১. বাবুরাম গাঙ্গুলি খুব মেধাবী

বনি
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

বাবুরাম গাঙ্গুলি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এনজিনিয়ারিং পাশ। করে আরও পড়াশুনার জন্য তিনি আমেরিকায় চলে যান এবং উচ্চশিক্ষার পর সেখানেই খুব ভাল চাকরি পেয়ে থেকে গেলেন।

বাবুরাম গাঙ্গুলির অবস্থা খুবই ভাল। বহু টাকা রোজগার করেন। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহর থেকে মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে একটি ছোট্ট শহরে তিনি থাকেন স্ত্রী প্রতিভার সঙ্গে। বিশাল বাড়ি, তিনটে দামি গাড়ি আছে তাঁদের। একটা বাবুরামের, একটা প্রতিভার আর একটা স্ট্যান্ডবাই।

বাবুরামের সবই আছে। কিন্তু দুঃখ একটিই। বিয়ের দশ বছর পরেও তাঁদের কোনও সন্তান হয়নি। সন্তান না থাকলে মানুষের কাছে গাড়ি বাড়ি টাকা-পয়সা সবই অর্থহীন হয়ে যায়। বাবুরাম আর প্রতিভার কাছেও জীবনটা ভারী অর্থহীন হয়ে উঠছিল।

এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল।

বাবুরাম আর প্রতিভা উইক এন্ডে বেড়াতে বেরিয়েছেন। তাঁরা যাবেন পেনসিলভানিয়ার পোকোনো জলপ্রপাত দেখতে। সকালবেলা। আশি নম্বর হাইওয়ে ধরে বাবুরাম গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে বসে প্রতিভা ম্যাপ দেখে রাস্তা ঠিক করছেন। ডেলাওয়ার ওয়াটার গ্যাপের কাছবরাবর যখন চলে এসেছেন তাঁরা তখন হঠাৎ বাবুরাম ভারী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ পাশের লেন দিয়ে একটা মস্ত গাড়ি তাঁর গাড়িকে পেরিয়ে যাচ্ছিল,সেই গাড়িতে অনেকগুলো বাচ্চার হাসিমুখ দেখতে পেয়েই বোধ হয় তাঁর নিজের শূন্য জীবনটার জন্য ফের দুঃখ হচ্ছিল। আর এই অন্যমনস্কতার মধ্যেই কিছু একটা ঘটে গেল। কী ঘটেছিল তা বাবুরাম জানেন না। পরে তাঁর মনে পড়েছিল, তিনি একটা প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন, তারপরই গাড়িটা রাস্তার ধারে তীরবেগে উলটে পড়ে যাচ্ছিল। বাবুরাম জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলেন তিনি একটা ঘরে শুয়ে আছেন। শুয়ে আছেন, কিন্তু বিছানায় নয়, মেঝের ওপর। গায়ে হাতে পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে তিনি উঠে বসে দেখলেন, একটু দূরে মেঝের ওপর প্রতিভাও পড়ে আছে। বাবুরাম পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন যে, প্রতিভাও বেঁচে আছে। তাদের কারও আঘাতই খুব গুরুতর নয়।

গাড়ি দুর্ঘটনার কথা বাবুরামের মনে পড়ল, কিন্তু এই বাড়ির মধ্যে তাঁরা কী করে এলেন তা বুঝতে পারলেন না। বাড়িতে লোকজন বা আসবাবপত্র কিছুই নেই। পরিত্যক্ত বাড়ি। দেওয়ালে অনেক ফুটো, মেঝের তক্তা ভাঙা,। হাইওয়ে থেকে অনেকটা দূরেই এই বাড়ি। কেউ যদি তাদের তুলে এনে এখানে রেখে গিয়ে থাকে তো সে অদ্ভুত লোক। হাসপাতালে নিয়ে না গিয়ে এরকম একটা পোড়া বাড়িতে তাঁদের আনার মানে কী?

বাড়িতে একটা ছোট সুইমিং পুল ছিল। তা থেকে জল এনে প্রতিভার চোখে-মুখে ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরালেন বাবুরাম। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুজনে বেরোলেন। আশেপাশে লোকবসতি নেই। ঘন জঙ্গল। তবে একটা কাঁচা রাস্তা আছে।

প্রায় মাইল-দুই হেঁটে তবে তাঁরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন। গিয়ে দেখলেন, গাড়িটি নেই। লোকজনও কেউ জমায়েত হয়নি সেখানে।

বাবুরাম হঠাৎ নিজের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলেন, সকাল ন’টা বাজে। দুর্ঘটনা ঘটেছে সকাল আটটা নাগাদ। এত তাড়াতাড়ি গাড়িটা সরাল কে? আমেরিকা কাজের দেশ বটে, কিন্তু তা বলে এত তাড়াতাড়ি তো এরকম হওয়ার কথা নয়।

হঠাৎ বাবুরামের চোখ গেল ঘড়ির তারিখের খোপে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, বারো তারিখ, সোমবার। এরকম তো হওয়ার কথা নয়। আজ তো দশ তারিখ, শনিবার।

“প্রতিভা, তোমার ঘড়িটা দ্যাখো তো আজ কত তারিখ এবং কী। বার?”

প্রতিভাও ঘড়ি দেখে অবাক হয়ে বললেন, “ও মা, এ তো দেখছি সোমবার আর বারো তারিখ।”

“সেটা কী করে সম্ভব? আমরা কি দু’দিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম?”

“অসম্ভব।”

বাবুরাম খুবই চিন্তিত হলেন। দুদিন অজ্ঞান হয়ে থাকলে তাঁদের প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ার কথা। প্রচণ্ড খিদে-তেষ্টাও পাওয়ার কথা। কিন্তু ততটা দুর্বল তাঁরা বোধ করছেন না। তবে এমনও হতে পারে, দুর্ঘটনার ধাক্কায় তাঁদের ঘড়ি বেগড়বাই করছে।

দু’জনে আরও মাইল-দুই হেঁটে একটা গ্যাস স্টেশন পেলেন। অর্থাৎ পেট্রল পাম্প। সেখান থেকে একটা এজেন্সিতে ফোন করলেন একখানা গাড়ি পাঠাতে। রেস্টরুমে গিয়ে দু’জনেই হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে একটা করে কোকাকোলা খেলেন। গ্যাস স্টেশনের লোকটিকে আজ কত তারিখ তা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলেও বাবুরাম লজ্জা পাচ্ছিলেন। প্রশ্ন শুনলে লোকটা তাঁকে হাঁদা মনে করে হাসবে। কিন্তু পেট্রল পাম্পের সামনেই খবরের কাগজের স্লট মেশিন রয়েছে। বাবুরাম পয়সা ঢুকিয়ে একখানা খবরের কাগজ বের করে দেখলেন। যা দেখলেন তা অবিশ্বাস্য। আজ যথার্থই বারো তারিখ। বাবোই সেপ্টেম্বর। সোমবার।

প্রতিভাকে আড়ালে ডেকে বাবুরাম বললেন, “আমরা য়ে দু’দিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম তাতে কোনও সন্দেহই নেই। আজ বারোই সেপ্টেম্বর। কিন্তু আমরা এমন কিছু চোট তো পাইনি যাতে দু’দিন অজ্ঞান হয়ে থাকার কথা।”

প্রতিভা অত্যন্ত ভয় পেয়ে বললেন, “শুধু তাই নয়। আমাদের দুজনকে দু’মাইল দূরে ওই পোডড়া বাড়িতেই বা নিয়ে গেল কে? কেনইবা নিল?”

