১. বিজ্ঞাপন ছাপা হল

এ মার্ডার ইজ অ্যানাউনসড (১৯৫০) – আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ

০১.

রীতিমত চমকে দেবার মত একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হল চিপিং ক্লেগহর্ন গেজেটের বিজ্ঞাপন কলমে।

…একটি খুন হবে শুক্রবার ২৯শে অক্টোবর, সন্ধ্যা সাড়ে ছটায়, লিটল প্যাডকস-এ। বন্ধুরা অনুগ্রহ করে একমাত্র ঘোষণাটি লক্ষ্য করবেন।

লিটল প্যাডকস হল ভিক্টোরিয়া যুগের আদলে মাঝারি আকারের একটি বাড়ি। বাড়িতে সবার আগে চোখে পড়ে দীর্ঘ বারান্দা আর সবুজ পাল্লার জানালা।

বিরাট দীর্ঘ ড্রইংরুম। একসময়ে এই ঘরখানায় দুটো দরজা ছিল। ঘরের একদিকে জানালা সহ একটা ছোট ঘর। অনেক আগে দুটো আলাদা ঘর হিসেবেই এটি ব্যবহৃত হত। বর্তমানে মাঝখানের বাধা সরিয়ে দুটো ঘরকে একটা ঘরেই বদলে নেয়া হয়েছে।

ঘরের মধ্যে দুপাশে দুটি চুল্লী। তবে এগুলো ব্যবহার করা হয় কম। কেননা বাড়িতে কেন্দ্রীয় তাপচুল্লী রয়েছে।

লিটল প্যাডকস-এর বর্তমান কর্তী মিস ব্ল্যাকলক। তাঁর বয়স ষাট ছুঁয়েছে। তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাইঝি জুলিয়া সিমন্স ও ভাইপো প্যাট্রিক সিমন্স থাকে তার সঙ্গে।

আর আছেন মিস ডোরা বানার-মিস ব্ল্যাকলকের স্কুল জীবনের বান্ধবী। দুজনেই সমবয়স্কা। এই অনাথা বান্ধবীটিকে দেখাশোনার কেউ ছিল না। বৃদ্ধ বয়সের পেনসনেই তার দিন কাটত।

স্কুল জীবনের বান্ধবী। নিতান্ত আবেগ তাড়িত হয়েই মিস ব্ল্যাকলক তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন, এতবড় বাড়ি সামলানোর জন্য তার বিশেষ সাহায্যের দরকার ছিল।

বেচারী ডোরা একটু ভুলো মনের মানুষ। সবসময় সব ব্যাপার খেয়াল রাখতে পারেন না। তার জন্য মাঝে মাঝে বেশ সমস্যায় পড়ে যেতে হয় মিস ব্ল্যাকককে। তবে তাদের উভয়ের মধ্যে স্নেহ প্রীতি আনুগত্য অক্ষুণ্ণই ছিল।

.

সরকারী ভাবে ঘটনাটার তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছিল ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর ডারমট ক্র্যাডকের ওপরে।

এই মুহূর্তে তার কাছেই ঘটনার বিবরণ শুনছিলেন মিডলসায়ারের চিফ কনস্টেবল জর্জ রাইডেসডেল।

ক্র্যাডক জানালেন, কনস্টেবল লেগ ফোন করেছিল স্যার। সে ঠিক মতই কাজ করে চলেছে। অবস্থার পর্যালোচনা করছে দ্রুত।

নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে? জানতে চাইলেন রাইডেসডেল।

-হ্যাঁ স্যর, রুডি সার্জ। জাতিতে সুইস। মেডেনহ্যাম ওয়েলসে স্পা হোটেলে রিসেপসানিস্টের কাজ করত। সার্জেন্ট ফ্লেচার সেখানে গেছে। সে বাসের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে সেখানে যাবে।

এমনি সময় দরজা খুলে ঘরের ঢুকলেন স্যার হেনরি ক্লিদারিং। দীর্ঘ চেহারার সুপুরুষ চেহারার বয়স্ক মানুষ। ইনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রাক্তন পুলিস কমিশনার।

-ক্র্যাডক নর্থ বেনহ্যাম নিউজ আর চিপিং ক্লেগহন গেজেটে আধ ইঞ্চি পরিমাণ বিজ্ঞাপনটা পড়ে শোনালেন।

-বেশ আগ্রহ জাগানো বিজ্ঞাপন। বলনেল স্যার হেনরি।

–বিজ্ঞাপনটা কে দিয়েছিল? জানতে চাইলেন রাইডেসডেল।

বর্ণনা যা পাওয়া যায় তাতে জানা যায়, রুডি সার্জ নিজেই দেয় বুধবার।

–এর উদ্দেশ্য কি হতে পারে? স্যর হেনরি প্রশ্ন করলেন।

–কি আর উদ্দেশ্য–স্থানীয় মানুষের কৌতূহল জাগানোর চেষ্টা আর কি। রাইডেসডেল বললেন।

–চিপিং ক্লেগহর্ন জায়গাটা কি রকম? স্যর হেনরি প্রশ্ন করলেন।

-বেশ বড় এলাকা। প্রাকৃতিক দৃশ্যময় গ্রাম। কৃষি শ্রমিকদের জন্য ওখানে যেসব কটেজ বানানো হয়েছিল বর্তমানে সেখানে কিছু বয়স্কা অবিবাহিতা মহিলা আর কিছু অবসরপ্রাপ্ত দম্পতির বাস। ভিক্টোরিয় যুগের কিছু বাড়িও আছে।

বোঝা যাচ্ছে, বিজ্ঞাপনটা দেখে স্থানীয় সকলেই যে সন্ধ্যা ছটায় সেখানে ব্যাপার জানতে হাজির হবে তাতে সন্দেহ নেই। সেই বৃদ্ধা মহিলাটি যদি হাজির থাকতেন তাহলে তিনিও নির্ঘাৎ মাথা গলাতেন। বললেন স্যর হেনরি।

-বৃদ্ধা মহিলাটি কে?

–তিনি ঈশ্বরের বিশেষ সৃষ্টি একজন গোয়েন্দা। অসাধারণ প্রতিভাময়ী। সারাক্ষণ এই বয়স্কা অবিবাহিতাকে শুধু সেলাই করতেই দেখা যায়। তিনি তোমাকে অবলীলায় বলে দেবেন কি ঘটতে পারত, আর সত্যিই কি ঘটেছিল। আর এটাও তিনি বলতে পারবেন কেন এটা ঘটেছিল।

–কথাটা মনে রাখব স্যর। বললেন ইনসপেক্টর ক্র্যাডক।

এরপর রাইডেসডেল তাঁর বন্ধু স্যর হেনরিকে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন।

–তোমার অনুমানই ঠিক। পড়শীরা সবাই সেখানে হাজির হয় ৬-৩০ মিনিটে। কিন্তু ওই সুইডিস ছোকরা কি জানত যে তারা সেখানে হাজির হবেই? তাছাড়া লুঠ করে নেবার মত যথেষ্ট জিনিস তাদের কাছে সেই সময় থাকা কি সম্ভব?

স্যার হেনরি বললেন, এটা কোন লুঠ করার ঘটনা নয়। সিনেমার মত ভয় দেখানোর মজা করাই হয়তো উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু লোকটা নিজেকে গুলি করল কি ভাবে?

রাইডেসডেল একটা কাগজ টেনে নিয়ে একপলকে দেখে নিয়ে বললেন, ডাক্তারের প্রাথমিক রিপোর্ট হল রিভলভার ছোঁড়া হয় খুব কাছে থেকে–এটা আত্মহত্যা না খুন বোঝার উপায় নেই।

–রিভলভার সম্পর্কে রিপোর্ট কি?

–বিদেশে বানানো। এর জন্য সার্জের কোন অনুমতিপত্র ছিল না।

–তাহলে তো ছোকরা দেখছি সুবিধের ছিল না। বললেন স্যর হেনরি।

রাইডেসডেল বললেন, ক্র্যাডক, সার্জ সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় কিনা একবার রয়্যাল স্পা হোটেলে গিয়ে খোঁজ নাও।

.

