ফিনিক্স – সায়েন্স ফিকশান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পূর্বকথা
ভাইরাসটির নাম ছিল ইকুয়িনা, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার করে বললে বলতে হয় ইকুয়িনা। বি. কিউ. ২৩–৪৯। যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার দীর্ঘদিন গবেষণা করে এই ভাইরাসটি দাঁড়া করিয়েছিলেন ভাইরাসটিকে তার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। বিজ্ঞানী ইকুয়িনা কখনো কল্পনাও করেন নি এই ভাইরাসটি ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের বাইরে যেতে পারবে তা হলে তিনি নিশ্চয়ই কিছুতেই নিজের নামটি ব্যবহার করতে দিতেন না। কিন্তু এই ভাইরাসটি ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের বাইরে গিয়েছিল, কারো কোনো ভুলের জন্য নয়, কোনো দুর্ঘটনাতেও নয়–এটি বাইরে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর নির্দেশে। সময়টি ছিল পৃথিবীর জন্যে খুব অস্থির একটা সময়, পৃথিবীর দরিদ্র দেশ আর উন্নত দেশগুলোর মাঝে তখন এক ভালবাসাহীন নিষ্ঠুর সম্পর্ক। পারমাণবিক বোমা আর মারণাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয় না, এটি সবার কাছেই আছে, যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে–নতুন ধরনের একটা অস্ত্রের খুব প্রয়োজন, ঠিক তখন ইকুয়িনা ভাইরাসটি যুদ্ধবাজ জেনারেলদের চোখে পড়ে। যদিও তখনো এটি পৃথিবীর একটি মানুষেরও মৃত্যুর কারণ হয় নি কিন্তু সবাই জানত মানুষকে হত্য করার জন্যে এর চাইতে নিশ্চিত কোনো ভাইরাস পৃথিবীর বুকে কখনো সৃষ্টি হয় নি। কোনো জীবিত মানুষের ওপর এটি পরীক্ষা করে দেখা হয় নি তবুও বিজ্ঞানীরা এর ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার কথা জানতেন। সংক্রমণের প্রথম সপ্তাহে কিছু বোঝা যাবে না, দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথমে খুশখুশে কাশি এবং অল্প মাথাব্যথা দিয়ে শুরু হয়ে কয়েকদিনের ভেতরে তীব্র মাথাব্যথা এবং জ্বর শুরু হবে। ধীরে ধীরে সেটা মস্তিষ্কের প্রদাহে রূপ নেবে, সপ্তাহ শেষ হবার আগে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে এমনভাবে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যাবে যে দেখে মনে হবে মানুষটির পুরো দেহটি বুঝি একটি গলিত মাংসপিণ্ড। যে দেহ একটি মাত্র ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, প্রতি বিন্দু রক্ত তখন কোটি কোটি ইকুয়িনা ভাইরাসে কিলবিল করতে থাকবে। এই ভাইরাস বাতাসে ভর করে চোখের পলকে কয়েক শ কিলোমিটার ছড়িয়ে পড়তে পারে। কোনো ভাবে একটি ভাইরাসও যদি মানুষের শরীরে স্থান নিতে পারে সেই মানুষটির বেঁচে যাবার কোনো উপায় নেই। এর কোনো প্রতিষেধক নেই, এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই। আক্রান্ত মানুষটির মৃত্যু হবে যন্ত্রণাদায়ক এবং নিশ্চিত একেবারে এক শ ভাগ নিশ্চিত, এবং সেইটি ছিল সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়।
সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা করার চেষ্টা করলেন। তাঁরা ভাইরাসটির মাঝে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলেন যেন ভাইরাসটি সব মানুষের ওপরে কার্যকরী না হয়ে শুধুমাত্র বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে সংক্রমিত হয়–তা হলে যুদ্ধবাজ জেনারেলরা সেটাকে বিশেষ দেশের বিশেষ মানুষের ওপর ব্যবহার করতে পারবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবছিল, পরিবর্তিত ইকুয়িনা ভাইরাসটি ছিল তাদের সেই ভয়ংকর পৈশাচিক স্বপ্নের উত্তর। সেই পৈশাচিক গবেষণাটি সফল হয় নি সেটা কিন্তু সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞানীরা জানতেন না। গোপন একটা ফিল্ড টেস্ট করতে গিয়ে ইকুয়িনা ভাইরাসটি পৃথিবীতে মুক্ত হয়ে যায়। আফ্রিকায় একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের পুরো দ্বীপবাসী দুই সপ্তাহের মাঝে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার খবরটি পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল এবং সেই গোপনীয়তাটুকু ছিল পুরোপুরি অর্থহীন কারণ ততক্ষণে সারা পৃথিবীর সকল মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মৌসুমি বাতাসে ইকুয়িনা ভাইরাস ইউরোপ–এশিয়া হয়ে উত্তর আমেরিকায় এবং অস্ট্রেলিয়া হয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে যায়। পরবর্তী দুই সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পৃথিবীর বুকে যে ভয়াবহ আতঙ্কের জন্ম নিল তার কোনো তুলনা নেই, এই ভাইরাসের ভয়াবহ থাবা থেকে কোনো মুক্তি নেই সেটি সাধারণ মানুষ তখনো জানত না, বেঁচে থাকার জন্যে তাদের উন্মত্ত আকুলতা সেই ভয়াবহ দিনগুলোকে আরো। ভয়াবহ করে তুলল।
