হীট দেম হোয়ার ইট হার্টস
০১.
ডার্ক ওয়ালেস আমার নাম। চল্লিশের কোঠায় বয়স, অবিবাহিত। আমায় দেখতে সুন্দর না কুৎসিত তা বলবনা। শুধু এটুকুই বলব যে আমায় দেখে বাচ্চারা মোটেই ভয় পায় না। ফ্লোরিডার প্যারাডাইস সিটির প্যারাডাইস অ্যাভিনিউতে আস্ত একটি বহুতল বাড়ি। নাম তার টুম্যান বিল্ডিং। এই বাড়িটির শেষ তলায় অ্যাকমে ডিটেকটিভ এজেন্সী নামে এক বেসরকারী গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের অফিস আছে। মোট কুড়িজন বেসরকারী গোয়েন্দা এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। আমি সেই কুড়িজনের একজন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে আমাদের এই বেসরকারী গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানটি ব্যয়বহুল হলেও কাজকর্মের দিক থেকে তা সেরা বললে খুব ভুল বলা হবে না। মাত্র দুবছর আগে কর্নেল ভিক্টর পার্নেল এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পার্নেল বুঝতে পেরেছিলেন যে আজই হোক বা কালই হোক প্যারাডাইস সিটির কোটিপতি বাসিন্দাদের অনেকেরই একটি ভাল বেসরকারী গোয়েন্দা, প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হবে। যেসব কাজে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সুনাম আছে তার মধ্যে আছে। বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকদের সমস্যা, ব্ল্যাকমেল, জুলুম করে টাকা আদায়, হোটেল প্রতারণা, স্বামী বা স্ত্রীর গতিবিধির ওপর নজর রাখা এবং খুন খারাপি বাদ দিয়ে তার কাছাকাছি কোন ধরণের অপরাধের বেসরকারী তদন্ত।
আমাদের প্রতিষ্ঠানের কুড়িজন গোয়েন্দা কর্মীর প্রায় সবাই আগে পুলিশ বা মিলিটারী পুলিশ বিভাগে কাজ করত। প্রত্যেকটি কেস তদন্তের ভার থাকে দুজন গোয়েন্দার ওপর। প্রতি দুজন গোয়েন্দার একটি অফিস আছে এবং খুব জরুরী বিষয় না হলে অন্যান্য সহযোগীরা কি করছে। তা কোনও গোয়েন্দা বা তার সহকর্মী ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে না। আমাদের কাজকর্ম খবরের কাগজের লোকেরা যাতে জানতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই এত সতর্কতার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গত দুবছরে মাত্র একবার গোয়েন্দা তদন্তের বিবরণ জানাজানি হয় এবং সে কেস নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করছিল সেই গোয়েন্দাদের ছাঁটাই করা হয়।
এই প্রতিষ্ঠানে গত আঠারো মাস যাবৎ চাকরী করার পর আমার পদোন্নতি হয়েছে। আমার একটি অফিসঘর আর একজন সহকর্মীও আছে। তার নাম বিল অ্যান্ডারসন। দেখতে বেঁটেখাটো হলেও তার গায়ে মোষের মত জোর আছে। বিল আগে ছিল সালেতে পুলিশের ডেপুটি শেরিফ। ঘটনাচক্রে নির্দিষ্ট বাচ্চা ছেলেকে খুঁজে বের করতে আমায় সার্লেতে যেতে হয়েছিল। আর সেখানেই বিলের সঙ্গে আলাপ হয়। সত্যি বলতে কি, সেবার বিলের সাহায্যেই কেসটার সমাধান সম্ভব হয়েছিল। কথায় কথায় বিল আমাকে বলে ফেলেছিল যে সে আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে চায়। কেসটা মিটে যাবার পর আমিও প্রতিদান হিসেবে কর্নেল পার্নেলকে বলে তাকে পুলিশের চাকরি ছাড়িয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এলাম।
এক কথায় বিলকে কাজের লোক বলা চলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ও একনাগাড়ে কাজ করে যেতে পারে, আমাদের লাইনে ওটাই দরকার। এখানে ওখানে গিয়ে পুরোনো কাগজ ঘেঁটে খবর যোগাড় করতে তার জুড়ি নেই। হাতে কাজ না থাকলে ও শহরের বিভিন্ন এলাকায়, রেস্তোরাঁয় নাইট ক্লাবে, নয়ত বন্দরের আশে পাশে ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় বস্তীগুলোয় ঘুরে নানা ধরনের • লোকের সঙ্গে ভাব জমায়। বিলের চেহারা দেখে সে সব এলাকার গুণ্ডা বদমায়েশরা ভয়ে ভয়ে ওকে এড়িয়ে যায় কারণ তারা জানে বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা এই লোকটার এক ঘুষিতে একটা হাতী পর্যন্ত কাৎ হয়ে পড়বে।
আমরা দুজনে জুলাই মাসের এক সকালে অফিসে কাজের আশায় বসে আছি। জানি যে কোন মুহূর্তে আমাদের ডাক পড়তে পারে। বাইরে বৃষ্টি, আবহাওয়া স্যাঁতসেঁতে। বিল তার বাড়ির জন্য একমনে চিঠি লিখছে আর আমি সুজির কথা ভাবছি।