রয়্যাল স্পা হোটেলে পৌঁছে ক্র্যাডক ম্যানেজার মিঃ রোল্যাণ্ডসনের ঘরে উপস্থিত হলেন।

ইনসপেক্টরের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানলেন, সার্জ অতি সাধারণ হাসিখুশি তরুণ বলেই মনে হয়েছে। এ ধরনের ডাকাতি করবার মত তাকে মনে হয়নি।

–আপনার এখানে সে কতদিন ছিল?

–তিন মাসের কিছু বেশি। প্রশংসাপত্র ভালই ছিল।

–মানে-ইয়ে–বলতে

–বোঝা যাচ্ছে কোথাও গোলমাল ছিল। কি সেটা?

–অনেকটা তাই মানে দুই একবার বিল নিয়ে একটু ঝামেলা হয়। এমন কিছু জিনিসের দাম ধরা হয়েছিল যা হোটেলে ছিল না। আর বিলের টাকা মিটিয়ে দেবার সময় সে সেই বাড়তি টাকা আত্মসাৎ করেছিল। এই রকমই কিছু…

–তার জীবনে কোন মেয়ে ছিল?

 –হ্যাঁ, মার্না হ্যারিস-গ্রিলের একজন ওয়েট্রেস।

তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। বললেন ক্র্যাডক।

.

মেয়েটি এককথায় সুন্দরী। চমৎকার মুখের গড়ন। রক্তিম চুল আর তীক্ষ্ণ নাক।

 পুলিস দেখে সে বেশ ভীত আর সতর্ক হয়ে পড়েছিল।

–আমি কখনওই ভাবতে পারিনি রুডি এই ধরনের লোক। রিসেপশানে কাজ করতো বলে ভাল বলেই মনে করেছিলাম। এখন দেখছি বিদেশীদের বিশ্বাস করা যায় না। তবে ও খুব শান্ত আর ভদ্র ছিল।

-আপনি তাকে ভাল জানতেন?

-তা বলা যাবে না। তবে আমরা বন্ধু ছিলাম। ওর বেশি কিছু নয়। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি রুডি খুব বড় বড় কথা বলতে চাইত।

–কি রকম বড় বড় কথা? জানতে চাইলেন ক্র্যাডক।

–যেমন সুইজারল্যাণ্ডে ওর আত্মীয়রা সকলেই বড়লোক…অর্থকরী লেনদেনের বাধা-নিষেধের জন্যই সে দেশ থেকে টাকা আনাতে পারে না। আমি অবশ্য কোন গুরুত্ব দিতাম না এসব কথায়। আরও বলত, আল্পস পর্বতে ওঠার কথা…হিমবাহের কাছে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সব গল্প…

–মিস ব্ল্যাকলকের কথা আপনাকে কখনও বলেছিল?

-না, রুডি তার নাম আমার কাছে কখনও করেনি। তবে জানতাম তিনি এই হোটেলে মাঝে মাঝে মধ্যাহ্ন ভোজ করেন। একবার এখানে থেকেও ছিলেন। আমি জানতাম রুডি তাকে চেনে।

–চিপিং ক্রেগহর্নের কথা কিছু বলেছিল?

–মনে করতে পারছি না।

 মার্না হ্যারিসের কাছ থেকে আর কিছু জানা গেল না। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইনসপেক্টর উঠে দাঁড়ালেন।

.

০২.

 লিটল প্যাডকস-এর সদর দরজায় এসে দাঁড়াল ক্র্যাডকের গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন্ট ফ্লেচার বাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো।

–তুমি রয়েছে ফ্লেচার, বলার মত আছে কিছু?

-বাড়িতে খোঁজ নিয়েছি স্যর। সার্জের হাতের নিদর্শন কোথাও পাওয়া যায় নি। বাড়ির দরজা জানালা জোর করে ভেঙে ঢোকার কোথাও চেষ্টা করা হয়নি। মনে হচ্ছে, সে ছটার সময় মেডেনহ্যাম থেকে বাসে এখানে আসে।

শুনলাম বাড়ির পাশের দরজা সাড়ে পাঁচটায় বন্ধ করা হয়। সে সামনের দরজা দিয়েই ঢুকেছিল–বাড়ির পরিচারিকা কিন্তু জানিয়েছে সারা বিকেল দরজা বন্ধ ছিল। মেয়েটা একটু পাগলাটে-ইউরোপীয় উদ্বাস্তুরা যেমন হয়ে থাকে।

-আর কিছু? হাসলেন ক্র্যাডক।

–আলোর ব্যবস্থায় কোথাও কোন গোলমাল দেখা যায়নি। কেবল ড্রইংরুম আর হলঘরের সার্কিটটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আলোর কারচুপিটা সে কি ভাবে করে বুঝতে পারা যাচ্ছে না। ফিউজবক্সে কিছু করতে হলে রান্নাঘরের সামনে দিয়ে যেতে হত তাহলে পরিচারিকার চোখে পড়ত।

–সে সার্জের লোক হতে পারে।

–খুবই সম্ভব স্যর। দুজনেই বিদেশী। তাছাড়া পরিচারিকাটি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ফ্লেচার তার বক্তব্য শেষ করলে ক্র্যাডক সদর দরজায় ঘন্টা বাজালেন।

 স্বর্ণকেশী সুন্দরী এক তরুণী দরজা খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে গেল।

লিটল প্যাডকস-এর কত্রী মিস ব্ল্যাকলককে নিজের পরিচয় দিলেন ক্র্যাডক। তিনি লক্ষ্য করলেন, মাহিলার বয়স ষাটের কাছাকাছি। বেশ বুদ্ধিমতী আর দৃঢ়তাব্যঞ্জক চেহারা। তাঁর বাঁ কানে ব্যাণ্ডেজ লাগানো।

মহিলার পাশেই বসেছিলেন গোলাকৃতি মুখের প্রায় একই বয়সের একজন স্ত্রীলোক। ক্র্যাডক বুঝলেন ইনিই মিস ডোরা বানার-কনস্টেবল লেগ তার সম্পর্কেই একটা বিশেষণ ব্যবহার করেছিল–খ্যাপাটে।

প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের সুযোগে ক্র্যাডক ঘরটা জরিপ করে নিলেন।

ভিক্টোরিয় যুগের আদলে তৈরি জোড়া ড্রইংরুম। দুটো বড় চেয়ার, সোফা। মাঝখানের টেবিলে বড় পাত্রে রাখা হয়েছে ক্রিসানথিমাম-টাটকা আর সজীব।

–দুঃখজনক ঘটনাটা কি এই ঘরেই ঘটেছিল মিস ব্ল্যাকলক?

–হ্যাঁ।

গতরাত্রে এইঘর একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। বলে উঠলেন মিস বানার। –গতরাতের ঘটনার কথায় আসার আগে আমি একটা কথা জানতে চাই, রুডি সার্জকে আপনি কখন প্রথম দেখেছিলেন?

-রুডি সার্জ…লোকটার ওই নাম? মেডেনহ্যামের স্পা হোটেলে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল?

-কতদিন আগে?

–প্রায় তিন সপ্তাহ আগে। আমি আর আমার বন্ধু এই ডোরা সেখানে সেদিন মধ্যাহ্নভোজ করছিলাম।

-কোন কথা হয়েছিল।

–আমরা যখন চলে আসি তখন এক তরুণ এগিয়ে এসে বলল, আপনি মিস ব্ল্যাকলক, তাই না? তারপর সে বলল, সে হল মট্রিউর হোটেল দ্য আলপসের মালিকের ছেলে। আমি আর আমার বোন যুদ্ধের সময় সেখানে একমাস ছিলাম।

-ওকে আপনি চিনতে পেরেছিলেন?