বাবরাম খুবই চিন্তিত হলেন।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই একখানা গাড়ি এসে গেল। প্রতিভা আর বাবরাম তাঁদের বাড়িতে ফিরে এলেন।

তাঁরা ফিরে আসবার পর প্রতিবেশী মাগারেট নামে একটি মেয়ে এসে খুব অবাক গলায় বলল, “তোমরা কোথায় ছিলে? পুলিশ-স্টেশন থেকে নোক এসে তোমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর করে গেছে। তোমরা নাকি গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছ? গাড়িটা একদম স্ম্যাশড হয়ে গেছে। অথচ তোমাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।”

এসব প্রশ্নের সদুত্তর বাবুরামের জানা নেই। তিনি চুপ করে রইলেন।

তারপর ধীরে-ধীরে ঘটনাটার কথা কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের স্মৃতিতে ফিকে হয়ে আসতে লাগল। আমেরিকায় কাজের লোকদের বিশ্রাম বলে কিছু নেই। প্রতিভাও চাকরি করেন। হাড়ভাঙা খাটুনি, দোকানবাজার করা, ঘরদোর গোছানো, রান্নাবান্না, কাপড়কাঁচা, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ইত্যাদিতে মানুষের আর অলস চিন্তার সময় থাকে না। সুতরাং ঘটনাটা নিয়ে তাঁরা বেশি মাথা ঘামানোর সময় পেলেন না।

এই ঘটনার ঠিক এগারো মাস বাদে তাঁদের প্রথম সন্তান জন্মাল। একটি ছেলে।

কিন্তু ছেলেটি জন্মানোর পরই দেখা গেল, তার হাত-পা অসাড় এবং স্থির। কান্নাকাটি তো দূরের কথা, কোনও শব্দই করল না

বাচ্চাটা জন্মের পর। ডাক্তাররা প্রথম তাকে মৃত বলে মনে করেছিলেন। জীবনের লক্ষণ দেখে তাকে রেখে দেওয়া হল একটি অক্সিজেন টেন্টের ভিতরে।

বাবুরামকে ডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন, “তোমার ছেলেটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। যদি বাঁচে তবে বাঁচবে উদ্ভিদের মতন। নড়াচড়া করতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না। চিরকাল ওকে। তোমাদের খাইয়ে দিতে হবে, টয়লেট করাতে হবে।”

বাবুরামের চোখে জল এল। এতদিন পরে যদিও-বা সন্তান হল তাও জড়পদার্থ বিশেষ।

ডাক্তার ক্ষীণ ভরসা দিয়ে বললেন, “নিউ ইয়র্কে ডাক্তার ক্রিলের কাছে একবার নিয়ে যেও। উনি বিশ্ববিখ্যাত নিউরোসার্জেন। যদি কিছু পারেন উনিই পারবেন। তবে আপাতত আমরা মাসখানেক বাচ্চাটিকে অবজারভেশনে রাখব।

নিউ ইয়র্কের মস্ত এক হাসপাতালের নিউরোলজির সর্বেসর্বা ডাক্তার ক্রিল। জেমস ক্রিলের খ্যাতি সত্যিই বিশ্বজোড়া।

ডাক্তার ক্রিল বাবুরামের বাচ্চাটাকে দেখলেন। নানারকম পরীক্ষা করে বললেন, “এর জড়তার কারণ আমরা ঠিক ধরতে পারছি না। মস্তিষ্কে কোন একটা অবস্ট্রাকশন আছে। আরও কিছু ইনভেস্টিগেশন দরকার।”

ডাক্তার জেমস ক্রিলের হাসপাতালে বনি অর্থাৎ বাবুরামের ছেলেকে ভর্তি করে দেওয়া হল।

অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হল। অবশেষে ক্রিল বললেন, “অপারেশন ছাড়া কোনও উপায় দেখছি না।”

অপারেশনের নামে ভয় পেলেন বাবুরাম আর প্রতিভা। তাঁদের অনেক আকাঙক্ষার ধন ওই বনি। ওইটুকু তো ছেলে, সে কি মাথার অস্ত্রোপচার সহ্য করতে পারবে?”

ক্রিলকে সে কথা বলতে তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, “আপনার ছেলেকে আমি সবরকমভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। তার হার্ট, লাংস চমৎকার। অপারেশনের ধকল সে সহ্য করতে পারবে বলেই মনে হয়।”

বাবুরাম আর প্রতিভা চোখের জল ফেলতে-ফেলতে হাসপাতালের কাছেই যে-হোটেলে তাঁরা এসে উঠেছেন সেখানে ফিরে এলেন এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে দু’জনেই মন-খারাপ করে বসে রইলেন।

ডাক্তার ক্রিল থাকেন সাউথ অফ ম্যানহাটানে। তাঁর বাড়িটি বিশাল।

অপারেশনের প্রস্তুতি শেষ করে ফেলেছেন ডাক্তার ক্রিল। আগামী কাল তিনি এই অদ্ভুত শিশুটির মস্তিষ্ক খুলে দেখবেন সেখানে গণ্ডগোলটা কিসের।

দোতলার বিশাল শয়নকক্ষে ডাক্তার জেমস ক্রিল একাই থাকেন। অন্যান্য ঘরে তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা। রাত দুটো নাগাদ এক, প্রবল অস্বস্তিতে ক্রিলের ঘুম ভাঙল। তিনি শুনতে পেলেন, খাটের পাশে তাঁর টেলিফোনটা বাজছে।

“হ্যালো।” একটা গম্ভীর ধাতব গলা বলল, “সুপ্রভাত, ডাক্তার ক্রিল। কাল সকালে একটি বাচ্চার ব্রেন অপারেশন করতে যাচ্ছ তুমি?”

“সেকথা ঠিক।”

“কোরো না, ও যেমন আছে তেমনই থাকতে দাও, প্লিজ।”

“তুমি কে?”