দুই মাসের মাঝে পৃথিবীর ছয় বিলিয়ন মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, বেঁচে রইল একেবারে হাতেগোনা কিছু শিশু এবং কিশোর। প্রকৃতির কোন রহস্যের কারণে এই হাতেগোনা অল্প কয়জন শিশু–কিশোর ইকুয়িনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে সেটি কেউ জানে না, সেই রহস্য খুঁজে বের করার মতো কোনো মানুষ তখন পৃথিবীতে একজনও বেঁচে নেই।
তারপর পৃথিবীতে আরো দুই শতাব্দী কেটে গিয়েছে। ইকুয়িনা ভাইরাসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সেই শিশু এবং কিশোরের বংশধরেরা পৃথিবীতে একটা নূতন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। পুরোনো পৃথিবী, তার জ্ঞান বিজ্ঞান–ইতিহাসের কোনো স্মৃতি কারো মাঝে নেই। পৃথিবীর নানা অংশে যাযাবরের মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মানুষেরা পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার মাঝে ঘুরে বেড়ায়। নানা ধরনের কুসংস্কার, কিছু সহজাত প্রবৃত্তি এবং বেঁচে থাকার একেবারে আদিম তাড়নার ওপর ভর করে মানুষগুলো বিচিত্র একটি পৃথিবীতে টিকে থাকার চেষ্টা করে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে তারা নিজের পরিবার নিজের গোষ্ঠীকে রক্ষা করে আবার প্রয়োজনে হিংস্র পশুর মতো অন্য গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। বড় বড় ট্রাকে করে তারা পৃথিবীর লোহিত মৃত্তিকায় ধূলি উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়, পৃথিবীর মানুষের হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার মাঝে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে বেড়ায়।
বেঁচে থাকার এক কঠিন প্রক্রিয়ায় তাদের সাহায্য করে তাদের নিজস্ব ঈশ্বর। কিংবা ঈশ্বরী।
১. প্রভু ক্লড
রিহান আধো ঘুমের মাঝে অনুভব করল কেউ একজন তার কাঁধে আলতোভাবে স্পর্শ করেছে। মুহূর্তের মাঝে রিহানের ঘুম ভেঙে যায়, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে ধরে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, কে?
মানুষটি নিচু গলায় বলল, আমি।
রিহান অস্ত্রটি নিচে নামিয়ে রেখে বলল, ও! তুমি? মানুষটি তাদেরই একজন, প্রতি রাতে সে পাহারার ডিউটি ভাগাভাগি করে দেয়। মাঝরাতে একবার ঘুরে ঘুরে দেখে সবাই ঠিকমতো তাদের ডিউটি করছে কি না। রিহান অপরাধীর মতো বলল, বসে থাকতে থাকতে চোখে ঘুম চলে এসেছিল।
মানুষটি উত্তর না দিয়ে নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করল।
রিহান বলল, আর হবে না, দেখে নিও।
মানুষটি আবার নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে বলল, চল।
রিহান ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায়?
গ্রাউসের কাছে।
গ্রাউস! রিহান চমকে উঠে বলল, গ্রাউসের কাছে কেন? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আর কখনো এরকম হবে না। আমি বসবই না–
আহ! মানুষটি হাত তুলে রিহানকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সেজন্য নয়। তুমি ডিউটিতে জেগে আছ না ঘুমিয়ে আছ সেটা নিয়ে গ্রাউস মাথা ঘামায়?
তা হলে কী জন্যে ডাকছে?
আমি কেমন করে বলব? মানুষটি হাত নেড়ে বলল, গ্রাউস আমাকে কখনো বলবে?
রিহান অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, মানুষটি ঠিকই বলেছে। গ্রাউস তাদের দলপতি, এতজন মানুষের দায়িত্ব তার ওপর। তাদের মতো ছোটখাটো মানুষের জন্য গ্রাউসের দেখা পাওয়াই একটি কঠিন ব্যাপার। তারপরও সে চেষ্টা করল, জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই জান না কেন ডেকেছে? আন্দাজও করতে পারবে না?
