স্ট্রিক্টলি ফর ক্যাশ
তখন বাজে রাত সাড়ে নটা। ক্রমাগত চার ঘণ্টা দৌড়ে আমাদের গাড়িটা পেলোট্রাতে এসে থামল। জায়গাটা পরিষ্কার ছিমছাম আর পাঁচটা শহরের মতো। স্যাম উইলিয়াম পরিশ্রান্ত, ও দম নিচ্ছিল গাড়ি চালাতে চালাতে। স্যাম উইলিয়াম বললো, ওই যে ওসান হোটেলপেলোট্রাতে এসে থামল। কংক্রীট মোড়া, বৃত্তাকার হোটেল চোখে পড়ল গাড়ির কাঁচের ভিতর দিয়ে। থুথু ফেলল স্যাম, জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে। মুছে নিলো হাতের ও পিঠে লাল মাংসল মুখটা। পয়সার ব্যাপার অনেক। মুষ্টিযুদ্ধের ব্যাপারও আছে শনিবারের সন্ধ্যেগুলোতে। ওই পেটেল্লি তারও মুরুব্বি। স্যাম সদর রাস্তা থেকে গাড়িটা ঘোরালো ডাইনে। মাঝখানের সরু রাস্তা দিয়ে চললো গাড়ি। এর দু পাশে কাঠের বাড়ি। চোখে পড়ছে সামনে সমুদ্র।
চাঁদের আলোয় রূপোলী সাজে মোড়া। সমুদ্রের মুখোমুখি ডেরাটা ওই কোণে, টম্ রোশের। স্যাম গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। আমার দেরী হয়ে গেছে তাই নইলে নামা যেত তোমার সঙ্গে। আমিই তোমাকে পাঠিয়েছিটমকে বলল। ওনা করলে ওর গিন্নীকে বোলো। তোমার ব্যবস্থা করে দেবে ও-ই মিয়ামি যাবার। আলো-আঁধার জায়গাটা। গাড়িটা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল জলের ধার দিয়ে।
ঘরগুলি সাজানো সারি সারি ভাবে। একদিকে সুদৃশ্য কাউন্টার। দুটো নোংরা চেহারার লোক বসে আছে টেবিলে। পরনে আধময়লা প্যান্ট ও ছেঁড়া গেঞ্জী। আরোও দুজন বসে আছেকাউন্টারের টেবিলে। প্রথমজন লম্বা চওড়া, গলায় লাল হলদে টাই ও ট্রপিক্যাল স্যুট পরে আছে। সামনের বেঁটে লোকটার পরনে তামাটে রঙা স্যুট। শূন্যদৃষ্টি মেলে বসেছিলো বেঁটে লোকটা বাইরের দিকে তাকিয়ে। মনে হলো ট্রাক চালক বসে। কাউন্টারে আর একটি লোকও বসে। একটা ফ্যাকাশে বোগা চেহারার মেয়েকে চোখে পড়লো কাউন্টারের পেছনে।
বোধহয় অ্যালিশ রোশ। একটা ট্রেতে মেয়েটা সাজাচ্ছিল দুকাপকফি। টম রোশকেও দেখলাম অন্যদিকে মাথাটা দুলিয়ে কি যেন সাফ করছে। ছোট্ট কালো মানুষ কালো চুল। আমাকে কেউ দেখেনি তখনও তাই দেখতে লাগলাম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত। লম্বা লোকটা যেখানে দোসর নিয়ে বসে, অ্যালিস কাউন্টার থেকে বেরিয়ে সেদিকে চলল ট্রে হাতে। লম্বা লোকটা মেয়েটার হাঁটুর নীচে তার হাতটা চালিয়ে দিলো। আড়ষ্ট হয়ে গেল মেয়েটা।
লোকটার মুখে ফুটে উঠলে একটা কুৎসিত হাসি। মনে হলো এবার চেঁচাবে হয়তো মেয়েটা বাকষিয়ে দেবে ওর গালে একটি চড়। কিন্তু না, দাঁড়িয়ে রইলো সে তেমনি ভাবে। রোশের দিকে তাকালো একবার পিছন ফিরে। কোন দিকে দৃষ্টি নেই তার, ভীষণ কাজে ব্যস্ত টম। মেয়েটার মুখ দেখে মনে হলো হৈ-হল্লা করার মতো যথেষ্ট শক্তিও নেই তার।
কারণ ব্যাপারটা সামাল দেওয়া টম রোশের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার শরীরে। ঢুকে গিয়ে একটা ঝাড় দেওয়া যায় নোকটাকে। কিন্তু নিজেকে বিরকরলাম টমের পৌরুষে আঘাত করা হবে ভেবে। কোন পরপুরুষ তার অর্ধাঙ্গিনীর কুল রক্ষে করুক তার উপস্থিতিতে তা কোন মানুষই চায় না আমি তা জানি।
একবার লোকটার হাতটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো অ্যালিস নীচু হয়ে কিন্তু পারলো না। ফিসফিসিয়ে অনুনয়ের ভঙ্গিতে কি যেন বললো, গুরুর কাঁধে হাত দিয়ে তার বেঁটে দোসর। টম রোশের দিকে তার চোখ।
একটা বিরাশি সিক্কার গুঁতো দিলো ভোলা লোকটা মুক্ত হাতের কনুই দিয়ে, বেঁটে লোকটা ককিয়ে উঠলো যন্ত্রণায়। লম্বা হাতটা এবার আস্তে আস্তে হাঁটুর ওপরে উঠলো এবার ওর নাকের ওপর একটা ঘুষি মারলো মেয়েটা সর্বশক্তি দিয়ে। টম ফিরলো এদিকে ঠিক সেই মুহূর্তে।
তার পায়ে অর্ডারি জুতো অল্প খোঁড়া হওয়ায়। অ্যালিসকে ঠেলে দিলো লম্বা লোকটা। সে পড়ল গিয়ে ট্রাকচালকটার গায়ের ওপর, টেবিলে পৌঁছলে রোশ। চেয়ার ছেড়ে উঠলোনা কিন্তু লোকটা, সেই ক্লেদাক্ত, হাসি তার মুখে, নোশ ঘুষি তুললে লোকটার মাথা লক্ষ্য করে, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো ঘুষি। রোশ সামলে নিলো নিজেকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে। সেই ফাঁকে একটা প্রচণ্ড ঘুষি মারলো লোকটা তার পেটে। রোশ ছিটকে পড়লো ঘরের এক কোণে। তখন সে হাঁফাচ্ছে। এবার আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালো লম্বা লোকটা, ফিরলো সে বেঁটে লোকটার দিকে, কেটে পড়া যাক চলল, –ঘেন্না ধরে গেছে, এ শালার জায়গায়। এক পা এগিয়ে করুণার দৃষ্টিতে রোশের দিকে তাকাল সে, শালা মেরে মুখ ভেঙ্গে দেবব, আবার যদি কোনোদিন হাত ওঠে তোমার।
একটা পা তুললে লোকটা রোশের মুখ লক্ষ্য করে। পারলামনা আর থাকতে, দ্রুতপায়ে ঢুকে রোশের কাছ থেকে সরিয়ে দিলাম ওকে ঠেলে। ওর মুখে সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘুষি মারলাম, লোকটা আমার দিকে ফিরতেই। শব্দ হলো যেন গুলি ছিটকে বেরোনোর, বাইশ বোরের বন্দুক থেকে।
লোকটাক্ষেপে যাওয়ার ফলে তার সমস্ত শরীর দুলে উঠল ঘুষিটা চালানোর জন্য। মাঠে মারা গেল ঘুষিটা আনাড়ি ভাবে। বিপদ হতো আমার ঘুষিটা জমাতে পারলে। ছিটকে পড়লো মেঝেয় কাটা পাঁঠার মতো। দরদরিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো চোয়াল ফেটে। অপেক্ষা করলাম না ওর উঠে দাঁড়ানো পর্যন্ত, উঠতেও পারবেনা আমি জানতাম। একবার পড়লে আর উঠতে পারেনা এ ধরনের মানুষগুলি। এখান থেকে হঠাও, নইলে ফিরে তাকালাম বেঁটে লোকটার দিকে। গুরুর ওপর নিবদ্ধ বেঁটের চোখ। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে।
আমি তাকে টেনে তুললাম রোশের দিকে এগিয়ে। মনে হোল রোশ লড়ে যেতে চায় দম না থাকলেও। সে লোকটার দিকে এগোতে লাগল এক পা দু-পা করে। টেনে ধরলাম তাকে, আর হাত লাগাতে হবে না–ও শালার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। টমের গা জড়িয়ে বললো অ্যালিস ছুটে এসে। লম্বার দিকে সরে এলাম, বেঁটে তখন ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাকে টেনে তোলার।
বের করেনাও ওকে এখান থেকে, হাত লাগাও তোমরাও একটু–আমি বললাম গেঞ্জীধারী ও ট্রাকচালকদের উদ্দেশ্যে। চোখ তুলে তাকালো এবার বেঁটে লোকটা, তার চোখে জল। জখম করে দিলে তুমি ওর মুখটা–লড়তে হবে ওকে শনিবার–, দুমড়ে দিতাম ওর গলাটা–নাও জলদি বের করো ওকে। এক পা এগোলাম, পালটে ফেলতে পারি আমার মত।
এবার ট্রাকচালকটা আমাকে মাপলো আপাদ মস্তক, তারপর বলে উঠলো বেশ উত্তেজিত গলায়, জানো? ঝড় কাকে দিলে জো ম্যাকডেীও এক নম্বর মুষ্টিযোদ্ধা এখানকার। শনিবার ও লড়ছে মিয়ামির ছোকরার সঙ্গে, লড়াইতে বাজিও ধরা আছে অনেক টাকার। গলাটা নামিয়ে দিলো খাদে। শীগগির কেটে পড়ো। পেটেল্লির কানে গেলে কেচ্ছা হবে ম্যাকের এই অবস্থার কথা শুনলে। জোরালোই হলো সে রাতে খাওয়াটা। চেয়ারে গা এলিয়ে হাত বাড়িয়ে টেনে নিলাম সিগারেটের প্যাকেটটা।
ভালো লাগছে অ্যালিসআর টমকে। মনে হচ্ছে ওদের, আমার মনের মতো মানুষ। স্বল্প সময়ের ব্যবধানেনাম ধরে ডাকতে শুরু করে দিয়েছি আমরা পরস্পরকে। ওদের কথা শুনেছি খেতে খেতে, মুখ খোলার পালা এবার আমার। তোমাদের জানার কৌতূহলহতে পারে, এখানে আমার আগমনের উদ্দেশ্য। আস্তানা ছিল আমার পিটসবার্গেই, ধরালাম সিগারেটটা। বাবার একটা কাফে ছিলো ওখানকার কারনেলি ইস্পাত কারখানার উল্টো দিকে। মনে হওয়া উচিৎ, কি বলল, টাকা তো খোলামকুচি! লম্বা টান দিলাম সিগারেটে। কিন্তু জিজ্ঞেস করো না, তা হয়নি। নিজেই জানি না কারণটা আমি। বুড়ো তো টেসে গেলো দেনা রেখে, আর আমি ফকিরুদ্দিন আমেদ রাস্তায়। হেসে উঠলাম নিজের রসিকতায়। ভাবলাম একবার ঘুরে দেখা যাক ফ্লোরিডার বাজারটা। ঠকিনি মনে হচ্ছে। তা আছেটা কি ফ্লোরিডার? চোয়াল বোলালো রোশ হাত দিয়ে। যাওনি তো কখনো পিটসবার্গে হাসলাম, ধোঁয়াশা আর আওয়াজ, ময়লা, ঝুল তাকাও যেদিকে। এখানেই তো কাটলো আমার জীবনটা। তোমার কথাই ঠিক হয়তো। বড় বিরক্তকর লাগে রোদ্দুরটা এক-একসময়।
গত তিন সপ্তাহ ধরে আমার জীবনের মধুরতম দিনগুলি কাটল ফ্লোরিডার রাস্তায় রাস্তায়। জায়গাটা কিন্তু দারুণ, তাই একটু থামলাম। স্যামকে চেনো? ও-ই তো পাঠালো আমাকে তোমার কাছে। অন্য মনে জবাব দিলো রোশ–হ্যাঁ বহুদিন থেকেই! ও তো বলল, মিয়ামি পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে তুমি। করবো। মিয়ামি যাতায়াত করে জন বেটস্ তো। আমার কাছেই থাকে ওর চিঠিপত্র। ব্যবস্থা করে দেবো তোমার–বে আসবে কাল সকালেই। তাহলে যাবে ঠিক করলে মিয়ামি? রোশ থামলো। হ্যাঁ।
বিয়ার ছাড়ো তো আর একটু। অ্যালিস, তেষ্টায় ছটফট করছে–দেখছে না দোস্ত। উঠে গেলো অ্যালিস। পোশ একটু উঠে বসল, ও রান্নাঘরে অদৃশ্য হতেই। কাউকে এমন হুক মারতে দেখিনি ডেম্পসি ছাড়া। লাইন খুব সুবিধের নয়। আমার শরীরে ঘুরলো রোশের চোখ দুটো।
মনে হচ্ছে তুমি লড়াইয়ের লাইনে ছিলে? ছিলাম। কিন্তু বহুকাল ছেড়ে দিয়েছি ওসব। কিন্তু কার সঙ্গে লড়েছে? চমক সৃষ্টি করতে পারে তোমার চেহারা আর ওই হুক।