“আমাকে চিনতে পারবে না।”

ফোন কেটে গেল। টেলিফোনে হুমকি বা ফাঁকা আওয়াজ ব্যাপারটা, নতুন বা অভিনব কিছু নয়। দুনিয়ায় নিষ্কমা, পাগল, বদমাস কত আছে। ক্রিল ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে শুয়ে পড়লেন।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ভোর চারটে নাগাদ ক্রিল তাঁর বুকে একটা চাপ অনুভব করলেন। তাঁর খুব ঘামও হচ্ছিল। তাঁর বয়স চল্লিশের কোঠায়, তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করেন এবং স্বাস্থ্যও ভাল। এরকম হওয়ার কথা নয়। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন। বাড়ির লোককে ডেকে তুলবেন না হাসপাতালে ফোন করবেন তা স্থির করতে একটু সময় গেল।

হঠাৎ আবার টেলিফোন বেজে উঠল।

“হ্যালো।”

এবারে একজন মহিলার কণ্ঠস্বর। বেশ মোলায়েম গলা, “সুপ্রভাত, ডাক্তার ক্রিল। আশা করি তুমি বনির ওপর অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত বদল করেছ!”

ডাক্তার ক্রিল,বললেন, “না তো! কিন্তু তোমরা কারা? কেন এই অপারেশন বন্ধ করতে চাও?”

“সেটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আমরা চাই বাচ্চাটা যেমন আছে তেমনই থাকতে দাও।”

“তাতে বাচ্চাটার ক্ষতিই হবে।”

“অপারেশন করলে তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তুমি মস্ত ডাক্তার বটে, কিন্তু তুমিও ভগবান নও। গত এক বছরে তোমার তিনজন রুগি অপারেশনের পর মারা গেছে। জার্সি সিটির, পি ডি আথারটন, কুইনসের মিসেস জে চেস্টারফিল্ড, বেকার্সফিল্ডের জন কোহেন।”

ক্রিল সামান্য উম্মার সঙ্গে বললেন, “এটা কোন ধরনের রসিকতা? ডাক্তার তো ভগবান নয়ই।”

“সেজন্যই তোমাকে সাবধান করা হচ্ছে। তা ছাড়া বনির কী। হয়েছে তাও তুমি ভাল করে জানো না। তোমার অপারেশন হবে। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো।”

ক্রিল রেগে গিয়ে বললেন, “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন বনির কী হয়েছে তা তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো!”

“কথাটা মিথ্যে নয় ডাক্তার ক্রিল। আমরা সত্যিই জানি। আর জানি বলেই বলছি, বাচ্চাটা যেমন আছে তেমনই থাকতে দাও।”

“এভাবে বেঁচে থেকে ওর লাভ কী?”

“সেটা তুমি বুঝবে না।”

“তোমরা কারা?”

“আমরা বনির বা তোমার শত্রু নই। শোনো ডাক্তার ক্রিল, আমাদের সংগঠন অতিশয় শক্তিশালী। আমরা যা বলছি তা না শুনলে তোমার বিপদ হবে। এখন যে তুমি অসুস্থতা বোধ করছ তার কারণ জানো? তুমি অস্থির বোধ করছ, তোমার ঘাম হচ্ছে, বুকে একটা চাপ অনুভব করছ-তাই না?”

ডাক্তার ক্রিল হাঁফধরা গলায় বললেন, “হ্যাঁ। তোমরা কী করেছ আমাকে? খাবারে বিষ মিশিয়েছ?”

“বিকেলে হাসপাতালে তুমি যে কফি খেয়েছিলে তাতে বিলম্বিত-ক্রিয়ার বিষ মেশানো ছিল। কাল সকালে তোমার অসুস্থতা আরও বাড়বে। বিষটা পৌঁছবে তোমার হৃৎপিণ্ডে। এই বিষের প্রতিষেধক তোমার জানা নেই।”

“আমি কি মারা যাব?”

“যাবে, যদি বনির ওপর অস্ত্রোপচার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত না নাও।”

“যদি অস্ত্রোপচার না করি তা হলে?”

“যদি কথা দাও অস্ত্রোপচার করবে না তা হলে কাল সকালে হাসপাতালে এসে প্রথম যে কফিটা খাবে তাতে আমরা বিষের অ্যালিডোট মিশিয়ে দেব। তবে তোমার শরীর সকালে আরও খারাপ হবে। হাসপাতালে নিজে গাড়ি চালিয়ে এসো না। একটা ক্যাব বা ভাড়াটে গাড়ি নিয়ে এসো। ভয় নেই, আমাদের কথা শুনে চললে তোমার কোনও ক্ষতি করা হবে না।”

ফোন কেটে গেল। ডাক্তার ক্রিল অবিশ্বাসের চোখে রিসিভারের দিকে চেয়ে রইলেন। বিশ্বাস হচ্ছে না বটে, কিন্তু তাঁর শরীর যে খারাপ তা তো মিথ্যে নয়।

রাত পোহানোর জন্য ক্রিল অপেক্ষা করলেন না। একটা এজেন্সিতে টেলিফোন করলেন চালকসহ গাড়ির জন্য। তারপর পোশাক পরে নিলেন চটপট। মাঝে-মাঝেই তিনি শ্বাসকষ্ট অনুভব করছেন, ঘাম হচ্ছে, বুকের চাপ বেড়ে যাচ্ছে।

ক্রিল যখন হাসপাতালে পৌঁছলেন তখনও ভোর হতে অন্তত দু’ঘণ্টা বাকি। রাতের কর্মচারীরা অবশ্য তাঁকে দেখে অবাক হল না, ভাবল, কোনও গুরুতর রুগিকে দেখতে এসেছেন।

নিজের ঘরে গিয়েই তিনি কফি চেয়ে পাঠালেন ফোনে। তারপর নিঝঝুম হয়ে বসে ঘটনাটা বিচার করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কফি এসে গেল। যে কফি আনল সে পুরনো লোক। গত দু’ বছর ধরে এ কাজ করছে।

ওরা বলেছিল প্রথম কাপ কফিতেই অ্যালিডোট মেশানো থাকবে। আছে কি? ভ্রু কুঁচকে ভাবতে-ভাবতে তিনি কফিতে চুমুক দিলেন।

কফি শেষ করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার ক্রিল বুঝতে পারলেন যে, তাঁর শরীরে একটা পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি অনেক ঝরঝরে এবং সুস্থ বোধ করছেন।

তিনি ধীরে-ধীরে বনির ঘরে এসে তার ছোট্ট বিছানাটার পাশে দাঁড়িয়ে শিশুটির দিকে নিস্পলক চেয়ে রইলেন। এই শিশুটিকে ঘিরে কোন রহস্য দানা বেঁধে উঠছে? কেন কিছু লোক চাইছে বনির চিকিৎসা বন্ধ করতে?