-না, চিনতে পারিনি। তবে হোটেলের মালিক অমায়িক মানুষ ছিলেন, তাই তার ছেলের প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে বলি, ইংলণ্ডে তার কেমন লাগছে। সে জানায় তার বাবা তাকে ছমাসের জন্য হোটেল ব্যবসা শিখতে পাঠিয়েছে।

তার সঙ্গে আপনার দ্বিতীয়বার কোথায় দেখা হয়?

–প্রায় দিন দশেক আগে। হঠাৎ এখানে এসে হাজির হয়। কিছু টাকা চায় আমার কাছে। জানায় তার মা অসুস্থ, সুইজারল্যাণ্ডে ফিরে যাবার জন্য তার ভীষণ টাকার দরকার।

-লেটি ওকে টাকা দেয়নি। মিস বানার বলে উঠলেন।

-হ্যাঁ; বললেন মিস ব্ল্যাকলক, তখন আমার ধারণা হয়েছিল, ছেলেটি ধাপ্পাবাজ। কেননা তার বাবা স্বচ্ছন্দেই এখানে তার করে তার ফেরার ব্যবস্থা করতে পারতেন। আমার সন্দেহ হয় হোটেলের টাকা তছরুপ করেছিল সে।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, টাকা না পেয়ে বিনা প্রতিবাদেই চলে গিয়েছিল সে। যেন টাকা পাবে না সে জানত।

–আপনার কি মনে হয়, টাকার অছিলা নিয়ে সে এবাড়ির খোঁজখবর নিতেই এসেছিল? অর্থাৎ গুপ্তচরবৃত্তি

-হ্যাঁ, কথাটা আমারও মনে হয়েছে। কেন না চলে যাওয়ার মুখে সে ঘরগুলো সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিল–তারপরই হঠাৎ সামনে লাফিয়ে সদর দরজা খুলে দেয়। সম্ভবতঃ দরজার খিল দেখতে চেয়েছিল।

-শুনেছি বাগানের দিকে একটা পাশের দরজা আছে।

–হ্যাঁ।

 –যখন বাইরে যান তখন ওটা বন্ধ ছিল?

–ভেতরে ঢোকার পর বন্ধ করি।

–সময়টা কি ছটার পরে?

–ওরকমই হবে আন্দাজ।

–আর সদর দরজা?

–ওটা পরেই বন্ধ হয়।

-সার্জের ঢোকার ওটাই ছিল সহজ পথ। হ্যাঁ…পরিষ্কার লুকিয়ে থাকার কোন জায়গা দেখে নেয়াই তার উদ্দেশ্য ছিল।

কিন্তু ইনসপেক্টর, কেউ এ ধরনের পরিশ্রম কেন করবে–এ বাড়িতে চুরি বা ছিনতাই করবার চেষ্টা কেনই বা করবে?

–এটা কোন চুরির ব্যাপার নয়, মিস বানার বলে উঠলেন, তোমাকে আগেও বলেছি; এ হল প্রতিশোধ। তুমি টাকা দাওনি বলে সে তোমাকে দুবার গুলি ছুঁড়েছিল।

–আচ্ছা, গতরাতে ঠিক কি ঘটেছিল মিস ব্ল্যাকলক?

একটু ভাবলেন মিস ব্ল্যাকলক। পরে বললেন, পড়শীরা অনেকেই উপস্থিত হয়েছিলেন–কিছু ঘটবে বলে সকলেই উদগ্রীব হয়ে ছিল। টেবিলের ঘড়িটা বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আলো নিভে গেল।

–কোন্ কোন্ আলো জ্বলছিল?

দেয়ালের ব্রাকেটে আর ঘরের শেষে।

–তারপর?

–আচমকা দরজাটা খুলে গেল।

–কোন্ দরজা? এ ঘরে তো দরজা দুটো।

-এ ঘরের দরজা। অন্য ঘরের দরজা খোলে না। দরজা খুলে গেলে নজরে পড়ল রিভলভার হাতে একজন লোক। সে কিছু বলে উঠেছিল–

-হাত তুলুন না হলে গুলি করব–আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। বলে উঠলেন মিস বানার।

–আপনারা সবাই হাত তুললেন?

–হ্যাঁ, আমরা সবাই তাই করি। বললেন মিস বানার।

–আমি তুলিনি। পরক্ষণেই আমার কানের পাশ দিয়ে একটা বুলেট বেরিয়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালে গেঁথে গেল। কেউ কেউ আর্তনাদ করে উঠেছিল। আমার কানে ভীষণ জ্বালা বোধ করছিলাম।

পরেই কানে এলো দ্বিতীয় গুলির শব্দ। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি অস্থির হয়েছিলাম। মুখোস পরা মূর্তিটা কাত হয়ে পড়ে যায়…পরক্ষণেই আর একটা গুলির শব্দ শুনি। টর্চ নিভে যায়। ঘরে হুলুস্থুলু পড়ে যায়।

–আপনি কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন মিস ব্ল্যাকলক?

–ওই টেবিলটার ওপাশে। খিলানের নিচে। আমার হাতে ছিল সিগারেটের বাক্স।

ক্র্যাডক উঠে গিয়ে দেয়ালটা পরীক্ষা করলেন। বুলেটের দুটো গর্ত পরিষ্কার দেখা গেল। রিভলভারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য গুলি দুটো বের করে নেয়া হয়েছিল।

-বরাতজোরে আপনি রক্ষা পেয়ে গেছেন। শান্তস্বরে বললেন ক্র্যাডক।

–লোকটা ওকে গুলি করেছিল, মিঃ বানার বললেন, আমি দেখেছি, লোকটা টর্চের আলোয় সকলকে দেখে নিয়ে ওর ওপর আলোটা ধরে আর গুলি করে তারপর না পেরে নিজেকেই গুলি করে।

–আমার মনে হয় না সে নিজেকে গুলি করতে চেয়েছিল। বললেন মিস ব্ল্যাকলক। আসলে গুলি ছোঁড়ার আগে পর্যন্ত সব ব্যাপারটাই আমার কাছে তামাশা বলে মনে হয়েছিল।

–আপনার এরকম মনে হবার কারণ? এমন অভিনব তামাশাটা কে করতে পারে বলে আপনার মনে হয়েছিল? বললেন ক্র্যাডক।

–প্যাট্রিকের কথাই প্রথমে তুমি মনে করেছিলে লেটি। বললেন মিস বানার।

–কে প্যাট্রিক? তীব্রস্বরে বলে উঠলেন ক্র্যাডক।

-আমার ভাইপো–প্যাট্রিক সীমন্স। বিজ্ঞাপনটা প্রথম দেখে মনে হয়েছিল, সেই মজা করার উদ্দেশ্যে করেছে। তবে সে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছিল।

–একটা খুন হবে পড়ে তুমি খুবই চিন্তিত হয়েছিলে লেটি, বললেন মিস বানার, তার গলার স্বর রীতিমত কাঁপছিল।

-আর কিছু জানতে চান ইনসপেক্টর?

-এবারে আমার জানার দরকার আপনার বাড়িতে ঠিক কতজন আছেন, তাদের সম্পর্কে কিছু কথা।

-হ্যাঁ, আমি আর ডোরা–এই তো দেখছেন। এ ছাড়া রয়েছে দূর সম্পর্কের দুজন বোনপো বোনঝি–প্যাট্রিক আর সীমন্স। ওদের মা ছিলেন আমার মাসতুতো বোন। ওরা আমাকে লেটি মাসী বলে ডাকে।

-ওরা বরাবর আপনার কাছেই আছে?

না, মাত্র দুমাস হল ওরা এসেছে। যুদ্ধের আগে ওরা দক্ষিণ ফ্রান্সে থাকত। প্যাট্রিক নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধের পর ওদের মা আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পেয়িং গেস্ট হিসেবে আছে। থাকা-খাওয়ার জন্য সামান্য টাকা দেয়। প্যাট্রিক মিলচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর জুলিয়া মিলচেস্টার জেনারেল হাসপাতালে ডিসপেনসারের কাজ শিখছে।

–শুনেছি ওরা ছাড়াও একজন মিসেস হেমস বলে কে আছেন?

