১. নীরা ত্রাতিনা

নীরা ত্রাতিনা গোল জানালা থেকে ভেসে ভেসে সরে যাচ্ছিল, সে হাত বাড়িয়ে জানালার কাচটা স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে নেয়। জানালার শীতল কাঁচে মুখ স্পর্শ করে সে দূর পৃথিবীর দিকে তাকায়, দুই হাজার কিলোমিটার দূরের নীল পৃথিবীটাকে কী সুন্দরই না। দেখাচ্ছে! উপর থেকে মহাদেশগুলোকে স্পষ্ট দেখা যায়, সাদা মেঘে বিষুব অঞ্চলটা ঢেকে আছে। এরকম কোনো একটা মেঘের নিচে এই মুহূর্তে তার প্রিয় শহর টেহলিস আড়াল পড়ে গেছে। কতদিন সে তার শহরে যায় নি, মহাকাশে ভেসে ভেসে সে কী গভীর একটা ভালবাসা নিয়েই না মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শহরটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

ফ্লাইট ক্যাপ্টেন রিশান মহাকাশ স্টেশনের শেষ মাথায় বড় টেলিস্কোপটায় চোখ লাগিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সে টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে ভেতরে তাকিয়ে নীরা ত্রাতিনাকে দেখতে পায়। ছিপছিপে কম বয়সী তরুণী, ঝকঝকে খাপখোলা তলোয়ারের মতো চেহারা। এই কম বয়সেই নিজেকে একজন সত্যিকার মহাকাশচারী হিসেবে পরিচিত করে ফেলেছে। মেয়েটির জন্য রিশান মাঝে মাঝেই নিজের বুকের গভীরে কোথাও এক ধরনের ভালবাসা অনুভব করে। কখনো সেটা সে প্রকাশ করে নি, কিন্তু সেটা কি এই মেয়েটার কাছে গোপন রয়েছে?

রিশান তার টেলিস্কোপটা ছেড়ে দেয়াল স্পর্শ করে ভাসতে ভাসতে নীরা ত্রাতিনার কাছে এগিয়ে এল। কাছাকাছি এসে জানালা স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে বলল, নীরা, এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ তুমি? O।

নীরা ত্রাতিনা রিশানের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসল, বলল, এই মহাকাশ থেকে পৃথিবী ছাড়া দেখার মতো আর কী আছে বলো?

 রিশান বলল, তুমি যেভাবে দেখছ, তাতে মনে হচ্ছে পৃথিবীটা আগে কখনো দেখ নি।

নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, সেটা তুমি কিন্তু খুব ভুল বলে নি। এখান থেকে আমি যতবার পৃথিবীকে দেখি ততবার মনে হয় আমি যেন প্রথমবার দেখছি।

রিশান বলল, আর দু সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীটাকে তুমি আরো অনেক কাছে থেকে দেখতে পাবে!

নীরা ত্রাতিনা বড় বড় চোখে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ। আমি খবর পেয়েছি, নতুন ক্রু আসছে। আমরা পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি।

নীরা ত্রাতিনা অবিশ্বাসের গলায় বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না!

প্রথমে আমারও বিশ্বাস হয় নি। তখন আমি মহাকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করেছি, তারা বলেছে এটি সত্যি।

নীরা একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল, দেখবে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রোগ্রামটা বাতিল করে দেবে।

না, তার সুযোগ নেই। মহাকাশ স্টেশনে টানা ছয় মাসের বেশি কারো থাকার নিয়ম নেই।

নিয়ম নেই তাতে কী হয়েছে? হয়তো আমাদের দিয়েই নিয়ম করবে। টানা ছয়। মাসের বেশি একটা মহাকাশ স্টেশনে থাকলে মহাকাশচারীদের মেজাজ কেমন তিরিক্ষে হয়ে থাকে সেটা নিয়েই হয়তো গবেষণা হবে।

রিশান শব্দ করে হেসে বলল, তোমার ভয় নেই নীরা। সেসব নিয়ে গবেষণা বহুকাল আগে শেষ হয়ে গেছে।

তা হলে তুমি বলছ আমরা সত্যি সত্যি পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি?