সুজি লং পুরো নাম, ও বেলভিউ হোটেলে রিসেপশনিস্টের চাকরী করে। এক হতচ্ছাড়া বদমাশ ঐ হোটেলের কামরা ভাড়া নিয়ে ব্ল্যাকমেলিংকরত। তার ওপর নজর রাখতে গিয়ে সুজির সঙ্গে আমার আলাপ। সুজি আমায় লোকটার গতিবিধি সম্পর্কে কিছু খবর দিয়েছিল, সেই খবরের ভিত্তিতে তদন্ত করে আমি লোকটাকে হাতে নাতে পাকড়াও করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তারপর সে ব্যাটার পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।
সুজির চুলের রং বাদামী। আর জায়গায় জায়গায় লালের ছোপ, সেই চুলের ঢাল দু কখ ছাপিয়ে পিঠের অনেকটা ঢেকে যায়। তার চোখের মণি ধূসর আর অদ্ভুত জীবন্ত। ঠোঁটে সবসময় দুষ্টু হাসির ছোঁয়া লেগে আছে। সুজির বুক যেমন চওড়া কোমর তেমন সরু, উরুদুটি খুব বড় আর পা দুটি বেশ লম্বা। এক কথায় ও হল তেমনই একটি মেয়ে যাদের আমি স্বপ্নে দেখি। ও আমার মনের মত মেয়ে। প্রত্যেক বুধবার রাতে ওর ছুটি থাকে। সেদিন আমরা একসঙ্গে ঘুরতে বেরোই। একটা সস্তা অথচ ভাল রেস্তোরাঁয় সমুদ্রের মাছের নানারকম রান্না খাই। তারপর তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে তার ছোট্ট খাটে পাশাপাশি শুয়ে দুজনে রাত কাটাই। মাস তিনেক এভাবে কাটাবার পর আমরা টের পেলাম যে দুজনেই দুজনকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছি। আমি কয়েকবার ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম কিন্তু প্রত্যেকবারই ও মাথা ঝাঁকিয়ে সেই একরকম দুষ্ট হাসি হেসে জবাব দিয়েছে, না ডার্ক এখনও আমাদের বিয়ে করার সময় আসেনি।
আমি অবাক হয়ে বলেছি, কেন? ও একই রকম ভাবে উত্তর দিয়েছে, বিয়ে করতে আমিও চাই। কিন্তু আমি যে চাকরীটা করছি তার মাইনে পত্র খুব ভাল। এক্ষুনি তোমায় বিয়ে করলে আমার চাকরীটা ছেড়ে দিতে হবে। তোমার আর আমার কাজের সময় এক নয়। এখনও সময় আসেনি সোনা। আর কিছুদিন অপেক্ষা করো।
.
ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত খুশির স্বাদ পাচ্ছি এই ভেবে, যে আজ বুধবার রাতে সুজির সঙ্গে বেড়াতে যাবো, এমন সময় আমার টেবিলের পাশে ইন্টারকমটা বেজে উঠল।
সুইচটা নামিয়ে বললাম, ওয়ালেস বলছি।
উল্টো দিক থেকে কর্নেল পার্নেলের সেক্রেটারী গ্লেন্ডা কেরীর কর্কশ স্বর ভেসে এল, একবার আমার অফিসে আসুন, দরকার আছে।
কর্নেল বিশেষ জরুরী কাজের দায়িত্ব নিয়ে ওয়াশিংটনে দুদিন হল গেছেন। যাবার আগে প্লেন্ডাকে অফিসের চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। এখন গ্লেন্ডার নির্দেশমত আমাদের চলতে হচ্ছে।
দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই গ্নেভা বলল, বসুন, আপনার জন্য একটা কাজ এসেছে। প্লে দেখতে বেশ লম্বা চওড়া পরনে সাদা রাউজ কালো স্কার্ট। আমি চেয়ার টেনে বসতেই সে বলল, মিসেস হেনরী থরসেন টেলিফোন করেছিলেন। আজ দুপুর বারোটা নাগাদ ওঁর সঙ্গে দেখা করুন, উনি একটা পারিবারিক রহস্য সমাধানের জন্য একজন স্মার্ট বেসরকারী গোয়েন্দা চাইছেন। আপনি ওর স্বামী হেনরী খরসেনের নাম এর আগে শোনেন নি?
ঘাড় নেড়ে বললাম, না।
হেনরী থরসেন ছিলেন এক ধনী ব্যবসায়ী, মাত্র বছর খানেক আগে তিনি মারা গেছেন। এই নিন ওঁর ঠিকানা।
আমি প্লেন্ডার কামরা থেকে বেরিয়ে নিজের কামরায় ঢুকলাম। বিলের চিঠি লেখা এতক্ষণে শেষ হয়েছে। তাকে বললাম, বিল, হাতে কাজ এসেছে। আমায় দুপুর বারোটায় মিসেস হেনরী থরসেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তুমি এই ফাঁকে হেরাল্ড পত্রিকার অফিসে চলে যাও। ওদের মর্গ থেকে একবছর আগের পুরনো কাগজ ঘেঁটে হেনরী থরসেন আর তার পরিবার সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করো। বিকেল চারটে নাগাদ আমি অফিসে ফিরব। তখন দেখা হবে। খালি হাতে ফিরে এসো না যেন।
বিল তিড়িং করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে খুশি খুশি মুখ করে বেরিয়ে গেল। আমি জানি এ ধরনের কাজ ওর খুব পছন্দ। আর খালি হাতে ফিরে আসবে না।
শহরের বাইরে প্রচুর গাছ গাছালির মধ্যে দুএকর জমি নিয়ে মৃত হেনরী গুরসেনের প্রাসাদোপম দোতলা বাড়িটি। বিশাল লন আর গাছপালার মাঝখান দিয়ে গাড়ি যাতায়াতের রাস্তাটা গিয়ে বাড়ির বারান্দার সামনে শেষ হয়েছে। চারপাশে কোথাও টু শব্দটিও নেই। বারোটা বাজতে তখনো তিন মিনিট বাকি। কলিংবেল বাজাতেই ভেতরে মিষ্টি সুরে ঘণ্টা বেজে উঠল।