বনি ঘুমোচ্ছে। চোখ বোজা। জেগে থাকলেও বনি কোনও শব্দ করে না। কাঁদে না, হাসেও না। কেবল চুপ করে চেয়ে থাকে। এই কাঠের পুতুলের মতো বাচ্চাটি সম্পর্কে কার এত আগ্রহ?

হঠাৎ ডাক্তার ক্রিল লক্ষ করলেন, বনি চোখ চেয়ে সোজা তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। সোজা তার চোখের দিকে। ডাক্তার ক্রিল একটু ঝুঁকে বনির দিকে চেয়ে রইলেন। খুব তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করতে লাগলেন শিশুটিকে। তাঁর কেমন যেন মনে হল, বনি সম্পর্কে তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্তে কোনও ভুল আছে। আজ তিনি বনির চোখ দেখে। বুঝতে পারলেন, এই শিশুটির আর সব অসাড় হলেও, মস্তিষ্ক অসাড় নয়। ওর চোখের দৃষ্টিতে একটি ক্রিয়াশীল মস্তিষ্কের প্রতিফলন রয়েছে। বনি আর যাই হোক, বোধহীন শিশু নয়।

বনির বাবা-মা সকালবেলায় যখন হাসপাতালে এল তখন ক্রিল তাঁর চেয়ারে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার কুঞ্চন।

বাবুরাম আর প্রতিভাকে আনমনেই অভ্যর্থনা জানালেন ক্রিল। তারপর ম্লান মুখে বললেন, “দুঃখিত, কোনও বিশেষ কারণে বনির অপারেশন করা সম্ভব নয়।”

বাবুরাম অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, “কেন?”

“কারণটা অত্যন্ত জটিল। মেডিক্যাল টার্মস আপনারা ভাল বুঝবেন না। তবে অপারেশনটা বনির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। আমার মনে হয়, বনি এখন যেমন আছে তেমনই থাক।”

“কিন্তু….”

ক্রিল একটু চাপা স্বরে বললেন, “কোনও কিন্তু নেই। বনির অপারেশন হচ্ছে না। আমি ওকে আরও কয়েকদিন অবজার্ভেশনে রেখে ছেড়ে দেব।”

অপারেশন হবে না শুনে প্রতিভা কিন্তু খুশিই। তিনি স্বামীকে বললেন, “শোনো, বনি যদি বেঁচে থাকে তা হলেই আমাদের ঢের।

আমি আর কিছু চাই না।”

বাবুরাম হতাশ গলায় বললেন, “কিন্তু এ তো ঠিক বেঁচে থাকা নয়। ওকে কে দেখবে আমাদের মৃত্যুর পর?”

প্রতিভা বললেন, “আমাদের মরতে এখনও ঢের দেরি। ততদিনে একটা কিছু হয়ে যাবেই।”

বাবুরাম ডাক্তার ক্রিলের দিকে চেয়ে বললেন, “আমরা কবে বনিকে নিতে আসব?”

ডাক্তার ক্রিল মাথা নেড়ে বললেন, “বলতে পারছি না। খুব বেশি হলে তিন-চারদিন।”

স্বামী-স্ত্রী বিদায় নিলে ডাক্তার ক্রিল আরও কিছুক্ষণ চিন্তাচ্ছন্ন রইলেন। তারপর রুগি দেখতে উঠতে হল।

বাবুরাম ও প্রতিভা সারাদিনই বনিকে নিয়েই কথা বলেন এবং বনিকে নিয়েই চিন্তা করেন। বিশেষ করে বনির ভবিষ্যৎ। এই নিষ্ঠর উদাসীন পৃথিবীতে বনির মত অসহায় শিশুর কী দশা হবে? কে। দেখবে ওকে? ও কি কোনওদিন হাঁটতে, চলতে বা কথা বলতে পারবে?

প্রতিভা ও বাবুরাম রোজই হাসপাতালে যান। বনিকে দেখে আসেন। তিনদিন বাদে ডাক্তার ক্রিল বললেন, “বনির অবজারভেশন শেষ হয়েছে। এবার ওকে আপনারা নিয়ে যেতে পারেন।”

বাবুরাম অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “অবজারভেশনে কী পেলেন?”

ক্রিল খানিকক্ষণ বাবুরামের মুখের দিকে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বললেন, “আমার মনে হয় বনি নির্বোধ নয়।”

“তার মানে কী ডাক্তার?”

“আমাদের যন্ত্রপাতি এবং কম্পিউটার বলছে, বনির মস্তিষ্ক ক্রিয়াশীল। তার হাত-পা-জিভ অসাড় হলেও তার মাথা নয়।”

“ও কি ভাল হবে?”

“তা বলা কঠিন। ভাল-মন্দ সম্পর্কে আমাদের ধারণা সাবেক কালের। হয়তো এ-সব ধারণা ভবিষ্যতে পালটাতে হবে।”

“এ-কথার অর্থ কী?”

“এর চেয়ে বেশি বলা আপাতত সম্ভব নয়।”

বাবুরাম জিজ্ঞেস করলেন, “বাড়িতে ওর চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা কি করে দেবেন?”

ক্রিল মাথা নেড়ে বললেন, “কোনও চিকিৎসা নয়। শুধু লক্ষ। রাখবেন। আর-একটা কথা। যদি পারেন বনিকে নিয়ে খুব দূরে কোথাও চলে যাবেন। কোনও নিরাপদ জায়গায়।”

“এ-কথার মানে কী ডাক্তার ক্রিল?”

“আমার মনে হয় আমেরিকা বনির পক্ষে খুব নিরাপদ জায়গা নয়।”

অনেক ঝুলোঝুলি করেও ডাক্তার ক্রিলের কাছ থেকে এর বেশি আর কিছু বোঝা গেল না। বাবুরাম ও প্রতিভা বনিকে নিয়ে তাঁদের নিউ জার্সির বাড়িতে ফিরে এলেন।

নিউ জার্সি খুব ছোট শহর নয়। কিন্তু আমেরিকার এসব শহর খুব নির্জন। রাস্তায় লোকজন প্রায় দেখাই যায় না। মাঠ, পার্ক, অরণ্য, খেলার মাঠ সবই আছে, কিন্তু বড় নিরিবিলি। এ-দেশে কারও বাড়িতেই বেশি লোজন থাকে না, যৌথ পরিবার নেই। এক-একটা বাড়িতে কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রী আর একটা-দুটো বাচ্চা থাকে। যে যার আপনমনে থাকে, এবাড়ি ওবাড়ি যাতায়াত বা গল্পগুজব করার সময় কারও নেই। এ হল কাজের দেশ। ফলে অধিকাংশ বাড়িই সকালবেলা থেকেই ফাঁকা হয়ে যায়।

