দি মার্ডার ইন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি
প্রথম পর্ব : ঘটনাপ্রবাহ
০১.
টরাস এক্সপ্রেসে একজন বিশিষ্ট আগন্তুক
সবেমাত্র ভোর পাঁচটা শীতের সকাল সিরিয়ায়। ঘুমের আমেজই কাটেনি ভালো করে। টরাস এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আলেপ্লার প্ল্যাটফর্মের ধারে। তাতে রাজকীয় বন্দোবস্ত রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার জন্য। রান্নার ব্যবস্থা, খাবার জায়গা, শোয়ার জন্য বগি-কামরা আর দুটো কোচ।
ফরাসী সেনাবাহিনীর একজন লেফটন্যান্ট দাঁড়িয়ে ঠিক শোয়ার কামরার দরজার মুখে। একজন ছোটখাটো গুফেঁ মানুষেরর সঙ্গে ব্যস্তভাবে কথা বলছেন। শুধু গোলাপী নাকের ডগাটুকু ছাড়া মানুষের আপাদমস্তক গরম জামাকাপড়ে ঢাকা।
হাত পা যেন জমে যায়। আঃ, কি ঠান্ডা! যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বেরোতে আপত্তি জানাতে পারে কিন্তু নিজের কর্তব্য পালনে অতিমাত্রায় সচেতন ও তৎপর লেফটন্যান্ট দুবো। তিনি ব্যস্ত ছিলেন অতিথিটির মনোরঞ্জনে মার্জিত ফরাসীভাষায়। কি যেন এক অজ্ঞাত কারণে জেনারেল সাহেব তার উপরওয়ালা দুবো তা জানেন। এই বেলজিয়ান ভদ্রলোককে তলব পাঠান আতঙ্কিত হয়ে। একজন হোমরাচোমড়া অফিসার আশ্চর্যজনক ভাবে মাত্র সাতদিন পরেই আত্মহত্যা করেন। আর একজন পদত্যাগ করেন। কি যেন এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে সামরিক পরিস্থিতি একেবারে ঠান্ডা হয়ে যায়। অমন ছুঁদে জেনারেলেরর মুখেও হাসি ফুটে ওঠে–আহা দশবছর আয়ু যেন কমে গেছে।
সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ছুটে আসা জেনারেল এই বেলজিয়ান ভদ্রলোকটিকে বলছেন, আপনি আমাদের বাঁচিয়েছেন বন্ধু, ফরাসী সেনাবাহিনীর মান রেখেছেন, আপনি রক্তপাত বন্ধ করেছেন অযথা। সব কাজ ফেলে আপনি যে আমাদের অনুরোধ রাখতে এগিয়ে আসবেন আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল এই সৌভাগ্য। আপনি এত কষ্ট করে…। দুবোর কানে এসেছিল।
বেলজিয়ান ভদ্রলোকটি হাত পা নেড়ে তার কথা থামিয়ে দিয়ে (নাম এরকুল পোয়ারো) বললেন, একি বলছেন, ছি ছি, একসময় আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছিলেন। আমার কি মনে নেই।
খানিকক্ষণ কথার মারপ্যাঁচে তারপর পরস্পরে মনোরঞ্জন চলল। অবশেষে জেনারেল পোয়ারোকে গাঢ় আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন।
প্রকৃত ঘটনাটা কি লেফটেন্যান্ট দুবো অবশ্য জানেন না। এই সম্মানিত অতিথিকে ট্রেন ছাড়বার আগে পর্যন্ত তার উপর দায়িত্ব দেওয়া আছে রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর বলা যায় না তো, হয়তো কর্তৃপক্ষ খুশী হয়ে প্রমোশনই দিয়ে দিল।
আজ হল রোববার, দুবো বললেন, কাল সোমবার আপনি ইস্তাম্বুলে সন্ধ্যায় পৌঁছে যাবেন (দূর ছাই কথাবার্তা চালানোই দায়। কতক্ষণ আর শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঐ আধবুড়ো গুফে লোকটার সাথে বকবক করা যায়। তাই তো মনে হয়, মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন। কটা দিন নিশ্চয়ই থাকবেন?
ইস্তাম্বুলে যাইনি কখনও। ইচ্ছে তো আছে–শহরটা একটু ঘুরে দেখব ভাবছি।
খুব সুন্দর শুনেছি আমি এখনও দেখিনি অবশ্য। ঠান্ডা কনকনে বাতাস বয়ে গেল এক ঝলক প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে, দুজনেই কেঁপে উঠলেন। লেফটেন্যান্ট দুবো ঘড়ি দেখলেন আর পাঁচ মিনিট বাকি আছে পাঁচটা বাজতে।
নেহাত দায়ে না পড়লে তোক বেরোয় না। বছরের এই সময়টা এত ঠান্ডা থাকে বুঝলেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
যা বলেছেন।
বরফ পড়া শুরু হবে না আশা করি।
এই সময়টা হয় নাকি?
তবে এ বছরে এখনো হয়নি, সাধারণত এই সময়ে হয়। ইউরোপের অবস্থা তো বেশ খাবপি শুনেছি। তাহলে বাবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই যেন বরফ পড়া শুরু হয়, অন্ততঃ দপ্তর থেকে যা খবর পাঠাচ্ছে তাতে সেইরকমই মনে হয়। বলকান অঞ্চলে তো যথেষ্ট বরফ পড়ছে।
হা ওখানে অবস্থা খুবই খারাপ। একই অবস্থা জার্মানীতেও শুনলাম।
আপনি কনস্তান্তিনোপোলে মনে হয় সন্ধ্যে সাতটা চল্লিশ আন্দাজ আশা করি পৌঁছে যাবেন।
যা বলেছেন, হ্যাঁ দারুণ জায়গা শুনেছি।
অপূর্ব।
ট্রেনের স্লিপার কামরার একটা জানালা খুলে গেল ঠিক মাথার উপর। মাথা নাড়ালেন একজন তরুণী।
মেরী ডেবেনহ্যাম বাগদাদ ছেড়েছেন গত বৃহস্পতিবার। তারপর থেকে একটু ভালো করে ঘুমাতে পারেননি, কি হোটেলে কি ট্রেনে। জানালা খুলতে বাধ্য হলেন মেরী। ওঃ ট্রেনের ভেতরটা কি গরম।
কোনো স্টেশন এটা! আলেপ্পা নিশ্চয়ই। অবশ্য দেখবার কি-ই বা আছে? সারি সারি টিমটিমে বাতি জ্বলছে। লম্বাটে প্ল্যাটফর্ম, দুজন লোক ফরাসী ভাষায় কথা বলছে জানালার ঠিক নিচেই। একজন লোক তো ফরাসী সেনাবাহিনীর অন্যজন ছোটখাট গোঁফওয়ালা। কি কাণ্ড! আপনমনেই হাসলেন মেরী যত রাজ্যের গরম জামাকাপড় গায়ে চাপিয়েছেন আধ বুড়ো ছোট্ট ভদ্রলোকটি। বাইরে হয়তো দারুণ ঠান্ডা কে জানে, ইস জানালাটা আর একটু নামিয়ে দিতে পারলে ভালো হত।
ট্রেন ছাড়বার সময় হয়েছে, কণ্ডাক্টর গার্ড দুবোর দিকে এগিয়ে এল। টুপি খুললেন ছোটখাটো মানুষটি, এবার উঠে পড়ার দরকার। এমা কেমন ডিমের মতো মাথা। হেসে উঠলেন মেরী ডেবেনহ্যাম। কি অদ্ভুত দেখতে ভদ্রলোককে। দেখলেই মজা করতে ইচ্ছে করে।
বিদায় ভাষণটা আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন লেফটেন্যান্ট দুবো। পরিষ্কার মার্জিত ভাষায় শেষ মুহূর্তের স্তুতি শুরু করলেন। যথেষ্ট বিনয়ীও মঁসিয়ে পোয়ারো।
গাড়ি ছাড়বার সময় হয়েছে মঁসিয়ে, কন্ডাক্টর বলল। পোয়ারো গাড়িতে উঠলেন অনিচ্ছুক পায়ে তার পিছু পিছু কণ্ডাক্টর। লেফটেন্যান্ট দুবো লম্বা স্যালুট ঠুকলেন। হাত নাড়লেন মঁসিয়ে পোয়ারো, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটি চলতে শুরু করল।
কণ্ডাক্টর তার স্লিপার কোচ দেখাচ্ছিল পোয়ারোকে। এই যে, আপনার ব্যাগটা এখানে রাখলাম, দেখুন মঁসিয়ে কেমন চমৎকার ব্যবস্থা।
বকশিশ দিলেন কণ্ডাক্টর গার্ডকে এরকূল পোয়ারো। আপনি বোধহয় ইস্তাম্বুলে যাবেন? আপনার পাসপোর্ট আর টিকিট আমার কাছেই থাকবে ধন্যবাদ স্যার।
বেশি লোক তো যাচ্ছে না, না?
হা। না। ওখানে নামবেন দুজনেই ইংরেজ। ভারতবর্ষ থেকে এসেছেন একজন-কর্নেল বাগদাদ থেকে আসছেন আর একজন তরুণী। আর কিছু কি লাগবে আপনার?
এক বোতল পেরিয়ার চাইলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। সূর্য উঠতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক দেরি এই ভোর পাঁচটায় ট্রেনে উঠা বিরক্তিকর। কটা দিন যা খাটুনি গেছে এই যা ভালো। যাক শেষ রক্ষা হয়েছে। গুটি সুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
তার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেলা সাড়ে নটা। তড়িঘড়ি গরম কফি খেতে তিনি পা বাড়ালেন কিচেন কোচের দিকে।
সেই সময় সেখানে একজন মাত্র উপস্থিত, অবশ্যই কন্ডাক্টর বর্ণিত ইংরেজ তরুণী। লম্বা, রোগা, তামাটে গায়ের রঙ আঠাশ-বছর বয়স। আত্মবিশ্বাস বোধও প্রবল, খুব চালাক চতুর আর চটপটে। অন্তত নিপুণভাবে খাওয়ার ধরন দেখে সেটাই মনে হয়। কফির জন্য কণ্ডাক্টরকে যেভাবে আদেশ করলেন, তাতে মনে হয় তরুণীটির ভ্রমণের অভ্যেস আছে। বেশ গরম ট্রেনের ভেতরটা, সেইমতো পাতলা সূতির জামা পরেছেন।
কোনো কাজ নেই পোয়ারোর হাতে, কাজেই তিনি তরুণীর প্রতি মনোনিবেশ করলেন। এই যুবতীটি সেই ধরনের যারা সবরকম অবস্থায় নিজেদের বাঁচিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। নরম ধূসর রঙের চোখ। কালো কুচকুচে ঢেউ খেলানো চুল, গায়ের চামড়া নরম মসৃণ। এক কথায় যথেষ্ট আকর্ষণীয়া। তাঁর নিঃশব্দ পর্যবেক্ষণ শুরু হল।
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বয়স একজন আগন্তুকের প্রবেশ ঘটল তার খানিকপর। সুগঠিত মেদহীন তামাটে চেহারা।
পোয়ারো স্বগোক্তি করলেন এই সেই কর্নেল। আগন্তুক তরুণীর দিকে ইষৎ ঝুঁকে অভিবাদন জানালেন।
সুপ্রভাত নিন ডেবেনহ্যাম।
সুপ্রভাত কর্নেল আবাথনট।
আপনার টেবিলে বসতে পারি?
নিশ্চয়ই। বসুন।
অসুবিধা নেই তো কোনো?
কিছুমাত্র না।
পোয়ারোর দিকেও একবার তাকালেন তিনি। বেয়ারাকে হাতের ভঙ্গিতে ডেকে ডিম আর কফির অর্ডার দিলেন কর্নেল আবাথনট। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি কর্নেল ভাবছে ব্যাটা ভিনদেশী উড়ে এসে জুড়ে বসেছে পোয়ারো ভাবলেন।
ঐ ভদ্রমহিলা আর কর্নেল দুজনেই ইংরেজ কাজেই গল্প টল্প করতে পারেন না কেউই। টুকটাক কথা চলছিল। মেরী উঠে তার কামরার দিকে চলে গেলেন একটু পরেই।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দুপুরের খাবার সময়ও। দায়সারাভাবে কথাবার্তা চালাতে লাগলেন কর্নেল আর মেরী একই টেবিলে বসে। ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ পোয়ারার উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাঞ্জাবের গল্প করছিলেন কর্নেল। তিনি বাগদাদে এক পরিবারে গভর্নেস ছিলেন, তরুণীর কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল। কিছু পরিচিত লোকজনের কথা উঠল দুজনেরই কথায় কথায়। সুতরাং দুজনেই স্বাভাবিক অল্পবিস্তর এখন। আপনি কি সোজা লন্ডনেই যাচ্ছেন না কি ইস্তাম্বুলে নামবার ইচ্ছে আছে, কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন।
না সোজা লন্ডনে যাব।
ইস, ইস্তাম্বুল শহরটা দেখা হবে না।
না না আমি দু বছর আগে তিনদিন থেকে ইস্তাম্বুলে সব ঘুরে বেড়িয়ে গেছি।
আমি সোজা লন্ডনেই যাব। তাহলে তো ভালোই হল, অকারণেই একটু লাল হলেন কর্নেল।
বেচারা। মনে মনে মুচকি হাসলেন পোয়ারো। সায় দিলেন মিস ডেবেনহ্যাম।
এক সঙ্গে যাওয়া যাবে ভালোই হল।
তাঁর কামরা পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। এবার কর্নেল মেরীর সঙ্গে। এরপর অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য টরাসের। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সকলে। মেরীর দীর্ঘশ্বাস শুনে চমকে উঠলেন হঠাৎ।
মেরী খুব মৃদুস্বরে বললেন, এত সুন্দর আমি যদি–ঘাড় ফেরালেন আবাথনট।
কি?
সব কিছু যদি উপভোগ করতে পারতাম।
কোনো উত্তর দিলেন না আবাথনট। তার দৃঢ় চোয়াল দৃঢ়তর হল।
তুমি এসব ঝামেলা থেকে দূরে থাক আমি প্রার্থনা করি ঈশ্বরের কাছে।
ভ্রূ বাঁকালেন মিস ডেবেনহ্যাম।
তুমি চুপ কর।
কর্নেল পোয়রোর দিকে বিরক্তি মাখানো চোখে এক ঝলক তাকালেন। কিন্তু ঠিক আছে–তোমার এই চাকরিটা আমার পছন্দ নয়। সর্বক্ষণ মায়েদের আর বাচ্চাদের তাবেদারী করা।
ইস এভাবে বোলো না। আমাদের মতো গভর্নেসদের আজকাল আর কেউ চোখ রাঙিয়ে কথা বলে না বরং মায়েরাই আমাদের ভয় পায়। চুপ করে রইলেন আবাথনট।
বাঃ দিব্যি জুটিটি, আপনমনেই ভাবলেন পোয়ারো। ট্রেন কেনিয়াতে এসে পৌঁছলো রাত সাড়ে এগারোটায়। হাত পা টান করতে স্টেশনে নামলেন দুজন ইংরেজ। হালকা পায়ে পায়চারি করতে ব্যস্ত দুজনেই। দুজনকে জানালা দিয়ে দেখছেন পোয়ারো। তিনি গরম জামা কাপড় পরে মিনিট দশেক পর সাহস সঞ্চয় করে হাত-পায়ের খিল ছাড়িয়ে নিতে নিচে নামলেন।
আবছা ছায়ামূর্তি দুটি খানিকটা দূরে। কথা বলছেন আবাথনট।
মেরী…
লক্ষ্মীটি এখন না না সব শেষ হয়ে যাবে।
ত্রস্তপায়ে পিছু হঠলেন মঁসিয়ে পোয়ারো। তারপর স্বগতোক্তি করলেন আশ্চর্য।
কেউই প্রায় কারোর সঙ্গে কথা বলছে না, রীতিমতো সন্দেহ হতে লাগলো। রীতিমতো চিন্তিত মেয়েটি। তার চোখের কোণে কালি পড়েছে। হঠাৎ থেমে গেল ট্রেনটা দুপুর আড়াইটার সময়। লাইনের ধারে জটলা বিভিন্ন কামরা থেকে লোকজন উঁকি মারছে। মুখ বাড়িয়ে পোয়ারো কণ্ডাক্টর-এর সঙ্গে কথা বললেন। মেরী ডেবেনহ্যামের সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগল পোয়ারোর, মাথাটা ভেতরে গলাতে গিয়ে।
ট্রেনটা থামল কেন? মেরী শঙ্কিত গলায় ফরাসী ভাষায় বললেন।
কিছু না একটু আগুন লেগেছিল কিচেন কোচের নিচে, ভয়ের কিছু নেয় তেমন। আগুনটা নিভিয়ে ফেলা হয়েছে টুকিটাকি কাজ চলছে মেরামতির।
হাতের অদ্ভুত ভঙ্গি করলেন মেরী।
হা, হ্যাঁ, তা তো বুঝলাম, কিন্তু এই সময়টা?
