১. পৌষ মাসের এই সকালবেলায়

ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

বৃত্তান্ত কথা

ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত ভিন্ন নামে আনন্দমেলায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। নানা কারণে উপন্যাসটি আমি প্রকাশ করতে অনুমতি দিইনি কাউকেই। মনে হয়েছিল, বেশ কিছু পরিবর্তন করা দরকার। এখন দেখছি, সংস্কার করতে হলে পুরো উপন্যাসটিই নতুন করে লিখতে হয়। আর তাই যদি হয় তাহলে পুরোনো উপন্যাসটি তার মূল রূপে প্রকাশ পেলে ক্ষতি কিছু নেই। ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত তাই দু-হাজার এগারোর কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হল। এর জটিল কাহিনি ও বিস্তার কার কেমন লাগবে, কে জানে!

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩০ ডিসেম্বর ২০১০

.

পৌষ মাসের এই সকালবেলায় ময়নাগড়ে অখণ্ড ৫। শান্তি বিরাজ করছে। রোদ এখনও ভালো করে ওঠেনি, চারদিকে বেশ জম্পেশ কুয়াশাও জমে আছে। রাঙা রোদ অবশ্য কুয়াশাকে হুড়ো দিয়ে তাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তাই একটু-একটু রাঙা আলো ফুটে উঠছে চারধারে। আর সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে পশুপতিবাবু তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁতন করছেন। এই দাঁতন করার সময়টায় তার মুখে একটা স্বর্গীয় আনন্দ ফুটে ওঠে। তিনি লোককে প্রায়ই বলেন, দাঁতন করার সময় আমার ভারী একটা দিব্যভাব আসে। মনে হয় যেন বাতাসের উপর হাঁটছি, অনেক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি, অনেক অলৌকিক শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

একটু পশ্চিমধারে নিজেদের বাড়ির উঠোনে গদাধর এইমাত্র পাঁচশো ডন শেষ করে পাঁচশো বৈঠক দিতে শুরু করেছে। তার হুপহাপ শব্দে বাতাস কাঁপছে। গদাধরও বলে, ডন-বৈঠক-মুগুর ভাজার সময় সে নাকি আর গদাধর থাকে না। তার শরীরে নাকি অন্য কিছু একটার ভর হয়। বাহ্য চৈতন্য থাকে না বলেই বোধহয় মাসখানেক আগে এক ভোরবেলায় চোর এসে তার সাইকেলখানা চোখের উপর দিয়েই চুরি করে নিয়ে গেল। গদাধর দেখেও দেখতে পায়নি।

থানার সেপাই রামশরণ হনুমানজির মন্দিরে পুজো চড়িয়ে ভজন গাইছে। মন্দিরটা অবশ্য একেবারেই বেঁটে বক্কেশর। মাত্র হাততিনেক উঁচু, বড়জোর দু-হাত লম্বা আর আড়াই হাত চওড়া। ভিতরে অঙ্গুষ্ঠপ্রমাণ একটা মূর্তিও আছে। তবে তেল-সিঁদুর, শ্যাওলা আর ময়লায় মূর্তির মুখ চোখ কিছু বোঝবার উপায় নেই। কিন্তু রামশরণ রোজ সকালে বিভোর হয়ে বেসুরো গলায় ভজন গেয়ে তার ভক্তি নিবেদন করে। হনুমানজির উপর তার ভক্তির কারণ আছে। সময়টা রামশরণের খারাপ যাচ্ছে। তার মোষটাকে নিধুবাবু খোঁয়াড়ে দিয়েছেন, তার ছেলে শিউশরণ এবার নিয়ে তিনবার ক্লাস সিক্সে ফেল মেরেছে। হেড কনস্টেবল হরিপদ সামনের মাসে রিটায়ার হওয়ার পর ওই পোস্টে রামশরণের যাওয়ার কথা, কিন্তু শোনা যাচ্ছে, ষষ্ঠীচরণকেই নাকি ওই পোস্টে বড়বাবু রেকমেন্ড করেছেন।

জীবনের উপর ঘেন্না ধরে যাওয়ায় পাঁচু কয়েকবারই অন্য মানুষ হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তাতে যে একটুআধটু কাজ হয়নি তাও নয়। পুরোনো পাঁচু কিছুতেই তার পাছু ছাড়ে না। সে হয়তো একদিন সকালে ঠিক করল, আজ থেকে সে নন্দগোপাল হয়ে যাবে। ব্যস, সেদিন সকাল থেকেই সে প্রাণপণে নন্দগোপাল হতে চেষ্টা করতে লাগল।

তবে নন্দগোপাল হওয়া খুব সোজা কাজ তো নয়। নন্দগোপাল হচ্ছে ভারী বিনয়ী লোক। এত বিনয়ী যে, যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই হাত কচলে, গ্যালগ্যালে হেসে বিনয়বচন আওড়াতে থাকে, আমি আপনার পায়ের ধুলোরও যুগ্যি নই, আপনার গোয়ালের গোরুটার চেয়েও আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন, আপনার বাড়ির পাপোষটার মর্যাদাও আমার চেয়ে বেশি, বড় হতভাগা আমি, বড়ই অকিঞ্চন, মাঝে-মাঝে আমাকে জুতোপেটা করবেন তো ভাই!

তা পাঁচুও ওইসব বলে বেড়াতে লাগল। একদিন নরহরি ঘোষ তার বিনয়বচন খুব মন দিয়ে শুনে বলল, হ্যাঁ রে পাঁচু, নন্দগোপাল কি মারা গেছে? কই, মারা গিয়ে থাকলে তার শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন পেলুম না তো!

জিভ কেটে পাঁচু বলে, না না, ছিঃ ছিঃ, তিনি মরবেন কেন?