না। এখন এটা নিয়ে সময় নষ্ট কোরো না। তাড়াতাড়ি চল। গ্রাউস অপেক্ষা করছে।
রিহান ইতস্তত করে বলল, এখানে ডিউটি করবে কে?
মানুষটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, সে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমার কাছে অস্ত্রটা দিয়ে তুমি যাও, তাড়াতাড়ি।
রিহান অস্ত্রটি মানুষটির হাতে দিল, মানুষটি সেটা হাতে নিয়ে তার কপালে স্পর্শ করে তারপর ম্যাগাজিনে ঠোঁট স্পর্শ করে সম্মান প্রদর্শন করে। এটি দ্বিতীয় মাত্রার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই সম্মান প্রদর্শন করা যায়। লেজার গাইডেড স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো হাতে নিলে হাঁটু গেড়ে সম্মান দেখাতে হয়।
রিহান দুশ্চিন্তিত মুখে আবছা অন্ধকারে তাদের আস্তানার দিকে হাঁটতে থাকে। তাদের আস্তানায় সব মিলিয়ে সাতচল্লিশটি নানা আকারের ট্রাক আর লরি রয়েছে। কাটাতার দিয়ে ঘিরে তার ভেতরে ট্রাকগুলো গোল করে ঘিরে রাখা হয়েছে, হঠাৎ করে কোনো দল আক্রমণ করলে চট করে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। রিহান হেঁটে হেঁটে গ্রাউসের লরিটা খুঁজে বের করল, এটি তুলনামূলকভাবে বড়, ইঞ্জিনটি শক্তিশালী। রিহান পেছনের দরজায় শব্দ করতেই সেটা খুট করে খুলে গেল। ভেতরে হলুদ রঙের একটা অনুজ্জ্বল আলো জ্বলছে, গ্রাউস দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল, এস রিহান। ভিতরে এস।
রিহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের মুখের ভাবভঙ্গি লক্ষ করার চেষ্টা করল, মানুষটির মুখে বড় বড় দাড়ি–গোফ, চোখ দুটো স্থির এবং ভাবলেশহীন, দেখে মনের ভাব বোঝা যায় না।
রিহান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে ডেকেছ গ্রাউস?
হ্যাঁ। গ্রাউস আরো কিছু বলবে ভেবে রিহান অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু গ্রাউস কিছু বলল না, একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।
রিহান একটু ইতস্তত করে বলল, আমাকে কেন ডেকেছ?
তোমাকে দেখার জন্যে।
রিহান অবাক হয়ে বলল, আমাকে দেখার জন্যে?
হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম তুমি আরো বড়। কিন্তু তুমি তো দেখছি একেবারে বাচ্চা ছেলে।
রিহান জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, না মহামান্য গ্রাউস, আমি মোটেও বাচ্চা ছেলে নই। গত শীতে আমার বয়স সতের হয়েছে। আমি এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালাতে অনুমতি পেয়েছি। রিকি বলেছে আমাকে একটা মোটরবাইক দেবে। আট সিলিন্ডারের।
গ্রাউস কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথাগুলো শুনেছে কি না রিহান ঠিক বুঝতে পারল না। কী কারণ জানা নেই, রিহান হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে, চাপা এক ধরনের ভয় হঠাৎ তার ভেতরে দানা। বাধতে শুরু করে। গ্রাউস আবার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, রিহান।
বলো, গ্রাউস।
তুমি কী করেছ?
আমি? রিহান চমকে উঠে বলল, আমি কী করব?
কিছু কর নি?
রিহান দ্রুত চিন্তা করতে থাকে, সে কি অস্বাভাবিক বা অন্যায় কিছু করেছে? তেরো নম্বর লরিটির হাসিখুশি কিশোরী মেয়েটির সাথে একটু ঠাট্টা-মশকরা করেছে, লরির দেয়ালে চেপে ধরে একটু চুমু খাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এই বয়সের ছেলেমেয়েরা তো সেটা করেই। থাকে, সেটা তো এমন কিছু বড় অন্যায় নয়। মেয়েটা রাগ হবার ভান করেছে কিন্তু আসলে তো রাগ হয় নি, একটু পরেই তো লরির উপর থেকে তার মাথায় আধ বোতল গ্যাসোলিন। ঢেলে হি হি করে হেসেছে।
মনে করতে পারছ না?
গ্রাউসের কথায় চমকে উঠে রিহান বলল, না গ্রাউস। আমি তো কিছুই মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস কর
গ্রাউস হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে তীব্র গলায় বলল, তা হলে কেন প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করতে চাইছেন?
রিহান আতঙ্কে শিউরে উঠে গ্রাউসের দিকে তাকাল, কথাটি শুনেও যেন বুঝতে পারছে, কিংবা বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, প্রভু ক্লড আ–আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন?
হ্যাঁ।
আ–আমার সাথে?