কিসের সময়?
এতে তো আমাদের পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।
হ্যাঁ তা অবশ্য হতে পারে।
ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ধরতে হবে কনফোরাস পেরিয়ে আমাদের ছটা পঞ্চান্নয় পৌঁছে। কিন্তু দেরি হলে তো চলবে না। দেড় দুই ঘণ্টা দেরি হলে তো ঐ ট্রেনটা ধরতে পারব না।
হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক।
হাত ও ঠোঁট কাঁপছে মেরী ডেবেনহ্যামের। জানালার ফ্রেমটা ধরে রয়েছেন।
আপনার কি খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে দেরি হলে? পোয়ারো নরম সুরে বললেন।
হা, হা, ওই ট্রেনটা আমার ধরতেই হবে।
করিডর ধরে কর্নেলের কামরার দিকে এগিয়ে গেলেন মেরী জানালার ধার থেকে সরে এসে।
ট্রেন চলতে শুরু করল মিনিট দশেক পরেই, মেরীর অবশ্য আশঙ্কা অমূলক। মিনিট পাঁচেক দেরিতে ট্রেনটা গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছালো।
স্টীমারে কনফোরাস পার হতে হয়। জল জিনিসটা আবার ধাতে সয় না মঁসিয়ে পোয়ারোর। স্টিমারে অবশ্য মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে মেরী বা কর্নেলের দেখা হল না।
.
০২.
তোকাতালিয়ান হোটেল
এরকুল পোয়ারো হোটেলে এসে স্নানাগার সমেত ঘর চাইলেন। আগেভাগেই কোনো চিঠিপত্র এসে অপেক্ষা করছে কি-না তার জন্য খোঁজ নিলেন তারপর।
একটা টেলিগ্রাম আর তিনটে চিঠি। টেলিগ্রামটা কিন্তু আসার কথা ছিল না। কাগজটা খুললেন ধীরেসুস্থে পোয়ারো। আপনার চিন্তাভাবনা অনুযায়ী প্রতিফলন ঘটেছে কাসনার ক্ষেত্রে, তাড়াতাড়ি ফিরে আসুন।
দেখো তো কি কাণ্ড। পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন। কপালে বিশ্রাম নেই।
একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছাড়ে কটায়? হোটেলের ম্যানেজারকে বললেন, আজ রাতেই আমাকে রওনা হতে হবে।
রাত নটায় মঁসিয়ে।
একটা শোবার বার্থ নিতে হবে।
নিশ্চয়ই মঁসিয়ে কোনো অসুবিধাই হবে না। এই সময়টা ট্রেন প্রায় খালিই যায়, তেমন ভিড় তো থাকে না। ফার্স্ট ক্লাস না সেকেন্ড?
ফার্স্ট ক্লাস।
খুব ভালো কথা, কতদূর যাবেন মঁসিয়ে?
লন্ডন।
বেশ আপনার টিকিটের ব্যবস্থা আমি করে দেব।
ইস্তাম্বুল শ্যালে কোচে।
আটটা বাজতে দশ পোয়ারো আবার ঘড়ি দেখলেন।
এখন কি রাতের খাবার পাওয়া যাবে?
হা হা নিশ্চয়।
ছোটখাটো বেলজিয়ান ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। ঘরটা নিয়েছিলেন থাকবার জন্য সেটা বাতিল করে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
সবেমাত্র বেয়ারাকে ডেকে খাবার আনতে দিচ্ছে একজন তার কাঁধে হাত রাখলেন।
আপনি এখানে? বন্ধু কি কাণ্ড। আমি আশাই করিনি কিন্তু।
বক্তা ভদ্রলোক একজন বেঁটে, মোটা বয়স্ক। ছোট করে ছাঁটা চুলগুলো, তিনি একগাল হাসি নিয়ে কথা বলছিলেন।
পোয়ারো লাফিয়ে উঠলেন।
মঁসিয়ে কুক!
মঁসিয়ে পোয়ারো!
মঁসিয়ে কুকও বেলজিয়ান। পদস্থ কর্মচারী রেল কোম্পানির। যখন বেলজিয়ান পুলিশে চাকরী করতেন মঁসিয়ে পোয়ারো তখন থেকেই দুজনের আলাপ।
কি খবর? বাড়ি ছেড়ে এতদূরে? মন খারাপ লাগছে না? মঁসিয়ে কুক বললেন।
একটা–কাজ ছিল সিরিয়ায়।
ফিরছেন কবে?
আজ রাতেই।
চমৎকার! আজ রাতের গাড়িতে আমিও ফিরব। যাবো লম্যান পর্যন্ত, কাজ আছে ওখানে। ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে আপনি নিশ্চয় যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, এই তো এক্ষুনি একটা বার্থ জোগাড় করতে বললাম। কটা দিন এখানে থেকে যাব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বিধিবাম। তাড়াতাড়ি ফিরে যাবার তলব এসেছে; এইমাত্র লন্ডন থেকে জরুরী তার পেলাম।
আঃ কাজ আর কাজ। কিন্তু এখন তো আপনি মশাই ওপরতলার মানুষ।
তা কয়েকটা ঘটনার সাফল্যে পেয়েছি।
কুক হাসলেন। পোয়ারো বিনীত হবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন।
আবার দেখা হবে খানিকপর।
গরম স্যুপের পাত্রে পোয়ারো সন্তর্পণে চুমুক দিলেন। আবার না গোঁফটা ভেজে। জনা ছয়েক মাত্র লোক ঘরে। কিন্তু দুজন পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটা টেবিলে তারা বসে আছেন খানিক দূরেই। যুবক কজন বছর ত্রিশেক বয়স, বেশ হাসিখুশি। কিন্তু পোয়ারোকে আকর্ষণ করেছিলেন বয়স্ক মানুষটি, নির্ঘাত আমেরিকান। ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে বয়স তার, দেখেই মনে হয় তার পায়ের তলায় জগতটা। সামান্য টাক মাথায়, দু সারি নকল দাঁত। উঁচু কপাল হাসি মুখ। কিন্তু দুটো চোখ কুতকুতে গর্তে ঢোকা শয়তানি মাখানো। যেন সবসময় বজ্জাতির ফন্দি আঁটছে। এক মুহূর্তের জন্য পোয়ারোর চোখে চোখ পড়ল, যুবকটির সাথে কথা বলতে বলতেই তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণতর হলো পলকেই। তারপর হেক্টর দামটা মিটিয়ে দাও, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন।
গলার স্বরটা ফ্যাসফ্যাসে। নিষ্ঠুরতা আর খলতা-মেশানো।
মঁসিয়ে কুকের সাথে পোয়ারো যখন হোটেলের বাইরে বারান্দায় মিলিত হলেন, এই দুজন তখন হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে মালপত্র। সবকিছু তদারক করছে যুবকটি। মিঃ র্যাফোট সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে বলল। কাঁচের দরজাটা সে ঠেলে ধরে।
বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
মৃদুস্বরে পোয়ারো বললেন, মঁসিয়ে কুক, আপনার কি মনে হয় এই দুজন যাত্রী সম্বন্ধে?
নিঃসন্দেহে আমেরিকান।
তাতো বটেই কিন্তু মানুষ হিসাবে যুবকটি তত দিব্যি চমৎকার।
আর অন্যজন?
সত্যি কথা বলব? দেখলেই কেমন গা জ্বলে যায়, আমার মোটেই ভালো লাগেনি। পোয়ারো এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আমার কি মনে হয় জানেন? আমার পাশ কাটিয়ে একটা বুনো হিংস্র জন্তু বেরিয়ে গেল।
ষোল আনার উপর আঠারো আনা কিন্তু কেতা আছে।
যা বলেছেন, ওর মধ্যে যেন ভেতরের পশুটা ঘাপটি মেরে বসে আছে। এই জামাকাপড় মানে বাইরের চটকটা যেন খাঁচার মতো।
এঃ এটা আমার বড্ড কষ্টকল্পনা হয়ে গেল না?
হতেও তো পারে। মনে হল পাশ দিয়ে সাক্ষাৎ শয়তান হেঁটে গেল।
ওই আমেরিকান বুড়ো ভদ্রলোকটি?
হা, ওই আমেরিকান বুড়ো ভদ্রলোকটি।
হেসে ফেললেন মঁসিয়ে কুক।
জগৎটাই যে শয়তানের কুক্ষিগত কি আর করবেন বলুন, ঘোর কলিকাল।
ম্যানেজার এগিয়ে এলেন দরজা খুলে।
আমি সত্যিই লজ্জিত মঁসিয়ে পোয়ারো কোনো ফার্স্ট ক্লাস বার্থ খালি নেই।
মঁসিয়ে কুক চেঁচিয়ে উঠলেন।
কি? এমন অবস্থা বছরের এই সময়েও। সাংবাদিকরা নির্ঘাত কোথাও যাচ্ছে ঝাঁক বেঁধে নাকি দলের রাজনৈতিক নেতারা? কিন্তু অবস্থা তো শোচনীয়।
জানি না স্যার। পোয়ারোর দিকে ফিরলেন মঁসিয়ে কুক।
আমি তো আছি কিছু ভাববেন না একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দেব। ষোল নম্বরটা খালি যায়। কণ্ডাক্টরকে বলছি। সময় হয়ে এসেছে আসুন রওনা হওয়া যাক।
কণ্ডাক্টর গার্ড স্টেশনে মঁসিয়ে কুককে বিনীত নমস্কার জানালেন। হাজার হোক ওপরওয়ালা তো বটে।
শুভ সন্ধ্যা মঁসিয়ে। আপনার কামরা এক নম্বর।
কুলিকে ডেকে গার্ডটি মালপত্র বুঝিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠল, পিছু পিছু কুক আর পোয়ারো। আজ নাকি সব জায়গা ভর্তি হয়ে গেছে তোমাদের শুনলাম।
হা মঁসিয়ে। কি কাণ্ড দেখুন যেন সারা দুনিয়ার লোক একই জায়গায় যাচ্ছে।
আমার সেসব জানার দরকার নেই। একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে আমার এই বন্ধু ভদ্রলোকটির জন্য, ষোল নাম্বার কামরায় বন্দোবস্ত করে দাও।
উপায় নেই মঁসিয়ে। ওখানেও জায়গা নেই।
সেকি। ষোল নম্বরেও?
কণ্ডাক্টর ও গার্ডের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মঁসিয়ে কুক তাকালেন। লম্বা ফ্যাকাসে চেহারার মাঝ বয়েসি লোকটি। কণ্ডাক্টর হাসল।
আজ সব ভর্তি হ্যাঁ আমরা তো বলছি মঁসিয়ে।
কিন্তু হলটা কি? মঁসিয়ে কুক রাগী গলায় বললেন। কোথাও সভা-সমিতি আছে নাকি কোনো?
না, মঁসিয়ে, হঠাৎই আজ রাতে যাত্রা করতে যেন সব লোকই মনস্থ করেছেন।
বেলগ্রেডে এথেন্সের কোচটা জোড়া হবে। বুখারেস্টে প্যারিস কোচটাও জোড়া হবে। কিন্তু সেও আগামীকাল সন্ধের আগে নয়। কোনো সেকেন্ড ক্লাস বার্থও খালি নেই। আজ রাতের ব্যবস্থাটা কি হবে?
একটা সেকেন্ড ক্লাস বার্থ অবশ্য খালি আছে।
তাহলে?
মানে ওই কামরায় একজন মহিলা আছেন। একজন জার্মান সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলার পরিচারিকা। মঁসিয়ে কুক মাথা নাড়লেন।
ওঃ হো ওখানে তো অসুবিধা হবে।
আমি এমনি যেভাবে হোক চলে যেতে পারব। না, না অত ব্যস্ত হবার কিছু নেই বললেন পোয়ারো।
মঁসিয়ে কুক ধমক দিলেন।
আপনি থামুন তো। কি কন্ডাক্টর যাত্রীরা কি সবাই এসে গেছেন?
একজন যাত্রী এখনও এসে পৌঁছাননি, কণ্ডাক্টর দ্বিধার সুরে বলল। সেকেণ্ড ক্লাস! সাত নম্বর বার্থ, উনি তো এখনও এলেন না। এখন নটা বাজতে চার মিনিট।
বুকের মালপত্র রদেরি হচ্ছে দাবিস তিনি যত
যাত্রীটি কে?
একজন ইংরেজ মিঃ হ্যারিস। কণ্ডাক্টর হাতের তালিকা দেখে বলল।
মিঃ হ্যারিস? ডিকেন্সের বইয়ের এক চরিত্রের নাম। পোয়ারো বললেন, মিঃ হ্যারিস হয়তো এখানে এসে পৌঁছবেন না।
সাত নম্বরে এই ভদ্রলোকের মালপত্র রেখে দাও, মঁসিয়ে কুক বললেন। যদি মিঃ হ্যারিস এসেও যায় ওঁকে বলে দেবে ওনার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে এই ভদ্রলোককে বার্থটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে যা হোক করে বোঝানো যাবে, মিঃ হ্যারিস তিনি যত লাটসাহেবই হোন না কেন আমার কিছু এসে যায় না।
তাহলে সেই ব্যবস্থাই করি, বলল কণ্ডাক্টর।
কণ্ডাক্টরর পোয়ারোর কুলিকে নির্দেশ দেবার পর বলল, একেবারে শেষের ঠিক আগের কামরাটা আপনার মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো মন্থর গতিতে এগিয়ে চললেন। বেশির ভাগ কামরার দরজায় যাত্রী বা যাত্রিনীরা দাঁড়িয়ে। তিনি যাকে তোকাতালিয়ান হোটেলে দেখেছিলেন পোয়ারোর কামরার ঠিক ভেতরে লম্বা সুদর্শন যুবকটি, পোয়ারোকে দেখেই ভুরু কুঁচকে গেল। কামরা চিনতে মনে হয় আপনার ভুল হয়েছে। রীতিমতো কষ্ট করে ভাঙা-ভাঙা ফরাসী ভাষায় সে পোয়ারোকে বলল।
পোয়ারো ইংরেজিতে উত্তর দিলেন।
আপনিই কি মিঃ হ্যারিস?