নরহরি তখন ভাবিত হয়ে বলে, না মরলে তার ভূত তোর ঘাড়ে ভর করল কি করে? বিজ্ঞান তো শিখলি না। বিজ্ঞানে পরিষ্কার বলা আছে, কেউ না মরলে ভূত হওয়ার জো নেই। জ্যান্ত মানুষের ভূত বলে বিজ্ঞান কিছু স্বীকারও করে না কিনা! অথচ দেখছি নন্দগোপালের ভূত দিব্যি তোর ঘাড়ে চেপে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে।

পাঁচু মাথা চুলকে বলল, ভূত-প্রেতের ব্যাপার নয় আজ্ঞে। নন্দগোপালবাবু বড্ড ভালো লোক তো, তাই একটু সেরকম হওয়ার চেষ্টা করছিলাম আর কি।

রাম রাম। নন্দগোপাল হতে চায় আহাম্মকেরা। সবসময় গ্যালগ্যালে ভাব নিয়ে থাকলে কেউ পোঁছে না। দেখিস না, নন্দ রাস্তায় বেরোলে পাড়ার ছেলেরা ওর পিছনে লাগে, হাততালি দিয়ে ছড়া কেটে খ্যাপায়। যদি মানুষের মতো মানুষ হতে চাস, তবে আমার মতো হ। লোকে আমাকে বিশ্বনিন্দুক বলে বটে, আসলে আমি মানুষের দোষ মোটে সইতে পারি না। লোকে আমাকে তো ঝগড়ুটেও বলে, আসলে কি আমি তাই? তবে হ্যাঁ, আমি উচিত কথা বলতেও কাউকে ছাড়ি না। লোকে আমাকে হিংসে করে কিপটেও তো বলে! তাই বলে কি আমি কিপটে হয়ে গেছি নাকি? এই তো আজ সকালেই ফুটকড়াই দিয়ে জলখাবার খেয়েছি। মিতব্যায়ী আর কৃপণ কি এক হল? সবদিক বিচার করে দেখেছি রে বাপু, আমার মতো লোক হয় না।

যে আজ্ঞে!

মুখে যাই বলুক, পাঁচু নরহরি ঘোষ হওয়ার চেষ্টা করেনি। নরহরির নাম নিলে নাকি হাঁড়ি ফাটে। তবে কিছুদিন পাঁচু শ্রীপদ হওয়ার চেষ্টা করেছিল বটে। শ্রীপদ হল গাঁয়ের লিডার, সবাই তাকে ভারী খাতির করে।

বক্তৃতায় তার খুব নামডাক। শ্রীপদর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনে লোকের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, মাথায় খুন চেপে যায়, আস্তিন গুটোতে থাকে। তার আবেগপূর্ণ ভাষণে লোকে ভেউ-ভেউ করে কাঁদে। দেশের অধঃপতন নিয়ে তার বক্তৃতার সময় সভায় সমবেত ছিঃ ছিঃ শোনা যায়। শ্রীপদর মুখ সর্বদাই গম্ভীর এবং চিন্তাকুল। এলেবেলে লোকের সঙ্গে সে কথাই কয় না। নিতান্ত মান্যগণ্যদের সঙ্গেও সে বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা কয়। সবাই বলে, শ্রীপদর নাকি খুব ব্যক্তিত্ব। পায়জামা আর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা শ্রীপদ কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ নিয়ে যখন রাস্তায় বেরোয়, তখন সর্বদাই তার সঙ্গে পনেরো-বিশজন মোসাহেব হেঁ-হেঁ করতে করতে পিছু নেয়। দৃশ্যটা দেখলেই বুক ভরে যায়।

তবে অসুবিধেও আছে। পাঁচুর পায়জামা আর পাঞ্জাবি নেই, মোসাহেবও নেই। বক্তৃতাও সে কস্মিনকালে করেনি। তবে শ্রীপদ হওয়ার জন্য সে নির্জন মাঠে-ঘাটে গিয়ে একা একাই বক্তৃতা প্র্যাকটিস করতে লাগল। কাজ শক্ত নয়, কিছু কিছু কথা শোনাই ছিল।

তারপর পাশের গাঁ বৃন্দাবনঘাঁটিতে হাটবারে গিয়ে জনসমক্ষে তেলেভাজাওয়ালা বিরিঞ্চিপদর নড়বড়ে টুলটার উপর দাঁড়িয়ে ঠিক শ্রীপদর মতো গলা করে বন্ধুগণ… বলে বক্তৃতা শুরু করে দিল। বক্তৃতা হচ্ছে শুনে অনেকেই বিকিকিনি থামিয়ে ভিড়ও করে ফেলল বেশ। পাঁচু দেশের দুর্নীতি, দুর্গতি, অবনতি নিয়ে বেশ গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল বটে। কিন্তু সভায় একটু হাসি আর হুল্লোড়ও শোনা যাচ্ছিল। তার কারণ, পাঁচুর পরনে নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর গায়ে খাকি রঙের সেই পুরোনো শার্টখানা।

তা প্রথমবার আধঘণ্টাটাক বলেছিল বটে পাঁচু। বক্তৃতার শেষটায় একটু গন্ডগোল হল। বিরিঞ্চিপদ তাকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে নিজের টুলখানা নিয়ে যাওয়ায় ভারী অপ্রস্তুত হল পাঁচু। তবে লোকে যথারীতি হাততালি দিয়েছিল। আর আদর্শ বিদ্যাপীঠের বাংলার মাস্টারমশাই বলাইবাবু এসে বললেন, ওরে, বক্তিমে তো দিলি, কিন্তু তোর যে ব্যাকরণের জ্ঞানই নেই। একান্নটা ভুল শব্দ বলেছিস, ক্রিয়াপদ আর উচ্চারণের দোষ ধরলে তো অগুনতি!

