১. দেরিতে চলছে ট্রেন

শুকনাঝাড়ে অর্জুন (২০১৪)
অর্জুন সমগ্র ৬ – সমরেশ মজুমদার

তিনঘণ্টা দেরিতে দেরিতে চলছে ট্রেন, দোলগোবিন্দবাবু বললেন, এই দেরি নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই ভাই। তিনটা বেড়ে ছয় থেকে নয় ঘণ্টা হলেও যখন মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই তখন যতটা পারো ঘুমিয়ে নাও।

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে যখন অর্জুন ট্রেনে উঠেছিল, তখন টিপটিপে বৃষ্টি, সাড়ে বারোটার ট্রেন এসেছিল একটা পনেরোতে। এমন কিছু দেরি নয়। গোটা ভারতবর্ষের ম্যাপের দিকে তাকালে মনে হয়, এই যে দেশজুড়ে ট্রেন প্রায় ঠিকঠাক প্রতিদিন চলে, এটাও একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। কত হাজার ট্রেন, কত হাজার হাজার স্টেশন, কত লক্ষ লক্ষ কর্মচারী কন্যাকুমারিকা থেকে গুয়াহাটি ট্রেনের ঘড়িটাকে সচল রেখেছেন। কিন্তু বৃষ্টিটা নামল ময়নাগুড়ি স্টেশন পার হতেই। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি। ভরদুপুরেই প্রায় অন্ধকার এবং জলের দেওয়াল এমনভাবে পথ আটকাল যে ট্রেনের ড্রাইভার ট্রেন থামিয়ে দিল। হাতির পারাপার হওয়ার এলাকাটা অনেক দুরে, থেমে যাওয়ার কারণ যে বৃষ্টি তা বুঝতে অসুবিধে হল না। এই সময় সামনের আসনে বসা ভদ্রলোক হেসে বললেন, জব্বর বৃষ্টি নেমেছে। আহা!

মানুষটিকে ভাল করে দেখল অর্জুন। ফরসা, নাদুসনুদুস শরীর, গোল মুখ। দাড়ি কামানো কিন্তু স্যর আশুতোষের মতো গোঁফ, গোল গোল চশমার কাঁচের ভিতর দিয়ে হাসিহাসি চোখ, মাথার সামনের দিকে চকচকে টাক, পিছনে চুল। দেখলেই মনে এল নামটা, দোলগোবিন্দ। এই নামটা কোনও গল্পের বইতে পড়েছে সে। ভুলেই গিয়েছিল, এঁকে দেখে ভুস করে উঠে এল।

দোলগোবিন্দবাবু চোখ বন্ধ করলেন। কেউ কেউ বসেই চমৎকার ঘুমোতে পারে। ইনিও পারলেন। বাইরের মেঘ আর বৃষ্টি সময়টা বুঝতে দিচ্ছে না। হাতঘড়ি ব্যবহার বন্ধ হয়ে গিয়েছে মোবাইল কেনার পর থেকে। মাঝে ট্রেন চলেছিল ঘণ্টাখানেক। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। থেমেছে আর এগিয়েছে। এই এসি থ্রি টায়ারে যাত্রীর সংখ্যা বেশি নেই। বেশির ভাগই শুয়ে সময় কাটাচ্ছে। হঠাৎ জোর হাওয়া বইল, কারণ তার ধাক্কায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন দুলে উঠল। তখনই চোখ খুললেন দোলগাবিন্দবাবু। বললেন ঘুমিয়ে পড়তে।

বাইরে অন্ধকার। অর্জুন বলল, এখানেই সন্ধে হয়ে গেল। সামনে অনেকগুলো নদী রয়েছে। যদি কোনও ব্রিজ ভেঙে যায় তো হয়ে গেল।

দোলগোবিন্দ হাসলেন, তুমি কী হে? ভবিষ্যৎ নিয়ে এত ভাবছ কেন? যদি এই হয়, যদি ওই হয়–! আরে বর্তমান নিয়ে একটু ভাববা।

তা হলে তো বৃষ্টির শব্দ শোনা ছাড়া কিছু করার নেই। একেই জানলার কাচ ঘষা, তার উপর বাইরের পৃথিবীটা অন্ধকারে ডুবে আছে। অর্জুন বলল।

কিন্তু দ্যাখো, এই দুর্যোগেও তোমার জামা-প্যান্ট ভেজেনি, জলের তোড়ে তুমি ভেসে যাচ্ছ না। বাইরের অনেক মানুষ কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার মতো নিরাপদে নেই। আমি তো এইজন্যে এতক্ষণ ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।

আপনি কি এই লাইনে প্রায়ই যাতায়াত করেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ ভাই। রেলে চাকরি করতাম। অবসর নেওয়ার পর একটা পাশ দেওয়া হয়েছে আমাকে। ভারতীয় রেলে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারি। ভাল na লাগলেই তাই বেরিয়ে পড়ি। দোলগোবিন্দবাবু হাসলেন, কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করে বের হই না। ট্রেনে দু-তিনদিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। বেশ চেঞ্জ হয়।

অর্জুন অবাক হয়ে মানুষটিকে দেখল। প্রয়োজন ছাড়াই ইনি ট্রেনে চেপে ঘুরে বেড়ান? তারপরেই মনে হল, সব মানুষের প্রয়োজনের চেহারা একরকম নাও হতে পারে। একটি বিশেষ জায়গায় থাকতে থাকতে যদি এঁর একঘেয়েমি লাগতে শুরু করে তা হলে সেটা দূর করার প্রয়োজনে উনি ট্রেনে চেপে বৈচিত্র্য আনতেই পারেন।

আপনি কি সেভাবেই এখন সফর করছেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

সফর? বাঃ। এই শব্দটা বাঙালিরা সাধারণত ব্যবহার করে না। মাথা নাড়লেন দোলগোবিন্দ, ধরে নিতে পারো সেইরকমই। প্রতিবার যখন যাই তখন কত মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। একবার এক কুখ্যাত খুনির সহযাত্রী ছিলাম। কী ভাল ব্যবহার। পুলিশ যখন ট্রেনে উঠে তাকে গ্রেফতার করল তখন জানতে পারলাম সে খুনি। এই যে তোমার সঙ্গে আলাপ হল, এটাও তো পাওয়া। দোলগোবিন্দবাবু তার ঝোলা থেকে একটা কাজুবাদামের প্যাকেট বের করে এগিয়ে ধরলেন, খাও।

না-না থাক।

ও, তাও তো বটে। অপরিচিত সহযাত্রীর দেওয়া খাবার খেতে রেল থেকে নিষেধ করেছে। কত লোক সর্বস্বান্ত হয়ে গেল এইভাবে। প্যাকেট খুলে একটা বাদাম মুখে দিয়ে চিবিয়ে বললেন, এবার তুমি স্বচ্ছন্দে খেতে পারো।

অর্জুন হেসে হাত বাড়াল, দিন।

তুমি কী করো হে? কাজু চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞাসা করলেন দোলগোবিন্দবাবু।

সত্যসন্ধান। অর্জুন জবাব দিল।

গুড, গুড, ভেরি গুড। মাথা দোলালেন দোলগোবিন্দবাবু, আমার একটা শখ আছে। বলব? বলেই ফেলি। আমি মিথ্যেসন্ধান করি।

আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন। এটা রসিকতা নয়, সত্যসন্ধান করা আমার পেশা। বহু বছর ধরে এই কাজটা করার চেষ্টা করছি।