না, আমার নাম ম্যাককুইন, আমি…।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে কণ্ডাক্টরের গলা শোনা গেল। ক্ষমা প্রার্থনার সুরে সে বলছে, উপায় নেই মঁসিয়ে এই ভদ্রলোককে এখানেই ব্যবস্থা করে দিতে হল অন্য কোথাও জায়গা খালি না থাকায়।
কন্ডাক্টর নিপুণ ভঙ্গিতে মাল তুলতে লাগলেন।
পোয়ারো মনে মনে হাসলেন তার এই ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি দেখে। লোকটি নির্ঘাত ভালো বকশিসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কামরাটা একলাই দখল করবে সেই আশায়। কিন্তু সে আশায় বাদ সাদলেন মঁসিয়ে কুক। একদিকে জাঁদরেল ওপরওয়ালা অন্যদিকে কাঁচা পয়সা; কণ্ডাক্টরের অবস্থা শোচনীয়।
সব মালপত্র গোছগাছ করে কন্ডাক্টর বলল, দেখুন সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলাম মঁসিয়ে। আপনার বার্থ ওপরে সাত নম্বরে। আর মিনিট খানেক বাদেই ট্রেন ছাড়বে।
কামরা ছেড়ে চলে গেল কন্ডাক্টর ব্যস্ত পায়ে। আবার নিজের কামরায় ঢুকে পোয়ারো স্বগতোক্তি করলেন, কি কাণ্ড? কন্ডাক্টর নিজেই মালপত্র গুছিয়ে দিচ্ছে এমনটা তো দেখাই যায় না।
হাসল তার সঙ্গীটি। তার রাগ পড়ে যাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে, অবশ্য রাগ করেই বা উপায় কি?
ট্রেন তো একদম ভর্তি।
এইবার ট্রেন চলতে শুরু করবে। তীক্ষ্ণ শীসের শব্দ। করিডরে পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলেন দুজনেই।
আমরা তাহলে চললাম, ম্যাককুইন বলল।
নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ সুরে আবার ইঞ্জিনটা জানান দিল কিন্তু ট্রেন চলল না।
পোয়ারোকে ম্যাককুইন বলল, স্যার নিচের বার্থটা আপনি ইচ্ছে করলে নিতে পারেন। আমার কোনো অসুবিধা হবে না উপরে শুতে।
যুবকটি চমৎকার, দেখলেই পছন্দ হয়।
প্রতিবাদ করলেন পোয়ারো।
না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
আরে না আমার কষ্ট হবে না।
বেলগ্রেডে এক রাতের মামলা, অবশ্য খুব অমায়িক লোক আপনি।
ওঃ আপনি বেলগ্রেডে নেমে যাচ্ছেন।
মানে তা নয়। আমি…।
ট্রেনটা হঠাৎ দুলে উঠল। চমকে উঠলেন দুজনে ঝাঁকুনি খেয়ে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে আলোকিত প্ল্যাটফর্ম সরে যাচ্ছে।
তার তিনদিনের যাত্রা শুরু করল ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস।
.
০৩.
পোয়ারো প্রত্যাখ্যান করলেন
মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোর কিচেন কামরায় ঢুকতে একটু দেরিই হয়ে গেল। ঘুম ভেঙে ছিল অবশ্য সকালেই, প্রাতঃরাশও একলাই প্রায় সেরেছেন। লন্ডনের সেই মামলাটার নথিপত্র নাড়াচাড়া করতে সারা সকালটা কেটেছে। দেখাই হয়নি মঁসিয়ে কুকের সঙ্গে।
মঁসিয়ে কুক পোয়ারোকে ডাকলেন। ইশারায় তার মুখোমুখি বসবার জন্য তিনি আগেভাগেই টেবিল দখল করে বসে আছেন। আর টেবিলটাও এমন জায়গায় যে, সব থেকে আগে বেয়ারারা ওখানে আসে।
চমৎকার খাওয়ার ব্যবস্থা। কয়েকটা পদ শেষ করে যখন দুজনে ক্রীম চীজে এসে পৌঁছেছেন, আহা আমার যদি কলকুকের মতো প্রতিভা থাকত। মঁসিয়ে কুক ভাবুক ভাবুক গলায় বললেন, তবে এই চমৎকার নিসর্গদৃশ্য কলমের আঁচড়ে ধরে রাখতাম।
কিছু বললেন না পোয়ারো। দু চারটে ভালো-মন্দ পদ পেটে পড়লে লোকে অমন কবি কবি হয়ে যায় এ তার বেশ ভালোই জানা আছে। ঠিক বলেছি কিনা বলুন, মঁসিয়ে কুক তার মৌনতাকেই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললেন। এই তো আমাদের চারপাশেই দেখুন না কত দেশ কত জাতি মানুষের মিলনতীর্থ। কত রকমফের চরিত্রেরই। একসঙ্গে মিলিত হয়েছে সবাই এই তিনদিন। একই ছাদের নিচে খাচ্ছে-শুচ্ছে আবার বিদায় নিয়ে চলে যাবে নানাদিকে। কোনোদিন দেখাই হবে না হয়তো।
যদি কোনো দুর্ঘটনা-পোয়ারো বললেন।
আঃ মশাই থামুন তো? এমন বাগড়া দেন না।
না না, ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সেইরকমই। এই চলমান পান্থশালার প্রতিটি অতিথি এক ও অদ্বিতীয় এক বন্ধনে আবদ্ধ তা হল মৃত্যুর। এরকম কিন্তু ভাবতে পারেন।
নিন তো একটু মদ খান। মাঝে মাঝে এমন উল্টোপাল্টা কথা বলেন না, আপনার নির্ঘাৎ হজমের গণ্ডগোল হয়েছে।
সায় দিলেন পোয়ারো। হতেও পারে। সিরিয়ার রান্নার ধাঁচটা মনে হয় ঠিক পোয় না আমার।
পোয়ারো আস্তে আস্তে সুরাপাত্রে চুমুক দিতে থাকলেন। তারপর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সমস্ত পরিবেশটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে জরীপ করতে লাগলেন।
সত্যিই কি বিচিত্র সব মানুষের সমাবেশ।
তিনটি পুরুষ বসে তাদের ঠিক বিপরীত দিকের টেবিলে। এককভাবে ভ্রমণ করছে বোধহয় তিনজনই। নিবিষ্ট মনে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছে একজন ইতালিয়ান। একজন বিরসবদন ইংরেজ তার ঠিক উল্টোদিকে যার হাবভাব দেখে মনে হয় খুব দক্ষ পরিচারক। আমেরিকান পোশাক পরা একজন হোমরাচোমড়া চেহারার ঠিক পাশের ইংরেজটা ব্যবসাদার নির্ঘাত। নিছক দায়সারাভাবে নিজেদের মধ্যে তিনজন টুকটাক কথাবার্তা চালাচ্ছে।
এবার অন্যদিকে চোখ ঘুরে গেল পোয়ারোর। এক মহিলা একটি ছোট টেবিলে সোজা হয়ে বসে আছেন। জীবনে কমই দেখেছেন তার মতো কুদর্শনা নারী। এঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে মনকে কিন্তু কুশ্রীতাও টানে। তার গলায় বড় বড় মুক্তোর কলার, আসল মুক্তো। হাতভর্তি আংটি, দামী ফারের কোট পরনে।
বেয়ারার সঙ্গে কথা বলছিলেন ভদ্রমহিলা খুব কর্তৃত্বের সুরে।
এক বোতল জল আর গ্লাস ভর্তি কমলালেবুর রস দিয়ে আসবে আমার কামরায়, ভুল যেন না হয় খবরদার। একদম ভালোমশলা বাদে আমি মুরগীর মাংস খাবো আজ রাতে। আর হা শোনো কিছু মাছ সেদ্ধও করো। বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছিল বেয়ারাটি। দৃপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রমহিলা। পোয়ারোর মুখের ওপর দিয়ে তার নিরুৎসুক উন্নাসিক দৃষ্টি ঘুরে গেল।
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, মঁসিয়ে কুক ফিসফিস করে বললেন। রাশিয়ান। ওঁর স্বামী পশ্চিম ইউরোপে ব্যবসার ধান্দায় চলে আসেন প্রচুর সম্পত্তি নিয়ে ঠিক বিপ্লবের আগে। এখন তো টাকার পাহাড়। কি ব্যক্তিত্ব তবে দেখতে ভালো নয়।
রাজকুমারীর নাম তিনিও শুনেছেন, পোয়ারো মাথা নাড়ালেন।
মেরী ডেবেনহ্যাম বসে আছেন অন্য আর একটা বড় টেবিলে। সঙ্গে আরও দুজন মহিলা। মাঝ বয়েসী লম্বা একজন সাদামাটা স্কার্ট আর ব্লাউজ পরা। বিরাট খোঁপার আড়ালে শোভা পাচ্ছে এক মাথা হলুদ চুল, চোখে চশমা, ভালো চেহারার মানুষ। মনে হয় দেখলেই সকলের • কথা মন দিয়ে শোনেন আর সায় দেন। তৃতীয় মহিলাটির বাক্যবাণে বিধ্বস্ত দুজনেই। একটানা বকরবকর করেই যাচ্ছেন। এই তৃতীয়জন মোটাসোটা ভারিক্কি চেহারার।
তারপর বুঝলেন আমাদের কলেজে কি চমৎকার পড়াশুনা হয়। মাগো তুমি ভাবতেই পারবে না আমার মেয়েটা তাই বলে। শিক্ষার মতো কি জিনিস আছে, কি সুন্দর পড়ান অধ্যাপকরা। আমার মেয়ে বলে পাশ্চাত্য দেশ থেকে কত ভালো-ভালো জিনিস প্রাচ্যে শিক্ষার বিষয় হতে পারে। একটা সুড়ঙ্গে সশব্দে ট্রেনটা ঢোকায় গলার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল ভদ্রমহিলার।
কর্নেল আবাথনট একলা বসে পাশের ছোট টেবিলটায়। মেরী ডেবেনহ্যামের দিকে করুণ সতৃষ্ণ নয়নে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। যা চিনে জোঁকের পাল্লায় পড়েছেন মেরীর কিন্তু উঠে আসার উপায় নেই। ওরা দুজনে এক সঙ্গেই কিন্তু বসতে পারতো প্রথম থেকেই বসলো না কেন?
পোয়ারো হয়ত ভাবলেন মেরী একটু সতর্ক প্রকৃতির মেয়ে, নিজেকে জড়াতে চায় না চট করে। এতে সুনামও নষ্ট হতে পারে তার চাকরীর। পোয়ারোর চোখ এবার কামরার অন্যদিকে চলে গেল। মাঝ বয়েসী জার্মান কালো পোশাক পরা সাধারণ চেহারার একজন স্ত্রী লোক একদম কোণে, রাজকুমারীর পরিচারিকা বোধহয়। একজন ভদ্রমহিলা আর একজন ভদ্রলোক নিচুস্বরে অন্তরঙ্গ তার ঠিক পরের টেবিলে আলাপরত। ভদ্রলোকের বয়স তিরিশের কোঠায়, চমৎকার এক জোড়া গোঁফের মালিক, সুবেশ ও সুদর্শন। তিনি এপাশে তাকালেন কথা বলতে বলতে। তরুণটি যে ইংরেজ নয় পোয়ারো নিশ্চিত। তার সঙ্গে ভদ্রমহিলাটি সুন্দরী বললে কম বলা হবে, মেয়ে বলাই ভালো তাকে, যেন ডানাকাটা পরী। বছর কুড়ি বয়স, চমৎকার ছাঁটকাটের পোশাক পরা। সাদা মসৃণ চামড়া হাতির দাঁতের মতো, মায়াবী বাদামী চোখ বড় বড়, কুঁচকুচে কালো চুল একমাথা চাপার কলির মতো আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেট। প্লাটিনামের ওপর পান্না বসানো গয়না পরেছে, চকচকে লাল রঞ্জনী নখে, চোখের দৃষ্টি আর গলার স্বর মদির স্বপ্নলু।
মেয়েটি কি সুন্দর, বোধহয় ওরা দম্পতি না?
হ্যাঁ, পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে কুক বললেন। হাঙ্গেরীর দূতাবাসে কাজ করেন সম্ভবতঃ, দুজনকে দারুণ মানিয়েছে তাই না?
কুক তার দৃষ্টি অনুসরন করলেন পোয়ারোকে নিরুত্তর দেখে। কঠিন দৃষ্টি পোয়ারোর। ম্যাককুইন আর রাশেট তার লক্ষ্য। রাশেট সেই শয়তানি মাখানো-ধূর্ত চাউনি পোয়ারোর দিকে মুখ করে বসে আছেন।
কি হল, বন্যপ্রাণীটিকে পর্যবেক্ষন করছেন, কুক বললেন। কুক কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ঘাড় নাড়লেন পোয়ারো।
আপনি তাহলে বসুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি আমার কামরায় যাচ্ছি একটু কাজ আছে, একটু পরে আড্ডা মারা যাবে আপনিও আসুন না।
বেশ তো।
ধীরে ধীরে কফি খেতে লাগলেন পোয়ারো। আরও পানীয় আনতে বেয়ারাকে আদেশ করলেন। অনেকেই উঠে যাচ্ছেন একে একে।
এখন বলে চলেছেন সেই প্রৌঢ়া আমেরিকানটি।
আমার মেয়ে বলে মা সঙ্গে একটা নামের তালিকা রেখো সব দেশের খাবারের। কোনো অসুবিধেই হবে না দেশে-বিদেশে বেড়াতে, কিন্তু এখানে দেখ পছন্দসই পানীয়টি পর্যন্ত ঠিকভাবে মেলে না আর জলটারও এত বাজে স্বাদ যে তেষ্টা মেটে না…।
যা বলেছেন, তার টেবিলে নিরীহ মহিলাটি মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
আমার মেয়ে বলে একরাশ খুচরো দীনার না কি যেন বলে আবার দেখুন, যত্তোসব ঝামেলা। চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মেরী ডেবেনহ্যাম তার সঙ্গে আর্বানটও। আমেরিকান প্রৌঢ়াটি ও অন্য মহিলাটি পিছু পিছু খুচরো টাকা ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়ালেন। এখন খানাকামরায় রাশেট আর ম্যাককুইন, হাঙ্গেরিয়ান দম্পতিও চলে গেছেন।
কি যেন বললেন নিচুস্বরে রাশেট ম্যাককুইনকে। খানা কামরা ছেড়ে ম্যাককুইন বেরিয়ে গেল। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই রাশেট উঠে এগিয়ে এলেন পোয়ারোর টেবিলের দিকে। রাশেট বললেন নরম ভাঙা ভাঙা নাকি সুরে, মাপ করবেন আপনার কাছে কি দেশলাই আছে? আমার নাম রাশেট।
পোয়ারো অভিবাদনের ভঙ্গি করে ঈষৎ ঝুঁকে দেশলাই বার করে আনলেন পকেটে হাত দিয়ে। রাশেট কাঠি জ্বালালেন না সেটা হাতে নিয়েও।
আজ আমার পরম সৌভাগ্য, বললেন, মনে হয় আমি মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে কথা বলছি।
আপনি ঠিকই ধরেছেন মাসিয়ে। আমি এরকুল পোয়ারো।
বড় তাড়াতাড়ি কাজের কথায় আসে আমার দেশের মানুষেরা। আপনি আমার জন্য একটি কাজ হাতে নিন আমি চাই।
ভ্রূ তুললেন পোয়ারো।
আজকাল আমি খুব কম সেই হাতে নিই মঁসিয়ে রাশেট।
মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি যে খুব ব্যস্ত মানুষ তা আমার অজানা নয়। নিশ্চয় আমি আপনাকে এর জন্য কিন্তু ভালো পারিশ্রমিক দেব। ভালো পারিশ্রমিক সত্যিই।
পোয়ারো দু-এক মিনিট চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে আপনি কি কাজের ভার দিতে চান মঁসিয়ে রাশেট?
আমি অত্যন্ত ধনী লোক মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার শত্রুর অভাব নেই। কাজেই বুঝতে পারছেন আমার একটি বিশেষ শত্রু আছে।
একটি বিশেষ শত্রু?