হ্যাঁ নীরা, আমরা দু সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি।

চমৎকার! নীরা জানালা থেকে হাতটা সরাতেই ভেসে উপরে উঠে যেতে শুরু করে। মহাকাশ স্টেশনের ছাদ স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে বলল, এই সুসংবাদটি দেবার জন্য চল একটু স্ফুর্তি করা যাক।

রিশান হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী রকম স্ফুর্তি করার কথা ভাবছ?

উত্তেজক পানীয় খেয়ে সবাইকে নিয়ে খানিকক্ষণ চেঁচামেচি করা যেতে পারে। আমার কাছে খাঁটি প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি একটা কেক আছে, ভালো কোনো ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মহাকাশ স্টেশনে এর থেকে ভালো কোনো ঘটনা আর কী হতে পারে।

ঠিকই বলেছ। রিশান বলল, তুমি সবাইকে খবর দিয়ে কেকটা কাটা শুরু কর। আমি আসছি। টেলিস্কোপে একটা গ্রহাণু একটু দেখে আসি।

নীরা ত্রাতিনা ভুরু কুঁচকে বলল, হঠাৎ করে এই গ্রহাণু দেখার জন্য ব্যস্ত হচ্ছ কেন?

মহাকাশ কেন্দ্র থেকে বলেছে। গতিপথটা নাকি সুবিধার নয়। পৃথিবীর কক্ষপথে পড়তে পারে।

নীরা ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল, বলল, পৃথিবীর মানুষের ভয় বড় বেশি। মহাকাশে একটা নুড়ি পাথর দেখলেও তাদের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়।

রিশান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। তবে বেচারাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না, পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগেকার ঘটনা মনে হয় ভুলতে পারছে না। পুরো ডাইনোসর জগৎ উধাও হয়ে গেল-সেই তুলনায় মানুষ তো রীতিমতো অসহায় প্রাণী!

ঠিক আছে তুমি গ্রহাণুটা দেখে আস। আমি সবাইকে ডেকে আনি।

.

আধঘণ্টা পর মহাকাশ স্টেশনের তিরিশ জন ক্রু নিয়ে একটা জমাট পার্টি শুরু হল। নীরা ত্রাতিনার বাচিয়ে রাখা কেক, কিছু বেআইনি উত্তেজক পানীয় এবং নিয়মবহির্ভূত গানবাজনায় ছোট মহাকাশযানটা রীতিমতো উদ্দাম হয়ে ওঠে। মহাকাশ স্টেশনের তরশূন্য পরিবেশে বিচিত্র নাচগানের চেষ্টা করতে গিয়ে ছোট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে একটা অবলাল ক্যামেরার মূল্যবান লেন্সটা ভেঙে ফেলার পর সিকিউরিটি অফিসার ফুল হাত তুলে পার্টির সমাপ্তি ঘোষণা করল, গলা উঁচিয়ে বলল, অনেক হয়েছে। সবাই এখন থাম। বাকিটুকু পৃথিবীর জন্য থাকুক।

আমুদে পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, পৃথিবীতে কি আমরা এই নাচ নাচতে পারব? কখনো পারব না।

না পারলে নাই। কিন্তু তোমরা যা শুরু করেছ আরেকটু হলে মহাকাশ স্টেশনের দেয়াল ভেঙে বের হয়ে যাবে।

জীববিজ্ঞানী কিরি বলল, আর একটু থুল।

উঁহু। আর না। তোমরা যেভাবে বেআইনি উত্তেজক পানীয় খাচ্ছ যদি পৃথিবীতে সেই খবর পৌঁছায় তা হলে নির্ঘাত আমাকে জেলে পুরে রাখবে।

নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি সেটা নিয়ে মন খারাপ করো না। কথা দিচ্ছি আমরা প্রতি সপ্তাহে জেলে তোমার সাথে খাবারের প্যাকেট নিয়ে দেখা করতে আসব।

থুল জোর করে মুখ শক্ত করে বলল, তুমি আমাকে দেখতে আসবে না আমি তোমাকে দেখতে আসব সে ব্যাপারে তুমি এত নিশ্চিত হলে কেমন করে?