আমি তো একবারও ভাবিনি যে তুমি রসিকতা করছ। দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আমি মিথ্যেসন্ধান করি কারণ একটা সত্যকে বিশ্বাস করে করে শেষপর্যন্ত তার অস্তিত্বের প্রমাণ না পেয়ে মানুষ তাকে মিথ্যে বলে ভেবে নেয়। ধরো, একজন মানুষ ভগবান আছেন বলে ভাবেন। তার উপর আস্থা রাখেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হলে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে ভগবানকে অনেক ডাকার পর যদি দ্যাখেন বাঁচাতে পারল না তখন তাঁর মনে হয় ভগবান বলে কিছু নেই। সব মিথ্যে। কেউ যখন কোথাও ভগবানকে দেখতে পায়নি তখন তিনি নেই। আমি এই মিথ্যেটার সন্ধান করি।

খুব শান্তভাবে দোলগোবিন্দবাবু কথাগুলো বললেন।

একই কথা ভূত সম্পর্কে বলা চলে। সবাই শুনেছে কিন্তু কেউ ভূত চোখে দ্যাখেনি। তা হলে ভূত মিথ্যে। অর্জুন হাসল।

ঠিক কথা। একদম ঠিক কথা। দোলগোবিন্দবাবু মাথা নাড়লেন।

বৃষ্টির দাপট একটুও কমেনি। ট্রেন চলছে ট্রেনের মতো। ঘষা কাঁচের ভিতর থেকেও বিদ্যুতের ঝলকানি চোখে পড়ছে মাঝে মাঝেই।

অর্জুন মোবাইলে সময় দেখল, রাত ন’টা বাজে।

চার ঘণ্টা লেট। দোলগোবিন্দবাবু মনে করিয়ে দিলেন।

মাঝরাতে স্টেশনে নেমে কিছু পাওয়া যাবে কি না কে জানে!

ভাই, তুমি বড় আগাম ভাবো। যখন যা ঘটবে আজ সেইমতো চলবে। তা তুমি নিশ্চয়ই এই অঞ্চলে এর আগেও এসেছ?

না। এই প্রথম আসছি।

এ হে! প্রথম দেখার চমকটা এই বৃষ্টির জন্য পেলে না। ক’দিন থাকবে?

সেটা নির্ভর করছে পরিস্থিতির উপর। কাজ শেষ হলেই ফিরে যাব।

বেশ, আমি আর একটু ঘুমিয়ে নিই। দোলগোবিন্দবাবু আবার চোখ বন্ধ করলেন। বসে বসেই প্রায় তৎক্ষণাৎ তার ঘুম এসে গেল।

অর্জুন উঠল। এসি কামরার দরজা ঠেলে ট্রেনের দরজার কাছে এসে দেখল সেখানে কেউ নেই, দরজা দুটো খোলা, জলে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। সে একটা দরজা বন্ধ করল। ট্রেন এখন কোন এলাকায় তা বোঝা যাচ্ছে না। কাউকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। এখন ট্রেন চলছে। বিদ্যুৎ চমকাল, বাজ পড়ল কোথাও। সেই সঙ্গে চকিত আলোয় শুধু ভেজা গাছের জঙ্গল চোখে পড়ল। ট্রেন থামল যে স্টেশনে সেখানে কোনও যাত্রী নেই, কুলির হাঁকাহাঁকিও নেই। ঝাপসা আলোয় স্টেশনের নাম পড়ল অর্জুন। এখান থেকে শুকনাঝড় কত দূরে কে জানে? দ্বিতীয় দরজা বন্ধ করল সে। ট্রেন দাঁড়িয়েই রয়েছে।

শুকনাঝাড়ে তার পোঁছোনোর কথা ছিল সন্ধের মুখে। তাকে নিয়ে যেতে লোক পাঠাবেন মঙ্গল বড়ুয়া। কাল রাতেও শেষ কথা হয়েছিল। আজ সকাল থেকে যতবার মোবাইলে ধরতে চেয়েছে, ততবারই অর্জুন শুনেছে, আউট অফ রিচ। এটা হয় যখন টাওয়ার কাজ করে না। মঙ্গল বড়ুয়া নিশ্চয়ই তাকে আসতে বলে কোনও জায়গায় চলে যাবেন না যেখানে মোবাইল কাজ করে না।

অর্জুন ফিরে এল নিজের জায়গায়। দোলগোবিন্দবাবু এখনও ঘুমোচ্ছেন। সে ডাকল, একটু শুনবেন?

কান খোলা আছে ভাই।

আমরা নসিবগুড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। এখান থেকে শুকনাঝাড় স্টেশনের দূরত্ব কতটা হবে আন্দাজ করতে পারেন? আপনি নিশ্চয়ই এদিকে এসেছেন?

মেরে দিয়েছ ভাই। ঠিক চললে আর আধঘণ্টা। চোখ খুললেন ভদ্রলোক। তাই বলো, তুমি শুকনাঝাড়ে নামবে? ওখানকার স্টেশনমাস্টার রাতবিরেতে ঘরের বাইরে যেতে চায় না। ভিতু বললে কম বলা হয়।

স্বস্তি পেল অর্জুন, যাক, আপনি চেনেন দেখছি। এই শুকনাঝাড়ের এক ভদ্রলোক, এককালের জমিদার, মঙ্গল বড়ুয়ার নাম শুনেছেন?

স্টেশনের বাইরে কখনও যাইনি, নাম শুনব কী করে? রেলের কেউ হলে বলো, এক কথায় বলে দিতে পারব।

মাথা নাড়ল অর্জুন। এটাই স্বাভাবিক। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার এবারের গন্তব্য কতদূরে?

রাত এগারোটায় পৌঁছোতাম। বড় স্টেশন। তাই কিছু খেয়ে নিয়ে ফাস্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে উঠে চা খেয়ে ফেরার ট্রেন ধরতাম। কিন্তু আজ যা অবস্থা দেখছি, ভোরের আগে ওখানে হয়তো পৌঁছোব। সঙ্গে যে কাজুবাদাম আছে তাই দিয়ে ডিনার সারতে হবে। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।

একটা অনুরোধ করব?

অবশ্যই।

আমার নাম অর্জুন। আপনি যদি শুকনাঝাড় স্টেশনের স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন তা হলে আমাকে কেউ নিতে না এলেও বিপদে পড়ব না।

কীভাবে? থাকবে কোথায়? ওখানে তো কোনও ওয়েটিংরুম নেই। একটু ভাবলেন দোলগোবিন্দবাবু। আচ্ছা, দেখি, রাতটা যদি অফিসঘরেই কাটাতে দেয়।

শুকনাঝাড় স্টেশনে ট্রেনটা পৌঁছোল রাত এগারোটায়। বৃষ্টির ক্লান্তি নেই। ছোট্ট প্ল্যাটফর্মে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, ট্রেন থামতেই উঠে পড়ল। কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগটা নিয়ে দোলগোবিন্দবাবুর সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে নেমে অর্জুন কোনও মানুষ দেখতে পেল না। অর্থাৎ কেউ আসেনি তাকে রিসিভ করতে।

কেউ আসেনি তো? আরে এই বৃষ্টিতে মানুষখেকো বাঘও রাস্তায় বের হবে না তো মানুষ আসবে। দোলগোবিন্দবাবু বলতে বলতে হাত নাড়লেন, এই যে মাস্টারমশাই, দাঁড়ান।

অর্জুন দেখল একটা লোক গার্ডের সঙ্গে কিছু কথা বলে দৌড়ে একমাত্র অফিসঘরের ভিতর ঢুকে গেল। ওরা দু’জন সেদিকে পা বাড়ালে ট্রেন দুলে উঠে চলা শুরু করল। অর্জুন চেঁচিয়ে বলল, এই রে। তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠুন, ছেড়ে দিয়েছে।

দোলগোবিন্দবাবু হাসলেন, দিক গে। আমি তো ট্রেনে বসে ঢুলতাম আর সকালের ট্রেন ধরে ফিরে আসতাম। তা এখান থেকেই সেই ট্রেন ধরব।

আপনার জিনিসপত্র?