হ্যাঁ। তোমার সাথে। গ্রাউস শীতল গলায় বলল, এখন বলো, কেন?
রিহানের হঠাৎ মনে হতে থাকে তার হাঁটুতে কোনো জোর নেই। এর আগে যারা প্রভু ক্লডের সাথে দেখা করতে গিয়েছে এবং কখনো ফিরে আসে নি হঠাৎ করে তাদের কথা মনে পড়ে যায়। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে কোনোমতে দুই পা পিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ করে তার মনে হতে থাকে কেউ বুঝি তার সারা শরীরের শক্তি শুষে নিয়েছে। সে কাঁপা গলায় বলল, বিশ্বাস কর গ্রাউস, আমি কিছু করি নি
গ্রাউস কিছুক্ষণ রিহানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, তাই যেন সত্যি হয় রিহান।
রিহান এক ধরনের কাতর গলায় বলল, আমি এখন কী করব গ্রাউস?
গ্রাউস জোর করে একবার হাসার চেষ্টা করে বলল, প্রভু ক্লড তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ কী করবে? তুমি এক্ষুনি দেখা করতে যাও। প্রভু ক্লড তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
কেমন করে যাব গ্রাউস?
আর্মাড কারের লাল দরজার সাসনে গিয়ে দাঁড়াও, ভেতর থেকে এসে তোমাকে ডেকে নেবে।
রিহান তবুও দেয়াল স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে রইল। গ্রাউস কঠিন গলায় বলল, যাও রিহান। দেরি কোরো না।
রিহান অনেক কষ্ট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর ঘুরে লরির দরজা খুলে বের হয়ে এল। পাটাতন থেকে নিচে নেমে এসে সে তাদের আস্তানার মাঝখানে তাকায়, ছয়টি আর্মাড কার বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে, তার ভেতরে প্রভু ক্লডের নিজস্ব আর, ভি,, বাইরে থেকে কখনো সেটা দেখা যায় না। রিহান অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকায়, এই এলাকাটি মরুভূমির মতো, রাত্রিবেলা আকাশটি একেবারে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ঝকঝক করতে থাকে। আকাশের অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে, প্রতিদিন দেখার পরও নক্ষত্রগুলোকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। মরুভূমির শুকনো হাওয়া বইছে, বাতাসের শব্দটি কেমন যেন হাহাকারের মতো শোনায়, কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে রিহানের বুকের ভেতর বিচিত্র এক ধরনের শূন্যতা এসে ভর করে। রিহান কয়েক মুহূর্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, মরুভূমির শীতল বাতাসের জন্যেই কিনা কে জানে হঠাৎ তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বুকের ভেতরে আটকে থাকা চাপা একটা নিশ্বাসকে বের করে দিয়ে রিহান সামনে এগিয়ে যায়। বড় আর্মাড কারের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে তার নিজেকে বড় অসহায় মনে হতে থাকে। সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, রাতের অন্ধকারে বড় বড় লরি এবং ট্রাকগুলোকে অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো মনে হয়। চারদিকে জমাট–বাধা অন্ধকার এবং নিঃশব্দ, শুধুমাত্র পাওয়ার স্টেশন থেকে চাপা গুঞ্জনের মতো একটা শব্দ আসছে। রিহানের মনে হতে থাকে বড় বড় লরির জানালা দিয়ে অন্ধকারকে আড়াল করে সবাই তার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে, সবার চোখে আতঙ্ক। হঠাৎ তার ইচ্ছে হতে থাকে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু তার সাহস হয় না। সে স্থাণুর মতো আর্মাড কারের লাল দরজার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।
রিহান কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না, হঠাৎ খুট করে দরজাটা খুলে গেল, ভেতরে আবছা অন্ধকার তার মাঝে রিহান শুনতে পেল নারী কন্ঠে কেউ তাকে চাপা গলায় ডাকল, ভেতরে এস।
রিহান সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসতেই কাচক্যাচ শব্দ করে পিছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। রিহান ভিতরে তাকাল, আসবাবপত্রহীন একটি ধাতব কন্টেইনার। কন্টেইনারের ঠিক মাঝখানে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটির পোশাক খুব সংক্ষিপ্ত এবং সেই পোশাকের ভেতর দিয়ে তার সুগঠিত শরীর দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির ধাতব রঙের চুলগুলো বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। মেয়েটির চোখের পাতায় নীল রঙ, ঠোঁট দুটো টকটকে লাল। যে কোনো হিসেবে মেয়েটি সুন্দরী কিন্তু চেহারায় কোনো এক ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে সেটি কী রিহান ঠিক ধরতে পারল না। মেয়েটির বুকের উপরে বুলেটের একটি বেল্ট, ডান হাতে তৃতীয় মাত্রার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আলগোছে ধরে রাখা। মেয়েটি শুকনো এক ধরনের খসখসে গলায় বলল, রিহান, তুমি দুই হাত পাশে ছড়িয়ে রেখে এক পা এগিয়ে এস।