তা দু-চারটে এরকম ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও তার প্রথম বক্তৃতাটা যে উতরে গেছে তা ভেবে পাঁচু বেশ খুশিই হল। এরকম কয়েকবার প্র্যাকটিস করলেই পাঁচুকে নিয়ে হইচই পড়ে যাবে। তখন আর পাঁচুকে পায় কে?

কিন্তু কপালটাই তার খারাপ। পরদিনই দুপুরবেলায় শ্রীপদর দুই চেলা মাধব আর কেলো এসে তাকে ধরল, অ্যাই, তুই নাকি বৃন্দাবনঘাঁটিতে হাটের মাঝখানে শ্রীপদদাকে ভেঙিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিস? আঁ, শ্রীপদদাকে নিয়ে ক্যারিকেচার! এত বড় সাহস!

তারপর সে কি মার রে বাপ! সারা শরীরে যেন একেবারে তবলালহরা বাজিয়ে গেল। মারের চোটে দিনসাতেক বিছানায় পড়ে থাকতে হল তাকে, তার ঘাড় থেকে শ্রীপদর ভূতও নেমে গিয়েছিল।

ইদানীং সে মন্মথ ভট্টাচার্য হওয়ার চেষ্টায় আছে। মন্মথবাবু অবশ্য বিদ্বান মানুষ। বিপিনচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলের হেডস্যার ছিলেন। সোজা সটান চেহারা, দিব্যি স্বাস্থ্য, গম্ভীর, কম কথার মানুষ, সবাই তাকে খুব শ্রদ্ধাভক্তি করে। গায়ে কোনও সভাসমিতি হলে মন্মথবাবু বাঁধা সভাপতি। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, কিংবা রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল-ক্ষুদিরাম-নেতাজিসন্ধ্যা, রক্তদান শিবির, শারদীয়া দুর্গোৎসবের শুভ উদ্বোধন কিংবা দ্বারোদঘাটনে মন্মথবাবুকে ছাড়া ভাবাই যায় না। তবে মন্মথবাবুর বক্তৃতাগুলো সাপটে ওঠা কঠিন। মরমী কবি রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি নজরুল, ক্ষুদিরামের আত্মদান, নেতাজির অন্তর্ধান, এসব বিষয়ে পাঁচুর তেমন ভাবটাব আসে না। তাই ও চেষ্টা সে করেনি। আপাতত সে শুধু সকাল আর বিকেলে মন্মথবাবুর প্রাতভ্রমণ আর সান্ধ্যভ্রমণটি নকল করার চেষ্টা করছে। মন্মথবাবুর ডান হাতে রুপোর বাঁধানো লাঠি, বাঁ-হাতে ধুতির কোচা, গায়ে গলাবন্ধ কোট, পায়ে মোজা আর পাম্পশু। ঘাড় উঁচু, পিঠ সোজা। হাঁটেন যেন গুলতি থেকে ছিটকে-যাওয়া গুডু লের মতো। এই এখন আছেন তো পরক্ষণেই ওই হোথা চলে গেছেন। কদিন ধরে মন্মথবাবুর পিছু নিয়ে হাঁটতে গিয়ে হেঁদিয়ে পড়েছে পাঁচু। তাও ভাগ্যিস, হাফপ্যান্টের কেঁচা হয় না, আর লাঠিও পাঁচু এখনও জোগাড় করে উঠতে পারেনি, পাম্পশুও তার নেই, তার পায়ে ছেঁড়া হাওয়াই চপ্পল।

এই সাতসকালে মন্মথবাবুর পিছু নিয়ে একটু দূর থেকে পাঁচু প্রায় দৌড়পায়ে আসছিল। বজরঙ্গবলীর মন্দির অবধি এসে আর পারল না। হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে লাগল। উদ্ধববাবু সেই অন্ধকার থাকতে সাতসকালে বাজার করতে বেরিয়েছেন। অত সকালে না বেরোলে তাঁর বাজারে পৌঁছতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। এই সকালে বেরিয়েও বেলা বারোটার আগে প্রায় কোনওদিনই বাজারে পৌঁছতে পারেন না। বাজার যে তার বাড়ি থেকে অনেক দূর তাও নয়। বিষ্ণুপদ কানুনগো মেপে দেখেছেন উদ্ধববাবুর বাড়ি থেকে বাজারের দূরত্ব মোট সাতশো সত্তর গজ। অর্থাৎ আধ মাইলের মতো। তবু যে ভোর সাড়েচারটেয় বেরিয়ে তিনি বেলা বারোটা নাগাদ বাজারে পৌঁছন, তার কারণ হল, রাস্তায় যত লোকের সঙ্গে দেখা হয়, দুপাশে যত বাড়ি আছে সকলেরই কুশল সংবাদ নেওয়া, নানা বিষয়ে দু-চারটে কথা কওয়া, কোন-কোন গাছে কেমন ফুল বা ফল হচ্ছে তার খতেন নেওয়া, নেড়ি কুকুর, হুলো বেড়াল, পোপাষা পাখিদের সম্পর্কেও খোঁজখবর করা তো আছেই। তা ছাড়া, কখনও হয়তো বিদ্যাচরণের সঙ্গে একহাত দাবা খেলে নিলেন, হাই স্কুলের মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে দেখে মাঠে নেমে একটু খাটান দিলেন, মহেশগয়লা দুধ দুইছে দেখে দাঁড়িয়ে খানিক দুধের ফেনার শুভ্রতা দেখে মুগ্ধ হলেন, আর এইসব করতে গিয়েই দেরিটা হয়ে যায়। তার বউ বলে-বলে হয়রান হয়ে এখন অন্য বন্দোবস্ত করেছেন। বাজারের ব্যাপারিরা মাছ আর আনাজ তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে পয়সা নিয়ে যায়। উদ্ধববাবু বাজার না করলেও বাড়ির চলে যায়। কিন্তু বাজার না করে উদ্ধববাবু মোটেই থাকতে পারেন না, তা হলে বড় আইঢাই হয়।