রিশি ঠাট্টা করে কী একটা বলতে যাচ্ছিল সিকিউরিটি অফিসার থুল তার সুযোগ দিল। হাত নেড়ে বলল, আর ঠাট্টা-তামাশা নয়। পার্টি শেষ। এখন যে যার কাজে যাও।

কাজেই কিছুক্ষণের ভেতরে যে যার কাজে চলে গেল। নীরা ত্রাতিনার এই মুহূর্তে কোনো কাজ নেই, ভেসে ভেসে নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে তার রিশানের সাথে দেখা হয়ে গেল, হালকা গলায় বলল, খুব মজা হল আজকে তাই না?

রিশান অন্যমনস্ক গলায় বলল, হুঁ।

নীরা ত্রাতিনা রিশানকে ভালো করে লক্ষ করল, মুখটায় এক ধরনের দুশ্চিন্তার ছাপ। সে দেয়ালে হাত দিয়ে নিজেকে থামিয়ে বলল, কী ব্যাপার রিশান, কিছু হয়েছে নাকি?

না। কিছু হয় নি।

তা হলে তোমাকে এত দুশ্চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?

ঐ গ্রহাণুটা-

কী হয়েছে গ্রহাণুটার?

পাজি গ্রহাণুটা একেবারে পৃথিবীর কক্ষপথে।

কত দূরে আছে?

এখনো অনেক দূর, প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন কিলোমিটার।

তা হলে এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? এত দূরে থাকতে কখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।

রিশান চিন্তিত মুখে বলল, না, দুশ্চিন্তা করছি না। তবে

তবে কী?

যদি এটা তার গতিপথ না বদলায় তা হলে আমাদের এটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে হবে। তার মানে বুঝতে পেরেছ?

নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বুঝতে পারছি। সেটা করতে হবে আমাদের।

হ্যাঁ।

নীরা ত্রাতিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে আমাদের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া পিছিয়ে যাবে।

হ্যাঁ। রিশান জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, পার্টিটা মনে হয় আমরা একটু আগেই করে ফেলেছি!

নীরা ত্রাতিনা বলল, মোটও আগে করি নি। ঠিক সময়ে করেছি।

কীভাবে ঠিক সময়ে করা হল?

যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে না পারি তা হলে এই গ্রহাণুকে আমাদের চূর্ণবিচূর্ণ করতে হবে। তা হলে ধরে নাও পার্টিটা হয়েছে পাজি গ্রহাণুকে চূর্ণবিচূর্ণ করা উপলক্ষে।

রিশান শব্দ করে হেসে বলল, মহাকাশে ছুটে আসা গ্রহাণুকে ধ্বংস করা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক, সবচেয়ে ভয়ংকর কাজগুলোর একটি। সেটা উপলক্ষে পার্টি করতে হলে বেশ নার্ভের প্রয়োজন!

নীরা ত্রাতিনা বলল, আমার নার্ভ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

রিশান বলল, জানি।

যদি সত্যি সত্যি নিউক্লিয়ার মিসাইল নিয়ে যেতে হয় আমি কিন্তু যাব।

ঠিক আছে।

এখন কি তুমি টেলিস্কোপে আবার গ্রহাণুটাকে দেখতে যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

আমি কি তোমার সাথে দেখতে পারি?

হ্যাঁ। অবশ্যই দেখতে পার।

নীরা ত্রাতিনা আর রিশান ভেসে ভেসে মহাকাশ স্টেশনের বড় টেলিস্কোপটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

.

এই মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবী থেকে দুই হাজার কিলোমিটার উপরে একটা কক্ষপথে বসানো রয়েছে। দুই ঘণ্টার কাছাকাছি সময়ে এটা পৃথিবীকে একবার করে প্রদক্ষিণ করে। এই মহাকাশ স্টেশনে সব সময় বিজ্ঞানীদের একটি দল থাকে, মহাকাশ নিয়ে নানা গবেষণা করার জন্য তাদের পাঠানো হয়। দৈনন্দিন কাজের বাইরেও তাদের আরো নানা ধরনের কাজ করতে হয়-কোনো একটি গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ছুটে এলে সেটাকে মাঝপথে থামিয়ে বিস্ফোরিত করে দেওয়া সেরকম একটা কাজ।

টেলিস্কোপের আইপিসে চোখ লাগিয়ে নীরা ত্রাতিনা বলল, কী বীভৎস দেখতে!

