১. পুকুরটার নাম দুধের সর

দুধসায়রের দ্বীপ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

পুটু বলল, “আচ্ছা, এই পুকুরটার নামই কি দুধের সর?” খাসনবিশ চোখ কপালে তুলে বলল, “পুকুর! এই সমুদুরের মতো বিরাট জিনিসকে তোমার পুকুর বলে মনে হচ্ছে? শহুরে ছেলেদের দোষ কী জানো তো! তারা সব জিনিসকে ছোট করে দেখে। তারা পাহাড়কে বলে ঢিবি, বোয়ালমাছকে বলে মাগুরমাছ, বুড়োমানুষকে ভাবে খোকা। ওই হল তোমাদের দোষ।”

পুটু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু ক্ষান্তমাসি যে কালকেই বলছিল, যাই দুধপুকুরে চ্যান করে আসি।”

“ক্ষ্যান্ত? তার কি মাথার ঠিক আছে? সে সুয্যিকে চাঁদ বলে মনে করে, মাঝরাত্তিরকে মনে করে বেহান বেলা, চোরকে ভাবে দারোগাবাবু। তার গুণের কথা আর বোলো না।”

“তা হলে এটা পুকুর নয়?”

“কক্ষনো নয়, কস্মিনকালেও নয়। রাজা প্রতাপচন্দ্র জীবনে ছোটখাটো কাজ করেননি কখনও, ছোট কাজ করতে ভারী ঘেন্না করতেন। তাঁর কথা ছিল, মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। কুমড়োর সাইজের রসগোল্লা খেতেন, লাউয়ের সাইজের পান্তুয়া। তাঁর তরোয়ালখানার ওজন ছিল প্রায় আধ মন।”

“এঃ, অত বড় তলোয়ার নিয়ে কেউ যুদ্ধ করতে পারে?”

“যুদ্ধ! যুদ্ধ করার দরকারটা কী? প্রতাপচন্দ্র নিজেও তলোয়ারটা তুলতে পারতেন না। কথাটা হল, উনি সবসময়ে বড়বড় কাজ করতে ভালবাসতেন। শুনেছি একবার ঘুড়ি ওড়ানোর শখ হওয়াতে কুড়ি ফুট বাই কুড়ি ফুট একখানা ঘুড়ি তৈরি করিয়েছিলেন আর পিপের সাইজের লাটাই।”

“ও বাবা! সে-ঘুড়ি ওড়াল কে?”

“কেউ না। ঘুড়ি মোটে আকাশে ওড়েইনি। কিন্তু তাতেও রাজা প্রতাপের নামডাক খুব বেড়ে গিয়েছিল। এই যে সমুদুরের মতো জলাশয় দেখছ এও রাজা প্রতাপের এক কীর্তি।”

“কিন্তু দুধের সর নাম হল কেন?”

“দুধের সর নয় বাবা, দুধসায়র। সায়র মানে সাগরই হবে বোধ হয়। আর দুধের ব্যাপারটাও সত্যি। প্রতাপচন্দ্র সায়র তৈরি করলেন বটে, কিন্তু তাতে প্রথমটায় জল ওঠেনি। একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলেন মা-চামুণ্ডা একটা দুধের পুকুরে চান করতে করতে বলছেন, “ওরে প্রতাপ, কিসের জোরে তোর এত বিষয়সম্পত্তি, এত পয়সাকড়ি তা ভেবে দেখেছিস? মাটি থেকেই না তোর এত আয় হয়। তা মাটিকে কি কিছু দিস হতভাগা? ভাল চাস তো সায়রে ঘড়া-ঘড়া দুধ ঢাল। দুধ পেলে বসুন্ধরা খুশি হয়ে জল ছাড়বে। নইলে ওই দহে কস্মিনকালেও জল হবে না। স্বপ্নাদেশ পেয়ে প্রতাপচন্দ্রের হুকুমে তিন হাজার গয়লা ঘড়া-ঘড়া দুধ ঢালতে লাগল। সে একেবারে থইথই দুধ।”

“এ মা, এত দুধ যে নষ্ট হল!”

খাসনবিশ চোখ কপালে তুলে বলল, “নষ্ট কী গো? তোমরা শহুরে ছেলেরা বড্ড সায়েন্স শিখে যাও অল্প বয়সে। দুধ নষ্ট হবে

কেন? মাটিতে দুধ গিয়ে কীরকম সার হল বলল। তাইতেই তো আশপাশের জমি সব দ্বিগুণ ফলন্ত হয়ে উঠল। আর দুধপুকুরেও বান ডাকার মতো হু-হুঁ করে মাটি খুঁড়ে জল বেরিয়ে এল।”

“পুকুরে দুধ ঢালতেই জল বেরিয়ে এল? হিঃ হিঃ, তা হলে নিশ্চয়ই গয়লারা দুধে খুব জল মিশিয়ে দিয়েছিল!”