-হ্যাঁ। সে ডায়াস হলে মিসেস লুকাসের বাড়িতে বাগান পরিচর্যার কাজ করে। আমার এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। ও খুবই ভাল মেয়ে। ওর স্বামী ইটালিতে মারা যায়। বছর আটেকের একটি ছেলে আছে, স্কুলে পড়ে।

-বাড়ির কাজের লোকজন

–প্রতি মঙ্গলবার শুক্রবার একজন মালী আসে। সপ্তাহের পাঁচদিন গ্রাম থেকে আসে এক মিসেস হাগিন্স। এছাড়া একজন বিদেশিনী উদ্বাস্তু, মিৎসি তার নাম-সে রান্নার কাজ দেখে। বেচারী, আমার বিশ্বাস জীবনে বড় কোন আঘাত পেয়েছে, তাই সব সময়ই কেমন খ্যাপাটে মনে হয়। ওর ধারণা, সবাই ওকে অপমান করতে চায়। তবে রান্নাটা মোটামুটি করে।

-আমাকে যিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন তিনিই মিস জুলিয়া সিমন্স?

–হ্যাঁ। কথা বলতে পারেন ইচ্ছে করলে। প্যাট্রিক একটু বাইরে গেছে। ফিলিপিয়া হেমসকে ডায়াস হলে পাবেন।

.

০৩.

 মিস ব্ল্যাকলক ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। জুলিয়া ঘরে ঢুকে তার খালি চেয়ারে এসে বসল।

–গত রাতের কথাটা আপনার কাছে জানতে চাই মিস সিমন্স। প্রশ্ন করলেন ক্র্যাডক।

–ওহ, গতকাল? একদল মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। কর্নেল আর মিসেস ইস্টারব্রুক, মিস হিনচক্লিফ আর মিস মারগাটরয়েড। মিসেস সোয়েটেনহ্যাম আর এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম এবং মিসেস হারমন, মানে ভিকারের স্ত্রী। এভাবেই পর পর তারা এসেছিলেন।

এরা সবাই ভাব দেখাচ্ছিলেন যেন হঠাৎ এসে পড়েছেন। তারপরেই ঘড়ি বেজে ওঠে আর আলো নিভে যায়।

দরজা খুলে একজন মুখোশধারী বলে ওঠে–সবাই মাথার ওপর হাত তুলুন। একদম ফিল্মের ব্যাপার যেন। তারপরেই সেই মুখোশধারী গুলি ছুঁড়ল লেটি মাসীর দিকে।

–ঘটনার সময় সকলে কোথায় ছিলেন?

–সকলে দাঁড়িয়েছিলেন।

–আপনারা সকলে এই ঘরটায়ই ছিলেন না দূরের ঘরটায়?

মনে হয় বেশিরভাগই এই ঘরে। প্যাট্রিক অন্য ঘরে শেরি আনতে গিয়েছিল।

–আপনি কোথায় ছিলেন?

–মনে হয় জানালার কাছে ছিলাম।

 –লোকটার হাতে টর্চ ছিল, সে সেটা দিয়ে কি করছিল?

–সে আমাদের সকলের ওপর আলো ফেলে। আমাদের সকলেরই চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল।

–লোকটা আলো এক জায়গায় ফেলেছিল না ঘোরাচ্ছিল?

একটু ভেবে নিল জুলিয়া। পরে বলল, ঘোরাতে চাইছিল আলোটা। আমার চোখে এসে পড়েছিল, তারপরই গুলির শব্দ হয় পর পর দুবার।

-তারপর?

-তারপর? লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। মিৎসি সাইরেনের মত শব্দ করে আর্তনাদ শুরু করল। টর্চটা নিভে গেল, আবার গুলির শব্দ শোনা গেল। তারপরই দরজাটা কাচ কাচ শব্দ করে আস্তে আস্তে বন্ধ হতে লাগল।

–লোকটা কি ইচ্ছে করেই নিজেকে গুলি করেছিল বলে আপনার মনে হয়?

 –আমার কোনই ধারণা নেই। আমি সবই তামাসা বলে ভাবছিলাম তখনও

–ধন্যবাদ মিস সিমন্স। এবারে মিৎসির সঙ্গে দেখা করতে চাই।

রান্নাঘরেই পাওয়া গেল মিৎসিকে। সে প্যাস্ট্রি তৈরি করছিল। ক্র্যাডককে দেখেই বলে উঠল, এখানে আপনার কি দরকার মিঃ পুলিসম্যান? আপনি কি জানতে চান?

–গত সন্ধ্যায় এ বাড়িতে যা ঘটেছে, সেটাই তোমার কাছে শুনতে চাই।

–সারা সন্ধ্যাই আমার খুবই খারাপ লাগছিল। একবার মনে হল চুপিচুপি কেউ যেন হলঘরে চলাফেরা করছে।

–ঘটনা কি ঘটেছিল তাই বল।

-তাইতো বলছি। আমি শেরী আর গ্লাসগুলো নিয়ে ড্রইংরুমে যাই। তখনই পরপর দরজা খুলে দিতে হচ্ছিল–একে একে সবাই আসছিল। তারপর আমি রান্নাঘরে চলে যাই। খুবই ভয় করছিল আমার।

-হ্যাঁ, তারপর?

–আমি গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। অমনি ডাইনিং রুমের দিকে ছুটতে থাকি–তখনই আবার গুলির শব্দ আর ধপ করে শব্দ করে হল ঘরে যেন কিছু পড়ল। আমি দরজার হাতলটা ঘোরাতে গিয়ে দেখি সেটা বাইরে থেকে বন্ধ। আমি ঘরের ভেতরে আটকে যাই। পরে ওরাই আমাকে হাতল ঘুরিয়ে বাইরে আসতে দেয়। ঘর অন্ধকার–আমি মোমবাতি নিয়ে এসে দেখি-উরে ব্বাপস-রক্ত-কেবল রক্ত।

–ঠিক আছে। আপাতত এই থাক মিৎসি।

.

হলঘর পার হয়ে সদর দরজার কাছে আসতেই ক্র্যাডক আর ফ্লেচারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এক সুদর্শন তরুণের।

যথারীতি নিয়ম ধরেই ক্র্যাডক তার নাম, বয়স, তার যুদ্ধের কাজের খুঁটিনাটি দিয়ে কথা শুরু করলেন। তারপর বললেন, মিঃ সিমন্স, গত সন্ধ্যার ঘটনা যদি দয়া করে একটু বলেন

–গত সন্ধ্যার কথা, সে আর কি বলব সবাই নার্ভাস হয়ে পড়েছিল–বানি তো সারাদিন ধরে ভয় ধরানো কথা বলে চলেছিল।

-মিস বানার কিছু কি আশঙ্কা করছিলেন?

 –মনে হচ্ছিল বেশ আনন্দ পাচ্ছিলেন।

–বিজ্ঞাপনটা দেখে মিস ব্ল্যাকক প্রথমে বোধহয় ওটা আপনার কাজ বলেই অনুমান করেছিলেন?

-ওহ, যাই ঘটুক, সবাই আমাকেই দায়ী করে।

মিঃ সিমন্স, এ ঘটনায় সত্যিই কি আপনার হাত ছিল?

–আমার–কখনই না।

 –ওই রুডি সার্জকে আপনি আগে দেখেছিলেন?

–জীবনে কোনদিন না।

–এবারে দয়া করে বলুন, ঠিক কি ঘটেছিল?