আপনি কি বলতে চান রাশেট, তীক্ষ্ণস্বরে বললেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে ধনী মানুষদের একাধিক শত্রু থাকে, মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন।
রাশেট যেন নিশ্চিন্ত হলেন পোয়ারোর কথায়।
হা হা তা তো বটেই, তাড়াতাড়ি বললেন।
আমার নিরাপত্তা প্রয়োজন। একজনই থাক তার দশজন, অবস্থা তো একই বুঝলেন মশাই। নিরাপত্তা।
হা। খুন করবার হুমকি দেওয়া হয়েছে আমায়, অবশ্য আমি প্রস্তুত শত্ৰু মোকাবিলা করতে। একটা ছোট ঝকঝকে স্বয়ংক্রিয় রিভলবার রাশেটের হাতে। তবে কি জানেন, সাবধানের মার নেই। তিনি বলে চললেন, আমি কিন্তু এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চাই যিনি নিরাপত্তার ঠিকঠিক ব্যবস্থা করবেন আমার। প্রচুর টাকা খরচ করতে রাজী আছি সেই জন্য। আপনার চেয়ে সে যোগ্য ব্যক্তি আমি পাবো না আর এও জানি।
রাশেটের মুখের দিকে চিন্তিত ভাবে তাকালেন পোয়ারো। তার মুখে ভাবলেশহীন এত কথার পরও। রাশেট কেন স্বয়ং ভগবানেরও সাধ্য নেই তা বোঝার। শেষ পর্যন্ত পোয়ারো বললেন ধীর স্বরে, মঁসিয়ে আমি দুঃখিত আমার পক্ষে সম্ভব নয় আপনার অনুরোধ রাখা।
রাশেট ক্রুর চোখে তার দিকে তাকালেন।
আপনি কত চান?
মাথা নাড়লেন পোয়ারো।
মঁসিয়ে আপনি বুঝতে পারছেন না আমারও টাকার অভাব নেই। আমাকে কম প্রাচুর্য দেয়নি আমার জীবিকা। যেগুলোত আমি নিজে উৎসাহ বোধ করি সেইসব কেসই হাতে নিই, কিন্তু আজকাল।
বেশ বেশ, আগাম কুড়ি হাজার ডলা পেলে আপনি কি কাজ শুরু করতে রাজী? রাশেট বললেন।
না।
যদি আমাকে ভেবে থাকেন টাকা আদায় চাপ দিয়ে করবেন তবে ভুল করছেন, আমি ব্যবসাটা ভালোই বুঝি।
আমিও…মঁসিয়ে রাশেট।
কিন্তু কি আশ্চর্য আপনার আপত্তিটা কোথায়?
উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো।
আশাকরি সত্যি কথাটা বলার জন্য আপনি আমায় ক্ষমা করবেন কিন্তু এই মুহূর্তে আপনার মুখ যে আমি অত্যন্ত অপছন্দ করছি।
মঁসিয়ে পোয়ারো বড় বড় পা ফেলে খানাকামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
.
০৪.
মধ্যরাতে আর্তনাদ
রাত পৌনে নটায় ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস বেলগ্রেডে পৌঁছালো। এখানে আধঘণ্টা থামবে। প্ল্যাটফর্মে নামলেন পোয়ারো। বাইরে বেশিক্ষণ থাকা কিন্তু গেল না। হাত, পা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। যথেষ্ট সুরক্ষিত অবশ্য প্ল্যাটফর্ম কিন্তু দারুণ বরফ পড়া শুরু হয়েছে। তিনি অগত্যা আবার ট্রেনের দিকে পা বাড়ালেন। তাকে দেখে রীতিমাফিক অভিবাদন জানিয়ে কণ্ডাক্টর বলল, এক নম্বরে আপনার সব জিনিসপত্র অর্থাৎ মঁসিয়ে কুকের কামরায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কোথায় তাহলে গেলেন মঁসিয়ে কুক?
নতুন যে কোচটা এক্ষুনি দেওয়া হল, তিনি তারই একটা কামরায় গিয়েছেন। কুকের নতুন কামরায় গেলেন পোয়ারো।
ছি ছি, খুব খারাপ লাগছে আমার। শুধু শুধু ঝামেলা হল আমার জন্য। কিছু ঝামেলা হয়নি রাখুন তো মশাই, কুক বললেন। সোজা ইংল্যান্ডে যাবেন তো আপনি। ব্যালে পর্যন্ত যাবে আপনার কোচটা তাই সুবিধাই হল ওখানে আপনার। মশাই এখানে দিব্যি নিরিবিলিতে আরামে আছি। একজন গ্রীক ডাক্তার আর আমি ব্যাস। দেখছেন কি ঠান্ডা পড়েছে। আর তেমনি বরফ পড়া। আমরা নিরাপদে ঠিক সময়মতো যেন পৌঁছে যাই ভগবানকে ডাকুন।
ট্রেন ছাড়লো ঠিক নটা পনেরোয়। পোয়ারো বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে করিডোর ধরে নিজের কামরায় চলে এলেন তার একটু পরেই।
মোটামুটি পরিচয় হয়ে গিয়েছে বোঝা যায় যাত্রীদের নিজেদের মধ্যে। ম্যাককুইনের সঙ্গে কর্নেল আবাথনট দরজার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। পোয়ারোকে দেখে ম্যাককুইন অবাক হলেন।
একি বেলগ্রেড নেমে যাবেন যে বললেন আপনি? হেসে ফেললেন পোয়ারো।
আমার কথাটা আপনি ঠিক ধরতে পারেননি। ট্রেনটাও তখন আসলে ছেড়ে দিল তো বেলগ্রেডের যখন কথা উঠল।
কিন্তু আপনার মালপত্র কই কামরায়?
অন্য কামরায় গেছে সেগুলো।
ওঃ তাই বলুন।
এগিয়ে গেলেন পোয়ারো।
কন্যাগতপ্রাণা প্রৌঢ়া আমেরিকানটির সঙ্গে একটু এগিয়েই দেখা হল। সুইডিশ মহিলাটির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত তিনি এখনও। একটা পত্রিকা সুইডিশ মহিলাটির হাতে গুঁজে দিতে দিতে বললেন শ্রীমতী হার্বাড, একটা পত্রিকা তো ভারী পড়তে নেবেন এত সঙ্কোচের কি আছে তাতে। আমার তো কত বই আছে সঙ্গে। কি ঠান্ডাটাই না পড়েছে।
সুইডিশ মহিলাটি ধন্যবাদ জানিয়ে বইটি নিলেন। বেশি রাত জেগে বই পড়বেন না কিন্তু তা বলে, শ্রীমতী হার্বাড বললেন। মাথা ধরেছে বললেন। তা আপনি ভালো করে ঘুমোবেন আজ রাতে। দেখবেন কাল সকালে উঠে শরীর দিব্যি ঝরঝরে হয়ে গেছে।
আগে এক কাপ চা খাব।
হা ঠান্ডা যা। আমার কাছে একটা অ্যাসপিরিন আছে দেব?
না না থাক। হয়তো আমার কাছেও আছে। আচ্ছা শুভরাত্রি।
নিজের কামরার দিকে সুইডিশ মহিলাটি পা বাড়াতেই এবার পোয়ারোকে নিয়ে পড়লেন শ্ৰীমতী হার্বাড। কাণ্ড দেখেছেন সুইডিশ মহিলাটির। এত কিন্তু কিন্তু ভাব। কোনো মঠ বা ধর্মীয় সংস্থায় মনে হয় কাজকর্ম করেন। এত ভালো মহিলাটি কিন্তু ইংরেজিতে কথাবার্তা চালাতে পারেন না বেশিক্ষণ। বারবার আমার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
ভদ্রমহিলার কন্যারত্ন সম্পর্কে শুনে শুনে পোয়ারোরও বোধ করি একটা বিশদ ধারণা হয়ে গেছে। শুধু পোয়ারো কেন? ইংরেজি যারাই বোঝেন ট্রেনে তাদের সকলের। শ্রীমতী হার্বাডের মেয়ে জামাই দুজনেই নামী কলেজে অধ্যাপনা করে। ভদ্রমহিলা প্রাচ্যভ্রমণ এই প্রথম। তিনি কি ভাবেন তুর্কীদের সম্বন্ধে। কি দারুণ অবস্থা রাস্তাঘাটের। নানা প্রসঙ্গেই ভদ্রমহিলার দৌলতে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল এখন পোয়ারো।
যখন দুজনে দাঁড়িয়েছিলেন, শীর্ণ চেহারার পরিচারকটা বেরিয়ে এল পাশের কামরার দরজাটা খুলে। মিঃ রাশেট বিছানায় বসে আছেন পোয়ারো ভেতরে এক ঝলক দেখলেন। তার চোখ মুখ বিকৃত হয়ে উঠল পোয়ারোর চোখে চোখ পড়তেই। বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।
ছি ছি, কি অভদ্র দেখছেন! ফিস ফিস করে বললেন শ্রীমতী হার্বাড। একটি ভদ্রবেশী শয়তান নির্ঘাৎ! আমি মানুষ চিনতে পারি মুখ দেখলেই। যার যা মনে হয় সেটাই ঠিক আমার মেয়ে বলে। এইরকম একটা অভদ্র লোকের পাশের কামরায় জায়গা পেয়েছি ভাবতেই তো আমার বাজে লাগছে। মনে হয় কাল রাতে লোকটা হাতল ঘোরাতে চেষ্টা করেছিল আমার কামরায়। আমি একটুও অবাক হব না ও যদি একজন মারাত্মক খুনীও হয়। ভয়ে তো আমার বুক কাঁপছে। এই লোকটার পাল্লায় পড়ে ওই যে সুন্দর দেখতে ছোকরাটা হাসি মুখে কাজ করছে তাই ভাবি।
ম্যাককুইনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলেন কর্নেল আবাথনট। আমার কামরায় আসুন, ম্যাককুইনকে বলতে শোনা গেল। আড্ডা মারা যাবে খানিক। রাত হয়নি এখনো তেমন। তার পর হা কি বলছিলেন যেন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে। ম্যাককুইনের কামরার দিকে এগিয়ে গেলেন দুজনে। আমিও যাই বুঝলেন, বললেন শ্রীমতী হার্বাড, রাতে একটু বই না। পড়লে ঘুমই আসে না আবার।
আচ্ছা শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি ম্যাডাম।
নিজের কামরার দিকে এগোলেন পোয়ারো। ঠিক পরের খুপরিটা রাশেটের। তিনি জামা কাপড় বদলিয়ে আধ ঘণ্টাটাক বিছানায় শুয়ে বই পড়লেন। হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দিলেন তারপর।
পোয়ারোর ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। কেন? একি কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে এল। সজোরে একটা ডাকঘণ্টা বেজে উঠল।
পোয়ারো চমকে উঠলেন আর্তনাদ শুনে। পোয়ারো লাফিয়ে উঠে দরজা খুললেন। তার ঠিক পাশের কামরাটি রাশেটের। দেখা গেল সেই মুহর্তে রাশেটের দরজায় এসে কণ্ডাক্টরও টোকা দিল। করিডরের ঠিক পাশের কামরা থেকেও ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ ভেসে এল এর মধ্যে। না না দরকার নেই সব ঠিক আছে (জ মে স্যুই এঁপে) সেই ঠিক সময়। রাশেটের বন্ধ কামরা থেকে ফরাসী ভাষায় জবাব পাওয়া গেল চোখ তুলে তাকালো কণ্ডাক্টর।
ধন্যবাদ সিয়ে, কণ্ডাক্টর বলল।
পাশের কামরার দিকে তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। বিছানায় ফিরে এলেন পোয়ারো। একটা বাজতে তেইশ মিনিট আলো নেভানোর আগে ঘড়ি দেখলেন, তার মন থেকে দুশ্চিন্তার ভার নেমে গেছে।
.
০৫.
হত্যাকাণ্ড ঘুম আসছে না পোয়ারোর চোখে। থেমে আছে কেন ট্রেনটা। এটা যদি কোনো স্টেশনেও হয় লোকজনের চেঁচামেচি তাহলে তো কানে আসতো। অনেক বেশি লোকজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে ট্রেনের মধ্যে। ঐ তো বেসিনে কল খোলার আওয়াজ হলো। জল পড়ছে কলকল করে। বন্ধ হল হল। রাশেটের চলাফেরার শব্দ পরিষ্কার পাশের কামরায়। কেউ যেন ঘরেপরার চটি পরে হেঁটে যাচ্ছে, বাইরে পায়ের শব্দ।
কামরার ছাদের দিকে চেয়ে চুপটি করে শুয়ে রইলেন এরকুল পোয়ারো। শুতে যাবার আগে জল চেয়ে নেওয়া হয়নি, ইস্ বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এত চুপচাপ কেন বাইরের স্টেশনটা। পোয়ারো ঘড়ি দেখলেন রাত সওয়া একটা। জল চাইবেন কি কণ্ডাক্টরকে ডেকে? ঘন্টা বাজবার বোতামে আঙুলটা রেখে সবে চাপ দিতে যাবেন হঠাৎ পাশের কোনো কামরা থেকে অর্ধেক ঘণ্টা ধ্বনি বেজে উঠল টিং টিং টিং এক মুহূর্ত লোকটার যেন সবুর সইছে না।
শ্ৰীমতী হার্বাডের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর, বাইরে ব্যস্ত পায়ের শব্দ। কে যেন হাতটা বোতামে রেখেই দিয়েছে। অন্য কামরার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কন্ডাক্টর।
ও শ্রীমতী হার্বাড। ভদ্রমহিলাটি নব্বইভাগ কথা বলেছেন আর দশভাগ কন্ডাক্টর, পোয়ারো হাসলেন নিজের মনেই। সন্ধি স্থাপন হলো খানিকক্ষণ বাদানুবাদ হবার পর। শুভরাত্রি মাদাম, পোয়ারো পরিষ্কার শুনলেন।
বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
এইবার ঘণ্টা বাজালেন পোয়ারো। কন্ডাক্টরটি সঙ্গে সঙ্গেই এসে হাজির হল। তাকে চিন্তিত আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
আমাকে একটু জল দেবে।
হা নিশ্চয় মঁসিয়ে।
সে নিশ্চিন্ত হল পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বরে, ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলাটি বুঝলেন।
তার কি হলো?
কন্ডাক্টর কপালের ঘাম মুছল।
কি অদ্ভুত উনি, ভাবতে পারবেন না–একই কথা বারবার, লোক ঢুকেছিল নাকি ওর কামরায়। বুঝুন কাণ্ড। আর সে নাকি মোটাসোটা চেহারার। লোকটা কি বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল নাকি। আমি তো সেই নিয়ে ওঁর সঙ্গে তর্ক করতে বাধ্য হলাম। ওঃ কি সাংঘাতিক মহিলা, নিশ্চয় ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছেন। নিশ্চিত নাকি তোক ঢুকেছিল। আপনিই বলুন তাহলে কি সে আবার বাইরে বেরিয়ে ভেতরে হাত গলিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে? দরজায় তো ফঁকফোকর নেই। এমনিতে বরফের ঝড়ে…।
বরফ?
হা। যা বরফ পড়েছে এগোনোই দায়। এরকম অবস্থা কদিন চলবে কে জানে। আপনি কি খেয়াল করেননি যে ট্রেন থেমে আছে? আমরা আটকা পড়েছি? একবার তো সাতদিন ট্রেন অচল ছিল।
এখন কোথায় আমরা?
ভিনভোকি আর ব্রডের মাঝামাঝি।
ইস কি কাণ্ড!
