিন্ন দেশের মানুষরা এখানে বাস করে। গ্রেস বে যেমন ঠিক তেমনই। সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, বেসবন থেকে এসেছে তারা। লারা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় দেখতে পেল একটা জায়গাতে একটা ফর সেল বোর্ড লাগানো আছে। সঙ্গে সঙ্গে ও এক ব্রোকারের সঙ্গে যোগাযোগ করল আর ওই বাড়িটার দাম জানতে চাইল।
ব্রোকার বলল, আশি মিলিয়ন ডলার।
এবার আরেকটি ব্রোকারের সঙ্গে তার দেখা হল। সেও একটা বাড়ির খবর দিল, দাম ষাট মিলিয়ন ডলার, আরেকটা একশো মিলিয়ন ডলার। আর জানতে ইচ্ছে হল না লারার। কারণ ওর কাছে মাত্র তিন মিলিয়ন ডলার আছে।
সরাসরি সে হোটেলে রুমে চলে এল। ভাবনা চিন্তার জগতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, শেষপর্যন্ত সে ভেবে দেখল ওর সামনে একটা রাস্তা খোলা আছে। তাহল কোনো বস্তিতে ছোট্ট একটা হোটেল তৈরি করা কিংবা আবার তার নিজের দেশে ফিরে যাওয়া। কিন্তু এই দুটো সিদ্ধান্তের কোনোটাই তার মনে ধরল না। সে মনে মনে ভাবল আমাকে যে করেই হোক সামনের দিকে এগোতে হবে। তার জন্য যদি কিছু ত্যাগ করতে হয় আমি অনায়াসে তা করতে পারবো।
পরদিন সকালবেলা, লারা একটা ব্যাঙ্কে গিয়ে হাজির হল। কাউন্টারের পেছনে একজন ক্লার্ককে দেখতে পেয়ে সে বলল–আমি এখানকার ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
বলে তার হাতে একটা কার্ড দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বেয়ারা লারাকে নিয়ে গেল। ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম টম পিটারসন, মাঝবয়সী মোটাসোটা এক মানুষ। মনে হয় সব ব্যাপারে তিনি যেন ভয় পাচ্ছেন। কার্ডটা তার হাতে ধরা ছিল। তিনি লারাকে জিজ্ঞাসা করলেন-বসুন, আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?
–আমি চিকাগোতে একটা হোটেল তৈরি করতে চাইছি। তার জন্য আমার কিছু অর্থের প্রয়োজন।
লারার এই কথা শুনে মিঃ পিটারসন হেসে ফেললেন। তিনি বললেন–সে জন্যই তো আমরা এখানে বসে আছি। বলুন আপনি কি ধরনের হোটেল তৈরি করতে চাইছেন।
–একটা বুটিক হোটেল।
–বাঃ চমৎকার পরিকল্পনা।
–সত্যি কথা বলতে কি আমার হাতে মাত্র তিন মিলিয়ন ডলার আছে। এটাকে আমি প্রাথমিক অর্থ হিসেবে ব্যবহার করবো ঠিক করেছি।
–কোনো সমস্যা হবে না, মিঃ পিটারসন হাসলেন। তার হাসির মধ্যে কি একটা অদ্ভুত শব্দ ঝংকারের সুর ছিল। লারার দেহে উত্তেজনার সৃষ্টি হল। লারা বলল, আপনি সত্যিই বলছেন মিঃ পিটারসন?
মিঃ পিটারসন বললেন–দেখুন মিস ক্যামেরন, আপনি যদি ঠিকমতো পরিকল্পনা করেন তবে ওই তিন মিলিয়ন দিয়েই কাজ হয়ে যাবে।
রিস্টওয়াচের দিকে একবার তাকালেন। তারপর বললেন, মিস ক্যামেরন, এখুনি আমার একটা জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। সবথেকে ভালো হয় যদি আপনি আজকে ডিনারের আসরে চলে আসেন। তখন আমার মাথার ওপর চাপ থাকবে না, তখন আমি শান্ত মনে আপনার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
লারা এটাই চাইছিল, যে করেই হোক এই মানুষটাকে চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে বাইরে নিয়ে আসতে হবে। লারা বলল ঠিক আছে, কোথায় কখন যেতে হবে বলুন তো?
মিঃ পিটারসন জানতে চাইলেন–আপনি এখানে কোথায় উঠেছেন?
–পামার হাউসে।
–আটটার সময় আপনাকে তুললে কি আপনি আপত্তি করবেন?
লারা উঠে দাঁড়িয়ে বলল–ভালোই হবে, আমার এখন ভালোই লাগছে। দিনটা শুরু হয়েছে হতাশার মধ্যে দিয়ে কিন্তু যখন আপনার সঙ্গে দেখা হল, তখন আমার মনে হল হতাশার ঘন অন্ধকার কোথায় হারিয়ে গেছে।
মিঃ পিটারসনের ঠোঁটের কোণে অভয়ের হাসি। তিনি বললেন–ঠিক আছে, কোনো চিন্তা নেই।
লারা ওখান থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। সারা দিন কেটে গেল নানা দোলাচলের মধ্যে। মিঃ পিটারসন যে ঠিক লোক এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার দেবার বিনিময়ে তিনি কি চাইবেন? মনে মনে সারা হেসে ফেলল। এই শরীরটা ছাড়া আর কীই বা তার দেবার আছে।
আটটার সময় মিঃ পিটারসন এসে তুলে নিয়ে গেলেন লারাকে। হোটেলে গিয়ে হাজির হল দুজনে। মিঃ পিটারসন মিটিমিটি হেসে বললেন, আপনি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন এতে আমি খুবই আনন্দিত। আমরা এখন পরস্পরকে আরও বেশি সাহায্য করবো তাই তো?
–আমরা?
–হ্যাঁ, এখানে অনেক সুন্দরী মহিলাকে আমি ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। কিন্তু সত্যি কথা–বলবো? আপনার মতো রূপসী সুন্দরী কোনো মেয়ে ইতিমধ্যে আমার চোখে পড়েনি। আপনি একটা বিলাসবহুল বেশ্যালয় খুলতে পারেন, এছাড়া…
লারা ভাবতে পারেনি সদ্য পরিচিত একজন তাকে এই ভাবে ভোলাখুলি কথা বলতে পারেন।
লারা বলল–ঠিক বুঝতে পারলাম না।
মিঃ পিটারসন শয়তানি হাসিতে মুখ উল্লাস করেছেন। তিনি বললেন, যদি গোটা ছয়েক সুন্দরী মেয়েকে জোগাড় করতে পারেন তাহলে আপনাকে কে পায়? আপনি পায়ের ওপর পা রেখে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারবেন।
লারা বুঝতে পারল ভদ্রলোকের মতলবটা কি। সে ওখানে আর একমুহর্ত থাকলো না । সে নিজের হোটেল রুমে চলে এল। মনটা একেবারে বিগড়ে গেছে তার।
পরের দিন আরও তিনটে ব্যাঙ্কারের সঙ্গে যোগাযোগ করল। প্রথম ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বললেন, মিস ক্যামেরন, আমি আপনাকে একটা ভালো পরামর্শ দিচ্ছি। রিয়েল এস্টেট ডেভলপমেন্টের ব্যবসা কোনো মহিলা কখনও করতে পারবে না। এতে এত ঝামেলা ঝঞ্ঝাট আছে যে পুরুষরাই পাগল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আপনি সফল হবেন এমন কোনো চাল নেই।
–ধন্যবাদ, কিন্তু একথা কেন বলছেন?
–এ লাইনে অনেক বাজে লোক আছে, তারা অন্ধকারের জীব, তারা আপনার সর্বনাশ করবে এক নিমিষে।
–কিন্তু গ্রেস বে-তে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি তো? কেউ আমার সর্বনাশ করেনি কেন?
ম্যানেজার হেসে বললেন, গ্রেস বে আর চিকাগো এক নয়।
–ঠিক আছে ধন্যবাদ। লারা উঠে পড়ল, আরেকটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করল। সেখানকার ম্যানেজার ওকে বললেন–আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারলে খুবই খুশি। হব। কিন্তু খরচের ব্যাপারটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এছাড়া বিনিয়োগের ব্যাপারটাও।
লারা বুঝতে পারল এখানে আর এক মুহূর্ত থাকাটা উচিত নয়। সে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ল।
এবার তিন নম্বর ব্যাঙ্ক। সেখানে দুজন বসেছিল, দুজনেই পুরুষ, একজনকে দেখতে খুবই সুন্দর, চমৎকার পোশাক আর অন্যজন কিছুটা রোগা। পোশাক-আশাকে তেমন জেল্লা নেই, মাথার চুল কম।
প্রথম জনকে প্রেসিডেন্ট বলে মনে হল লারার।
সুন্দর দেখতে লোকটা অন্য লোকটার সঙ্গে লারার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল–মিস ক্যামেরন, ইনি হচ্ছেন হাওয়ার্ড কেলার। আমাদের ব্যাঙ্কের একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমার নাম বব ভ্যান্স। বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
লারা জানালো–আমি চিকাগোতে একটা হোটেল করতে চাই। তার জন্য আমার ঋণের দরকার।
বব ভ্যান্স মৃদু হাসলেন। বললেন, আপনি সঠিক জায়গাতে এসেছেন, আপনি কোনো লোকেশন সুনির্দিষ্ট করেছেন?
–আমি একটা মোটামুটি ভালো জায়গা চাই। এখনও ঠিক করতে পারিনি, জায়গাটা মিচিগান এ্যাভিনিউ থেকে বেশি দূরে হলে কিন্তু চলবে না।
–ঠিক আছে।
লারা ওদের দুজনকে বুটিক হোটেলের ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলল। বব ভ্যান্স সব কথা শুনে আনন্দে অধীর হয়ে বললেন–চমকার প্রস্তাব, আমার তো খুবই ভালো লাগছে। একাজে অনেক টাকা খরচ হবে তা আপনি জানেন কি? আপনার হাতে কত ফ্র ক্যাশ আছে?
লারা বলল–আমার কাছে তিন মিলিয়ন ডলারের মতো আছে। বাকিটা আমি লোন হিসেবে নেবো।
এবার বব ভ্যান্স-এর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। উনি বললেন না তাহলে বোধহয় হল না , মিস ক্যামেরন আপনাকে আমরা কোনো সাহায্য করতে পারছি না, আপনার যে পরিকল্পনা আছে তাতে অনেক বেশি অর্থ লগ্নি করতে হবে। তার চেয়ে বরং আপনার অর্ধেক ইনভেস্ট করতে রাজি থাকেন তাহলে…
–ধন্যবাদ, এসবের কোনো দরকার নেই।
একটা বোবা কান্না তখন লারার বুক থেকে বেরিয়ে এল। গ্রেস বে-তে তিন মিলিয়ন ডলারের গুরুত্ব আছে, কিন্তু চিকাগোতে তার কানাকড়িও মূল্য নেই। সাত-পাঁচ ভাবতে ভারতে সে ফুটপাত ধরে হাঁটছিল, হঠাৎ পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল–এই যে মিস ক্যামেরন?
লারা পেছন ফিরে তাকাল। ভদ্রলোককে চিনতে তার মোটেই অসুবিধা হল না। সে হাওয়ার্ড কেলার, যার মুখোমুখি লারা বসেছিল একটু আগে। মিঃ কেলার ওর সামনে এগিয়ে এলেন। লারা বললেন কি ব্যাপার বলুন তো?
–আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই। আসুন কফি খেতে খেতে আলোচনা করা যাক।
লারা কিছুক্ষণ ভাবল। ওর মনে একটা আশঙ্কার উদয় হল। ভদ্রলোকের আসল মতলবটা কি? চিকাগো শহরের সব পুরুষই কি খুবই কামুক নাকি? নাহলে এই লোকটা হঠাৎ আমাকে অনুসরণ করল কেন?
হাওয়ার্ড বলল–পাশেই একটা কফিশপ আছে, সেখানেই যাওয়া যাক কেমন?