সদর দরজা মিনিট পাঁচেক বাদে খুলল, ভেতর থেকে এক দীর্ঘকায় কৃষ্ণাঙ্গ এসে দাঁড়াল। তার পরনে সাদা কোট কালো ট্রাউজার্স, গলায় কালো রংয়ের বো টাই। লোকটি বেশ বুড়ো, তার মাথায় সাদা চুল বেশীর ভাগ ঝরে গিয়ে জায়গায় জায়গায় টাক গজিয়েছে, বয়স সত্তরের নীচে নয়। তার রক্তাভ চোখ দেখে বুঝতে পারলাম যে সে একটু বেশীরকম মদ খায়।
অ্যাকমে ডিটেকটিভ এজেন্সী থেকে আসছি। আমার নাম ডার্ক ওয়ালেস। মিসেস থরসেন আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন। ওকে খবর দাও আমি এসেছি।
আমার সঙ্গে আসুন, বলে সে আমায় পথ দেখিয়ে একতলায় বিশাল ড্রইংরুমে নিয়ে এল। একটা বড় কৌচ দেখিয়ে বলল, আপনি বসুন, ম্যাডাম এক্ষুনি আসছেন। বলে ঘাড় হেলিয়ে ছোট্ট অভিবাদন জানিয়ে সে চলে গেল।
ড্রইংরুমের দেয়ালে অসংখ্য প্রাচীন তৈলচিত্র আর পুরনো আমলের সৌখিন আসবাব বাড়ির মালিকের অতুল বৈভব আর শিল্পরুচির পরিচয় বয়ে বেড়াচ্ছে। সেইসব দেখতে দেখতে একসময় বিরক্ত হয়ে পড়লাম, কিন্তু গৃহকত্রী মিসেস থরসেনের দেখা নেই।
পুরো পঁচিশ মিনিট বাদে তিনি এলেন। চটির হালকা শব্দে মুখ তুলে দেখি লম্বা পাতলা ছিপছিপে চেহারার এক মাঝবয়সী মহিলা পায়ে পায়ে ঘরের মাঝখানটিতে এসে দাঁড়ালেন। যৌবন চলে গেলেও নানারকম প্রসাধন ও সাজগোজের ভিতর দিয়ে তিনি তা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। মহিলার মুখখানা বেশ সুশ্রী, চোখের তীক্ষ্ণ চাউনি গায়ের চামড়া ছুঁড়ে ভেতরের সবকিছু পলকের মধ্যে দেখে নিতে পারে। মাথার চুলে পাক ধরেছে।
তাকে দেখে কৌচ ছেড়ে উঠে দাঁড়ানো সত্ত্বেও তার মুখে ভদ্রতা বা সৌজন্যের সামান্য হাসির রেশটুকুও ফুটল না। কঠোর চোখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একনজরে দেখে তিনি প্রশ্ন করলেন
আপনিই মিঃ ওয়ালেস?
বিনয়ের সুরে বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ।
বসুন। আমি অল্প দু-এক কথায় কাজ সেরে নেব।
বেশ কিছুটা দূরে বসলেন মিসেস থরসেন। তারপর বললেন, শুনেছি আপনারা ব্ল্যাকমেলিংয়ের কেস খুব ভাল করেন। কথাটা কি ঠিক?
একশোবার ঠিক মিসেস থরসেন। আপনি ঠিকই শুনেছেন, এ ব্যাপারে আমাদের জুড়ি নেই।
আমার মেয়েকে কেউ ব্ল্যাকমেল করছেমিঃ ওয়ালেস, সে লোকটিকে আমি খুঁজে বের করতে চাই।
আপনি যদি আমাদের ঠিক ঠিকমত সাহায্য করেন তাহলে এটা কোন সমস্যাই নয়। কিন্তু তার আগে জানতে চাই ব্ল্যাকমেলিংয়ের সন্দেহটা আপনার মনে দানা বাঁধল কেন?
আমার মেয়ে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রত্যেক মাসে দশহাজার ডলার তুলছে, গত দশমাস ধরে এটা চলছে। মিঃ অকল্যান্ড ব্যাপারটা নিয়ে খুব চিন্তিত। তিনিই কয়েকদিন আগে খবরটা আমায় দিলেন। বললেন মেয়ের ওপর যেন নজর রাখি।
মিঃ অকল্যান্ড কে?
আমাদের পরিবারের টাকাকড়ি প্যাসিফিক অ্যান্ড ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আছে। মিঃ অকল্যান্ড সেই ব্যাঙ্কের প্রধান অংশীদার। আমার স্বামীর সঙ্গে তার বহুদিনের বন্ধুত্ব ছিল, এখন উনি আমাদের পারিবারিক বন্ধুদের একজন। প্রয়োজনে নানারকম উপদেশ দিয়ে আমাদের সাহায্য করেন।
তার মানে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে আপনার মেয়ের নিজস্ব আয়ের পথ আছে, আর তার নামে ঐ ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্টও আছে?
দুর্ভাগ্যবশতঃ তাই। আমার স্বামী আমাদের একমাত্র মেয়ে ঐ অ্যাঞ্জেলাকে খুব ভালবাসতেন। তাকে একদিনের জন্য চোখের আড়াল করে তিনি থাকতে পারতেন না। মারা যাবার আগে তিনি ওর নামে মোটা টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখেছিলেন। সেই টাকার মাসিক সুদ পনেরো হাজার ডলার। ওর মত অল্প বয়সী একটি মেয়ের কাছে এটা কিন্তু প্রচুর টাকা।
ওর বয়স কত?
চব্বিশ।
আমার মতে একটি চব্বিশ বছরের মেয়ের প্রত্যেক মাসে এতগুলো টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া করা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু অ্যাঞ্জেলা নিজে স্বাভাবিক মেয়ে নয়, ও হল মিসল বেবী। তার অর্থ কি তা জানেন?