হ্যাঁ, এই গ্রহাণুটা দেখতে ভালো নয়।

কেমন লালচে রং দেখছ? পচা ঘায়ের মতন।

রিশান বলল, হ্যাঁ। এটা এস-টাইপ গ্রহাণু। লোহা আর ম্যাগনেসিয়ামে তৈরি। শতকরা পনের ভাগ গ্রহাণু এরকম।

নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, প্রহাণুটা তার কক্ষপথ ছেড়ে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসতে শুরু করল কেন?

ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত অন্য কোনো গ্রহাণুর সাথে ধাক্কা লেগে গতিপথ পাল্টে গেছে।

নীরা ত্রাতিনা খানিকক্ষণ গ্রহাণটা লক্ষ করে বলল, গ্রহাণ হিসেবে এটা বেশ বড়।

হ্যাঁ। প্রায় বারো কিলোমিটার। সত্যি সত্যি পৃথিবীতে আঘাত করলে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে।

নীরা ত্রাতিনা টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে বলল, শুধু শুধু দুশ্চিন্তা না করে চল এর গতিপথটা বের করে ফেলি।

হ্যাঁ। আমি সেজন্য এসেছি।

আমার এখন সেরকম কোনো কাজ নেই। তোমাকে সাহায্য করতে পারি?

অবশ্যই। তুমি যদি শুধু পাশে বসে থাক তা হলেই আমার অনেক বড় সাহায্য হবে। একা একা এই বিদঘুটে গ্রহাণুটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না।

তোমার ভয় নেই রিশান, আমি তোমার সাথে আছি।

পরবর্তী ছয় ঘণ্টা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে গ্রহাণুর গতিপথটি ছকে ফেলে নীরা ত্রাতিনা আর রিশান আবিষ্কার করল টোরকা নামের বারো কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটা গ্রহাণু মূর্তিমান বিভীষিকার মতো পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। গ্রহাণুটি লালচে, আকৃতি একটু লম্বা এবং পৃষ্ঠদেশ অসমতল। গ্রহাণুটি ঘুরছে এবং সে কারণে গতিপথ অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে একচল্লিশ দিনের মাথায় এই গ্রহাণুটির বায়ুমণ্ডলে ঢোকার কথা।

এরপর যে ঘটনাটি ঘটবে সেটি কেউ চিন্তাও করতে সাহস পায় না।

কিছুক্ষণের মাঝেই মহাকাশযানের সব ক্রু গ্রহাণু টোরকার কথা জেনে গেল, মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন জরুরিভাবে সবাইকে তার কেবিনে ডেকে পাঠাল। গ্রহাণুটা পৃথিবীকে আঘাত করলে কী হতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পদার্থবিজ্ঞানী রিশি একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, টোরকা গ্রহাণুটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঘণ্টায় এক শ বিশ হাজার কিলোমিটার বেগে আঘাত করবে।

উপস্থিত বেশ কয়েকজন বিস্ময়ে শিস দেবার মতো একটা শব্দ করল। রিশি মাথা নেড়ে বলল, গ্রহাণুটার আকার বারো কিলোমিটার। এটা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে যাবে এবং কিছু বোঝার আগে, প্রায় চোখের পলকে, পৃথিবীতে আঘাত করবে। শেষবার এরকম একটা উল্কা আঘাত করেছিল জনমানবহীন সাইবেরিয়াতে তাই কোনো প্রাণহানি হয় নি। কিন্তু এই গ্রহাণুটা আঘাত করবে এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল এলাকায়। গ্রহাণুটা যখন পৃথিবীতে আঘাত করবে সেটা পৃথিবীর উপরের স্তর কয়েক কিলোমিটার ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাবে। সেই ভয়ংকর বিস্ফোরণটি হবে কয়েক হাজার নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণের সমান। মুহূর্তে প্রায় অর্ধবিলিয়ন মানুষ মারা যাবে।

যারা উপস্থিত ছিল তারা আবার শিস দেবার মতো একটা শব্দ করল। রিশি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। সেটা হচ্ছে স্ক। এই বিস্ফোরণে পাথর ধুলাবালি বিদ্যুৎগতিতে উপরে উঠে যাবে। কেন জান?

নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, কেন?