–ঠিক আছে, লারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল। ওরা কফি শপে হাজির হল। কফি খেতে খেতে হাওয়ার্ড বলল মিস ক্যামেরন, আমি আপাকে একটা পরামর্শ দিচ্ছি, অবশ্য যদি আপনি কিছু মনে না করেন।
–বেশ তো, লারা সংক্ষেপে জবাব দিল, তার পরামর্শটা কি লারা হয়তো বুঝতে পারছে। ওই ভদ্রলোক হয়তো লারাকে কোনো ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। হাওয়ার্ড বলল–বুটিক হোটেল একটা চমৎকার পরিকল্পনা। এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। চিকাগোতে এই ধরনের হোটেলের দরকার আছে। কিন্তু আপনি কি তা করতে পারবেন?
হাওয়ার্ডের এই কথায় লারা একটু রুষ্ঠ হল। এখনও তাকে দেখে কি এক নাদান মেয়ে বলে মনে হয়? সে বলল–আপনি কি বলতে চাইছেন?
মৃদু হেসে হাওয়ার্ড বলল–আমার পরামর্শ হল আপনি এখানে একটা ভালো লোকেসনে পুরনো হোটেল কিনে নিন। সেই হোটেলটাকে ভালোভাবে তৈরি করে নিন।
সামান্য চুপ করে হাওয়ার্ড লারাকে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর বলল–ম্যাডাম, আপনি একটু দেখলেই কম দামে হোটেল কিনতে পারবেন। প্রথমে তিন মিলিয়ন ডলার দিয়ে হোটেলটা কিনে নিন। তারপর ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে সেটাকে বুটিক হোটেলে পরিবর্তন করুন।
পরিকল্পনাটা ভালোই লাগল লারার। এই ভদ্রলোককে অযথা সে সন্দেহ করেছিল, নাহ, তার মাথা বোধহয় ঠিক মতো কাজ করছে না। সে বলল–আপনার হাতে কি তেমন কোনো লোক আছে যারা এই ব্যাপারে অভিজ্ঞ?
হাওয়ার্ড বলল–হ্যাঁ, ভালো আর্কিটেক্ট এবং বিল্ডারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে, কবে তাদের সঙ্গে মিটিং করবেন?
বার্জ স্টিলের মুখটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল লারার। লারা ভাবল আবার কোনো ষড়য়ন্ত্রের জালে সে পা দিচ্ছে নাকি?
শেষ অবধি সে বলল, আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।
হাওয়ার্ড কেলারের দিকে তাকাল লারা। তারপর বলল–আমি যদি কোনো ভালো জায়গা খুঁজে পাই তাহলে কি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
–যে কোনো সময়ে, গুডলাক।
লারা এবার একটু অপেক্ষা করতে লাগল। নিশ্চয়ই হাওয়ার্ড বলবে ওর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে কথা বলতে যেমনটি সব পুরুষেরা বলে থাকে। দুর্বল অসহায় মেয়ে দেখলে সুযোগ নেয়। কিন্তু এ কি? হাওয়ার্ড বলল, মিস ক্যামেরন, আপনি কি আরেকটু কফি খাবেন?
–না আপনাকে ধন্যবাদ, লারা উঠে পড়ল। বিদায় জানিয়ে চলে এল ওখান থেকে। ফুটপাত দিয়ে চলার সময় সে সর্তক দৃষ্টিতে দুপাশে নজর রাখছিল। হঠাৎ একটা পুরনো ধরনের হোটেল তার চোখে পড়ে গেল। থমকে থেমে গেল লারা। ভালো করে দেখল ওই হোটেলটাকে। অনেক বছরের পুরনো তা ওই হোটেলের জরাজীর্ণ দশা দেখেই বোঝ যাচ্ছে। দেওয়ালের রং উঠে গেছে, হোটেলটা নতলা উঁচু। বাইরে অস্পষ্টভাবে লেখা আছে–
কংগ্রেসনাল হোটেল। লারা হোটেলের ভেতর ঢুকে পড়ল। ভেতরের অবস্থা আরও শোচনীয়, দরজার সামনে একজন ক্লার্ক বসে আছে। ডেস্কের কাছে টিকিট কাউন্টার এবং রিসেপশনের জায়গা। সব কিছুই কেমন ম্লান এবং জরাজীর্ণ। মানুষটাকেও মনে হচ্ছিল যেন কোনো রকমে বেঁচে আছে। লবির শেষপ্রান্তে পুরনো দিনের একটা সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। লারা ক্লার্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা জিজ্ঞাসা করল–আপনার ঘর চাই?
–না আমি জানতে চাই… ।
হঠাৎ ও দেখল একজন ভারী চেহারার মহিলা ওর দিকে এগিয়ে আসেছ। মহিলা এসে ওই ক্লার্ককে বললআমাকে চাবি দাও মাইক। কাছেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিল। ক্লাকটি সঙ্গে সঙ্গে চাবি দিয়ে দিল। চাবি নিয়ে ওরা হেলতে দুলতে ভেতরে চলে গেল। ক্লার্ক আবার জিজ্ঞাসা করল–বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি? |||||||||| —
লারা জিজ্ঞাসা করল–এই হোটেলটা কি বিক্রির জন্য আছে? সঙ্গে সঙ্গে সে বলল আমি এইরকমই একটা হোটেল কিনতে চাইছি।
ক্লার্ক ব্যাপারটা বুঝলল, সে বলল–এখানকার সবকিছুই বিক্রির জন্য। আপনার বাবা নিশ্চয়ই রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ী?
–না, আমি নিজেই, লারা বলল। এই কথা শুনে ক্লার্কের চোখ দুটো কুঁচকে গেল, সে বুঝি এমন কথা এ জীবনে কখনও শোনেনি।
ক্লার্কটি এবার বলল ঠিক আছে, যদি আপনি আগ্রহী থাকেন তাহলে ডায়মন্ড ব্রাদার্সের একজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এখন ওরাই এই হোটেলটার মালিক।
–কোথায় পাবো ওদের? লারা জিজ্ঞাসা করল। ক্লার্ক ডায়েরী দেখে ঠিকানাটা বের করে কাগজে লিখে লারার হাতে দিল, স্টেট স্ট্রীটে ওদের পাওয়া যাবে। কাগজের টুকরোটা পকেটে ঢুকিয়ে লারা বলল–আমি একটু জায়গাটা ঘুরে দেখতে পারি?
লোকটা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল ইচ্ছে হলে দেখতে পারেন, আমার অনুমতির কোনো দরকার নেই।
লারা বুঝতে পারলো, এই লোকটাকে ঠিকমতো মাইনে দেওয়া হয় না। তাই এর স্বভাবটা এমন কুঁড়ে টাইপের হয়ে গেছে। লারা এগিয়ে গেল। পুরো হোটেলটা ঘুরে দেখতে লাগল। সব কিছু পুরনো আমলের, বেশির ভাগের অবস্থা শোচনীয়। লারা মনে মনে খুশি হল। মনের উত্তেজনা চেপে রেখে আবার ক্লার্কের কাছে ফিরে এল সে। বলল–একটা ঘর দেখতে পেলে ভালো হত।
ক্লাকটি এবার মৃদু হাসল, একটা চাবি পেড়ে ওর হাতে দিয়ে বলল–দেখে আসুন বি ১০।
ক্লার্ককে ধন্যবাদ জানিয়ে লারা এগিয়ে গেল। এলিভেটরে চড়ে ওপরে উঠতে উঠতে লারার মনে হল এত ধীর গতির এলিভেটর এই প্রথম দেখতে পাচ্ছে। এটাকে নতুন করতে হবে। ভেতরে আধুনিক ডিজাইনের মূরাল লাগানো যেতে পারে। মনে মনে সে ভেবে নিচ্ছিল কিভাবে এই হোটেলটার খোলনলচে পাল্টাবে। ঘরে ঢুকে দেখল একেবারে এলোমেলা অবস্থা। ঘরটা বড়ো কিন্তু ফার্নিচারগুলো খুবই বেসামাল। রুচিবোধের কোন ছাপ নেই। লারার হৃৎপিন্ডের গতি আচমকা বেড়ে গেল। এটাই ওর পক্ষে একটা আদর্শ হোটল হতে পারে। সবকিছু ভালো করে দেখে আবার ক্লার্কের কাছে ফিরে এল। ক্লার্কের হাতে চাবিটা জমা দিল।
ক্লার্ক প্রশ্ন করল-সব দেখেছেন ভালোভাবে?
–হ্যাঁ ধন্যবাদ, মুচকি হেসে লারা বলল।
ক্লার্ক জানতে চাইল–সত্যি সত্যি আপনি এই ডেঞ্জার বাড়িটাকে কিনতে চান?
–হ্যাঁ চাই, জবাব দিল লারা। লোকটা আর কিছু বলল না। হঠাৎ এলিভেটরের দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে একজন তরুণী আর তার সঙ্গী বেরিয়ে এল। মেয়েটা ক্লার্কের হাতে চাবি আর কিছু নগদ টাকা দিয়ে বললধন্যবাদ মাইক।
ওরা বেরিয়ে গেল, লোকটা লারাকে জিজ্ঞাসা করল সত্যি সত্যি আপনি কি আবার আসবেন?
–হ্যাঁ, আসবো, এই কথা বলে তারা বাইরে বেরিয়ে এল। পরের স্টপেজটা হল সিটি হল অব রেকর্ডস। সেখানে গিয়েও রেকর্ড পত্রগুলো দেখতে চাইল। দশ ডলারের বিনিময়ে কনগ্রেসনাল হোটেলের যাবতীয় রেকর্ডপত্রের ফাইল পেয়ে গেল। পাঁচ বছর আগে ডায়মন্ড ব্রাদার্স ছমিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে হোটেলটাকে কিনেছে। এখন ওকে ডায়মন্ড ব্রাদার্সের অফিসে যেতে হবে।
স্টেট স্ট্রীটের একেবার শেষপ্রান্তে ডায়মন্ড ব্রাদার্সের অফিস। এই বাড়িটা পুরনো ধাঁচের। লারা ভেতরে ঢুকে পড়ল। ডেস্কের সামনে প্রাচ্যদেশীয় এক মহিলা বসেছিলেন। তারা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসা করল–আমি ডায়মন্ডদের সঙ্গে দেখা করবো কি করে?
–কার সঙ্গে?
–যে কোনো একজনকে পেলেই চলবে।
–ঠিক আছে, ফোনটা তুলে নিয়ে মহিলা কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর মাউথপিসটা চেপে লারাকে প্রশ্ন করল–আপনি কি জন্য এসেছেন?
–আমি ওদের একটা হোটেল কিনতে চাই। লারা স্পষ্টভাবে বলল, রিসেপশনিস্ট ফোনে তাই বলল। কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হল লারাকে। ভদ্রমহিলা বলল, আপনি ভেতরে যান।
লারা ভেতরে ঢুকে পড়ল। জন ডায়মন্ড চেয়ারে বসেছিল। মাঝ বয়সী, চেহারাটা মোটাসোটা ধরনের। মাথায় একরাশ চুল, মুখটা খেলোয়াড়দের মতো চোয়ারে ধরনের। লম্বা একটা সিগারেট টানছিল সে। লারা যেতেই তাকে বসতে বলা হল। জন ডায়মন্ড বলল–আমি আমার সেক্রেটারীর মাধ্যমে জানলাম যে আপনি একটা হোটেল কিনতে চাইছেন। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি এখনও নাবালিকা। এটা কি আপনার রসিকতা?
লারা মৃদু হেসে বলল–না না, আমি ভোট দিয়েছি। তাছাড়া আপনার বাড়ি কেনার মতো আর্থিক সঙ্গতি আমার আছে।
–আচ্ছা চমৎকার ব্যাপার, আপনি কোন্ হোটেলটা কিনতে চাইছেন?