গলার স্বর শুরে রিহান হঠাৎ করে মেয়েটিকে চিনতে পারল, মেয়েটি দৃনা, ছয় নম্বর লরিতে থাকত, আজ থেকে চার বছর আগে হঠাৎ করে একদিন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কী আশ্চর্য! দৃনা এখানে? প্রভু ক্লডের কাছে? রিহান চাপা গলায় বলল, দৃনা! তুমি এখানে? আমরা ভেবেছিলাম
দৃনা রিহানকে বাধা দিয়ে যান্ত্রিক গলায় বলল, দুই হাত পাশে ছড়িয়ে এগিয়ে এস।
রিহান থতমত খেয়ে থেমে গিয়ে হতচকিত ভাবে দৃনার দিকে তাকাল, ভাবলেশহীন এক ধরনের মুখ, সেখানে অনুভূতির কোনো চিহ্ন নেই। রিহান একটা নিশ্বাস ফেলে দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে দিয়ে এক পা এগিয়ে আসে। দৃনা দক্ষ মানুষের মতো রিহানের শরীর সার্চ করে, নির্বিকারভাবে তার জম্মদেশ, বুকে, পিঠে হাত দিয়ে দেখে সামনে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে বলল, আমার সাথে এস।
রিহান হাঁটতে থাকে। সামনে আর্মাড কারের দরজা খুলে রিহান বের হয়ে আসতেই প্রভু ক্লডের বিশাল আর. ভি. টি দেখতে পেল। জানালায় হালকা নীল আলো জ্বলছে, উপরে কয়েকটি বিচিত্র ধরনের এন্টেনা, দেখে মনে হয় কোনো ধরনের স্থাপত্যকর্ম। দৃনা নিচু গলায় বলল, যাও।
রিহান কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
সামনে গেলেই দরজা দেখতে পাবে। দরজা খুলে ঢুকে যাও। দৃনা একমুহূর্ত থেমে বলল, আর শোন, কখনোই সরাসরি প্রভু ক্লডের চোখের দিকে তাকাবে না।
রিহান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে, তাকাব না।
প্রভু তোমাকে অনুমতি দিলেই শুধু কথা বলবে, নিজে থেকে একটি কথাও বলবে না।
বলব না।
মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন করবে।
ঠিক আছে দৃনা।
বের হবার সময় কখনো প্রভুর দিকে পিছন দেবে না।
দেব না।
মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে না।
রিহান মাথা নেড়ে বলল, দাঁড়াব না।
হে প্রভু ক্লড, হে ঈশ্বর-পুত্র বলে তাকে সম্বোধন করবে।
ঠিক আছে দৃনা।
যাও। এবার ভেতরে যাও।
রিহান একমুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, তুমি কি জান প্রভু ক্লড আমাকে কেন ডেকেছেন?
দৃনা বলল, না, জানি না।
রিহান কাতর গলায় বলল, না, আমার খুব ভয় করছে। তুমি কি আমার জন্যে বাইরে অপেক্ষা করবে?
দৃনা তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, যাও। ভেতরে যাও।
রিহান একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর সাহস সঞ্চয় করে বিশাল আর. ডি. টির দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে একটু উপরে একটি দরজা। দরজাটি বন্ধ, হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই দরজাটি খুলে গেল। ভেতরে হালকা নীল রঙের একটা আলো জ্বলছে। রিহান নিশ্বাস নিতেই ক্ষীণ বাসি ফুলের মতো এক ধরনের গন্ধ পেল। রিহানের বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করছে, তার ভেতর কোনোভাবে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দৃনা তাকে মাথা তুলে তাকাতে নিষেধ করেছে, সে মাথা তুলে তাকাল না। লাল নরম কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে সে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আর, ভি.য়ের অন্যপাশে হঠাৎ কাপড়ের এক ধরনের খসখসে শব্দ শুনতে পায়–রিহান মাথা উঁচু করে সেদিকে তাকাতে সাহস পেল না, মাথা নিচু করে অভিবাদন করল।
রিহান শুনল প্রভু ক্লড বললেন, আমার দিকে তাকাও, ছেলে তোমার চেহারাটা দেখি।
ভারী ভরাট গলা, ঘরে তার কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল। দৃনা সোজাসুজি প্রভু ক্লডের দিকে তাকাতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু রিহান প্রভু ক্লডের আদেশ অমান্য করতে সাহস পেল না। রিহান মাথা তুলে ক্লডের দিকে তাকাল, দুজন প্রথমবারের মতো দুজনকে দেখতে পেল।
প্রভু ক্লডের মাথায় ধবধবে সাদা চুল এবং দাড়ি, পরনে লম্বা সাদা আলখাল্লা। মুখে বয়সের বলিরেখা, চোখ দুটো আশ্চর্য রকম নীল। তার চোখের দৃষ্টি এত তীব্র যে রিহান বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না, সে চোখ নামিয়ে নিল।
প্রভু ক্লড জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে, তোমাকে আমি কেন ডেকেছি জান?