এই ঝোলা ছাড়া কিছু নেওয়ার দরকার পড়ে না তো।

ট্রেন বেরিয়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকাল এবং প্রচণ্ড শব্দে মেঘ ডাকল।

আহা। এ একেবারে প্রলয়, প্রলয় বলে মনে হচ্ছে, কী বলো?

অর্জুন লক্ষ করল প্ল্যাটফর্মের আলোগুলোও বেশ বিবর্ণ। ট্রেন চলে যেতেই কীরকম গা-ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছে।

অফিস ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দোলগোবিন্দবাবু গলা তুললেন, ওহে মাস্টার, দরজা খোলো।

কোনও সাড়া না পেয়ে তিনি আরও জোরে ডাকলেন, মাস্টার। আমায় দেখলেই চিনতে পারবে। দরজা খোলো।

তবু কোনও প্রতিক্রিয়া না হওয়াতে ধাক্কা দিলেন জোরে, আরে আমরা দু’জন আছি। ভুত নই। ভুতেরা দু’জনে কোথাও যায় না। খোলো।

কে? কে? ভিতর থেকে একটি শীর্ণ কণ্ঠ ভেসে এল।

আমি রিটায়ার্ড রেলওয়ে এমপ্লয়ি। কোনও ভয় নেই। দরজা খোলো।

খুব সন্তর্পণে দরজা ফাঁক করল স্টেশনমাস্টার। ভিতরে চেন লাগানো আছে যাতে বাইরের লোক জোর করে ঢুকতে না পারে। দুটো কুতকুতে চোখ খানিকটা সময় জরিপ করে বলল, আপনারা? আপনারা কি ট্রেন থেকে নেমেছেন?

আচ্ছা ভিতুর ডিম! আমাকে আগে কখনও দ্যাখেননি? দোলগোবিন্দবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন।

হ্যাঁ। দেখেছি। আচ্ছা! এবার দরজা খুলে স্টেশনমাস্টার বলল, কিছু মনে করবেন না। আমার উপর অর্ডার আছে রাত দশটার পর দরজা না খুলতে।

ভিতরে ঢুকে পড়ল ওরা। চারধারে রেলের যাবতীয় জিনিসপত্র আলমারিতে ঠাসা। একটা টিকিট কাউন্টার আছে যেটা এখন বন্ধ। ওপাশে একটা ক্যাম্প খাটে বিছানা পাতা। তার ওপাশে স্টোভ, ঝুড়িতে সবজি, থালা-বাসন।

দোলগোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, খাওয়া দাওয়া নিশ্চয়ই হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। রাত তো অনেক হয়ে গেছে। খাই তো ভাতে ভাত। স্টেশনমাস্টার বলল।

তাই এখন অমৃত বলে মনে হবে। কী বলো অর্জুনবাবু? অর্জুন কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

একটার বেশি চেয়ার নেই? দোলগোবিন্দবাবু বিরক্ত।

এখানে তো দু’জন লোক কখনওই বসার জন্যে আসেনা। স্টেশনমাস্টার বিব্রত।

অর্জুন এক পা এগিয়ে গেল, আপনি তো এই স্টেশনে কিছুদিন ধরে কাজ করছেন, শুকনাঝাড়ের লোকজনদের নিশ্চয়ই চেনেন?

না। আমি স্টেশনের বাইরে যাই না। সে কী! রান্নার মাছ, সবজি, চাল, ডাল কিনতে বাজারে যেতে হয় না?

না। বিল্ট আসে সকালে। ক্যাজুয়াল এমপ্লয়ি। স্টেশন পরিষ্কার করে, আমার জল-বাজার এনে দেয়। বিকেলে আর আসে না।

শুকনাঝাড় নিশ্চয়ই বড় শহর নয়। এখানকার মানুষ স্টেশনে বেড়াতে এসে আপনার সঙ্গে কথা বলেন না?

বিকেলের পর কেউ আসে না। দিনের বেলায় দু-চারজন আসে যাদের কেউ না কেউ ট্রেনে চেপে কোথাও যাবে। টিকিট কাউন্টারের ওপারে দাঁড়িয়ে কথা বলে। হাত দেখতে পাই, মুখ দেখার সুযোগ থাকে না। স্টেশনমাস্টার খুব বিরক্ত হয়ে উঠছিলেন। শেষপর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন, এত রাতে আপনারা ঠিক কী চান বলুন তো?

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, দু’জনের চাওয়া দুইরকম। এই শুকনাঝাড়ে একজন ভদ্রলোক থাকেন যার নাম মঙ্গল বড়ুয়া। অর্জুন তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রিত। সেখানে ও যেতে চাইছে। দ্বিতীয় চাওয়াটা আমার, বাকি রাতটা আপনার এখানে থাকতে চাই।

সর্বনাশ! বেশ জোরে শব্দটা উচ্চারণ করলেন স্টেশনমাস্টার, এখানে শোওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। আর মঙ্গল বড়ুয়ার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। থাকলেও এই ভয়ংকর দুর্যোগে আমি বের হতে পারি । আপনারা ইচ্ছে করলে বাইরের প্ল্যাটফর্মে বসতে পারেন। মাথার উপর শেড আছে, আমি একটা শতরঞ্জি দিচ্ছি। বা চাইলে এই চেয়ারটায় পালা করে বসুন। আমার সঙ্গে আর কথা বলবেন না। তবে হ্যাঁ, কেউ ডাকলে বা শব্দ করলে দয়া করে দরজা খুলবেন না। ঠিক করুন, কী করবেন।

অর্জুন হেসে ফেলল, আচ্ছা, আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন? কাদের জন্য?

তেনাদের।

মানে? অপদেবতাদের?

আঃ, নাম বলবেন না।

অর্জুন দোলগোবিন্দবাবুকে বলল, আপনি তোমিথ্যেসন্ধানী। অনুসন্ধানের ক্ষেত্র পেয়ে গিয়েছেন। কাজ শুরু করুন।

এইসময় বাইরে মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তারপর বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে ডাক ভেসে এল, মাস্টার, ও মাস্টার।

সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনমাস্টার ঠোঁটে আঙুল চাপলেন। মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন শব্দ না করতে। দ্বিতীয় গলা ডাকতে লাগল, দরজায় শব্দ হল।

অর্জুন ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কে ওরা?

গলা আরও নামিয়ে স্টেশনমাস্টার বললেন, বুঝতে পারছেন না? তেনারা।

ধ্যাৎ! অর্জুন হেসে ফেলল।

আশ্চর্য? এত রাতে এই দুর্যোগে আর কে আসবে?

ও মাস্টার। ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? সন্ধের ট্রেন কি চলে গেছে? আজ একজনের আসার কথা ওই ট্রেনে। বৃষ্টিতে ট্রেনের আওয়াজ শোনা যায়নি। মাস্টার!

অর্জুন সোজা দরজার কাছে চলে গিয়ে ওটা খুলল। দুটো মাঝবয়সি মানুষ একেবারে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একজনের কাছে টর্চ।

আপনাদের কে পাঠিয়েছে?

বড়বাবু।

তার নাম কী?

দ্বিতীয়জন বলল, শ্রীযুক্ত মঙ্গলময় বড়ুয়া।

স্বস্তির শ্বাস ফেলল অর্জুন। সন্ধেবেলায় ট্রেন আসার কথা, আপনারা মাঝরাতে খোঁজ নিতে এলেন কেন?