বাবুরামের বাড়িটাও এইরকম নির্জন এক পাড়ায়। চারদিকে লম্বা-লম্বা গাছে ছাওয়া ভারী সুন্দর বাড়ি। এ-দেশে বাড়ির সামনে এবং পিছনে লন বা ঘাসজমি রাখতেই হয়। সব বাড়িরই মাটির তলায় একটা করে প্রশস্ত ঘর থাকে, তাকে বলে বেসমেন্ট। একতলায় সাধারণত বৈঠকখানা, লিভিংরুম, রান্না আর খাওয়ার ঘর থাকে। ওপরতলায় শোওয়ার ঘর। বাবুরাম সকাল সাতটার মধ্যেই বেরিয়ে যান। সারাদিন বাড়িতে প্রতিভা ছেলে বনিকে আগলে নিয়ে থাকেন। বনিকে নিয়ে কোনও ঝামেলা নেই। জেগে থাকলে সে চেঁচায় না বা কাঁদে না। শুধু চেয়ে থাকে। যখন ঘুমোয় তখন চোখ বুজে থাকে। চোখের পাতা ছাড়া বনির শরীরে আর কোনও কিছুই নড়ে না। তবে বনি খায়। দুধ, ফলের রস খেতে সে খুব ভালবাসে, এটা প্রতিভা বুঝতে পারেন। বনির স্বাস্থ্যও মোটামুটি ভালই।

প্রতিদিন সকালে ঘরের যত আবর্জনা, তরকারির খোসা বা এটোকাঁটা একটা প্লাস্টিকের থলিতে করে নিয়ে বাড়ির সামনে রেখে দিতে হয়। গারবেজের গাড়ি এসে সেটা নিয়ে যায়। একদিন সকালে প্রতিভা গারবেজ ব্যাগ রাখতে গিয়ে হঠাৎ দেখলেন, রাস্তার ও-পাশে একটা পপলার গাছের নীচে একজন ভবঘুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকেই লক্ষ করছে। লোকটার মাথায় একটা তোবড়ানো টুপি, চুল-দাড়ি-গোঁফে মুখটা আচ্ছন্ন, গায়ে ময়লা কোট, পরনে প্লিমারা ট্রাউজার্স, পায়ে নোংরা বুটজুতো, গলায় বড়-বড় লাল পুঁতির একটা মালা আর কাঁধে একটা বেহালার বাক্স। বিচিত্র চেহারা এবং পোশাকের এইসব ভবঘুরেকে অবশ্য আমেরিকার সর্বত্রই দেখা যায়। এরা আবর্জনা ঘেঁটে খাবার বা পয়সা খোঁজে, ভিক্ষে করে, নেশাভাঙের পয়সা জোটাতে চুরি তো করেই, খুনখারাপিতেও পিছপা হয় না।

প্রতিভা অবশ্য ভয় পেলেন না। আমেরিকায় তিনি অনেকদিন আছেন। ভবঘুরেও বিস্তর দেখেছেন। কিন্তু লোকটা এমন স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে চেয়ে আছে যে, ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। তিনি তাড়াতাড়ি ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

একটু বাদেই হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। এই অসময়ে কারও আসবার কথা নয়। আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে এখানে কেউ কারও বাড়ি যায় না। তবে সেলসম্যান বা ডাকপিয়ন হতে পারে। কিন্তু তা হলে সামনে গাড়ি পার্ক করা থাকবে। এখানকার সেলসম্যান বা ডাকপিয়ন গাড়ি ছাড়া আসবে না। প্রতিভা দোতলার ঘর থেকে কাঁচের শার্শি দিয়ে উঁকি মেরে কোনও গাড়ি দেখতে পেলেন না। তবে লক্ষ করলেন, পপলার গাছের নীচে ভবঘুরেটা নেই।

প্রতিভার বুকটা একটু কেঁপে উঠল। ভবঘুরেটাই কি ডোরবেল বাজাল? প্রতিভা অবশ্য এসব পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছেন। সুতরাং ঘাবড়ালেন না। তাড়াতাড়ি একতলায় নেমে রান্নাঘরের টেবিল থেকে বড় তরকারি কাটার ছুরিটা হাতে নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললেন। দরজায় চেন লাগানো, চট করে কেউ ঢুকতে পারবে না।

সেই ভবঘুরেটাই একগাল হাসি নিয়ে বলল, “সুপ্রভাত। আমি বড় ক্ষুধার্ত। কিছু দিতে পারেন?”

প্রতিভা কী বলবেন ভেবে পেলেন না। লোকটার হাবভাব তাঁর ভাল লাগছে না। “দাঁড়াও।” বলে প্রতিভা দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন।

লোকটা তার পায়ের বুট দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আটকাল।

চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই। কেউ শুনতে পাবে না। সারা শহর এখন খাঁখাঁ জনশূন্য। প্রতিভা প্রাণপণে দরজাটা চেপে ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। লোকটাও তেমন ঠেলাধাক্কা করল না, শুধু ভারী বুট দিয়ে দরজাটা আটকে দাঁড়িয়ে রইল।

প্রতিভা ছুরিটা শক্ত করে ধরে দরজার ফাঁক দিয়ে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “কী চাও?”

লোকটা একটু হেসে বলল, “এই তো কাজের কথা ম্যাডাম। গায়ের জোর দেখিয়ে লাভ নেই। আমি কিছু টাকা চাই। দশ-বিশ ডলার হলেই চলবে। আর কিছু খাবার। বাসী হলেও আপত্তি নেই।”

প্রতিভা আর কী করেন, মনে আতঙ্ক নিয়েই লোকটাকে তাড়ানোর জন্য তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসে একটা আস্ত পাউরুটি, এক প্যাকেট মাখন, একটা পিচ আর একটা আপেল একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরলেন। পাঁচটা ডলার হাতে নিয়ে সদর দরজার দিকে আসতেই দেখলেন, লোকটা দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে পড়েছে এবং চারদিকে চেয়ে দেখছে। হাবভাব ভাল নয়।

প্রতিভা পিছিয়ে গিয়ে খাওয়ার টেবিল থেকে আবার ছুরিটা তুলে নিলেন তারপর এগিয়ে গিয়ে বললেন, “তোমার যথেষ্ট দুঃসাহস। কার হুকুমে তুমি ঘরে ঢুকেছ?