–কংগ্রেসনাল হোটেল।
–কি? লারার কথায় জনের ভুটা কুঁচকে গেল।
লারা বলল–হ্যাঁ এই নামটাই তো লেখা আছে সাইনবোর্ডে।
–আচ্ছা, এই হোটেলটা বিক্রির জন্য আছে।
জন আরও প্রশ্ন করল–হ্যাঁেটেলটার অবস্থা খুবই খারাপ। আপনি কি সব ঘুরে দেখেছেন? যে কোনো সময়ে ওটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে। এটা আপনি কেন কিনতে চাইছেন?
আমি কিনে সামান্য কিছু সংস্কার করতে চাই। লোকজন থাকলে খালি করে দিতে পারলে ভালো হয়।
–ঠিক আছে কোনো সমস্যা হবে না। ওখানে যারা থাকে তারা সপ্তাহের ভাড়াটে। আশা করি আমার কথার অর্থ আপনি বুঝতে পারছেন?
–কটা রুম আছে মোট?
–সব মিলিয়ে একশো পঁচিশটা, বাড়িটার আয়তন এক হাজার স্কোয়ার ফিট।
লারা ভাবল রুমের সংখ্যাটা ভালোই হল। কিন্তু সংখ্যাটা কমিয়ে ৬০-৭৫ করতে হবে।
লারা প্রশ্ন করল–কত দাম ছাইছেন?
–ডায়মন্ড বলল–দশ মিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে ছমিলিয়ন আগেই নগদ দিতে হবে।
লারা বলল–আমি…
ওকে থামিয়ে জন ডায়মন্ড বলল–এব্যাপারে আমি দর কষাকষি পছন্দ করি না।
লারা মনে মনে ভাবতে লাগল হোটেলটাকে সংস্কার করতে কত খরচ হবে। প্রতি স্কোয়ার ফিটে আশি ডলার করে খরচ করলে ৮ মিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে ফার্ণিচার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ আছে। লারা জানে ব্যাঙ্ক থেকে লোন পেতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু এখনই ছমিলিয়ন ডলার চাই। ওর কাছে ৩ মিলিয়ন ডলার আছে, ডায়মন্ড বোধহয় একটু বেশি চেয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় লারাকে পিছিয়ে গেলে চলবে না, যে করেই হোক ওই হোটেলটাকে কিনতেই হবে। লারা বলল–এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে একটা চুক্তি করতে চাই।
–কি চুক্তি?
–আপনি যা বলেছেন তাই হবে।
–তাহলে?
–আমি এখনই আপনাকে ৩ মিলিয়ন ডলার নগদ দেবো।
–না, মাথা নেড়ে জন ডায়মন্ড বলল,.৬ মিলিয়ন এক বারে ক্যাশ আমার সামনে রাখতে হবে।
–আপনি পাবেন।
–ঠিক আছে, বাকি ৩ মিলিয়ন কোথা থেকে আসবে?
–ওটা আসবে আপনার কাছ থেকে।
–কি? এবার জন ডায়মন্ডের অবাক হওয়ার পালা। লারা হাসি হাসি মুখ করে তার পরিকল্পনাটা বোঝাতে শুরু করেছে–আপনার কাছ থেকে আমি তিন মিলিয়ন ডলার ধার নেবো।
জন ডায়মন্ডের মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। সে বলল–আপনি আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আমারই হোটেল কিনতে চাইছেন?
হঠাৎ লারার মনে পড়ে গেল সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের মুখটা। এইরকমই হয়েছিল ব্যাপারটা। লারা বলল–দেখুন ভাবনার কিছু নেই। আমি যত দিন না শোধ করতে পারি ততদিন এটা আপনার থাকবে। এমন কি আমি যদি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এই টাকা দিতে না পারি তাহলে হোটেলটা আপনার কাছেই ফিরে যাবে। আমার এই ৩ মিলিয়ন ডলার নষ্ট হবে। আপনি কিছুই হারাবেন না।
এবার জন ডায়মন্ড হেসে ফেলল। বলল–ঠিক আছে তাই হোক। জন ডায়মন্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল লারা। যে করেই হোক হোটেলটা তার চাই।
দরজার সামনে নেম প্লেট লেখা আছে হাওয়ার্ড কেলার। রুমটি বেশ সাজানো গোছানো। লারাকে দেখে হাওয়ার্ড অবাক হল। বলল–কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি?
লারা বলল–কেন, আপনি বলেছেন হোটেল পাওয়া গেলেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি পেয়েছি।
চেয়ারে হেলান দিয়ে হাওয়ার্ড বলল, ঠিক আছে, বলুন।
লারা বলল–মিচিগান এ্যাভিনিউ থেকে কিছুটা দূরে আমি একটা পুরনো হোটেলের সন্ধান পেয়েছি। আমি ওটাকেই কিনতে চাই। একসময় এটাই হবে চিকাগোর সেরা হোটেল।
–ব্যবসায়িক চুক্তি?
জন ডায়মন্ডের সঙ্গে যা কথা হয়েছিল লারা সব গড়গড় করে বলে গেল। পাশেই বব ভ্যান্স বসেছিল। সেও মন দিয়ে লারার কথা শুনছে। লারার কথা বলা শেষে হতেই বব বলল–আপনি কি আগে কখনও হোটেল চালিয়েছেন মিস ক্যামেরন।
গ্রেস বে-তে লারা কি করেছিল সব মনে পড়ে গেল। হোটেল চালানোর অভিজ্ঞতা রীতিমতো তার আছে। সে বলল–আমি হোটেলের সমস্ত কাজকর্ম জানি। আমার বোর্ডিং হাউসে কুলি শ্রমিক থেকে শুরু করে কাঠের মিস্ত্রি প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার লোকজন ছিল। ওদের নিয়ে চলতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি।
এবার হাওয়ার্ড ববকে বললবব, চল হোটেলটা ঘুরে দেখে আসি।
–বেশ তো।
লারা এবার উত্তেজনার তুঙ্গে উঠে গেছে। আরেকটা স্বপ্ন সফল হবার পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে সে।
লারার উদ্যমী ক্ষমতা তুলনাহীন। হাওয়ার্ড কেলার লারার সঙ্গে হোটেলটা দেখে এল। লারা যা যা বলেছে সব অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। হোটেলটা সত্যিই পুরনো ধাঁচের, লারা ওকে বুঝিয়ে বলল কিভাবে প্রতিটি ঘরদোর তৈরি করবে। অবস্থাপন্ন ট্যুরিস্টদের জন্য একেবারে নিজের মতো পরিবেশ হবে। এই হোটেলের চরিত্র হবে A real home away from home। নিবাস থেকে দূরে এই প্রকৃত নিবাসে অতিথি যে খুবই আনন্দ পাবে এ বিষয়ে লারার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
সব শুনে হাওয়ার্ড কেলার বলল–আপনার মাথাটা খুবই পরিষ্কার, আপনার পরিকল্পনা শুনে আমার খুবই ভালো লাগছে। আচ্ছা আচ্ছা আর্কিটেক্টরা বোধ হয় আপনার মতো এত সুন্দর পরিকল্পনা তৈরি করতে পারবে না।
প্রশংসায় লারার মুখ লাল হয়ে গেল। সে বলল–তাহলে ব্যাঙ্ক লোন পাবো বলছেন?
–দেখা যাক কত দূর এগোনো যেতে পারে।
ওরা দুজন চলে এলো। লারার দুচোখে স্বপ্ন তখন আরও জমাট হয়েছে।
আধ ঘন্টা পরে হাওয়ার্ড কেলার এবং বব ভ্যান্স পরস্পরের মুখোমুখি বসে আছে। বব জিজ্ঞাসা করল–তুমি এ ব্যাপারে কি ভাবছো হাওয়ার্ড, সত্যি করে বলে তো?
–মেয়েটার প্রতিভা আছে, ওর বুটিক হোটেলের ভাবনাটা আমার মনে ধরেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম বব ভ্যান্স। তারপর বলল–আমারও ভালো লেগেছে, কিন্তু সমস্যা একটাই, মেয়েটার বয়স খুবই কম, এই ব্যাপারে এত ঝক্কি ঝামেলা পোয়াতে পারবে? আমার মনে হয় ব্যাপারটাতে বেশ ঝুঁকি আছে।
এ ব্যাপারে হাওয়ার্ডও এক মত হয়েছে ববের সঙ্গে। তবুও বলল, দেখা যাক আমরা দুজনে মিলে সমস্যার সমাধান করতে পারি কিনা।
পরিকল্পনার নানা দিক নিয়ে দুজন আলোচনা করলো। শেষপর্যন্ত হাওয়ার্ড বলল আমার মনে হয় সাবধানে পা ফেলে চললে কোনো ক্ষতি হবে না। যদি লারা এই কাজে অসফল হয় তাহলে আমরা দায়িত্ব নিতে পারি।
তাহলে আমরা একসঙ্গে হোটেলের দায়িত্ব নেব।
–এই প্রস্তাবটা খুব একটা খারাপ নয়, বব ভ্যান্স মাথা নাড়ল।
তখনকার মতো আলোচনা শেষ হল। এবার এগোতে হবে।
পামার হাউসে লারা হাওয়ার্ড কেলারের ফোনটা পেল। ফোনটা পেয়েই সে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে বলল–বলুন, কী করতে হবে?
–আপনাকে একটা সুখবর দিচ্ছি। আপনি লোন পেয়েছেন, ব্যাঙ্ক আপনার লোন অনুমোদন করেছে।
লারা তখন আর কথা শুনতে পাচ্ছে না। তীব্র আনন্দে তার বাকশক্তি একেবারে হারিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে ও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল–সত্যি, আমি যে কতটা আনন্দ পেয়েছি, তা বলে বোঝাতে পারব না।
হাওয়ার্ডের কণ্ঠস্বর ভেসে এল-মিস ক্যামেরন, আরো কিছু কথা বাকি আছে। আজ সন্ধ্যবেলা আসুন। আমরা একসঙ্গে ডিনার করব। ওখানেই বাকি কথা হবে।
–ঠিক আছে।
–চমৎকার। আমি সন্ধ্যে সাতটার সময় আপনাকে তুলে নেব।
লারা খুশীর গলাতে জবাব দিল–আমি তৈরী হয়ে থাকব।
হাওয়ার্ড ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে লাইন কেটে দিল। লাফিয়ে গিয়ে লারা শুয়ে পড়ল বিছানাতে, এই কাজে আর একটা কঠিন ধাপ ও পার হতে পেরেছে।
ইমপিরিয়াল হাউসে ওরা ডিনার করছিল। লারা খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে, ভালোভাবে কথা বলতে পারছে না। এমন কী মাঝে মধ্যে খেতেও ভুলে যাচ্ছিল।
সে বলল–বিশ্বাস করবেন না, আমি ভাবতে পারিনি, এত সহজে এত বড়ো স্বপ্নটা সফল হবে।
সামান্য খাবার মুখে দিয়ে সে বলল–আমি বলছি, এক সময় এটাই হবে চিকাগোর সবথেকে সেরা হোটেল।
–একটু স্বাভাবিক হোন, এত আবেগ প্রবণ হলে চলবে কেমন করে?
হাওয়ার্ড মৃদু হাসল। তারপর বলল, এখনো অনেকটা পথ চলা বাকি আছে। আমি আপনাকে ভোলাখুলি কয়েকটা কথা বলতে চাই।
–হ্যাঁ, বলতে পারেন।
–আপনি সত্যি একটা কালো ঘোড়া, তা আমি বুঝতে পেরেছি। জীবনের লড়াইতে চট করে হারবার জন্য আপনি আসেন নি। কিন্তু আর একটা কথাও মনে রাখতে হবে, এ ব্যাপারে আপনার কোনো ট্রাক রেকর্ড নেই। বুঝতেই পারছেন তো অবস্থাটা?
লারা আমতা আমতা করে বাধা দেবার চেষ্টা করল-গ্রেস বে-তে?