কী করে আসব। যা তুফান শুরু হয়েছে, পথে হাঁটাই যাচ্ছে না। তার উপর শ্মশানের পাশের খালটা এখন ভয়ংকর নদী হয়ে সাঁকো উড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে। এপারে আসতে না পেয়ে ফিরে গিয়েছিলাম। বড়বাবু খুব রাগারাগি করলেন বলে আবার বের হলাম। প্রথমবারেই ছাতি ভেঙে গিয়েছিল, এবার তাই ভিজতে ভিজতে খালের জল সাঁতরে পার হয়ে এলাম। প্রথম লোকটি বলল।

দোলগোবিন্দবাবু মন দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, খালের জল সাঁতরে এলে তবু টর্চটা ঠিক জ্বলছে কী করে? অ্যাঁ?

দ্বিতীয় লোকটি জবাব দিল, বাঁ হাতে টর্চ উপরে তুলে ধরে ডান হাতে সাঁতার কেটেছি। উঃ, কী ভয়ংকর। কিন্তু বাবু, ট্রেন কি চলে গেছে?

এবার স্টেশনমাস্টার জবাব দিলেন পিছন থেকে, হ্যাঁ। এঁরাই ওই ট্রেনে এসেছেন।

প্রথমজন ঝুঁকে দেখল। তারপর বলল, কিন্তু বড়বাবু বললেন একজন আসবেন?

দোলগোবিন্দবাবু হাসলেন, আপনারা একজনকেই নিয়ে যান। ইনি অর্জুনবাবু। আমি আপনাদের মঙ্গলময়বাবুর বাড়িতে আমন্ত্রিত নই।

অর্জুন ঘুরে দাঁড়াল, এ কী কথা? এখানে তো থাকার জায়গা নেই। আপনি আমার সঙ্গে চলুন। বাকি রাত একটু ঘুমিয়ে সকালের ট্রেন ধরবেন।

স্টেশনমাস্টার বলে উঠলেন, সেই ভাল। আপনারা চলে গেলেই আমি শুয়ে পড়ব।

বেশ, যখনবলছ। আমার আপত্তি নেই। শয়নংযত্রতত্র। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।

বৃষ্টি একটু ধরেছে। কিন্তু ফোঁটা ফোঁটা পড়েই চলেছে।

প্রথমজন জিজ্ঞাসা করল, বাবুরা, আপনারা সাঁতার জানেন তো?

আমি রেলে চাকরি করতাম, জাহাজে নয়। সাঁতারের প্রয়োজন হত না। খুব বিরক্ত হয়ে দোলগোবিন্দবাবু কথাগুলো বলামাত্র পিছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তিনি একই গলায় মন্তব্য করলেন, লোকটি অতিশয় অভদ্র।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, খালের জল কতটা গভীর?

অন্যসময় কোমরের নীচে থাকে, এখন অন্তত দেড় মানুষ। সর্বনাশ! দোলগোবিন্দবাবু বললেন, থাক, আজ আর না গিয়ে এখানেই শুয়ে পড়ি। লোকটাকে ডাকো, শতরঞ্জি বের করে দিক।

দ্বিতীয়জন বলল, না, না, এখানে শোবেন না। আধঘণ্টা বৃষ্টি না থাকলে জল হু হু করে কমে যাবে। পা চালিয়ে চলুন। আপনার ব্যাগটা আমাকে দিন।

ব্যাগ হস্তান্তর হওয়ার পর হাঁটা শুরু করে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এখানে রাত কাটাতে আপত্তি করলেন কেন?

প্রথমজন বলল, ঘরের ভিতর তেনারা ঢোকেন না, বাইরে শুলে আর দেখতে হবে না। সন্ধের পর খালের এধারে তো বটেই, ওধারেও বাধ্য না হলে কেউ বের হয় না। পথ চলতে এ বিষয়ে আর কথা বলবেন না বাবু।

অর্জুন হাঁটতে হাঁটতে বলল, আপনার তো শাপে বর হয়ে গেল।

কীরকম?

গবেষণায় রসদ পেয়ে গেছেন। মিথ্যেসন্ধান শুরু করুন।

এরই মধ্যে জলের ফোঁটা মাথা থেকে বুক ভিজিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। টর্চের আলোয় পথ চলতে হচ্ছে। মাটির পথ এখন কাদায় ভরে গেছে। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনার অসুবিধা হচ্ছে না তো?

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, শেষরাতে জ্বর এলে কোনওরকমে ট্রেনে তুলে দিয়ো ভাই।

আচমকা কানের পরদা ফাটিয়ে মেঘ ডাকল, কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। চারজনেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সেই শব্দ শুনে। অর্জুন অন্ধকারে চারপাশে কিছুই দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোনও আলো জ্বলতে দেখছি না। এদিকে মানুষজন থাকে না?

তাদের এখন গভীর রাত। খামোকা আলো জ্বেলে তেল পোড়াবে কেন? কেরোসিন তেল তো এদিকে সহজে পাওয়া যায় না। ব্ল্যাকে যা দাম। দ্বিতীয়জন জবাব দিল।

মিনিট কুড়ি হাঁটার পর প্রথমজন গম্ভীর গলায় বলল, বাঁ দিকে তাকাবেন না কেউ, মাটির দিকে তাকিয়ে টর্চের আলো দেখে হাঁটুন।

অর্জুন দাঁড়িয়ে বাঁ দিকে তাকাল। চাপ চাপ অন্ধকার সেদিকে। জিজ্ঞাসা করল, বাঁ দিকে তাকাতে নিষেধ করছেন কেন?

এর জবাব এখানে দাঁড়িয়ে দিতে পারব না বাবু।

ঠিক তখনই এক থেকে একাধিক শিশুর কান্না ভেসে এল বাঁদিক থেকে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি, তাড়াতাড়ি হাঁটুন বাবু বলে হাঁটতে শুরু করল।

অনেকটা হাঁটার পর টর্চের আলোয় খালটাকে দেখা গেল। এখনও সেখানে প্রবল বেগে জল ছুটেছে। দ্বিতীয়জন বলল, একটু কমেছে মনে হচ্ছে।

এখন এক মানুষ হবে। প্রথমজন বলল।

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, আমি স্টেশনে ফিরে যাচ্ছি।

অর্জুন অবাক হল, সে কী? কেন?

মাথার উপর দিয়ে জলের স্রোত বইবে আর আমি হেঁটে খাল পার হব? এরা কি আমাকে উন্মাদ ভাবছে?

অর্জুন টর্চ চেয়ে নিয়ে চারপাশে আলো ফেলতে লাগল। বাঁদিকের কোণে আলোেটা পড়তে মনে হল ওখানে চালাঘর রয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ওই চালাঘর কীসের?

আজ্ঞে, ওদিকটা শ্মশান। দাহ করতে লোকজন এসে ওখানে বিশ্রাম করে।

শোনামাত্র দোলগোবিন্দবাবু বললেন, বাঃ। চলো, ওখানেই বিশ্রাম করা যাক। ভিজে একদম ন্যাতা হয়ে গেছি।

সঙ্গে সঙ্গে প্রথমজন বলে উঠল, না বাবু, ওখানে এখন যাবেন না। কেন?

ওখানে রাতের বেলায় কেউ দাহ করতে আসে না। চালাঘরে লোকে দিনের বেলায় যায় কিন্তু রাতের বেলায় কখনও না।

কেন না?