আমার কারও হুকুমের দরকার হয় না। ছুরিটা রেখে দাও, ওটা যদি ব্যবহার করার ইচ্ছে থাকে তা হলে সেটা ছেলেমানুষী হবে।

প্রতিভা কী করবেন ভেবে পেলেন না। খুব ভয় পেয়েছেন, কিন্তু কিছু করারও নেই। শুধু বললেন, “তুমি কী চাও? এই খাবার নাও, পাঁচটা ডলার দিচ্ছি, নিয়ে যাও। কিন্তু দয়া করে বিদেয় হও।”

লোকটা প্রতিভার কথায় কর্ণপাত করল বলে মনে হল না, পাত্তাও দিল না। শিস দিতে দিতে ঘুরে ঘুরে ঘরের জিনিসপত্র দেখতে লাগল। বেশ বেপরোয়া ভাব। প্রতিভা চেষ্টা করলেও লোকটাকে ছুরি মারতে পারবেন না এটা তিনি ভাল জানেন। সুতরাং তিনি লোকটার দিকে আতঙ্কিত চোখে চেয়ে রইলেন শুধু।

লোকটা চারদিক দেখতে দেখতে এ-ঘর থেকে ও-ঘর যাচ্ছিল। প্রতিভা একটু ব্যবধান রেখে তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। লোকটা ধীরেধীরে দোতলায় উঠল।

প্রতিভা চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওখানে আমাদের শোওয়ার ঘর। কেন ওখানে যাচ্ছ?”

“শোওয়ার ঘরেই মানুষ মূল্যবান জিনিসগুলি রাখে।”

“প্লিজ! ও-ঘরে আমার ছেলে ঘুমোচ্ছে। সে অসুস্থ। শব্দ করলে জেগে যাবে।”

লোকটা প্রতিভাকে গ্রাহ্যই করল না। দোতলায় উঠে প্রতিভার শোওয়ার ঘরে ঢুকল। বনির নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রতিভা তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ছেলেকে আগলে বসলেন।

লোকটা বনির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “তোমার ছেলে তত জেগেই আছে দেখছি।”

প্রতিভা দেখলেন সত্যিই বনির চোখ খোলা। সে তাকিয়ে আছে।

লোকটা হঠাৎ বলল, “তোমার ছেলের চোখের রং কি লাল? টকটকে লাল?”

“না। আমার ছেলের চোখের রং কালো।”

লোকটা হঠাৎ যেন উত্তেজিত হয়ে বলল, “ভাল করে দ্যাখো, তোমার ছেলের চোখের রং লাল। ঘোর লাল।”

প্রতিভা বনির দিকে চেয়ে এত অবাক হয়ে গেলেন যে, বলার নয়। বনির চোখের কালো মণিদুটো দুটি চুনি পাথরের মতো লাল আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এরকম অস্বাভাবিক চোখ প্রতিভা কখনও দেখেননি।

“ও মা! বনির কী হল!” বলে তিনি তাড়াতাড়ি ছেলেকে জাপটে ধরলেন।

লোকটা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “সবুজ! ওর চোখের রং সবুজ হয়ে যাচ্ছে! এ তো ভূতড়ে ব্যাপার।

প্রতিভা বনির চোখের দিকে চেয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, চুনি নয়। দুটি চোখ পান্নার মতো সবুজ। চোখ থেকে যেন দ্যুতি ঠিকরে আসছে।

ভবঘুরেটার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। শুকনো ঠোঁট চাটতে চাটতে লোকটা পিছু হটে দরজার কাছে পৌঁছল। তারপর দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দড়াম করে সদর দরজা বন্ধ করে পালিয়ে গেল। প্রতিভা জানালার দিকে দেখলেন, লোকটা রাস্তা ধরে ছুটছে।

প্রতিভা দেখলেন, বনির চোখের রং আবার কালো হয়ে গেছে।

প্রতিভা ঘাবড়ে গেছেন বটে, কিন্তু জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন, বাবুরামের ফেরার জন্য। বনির জন্য তাঁর এত দুশ্চিন্তা হল যে, সারাদিন তিনি বনিকে আর কোল-ছাড়া করলেন না। বনির কি চোখের দোষ আছে? বনির ওপর কি কোনও অপদেবতার ভর হয়? নইলে চোখের রং অমন অস্বাভাবিকভাবে পালটে যাবে কেন?

বিকেলে বাবুরাম ফিরে সব শুনলেন। টেলিফোন করে তক্ষুনি ডাক্তার ক্রিলের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হল। পরদিন সকাল সাতটায় ক্রিল বনিকে দেখবেন। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

পরদিন হাসপাতালে শুধু ডাক্তার ক্রিল নয়, একজন চোখের ডাক্তারও বনিকে ভাল করে দেখলেন। তাঁরা মত দিলেন, বনির চোখে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। বনির চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক।

ক্রিল প্রতিভাকে ঘটনাটি সম্পর্কে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে সব জেনে নিলেন। তারপর চিন্তিতভাবে বললেন, “তুমি বলছ যে, বনির চোখের তারার রং পাল্টে যাচ্ছিল? আশ্চর্যের বিষয় এই অবিশ্বাস্য ঘটনাকে আমি কেন যেন ঠিক অবিশ্বাস করতে পারছি না। বনির ক্ষেত্রে সবই সম্ভব। আমি তোমাদের আবার বলছি, বনিকে আমেরিকায় রাখাটা ঠিক হবে না। তোমরা যদি পারো ওকে নিয়ে কোনও দূর দেশে চলে যাও।”

প্রতিভা করুণ মুখ করে বললেন, “আমাদের দেশ ভারতবর্ষে এত উন্নত ধরনের চিকিৎসা নেই। জল-হাওয়াও ভাল নয়। তা ছাড়া আমরা আমেরিকাকেই আমাদের দেশ করে নিয়েছি।”

ক্রিল মাথা নেড়ে বললেন, “বনির চিকিৎসা পৃথিবীর কোথাও হবে। আমার মনে হয় আমেরিকায় ও নিরাপদ নয়। এখন তোমরা যা ভাল বোঝো করবে।“

তিন-চারদিন পর একদিন সকালবেলায় বাবুরাম অফিসে গেছেন। একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। ক’দিনের মধ্যেই কনকনে হাওয়া বইবে, তারপর শুরু হবে তুষারপাত। প্রতিভা কিছু কাঁচাকাচি করে কাপড়গুলো বাইরের রোদে মেলে দিচ্ছিলেন, হঠাৎ নজরে পড়ল, একটা পপলার গাছের তলায় জনাপাঁচেক ভবঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। কারও হাতে ব্যাঞ্জো, কারও বেহালা, কারও বগলে বাঁশি। তারা খুব কৌতূহল নিয়ে এবাড়ির দিকে চেয়ে আছে।

ভবঘুরে দেখে প্রতিভা খুব ভয় পেলেন। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর জানালার পর্দা সরিয়ে লক্ষ করতে লাগলেন, ওরা কী করে। দেখতে পেলেন, পাঁচ জনের মধ্যে দুজন। মেয়েও আছে। সকলেরই উলোঝুলো পোশাক এবং নোংরা।