নিশ্চয়ই। গর্ভবতী মায়েদের কখনও কখনও হাম হয় এবং গর্ভের সন্তানের ওপর তার প্রভাব পড়ে। সেসব সন্তান ভবিষ্যতে কিছুটা অস্বাভাবিক হয়।
ঠিক তাই। অ্যাঞ্জেলার বেলাতে ঠিক তাই ঘটেছে। ফলে ও মানসিক দিক থেকে অস্বাভাবিক হয়েছে। ছোটবেলা থেকে দিনরাত অসুখে ভোগায় লেখাপড়াও সেরকম কিছুই হয়নি। তারই ভেতর বাড়িতে প্রাইভেট টিউটরের কাছে সামান্য কিছু পড়েছে। কুড়ি বছরের পর থেকে ওর মানসিক অবস্থার একটু উন্নতি হয়। আমার স্বামী ইতিমধ্যে মারা যান, আর তার আগে তিনি ওর জন্য ব্যাঙ্কে এক মোটা অঙ্কের সেভিংস অ্যাকাউন্ট খোলেন। প্রথম দুমাস এমনভাবে ছিল যেন মাসিক সুদের টাকার ওপর ওর কোন মোহ নেই। তারপরেই তৃতীয় মাস থেকে ও প্রত্যেক মাসের একটি নির্দিষ্ট তারিখে সুদের দশ হাজার ডলার অ্যাকাউন্ট থেকে তুলতে শুরু করে। মিঃ অকল্যান্ড আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, উনিই খবরটা আমায় জানান এবং নিজেও খুব উৎকণ্ঠার ভেতরে থাকেন। উনিই আমায় বললেন যে তার ধারণা অ্যাঞ্জেলাকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করছে। মিঃ অকল্যান্ড খুব খাঁটি লোক, আমি ওকে খুব শ্রদ্ধা করি।
আপনার স্বামী একবছর আগে মারা গিয়েছেন তাই না মিসেস থরসেন?
হ্যাঁ।
তারপর থেকেই আপনার মেয়ে প্রত্যেক মাসে দশহাজার ডলার করে ব্যাঙ্ক থেকে তুলছে, তাই না? গত দশমাস যাবৎ এটা ঘটছে, কেমন?
ঠিক তাই।
কিন্তু প্রথম দুমাস সে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলেনি, তাই না?
তুলেছিল তবে তার পরিমাণ খুবই কম। মিঃ অকল্যান্ডের মতে ও সে সময় মাত্র দু হাজার ডলার করে তুলেছিল নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে। ঐ টাকায় সে নিজের থাকা খাওয়া চালিয়ে আর যে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটি ওর দেখাশুনা করে তার বেতন দিয়েছে।
আপনার মেয়ে নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে থাকে?
গম্ভীর গলায় মিসেস থরসেন বললেন, না, আমার স্বামী ওর জন্যে একটা ছোট্ট বাড়ি বাংলো ধাচের বানিয়ে দিয়েছিলেন। এই এস্টেটের শেষ ভাগে গেলে সেই বাড়িটা চোখে পড়বে। কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটিকে নিয়ে সে ঐ বাড়িতেই থাকে। অ্যাঞ্জেলার ঘরসংসার দেখাশোনা থেকে শুরু করে রান্নাবান্ন ঘর সাফ করা সব ঐ মেয়েটিই করে। গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে আমার একবারও দেখা হয়নি। ও কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে যায় না। আমি যে সমাজে মেলামেশা করি সে ওই সমাজকে এড়িয়ে চলে। তাছাড়া ওর চেহারায় চটক বা আকর্ষণ কিছুই নেই।
ওর কি একটিও বান্ধবী নেই?
আমি জানি না। ও ওর নিজের মত জীবন কাটায় আমি আমার নিজের মত জীবন কাটাই।
কিন্তু ছেলে বন্ধু? ওর কি কোন ছেলে বন্ধুও নেই?
বিরক্তির সুরে তিনি বললেন, সম্ভবতঃ তাই। কোন সুন্দর স্মার্ট ছেলে আজেলার প্রতি আকৃষ্ট হবে এ আমি ভাবতেই পারি না। আমি আগেই বললাম, ওর চেহারায় কোন আকর্ষণ নেই।
কিন্তু ও ধনী মিসেস থরসেন। প্রচুর টাকা আছে এমন বহু লোক দেখতে আকর্ষণীয় নয় এমন অনেক মেয়ে নিয়ে দিন কাটায়।
একথাটা আমি ও মিঃ অকল্যান্ডও ভেবেছি। তেমন কেউ যদি সত্যিই অ্যাঞ্জেলার জীবনে এসে থাকে তবে আপনি তাকে খুঁজে বের করুন মিঃ ওয়ালেস। সেটাই হবে আপনার কাজ।
আমি সে কাজ নিশ্চয়ই করব মিসেস থরসেন। আপনার মেয়ের সম্পর্কে এখন কিছু খোঁজখবর আমার প্রয়োজন। ও কিভাবে সময় কাটায় সে সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা আছে কি? যেমন ধরুন ও কি সাঁতার কাটে, টেনিস খেলে, নাচতে যায়?
জানি না। আমি আগেই বললাম যে আমাদের দুজনের খুব কমই সাক্ষাৎ হয়।
মিসেস থরসেনের ওপর আমার একধরনের বিতৃষ্ণা আসতে লাগল। মা হিসেবে ওকে কখনই আদর্শ বলতে পারবো না।
অ্যাঞ্জেলা কি আপনার একমাত্র মেয়ে?
মিসেস থরসেন একটু আড়ষ্ট হলেন, ওর দুচোখ যেন জ্বলে উঠল।
আমার একটি ছেলে ছিল কিন্তু ওকে নিয়ে আলোচনা করার কোন দরকার নেই। ওর সম্পর্কে এটুকুই বলছি যে বেশ কিছুদিন আগে ও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি বা কোন খবর পাইনি। এতে আমি খুব খুশি। অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে যে সমস্যা, মনে হয় তার সঙ্গে ওর কোন সম্পর্ক নেই।
আমি মিঃ অকল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করতে চাই মিসেস থরসেন। আশাকরি তাতে আপনার কোন আপত্তি নেই?
একদম নয়, মিঃ অকল্যান্ডের ওপর আমার পুরো আস্থা আছে। সত্যিকথা বলতে কি, উনিই আমায় আপনার সাহায্য নেবার কথা বলেছিলেন। ওর সঙ্গে দেখা করুন।
আপনার মেয়েকেও আমার দেখা দরকার।
হা। আগামীকাল মাসের প্রথম তারিখ। ও নিশ্চয়ই ব্যাঙ্কে যাবে। মিঃ অকল্যান্ডকে বললেই উনি ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু আপনি আমার মেয়ের সঙ্গে আলাপ করতে যাবেন না। ওর সম্পর্কে যে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে এটা অ্যাঞ্জেলাকে জানানো আমার ইচ্ছা নয়। আপনার এজেন্সী নিশ্চয়ই সবরকম গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে?