-আমি পানীয় আনতে ছোট ড্রইংরুমে ঢুকেছিলাম, তখনই ঝপ করে আলো নিভে গেল। ঘুরে তাকাতেই চোখে পড়ল, একটা লোক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলছে–সবাই হাত তুলুন। অমনি অন্ধকার ঘরে চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। তখনই লোকটা রিভলভার ছুঁড়তে শুরু করল, তারপর নিজেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, তার হাতের টর্চ নিভে গেল। আর সবাই আমরা অন্ধকারে ডুবে গেলাম।

–লোকটা মিস ব্ল্যাকলককেই তাক করছিল বলে আপনার মনে হয়?

–ওসব কিছুই না। লোকটা মজা করতেই চেয়েছিল। যখন দেখল বাড়াবাড়ি করে । ফেলেছে–

-তখন বলছেন নিজেকেই গুলি করে?

–অসম্ভব মনে হয় না।

–আপনি নিশ্চিত যে রুডি সার্জকে কখনও দেখেননি?

–বলছি তো কোনদিন না।

ধন্যবাদ মিঃ সিমন্স, আপনাকে আর বিরক্ত করব না। গতরাতে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিভাবে শুরু করলে সুবিধা হবে?

–একেবারে নাগালের মধ্যে রয়েছে ফিলিপিয়া হেমস, তাকে দিয়েই শুরু করতে পারেন। উল্টো দিকের দরজাটাই ডায়াস হল। এরপর কাছাকাছি থাকে সোয়েটেনহ্যামরা–

.

০৪.

 ইনসপেক্টর ক্র্যাডক তার গৃহীত সাক্ষাৎকারের বিবরণ যথারীতি চিফ কনস্টেবলকে পেশ করলেন।

রাইডেসডেল বললেন, সুইস পুলিসের কাছ থেকেও রিপোর্ট পাওয়া গেল। ছোকরা অলঙ্কার চুরি, চেক জাল, পরিচয় ভাড়ানো-নানা অসৎ কাজের সঙ্গেই যুক্ত ছিল। সবই অবশ্য ছোটখাট ব্যাপার।

কথা শেষ করে তিনি ক্র্যাডকের বিবরণ দ্রুত চোখ বোলাতে লাগলেন।

–খুবই সাধারণ ব্যাপার স্যর দেখছি। বিভিন্ন মানুষের বর্ণনা…বড্ড অসংলগ্ন আর পরস্পর-বিরোধিতা। তবে আসল ব্যাপারটা পরিষ্কারই পাওয়া যাচ্ছে।

-তবে স্যার, এটা একটা ভুল ছবি বলেই মনে হচ্ছে।

বেশ তো, ঘটনাটা আর একবার দেখে নেওয়া যাক। রুডি সার্জ মেডেনহ্যাম থেকে বাসে চেপেছিল ৫-২০ মিঃ। চিপিং ক্লেগহর্ন পৌঁছায় ছটার সময়। বাসের কণ্ডাক্টর আর দুজন যাত্রীর কাছ থেকে এই সাক্ষ্য পাওয়া গেছে।

বাসস্টপ থেকে হেঁটেই সে লিটল প্যাডকস-এ পৌঁছায়। সম্ভবত সদর দরজা দিয়েই বাড়ির ভেতরে ঢোকে।

সে সকলকে রিভলভার দেখায়, গুলি ছোঁড়ে, একটা গুলিতে মিস ব্ল্যাকলক সামান্য আহত হন। তৃতীয় গুলিটাতে সে আত্মহত্যা করে।

এই শেষের ব্যাপারটাই যা একটু গোলমেলে, সেটা হঠাৎ দুর্ঘটনা জনিত না ইচ্ছাকৃত কোনটারই নিশ্চিত প্রমাণ নেই।

এতসব কাণ্ড এই ছোকরা কেন করল তার বিশ্বাসযোগ্য কোন কারণ অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে করোনারের জুরিরা সম্ভবত এটাকে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনাজনিত একটা কিছু বলবে। যাই বলা হোক আমাদের কাছে তা সমান।…এই তো মামলা

-তবু আমার মনে হয় স্যার, পুরো চিত্রটাই ভুল।

তার মানে তুমি বলতে চাইছ, চিপিং ক্লেগহর্নের ঘটনায় যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের কেউ তোমাকে মিথ্যা বলেছে?

-স্যার, ওই বিদেশী উদ্বাস্তু মেয়েটা, মনে হয় সে যা জানে সব বলেনি।

–তাকে লোকটার সঙ্গে জড়িত বলে মনে হচ্ছে তোমার? সে তাকে একাজে সাহায্য করেছিল?

-এরকম কিছু হবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে সেখানেও গোলমাল থেকে যাচ্ছে বাড়িতে মূল্যবান কিছুই ছিল না। মিস ব্ল্যাকক একথা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন। আবার মিস বানার অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন মিস ব্ল্যাকলককেই সরাসরি হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। চিন্তিত ভাবে বললেন ক্র্যাডক।

–কিন্তু রুডি সার্জ মিস ব্ল্যাকলককে হত্যা করতে চাইবে কেন?

–এখানেই তো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে স্যার। মিস ব্ল্যাকলকের কাছেও এটাই জিজ্ঞাস্য। অবশ্য যদি তিনি মিথ্যা বলে না থাকেন।

–ঠিক আছে–আরও একটু চেষ্টা করা যাক। আজ মেডেনহ্যামের হোটেলে তুমি আর স্যার হেনরির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যাবে।

-ধন্যবাদ স্যার। ক্র্যাডক অবাক হয়ে তাকালেন চিফ কনস্টেবলের দিকে।

 –ঘটনা হল আমরা একটা চিঠি পেয়েছি

ঠিক এই সময়ে স্যার হেনরি ঘরে ঢুকলেন।

সুপ্রভাত ডারমট।

–তোমার জন্যই একটা জিনিস নিয়ে অপেক্ষা করছি। বললেন রাইডেসডেল।

ব্যাপারটা কি

রয়্যাল স্পা হোটেলে আছেন এমন একজন বয়স্কা মহিলার কাছ থেকে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। চিপিং ক্রেগহনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে এমন কিছু তাতে আছে। মহিলার নামটা হল…কি যেন..মারপল-হ্যাঁ জেন মারপল।

–এই তো আমার সেই প্রতিভাময়ী গোয়েন্দাটি–এঁর কথাই বলেছিলাম, সোল্লাসে বলে উঠলেন স্যর হেনরি, যেভাবেই হোক তিনি মেডেনহ্যাম ওয়েলসে হাজির ছিলেন আর স্বভাববশে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।

-ঠিক আছে, বললেন রাইডেসডেল, রয়্যাল হোটেলে মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা এই মহিলার সঙ্গে দেখা করব।

.

 গোলাপী মুখে সামান্য বলিরেখা জেগেছে, মাথায় শ্বেতশুভ্রা চুল, নীলাভ চোখে কোমলতা মাখানেনা। সারা দেহে পশমী পোশাক জড়ান। বেশ বৃদ্ধা মনে হচ্ছিল তাকে। কোন বাচ্চার জন্য কিছু বুনে চলেছিলেন। অবিরাম।

স্যার হেনরিকে দেখেই নির্মল হাসি হাসলেন তিনি। চিফ কনস্টেবল আর ডিটেকটিভ ইনসপেক্টরের পরিচয় পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।

-অনেক দিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা হল স্যার হেনরি। আমার ভাইপো রেমণ্ড তার একটা বইয়ের জন্য বেশ কিছু অর্থ পেয়ে গেছে। তাই জোর করে হোটেলে পাঠিয়ে দিল।

চিফ কনস্টেবল দু-চার কথার পরই সরাসরি কাজের কথা পাড়লেন।

–আপনার কথাই শুনতে এলাম মিস মারপল। বলুন এবারে শোনা যাক।

–ওহ। একটা চেকের ব্যাপার। ওই রুডি সার্জ সেটার কিছু বদলে দিয়েছিল।

রুডি সার্জ। চমকে উঠলেন রাইডেসডেল। আপনার চেকের লেখা বদলে দিয়েছিল।

–হ্যাঁ, আজই সকালে ব্যাঙ্ক থেকে এসেছে। চেকটা ছিল সাত পাউণ্ডের, সে সেটাকে সতের পাউণ্ড করে দেয়। সাত সংখ্যার আগে একটা দাগ বসিয়েছে আর অক্ষর লেখার শেষে ইংরাজি টিন কথাটা যোগ করেছে–একই কালি দিয়ে লেখা। আমার সন্দেহ হচ্ছে, এরকম কাজ সে আগেও করেছে।

