ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

১. পলাতক

শায়ক (উপন্যাস) – ময়ূখ চৌধুরী

১. পলাতক

খৃ: পূ: ৩২৭ অব্দ–দিঘীজয়ী বীর আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে ভারত আক্রমণ করল দুর্জয় গ্রীক বাহিনী। কয়েকজন ভারতীয় রাজাকে পরাস্ত করে আলেকজান্ডার যখন মগধ আক্রমণের উদ্যোগ করছেন, সেই সময় গ্রীকশিবির থেকে বহুদূরে অবস্থিত বিশা নামক মগধের অধীন করদরাজ্যের এক অখ্যাত সরাইখানায় শুরু হচ্ছে আমাদের বর্তমান কাহিনি…।

সরাইখানার মধ্যে একটি কাষ্ঠাধারের উপর খাদ্য রেখে কাঠের চারপায়াতে বসে আহার করছিল একটি যুবক। তার ছিন্ন ও মলিন বেশভূষা দেখে বোঝা যায় সে নিতান্ত দরিদ্র। সম্মুখে রক্ষিত আহার্যও ছিল অতি নিকৃষ্ট। স্পষ্টই বোঝা যায় বেশি দাম দিয়ে ভালো খাবার খাওয়ার সামর্থ্য তার নেই।

যুবকের থেকে একটু দূরে অনুরূপ কাষ্ঠাধার ঘিরে তিনটি চারপায়া কাঠের আসন অধিকার করে পানভোজন করছিল বিশারাজ্যের তিন সৈনিক। তারা খেতে খেতে কথা বলছিল এবং মাঝে মাঝে মলিন বেশধারী যুবকের দিকে বক্র কটাক্ষে দৃষ্টিনিক্ষেপ করছিল..

সৈনিকদের পানভোজনের পালা প্রায় শেষ। পানপাত্রে শেষ চুমুক দিয়ে শূন্য পাত্র সশব্দে কাষ্ঠাধারের উপর রেখে একজন সৈনিক উঠে দাঁড়াল, তারপর সঙ্গীদের দিকে চোখের ভঙ্গিতে ইশারা জানিয়ে উপস্থিত হল ভোজনরত যুবকের পাশে।

অপর দুটি সৈনিকও উঠে এসে যুবককে ঘিরে দন্ডায়মান হল। যে সৈন্যটি প্রথম উঠে গিয়েছিল, সে যুবককে উদ্দেশ্য করে বলল, ওরে হতভাগা! তোর চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি তোর কাছে একটি কপর্দকও নেই। এটা বিনামূল্যে খাওয়ার জায়গা নয়– বুঝেছিস?

যুবক মুখ তুলে তাকাল, কিন্তু কথা কইল না। উত্তর না পেয়ে বক্তা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, কীরে! কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে? ভদ্র ব্যক্তির সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় জানিস না? এখনই উঠে দাঁড়া। বর্বর! আমরা দাঁড়িয়ে আছি, আর তুই বসে আছিস?

সঙ্গেসঙ্গে প্রথম সৈনিক যুবকের চোয়ালে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দিল। যুবক ছিটকে পড়ল মাটিতে। আহত চোয়ালে একবার হাত বুলিয়ে সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।

কিন্তু সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই দ্বিতীয় সৈনিকতার মুখের উপর প্রচন্ড বেগে পদাঘাত করল। যুবক রক্তাক্ত মুখে আবার ধরাশায়ী হল। দাঁড়াতে চেষ্টা করল না, ভূমিতে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে বসে রইল।

সৈন্যরা চমকে গেল। তাদের পায়ে ছিল ভারী চামড়ার জুতো। সেই জুতো পরা পায়ের লাথি সজোরে মুখের উপর পড়লে যে-কোনো মানুষের পক্ষে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক খুব শক্ত ও বলিষ্ঠ মানুষ হলে চৈতন্য না হারালেও পদাঘাতের যন্ত্রণায় নিশ্চয়ই ছটফট করবে– কিন্তু এই হতভাগা অজ্ঞান হওয়া তো দূরের কথা, মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ পর্যন্ত করছে না! এমন কি তার মুখে-চোখে যন্ত্রণার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।