কারণ এই গ্রহাণুটা যখন পৃথিবীর দিকে ছুটে যাবে তখন তার পেছনের সব বাতাসকে সরিয়ে নেবে, পেছনে থাকবে একটা শূন্যতা, সেই শূন্য গহ্বর দিয়ে ধুলাবালি পাথর ধোঁয়া আবর্জনা সবকিছু উঠে আসবে। তারপর সেটা ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীর আকাশে। আমাদের কেউ যদি তখন মহাকাশের এই স্টেশনে থাকি তা হলে আমরা দেখব কালো ধোঁয়ায় পৃথিবীটা ঢেকে যাচ্ছে। গ্রহটিকে আর নীল দেখাবে না, এটাকে দেখাবে ধূসর।

রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে দিন-রাতের কোনো পার্থক্য থাকবে না, পুরোটাই হবে কালো রাত। কুচকুচে অন্ধকারে সবকিছু ঢাকা থাকবে। হিমশীতল ঠাণ্ডায় পৃথিবী স্থবির হয়ে যাবে। আকাশ থেকে কালো ধুলাবালি পৃথিবীতে পড়তে থাকবে, পুরো পৃথিবী ঢেকে। যাবে কালো ধুলার স্তরে। প্রথমে যারা মারা যায় নি তখন তারা মারা পড়তে শুরু করবে।

রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করল। জীববিজ্ঞানী কিরি বলল, হ্যাঁ আমার ধারণা পৃথিবীর জীবিত প্রাণীর প্রায় নিরানব্বই শতাংশ মারা যাবে। সমুদ্রের পানি ধুলায় ঢেকে যাবে, জলজ প্রাণীরা নিশ্বাস নিতে পারবে না। গাছপালা কীটপতঙ্গ মারা যাবে প্রচণ্ড শীতে। পশুপাখি মারা যাবে না খেতে পেয়ে। তাদের খেয়ে বেঁচে থাকত যে প্রাণী তখন মারা যাবে সেই। প্রাণী! ফুড চেইন ধরে একটি একটি প্রজাতি ধ্বংস হতে শুরু করবে। পরবর্তী এক বছরে পুরো পৃথিবী প্রায় প্রাণহীন একটা গ্রহে পাল্টে যাবে।

রিশি বলল, হ্যাঁ। এক দুইজন মানুষ নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকবে। তারা আবার একেবারে গোড়া থেকে পৃথিবীর সভ্যতা শুরু করবে!

রিশির কথা শেষ হবার পরও সবাই কেমন যেন হতচকিতের মতো বসে থাকে, পুরো বিষয়টি যেন এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সিকিউরিটি অফিসার থুল কিছু একটা বলার চেষ্টা করে থেমে গেল। ঠিক তখন একটা হাসির শব্দ শোনা যায়-সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হাসছে।

থুল একটু ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, কী হল? তুমি হাসছ কেন?

তোমাদের সবাইকে দেখে।

আমাদের মাঝে হাসির ব্যাপারটা কী?

তোমাদের চেহারা দেখেই হাসি পাচ্ছে। তাকিয়ে দেখ সবাইকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে টোরকা গ্রহাণুটা সত্যি সত্যি পৃথিবীকে আঘাত করে ফেলেছে। সত্যি সত্যি পৃথিবীর সব মানুষ মরে ভূত হয়ে গেছে। মনে রেখ এখনো ব্যাপারটা ঘটে নি এবং আমরা সেটা ঘটতেও দেব না।

কেউ কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। নীরা ত্রাতিনা বলল, আমরা এখান থেকে একটা মিসাইল দিয়ে গ্রহাণুটাকে আঘাত করব। নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে টোরকাকে টুকরো টুকরো করে দেব।

রিশান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমাদের কাছে পৃথিবী থেকে সেরকম একটা নির্দেশ এসেছে।

কাজেই তোমরা সবাই এরকম প্যাচার মতো মুখ করে থেকো না। তোমাদের দোহাই লাগে-শুধু শুধু কেউ মুখ ভোঁতা করে বসে থাকলে দেখতে খুব খারাপ লাগে!

