অধ্যাপক ত্রিবেদীর বিচিত্র কীর্তি (উপন্যাস)
অধ্যাপক ত্রিবেদী ও কালো বিড়াল
০১.
কলকাতার কাছে এক অখ্যাত শহরতলিতে একদিন বিকালে যে-ভদ্রলোকটিকে দেখা গেল, তিনি এই এলাকায় নবাগত- মাঝারি আকারের অত্যন্ত রোগা চেহারার মানুষটি তার চশমার ভিতর দিয়ে একটি বৃহৎ অট্টালিকার দিকে নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে কী-যেন ভাবছিলেন।
বাড়িটি মস্ত বড়ো, কিন্তু একনজর তাকালেই বোঝা যায় সেখানে জনপ্রাণী বাস করে না;— তার দেয়ালে দেয়ালে ফাটল ধরেছে এবং পাঁচিলের গা ঘেঁষে বাগানের সীমানার মধ্যে বেড়ে-ওঠা আগাছার ঝোঁপ ভেদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে একটা ছোটোখাটো গাছ আপাতত সেই গাছটার দিকেই তাকিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন উক্ত ভদ্রলোক।
অকস্মাৎ তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে দিল একটি বালকের কণ্ঠস্বর, এই যে স্যার, আপনিই তো বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী? আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছেন, তাই না?
চমকে উঠে ভদ্রলোক দেখলেন তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলে। প্রশ্নটা যে সে-ই করেছে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। এতক্ষণ যেন অন্য জগতে বিচরণ করছিলেন ভদ্রলোক, ছেলেটির কণ্ঠস্বর আবার তাকে বাস্তব পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে দিল, তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, বিখ্যাত কিনা জানি না, তবে আমিই অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী। উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে থাকি। কিন্তু তুমি আমাকে চিনলে কি করে?
ছেলেটি হাসল, খবরের কাগজে মাঝে-মধ্যেই আপনার ছবি দেখতে পাই। কয়েকদিন আগে এই পাড়ারই একটি বাড়ির দরজায় আপনার নাম দেখতে পেলাম। বুঝলাম, আপনি হঠাৎ আমাদের পাড়ায় এসে উঠেছেন। কিন্তু কেন? আপনি তো দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন। হঠাৎ এই জায়গায় আপনার মতো বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের উঠে আসার দরকার হল কেন? এখানকার গাছপালা নিয়ে কিছু গবেষণা করছেন নাকি?
অধ্যাপক ত্রিবেদী ভীষণ চমকে গেলেন, কিন্তু মনের ভাব গোপন করে বললেন, না, না, ওসব কিছু নয়। এই অঞ্চলে এখনও তেমন গাড়ি-টাড়ির চলাচল শুরু হয়নি, এখানকার বাতাস কলকাতার মতো দুষিত নয়, তাই এখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাব ভাবছিলাম।
–খুব ভালো কথা। কিন্তু হানাবাড়ির দিকে তাকিয়ে আপনি অত মন দিয়ে কী দেখছিলেন?
ত্রিবেদীর ভ্রু কুঞ্চিত হল, হানাবাড়ি? তার মানে?
–লোকে তো তাই বলে। আমার সঙ্গে কেউ থাকলে একটা রাত ওই বাড়িতে থেকে ভূত দেখার চেষ্টা করতাম। আমার বন্ধুরা ভীতু, কেউ ওখানে রাত কাটাতে রাজি নয়। আর আমি আমি ঠিক ভীতু নই, তবে একা-একা ওই হানাবাড়িতে রাত কাটাতে আমারও সাহস হয় না।
-কেন? ভূতে ঘাড় মটকে দেবে?
–না, না, তা নয়। তবে ইয়ে মানে, বলা তো যায় না, যদি
বুঝেছি, অধ্যাপক ত্রিবেদী হাসলেন, অর্থাৎ ভূতের ভয় তোমার আছে। কিন্তু ভূত বলে কিছু নেই। এই সব কুসংস্কার তোমাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। তুমি যদি আজ এই হানাবাড়িতে রাত কাটাতে রাজি থাকো, তবে আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
সত্যি বলছেন স্যার? ছেলেটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাহলে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঠিক রাত দশটার সময়ে আপনি এখানে আসুন। আমিও আসব।
ছেলেটি পিছন ফিরে চলতে শুরু করেছিল, অধ্যাপক তাকে ডাকলেন, শোনো। তোমার নামটি তো আমার জানা হল না।?
আমার নাম গোবিন্দ ঘোষ। এখন আমি চললাম। মনে রাখবেন, ঠিক দশটায় আমি আসব।
-আরে, শোনো, শোনো। তোমার বাবা-মা তোমার মতো ছোটো ছেলেকে সারা রাত এই বাড়িতে থাকার অনুমতি দেবেন বলে আমার মনে হয় না। বরং চলো, আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে তাদের অনুমতি নিয়ে আসি।
-দরকার নেই স্যার। মার আবার ভীষণ ভূতের ভয়। তিনি কিছুতেই আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দেবেন না।
তাহলে? তাহলে তুমি আসবে কি করে? রাত্রে তোমাকে দেখতে না পেলে বাড়ির সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করবে, হয়তো থানাতে খবর যাবে। নাঃ, তোমার আসার দরকার নেই।
-না, স্যার; আমি বাড়িতে বলেই আসব। তবে হানাবাড়িতে থাকার কথা বলব না। আমাদের ক্লাসের রথীন অঙ্কে খুব ভালো, আমি মাঝে মাঝে তার বাড়িতে অঙ্ক করতে যাই। অনেক সময় রাতেও থাকি। আমি অঙ্কে খুব কঁচা কিনা, তাই রথীনের বাড়িতে অঙ্ক করতে গেলে বাড়ির কেউ কখনো বাধা দেয় না। আজ রাতে আমি রথীনের বাড়ি যাচ্ছি বলেই বেরিয়ে আসব বুঝেছেন?
ত্রিবেদী গম্ভীর হলেন, গোবিন্দ, মিছে কথা বলে বাবা-মাকে ফাঁকি দেওয়া কখনো উচিত নয়। তবে একটা কুসংস্কার পুষে রাখবে, সারা জীবন অলীক ভয়ের দাপটে মনের স্বাস্থ্য নষ্ট করবে, এটাও ঠিক নয়। বিজ্ঞানী হিসাবে তোমার মন থেকে এই অলীক ভুতুড়ে ব্যাপারটা মুছে ফেলা আমার কর্তব্য। শুধু সেইজন্যই তোমার মিথ্যাভাষণ এবারের মতো আমি ক্ষমা করতে রাজি আছি। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনো বাবা-মার কাছে মিছে কথা বলবে না। আমার কথাটা মনে থাকবে?
থাকবে স্যার। তাহলে ওই কথাই রইল। আপনি রাত দশটায় আসছেন তো?
–আসছি। এখন বাড়ি যাও।
.
০২.
কাঁটায় কাঁটায় রাত দশটার সময়ে যথাস্থানে উপস্থিত হলেন ত্রিবেদী। বাড়ির চারদিক ঘিরে যে পাঁচিলটা রয়েছে, তার গায়ে লাগানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল গোবিন্দ।
পাঁচিলের পরে কিছুটা জমির উপর বাগান। এখন অবশ্য বাগান বলা চলে না, দীর্ঘকাল, অযত্নের ফলে জায়গাটা আগাছার জঙ্গলে পরিণত। সেই একদা-নির্মিত উদ্যান এবং বর্তমানে আগাছার জঙ্গল ভেদ করে একটা সরু পথ এগিয়ে গেছে বাড়ির দরজার দিকে। ওই দরজাই হল বাড়ির প্রবেশ পথ। গোবিন্দের সঙ্গে ওই পথেই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন ত্রিবেদী। একটা ঘরের সামনে এসে গোবিন্দ বলল, একটু দাঁড়ান স্যার, আলো জ্বালি।
পকেট থেকে মোমবাতি আর দেশলাই বার করে আলো জ্বালিয়ে দিল গোবিন্দ। ত্রিবেদী। দেখলেন ঘরটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ধুলো বালি নেই এবং মেঝের উপর মাদুর ও চাদর বিছিয়ে যে শয্যাটি প্রস্তুত করা হয়েছে, সেখানে স্বচ্ছন্দে দুটি মানুষের স্থান হয়ে যাবে। উপরন্তু শয্যার উপর রয়েছে দুটি বালিশ– অর্থাৎ রাত্রিযাপনের জন্য আয়োজনের কোনো ত্রুটি নেই।
ত্রিবেদী বিস্মিতকণ্ঠে বললেন, এমন পোড়ো বাড়ি, কিন্তু মেঝেটা দেখছি বেশ পরিষ্কার। এই সব মাদর, চাদর, বালিশ প্রভৃতি সব কিছুই তুমি জোগাড় করেছ নিশ্চয়? আমি তো ওগুলোর কথা একেবারেই ভাবিনি। তুমি বেশ করিকর্মা ছেলে গোবিন্দ।
গোবিন্দ গর্বিতস্বরে বলল, আমি বিকেলবেলা এসে এই ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রেখেছিলাম। মাদুর, চাদর আর বালিশ একটু আগে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি।..
ত্রিবেদী বললেন, বেশ, বেশ। এখন কিছুক্ষণ পর্যন্ত জেগে থেকে তুমি ভুতের জন্য অপেক্ষা। করতে পার। অবশ্য কোনো ভূতই যে তোমাকে দেখা দিতে আসবে না এবিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। ভূতের দেখা না পেয়ে তুমি যখন হতাশ হয়ে পড়বে, তখন তুমিও শুয়ে পড়ে নিদ্রার আয়োজন করবে– কী বলো?
গোবিন্দ বলল, আমি ভূতের জন্যে অপেক্ষা করব না স্যার। আমার দারুণ ঘুম পেয়েছে। ভূত যদি এসে গোলমাল বাধায়, তাহলে তো উঠে পড়তেই হবে।
কিন্তু এই বাড়ির আনাচকানাচ হয়ত অনেক ভূত ওত পেতে আছে। সেকথা ভেবেও কি তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে?
আপনি ঠাট্টা করছেন স্যার? আমি একা থাকলে নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারতাম না। কিন্তু আপনি তো আছেন, তাই নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ছি।
-আচ্ছা, তাহলে গুডনাইট গোবিন্দ।
–গুডনাইট, স্যার।
… গভীর রাত্রে হঠাৎ গোবিন্দের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে সে ঘুম ভাঙার কারণটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু একটা ধুপ-ধাপ শব্দ তার কানে আসতেই সে বুঝল ওই শব্দটাই তার ঘুম ভেঙে দিয়েছে। দুই হাতে চোখ দুটো ভালো করে ঘষে নিয়ে সে শব্দ লক্ষ্য করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, সঙ্গে সঙ্গে এক অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠল তার চোখের সামনে!- নানারকম অঙ্গ-ভঙ্গি করে নাচছেন অধ্যাপক ত্রিবেদী। ধুপধাপ শব্দের উৎস হচ্ছে তার নৃত্যচপল দুই পা! শুধু যে অশান্ত পদক্ষেপেই নৃত্য অভ্যাস করছেন ত্রিবেদী তা নয়, তার দুটি হাতও এঁকেবেঁকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঘুরছে! দারুণ আতঙ্কে গোবিন্দের চুল খাড়া হয়ে উঠল, সে বুঝল ত্রিবেদীর উপর ভূতের ভর হয়েছে– নাহলে রাত দুপুরে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হঠাৎ নৃত্যকলার চর্চা করতে যাবেন কেন? তাঁর যে হাত দুটি এখন নাচের মুদ্রায় ঘুরছে, সেই হাত যদি হঠাৎ গোবিন্দের গলা টিপতে চায়, তাহলে কি হবে?
কে বাঁচাবে তাকে?… গোবিন্দ ভেবেছিল অশরীরী হঠাৎ শরীর ধারণ করে তাকে ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু ভূতেরা যে কখনো কখনো মানুষের উপর ভর করে এবং সেই ভূতে-পাওয়া মানুষ যে নানারকম ভয়াবহ কাণ্ড করে থাকে, একথা অনেকবার শুনলেও গোবিন্দ ভাবতে পারেনি যে, অধ্যাপক ত্রিবেদীর উপরেই হঠাৎ ভর করবে হানাবাড়ির ভূত!
ভীষণ ভয় পেলেও গোবিন্দের মস্তিষ্ক আতঙ্কে অসাড় হয়ে যায়নি। সে চটপট ভেবে নিল এখন অধ্যাপক ত্রিবেদীর থেকে যথাসম্ভব দুরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। গোবিন্দ শুনেছিল ভুতে-পাওয়া মানুষ নাকি অস্বাভাবিক শক্তির অধিকারী হয়। কিন্তু বরাবর স্কুলের স্পোর্টসে দৌড়-প্রতিযোগিতায় সে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে, আজ যদি সে একবার টেনে দৌড় মারতে পারে, তাহলে ত্রিবেদী অথবা ভূত কিংবা ত্রিবেদী ও ভূতের সম্মিলিত শক্তি অর্থাৎ ভূতে-পাওয়া অধ্যাপক ত্রিবেদী যে তার ভৌতিক শক্তি দিয়েও তাকে ধরতে পারবেন না, এবিষয়ে গোবিন্দের সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। কিন্তু দৌড় দেওয়ার আগেই ত্রিবেদী যদি তাকে ধরে ফেলেন, তাহলে তাঁর হাত ছাড়িয়ে পালানো যে সম্ভব হবে না একথাও বুঝতে পারছিল গোবিন্দ। নাঃ, সেই সুযোগ গোবিন্দ তাকে দিতে রাজি নয়, ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে শরীরটাকে সে গুটিয়ে আনল, এইবার দৌড় দিলেই হয়—
আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী, তার হাত পায়ের আন্দোলনও বন্ধ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ!
গোবিন্দ সভয়ে দেখল দরজা এবং তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন ত্রিবেদী! পলায়নের পথ একেবারেই বন্ধ!
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে গোবিন্দের মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন ত্রিবেদী। গোবিন্দের বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল দারুণ আতঙ্কে- এইবার বোধহয় ভূতগ্রস্ত ত্রিবেদী ঝাঁপিয়ে পড়বেন তার উপর…
প্রায় আচ্ছন্ন অবস্থায় গোবিন্দের কানে এল ত্রিবেদীর কণ্ঠস্বর, আরে গোবিন্দ, তুমি জেগে বসে আছ? তাহলে সাড়া দিচ্ছ না কেন? ওহে গোবিন্দ, গো-বি-ল-অ-অ-অ!
চোখ খুলে কাঁপা কাঁপা গলায় সাড়া দিল গোবিন্দ, হ্যাঁ, স্যার। আমি জুজ-জেগে আছি স্যার।
কী কাণ্ড! ত্রিবেদীর গলা খুবই স্বাভাবিক, তাহলে এতক্ষণ আর যন্ত্রণা ভোগ করলাম কেন? আমি ভাবলাম তুমি ঘুমিয়ে রয়েছ, তাই আর তোমার ঘুম ভাঙাতে চাইনি। যাক, তুমি যখন জেগেই আছ তখন একটা কাজ করো আমার পিঠের এই জায়গাটা একটু চুলকে দাও–
ত্রিবেদী পিছন ফিরে পিঠের একটা জায়গায় হাত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন, ওই জায়গাটায় কিছুতেই আমার হাত যাচ্ছে না।
বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে গোবিন্দ বলল, আ-আ-আপনি পি-পি-পিঠ চুলকাতে চেষ্টা করছিলেন?
-হ্যাঁ, গোবিন্দ। কখন থেকে চেষ্টা করছি, ঠিক জায়গায় কিছুতেই হাত যাচ্ছে না… হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক জায়গায় তুমি হাত দিয়েছ গোবিন্দ… বাঃ, ভালো করে চুলকে দাও, ভালো করে…হ্যাঁ, জোরে আরও জোরে আঃ! কি আরাম! কি আরাম।…
ভোরবেলা হানাবাড়ির দরজা খুলে বাইরে এসে ত্রিবেদী বললেন, দেখলে তো গোবিন্দ, সারা রাত আমরা অপেক্ষা করলাম, ভূত কি এল? আসলে ভূত-টুত কিছু নেই। ওই সব অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারে কখনো বিশ্বাস করবে না, বুঝেছ?
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গোবিন্দ বলল, হা স্যার, বুঝেছি।
-আচ্ছা, তুমি তাহলে বাড়ি যাও। আমিও আমার বাড়ির দিকেই রওনা হই। পরে আবার দেখা হবে।
অধ্যাপক ত্রিবেদী খুব তাড়াতাড়ি পা চার্লিয়ে গোবিন্দের চোখের আড়ালে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইল গোবিন্দ। পথের বাঁকে অধ্যাপকের চলমান দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল এবং অন্য একটা রাস্তা ধরে বাড়ির উদ্দেশে পদচালনা করতে করতে গোবিন্দ ভাবতে লাগল- ত্রিবেদী স্যার যে বাড়িতে থাকেন, সেই বাড়িটা তো আমি চিনি। কিন্তু উনি তো নিজের বাড়ির দিকে গেলেন না, আবার ঘুরে হানাবাড়ির দিকেই হাঁটা দিলেন যে ত্রিবেদী স্যার কি ওখানে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন? শুনেছি, পোড়োবাড়িতে অনেক সময় গুপ্তধন থাকে… নাঃ, ব্যাপারটা বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে
কিন্তু হানাবাড়ি আর ত্রিবেদীকে নিয়ে বেশিক্ষণ চিন্তার সুযোগ পেল না গোবিন্দ, আচম্বিতে তার কর্ণকুহরে সবেগে ধাক্কা মারল কুকুর ও বিড়ালের মিলিত কণ্ঠের ক্রুদ্ধ আস্ফালন-ভোক! ভোক!-ফ্যাঁসস!
শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে গিয়ে গোবিন্দ দেখল একটা ইটের পাঁজার উপর আশ্রয় নিয়ে সর্বাঙ্গের লোম ফুলিয়ে গজরাচ্ছে একটা কুচকুচে কালো বিড়াল আর সেই ইটের পাঁজার নিচে দাঁড়িয়ে বিড়ালটাকে ক্রমাগত ধমক দিচ্ছে একটা প্রকাণ্ড কুকুর!
ঈসস! গোবিন্দ বলে উঠল। বগলুর হতভাগা কুকুরটা একটা কালো বিড়ালকে কোণঠাসা করেছে। বেড়ালটা ইটের পাঁজার উপর উঠেছে বলে কুকুরটা ওর নাগাল পাচ্ছে না, উঠতে গেলেই বেড়ালের থাবা পড়ছে নাকে কিন্তু একবার যদি খুনে কুকুরটা বেড়ালটাকে ধরতে পারে তাহলেই বেড়ালের দফারফা। নাঃ, বেড়ালটাকে বাঁচাতে হবে।
গোবিন্দ এগিয়ে গিয়ে কুকুরটাকে তাড়া দিল, হেট! হেট! যাঃ! বেড়ালকে ছেড়ে কুকুরটা এবার গোবিন্দের দিকে ফিরে দাঁত খিঁচিয়ে গর্জে উঠল, গরর! গরর! ভো! ভোঃ!
আরে গেল যা! আমাকেই কামড়াবে নাকি? গোবিন্দ নিচু হয়ে দুটো ইট কুড়িয়ে নিল, আমি বেড়াল নই, বুঝেছিস? আমাকে কামড়াতে এলে নাক মুখ আস্ত রাখব না।
কুকুরটা বোকা নয়- গোবিন্দ ইট তুলতেই সে বুঝে গিয়েছিল এই মনুষ্যশাবক দস্তুর মতো বিপজ্জনক, এর শরীরে দন্তস্ফুট করতে গেলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে– অতএব দূরে দাঁড়িয়ে সে সারমেয় ভাষায় গালাগালি করতে লাগল, ভোক! ভোক! ভৌ-উ-উ-উ-ভোঃ!
দ্বিপদ ও চতুস্পদ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্ভাব্য দ্বৈরথ-যুদ্ধে বাধা দিয়ে হঠাৎ অকুস্থলে দেখা দিল গোবিন্দেরই সমবয়সী একটি ছেলে, এই গোবিন্দ! আমার কুকুরের পিছনে লাগছিস কেন রে?
আরে বগলু যে! গোবিন্দ হাতের উদ্যত ইট নামিয়ে নিল, তোর কুকুর ওই বেড়ালটাকে কামড়াতে যাচ্ছিল, তাই আমি কুকুরটাকে তাড়া দিচ্ছিলাম।
বেড়াল? বগলু জানতে চাইল, কোথায়?
গোবিন্দ কিছু বলার আগেই বেড়ালটা ইটের পাঁজার উপর থেকে একলাফে নেমে ছুটে পালাতে লাগল এবং তৎক্ষণাৎ তাকে তাড়া করে ছুটল বগলুর কুকুর। বগলু এবার দেখতে পেল বেড়ালটাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠল, আরে! আরে! কুচকুচে কালো একটা বেড়াল! জিম- ধর ওটাকে, যা, যা, ধর!
জিম আগেই তাড়া করেছিল, প্রভুর উৎসাহ পেয়ে সে আরও জোরে ছুটল বিড়ালের পিছনে।
গোবিন্দ ক্রুদ্ধস্বরে বলল, বগলু, তুই কুকুরটাকে লেলিয়ে দিলি? ধরতে পারলে বেড়ালটাকে মেরে ফেলবে। তোর কুকুর এই এলাকাতে তিন-চারটে বেড়াল মেরেছে।
বগলু হাসল, এটাকেও মারবে। ওই দ্যাখ।
বাস্তবিকই বেড়ালটাকে তখন প্রায় ধরে ফেলেছে বগলুর কুকুর। হঠাৎ বেড়াল দিক-পরিবর্তন করল একপাক ঘুরেই সোজা রাস্তা ছেড়ে পাশের একটা গলিতে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু নিয়ে অদৃশ্য হল বগলুর কুকুর।
.
০৩.
নতুন জায়গায় এসে অধ্যাপক ত্রিবেদী সদ্য ভাড়া-নেওয়া বাড়িটির একটি ঘরে প্রয়োজনীয় বস্তু দিয়ে ছোটোখাটো একটি ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার সাজিয়ে নিয়েছিলেন। বর্তমানে ওই গবেষণাগারের ভিতর একটি কাঁচের টিউবে কিছু তরল পদার্থ নিয়ে তিনি পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎ সারমেয় কণ্ঠের তীব্র চিৎকার তাকে চমকে দিল, আর একটু হলেই কাঁচের টিউবটা তার হাত থেকে ছিটকে পড়ত। কুকুরটা তখনও থামেনি, মহাআক্রোশে চিৎকার করে কোন অদৃশ্য শত্রুকে ধমকের পর ধমক দিচ্ছে!
ত্রিবেদী হাঁক ছাড়লেন, সনাতন! অ্যাই সনাতন!
উত্তর এল, যাই বাবু।
–এখানে আসতে হবে না। বাড়ির সামনে একটা কুকুর, ভীষণ চ্যাচাচ্ছে। ওটাকে তাড়িয়ে দে। যদি সহজে যেতে না চায়, তাহলে লাঠিপেটা করে বিদায় কর। যত সব আপদ- স্থির হয়ে যে একটু কাজ করব, তার উপায় নেই।
নেপথ্য থেকে উত্তর এল, কুকুরের তাড়া খেয়ে নিচের জানালা দিয়ে একটা বেড়াল ঘরে ঢুকেছে। ওটাকে ধরতে না পেরে কুকুরটা চাঁচাচ্ছে। এখন আর আপনাকে কাজ করতে হবেকনি। বেলা হইছে, খাতি আসেন।
-আচ্ছা, আচ্ছা, এখনই যাচ্ছি।
-হ, তাড়াতাড়ি আসেন।
ত্রিবেদী হাতের টিউবটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করলেন, একটু ইতস্তত করে টিউবের তরল পদার্থ গলায় ঢেলে দিলেন। হাতঘড়িটা চোখের উপর তুলে ভাবতে লাগলেন- জাপানি প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনা আমাকে যে ফরমুলা দিয়েছিলেন, সেই ফরমুলা অনুসারেই তো এই মিকশ্চার তৈরি করেছি। যে-নমুনা তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, হানাবাড়িতে তো ঠিক সেই বস্তুটি পেয়েছি বলেই মনে হচ্ছে। তাগাসাকি বলেছেন পনেরো মিনিট পরেই ফল পাওয়া যায়, আমি না-হয় আধঘণ্টা অপেক্ষা করব।
একতলা থেকে সনাতনের উচ্চকণ্ঠ ভেসে এল, আপনাকে নিয়ে আর পারি না বাবু। কাজ থাকলে তো ফল-মিষ্টি আর দুধ ছাড়া কিছু খান না। তা-ও যদি সময়মতো না খান, তাহলে শরীর থাকবে কি করে?… আবার দেখছি খাবার টেবিলে কতগুলো গাছের পাতা রেখে গেছেন এগুলো কি হবে?
ওগুলো নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না, ত্রিবেদী চেঁচিয়ে উঠলেন, এইবার খেয়ে নেব। পরে হয়তো খাওয়ার সময় পাব না। তুই তাড়াতাড়ি খেতে দে।
তিক্তস্বরে উত্তর এল, অনেকক্ষণ দিয়েছি।
খাবার টেবিলের সামনে চেয়ারের উপর আসন গ্রহণ করতে করতে ত্রিবেদী বললেন, অনেক বেলা হয়েছে, তুই এইবার খেতে যা, সনাতন। আমি তো শুধু ফল-মিষ্টি আর দুধ খাব, পরিবেশনের ঝামেলা নেই। তোর খাওয়া হলে চিঠির বাক্সটা দেখবি, চিঠি আসতে পারে।
সনাতনের গমনপথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ত্রিবেদী এবার কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালেন, আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে। সনাতনটাও খেতে গেছে, এই সুযোগে পরখ করে দেখি।
ডাইনিং টেবিল অর্থাৎ খাবার টেবিলটা দুহাতে ধরে সেটাকে ভোলার চেষ্টা করলেন ত্রিবেদী; টেবিল নড়ল না। আবার চেষ্টা করলেন তিনি, এবারও তার চেষ্টা সফল হল না– টেবিল তখনও স্থাণু, নট নড়নচড়ন ন কিছু!
ত্রিবেদীর ভ্রূ কুঁচকে গেল, এ কী হল! টেবিল একটুও নড়ল না! কিন্তু প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনার নমুনা তো এইরকমই ছিল মনে হচ্ছে। তার দেওয়া ফরমুলা মিলিয়েই তো সব করেছি– তবে?… আচ্ছা, নোটবইটা প্যান্টের পকেটেই রয়েছে, খেতে খেতে বরং আর একবার ফরমুলাটা দেখি… নাঃ, সব তো ঠিকই আছে দেখছি, কোথাও তো ভুল হয়নি… তাহলে.. তাহলে কি এটা আসল জিনিস নয়? তাগাসাকি বলেছিলেন আমাজন নদীর অববাহিকায় এই জিনিস তিনি পেয়েছিলেন। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বিচরণ করেছেন তিনি, কিন্তু ওই বস্তুটি তিনি কোথাও দেখতে পাননি, এমনকি আফ্রিকার গভীর অরণ্যেও নয়- আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটা জায়গায় ওই ধরনের গাছ তার চোখে পড়েছিল। কিন্তু সেগুলো পরীক্ষার সুযোগ–ঈঃ! থু! থু!
অন্যমনস্ক হয়ে ফল খেতে খেতে টেবিলের উপর পড়ে-থাকা গাছের পাতাগুলোর উপর ত্রিবেদীর হাত পড়ে যায়, নোটবুকে দৃষ্টি নিবদ্ধ ত্রিবেদী কয়েকটা পাতা তুলে মুখে ফেলে দেন, পরক্ষণেই অতিশয় কটু তিক্তরসে পরিপূর্ণ হয়ে যায় তার মুখগহ্বর- ঈস! কী তেতো রে বাবা! অন্যমনস্ক হয়ে কয়েকটা পাতা মুখে দিয়ে ফেলেছি… ওই যাঃ!
আবার এক অভাবিত দুর্ঘটনা! হঠাৎ তাঁর হাতের ধাক্কা লেগে উলটে গেল দুধের গেলাস! টেবিলের উপর পাতার রাশি ভিজিয়ে ছুটল দুগ্ধস্রোত! সেই অমল ধবল তরল স্রোতের দিকে করুণ নয়নে তাকিয়ে ত্রিবেদী যখন তাঁর দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করছেন, সেই সময় হঠাৎ জানালার ফাঁক গলে অকুস্থলে উপস্থিত হল একটি কালো বিড়াল। ত্রিবেদীর দিকে এক নজর তাকিয়ে বিড়াল বুঝে নিল এই লোকটি তেমন বিপজ্জনক হবে না। অতএব একলাফে জানলা থেকে টেবিলে উঠে সে বহমান দুগ্ধস্রোতের স্বাদগ্রহণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল…
ত্রিবেদী সম্পর্কে বিড়ালের চরিত্র-বিশ্লেষণ ছিল নির্ভুল, ত্রিবেদী তাকে একবারও তাড়া দিলেন না, দুগ্ধপানে নিবিষ্টচিত্ত মার্জারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, কোথা থেকে একটা কালো বেড়াল এসে জুটেছে!… ওহো, একটু আগে সনাতন বলছিল বটে কুকুরের তাড়া খেয়ে একটা বেড়াল একতলার জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। নিচের তলায় অন্যান্য ঘরে ঘোরাঘুরি করতে করতে বেড়ালটা বোধহয় দুধের গন্ধ পেয়ে এই ঘরে হানা দিয়েছে… তা খাক, দুধটা তো আর আমি খেতে পারলাম না, ও-ই খা… আমি বরং একটু বিশ্রাম করি। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল, সব পরিশ্রম ব্যর্থ।
খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে অন্য ঘরে একটা সোফার উপর শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী…
ভোক! ভৌউ-উ! ভোঃ- কাঁঈঈঈ!
আচম্বিতে একটা কুকুরের তীব্র ক্রুদ্ধ চিৎকার তন্দ্রাচ্ছন্ন ত্রিবেদীকে জাগিয়ে দিল- পরমুহূর্তেই ক্রুদ্ধ গর্জন পরিণত হল সুদীর্ঘ আর্তনাদে!
একলাফে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী। কুকুরের আর্তনাদ তখন থেমে গেছে। বিস্মিত ও বিমূঢ় ত্রিবেদীর মনে হল আওয়াজটা যেন এই বাড়ির একতলা থেকেই এসেছে!
বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই, গজগজ করতে করতে দ্রুত পদক্ষেপে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে একতলার বৈঠকখানায় উপস্থিত হলেন ত্রিবেদী। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অভাবিত দৃশ্য–
খোলা দরজার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার ভৃত্য সনাতন এবং ঘরের মধ্যে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে একটা মস্ত বড়ো কুকুর!
পায়ে পায়ে এগিয়ে কুকুরটার শায়িত দেহের সামনে এসে দাঁড়ালেন ত্রিবেদী। একবার তাকিয়েই তিনি বুঝতে পারলেন কুকুরটা জীবিত নেই তার বাঁ চোখের তলা থেকে গলা পর্যন্ত হাঁ করে আছে একটা গভীর ও সুদীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন এবং সেই ক্ষত থেকে রক্তধারা ঝরে ঘরের মেঝেটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।
ত্রিবেদী কিছুক্ষণ কথা কইতে পারলেন না, তারপর যখন কণ্ঠস্বর কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে এল, তখন ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, কী সাংঘাতিক কাণ্ড! কুকুরটাকে এমনভাবে খুন করে ঘরের মধ্যে ফেলে গেল কে?
সনাতনের মানসিক অবস্থাও তার প্রভুর চাইতে ভালো নয়, তবু সে অধ্যাপকের প্রশ্নের উত্তর দিতে সচেষ্ট হল, কুকুরটাকে কেউ ঘরের মধ্যে ফেলে যায়নি, বাবু। আমি ঘরে ঢুকে একটা কালো বেড়ালকে বসে থাকতে দেখনু। আমি জানতাম ওটা কুকুরের তাড়া খেয়ে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে; তাই ওটাকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দরজা খুলে যেই না চিঠির বাসকো দেখতে গিছি, অমনি এই হতভাগা কুকুর ঘরে ঢুকে বেড়ালটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেড়ালটা প্রথমে পালাতে চেয়েছিল, কিন্তু বন্ধ ঘরে পালাবে কোথায়? দরজাটা আমি খুলে দিয়েছিলাম বটে, কিন্ত সেই রাস্তা আগলে রেখেছিল কুকুরটা- ওদিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করলেই ঘ্যাক করে বেড়ালের ঘাড় কামড়ে কুকুরটা তাকে মেরে ফেলত। বেড়াল যখন দেখল পালিয়ে জান বাঁচানো যাবে না, তখন রুখে দাঁড়িয়ে কুকুরটাকে মারল এক থাপ্পড়। উরি বাস সে কী থাপ্পড়! কুকুরটা একবার কাতরে উঠেই এলিয়ে পড়ল আর বেড়ালটাও দরজা খোলা পেয়ে এক দৌড়ে হাওয়া!
বলিস কী সনাতন, ত্রিবেদী বিস্মিতকণ্ঠে বললেন, বেড়ালের থাবায় কুকুরের এমন অবস্থা হতে পারে? বেড়াল বাঘের মাসি বটে, কিন্তু তার থাবা তত বাঘের মতো ভয়ংকর নয়। চোয়াল থেকে গলা অবধি ছিঁড়ে রক্তের বান ডেকেছে, বেড়ালের থাবায় এমন রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটতে পারে না। তুই নিশ্চয় কুকুরটাকে মেরে বেড়ালের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস।
কী যে বলেন বাবু, সনাতন রেগে গেল, এমন রক্তারক্তি করতে গেলে তোয়াল কিংবা ভোজালির কোপ বসাতে হয় এ বাড়িতে তো সেসব কিছু নেই, থাকার মধ্যে আছে দুগাছা লাঠি। তাই দিয়ে কি এমনভাবে ঘাড়-গলা-চোয়াল পেঁচিয়ে কাটা যায়?
তাহলে কি বলছিস বেড়ালের থাবার নখ লেগে কুকুরটার এমন দুরবস্থা হয়েছে? ত্রিবেদীর কণ্ঠে অবিশ্বাস, এটা কি বিশ্বাস করার মতো কথা?
হঃ আমি যা দেখনু, তাই বলনু। বেড়ালটা কুচকুচে কালো। কালো বেড়ালের উপর ভূতের ভর হয়, জানেন? ওটাতেও নিচ্চয় ভূতে ভর করেছিল! নিজের চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতে পারতাম না যে, বেড়ালে এমনভাবে কুকুর মারতে পারে। ওঃ বাবু, আপনি তো দেখেননি– সে কী বিষম থাপ্পড়! কুকুরটা একবার ডেকে উঠেই চোখ উলটে শুয়ে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে মিত্যু! একে দুপুরবেলা, সামনে রয়েছে হানাবাড়ি, তার উপর বেড়ালের রং কুচকুচে কালো- একেবারে তেরোস্পর্শ যোগ। কথায় বলে ঠিক দুপুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা! নিয্যস ওই কালো বেড়ালটার উপর ভূতের ভর হয়েছিল। ভাগ্যি ভালো, কুকুরের উপর দিয়েই চোটচ গেছে- আমি যদি বেড়ালটাকে তাড়া দিতাম, তাহলে আমারও দশা হতো কুকুরটার মতো।
ওঃ! আবার হানাবাড়ি আর ভূত! ক্রোধে ফেটে পড়লেন ত্রিবেদী, আজকের দিনটাই খারাপ। কুকুর, বেড়াল আর তোর মতো ভূত নিয়ে সকালটা পণ্ড সরিয়ে নে এই কুকুরটাকে।
সজোরে কুকুরটাকে এক লাথি মারলেন ত্রিবেদী। পরক্ষণেই যা ঘটল তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি তার লাথি খেয়ে কুকুরের মৃতদেহটা খোলা দরজা দিয়ে তিরবেগে বেরিয়ে গেল এবং শুন্যপথে অনেকগুলো ডিগবাজি খেয়ে প্রায় তিরিশ হাত দূরে ছিটকে পড়ল! ভাগ্যিস পথে লোকজন ছিল না- নইলে, মৃত কুকুরের এমন বিদ্যুৎগতিতে শূন্য পথ ভ্রমণের কোনো বিশ্বাসযোণ্য কারণ দেখাতে পারতেন না অধ্যাপক মহাশয়!
