শক্ ট্রিটমেন্ট
০১.
পেঁচার ছায়া
ক্যালিফোর্নিয়ার পাহাড়ী অঞ্চলেশ্লীন ক্যাম্প রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো পড়ে আছে। গ্রীষ্মের অবকাশে অনেক লেখক বা শিল্পী বা পেনশন ভোগী এখানে বিশ্রামের জন্য আসতো। এই জায়গাটা প্রশান্ত মহাসাগর থেকে খুব দূরে নয়।
আমি এখন যা বলতে যাচ্ছি তা বোধহয় গীন ক্যাম্প ছাড়া অন্য কোনো শহরে ঘটতেই পারতো না। এখানে আমি একটা সুন্দর বাড়ি ভাড়া করে ছিলাম, কেননা এখানেই আমি আমার রেডিও আর টেলিভিশন বিক্রির কারবার ফেঁদেছিলাম। গ্রীন ক্যাম্প থেকে আমার বাড়িটা মাইল চারেক দূরে সপ্তাহে একবার আমি শহর থেকে মশলাপাতি কিনে আনতাম। এছাড়া যেতাম শেরিফ জেফারসনের অফিসে গল্প করতে।
এই জেফারসন সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া ভালো কেননা এই গল্পে তার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। লোকে বলে তার বয়স নাকি আশির ওপরে হবে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে বেশির ভাগ সময়ই তিনি গ্লীন ক্যাম্পের শেরিফ। স্ট্যাচু অব লিবার্টি ছাড়া যেমন নিউইয়র্কের কোনো অর্থ হয় না, তেমনি শেরিফ জেফারসন ছাড়া গ্লীন ক্যাম্পের কথা চিন্তাই করা যায় না।
ইনি ছাড়া আর যার কথা বলা প্রয়োজন তিনি হলেন ডাঃ ম্যালার্ড।
যতদিন ধরে জেফারসন প্রশাসন চালাচ্ছেন ততদিন ধরেই ডাক্তার হলেন তিনিই। তাকে প্রায় কিছুই করতে হতো না। কেউ যদি খুব অসুস্থ হয়ে পড়তো বা কারো হয়তো বাচ্চা হবে তাহলে তাকে আশি মাইল দূরে লস এঞ্জেলস্ স্টেট হসপিটালে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ডাঃ ম্যালার্ড জেফারসনের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় কাটাতেন।
তখন গ্রীষ্মকাল, আমি একদিন শহরে একটা টি. ভি. সেট আনতে গিয়েছি। সেন্টাল গাড়িতে তুলে আমার অভ্যাস মতো জেফারসনের অফিসে গল্প করতে ঢুকলাম।
কিছুক্ষণ গল্প করার পর আমি বললাম, আমিব্লু-জয় লেকের দিকে যাবে, আবার এদিকে এলে দেখা করবো।
জেফারসন বললেন, যদি ওদিকেই যাও তবে একজন নতুন খদ্দের পাওয়ার আশা আছে। মিঃ উইলিয়ামসের বাড়িতে নতুন এক ভদ্রলোক এসেছেন–স্বামী-স্ত্রী। স্বামীটি প, চাকাওয়ালা চেয়ারে বসে থাকতে হয় তাকে। আমার মনে হয় উনি হয়তো টি. ভি. সেট নিতে চাইবেন।
আমি তাঁর কাছ থেকে নামটা জেনে নিলাম–মিঃ ডেলানি, বাড়ি ফেরার পথে একবার ঘুরে যাবো ভাবলাম। আমার মনে হলো যাকে চেয়ারে বসে ঘুরে বেড়াতে হয়, তিনি একটা টি. ভি. সেট নিতেই পারেন। আমার এক খদ্দেরের বাড়িতে রেডিওটা চালু করে দিয়ে আমি ব্লু-জয় কেবিনের দিকে গাড়ি চালালাম।
জায়গাটা ছোট্ট হলেও খুবই সুন্দর, বেশ আরামের। বছর দুয়েক আগে আমি এখানে এসেছিলাম। এখান থেকে চারিদিকে মনোরম পাহাড় দেখা যায়, নীচে উপত্যকা আর সমুদ্র।
ওপরে একটা গেট। গাড়ি থেকে নেমে গেটটা খুললাম, সুন্দর একটা রাস্তা বাড়ি পর্যন্ত চলে। গিয়েছে। সিঁড়ির পাশে একটা বড়োসড, ঝকমকে বুইক ওয়াগন, সেটার পিছনেই আমি গাড়ি দাঁড় করালাম।
বারান্দায় একজন ভদ্রলোক। চাকাওয়ালা একটা চেয়ারে বসে আছেন। মুখে সিগার, কোলের ওপরে একটা ম্যাগাজিন খোলা রয়েছে। ভদ্রলোকের বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, চোখের চাহনিটা বিতৃষ্ণায় ভরা।
গাড়ি থেকে নেমে আমি বারান্দায় উঠলাম।
মিঃ ডেলানি?
ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকালেন।
আমি শুনলাম আপনি সবে এসেছেন। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, মনে হলো আপনার জন্য একটা রেডিও বা টি. ভি. সেট দিতে পারি আমি।
তিনি আমার কথা শুনে বললেন, এই সব পাহাড়ের মধ্যে কোনো ভালো রিসেপশন পাওয়া অসম্ভব।
আমি তাকে জানালাম যে ভালো এরিয়েল লাগালে সুন্দর রিসেপশনই পাওয়া যাবে। প্রমাণ দেবার জন্য আমি গাড়ি থেকে একটা ছোট টি. ভি. সেট নিয়ে এসে টেবিলের ওপরে রাখলাম। তারপর একটা বিশেষ ধরনের এরিয়েল খাটিয়ে দিলাম। মিনিট সাতেকের মধ্যেই পর্দায় একটা পরিষ্কার ছবি ফুটে উঠলো।
ম্যাগাজিনটা রেখে দিয়ে মিঃ ডেলানি ব্যাপারটা দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, রিসেপশনটা কেমন?
ডেলানি বললেন, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দারুণ হয়েছে। কত দাম পড়বে?
আমি দামটা বললাম।
আপনার নামটা কি?
আমি বললাম, টেরি রেগান। এখানকার টি. ভি., রেডিও সমস্তই আমি দেখি। আমি তাকে বললাম যে, আমি একটা বিশেষ ধরণের সেটই দিতে পারি। এতে একটা পঁচিশ ইঞ্চি পর্দা থাকবে, থাকবে একটা এফ. এম. রেডিও, রেকর্ড প্লেয়ার আর একটা টেপ রেকর্ডার।
এছাড়া একটা স্পীকার আমি আলাদা ভাবেই দেবো।
কি করে বুঝবো যে এটা কাজের হবে?
আমার কথায় বিশ্বাস করতে বলছি না। আমি এরকম একটা মিঃ হামিশকে করে দিয়েছি। উনি একজন লেখক, এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে থাকেন। তাকে টেলিফোন করলেই জানতে পারবেন সব কিছু।
ঠিক আছে আমি আপনার কথাই মেনে নিচ্ছি। কত দাম পড়বে?
আপনি যে রকম ক্যাবিনেট চান, তার ওপর নির্ভর করবে। তবে পনেরোশো ডলারের একটা ভালো জিনিষ আমি বানিয়ে দিতে পারি।
কথাটা শেষ হতে না হতে পিছন দিকে একটা শব্দ হলো–কোনো কারণ ছিল না, তবু আমার শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি চুলের গোড়া পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল।
.