নীরা ত্রাতিনার কথা শুনে এবারে বেশ কয়েকজন সহজ গলায় হেসে উঠল। রিশি বলল, নীরা ঠিকই বলেছে। এই বিদঘুটে গ্রহাণুটা তো সত্যি সত্যি পৃথিবীকে আঘাত করে নি! আমরা এটাকে তার আগেই ধ্বংস করব।

থুল হাত উঁচু করে বলল, অবশ্যই ধ্বংস করব।

একসাথে এবারে অনেকে হাত তুলে প্রায় স্লোগানের ভঙ্গিতে বলল, অবশ্যই ধ্বংস করব।

.

একটা স্কাউটশিপে করে ফ্লাইট ক্যাপ্টেন রিশান এবং মহাকাশচারী শুরার গ্রহাণু টোরকার কাছে যাবার কথা ছিল, কিন্তু নীরা ত্রাতিনা বলল সেও যেতে চায়। কাজটি বিপজ্জনক তাই কেউ যদি স্বেচ্ছায় যেতে চায় তাকে অগ্রাধিকার দেবার নিয়ম। নীরা ত্রাতিনার বয়স তুলনামূলকভাবে কম হলেও সে প্রথম শ্রেণীর মহাকাশচারী। তাই পৃথিবী থেকে তার অনুমতি পেতে সমস্যা হল না। স্কাউটশিপটি ছোট, সেখানে তিন জন যাওয়া সহজ নয় তাই শেষ পর্যন্ত। রিশান এবং মহাকাশচারী শুরার পরিবর্তে নীরা ত্রাতিনাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।

গ্রহাণুটি এখনো অনেকখানি দূরে কিন্তু সেটা কাছে আসার জন্য কেউই অপেক্ষা করতে রাজি নয়। এটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধ্বংস করা দরকার তাই রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা খুব তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মচারীরা স্কাউটশিপে দুটি হালকা নিউক্লিয়ার বোমা তুলে দেয়। স্কাউটশিপে জ্বালানি ভরতে অনেক সময় লেগে গেল। সেখানকার মূল কম্পিউটারে মহাকাশ স্টেশন এবং পৃথিবী থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রবেশ করিয়ে শেষ পর্যন্ত স্কাউটশিপটাকে রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত করে নেওয়া হল।

মহাকাশযানের ইঞ্জিনিয়াররা যখন স্কাউটশিপটার যান্ত্রিক ঘুঁটিনাটি শেষবারের মতো পরীক্ষা করছে তখন বায়ু নিরোধক গোলাকার হ্যাঁচ দিয়ে রিশান আর নীরা ত্রাতিনা তাদের স্কাউটশিপে গিয়ে ঢোকে। ধাতব দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে দু জনে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারে বসে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই কাউন্ট ডাউন রু হয়ে যায়। সামনে বড় মনিটরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের অফিসারদের দেখা যায়, তারা গম্ভীর গলায় কিছু রুটিন চেকআপ করে নেয়। নীরা ত্রাতিনা আর রিশান তাদের অভিজ্ঞ হাতে কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ স্পর্শ করে পুরো স্কাউটশিপটাকে সচল করতে থাকে।

কিছুক্ষণের ভেতরেই একটা চাপা গুম গুম শব্দ করে স্কাউটশিপটা গভীর মহাকাশের দিকে ছুটতে থাকে।

.

পৃথিবীর মহাকর্ষ থেকে বের হবার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে স্কাউটশিপটা তার গতি সঞ্চয় করতে থাকে। মহাকাশযানের ককপিটে বসে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা তার তৃরণটুকু অনুভব করতে শুরু করে। তাদের মনে হতে থাকে অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি তাদেরকে চেয়ারে চেপে ধরেছে। রিশান কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে বলল, নীরা, সবকিছু ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ, কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিক আছে।

তুমি যদি সহ্য করতে পার তা হলে গতিবেগ আরো দ্রুত বাড়িয়ে ফেলি।

আমি সহ্য করতে পারব।

চমৎকার। রিশান থ্রটল বারটা নিজের কাছে টেনে আনতে আনতে বলল, তোমার মতো মহাকাশচারীকে নিয়ে উড়ে যাওয়ার একটা আনন্দ আছে। আমার সাথে আসার জন্য ধন্যবাদ নীরা।

ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে যেতে পারা আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য।