জবাবটা এখন দিতে পারব না বাবু।

দ্যাখো, এই খালের জলে উনি নামতে পারবেন না। ওঁর পক্ষে স্টেশনে ফিরে যাওয়া সম্ভব হলেও আমি দিতে পারি না। তাই আমরা ওই চালাঘরেই আজ থাকব। তোমাদের ইচ্ছে হলে সঙ্গে আসতে পারো। দোলগোবিন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে অর্জুন বলল, চলুন। আর ভেজা যাচ্ছে না।

চালাঘরের ভিতরটা পরিষ্কার। বাঁশের উপর তক্তা পেতে দুটো বেঞ্চি করা হয়েছে। চারপাশে খোলা, কোনও দরজা নেই সেই কারণে। হাওয়া ঢুকছে হু হু করে কিন্তু বৃষ্টির ছাঁট ভিতরে আসতে পারেনি খড়ের চাল একটু বাইরে বেরিয়ে আছে বলে। ওই দুটো লোক প্রথমে আসতে চায়নি। শেষে বাধ্য হয়ে এল। এসে চালাঘরের এক কোণে বসে পড়ল। দোলগোবিন্দবাবু ততক্ষণে বেঞ্চিতে বসে ব্যাগ থেকে কাজুবাদাম বের করেছেন। বললেন, কয়েকটা খেয়ে নাও হে। শরীরে বল পাবে।

বিদ্যুৎ চমকাল। পৃথিবীটা কয়েক মুহূর্তের জন্যে সাদা হয়ে গেল। বাদাম নিল অর্জুন।

আশ্চর্য ব্যাপার, বৃষ্টি যেই বন্ধ হল খালের জল কমতে লাগল দ্রুত। তখনও সূর্যের নামগন্ধ নেই, চারপাশে জমাট অন্ধকার। আবার শিশুদের কান্না ভেসে এল একসঙ্গে। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আশপাশের গাছে শকুনের বাসা আছে, তাই তো?

না বাবু, এটা শকুনের বাচ্চার কান্না নয়। আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। বাবু, জল এখন হাঁটুর উপরে, স্রোতও কমে গিয়েছে। এই খাল পার করে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই বড়বাবুর বাড়ি। এই ভয়ংকর জায়গায় না বসে থেকে দয়া করে চলুন। গিয়ে কিছু খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়বেন। নোকটা কথা শেষ করতেই এত জোরে বাতাস বইল যে মনে হচ্ছিল চালাঘর উড়ে যাবে। দুটো লোকই একসঙ্গে রামনাম জপ করতে লাগল জোরে জোরে।

অর্জুন উঠে দাঁড়াল। দোলগোবিন্দবাবু বাদাম চিবিয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন, ওদের বলো ফিরে যেতে। আমরা দু’জন এই দুটো বেঞ্চিতে বাকি রাতটা লম্বা হয়ে পড়ে থাকি। আলো ফুটলে তুমি যেয়ো খাল পেরিয়ে, আমি স্টেশনে।

অর্জুন বলল, ভেজা জামাপ্যান্ট একটুও শুকোয়নি। এগুলো পরে থাকলে কাল জ্বর আসতে বাধ্য। এক যাত্রায় পৃথক ফল করবেন না, চলুন।

আরে! আমরা কি একসঙ্গে যাত্রা করেছি?

ট্রেন থেকে একসঙ্গে নেমেছি। চলুন।

জল উঠল কোমরে। দোলগোবিন্দবাবু খাল পার হচ্ছিলেন টলতে টলতে। ওই অবস্থায় বললেন, আমি চাই না কেউ আমার শ্রাদ্ধ করুক। এখন ভেসে গেলে এই ইচ্ছেটা পূর্ণ হবে। আমার ডেডবডি হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না।

তার কোনও চান্স নেই। আপনি খাল প্রায় পেরিয়ে গেছেন।

.

রাস্তা বলতে কিছু নেই। জল-কাদা ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে একটা পাঁচিল ঘেরা বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে গেল ওরা। প্রথমজন বলল, আসুন বাবুরা, কিন্তু আমাদের পিছন পিছন হাঁটবেন।

কেন? দোলগোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

বড়বাবুর দুটো বিশাল রাগী কুকুর রাতে ছাড়া থাকে। আমাদের চেনে বলে কিছু বলবে না। দু’-দু’বার চোর ধরেছে। হাতে-পায়ে অনেক সেলাই করতে হয়েছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে। দ্বিতীয় লোকটি বলল।

এ আমরা কোথায় এলাম অর্জুন? দোলগোবিন্দবাবুর গলা কেঁপে গেল।

টর্চের আলোয় চারপাশে দেখল অর্জুন। বাগান, প্রচুর গাছ। কিন্তু কুকুর দুটোর দেখা পাওয়া গেল না।

বাড়ির গায়ে আলো ফেলে বোঝা গেল ওটা পেল্লাই এবং দোতলা। ঢোকার দরজা পিছন দিকে যা স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ।

লোকদুটো তাদের নিয়ে গেল বাগানের ওপাশে যেখানে একটা সুন্দর কটেজ আছে। দুটো ঘর। চমৎকার বিছানা, অ্যাটাচড বাথ। ঘরে হারিকেন জ্বলছিল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কারেন্ট থাকে না?

এই বৃষ্টির সময় চলে যায়। আপনারা দুটো ঘরেই থাকতে পারেন। আমরা ভৃগুদাকে ডেকে দিচ্ছি, উনি খাবারের ব্যবস্থা করবেন। প্রথমজন বলল।

অর্জুন মাথা নাড়ল, কাউকে ডাকতে হবে না। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। এখন নিশ্চয়ই কিছু খাব না। শুধু বলে দাও, সকাল আটটার আগে কেউ যেন না ডাকে। তোমরা যেতে পারো।

লোকদুটো চলে গেলে দোলগোবিন্দবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা কি আলাদা ঘরে ঘুমোব? বলছিলাম কী, এই ঘরেই যখন দুটো সেপারেট বিছানা আছে, নতুন জায়গা তো–!

আমার কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার পোশাকের যা অবস্থা, সঙ্গে তো ব্যাগ নেই, চেঞ্জ করবেন কী করে? অর্জুন শার্ট খুলল।

নো প্রবলেম। এই ঝোলায় লুঙ্গি, গামছা, টুথব্রাশ, পেস্ট, সাবান আছে। তুমি বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে এসো। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।

শুকনো পোশাক পরে স্বস্তি হল অর্জুনের। সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখল দোলগোবিন্দবাবুর পরনে লুঙ্গি, ঊর্ধ্বাঙ্গে গামছা। ভেজা পোশাক তারের উপর মেলে দিয়েছেন। অর্জুন বের হতেই তিনি ঢুকে গেলেন বাথরুমে।

.

দরজায় সামান্য শব্দ হতেই ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের। সে উঠে পড়ল। দোলগোবিন্দবাবু বিছানায় রাখা চাদর আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। দরজা খুলতেই দেখা গেল একজন প্রৌঢ় হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অর্জুন সরে দাঁড়ালে লোকটা ট্রে টেবিলের উপর রাখল। চা আর বিস্কুট।

আপনার নাম ভৃগু?

আমাকে আপনি বলবেন না। আমি এই বাড়ির চাকর।

মঙ্গলময়বাবু উঠেছেন?

অনেকক্ষণ। স্নান করে পুজোয় বসেছেন।

পুজো কখন শেষ হবে।

ঠিক ন’টায়। শাঁখের আওয়াজ পাবেন। বাবু হুকুম দিয়েছেন আপনাদের যেন কোনও অযত্ন না হয়। জলখাবার কখন দেব বাবু?

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পেটে ছুঁচো ডন মারছে। চাদর মুড়ি দিয়েই কথাগুলো বললেন দোলগোবিন্দবাবু।

আধঘণ্টার মধ্যে দিচ্ছি। ভৃগু দ্রুত চলে গেল। মিনিট সাতেক পরে চা খেতে খেতে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, কার কপালে কী লেখা আছে তা কেউ বলতে পারে না। এতক্ষণে আমার ফিরতি ট্রেনে বসে ঢোলার কথা। অথচ দ্যাখো, তোমার কল্যাণে দামি চা খাচ্ছি। কিন্তু আমি ভাবছি মঙ্গলবাবুকে তুমি আমার কী পরিচয় দেবে? উনি তো আমাকে চেনেন না। আমন্ত্রণ জানানোর প্রশ্নই নেই। অথচ আমি এসেছি, এসে জুড়ে বসেছি। তা ছাড়া তুমি তো আমার পরিচয় দূরের কথা, নামও জানো না। কী বলবে ওঁকে?