গিল্ডা ডেলানিকে প্রথম দেখার কথাটা বোধ হয় আমি কখনও ভুলতে পারবো না।
মাঝামাঝি ধরনের লম্বা, সোনালী রঙ, কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে চকচকে চুলের রাশি। চোখ দুটো বড় বড়, গভীর নীল, যেন ফরগেট মিনট ফুল। মেয়েটার পরনে একটা কাউবয় সার্ট আর নীলরঙের চাপা প্যান্ট। চেহারাটা তাকিয়ে দেখার মতোই।
ডেলানি ওর দিকে তাকিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন–আমার স্ত্রী।
এঁর নাম মিঃ রেগান। উনি এই অঞ্চলে রেডিও আর টি. ভি. সেটের কারবার করেন। আমাকে একটা টি. ভি. সেট বিক্রি করতে চাইছেন।
তুমি তো তাই চাইছিলে, আর টি. ভি. থাকলে তোমার ভালোই লাগবে। মেয়েটি বললো।
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে অল্প একটু হাসলো তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে হেঁটে চোখের বাইরে চলে গেল।
যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এর আগে আমি যত মেয়ে দেখেছি তার চেয়ে অনেক বেশি করে ওকে কামনা করতে লাগলাম।
ডেলানি বললেন, ঠিক আছে আপনি সেটটা তৈরী করুন। পছন্দ হলে কিনবো।
ঠিক আছে, আমি বললাম, আমি বানিয়ে দেবো। হপ্তা দুয়েক লাগবে। ইতিমধ্যে এই সেটটা আপনি রেখে দিতে পারেন। আমি এটা এমনিই রেখে যাচ্ছি। আপনার একটা পাকাপাকি এরিয়েল লাগবে। কালকে এসে সেটা লাগিয়ে দেবো।
তাই আসুন। আমি তো সবসময়েই আছি।
আমি আর দেরী না করে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে এলাম। সারাটি পথ মেয়েটির কথা ভাবতে ভাবতে এলাম। রাত্রেও মেয়েটির চিন্তা মন থেকে দূর করতে পারলাম না।
পরের দিন বিকেলের দিকে আমি ব্লু-জয় কেবিনে গেলাম। মিঃ ডেলানি বারান্দায় বসে একমনে টেলিভিশন দেখছিলেন। আমি গাড়ি থেকে নামার সময় উনি আমাকে ভালো করে লক্ষ্যই করলেন না।
এরিয়েলটা, খানিকটা তার আর যন্ত্রের বাক্সটা নিয়ে আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম।
ভেতরে যান, উনি হাত নেড়ে বোঝালেন, আমার স্ত্রীকে বা চাকরটাকে পেয়ে যাবেন।
ভেতরের ঘরটা খুবই সাজানো গোছানো, কাউকে দেখতে না পেয়ে আমি দরজা ঠেলে বাইরে গেলাম। একটা ভোলা জায়গায় ছোট একটা ফোয়ারা, জলের মধ্যে অনেকগুলি গোল্ডফিশ খেলে বেড়াচ্ছে।
জায়গাটা পেরিয়ে দরজা ঠেলে একটা বড়ো ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম। এ ঘরটার অনেকগুলো দরজা, একটা দরজা খোলা আর সেখান থেকে গিল্ডা ডেলানির মৃদু গলার সুর ভাজা শোনা যাচ্ছিল।
আমাকে দেখে মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর চোখের চাহনির কোনো বর্ণনা হয় না, শরীরের ইন্দ্রিয়পরায়ণতার তুলনা দেওয়া যায় না, আর যেমন করে তার চকচকে চুলের রাশ জানলা দিয়ে আসা রোদ্দুরে ঝম করে উঠছিলো, তারও কোনো সঠিক রূপ স্মৃতি থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব। পরনে একটা ক্ৰীম রঙের সিল্কের শার্ট, একটা আকাশী নীল স্কার্ট। ওকে দেখে আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো।
মিঃ রেগান, কি খবর? মেয়েটি হেসে বললো।
আপনার স্বামী আমায় আসতে বলেছিলেন, এরিয়েলটা লাগাতে হবে। ছাদের ওপর যাওয়া যাবে কি?
ঐ ঘরে স্কাইলাইট আছে। আপনার সিঁড়ি লাগবে। স্টোর রুমে সিঁড়িটা আছে, ঐ যে দরজা, ও আঙুল তুলে দেখালো।
আমি মিসেস ডেলানিকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্টোর রুম থেকে সিঁড়িটা নিয়ে ঘরে ঢুকে ছাদের দরজাটার নীচে রাখলাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজাটা খুলে দিলাম।
জিনিসপত্র নিয়ে আবার জন্য নিচে নামলাম। জিনিস নিয়ে ফিরে আসছি এমন সময় মেয়েটিকে দেখতে পেলাম। আমি ওর চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
আপনার কোনো সাহায্যের দরকার? মেয়েটি বললো। দরকার হলে করতে পারি। আমি বললাম, তাহলে তো ভালোই হয়। যন্ত্রপাতিগুলো ছাদে নিয়ে যেতে চাইনা। আপনি যদি ওগুলো হাতে হাতে এগিয়ে দিতে পারেন, তাহলে উপকার হবে। আপনি ওপরে উঠতে পারবেন তো?