“অ্যাাঁ! বলে কী রে খোকা? কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে দুধে জল মেশাবে? কিন্তু তুমি মহা বিচ্ছু ছেলে দেখছি পুটুবাবু। এইটুকু বয়সে যে কেউ এত নাস্তিক হয় তা জানা ছিল না বাপু।”

“নাস্তিক মানে কী খাসনবিশদাদা?”

“নাস্তিক মানে হচ্ছে যারা কিছু মানেটানে না। সব জিনিস আজগুবি বলে উড়িয়ে দেয়। তুমি নাস্তিক হবে নাই বা কেন? তোমার বাপটাই তো একটা আস্ত নাস্তিক।”

“তুমি কেমন করে জানলে যে বাবা নাস্তিক?”

“জানব না? তাকে যে এই এতটুকু বয়স থেকে কোলে কাঁখে করে বড় করেছি। আমার বড্ড ন্যাওটা ছিল। এখন ভারী চশমা চোখে এঁটে মোটা-মোটা বই পড়ে বটে, কিন্তু ছেলেবেলায় মহা বিচ্ছু ছিল। কিছু বললেই তোমার মতো চোখাচোখা প্রশ্ন করত। তখন থেকেই নাস্তিক।”

“না, বাবা মোটেই নাস্তিক নয়। বাবা তো বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, নাস্তিক হবে কেন?”

“ওই হল বাপু। বিজ্ঞান কি আর ভাল জিনিস? বিজ্ঞান অ্যাটম বোমা বানায়, ভগবানের নামে নিলেমন্দ করে, এঁটোকাঁটা মানে না।”

“হিঃ হিঃ, তুমি যে একটা কী না খাসনবিশদাদা! আচ্ছা শোনো, তোমরা কি বাতাসা দিয়ে দুধ খাও?”

“ও মা, ও কী কথা? হঠাৎ বাতাসা দিয়ে দুধ খাওয়ার কথা উঠছে কেন?”

“ওই যে দ্যাখো, দুধের সরের মাঝখানে ঠিক বাতাসার মতো একটা জিনিস ভাসছে না?”

খাসনবিশ একগাল হেসে বলল, “তা বটে ঠিক। ওটা দেখতে বাতাসার মতোই বটে। তবে দূর থেকে বাতাসা বলে মনে হলেও ওটি কিন্তু একখানা দ্বীপ। তা ধরো দশ বারো বিঘে জমি তো আছেই। ওটা ছিল প্রতাপরাজার বাগানবাড়ি।”

“কই, বাড়ি তো দেখা যাচ্ছে না!”

“না বাপু, এত দূর থেকে কি আর অত ঠাহর করা যায়? তা ছাড়া বড় বড় গাছ আর আগাছায় সব ঢেকে গেছে। বাড়িরও বড্ড ভগ্নদশা, সাপখোপের আড্ডা।”

“কেউ যায় না ওখানে?”

“নাঃ। কে যাবে? গিয়ে হবেটাই বা কী? আগে কেউ-কেউ সোনাদানা মোহর কুড়িয়ে পাবে বলে লোভে-লোভে যেত। আজকাল আর কেউ যায় না। খামোখা হয়রান হয়ে লাভটা কী?”

“কিন্তু পিকনিক করতে যেতে পারে তো!”

“ওসব পিকনিক-টিকনিক এখানে হয় না। এ গাঁ-গঞ্জ জায়গা।”

পুটু বলল, “কিন্তু আমরা যদি যাই?” খাসনবিশ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “না যাওয়াই ভাল। সাপখোপ ছাড়াও অন্যসব জিনিস আছে।”

“কী জিনিস খাসনবিশদাদা?” খাসনবিশ মাথা চুলকে বলল, “তুমি তো আবার নাস্তিক। তোমাকে বলেও লাভ নেই।”

“তুমি নিশ্চয়ই বলবে, ওখানে ভূত আছে!”

“বলব বলব করছিলাম, তা তুমিই যখন বলে দিলে তখন সত্যি কথাটা স্বীকার করাই ভাল। এখানে ইদানীং ভূতের উৎপাত হয়েছে বলে শুনেছি।”

“আমি ভূতপ্রেত মানি না।”

খাসনবিশ খিঁচিয়ে উঠে বলল, “তা মানবে কেন? দু’পাতা সায়েন্স পড়ে তোমরা সব গোল্লায় গেছ। তবে কুনকে তো আর মিছে কথা বলার ছেলে নয়!”

