১. টেলিভিশনটা কিনে

॥ ১ ॥

‘টেলিভিশনটা কিনে কোনো লাভ হল না মশাই,’ বললেন লালমোহনবাবু। ‘দেখার মতো কিস্যু থাকে না। রামায়ণ মহাভারত দুটোই দেখতে চেষ্টা করেছি। পাঁচ মিনিটের বেশি স্ট্যান্ড করা যায় না।’

‘আপনি যে খেলাধুলোয় ইন্টারেস্টেড নন,’ বলল ফেলুদা। ‘তা হলে দেখতেন মাঝে মাঝে বেশ ভালো প্রোগ্রাম থাকে। টেনিস, ক্রিকেট, ফুটবল—কোনটাই বাদ নেই। যেমন দেশের খেলা, তেমনি বিদেশের খেলা।’

‘তবে ওরা আমার একটা গল্প থেকে টি ভি সিরিয়াল করতে চাচ্ছে।’

‘বাঃ, এ ত ভালো খবর।’

‘ভালো মানে? প্রখর রুদ্র করবে এমন কোনো অ্যাকটর আছে বাংলাদেশে? অথচ ও দেশে দেখুন—সুপারম্যানের জন্য পর্যন্ত লোক পেয়ে গেল। মনে হয় একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে।’

আমাদের পাড়ায় কোনো বড় পুজো নেই। তবে একটু দূরেই আছে, সেখান থেকে মাঝে মাঝে লাউডস্পীকারে হিন্দি গান ভেসে আসছে। লালমোহনবাবু তার সঙ্গে গলা মেলাতে চেষ্টা করে পারছেন না। গানটা ভদ্রলোকের একেবারেই আসে না, যদিও বলেন ওঁর দাদামশাই নাকি খান ত্রিশেক ওস্তাদী গান রেকর্ড করেছিলেন।

চা এক প্রস্থ হয়ে গেছে, আরেকবার হবে কি না ভাবছি এমন সময় বাইরে গাড়ি থামার শব্দ পেলাম। আর তার পরেই ডোরবেল।

দরজা খুলে দেখি এক লম্বা চওড়া ধবধবে ফরসা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।

‘এটা কি প্রদোষ মিত্রের বাড়ি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ—আসুন ভিতরে।’ ফেলুদা সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।

ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। ধুতি, পাঞ্জাবি আর কাঁধে সাদা চাদর। পায়ে সাদা পাম্প শু। আভিজাত্য ফুটে বেরোচ্ছে সমস্ত শরীর থেকে।

‘বসুন,’ বলল ফেলুদা।

ভদ্রলোক একটা সোফায় বসে লালমোহনবাবুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন। ‘ইনি আমার বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলি,’ বলল ফেলুদা। লালমোহনবাবু একটা নমস্কার করলেন, কিন্তু ভদ্রলোক যেন সেটা দেখেও দেখলেন না। পায়ের উপর পা তুলে গিলে করা ধুতির কোঁচাটাকে সযত্নে কোলের উপর রেখে বললেন, ‘আপনার কথা আমায় বলে পাইকপাড়ার সাধন চক্রবর্তী।’

‘ওঁর একটা তদন্তের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম,’ বলল ফেলুদা।

‘ভদ্রলোক আপনার সুখ্যাতি করলেন, তবে ডিটেল কিছু দেননি। আপনি কদ্দিন ধরে করছেন এ কাজ?’

‘বছর দশেক হল।’

‘সিসটেমটা দিশি না বিলিতি?’

‘যে কেসে যেমনটা দরকার হয় আর কি।’

‘আই সী…’

‘আপনার সমস্যাটা কী সেটা যদি বলেন…’

‘সেটাকে সমস্যা বলা চলে কি না জানি না। সেটা আপনিই বিচার করবেন।’

ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা খাম বার করলেন। তারপর তার থেকে সযত্নে একটা ছবি বার করে ফেলুদাকে দিলেন। আমি ফেলুদার কাঁধের উপর দিয়ে দেখলাম ফিকে হয়ে যাওয়া পুরোন একটা ফোটোগ্রাফ, তাতে রয়েছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পরস্পরের কাঁধে হাত দিয়ে দু’জন প্যান্ট-সার্ট পরা ছেলে। তাদের বয়স যোলো-সতেরোর বেশি নয়।

এঁর মধ্যে কাউকে চিনছেন কি?’ ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।

‘বাঁ দিকের জন ত আপনি,’ বলল ফেলুদা।

‘হ্যাঁ, ওই একজনকেই আমিও চিনতে পারছি।

‘অন্যটি আপনার বন্ধু অবশ্যই।’

‘দেখে ত তাই মনে হয়, তবে ওর পরিচয় ধরতে পারিনি। ছবিটা আমি সম্প্রতি পেয়েছি। একটা দেরাজের কাগজপত্রের তলায় ছিল। আপনাকে আমি একটিমাত্র কাজ দিতে এসেছি। ভেবে দেখুন সেটা নেবেন কি না।’

‘কী কাজ?’

‘আমার সঙ্গে ওই ছেলেটি কে সেটা আমার জানা চাই। এর পরিচয় আপনাকে অনুসন্ধান করে উদঘাটন করতে হবে। ও কোথায় আছে, কী করে, আমার সঙ্গে পরিচয় হল কবে, কী করে—সে সব আমার জানা চাই। সেটা করলেই আপনার কাজ শেষ। এর জন্য আপনার পুরো পারিশ্রমিক আমি দেব।’

‘আমার আগে জানা দরকার আপনি নিজে কোনো খোঁজ করেছেন কি না।’

‘ক্লাবে আমার স্কুল-কলেজের কয়েকজন সহপাঠী আছে, আমি তাদের দেখিয়েছি। তারা কেউ চিনতে পারেনি। আপনি লক্ষ করবেন ছেলেটি বাঙালী কি না তাও বোঝা শক্ত।’

‘চুলটা ত কালো, তবে চোখ দুটো যেন একটু কটা। আপনার সাহেব বন্ধু ছিল কখনো?’