আপনি যদি এটাকে ঠিক করে ধরে রাখেন তাহলে পারবো। ও এগিয়ে এলো। আমি এরিয়েলটা নিয়ে পাশে দাঁড়ালাম। ওর শরীর থেকে একটা সুগন্ধ আসছিল।
আমি সিঁড়িটার গায়ে হাত রেখে বললাম–এটা নিরাপদ।
এই সব কাজের জন্য চাপা প্যান্ট পরা উচিত ছিল আমার। ও হাসলো।
আমি বললাম, ঠিক আছে আমি তাকাবো না।
ও হেসে উঠে হাত দিয়ে ধাপগুলি ধরে ধরে ওপরে উঠতে লাগলো।
স্কার্টটা একবার ফুলে উঠলো, যেটুকু দেখতে পেলাম, তাতে আমার রক্তের গতি দুরন্ত হয়ে গেল।
ওপরের দরজার ফাঁক দিয়ে ও তাকালে আমার দিকে। ওর সেই দৃষ্টিকোণ দেখে, ওকে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছিল।
সেই দৃষ্টি, যে দৃষ্টি থাকে এমন মেয়ের চোখে, যে পুরুষের সব কিছু খবর রাখে, আর এইমাত্র আমি যা দেখেছি, তা দেখে পুরুষের অবস্থা কি হয়, এটাও জানে।
আপনি যদি এরিয়েলটা আমাকে দেন…ও বললো।
আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর হাতে এক এক করে এরিয়েল, তারের টুকরো আর যন্ত্রের বাক্সটা তুলে দিলাম।
ওপরে উঠে গেলাম, হঠাৎ মনে হলো যে পৃথিবীতে আমরা কেবল দুজনেই রয়ে গেছি। ওখান থেকে টেলিভিশনের শব্দটা শোনা যাচ্ছে না।
আমি তারের টুকরোর পাক খুলতে লাগলাম। আমি কথায় কথায় জানতে চাইলাম ওর স্বামীর কথা, কোন দুর্ঘটনা হয়েছিল কিনা।
মেয়েটি তার কাঁধের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো, হ্যাঁ, ও তাই নিয়ে সাংঘাতিক ভাবে। ওর পক্ষে এটা খুব খারাপ হয়েছে। প্যাসিফিক ফিল্ম স্টুডিওগুলোতে ও টেনিস কোচ ছিল। সবনামকরা অভিনেতাদের ও শিখিয়েছে। কাজটা খুব রোজগেরে ছিল। পঞ্চাশের কাছে ওর বয়স। এই বয়সে ও খুব হৈ হৈ করতো, শেখাতে ভালবাসতো। এমন সময় দুর্ঘটনা ঘটলো। ও আর হাঁটতেও পারে না।
সব কথা শুনে ব্যাপারটা আমার কাছে খুব করুণ মনে হলো।
আমি বললাম, খুব মুস্কিলের কথা, উনি ভালোবাসেন এমন কিছু নেই? চেয়ারে বসে কিছু না করে বাকি জীবনটা কাটাতে চাইছেন না নিশ্চয়?