আপনি সে সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারেন মিসেস থরসেন। আজ বিকেলেই আমি মিঃ অকল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করব। দেবার মত কোনও খবর পেলে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
আমার এটুকু ভরসা আছে যে এ ব্যাপারে খুব বেশী সময় লাগবে না। তবে আপনার চার্জ বড্ড বেশি।
আমাদের হাতে অনেক কাজ জমে আছে মিসেস থরসেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন যত তাড়াতাড়ি পারি আমরা আপনাকে কিছু খবর দেওয়ার চেষ্টা করব।
সেই ভাল, তবে খবর দেবার আগে দয়া করে টেলিফোনে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেবেন কারণ আমি খুব ব্যস্ত জীবন যাপন করি। বলেই মিসেস থরসেন দরজার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, আপনি তাহলে আজ আসুন, দরজাটা নিজেই খুলে নিন। আমার বাটলার স্মেডলি যখন তখন মদ খেয়ে নেশায় চুর হয়ে থাকে তাই আমি ওকে সবসময় ডাকি না।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনি কি ওকে ছাড়িয়ে দেবার কথা ভাবছেন মিসেস থরসেন?
ভুরুদুটো তুলে ঠাণ্ডা ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্মেডলি গত ত্রিশ বছর যাবৎ আমাদের পরিবারে আছে। আমার সব অভ্যেস ওর জানা আছে তাছাড়া ও রুপোর বাসনগুলোর যত্ন নিতে জানে। ওর অবস্থা যতদিন না খারাপ হয় ততদিন আমি ওকে বহাল রাখছি। বিদায় মিঃ ওয়ালেস।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি তোড়ে বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টির ভেতর দিয়েই দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম।
একটা হামবার্গার দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। তারপর বিকেল তিনটে নাগাদ গাড়ি চালিয়ে প্যাসিফিক অ্যান্ড ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে হাজির হলাম।
ব্যাঙ্কের ভেতরের চেহারা দেখে বোঝা যায় যে এর মালিক সত্যিই ধনবান লোক। দুজন সিকিউরিটি গার্ড সবসময় ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে, তাদের চোখে সতর্ক দৃষ্টি। টেলার কাউন্টারের সামনে বুলেট প্রুফ কাঁচ। ভেতরে অসংখ্য ফুলদানিতে থরে থরে টাটকা মরশুমি ফুল সাজানো। মেঝেতে পুরু কার্পেট। এয়ার কণ্ডিশনারের মৃদু শব্দ।
আমি গার্ড দুজনের সতর্ক চোখ পেরিয়ে একটা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। টেবিলের ওপর পতাকার মত একফালি কাপড়ে লেখা অভ্যর্থনা। টেবিলের সামনে এক বয়স্কা মহিলা বসে, যার চোখ দেখে বোঝা যায় লোকের গা কে বলে দিতে পারেন সে ধনী কিনা, সে শিক্ষাই তাকে দেওয়া হয়েছে যদিও আমার গা থেকে তেমন কোন টাকাপয়সার গন্ধ বেরোচ্ছিল না।
বলুন?
মিঃ অকল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
আপনার সঙ্গে কি ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
কথা না বাড়িয়ে ওয়ালেট থেকে আমার একটা কার্ড বের করে তার সামনে রেখে বললাম, এটা দেখালেই উনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
ভদ্রমহিলা খুঁটিয়ে কার্ডখানা দেখে বললেন, মিঃ অকল্যান্ড এখন ব্যস্ত আছেন। আপনি কি দরকারে এসেছেন?
আপনার যখন এতই কৌতূহল মিসেস থরসেনকে টেলিফোন করে আমার কথা বলুন। তাহলেই উনি আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। তবে অন্যদিকে উনি এমন ব্যবস্থা নিতে পারেন যে হয়ত ভবিষ্যতে আপনার এখানে চাকরী করা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। এক গাল হেসে বললাম, চুপ করে বসে রইলেন কেন? একটা সুযোগ নিয়ে দেখুন না, ওকে টেলিফোন করুন।
আসলে মিসেস থরসেনের নাম শুনেই ওর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে। আমার কার্ডখানা তুলে নিয়ে হেঁটে মিঃ অকল্যান্ডের চেম্বারে গিয়ে ঢুকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, মিঃ অকল্যান্ড আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। আপনার ডানদিকের প্রথম দরজা, চলে যান।
ধন্যবাদ বলে ডানদিকের প্রথম দরজায় টোকা মেরে ভেতরে ঢুকলাম। সামনে বিশাল টেবিল, তার ওপাশে বসে হোরেস অকল্যান্ড। ভদ্রলোক বেঁটে, মোটা, টাকমাথা এবং ভয়ঙ্কর দেখতে। কিন্তু তার সতর্ক বাদামী চোখের চাউনি মোটেই ভয়ঙ্কর নয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রথমেই তিনি কামরার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ইঙ্গিতে আমাকে বসতে বললেন।
মিসেস থরসেন আমায় টেলিফোন করে আপনার কথা বলেছেন, মিঃ ওয়ালেস। লেসার রশ্মির মত অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বললেন, উনি বললেন আপনার কয়েকটা প্রশ্ন আছে।
চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, মিঃ অকল্যান্ড, মেয়েটি সম্পর্কে আপনি কি আপনার অভিমত জানাবেন? ওর মা বলছেন যে ও মানসিক দিক থেকে সুস্থ নয় বরং পিছিয়ে পড়া বললেই ঠিক হবে। আপনি কি মনে করেন?