‘আমি ইংল্যান্ডে চার বছর স্কুলে আর এক বছর কলেজে পড়ি। বাবা ওখানে ডাক্তারি করতে গিয়েছিলেন। তারপর অবিশ্যি আমরা সবাই দেশে ফিরে আসি। ফিরে আসার আগে ইংল্যান্ডের কোনো কথা আমার মনে নেই, কারণ ওখানে থাকতে বাইসিক্‌ল থেকে পড়ে গিয়ে আমার স্কাল ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। তার ফলে পাঁচ-সাত বছরের স্মৃতি আমার মন থেকে লোপ পেয়ে গেছে।’

‘কোন স্কুল আর কলেজে পড়েছিলেন সেটা মনে নেই?’

‘বাবা বলেছিলেন। সে-ও অনেক বছর আগে। কলেজ বোধ হয় কেমব্রিজ। স্কুলের নাম মনে নেই।’

‘স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো ওষুধ-টষুধ খাচ্ছেন না?’

‘অ্যালোপ্যাথিক খেয়েছি। তাতে কোনো কাজ হয়নি। এখন একটা কবিরাজী ওষুধ খাচ্ছি।’

‘ইংল্যান্ড থেকে ফিরে কী হয়?’

‘সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হই। বাবাই সব ব্যবস্থা করে দেন, কারণ তখনও আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হইনি।’

‘সেটা কোন বছর?’

‘ফিফ্‌টি টু। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই।’

‘হুঁ…।’

ফেলুদা ছবিটা হাতে নিয়ে মিনিটখানেক ভাবল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘আপনার কি মনে হয় এই ছেলের সঙ্গে কোনো একটা বিশেষ ঘটনা জড়িয়ে আছে?’

‘সেরকম মনে হয়েছে। এক-এক সময় আবছা আবছা স্মৃতি ফিরে আসে, আর তখন যেন একে দেখতে পাই। কিন্তু এর পরিচয় অজানাই থেকে যায়। অত্যন্ত অস্বস্তিকর ব্যাপার। যার সঙ্গে এত বন্ধুত্ব ছিল সে কে, সে এখন কোথায় আছে, কী করে, আমাকে মনে রেখেছে কি না, এ সব জানার জন্য প্রবল কৌতূহল হয়। কাজটা সহজ না বুঝতে পারছি, কিন্তু সেই কারণেই হয়ত আপনি ইন্টারেস্টেড হতে পারেন।’

‘ঠিক আছে। কাজটা আমি নিচ্ছি। তবে এতে কত সময় লাগবে তা আমি বলতে পারছি না। আর ধরুন যদি বিলেত যেতে হয়?’

‘তা হলে আপনার এবং আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টের প্লেন ভাড়া আমি দেব, ওখানে হোটেলে থাকার খরচ আমি দেব, যে পাঁচশো ডলার আপনাদের প্রাপ্য তার টাকাটা আমি দেব। বুঝতেই পারছেন আমি এর পরিচয় পাবার জন্য কতটা আগ্রহী।’

‘আপনার বাবা কি—?’

‘মারা গেছেন। বিলেত থেকে ফেরার পাঁচ বছরের মধ্যেই। মা-ও মারা গেছেন দশ বছর হল। আমার স্ত্রী বর্তমান। একটিই সন্তান আছে—আমার মেয়ে। সে বিয়ে করে দিল্লিতে রয়েছে। স্বামী আই. এ. এস। এই হল আমার কার্ড। এতে আমার নাম ঠিকানা ফোন নম্বর সবই পাবেন।’

কার্ডটা দেখলাম। নাম—রঞ্জন কে. মজুমদার; ঠিকানা—১৩ রোল্যান্ড রোড; ফোন—২৮-৭৪০১।

ফেলুদা বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ রাখব। কোনো প্রয়োজন হলে আশা করি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।’

‘সম্ভব হলে নিশ্চয়ই করব।’

ভদ্রলোক উঠে পড়ে বললেন, ‘ছবিটা তা হলে আপনার কাছেই রইল।’

‘হ্যাঁ। ওটার একটা কপি করে ওরিজিন্যালটা আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব। ভালো কথা—আপনি কী করেন সেটা ত জানা হল না।’

‘সরি। আমারই বলা উচিত ছিল। আমি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বি. কম পাশ করি সেন্ট জেভিয়ার্স থেকেই। লী অ্যান্ড ওয়টকিন্‌স হচ্ছে আমার আপিসের নাম।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

‘আসি তা হলে। গুড ডে।’

‘অভিনব মামলা,’ ভদ্রলোকের গাড়ি চলে যাবার পর বললেন লালমোহনবাবু।

‘সে বিষয়ে সন্দেহ নেই,’ বলল ফেলুদা। ‘এমন কেস আর পেয়েছি বলে ত মনে পড়ে না।’

‘একবার ছবিটা দেখতে পারি কি?’

ফেলুদা ছবিটা জটায়ুকে দিল। ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে সেটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘সাহেব না ইন্ডিয়ান তা বোঝার কোনো উপায় নেই। এ কেস আপনি কীভাবে কনডাক্ট করবেন তা আমার মাথায় আসছে না।’

‘আপনার মাথার প্রয়োজন নেই। ফেলু মিত্তিরের মাথায় এলেই হল।’