হ্যাঁ তাই, ওর অনেক টাকা আছে। ওটার কোনো অভাব নেই আমাদের। মেয়েটির ঠোঁটে একটা তিক্ত হাসি দেখা দিল এখানে ও চলে এসেছে ওর বন্ধুদের এড়াবার জন্য। কেউ করুণা করলে ওর ঘেন্না লাগে।
আমি তারটা এরিয়েলের সংগে লাগালাম। কথাবার্তা ভেঙে গেলো। এরিয়েলটা ও আমার হাতে তুলে দিল। এরিয়েল লাগাতে বেশি সময় লাগলো না। যতবার ওর হাত থেকে কোনো যন্ত্র নিচ্ছিলাম, ততোবারই কিন্তু ওর সম্বন্ধে আমার আগ্রহ বেড়ে উঠছিল।
ও আমার খুব কাছে দাঁড়িয়েছিল, আমার নিঃশাস দ্রুত হয়ে উঠছিল। আমি বুঝতে পারলাম ও একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চিবুকটা তোলা, চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিল। হঠাৎ ও আমার দিকে ঢলে পড়লো। আমি ওকে চেপে ধরলাম।
এর আগে আমি অনেক মেয়েকেই চুমু খেয়েছি কিন্তু এটা সম্পূর্ণ আলাদা রকমের ছিল। এই চুম্বনের জন্যই কি লোকে স্বপ্ন দেখে? বোধ হয় কুড়ি কি ত্রিশ সেকেন্ড আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তারপর ও সরে গিয়ে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখলো। ওর দুটো চোখ, সেই ফরগেট–মিনট, ভিজে উঠলো, বন্ধ হয়ে রইলো একটু, ও আমার মতই জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলো আমার চোখের সামনে থেকে।
আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলাম। ওর চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে নিজের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ কানের কাছে জোরে বেজে উঠতে লাগলো।
রাত আটটার সময় আমি বাড়ি ফিরলাম। আমি কেবল গিল্ডার কথাই ভাবছিলাম। বারান্দায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু ভাবতে চাইলাম আমি।
ও আমাকে চুমু খেলো কেন? ওর মতো সুন্দরী মেয়ে যে এতো ঐশ্বর্যের মধ্যে রয়েছে, সে আমাকে নিশ্চয় বিশেষ কিছু ভাবেনি। এটা একটা আবেগের বশেই হয়েছে। ব্যাপারটা মন থেকে মুছে ফেলাই উচিত। আমার জন্য ও স্বামীকে ছেড়ে আসবে এরকম ভাবা ছেলেমানুষি। তাকে দেবার মতো আমার কি আছে?
হঠাৎ আমার ভাবনাটা থামিয়ে টেলিফোনটা বেজে উঠলো। আমি উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুললাম।
মিঃ রেগান, আপনাকে বিরক্ত করছি না তো! আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই ঠিক এগারোটা নাগাদ।
ওর গলার স্বর শুনে আমার মাথার মধ্যে রক্তের স্রোত বয়ে গেল।
এগারোটা বাজবার মিনিট খানেক পরে, আমি গাড়ির হেডলাইট দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওর গাড়িটা এসে থামলো দেখে আমার বুকটা ধকধক করে উঠলো।
মিঃ রেগান, দেরী হলো বলে দুঃখিত, ও বললো, কিন্তু আমার স্বামী ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে।
তার মানে একটা লুকোচুরি চলছে। আমার নিঃশ্বাস জোরে পড়তে লাগলো।
মিসেস ডেলানি, আপনি বারান্দায় উঠে আসুন।
ও বারান্দায় উঠে এলো। আমি আলো নিভিয়ে দিয়েছিলাম, কেবল ভেতর থেকে একটা আলোর টুকরো এসে পড়ছিল।
ওর পরনে সেই কাউবয় শার্ট আর ম্যাকস। ও একটা চেয়ারে বসে পড়লো।
খুব শান্ত গলায় ও বললো, আজ বিকেলে যা ঘটেছে, তার জন্য ক্ষমা চাইতে এলাম। আপনি হয়তো ভাবছেন যে আমি সেই ধরনের মেয়ে যারা যে কোনো পুরুষের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আমি বললাম, মোটেই না, এটা হয়তো আমারই দোষ।
ও একটা চেয়ারে বসে পড়লো। একটা সিগারেট হবে?