এই কল্পনাতীত কাণ্ড দেখে সনাতনের চোখ কপালে উঠে গেল, সশব্দে শ্বাসগ্রহণ করে সে বলে উঠল, আরে ব্বাস! আপনার দেহে যে এমন ভীমের শক্তি তা তো জানতাম নি! এক লাথিতে অতবড়ো কুকুরটাকে আপনি বিশ হাত দূরে ছিটকে ফেইলে দিলেন।
য্যাঁ, তাড়াতাড়ি বিস্ময়ের চমক কাটিয়ে সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করলেন ত্রিবেদী, হ্যাঁ, বুঝেছি… ইয়ে হয়েছে সনাতন.. আমার গায়ের জোর একটু বেশি… তা ইয়ে হয়েছে, মানে শোন… তুই এবার একটু বিশ্রাম কর, দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নেওয়া ভালো… আবার দাঁড়িয়ে রইলি কেন?… যা, যা, শুয়ে পড়।
সনাতন অবাক হয়ে বাবুর দিকে তাকিয়ে ছিল তার নিতান্ত রোগা ও নিরীহ প্রকৃতির মনিবটি যে এমন প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী, তা সে চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। ত্রিবেদী আর একবার তাড়া দিতেই সে নিজের ঘরে বিছানাটির উদ্দেশ্যে প্রস্থান করল…
সনাতন চলে যেতেই অধ্যাপক ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদী সমস্ত ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে শুরু করলেন– এতক্ষণে তিনি বিস্ময়ের চমক কাটিয়ে প্রকৃতিস্থ হয়েছেন এবং তাঁর মস্তিষ্ক দস্তুরমতে সক্রিয় হয়ে চিন্তার জাল বুনতে শুরু করেছে–
জাপানি প্রফেসর তাগাসাকি বুবুসোনা আমাজন নদীর ধার থেকে সংগৃহীত যে গাছের পাতা আমাকে দেখিয়েছিলেন, এখানে বাগচী মশাই-এর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে হানাবাড়ির মধ্যে ঠিক সেইরকম পাতার গাছ আমি দেখতে পেয়েছিলাম। ওই পাতা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার জন্যই এই পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিলাম। কিন্তু লোকের সামনে ওই গাছের পাতা সংগ্রহ করতে গেলে লোকে হয়তো আমাকে পাগল ভাবত তার চেয়েও বিপদের কথা, কোনো চেনা লোক আমাকে পাতা ছিঁড়তে দেখলে ওই পাতা সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়ত, আর তার ফলে নানাধরনের অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি নাজেহাল হয়ে পড়তাম। তারপর ভেবে দেখলাম বেশি রাত্রে অথবা খুব ভোরে ওই পথে যখন লোক চলাচল বিশেষ থাকে না, সেই সময়ই কাজ হাসিল করতে হবে। আজ খুব সকালে গোবিন্দকে বাড়ির পথে রওনা করে দিয়ে আবার হানাবাড়িতে হানা দিয়ে আমি ওই পাতা অনেকগুলো জোগাড় করে এনেছি। পরে বুঝলাম বুবুসোনা যে-পাতা আমাকে দেখিয়েছিলেন, এগুলোর সঙ্গে বুবুসোনার নমুনার সাদৃশ্য থাকলেও হানাবাড়ির গাছের পাতা বুবুলোনার সংগৃহীত নমুনার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। বুবুলোনা তাঁর গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখেছেন কয়েকটা বিশেষ ধরনের বস্তু ওই পাতার সঙ্গে মিশিয়ে যে-নির্যাস তরি হয়, সেই মিশ্রিত তরল পদার্থ পান করলে কিছুক্ষণের জন্য অসীম শক্তির অধিকারী হওয়া যায়। হানাবাড়ি থেকে যে-পাতা আমি এনেছি, সেগুলো পিষে রস করে তার সঙ্গে বুবুলোনার ফরমুলার জিনিস মিশিয়ে পান করলে কোনো ফল পাওয়া যায় না কিন্তু ওই পাতা কাঁচা অবস্থায় খেলে শরীরে প্রচণ্ড শক্তির জোয়ার আসে। বেড়ালটা দুধের সঙ্গে নিশ্চয়ই কয়েকটা দুধমাখা পাতা খেয়ে ফেলেছিল, তাই তার থাবার আঘাতে কুকুরটার অমন দুর্দশা। আমিও খাওয়ার সময়ে অন্যমনস্ক হয়ে কয়েকটা পাতা চিবিয়ে ফেলেছিলাম– তাতেই আমার দেহে এমন অমানুষিক শক্তির সঞ্চার হল যে, অতবড় কুকুরটা আমার লাথিতে প্রায় বিশ-পঁচিশ হাত দুরে ছিটকে পড়ল!… প্রথমে আমিও হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু এখন আমি। সব রহস্যের সমাধান করে ফেলেছি। এখনও আমার সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড শক্তির জোয়ার অনুভব করছি। কিন্তু কতক্ষণ? আর কতক্ষণ স্থায়ী হবে আশ্চর্য-পাতার এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা?
আমাদরও প্রশ্ন আশ্চর্য-পাতার ক্ষমতা কতক্ষণ স্থায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর দেবে পরবর্তী কাহিনি– অধ্যাপক ত্রিবেদী ও বাঘা মুকুন্দ!