হাওয়ার্ড বলল–মনে রাখবেন, এটা কিন্তু গ্রেস বে নয়। এটা চিকাগো শহর। এই শহরের চরিত্র একেবারই আলাদা। আমার তো মনে হয়, পৃথিবীর আর কোনো শহরের সাথে এর বিন্দুমাত্র মিল নেই।
–তাহলে ব্যাঙ্ক কেন লোন দিচ্ছে? লারা জিজ্ঞাসা করল।
হাওয়ার্ড কেলার বলল–আপনি আমাকে ভুল ভাববেন না। আমরা কোনো দাঁতব্য সংস্থা নই। ব্যাঙ্ক লোকসান হবে ভেবে লোন দেয় না। কিন্তু আপনার ব্যাপারটা আমরা অনুভব করছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আপনি এই কাজটা করতে পারবেন। কিন্তু একটা হোটেল নিয়ে আপনি বসে থাকবেন না বলে আমার মনে হয়?
আপনি ঠিকই ধরেছেন, ভবিষ্যতে এমন আরো কতগুলো হোটেল তৈরীর পরিকল্পনা
আছে আমার।
হাওয়ার্ড লারার দিকে সোজাসুজি তাকাল। বলল–বলুন, একটা ব্যাপার পরিষ্কার করা যাক। এর আগে আমি যাদের লোন দিয়েছি, তাদের ব্যবসায়িক সফলতার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারা ঠিক মতো লোনের টাকা শোধ করতে পারছে কিনা, সেটা আমি দেখতাম। কিন্তু আপনার বেলায় ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। যে কোনো সময় যদি আপনার সাহায্য লাগে, অনায়াসে আমার কাছে আসবেন। কোনো চিন্তা নেই, আপনি সাহস করে এগিয়ে চলুন।
এত প্রশংসাতে লারা অভিভূত হচ্ছিল। হাওয়ার্ড কেলারকে ও যত দেখছে, ততই ভালো লাগছে ওর।
হাওয়ার্ড কেলারও বোধহয় লারাকে ভাললাবেসে ফেলেছিল। প্রথম দেখার পর থেকেই মনে মনে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা বোধ করছিল সে। বিশেষ করে লারার উৎসাহ এবং তার মানসিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হাওয়ার্ড অভিভূত হয়ে গেছে। মেয়েটা এখনো শিশুর মতো সরল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেলার মনে মনে স্বপ্ন দেখছিল, ভবিষ্যতের বিখ্যাত একটা মহিলাকে সে কেমন করে গড়ে তুলবে? অন্যদিকে লারার দুচোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন। স্বপ্নের ঘুড়ি নীল আকাশে উড়তে উড়তে কোথায় উড়ে গেল, কেউ জানে না।
.
অষ্টম অধ্যায়
ছোটবেলা থেকে হাওয়ার্ড কেলারের স্বপ্ন ছিল বড়ো হয়ে সে একজন বেসবল খেলোয়াড় হবে। স্কুলে ভালো খেলত। ইউনিভারসিটিতে গিয়েও বিখ্যাত খেলোয়াড় হিসাবে পরিচিত হয়েছিল। বাবা ওকে নিয়ে গর্ববোধ করতেন। মাকে বলতেন, দেখো হাওয়ার্ড একদিন বিশ্বের : এক বিখ্যাত খেলোয়াড় হবে।
তখনো সবকিছু ঠিক মতো চলছিল। ঠিকমতো চললে হয়তো হাওয়ার্ডকে আজ ব্যাঙ্কের খাঁচায় বন্দী হয়ে জীবন কাটাতে হত না। নামকরা খেলোয়াড় হিসাবে সর্বত্র ঘুরতে হত তাকে। কিন্তু বাবা আর মায়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গেল। ব্যাপারটা এখনো হাওয়ার্ড মন থেকে মানতে পারে না। হাওয়ার্ডের বাবা অন্য এক মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন। হঠাৎ সেদিন তিনি সেই মেয়েকে নিয়ে সংসার ছাড়লেন। সেদিনটা ছিল ইউনিভারসিটি ছাড়ার আগের দিন। সব শুনে হাওয়ার্ডের দুচোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল।
সে বলেছিল-বাবা যে এরকম করবে আমি তা ভাবতে পারিনি। কীভাবে সব হয়ে গেল ভেবে পাচ্ছি না।
স্বামীর এই আচরণে হাওয়ার্ডের মা রীতিমতো ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন–ওনার জীবনে একটা পরিবর্তন ঘটেছে, তা আমি ভাবছিলাম। কিন্তু এতটা আশা করিনি। তোমার বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আগামী দিনে উনি আবার আমাদের কাছেই ফিরে আসবেন।
মায়ের কথা শুনে হাওয়ার্ড চুপ করে গেল। কোনো উত্তর দিল না। পরের দিন অ্যাটর্নি মারফত একটা চিঠি পেল হাওয়ার্ডের মা। তাতে লেখা আছে, হাওয়ার্ড কেলার সিনিয়ার, ওনার কাছ থেকে ডিভোর্স চাইছেন। এর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ বা খোরপোষ তিনি দিতে পারবেন না। তবে ছোটো বাড়িটা ইচ্ছে করলে উনি ভোগ করতে পারেন। চিঠি পেয়ে হাওয়ার্ডের মা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। মাকে এই অবস্থায় সান্ত্বনা দেওয়া উচিত, এটা বুঝতে পেরেছিল হাওয়ার্ড।
সে বলেছিল–মা, আমি আগে ঠিক মতো দাঁড়াই। তারপর তোমাকে দেখব। তোমার কোনো চিন্তা নেই।
হাওয়ার্ডের মা দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেননা, তোমাকে আর এখানে আসতে হবে না। আমি চাই না, আমার জন্য তোমার পড়াশুনার কোনো ক্ষতি হোক। তুমি আরো বড়ো হও। সেটাই হবে আমার জীবনের সবথেকে বড়ড়া পুরস্কার।
সমস্ত রাত্রি হাওয়ার্ড দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। একবার ভাবল, স্কলারশিপ নিয়ে হাভার্ডে চলে যাবে। বেসবল খেলোয়াড় হিসেবে ইতিমধ্যেই নাম হয়েছে ওর। সেখানে থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু মাকে ছেড়ে যাব কেমন করে?
সিডনি সেল্ডন রচনাসমগ্র পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে মাকে দেখতে না পেয়ে হাওয়ার্ড আরো অবাক হয়ে গেল। মায়ের ঘরে গিয়ে হাজির হল। সেখানে যে দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল, তা ওকে আতঙ্কিত করার পক্ষে যথেষ্ট। ও দেখল, মা স্ট্রোকে পাথরের মতো হয়ে গেছে। সমস্ত দেহটা স্থির আর মাথাটা একদিকে হেলে গেছে।
কোনোভাবে ওই যাত্রা সামলে উঠেছিলেন হাওয়ার্ডের মা। তবে সাময়িকভাবে শরীরটা অকেজো হয়ে গেল তার। হাওয়ার্ড কেলারের জীবনে তখন একটা নতুন পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ব্যাঙ্কে চাকরি নিতে বাধ্য হল হাওয়ার্ড। সকালে বেরিয়ে যেত। ফিরতে ফিরতে বিকেল, এসে মাকে দেখাশোনা করত। তাই বেসবল খেলোয়াড় হবার স্বপ্ন তার কোথায় হারিয়ে গেল।
স্ট্রোকটা অল্প ছিল বলে সে যাত্রা হাওয়ার্ডের মা বেঁচে গেলেন। এরপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে হাওয়ার্ডের মনে হল। তখনো হাওয়ার্ড খেলার প্রস্তাব পাচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। কিন্তু যাবে কেমন করে? অসুস্থ মাকে ছেড়ে সে কি যেতে পারে? কয়েকটা মাস এইভাবে কেটে গেল। তখনো মা একইরকম অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। কথা বলতে পারেন না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। মায়ের মুখের দিকে তাকালে হাওয়ার্ডের বুকটা হুহু করে ওঠে। বাবাকে বারবার দায়বদ্ধ করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু যে মানুষটা চলে গেছেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কোথায় দায়ের করবে?
শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে গেল হাওয়ার্ড। ডাক্তার বললেন–এই অবস্থায় রোগী কবে সুস্থ হবে কিছুই বলা যায় না। কয়েক মাস লাগতে পারে, আবার কয়েক বছরও হতে পারে।
হাওয়ার্ড আর কিছু বলল না। কঠিন বাস্তবটা তাকে মানতেই হবে।
বছর শেষ হয়ে আর একটা নতুন বছর এল। হাওয়ার্ডের মা একই রকম অবস্থায় বেঁচে আছেন। ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে এসে হাওয়ার্ড মনে-প্রাণে মায়ের সেবাযত্ন করছে। বেটি কুইননান নামে একটা মেয়েকে হাওয়ার্ড খুবই ভালোবাসতেন। সেও এই অবস্থার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাইল না। উচ্চাকাঙ্খী এক যুবকের সঙ্গে ঘর বাঁধল। হাওয়ার্ডের জীবনে মা ছাড়া কেউ রইল না। রান্নাবান্না থেকে বাজার করা–সবই একা হাতে করত সে। চারটি বছর কেটে গেছে। একদিন সকালে মাকে মৃত অবস্থায় বিছানায় পাওয়া গেল।
এবার সত্যি সত্যি পৃথিবীতে হাওয়ার্ড একা হল। খেলার প্রতি উৎসাহ কবেই হারিয়ে গেছে তার। ব্যাঙ্কের কাজ নিয়ে ব্যস্ত রইল। এখন ও একজন ব্যাঙ্কার। ব্যাঙ্কার হিসাবেই বেঁচে থাকতে চায়।
হাওয়ার্ড কেলার আর লারা মুখোমুখি বসে আছে। হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে লারা জিজ্ঞাসা করল–আমরা কীভাবে আরম্ভ করব?
–তুমি যাতে হোটেলটা কিনতে পারে, তার ব্যবস্থা কর। এর জন্য প্রয়োজনীয় টাকা আমরা তোমাকে দেব। তারপর রিয়েল এস্টেটের বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন আইনজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। দলিলের ব্যাপারে অনেক ফাঁকফোকর থাকে। আইন বিশারদ ছাড়া কেউ সেগুলো বুঝতে পারবে না। ডায়মন্ড ব্রাদার্স-এর সঙ্গে একটা চুক্তি করতে হবে। ভালো আর্কিটেক্টদের সাথেও দেখা করা দরকার। এব্যাপারে একজনকে আমি জানি। তারপর কনস্ট্রাকশন কোম্পানী ভাড়া করব। এক-একটা রুমের তিরিশ হাজার ডলার খরচ হবে। হোটেলটাকে ঠিকমতো দাঁড় করাতে গেলে সাত মিলিয়ন ডলার দরকার। যদি প্রতিবেদনে কোনো ত্রুটি না থাকে, তাহলে এখনই কাজ আরম্ভ করা যেতে পারে।
লারা বলল–ঠিক আছে।
টেড টাটাল নামে একজন আর্কিটেক্টকে নির্বাচন করা হল। লারার সমস্ত প্রকল্পটা শুনে টেড বলল–ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করবেন। আমি অনেকদিন ধরে এমনি একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছিলাম।
টেডকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে হল লারার। দশদিন বাদে টেড একটা ড্রইং দেখাল। লারা আনন্দে অভিভূত হয়ে গেল। ওর স্বপ্নে দেখা প্রতিটি জিনিস টেডের ড্রইং-এর মধ্যে লুকিয়ে আছে।
টেড বলল–হ্যাঁেটেলে মোট একশো পঁচাত্তরটা রুম আছে। আমি সেটাকে কমিয়ে পঁচাত্তরটা করেছি। পাঁচটা সুইট আর পঁচিশটা ডিলাক্স রুম আছে।
লারা বলল–চমৎকার হয়েছে। আমি এটাই চেয়েছিলাম।
প্ল্যানটা হাওয়ার্ড কেলারকে দেখানো হল। হাওয়ার্ডও এই প্ল্যানটা দেখে খুবই খুশী হয়েছে। স্টিভ রাইস নামে এক কনট্রাক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। বিল্ডিং-এর ড্রইং অনুসারে প্রথম পর্যায়ের কাজ আরম্ভ হল। বিভিন্ন কনট্রাক্টরের কাছে ব্লু প্রিন্ট পাঠিয়ে দেওয়া হল। যারা স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার, তাদের হাতেও কাগজ পাঠিয়ে দেওয়া হল। পৌঁছে গেল উইন্ডো কোম্পানীর ইলেকট্রিক্যাল কনট্রাক্টারদের কাছে। ষাট জনের বেশী সাব কনট্রাক্টর বিশাল এই কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে পড়ল।
হাওয়ার্ড আর লারা দুজনেই খুশী হয়েছে। হাওয়ার্ড এখন লারার প্রতি আরো বেশী অনুরক্ত। ব্যাঙ্কের কাজ শেষ হলে সে সোজা লারার কাছে চলে আসে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হয়। মাঝেমধ্যে সে আড় চোখে লারাকে পর্যবেক্ষণ করে। ভাবে, এই মেয়েটা বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবছে?