আমি সিগারেট কেসটা এগিয়ে দিলাম। ও একটা সিগারেট নিল।
আমি দেশলাইটা জ্বালালাম। আমার হাতটা খুবইকাঁপছিল, সিগারেট ধরাবার জন্য ওকে আমার হাতটা চেপে ধরতে হলো। সেই ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় আমার বুকের শব্দটা বেড়ে গেলো।
ও বলে চললো, আমার লজ্জা করছে, আমার মতো অবস্থার মেয়েদের পক্ষে অনেক সময় খারাপ লাগে। তবু, রহস্যকরে লাভ কি? আমার সংযমীহওয়া উচিত ছিল। আমি ভাবলাম আপনার কাছে এসে সবটা পরিষ্কার করে বলবো।
দরকার ছিল না…আমি কিছু মনে করিনি।
নিশ্চয়ই করেছেন। আমি জানি পুরুষের চোখে আমি আকর্ষণীয়া, এর জন্য আমার কিছু করার নেই। আর যখন কেউ দেখে যে আমার স্বামী পন্তু তারা আমায় বিরক্ত করতে থাকে। আজ পর্যন্ত আমার চোখে তেমন কোনো পুরুষ পড়েনি, এজন্য ওদের ঠেকিয়ে রাখা সহজ ছিল। কিন্তু আপনার মধ্যে কি আছে…? যাই হোক আমি এই কথা বলতে এসেছি যে আর এরকম হবেনা। মিঃ রেগান। আমার যদি আর কারো সঙ্গে প্রেমে পড়ার দুর্ভাগ্য হয় তবুও আমি স্বামীকে ছেড়ে যেতে পারবো না। উনি পঙ্গু। আমার ওপরেই নির্ভরশীল। আমার তো একটা বিবেক আছে।
আমি বললাম, যদি আপনি কারো সঙ্গে প্রেমে পড়েন, স্বামীকে ত্যাগ করলে আপনাকে কেউ দোষ দেবেনা। আপনার বয়স অল্প, বাকি জীবনটা ওঁর সঙ্গেই নিজেকে বেঁধে রাখবেন এতটা আশা করা ঠিক নয়। এতে আপনার জীবনটা নষ্ট করা হচ্ছে।
আপনি কি তাই মনে করেন? যখন আমি বিয়ে করেছিলাম, তখন প্রতিজ্ঞা করেছি যে ভালো হোক মন্দ হোক, ওর সঙ্গেই থাকবো। এখন চলে যাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া যে দুর্ঘটনায় ও পঙ্গু হয়ে গেছে তার জন্য আমিই দায়ী। সেই কারণেই, বিয়ের বাঁধন ছাড়াও ওর সম্বন্ধে আমার বিবেক রয়ে গেছে।
আপনি দায়ী?
হ্যাঁ, দুর্ঘটনার পর আপনিই প্রথম ব্যক্তি যাকে আমার সব বলতে ইচ্ছা করছে। আমরা চার বছর হলো বিয়ে করেছি। বিয়ের তিনমাস পর দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা একটা নেমন্তন্নে গিয়েছিলাম। জ্যাক খুব মদ খেয়েছিল। এ অবস্থায় ওকে আমি গাড়ি চালাতে দিই নি। আমি নিজেই চালালাম। আমরা একটা পাহাড়ী পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। জ্যাক ঘুমিয়ে পড়লো। খানিকটা এসে দেখলাম একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে পথটা আটকে রেখেছে। ওটা আমাদেরই এক বন্ধুর, তার গ্যাস ফুরিয়ে গিয়েছে। আমি গাড়িটা দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ে তার দিকে যেতে লাগলাম। পথটা ওখানে খুবই খাড়াই ছিল। গাড়িটা পেছন দিকে চলতে শুরু করলো। ব্রেক ঠিকমতো লাগাতে পারিনি। জ্যাক তখনও ঘুমোচ্ছ। আমি দৌড়ে গেলাম কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে।
গাড়িটা রাস্তা থেকে পড়ে গেলো, সে কী ভীষণ শব্দ, সেই মুহূর্তটা আমি ভুলতে পারবো না।
আমি বললাম, এটা একটা দুর্ঘটনা যে কোনো লোকেরই এরকম হতে পারত।
জ্যাক তা মনে করে না। ওর ধারণা এটা আমারই দোষ। এরজন্য ভয়ঙ্কর দোষী মনে হয় আমাকে। আর সেই কারণেই আমি ওকে ছেড়ে যেতে পারি না।
আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম, আপনি এখনও ওকে ভালোবাসেন?