যুদ্ধের সময় জো-লুইয়ের সঙ্গে লড়েছি প্রদর্শনী লড়াইলোর কয়েকটাতে। আহা জো খুব বলেছিলো গোল হয়ে ভালো ছিল। বলেছিলো সুন্দর আমার ডান হাতের কাজ। ই আর এক লিনস্কির বদলি সেদিন দ্বিতীয় রাউন্ডে ফেলে দিয়েছিলাম। রাশের চোখ দুটো জ্যাক ওয়াইনার এর দিকে। সেদিনটা এক পরমসুখের দিন আমার জীবনের। বিস্তৃত হলো রোশের মুখের ফাঁকটা, জ্যাক ওয়াইনার মানে ক্যালিফোর্নিয়ার একনম্বর! হ্যাঁ, বলছি তো তারকথা–পিষে দিলাম পায়ে সিগারেট ফেলে। ভেঙ্গে দিয়েছিলাম জ্যাকের চোয়াল। হেসে উঠলাম। বড় বেশি বিশ্বাস ছিলো ব্যাটার নিজের ওপর। যাব বাবা! তা কেন ভাই ছাড়লে? ব্যাপার তো বেড়ে। ঠিক রাখতে মুখের ভূগোল, তাছাড়া বাধাও ছিলো অন্য ধরনের। রোশ মাথা নাড়লল, দোস্ত অপচয় করছে প্রতিভার। তুমি তাহলে বধ করে থাকো যদি ওয়াইনারকে। আর আমাকে কেটে পড়তে বলে গেল ওয়াইনার–ট্রাকচালকটা। বললো পেটেল্লির নাকি কিছু বলার থাকতে পারে ম্যাকডেীর ব্যাপারে। রোশকে থামিয়ে দিলাম। ভাববার কিছু নেই, পেটেন্নির জন্য। হয়তো এতক্ষণে সাবড়ে দিয়েছে ওকেসলি ব্র্যান্টি। তাছাড়া পেটেল্পিত মদত দিতেই ব্যস্ত তার মিয়ামির বাচ্চাটাকে। অবশ্য তোমার বিপদ ছিলো ওই ছোঁড়াটার গায়ে হাত তুললে। পেটেল্লির মাথা ব্যথা নেই ম্যাকডেীর জন্য।
বেঁটে লোকটা কি সেই–সলি ব্র্যান্ট এই যে নাম বললে তুমি। যাকে দেখলাম ম্যাকডেীর সঙ্গে। হ্যাঁ ও-ই বেচারা ম্যাকক্ৰেডীর মালিক। এখন মাথা চাপড়াচ্ছে। একটা ভাম ম্যাকটা। কিন্তু ব্রান্ট তো ভালো লোক। হাতে দুটো বিয়ারের পাঁইট নিয়ে অ্যালিস ফিরলো। রোশ দম্পতির অনুরোধে ঠিক করলাম রাতটা ওদের কাফেতে কাটাবো। চোখে ঘুম নেই গত তিনটে সপ্তাহ।
অন্ততঃ ঘুমোতে পারবো ভালো করে আজকের রাতটা। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম, আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর। অ্যালিস পৌঁছে দিলো আমাকে দোতলার একটা ছোট্ট ঘরে। ঘরটা থেকে সৈকত চোখে পড়ে পরিষ্কার। আপনার কিছু দরকার হয় যদি কিস্যু লাগবে না, থামিয়ে দিলাম অ্যালিসকে। খাসা দেখছি তো বিছানাটা। বাথরুম আছে ওইদিকে যদি স্নান করতে চান তো৷ মিষ্টি হেসে অ্যালিস বলল। ও দেখালো হাত বাড়িয়ে। করতে হবে হ্যাঁ। অনেক করেছেন–অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ, আপনি যা করেছে। হয়তো মেরেই বসততটমকে জংলীটা। উদ্বিগ্ন মুখে অ্যালিস বললো, আর দেখলেনই তো টমের স্বাস্থ্য।
তবু হিম্মত আছে টমের বলতে হবে, আপনার গর্ব বোধ করা উচিৎ ওর জন্য।
করিই তো, অ্যালিস, নরম হাতটা আস্তে রাখলো আমার কাঁধে। আনন্দের ঝিলিক ওর চোখ দুটোতে। জানেন খুব খারাপ গেছে ওর সময়টা। লড়াই করেছে বাঁচার। কিন্তু দুব্যবহার কোনদিন করেনি আমার সঙ্গে। চরম দুঃসময়েও না। আপনি এসে না পড়তেন–যদি; মিসেস রোশ–আরে ওসব ভুলে যান। শুধু বলে যাই একটা কথা ওই সময়। যাবার আগে, তুলনা নেই আপনার। ঠিক আছে তো সব? ঘরে উঁকি দিলো রোশ।
রোশ এক পা এগোল ঘরের মধ্যে। নিশ্চয়ই–টম পাল্টালে পায়ের ভর, নাকটা ঘষে নিলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে। আমার দিকে তাকালো চোখে চিন্তার ছায়া নিয়ে।
টম কি ভাবছো? ওকে মুক্তি দিতে চাইলাম অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে। তোমাকে একটা প্রস্তাব দেবো ভাবছিলাম। অবশ্য এ নিয়ে আমার কথা হয়েছে অ্যালিসের সঙ্গে। আচ্ছা, আপত্তি আছে কি কাজ করতে আমাদের সঙ্গে? মোটামুটি ভালোই আমাদের ব্যবসা। বাড়ানো যেতো আরও তুমি থাকলে। পোশ একটু থামলো–তাই বলে তুমি বড়লোক বনে যাবে রাতারাতি একথা বলছি না, আমি কিন্তু চাকরি নিতে বলছিনা তোমাকে–তবে আগ্রহ থাকলে। একভাগ তোমার লাভের তিন ভাগের মধ্যে, হাসলে রোশ। দোস্ত ভালোই হবে অ্যালিসও বলছিলো তাই।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তাই ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে রইলাম। আরে পাগলা হয়ে গেছো তুমি, আমাকে জানো না চেনো না–অংশীদার বানিয়ে দিচ্ছো চোয়াল থেতলেছি বলে কোন শালার।
কেন–বলছি রোশ বিছানায় বসলো, এখানে আমদানী হয় অনেক আজে বাজে লোকের। তাদের মোকাবিলা করা আমার পক্ষে প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। সেজন্যই তোমাকে আসতে বলছি। অনেক অস্বস্তি থেকে তুমি আমাদের বাঁচাতে পারবে। তুমি নিজের হিম্মতেই নেবে তোমার রোজগারের প্রতিটি পয়সা, লজ্জা নেই এতে। না। নেই লজ্জা।
চাইলাম না আমি। বললাম, তাহলে দ্যাখো রোশ। প্রভাবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমি কৃতার্থ মনে করছি নিজেকে। কিন্তু সম্ভব নয় এটা। ভুল বুঝো না আমাকে। শুধু অনেক টাকার স্বপ্ন দেখে এসেছি আমি সারাজীবন। কাজেই সন্তুষ্ট হতে পারবো না অল্প টাকায়। ওর দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলাম প্যাকেট থেকে বের করে। ধরালাম নিজেও। জানো কেন হয়েছে এটা? অভাবে রেখেছে বাবা আমাকে ছোটবেলা থেকে, শুধু খাবার জুটেছে দুবেলা দুমুঠো। আমাকে রোজগার করতে হয়েছে। আর বাকি সবকিছুর জন্যই। মানুষের ফরমাস খেটেছি, দোকানে কাজ করেছি খবরের কাগজ বেচেছি।
বুড়ো তো তারপর টেসে গেলল। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিলাম একটা লম্বা টান দিয়ে, ভাবলাম কিছু পাব দোকানটা বেচে দিয়ে কিন্তু সব চলে গেলো দেনা মেটাতে। চল্লিশটি ডলার আছে আমার হাতে এই মুহূর্তে, বলে গেলাম একটু চুপ করে থেকে। পরে আছি যে জামা-প্যান্ট আর টাকা মিলিটারী পেনসনের। দেখিয়ে দিলাম নিজের শরীরটা, আমাকে যেতেই হবে মিয়ামি আমার চাই যে অনেক টাকা।
রোশ টেনে চলেছে সিগারেট নির্বিকার মুখে বসে। সে নড়েচড়ে বসলো বেশ কিছু পরে, তা মিয়ামি কেন সেজন্য? অনেক টাকা অন্য কোন বড় শহরে বা নিউইয়র্ক এও আছে।
শুনেছি জায়গাটা নাকি ভূস্বর্গ, মিয়ামি দেখেছে এমন একজনের কাছে। সেখানে ঘরে ঘরে নাকি কোটিপতি, তারা ছুটি কাটাতে আসে, আর খোলামকুচির মতো হাসলাম।
রোশ কিন্তু তেমনি গম্ভীর হয়ে বসে আছে। সেই টাকার খোঁজে আমি চলেছি–শুনেছি সেখানে নাকি দারুণ লাভজনক, সমুদ্রের ধারে মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজটা। আরও বলেছিলো ওই লোকটা, সে একজনের কথা জানে যে নাকি এক হাজার ডলার পেয়েছিলো একবার এক চিত্রাভিনেতার জান বাঁচিয়ে। উপরি একটা চাকরিও হলিউডে পেয়েছিলো। সে ব্যাটা গাড়ি চালাতো–আমি যার কথা বলছি তাকে পাঁচ হাজার দিয়ে গিয়েছিলো তার কর্তা মরার আগে। পাঁচ হাজার মাত্র তিন বছরে।
বোঝা হাওয়ায় উড়ছে টাকা, রোশ চুলকে নিলা হাঁটুটা হাত নামিয়ে, ফিরলো আমার দিকে–চিন্তার আভাস তার চোখে, সবই তো বলেছে দেখছে আমার দোস্ত, কিন্তু আমার কাছে বলেনি এমন অনেক খবর। বাজে লোকেরও বাস অনেক মিয়ামিতে। পথে পথে ছিনতাইবাজ, পতিতা, জুয়াড়ী। হাওয়ায় ভর করে কোটিপতিদের টাকা ওদের পকেটেই সেঁদোবে তোমার পকেটে ঢোকবার আগে।
মুহূর্তের জন্যও আর নজরছাড়া করবেনা; তোমার মতো এক কাপড়ের মানুষ দেখলে। রোশ বললো জানি, শোন, আমি গিয়েছি মিয়ামি। আমি ট্রাক চালাতাম, আমার পা জখম হবার আগে।
মাথা থেকে বের করে দাও মিয়ামির ব্যাপারটা, শোনো দোস্ত আমার কথা। নির্বাট জীবন, থাকবে মোটা ভাত–কাপড়ে। চলে যাও এখান থেকে। ভালোই লাগে চিন্তা করতে মোটা মালের কথা। কিন্তু সঙ্গে মনে রাখা দরকার বিপদের কথা। উঠে দাঁড়াল রোশ, ভাবো মাথা ঠাণ্ডা করে, টাকা পাবার রাস্তা, বক্সিং লড়ে নেওয়া। জানি না হিম্মত কেমন সেখানে তোমার, তবে, যদি নমুনা হয় আজকের ঘুষির ব্যাপারটা।
তাহলে–ওকে থামিয়ে দিলাম, বলেইছি তো, ছেড়ে দিয়েছি আমি লড়াই–কোনো মানে হয় না কানা হয়ে বেঁচে থাকার।
ইতি ঘটে গেছে ও অধ্যায়ের, জায়গা ভালো না মিয়ামি তুমি বলছে। একবার বুঝতে হয় ব্যাপারটা নিজে গিয়ে। গোলমাল থাকতে পারে আমার মাথায়। কিন্তু হবেই আমাকে যেতে হাত রাখলাম রোশের কাঁধে, টম দুঃখিত আমি, স্থির করে ফেলেছি মন, অকৃতজ্ঞ ভেবো না আমাকে। ঠিক আছে। রোশ একটা ভঙ্গী করলো তার সরু কাঁধের। চলে যাও যদি তাই মনে করো, ঘুরে ফিরে দ্যাখো।
এখানে ফিরে এসো সুবিধে না হলে। আমার দরজা খোলা থাকবে তোমার জন্য। অন্য কাউকে কাজে নিচ্ছি না মাস তিনেকের মধ্যে। শুধু মালিক তোমার আমি আর অ্যালিস, লাভের এক তৃতীয়াংশ, দ্যাখো ভেবে–রোশ, ম্লান হাসি হাসবার চেষ্টা করল। ভাবনা তত শেষ আমার। টম থেকো না আমার অপেক্ষায়, বললাম, নিয়ে নাও তুমি লোক, ফিরবো না আমি।
একটা সিগারেট ধরিয়েছি প্রাতরাশ শেষ করে। এমন সময় মুখ বাড়ালো রোশ দরজার ফাঁকে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায় সলি ব্র্যান্ট, কি বলবো? একটু ইতস্তত করলাম, তুমি বলো। দেখা করবো, নাকি করবো না? সরিয়ে দিলাম খাবারের প্লেট। দাও–ভিরিয়ে। ঢুকলো ব্র্যান্ট। পেছনে সরিয়ে দিলো টুপিটা চেয়ার টেনে বসে। লোকটা ঘুমায়নি যেন কতকাল। কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললাম ও মুখ খোলার আগেই। কিন্তু লড়িয়ে নয় তো তোমার ছোকরাটি পেয়েছে ওর পাওনা। লাভ নেই কাঁদুনি গেয়ে আমার কাছে। দরকার কিছু নেই আমার। জানি যন্ত্রণা হয়েছে ও শালা ভামকে নিয়ে। ব্র্যান্ট চুলকালো মুখটা হাত দিয়ে। শালা রাতারাতি বাড়িয়ে দিয়েছে আমার বয়সটা। আমার দিকে ব্র্যান্ট তার মোটা আঙুল বাড়িয়ে দিলোতা, দাদা কোথায় পেয়েছে ঘুষির ট্রেনিংটা?