একদিন কথা প্রসঙ্গে লারা বলল–আজকের খবরের কাগজ পড়লাম সিয়ারস টাওয়ার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। একশো দশ তলা এই বাড়িটা হবে পৃথিবীর সব থেকে উঁচু বাড়ি। তাই তো?
কেলার বলল–ঠিক বলেছো।
লারা বলল–আমি একদিন এর থেকেও উঁচু বাড়ি তৈরী করব।
হাওয়ার্ড বলল–আমি তোমার এই কথায় বিশ্বাস রাখছি।
হোয়াইট হলে স্টিভ রাইসের সঙ্গে সকলে মিলে লাঞ্চ করল। লারা জানতে চাইল–এরপর কী ঘটবে?
রাইস বলল–প্রথম বাড়ির ভেতরের ভিতটা আমরা ঠিক করে ফেলব। এখানে মার্বেল দেওয়াটাই সব থেকে ভালো। তারপর বাথরুমের পালা। তৃতীয় দফায় ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং আর চতুর্থ দফায় কাঠের কাজ হবে। তবে সবথেকে আগে পুরোনো হোটেলের অনেক কিছু ভেঙে ফেলতে হবে।
–কতজন কাজ করবে?
রাইস বলল বলতে পারেন বিরাট দল। জানলা তৈরীর লোকজন, বাথরুম তৈরীর লোকজন, করিডর রুম, প্রত্যেকের কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। হোটেলে দুটো রেস্তোরাঁ থাকবে। একটাতে পরিবেশিত হবে ভালো খাবার। অন্যটাতে একটু কম দামী। আশা করি, আমার পরিকল্পনা ঠিক আছে।
আঠারো মাসের মধ্যে হোটেলটা ঝকঝকে অবস্থায় এসে যাবে বলে রাইসের মনে হল। কিন্তু লারা এতটা সময় অপেক্ষা করতে চাইছে না। সে এখন ছটফট করছে। সে বলল মিস্টার রাইস, যদি একবছরের মধ্যে বাড়িটা তৈরী করতে পারেন, তা হলে আপনাকে আমি অতিরিক্ত বোনাস দেব।
নামটাও পাল্টাতে হবে। এর নাম হবে ক্যামেরন প্যালেস। এই কথা বলে লারার শরীরে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ জাগে। শিহরণ এবং উত্তেজনার অনুভূতি। নামটা ওর মাথায় হঠাৎ চলে এসেছে। ক্যামেরন প্যালেসের মাধ্যমে ওর নাম পৃথিবীর সমস্ত ধনী লোকের কাছে পৌঁছে যাবে।
সেপ্টেম্বরে শুরু হল হোটেলটাকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার কাজ। লারা সাইটেই থাকে বেশীর ভাগ সময়, মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। হঠাৎ লারা একজনকে দেখতে পেল, প্রথমে সে ভালোভাবে বুঝতে পারেনি। তারপর কাছে আসতেই অবাক হয়ে গেল। হাওয়ার্ড কেলার? লারা জানতে চাইলকী ব্যাপার? আপনি এত সকালে এসেছেন কেন?
কেলার-সারারাত আমি উত্তেজনায় ছটফট করেছি। আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।
লারা জানতে চাইলকী রকম?
–একটা বিরাট কর্মকাণ্ডের শুভ সূচনা হল।
লারা হেসে ফেলল।
তারা পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বিমুগ্ধ বিস্ময়ে।
বারোটি মাস কেটে গেছে। ক্যামেরন প্যালেস খুলে দেওয়া হয়েছে। ল্যান্ড অফিস বসে গেছে। চিকাগোর ট্রিপল কাগজে সমালোচক লিখল–এই প্রথম চিকাগো শহরে একটা বিশেষ উদ্দশ্য নিয়ে হোটেল তৈরী হচ্ছে। নিবাস থেকে দূরে এই প্রকৃত নিবাস, কনসেপ্টটা দারুন।
লারা ক্যামেরন ইতিমধ্যেই একজন গর্বিত ভদ্রমহিলাতে পরিণত হয়েছে। প্রথম মাসটা শেষ হবার আগেই হোটেলে লোকজন ভর্তি হয়ে গেল। দীর্ঘ লাইন পড়ে গেল ওয়েটিং লিস্টে। হাওয়ার্ড কেলারকে একজন উদ্যমী পুরুষ বলা যেতে পারে। লারাকে সে বলল–যদি এইভাবে চলতে থাকে, তাহলে বারো বছরের মধ্যেই ব্যাঙ্কের সমস্ত ধার পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
–তেমন কিছু এখনো হয়নি, আমি রুম রেন্টটা আর একটু বাড়াতে চাইছি।
কেলারের দিকে তাকাল লারা, তার অভিব্যক্তি দেখতে চাইছে সে। লারা বলল–ভাববার কিছু নেই, ওরা নিশ্চয়ই বেশী টাকা দেবে। কোথায় এমন সুন্দর দুটো ফায়ার প্লেস পাওয়া যাবে? পিয়ানো স্ট্যান্ড আর কোন হোটেলে আছে?
দুসপ্তাহ বাদে ক্যামেরন প্যালেস খুলে দেওয়া হল। বব ভ্যান্স আর হাওয়ার্ড কোর : লারার সঙ্গে আলোচনাতে বসল।
লারা বলল–আমি আর একটা ভালো জায়গা দেখেছি হোটেলের জন্য। সেটাও ক্যামেরন প্যালেসের মতো হবে। আরো বড়ো এবং আরো আরামদায়ক।
হাওয়ার্ড বলল–ওটার দেখাশোনা আমি নিজের হাতে করব।
–বেশ তো, করবেন।
তিনজনে মিলে তখন আর একটি হোটেল তৈরীর স্বপ্ন দেখছে।
নতুন এই সাইটটাও চমৎকার। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ব্রোকার বলল–আপনারা একটু দেরী করে ফেলেছেন। স্টিভ মার্কিন নামে একজন ডেভলপার ভদ্রলোক সকালে এখানে এসেছেন। তিনি একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা উনি কিনতে চাইছেন।
লারা জানতে চাইল–উনি কত দাম দিয়েছেন?
–তিন মিলিয়ন ডলার।
–ঠিক আছে, আমি আপনাকে চার মিলিয়ন ডলার দেব। আপনি এখনই সব কাগজপত্র ঠিক করুন।
এই কথা শুনে ব্রোকার অবাক হয়ে গেল। সে বলল ঠিক আছে, আমি দেখছি।
সেদিন বিকালে লারা একটা টেলিফোন পেল। ও প্রান্তে কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে।
সে বলল–আমি স্টিভ মার্কিন বলছি। শুনুন, এভাবে আমার অসুবিধা করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে কিন্তু আপনার ক্ষতিই হবে।
লারা কিছু বলার আগে লাইনটা কট করে কেটে গেল। লারা রিসিভারটা একবার নাড়াচড়া করে রেখে দিল। তার ঠোঁটের কোণে তখন দুষ্টুমি ভরা হাসির টুকরো ফুটে উঠেছে।
১৯৭৪ সাল। সারা পৃথিবী জুড়ে তখন চলেছে এক উত্তাল অবস্থা। প্রেসিডেন্ট নিকসন। ইমপিচমেন্ট এড়াতে প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের প্রধান এখন জেরাল্ড ফোর্ড। ওপেকের বৈঠকে সে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইসাবেলা পেরন আর্জেন্টিনার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছেন।
ঠিক এই সময়ে চিকাগো শহরের বুকে লারা ক্যামেরনের দ্বিতীয় হোটেল তৈরীর কাজ শুরু হল। অত্যন্ত দ্রুত কাজ এগিয়ে চলেছে। আঠারো মাস বাদে ক্যামেরন প্যালেসের। থেকে আরো বড়ো একটা চমৎকার হোটেল মাথা তুলে দাঁড়াল। এরপর লারা আর থেমে থাকল না। ওখানকার অন্যতম ম্যাগাজিন কোবারস লিখল-লারা ক্যামেরন একটা কিংবদন্তী, যাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তার নিত্য নতুন আবিষ্কার হোটেল সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে একেবারে পাল্টে দিয়েছে। সে প্রমাণ করে দিয়েছে পুরুষ ডেভলপারদের থেকে সে অনেক কদম এগিয়ে আছে। একজন নারীও যে পুরুষের মতো ক্ষমতাশালী হতে পারে, লারা ক্যামেরন তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
চারিদিক থেকে অনবরত তার ওপর প্রশংসাবাণী বর্ষিত হচ্ছে। চার্লস কোন একদিন লারাকে ফোন করল। চার্লসের অভিভূত কণ্ঠস্বর শোনা গেল–আমি তোমার জন্য গর্ববোধ করছি। সত্যি কথা বলতে কী, তোমার মধ্যে যে এতখানি প্রতিভা আছে আমি তা আগে বুঝতে পারনি।
লারা শান্তভাবে বলল–আমার কোনো অভিভাবক ছিল না। চার্লস, সেই জায়গাটা আমি তো তোমাকেই দিয়েছি। তুমি না থাকলে এবং ওইভাবে সাহায্য না করলে আমি কখনো এখানে এসে পৌঁছাতে পারতাম না।
কোহনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল–তুমি এবার নিশ্চয়ই একটা সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে।
লারা বলল–ঠিকভাবে এগিয়ে যেও, কেমন? অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করো।
কোহন ফোনটা ছেড়ে দিল। লারা রিসিভারটা রেখে সামনের দিকে তাকাল। চার্লস কোহনের মুখটা তার দৃষ্টিপথে ভেসে উঠল। এই মানুষটা সত্যি তাকে অনেক সাহায্য করেছে।
১৯৭৫, জস নামে একটা ছবি তখন সমস্ত আমেরিকাকে আলোড়িত করেছে। ছবিটা দেখার পর লোকজন সমুদ্রে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা ৪০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই কথা শুনে লারা খুবই খুশী হল।
একদিন ও কেলারকে জিজ্ঞাসা করল মিস্টার কেলার, পৃথিবীর এত জনগণের জন্য কত বাড়ি দরকার পড়বে, বলুন তো?
হাওয়ার্ড কেলার লারার মুখের দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল না, লারা তার সঙ্গে রসিকতা করতে চাইছে কিনা।
এরপর তিনটে বছর কেটে গেছে। দুটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরী হয়েছে। তৈরী হয়েছে একটা কমিনিয়াম। লারা একদিন ডিনার টেবিলে কেলারকে বলল–আমি এবার অফিস বিল্ডিং তৈরী করতে চাইছি। শহরের কেন্দ্রস্থলে।
কেলার ওর দিকে তাকিয়ে বলল–বাজারে একটা চমৎকার প্রপাটির অংশ আছে। যদি আপনার পছন্দ হয়, তাহলে আমরা অর্থের ব্যবস্থা করতে পারি।
–ঠিক আছে। আগে দেখে আসি। তারপর ভাবব।
সেদিন বিকেলে দুজনে জায়গাটা দেখতে গেল। সামনেই একটা পুকুর। জায়গাটা বেশ ভালোই লাগল লারার। দাম কত?