কন্ডাক্টরর দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস জল নিয়ে এল।
শুভরাত্রি মঁসিয়ে।
জল খেয়ে ঘুমোবার চেষ্টা কলেন পোয়ারো। চোখের পাতাটা সবেমাত্র বুজে এসেছে দরজার কাছে একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দ হল এমন সময়।
পোয়ারো লাফিয়ে উঠে দরজা খুললেন। কই কিছু নাতো! তার নজরে পড়ল এক ভদ্রমহিলা ডানদিকে করিডোর ধরে হেঁটে চলে যাচ্ছেন ধীর লয়ে।
পরনে লাল টুকটুকে কিমোনো। আর সব চুপচাপ অন্য প্রান্তে কন্ডাক্টর ছোট্ট চেয়ারে বসে একরাশ কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে আছে।
যতসব উল্টোপাল্টা শব্দ শুনছি–ভাবলেন পোয়ারো, সত্যিই আমার ভীমরতি হয়েছে।
তিনি আবার বিছানায় এসে শুলেন, ঘুমটা অবশ্য এবার ভালোই হল।
যখন ঘুম ভাঙল জানালার শার্সি খুলে মুখ বাড়ালেন পোয়ারো, তখনো ট্রেনটা থেমে রয়েছে। ঘড়িতে নটা বেজে গেছে। বাইরে চাপ চাপ বরফ। খানাকামরায় ফুলবাবুটি হয়ে ঠিক পৌনে দশটায় গেলেন তখন সেখানে জমজমাট অবস্থা। প্রথম পরিচয়ের বাধাটা কেটে যাওয়ার পর তিনি দেখলেন সবাই নিজেদের মধ্যে জোর কথাবার্তা চালাচ্ছেন। এই তুষার ঝড়ের কল্যাণে একটা কথা সকলের মুখে। অবশ্য শ্রীমতী হার্বাডের গলাই কানে ভেসে আসে সব কিছু ছাপিয়ে। আমার নাকি কিছু অসুবিধা হবে না বলে আমার মেয়ে আমাকে পই পই করে এই ট্রেনেই শুয়ে বসে চলে আসতে পারব বলল। দেখুন কাণ্ডটা। কিন্তু এখন। কাল বাদে পরশু স্টীমার ছাড়বে। কদিন এমন দুর্ভোগ কপালে আছে কে জানে। সেটা ধরতে পারব কি না তাই বা কে জানে।
একই অবস্থা ইতালিয়ানটিরও। মিলানে তার জরুরী ব্যবসায়িক লেনদেন আছে। ঘন্টা কয়েক পর ট্রেন চলতে শুরু করবে সকলেই এমন আশা করছে। আমার বোন আর তার ছেলে মেয়েরা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে বলে সুইডিশ মহিলাটি কুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। নিশ্চয়ই ভাববে কোনো গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাদেরও তো কোনো উপায় নেই জানবার। আচ্ছা, আর কতক্ষণ আমরা এখানে আটকা পড়ে থাকব। কেউ কি উত্তরটা দিতে পারবে না? মেরী ডেবেনহ্যাম জিজ্ঞাসা করলেন। অধৈর্য তার গলার স্বর। কিন্তু লক্ষ্য করলেন পোয়ারো আগের মতো তাতে আর উৎকণ্ঠা নেই। আবার শ্রীমতী হার্বাড মুখ খুললেন।
কারও আর উৎসাহ নেই কেউ কোনো খবরই রাখে না। কেন একটু গতর নাড়তে কি হয়, তেমনি হয়েছে এই ট্রেনটাও। এক দঙ্গল নিষ্কর্মা বিদেশী।
আপনি বোধহয় রেল কোম্পানির ডিরেক্টরের পদে আছেন যদি এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে পারেন, বললেন আবাথনট ফরাসীতে পোয়ারোর দিকে ফিরে।
পোয়ারো তাঁকে হাত নেড়ে থামিয়ে দিলেন।
আপনি বোধহয় আমাকে মঁসিয়ে কুক ভেবে ভুল করছেন।
ওঃ হো, আমি দুঃখিত।
না, তাতে কি হয়েছে। এ রকম ভুল তো হয়েই থাকে। আমি আবার ওর জন্য বরাদ্দ কামরাটাতেই এখন আস্তানা গেড়েছি।
খানাকামরায় অনুপস্থিত কিন্তু মঁসিয়ে কুক। কে কে আসেননি আর?
রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, হাঙ্গেরিয়ান দম্পতি, রাশেট তাঁর পরিচালক, রাজকুমারীর জার্মান পরিচারকটি। চোখ মুছলেন সুইডিশ মহিলাটি।
এভাবে পাঁচজনের সামনে কেউ কান্নাকাটি করে! ইস কি বোকামিটাই না করলাম। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য।
তবে এইভাবে কদিন থাকতে হবে কে জানে। তা ঠিক, অধৈর্য গলায় ম্যাককুইন বলল।
কোনো মুলুকে আছি তাই বা কে জানে! সজল চোখে মিসেস হার্বাড বললেন।
তিনি শুনে বললেন, যুগোশ্লাভিয়া। ওঃ বলকান অঞ্চল তাই বলুন।
সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার মানুষ দেখছি আপনিই মাদমোয়াজেল। মিস ডেবেনহ্যামকে বললেন পোয়ারো।
মেরী কাঁধ ঝাঁকালেন।
মিথ্যে চেঁচামেচিই তো সার হবে। কিই বা করা যাবে বলুন।
আপনি সত্যিই বুদ্ধিমতী।
অকারণ আবেগ আমার আসে না। তবে অবস্থার সঙ্গে মানুষকে মানিয়ে চলতেই হবে। তা নয়। বাইরের বরফের স্তূপের দিকে উদাস চোখে মেরী তাকালেন। সব থেকে মনের জোর বেশি আমাদের মধ্যে আপনার। চারিত্রিক দৃঢ়তাও খুব আপনার।
না না। আমার থেকে অনেক মনের জোর রাখেন অন্ততঃ আমি একজনকে জানি।
কে তিনি?
মেরী ডেবেনহ্যামের হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল। তার মুখে হাসি ফিরল মনে পড়ল এতক্ষণ সে একজন অচেনা বিদেশীর সঙ্গে কথা বলছিল। ঐ যে কুশ্রী মহিলাটি শুধুমাত্র নিঃশব্দ তর্জনী হেলানই কেমন বিশ্বচরাচর শাসন করছেন বরং ঐ বয়স্কা মহিলাটির কথাই ধরুন না কেন। সমস্তই যেন ওঁর পৈতৃক সম্পত্তি।
আমার বন্ধু কিন্তু ট্রেনের সব কর্মচারী মঁসিয়ে কুকেরও বংশব্দ। অবশ্য তিনি একজন ওপরওয়ালা বলে। তার চরিত্রের অনমনীয়তার জন্য নয়।
মেরী ডেবেনহ্যাম হাসলেন।
এইভাবে সকালটা কেটে গেল। দুশ্চিন্তা অনেক কমে যায় সবাই মিলে একসঙ্গে কথাবার্তা বললে, খানাকামরায় পোয়ারো কেন অনেকেই বসেছিলেন। তাঁর মেয়ের কথা, মৃত স্বামীর খুঁটিনাটি অভ্যাস, স্ত্রীর বোনা মোজা না পরলে ভদ্রলোক নাকি শান্তি পেতেন না। এইরকম গল্পে মিসেস হার্বাড একাই আসরের মধ্যমণি ছিলেন। তার কথার স্রোত যেন থামতেই চায় না।
বেশ খানিকক্ষণ পর সুইডিশ ভদ্রমহিলার সঙ্গে পোয়ারো যখন ব্যস্ত তখন একজন কন্ডাক্টর এসে দাঁড়ালো।
আমি সত্যিই দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, মাপ করবেন মঁসিয়ে।
কি ব্যাপার?
আপনাকে একবার মঁসিয়ে কুক দেখা করতে বলেছেন। সুইডিশ ভদ্রমহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, পোয়ারোকে নিয়ে এল কন্ডাক্টর।
মঁসিয়ে কুকের নয় এই দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরাটা। এই কামরাটাকে পছন্দ করা হয়েছে কারণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবার জায়গা এবং আলাপ আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত। আরও কয়েকজন আছেন ঘরে উঁসিয়ে কুক ছাড়াও। মঁসিয়ে কুক একটা ছোট সীটে বসে আছেন। একজন ছোটোখাটো চেহারার গাঢ় বাদামী চামড়ার মানুষ উল্টোদিকের জানালার ধারে। বাইরে বরফের স্তূপের দিকে তাঁর চোখ। নীল পোশাক পরা একজন মানুষ দরজার ঠিক সামনে। এ ছাড়াও আছে পূর্ব পরিচিত পোয়ারোর কন্ডাক্টরটি।
এই তো আপনি এসে গেছেন, চেঁচিয়ে উঠলেন মঁসিয়ে কুক। আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার আপনাকেই।
পোয়ারো বন্ধুর মুখোমুখি বসলেন। একটু সরে গিয়ে জানলার ধারে মানুষটি পোয়ারোকে বসবার জায়গা করে দিলেন। বেশ গুরুতর কোনো কিছু ঘটেছে তা কুকের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ব্যাপার কি বলুন তো?
আর বলবেন না এই বরফের ঝড়ে ট্রেনআর চলছে না তার উপর…।
একটু থামলেন মঁসিয়ে কুক, একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এল কন্ডাক্টরের গলা থেকে।
আবার কি হল?
একজন যাত্রীকে খুন করা হয়েছে ছোরা দিয়ে। তাকে তার কামরায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।
কাকে?
দাঁড়ান নামটা হল গিয়ে। হ্যাঁ, রাশেট-এই যে কাগজে লেখা আছে উনি একজন আমেরিকান।
মাথা নেড়ে যায় দিল কন্ডাক্টর।
ইস, চোখ মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে বেচারীর। পোয়ারো মুখের দিকে তাকালেন কন্ডাক্টর।
এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে বেচারীর যা অবস্থা দেখছি, ওঁকে একটু বসতে বলুন মঁসিয়ে
কন্ডাক্টর গার্ড সসঙ্কোচে একটা কোণে বসল নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি সরে দাঁড়াতেই। তার মুখ দু হাত দিয়ে ঢাকা।
তাহলে তো সাংঘাতিক কাণ্ড মশাই। গম্ভীর গলায় পোয়ারো বললেন।
তাছাড়া আবার কি! খুন যেভাবে হল, ঝামেলা প্রচণ্ড বেড়ে গেল তার উপর আবার ট্রেন যেভাবে আটকে আছে। কতক্ষণ যে এই দুর্দশা চলবে কে জানে?
এখন যে আমরা যুগোশ্লাভিয়ায় আটকে পড়লাম। ট্রেনে এই মুহূর্তে এখানকার কোনো পুলিশও নেই যে তার সাহায্য আমরা নিতে পারি।
এতো ভীষণ মুশকিল হল।
ওঃ হো। ইনিই ডাক্তার কনস্টানটাইন, আর ডাক্তার ইনি মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো। আপনার সঙ্গে কথায় কথায় আলাপ করিয়ে দিতে একেবারে ভুলেই গেছি।
ডাক্তার ঈষৎ ঝুঁকে অভিবাদন জানালেন। ওঁর চেহারাটি খুবই ছোটোখাটো।
ডাক্তার বললেন, আমি কিন্তু মোটামুটি নিঃসন্দেহ যে খুনটা রাত বারোটা থেকে দু-টোর মধ্যে হয়েছে। এই রকম পরিস্থিতিতে কিছুই বলা যায় না অত হিসেব করে।
মিঃ রাশেটকে জীবিত অবস্থায় সবার শেষে কে দেখেছে? পোয়ারো জানতে চাইলেন।
উনি জীবিত ছিলেন খবর যা আছে আমাদের কাছে তাতে মনে হয় রাত একটা বাজতে কুড়ি মিনিট উনি কন্ডাক্টর গার্ডের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
এ কথা পোয়ারো সমর্থন করলেন।
আমার ঠিক পাশের কামরাতেই তো। হ্যাঁ আমি নিজের কানে তা শুনেছি। আমিও জানি কোনও খবর আর মেলেনি তারপর।
ডাক্তার বললেন, জানালাটা হাট করে খোলা ছিল রাশেটের। ঐ পথেই মনে হয় আততায়ী পালিয়েছে। কিন্তু বরফের উপর তো ছাপ থাকত তাহলে। আমাদের সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত করবার জন্যই জানালাটা খোলা ছিল আমার মনে হয়।
আর কখন এই হত্যাকাণ্ডের খবরটা জানতে পারা গেল? গম্ভীর গলায় কুক বললেন, মিশেল, যা যা জানতে চান মঁসিয়ে পোয়ারো তার উত্তর দাও।
পূর্ব পরিচিত মিশেল নামের কন্ডাক্টর গার্ডটি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো।
স্যার আজ সকালে মিঃ রাশেটের পরিচারকটি মনিবের কামরার দরজায় ধাক্কা দেয়। কোনো সাড়া শব্দ ভেতরে থেকে পাওয়া যায়নি। মিঃ রাশেট প্রাতঃরাশ করবেন কি না তা জানতে খানাকামরার লোক আসে আধঘন্টা আগে তাও প্রায় ধরুন বেলা এগারোটা নাগাদ। বাধ্য হয়ে ওঁর কামরার দরজা আমি আমার চাবি দিয়ে খুলি, ভিতরে কিন্তু শেকল দেওয়া ছিল। হু হু করে বরফ কুচি ভেতরে ঢুকছে জানালাটা খোলা থাকার জন্যে সঙ্গে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া। ভদ্রলোক বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছেন ভাবলাম। আমি তাড়াতাড়ি এই ট্রেনেরই একজন কর্মচারীকে ডেকে দরজার শেকল ভেঙ্গে দুজনে ভেতরে ঢুকে দেখি উনি মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন।
ওঃ সে কি ভয়ানক দৃশ্য।
শিউরে উঠে মিশেল আবার দু হাতে মুখ ঢাকলো।
আচ্ছা আত্মহত্যা নয় তো? চিন্তিত গলায় পোয়ারো বললেন, শেকল তুলে কুলুপ দেওয়া ছিল ভেতর থেকে, গ্রীক ডাক্তার মৃদু হাসলেন।
না মশাই। একটা সুস্থ বুদ্ধির লোক নিজের দেহে বারো চোদ্দবার ছোরার আঘাত করবে আত্মহত্যা করতে চাইলে?
পোয়ারোর চোখ কপালে উঠল।
সেকি! এ তো নৃশংস-কাণ্ড।
এই প্রথম মুখ খুলল নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি। নির্ঘাত কোনো মেয়ের কাণ্ড। এরকম ওরাই করতে পারে।
তাহলে তো বলতে হবে শরীরে যথেষ্ট শক্তি রাখেন সেই মহিলাটি। ডাক্তার বললেন, ডাক্তারী শাস্ত্রমতে যথেষ্ট গায়ের জোর দরকার ওইরকমভাবে ছোরা চালাতে গেলে। দু-তিনটি কোপ তো মাংস ভেদ করে হাড়ে গিয়ে ঠেকেছে মশাই।
কি বলেন? পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত বা কেতাদুরস্ত নয় পোয়ারো বললেন।
যা বলেছেন। দেখলে মনে হবে নির্ঘাত কোনো পাগলের কাণ্ড, যেমন তেমন ভাবে যত্রতত্র আঘাত করা হয়েছে আবার মৃদু আঁচড়ের মতো আঘাতও আছে কোনো কোনো জায়গায়। যেমন হয় কেউ এলোমেলো ভাবে ছোরা চালায় চোখ বন্ধ করে। রাগলে তো মেয়েদের আর জ্ঞান থাকে না। দেখবেন এ কোনো মেয়ের কাণ্ড না হয়েই যায় না নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটি বলল।
আমার একটা কথা বলবার ছিল। বললেন পোয়ারো, মিঃ রাশেটের মৃত্যুভয় ও জীবনহানির আশঙ্কা ছিল সে কথাই মিঃ রাশেট আমাকে বলেছিলেন গতকাল। একটু রসিকতা করলেন এতক্ষণ পর মঁসিয়ে কুক। কোনো মহিলা নিশ্চয়ই নয়। এই ট্রেনেই একজন জাঁদরেল চেহারার আমেরিকান আছে চকচকে জামাকাপড় পরে আর চুইংগাম খায়। আমি যার কথা বলছি বুঝতে পারছেন তো, বেশ সন্দেহজনক লোকটার হাবভাব।
মাথা নাড়লো কন্ডাক্টর গার্ড।
তবে আমার কিন্তু ওঁকে সন্দেহ হয় না স্যার। এই আমেরিকান ভদ্রলোক ষোল নম্বর কামরায় আছেন আমি ওঁকে একেবারের জন্য কামরা থেকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখেনি।
ওভাবে কি কাউকে অষ্টপ্রহর চোখে চোখে রাখা যায় নাকি। সেটা তুমি নাও দেখতে পারো। কথা হচ্ছে আমরা এখন কি করব?