যে সৈন্যটি পদাঘাত করেছিল, সে আবার পা তুলল লাথি মারার জন্য। কিন্তু তার পা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত করার আগেই তার কাঁধের উপর এসে পড়ল একটি হাত এবং পরক্ষণেই তার দেহটা প্রবল আকর্ষণে ছিটকে সরে এল কয়েকহাত দুরে।

তিন সৈনিক সচমকে দেখল সরাইখানার মধ্যে উপস্থিত হয়েছে একটি বলিষ্ঠ পুরুষ! বলা বাহুল্য, সেই নবাগত মানুষটি টান মেরে প্রহার-উদ্যত সৈন্যটিকে যুবকের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে।

এই অভাবিত স্পর্ধায় তিন সৈনিক স্তম্ভিত হয়ে গেল। কোনো সাধারণ নাগরিক যে রাজ সৈন্যের গায়ে হাত তুলতে পারে এমন কথা তারা ভাবতেই পারেনি। আগন্তুকের পোশাক-পরিচ্ছদ বেশ জমকালো। তার ঊর্ধ্বাঙ্গে রয়েছে একটি ঘন সবুজ আঙরাখা, নিম্নাঙ্গে পারসীকদের ন্যায় সেলাই করা পীতবর্ণ অধোবাস– তার মস্তকে শোভা পাচ্ছে একটি রক্তবর্ণ উষ্ণীষ এবং সেই উষ্ণীষের শোভা বর্ধন করছে একটি পাখি পালক! নাকের তলায় সরু গোঁফ ঈষৎ বক্র হয়ে মাঝপথে থমকে গেছে, চোয়াল পরিষ্কার ভাবে কামানো শুধু চিবুকের উপর রয়েছে একটুখানি দাড়ি। এক নজর দেখলেই বোঝা যায় লোকটি দস্তুরমতো শৌখিন।

তবে চেহারা ও পোশাকে বাহার থাকলেও মানুষটি যে নিতান্ত ফুলবাবুটি নয়, সে কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তার কোমরে বাঁদিকে ঝুলছে একটি দীর্ঘ তরবারি। কটিবন্ধের ডানদিকে একটি বৃহৎ শিঙা দৃশ্যমান। শিঙাটি কোন কাজে লাগবে কে জানে, কিন্তু আগন্তুকের চোখের উগ্র দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় তলোয়ারটা নিতান্ত অঙ্গশোভার জন্য কটিবন্ধে স্থান পায় নি তলোয়ারের মালিক ওই বস্তুটিকে ভালোভাবেই ব্যবহার করতে জানে। উপরন্তু তার বাঁহাতের মণিবন্ধ থেকে পুরোবাহুর অর্ধাংশ আবৃত করেছে একটি চমনির্মিত আবরণ। পেশাদার যুদ্ধ-ব্যবসায়ী যোদ্ধা ওই ধরণের চর্মাবরণ ব্যবহার করে থাকে। আঘাত থেকে বাঁচতে এবং প্রত্যাঘাত করতে ব্যবহৃত হয় ওই ধরণের চর্মাবরণ।

সৈন্যরাও সশস্ত্র এবং দলে ভারি একের বিরুদ্ধে তিন! তবু আগন্তুকের অতর্কিত আবির্ভাব ও উদ্ধত আচরণ তাদের চমকে দিয়েছিল। তিনজন সশস্ত্র সৈনিকের বিরুদ্ধে একজন নগরবাসীর এমন যুদ্ধং দেহি মনোভাব কল্পনা করা যায় না।

বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আগন্তুক যে সৈনিকের কাঁধে হাত দিয়েছিল, সে ঘুষি বাগিয়ে এগিয়ে এল, কে তুই? সাধারণ নাগরিক হয়ে তুই রাজসৈন্যের গায়ে হাত তুলিস? তোর এত সাহস!