প্রতিভা ভেবে দেখলেন, এরা যদি সবাই মিলে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে তা হলে তিনি আটকাতে পারবেন না। সুতরাং তিনি পুলিশে ফোন করতে গেলেন। কিন্তু টেলিফোন ডেড। এরাই বোধ হয় তার কেটে দিয়েছে। প্রতিভা শোওয়ার ঘরে গিয়ে কম্পিতবক্ষে বাবুরামের ড্রয়ার খুলে ভারী রিভলভারটা তুলে নিলেন। কোনও বেয়াদবি দেখলে আজ তিনি কিছুতেই ওদের ছাড়বেন না। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে নীচে নেমে এসে দরজা খুলে বেরোতে গিয়ে ভীষণ অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।

পাঁচ জন বাউন্ডুলে, উলোঙ্কুলো পোশাক-পরা পুরুষ ও মেয়ে তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইছে একযোগে। গানের কথা বোঝা যাচ্ছে না, তবে মনে হয় এরা কারও জয়ধ্বনি দিচ্ছে। প্রতিভাকে দেখে গান গাইতে গাইতেও তারা অভিবাদন জানাতে লাগল বার বার।

কিছুক্ষণ বাদে গান থামিয়ে একজন এগিয়ে এসে বলল, “সুপ্রভাত। আমরা শুনেছি, তোমার একটি শিশুপুত্র আছে এবং সে অলৌকিক ক্ষমতা ধরে। আমরা তাকে একবার দেখতে এসেছি। ভয় নেই, আমরা দূর থেকে তাকে একবার দেখব এবং কিছু উপহার দিয়ে চলে যাব।”

“তোমরা কার কাছে একথা শুনেছ?”

“সে আমাদের বন্ধু এক বাউন্ডুলে। তার নাম এডি। সে চুরি করতে তোমার বাড়িতে ঢুকেছিল। তোমার ছেলেকে দেখে সে ভয়ে পেয়ে পালিয়ে যায়। আজও তার ভয় কাটেনি। সে বলছে, স্বয়ং ঈশ্বরপুত্র তাকে ভর্ৎসনা করেছেন।”

প্রতিভার মনটা প্রসন্ন হয়ে গেল। তিনি ওপরে গিয়ে বনিকে কোলে নিয়ে নেমে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। বাউন্ডুলেরা মুগ্ধ চোখে বনিকে দেখল, তারপর সকলেই সাষ্টাঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে ভূমি-চুম্বন করে উঠে কেউ সিকি ডলার, কেউ একটা ফল, কেউ তার বাঁশিটা উপহার হিসেবে দরজার সামনে রাখল। তারপর নিঃশব্দে চলে গেল।

এরকম দৃশ্য প্রতিভা কখনও দেখেননি। যেমন অবাক হলেন, তেমনই খুশিও হলেন। ভবঘুরে বাউন্ডুলেরা সবাই তা হলে খারাপ নয়।

দুদিন পরেই হঠাৎ হইহই করে বাড়িতে এসে চড়াও হল টেলিভিশন টিম। তাদের সঙ্গে ক্যামেরা, রিফ্লেক্টর, যন্ত্রলাগানো গাড়ি। হাসপাতাল সূত্রে তারা শুনেছে বনি এক অদ্ভুত শিশু। তারা বনির খবর সারা দেশে প্রচার করতে চায়।

বাবুরাম আর প্রতিভার সাক্ষাৎকারও তারা নিল। পরদিন টেলিভিশনে বনির ছবি আর বাবুরাম এবং প্রতিভার সাক্ষাৎকার ফলাও করে প্রচার করা হল। ফলে পরদিন থেকেই কৌতূহলী লোকজন আসতে লাগল বনিকে দেখতে। তারা নানা রকম উপহারও দিয়ে যেতে লাগল। এল অজস্র টেলিফোন। আসতে লাগল চিঠি, টেলিগ্রাম, ডলার। বাবুরাম আর প্রতিভা অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগলেন।

বাবুরাম ডাক্তার ক্রিলকে টেলিফোন করে বললেন, “বনির কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এভাবে মিডিয়াকে জানিয়ে দিয়ে ঠিক কাজ করেনি ডাক্তার ক্রিল। আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।”

ডাক্তার ক্রিল খুব মোলায়েম গলায় বললেন, “আমি এরকমই চেয়েছিলাম। যাতে অতিষ্ঠ হয়ে তোমরা আমেরিকা ছেড়ে পালাও। তোমাদের কি যাওয়ার জায়গা নেই?”

বাবুরাম বিষঃ গলায় বললেন, “আছে। কিন্তু…”

“কোনও কিন্তু নেই। তোমাদের চলে যাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। আমি তোমাদের একটা কথা এতদিন বলিনি, আজ বলছি। বনির ওপর একটা দুষ্টচক্রেরও নজর আছে। তারা কী করতে চায় আমি জানি না। কিন্তু বনির ওপর অস্ত্রোপচার তারাই আমাকে করতে দেয়নি। সাবধান থেকো, আমার বিশ্বাস, তারা লোক ভাল নয়।”

বাবুরাম একথায় খুব ভয় পেলেন। কিন্তু প্রতিভাকে কিছুই বললেন না।

বাবুরাম ভেবে দেখলেন, বনিকে নিয়ে তিনি দেশে ফিরে যেতে পারেন। সেখানে তাঁর বুড়ো বাবা আছেন, মা আছেন, ভাই-বোনেরাও আছেন। বনি সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। বনি যে অস্বাভাবিক, বনি যে অসাড় এবং পঙ্গু এই সংবাদ তাঁদের জানাননি বাবুরাম। ভেবেছিলেন চিকিৎসা করে বনিকে সুস্থ করে দেশে গিয়ে মা বাবাকে দেখিয়ে আনবেন। বাবাও নাতিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে বার বার চিঠি দিচ্ছেন। চিঠি দিচ্ছেন মাও। নাতির কী নাম রাখা হবে তাই নিয়ে দাদু আর ঠাকুমাতে নাকি রোজই। তকাতর্কি হচ্ছে।

বাবুরাম প্রতিভাকে বললেন, “এই টেনশন আর লোকজনের ভীড় আর ভাল লাগছে না। চলো, দেশ থেকেই ক’দিনের জন্য ঘুরে আসি।”

প্রতিভা রাজি হয়ে বললেন, “সেই ভাল।” বা

বুরাম বললেন, “কিন্তু বনির অসুস্থতা সম্পর্কে বাড়ির লোক কিছুই জানে না। বাবা-মা বনিকে দেখে খুবই মুষড়ে পড়বেন। আমার মনে হয় এঁদের এ ব্যাপারটা চিঠি লিখে আগেভাগেই একটু জানিয়ে দেওয়া ভাল।”