সত্যি বলতে কি, আমি তা ঠিক জানি না। মেয়েটিকে দেখে তো খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়, আর তাও অল্প কয়েক মিনিটের জন্য যখন ও টাকা তোলে। ওর পোশাকও বড্ড অদ্ভুত কিন্তু এখানকার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা সবাই ওরকম অদ্ভুত পোশাক পরে। নিজস্ব মতামত দিতে আমি ঘাবড়াই না।
শুনেছি ওর একটা নিজস্ব অ্যাকাউন্ট আছে যেখান থেকে প্রতিমাসে সুদ বাবদ পনেরো হাজার ডলার আয় হয়। ও যদি মারা যায় তখন ঐ টাকার কি হবে?
মিঃ অকল্যান্ড ভুরু কুঁচকে, মিঃ ওয়ালেস, ওর বয়স মাত্র চব্বিশ বছর।
আপনার বয়স যাই হোক না কেন, আপনি দুর্ঘটনায় যে কোন সময় মরতে পারেন এটা তো ঠিক?
ও মারা গেলে ওর অ্যাকাউন্টটা বন্ধ হয়ে যাবে, টাকার মালিক হবে তখন ওদের এস্টেট।
টাকার পরিমাণটা কত?
মিঃ থরসেন ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন। ওর কত টাকা আছে তা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।
মিসেস থরসেন ওর স্বামীর টাকার উত্তরাধিকারিনী হয়েছেন। ওঁর মেয়ে মারা গেলে উনি তো আরও অনেক টাকার মালিক হবেন, তাই না?
হ্যাঁ, সম্পত্তির অন্য কোনও উত্তরাধিকারী নেই।
ওঁর একটি ছেলে আছে।
হ্যাঁ, টেরেন্স থরসেন। দুবছর আগে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর ওকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এস্টেটের টাকার ওপর ওর কোন দাবী নেই।
তাহলে আর কেউ নেই?
মিঃ অকল্যান্ড আমার প্রশ্ন শুনে এমনভাবে নড়েচড়ে বসলেন বুঝলাম তিনি বিরক্ত হচ্ছেন।
ভাগীদার অনেক আছে। মিঃ থরসেন উইলে তার বাটলার স্মেডলির নামেও বেশ কিছু টাকা রেখেছেন। মিসেস থরসেন মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ হাজার ডলার দেওয়া হবে।
মিঃ অকল্যান্ড, আপনি কি মনে করেন যে প্রত্যেক মাসে মেয়েটি যে এভাবে দশহাজার ডলার তুলছে তা শুধু কোনও ব্ল্যাকমেলারকে চাপা দেবার জন্য।
মিঃ ওয়ালেস, গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমি একটানা ব্যাঙ্কের কাজ করে যাচ্ছি। মিস থরসেনের বয়স মাত্র চব্বিশ আর আমার মনে হয় ও সব দিক থেকেই পুরোপুরি স্বাভাবিক। ওর টাকা নিয়ে যা খুশি করার অধিকার ওর আছে। কিন্তু হেনরী থরসেন আর আমি দুজনেই দুজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। আমরা পরস্পরকে খুবই বিশ্বাস করতাম। আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম যে ওর কিছু ঘটলে অ্যাঞ্জেলার হাতে যখন এত টাকা আসবে তখন আমি যেন তার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখি। মিসেস থরসেন নিজেও আমার একজন বন্ধু এবং আর্থিক ব্যাপারে তিনি আমার উপদেশ মেনেই চলেন। অন্যান্য নানারকম সমস্যায় আমি তার পাশে দাঁড়াই, এজন্য উনি আমায় খুব বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই বিশেষ পরিস্থিতিতে অ্যাঞ্জেলার টাকা, তোমার কথা আমি ওকে বলতাম না। আমি পুরো দশটি মাস লক্ষ্য করছি। সুতরাং একজন পারিবারিক বন্ধু হিসেবেই মিসেস থরসেনকে সতর্ক করেছি। ব্ল্যাকমেলের সম্ভাবনাটা আমারই মাথায় এসেছিল, তাই ওকে তদন্ত করতে বলেছিলাম যাতে নিশ্চিত হওয়া যায়।
আপনার মনোভাব আমি বুঝতে পেরেছি মিঃ অকল্যান্ড।
আপনাকে যা বললাম তা যেন পুরোপুরি গোপন থাকে। বুঝতে পেরেছেন?
নিশ্চয়ই মিঃ অকল্যান্ড। এবার মিস থরসেনকে আমি একটু নিজের চোখে দেখতে চাই। ওর মা বলে দিয়েছেন আমি যেন তার মেয়ের সঙ্গে কোনমতেই আলাপ না করি। কিভাবে ওর দেখা পাব?
ওর দেখা পাওয়া খুবই সহজ। আগামীকাল সকালে ও এখানে টাকা তুলতে আসবে। আমি ব্যবস্থা করে রাখব যাতে ভেতরে ঢোকার আর বেরোবার সময় আপনি ওকে ভাল করে দেখতে পারেন। বাকিটা আপনার ওপর।
খুব ভাল কথা, আমি তাহলে কখন আসব?
ও সকাল দশটায় আসে। আপনি ঠিক পৌনে দশটায় চলে আসুন। এখানে লবিতে বসে অপেক্ষা করুন। আমি মিস বার্চকে বলে রাখছি যাতে ও ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দেয়।
কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে তার টেবিলের ওপর রাখা ইন্টারকমে শব্দ হল, হ্যাঁ মিস বার্চ। ঠিক তিন মিনিটের মধ্যে রিসিভার নামিয়ে রেখে আমায় বললেন, মাপ করবেন মিঃ ওয়ালেস হাতে আর সময় নেই।
সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে করমর্দন করে বললাম, আমি আজ তাহলে যাচ্ছি মিঃ অকল্যান্ড। আগামীকাল ঠিক পৌনে দশটায় আসব।
অফিসে ফিরে গ্লেন্ডা কেরীকে রিপোর্ট দিতে গিয়ে বললাম, মিসেস খরসেন এই ঝামেলাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিয়ে ফেলতে চান। উনি বলছেন, আমাদের চার্জ নাকি খুব বেশী।
গ্লেন্ডা শুকনো হেসে, সবাই ঐ একই কথা বলে তারপরেও সবাই আমাদের কাছেই আসে। বলুন, এরপর কি করবেন?