আগন্তুক হাসল, সাহসের পরীক্ষা পরে দেব, এখন একটু ভদ্রতার বিনিময় হয়ে যাক। কিছুক্ষণ আগেই ভদ্রতা শিক্ষা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল না? এস বৎস! গুরুর নিকট হতে কিঞ্চিৎ ভদ্রতার শিক্ষা গ্রহণ করো–

মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই আগন্তুক হাত চালাল। যুবকের মুখে যে সৈন্যটি লাথি মেরেছিল, মুখের উপর ঘুষি খেয়ে সে সশব্দে ধরাশয্যা গ্রহণ করল। তার দুই সঙ্গী সবিস্ময়ে দেখল একটি ঘুষিতেই সৈন্যটি অজ্ঞান হয়ে গেছে!

আগন্তুক সৈন্যদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করল না। তার মুষ্টিবদ্ধ হাত আবার আঘাত হানল দ্বিতীয় সৈনিকের উপরে। দুই হাতে পেট চেপে সৈন্যটি সামনে ঝুঁকে পড়তেই আগন্তুক বলল, তোমার পেট ব্যথা করছে বুঝি? নিশ্চয়ই খাবার হজম হয়নি। এখন তাহলে তোমার শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া উচিত।

সঙ্গেসঙ্গে চোয়ালে আর একটি মুষ্ঠাঘাত এবং প্রথমজনের মতো দ্বিতীয় সৈনিকও জ্ঞান হারিয়ে লম্বমান হল ভূমিপৃষ্ঠে!

তৃতীয় ব্যক্তি ছিল সেনাদের দলপতি। সে এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল– সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে, সে হানাহানিতে অংশগ্রহণের সময় পায় নি। এখন ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল আগন্তুকের উপর

পরক্ষণেই ব্যাপারটা কি ঘটল তা কেউ বুঝতে পারল না সরাই এর মালিক ও পদাহত যুবকটি দেখল দলপতির বিশাল দেহ ছিটকে পড়ল দেয়ালের উপর এবং সেখান থেকে মাটির উপর গড়িয়ে পড়ে স্থির হয়ে গেল!

আগন্তুক সরাইখানার মালিকের দিকে তাকিয়ে স্মিতমুখে বলল বড়োখোকা ঘুমিয়েছে। ওর শিষ্যরাও ঘুমিয়ে পড়েছে। খোকারা বড়ো অশিষ্ট আচরণ করছিল, তাই ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।

মালিক ধরাশায়ী তিন সৈনিকের দিকে তাকিয়ে বুঝল তাদের এখন জ্ঞান ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। ভরসা পেয়ে সে বললে, ওদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। ওরা সরাইখানায় প্রবেশ করলে নগরবাসী সাধারণ মানুষ লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে এখানে ঢুকতে চায় না। এই যুবক মনে হয় বিশার নাগরিক নয়, তাই সৈন্যদের দেখেও এখানে ঢুকেছিল।

আহত যুবককে হাত ধরে তুলল আগন্তুক, আমার সঙ্গে এস। এখানে আর থাকা নিরাপদ নয়। এই সেনাদের সঙ্গীরা হঠাৎ এসে পড়তে পারে।

যুবক তার জীর্ণ বস্ত্রের ভিতর থেকে কয়েকটি তাম্র মুদ্রা বার করে সরাই এর মালিকের হাতে দিল।

আগন্তুক বলল, তোমার কাছে অর্থ না থাকলেও ক্ষতি ছিল না। মঘবা খাদ্যের দাম চুকিয়ে দিত।

আগন্তুক বলল, কোনো সব্যক্তি তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়, আমি তা চাই না। বঞ্চনা ও অত্যাচারের প্রতিকার করতে আমি সর্বদাই সচেষ্ট।

যুবকের দিকে তাকিয়ে আগন্তুক আবার বলল, আমি ঠিক সময়েই এসে পড়েছিলাম।

নিষ্প্রাণ নিরুৎসুক স্বরে বলল, ধন্যবাদ মহাশয়। কিন্তু আপনি না এলেও বিশেষ ক্ষতি ছিল না।