অন্য কোথাও হাতটা দাবাতাম এতো ঠুনকো জানলে ও শালার চোয়ালটা। শক্তই ওর চোয়াল–অনেক শালাই তো ওর চোয়ালে হাত বোলাচ্ছে বছরের পর বছর করে আসছে তো হজমও। কিন্তু আমি জন্মে দেখিনি ওই মার।
যাক গে, ও শালাকে ফুটিয়ে দিতাম যদি অন্য কাউকে পেতামমিয়ামির ছোকরাটার মোকাবিলা করার জন্য ব্র্যান্ট থেমে গেলোবিমর্ষ মুখোবাজি অনেক টাকার লাগিয়েছিলাম সাড়ে সাত–এবার ও আমার চোখে, আমি? নানা সোজা তাকালো, আচ্ছা তুমি বলেছিলে কার সঙ্গে লড়েছিলে? তাতে কিছু আসে যায় না, আমি কার সঙ্গে লড়েছি। সড়তে পারছি না তোমার জন্য জেনে রাখো এটুকু। অনেকদিন হাতে দস্তানা গলাইনি, আমি বোধহয় রিংয়ে আর ফিরছি না।
আদেখলার মতো আমার শরীরে ঘুরলো, ব্র্যান্টের ক্ষুদে বাদামী চোখ দুটো, অরিজিনাল হক আর এই চেহারা–ছেড়েছে কদিন দাদা। বহুৎ দিন। ইচ্ছেও নেই আর হয়। ভাইটি এক মিনিট, সত্যি যাক, এই ব্যাপারেই যদি তোমার শুভাগমন ঘটে থাকে। তুমি নাকি ওয়াইনারকে দ্বিতীয় রাউন্ডে শুইয়ে দিয়েছিলে?
রোশের কাছে শুনলাম। কি উপকারটা হচ্ছে শুনি তাতে তোমার? তাহলে চলেছে মিয়ামি, ব্র্যান্ট প্রসঙ্গ পাল্টালো। শোনো দোস্ত বলে সেউঠে দাঁড়ালো। করবেটা কি মিয়ামি গিয়ে এই হেটো পোষাকে। ট্রপিক্যাল স্যুট চড়িয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যাওয়াই ভালো, তাই না?
যদি যেতেই হয়, দশ মিনিটে আউট হয়ে যাবে। উঠলাম আমি–মাথাব্যথা সেটা আমার। জানি–ব্র্যান্ট ভেতরে উঁকি দিলো টুপিটা খুলে। ওর মধ্যে যেন কিছু হারিয়েছে।
জানিনা, তোমার ঝুলিতে যদি অন্য কিছু থাকে। ওই ঘুষি ছাড়া। তোমার খারাপ দাঁড়াবে না ব্যাপারটা? আচ্ছা ঘটনাটা বোঝা যাক–একবার এসো না ব্যায়ামাগারে। পড়ে গেলাম চিন্তায়। রোশ, বেটুমিয়ামি পাড়ি দেবে আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই। হয় এখানে পড়ে থাকতে হবে আরও চারটে দিন, আর না হয় কেটে পড়তে হয় ওর সঙ্গে।
পকেটে রেস্ত নিয়ে নিজের গাড়িতে চড়ে বেরোতে মন্দ লাগবে না। কিন্তু এক অচেনা অজানা হেভীওয়েট মুষ্টিকের সঙ্গে লড়তে হবে, ওই দুটো বস্তু পাবার আগে। কাজও ভালো ডানহাতের ক্ষিপ্রতা আছে মোটামুটি। কিন্তু ভাবতে হবে না সেসব তোমাকে। তোমায় হারাতে হবে না ওকে, শুধু চালিয়ে যাওয়া কয়েক রাউন্ড। ওর ওপরেই লাগানো আছে বাজির সমস্ত টাকাটাই।
তবে সোনা বাঁধানো দাঁত বের করে ব্র্যান্ট হাসলো, একটা সিগারেট ধরিয়ে। সে চোখের ভঙ্গী করলো একটা কথা অসমাপ্ত রেখে। না বললাম কথা হওয়াই ভালো একরকম। আরে, বুঝলে না কথার কথা। বেরিয়ে পড়ি চল না, যেতে যেতে কথা হবে। ব্যায়ামাগার পৌঁছলাম অল্পক্ষণের মধ্যেই। লড়াইয়ের স্টেডিয়ামটা একটা ঘিঞ্জি জায়গায়, রাস্তার শেষে পেলোট্টার সদর। একটা ঘরও আছে সাজ বদলের–ছড়ানো নোংরা মাদুর, পাঞ্চিং ব্যাগ। দুটো রিং, বড় ঘর একটা। সাধারণই ব্যবস্থা। চোখে পড়লো না আশেপাশে কাউকে। এখুনি এসে পড়বে ম্যাকক্রেডীর অনুশীলন জুটি–ওয়ালার। লোকটার শরীর লোহার মতো।
দস্তানা আর লড়াইয়ের পোষাক বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ওয়ালার চুকলো সেগুলো পরতে পরতেই। নিগ্রো বিরাট চেহারার। আমাকে মাপলো ফোলা ফোলা রক্তাক্ত চোখে। ব্র্যান্টের উদ্দেশ্যে সাজ ঘরে ঢুকে পড়লে মাথাটা একটু হেলিয়ে। আরে শরীরে দেখছি একেবারে চর্বিটর্বি নেই একেবারে ভালো জমবে। জমবে, কথাটা ছুঁড়েদিলাম রিংয়ে ঢুকতে ঢুকতে। আবার সিগারেটটাও ছাড়তাম, এই কম্ম করতে হবে জানলে। লড়াই দেখব একটা শোনো হেনরি–যাচাই করা দরকার জনির এলেমটা। কিছু নেই মারামারি করার। হুশিয়ারী দিলো ব্র্যান্ট। একটা বিচিত্র শব্দ বের করলো ওয়ালার উত্তরে নাক দিয়ে। আমার দিকে ঘুরলো ব্র্যান্ট, এবার তুমিও শুনলে ফারার নাও; শুরুকরো ব্র্যান্ট বেল বাজিয়ে দিলো। ওয়ালার এগিয়ে এলোনীচের দিকে মাথাটা ঝুঁকিয়ে। তাকে একটা অতিকায় কাকড়া মনে হচ্ছে। দুজনে দুজনের চোখে চোখ রেখে রিংয়ে পাক খেতে শুরু করলাম। ওয়ালার দুটো ঘুষিও ছুঁড়লো। একটা হুকও ডান হাতের। সরে গেলাম বাঁ হাতের একটা মার দিয়ে। আমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই আমার ঘুষির ওজন নিয়ে। মাথা ঘামাচ্ছি সময়ের ব্যাপারটা নিয়েই।
কিন্তু পারছি না মারতে। ওয়ালার মোক্ষম মার দিলো একটা এক ফাঁকে মাথার এক পাশে। শরীর টলছে, কোনোরকমে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। ওই অবস্থায় বাঁ হাত চালিয়ে দিলাম, ওয়ালার আর এক পা এগোতে।
তুমি মনে হচ্ছে রিংয়ের মুখ দেখনি অনেকদিন, সময়মত পাঞ্চগুলো হচ্ছে না। দোস্ত আরো হুঁশিয়ার হতে হবে পরের রাউন্ডে। চেষ্টা করো একটু তফাতে থাকতে। দিলাম না জবাব। আমি জানি কি করবো, ধ্বসাতে হবে ওকে এই রাউন্ডেনইলে টিকতে পারবোনা বোধহয় তৃতীয় রাউন্ড পর্যন্ত। ওয়ালার কিন্তু বসলোও না বিরতির সময়টুকু। পাক খেয়ে চললো রিংয়ে। উঠে দাঁড়ালো ব্র্যান্ট, ঠিক আছে সব? চলো জনি, এগোতে লাগলাম উঠে আসতে। আবার তেড়ে এলে ওয়ালার, সরে দাঁড়ালাম বাঁ–হাতের একটা জোরালো জমাবার মুহূর্তে। তারপর ওর পেটে ঘুষি জমালাম গোটা তিনেক।
ককিয়ে উঠলো কৃষাঙ্গ ওয়ালার ব্যথায় কুঁকড়ে গেছে তার সারা শরীরটা। সে আমার দেহের ওপর পড়ল অবশিষ্ট শক্তিটুকু দিয়ে, দুজনে জড়িয়ে গেলাম। ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম ওকে কিন্তু সুবিধা হলো না। সরে যেতে বলে আমাদের ব্র্যান্ট চেঁচিয়ে উঠলো। আর একটা আপারকাট বসালাম সেইমুহূর্তেই। গর্জন করে সরে গেলো ওয়ালার। কিছুক্ষণ ঘুমোঘুষি চললো দুজনের। অনেকটা ধাতস্থ আমি এখন।
এবার বাঁ হাতে হুক চালালাম সুযোগ বুঝে, ওয়ালারের বাঁ হাতটা নেমে গেলো, সেটা ওর মুখ আড়াল করে রেখেছিলো। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি এখন ওর মুখটা। আমার ডান হাত উঠলো। এবার দাঁতকপাটি লেগে গেলো ওয়ালারের। কিছুতেই আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়া থামছে না। ভারী হয়ে আসছে নিশ্বাসও, মুছলামও বার দুয়েক। তবে নিশ্চিন্ত বোধ করছি খানিকটা। উঠতে পারবে না চট করে নিগ্রোটা।
রিংয়ে ঢুকলো ব্র্যান্ট লাফিয়ে, আকণ্ঠ হাসি ঠোঁটে। দুজনে ধরাধরি করে ওয়ালারকে নিয়ে গেলাম রিংয়ের একটা কোণে। পরিচর্যা শুরু করতেই দরজার দিক থেকে একটা শব্দ ভেসে এলো। মনে হচ্ছে ছোকরাটি বেশ চালু–কোত্থেকে জোটাল ব্র্যান্ট ওকে?