অর্জুন চুপচাপ চা খেয়ে যাচ্ছিল।

দোলগোবিন্দবাবু চোখ ছোট করলেন, কী হল?

অর্জুন বলল, আপনি রেলে চাকরি করতেন। একটু উপরের দিকের চাকরি।

অন প্রমোশন! মাথা নাড়লেন দোলগোবিন্দবাবু।

অবসর নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে।

হে হে, আমার বলা কথা আমাকেই শোনাচ্ছ হে।

আমার বিশ্বাস, হয় আপনি অবিবাহিত নয়, বিপত্নীক।

মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বোনেদের বিয়ে না দিয়ে নিজে বিয়ে করব না। ছোট বোনটার বিয়ে দিলাম যখন তখন আমি ফর্টি থ্রি। তারপর আর বিয়ে করে কী হবে? করলাম না।

মা কিছু বলেননি?

স্কোপ পাননি। তার আগেই– একটা আঙুল দিয়ে উপরটা দেখালেন তিনি। কিন্তু এই ব্যাপারটা কী করে বুঝলে?

আপনি যে জীবনযাপন করছেন তা কোনও স্ত্রী অ্যালাউ করবে না। তাই মনে হল, হয় তিনি নেই, নয় কখনও আসেননি।

আমার নাম তুমি জানো না, কী বলবে ওঁকে?

অর্জুন হেসে ফেলল, আমি যদি ওঁকে বলি আপনার নাম জগদীশবাবু তা হলে উনি তাই মেনে নেবেন। যদি বলি দোলগোবিন্দবাবু, তা হলেও অস্বীকার করবেন না। এখানে কেউ আপনাকে চেনে না। শেক্সপিয়র সাহেব তো বলে গেছেন, নামে কী এসে যায়, গোলাপকে যে নামেই ডাকো সে সুগন্ধ ছড়াবে।

হাঁ হয়ে তাকিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তারপর শরীর কাঁপিয়ে হো হো করে হাসতে লাগলেন। তার আশুতোষ-গোঁফ নাচতে লাগল। কোনওরকমে সেসব থামিয়ে বললেন, দোলগোবিন্দ, ওহো, বেড়ে নাম হে। আমার দাদামশাইয়ের নাম ছিল গোবিন্দ, আমি দোলগোবিন্দ। ঠিক আছে, এখন থেকে আমি দোলগোবিন্দ ঘোষাল। ওই নামেই ডাকবে আমাকে।

আসল সত্যটা কী?

ওই যে বললাম, ঘোষাল। গোটা চাকরিজীবনে শুনে এসেছি একটাই ডাক, ঘোষালবাবু। ভাল, এখানে এসে একটা নতুন নামও পেলাম। হাসলেন দোলগোবিন্দবাবু। যদি কিছু মনে না করে তা হলে বলি, মঙ্গলময়বাবুর কোন সত্যসন্ধান করতে তুমি এখানে এসেছ?

টেলিফোনে উনি আমাকে পুরোটা বলেননি। তা ছাড়া ক্লায়েন্টের অনুমতি ছাড়া তার সমস্যার কথা আলোচনা করা কি উচিত?

বুঝেছি। বেশ, তুমি সত্যসন্ধান করো, আমি মিথ্যেসন্ধান করব।

লুচি-বেগুনভাজা-তরকারি আর ক্ষীর দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, এই বয়সে যা যা খাওয়া উচিত নয় তাই খেলাম।

অর্জুন তৃপ্তি করে খেয়ে বলল, একদিনই তো।

প্লেট গ্লাস নিয়ে যেতে এসে ভৃগু বলল, বড়বাবু বাগানে এসে বসেছেন, বলেছেন, আপনাদের খাওয়া শেষ হলে একবার যেন ওখানে যান।

ভৃগু বেরিয়ে গেলে দোলগোবিন্দবাবু বললেন, খাঁটি ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। নইলে এত বিনয় দেখাতেন না।

অর্জুন বলল, চলুন।

আজও আকাশে মেঘেরা রাজত্ব করছে, তাই রোদ নেই। দূর থেকেই অর্জুন ভদ্রলোককে দেখতে পেল। গোল টেবিলের চারপাশে চারটে চেয়ার। তার একটায় বসে গড়গড়ায় পাইপ মারফত ধোঁয়া খাচ্ছেন। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি, ধুতি। ভদ্রলোক ষাট থেকে পঁয়ষট্টির মধ্যে।

ওদের দেখে মঙ্গলময়বাবু উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করলেন, আসুন, কাল খুব অসুবিধে হয়েছে আপনাদের। এমন ভয়ংকর দুর্যোগের মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। অবশ্য ট্রেন যদি ঠিক সময়ে আসত তা হলে আপনারা এত বিপদে পড়তেন না। শরীর ঠিক আছে তো?

অর্জুন নমস্কার করে বলল, এখন আমরা ঠিক আছি। এঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি দোলগোবিন্দ ঘোষাল, রিটায়ার্ড রেলওয়ে অফিসার। আর এঁর কথা আপনাকে বলেছিলাম।

দোলগোবিন্দবাবু নমস্কার করলেন।

মঙ্গলময়বাবু বললেন, বসুন।

দোলগোবিন্দবাবু বললেন, না, আপনার কথা বলুন, আমি একটু জায়গাটা ঘুরে দেখতে চাই।

নিশ্চয়ই। ওপাশে একটা নদী আর আড়াইশো বছরের শিবমন্দির ছাড়া দেখার মতো কিছু নেই। আপনার সঙ্গে একজনকে দিয়ে দিচ্ছি, ঘুরতে সুবিধা হবে। মঙ্গলময়বাবু ইশারায় দূরে দাঁড়ানো একজন কর্মচারীকে ডাকলেন। সে দৌড়ে এলে বললেন, ইনি যেখানে যেতে চান নিয়ে যাও।

দোলগোবিন্দবাবু পা বাড়িয়েই থেমে গেলেন, কিছু মনে করবেন না। কাল রাতে দেখলাম এখানকার স্টেশনমাস্টার ভূতের ভয়ে দরজাই খুলছিলেন না। যে দুটি লোককে আপনি আমাদের নিয়ে আসার জন্যে পাঠিয়েছিলেন তারাও শ্মশানের কাছে এসে খুব ভয় পাচ্ছিল। আপনার কি মনে হয় এই ভয়ের পিছনে কোনও কারণ আছে?

প্রত্যেকের অনুভব শক্তি সমান নয়। আমি ঈশ্বরকে মানি। নিয়মিত তার পূজা করি, অথচ অনেক মানুষ মনে করেন ঈশ্বর নেই। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মনে করে প্রেতাত্মা আছে। শ্মশানের কাছে গেলে তারা তা অনুভব করে। হয়তো স্টেশনমাস্টারের সেই অনুভব ক্ষমতা একটু বেশি। আবার ওসব কিছু নেই বলে অনেকে উড়িয়ে দেন। এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। মঙ্গলময় বললেন, মাথা নাড়লেন দোলগোবিন্দবাবু। তারপর মঙ্গলময়বাবুর কর্মচারীকে বললেন, চলো ভাই।

ওরা চোখের আড়ালে চলে গেলে মঙ্গলময়বাবু বললেন, আপনার ওয়েবসাইটে যে ছবি দেখেছি, সামনাসামনি অনেক কম বয়স মনে হচ্ছে।

অর্জুন সরাসরি কথা বলল, বলুন, আমি কী করতে পারি?