বন্ধুর মুখের দিকে তাকালেন পোয়ারো।
দেখুন আমি কি বলতে চাইছি তা আপনি বুঝতে পারছেন, বললেন মঁসিয়ে কুক। আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে। আপনি পূর্ণ তদন্তভার গ্রহণ করুন এটাই আমি চাই। না না, আপত্তি মোটেই করবেন না। একটা দায়িত্ব মানে রেল কর্তৃপক্ষের তো আছে। আমি একটা সমাধান চাইছি যুগোশ্লাভিয়ার পুলিশ আসার আগেই।
তা যদি না হয় ঝঞ্জাট, ঝামেলা অনেক বেড়ে যাবে। আপনিও নিশ্চয় চান না। অন্য কোনো নিরীহ যাত্রী অকারণ দুর্ভোগ সহ্য করুক। আমার অগাধ আস্থা আপনার বিদ্যাবুদ্ধির উপর মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি যদি খুনীকে ধরে দেন তাহলেই আমার কাজ শেষ। পুলিশ যখন আসবে তখন এই একটা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আর এই লোকটা খুনী। বললেই কাজ শেষ।
আমি যদি কাজটা হাতে না নিই বা সমাধান না করতে পারি তাহলে?
আহা, এমন করে বলবেন না, বন্ধুকে পিঠ চাপড়ানোর ভঙ্গিতে মঁসিয়ে কুক বললেন। আপনি অসীম ক্ষমতাবান আর এটা একটা সোনার সুযোগ আমি জানি। মশাই হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলবেন না।
সমস্ত যাত্রীদের খুঁটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করা কি সোজা কাজ?
আমি যা শুনেছি, আপনি গোঁফে তা দিতে দিতে চেয়ারে বসে বসেই রহস্যের সমাধান করতে পারেন। আমার এই উপকারটা দয়া করে করুন। আমি আর কিছু চাই না। আপনি মৃতদেহ দেখুন, যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করুন, সূত্র সংগ্রহ করুন, তার একটা সন্তোষজনক সমাধান করে দিন। আপনার উপর আমি সত্যিই ভরসা রাখি এবং জানি আপনি কি ভীষণ বুদ্ধিমান। আপনাকে শুধু একটু মাথা খাটাতে হবে। আর আপত্তি করবেন না।
আবেগ মাখানো সুরে পোয়ারো বললেন, তখন হয়তো অতটা বুদ্ধিমান নই। তবে সমাধান এই ঘটনার পক্ষে অতটা কঠিন হবে না। আমি একটু আগেই ভাবছিলাম হাতে কোনো কাজ নেই এতখানি সময়। কিন্তু দেখুন ঠিক কাজ এসে জুটে গেল হাতের কাছে। কথায় আছে কেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙ্গে।
তাহলে আপনি তদন্ত করছেন?
নিশ্চয় আমার উপর সেটুকু ভরসা করতে পারেন।
খুব ভালো হল। আমরা আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব।
এই ট্রেনটার একটা নক্সা চাই প্রথমেই। এবং তাদের পাসপোর্ট টিকিট এবং কে কোনো কামরায় আছে তাদের পরীক্ষা করা দরকার।
এ বিষয়ে মিশেল আপনাকে সাহায্য করবে।
বাইরে বেরিয়ে গেল কন্ডাক্টর।
আমি যাঁদের চিনি তারা ছাড়া ট্রেনে আর কে কে আছেন, ডাক্তার কনস্টানটাইন আর আমি এই কোচটাতে।
তাঁকে ভালো করেই চেনে কন্ডাক্টর বুখারেস্ট থেকে আসা কোনো একজন খোঁড়া বয়স্ক ভদ্রলোককে। তারপর অন্যান্য কামরাগুলো বোধহয় কাজে আসবে তেমন। কারণ ঐ দিকের জানালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কাল রাতে। খানাকামরা কি ইস্তাম্বুল ক্যালে কোচের সামনের দিকে ক্যাস, ডাক্তার আপনি তো তাই বলতে চান, যে ইস্তাম্বুল-ক্যালে কোচের ভেতরেই খুনীর খোঁজ পাওয়া যাবে তাই না? পোয়ারো ধীর স্বরে বললেন।
ঘাড় নাড়লেন ডাঃ কনস্টানটাইন।
আমরা তুষার ঝড়ের মধ্যে পড়ি রাত সাড়ে বারোটার পরই তারপর থেকে অন্য কোথাও একজন যাত্রীও নেমে যাননি।
চিন্তার সুর মঁসিয়ে কুকের গলায়।
এই ট্রেনে..এই মুহূর্তে…খুনী তাহলে তো আমাদের সঙ্গেই আছে।
.
০৬.
রহস্যময়ী?
পোয়ারো বললেন, আমার খুব ভালো হয় প্রথমে আমি মিঃ ম্যাককুইনের সাথে কথা বলবার পর একবার মৃত মিঃ রাশেটের কামরায় ডাক্তার যদি আমার সঙ্গে যান।
নিশ্চয়ই যাবো।
সেখানকার কাজ মিটে গেলে…।
হেক্টর ম্যাককুইন ঠিক সেই মুহূর্তে প্রবেশ করলেন। উঠে দাঁড়ালেন মঁসিয়ে কুক।
মিঃ ম্যাককুইন আপনি বরং আমার জায়গায় বসুন এই জায়গাটা বেশ ছোট। আর মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার মুখোমুখি।
তিনি তারপর কর্মচারীটির দিকে ফিরলেন।
শোনো সব লোকজন সরিয়ে দাও খানাকামরা থেকে। মঁসিয়ে পোয়ারোর সুবিধে হবে ওখানে বসে কথাবার্তা বলতে আমার মনে হয়।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সে বলল ভাঙা ভাঙা ফরাসীতে, শুধু শুধু আমাকে কেন…এ সবের মানেটা কি? তখনও ম্যাককুইন দাঁড়িয়ে।
পোয়ারো তাকে বসতে বললেন হাতের ইঙ্গিতে।
ব্যাপার কি মশাই, চেয়ারে বসে আবার জিজ্ঞাসা করল ম্যাককুইন।
মাথা নাড়লেন পোয়ারো।
আপনার মনিব মিঃ রাশেট মারা গেছেন তাই আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল। শিস দিয়ে উঠল ম্যাককুইন। সে অবাক হয়ে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ দুটো চকচক করে উঠল যেন। মুখের ভঙ্গিটা যাই হোক না কেন দুঃখ বা বেদনার ছায়ামাত্র তার মধ্যে দেখা গেল না।
এই করল তাহলে শেষ পর্যন্ত ওরা…
মিঃ ম্যাককুইন আপনি ঠিক কি বলতে চান?
ম্যাককুইন দ্বিধাগ্রস্ত।
মিঃ রাশেটকে খুন করা হয়েছে তা আপনি কি ধরেই নিয়েছেন, জিজ্ঞাসা করলেন পোয়ারো।
ম্যাককুইন এবার সত্যি সত্যিই অবাক হল।
হয়নি বুঝি? সেইরকমই ভেবেছিলাম কিন্তু আমি।
তাহলে উনি ঘুমের মধ্যে মারা গেছেন অসুস্থ হয়ে আপনি বলতে চান; স্বাস্থ্য কিন্তু ওনার দারুণ ভালো ছিল।
মিঃ রাশেটকে ছোরা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু আপনি এ বিষয়ে এত নিশ্চিত হলেন কি করে সেটাই অবাক লাগার এবং আপনার ধারণাটাই সঠিক। আমাকে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ম্যাককুইন বলল, আপনি কে? কেনই বা এত প্রশ্ন করা হচ্ছে?
আমি একজন গোয়েন্দা। আমার নাম এরকুল পোয়ারো। আমি এ বিষয়ে তদন্ত করছি রেল কর্তৃপক্ষের হয়ে।
পোয়ারো ম্যাককুইনের চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর না দেখার ফলে একটু হতাশ হলেন। বললেন, আমার নামটার সঙ্গে আপনি হয়তো পরিচিত।
হা মানে কোনো মহিলা দর্জির দোকানে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে-নামটা দেখেছি।
তাঁর নামের ওই রকম মাহাত্ম্য দেখে পোয়ারোর মুখটা কুঁচকে গেল।
যাকগে ওসব কথা। আপনি আপনার মনিব সম্পর্কে কতটুকু জানেন সেটাই হল আমার আসল বক্তব্য, ওঁর কি আপনি আত্মীয় ছিলেন?
না না নেহাতই সচিব।
ওঁর কাছে কাজ করছেন কতদিন হল?
এই বছর খানেক হবে।
ওঁর সম্পর্কে ঠিক কি কি জানেন?
পারস্যে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বছর খানেক আগে।
ম্যাককুইনকে বাধা দিলেন পোয়ারো।
মাপ করবেন। আপনি ওখানে কি করছিলেন?
সে অনেক কথা। একটা তেল কোম্পানির কাজ নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে গিয়েছিলাম।
মিঃ রাশেটও একই হোটেলে আমার সঙ্গে ছিলেন। ওখানে রীতিমত আর্থিক কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। সেই সময় ঝগড়াঝাটি চলছিল ওঁর সচিবের সঙ্গে তাই এই কাজটা উনি আমাকে নিতে বলেন। বেশ খারাপ অবস্থা থাকার দরুন আমার কাজটা নিতে অগত্যা রাজী হয়ে যাই। অবশ্য মাইনেপত্রও ভালোই ছিল।
তারপর?
মিঃ রাশেটের ভ্রমণের নেশা ছিল। কিন্তু বিদেশী ভাষা জানতেন না। দেশ বিদেশে ঘোরার ফলে আমার কিছুটা দো-ভাষীর কাজও করতে হত এবং কাজটা আমার মনের মতোই ছিল।
এইবার বলুন আপনার মনিব কেমন ছিলেন?
ম্যাককুইন কাঁধ ঝাঁকালো। তার চোখমুখ দেখলে মনে হয় বিব্রত বোধ করছে।
বেশ কঠিন সেটা বলা।
পুরো নাম কি ওঁর?
স্যামুয়েল এডওয়ার্ড রাশেট।
আমেকিান নাগরিক?
হা।
কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা?
সঠিক বলতে পারব না।
আপনি তাহলে যতটুকু জানেন তাই বলুন।
মিঃ রাশেট সম্বন্ধে আমার তেমন কিছুই জানা নেই, সত্যি কথা বলতে নিজের কথা উনি সাতকাহন করে শোনাতেন না।
কেন বলুন তো?
কি করে জানব? কিছু কিছু মানুষের জীবনে তো এরকম ঘটে পুরানো দিনের কথা ভুলতে চাইতেন উনি। ওঁর অতীত কিঞ্চিৎ লজ্জাকর।
ব্যস। আপনি কি সন্তুষ্ট ছিলেন এইরকম কিছু ঘটেছে ধরে নিয়েই।
তা নয় ঠিক।
আত্মীয়স্বজন কি ছিল ওঁর?
তেমন কারো কথা বলতে শুনিনি কখনও।
ঈষৎ কাঠিন্য গলার স্বরে আনলেন পোয়ারো।
তবুও আপনার কিছু একটা অস্পষ্ট ধারণা নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে?
হ্যাঁ, কিছুটা তা বলতে পারেন। এই যেমন ধরুন রাশেট ওঁর আসল নাম নয় আমার কেন জানি না মনে হয়। তিনি আমেরিকা ছাড়েন নির্ঘাত কোনো গোপন কারণে। কেননা তিনি দিব্যি খোশমেজাজে ছিলেন আর কয়েক সপ্তাহ আগে।
তারপর?
ভয় দেখানো উড়ো চিঠি আসতে শুরু করে ওঁর নামে।
স্বচক্ষে দেখেছেন আপনি?
হা। চিঠিপত্র লেনদেন ওঁর আমিই করতাম।
চাকরীর একটা অঙ্গ ছিল এটা। প্রথম চিঠিটা ধরুন দিন পনেরো আগে আসে।
এই চিঠিগুলি কি নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল?
না। বোধহয় আমার কাছেই খুঁজলে পাওয়া যাবে গোটা দুয়েক চিঠি। একটা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন রাগের মাথায়। লাগবে চিঠিগুলো?
বড় উপকার হয়, যদি একটু কষ্ট করে খুঁজে দেখেন। কামরা ছেড়ে ম্যাককুইন বেরিয়ে গেল। খানিক পর ফিরে এসে পোয়ারোর টেবিলে দুটো নোংরা কাগজ রাখল।
এই রকম প্রথম চিঠিটা :
আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যদিও তুমি সফল হতে পারোনি। তোমাকে আমরা খুঁজে বার করবই এবং জীবন দিয়ে তোমাকে ঋণ শোধ করতে হবে। পৃথিবীর যেখানেই থাকো না কেন রাশেট নিস্তার তোমার নেই।
সাক্ষর নেই কোনো চিঠির নিচে।
দ্বিতীয় কাগজটা ভুরু কুঁচকে পোয়ারো হাতে নিলেন।
রাশেট তোমার এবার শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। খুব শীগগিরই দেখা হবে। আমরা তোমায় ছাড়ব না।
ধীরে ধীরে চিঠিটা নামিয়ে রেখে পোয়ারো বললেন, মোটামুটি একই ধাঁচ চিঠি দুটোর। অবশ্য সম্পূর্ণ একই রকম নয় হাতের লেখাটা।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে রইল ম্যাককুইন। মিঃ ম্যাককুইন চিঠিটা একজন লোক লেখেনি। অবশ্য আপনার চোখে এত কিছু ধরা পড়বে না; এর জন্য চোখ চাই অভিজ্ঞ লোকের বললেন পোয়ারো। এক সঙ্গে দু তিনজনে মিলে লিখেছে। অনেকটা এই রকম একজন একটা লিখেছে–অন্যজন আরেকটা যাতে চট করে হাতের লেখা না চেনা যায়, সবই বড় বড় অক্ষরে একজন একটা শব্দ লিখেছে। আচ্ছা মিঃ রাশেট যে আমার সাহায্য চেয়েছিলেন তা জানেন?
আপনার সাহায্য?
এ বিষয়ে সে যে বিন্দুবিসর্গও জানেন না। ম্যাককুইনের গলার স্বরেই পরিষ্কার টের পাওয়া গেল।
পোয়ারো ঘাড় নাড়লেন।
হা ভয় পেয়েছিলেন উনি। আচ্ছা ওঁর কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বলুন তো প্রথম চিঠিখানা পেয়ে।
সেভাবে সঠিক করে কিছু বলা মুস্কিল। কিছুটা দ্বিধার সুরে বলল ম্যাককুইন। একটু হেসেছিলেন প্রথমে। কিন্তু শঙ্কিত হয়েছিলেন বেশ মনে মনে। চেঁচামেচি করে বাইরে প্রকাশ করার মানসিকতা ওঁর ছিল না।
সায় দিলেন পোয়ারো। তারপর একটা সত্যি কথা বলবেন মিঃ ম্যাককুইন, আপনি কি ধারণা পোষণ করতেন আপনার মনিব সম্বন্ধে? আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন।
হেক্টর ম্যাককুইন ভাবলো দু এক মুহূর্ত উত্তর দেবার আগে। তারপর দ্বিধাহীন গলায় বলল, আমি ওঁকে একেবারেই পছন্দ করতাম না।
কেন?