আজও উদ্ধববাবু সাতসকালেই বেরিয়েছেন বটে। সাড়েচারটেয় বেরিয়ে এই সকাল ছটা নাগাদ বাড়ি থেকে মোট একশো গজ আসতে পেরেছেন। সাতজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়েছে, পরেশবাবুর বাড়িতে চা আর বিস্কুট খেয়েছেন। নরেশবাবুর বাড়িতে চারখানা নারকেলের নাড়ু আর জল, খগেনবাবুর বাড়িতে মাখন-টোস্ট দিয়ে এক কাপ কফি আর রমেশবাবুর বাড়িতে দু-গেলাস খেজুরের রস। আরও হবে, পথ এখনও মেলা বাকি।

সাতুবাবুর লাল গাইটার কাল পেট খারাপ করেছিল। তারও একটু খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন উদ্ধববাবু। দেখলেন, গাই ভালো আছে। সাতুবাবু সেই গোরুর এক গেলাস দুধও খাওয়ালেন তাঁকে। দুধ খেয়ে তেঁতুলতলার পথ ধরে বড় সড়কের দিকে এগোচ্ছিলেন উদ্ধববাবু। সকালবেলায় আজ খাওয়াদাওয়াটা বেশ হয়েছে। মনটা খুশি খুশি লাগছে। তেঁতুলতলার পথটা ভারী নির্জন আর জংলা, রাস্তা বলতে একটা সরু মেটে পথ, দু-ধারে আগাছা আর কাটাঝোঁপের জঙ্গল। দুটো কয়েতবেলের গাছ আছে বা ধারটায়। কদিন আগেও দেখেছেন প্রচুর কচি কয়েতবেল ফলেছে। এখন একটাও নেই। গাঁয়ের পাজি ছেলেগুলো ফলপাকুড় মোটে পাকতেই দেয় না। ধীরেসুস্থে চারদিক দেখতে-দেখতে, আর সকালবেলার মিঠে রাঙা রোদ আর চারদিককার দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে করতে উদ্ধববাবু সড়কের দিকে মোড় ঘুরেই দেখতে পেলেন, বটতলার ছায়ায় একটা ভারী ঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে একটা ঢোলা পাতলুন গোছের জিনিস, গায়ের কামিজটাও বেজায় ঢলঢলে। দুটোর রংই নীল। মাথায় একটা গোলমতো টুপিও আছে, তবে গায়ে গরম জামা নেই। উদ্ধববাবু লোকটাকে চিনতে পারলেন না। এরকম ঢ্যাঙা কোনও লোকের সঙ্গে তার পরিচয় নেই।

তবে লোকটাকে দেখে খুশিই হলেন উদ্ধববাবু। নতুন লোকের সঙ্গে কথা কয়ে আরাম আছে। কত কী জানা যায়।

মুখোমুখি হতেই দেখতে পেলেন, লোকটা বেশ ফরসা, মুখ-চোখ বেশ ভালো, চিনেদের মতো ঝোলা গোঁফ আছে। আর ডান বগলে একটা বড়সড়ো পোঁটলা আর বাঁ-কাঁধ থেকে একটা ছোট ঢোলের মতো জিনিস দড়িতে ঝুলছে। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়।

উদ্ধববাবু একগাল হেসে বললেন, এ গাঁয়ে নতুন বুঝি?

ছোঁকরা একটু ফচকে হাসি হেসে বলল, তা একরকম নতুনই বলতে পারেন। তবে এককালে আমার ময়নাগড়ে যাতায়াত ছিল।

বটে! তা হলে তো তুমি এ গাঁয়ের পুরোনোলোকই বটে। বাবার নাম কী বলো তো? কোন পাড়ায় বাড়ি? কাঁদের ছেলে তুমি?

ছোঁকরা তেমনই ফচকে হাসি হেসে বলল, আন্দাজ করুন তো!

উদ্ধববাবু বললেন, দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। মুখটা বড্ড চেনা-চেনা ঠেকছে! আচ্ছা, তুমি মদন পোদ্দারের ভাগ্নে নও তো? এইটুকুন দেখেছি। ছেলেবেলায় বড্ড বাঁদর ছিলে বাবা। গাছ বাওয়া, ফল-পাকুড় চুরি করা, ঢিল মারা, মারপিট করা, পড়াশুনোয় ফাঁকি, কোন গুণটা না ছিল তোমার! তবে আমি কিন্তু বরাবর মদনকে বলে এসেছি, ওরে মদন, যারা ছেলেবেলায় দুষ্ট থাকে, তারা বড় হয়ে কেষ্টবিষ্টু হয়ে দাঁড়ায়। দেখিস, এ ছেলে এলেবেলে নয়, জজ-ব্যারিস্টার না হয় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবেই। তা বাপু, এখন কী করাটরা হয়?

ছোঁকরা ভারী সপ্রসংশ চোখে উদ্ধববাবুকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বলল, আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই! আমার সম্পর্কে আপনার অনুমান তো প্রায় মিলেই গেছে দেখছি! বাঃ!

উদ্ধববাবু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, মিলবে না! লোকে তো পঞ্চমুখে বলে, হা উদ্ধবের চোখ আছে বটে, একবার যা দেখে তা বিশ-পঁচিশ বছরেও ভুল হওয়ার জো নেই।

তাই দেখছি।

তা মদনের বাড়িতে উঠেছ তো!

আজ্ঞে না।

কেন বলোত! মামার সঙ্গে কি বনিবনা হচ্ছে না? নাকি মামি হুড়ো দিচ্ছে! মদনের বউটা অবশ্য একটু কুঁদুলে আছে।

মামার বাড়িতে যে উঠিনি তার কারণ আপনি ঠিকই ধরেছেন। বনিবনা নেই। আর মামির ব্যাপারেও বোধহয় আপনি খুব একটা ভুল বলেননি। তবে তৃতীয় আর-একটা কারণ আছে।

উদ্ভববাবু সাগ্রহে গলাটা খাটো করে বললেন, কী কারণ বলো তো বাপু। ভয় নেই, আমি পাঁচকান করব না।

কথা দিলেন তো?