রিহান মাথা নাড়ল, বলল, না, প্রভু ক্লড, আমি জানি না।
তুমি অনুমান করতে পার?
পারি না প্রভু ক্লড। আমি অনুমান করতে পারি না।
প্রভু ক্লড কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ শীতল গলায় বললেন, গত পরশু দিন তুমি পাওয়ার স্টেশনে কী করেছিলে?
রিহানের হঠাৎ বুক কেঁপে উঠল, সে আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠে বলল, প্রভু ক্লড, ঈশ্বরপুত্র, আমার ভুল হয়েছিল। আমার খুব বড় ভুল হয়েছিল।
প্রভু কুড হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ভুল না শুদ্ধ আমি তোমার কাছে সেটি জানতে চাইছি না ছেলে–আমি জানতে চেয়েছি সেখানে কী হয়েছিল।
আপনি সব জানেন প্রভু।
তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
রিহান তবু চুপ করে রইল, তখন প্রভু ক্লড কঠিন গলায় বললেন, বলো।
রিহান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, পাওয়ার স্টেশনের সামনে আমার ডিউটি পড়েছিল প্রভু ক্লড, হঠাৎ সেটা অদ্ভুত এক রকম শব্দ করতে লাগল। কয়েকটা যন্ত্র থেমে কেমন যেন সংকেতের মতো শব্দ বের হতে লাগল। তখন– রিহান কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায়।
বলো ছেলে। তখন কী হল?
আমি তখন পাওয়ার স্টেশনের কাছে গেলাম।
একটি নবম মাত্রার যন্ত্রের কাছে তুমি অনুমতি না নিয়ে গেলে? অপবিত্রভাবে গেলে? সম্মান প্রদর্শন না করে গেলে?
রিহান কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভু ক্লড শীতল গলায় বললেন, তারপর কী হল?
আমি আমি পাওয়ার স্টেশনটি পরীক্ষা করে দেখলাম। দেখলাম একটা পানির টিউব ফেটে গেছে, পানি যাচ্ছে না। স্টেশনটি গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি তখন– রিহান আবার চুপ করে যায়।
তখন? তখন কী?
রিহান মাথা তুলে কাতর গলায় বলল, আমাকে ক্ষমা করুন। প্রভু ক্লড–ক্ষমা করুন।
প্রভু ক্লড কঠিন গলায় বললেন, তখন কী?
রিহান ভাঙা গলায় বলল, তখন আমি পানির পাইপটা পাল্টে দিয়েছি।
কী দিয়ে পাল্টে দিয়েছ?
পুরোনো ট্রাকে সেরকম একটা পাইপ ছিল, সেটা খুলে।
তুমি কী দিয়ে খুলেছ?
আমার কাছে একটা প্লায়ার্স ছিল।
তুমি কোথায় পেয়েছ প্লায়ার্স?
রিহান পুরোপুরি ভেঙে গিয়ে বলল, যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে চুরি করেছি প্রভু ক্লড।
কেন চুরি করেছ?
আমার–আমার
তোমার কী?
আমার যন্ত্রপাতি দিয়ে খেলতে ভালো লাগে প্রভু ক্লড। যন্ত্র কেমন করে কাজ করে আমার জানতে ইচ্ছে করে, বুঝতে ইচ্ছে করে– কথা বলতে বলতে রিহানের গলা ভেঙে গেল। সে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে যায়, দুই হাত জোড় করে অনুনয় করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু ক্লড। হে ঈশ্বরপুত্র হে করুণাময়
প্রভু ক্লড নরম গলায় বললেন, রিহান–
গলার স্বর শুনে রিহান চমকে উঠে আশান্বিত চোখে প্রভু ক্লডের দিকে তাকাল, বলুন প্রভু।
তুমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালাতে পার?
পারি। রিহান গলার স্বরে খানিকটা উৎসাহ ঢেলে বলল, আমার বয়স সতের হবার পর আমাকে শেখানো হয়েছে। আমি রাত্রিবেলা ডিউটি করি মহামান্য প্রভু ক্লড।
তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির কী হয়েছিল?
রিহানের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে যায়, তার সারা শরীর আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। সে মাথা নিচু করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু ক্লড।
কী হয়েছিল তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের?
সেটি জ্যাম হয়ে গিয়েছিল।
অস্ত্র জ্যাম হয়ে গেলে কী করতে হয়?