যে কথা বলতে চাই তা বলব কি না তাই নিয়ে নিজেরই ধন্দ আছে। তার উপর আপনি বয়সে তরুণ। আপনাকে আমি টেলিফোনে বলেছিলাম, আমার অস্তিত্ব বিপন্ন। ঠিক কথা। চোখ বন্ধ করলেন মঙ্গলময়বাবু। তারপর বললেন, যেহেতু আপনি সত্যসন্ধানী, এটাই আপনার পেশা, নিশ্চয়ই পেশাদারদের মতো ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা রাখবেন।

আপনি এই ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করবেন না। অর্জুন ওঁর সমস্যা আন্দাজ করতে পারছিল না। ভদ্রলোক কথা বলার জন্যে বাড়ির ভিতরের কোনও ঘরে নিয়ে যাননি, নিজে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন এই বাগানের নির্জনতায়। এখানে ওঁর কথা কোনও তৃতীয় ব্যক্তির কানে পৌঁছোবে না।

মঙ্গলময়বাবু বললেন, আমি অবশ্যই বিবাহিত, দুটি সন্তানের পিতা। দুটিই কন্যা। বিয়ে দিয়েছি অনেক বছর হয়ে গেল। দু’জনের সংসার বিদেশে। আমার স্ত্রী অসুস্থ। মানসিক রোগী। না, সাধারণত যাদের পাগল বলা হয়, আমার স্ত্রী তাদের দলে পড়ে না। তার কোনও স্মরণশক্তি নেই। এমনকী নিজের মেয়েদের নামও তার মনে নেই। তারা সামনে এলে সে চিনতে পারে না। ইদানীং তার ধারণা হয়েছে যে বয়স বেড়ে যাওয়ায় চেহারা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই সারাক্ষণ আয়নার সামনে বসে সাজগোজ করে। স্নান করতে যায় মুখে পাউডার বুলিয়ে।

ডাক্তার কী বলেছেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

কাউন্সেলিং-এর জন্য ওকে গুয়াহাটিতে নিয়ে গিয়েছি, কলকাতায় গিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছি। তেমন কিছু কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না।

এর শুরু কবে থেকে?

আড়াই বছর আগে। আমার এক কাকা ছিলেন। আমরা তাকে ডাকতাম সন্ন্যাসী কাকা বলে। সংসারে না থেকে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতেন। কালীভক্ত ছিলেন, তন্ত্রচর্চা করতেন। সেবার এলেন দশ বছর নিরুদ্দেশ থাকার পরে। তার জন্যে আলাদা পুজোর ঘর করে দেওয়া হয়েছিল। আমার স্ত্রী তার যত্ন যাতে ঠিকঠাক হয় তা দেখাশোনা করতেন। এক শনিবার সকালে দেখলাম তিনি এই বাগানে পায়চারি করছেন, বেশ উত্তেজিত। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বললেন, মুক্তি দিতে এসেছি, তোর বাড়ির বন্ধন থেকে মুক্তি দিতে এসেছি।

কাদের মুক্তির কথা বলছেন?

আমার ঠাকুরদা ছলে বলে কৌশলে একটা বিরাট ধনভাণ্ডারের মালিক হয়েছিল। কত রক্ত, কত চোখের জল তার জন্যে ঝরেছিল। এই যে, যে বাড়িতে তোরা আছিস, তা ওই রক্তমাখা ধনে তৈরি। কিন্তু এটা কিছুই নয়। আরও বিশাল ধনভাণ্ডার লুকিয়ে রেখে গেছে লোকটা। সেসব পাহারা দেওয়ার জন্যে যাদের রেখেছে তাদের মুক্তি দিতে আমি এসেছি। আজ শনিবার। রাত ন’টার সময় বউমাকে আমার পুজোর ঘরে আসতে বলছি। খবরদার, তুই ওর সঙ্গে আসবি না।

একটু চুপ করলেন মঙ্গলময়বাবু। তারপর বললেন, বিপুল ধনদৌলতের কথা আগে আমি কখনও শুনিনি। আমার পরলোকগত পিতাও জানতেন বলে মনে হয় না। সন্ন্যাসীকাকা আমার স্ত্রীকে পুজোর ঘরে ডেকে কি সেই সম্পত্তির খবর দেবেন? কিন্তু কী হল? ঠিক দেড়ঘণ্টা পরে আমার স্ত্রী যখন ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এল, তখন সে কাউকে চিনতে পারল না। শুধু বলে যাচ্ছে, কাউকে বলব না। কী কথা বলবে না জিজ্ঞাসা করতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সন্ন্যাসীকাকাকে পুজোর ঘরে পাওয়া যায়নি। শুনেছি তান্ত্রিকদের অনেক ক্ষমতা থাকে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমার স্ত্রীর মস্তিষ্ককে সন্ন্যাসীকাকা লকারের মতো ব্যবহার করেননি তো? সোজা হয়ে বসলেন মঙ্গলময়বাবু।

অর্জুন চমকে উঠল। লকারের ভিতরে কিছু রেখে চাবি দিয়ে দিলে সেটা থেকে অন্যদের পক্ষে জিনিসটা বের করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে কি ওই ভদ্রমহিলার মস্তিষ্কে কোনও তথ্য ঢুকিয়ে দিয়ে তার স্মরণশক্তি অকেজো করে দেওয়া হয়েছে? চেষ্টা করেও তিনি মনে করতে পারবেন না তার কাছে কী গোপন তথ্য রয়েছে। আবার লকার খোলার মতো ওই সন্ন্যাসীকাকা এসে স্মরণশক্তি ফিরিয়ে দিলেই মিসেস বড়ুয়া ঝটপট মনে করতে পারবেন তথ্যটির কথা।

অর্জুন বলল, মিস্টার বড়ুয়া, আপনি ফোনে বলেছিলেন, আপনার অস্তিত্ব বিপন্ন। এখন পর্যন্ত যা শুনলাম, তার সঙ্গে আপনার অস্তিত্বের কী সম্পর্ক তা আমি বুঝতে পারছি না। যা বললেন, তা আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার। আপনি বললেন, মিসেস বড়ুয়াকে গুয়াহাটি ও কলকাতায় সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার কাউন্সেলিং-ও হয়েছিল। ওই ডাক্তারবাবুরা কি একই সন্দেহ করেছেন? কেউ মাথায় কিছু ঢুকিয়ে দিতে স্মৃতির ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়েছে? ওঁদের বক্তব্য কী?

মঙ্গলময়বাবু বললেন, ওঁরা ওর সঙ্গে কথা বলে দেখেছেন, কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর ঠিক অথবা ভুল দেওয়ার পরেই ও বোবা হয়ে যাচ্ছে। ওঁদের সামনে যেন একটা দেওয়াল এসে যাচ্ছে যা ওঁরা কিছুতেই ভেদ করতে পারেননি। আঙুলের আংটি ঘুরিয়ে দেখলেন মঙ্গলময়বাবু, আমি আপনাকে বলেছি যে আমার অস্তিত্ব বিপন্ন। সন্ন্যাসীকাকার কথা সত্যি হলে তিনি তার ঠাকুরদার বহাল করা পাহারাদারদের মুক্তি দিতে এসেছিলেন। যদি তা দিয়ে থাকেন তা হলে তারা কোথায় গেল? বুঝতে পারছেন, এতকাল যারা পাহারায় ছিল তারা কখনওই মানুষ হতে পারে না। তারা নিশ্চয়ই বন্দি হয়ে ছিল বলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে। ঠাকুরদা নেই। বংশে আমি আর কাকা বেঁচে আছি। অবশ্য কাকা এখন আছেন কি না তা জানি না। সেই চলে যাওয়ার পর আর তার কোনও খবর পাইনি। তাই আমাকেই ওরা টার্গেট করবে। ইতিমধ্যে তাদের অস্তিত্ব গ্রামের মানুষ নানাভবে জানতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, আমার স্ত্রীর স্মৃতি যদি ব্লক করে দেওয়া সম্ভব হয়ে থাকে আমার উপরেও সেই অপশক্তির প্রয়োগ করা হতে পারে। তাই না?