ব্যাঙ্কে যাব, অ্যাঞ্জেলার পিছু নেব। দেখব ও কার হাতে টাকাটা দেয়। তারপর যদি বরাত ভাল থাকে তো একটা ফটো নেব। আমি বিলকে থরসেন পরিবারের ইতিহাস বের করার কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।
ঠিক আছে, কাজ চালিয়ে যান।
আমি আমার কামরায় ফিরে দেখি বিল তার রিপোর্ট খুব মনোযোগ দিয়ে টাইপ করছে। মিসেস থরসেন আর হোরেস অকল্যান্ডের সঙ্গে যা কথাবার্তা হয়েছে তার সবটুকুই তাকে বললাম।
একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছেনা যে মিসেস থরসেন। যিনি তার মেয়ে কি করে বেড়াচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র উৎসাহী নন, সে কেন মোটা টাকা খরচ করে জানতে চাইছেন কেউ অ্যাঞ্জেলাকে ব্ল্যাকমেল করছে কিনা। কেন? এই প্রশ্নটার উত্তর আমার জানা দরকার। আর এখানেই আমি একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।
বিল পাল্টা প্রশ্ন করল, তাতে তোমার বা আমার কি এসে যায়? মেয়েটাকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে কিনা জানার জন্য আমাদের ভাড়া করা হচ্ছে। এর পেছনে মিসেস থরসেনের যাই মোটিভ থাকুক না কেন তা জেনে আমাদের কোন দরকার নেই।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এটা একটা ইন্টারেস্টিং কেস। বিল আমি কাল ব্যাঙ্কে গিয়ে অ্যাঞ্জেলাকে বের করব। তুমি বাইরে গাড়িতে বসে থাকবে। ইঞ্জিন চালু রাখবে। আমি ওর পেছনে পেছনে বেরিয়ে এসে ইশারা করলেই তুমি স্টার্ট দেবে। আমিও আমার গাড়ি নিয়ে ওর পিছু নেব। তুমি আগে থাকবে, মাঝখানে থাকবে অ্যাঞ্জেলা, আমি তার পেছনে থাকব। এভাবে ফলো করলে ও আমাদের ব্ল্যাকমেলারের কাছে ঠিক নিয়ে যেতে পারবে। এবার বল হেনরী থরসেন সম্পর্কে কতটুকু জানতে পেরেছ?
হেনরী থরসেন শেয়ারের দালালী করে প্রচুর টাকা রোজগার করেছিলেন। থরসেন অ্যান্ড চারটেরিস কোম্পানীর তিনি ছিলেন সিনিয়ার পার্টনার। নিউইয়র্কে ওদের একটা শাখা অফিস থাকলেও ব্যবসার সবকাজকর্ম এখানেই হয়। থরসেনের হাতে যাদুর ছোঁয়া ছিল। কোন্ শেয়ারের দর কেমন উঠবে বা পড়বে তা তিনি আগে থেকে টের পেয়ে যেতেন। শুধু মক্কেলদের জন্যে নয়, তিনি নিজের জন্যও প্রচুর টাকার শেয়ার কিনেছিলেন।
উনি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ক্যাথলীন লিভিংস্টোনকে বিয়ে করেন। ক্যাথলীনের বাবা জো লিভিংস্টোন পেট্রলের খোঁজে তিনটে জায়গায় খোঁড়াখুড়ি করছিলেন। তাতে তিনি খুব লাভবান হননি। তাই থরসেনের মত পয়সাওয়ালা লোককে বিয়ে করে ক্যাথলীন সৌভাগ্যবতী হতে পেরেছেন। তার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্মায়। ছেলের নাম টেরেন্স, মেয়ের নাম অ্যাঞ্জেলা। পুরনো কাগজে তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু উল্লেখ না থাকলেও মিসেস থরসেন কিভাবে তার স্বামীর টাকা দুহাতে উড়িয়েছে তার বিবরণ আছে। উনি এখানকার সেরা সোসাইটি লেডীজের একজন। সভাসমিতি আর পার্টিতে ওর চারপাশে সবসময় নানা ধরনের লোক ভীড় করে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই, কোনমতে ওর কৃপাদৃষ্টি পাওয়া।
মারা যাবার আগে থরসেন দশবছর যাবৎ হার্টের অসুখে ভুগছিলেন। প্রচণ্ড মানসিক চাপের ভেতর ওকে অর্থ রোজগার করতে হয়েছে। গতবছর উনি নিজের বাড়ির লাইব্রেরীতে বসেছিলেন। সেই সময় হঠাৎ ওর হার্ট অ্যাটাক হয়। সেবারের ধাক্কাটা উনি আর সামলাতে পারেন নি, লাইব্রেরীতেই উনি মারা যান। পরে সবাই ওকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পায়। সন্দেহের কোন অবকাশ ছিল না। তাই ডাক্তারও ডেথ সার্টিফিকেট দিতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মৃতদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছিল। করোনার ডাঃ হীবার্ট ডসন মৃতদেহ পরীক্ষা করতে গিয়ে তার রগের কাছে একটা ছোট্ট ক্ষত দেখতে পেয়েছিলেন আর সেটাই তার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছিলো। পুলিশ বাড়ির লোকেদের জেরা করেছিল, জেরার উত্তরে বহুদিনের পুরোনো বাটলার জোশ স্মেডলি বলেছিল যে সে লাইব্রেরী ঘরে ভারী কোন জিনিস পড়ে যাবার শব্দ শুনতে পেয়েছিল, ছুটে এসে দেখেছিল তার মনিব টেবিলের ধার ঘেঁষে মেঝেয় পড়ে আছে। ওদের পারিবারিক চিকিৎসকের মতে মিঃ থরসেন নিশ্চয়ই বুকের ব্যথায় ছটফট করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। পড়ে যাবার সময় টেবিলের কোণায় তার মাথাটা আছড়ে পড়েছিল আর তখনই তার রগে ক্ষত হয়েছিল। করোনার ডঃ ডসন এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন। এরপর মিসেস থরসেন তাঁর স্বামীর সব বিষয় সম্পত্তির মালিক হন। তার উইল অনুযায়ী অ্যাঞ্জেলার অ্যাকাউন্টে প্রচুর টাকা জমা পড়ে যা থেকে সে প্রত্যেক মাসের সুদ পায় পনেরো হাজার ডলার কিন্তু নিজের ছেলে টেরেন্সকে তিনি একপয়সাও দেননি। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন।