আড়ষ্ট হয়ে গেলো ব্র্যান্ট, তার হাত চলছেনা। তাকালাম ফিরে। তিনটে লোক দাঁড়িয়ে রিংয়ের বাইরে দরজার কাছে। কখন নিঃশব্দ পায়ে ঢুকেছে। চওড়া কাঁধের লোকটা কথা বললো, তাকে বেঁটেই বলা যায়। কোনদিন আপোষ করেনি এ নোক মুখ দেখে বোঝা যায়, আর কোনদিন করবে না। চকচক করছে তীক্ষ্ণ স্থির চোখ দুটো।
সবুজ লিনেনের পোষাক পরনে পেনসিলের মতো সরু গোঁফটা তার, আরও স্পষ্ট দেখাচ্ছে জলপাই রঙ গায়ের চামড়ায়। মনে হলো ওর চামচে মস্তান মার্কা সঙ্গের দুজন।
আমার ভালো লাগলো না ওদের কাউকেই।
বললাম তো আপনাকে এর কথাই, চোয়াল ফাটিয়েছে ম্যাকডেীর ব্র্যান্ট কপালটা মুছলো রুমাল বের করে। তা শুনেছি তো, তা একেই কি লড়াবে ঠিক করেছে মিয়ামির ওই ছোঁড়াটার সঙ্গে? মানো –আপনার কাছে যাচ্ছিলাম তো ওই ব্যাপারেই কথা বলতে মিঃ পেটেল্লি–একটু দেখে নিচ্ছিলাম ওর হাতটা।
ভালোই তোমনে হোল তোমার কাজকম্মকাজ দেওয়া যাবে কিছু লড়াইয়ের পেটেল্লি থেমে একটু প্রশ্ন করলো, সই করেছেনাকি ব্র্যান্টের হয়ে? করিনিকরবোনা কারুর হয়ে। একদিনের জন্যেই লড়াইতো। চলে এসে ব্র্যান্টের সঙ্গে, বলা যাবে কথা।
রোশের কাফের সামনে পৌঁছতেই রাস্তার ধুলো উড়িয়ে মিয়ামির রাস্তায় উঠে যেতে দেখলাম বেটসের ট্রাকটাকে। দাঁড়িয়ে রইলাম মনে একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে মিয়ামি পাড়ি দেবার কথা ছিল আমার ওই ট্রাকেই। ঢুকলাম কাফের ঝোলানোদরজা ঠেলে। কাজে ব্যস্ত রোশ। বলে উঠলো আমাকে দেখে, তাহলে পাল্টেছে তোমার মত? বেটস তো চলে গেলো এতক্ষণ অপেক্ষা করে। এতক্ষণ কি করছিলে? ফেঁসে গেছিটম আর বোলোনা, ওকে বললাম ব্র্যান্টের কথা। একটা গাড়ি আর পাঁচশো নগদ, মোটামুটি চলে যাবে। কি বলো? তবে, থেকে যেতে হচ্ছে আরও চারটে দিন। মুক্তবিহঙ্গ তারপর–হেসে উঠলাম। রোশকে পেটেল্লির কথাও বললাম।
কিন্তু জনি উড়িয়ে দিওনা ওর ব্যাপারটা। লোকটার কিঞ্চিৎ দুর্নাম আছে বাজারে। –শুনেছি, ওর ছায়া মাড়াতে চাইছি না সেজন্যেই তো। তার সময়তো দিতে হচ্ছে রিংয়ে কিছুটা। লড়াইটা হয়ে গেলেই শনিবার পর্যন্ত। জনি আমাদের সঙ্গে থেকে যাও–তোমার ভালোই লাগবে, আমাদেরও।
বললাম না কিছু। খারাপ তো লাগছেনা ওদের সঙ্গ। সলি ব্র্যান্ট ঢুকলো কিছু পরেই। সে বসে পড়লো একটা কোণের টেবিল বেছে। হাঁফাচ্ছে, কি করে এলাম সব। তুমি শুধু এই লড়াইটাতে নামছে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো এটা পেটেল্লিকে বোঝতে।
ব্র্যান্ট ঝাপী হাতে সিগারেট ধরালো। তবে ফারার তুমি ভুল করছো আমার মনে হয়। আখের গোছাতে পারতে পেটেল্লির মাথায় হাত বুলিয়ে। দরকার নেই–ওকে বুঝিয়েছি আমিও তাই, আর কিছু নেই যদি শেষ পর্যন্ত রাজিও করিয়েছি তবে, এখনো সময় আছে তোমার হাতে, যদি? টদির ব্যাপার। অস্বস্তি বোধ করছে ব্র্যান্ট। বসলো একটু নড়ে। একটু আছে–কিরকম? প্রশ্ন রাখলাম অধৈর্য গলায়। তাহলে দ্যাখো, যদি শেষ লড়াই হয়। এটা তোমার–পেটেল্লি উৎসাহিত হবে তোমার ব্যাপারে আশা কর না এটা নিশ্চয়?
বলছিও না হতে–যত কম মোলাকাত হয় ততই মঙ্গল ওর সঙ্গে আমার–কিন্তু পেট্টেল্লি তো মেলা টাকা লাগিয়ে বসে আছে মিয়ামির ওই ছোকরার ওপরে। কাজেই জেতাতে হবে ওটাকে–ঠিক আছে, যদি লড়ে জিততে পারে তো জিতবেব্যাপারনয় যদিরও জিতবে ব্র্যান্ট ফিরিয়ে দিলো আমার কথা। আর পেট্টিল্লির নির্দেশ এটাই, তাহলে ব্যবস্থা পাকা করেই এসেছে আমাকে তাড়াবার তা একরকম তাই। পেট্টেল্লি বহুৎ টাকা লাগিয়ে বসে আছে ছোঁড়াটার ওপর।
তোমাকে মাটি নিতে হবে তেসরা রাউন্ডেই ব্র্যান্ট সাহেব দ্যাখো, ও বিদ্যেটা আমার জানা নেই তোমাকে তো বলেছি–আর, ওটা তো হবেই না এই লড়াইয়ে। ব্র্যান্ট মুখ মুছে ফেললো দ্রুতহাতে ময়লা রুমালটা বের করে দোস্ত শোনো–পেয়ে যাচ্ছে গাড়ি আরনগদ টাকা শনিবারের ব্যাপারটার পর। ঘোলা কোরোনা জল। ব্র্যান্ট শোন, আমিও বলছি, যদি তোমাদের ওই ছোকরা
আমাকে ফেলতে না পারে কবজির জোরে, তাহলে মরতে হবে ওকে–কোনো গ্যাঁড়াকলে নেই আমি।
করছি না মস্করা। দুবছর আগে ফ্যাসাদে পড়েছিলো এক ছোঁড়া ওর কথা না শোনার জন্য–ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল ওর হাত দুটো লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে। বুঝতেই পারছে তাহলে–পেলে তো আমাকে–পাবে। চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ব। আর এক ছোঁড়াও, ভেবেছিলো পারেনি কিন্তু। ধরা পড়লো ছমাস পরে–ফাটলো মাথার খুলি, ছেলেটার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে
ভয়টয় দেখিওনা আমাকে, আমি আছি যদি লড়াই লড়াইয়ের মতো হয়, কেটে পড়ছি নয়তো–ফারার ভেবে দেখো, করো পেট্টোল যা বলছে। এখানকার যে কোন লোককে জিজ্ঞাসা করো আমার কথা বিশ্বাস না হয়, মাজাকি চলবেনা পেট্টিন্নির সঙ্গে রোশও জানে–ওর যে কথা সেই কাজ–
বোধ হয় তা চলবে না আমার সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম এটাই শেষ লড়াই আমার আর শেষ হবে তা আমার ইচ্ছে মতোই, একথা তুমি জানিয়ে দিতে পারো পেটিল্লি সাহেবকে–এখন ওটা তোমার ব্যাপার, তুমি বলো বলতে হয়–ব্রাষ্ট কথা গুলি এক নিশ্বাসে ছেড়ে দিলো। না, দাদা–তুমি বলবে, তুমিই হোতা–এ ব্যাপারের। রিংয়ে যাচ্ছি আমি
ওরা ঢুকলো এ রকম একটা ভাব নিয়ে যেন জায়গাটা ওদের পৈত্রিক দখল। ওয়ালার ওদের দেখে কাধ মেরে গেল। আমার শরীর বেয়ে এক শীতল শিহরণ নামলো কেন জানি না ওদের দর্শনে।
চলো গলিয়ে নাও জামাটা ওস্তাদ–তোমার খবর শুরু নেবে–পেপি মেলে দিলো বুড়ো আঙুল আমার দিকে। বললাম গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ব্যস্ত আছি, তাকে এখানেই আসতে হবে গুরুর দরকার থাকলে শুনলাম নিশ্বাস রুদ্ধ হতে ওয়ালারেরসন্দিহান হয়ে পড়েছে আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে, মনে হোলো ওর দৃষ্টিতে।
ও–পেপি খেকিয়ে উঠলো, জলদি গলিয়ে নাও জামাটা–পেপি কিছু খাটো আমার চেয়ে, আমার কোনো ইচ্ছে নেই ওর গায়ে হাত তোলার কিন্তু মনে হোলোহাত লাগাতে হবেনা পাল্টালে ওর কথাবার্তার ধরনধারন, তোমরা দুজনেই, এখান থেকে বেরোও বলছি, না হলে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো।
তাহলে দ্যাখো সেই চেষ্টা করেই–অটোমেটিক বেরোলে বেনোর পকেট থেকে, শুনছে আমাদের কথা আমাদের সঙ্গে চলো জামা গলিয়ে, যদি খেতে না চাও গুলিওর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম, বেনোর চোখ দুটো অঙ্গার। ও মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে না বুঝলাম। তুমি চেনোনা ওদের–ঠিক বলেছে ওয়ালারাদ–মৃদু হাসি ফুটলো পেপির ঠোঁটে, তুমি তো চেনোআমাদের, বেনো. তো ফেঁসে আছে গুলি মারার কেসে ও বছরেই তিনটে–না বাড়ালেই ভালো সংখ্যাটা–প্রকাণ্ড ক্যাডিলাক গাড়িটা চোখে পড়লো জামা প্যান্ট পরে ওদের সঙ্গে রাস্তায় নামতেই। অটেমেটিক ধরা বেনোর হাতে। দাঁড়িয়ে ছিলো পুলিসের একটা সিপাই কিছু দূরে, সিপাইটা অদৃশ্য হয়ে গেলো দ্রুতপায়ে রাস্তার মোড়ে বেনোর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই। হাড়ে হাড়ে এবার ব্যাপারটা বুঝলাম।
পরিষ্কার হলো তাও কার খপ্পরে পড়েছি। বসলাম পেপির পাশে দরজা খুলে। পেছনে উঠলো বেনো। মিনিট খানেকও লাগলোনা ওসান হোটেলে পৌঁছতে। একটা লিফটের সামনে এলাম গাড়ি। থেকে নেমে। তিনজনেই ওপরে উঠে গেলাম। কথা নেই কারো মুখে, শুধু তাক করা আমার দিকে বেনোর নলটা। আমরা হেঁটে চললাম একটা লম্বা বারান্দা দিয়ে। আমিও এবং ওরা দাঁড়িয়ে পড়লো একটা দরজার সামনে।
খোদাই করা প্রাইভেট কথাটা দরজার ওপরে। দরজা ঠেলে দিলো পেপি টোকা দিয়ে। একটি মেয়ে অফিস ঘরে টাইপ করে চলেছে। চিবোচ্ছে চিউয়িং গাম। চকিতে উদাস চাহনিতে মেয়েটা তাকালো চোখ তুলে। যাও চলে, ইশারা করলো মাথা হেলিয়ে ভিতরের দিকে, অপেক্ষা করছে উনি–ও পেপির উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বললো। পেপি ঘরে উঁকি দিলো ভেতরের দরজায় টোকা দিয়ে। ঢুকে পড়োপরে আমাকে ইশারা করলো এক পাশে সরে গিয়ে। একটু সামলে কথাবার্তা!
ঢুকলাম। সিনেমার স্টুডিয়োর বাইরে আমি কখনও দেখিনি এরকম সাজানো। হালকা সবুজ রঙা কার্পেটে মোড়া সারা মেঝে। অগণিত হেলান দেওয়া চেয়ার সার সার। আয়না বসানো চারদিকের দেওয়ালে, চোখে পড়ে নিজের প্রতিবিম্ব প্রতিপদক্ষেপেই। পেটেল্লি বসে কনুইয়ের ভর দিয়ে টেবিলের ওপর, আমার দিকে চোখ।
বললো হাত তুলে টেবিলের গজ খানেকের মধ্যে পৌঁছতে, শোনো থোকা একটু মন দিয়ে যা বলছি–পেটেল্লির গলা ঠাণ্ডাকর্কশ, ভাল লড়িয়ে তুমি, পারতাম কাজ করাতে তোমাকে দিয়ে। কিন্তু তুমি চাইছে লড়াই ছেড়ে দিতে।
শুনলাম ব্র্যান্টের কাছে সত্যি কি কথাটা? হু–ভালই লড়ে মিয়ামির এই ছোঁড়াটা তবে ও শিশু তোমার ওই ঘুষির কাছে। যদি আমি না পাই তোমাকে, তাহলে আমাকে ওকেই ধরতে হবে।
ছোকরা এই প্রথম লড়ছে পেলোট্রাতে জেতাতে হবে ওকে–পেটেল্লি ছাই ঝাড়লো সিগারের, লাগিয়েছি দশ হাজার–চলবেনা গুবলেট হলে। সেইজন্যেই ব্র্যান্টকে বলেছি ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে তোমাকে, খেলা শেষ হবে তৃতীয় রাউন্ডে বসে যেতে হবে তোমাকে, মানে হারতে হবে। শুনলাম তোমার নাকি মনঃপূত হয়নি ব্যবস্থাটা। যাক, তোমার মাথাব্যথা ওটা। কিছুই করার নেই আমার তোমার একটাই সুযোগ ছিলো আমার সঙ্গে হাত মেলাবার, কিন্তু তুমি হারিয়েছে সেটা পেটেলি একটু নড়ে বসলো,
তুমি নিশ্চয়ই জেনে গেছে একথা যে এই এলাকা আমার। পেলোট্টার সব চলে আমার কথাতেই।
লোকের খবর নেওয়া যাদের কাজ, এমন কিছু লোকও আছে আমার।
তারা খবর নেবে তোমারও, এখন থেকে নজর রাখা হবে তোমার ওপর যদি ভুল রাস্তায় হাঁটো। চেষ্টা কোরো না নড়বার শহর ছেড়ে আর লড়বে মিয়ামির ছোঁড়াটার সঙ্গে শনিবার।
তবে ওই দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্তই বেশ জমিয়ে। তারপর ওকে ছেড়ে দেবে আমার নির্দেশ এটা–পেটেল্লি ভঙ্গি করল আড়মোড়া ভাঙ্গার, শেষ করে দেওয়া হবে তোমাকে, এদিক ওদিক হলে–
বুঝলেন তো কেন? বান্ধবহীন, বড় নিঃসঙ্গ, রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝেছি। পা বাড়ালাম লিফটের দিকে। বেনোকে দেখলাম রাস্তায় নামতেই উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে। এগোলাম ব্যায়ামাগারের দিকে, বেনো ছায়ার মতো পেছন পেছনচলেছে। সেদিনইনা শুধু, পেপি বা বেনো আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে চললো পরের চারটে দিনই, চোখের আড়াল করেনি মুহূর্তের জন্যেও। ভেবেছিলাম মিয়ামি চলে যাব চুপি চুপি শহর থেকে পালিয়ে। কিন্তু হোলোনা তো আর–চামচে দুটো আমার সঙ্গে আঠার মতো লেগেই রইলো।
রোশ একপলক তাকিয়ে বুঝললো আমার চোখে, বলতে গিয়েও বললো না কিছু একটা, রইলো চুপকরে। ব্র্যান্টকে বলি নি আমার সঙ্গে পেট্টেনির মোলকাতের কথাটা, কিন্তু জেনেছে ও, কারণ সে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে আমাকে।
শুরু করে দিলো প্রহার।
অবশেষে সেই বহুপ্রতীক্ষিত শনিবার দিনটি এলো।
আমার অন্তর ছুঁতে পারছে না রাস্তার জনতার উল্লাস। দেখলাম স্যাম উইলিয়ামস আর টম রোশকে। কোনরকমে একটা দুর্বল হাসি ফোঁটাতে পারলাম আমার ঠোঁটে, ওদের উষ্ণ অভিবাদনের প্রত্যুত্তরে। পেট্টেল্লি ফিগার টেনে চলেছে নির্বিকার মুখে কাটা ঘরের একটা কোণে। পেছনে দাঁড়িয়ে পেপি।
কঠিন রেখার সাক্ষর মুখে। দেখলাম জনতার অভিবাদন নিচ্ছে দাঁত বার করে মোটা চেহারার একটা লোককে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছোকরার ম্যানেজার লোকটা। ঢুকে পড়লাম সাজ ঘরে। জনতার আর এক দফা উল্লাস কানে এলো পোষাক পাল্টানোর ফাঁকে ফাঁকে। সম্ভবত ওই হতচ্ছাড়া ছোঁড়াটা এবারে লক্ষ্য।
দেখলাম বস্তুটিকে উঁকি দিয়ে। তরুণটি বেশ বড় চেহারার। দৃষ্টি নামিয়ে আনলাম ওর হাতের ওপর–মনে হোলো কবজিতে হিম্মত আছে, সামান্য ভারী কোমরটা। আমি বেরোতে সে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো অবজ্ঞার একটা মৃদু হাসি দিয়ে।
পালা শেষ হলো ওজন নেওয়ার। আমার চার পাউন্ড ওজন বেশি ছেলেটার চেয়ে। আমার ইঞ্চি তিনেক বেশি ঘুষিরনাগালও। কি আছে–ওইগুলো পড়েও তত তাড়াতাড়ি যত বেশি দামড়া হয়। ছোকরা তার ম্যানেজারকে শুনিয়ে দিলো কথাগুলো উঁচু গলায়। জনতার সকলে শুনলো।
ধুস। সে হেসে উঠলো হ্যাঁ হ্যাঁ করে। কথা বলো হাত ছেড়ে। ওর দিকে তাকালাম কঠিন চোখে। হলো কাজ। ছোকরা নামিয়ে নিলো হাত। নেবে এলো নিস্তব্ধতা। আবার গুঞ্জন উঠলো আমি ফিরে চলতেই। আমার পিছনে দৌড়ে এলো ব্র্যান্ট।
আরে জনি–কান দিওনা ওর কথায়, আলফাল বকে ও শালা–তাই নাকি এর দাওয়াই জানি আমি। বুঝলাম কি বলতে চাইছে ব্র্যান্ট। সে এই আশংকা করছিলো বাড়বে মারের পরিমাণটা বেশি বাড়াবাড়ি করলে ছোঁড়াটা।
মিথ্যে নয় কথাটা বাগে পেলে একবার–যাই হোক ব্র্যান্ট টাকার প্রথম কিস্তি নিয়ে এলো বিকেলেই। নিয়ে এলাম এ–গুলো, ব্র্যান্ট বলে গেলো অন্যদিকে তাকিয়ে।
খুলে দিলো বাক্সের ডালাটা ভেতরে আছে একটা সাদা সবুজ টাই, একটা তিনরঙা শার্ট রয়েছে রয়েছেসাদা লিনেনের স্যুট। এক কোণে এক জোড়া বাকস্কিনের জুতোও। ফারার তোমাকে এগুলো দারুণ মানাবে। ঠিক হয় কিনা পরে দেখো তো
ওগুলো থাক যেমন আছে, কেটে পড় তুমি
এগোলো এক পা ব্র্যান্ট। আরে, তোমার কি হোলো কি? তুমি তো চেয়েছিলে এই রকমই– সে আমার নাকের সামনে সুটটা মেলে ধরলো।
কেটে পড়, আমাকে উঠতে হবে আবার না হলে–
চেষ্টা করলাম নিজেকে বোঝাবার করার তো কিছু নেই আমার, আমি তো পান করেছি বিষ জেনে শুনেই–লড়াই ছেড়েছি নোংরামি এড়াতে, রিংয়ে ফিরে এলাম তবু আবার, সেই টাকার জন্যেই। ভালো ছিলো মিয়ামিতে ফুটানির স্বপ্ন না দেখলেই বাক্সভর্তি টাকা আর গাড়ি নিয়ে।
কেন ট্যাক্সি, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি আমার গাড়িতেই। পাঁচ মিনিট–রোশ বেরিয়ে গেলো। মোটামুটি গায়ে লাগলো–তবু খুঁতখুঁত করতে লাগলো মনটা।
নিজের গুলো পরা যেত সেগুলো ময়লা না হলে।
তবে মনেপ্রাণে কামনা করছি আপনার জয়–নিজেকে শুনিয়ে বললাম মৃদুকরুণ কণ্ঠে আচ্ছা, তাহলে বেরোনো যাক। অ্যালিস একপাশে সরে দাঁড়ালো দরজা ছেড়ে, আপনি নিশ্চয় ফিরে আসছেন? উত্তর দিলাম অন্যমনস্ক হয়ে। আসছি কি? কে জানে–আসবেন বইকি, ওমা, সে কি কথা। এর গু আছে। ফেলুন তো পকেটে এটা–অ্যালিস আমার হাতে দিলো রুপোর পদক জাতীয় একটা বস্তু। পদকটা ফেলে দিলাম পকেটে।
রাস্তায় পড়তেই দ্রুতপায়ে নেবে, আমার সামনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো পেট্টেল্লির পেন্নায় ক্যাডিলাক গাড়িটা। ব্র্যান্ট পেছনে, বেনো বসে স্টিয়ারিংয়ে। ব্র্যান্ট মুখ বাড়ালো জানলার বাইরে। ভাবলাম তুলে নিই যাবার পথে তোমাকে। ভালো তো শরীর? ভালো। তুমি এগোও, আমি আসছি রোশের সঙ্গে। তুমি যাচ্ছে এই গাড়িতে। তাকালাম, পেছনে দাঁড়িয়ে পেপি, আগুনের টুকরো চোখ দুটো, খোকা তোমাকে কাছছাড়া করছি না লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত
নইলে–ধমকে থামিয়ে দিলাম, থাকো চুপচাপকথাটা আমার অনেকবার শোনা হয়ে গেছে। গাড়ি আর গাড়ি চারিদিকে। এবার বেনোর চাপা গলা পেলাম, পেয়ে যাবো মাল খেলা শেষ হলেই, পেছন দিকে থাকবে গাড়িও, পেট্রোল ভর্তি, ঠিক আছে?
থেকে থেকে কানফাটানো উল্লাস উঠছে। শালা কিছু লোকও হয়েছে–তৈরী হয়ে নাও ফারার–ব্র্যান্ট আমার কানে মৃদুস্বরে বললো। সাজ ঘরের বাইরে শুরু হয়ে গেছে জটলা–গুণ মুগ্ধদের আর সংবাদ পত্রসেবীদের। ব্র্যান্ট ঢুকতে দিল না তাদের ভিতরে, বন্ধ করা গেলো দরজাটা অনেক কসরৎ করে। ওদের সামলাতে পপপি বাইরে রইলো। ওয়ালার অপেক্ষায় রয়েছে আমার। ফিরলাম ব্র্যান্টের দিকে, তোমার দরকার নেই থাকার, দেখতে পারবে সব ওয়ালারই
কিন্তু জনি–আমি তোমাকে এখানে চাই না, রিংয়েও না–ব্র্যান্টকে থামিয়ে দিলাম।
কেন এত গরম হচ্ছো? ঠিক আছে, ঠিক আছে, উপায় তো ছিলো না আমার
আমার দরকার নেই ওসব জানার–তুমি আমাকে ভিড়িয়েছে এই ছেঁড়া ঝঞ্ঝাটে, সে জন্যেই তোমাকে বলছিদূরে থাকতে ব্র্যান্ট ফিরলো দরজার কাছে গিয়ে, ফারার চেষ্টা কোরোনা হিড়িক দেবার, নিষ্কৃতি নেই এ থেকে তোমার।
চেঁচিয়ে উঠলাম– ফোটো।
সে অনেক ক্ষতি করেছে সুস্থ বক্সিং পরিবেশের, করছেও। পূর্বনির্ধারিত লড়াই নয়তো এটাও আর একটা। সবতো জেনেইছে–আর কেন জানবেনাই বা, ব্যাপারটা জানতে বাকি নেই শহরের কারোই। অত টাকা লাগিয়ে বসে আছে ওই ছোকরার ওপর পেট্টেন্নি, তখন আশা করা যায় কি আর? আমাকে লড়াই ছেড়ে দিতে বলেছে তৃতীয় রাউন্ডে। একটা সহানুভূতির শব্দ বেরলল ওয়ালার-এর ঠোঁট থেকে, কিন্তু দোষ নেই মিঃ ব্র্যান্টের; খারাপ নয় লোকটা। নিশ্চয় বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা তার পেট্টেল্লির সঙ্গে টেক্কা দিতে যাওয়াটা। লাশ পড়বে এদিক-ওদিক হলেই। ব্র্যান্টের ছেলে-বৌ আছে তোওসব যেতে দাওআমি পারছি না ওকে সহ্য করতে।
আর আছ তো তুমি–দরকার হবে না কারোরই থাকার যদি লড়াই তিন রাউন্ডেই শেষ হয়ে যায়–ওয়ালারের কথাগুলি কেমন ম্লান শোনালো। আচ্ছা বসলাম উঠে, ধর যদি আমি না হারি ওই রাউন্ডে? যদি প্যাদাই ওই চ্যাংড়াটাকে? তাহলে তোমার জানা আছে কোনো রাস্তা এখান থেকে জীবন নিয়ে বেরোবার? ওয়ালার তাকালো এদিক ওদিক ভয়ে ভয়ে, ভাবটা চুপ, কান আছে দেওয়ালেরও, জনি পাগলামি কোরো না, বের করে দাও ও চিন্তা মাথা থেকে তার চোখদুটো বিস্ফারিত।
আরে দোষ কি ভাবতে! একটু পরে বললাম জানলার দিকে তাকিয়ে কোথায় নামা যায় ওই জানলাটা দিয়ে? জনি মাথা ঠিক রাখো, ওসব ভেবো না একদম কাদো কাঁদো গলা ওয়ালার এর। ওর কথার জবাব না দিয়ে বাইরে চোখ মেলে দিলাম জানলার দিকে এগিয়ে গিয়ে। জানলার নীচে গাড়ি রাখার জায়গাটা মাটি থেকে ফুট তিরিশেক দূরে।
আমার হয়তো খারাপ লাগতো না অন্য সময় এটা পরতে। কিন্তু আজ এটাকে দুর্বিসহ মনে হচ্ছে। আমি বেরিয়ে আসতেই প্রতিপক্ষরা মিয়ামির, ছোকরাকে নিয়ে ঢুকলো বাদ্যভাণ্ডর সমারোহে। প্রবল হর্ষধ্বনি উঠলো ছোকরা রিংয়ে ঢুকতে।
এগিয়ে এলো ব্র্যান্ট, ফারার চলল, এগোনো যাক সামনে আমরা আছি পেছনে চিন্তিত দেখাচ্ছে ঘামে ভেজা ওর সারা মুখ। এগোলাম। বেনো, পেপি, ওয়ালার, ব্র্যান্ট আমার পেছনে। . সারাটা পথ অভ্যর্থনার প্লাবনে মুখরিত হলো। উত্তেজনায় অনেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
ফেরার সময় কল্পনাকরলাম কেমন হবে সম্বর্ধনার ধারাটা। চলে গেলাম নিজের জায়গায় রিংয়ে ঢুকে। হলদে ড্রেসিং গাউন প্রতিদ্বন্দ্বি ছোরার গায়ে কেরামতি দেখাচ্ছে শূন্যে ঘুষি ছুঁড়ে। টুলে বসলাম কানে নিয়ে দর্শকের উল্লাস।
ওয়ালার শুরু করলো দস্তানা পড়তে। আমাকে দেখছে আমার ঘাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে মিয়ামি ছোকরার ম্যানেজার। নাকে আসছে সিগারের ধোঁয়ার সঙ্গে হুইস্কির গন্ধও। রিংয়ের বাইরে তাকালাম মাথাটা সরিয়ে নিয়ে। আর দেখলাম ঠিক সেই মুহূর্তেই বসে আছে দড়ির নীচেই।
মাইকে বকবক করে চলেছে টাকমাথার ঘোষক, কিন্তু কিছুই ঢুকছে না আমার মাথায়। সে যখন আমার পরিচিতি দিচ্ছে শুনছিনা আমি তখনও–ওয়ালার দাঁড় করিয়ে দিলো আমাকে ঠেলে কানে তালা লাগানো চিৎকার আরও একবার উঠলো। আমি চোখ সরিয়ে নিতে পারছি না ওই মহিলাটির ওপর থেকে। আঙুলে আঙুলে ঠেকে যাবে ও যে হাত বাড়ালে এতো কাছে বসে।
জীবনে দৃষ্টি দিয়েছি অনেক নারীর ওপর। বাইরে এবং চলচ্চিত্র জগতে। কিন্তু কখনও তো চোখে পড়েনি এমনটি। সিঁথি কাটা চকচকে কালো চুলের মাঝ বরাবর প্রায় চোখেই পড়ে না এতো সূক্ষ্ম যে। চোখ দুটো ঝকঝকে। কেমন একটা জেল্লা মসৃণ গায়ের চামড়ায়। আমন্ত্রণের আভাস পুরু ঠোঁটে।
নানা বয়সের আরও তো কত মহিলা বসে রিংয়ের বাইরে নানা ভঙ্গিমায় সকলের অঙ্গেই সান্ধ্য সাজ, কিন্তু যেন ওকে অনন্যা মনে হচ্ছে ওর আপেল রঙা ফিকে সবুজ লিনেনের স্কার্ট আর রেশমী রাউজে। সাধারণের থেকে ওর উচ্চতা কিছু বেশিই হবে মালুম হয়।
ওর–চওড়া কাধ আর তন্বী পা দুটো থেকে আমার দৃষ্টি চলে গেলো ওর সজ্জার গভীরে। বেমালুম ভুলে মেরে দিলাম পেট্টেল্লির ব্যাপারটা। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তেজনা থরথর দৃষ্টিতে। শুকিয়ে গেলো আমার ঠোঁট ওর চাহনিতে, দ্রুততর হলো হৃৎস্পন্দন। ওর চোখের ভাষা প্রাঞ্জল মঠের সন্ন্যাসীর কাছেও, আর মঠের লোক তত নই আমি। তোমার কি হলো কি?
মনে হচ্ছে দেখেশুনে ময়ুরের মতো নাচে হৃদয় আমারওয়ালার শেষ করলো দস্তানা পরানো।
হয়তো তাই কথাগুলো বললাম মেয়েটির দিকে মৃদু হেসেই, ও ফিরিয়ে দিলো হাসি–ভরপুর হাসিতে অন্তরঙ্গতার আমেজ। সঙ্গে কেউ আছে কিনা পাশের লোকটার দিকে চোখ ফেরালাম যাচাইয়ের জন্য এক বিত্তবান সঙ্গী চোস্ত স্যুটে মোড়া–মোটামুটি বলাচলে সুপুরুষই।
আমার কৌতূহলী চাহনির প্রত্যুত্তরে ক্রোধের বিস্তার দেখলাম অপ্রশস্ত চিবুকে। আরে ওঠো, অপেক্ষা করছে তো রেফারী। ওয়ালার ঠেলা দিলো আমাকে আলতো হাতে। হ্যাঁ। মিয়ামির ছোকরাটাও অপেক্ষারত। দাঁড়ালাম রিংয়ের মাঝে গিয়ে।
দোস্ত কুছ পরোয়া নেই, অতক্ষণ তোমাকে পড়ে থাকতে হবে না কোণা আগলে, এক্ষুনি তোমাকে ঝাড় দেবেনা–দাঁত বের করলো ছোকরা। রেফারী এবার তৎপর হলো, আচ্ছা ভাই শুনে নিন এবার কাজে নামা যাক মস্করা ছেড়ে…তার প্রাক্ লড়াই ফিরিস্তি শুরু হলো। যা আগে অনেকবার শুনেছি।
ওয়ালার ছাড়িয়ে নিলো আমার গাউন। তাকালাম শেষবারের মতো রিংয়ের বাইরে, দেখার জন্যে ওকে। ও সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে–ওর অনেক প্রত্যাশা জ্বলজ্বলে চোখে, মুছে দিতে হবে ওই নোংরা হাসি ওর মুখ থেকে দিতে হবে শিক্ষা–মানবী বললো ফিসফিসিয়ে।
সঙ্গের লোকটা শান্ত করলো ওর কাঁধে হাত রেখে। অধৈর্য হাতে মেয়েটা তার হাত ঝেড়ে ফেলে দিলো, আমার শুভেচ্ছা রইলো–ওর গলা পেলাম নরম রিনরিনে। ধন্যবাদ–বললাম ওর চোখে চোখ রেখে। দাঁড়িয়ে গেলো আমাদের মাঝখানে ওয়ালার মরীয়া হয়ে, আরে নজর দাও তো লড়াইয়ের ওপর
বাজলো ঘণ্টা। মিয়ামির মস্তান তার কোণ থেকে বেরিয়ে এলো দ্রুতপায়ে। সেই চ্যাংড়াহাসির প্রলেপ মুখে তার। ওই–ই প্রথমে হাত চালালোবাঁ হাত, মার ফসকালে অল্পের জন্য। ডান হাত বাড়ালো ছোকরা–এবার ফাঁকা গেলো এটাও। ওর একপাশে আস্তে আস্তে সরে গেলাম। খুঁজছি। মওকা, ওর ছটফটানি কমাতে একটা মোটা মার দিতে হবে। আচমকা একটা মার পড়লো আমার। মুখে। সঙ্গে সঙ্গে দুহাতে কয়েকটা ঘুষি মারলাম ওর পেটে। আবার আমার মুখে একটা ঘুষি পড়লো ওর বাঁ হাতের ছোঁড়াটা সঙ্গে তুলেছিলো ডান হাতটাও, কিন্তু সেটা কোনোরকমে এড়িয়ে গেলাম। ও এগিয়ে এলো আরো, ওর পায়ের কাজ অনেক দ্রুত আমার চেয়ে, মার পড়লো আরো কিছু আমার পাঁজরায়। ওকে এবার জড়িয়ে নিলাম। রেফারী এগিয়ে এসে আমাদের ছাড়িয়ে দিলো।
হাসলাম মনে মনে, ব্যাটার শিক্ষা হয়ে গেছে প্রথম দাওয়াইতেই। দুজনে আবার জড়িয়ে পড়লাম, ঘুষিও খেলাম পাঁজরায় একটা। ঘন্টা পড়লো। নিজের কোণে সরে গেলাম। বাইরে তাকালাম। ওয়ালার পরিচর্যা শুরু করেছে। আর আমন্ত্রণের ইশারা নেই মেয়েটার চোখে, ক্রুদ্ধ তিরস্কার দুচোখে। চাপা অভিমান ঠোঁটে। ফাঁকি দিতে পারে নি আমার অভিনয় ওর চোখকে। বুঝলাম। ওয়ালার ঠাণ্ডা জলের ছিটে দিলো আমার মুখেচোখে। আমার মন কোথায় হারিয়েছে ও বুঝেছে।
আড়াল করে দাঁড়ালো সে; বললো ঘুরে এসে মেয়েটাকে, কি শুরু করেছে? ব্র্যান্টও এলো। ছোঁড়াটাকে ওভাবে মারলে কেন? মারবো না কেন? ও শালা লড়তে এসেছে নাকি? বলছে পেটেল্লি–পেটেল্লি চুলোয় যাক–ওর কথা কেটে দিলাম। ঘণ্টা পড়লো শুরুর ঘোষণা দ্বিতীয় রাউন্ড। দাঁড়ালাম উঠে। উঠলো মিয়ামি থোকা, ও সতর্ক চোখে পায়ে পায়ে এগোলো আমাকে জরীপ করে। সেবা হাত উঁচিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমাকে ফারাকে রাখার। কিন্তু বেশিনাগাল, একটা ঘাড়ের পাশে আর একটা মুখে, দুটো, দিলাম কষিয়ে। ছোকরা গরম হয়ে গেলো, পাটা চালালে সেও.. কয়েক সেকেন্ড দুজনে জড়িয়ে পড়লাম। বে–রে করে উঠলো দর্শকরা, মুক্ত করে নিলো থোকা নিজেকে; একটা হুক চালালাম ও সরে যাবার আগে। সৃষ্টি হলো একটা ক্ষতের, রক্ত পড়ছে ডান চোখের নীচে। ও লাফিয়ে পিছিয়ে গেলে একটা খিস্তি দিয়ে। ওরই মধ্যে কাজ চালিয়ে গেলাম দুহাতে। ছোকরা ঠেকা দিয়ে চললো বাঁ হাতে চোখ সামলে।
এবার পেটে মারলাম আরো এক পা এগিয়ে। এবার বোধহয় ছোকরার জয়ের ব্যাপারটা খুব সহজসাধ্য মনে হোল না। তাই সে এবার দৌড়ে এলো মরীয়া হয়েই। একটাক জমার্লো সর্বশক্তি দিয়ে সপাটে আমার মুখে। আমার মাথা ঘুরে গেলো।
ছিটকে গেলাম পেছনে। বাঁহাতে ঘুষি চালালাম পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে। কিন্তু ওতো বুঝে নিয়েছে আমার অবস্থা। ও এগিয়ে আসতে লাগলো…ওর হাতটা নেমে আসার সময় আমার মুখের ওপর, ঘুষি মারলাম ওর অরক্ষিত মুখ লক্ষ্য করে; মারটা পড়লো চোয়ালে। হাঁটু ভেঙ্গে মস্তান মাটিতে পড়লো। আবার ঘণ্টা বেজে উঠলো রেফারী গুনতে শুরু করার মুহূর্তে। ছোকরার লোকেরা এসে ওকে ওর জায়গায় তুলে নিয়ে গেলো। টুলে বসতে যাবো নিজের জায়গায় ফিরে, গলা পেলাম পেপির। হ্যাঁকোড়বাবু কিন্তু পরের রাউন্ডেই। যেন মনে থাকে–এখান থেকে সরে যাও। ওয়ালারও চমকে উঠলো আমার গলার আওয়াজে। ওয়ালার স্পঞ্জ করতে লাগলো আমার মুখ পেপিকে সরিয়ে দিয়ে। ভারী হয়ে এসেছে ওর নিশ্বাস উত্তেজনায়। হচ্ছে ভালোই।
নজর রাখো ওর ডান হাতটার ওপর ব্যাটা মারতে পারে ওই হাতেই। তাকালাম রিংয়ের অন্য প্রান্তে, খাটছে পাগলের মতো ছোকরার লোকগুলো। স্মেলিং সল্ট একজন ধরেছে নাকের কাছে, কাঁধের পাশে আর একজন দলাইমলাই চালিয়েছে।
কি বলো তাহলে শেষ হয়ে এলে লড়াই? একটা রাউন্ড আর–। হু যাক–সকলের কাছে মনে হয়েছে তো লড়াই বলেই, তুমি কাউকেই ঠকাওনি।
ওয়ালার বললো মৃদু গলায়। এবার চোখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালাম রিংয়ের বাইরেও হাসছে। স্বাগত জানালো আমাকে হাত তুলে। বাজলো শেষ ঘণ্টা।
দাঁড়ালাম উঠে। মনে হচ্ছে পরিশ্রান্ত, অনভ্যাস অনেকদিনের। দুপা এগোতেই এবার ছোকরা রক্ষণাত্মক কায়দায় লড়ছে। লক্ষ্য করলাম ছড়ে গেছে নাকের পাশে, ক্ষত চোখের নীচে, অসংখ্য লালচে দাগ পাজরায়। কোণায় ঠেলে নিয়ে একটা প্রচণ্ড ঘুষি মারলাম ওর রক্তঝরা নাকের ওপরই। আবার শুরু করলে রক্ত পড়তে ঝলকে ঝলকে। হয়তো ও পড়েই যেতো আমি না ধরলে। বলে দিলাম কানে কানে দাঁড় করিয়ে দিতে দিতে ঠিক আছে মারো কষে পেলুবাবু। ছেড়ে দিয়ে সরে গেলাম।
ছোকরা হাওয়ায় বাঁ হাত ছুঁড়লো। মুখোমুখি হলাম এবার সুযোগ দিয়ে ওকে মারবার। একটা আপার কাট আমার চোয়ালে বসালো কোনো রকমে, বসে গেলাম হাঁটু ভেঙ্গে। আমার লাগেনি খুব বেশি কিন্তু আমাকে তো হারতে, হবে এই রাউন্ডেই, কাজেই দরকার তার প্রস্তুতি। শুনতে পাওয়া যাচ্ছে সম্ভবত মিয়ামি থেকে এবারের গণউল্লাস। রেফারী গুনতে শুরু করলো আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে। আড়চোখে তাকালাম ছোরার ওপর। ওর চোখেমুখে স্বস্তির ভাব। দাঁড়িয়ে আছে হেলান দিয়ে দড়ির ওপর। কাঁপছে হাঁটু, ঝাঁকিয়ে নিলাম মাথাটা। চোখে দেখছি সরষে ফুল ভাবটা যেন। খাড়া হয়ে গেলাম ছয় গোনর সঙ্গে সঙ্গে। চোখে চোখ পড়লো ছোকরার। পটে লিখা ওর মুখটা যেন।
আমি আর উঠবো না ছেলেটা নিশ্চিন্ত ছিলো, তাই ও দুপা পিছিয়ে গেলো আমি উঠতেই। আরও একবার চিৎকার উঠলো দর্শকের। এবার সে উল্লাসে বিদ্রুপের ছোঁয়া। ওকে চেষ্টা করলো উত্তেজিত করার ছোকরার সমর্থকরা। ও এগিয়ে এলো ঘোর অনীহায়। পেছোলাম–শুরু হলো আমারও অভিনয়। আমি ফেরত দিলাম মার সঙ্গে সঙ্গে ও বাঁ হাত চালাতে। মিয়ামির ছেলেটা ক্ষিপ্ত হলো যন্ত্রণায়। আগুনের টুকরো যেন চোখ দুটো। আবার পড়ে গেলাম মার খেয়ে। পেলাম তাই যা চেয়েছিলাম। বেশ ছিলাম প্রথম কয়েক মুহূর্ত–চোখ মেলোম আতে। পড়ে আছি মুখ থুবড়ে। পাশ ফিরে দৃষ্টি ফেরালাম। রিংয়ের বাইরে। উঠেদাঁড়িয়েছে আমার প্রেরণা, অজস্র ধিক্কার নিয়ে বিস্ফারিত চোখেও চেঁচিয়ে উঠলো চোখে চোখ মেলতেই। ওঠো লড়ে যাও উঠে, কেঁচো কোথাকার! এতো কাছে ও আমার, ছোঁয়া যায় হাত বাড়ালেই। উঠে পড়েছে আশে পাশের মানুষও–ধিক্কার তাদের কণ্ঠেও, কিন্তু আমি তো শুনছি শুধু ওর কথাই। জেনি ওঠরাস্তা নেই। আর ফেরার
ও বিকৃত গলায় বলে উঠলো। ক্রোধে ওর চোখে, হতাশা আর ধিক্কারের ছায়া–একের পর এক। আমার সারা শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ–চেয়েছিলাম এই তো। আমার কথা তো ছিলো না পেট্টেল্লির কথায় চলার, প্রেরণার মুখ বিকৃতিই পথ বাতলে দিলো আমার। শুনতে পাচ্চি রেফারীর গলা, সংখ্যার অনুরণন ভেসে আসা যেন কত দূর থেকে সাত–আট…উঠে পড়লাম কোনোরকমে ছোঁড়াটার হাত বাঁচিয়ে ও এগোতেই আর এক পা, দস্তানার বাঁধনে জড়িয়ে ধরলাম ওকে মৃত্যু আসে আসুক। ছেলেটা ব্যর্থ প্রয়াস চালালো অক্টোপাশের বাঁধন থেকে মুক্ত হবার…আমার মন ফাঁকি দিতে চাইছে পেট্টেল্লিকে। হারছেও–ওকে মরতে হবেআমাকে মারতে না পারলে। আমার আর দরকার কটা সেকেন্ড হালকা করার জন্য মাথাটাকে। সজোরে ঘুষি কলাম বাঁ হাতে বাঁধনমুক্ত হবার আগে।
মিয়ামির সেরা লড়িয়ে তেড়ে এলো হিংস্র শ্বাপদের পায়ে…কিন্তু আর তো পাবে না আমার নাগাল, ব্যাটাকে খেলিয়ে চললাম…তিনবারের পর চতুর্থ বারে ডান হাতে সোজা হুক চালালাম আমার আওতায় পেয়ে–ছেলেটা ছিটকে পড়লোকাটা পাঁঠার মতো, রক্তে লাল সারা মুখ। না, সাড়া নেই কোনো মিয়ামির ছেলে অনড় পড়ে আছে। অনেক আশার ধন পেট্টেল্লির।
ব্যাপারটা বুঝলো রেফারীও, তবু ত্রুটি নেই তার কর্তব্যে। শুরু হলো গোনার পালা..শেষও হলো…কিন্তু পড়ে রইলো মাটি আঁকড়েই প্রতিদ্বন্দ্বী। আমার হাতটা তুলে নিয়ে রেফারী এগিয়ে এসে ঘোষণা করলো ফ্যাকাশে মুখে, বিজয়ী–ফারার আজকের লড়াইয়ে। কাঁপছে ওর হাত।
আমার চোখ চলে গেলো রিংয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়েছে মানবী, উত্তেজনায় উথাল–পাথাল তার ভরা বুক–চুম্বন ছুঁড়ে দিলো আমার দৃষ্টি মিলতেই।
তৎপর হলো কাগজ আর ক্যামেরার লোক আর দেখতে পেলাম না ওকে। এগিয়ে এলো ভিড় ঠেলে পেট্টেল্লি চাপা হাসি ঠোঁটে। তাকালাম চোখেরদিকে–সেখানে দেখা দিয়েছেআগুনের হলকা, ফারার সাবাশ–কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যাবে তোমার প্রাপ্য–ছোকরার ম্যানেজারের দিকে পেট্রেন্নি সরে গেলো। আমার কাঁধে ফেলে দিলো ড্রেসিং গাউনটা ওয়ালার নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে।
পেপিকে দেখতে পেলাম রিংয়ের বাইরে বেরোতে দাঁড়িয়ে মুখে নরকের হাসি নিয়ে। লোকের ভিড় আমি নিশ্চিন্ত সাজঘরে যতক্ষণ থাকবে কিন্তু সরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা–আর পারছি না ভাবতে..ওয়ালারও সঙ্গেই সাজঘরে ফিরছিলো, বারবার ভয়ার্ত চোখে তাকাতে লাগলো দরজার দিকে পরিচর্যা পর্ব শেষ হতেই। এসেছিলো টম রোশও, কিন্তু থাকতে দিলাম না ওকে বেশিক্ষণ–আমি চাই না আমার জন্য ও বিপদে পড়ুক। ঘরে জটলা চলছে কাগজওলা আর গুণমুগ্ধদের–ওরা আলোচনায় মুখর কে কবে জোরালো মার দিয়েছে হেভীওয়েট লড়াইয়ে, আর কারও দৃষ্টি নেই আমার ওপর। ওয়ালারের দিকে ফিরলামটাইয়ের গিট দিতে দিতে, অনেক ধন্যবাদ ভাই ওয়ালার–তুমি এবার এসো–মুছে নিলো ঘামচপচপে মুখটা হাতের উল্টোপিঠে অতিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটা। জনি সব করতে পারি তোমার জন্য সে গলা নামিয়ে দিলো, জলদি সরে পড় এখান থেকে–ওরা একা পেলে তোমাকে…তোমার কিন্তু উচিত হয়নি ওটা করা।
কোনটা? কি হয়নি উচিৎ। আমার হাত থমকে গেলো গিটে। আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নামছে সেই হীমশীতল অনুভূতি–তাকালাম ফিরে কালো হরিণ চোখ সেই বেশে দাঁড়িয়ে আছে চোখে চোখ রেখে আমার। জনি তোমার কি করা উচিৎ হয়নি। মেয়ে আবার প্রশ্ন রাখলো।
ওয়ালারকে যেতে দেখলাম লঘুপায়ে ঘর ছেড়ে। স্তব্ধ জটলার কাকলি–ক্ষুধার্ত চোখে মেয়েটাকে ওরা লেহন করছে। বলে উঠলো ওদের একজন, চলো হে, সরে পড়া যাক–মনে হচ্ছে আমাদের প্রয়োজন নেই থাকার সাহেবের কাছে। ফোয়ারা ছুটলো হাসির মানুষগুলো যেন মজার কথা জেনেছেদুনিয়ার–ওরা একে একে বেরুলো। নৈঃশব্দনামলে সারা ঘরজুড়ে। বললাম বেশ খানিক পরে কি খবর। টাকা পেলেন বাজির?
তাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মনে হয়েছে।
তাহলে তাকেই তো আপনার জানিয়ে দেওয়া উচিৎ সেটা জানেন তো মেয়েরা স্তুতি পছন্দ করে। ঠোঁটে ওর দুষ্টু হাসি। বলছি তো তাকেই–সত্যি! বিস্তৃত হলো হাসি। কিন্তু শান পড়লো চোখে তোষামোদের কথা ওটা, ওসব বিশ্বাস করি না আমি, আর–লড়াইয়ের ব্যাপারটাও আমার সাজানো মনে হোলো। আপনি কি বোঝেন লড়াইয়ের? চেষ্টা করলাম হাসবার বুঝি। প্রায়ই আমি দেখতে যাই এখানকার লড়াইকাজেই, নতুন কিছু নয় এ ব্যাপার আমার কাছে–ঘটানো হয়ে থাকে ওগুলো, বললো একটু চুপ করে থেকে তা কেন মত পাল্টালেন?