তাকে সম্মানের সাথে অস্ত্রাগারে ফেরত দিয়ে নূতন অস্ত্র নিতে হয়।
আর, তুমি কী করেছিলে?
রিহান একমুহূর্তের জন্যে মাথা উঁচু করে আবার মাথা নিচু করে বলল, আমি অস্ত্রটি ঠিক করেছিলাম প্রভু ক্লড।
কীভাবে ঠিক করেছিলে?
আমি সেটা খুলেছিলাম। খুলে পরিষ্কার করেছিলাম। যেখানে যেখানে জং ধরেছিল সেখানে গ্রিজ লাগিয়েছিলাম।
তখন সেটি ঠিক হয়েছিল?
হয়েছিল প্রভু ক্লড।
প্রভু ক্লড কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলে, তোমার অস্ত্রটি জ্যাম হয়েছিল কেন?
রিহান কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইল। প্রভু ক্লড শান্ত গলায় বললেন, আমার কথার উত্তর দাও ছেলে।
আমি অস্ত্রটিতে পানি ঢেলেছিলাম।
কেন পানি ঢেলেছিলে?
কী হয় দেখার জন্যে। অস্ত্রে কীভাবে জং ধরে বোঝার জন্যে।
বুঝে কী হবে?
ভবিষ্যতে অস্ত্রগুলো রক্ষা করা যাবে।
তুমি কী বুঝেছ?
রিহান কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইল। প্রভু ক্লড জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আর কী কী করেছ রিহান?
আপনি সব জানেন। আপনি প্রভু ক্লড। আপনি ঈশ্বরপুত্র ঈশ্বর। আপনি সর্বজ্ঞ। আপনি মহাশক্তিমান।
তবুও আমি তোমার মুখেই শুনতে চাই ছেলে। বলো।
রিহান কাঁপা গলায় বলল, আমি বুলেট ভেঙে দেখেছি তার ভিতরে কী আছে।
কী আছে?
কালো রঙের এক ধরনের পাউডার।
কী হয় সেই পাউডার দিয়ে?
আগুন জ্বালালে বিস্ফোরণ হয়।
সেই পরীক্ষা করতে গিয়ে তোমার কী হয়েছিল?
রিহান নিচু গলায় বলল, আপনি সর্বজ্ঞ। আপনি জানেন। আমার হাত পুড়ে গিয়েছিল।
তুমি চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলে?
না মহামান্য প্রভু।
কেন যাও নি?
আমি ভয় পেয়েছিলাম।
রিহান হাঁটু ভেঙে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, প্রভু ক্লড হেঁটে তার খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ সময় কেউ কোনো কথা বলল না। একসময় প্রভু ক্লড একটি নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বললেন, ছেলে, তুমি কি জান এই পৃথিবীতে কী হয়েছিল?
রিহান মাথা নাড়াল, বলল, না প্রভু। আমি জানি না।
এই পৃথিবীতে একসময় ছয় বিলিয়ন মানুষ ছিল।
রিহান মাথা তুলে বিস্তারিত চোখে প্রভু ক্লডের দিকে তাকাল, বলল, ছয় বিলিয়ন?
হ্যাঁ। একদিন তারা সব মরে গিয়েছিল। কেন জান?
জানি না প্রভু ক্লড।
প্রভু ক্লড তীব্র স্বরে বললেন, তোমার মতো মানুষের জন্যে। তাদের কৌতূহলের জন্যে। প্রভু ক্লড কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মানুষের সেই সভ্যতা শেষ হয়ে গেছে ছেলে। এখন পৃথিবীতে নূতন সভ্যতার জন্ম হয়েছে। এই সভ্যতায় কৌতূহলের কোনো স্থান নেই।
আমার ভুল হয়েছে প্রভু।
এই সভ্যতায় মানুষকে রক্ষা করার জন্যে আমরা আমাদের জীবনকে উৎসর্গ করেছি।
আমরা জানি প্রভু। আমরা সে জন্যে কৃতজ্ঞ।
আমরা তোমাদের প্রভু হয়েছি। তোমাদের ঈশ্বর হয়েছি। তোমাদের সাহায্য করার জন্যে আমরা সর্বজ্ঞ হয়েছি।
আপনাদের দয়া। আপনাদের মহানুভবতা।
আমি প্রভু ক্লড হয়ে তোমাদের প্রায় অর্ধশতাব্দী থেকে রক্ষা করে আসছি। এই সুদীর্ঘ সময়ে কেউ আমার আশাভঙ্গ করে নি। ঠিক যেভাবে চেয়েছি সেভাবে চলে এসেছে। তুমি–
রিহানের সারা শরীর হঠাৎ আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠল। প্রভু কুডের গলায় হঠাৎ এক আশ্চর্য কাঠিন্য এসে ভর করে, তুমি প্রথমবার আমাকে নিরাশ করেছ। তুমি নিউক্লিয়ার রি–একটরের কুলিং নিয়ে খেলা করেছ। তুমি জান নিউক্লিয়ার রি–একটর কী? তুমি জান রেডিয়েশান কী? তুমি জান কোর মেন্টডাউন কী? জান না–কিন্তু তার পরও তুমি সেখানে হাত দিয়েছ! নির্বোধ ছেলে প্রচণ্ড রেডিয়েশানে আমরা সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারতাম!