আপনার মেয়েরা এসব জানেন?

না। এতটা ডিটেলসে জানে না। ছোটমেয়ে থাকে বস্টনে। ও প্রায়ই বলছে ওখানে যেতে। ওর মায়ের চিকিৎসা আরও ভালভাবে করাতে চায়। যাব বললেই তো যাওয়া যায় না। আমার স্ত্রীর পাসপোর্ট নেই। এইরকম মানসিক পরিস্থিতিতে ভিসা দূরের কথা, পাসপোর্টই পাবে না সে। আমার বড়মেয়ে থাকে সিডনিতে। আপনার কথা সে-ই বলল। ল্যাপটপে আপনার কথা পড়ার পর মনে হল, যোগাযোগ করি। যদি আপনি সাহায্য করতে পারেন! মঙ্গলময়বাবু ধীরে ধীরে কথাগুলো বললেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, না মিস্টার বড়ুয়া। সাইকিয়াট্রিস্টরা যখন সক্ষম হননি তখন আপনার স্ত্রীর মনে কী কথা লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা আমার পক্ষে জেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আর আপনি যাদের মুক্ত পাহারাদার বলছেন তাদের অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না। আশা করি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি।

এর অর্থ হল, আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন না।

আমার ক্ষমতা নেই।

তা হলে তো আপনাকে মিছিমিছি এত কষ্ট দিলাম। আমারই দুর্ভাগ্য। কিন্তু আপনি আমার অনুরোধে সময় নষ্ট করে এসেছেন, তাই আমার তরফে সামান্য সম্মানদক্ষিণা দিতে চাই। আপনি কি আজই ফিরে যাবেন?

হ্যাঁ। কিন্তু সম্মানদক্ষিণা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কেন?

কোনও কাজ না করে ওটা নিতে আমার বিবেকে বাধবে।

মঙ্গলময়বাবু মুখ নিচু করলেন। ঠিক তখনই পাশের নারকোল গাছ থেকে দুটো নারকোলকে নীচে নেমে আসতে দেখল অর্জুন। সে এক লাফে কাছে। গিয়ে মঙ্গলময়বাবুকে টেনে সরিয়ে দিতেই ওই দুটো তাঁর চেয়ারে আছড়ে পড়ল। নারকোল দুটোর ওজন এবং গতির কারণে কাঠের চেয়ারের একটা হাতল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

থরথর করে কাঁপছিলেন মঙ্গলময়বাবু। তাঁর মুখ রক্তশূন্য। কোনওরকমে অর্জুনের ডানহাতের কনুই আঁকড়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

অর্জুন বলল, ভয় পাবেন না। এটা স্রেফ একটা অ্যাক্সিডেন্ট।

কিন্তু আপনি যদি আমাকে টেনে সরিয়ে না দিতেন তা হলে আমার মাথা চুরমার হয়ে যেত। গলার স্বর কাঁপছিল মঙ্গলময়বাবুর।

নারকোল দুটো তুলে টেবিলের উপর রাখল অর্জুন। কথাটা সত্যি। ভাগ্যিস সে উপরের দিকে তাকিয়েছিল। না হলে মৃত্যু অবধারিত ছিল ভদ্রলোকের।

মঙ্গলময়বাবু বললেন, বোঁটা শুকিয়ে গেলে কখনও কখনও নারকোল গাছ থেকে পড়ে যায় কিন্তু দু-দুটো নারকোল একসঙ্গে পড়েছে বলে শুনিনি।

অর্জুন নারকোলের যে অংশ গাছের সঙ্গে ছিল তা পরীক্ষা করল। অদ্ভুত ব্যাপার। ছেঁড়া জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ জোর করে নারকোলটা ছিঁড়েছে। কিন্তু কে ছিঁড়বে? এখন হাওয়াও জোরে বইছে না যে তার ধাক্কায় ঘটনাটা ঘটেছে। মঙ্গলময়বাবু বললেন, আমি আপনাকে বলেছিলাম, আমার জীবন বিপন্ন। অনুমানটা যে ভুল নয়, তা নিশ্চয়ই বুঝেছেন!

বুঝিনি। একটা কাকতালীয় ঘটনাকে প্রমাণ হিসাবে মেনে নেওয়া যায় না। আপনার কী মনে হয়? আপনাকে যারা মারতে চাইছে তারা যদি এই বাগানের গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায় তো দুটো নারকোল ছুঁড়ে থেমে যাবে কেন? এই আড়াই বছরে অনেকভাবে কাজটা করতে পারত। একটু ভেবে দেখুন। অর্জুন বলল।

বড় শ্বাস ফেললেন মঙ্গলময়বাবু। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আপনি এখন বিশ্রাম করুন। সকালের ট্রেন নিশ্চয়ই চলে গেছে। বিকেলের ট্রেনের টিকিট কাটাতে লোক পাঠাচ্ছি। ওই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই লাঞ্চের আগে চলে আসবেন। কথাগুলো বলে বাড়ির দিকে চলে গেলেন ভদ্রলোক।

অর্জুন গেস্টহাউসে ফিরে এল। সুস্থ মাথায় চিন্তা করলে পুরো ব্যাপারটাকে অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু মনে হবে না। শকুন ছানার কান্নাকে যেমন মানুষ ভূতের কান্না বলে ভুল বুঝে খুশি হয়, তেমনই। কিন্তু অর্জুনের খটকা লাগছিল একটা ব্যাপারে যা সে মঙ্গলময়বাবুকে বলেনি। নারকোল ঝুনো হয়ে গেলে, বোঁটা শুকিয়ে গেলে বাতাস না বইলেও ঝরে পড়তে পারে। কিন্তু ওই নারকোল দুটোর বোঁটার অনেকটাই কাঁচা ছিল। হাওয়াও বইছিল না। ওই অবস্থায় নারকোলের ঝরে পড়া কখনওই সম্ভব নয়। তার উপর একসঙ্গে দু-দুটো। এটা কেন এবং কী করে সম্ভব হল? এর আগে নারকোল পড়লে মঙ্গলময়বাবু নিশ্চয়ই তাকে বলতেন। আজই ওই ঘটনা ঘটে গেল? অনেকদিন আগে অমল সোম তাকে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন যার নাম বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। এটাকে সেরকম ভাবাই ভাল।

.

বেলা বারোটা নাগাদ দোলগোবিন্দবাবু ফিরলেন। তার হাতে একটা নারকোল। ঘরে ঢুকে বললেন, খুব জোর বেঁচে গেছি ভাই। এক পা এগোলেই মাথা চৌচির হয়ে যেত। কী সলিড নারকোল।

অর্জুন এগিয়ে এসে নারকোলটাকে হাতে নিয়ে দেখল ওটা একেবারেই ঝুনো। বোঁটা খটখটে। বলল, পেলেন কোথায়?

নদীর ধরে একটা মন্দির আছে। আমি একটা নাস্তিক। তবু কৌতূহল হল, জুতো পরে চাতালে উঠতেই উপর থেকে ঝরে পড়ল। গাছটা একটু বেঁকে ছিল এখানে। ভগবানের ইচ্ছে ছিল না যে আমি দর্শন করি। আর এগোইনি। নারকোলটাকে নিয়ে এলাম। দোলগোবিন্দবাবু বললেন।

মিছিমিছি কষ্ট করলেন। এর ভিতরে শাঁস দুরের কথা, জলও নেই। তবে স্মৃতি হিসাবে নিয়ে যেতে পারেন। স্নান করে ফেলুন।

এত তাড়াতাড়ি? কোথাও বের হবে নাকি?

না। বিকেলের ট্রেন ধরব। সময় আছে।

বাঃ। খুব ভাল কথা। তোমার তো স্নান হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি।