১. দাদুর ঘড়ি চুরি গেছে

ভুতুড়ে ঘড়ি – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দাদুর ঘড়ি চুরি গেছে। ব্যাপারটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। এই নিয়ে তাঁর মোট তিনশো বাইশটা ঘড়ি হয় চুরি গেছে, নয়তো হারিয়েছে, কিংবা নিজেই মেরামত করতে গিয়ে নষ্ট করেছেন। একবার কলকাতার রাধাবাজারে গলির গলি তস্য গলির মধ্যে এক ঘড়িওয়ালাকে দামি একটা ওমেগা সারাতে দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বছর তিনেক ধরে বহু ঘোরাঘুরি করেও সেই দোকানটা আর খুঁজে পাননি। এবারের ঘড়িটা গেল একটু অদ্ভুত উপায়ে। প্রায়ই ঘড়ি চুরি যায় বলে দাদু ঘড়িটাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন একটা ট্রানজিস্টার রেডিওর ভিতর। খুবই নিরাপদ জায়গা। রেডিওতে ব্যাটারির যে খোপ আছে তা থেকে ব্যাটারি বের করে নিয়ে ঘড়িটা ঢুকিয়ে ঢাকনা লাগালেই নিশ্চিন্ত। কেউ টেরই পাবে না ঘড়ি কোথায়। রেডিওটা জানালার পাশেই টেবিলের ওপর রাখা ছিল। চোর রাত্রিবেলা পাইপ বেয়ে উঠে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে রেডিও এবং আরও কিছু জিনিস নিয়ে গেছে। সকালে চেঁচামেচি। ঘড়িটা যে রেডিওর মধ্যে ছিল তা কেউ টের পায়নি, দাদুও সেকথা তোলেননি। তবে ঠাকুমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া খুব মুশকিল। তিনি সব দেখেশুনে হঠাৎ গিয়ে দাদুকে ধরলেন, “তোমার ঘড়ি কোথায়?”

দাদু প্রথমটায় আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “ঘড়ি! ঘড়ি নিশ্চয়ই কোথাও আছে। নিশ্চয়ই চুরি যায়নি। নিশ্চয়ই খুঁজে পায়নি ব্যাটা।”

ঠাকুমা গম্ভীর গলায় বললেন, “তবে বের করো। দেখাও।”

দাদু মাথাটাথা চুলকে বললেন, “ঘড়িটাকে চুরির মধ্যে ধরা যায় না। চোর নিয়েছে রেডিওটা। সে তো আর ঘড়ি নিতে আসেনি। তবে চুরির মধ্যে পড়বে কী করে?”

“তার মানে কী? ঘড়ি কি তুমি রেডিওর মধ্যে রেখেছিলে?”

“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা চোরের জানা ছিল না। ফলে ঘড়িটা চুরি গেছে, এ কথাটা লজিক্যাল নয়।”

“রাখো তোমার লজিক। ফের ঘড়ি গেল, এটা নিয়ে কটা হারাল তা জানো?”

দাদু মিনমিন করে বললেন, “হারিয়েছে এমন কথাও বলা যায় না। বরং বলা যেতে পরে ঘড়িটা নিখোঁজ।”

কিছুক্ষণ এই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হল। দাদু কিন্তু বারবারই বললেন, “চুরি গেছে আসলে রেডিওটা। ঘড়িটা চোরের হাতে চলে গেছে বাই চান। ক্রেডিটটা চোরকে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে?”

তবু যাই হোক তিনশো বাইশতম ঘড়িটা হারিয়ে দাদুকে একটু লজ্জিতই মনে হল। বেশি কথাটথা বলছিলেন না। তিনি ঘড়ি ধরে ওঠেন বসেন, সুতরাং ঘড়ি ছাড়া তাঁর চলেও না। ঘড়ির কথাটা আস্তে-আস্তে চাপা পড়ে গেল সারাদিনের নানা কাজে।

বিকেলের দিকে দাদুর বাল্যবন্ধু তান্ত্রিক শ্যামাচরণ আসায় কথাটা ফের উঠল। শ্যামাচরণের সঙ্গে দাদুর বন্ধুত্ব কী রকম তা লাটু, কদম বা ছানু জানে না। তবে তারা দেখে জটাইদাদু এলেই

তাদের দাদুর সঙ্গে ঝগড়া লাগে। তারা প্রায়ই পড়াশুনো ফেলে রেখে ঝগড়া শোনে।

দাদু হয়তো হঠাৎ বলে বসলেন, “ক্লাস এইট-এ ফেল করে তো সাধু হয়েছিলে। সব জানি। বেশি যোগ-ফোগ আর তন্ত্র মন্ত্র আমাকে দেখাতে এসো না। যোগের তুমি জানো কী হে? যোগ কথাটার মানে জানো?”

জটাইদাদু তাঁর বিশাল জটাসুদ্ধ মাথাটা সামান্য নাড়েন আর মৃদু মৃদু হাসেন। খুব ঠাণ্ডা ভদ্র গলায় বলেন, “মানে বললেই কি আর তুমি বুঝবে? বস্তুর সাধনা করে করে তো বোধশক্তিটাই হয়ে গেছে বস্তুতান্ত্রিক। যোগ মানে হল আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগ। কুলকুণ্ডলিনীর সঙ্গে সহস্রারের যোগ। রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের…”

“বুঝেছি! এক আজগুবির সঙ্গে আর এক আজগুবির যোগ! একটা মিথ্যের সঙ্গে আর একটা মিথ্যের যোগ। একটা পাগলামির সঙ্গে আর এক পাগলামির যোগ। বলি, এসব গুলগপ্পো আর কতদিন চলবে? বুড়ো হয়ে মরতে চলেছ, এখন আর মিথ্যে কথা

বাড়িয়ে সত্যি কথাটা বলেই ফেল না। বলেই ফেল যে, ভগবান-ফগবান কিছু নেই। স্রেফ গাঁজাখুরি গল্প। বলি যোগ-যোগ যে করছ, ভগবান দেখেছ নিজের চোখে?”

জটাইদাদু তবু অমায়িক হাসেন আর মড়ার খুলিতে চা খেতে খেতে মাথা নাড়েন। মড়ার খুলি ছাড়া জটাইদাদু চা বা জল খান না। প্রথমদিন যখন ঝোলা থেকে করোটি বের করে কাপের চা ঢেলে নিলেন সেদিন, ঠাকুমা কেঁপে-ঝেপে অস্থির হয়ে বলে ফেলেছিলেন, “ঠাকুরপো, এ হল বামুনবাড়ি, ওসব মড়াটড়ার ছোঁয়া কি ভাল? সব অশুদ্ধ হয়ে যাবে যে!” জটাইদাদু খুব হেসে উঠে বললেন, “বলেন কী বউঠান! করোটি অশুদ্ধ হলে আমার

সাধনাও যে অশুদ্ধ। আমাদের যে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে সাধনা করতে হয়। আর এ হচ্ছে হরি ডোমের করোটি। সে ছিল মস্ত সাধক। অমাবস্যায় নিশুত রাত্তিরে এই খুলি জাগ্রত হয়ে ওঠে, কথা নয়।” একথা শুনে ঠাকুমা বাক্যহারা হয়ে গেলেন। তারপর আর বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি।

ঘড়ি চুরির পরদিন সন্ধেবেলাও জটাইদাদু এসেছেন এবং তাঁকে যথারীতি করোটিতে চা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। লাটু, কদম আর ছানু পড়ার ঘরে পড়া থামিয়ে কান খাড়া করে আছে।

কিন্তু দাদু যেন আজ একটু মনমরা। জটাইদাদুকে দেখেও খেঁকিয়ে উঠলেন না। বরং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ওহে, ইয়ে, তোমাদের তন্ত্র-মন্ত্রে নিরুদ্দিষ্ট জিনিস খুঁজে পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা আছে?”

জটাইদাদু মৃদু হেসে বললেন, “থাকবে না কেন? তন্ত্রসাধনায় সবই হয়।”

“ইয়ে, কাল রাত থেকে আমার ঘড়িটা নিখোঁজ।” দাদু চাপা স্বরে বললেন।

“নিখোঁজ? চুরি নাকি?” দাদু মাথা নেড়ে বলেন, “না, চুরি নয়। চুরি তো হয়েছে রেডিওটা।”

“ওঃ তাই বলো! রেডিও! তা এতক্ষণ ‘ঘড়ি ঘড়ি’ করছিলে কেন?”

দাদু তখন ঘটনাটা ব্যাখ্যা করলেন। জটাইদাদু নিমীলিত নয়নে হরি ডোমের করোটিতে চা খেতে খেতে সব শুনে বললেন, “এ অভ্যাস তোমার ছেলেবেলা থেকেই। ক্লাসে প্রায়ই তোমার পেনসিল হারাত। আমার মনে আছে।”

দাদু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আজকাল আমি মোটেই পেনসিল হারাই না। বাড়ির লোককে জিজ্ঞেস করতে পারো। এই লাটু, কদম, ছানু, তোরাই বল তো, আমি আজকাল পেনসিল হারাই?”

তিনজন সমস্বরে বলে ওঠে, “না তো! দাদু তো এখন কেবল। ঘড়ি, বাঁধানো দাঁত, চশমা আর চটিজুতো হারায়।”

এমন সময় ঠাকুমা ঘরে ঢুকে বলে ওঠেন, “পেনসিলের কাজ থাকলে তাও হারাত। আচ্ছা, তোমার কি আক্কেল হয় না?”

জটাইদাদু অবিচল কণ্ঠে বললেন, “ঠিকই বলেছেন বউঠান, হারাতে হারাতে হারান যে আমাদের বুড়ো হতে চলল, তবু বুঝল

ঈশ্বরপ্রেমে আত্মহারা হলে এত কিছু হারাতই না ওর। হারান রে, আত্মহারা হ, আত্মহারা হ।”

এইভাবেই আবার একটা তুলকালাম বেধে উঠল।

দাদু অর্থাৎ হারানচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তিন ছেলে। সত্যগুণহরি, রজোগুণহরি এবং বহুগুণহরি। বলা বাহুল্য, ছেলেদের নামকরণ হারানচন্দ্রের নয়। তিনি ঘোর নাস্তিক। তবে তাঁর বাবা হরিভক্ত ছিলেন। তাঁর নামও ছিল হরিভক্ত চট্টোপাধ্যায়। নাতিদের নামকরণ তিনিই করে যান, এবং পাছে তিনি মারা গেলে নাতিরা নাম পাল্টে ফেলে সেই ভয়ে একেবারে ইশকুলের খাতায় নাম তুলে দিয়ে তবে মরেছেন। বড় ছেলে সত্যগুণের দুই ছেলে লাটু আর কদম এবং এক মেয়ে ছানু। রজোগুণ ও বহুগুণ বিয়ে করেননি।

সত্যগুণ কলকাতায় থেকে চাকরি করেন। শনিবার বাড়ি আসেন। সোমবার ফিরে যান। হারানবাবুর ঘড়ি চুরির খবর পেয়ে এক শনিবার তিনি কলকাতা থেকে একটা ঘড়ি কিনে আনলেন।

ঘড়ি দেখে হারানচন্দ্র ভারী লাজুক হেসে বললেন, “আবার ঘড়ি কেন? আমি ভাবছিলাম আর ঘড়িটড়ি ব্যবহারই করব না। তা এটা কেমন ঘড়ি।”

সত্যগুণ মাথা চুলকে বললেন, “ভালই হওয়ার কথা। আমার এক চেনা লোক দিয়েছে। শপ্রুফ, ওয়াটারপ্রুফ, অটোমেটিক।”

“বটে! ওরে, এক গামলা জল নিয়ে আয় তো!” হারানচন্দ্র হাঁক দিলেন।

কোনও জিনিস পরীক্ষা না করে হারানচন্দ্রের শান্তি নেই। চাকর এক গামলা জল দিয়ে গেল। হারানচন্দ্র ঘড়িটা তাতে ডুবিয়ে দশ মিনিট অপেক্ষা করে তারপর তুললেন। না, জল ঢোকেনি। এর পর হাত তিনেক ওপর থেকে ঘড়িটা মেঝেয় ফেললেন, না, ভাঙল না।

হারানচন্দ্ৰ খুশি হয়ে বললেন, “ভালই মনে হচ্ছে। তবে এ ঘড়ির দেখছি অনেক ঘর। সাধারণ ঘড়ির মতো বারোটা নয় তো?”

সত্যগুণ দুরুদুরু বক্ষে ঘড়ির ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষণ করছিলেন। এবার তাড়াতাড়ি বললেন, “হ্যাঁ, ওইটাই এ ঘড়ির বিশেষত্ব। দিনের চব্বিশ ঘণ্টার হিসেবে ওতেও চব্বিশটা ঘর। নতুন ধরনের করেছে আর কি!”

হারানচন্দ্র ভ্রু কুঁচকে ঘড়িটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “এর ডায়ালের ওপর আরও তিনটে ছোট ছোট ডায়াল আছে দেখতে পাচ্ছি। ওগুলো কী?”

সত্যগুণ বললেন, “সব আমি জানি না। ঘড়িটা এদেশে নতুন এসেছে। খুব আধুনিক ব্যাপার-স্যাপার আছে ওতে। পরেরবার জেনে আসব।”

ঠাকুমা বাসবনলিনী দেবী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঝংকার দিয়ে বললেন, “তা এটা কবে চোরের ঘরে যাচ্ছে সেটাই হিসেব করো। আমি বলি কী, ঘড়ি একটা ওঁকে জলের সঙ্গে বড়ির মতো গিলিয়ে দে। পেটে গিয়ে টিকটিক করুক। চুরিও যাবে না।”

এইসময়ে জটাই তান্ত্রিক ঘরে ঢুকে নির্নিমেষ লোচনে বাল্যবন্ধুর হাতে ঘড়িটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “তিনশো তেইশ নম্বরটা এল বুঝি! ভাল। কিন্তু একটু সবুর করলে চুরি যাওয়া তিনশো বাইশ নম্বরটাও পাওয়া যেত হে। সেটার খোঁজে বাঞ্ছারামকে লাগিয়েছি।”

হারানবাবু অবাক হয়ে বলেন, “বাঞ্ছারামটি আবার কে?”

“আছে হে আছে। চিনবে। ভারী চটপটে, ভারী কেজো। বস্তুবাদীরা তাকে চোখে দেখতে পায় না বটে, কিন্তু সে জাজ্বল্যমান হয়েই ঘুরে বেড়ায়।”

হারানচন্দ্র চটে উঠে বলেন, “গুলগপ্পোর আর জায়গা পাওনি! আমাকে ভূত দেখাতে এসেছ? ঠিক আছে, বের করো তোমার বাঞ্ছারামকে। বের করো।”

জটাই তান্ত্রিক দাড়ির ফাঁক দিয়ে সদাশয়ের মতো হেসে বললেন, “বের করলেই যে ভিরমি খাবে। তার দরকারই বা কী? ঘড়ি পেলেই তো হল।”

“বেশ, তবে বের করো ঘড়ি।”

“আহা, অমন তাড়া দিলে কি চলে? ঘড়ি ঠিক আসবে। কিন্তু আমি বলি, এত ঘড়ি কিনলে আর হারালে, তবু কি তোমার সময়ের জ্ঞানটা হয়েছে হারান? আয়ু যে ফুরিয়ে এল সেটা খেয়াল করছ? পরকালের কাজ বলে কি কিছু নেই? এইসব ছেলেখেলা নিয়ে ভুলে থাকলেই চলবে?”

হারানচন্দ্র বিষাক্ত হাসি হেসে বললেন, “পরকালের তত্ত্ব তোমার মতো ক্লাস এইট-এ লাড্ড পাওয়া গবেটের কাছে জানতে হবে নাকি? যত্ত সব গুলবাজ, গাঁজাখোর, ধর্মব্যবসায়ী!”

বাসবনলিনী শিহরিত হয়ে ধমক দিলেন, “ছিঃ ছিঃ, ঠাকুরপোকে ওরকম করে বলতে আছে? তোমার যে কবে কাণ্ডজ্ঞান হবে! ছোটরা শুনছে না?”

হারানচন্দ্র স্তিমিত হয়ে বলেন, “তা ও ওরকম বলে কেন?”

জটাই তান্ত্রিক করোটিটা ঝোলা থেকে বের করে টেবিলে রেখে বলেন, “আহা, বলুক, বলুক বৌঠান। মরা মরা বলতে বলতে যদি কোনওদিন রামনাম ফুটে ওঠে।”

হারানচন্দ্র রাত্রে ঘড়িটা বালিশের তলায় নিয়ে শুলেন। মাঝরাতে হঠাৎ তিনি চেঁচামেচি করে উঠলেন, “এই, শিগগির রেডিওটা বন্ধ কর। এত রাত্রে রেডিও শুনছে কে রে? অ্যাঁ!”

হারানচন্দ্রের বাজখাঁই গলার চিৎকারে বাড়িসুষ্ঠু লোক উঠে পড়ে। কে রেডিও চালাচ্ছে তার খোঁজ শুরু হয়ে যায়।

বাসবনলিনী উঠে সবাইকে ধমক দিয়ে বলেন, “তোদের কি মাথা খারাপ হল নাকি যে, ওঁর কথায় কান দিচ্ছিস! রেডিও কোথায় যে বাজবে? রেডিও চুরি হয়ে গেছে না?”

তখন সকলের খেয়াল হল। তাই তো! বাড়িতে রেডিওই নেই যে!

হারানচন্দ্র আমতা-আমতা করে বলেন, “কিন্তু আমি যে স্পষ্ট শুনেছি। রেডিওতে গান হচ্ছে। কথাবার্তা হচ্ছে।”

বাসবনলিনী রাগ করে বলেন, “এত রাত্রে রেডিওতে গানবাজনা হয় বলে শুনেছ? রেডিওর লোকেদের কি ঘুম নেই?”

তাও বটে। হারানচন্দ্র বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বের করে দেখলেন। তারপরই আঁতকে উঠে বললেন, “এ কী? এ যে দেখছি ভোর হয়ে গেছে। সকাল ছটা বাজে যে! না, না, আটটা, নাকি…দূর ছাই, এ ঘড়ির যে কিছুই বোঝা যায় না!”

বাসবনলিনী উদার গলায় বললেন, “আর কষ্ট করে ঘড়ি দেখতে হবে না। আমি একটু আগেই দেয়াল-ঘড়িতে রাত দুটোর ঘণ্টা শুনেছি। এখন দয়া করে ঘুমোও।”

লজ্জা পেয়ে হারানচন্দ্র ঘুমোলেন। কিন্তু একটু পরেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। খুব কাছেই যেন কারা চাপা গলায় কথাবার্তা বলছে। ভাষাটা একটু বিচিত্র।

হারানচন্দ্র চোর এসেছে বুঝতে পেরে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন, “চোর! চোর! পাকড়ো!”

আবার বাড়িসদ্ধ লোক উঠে ছোটাছুটি দৌড়োদৌড়ি শুরু করল। কিন্তু চোরের কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। বন্ধ দরজা বা জানালার শিক সব অক্ষত আছে। খাটের তলা বা পাটাতনেও কেউ লুকিয়ে নেই।

হারানচন্দ্র মাথা চুলকে বললেন, “একজন নয়। কয়েকজন চোর এসেছিল। তাদের মধ্যে একজন আবার মেয়েছেলে। আমি স্পষ্ট তাদের কথা শুনেছি।”

বাসবনলিনী চোখ পাকিয়ে বললেন, “কী বলছিল তারা শুনি!”

“কথাটা ঠিক ধরতে পারলাম না। ভাষাটা অন্যরকম।”

“জন্মে শুনিনি যে, চোরে চুরি করতে এসে কথা বলে। তোমার আজ হয়েছে কী বলো তো! এই রেডিওর শব্দ শুনছ, এই চোরের কথাবার্তা শুনছ! বলি লোককে ঘুমোতে দেবে, না কী?”

হারানচন্দ্র ধমক খেয়ে আবার শুলেন। কিন্তু ঘুম এল না। চোখ বুজে নানা কথা ভাবছেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন, কাক ডাকছে, কোকিল ডাকছে, শাঁখ বাজছে। চমকে উঠে বসলেন। তবে এবার আর চেঁচামেচি করলেন না তাঁর মনে হল, বাস্তবিক তিনি স্বপ্নই দেখছেন বোধহয়। কারণ, কাক ডাকার কোনও কারণ নেই। ভোর হতে বিস্তর বাকি। বাইরে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার।

হারানচন্দ্র বসে বসে ভাবতে লাগলেন, এসব হচ্ছেটা কী?

তিনি যা শুনছেন তা মিথ্যে নয়। অথচ আর কেউ শুনছে না। কেন? ভাবতে ভাবতে বালিশের তলা থেকে ঘড়িটা বের করে হাতে পরলেন, তারপর বিছানা থেকে নেমে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আরও ভাবতে লাগলেন।

আচমকা একটা মেয়ে খুব কাছেই কোথাও খিলখিল করে হেসে উঠল। হারানচন্দ্র চমকে উঠে চারদিকে তাকালেন। কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। হাসির শব্দটা ঠিক স্বাভাবিক নয়, একটা ধাতব শব্দ। যেমন লাউডস্পিকার বা রেডিওতে শোনা যায়। হারানচন্দ্র উঠে চারদিকটা ঘুরে এলেন। না, কেউ কোথাও নেই। এসে আবার বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেই তাঁর একটা খটকা লাগল। এই যে তিনি বাড়ির ভিতরে চারদিক ঘুরে এলেন, কিন্তু তিনি তো আলো জ্বালাননি। ঘরগুলো তো অন্ধকার। আলো না জ্বালিয়েও তিনি সবই দেখতে পেয়েছেন। এটা কী করে সম্ভব হল?

নাঃ, আজ মাথাটা বড় গরম হয়েছে। একবার তাঁর এও মনে হল, জটাই তান্ত্রিককে অত গালাগালি রোজ করেন বলেই বোধহয় তান্ত্রিকের পোষা ভূতেরা এসে এসব কাণ্ড করছে। কাল সকালেই একবার জটাইয়ের কাছে যেতে হবে। হারানচন্দ্র ভূত বা ভগবান মানেন না বটে, কিন্তু এখন কেমন যেন একটা সন্দেহ হচ্ছে। গা ছমছম করছে।

ভোরের দিকটায় হারানচন্দ্র ইজিচেয়ারে শুয়েই একটু ঘুমোলেন। ঘুম ভাঙল আবছা আলো ফুটে ওঠার পর।