ভালোবাসা? ও কথা আসেনা। চার বছর ওর সঙ্গে আছি। ওর সঙ্গে থাকা খুব প্রীতিকর নয়। ও মাতাল, ও আমার থেকে তেইশ বছরের বড়ো। আমার সঙ্গে ওর মতের মিল নেই। কিন্তু ওকে আমি বিয়ে করেছি। আমায় মেনে নিতেই হবে। আমার জন্যই ও পঙ্গু আর আমার জন্যই ওর জীবন নষ্ট হয়েছে।
আমি বললাম, যা হয়েছে তার জন্য আপনি নিজেকে দোষ দিতে পারেন না। যদি চান তাহলে ওকে ছেড়ে আসতে পারেন আপনি, আমার এই রকমই মনে হয়।
কিন্তু আপনার তো আমার বিবেকটা নেই, ও হাত বাড়িয়ে দিতে আমি একটা সিগারেট এগিয়ে দিলাম। দেশলাইয়ের আগুনে দুজনে দুজনকে দেখলাম।
আপনি পাগল করে দিতে পারেন…খুব নীচু গলায় ও বলল।
আপনিও তাই।
আমি জানি, আমি কেবল পুরুষকে পাগল করে দিতে পারি তা নয়, আমি নিজেকেও উন্মাদ করে দিই। মিঃ রেগান, আমার জীবনটা দুঃসহ। আপনি হয়তো সেটা বুঝতে পেরেছেন। আজ বিকেলে যা করেছি তার জন্য আমি উদ্বিগ্ন। আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা চাইবার দরকার নেই। আমি বুঝতে পেরেছি।
আমার বিশ্বাস আপনি বুঝেছেন, যদি আমার তা মনে না হতো, তাহলে এই রাত্রে আমি একা এখানে আসতাম না। এবারে আমি ফিরে যাবো, ও উঠে দাঁড়ালো।
আমরা দুজন চন্দ্রালোকিত গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলাম।
ও হঠাৎ বললো, আপনি কি একাই থাকবেন? আপনার বিয়ে করা উচিত।
আমি এখনো মনের মত মেয়ে পাই নি। ও আমার দিকে তাকালো। চাঁদের আলো সোজাসুজি পড়লো ওর মুখে, আমি একটা তিক্ত হাসি দেখতে পেলাম।
আপনাকে খুশি করা কি শক্ত?
সেইরকমই, বিয়ে একটা চিরস্থায়ী ব্যাপার–অন্তত আমার কাছে।
প্রেম থাকা চাই। আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসিনি, নিরাপত্তার জন্য বিয়ে করেছিলাম। ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আমার কিছু ছিল না। কিছুই না থেকে যদি কেবল স্বাধীনতা থাকতে তবে আর অনেক সুখী হতাম।
আপনি এখনও স্বাধীনতা পেতে পারেন।
এখন নয়। যদি ওকে ছেড়ে যাই, তবে আমার বিবেক আমাকে তাড়না করতে থাকবে। বারান্দার রেলিঙে অলসভাবে হাত রেখেও বললো, একটা উত্তেজনায় এখানে এসেছিলাম। আমি আপনাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে…
আমি ওর হাতে হাত রাখলাম, গিল্ডা…।
ও ঘুরে দাঁড়ালো–কাঁপছে।
গিল্ডা আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে গেছি..
আমিও, আমার লজ্জা করছে, কিন্তু যখনই তোমায় দেখলাম…আমি ওকে দুহাতে টেনে নিয়ে মুখের ওপরে আমার মুখ রাখলাম। আমাকে চেপে ধরার সময় ওর শরীরের আকুতি টের পেতে লাগলাম আমি।
ওকে দুহাতে তুলে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। গ্যারেজের ছাদে যে পাচাটা বসে থাকে সে হঠাৎ উড়ে গেলো।
একটা ছোট্ট ছায়া মাটিতে পড়লো।