মা কালীর দিব্যি।

তা হলে চুপিচুপি বলি। কারণটা হল, মদন তপাদার আমার মামা নন।

আঁ! তবে যে মদন তোমাকে ভাগ্নে বলে পরিচয় দিত! সেটা কি তবে মিথ্যে কথা? কাজটা তো মোটেই ঠিক করেনি মদন!

ছোঁকরা ফের একটা ফিচকে হাসি হেসে বলল, মদন তপাদারকে মোটেই বিশ্বাস করবেন না মশাই। যাকে-তাকে ভাগ্নে বলে চালিয়ে দেন।

উদ্ধববাবু সাগ্রহে বললেন, আর কাকে ভাগ্নে বলে চালিয়েছে বলো তো!

ছেলেটা ভালমানুষের মতো বলল, তা অবশ্য আমি জানি না। কারণ, আমি মদন তপাদারকে চিনি না, কস্মিনকালেও দেখিনি। উদ্ধববাবু চোখ বড়-বড় করে বললেন, দ্যাখোনি! অ, তা হলে তুমি মদনের সেই ভাগ্নে নও বোধহয়।

আজ্ঞে না। তবে আপনার অনুমান খুব কাছাকাছি গেছে। মদন তপাদার না হলেও আমি কারও-না কারও ভাগ্নে তো বটে।

তা, সেটা আগে বলতে হয়। তবে তোমার মুখোনা বড় চেনা-চেনা ঠেকছে হে। কোথায় যেন দেখেছি! আচ্ছা, তুমি নিমাইচাঁদের সেই নিরুদ্দেশ নাতি শিবাদ নও তো! আহা, শিবচাঁদ বড় ভালো ছেলে ছিল। সাত-পাঁচে নেই, সাত চড়ে রা কাড়ে না, সাত-সতেরোয় থাকে না, সাতকাহন গল্প ফেঁদে বসে না, সপ্তগ্রামে গলা তুলে চেঁচায় না, আর তাকেই কিনা সাতঘাটের জল খাইয়ে ছাড়লে সাতকড়ি সরখেল। কী না সরখেলের বাবাকেলে পকেটঘড়িটা চুরি গেছে। ওরে বাবা, ঘড়ি কার না চুরি যায়! দুনিয়ায় কি ঘড়িচোরের অভাব আছে! তা সাতকড়ির সন্দেহ গিয়ে পড়ল শিবচাঁদের উপর। কেন, না শিবচন্দ্র নাকি দুপুরে গোবর কুড়োতে এসে সাতকড়িকে টাইম জিগ্যেস করেছিল। সুতরাং সাতকড়ির মনে হয়েছে, ও ঘড়ি শিবু ছাড়া আর কেউ সরায়নি। থানা-পুলিশ করে শিবুকে কী হেনস্থাটাই করল সাতকড়ি। সেই দুঃখেই ছেলেটা বিবাগী হয়ে গিয়েছিল। যাক বাবা, এতদিন পর যে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছ, দেখেই ভারী আনন্দ হচ্ছে হে শিবু। তা আর কোনও চুরির মামলায় ফেঁসে যাওনি তো বাবা! দাদুর সঙ্গে দেখা করেছ তো! সেই নাক, সেই মুখ, সেই চোখ, ঠিক আগের মতোই আছ বাবা শিবু। তবে সেই শিবু ছিল বেঁটে, তুমি একটু লম্বা। শিবুর গায়ের রং ছিল কালো, তুমি অবশ্য ফরসাই। শিবুর চুল ছিল সটান, তোমার টুপির ধার দিয়ে যা দেখছি তাতে চুল কোঁকড়া বলেই মনে হচ্ছে। তা হোক, তা হোক, অত ধরতে নেই। দু-চারটে জিনিস না মিললে তুমিই যে আমাদের শিবু তাতে সন্দেহের অবকাশই নেই।

ছোঁকরা চোখ নাক কুঁচকে বলল, এবারের অনুমানটাও বড় কাছাকাছি এসে গেছে মশাই। আপনার দেখার চোখ আছে বটে! দিব্যদৃষ্টি কি একেই বলে!

হেঁ-হেঁ, কী যে বলো শিবু। ওইটেই আমার দোষও বটে, গুণও বটে। মুখ দেখে পেটের কথা ধরে ফেলতে পারি বলেই অনেকে যেমন আমার সুখ্যাতি করে। তেমনই আবার কারও কারও আঁতেও লাগে। এই তো সেদিন রামগোপাল বটতলায় মুখোনা শুকনো করে বসে ভাবছিল। আমি সটান গিয়ে তাকে বললুম, কী রে রেমো, তোর বউয়ের সঙ্গে আজ ঝগড়া হয়েছে তো! রেমো তো অবাক। বলল, কী করে বুঝলেন দাদা! দিন, পায়ের ধুলো দিন। তা হলে সব ঠিকঠাকই বলেছি তো শিবু? ভুল করিনি তো?