তা ঠিক বলতে পারব না। উনি আমার সঙ্গে মোটামুটি সহৃদয় ব্যবহারই করতেন কিন্তু আমি ওঁকে সত্যি কথা বলতে–ঠিক বিশ্বাস করতে পারতাম না। উনি একজন নৃশংস ভয়ঙ্কর লোক মনে হত। অবশ্য আমার এই ধারণার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না এটা স্বীকার করতেই হবে।
ধন্যবাদ মিঃ ম্যাককুইন। আর একটা কথা, আপনি শেষ কখন জীবিত অবস্থায় দেখেন মিঃ রাশেটকে।
কাল রাতে। এই ধরুন দশটা হবে। কয়েকটা জরুরী কাগজে সই করতে আমি ওঁর কামরায় গিয়েছিলাম।
কাগজ? কি সংক্রান্ত?
কিছু পুরানো কাঁচের জিনিস পারস্যে উনি কিনেছিলেন। তারই রসিদ, যে জিনিসগুলি আসলে উনি কেনেন, ভুল করে অন্য মাল পাঠানো হয়েছিল তার বদলে। আমরা বেশ খানিকক্ষণ কথা বলি সেই বিষয়ে।
এবং তখনই মিঃ রাশেটকে শেষবারের মতো জীবিত অবস্থায় আপনি দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
শেষ উড়ো চিঠিটা কবে নাগাদ পান মিঃ রাশেট আপনি কি জানেন?
কনস্তান্তিনোপোল আমরা যেদিন ছাড়ি সেইদিন সকালবেলায়।
আর একটা কথা, আপনার মনিব মিঃ রাশেটের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল মিঃ ম্যাককুইন? চোখ দুটো ঝিকিয়ে উঠল ম্যাককুইনের।
চমৎকার স্যার। এককথায় চমৎকার। বিন্দুমাত্র তিক্ততা ছিল না আমাদের সম্পর্কের মধ্যে।
একটু লিখে দিন আপনার নাম আর ঠিকানাটা।
ম্যাককুইন লিখে দিল। হেক্টর উইলার্ড ম্যাককুইন।
ঠিকানা : নিউইয়র্কের এক জায়গা।
মিঃ ম্যাককুইন আজ এই পর্যন্তই।
আপনার সঙ্গে আজ যে সমস্ত কথাবার্তা হল, এই মুহূর্তে দয়া করে প্রকাশ করবেন না বাইরে এমনকি অপনার মনিব যে নিহত হয়েছেন তাও।
ওঁর পরিচারক ম্যান্টার ম্যান তো জানবেই।
এতক্ষণে সে হয়তো জেনেও গেছে। নরম গলায় পোয়ারো বললেন, তাই যদি হয় তবে তাকেও মুখ বন্ধ করে থাকতে দয়া করে অনুরোধ জানাবেন।
কোনো অসুবিধা নেই তাতে। খাঁটি ইংরেজ তত মিশুকে নয় মোটেই কারুর সাতে পাঁচে থাকে না দিব্যি আপন মনে থাকে। তাছাড়া ওর ধারণা আমেরিকানদের সম্পর্কে বেশ নিচুমানের আর অন্য জাতের লোকেদের তো মনিষ্যি বলেই মনে করেন না।
ধন্যবাদ মিঃ ম্যাককুইন।
কি মনে হয় সবই বিশ্বাসযোগ্য, মঁসিয়ে কুক বললেন। ম্যাককুইন বাইরে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র।
ও মোটেই পছন্দ করত না মনিবটিকে সেটা স্পষ্টই বলে গেল। রাশেট যে সাহায্য চেয়েছিলেন আমার কাছে তাও ওর কাছে অজানা ছিল অবশ্য অবাক হবার কিছুই নেই এর মধ্যে কারণ রাশেট গোপনীয়তা পছন্দ করতেন।
কিছুটা উৎফুল্ল হলেন মঁসিয়ে কুক।
তাহলে আমরা অন্ততঃ একজনকে সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখতে পারি।
আমি কিন্তু সেরকম কিছুই বলিনি।
আমার পেশা সবাইকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সন্দেহ করা।
আমার বিশ্বাস এই ভদ্র সুন্দর সুদর্শন ব্যক্তিটি তার মনিব মিঃ রাশেটকে রাগের মাথায় এলোপাথাড়ি বারো চোদ্দবার ছোরা চালিয়ে নিশ্চয় খুন করেনি।
তা ঠিক। মনে হয় নির্ঘাত পাগল খুনিটা। কোনো মহিলা নয়তো কোনো লাতিন মনোবৃত্তির মানুষ ঘৃণায়, আক্রোশে হয়তো সে স্বাভাবিক মানুষ ছিল না।
.
০৭.
মৃতদেহ
পোয়ারো ডাঃ কনস্টাইনের পিছু পিছু নিহত মিঃ রাশেটের কামরায় এসে প্রবেশ করলেন। একটু আগেই কণ্ডাক্টর দরজা খুলে দিয়েছিল চাবি দিয়ে।
জিনিসপত্র কি খুব বেশি নাড়াচাড়া করা হয়েছে এ কামরার, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন।
না। সাবধানেই মৃতদেহ যথাসম্ভব পরীক্ষা করেছি।
কিছুই ছোঁয়া হয়নি।
পোয়ারো চারধারে চোখ বুলিয়ে নিলেন।
অসম্ভব ঠান্ডা কামরার ভেতরটা, হু হু করে হাওয়া ঢুকছে শার্সির ফাঁক দিয়ে। ডাক্তার হেসে বললেন, জানালাটা বন্ধ করিনি আমি ইচ্ছে করেই যেমন ছিল তেমনই আছে।
জানালাটা পরীক্ষা করলেন পোয়ারো।
জানালাটা বিভ্রান্ত করবার জন্যেই খোলা রয়েছে। কেউ বাইরেও বেরোয়নি এই পথে। যদি হত্যাকারী পালাতেও কিন্তু তুষার ঝড়ই সে আশায় বাধ সেধেছে।
জানালার ধারে পোয়ারো কিছুটা সাদা রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে দিলেন।
না। কোনো কিছুই পাওয়া গেল না, আঙুলের ছাপটাও নেই। অবশ্য আঙুলের ছাপ কারই বা পাওয়া যেতো।
আজকাল খুনীরা এই সব কাঁচা কাজ করেই না। জানালাটা বন্ধই করাই ভালো।
পোয়ারো জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে রাশেটের মৃতদেহের দিকে ঘুরে তাকালেন।
রাশেটের পরনে পায়জামা আর কুর্তা। জামার বোতামগুলো খোলা আর জায়গায় জায়গায় রক্তের কালচে ছোপ। আমি বোতামগুলো খুলেছিলাম মৃতদেহ পরীক্ষা করবার সময়, ব্যাখ্যা করলেন ডাক্তার।
সামনের দিকে ঝুঁকে পোয়ারো নীরস গলায় বললেন, ওঁকে কেউ এখানে দাঁড়িয়ে বারম্বার আঘাত করেছে, গুণে দেখেছেন কি ক্ষতস্থানের সংখ্যা কটা?
গোটা বার তো হবেই–কয়েকটা সামান্য আঁচড়ের মতো তার মধ্যে তিনটে ক্ষত সাংঘাতিক, এগুলোর মধ্যে যে কোনো একটাই মৃত্যু ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট। পোয়ারো ফিরে তাকালেন কারণ তার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল।
মৃতদেহের দিকে স্থির দৃষ্টিতে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছেন ডাক্তার।
নতুনত্ব কিছু চোখে পড়ছে ডাক্তার?
ঠিকই ধরেছেন।
ব্যাপারটা কি?
এই যে এখানে লক্ষ্য করুন ক্ষতস্থানগুলো যতটা গভীর রক্তপাত কিন্তু হয়নি ঠিক এই দুটি ক্ষতস্থানে।
অর্থাৎ?
এই আঘাতগুলো করা হয়েছিল রাশেটের মৃত্যুর পর।
কিন্তু সেটা সম্ভব কি?
পোয়ারো চিন্তান্বিতভাবে জবাব দিলেন, হত্যাকারী হয়তো নিশ্চিত ছিল না যে সে কাজটা করতে পেরেছে কিনা। সেই জন্যেই দ্বিতীয়বার ফিরে এসেছিল এটা একটা ব্যাপার হতে পারে। তবে এতে ঝুঁকি থেকে যায়। আপনার আর কিছু নজরে পড়ছে?
আর একটা কথা।
বলুন।
এই ক্ষতটা দেখুন। ডান কাঁধের কাছাকাছি ডান হাতের নিচে। এই পেন্সিলটা দিয়ে আপনি কি এই আঘাত করতে পারবেন?
উজ্জ্বল হয়ে উঠল পোয়ারোর মুখ।
একটু কষ্টসাধ্য ডান হাত দিয়ে আঘাত করাটা তবে বাঁ হাত দিয়ে করে থাকলে…
ঠিক তাই মঁসিয়ে পোয়ারো বাঁ হাত দিয়েই আঘাতটা করা হয়েছে। ডাক্তার বললেন।
অর্থাৎ আমাদের হত্যাকারী ন্যাটা। কাজটা কিন্তু তাহলে আমাদের আরও জটিল হয়ে গেল।
হা। ডান হাত দিয়েও কতকগুলো আঘাত নিশ্চিতভাবে করা হয়েছে। অর্থাৎ একজন সঙ্গী ছিল হত্যাকারীর। আচ্ছা কামরার আলো জ্বলছিল?
বলা শক্ত। কারণ সব কামরার আলো সকাল দশটায় কণ্ডাক্টর নিভিয়ে দেয়।
বোঝা যাবে সুইচগুলো দেখলে।
দুটো আলো কামরায়। বড় আলোটা কামরাটাকে পুরো আলোকিত করার জন্য, মাথার কাছে যে আলো সেটা বইপত্র পড়ার জন্য। দ্বিতীয় আলোটার মাথায় ঢাকনা আছে সেটা টানলে আড়াল পড়বে। সুইচ বন্ধ ছিল আলোটার আর ঢাকা দেওয়া ছিল দ্বিতীয় আলোটার।
প্রথম আততায়ী ফিরে যাবার সময় বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যায় তার কাজ শেষ হয়ে যাবার পর। দ্বিতীয় জন কয়েকবার মৃত দেহে আঘাত করে চুপি সারে চলে যায়। আমার মনে হয়, পোয়ারো বললেন।
চমৎকার, ডাক্তার বললেন।
খুব সন্তোষজনক ব্যাখ্যা এটাও কিন্তু আমার কাছে নয়।
পরিস্থিতিটা কিভাবে আর বোঝাতে পারবেন বলুন।
নিজের কাছে বারবার জিজ্ঞেস করছি সেই কথাই। আচ্ছা আসুন ভাবা যাক এর স্বপক্ষে আর কি কি যুক্তি খাড়া করা যায় যে হত্যাকারীরা কমপক্ষে দুজন।
সে কথা তো বোঝা যাচ্ছে ক্ষতগুলো পরীক্ষা করলেই।
সেগুলি হালকা আঁচড়ের মতো তার জন্য দৈহিক শক্তির প্রয়োজন হয়নি কিন্তু সেগুলি মাংসপেশী ভেদ করে গেছে। এমনই গভীর সেগুলোর ক্ষেত্রে দৈহিক শক্তির প্রয়োজন হয়েছে।
নিঃসন্দেহে একজন পুরুষ দায়ী গভীর ক্ষতগুলোর।
হা।
একেবারেই অক্ষম কি কোনো মহিলা এই ধরনের আঘাতের ক্ষেত্রে।
তা নয়। তবে দক্ষতা এবং তারুণ্য দরকার। আমি ডাক্তার হিসাবে বলতে পারি যে, এ কোনো মহিলার কাজ নয়। এবং এ যুক্তি সমর্থন যোগ্যও নয়।
পোয়ারো চুপ করে থাকলেন দু এক মুহূর্ত।
আপনি কি আমার কথাটা বুঝতে পারছেন? ডাক্তার উদ্বিগ্ন গলায় বললেন।
নিশ্চয়ই। কোনো মহিলার দ্বারা হালকা আঁচড়গুলো সৃষ্ট আর একজন শক্তিশালী পুরুষ রাশেটকে আঘাত করেছে ব্যাপারটা হল এই। আর একজন নিশ্চয় ন্যাটা। কি আক্কেল দেখুন মিঃ রাশেটও দিব্যি শান্তভাবে খুন হয়েছে, কোনো ধস্তাধস্তির বিন্দুমাত্র চিহ্নই নেই।
ছোট্ট স্বয়ংক্রিয় পিস্তলটা বার করলেন পোয়ারো রাশেটের বালিশের নিচে থেকে।
পিস্তলে গুলি ভরা আছে, তার মনে বিপদের আশঙ্কা ছিল দেখুন ডাক্তার।
রাশেটের দিনের বেলায় পরবার স্যুট কামরার দেওয়ালে হুকে পরিপাটিভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বাঁধানো দাঁতের পাটি একটি গ্লাসে ডোবানো। একটা খালি গ্লাস, ছাইদানী, জলের বোতল, ফ্লাক্স। ছাইদানীতে এক-একটা পোড়া সিগারেটের টুকরো। আর কয়েক টুকরো পোড়া কাগজ, দুটো ব্যবহার করা দেশলাই কাঠি। খালি গ্লাসটা নাকের কাছে আনলেন ডাক্তার।
হু এবার বোঝা যাচ্ছে কড়া ঘুমের ওষুধের জন্য রাশেট হত্যাকারীকে বাধা দেয়নি।
পোয়ারো পোড়া দেশলাই কাঠি দুটি পরীক্ষা করতে লাগলেন।
কি মশাই সূত্র মিললো? ডাক্তার উৎফুল্ল গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।
একটা সাধারণ, অন্যটা চ্যাপ্টা, কাগজের তৈরি দুটো কাঠি দু রকমের।
সাধারণত ট্রেনে এই ধরনের কাগজের কাঠি বিক্রি হয়। পোয়ারো রাশেটের জামাকাপড়ের ভেতর থেকে একটা দেশলাই পেলেন।
এটা দেখুন সাধারণ মানের। চ্যাপ্টা দেশলাই কাঠিটা নিঃসন্দেহে ওঁর নয়। ওই রকম প্যাকেট কামরায় পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখি একটু।
কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সারা কামরা খোঁজার পর তিনি একটি মেয়েদের দামী রুমাল পেলেন, তাতে রঙিন সূততা দিয়ে এককোণে লেখা আছে ইংরেজীতে H অক্ষর।
রেলকর্মচারীর সন্দেহ তাহলে ঠিকই ছিল যে এ ব্যাপারে কোনো মহিলা নিশ্চয় জড়িত, ডাক্তার বললেন।
হতেও তো পারে সেই মহিলাটি চলচ্চিত্রের গোয়েন্দা গল্পের মতো তার রুমালটা সূত্র হিসাবে ফেলে রেখে গেছেন।
তাই নাকি?
ঈষৎ ব্যাঙ্গের সুর যেন শোনাল পোয়ারোর কথায় ডাক্তারের মনে হল।
আরও একটা পাইপ ক্লিনার খুঁজে পেলেন পোয়ারো। এটা হয়তো রাশেটের সম্পত্তি, ডাক্তার বললেন।
না, রাশেটের সম্পত্তির মধ্যে পাইপ, পাউচ, বা তামাক কিছুই নেই।
এটাও একটা রহস্যের সূত্র তাহলে।
নিশ্চয়ই, সূত্রের এই আধিক্যটাই আমাকে বেশি ভাবচ্ছে। যে জিনিস পুরুষ মানুষের তিনিও কি ভুল করে ফেলে গেছেন? আচ্ছা গেল কোথায় ছোরাটা?