তার এরকম কিছু দুষ্কর্মের কথা আমরাও সুইস পুলিসের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, বললেন রাইডেসডেল, পুলিসের খাতায় তার নাম আছে।

পুলিসের তাড়া খেয়েই হয়তো কাগজপত্র জুটিয়ে নিয়ে এদেশে চলে এসেছে, বললেন মিস মারপল।

–ঠিকই অনুমান করেছেন। সম্মতি জানালেন রাইডেসডেল।

মিস মারপল বললেন, ডাইনিংরুমের স্বর্ণকেশী মেয়েটির সঙ্গে সে মেলামেশা করতে চাইত। মেয়েটি বিশেষ সাড়া দিয়েছে বলে মনে হয় না। মেয়েটি সব কথা আপনাদের বলেছে?

ক্র্যাডকের উদ্দেশ্যে বললেন মিস মারপল। তাকে খুবই চিন্তিত লাগছিল।

ডিটেকটিভ ইনসপেক্টর বললেন, তার কাছ থেকে আরও কিছু জানতে পারা যাবে বলছেন?

–সে হয়তো তাকে বলে থাকতে পারে লোকটি কে ছিল। বললেন মিস মারপল।

–লোকটি?

–হ্যাঁ, যে ছেলেটিকে কাজে লাগাতে চেয়েছি তার কথাই বলছি।

–এর পেছনে দ্বিতীয় কেউ ছিল বলছেন?

-হ্যাঁ। একজন সুদর্শন যুবক, বললেন মিস মারপল, চেক ইত্যাদি জাল করা এমনি ছোটখাট চুরিতে ও বেশ দক্ষ। আচমকা সে একটা রিভলভার নিয়ে খুনোখুনিতে নেমে পড়বে ব্যাপারটা বেশ অসংলগ্ন বলেই মনে হয়।

-আসলে তখন কি ঘটেছিল, সম্ভবত আপনিই বলতে পারবেন মিস মারপল। ক্র্যাডক বললেন।

মিস মারপলের মুখে লাল আভা দেখা গেল। তিনি বললেন, কিন্তু আমি জানব কি করে? খবরের কাগজে ঘটনার বিবরণ যা ছাপা হয়েছে তার বেশি কিছু চোখে পড়েনি।

–চিপিং ক্লেগহনে ক্র্যাডক যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে, সেটা মিস মারপলকে একবার দেখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বললেন স্যার হেনরি।

-হ্যাঁ, উনি দেখতে পারেন। তাঁর মতামত জানার জন্য আমারও আগ্রহ রয়েছে। বললেন রাইডেসডেল।

বলে তিনি টাইপকরা রিপোের্ট এগিয়ে দিলেন।

–বেশি সময় লাগবে না, আমাদের চোখে যা এড়িয়ে গেছে, আপনি তা পেতে পারেন। প্রসঙ্গত বলি, ক্র্যাডকেরও আপনার মতই মত–চিত্রটা অন্য রকম।

 মিস মারপল কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে নামিয়ে রাখলেন।

–মানুষ কত রকমই চিন্তা করে, বলেও আবোল তাবোল। বেশির ভাগই তুচ্ছ।

ক্র্যাডক কিছুটা হতাশই হল মিস মারপলের মন্তব্যে। কিছুটা বিরক্তিও জমল তার মনে। তিনি বললেন, যে যাই বলে থাকুক, একটা ব্যাপার পরিষ্কার, তারা সকলেই দেখেছিল রিভলবার হাতে একজন লোক টর্চ জ্বেলে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছিল। সে হুকুম করেছিল, মাথার ওপরে হাত তুলবার জন্য।

–কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল, মিস মারপল বললেন, তাদের কিছুই দেখবার সুযোগ ছিল না। হলঘরে কোন আলোই ছিল না, ওপরের চাতালেও না।

-হ্যাঁ, তা ঠিক। বললেন ক্র্যাডক।

-একটা লোক যদি অন্ধকার ঘরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টর্চের জোরালো আলো ঘরের মধ্যে ফেলে তাহলে কেবল আলো ছাড়া কোন লোকের পক্ষেই আর কিছু দেখা সম্ভব নয়।

হ্যাঁ, আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। বললেন ক্র্যাডক।

–এই অবস্থায় যদি কেউ বলে মুখোশপরা একজন মানুষ দেখেছে, তাহলে বোঝা যায়; এটা হল, তাদের আলো ফিরে আসার পরের চিন্তাধারারই ফল। সামনে রুডি সার্জ রয়েছে এটাই সকলে পরে দেখেছিল।

-আপনি বলতে চাইছেন, কারোর নির্দেশেই রুডি সার্জ ঘরভর্তি মানুষকে রিভলভার তুলে ভয় দেখিয়েছিল?

–আমার ধারণা তাকে একটু মজা করার কথাই বলা হয়েছিল, বললেন মিস মারপল, এজন্য তাকে টাকাও দেওয়া হয়েছিল। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার জন্যও টাকা পেয়েছিল সে।

বলা হয়েছিল নির্দিষ্ট রাতে মুখোশ আর কাল পোশাক পরে দরজা খুলে দাঁড়াতে, আর টর্চ জ্বালিয়ে চিৎকার করে বলতে–মাথার ওপরে হাত তুলুন।

-কিন্তু রিভলভার ছোঁড়ার ব্যাপারটা?

-ওহ, না তার কাছে কোন রিভলভার ছিল না।

 –কিন্তু প্রত্যেকেই বলেছে

–হ্যাঁ, জানি। কিন্তু তার হাতে রিভলভার থাকলে সেটা কারোর দেখার কথা নয়। আমার ধারণা, সে হাত তুলুন বলার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, আর তার কাঁধের ওপর দিয়ে পর পর দুবার গুলি ছুঁড়েছিল। রুডি সার্জ আচমকা গুলির শব্দে ভয় পেয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেই পেছনের লোক তাকে গুলি করে। পরে রিভলভারটা তার পাশেই ফেলে দেয়।

উপস্থিত তিন জনেই বিস্ফারিত চোখে মিস মারপলের দিকে তাকালেন।

-কিন্তু ওই অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এসেছিল–লোকটি কে? রাইডেসডেল বললেন।

–সেটাই আপনাদের খুঁজে বার করতে হবে–সেই অজানা লোকটি কে যে মিস ব্ল্যাকলককে খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল।

–তাহলে এটাকে ইচ্ছাকৃত আক্রমণ বলেই বলছেন আপনি?

–আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। তবে এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই যে, যে লোক এই পরিকল্পনা ছকেছিল রুডি সার্জ তাকে জানত। তার মুখ বন্ধ রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করেছিল। রুডি যদি কিছু বলে থাকে তাহলে ওই মার্না হ্যারিসকেই বলা সম্ভব।

–আমি এখনই তার সঙ্গে দেখা করছি। উঠে দাঁড়ালেন ক্র্যাডক।

 –হ্যাঁ, তাহলে কিছুটা আলো অন্তত পাওয়া যাবে।

 ক্র্যাডক ঘর ছেড়ে চলে গেলে রাইডেসডেল বললেন, আপনি আমাদের কিছু নতুন চিন্তার খোরাক দিলেন মিস মারপল।

.