ছোঁকরা সবেগে মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে না, ভুল হওয়ার জো-ই নেই। শুনতে-শুনতে এখন তো নিজেকে আমার শিবু বলেই মনে হচ্ছে। নিজের গা থেকে আমি একটা শিবু শিবু গন্ধও পাচ্ছি।

উদ্ধববাবু হাঁ করে একটু চেয়ে থেকে বললেন, তা হলে কি তুমি বলতে চাও যে, তুমি শিবু নও? আপত্তি থাকলে আমি চাপাচাপি করব না। ঘড়িচোরের বদনাম ঘাড়ে নিয়ে শিবু হতে কারই বা ইচ্ছে থাকে। বলি, পরান মণ্ডলের মেজো ছেলে প্রাণকৃষ্ণ কি না জিগ্যেস করলেও তুমি হয়তো বলে বসবে, প্রাণকৃষ্ণকেও তুমি চেনো না। তা প্রাণকৃষ্ণ তো আর ঘড়ি চুরি করেনি। দোষের মধ্যে তার একটু থিয়েটার করার শখ ছিল। চেহারাখানাও বেশ নাদুসনুদুস। শেষে মুম্বই গিয়ে জুটেছিল সিনেমায় নামবে বলে। ইদিকে আমরা গাঁসুন্ধু লোক সিনেমার পরদায় তার দেখা পাব বলে আশপাশের শহরে গিয়ে রাজ্যের হিন্দি সিনেমা দেখতে লাগলাম। কোনওটাতেই প্রাণকৃষ্ণ নেই। মুরগিহাটার কুশচন্দ্র অবশ্য বলেছিল, কোনও একটা সিনেমায় নাকি নারদের রোলে এক মিনিটের জন্য তাকে দেখিয়েছে। তবে নারদের যা বিচ্ছিরি দাড়িগোঁফ, তাতে কুশচন্দ্রের ভুলও হতে পারে। ফরসাগঞ্জের ফটিক খুব জোর দিয়ে বলেছিল, সে নাকি প্রাণকৃষ্ণকে পিয়াস লাগি ছবিতে একটা চাকরের পার্ট করতে দেখেছে। সিনেমায় প্রাণকৃষ্ণের নাম হয়েছে প্রাণকুমার। কিন্তু ফটিক দিনেদুপুরে মিথ্যে কথা বলে। তা সে যাই হোক, প্রাণকৃষ্ণের কোনও খবর সেই থেকে আর পাওয়া যায়নি। তোমাকে দেখে আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে, আমাদের সেই প্রাণকৃষ্ণই ফিরে এল কি না! কী হে বাপু, শুনে যে মুখোনা একেবারে শুকিয়ে গেল! ওরে বাপু, ঘাবড়ানোর কী আছে? সত্যি কথাটা যদি বলেই ফ্যালো, তা হলে তো আর আমি লোককে বলে বেড়াব না। আমরাও তো জানি ফিল্মস্টারদের কত হ্যাপা সামলাতে হয়। অটোগ্রাফ দাও রে, সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে ফোটো তোলো রে, এ পেন্নাম করে তো ও ছুঁয়ে দ্যাখে, রক্তমাংসের মানুষ কি না। তা বাপু, তোমার কোনও ভয় নেই, তুমি যে ফিল্মস্টার তা কাকপক্ষীতেও জানবে না। কথা দিচ্ছি। আমাদের সেই প্রাণকৃষ্ণ এত বড় কেউকেটা হয়েছে, এ তো তল্লাটের মস্ত গৌরব!

ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ধরে যখন ফেলেছেনই, তখন লুকিয়ে আর কী লাভ খুডোমশাই। আপনার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার এলেম আমার নেই। তবে কিনা আমাকে ফিল্মস্টার বলাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। প্রাণকৃষ্ণ বলুন, আপনি গুরুজন, মাথা পেতে মেনে নেব। কিন্তু ফিল্মস্টার বললে আসল ফিল্মস্টাররা ভারী অপমান বোধ করবেন!

বটে! তা হলে কি তুমি ফিল্মস্টার হতে পারোনি হে প্রাণকৃষ্ণ?

আজ্ঞে না।

কুলাঙ্গার! কুলাঙ্গার! আমরা হাপিত্যেশ করে এতকাল বসে রইলাম তোমাকে সিনেমায় দেখব বলে, তা সেটা পেরে উঠলে না? ছিঃ ছিঃ, লোকের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে?

আজ্ঞে, সেই জন্যই তো আড়ালে আবডালে মুখ লুকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

অপদার্থ আর কাকে বলে! ওরে আহাম্মক, ফিল্মস্টার হতে কী এমন হাতিঘোড়া লাগে বল তো! ক্যামেরার সামনে একটু নাচগান, একটু ফাঁইট আর ডায়লগ হাঁকড়ে যাওয়া। এও পেরে উঠলে না?

ছেলেটা ভারী কাচুমাচু হয়ে বলে, সবার কি সব হয় খুডোমশাই? ফিল্মস্টার হতে পারিনি, প্রাণকৃষ্ণও হতে পারব কি না জানি না। প্রাণকৃষ্ণ হতে চাইলেই তো হবে না, প্রাণকৃষ্ণ এবং তার বাবা-মা, তস্য আত্মীস্বজন ও বন্ধুবান্ধবাদি নানারকম আপত্তি তুলতেই পারে। থানা-পুলিশ হওয়াও সম্ভব। ভেবে দেখুন, এত সব ফ্যাকড়ায় আপনিও জড়িয়ে পড়তে চান কি না।

উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, প্রাণকৃষ্ণ না হয় নাই হলে, তা বলে তুমি লোকটা আসলে কে, তাও তো জানা দরকার হে! গায়ে একটা উটকো লোক হঠাৎ

উদয় হলে চারদিকে একটা কানাকানি, ফিসফাস শুরু হবে না? চাই কী, দাঙ্গাহাঙ্গামাও বেধে যেতে পারে। এই তো বছরতিনেক আগে এক মস্ত জটাজুটধারী সাধু এসে থানা গেড়েছিল বটতলায়, সঙ্গে গুটিদুই চেলা। পরে শোনা গেল, সে নাকি স্পাই। দিনকাল তো ভাল নয় হে। তাই বলছি, ঝেড়ে কেশে ফ্যালো। তোমাকে আমার বড় চেনা-চেনা ঠেকছে কেন কে জানে!

জন্মান্তর মানেন খুড়োমশাই?