সেটা নিশ্চয়ই হত্যাকারী সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।
কিন্তু কেন?
রাশেটের জামার বুক পকেটে এই সোনার ঘড়িটা ছিল এটা নজরে পড়েনি এই দেখুন। ডাক্তার, মঁসিয়ে পোয়ারোকে বললেন।
ঘড়িটা একটা বেজে পনের মিনিটে বন্ধ হয়ে গেছে এবং নিশ্চয় আঘাতের ফলে কাঁচটাও ভেঙে গেছে।
একটা মোটামুটি আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে যে খুন হবার সঠিক সময়ের। রাত বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে যে কোনো সময় ঘটনাটা ঘটেছে অবশ্য আমিও বলেছিলাম।
হা হা সে তো হতেই পারে।
বোধহয় পোয়ারোর স্বরে সূক্ষ্ম বক্রোক্তি ছিল।
ফিরে তাকালেন ডাক্তার।
আমি বুঝি না মশাই আপনি কি এত ভাবেন সময় সময়।
আমিও নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
আর সেজন্যই বেশি করে ভাবাচ্ছে আমায়।
তীক্ষ দৃষ্টিতে পোয়ারো জরীপ করতে লাগলেন। এক টুকরো আধপোড়া কাগজ দেখালেন ডাক্তার।
সেটাকে খুব যত্ন করে তাকের উপর রেখে শুকনো কাপ চাপা দিয়ে রাখলেন পোয়ারো, যাতে উড়ে না যায়।
যে কোনো মহিলার একটা টুপি রাখার বাক্স খুবই প্রয়োজন বুঝলেন ডাক্তার। দাঁড়ান কণ্ডাক্টরকে ডাকি। পোয়ারো কামরার দরজা খুলে মুখ বাড়ালেন কণ্ডাক্টর গার্ড দৌড়ে এল।
এই বগিতে মহিলা কজন আছেন? জিজ্ঞাসা করলেন।
মঁসিয়ে ছজন। ঐ আমেরিকান প্রৌঢ়া, সুইডিস মহিলা। ইংরেজ তরুণী। কাউন্টেস আন্দ্ৰেসি, রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, আর তাঁর পরিচারিকা।
টুপি রাখবার বাক্স কি সবার কাছে আছে এঁদের?
হা মঁসিয়ে।
বেশ তুমি বরং … আচ্ছা ঐ সুইডিস মহিলাটির আর রাজকুমারীর পরিচারিকাটির কামরা থেকে বাক্স দুটো হাতিয়ে নিয়ে এস। যদি ধরা পড়ে যাও কিছু একটা বানিয়ে বলে দেবে।
কোনো অসুবিধেই হবে না মঁসিয়ে, কেউ ওঁদের কামরায় নেই।
তাহলে চটপট যাও।
কণ্ডাক্টর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গিয়ে বাক্স দুটো নিয়ে এল। পরিচারিকাটির বাক্সটি খুলে আবার বন্ধ করে সরিয়ে রাখলেন পোয়ারো। সুইডিস মহিলার বাক্সটি থেকে কোনো ঈঙ্গিত বস্তুর বোধহয় সাক্ষাত মিলল। ধাতব তৈরি তারের ছোট ছোট টুকরো জাল বের করলেন টুপিগুলো সাবধানে সরিয়ে।
এই দেখুন পেয়েছি। এই টুপি রাখার বাক্সগুলো পনের বছর আগে চালু ছিল। একটা পিন দিয়ে টুপিগুলো জালের উপর আটকে রাখা যায়।
দু টুকরো জাল নিপুণভাবে খুলে নিয়ে কণ্ডাক্টরের হাতে বাক্সগুলো ফেরত দিলেন।
এবার জায়গা মতো এটা রেখে এস।
আপনি বোধহয় অবাক হচ্ছেন আমার কাজের পদ্ধতি দেখে, ডাক্তারকে পোয়ারো বললেন কণ্ডাক্টর চলে যাবার পর। আসলে আমি বিশ্বাসী নই চিরাচরিত ধারায়-তাই যে কোনো অপরাধের পেছনে আমি খুঁজি মনস্তত্ব। দু-চারটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দরকার মনস্তাত্বিক জটিলতা সমাধানের জন্য। অনেক সূত্র তো সারা কামরায় আছে কোনোগুলি আসল আর কোনোগুলি জাল তা আগে জানা উচিত।
বুঝলাম না ঠিক।
আপনাকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমরা একটা মহিলার রুমাল পেয়েছি। তিনিই কি এই রুমালটা ফেলে গেছেন? নাকি কোনো পুরুষ আমাদের বিভ্রান্ত করবার জন্য একাজ করেছেন তা জানা জরুরী। আবার এও হতে পারে মহিলাটিই অপরাধী তিনি আমাদের বিভ্রান্ত করবার জন্য পাইপ ক্লিনারটা ফেলে গেছেন অর্থাৎ যাতে আমরা ভাবি এ নিশ্চয় কোনো পুরুষের কাজ। আবার এও অবাস্তব নয় যে দুজনেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তারা একটা করে সূত্র দুজনেই ফেলে রেখে যাবার মতো কি ভুল করতে পারে?
কিন্তু ঐ টুপি রাখার জালের ব্যাপারটা
ওটার কথায় পরে আসছি। রাত একটা বেজে পনেরো মিনিটে ঘড়িটি বন্ধ হয়ে গেছে দেখা যাচ্ছে। সূত্র হিসাবে এই তিনটেই যেমন একদিকে খাঁটিও হতে পারে অথবা জাল হওয়াও অসম্ভব নয়। তবে এর মধ্যে একটা সূত্র অবশ্য সঠিক, কাগজের তৈরি চ্যাপটা দেশলাই কাঠিটা কিন্তু রাশেটের নয়। বোঝাই যাচ্ছে ওটা হত্যাকারীর, এটা আবার বিশ্বাস্য। কারণ ওই টুকরো কাগজটা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল যা ছিল হত্যাকারীর পক্ষে বিপজ্জনক কোনো চিঠি। আমি আসছি দাঁড়ান।
কামরা থেকে পোয়ারো বেরিয়ে গেলেন।
একটা স্পিরিট ল্যাম্প, আর এক জোড়া সরু চিমটে নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন।
এই বুদ্ধিমান বেলজিয়ান ছোটোখাটো ফিটফাট চেহারার গোয়েন্দাটিকে ডাক্তার অবাক হয়ে দেখছিলেন।
পোয়ারো এক টুকরো জালের উপর আধপোড়া কাগজটিকে বিছিয়ে দিয়ে অন্য জালের টুকরোটা চাপা দিলেন, এরপর সাবধানে পুরো জিনিষটা চিমটে দিয়ে ধরে স্পিরিট ল্যাম্পের শিখায় ধরলেন, তারের জালগুলো লালচে হয়ে উঠল এবং একটু পরেই কয়েকটি অস্ফুট কথা ফুটে উঠল কাগজে।
মনে রেখো ছোট্ট ডেইজি আর্মষ্ট্রংয়ের কথা।
তিনি সমস্ত জিনিষগুলো টেবিলের উপর নামিয়ে রাখার পর তাকে খুব পরিতৃপ্ত দেখাল।
কিছু পেলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
নিশ্চয়ই।
পোয়ারোর চোখ দুটো উত্তেজনায় চকচক করছিল।
মৃত ব্যক্তির পরিচয় আমি জানি ডাক্তার। সে কেন আমেরিকা থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল তাও।
মিঃ রাশেটের আসল নাম কি?
কাসেট্টি।
কাসেট্টি? আমেরিকার কোনো ঘটনা কি? দাঁড়ান দাঁড়ান একটু একটু যেন মনে পড়ছে..।
হ্যাঁ।
ডাক্তার দেখছিলেন যে মিঃ রাশেটকে এই প্রথম সে বলে সম্বোধন করলেন পোয়ারো, শুধু তাই নয় আমেরিকা থেকে সে কেন পালাতে বাধ্য হয়েছিল তাও বা কেন বললেন।
মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন কিন্তু পোয়ারো।
ডাক্তার বললেন, আমায় একটা জিনিষ বুঝিয়ে দেন যদি পোয়ারো। হত্যাকারী জানালা দিয়ে না পালিয়ে পালালো তাহলে কোনো পথে? কেননা এই কামরা আর পাশের কামরা তো বন্ধ ছিল। অন্য দিক থেকে আবার করিডোর থেকে যে বেরোবার দরজা সেটাও তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
ভানুমতির খেল দেখেছেন কি ডাক্তার? সেই যে একটা লোককে হাত পা বেঁধে সিন্দুকে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া তালা চাবি এঁটে। অথচ কিছুক্ষণ পর লোকটিকে আর দেখা গেল না।
এখানেও কি সেই একই ব্যাপার।
হা। অনেকটা সেই। হত্যাকারী অন্যদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। সে যেন জানালা দিয়েই পালিয়েছে এবং অন্য পথ তার বন্ধই ছিল। একটা বুদ্ধির খেলা আছে সেটা খুব কৌশলেই আমায় ধরতে হবে। ওধার থেকে তো পাশের কামরা বন্ধই ছিল। এদিক থেকে সেটাও বন্ধ করে দিলেন পোয়ারো।
মিসেস হার্বাডের যা কৌতূহল, বুঝলেন ডাক্তার। বলা তো যায় না গোপনে অকুস্থল দেখার লোভ উনি সামলাতে পারবেন না হয়তো সেই মেয়েকে চিঠি লেখবার আগে। এবং আমি সেই হেতু ও পথ বন্ধ করে দিলাম।
আরো একবার ভালো করে দেখে নিলাম। বললেন চলুন মঁসিয়ে কুকের ওখানে যাওয়া যাক কেননা এখানে আপাতত আর কোনো কাজ নেই।
.
০৮.
আর্মষ্ট্রং পরিবারের কথা
তারপর তদন্তের কাজ কতদুর এগোল মঁসিয়ে পোয়ারো। মঁসিয়ে কুক জিজ্ঞাসা করলেন।
কুক, পোয়ারো আর ডাক্তার এই তিনজন কামরায় ছিলেন। যাত্রীদের সবাইয়ের খাওয়া দাওয়ার পর খানা কামরায় বসে সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবেন মঁসিয়ে পোয়ারো সেই রকমই বলেছেন মঁসিয়ে কুক।
মিঃ রাশেটের প্রকৃত পরিচয় জানা গেছে এবং সে কেন আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল তাও।
একটু প্রাঞ্জল করে বলবেন ব্যাপারটা।
আপনারা কাসেট্টির নাম শুনেছেন নিশ্চয়। যে আর্মষ্ট্রং নামের ফুলের মতো একটি শিশুকে হত্যা করেছিল।
দাঁড়ান দাঁড়ান। নামটা খুবই চেনা লাগছে, একটু খুলে বলুন তো।
নিহত মিঃ রাশেটের আসল নাম কাসেট্টি। কর্নেল আর্মষ্ট্রং ছিলেন ইংরাজ। তিনি ভিক্টোরিয়া ক্রস পান প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। জন্ম সূত্রে তাকে অবশ্য আধা আমেরিকানও বলা চলে। ওঁর মা ছিলেন একজন নামজাদা মার্কিন কোটিপতির মেয়ে। বিখ্যাত অভিনেত্রী লিণ্ডা আর্ডেনের মেয়েকে উনি বিয়ে করেন। ট্রাজিক চরিত্র অভিনয়ে শ্রীমতী আর্ডেনের তুলনা মেলা ভার ছিল। আমেরিকায় থাকতেন কর্নেল আর্মস্ট্রং। ডেইজি নামের একটা ফুটফুটে মেয়ে ছিল। যখন তার বয়স তিন তখন তাকে অপহরণ করা হয়। কাসেট্টি তখন দুবৃত্ত দলের নেতা ছিলেন। মোটা টাকা মুক্তিপণ হিসাবে নেওয়ার পরও ডেইজিকে আগে মারা হয়েছিল। রাশেট এরকম নৃশংস কাজ আগেও করেছে। সমাজবিরোধী কাজকর্ম করেও সে কোটিপতি হয়ে উঠে তারপর কাগজেও হৈ চৈ হয়। পরে সে আমেরিকা ছেড়ে পালায়। এখানেই কিন্তু ঘটনার শেষ নয়। মিসেস আর্মষ্ট্রং সেই সময় সন্তান সম্ভবা ছিলেন। এই আকস্মিক আঘাত সহ্য করতে না পারার দরুণ তিনি মারা যান একটি মৃত শিশুর জন্ম দিয়ে এবং কর্নেল আর্মস্ট্রং আত্মহত্যা করেন।
কুক বললেন, ওঃ কি ভয়ানক। আমারও এবার মনে পড়েছে ঐ পরিবারের বোধ হয় আরও একটা মৃত্যু…।
হ্যাঁ ডেইজির দেখাশোনা করত এক হতভাগিনী ফরাসী পুলিশ। তাকে অহেতুক সন্দেহ করার ফলে সে লজ্জায় ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছিল খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু সে ছিল সম্পূর্ণ নিরাপরাধ।
আর্মষ্ট্রং পরিবারের মৃত্যু যজ্ঞের মূল হোতা কাসেট্টি ছ মাস পরে ধরা পড়ে। এবং পুলিশের আওতা থেকে কোনোরকমে বেরিয়ে এসে আমেরিকা ছেড়ে পালায়, সেই হেতু তার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানতে পারেনি।
তাহলে দেখছি খুন হয়ে উচিত শাস্তিই সে পেয়েছে। একটা ঘৃণ্য জন্তুরও অধম, কুক বললেন।
আপনার সঙ্গে আমি একমত এ বিষয়ে। কিন্তু এত জায়গা থাকতে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে কেন?
পোয়ারো একটু হাসলেন।
এটা আমারও প্রশ্ন বন্ধু।
তবে কি অন্যদলের কেউ রেষারেষি করে ওকে খুন করল? নাকি পুরোপুরি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফসল?
অনুমান যদি সত্য হয় হত্যাকারী এই কাগজটা কেন পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল, আর্মষ্ট্রং পরিবারের উল্লেখ ছিল বলে।
কেউ কি জীবিত আছেন আর্মস্ট্রং পরিবারের?
দুঃখের বিষয় আমার তা জানা নেই। তবে কাগজে পড়েছিলাম মিসেস আর্মষ্ট্রং-এর এক বোন ছিল।
ভাঙা ঘড়িটার কথা উঠতেই কুক বললেন, তাহলে তো খুনের সঠিক সময়টা জানা হয়ে গেল।
হা। সময়টা সঠিক বলেই মনে হচ্ছে। একটু চিন্তান্বিত গলায় পোয়ারো বললেন।
তার কথা বলার ভঙ্গিতে একটা এমন কিছু ছিল, যে অন্য দুজন চমকে তাকালেন।
রাত একটা বাজতে কুড়ি মিনিটে রাশেট ওরফে কাসেট্টি জীবিত ছিলেন আপনি বলেছেন কারণ তার সঙ্গে কণ্ডাক্টর কথা বলছিল।
একটা বাজতে তেইশ মিনিট তখন।
অর্থাৎ বারোটা সাঁইত্রিশেও জীবিত ছিল। এটা তো আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
পোয়ারো কোনো উত্তর দিলেন না। দরজায় মৃদু টোকা পড়ল, একজন রেল কর্মচারী খবর দিল যে পোয়ারো ইচ্ছে করলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন যাত্রীদের। মঁসিয়ে কুক উঠে দাঁড়ালেন।
চলুন যাওয়া যাক।
আমিও আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি, বললেন ডাক্তার।
নিশ্চয়। অবশ্য মঁসিয়ে পোয়ারো যদি আপত্তি না করেন।
কিছুমাত্র না আপনিও চলুন।
তিনজন এগিয়ে গেলেন খানাকামরার দিকে।