ওই মেয়েটার জন্য, তাদের কথা ভেবে–আর বাজি ধরেছে কারা আমার ওপর। মেয়েটা তাহলে জায়গা জুড়ে রয়েছে দেখছি আপনার বুকের অনেকখানি
পূর্ণদৃষ্টি মেলে দিলো আমার দিকে, ভালো লাগছে আপনাকে আমার, হঠাৎ আমার খেয়াল হলোহাতে নেই তো সময়, আর কেটে পড়া দরকার ভীড় থাকতে থাকতে। বেরোতে গেলে ও–ভাবেই বেরোতে হবে পেট্রেন্নির চ্যালা দুটোর চোখে ধুলো দিয়ে কিন্তু বেরোতেই মন চাইছে না এই মুহূর্তে ঘর ছেড়ে।
আচ্ছা কে আপনি? বলুন তো এখানে এসেছেনই বা কেন? ওর চোখে তাকালাম। ও ভাবছে কি যেন, ব্যস্ত হবার দরকার নেই আমি কে তা নিয়ে–আমাকে ডাকবেন ডেলা বলে। এখানে এসেছি আমি জেনেই বিপদে পড়েছেন আপনি, এবং এর জন্যে দায়ী আমি। ঠিক বললাম তো? ঝিলিক উঠলোকালোহরিণ চোখে। হ, তা আর কি করবেন তার আর আপনি, না মানে–জানতে পারি বিপদটা কি ধরনের? আমার পিছু নিয়েছে দুটো মস্তান ধরতে পারলে–বুঝেছি খপ্পরে পড়েছেন পেট্রেন্নির–তাকে আপনি চেনেন? চমকে উঠলাম, কে না জানে ওরকথা? ওরনামটাই জানি আমি অবশ্য–প্রবৃত্তি বা ইচ্ছে নেই পরিচয় করার কিন্তু সময় নষ্ট করছি আমরা বোধ হয়, বের করে নেওয়া দরকার আপনাকে এখান থেকেও বাইরে তাকালো জানলার দিকে এগিয়ে।
আপনি এই জানলা দিয়ে নেবে নিশ্চয়ই যেতে পারবেন ওই গাড়ি রাখার জায়গা পর্যন্ত? অনুসরণ করলাম ওর দৃষ্টি। সেখানে এখনোদাঁড়িয়ে দু–চার খানা গাড়ি। আমার প্রথম সারির গাড়িটা ডান দিকের দ্বিতীয়–ডেলা দেখালো হাত বাড়িয়ে। আপনি ওখানে পৌঁছাতে পারলেই নিরাপদ সবার নজর এড়িয়ে।
দাঁড়ান আপনাকে জড়াতে চাই না এর মধ্যে বিপজ্জনক এই লোকগুলো করবেন না বোকামি জানতে পারবেনা ওরা–কিন্তু বাড়াবেননাকথা, আমি ফিরে যাচ্ছি গাড়িতে। এগোলো ডেলা, বন্ধ করে দিন দরজাটা নামতে শুরু করবেন আমি গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলে। গাড়ি চালিয়ে আসবো আমি, উঠে পড়বেন আপনি। কিন্তু এতে বোধহয় খুশি হবেন না আপনার বন্ধু, আর আপনার অপেক্ষায় রয়েছেন বোধহয় উনি; আঙুল বাড়িয়ে লোকটার দিকে দেখালাম, গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো।
লোকটাকে মনে হলো অধৈর্য। ডেলা ঠোঁটে, নিরস হাসি ফোঁটালো ও আমার স্বামী, বন্ধু না–ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলে দরজার দিকে, আমার লাগবে না পাঁচ মিনিটও কাউকে এখানে ঢুকতে দেবেন না–ডেলা অদৃশ্য হয়ে গেলো আমি মুখ খোলার আগেই। দরজা বন্ধ করে দিলাম ও বেরোতেই।
আমি একা, এখন একা। ফিরে গেলাম জানলায়। পায়চারী করছে ডেলার স্বামী। ধরালো একটা সিগারেট চমকে উঠলাম পেছনে একটা শব্দ হতেই। চোখ পড়লোদরজার হাতলের ওপর–চেষ্টা করছে কেউ ঘোরাতে–ঘুরল না হাতলধাওয়া শুরু করেছে ওরা। আমার দর্শনের জন্য ব্যাকুল … হয়েছে স্টেডিয়াম ফাঁকা হতে। বাইরে সপ্তমে উঠেছে নাচের বাজনা। যথেষ্ট সোচ্চার।
দরজার ছিটকিনিটা দেখলাম সন্তর্পণে এগিয়ে, মনে হলো না খুব পোড়, কানে এলো বাইরে ফিসফিস কথা ও দুর্বোধ্য ভাষা; কিন্তু ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে গেলো তাতেই আমার। দরজার দিকে গেলাম ম্যাসাজের টেবিলটা টেনে নিয়ে, মনে ভয় ঢুকেছে। ওরা অনেক ভালো জানে আমার চেয়ে স্টেডিয়ামের আনাচ–কানাচ। জানে আমার পক্ষে শক্ত হবেনা জানলা দিয়ে নেবে পালানো। আমাকে নীচে খুঁজবেদরজা খোলার চেষ্টা ব্যর্থ হলে। ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেবে গাড়ি রাখার জায়গায় হাজির হবে তিন–চার মিনিটের মধ্যেই, নামতেও শুরু করেছে বোধহয়–কিছুকরা দরকার এখুনি। দরজার ওপর শারীরিক প্রয়োগের শব্দ উঠলো জানলার ওপর পা চড়িয়ে দিতেই। কার্নিশে নেমে গেলাম, ফিরে তাকালাম না। পা পিছলে গেলো পাইপে পৌঁছবার আগেই শুন্যে উঠে গেলো শরীরের বেশ কিছুটা অংশ।
তারই মধ্যে নখ বসালাম অসমতল ক্ৰংক্রীটের দেওয়ালে কোনোরকমে। পা ফিরিয়ে আনলাম কার্নিশে কোনোরকমে। নামতে লাগলাম এগিয়ে পাইপ লক্ষ্য করে। লাফিয়ে পড়লাম মাটিতে, মাটি থেকে ফুট দশেক ওপর থেকে। শব্দ উঠলো গাড়ির ইঞ্জিন চালু হবার দ্রুতগামী পায়ের আওয়াজও সেই সময়। থমকে গেলাম গাড়ির দিকে ছুটে যেতে গিয়ে অনেক নিরাপদ এখানকার দেওয়ালের ছায়া, আলো ঝলমল গাড়ি রাখার জায়গাটা।
নেভানো হেডলাইট গাড়িটা এগোচ্ছে আমার দিকে। আমার ডান পাশটা স্বল্পালোকে নজর পড়লো–পেপি নিশ্চল দাঁড়িয়ে একশো গজ দূরে আমার থেকে তার চোখ স্থির সাজঘরের জানলায়। আওয়াজ উঠলো একটা প্রচণ্ড। ভেঙ্গে গেলে সাজঘরের দরজা কমে এলো গাড়ির গতি ডেলার গলা পেলাম আমার সামনে আসতেই, শীগগির উঠে পড়ুন।
উঠে বসতেই গাড়িটা বিদ্যুৎগতিতে এগোলো একটা ঝাঁকি দিয়ে। ডেলা হাত দিলো হেডলাইটের বোতামে, দেখতে পায় নি তো আপনাকে? বলতে পারছি না ঠিক–তাকালাম পেছনে। পেছনেবসে কালো চুলো লোকটা। ডেলা পরিচয় দিয়েছেযাকে ওর স্বামীবলে। অন্ধকারে ঠাহর হচ্ছে না ওর মুখটা। চোখ মেলে দিলাম লোকটার মাথার পেছনে, না, চিহ্ন নেই কোনো অনুসরণ কারী গাড়ির। এখনো পিছু নেয়নি ওরা কেউ–এবার ফেটে পড়লো ডেলার স্বামী। মাথা খারাপ হয়ে গেছে ডেলা তোমার। দরকার নেই যাবার এই সব উটকো ঝামেলার মধ্যে, নামিয়ে দাও এ লোকটাকে। হেসে উঠলো ডেলা। পেলে তুমি বসো তো চুপচাপ, শেষকরে দিতে চাইছিলো ওকে ওরা। আর এটা হতে দেওয়া যায় না এক হাজার ডলার জেতার পর।
বোকা মেয়ে, সব সময়ই মাথা গলাবেই একটা না একটা ঝাটে–লোকটা স্বগতোক্তি করলো। আবার ডেলা হেসে উঠলো, দারুণ রোমাঞ্চকর আমার কাছে এর প্রতিটি মুহূর্ত। ঠিক আছে আসনে গা এলিয়ে দিলো একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে লোকটা, তাহলে জলদি বেরোও এ নরক থেকে, গরে একে ছেড়ে দিও রাস্তায়–ডেলা আমাকে আড়চোখে দেখলো।
আমার গায়ে একটা ঠেলা দিলো ডেলা, ওকে সে কথা বলতেই হতে পারে, শুয়ে পড়ুন তো আপনি নীচে। আরও কয়েকখানা গাড়ি আমাদের আগে, লাইন ধরে এগোচ্ছে ধীরে–ডেলাকে চলতে হচ্ছে পেছন পেছন মৃদু গাড়ির গতি। দেখুন, উঁকি দিচ্ছে সব গাড়িতে ব্যাটারা। বেরোলে পরে অন্য গাড়িগুলো। শেষ হলোনা ওর কথা, পল বলে উঠলোবিকৃতগলায়, গাড়ি আসছে পেছনে একটা দারুণ জোরে। নেমে যাই বরংআমি–চুপ। ডেলা জোর করেনামিয়ে দিলো আমার মাথাটা কথা থামিয়ে দিয়ে, বলছি যা করুন–ডেলা তাকালো পেছনে।
আমি মুখ নামাতে চোখ আটকে গেলো ডেলার নিটোল পায়ের গোছে–জুতোয় মোড়া সাদা বাস্কিন চামড়ায়। পেছনের গাড়ি মারতে শুরু করেছে হেডলাইট। পেছন থেকে হর্ন বেজে উঠলো ডেলা গতি কমাতে।
কেন থামাচ্ছো–চালিয়ে যাও মাঝরাস্তা দিয়ে পলের অধৈর্য গলা। গেট সামনে। মাথা তুলবার চেষ্টা করলাম গাড়ির গতি বাড়তেই, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেলো পাহারাদারদের একজনের সঙ্গে, অ্যাই এক মিনিট উত্তেজিত গলায় সে গাড়ির হাতল ধরে ফেললো কথাগুলো ছেড়ে দিয়েই। আমি হাতল ধরে রাখলাম প্রাণপণ শক্তিতে, খুলল না দরজা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডেলা পায়ের চাপ বাড়ালো অ্যাকসিলারেটারে; স্পিডোমিটারের কাটা নব্বইয়ের ঘরে উঠলো কাঁপতে কাঁপতে, বিরানব্বই, তিরানব্বই, চুরানব্বইতে করতে লাগলো লটপট। তীব্রতা কমছে পেছনে আলোর দূরত্ব বাড়ছে দুটো গাড়ির। আর পাচ্ছে না ওরা আমাদের।
রাস্তায় জোয়ার এলো আলোর। আরে সামনে বাঁক আছে, দেখে চালাও। গতি একটু কমাও না, পল চেঁচিয়ে উঠলো, ক্ষিপ্ত গলায়। সে ঝুঁকে বসেছে।
আঃ, কোরো না তো, গলা চড়ালো ডেলাও। তাকালাম আবার ফিরে। খুব পেছনে পড়ে নেই পেছনের গাড়ি, মনে হোল দুশো গজের মধ্যেই। বাঁকের মাথায় ডেলাকে কমাতেই হোলো গাড়ির গতি, পেছন থেকে অনেক কাছে এসে গেলো বিশাল ক্যাডিলাকটাও।
ডেলা জুড়ে রেখেছে রাস্তার মাঝখানটা, কাটা ওঠা নামা করছে সত্তরের ঘরে; গতি অনেক বেশিই বলা যায় এরাভার তুলনায়। সামনে গাড়ি সাবধান। সামনে এগোতে দেখে ককিয়ে উঠলাম। বাঘের জলন্ত চোখের মতো দুটি হেডলাইড। ডেলা পা সরিয়ে নিলো আলো নিভিয়ে দিয়ে অ্যাকসিলারেটার থেকে। বাদুরের মতো গাড়িটা এগোচ্ছে পাখনা ঝাঁপটে। পেছনে আওয়াজ পেলাম ব্রেক কষার–তাকালাম, থেমে গেছে ক্যাডিলাক। আমাদের গাড়ি ডাইনে ঘুরলো একটা ঝাঁকুনি দিয়ে।
চোখ ফেরালাম সামনে রাস্তার মাঝবরাবর গাড়ি একেবারে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায় আমাদেরই ওপর চোখ ধাঁধানো আলোর সম্ভার নিয়ে আরো ডাইনে সরলো ডেলা–লাফিয়ে উঠলো পেছনের চাকা দুটো। ডেলা স্টিয়ারিং নিয়ে প্রচণ্ড কসরৎ চালালো। সোজা রাখার জন্য গাড়ি। কিন্তু আমাদের যেন দেখতেই পাচ্ছে না সামনের গাড়িটার চালক–চিৎকার করে উঠলো পল–গাড়িটা বেরিয়ে গেলো বেন্টলের গা ছুঁয়ে। কানে এলো ডেলার আর্তনাদ–সামনের ঝোপে গিয়ে পড়লো মড়মড়িয়ে অন্য গাড়িটা।
আমি আঁকড়ে ধরলাম ড্যাশ বোর্ড শূন্যে উঠতেই। আমাদের গাড়িটা মাকড়সার জাল হয়ে গেলো কাঁচ ভেঙ্গে। শব্দ উঠলোকাঠ ফাটার। প্রবল ঝাঁকুনি। একটা সাদা আলোর ঝলকানি। একটা তীব্র আর্তস্বর ভেসে আসছে ডেলার। এসবের মধ্যে মিলিয়ে গেলো আলোআমার চোখে নেবে এলো আঁধার। আয়োডফর্ম আর ইথারের গন্ধে আমি হাসপাতালে মালুম হলো। পারলাম না চেষ্টা করেও চোখের পাতা খোলবার, পাতা ভারী হয়ে আছে।
.