বাবুরাম বাড়িতে চিঠি লিখলেন এবং অফিসে ছুটির দরখাস্ত করে যাওয়ার জন্য অগ্রিম তোড়জোড় শুরু করলেন। বাবুরাম খুবই দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণ বললেই ছুটি পাওয়া শক্ত। অনেক আঁটঘাট বেঁধে তবে ছুটি নিতে হয়।

দেশে যাওয়ার কথায় প্রতিভা খুব খুশি। আমেরিকায় তাঁরা খুবই সুখে আছেন বটে কিন্তু দেশ হল অন্য জিনিস। দরিদ্র হোক, শত অসুবিধে থাকুক তবু ওই মাটির টান কখনও কমে না।

প্রতিভা এক দুপুরবেলা বনিকে আদর করতে করতে বললেন, “জানিস বনি, আমরা তোকে নিয়ে দেশে যাব। তুই দাদু-ঠাম্মাকে দেখবি, দাদামশাই-দিদাকে দেখতে পাবি। কাকা পিসি মাসি মামারা কত আদর করবে তোকে…”

বনির কালো চোখ হঠাৎ নীলকান্তমণির দ্যুতিতে ভরে উঠল। এমন আশ্চর্য নীল প্রতিভা কখনও দেখেননি। তিনি বনিকে বুকে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “বনি! বনি! তোর কী হল হঠাৎ?”

এই সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। প্রতিভা গিয়ে টেলিফোন ধরতেই একটা গম্ভীর গলা মার্কিন ইংরেজিতে বলে উঠল, “সুপ্রভাত। আমি কি বনির মা’র সঙ্গে কথা বলছি?”

“হ্যাঁ। আমিই বনির মা। কী চাই?”

“আমরা শুনেছি আপনারা বনিকে নিয়ে ভারতবর্ষে চলে যেতে চাইছেন?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?”

“আমি যে-ই হই, যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। বনিকে এ-দেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আপনারা ঘোর বিপদে পড়বেন।”

“তার মানে?”

“বনি এ-দেশেই থাকবে। যদি ওকে নিয়ে পালাতে চান তা হলে আপনাদের বাধা দেওয়া হবে এবং বনিকে আপনাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে।”

ফোন কেটে গেল। প্রতিভা স্তম্ভিত হয়ে ফোনটার দিকে চেয়ে। রইলেন।

বাবুরাম বিকেলবেলায় এসে স্ত্রীর কাছ থেকে সব শুনে গম্ভীর ও বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। বললেন, “পুলিশের সাহায্য নেওয়া ছাড়া আর তো পথ দেখছি না।”

প্রতিভা মাথা নেড়ে বললেন, “কক্ষনো নয়। পুলিশ এ ব্যাপারে নাক গলালে আমার বনির যদি বিপদ হয়?”

“তা হলে কী করব? ডাক্তার ক্রিল আমাকে সেদিন গোপনে বলেছেন একটা দুষ্টচক্র বনির সম্পর্কে তাঁকেও হুমকি দিয়েছে। এরা নাকি বিপজ্জনক লোক।”

প্রতিভা বললেন, “বনির ভালর জন্য আমাদের সবকিছুই মেনে নিতে হবে।”

বাবুরাম অনেকক্ষণ ভেবে বললেন, “দ্যাখো, আমার মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয়, বনির জন্মের পিছনে একটা রহস্যময় কারণ আছে। আমি নিজে সায়েন্টিস্ট বলেই বলছি, কারণটা হয়তো বৈজ্ঞানিক। সেই ডেলাওয়্যার ওয়াটার গ্যাপে বেড়াতে যাওয়ার পথে আমাদের যে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল তার কথা মনে আছে?”

“বাবাঃ, মনে থাকবে না! খুব আছে।”

“আমার মনে হয় ওই অ্যাকসিডেন্টটাও স্বাভাবিক ছিল না। অ্যাকসিডেন্ট স্পট থেকে কে বা কারা আমাদের দুজনকে অনেক দূরে একটা পোড়ো বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন বনি সদ্য মাতৃগর্ভে এসেছে। সেই সময়ে কিছু উন্নত মস্তিষ্কসম্পন্ন লোক এমন কিছু ওষুধ তোমার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বা কোনও সূক্ষ্ম উপায়ে গর্ভস্থ ভূণের এমন কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছিল যার ফলে বনির আজ এই অবস্থা।”

“তা হলে আমরা কী করব এখন?”

“আমার সন্দেহ হচ্ছে, বনিকে কোনও একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

“সে কী!” বলে আর্তনাদ করে উঠলেন প্রতিভা।

“ঘাবড়ে যেও না। আমরা এখনও প্রায় কিছুই জানি না। শুধু সন্দেহই হচ্ছে। তবু আমার ইচ্ছে এব্যাপারটা নিয়ে একটু অনুসন্ধান করি। সামনের উইক এন্ডে চলো আমরা আবার সেই জায়গাটায় যাই।”

“আবার যদি বিপদ হয়?”

“ভয় পেও না। আমাদের এখন যে বিপদ চলছে তার চেয়ে বেশি বিপদ আর কী হতে পারে? বনি সম্পর্কে আমরা এখনও প্রায় কিছুই জানি না। না জানলে ওর সমস্যার সমাধান করব কীভাবে?”

“বনিকে নিয়েই তো যাব?”

“হ্যাঁ। অবশ্যই।”

প্রতিভা চেয়ে দেখলেন, বনির চোখ থেকে এক আশ্চর্য গোলাপি আভা ঠিকরে বেরোচ্ছে।

“বনি!” বলে ফের চেঁচালেন প্রতিভা।

বাবুরাম গিয়ে ছেলের অসাড় দেহটি কোলে তুলে নিয়ে তার কানেকানে বললেন, “বনি, আমি জানি তোমার শরীর অসাড় হলেও তোমার মগজ নয়। তুমি সবই বুঝতে পারছ। হয়তো আমাদের চেয়েও তোমার মগজের শক্তি বেশি। তুমি কী বলল বাবা, আমরা কি ওই জায়গাটায় যাব? যাওয়া কি উচিত?”

চোখের ভুলও হতে পারে, তবু বাবুরামের মনে হল, বনির ঠোঁটে যেন একটা খুব হালকা হাসির ছোঁয়া চকিতে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।

বনির বয়স মাত্র এক বছর। এই ছোট বাচ্চার বোধ শক্তি প্রবল নয়। বনির ক্ষেত্রে তো আরও নয়। তবু কি বনি বাবুরামের কথা বুঝতে পারল এবং সায় দিল?

বাবুরাম নিশ্চিন্ত হয়ে প্রতিভাকে বললেন, “আমরা যাব।”

প্রতিভা মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে।”