সামান্য কয়েক কথাতেই ক্র্যাডক মানা হ্যারিসের প্রতিরোধ ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর সতর্ক ও সহানুভূতিপূর্ণ ছিল।

–আপনাকে সবই আমি বলব। অনুগ্রহ করে আমাকে কেবল এসবের বাইরে রাখবেন।

একটু থেমে মার্না হ্যারিস আবার বলতে শুরু করল, ছবি দেখতে যাবার প্রস্তাব ও একদিন নিজেই করেছিল। ঠিক হয়েছিল ওই দিন সন্ধ্যার সময় যাব। কিন্তু পরে আমাকে জানাল ও আসতে পারছে না। কারণ সেদিন রাতে ও একটা মজার খেলায় যোগ দেবে, অবশ্য এতে পকেটেও কিছু আসবে।

একজন বিদেশীর কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আমি মেনে নিতে পারিনি। তারপর থেকে আমি একরকম তাকে এড়িয়ে থাকবারই চেষ্টা করেছি।

মনে পড়ছে, ও বলেছিল ওই দিন রাতে কোন বাড়িতে একটা পার্টি হবে, সেখানে তাকে একটা ডাকাতের অভিনয় করতে হবে। তারপর কাগজের একটা বিজ্ঞাপনও আমাকে দেখাল।

এরপরে, স্যর, বুঝতেই পারছেন, কাগজ পড়ে সবই জানতে পারলাম। রুডি একজনকে গুলি করে পরে নিজেই আত্মহত্যা করে। খবরটা পড়ে আমি খুবই বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম। ব্যাপারটা আগেই জানতাম বলে নিজেকেও এর সঙ্গে জড়িত মনে হচ্ছিল।

রুডি আমাকে এমনভাবে কথাটা বলেছিল যে সত্যিই একটা কৌতুকের ব্যাপার বলেই মনে হয়েছিল আমার। তবে ওর যে একটা রিভলভার ছিল, সেকথা আমি জানতাম না।

–ওই পার্টি কে ঠিক করেছিল সেসব কিছু জানিয়েছিল সে?

 প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মান্নার মুখের দিকে তাকালেন ক্র্যাডক।

-না, এসব কিছু বলেনি।

–সবই কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে।

মেডেন হ্যাম ফেরার পথে রাইডেসডেল বললেন, একজন অজানা লোক অন্ধকারে সুইস ছোকরার পেছনে হাজির হল, কোথায় ছিল সে, কে লোকটা?

–সে পাশের দরজা দিয়ে আসতে পারে, বললেন ক্র্যাডক।

–রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে এসেছিল বলছ?

–হ্যাঁ স্যর। ওই মেয়েটিকে আমার গোড়া থেকেই সন্দেহজনক মনে হয়েছে। সেই হয়তো ওই লোকটিকে ঠিক মুহূর্তে ঢুকতে সাহায্য করেছিল। পরে সন্দেহমুক্ত থাকবার জন্য ডাইনিং রুমের দরজা বন্ধ করে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়েছিল।

কিন্তু ওই যে কি নাম…এডমণ্ড সোয়েটেনহ্যাম, সে তো দেখলাম বলেছে দরজায় চাবি দেওয়া ছিল বাইরে থেকে। সে দরজা খুলে মেয়েটাকে বাইরে এনেছিল। বাড়ির ওই অংশে আর কোন দরজা আছে?

হ্যাঁ। পেছনের সিঁড়ির নিচে রান্নাঘরের দিকে একটা দরজা আছে। তবে ওটার হাতল নাকি তিন সপ্তাহ আগে খুলে যায়। সেটা এখনও লাগান হয়নি। দরজাটা তাই বন্ধই ছিল। হাতলের জায়গায় বেশ পুরু ধুলো জমে ছিল।

যাই হোক, মেয়েটার রেকর্ড ভাল করে দেখে নিও। যদিও পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে একটা থিওরি বলেই মনে হচ্ছে।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ওই রিভলভারটা–যদি এই থিওরি সঠিক হয় তাহলে ধরতে হবে ওটা সার্জের নয়। তার যে কোন রিভলভার ছিল সেকথাও কেউ বলেনি।

-তদন্তের আর অন্য কোন দিক, স্যার

যদি থিওরি ঠিক হয় তাহলে কোথাও একটা মোটিভ পাওয়া যাবে। ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার পরিকল্পনা বিনা কারণে হয় না। কিন্তু বুঝতে পারছি না মিস ব্ল্যাকলককে কে খুন করার চেষ্টা করতে পারে? একথার উত্তর দিতে পারেন একমাত্র মিস ব্ল্যাকলক নিজে।

–কিন্তু তিনি তো জোরের সঙ্গে এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।

–হ্যাঁ স্যার। রুডি সার্জ তাকে কেন খুন করতে চাইবে এটা তিনি বিশ্বাসই করতে চাননি। তাছাড়া অন্য একটা ব্যাপারও আছে।

–সেটা কি?

–এই চেষ্টা আবার হতে পারে স্যার।

–তাহলে থিওরির সত্যতা প্রমাণ হবে। মিস মারপলের ওপরেও তুমি নজর রেখো। বললেন রাইডেসডেল।

–তিনি কেন, স্যার?

–আমি শুনেছি তিনি ক্রেগহর্নের ভিকারেজে আছেন। চিকিৎসার জন্য সপ্তাহে দুদিন মেডেনহ্যাম ওয়েলসে আসতে হয় তাঁকে। ভিকারের স্ত্রী সম্ভবত তাঁর বান্ধবীর মেয়ে। বুড়ি উত্তেজনার খোরাক খুঁজতে আনন্দ পায়।

.

০৫.

 –আপনাকে আর একটু বিরক্ত করতে এলাম মিস ব্ল্যাকলক।

–শুনলাম ইনকোয়েস্ট সাতদিন পিছিয়ে গেছে?

–হ্যাঁ। সেজন্যই নতুন কোন সূত্রের সন্ধান করতে হচ্ছে, বললেন ক্র্যাডককে, রুডি সার্জ সম্পর্কে জানা গেছে, মন্ট্রির হোটেল কেম আলপসের মালিকের ছেলে নয়। সে আর্দালির কাজ করত বের্ন-এর হাসপাতালে। সেই সময় অনেক রুগীরই অলঙ্কার খোয়া যেত। এক রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজও করেছিল। সেখানে ডুপ্লিকেট বিল করে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিত।

এরপর জুরিখের এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কিছুদিন কাজ করে। সেখানেও যতদিন ছিল মালপত্র চুরি হত।

–ছিঁচকে চুরিতে ভালই হাত পাকিয়েছিল। তাকে আমার চেনা মনে হয়নি।

–হ্যাঁ, রয়্যাল স্পা হোটেলে সে আপনাকে চিনতে পারার ভাঁওতা দিয়েছিল। সুইজারল্যাণ্ডে পুলিসের তাড়া খেয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জাল করে এদেশে পাড়ি জমিয়েছিল।

–কিন্তু চিপিং ক্লেগহর্নে সে এসেছিল কেন?

–বাড়িতে আপনার সত্যিই কি কোন মূল্যবান জিনিস নেই বলছেন?

–আমি শপথ করে বলতে পারি ইনসপেক্টর।

 –তাহলে বুঝতে হয়, আপনাকে আক্রমণ করার জন্যই এখানে এসেছিল।

–আমিও তোমাকে একথাই বলেছিলাম, লেটি। মিস বানার বলে উঠলেন।

–ওকথার কোন অর্থই হয় না। বললেন মিস ব্ল্যাকলক।

-এমন হতে পারে সে এরকম ঘটনা ঘটাতে চায়নি, বললেন মিস বানার, তোমাকে ভয়ঙ্কর কোন ইঙ্গিত করতেই চেয়েছিল হয়তো। বিজ্ঞাপনটা দেখেই আমার ভয় ধরেছিল। মিৎসি দেখনি, কেমন ভয় পেয়েছিল।

-হ্যাঁ, ওই মেয়েটির সম্পর্কেও আরও কিছু আমাকে জানতে হবে। বললেন ক্র্যাডক।

 –ওর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যথাযথই ছিল। বললেন মিস ব্ল্যাকলক।

–ওসবে আমি সন্দেহ করছি না, রুডি সার্জের কাগজপত্রও ত্রুটি হীন বলেই মনে হয়েছিল।

–কিন্তু এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, রুডি সার্জ আমাকে খুন করতে চাইবে কেন?