কেন বাপু, জন্মান্তর মানব না কেন? আমাদের রামহরি গুণ মস্ত তান্ত্রিক। ভৃগুর গণনায় একেবারে সিদ্ধবাক। কে আগের জন্মে কী ছিল, তা গড়গড় করে বলে দেয়। তোমাকে চুপিচুপি বলছি, কাউকে বোলো না, আমাদের মন্মথবাবু নাকি আগের জন্মে কুমির ছিলেন। আমার কেমন যেন আগে থাকতেই তা মনে হত। আমার সেজো ছেলে পন্টুকে যখন ক্লাস এইটে তিনবার ফেলে করিয়ে দিয়েছিলেন, তখনই আমার মন বলছিল, উনি কুমির না হয়ে যান না। কুমির নাগালে পেলে তোমাকে কিছুতেই ডাঙায় উঠতে দেবে না, ঠ্যাং কামড়ে হিড়হিড় করে জলে নামাবেই কি নামাবে। দিল আমার পন্টুকে ডাঙায় উঠতে? এই যে পশুপতিবাবুর কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা হাওলাত নিয়েছিলাম, চণ্ডীমণ্ডপে মাতব্বরদের সামনে কী অপমানটাই করলেন আমাকে। তা তিনি আগের জন্মে কী ছিলেন, জানো? চুম্বক লোহা, চুম্বক লোহা আশপাশের সব জিনিস টেনে রাখে, উনিও তাই, ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। তা বাপু, জন্মান্তরের কথাটা উঠছে কেন?

ছোঁকরা মিষ্টি হেসে বলল, না ভাবছিলাম, আপনার সঙ্গে হয়তো আমার আগের জন্মে পরিচয় ছিল, তাই আমাকে আপনার এত চেনা-চেনা ঠেকছে।

উঁহু, তুমি আমাকে যত বোকা ঠাউরেছ, আমি তত বোকা নই হে। আমার স্মৃতিশক্তি অতি চমৎকার। এই। পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও সতেরোর ঘরের নামতা বলে যেতে পারি।

ওরে বাবা, সে তো খুবই শক্ত কাজ খুড়োমশাই!

তাই তো বলছি হে, আমাকে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়।

ছেলেটা আমতা-আমতা করে বলল, তাই তো! বড্ড মুশকিলে ফেললেন দেখছি!

কেন হে বাপু, নাম-ধাম-পরিচয় বলে ফেললেই তো হয়।

নামটা বড় গোলমেলে। ভাবছি, আপনার যদি বিশ্বাস না হয়, পিতৃদত্ত নাম, ফেলেও দিতে পারি না।

আহা, নাম কি কেউ ফেলে? ও কি ফেলার জিনিস?

বাপ-পিতেমোর দেওয়া নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে হয়। নাও, বলে ফ্যালো, ফেললেই দেখবে ল্যাঠা চুকে যাবে।

আজ্ঞে না খুড়োমশাই, নতুন ল্যাঠাও উপস্থিত হতে পারে।

কেন হে বাপু, তোমার নামে কি হুলিয়া আছে?

বিচিত্র নয়। গুজব শুনেছি, অনেকে নাকি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ও বাবা! তা তুমি করেছটা কী?

সে বলতে গেলে মহাভারত। কাজ কী আপনার ওসব শুনে?

বলি চোর, ডাকাত বা খুনি নও তো?

ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সে হলেও তো ভাল ছিল খুড়োমশাই। আজকাল তো দেখতে পাই, চোর ডাকাত-খুনিদের বেজায় নামডাক আর বোলবালাও। তারাই সব মুরুব্বি-মাতব্বর কেষ্টবিষ্ট হয়ে বসে আছে।

যা বলেছ বাবা, একেবারে প্রাণের কথাটি। এই যে আমাদের ময়নাগড়ের মাতব্বর মহাদেব বিশ্বাস, দেখলে মনে হবে দেশের দরদে প্রাণ উথলে উঠছে। বললে পেত্যয় যাবে না, আঠারোখানা খুনের মামলা ছিল ওর নামে। ওই যে বিষ্ণু সাঁতরা, গাঁয়ে উন্নতির নামে সরকারি যে টাকা আসে, তা ফাঁক করে তেতলা বাড়ি করে ফেলল চোখের সামনে। আরও শুনবে? রাত ভোর হয়ে যাবে কিন্তু!

আজ্ঞে, তবে থাক।

তা তোমার অপরাধটা কী?

আজ্ঞে, বললে বিশ্বাস যাবেন না, আমার অপরাধ হল, আমি ম্যাজিক দেখাই।

ম্যাজিক দেখাও, বটে? তা সে তো খুব ভালো জিনিস হে! তাতে দোষের কী?

সেইটেই তো বুঝতে পারছি না খুড়োমশাই। তবে অনেকেই আমাকে ভালো চোখে দেখে না।

না হে বাপু, এ বড় হেঁয়ালি ঠেকছে। ম্যাজিকের মধ্যে আবার গন্ডগোেলটা কীসের? ম্যাজিক মানে তো হাতসাফাই আর একটু হিপনোটিজম। ও তো স্রেফ মজা ছাড়া কিছু নয়।

ওখানেই তো মুশকিল। আমার ম্যাজিকে অনেকে মজাটা খুঁজে পাচ্ছে না। তারা আমার গর্দান নেওয়ার জন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

এটা তো খুব অন্যায় কথা হে!

আজ্ঞে, কলিযুগে ন্যায়টা আর দেখছেন কোথায় বলুন। সেও ঠিক কথা। কিন্তু ম্যাজিশিয়ানের গর্দান কেন চাওয়া হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছি না। থাক গে, তোমার নামটা শুনি।

 শুনে বিশ্বাস হবে তো আপনার?