রিহান কোনো কথা বলল না, মাথা নিচু করে হাঁটু ভেঙে বসে রইল। প্রভু ক্লড আবার বললেন, তুমি বারুদের মাঝে আগুন দিয়েছ। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নষ্ট করেছ? সেটা খুলে ফেলেছ! তুমি জান এর অর্থ কী?
রিহান মাথা নাড়ল, বলল, জানি না প্রভু। আমি মূর্খ। আমি নির্বোধ। আমি তুচ্ছ–
এর অর্থ তুমি অনেক কষ্ট করে তৈরি করা আমাদের এই পদ্ধতিটি অস্বীকার করেছ।
রিহান মাথা নেড়ে বলল, না প্রভু না। আমি অস্বীকার করতে চাই নি। আমার ভুল হয়েছে। আমার অনেক বড় ভুল হয়েছে।
প্রভু ক্লড একটা নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ কোমল গলায় বললেন, তুমি কেন এটা করেছ ছেলে? তুমি কেন এই নিয়ম ভেঙেছ?
রিহান প্রভু ক্লডের গলায় কোমল স্নেহের আভাস পেয়ে প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, আমার মনে হয়েছিল
কী মনে হয়েছিল?
এই যন্ত্র তো মানুষ তৈরি করেছে। মানুষের তৈরি যন্ত্রকে কেন আমাদের উপাসনা করতে হবে? আমরা কেন যন্ত্রকে বুঝতে চেষ্টা করব না?
তোমার তাই মনে হয়েছিল?
জি মহামান্য ঈশ্বরপুত্র। আমার কাছে মনে হয়েছিল এই নিয়মটি একটি বাহুল্য। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি যন্ত্রের উপাসনা করা না হলেও সেগুলি কাজ করে।
তুমি সেটি পরীক্ষা করেছ?
জি মহামান্য প্রভু ক্লড।
প্রভু ক্লড বললেন, তুমি জান তুমি একটি খুব বড় অপরাধ করেছ। যে প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে আমাদের পুরো সভ্যতাটি গড়ে উঠেছে তুমি সেই প্রক্রিয়াটিকে অবিশ্বাস করেছ। অসম্মান করেছ।
রিহান কাতর গলায় বলল, আমি বুঝতে পারিনি, মহামান্য প্রভু।
যে যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, তুমি সেই যন্ত্রকে অসম্মান করেছ।
আমার ভুল হয়েছে। রিহান মাথা নিচু করে বলল, আপনি আমাকে শাস্তি দিন।
প্রভু ক্লড কয়েক মুহূর্ত রিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী শাস্তি চাও?
আপনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি সেই শাস্তি মাথা পেতে নেব।
প্রভু ক্লড একটি নিশ্বাস ফেলে কঠোর গলায় বললেন, আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম।
রিহান ভয়ংকর আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে ওঠে। দুই হাত জোড় করে কাতর গলায় বলল, না, প্রভু না। আমাকে অন্য কোনো শাস্তি দিন। আমাকে বেঁচে থাকতে দিন। একটিবার মাত্র একটিবার সুযোগ দিন
প্রভু ক্লড স্থির দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রিহান মাথা নিচু করে ভাঙা গলায় বলল, আমায় ক্ষমা করুন প্রভু। ক্ষমা করুন। আমি ভুল করেছি, আর আমি ভুল করব না। আমাকে মাত্র একটিবার সুযোগ দিন
রিহান মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই। প্রভু ক্লড ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রিহান পাগলের মতো উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় হাহাকার করে বলল, প্রভু ক্লড! প্রভু—প্রভু–
হঠাৎ করে রিহান অনুভব করে তার দুইপাশ থেকে দুজন তাকে শক্ত করে ধরেছে। রিহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, মুখে রঙ মাখা দুজন মেয়ে। ধাতব রঙের চুলগুলো মাথার উপরে চুড়োর মতো করে বাঁধা। মেয়ে দুটো আলগোছে একটা করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখেছে।
রিহান উন্মাদের মতো ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, কিন্তু পারল না। ঠিক তখন কে জানি তার মাথায় পিছন থেকে আঘাত করে।
চোখের সামনে তার সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। গভীর বিষাদে তার হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। এই কি তা হলে মৃত্যু?