–একশো কুড়ি মিলিয়ন ডলার।
লারা বলল–আমার তো আতঙ্ক হচ্ছে।
–লারা রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করতে গেলে এধরনের ঝুঁকি নিতেই হবে।
লারার হঠাৎ সেই বাক্যটা মনে পড়ে গেল–অন্য লোকের অর্থ, অর্থাৎ জনসাধারণের অর্থ। বিল রজার্স তাকে একাধিকবার বলেছিল এই কথাগুলো। লারা সেগুলো সযত্নে মনে রেখেছে। মনে রেখেছে বলেই আজ সে এতটা উঠতে পেরেছে।
–এমন একজন ডেভলপারকে জানি, যারা বিল্ডিং তৈরীতে এক কপর্দকও খরচ করেনি।
লারা ভেবেচিন্তে কথাটা বলল, সত্যিই তো, অভিজ্ঞতা তার তো কম হল না। হাওয়ার্ড কেলার নানা কথা বলছে লারাকে। বলছেলারা, আপনাকে প্রতি পদক্ষেপে সাবধান থাকতে হবে। আসলে যে পিরামিড তৈরী হয়েছে সে তো কাগজের তৈরী, সবকিছু মর্টগেজ রাখা। কোথাও গোলমাল হয়ে গেলে মুনাফা অন্যের পকেটে চলে যাবে। আর আপনার ওই বিশাল পিরামিড তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। তার নীচে আপনিও চাপা পড়ে যাবেন।
–ঠিকই বলেছেন, কিন্তু এই নতুন সম্পত্তিটা কীভাবে নেওয়া যায় বলুন তো?
–যদি আমরা দুজন উদ্যোগী হতে পারি, তাহলে একটা পন্থা বের হতে পারে।
কেলার বলল–আমি বব ভ্যান্সের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করব। ব্যাঙ্কের ব্যাপারটা ও দেখাশোনা করবে। অথবা আমরা কোনো ইনসিওরেন্স কোম্পানীর সাথে কথা বলতে পারি। এরকম জায়গা থেকে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার মর্টগেজ লোন নিতে কোনো অসুবিধা হবে না।
লারা মন দিয়ে সব শুনে বলল–আপনি আমার সঙ্গে আছেন তো?
–নিশ্চয়? পাঁচ-ছবছর বাদে লিজ শেষ হবে। তখন এটা আপনি বিক্রি করতে পারবেন। আমি হিসেব করে বলছি, তাহলে আপনার ভাগ্য আরো খুলে যাবে।
–চমৎকার। লারা হেসে উঠল।
লারা মনে প্রাণে চাইছে, হাওয়ার্ড যেন তার সঙ্গে কাছে থাকে। প্রস্তাবটা সে হাওয়ার্ডের সামনে পেড়ে ফেলল। মনে মনে ভাবল, এটাই ওর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে। লারাকে হাওয়ার্ড ইতিমধ্যেই ভালোবেসে ফেলেছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কীভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করবে সে?
সমস্ত রাত হাওয়ার্ডের চোখে ঘুম এল না। রাত বুঝি আর শেষ হতে চায় না। ভোর রাতের দিকে তন্দ্রা লেগেছিল চোখের তারায়। ভোর ছটার সময় তার ঘুমটা ভেঙে গেল। কোনোরকমে মুখটা ধুয়ে ও লারার কাছে গিয়ে হাজির হল। লারা তখন একমনে খবরের কাগজ পড়ছিল। খবরের কাগজে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে সম্পত্তি সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনগুলো পড়ে। কোন বিজ্ঞাপনের মধ্যে কী লুকিয়ে আছে কে জানে।
এত সকালে হাওয়ার্ডকে আসতে দেখে তারা একটু অবাক হয়েছে। সে বলল কী ব্যাপার? এত সকালে?
হাওয়ার্ড বলল–লারা…আমি…
লারা এবার সোজাসুজি হাওয়ার্ডের মুখের দিকে তাকাল, বলল কী হয়েছে? রাতে ঘুম হয়নি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন? কী ব্যাপার বলুন তো?
–লারা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল হাওয়ার্ড। তারপর ঢোক গিলে আরো কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু লারা বলল–আমি তা জানি হাওয়ার্ড। আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।
এই বলে লারা এগিয়ে এসে হাওয়ার্ডের গালে একটা চুমু খেল। তারপর বলল এসো, আমরা দুজনে মিলে একসঙ্গে হোটেল প্রোডাকসনের সিডিউলটা তৈরী করি।
হাওয়ার্ডের আর সাহস হল না লারাকে পাল্টা চুমু খাওয়ার। ওই চেষ্টা করল না সে।
লারা আবার জিজ্ঞাসা করল–তুমি আমার পার্টনার হবে তো?
হাওয়ার্ডের কাছে এটা একটা লোভনীয় প্রস্তাব। পার্টনার হলে সবসময় সে লারাকে কাছে কাছে পাবে। এর থেকে বুড়ো প্রাপ্তি আর কী বা তার হতে পারে। কিন্তু লারাকে সে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে কি?
কদিন বাদে লারা প্রশ্ন করেছিল হাওয়ার্ড, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?
হাওয়ার্ড বলেছিল, নিজের জীবনের থেকেও তোমাকে আমি বেশী বিশ্বাস করি।
–তুমি এতদিন যা করেছে, আমি তোমাকে তার দ্বিগুণ দেব। কোম্পানীর পাঁচ শতাংশ শেয়ার তোমার থাকবে।
–আমি কি এব্যাপারে ভাবতে পারি?
–ভাবনার কী আছে? কিছুই তো নেই তাই না?
–আমি তোমার পার্টনার হব? ভাবতেই পারছি না এই প্রস্তাবটা!
কথাগুলো অসংলগ্ন হয়ে গেল। লারা ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ও হাওয়ার্ডের কাছে এগিয়ে গেল। তাকে জড়িয়ে ধরল, লারার আচরণ এখন আগের থেকে সাহসী হয়ে উঠেছে। হবারই কথা। এত অর্থের অধিকারিণী সে, যে কোনো পুরুষ এখন তার প্রেমে পড়ার জন্য ছটফট করবে।
লারা বলল–আমরা অনেক নতুন বাড়ি তৈরী করব। চারপাশের বাড়িগুলোর দিকে। তাকালে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। পরিকল্পনা নেই, যে করেই হোক একটা বাক্স খাড়া করেছে।
হাওয়ার্ড লারার কাঁধে একটা হাত রাখল। তারপর বলল–ভবিষ্যতে তুমি একইরকম থাকবে তো?
লারা কঠিন দৃষ্টিতে হাওয়ার্ডকে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর বলল–না, কোনোদিন আমি বদলাব না।
.
নবম অধ্যায়
১৯৭৬ সালকে আমরা একটা পরিবর্তনের বছর হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। এবছর দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। ইজরায়েলের সেনাবাহিনী এনটেবেতে মারাত্মক আক্রমণ চালাল। বিশ্ববিখ্যাত নেতা মাও জে দং-এর মৃত্যু হল।
আর একটি ঘটনা ঘটল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হলেন জেমস আলকাটার জুনিয়ার।
লারা ইতিমধ্যে আরো কয়েকটা বাড়ি তৈরী করেছে। একটা সুন্দর অফিস বিল্ডিং বানিয়েছে সে। ১৯৭৭, বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যু হল। এল.ভি.বেসলেকেও মৃত্যু গ্রাস করল। লারা চিকাগো শহরের সবথেকে বড়ো শপিং মল তৈরী করল। এত সুন্দর মল চিকাগোতে এই প্রথম।
এবার এল ১৯৭৮ সাল। গুয়ানা শহরে ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা। রেভারেন্ড জিম জেনস এবং তার নশশা এগারো জন অনুগামী গণ আত্মাহুতি দিলেন। আমেরিকা কমিউনিস্ট চীনকে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করল। অনুমোদন লাভ করল পানামা খাল চুক্তি।
লারা রজার্স পার্কে বেশ কয়েকটা উঁচু এবং সুন্দর কন্ডোমিনিয়াম তৈরি করে বসেছে।
এবার ১৯৭৯ সাল। ইজরায়েল আর ইজিপ্ট ক্যান ডেভিডে একটা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করল। নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটে গেল একটা দ্বীপপুঞ্জের তিন মাইল দূরে। ইরানে মুসলিম মৌলবাদীরা আমেরিকার দূতবাস বন্ধ করে দিল।
চিকাগো শহরের উত্তরে ডিয়ার ফিল্ডে লারা একটা আকাশ ছোঁয়া বাড়ি তৈরী করল। তৈরী করল একটা সুন্দর রিসর্ট।
এই হল পুরো সত্তর দর্শক জুড়ে সারা পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী। এরই পাশাপাশি আমরা লারা ক্যামেরন নামে এক মেয়ের উত্থানের গল্প শুনিয়ে দিলাম। লারা মানসিকতা রক্ষার ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিল না। এসব ব্যাপার ওর মধ্যে কোনোদিনই নেই। আসলে
ও তো একটা ভূঁইফোড়, আকাশে একটা ধূমকেতু, আত্মীয়স্বজন কোনদিনই ছিল না। সামান্য কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল। কিন্তু কারো সাথে বেশীক্ষণ আড্ডা মারা তার ধাতে সইত না। অ্যাডি বলে একটা ক্লাবে যাওয়াটাই ওর বেশী পছন্দের, কারণ সেখানে ওর বিখ্যাত জাজ শিল্পীরা বাজায়। ওদের অনুষ্ঠান লারা উপভোগ করে। লারার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈচিত্র্য হল, সে কখনো নিঃসঙ্গতা মনে করে না। আসলে মনে করার জন্য যে সময় দরকার, সেটা ওর হাতে ছিল না। প্রত্যেকটা দিন ওকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটাতে হত। সেই আর্কিটেক্ট অথবা কার্পেন্টার, ইলেকট্রিসিয়ান অথবা অন্য কোনো শ্রমিক–এদের সাথে মিলেমিশে থাকতে ভালোবাসতো লারা। বাড়ি তৈরীর ব্যাপারটা তার কাছে একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। চিকাগোতে একটার পর একটা বাড়ি তৈরী করেছে এবং আশাতীত সফলতা লাভ করেছে। এখন লারা ক্যামেরন একজন উদীয়মান তারকা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সত্যি কথা বলতে কী, ব্যক্তিগত জীবন বলতে ওর কিছুই ছিল না। সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের সঙ্গে ওর যে যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, তার স্মৃতি এখনো ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কোনো পুরুষের সাথে দুবার মেশার আগে অনেকক্ষণ চিন্তা করে। ওর প্রতি অনুরক্ত এমন অনেক পুরুষকে ও দুহাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আবার অনেকের সাথে একাধিকবার কথা বলেও তার মনে বা দেহে ছাপ ফেলতে পারেনি। মাঝে মধ্যে দু-একটা মুখ ভেসে আসত মনের ক্যানভাসে, আবার দ্রুত মিলিয়ে যেত।
লারার অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছিল। বিজনেস এগজিকিউটিভ থেকে শুরু করে সামান্য শ্রমিক সমাজের সর্বস্তরের পুরুষেরা তখন পাগলের মতো লারাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছে। এমন কী রাজনৈতিক নেতা থেকে কবি, সাহিত্যিকদের কানে কানে পৌঁছে গেছে লারার নাম। লারার প্রণয় প্রার্থী ক্রমশ আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ও যাদের সঙ্গে কাজকর্ম করত, তাদের সকলেই একটু বেশী ভালোবাসত। প্রত্যেকের সঙ্গে ও হাসিমুখে কথা বলত। কিন্তু কারো সঙ্গে বেশী ঘনিষ্ঠতা করত না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত ঝাঁকানি দিত। কিন্তু কোনো গুণমুগ্ধ পুরুষ লারার অন্দরমহলের চাবি খোলার সুযোগ এবং সাহস পায়নি। খোলামেলা এবং মিশুকে স্বভাবের হলেও ও সবসময় মুখের ওপর একটা কঠিন গাম্ভীর্যের মুখোশ চাপিয়ে দিত।
এই সময় লারা পিট রায়ান নামে একজনের ওপর আকর্ষণ বোধ করেছিল। সে লারার কর্মচারী, বয়সে যুবক। দেখতে ভালো। সব সময় মুখে অমায়িক হাসি লেগে থাকে। কাজ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে লারার সঙ্গে সে আলোচনা করত। পিটের উপস্থিত বুদ্ধি লারাকে তার দিকে আরো আকর্ষণ করে। নিজের সংস্থার এই তরুণ ফোরম্যানটিকে লারার বেশী করেই ভালো লাগতে শুরু করে।
একদিন কথা প্রসঙ্গে পিট লারাকে জিজ্ঞাসা করেছিল–আপনি কি আমার সঙ্গে ডিনার করতে রাজী আছেন?