খুব হবে, খুব হবে। আমার খুড়তুতো এক শ্যালক আছে, তার নাম পর্বত। আমার এক মাসতুতো দিদি আছে, তার নাম পেত্নি।

বাঃ, তবে তো আপনার অভ্যাস আছেই। আমার নাম হিজিবিজি।

উদ্ধববাবু একটু হাঁ করে চেয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ঠিক শুনেছি তত বাপু? আমার কানের কোনও দোষ হয়নি তো!

ভারী লাজুক মুখে ছেলেটা বলল, এতক্ষণ তো আপনার কান ঠিক মতোই কাজ করেছে, তাই না?

তা বটে।

দোষ নেবেন না খুড়োমশাই, আমি তো আগেই আপনাকে সাবধান করেছিলাম।

উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তা নামটাকে খারাপও বলা যাচ্ছে না, বেশ নতুন ধরনের নাম। তা বাপু হিজিবিজি, তুমি কি এই নামেই ম্যাজিক দেখাও? তোমার বাবা কি এই নামেই তোমাকে ডাকেন? যদি একদিন তোমার দেশজোড়া নাম হয় তখনও কি এই নামই বহাল থাকবে? উপায় কী বলুন। এই নামেই যে সবাই আমাকে চেনে। তা বাপু হিজিবিজি, তোমার বাবা এই মোক্ষম নামটা পেলেন কোথা থেকে?

শুনলে হাসবেন খুড়োমশাই, ছেলেবেলায় খুব দুষ্টু ছিলাম তো। সর্বদাই অকাজ-কুকাজ করে বেড়াতুম। বাবা আমাকে দেখিয়ে লোককে বলত, হি ইজ বিজি। সেই থেকেই লোকে হিজিবিজি বলে ডাকতে শুরু করে। শেষে এই নামটাই আমার সঙ্গে সেঁটে গেল।

উদ্ধববাবু ভারী খুশি হয়ে বললেন, এইবার বুঝলুম, বাঃ এই তো হিজিবিজি একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল। তা বাবা হিজিবিজি, তুমি কি ম্যাজিক দেখানোর মতলবেই ময়নাগড়ে এসে জুটেছ?

মাথা নেড়ে একটু হেসে হিজিবিজি বলে, না খুড়োমশাই, ম্যাজিক আমার মাথায় উঠেছে। আমি এসেছি বিপদে পড়ে। গত সাতদিন ধরে এক জায়গায় দুরাত্তির থাকতে পারিনি।

কেন বাপু, কেন?

চারদিকে আমার খোঁজ হচ্ছে যে!

কারা খুঁজছে তোমাকে? তারা কি খারাপ লোক?

সবাইকে খারাপ বলি কী করে বলুন! ধরুণ পুলিশ, মিলিটারি, ইন্টারপোল, আন্তর্জাতিক গুন্ডা কে না খুঁজছে আমাকে। সবাই তো আর খারাপ লোক নয়।

তা হলে গা-ঢাকা দিতে এসেছ নাকি? সে গুড়ে বালি। এখানে কারও পেটের কথা গোপন থাকে না। মাঝরাত্তিরে হয়তো তোমার কান কটকট করেছিল, সকালে উঠে দেখবে সারা তল্লাটে তাই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তোমাকে কী বলব বাবা, মা মরার সময় দশটা মোহর তার বাক্স থেকে বের করে আমাকে দিয়ে বলেছিল, সাবধানে লুকিয়ে রাখিস। তা আমি নিশুতি রাতে সেই মোহর অন্ধকারে বসে বালিশের সেলাই খুলে তার মধ্যে ঢুকিয়ে ফের সেলাই করে দিই। আগাগোড়া অন্ধকারে কাজ করতে হয়েছিল, তাতে বারদশেক ছুঁচের খোঁচা খেতে হয়েছিল হাতে। এত সাবধান হওয়া সত্ত্বেও পরদিন সাতকীবাবুর সঙ্গে দেখা হতেই গম্ভীর মুখে বললেন, মাসিমার দেওয়া মোহরগুলো বালিশে ভরে রাখা কি নিরাপদ হল মশাই?

আশ্চর্য তো!

এ আর আশ্চর্যের কী। বাজারের মাছওলা নিতাই একগাল হেসে বলল, উদ্ধববাবু, চোর তো বালিশটাই হাপিশ করে দেবে মোহরসুন্ধু! না না, ও আপনার বড্ড কাঁচা কাজ হয়েছে। সনাতন পাল বলল কী জানো? বলল, আহা বালিশের বাঁ-কোণে যে মস্ত একটা ছেঁড়া জায়গা রয়েছে উদ্ধববাবু, লক্ষ করেননি? চুরি যদি নাও যায়, ফুটো দিয়ে পড়েও তো যেতে পারে। তবেই বোঝো, ময়নাগড় কেমন জায়গা। এখানে লুকোছাপা ব্যাপারটাই নেই। সবাই সবাকার হাঁড়ির খবর জেনে যায়। আমার তো মনে হয় ময়নাগড়ের কুকুর, বেড়াল, পাখি-পক্ষী, পোকামাকড়, অবধি খবর ছড়িয়ে বেড়ায়।

হিজিবিজি ভাবিত হয়ে বলল, তা হলে তো মুশকিল। হল খুড়োমশাই!

তুমি বরং বৃন্দাবনঘাঁটি বা তালপুকুরে চেষ্টা করে দ্যাখো, এখানে সুবিধে হবে না।

আচ্ছা, তা হলে আসি খুড়োমশাই।

এসো গিয়ে। বলেই উদ্ধববাবু হাঁ। গাছতলায় দাঁড়ানো হিজিবিজি একটুও নড়ল না, চড়ল না, দাঁড়িয়ে থেকেই যেন হঠাৎ বাতাসে মিলিয়ে গেল। ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি চোখের পলকে ঘটে গেল যে, উদ্ধববাবু ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বেকুবের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ ওরে বাবা রে! ভূত! ভূত! ভূ… বলে চেঁচাতে চেঁচাতে প্রাণপণে দৌড় লাগালেন।