“কুনকে আবার কে?”

“কুণ্ডবাড়ির ছেলে কনিষ্ক কুণ্ডু, ক্লাসে ফার্স্ট হয়। সে আর পালপাড়ার ভোলা দু’জনেই স্বচক্ষে দেখে এসেছে।”

“কী দেখেছে খাসনবিশদাদা?”

“তা আর তোমাকে বলে কী হবে? বিশ্বাস তো আর করবে!”

“ভূতের গল্প শুনতে যে আমার ভীষণ ভাল লাগে!”

“গল্প? হুঁ, তোমার কাছে গালগল্প হলেও যারা দেখেছে তাদের কাছে তো নয়।”

“না বললে কিন্তু তোমার তামাক-টিকে চুরি করে লুকিয়ে রাখব।”

চোখ কপালে তুলে খাসনবিশ বলে, “ও বাবা, তুমি যে দেখছি গুটকের চেয়েও বেশি বিচ্ছু!”

“গুটকেটা তো হাঁদারাম, সাইকেল চালাতে পারে না।”

“তা না পারুক, গুটকে সাঁতার জানে। তুমি জানো?”

“ও আমি দু’দিনে শিখে নেব। এবার গল্পটা বলল। কুনকে আর ভোলা কী দেখেছিল?”

“কুনকে খুব হামাদ ছেলে, ভয়ডর বলতে কিছু নেই, বুঝলে!”

“সে আমারও নেই। তারপর বলো।”

“কথাই তো কইতে দাও না, কেবল ফুট কাটো। হ্যাঁ, তা হয়েছে কী গতবার শীতের শুরুতেই তারা দুজন এক দুপুরবেলা একটা ডিঙি নৌকো বেয়ে ওই দ্বীপে গিয়েছিল।”

“ওরা নৌকো বাইতে পারে বুঝি?”

“পারবে না? গাঁয়ের ছেলেরা সব পারে। তোমাদের শহুরে ছেলেদের মতো তো নয়।”

“আমিও দু’দিনে শিখে নেব। তারপর বলো।”

“তা তারা গিয়েছিল বেজির বাচ্চা খুঁজতে।”

“ওখানে বেজি আছে বুঝি?”

“প্রতাপরাজার আমলে মেলাই ছিল। উনি খুব বেজি পছন্দ করতেন। তা সেইসব বেজি এখন ঝাড়েবংশে বেড়েছে হয়তো।”

“এই যে বললে ওখানে সাপখোপের আড্ডা! বেজিরা তো সাপগুলোকে মেরেই ফেলবে।”

“ওরে বাবা, জঙ্গলের নিয়ম কি আর আমাদের মত? সেখানে সবাই থাকে। ঝগড়াঝাঁটি খুনখারাপি হয়, আবার থাকেও একসঙ্গে। সাপও আছে, বেজিও আছে। তা সেইখানে গিয়ে যখন জঙ্গলের মধ্যে দু’জনে বেজি খুঁজছিল সেই সময়ে হঠাৎ দেখতে পায় একটা খুব লম্বা লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”

“সেটাই কি ভূত?”

“আঃ, ফের কথা বলে! হ্যাঁ বাপু, সেটাই ভূত।”

“যাঃ, লম্বা লোক হলেই বুঝি ভূত হয়? তা হলে আমার নসু কাকাও তো ভূত।”

“ওরে বাপু, লম্বার তো একটা বাছবিচার আছে! তিন-চার হাত লম্বা হলে কথা ছিল না, এ-লোকটা যে সাত-আট হাত লম্বা।”

“তার মনে কত ফুট?”

“তা ধরো দশ বারো ফুট তো হবেই।”

“গুল মারছ খাসনবিশদাদা।”

“এইজন্যই তোমাকে কিছু বলতে চাই না।”

“দশ বারো ফুট লম্বা কি মানুষ হয়?”

“মানুষ হলে তবে তো?”

“তা সে-লোকটা কী করল?”

“কী আবার করবে? লোকটা একটা নারকোল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে চেয়ে ছিল। ওরা কি আর কিছু দেখেছে? ওরকম ঢ্যাঙা একটা লোককে দেখেই পড়ি কি মরি করে দৌড়ে এসে ডিঙিতে উঠে পালিয়ে এসেছে।”

“দুপুরবেলা?” “হ্যাঁ, ঠিক দুপুরবেলা। কথাতেই তো আছে, ঠিক দুকুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা।”