আরও কিছুদূর এগিয়ে গাছতলায় বাঁধা একটি ঘোড়ার পাশে দাঁড়াল আগন্তুক, তারপর যুবককে উদ্দেশ করে বলল, উঠে পড়ো। ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস আছে তো? অভ্যাস না থাকলেও অসুবিধা হবে না, আমি তোমার পিছনে বসে তোমায় ধরে রাখব।

আগন্তুক সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। কিন্তু তার প্রসারিত হস্তকে উপেক্ষা করে যুবক। একলাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসল। আগন্তুক এমন তৎপরতা আশা করে নি, বিস্ময়ের চমক সামলে সে যুবকের পিছনে স্থান গ্রহণ করে ঘোড়া চালিয়ে দিল। কিছুক্ষণ অশ্বারোহণে চলার পর আগন্তুক বলল, আমরা এখন নৈমিষারণ্যের দিকে চলেছি। ওইখানে আমার আস্তানা। আমার নাম মঘবা।

যুবক স্তব্ধ, নির্বাক। কোথায় পাওয়া হচ্ছে অথবা চার পাশে কি ঘটছে সে বিষয়ে তার কিছুমাত্র কৌতূহল নেই।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল মঘবা, এখানকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা আমার নাম জানে। আমাকে চাক্ষুষ দেখেছে খুব কম লোক কিন্তু মঘবা নামটি সকলেরই পরিচিত। তুমি বোধহয় এখানকার মানুষ নও। কোথায় থাকো তুমি?

–বিপুল আর্যাবর্ত আমার বাসভূমি। কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আমি বাস করি না। বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ করতে করতে আজই এখানে এসে পড়েছি।

–তোমার নাম কি?

–সুবন্ধু।

-শোন সুবন্ধু! তুমি যখন এখানকার অধিবাসী নও। তখন এই রাজ্যের পরিস্থিতি তোমার জেনে রাখা উচিত। নাহলে আবার বিপদে পড়বে। এই রাজ্যের নাম বিশা। বিশার রাজা অলষুষ অতিশয় অত্যাচারী পাষণ্ড। প্রজারা তার অত্যাচার ও উৎপীড়নে অতিষ্ঠ। আমি কয়েকজন সাহসী রণনিপুণ নাগরিককে নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেছি। আমরা সকলেই নৈমিষারণ্য নামক নিকটবর্তী অরণ্যে আত্মগোপন করে আছি। আমরা সুযোগ পেলেই রাজার সম্পত্তি লুঠ করি। লুণ্ঠিত অর্থের কিছু অংশ দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করি এবং কিছু অংশ বিদ্রোহী-বাহিনীর অন্নবস্ত্রের জন্য ব্যয় করে থাকি। রাজা অলঘুষ আমার মাথার জন্য সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। কিন্তু ওই অর্থের লোভে কোনো সেনানায়ক নৈমিষারণ্যে প্রবেশ করতে সাহস পায় না। ওই অরণ্য বিশার সৈন্যদলের পক্ষে মৃত্যুফঁদের মতোই ভীতিপ্রদ। ওখানে অমরা আপাতত নিরাপদ, কিন্তু সেই নিরাপত্তা কতদিন বজায় থাকবে বলা যায় না। বিশা মগধের করদরাজ্য– রাজা অলষুষ মগধের অধিপতি নন্দরাজার অন্তরঙ্গ বান্ধব ভবিষ্যতে অলঘুষের অনুরোধে যদি নন্দরাজা মগধের সেনাদল প্রেরণ করে, তাহলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়ব। মগধের সুশিক্ষিত বিপুল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে এই মুহূর্তে আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করা হয় না। কারণ, গ্রীকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকায় নন্দরাজার অধীন মগধবাহিনী এখন প্রতিরক্ষার জন্য সর্বতোভাবে প্রস্তুত হচ্ছে এই সময় সেনাদলের কোনো অংশকেই সে ভিন্নরাজ্যে নিযুক্ত করতে চাইবে না।