–বেশ তো চলুন।
পিট বলল–তাহলে আমি আপনাকে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সময় মতো তুলে নেব।
–ঠিক আছে।
লারা চলে এল। নির্দিষ্ট সময়ে পিট তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। কিন্তু ডিনারে নয়, সোজা নিজের ফ্ল্যাটে, সেখানে গিয়ে বলল–জায়গাটা খুব সুন্দর।
–খুবই সুন্দর।
–তুমিও খুব সুন্দর লারা।
পিট দুহাত দিয়ে লারাকে জড়িয়ে ধরল। লারারও মানসিক প্রস্তুতি আগে থেকেই করা ছিল। অনেক আগে থেকে সে একটা তীব্র আকর্ষণ টের পাচ্ছিল। লারাকে জড়িয়ে পিট বিছানাতে গেল। তারপর দুজন সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়াল।
হঠাৎ সিন ম্যাক অ্যালিস্টারের মুখখানা ভেসে উঠল লারার মনের প্রেক্ষাপটে। প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা তাকে প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণা দেয়। কিন্তু পিট রায়ানের সঙ্গে সে যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করল, সেটা তাকে চরম আনন্দের শিখরে নিয়ে গেল। মিলনে এত উত্তেজনা আর সুখ থাকতে পারে, লারা এই প্রথমবার তা অনুভব করল। পিট রায়ানের কাছে ও সত্যি কৃতজ্ঞ। লারার প্রত্যাশা পিট মিটিয়েছে। সে যুবক, ভদ্র এবং সুন্দর ভাষায় কথা বলে। তারা একে অন্যকে বুঝতে পারে। আর কী চাই লারার?
পরের দিন সকালে লারা সাইটে গিয়ে হাজির হল। পিট রায়ানের সঙ্গে এখন দেখা করতে হবে। লারা সাইটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কাজ দেখছিল। হঠাৎ একজন শ্রমিক বলে উঠল–গুড মর্নিং মিস ক্যামেরন।
কথা বলার ভঙ্গিমাটা ভালো লাগল না লারার। ইতিমধ্যে আরো দুজন শ্রমিক এসে ওকে সম্ভাষণ জানিয়ে চলে গেছে। এখানকার সব শ্রমিক ওর দিকে তাকিয়ে কী সব বলাবলি করছে। লারা খানিকটা লজ্জা পেল। সোজা চলে এল পিট রায়ানের কাছে। পিট ওকে। দেখে হাসল, বলল–মর্নিং সুইটি, আজ রাতে তুমি কখন ডিনার করবে?
–তোমারই তো আগে খাওয়ার প্রয়োজন। আমি বুঝতে পারছি, তুমি খুবই ক্ষুধার্ত।
–যা বলেছে। পিট রায়ান হেসে উঠল।
লারা ওর দিকে আর তাকাল না।
প্রত্যেকটি বাড়ি তৈরী লারার কাছে এক একটি চ্যালেঞ্জ। কয়েকটা ছোটোখাটো অফিস বিল্ডিং ইতিমধ্যে সে তৈরী করে ফেলেছে। হোটেলের ধারে কয়েকটা কটেজবার নিয়েছে। বাড়িটা কী ধরনের হল, এব্যাপারে লারার যত না উৎসাহ, তার থেকে বেশী উৎসাহ লোকেসন নির্বাচন। বিল রজার্সের কথাটা ওর মনে গেঁথে আছে। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনটে জিনিস মনে রাখা দরকার। এক, লোকেসন, দুই লোকেসন এবং তিন লোকেসন।
লারার সাম্রাজ্য তখন ক্রমশ বেড়ে চলেছে। শহরের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকরাও লারাকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে। প্রেসের লোকজন মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য । ছটফটানি শুরু করে। লারা এখন এই শহরের এক গ্ল্যামারাস ফিগার। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ও যেখানে যায়, চারপাশের গুণমুগ্ধদের ভিড় জমে ওঠে। ক্যামেরাম্যানরা ফটো তোলে। ওর খবর জানার জন্য প্রেস উদগ্রীব চিত্তে অপেক্ষা করে। প্রচারমাধ্যমের মুখোমুখি ওকে মাঝে মধ্যে দাঁড়াতে হয়। এতগুলো সফল বিল্ডিং-এর মালিক হওয়া সত্ত্বেও লারা কিন্তু তৃপ্ত নয়। লারার কেবলই মনে হয়, ওর জীবনে এমন একটা ম্যাজিক ঘটুক, যা হবে কল্পনার বাইরে, অভিনব কিছু, যাকে ও কোনোদিন ভাবতে পারেবে না।
হাওয়ার্ড কেলার একদিন জিজ্ঞাসা করল–লারা, তুমি আর কী চাও?
লারা চোখ বন্ধ করে বলল–চাওয়ার কী শেষ আছে, হাওয়ার্ড? আমি অনেক কিছু চাই। আমি এই গোটা পৃথিবীর সম্রাজ্ঞী হতে চাই।
লারার দুটি চোখ তখন স্বপ্নের জগতে ভেসে গেছে। লারা তখন অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল সে। তারপর ওর ঘোর কেটে গেল। ও হাওয়ার্ডকে বলল–হাওয়ার্ড, তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে, আমরা বিভিন্ন সার্ভিসের পেছনে প্রতি মাসে কত খরচ করছি?
হাওয়ার্ড বলল–সেটা তো একটা প্রয়োজনীয় খরচ।
–আমি সেই খরচটা কিনতে চাইছি।
–তুমি কী বলতে চাইছো?
–আমরা একটা সাপ্লাই ডেয়ারি ব্যবস্থা কি চালু করতে পারি না? অন্য বিল্ডাররা তা কখনো ভেবে দেখেনি। ধরো, আমরাই এ ধরনের সার্ভিস চালু করলাম। লিনেন সার্ভিস থেকে উইন্ডো, ওয়াশার, দারোয়ান প্রভৃতি সব আমরাই সাপ্লাই করব।
এই ব্যবস্থা শুরু হল। প্রথম থেকেই এটা সফল হতে শুরু করল। হাওয়ার্ড কেলারের মনে হচ্ছিল, লারা নিজের চারপাশে আবেগের একটা দেওয়াল তৈরী করেছে। হাওয়ার্ড অন্যদের থেকে অনেক বেশী কাছের লোক। কিন্তু হাওয়ার্ডকে লারা কোনোদিন তার পরিবার সম্পর্কে কোনো কথা বলেনি। মনে হয়, ও বোধহয় একটা কুয়াশার ঘেরাটোপের মধ্যে বসে থাকতে ভালোবাসে। এই প্রহেলিকা ভেদ করা খুবই কঠিন। প্রথম থেকেই হাওয়ার্ড কেলার লারার কাছে অভিভাবকের মতো থেকেছে। মাঝেমধ্যে লারাকে শিখিয়েছে ওকে চালনা করেছে, কিন্তু ইদানিং লারা হাওয়ার্ডের কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাওয়ার্ড বুঝতে পারছে, আগামীকাল লারা হয়তো ওর বাঁধন কেটে অন্য কোথাও উড়ে যাবে।
লারা জানে, তার নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য পথ নেই। স্মরণ করার মতো কোনো অতীত নেই। ভাববার মতো ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু নিজের ওপর প্রচণ্ড আস্থা আছে লারার, ওকে থামানোর সাধ্য কারোর নেই। এছাড়া আর একটা শব্দ ও মেনে চলে। তাহল, অল্পে তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। যে কোনো কাজ করতে গেলে সেই কাজকে ত্রুটি শূন্য করতে হবে। লারা যেটাকে পেতে চায়, সেটাকে পাবার জন্য তীব্র জেদ আর ক্ষমতা জাহির করে। প্রথম দিকে লারা অনেক কিছু জানত না। কিছু কিছু শ্রমিক কর্মচারী ওর অসহায়তার সুযোগ নিয়েছিল। এখন লারা সব কিছু জেনে গেছে। কোনো কোনো পুরুষ কর্মীদের মনে একধরনের হীনমন্যতা দেখা দিয়েছিল। মহিলার অধীনে কাজ করতে হবে ভেবে তারা প্রতি মুহূর্তে দগ্ধ হচ্ছিল। কিন্তু এখন ব্যাপারটা একেবারে পাল্টে গেছে। এখন লারার কোম্পানীতে যোগ দেবার জন্য মানুষের লাইন চোখে পড়ে।
লারাও ব্যাপারটা উপভোগ করে। একদিন হাওয়ার্ড কেলারকে সঙ্গে নিয়ে লারা গাড়ি ড্রাইভ করে কে. জি. এভিনর ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা মাঝারি গোছের ব্লক লারার চোখে পড়ল। সেখানে ছোটো ছোটো দোকান আছে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা থামাল। হাওয়ার্ডকে বলল হাওয়ার্ড, এই ব্লকটা তো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে একটা সুন্দর হাইরাইজ হতে পারে নাকি? দেখতেও সুন্দর হবে বাড়িটা, বেশী লাভ হবে। এইসব ছোটো দোকানের আয় কতই বা হয়?
হাওয়ার্ড বলল–সবই ঠিক ম্যাডাম, কিন্তু এই দোকানদাররা যদি তাদের দোকান বিক্রি করতে না চায়, তা হলে কী হবে?
–আমি সবটাই কিনে নেব। অর্থের কোনো অভাব হবে না। ওদের রাজী হতেই হবে। হাওয়ার্ড বলল ঠিক আছে, তুমি এখানে একটা উঁচু বাড়ি তৈরী করতে চাইছে, এই খবরটা জানলে রাজী হবে না।
–ওরা জানবে কী করে? আমি কী করতে চাইছি সে খবর বলব কেন? ওদের প্রত্যাশার থেকে অনেক বেশী দিয়ে আমি ওদের কাছ থেকে সবকিছু কিনে নেব।
লারা কেনবার উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠেছে। সে বলল–আগে সবাইয়ের কাছে আমার প্রস্তাবটা দেওয়া যাক।
–ঠিক আছে। আমি আগে কথা বলি। কিন্তু সবাধান খবরটা যেন কোনো ভাবেই ফাঁস না হয়। তাহলে ওরা কিন্তু পেয়ে বসবে।
লারা আর হাওয়ার্ডদুজনেই ব্লকটা কেনার জন্য এগিয়ে এল, কে. জি. এভিনর এই ব্লকটাতে এক ডজনের বেশী দোকান আর স্টোর আছে। কোনোটা বেকারী, কোনোটা ওষুধের দোকান। কোনোটায় দরজি বসে বসে সেলাই করছে। কেউ বা পোশাকের দোকান দিয়েছে। আর আছে হার্ডওয়্যার স্টোর।
হাওয়ার্ড কেলার লারাকে সাবধান করে দিয়ে বলল–খুব সাবধানে কথাবার্তা বলতে হবে। একজন যদি না চায়, তাহলে কিন্তু আমাদের প্রস্তাবটা কার্যকর হবে না।
লারা বলল–চিন্তার কিছু নেই। আমি নিজে এ ব্যাপারটা দেখছি।
এই মুহূর্তে লারাকে কেউ থামাতে পারবে না। এক সপ্তাহ কেটে গেছে। একজন আগন্তুক এসে একটি সেলুনে হাজির হল। তখন সেখানে একজন চুল কাটছিল। আগন্তুককে বসতে বলল লোকটি। পাশেই একজন বসে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিল। সে বলল–আপনি কি চুল কাটবেন?