–তাকে দিয়ে একাজ কেউ করাতে পারে একথা ভেবে দেখেছেন?

ধীরে ধীরে বললেন ক্র্যাডক। কিন্তু এ কথায় মিস ব্ল্যাকলকের কোন প্রতিক্রিয়া তার চোখে পড়ল না।

–এই উত্তরও আমার জানা নেই। কেউ আমাকে খুন করতে চাইবে কেন?

–এর উত্তর আপনার কাছ থেকেই আশা করছি মিস ব্ল্যাকক।

–আমি এটুকুই বলতে পারি–আমার কোন শত্রু নেই। আর মিৎসি মেয়েটিকেও এর সঙ্গে জড়িত ভাবা একেবারেই হাস্যকর। গেজেটে বিজ্ঞাপন দেখেই ও ভয়ে আধমরা হয়ে ছুটে এসেছিল-মালপত্র নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার অনুমতি চেয়েছিল।

–এটা একটা কৌশলও হতে পারে। আপনি তাকে যেতে দেবেন না সে জানত।

-ওসব ভাবনা আপনার, উত্তরও আপনি নিজেই পেয়ে যাবেন। আমি এটুকু বলতে পারি, আমার প্রতি কোন রকম আক্রোশ থাকলে মিৎসি অনেক সহজ উপায়ে আমাকে বিষ খাওয়াতে পারত। সমস্ত ব্যাপারটাই অবাস্তব। বিদেশী বলেই তাকে ঠাণ্ডা মাথার খুনী ভাবা ঠিক নয়। দরকার হলে তাকে আবার জেরা করতে পারেন।

ক্র্যাডক এবারেও সহজ উত্তরই পেলেন মিৎসির কাছে। বিজ্ঞাপনটা পড়ে সে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাই চারটের পরেই সদর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

ক্র্যাডক তাকে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু মিসেস হেমস বলেছেন, কাজ সেরে ওই দরজা দিয়েই ৫-৩০ মিঃ বাড়িতে ঢোকেন। তারপর দরজা বন্ধ করে দেন।

–বন্ধ করেননি, বলল মিৎসি, আমার ধারণা তিনি খেয়াল রেখেছিলেন যাতে দরজা বন্ধ হয়।

-তোমার এ কথার উদ্দেশ্য?

–ওই ছোকরা আঁটঘাট আগে থেকেই বেঁধে নিয়েছিল। সে জানত কোথায় আসতে হবে, আর তার জন্য দরজাটা খোলা থাকবে।

–আরও পরিষ্কার করে বল মিৎসি।

-আমি বলতে পারি, কিন্তু জানি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু বলছি, এক সপ্তাহ আগে ওই ছোকরা টাকা চাইতে এলে তাকে মিস ব্ল্যাকলক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাকে দেখেছি, বাইরে এসে মিসেস হেমসের সঙ্গে কথা বলেছিল।

-কিন্তু সামার হাউসে ওদের কি কথা হয় তা তোমার শোনা সম্ভব ছিল না নিশ্চয়ই।

–কেন সম্ভব হবে না। আমি তরকারীর জন্য কচি বিছুটি পাতা আনতে বাগানে গিয়েছিলাম। তখন আমি ওদের কথা বলতে শুনেছি। ছোকরা তাকে বলল, আমি কোথায় লুকোব? মিসেস হেমস বলেছিল, আমি দেখিয়ে দেব। ঠিক সওয়া ছটার সময়।

আমি ভেবেছিলাম ভালবাসার ব্যাপার–এখন বুঝতে পেরেছি ওরা দুজনে মিলে খুনের আর ডাকাতির মতলব করেছিল।

–আর কি দেখেছ তুমি?

–তাকে সামার হাউস থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম।

–এসবকথা সেদিন আমাকে বলনি কেন? সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করলেন ক্র্যাডক।

–ওদের মতলবটা তখনও বুঝে উঠতে পারিনি।

–কিন্তু ধর, কেউ যদি বলে, তোমাকে রুডি সার্জের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে—

মিথ্যে মিথ্যে, একদম মিথ্যে কথা।

মিৎসির কথাগুলো ক্র্যাডকের মনে আলোড়ন তুলেছিল। মিসেস হেমস সম্পর্কে কথাগুলো সে বেশ জোর দিয়েই বলেছে।

ফিলিপিয়া হেমসের সঙ্গে কথা বলবেন স্থির করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।

হলঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় একটা ভুল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ক্র্যাডক।

 সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখতে পেয়ে মিস বানার তাকে ঠিক দরজাটা দেখিয়েছিলেন।

–ওই দরজাটা খোলে না। বাঁদিকে পরের দরজাটা। আমারও প্রায়ই ভুল হয়ে যায়। ওটাতে ঠেস রেখে হলঘরে টেবিল রাখা হত। পরে সেটা দেয়ালের দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

ক্র্যাডক সচকিত হয়ে উঠলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, টেবিলটা সরানো হয়েছে? কতদিন আগে?

–দিন দশ-পনেরো হবে

 বললেন মিস বানার।

–টেবিলটা সরানোর দরকার হল কেন?

–ঠিক মনে পড়ছে না। মনে হয় ফিলিপিয়া বড় একটা ফুলদানী তৈরি করেছিল। রঙবেরঙের ফুল ডাল পাতা সুন্দরভাবে সাজাতে পারে ও। ফুলগুলো দরজার সামনে না রেখে দেয়ালের দিকে রাখলে বেশি ভাল দেখাবে এজন্যই টেবিলটা সরিয়ে নিয়েছিল।

ক্র্যাডক লক্ষ করলেন, যে-দরজা তিনি খোলার চেষ্টা করছিলেন তার মাঝামাঝি সরু সরলরেখার মত একটা দাগ। টেবিলটা এখানে রাখা ছিল, এটা তারই দাগ, তিনি বুঝতে পারলেন।

দরাজাটা কি পেরেক এঁটে বন্ধ করা হয়েছিল? প্রশ্ন করলেন ক্র্যাডক।

–খুব সম্ভব তালা লাগিয়ে, খিলও আঁটা হয়েছিল। বললেন মিস বানার।

ক্র্যাডক হাত বাড়িয়ে খিলটা দেখতে চাইলেন, খিলটা সহজেই সরে এল।

-দরজাটা শেষ কবে খোলা হয়েছিল, মিস বানার?

–অনেক বছর হয়েছে, বললেন মিস বানার, আমি এখানে আসার পর ও দরজা খোেলা হয়নি।

-তালার চাবি কোথায় থাকে আপনি বলতে পারবেন?

–হলঘরের ড্রয়ারে অনেক চাবি আছে। তার মধ্যেই আছে নিশ্চয়।

ক্র্যাডক মিস বানারের সঙ্গে গিয়ে ড্রয়ারের অনেক চাবি নেড়েচেড়ে দেখলেন। একটা চাবি একটু অন্য রকম মনে হল তার। সেটা তুলে নিয়ে দরজার কাছে এলেন। চাবিটা সহজেই তালায় ঢুকে গেল। তারপর একটু ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।

ক্র্যাডকের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। তিনি দরজাটা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখলেন।

–মিস বানার, দরজাটা সম্প্রতি ভোলা হয়েছে দেখছি। কজায় তেল দেওয়াও হয়েছে। মিস বানার বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিনি যেন ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

বিস্ময়ের ঘোর কাটলে বললেন, কিন্তু এ কাজ কে করতে পারে? দরজাটা তো খোলা যায় না জানতাম।

ক্র্যাডক বুঝতে পারলেন, অজানা যে লোকের সন্ধান তিনি করছেন, সে লোক–এখানে এই ড্রয়ংরুমেই ছিল সেই রাতে।