রিশানের খুব ইচ্ছে হল বলে যে, তোমার সাথে পাশাপাশি যেতে পারাও আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য! সে সেটি বলতে পারল না। ইঞ্জিনের গর্জনের সাথে সাথে গতিবেগ বাড়তে থাকে, প্রচণ্ড ত্বরণের কারণে তাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মনে হয় বুকের উপর কেউ একটা বিশাল পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। তাদের চোখের সামনে একটা লাল পরদা কাঁপতে থাকে। মনে হতে থাকে আর একটু হলেই তারা অচেতন হয়ে যাবে। দুজন দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে বসে থাকে, রিশান চোখের কোনা দিয়ে নীরা ত্রাতিনাকে দেখার চেষ্টা করে। তাকে বলার ইচ্ছে করে, তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি নীরা। কিন্তু সে সেটাও বলতে পারে না। মহাকাশযানের দুটি ইঞ্জিন প্রচণ্ড গর্জন করছে, পুরো স্কাউটশিপটি থরথর করে কাঁপছে, শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য স্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এরকম একটা সময়ে কেউ এ ধরনের একটি কথা বলে না। রিশান তাই সেটি বলার চেষ্টা করল না।

ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই স্কাউটশিপটা তাদের কাঙ্ক্ষিত গতিবেগে পৌঁছে যায়। তৃরণটি বন্ধ করার সাথে সাথে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনার নিজেদেরকে ভরশূন্য মনে হতে থাকে। দুজনেই এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে। মহাকাশের অন্ধকারে এখন তাদের শুধু ছুটে যাওয়া। যতই সময় পার হবে তাদের যাত্রা হবে আরো বিপজ্জনক। ছোটবড় অসংখ্য গ্রহাণুর ভেতর দিয়ে তাদের উড়ে যেতে হবে। টোরকা গ্রহাণুটা এখনো অনেক দূরে, সেখানে পৌঁছাতে এখনো তাদের অনেক দিন বাকি।

পরের কয়েকদিন রিশান আর নীরা ত্রাতিনা ছোট স্কাউটশিপটার মাঝে টোরকা গ্রহাণুটাতে পৌঁছানোর পর তার ওপর নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকগুলো বসানোর ঘুঁটিনাটি পরিকল্পনা করে কাটিয়ে দিল। পৃথিবীর মহাকাশ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ আছে, মহাকাশ স্টেশনের সাথেও যোগাযোগ আছে। তাদের স্কাউট স্টেশনের গতিপথ আর টোরকা গ্রহাণুর গতিপথ হিসাব করে তাদের স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ মডিউলের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। রিশান আর নীরা ত্রাতিনা এর মাঝে বেশ কয়েকবার পুরো পরিকল্পনাটা পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে।

দুজন মানুষ খুব কাছাকাছি একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে থাকলে তাদের মাঝে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতার জন্ম হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। দুজন যে শুধুমাত্র গতিপথ আর বিস্ফোরক নিয়ে কথা বলল তা নয়, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, প্রিয়-অপ্রিয়, ভালো লাগা এবং না লাগার বিষয় নিয়েও কথা বলল। টোরকা গ্রহের কাছাকাছি যেদিন পৌঁছে গেছে সেদিন নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকের ডেটনেটরগুলো শেষবারের মতো পরীক্ষা করতে করতে রিশান নীরা ত্রাতিনাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে কী করবে, ঠিক করেছ?

হ্যাঁ।

কী করবে?

হ্রদের তীরে একটা কটেজ ভাড়া করে সেখানে ওক কাঠের শক্ত একটা বিছানায় ঘুমাব। ভরশূন্য অবস্থায় বাতাসে ঝুলে ঝুলে ঘুমাতে ঘুমাতে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

রিশান হেসে বলল, অনুমান করছি সপ্তাহখানেকের ভেতরেই তোমার যথেষ্ট ঘুম হয়ে যাবে। তখন কী করবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবার ইচ্ছে আছে। মহাজাগতিক নিউক্লিয়াস নিয়ে একটা জিনিস অনেক দিন থেকে মাথায় কুটকুট করছে। বিষয়টা নিয়ে একটা বড় এক্সপেরিমেন্ট করব ভাবছি।

হুম! রিশান মুখ গম্ভীর করে বলল, শুধু পড়াশোনা এবং গবেষণা! আমি শুনেছিলাম মেয়েরা নাকি ঘর-সংসার করতেও খুব পছন্দ করে।

করি। আমিও করি। ঘর-সংসার বাচ্চাকাচ্চা আমার খুব পছন্দ। নীরা ত্রাতিনা মুচকি হেসে বলল, আমি ঠিক করেছি আমি যখন সংসার শুরু করব তখন আমার উনিশ জন বাচ্চা হবে।

রিশান চোখ কপালে তুলে বলল, কতজন?