বাঃ তুমি খুব ভাল কাজ করেছে বিল। অ্যাঞ্জেলাকে কেউ ব্ল্যাকমেল করছে কিনা সেটা বের করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন ব্যাপারে কৌতূহলী হওয়া ঠিক নয়। তোমার এ সিদ্ধান্তটা আমি মেনে নিচ্ছি। অন্যদিকে থরসেন পরিবারের ইতিহাস আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওর ছেলে টেরেন্সের কথা বার বার আমার মনে আসছে। সেই বাটলার স্মেডলিকেও আমি মন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারছি না। বেশ তাহলে কাজে লেগে যাও। থরসেন পরিবারের একটা ফাইল তৈরী করো। কর্নেল পার্নেলের স্বভাব তত জানাই আছে। ফিরে এসেই কিন্তু উনি জানতে চাইবেন আমরা কতটুকু এগিয়েছি, কি কি খবর যোগাড় করেছি।
আমিও তাই ভাবছি, বলে বিল টাইপ রাইটার টেনে নিল।
অফিসের কাজ সারতে সাড়ে ছটা বাজল। সুজি লংয়ের জন্য মনটা আনচান করতে শুরু করেছে। এই সময় সমুদ্রের ধারে আমাদের সেই পুরোনো রেস্তোরাঁটায় আমরা দেখা করি, তারপর সমুদ্রের বড় কাঁকড়া আর চিংড়িমাছের সুস্বাদু রান্না খেয়ে রাতের ডিনার শেষ করি। টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বললাম, বিল, আজ রাতে তুমি কি করছ?
হতাশার সুরে বিল বলল, কি আর করব। ঠেকে ফিরে রাত্রের খাবার জন্য চটপট যাহোক কিছু বানিয়ে নেব তারপর যতক্ষণ না ঘুম আসে ততক্ষণ টিভি দেখব।
ওভাবে বাঁচা যায় না বিল। আমার মত তুমিও একটা দেখতে ভাল গোছের মেয়ে জুটিয়ে নাও।
যে টাকাটা জমাচ্ছি তার কথা একবার ভেবেছো? তোমার পথে এগোলে দুদিনে সব উড়ে যাবে। তার চেয়ে এই বেশ আছি। চলি ডার্ক, আবার দেখা হবে। বলে সে বেরিয়ে গেল।
সমুদ্রের ধারে বস্তী এলাকায় একখানা দু কামরার অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে আমি থাকি। গাড়ি পার্ক করে নড়বড়ে লিফটে চেপে চারতলা পেরিয়ে আমার ডেরায় পৌঁছলাম। প্যারাডাইস সিটিতে আসবার পর এই আস্তানাটা খুব সস্তায় পেয়েছিলাম। ভেতরে দেয়ালের গায়ে বাদামী বার্নিশ। আসবাবপত্র খুবই পুরানো আর ব্যবহারের অনুপযোগী। খাটে চাপলেই ক্যাচকোচ শব্দ হয়। আর শোবার পর পিঠে এমন ব্যথা হয় যে বোঝা যায় তোষক অক্ষত নেই। আসলে এখানে বেশিদিন থাকবার ইচ্ছে ছিল না বলেই কম ভাড়ায় তখন সুখের স্বর্গটি আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু সুজি এখানে প্রথমদিন এসে বেশ ঘাবড়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, এটা আবার অ্যাপার্টমেন্ট নাকি? এতো শেয়ালের গর্ত। উঁহু এমন গর্তে তোমার থাকা চলবেনা। আমি বললাম এখানকার ভাড়া খুব কম। শুনে সে বলল, ঠিক আছে, এবার দেখো আমি কি করি।
আমি এক সপ্তাহ বিলের ছোট্ট কামরায় রইলাম, আর সুজি তার বেলভিউ হোটেলের দুজন রাজমিস্ত্রীকে এনে এখানকার দেওয়ালগুলো হোয়াইট ওয়াশ করিয়ে দিল। সেই সঙ্গে হোটেলের কিছু বাতিল আসবাবপত্র জলের দরে কিনে আমার ডেরায় এনে তুলল। সে আস্তানার চেহারাই বদলে দিল। সেদিন আমার কি ভাল যে লাগছিল বলে বোঝাতে পারব না।
দরজা দিয়ে ঢুকেই সামনের ফাঁকা দেয়ালে আমি একটা বুক সেলফ রাখব ভেবেছিলাম। কিন্তু সুজি বলল একটা বড় সাইজের ছবি লাগালে ঘরের ছিরি ফিরবে। শেষে বুঝলাম যে ওর মতই টিকবে।
কিন্তু আজ ঘরে ঢোকার পর সামনের দেয়ালটায় দেখলাম কে যেন বড় কালো অক্ষরে লিখে রেখেছে
অ্যাঞ্জিওকে ঘাঁটালে মুশকিলে পড়বে…
লোকটা নিশ্চয়ই দরজার পেছনে ঘাপটি মেরে ছিল। সে খুবই চটপটে এবং ওস্তাদ লোক তাতে সন্দেহ নেই। কারণ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই পেছন থেকে সে ভারী কোন জিনিস দিয়ে আমার মাথায় এক ঘা মারল। সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়লাম।