যুবক মঘবার কথা শুনল নীরবে, কোনো মন্তব্য করল না। মঘবাও আর কথা বলার চেষ্টা না করে অশ্বকে চালনা করল তার আস্তানার দিকে…

নৈমিষারণ্যে মঘবার আস্তানায় কয়েকটি দিন অতিবাহিত হল। সুবন্ধুর ক্ষতস্থান ধুয়ে দলের চিকিৎসক নাগদেব বিভিন্ন ঔষধ প্রয়োগ করে তাকে সুস্থ করে তুলল। কিন্তু সুবন্ধুর আচরণ পূর্ববৎ। সে কারও সঙ্গে কথা বলে না। প্রশ্ন করলে কখনও উত্তর দেয়, কখনও দেয় না। খাওয়ার ডাক পড়লে নিঃশব্দে এসে আহার করে উঠে যায়।

সুবন্ধু সম্পর্কে সব কথাই দলের লোকদের জানিয়েছিল মঘবা। একদিন যখন সকলে মিলে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করছে, সেইসময়ে হঠাৎ দলের মধ্যে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও দুঃসাহসী বলে খ্যাতিমান বজ্র নামক যোদ্ধাটি বলে উঠল, ওহে মঘবা! এই সুবন্ধু লোকটার ব্যাপারটা কি বল তো? লোকটার দেখছি কোনো কিছুতেই গা নেই। মনে হয় আদর-ভালোবাসা, অবহেলা-অপমান সবই তার কাছে সমান, কিছুতেই তার স্পৃহা নেই।

মল্লযুদ্ধে দুর্জয় ক্ষুদ্রক নামে মঘবার সহচর বলল, মঘবা! তোমার কাছে যা শুনেছি, তাতে মনে হয় ওই যুবক নিতান্তই ভীরু চরিত্রের মানুষ। সৈন্যরা যখন তাকে প্রহার করছিল তখন সে বাধা দিতে সাহস করে নি, নির্বিকারভাবে মার খেয়েছে। তুমি যখন তাকে সাহায্য করতে এলে তখনও তোমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে অত্যাচারী সৈন্যদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় নি। লোকটা একেবারে মেরুদণ্ডহীন ক্লীব– পুরুষ নামের অযোগ্য, কাপুরুষ।

মঘবা ও তার যোদ্ধৃবর্গের মন্ত্রণাদাতা প্রবীণ ব্রাহ্মণটি যে কখন নিঃশব্দে এসে সকলের কথা শুনছিলেন, তা কেউ লক্ষ্য করে নি- এইবার সকলকে চমকে দিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ওই যুবকের মনে কষ্ট আছে। ওকে আজ তোমরা বুঝবার চেষ্টা কোরো না। ওকে একা থাকতে দাও।

ব্রাহ্মণকে অভিবাদন জানিয়ে ক্ষুদ্রক বলল, গুরুদেব! আপনি প্রবীণ এবং লোকচরিত্রে বিলক্ষণ অভিজ্ঞ। কিন্তু শশক সম্পর্কে বোধহয় আমরা ভুল করি নি।

-শশক! সে আবার কে?

–গুরুদেব! ওই যুবকের নাম সুবন্ধু। কিন্তু যুবকটি শশকের ন্যায় ভীরু। তাই আমরা ওর নাম রেখেছি শশক।

ভুল করেছ, ব্রাহ্মণ গম্ভীর স্বরে বললেন, পৃথিবীতে বাঁচার প্রয়োজন ওর কাছে ফুরিয়ে গেছে। ওকে শান্তিতে দিনযাপন করতে দাও। একদিন হয়তো সে জীবনধারণের সার্থকতা খুঁজে পাবে। আর সেইদিনই তোমরা ওর স্বরূপ নির্ণয় করতে পারবে সঠিকভাবে।