উনিশ জন। তার থেকে একজনও কম নয়!

রিশান শব্দ করে হেসে বলল, আমি তোমার সাফল্য কামনা করছি নীরা।

নীরা ত্রাতিনা এবারে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, পৃথিবীতে ফিরে তুমি কী করবে?

আমি?

হ্যাঁ।

রিশান মাথা চুলকে বলল, এখনো ঠিক করি নি। তুমি কোন হ্রদের তীরে কটেজ ভাড়া করবে যদি বলো তা হলে সেই হ্রদে মাছ ধরতে যেতে পারি।

নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি বুঝি মাছ খেতে খুব পছন্দ কর?

উঁহু।

তা হলে?

আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি!

নীরা ত্রাতিনা আবার খিলখিল করে হাসতে গিয়ে থেমে গেল, রিশানের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, একটা ছোট স্কাউটশিপে কাউকে নিয়ে দিনের পর দিন মহাকাশে ছুটে যেতে হলে পছন্দ না করে উপায় কী?

রিশান বলল, আসলে বিষয়টা এত সহজ না।

তা হলে বিষয়টা কী?

টোরকা গ্রহাণুটা পৃথিবীর জন্য খুব ভয়ংকর একটা বিপদ। আমাদের যে করেই হোক এটা ধ্বংস করতে হবে। আমরা যদি এখন এটা ধ্বংস করতে না পারি পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তুমি বুঝতে পারছ, কাজটা খুব কঠিন। আমরা যেটা করছি এর আগে সেটা কেউ করে নি। যতই কাছে যাচ্ছি ততই বুঝতে পারছি কাজটা কত বিপজ্জনক। গ্রহাণুটা অত্যন্ত বিচিত্রভাবে ঘুরছে, পুরোটা এবড়োখেবড়ো-বিশাল বিশাল পাথরের চাই উঁচু হয়ে আছে, ডক করার সময় আমাদের স্কাউটশিপ টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণটা ঘটার সময় আমাদের স্কাউটশিপটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। আমরা নিজেদের কাছে নিজেরা স্বীকার করছি না, কিন্তু দুজনেই খুব ভালো করে জানি এখান থেকে জীবন্ত ফিরে যাবার সম্ভাবনা কম!

নীরা ত্রাতিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, কেন ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ?

আমি মোটেই তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না। রিশান একটু হেসে বলল, তোমাকে আমি অনেক দিন থেকে খুব কৌতূহল নিয়ে লক্ষ করছি–তোমার ভিতরে কোনো ভয়ডর নেই। শুধু যে নিজের ভিতরে নেই তা নয়, যারা তোমার আশপাশে থাকে তারাও তোমার সাহসটুকু পেয়ে যায়–তোমাকে ভয় দেখাব কেমন করে? আমি যেটা বলছি সত্যি বলছি। তোমার কিংবা আমার কিংবা আমাদের দুজনেরই কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। তুমি জান?

নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, জানি।

তাই আমি ভাবছিলাম যখন দুজনই বেঁচে আছি তখন তোমাকে কথাটা জানিয়ে রাখি। তুমি খুব চমৎকার মেয়ে নীরা। তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি। কথাটি এখনই বলছি কারণ এই কথাটি হয়তো আর কখনো বলার সুযোগ পাব না।

নীরা ত্রাতিনা কিছুক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কোন হ্রদের তীরে কটেজ ভাড়া করব সেটা তোমাকে জানিয়ে রাখব রিশান। তুমি মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে এই কথাগুলো বলার অনেক সুযোগ পাবে।

সত্যি?

হ্যাঁ। নীরা ত্রাতিনা একটু হেসে বলল, সত্যি।