আগন্তুক বলল–না, আমি এখানে চুল কাটতে আসিনি। আমি এ শহরে প্রথম এসেছি। নিউজার্সিতে আমার একটা সেলুন আছে। কিন্তু আমার স্ত্রী চাইছে এখানে সেলুনটা নিয়ে আসতে। তা হলে সে অসুস্থ মায়ের কাছাকাছি থাকতে পারবে। সেজন্য আমি এখানে একটা দোকান খুঁজছি।
–এখানে সেলুন এই একটাই। বিক্রির জন্য কোনো চিন্তাভাবনা নেই আমার। আগন্তুক মৃদু হাসল-দেখুন, বিক্রি যখন ইচ্ছে করা যায়। এর কোনো সময় অসময় নেই। কি তাইতো? আমি যদি উপযুক্ত দাম দিই, এই ধরুন পঞ্চাশ কিংবা ষাট হাজার ডলার, তাহলে কি আপনি ব্যাপারটা নিয়ে ভাববেন?
লোকটা গম্ভীর হয়ে গেল, আগন্তুক বলল–দেখুন, আমি দোকানটা পাওয়ার জন্য খুবই আগ্রহী। আমি পঁচাত্তর হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে রাজী আছি।
–আমি সেলুনটা বিক্রির ব্যাপারে এখনই কোনো চিন্তাভাবনা করছি না।
আগন্তুক তখনো নির্বিকার। সে বলল–একশো হাজার ডলার।
–আমি সত্যিই ভাবছি না।
আগন্তুক বলল–দেখুন, এখানে যা যা যন্ত্রপাতি আছে, সে সবও আপনি নিয়ে যেতে পারেন।
লোকটি এবার অদ্ভুত দৃষ্টিতে আগন্তুককে দেখল। বলল–আপনি বলছেন?
-হ্যাঁ, আমার নিজের যন্ত্রপাতি আছে।
–আমাকে একটু ভাবতে দিন, আমার স্ত্রীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হবে।
–নিশ্চয়ই। আমি তাহলে আগামী পরশু আসব। ঠিক এই সময়ে।
আগন্তুক চলে গেল। লোকটা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল।
দু-দিন বাদে দোকানটা বিক্রি হয়ে গেল। কিনল ওই আগন্তুক।
লারা মৃদু হেসে বলল–একটা হল, এর পরের লক্ষ্য বেকারী। সেটাকেও কিনে নিল সে।
প্রায় ছ-মাসের মধ্যে সব কিছু কেনা হয়ে গেল। এবার এখানে অন্য লোকজনের আগমন ঘটল। প্রথমেই লারা আর্কিটেক্টকে দিয়ে আকাশছোঁয়া অট্টালিকার একটা নকশা তৈরী করে নিল। কিন্তু হাওয়ার্ড একদিন বলল–লারা, একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
–কী সমস্যা?
–কফি শপের লোকটা এখনো রাজী হয়নি।
–আচ্ছা, এটা নিশ্চয়ই একটা সমস্যা। পাঁচ বছরের লিজে ও এখানে আছে। লিজ ছাড়তে চাইছে না। তাই তো? অর্থের বেশী লোভ দেখাতে হবে?
–যে কোনো মূল্যেই ও রাজী হচ্ছে না।
লারা হাওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল–লোকটা কি জানে এখানে হাইরাইজ হবে?
-না।
–ঠিক আছে। আমি নিজে ওর সঙ্গে কথা বলব। চিন্তার কিছু নেই। তুমি বরং খোঁজ নাও, ও কার কাছ থেকে লিজ নিয়েছে।
-বেশ।
হাওয়ার্ড যত লারাকে দেখছে, তত অবাক হয়ে যাচ্ছে। কোনো ব্যাপারেই সে অল্পেতে ভেঙে পড়ে না। মেয়েটা রীতিমতো আত্মপ্রত্যয়ী। যে কাজ কেউ করতে পারবে না, সে কাজে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পরদিন সকালবেলা লারা তার নতুন সাইটে হাজির হল। ব্লকের শেষ প্রান্তে অফিস ঘর। দোকান খুবই ছোটো। কয়েকটা মাত্র চেয়ার টেবিল। কাউন্টারের পেছনে একজন দাঁড়িয়েছিল। লারার মনে হল, এই লোকটাই বোধহয় দোকানের মালিক। তার বয়স ষাটের কাছাকাছি।
লারা গিয়ে একটা চেয়ারে বসল। লোকটা ওকে দেখে বলল–সুপ্রভাত, কী খাবেন বলুন?
–অরেঞ্জ জুস আর একটা কফি।
–এখনই দিচ্ছি।
লোকটা কফি ঢালতে ঢালতে বলল–আমার কাজের মেয়েটি এখনো আসেনি। অগত্যা সবকিছু আমাকেই করতে হচ্ছে। প্লেটটা নিয়ে সে এগিয়ে এল লারার কাছে। একটা হুইল চেয়ারে সে বসে আছে, তার দুটি পা নেই। লারা দেখল ভালো করে।
লারা বলল–জায়গাটা খুবই চমৎকার। আরো জানতে চাইল সেকতদিন এখানে আছেন?
লোকটি বলল–দশ বছর।
–এখনো বিশ্রাম নেবার কথা ভাবেননি কেন?
লোকটি মাথা নাড়ল। বলল–আপনি হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যে আমাকে এই কথাটা জিজ্ঞাসা করল। আমি রিটায়ারের কথা এখনো ভাবিনি।
–যদি আপনি অনেক অর্থ পেয়ে যান, তাহলে? নিশ্চয়ই আপনাকে কেউ এরকম প্রস্তাব দেয়নি, তাই না?
লারা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকল। এখন সে মুখের ভাষা পড়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আয়ত্ত করেছে।
লোকটা বলল–অর্থ কোনো ব্যাপার নয় মিস। এখানে আসার আগে আমি দুবছর হাসপাতালে ছিলাম। আমার কোন বন্ধু ছিল না। জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। হঠাৎ একজন আমাকে এই জায়গাটা লিজ দেবার প্রস্তাব দেয়। সেটা আমার জীবনের চলার ছন্দকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। এখানকার অনেকেই চলে গেছে। কিন্তু আমার কাছে জায়গাটার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। অর্থ দিয়ে তা বিচার করা সম্ভব নয়।
আবেগে লোকটার কণ্ঠস্বর বুজে এসেছে। সে বলল–আপনাকে আর একটু কফি দেব কি?
–দিন।
এই মুহূর্তে লারাকে আরো কথা বলতে হবে। এই লোকটাকে সরাতে না পারলে তার স্বপ্নটা সফল হবে না। জীবনের কোনো খেলায় লারা কখানো পরাজিত হয়নি। এই খেলাতেও সে শেষ পর্যন্ত জিতবে।
আর্কিটেক্টের কথা মনে পড়ে গেল লারার। পাশেই বসেছিল হাওয়ার্ড কেলার। ওর মুখটা গম্ভীর।
কথার মাঝখানে হাওয়ার্ড বলল–এখনো পর্যন্ত এই দোকানটা আমরা নিতে পারিনি, কিন্তু মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। ওর শর্ত হল প্রতি মাসে যদি ও ঠিকমতো ভাড়া না দিতে পারে তাহলে মাস কয়েক পরে এই দোকানটা বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে।
লারা শুনল। তারপর জিজ্ঞাসা করল–আর একটা প্রশ্ন আছে।
ড্রইংটা টেবিলের ওপর মেলে ধরল লারা। কফি শপের ওপরে পেনসিলটা রাখল। বলল–আমরা যদি জায়গাটাকে ছেড়ে দিয়ে বিল্ডিংটা তৈরী করি, তাহলে কি কোনো অসুবিধা হবে? জায়গাটা খুবই ছোটো আর একদম ধারে।
আর্কিটেক্ট বলল–অসুবিধা হবে না। প্ল্যান ডিজাইনটা একটু পাল্টাতে হবে।
হাওয়ার্ড বলল–লোকটাকে জোর করে তুলে দিলে কেমন হয়?
লারা মাথা নেড়ে বলল–না-না, তা কেমন করে হবে? তাছাড়া ওটাকে বাদ দিয়ে তো আমরা কিনেছি।
হাওয়ার্ড মাথা নেড়ে বলল–তুমি ঠিকই বলেছে।
লারা বলল ঠিক আছে, আমাদের কাজ শুরু হোক। কফিশপ যেমন আছে, তেমনই থাক। এতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।
হাওয়ার্ড আরো একবার লারার অসামান্য সাহস আর উৎসাহের পরিচয় পেল। সে বুঝতে পারল, লারাকে কেউ কোনোদিন থামাতে পারবে না।
কয়েক দিন কেটে গেছে। লারা হাওয়ার্ডকে বলল–আমার ইচ্ছে, তুমি একবার স্কটল্যান্ড যাও।
–কেন? স্কটল্যান্ডে বাড়ি তৈরী করবে নাকি?
লারা মৃদু হাসল, তার চোখের দৃষ্টিতে রহস্যের আভাস। সে বলল–আমি ওখানে একটা প্রাসাদ কিনতে চাই। ওখানে একটা উঁচু জমি আছে। নাম লট মারলিক। রাস্তার ওপরে সমস্ত জায়গাটা জুড়ে একাধিক প্রাসাদ আছে। এর মধ্যে যে কোনো একটা আমি কিনব।
–অনেকটা খামার হোমের মতো। তাই তো?
–না, আমি গরম কালে ওখানে থাকব না। সেরকম কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। ওখানকার মাটিতে আমার বাবার সমাধি করতে চাই। আমার বাবার কবরটা এখন গ্রেস বে-র গ্রিল ভিউ সিমিস্ট্রিতে রয়েছে। ওখান থেকে স্থানান্তরিত করতে হবে।
এই প্রথম হাওয়ার্ড লারার পরিবারিক ব্যাপারে খবর শুনল। সে বলল–তোমার বাবাকে তুমি খুবই ভালোবাসো, তাই না?
–ভালোবাসা? লারা মুখের ওপর মনের ভাব প্রকাশ করল না। সে বলল–কাজটা তুমি করবে তো?
–নিশ্চয়ই?
–সমাধির জন্য একটা জায়গা ঠিক করবে। কেয়ারটেকারও নিযুক্ত করতে হবে।
–বেশ তো।
বাবার প্রতি ভালোবাসার কথা শুনে হাওয়ার্ড মুগ্ধ হয়ে গেল।
তিন সপ্তাহ বাদে হাওয়ার্ড স্কটল্যান্ড থেকে ফিরে এসে বলল–সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তোমার একটা প্রাসাদ কেনা হয়েছে। সেটাই তোমার বাবার বিশ্রাম স্থান হবে। পাহাড়ে ঘেরা আর গাছপালায় ভরা জায়গাটা খুবই সুন্দর। দেখলে দুচোখ জুড়িয়ে যাবে। তুমি কবে যাবে?
লারা বলল–আমি? আমি তো যাব না!
লারার কথা শুনে হাওয়ার্ড কেলার খুবই অবাক হয়ে গেল। এখনো পর্যন্ত লারা তার কাছে এক দুর্বোধ্য রহস্যময়ী নারী হিসাবেই থেকে গেছে। হাওয়ার্ড জানে, ওই রহস্যের আবরণ সে কোনোদিন ভেদ করতে পারবে না।