একটু দূরে একটা গাছের তলায় চুপচাপ বসেছিল সুবন্ধু। তার দিকে তাকিয়ে মঘবা হাঁক দিল, সুবন্ধু! শুনে যাও।

যন্ত্রচালিতের মতো ধীর পদক্ষেপে সুবন্ধু এসে দাঁড়াল মঘবার সামনে। মঘবা বলল, কয়েকদিন পরেই বিশারাজ্যের বৃহত্তম সারিবদ্ধ পণ্যবিপণনিতে বস্ত্র বিক্রয় করতে যাবে বজ্র নামক তন্তুরায়। যে-সব কাপড় বিক্রয় হবে না, সেগুলোকে অশ্বচালিত শকটে বহন করে বজ্র যাবে কোশল নামক অন্য রাজ্যে। দৈবক্রমে সেদিনের সেই তিন সৈনিকের নজরে যদি পড়ে যাও, তাই শকটের ব্যবস্থা করেছি। ধাবমান অশ্ববাহিত রুদ্ধদ্বার শকটের মধ্যে তোমাকে কেউ দেখতে পাবে না। কোশল রাজ্যে পৌঁছালে আর তোমার ভয় নেই। এই অরণ্যেও অবশ্য তুমি নিরাপদ। কিন্তু এটা হচ্ছে যোদ্ধাদের আস্তানা, এখানে তুমি বেশিদিন থাকতে পারবে না।

নির্দিষ্ট দিনে বিভিন্ন ধরনের ভোজ্য, পরিধেয় ও নিত্যব্যবহার্য বস্তুতে সজ্জিত পণ্যবিপণির একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সুবন্ধু আর মঘবা। ঠিক দুপুরে আসবে বজ্র। সুবন্ধু আর মঘবা একটু আগেই এসে অপেক্ষা করছিল তার জন্য। কথা ছিল বজ্র যখন হাটের মধ্যে তার পসরা সাজিয়ে বসবে, তখন গাড়ির ভিতর লুকিয়ে বসে পড়বে সুবন্ধু। গাড়ির বন্ধ দরজা খুলে কেউ উঁকি মারতে আবে না কাজেই সুবন্ধুর ধরা পড়ার ভয় নেই। যথাসময়ে বিক্রি-বাটা চুকিয়ে বভ্র ঘোড়ার গাড়িতে উঠবে এবং সেনাদলের অগোচরে কোশলরাজ্যের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে সুবন্ধুকে।

পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি ছিল না, কিন্তু বরাত খারাপ— একদল রাজসৈন্য হাটের মধ্যে টহল দিচ্ছিল, তাদের মধ্যে ছিল সরাইখানায় মঘবার প্রহারে জর্জরিত সৈন্যদের দলপতি। এতদিনেও তার গায়ের ব্যথা যায় নি। হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল মঘবার দিকে।

মঘবার মাথায় আজ উষ্ণীষ ছিল না। কালো কাপড় দিয়ে মাথা ও মুখের কিছু অংশ সে ঢেকে রেখেছিল। রাজসৈন্যদলের কেউ কেউ তাকে চিনতো, তাই এই সতর্কতা। তৎক্ষণাৎ সে চিৎকার করে সঙ্গীদের বলল, ওই যে দুবৃত্ত দাঁড়িয়ে আছে! মনে করেছে কালো কাপড়ে মাথা ঢাকলে কেউ ওকে চিনতে পারবে না। সৈন্যগণ! ওকে ধরো। পাপিষ্ঠ যেন পালাতে না পারে।

একদল হিংস্র নেকড়ের মতো ছুটে এল সেনাবাহিনী। সঙ্গেসঙ্গে মঘবার হাতে সূর্যালোকে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে জ্বলে উঠল কোষমুক্ত তরবারি। সুবন্ধু মঘবার পাশে দাঁড়াল না, তীরবেগে ছুটে অন্তর্ধান করল অকুস্থল থেকে। সৈন্যরা একবারও সুবন্ধুর দিকে চাইল না, তাদের সমবেত ক্রুদ্ধ দৃষ্টি তখন মঘবার দিকে।