পটাশগড়ের জঙ্গলে – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
জয়পতাকাবাবুকে দেখে কিন্তু মোটেই বীর বলে মনে হয় না। তিনি ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলের নামকরা অঙ্কের মাস্টারমশাই। কোঁচানো ধুতি, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে গোল রোল্ডগোল্ড ফ্রেমের চশমা, মাথার মাঝখানে চেরা সিঁথি, পায়ে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সবসময়ে সাদা মোজা আর পাম্পশু। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়। কিন্তু গাম্ভীর্য, পোশাক আর চালচলনে প্রবীণের মতো দেখায়। ছেলেরা তাঁকে ভয় খায় বটে, কিন্তু বীর বলে মনে করে না।
সেবার ভজুরাম মেমোরিয়ালের সঙ্গে কালীতলা স্কুলের ফুটবল ম্যাচ। দুটোই নামা টিম। সুতরাং মর্যাদার লড়াই। মাঠে কাতারে কাতারে লোক জড়ো হয়েছে খেলা দেখতে। খেলা শুরু হয়-হয়। ঠিক এই সময়ে বিপত্তিটা ঘটল।
শহরের সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক জীবটির নাম হচ্ছে কালু। যে হল শিবের ষাঁড়। গায়ে-গতরে যেমন বিশাল, তেমনি তার গোঁ আর রাগ। খেপলে সে আরবি ঘোড়ার মতো দৌড়য়।
ঘোষবাড়ির ভুতু হচ্ছে এশহরের সবচেয়ে বিচ্ছু ছেলে। ভজুরাম মেমোরিয়ালের ক্লাস এইটের ছাত্র। ফুটবল টিমে তার ঢাকা অনিবার্য ছিল। কিন্তু হেডসারের ইংরেজি ক্লাসের সময় সে সারের টেবিলের নিচে একটা জ্যান্ত কাঁকড়া বিছে ছেড়ে দেওয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। খেলা তো বন্ধই, স্কুল থেকে তাড়িয়েও দেওয়া হতে পারে।
ভুতু খেলার দিন একটা পাকা কাঁঠাল জোগাড় করে সোজা বাজরের রাস্তায় কালুকে গিয়ে ধরল। কালু বটতলায় বসে ঝিমোচ্ছিল, কাঁঠালের মনমাতানো গন্ধে চনমন করে উঠল। ভুতু একটি একটি করে কাঁঠালের কোয়া নিজে হাতে কালুকে খাওয়াতে খাওয়াতে খেলার মাঠের দিকে হাঁটতে লাগল। কাঁঠালের সম্মোহনে কালুও তার পিছু পিছু যাচ্ছে।
খেলার মাঠে সাঙ্ঘাতিক ভিড়। চেঁচামেচিও বেশ হচ্ছে। কাঁঠাল খাওয়ানো শেষ করে ভুতু কালুর লেজ ধরে পেল্লায় এক মোচড় দিয়ে বলল, “যাঃ, কালু যাঃ, লেগে পড়। সব লণ্ডভণ্ড করে দে।”
কালু লেজের মোচড় পছন্দ করে না। সে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বাঘের মতো গর্জন করল। আর তখন, কাঁঠালের ভুতিটা তাকে একবার শুকিয়ে ভুতু সেটা মাঠের মাঝখানে ছুঁড়ে দিয়েই পালাল।
তারপর আর কাণ্ডটা দেখতে হল না। কালু আর-একটা গর্জন ছেড়ে তীব্র গতিতে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে পড়ল। গোটাচারেক লোক শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে পড়ল। তারপর মাঠের মাঝখানে এক রণতাণ্ডব শুরু করে দিল কালু।
লোকে পড়ি কি মরি করে পালাতে লাগল চারিদিকে। প্লেয়াররা কিছু পালাল, কয়েকজন গোল পোস্টের ওপর উঠে পড়ল। চারদিকে হুড়োহুড়ি হুলুস্থুল কাণ্ড।
একধারে দুই স্কুলের মাস্টারমশাইরা চেয়ারে বসেছিলেন। মাঝখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সামনের টেবিলের ওপর ষষ্ঠীচরণ। স্মৃতি শিল্ড এবং বগলাপতি রানার্স আপ কাপ সাজানো। কালু মাঠে নামতেই মাস্টারমশাইরা উঠে দুড়দাড় পালালেন। ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব চেঁচিয়ে পুলিশদের ডাকাডাকি করছিলেন। কেউ অবশ্য এগিয়ে এল না। এখানকার পুলিশদের ধারণা, কালু শিবের সাক্ষাৎ বাহন, তার গায়ে গুলিও লাগবে না। উপরন্তু শিবের কোপে নির্বংশ হতে হবে।
ঠিক এই সময়ে দেখা গেল, জয়পতাকাবাবু বীরদর্পে উঠে দাঁড়িয়েছেন। একটা লাল সালুতে ‘ষষ্ঠীচরণ স্মৃতি শিল্ড’ লেখা। যেটা প্যান্ডেলের মাথায় টাঙানো ছিল। একটা চেয়ারে উঠে সালুটা খুলে ফেললেন জয়পতাকাবাবু। তারপর সোজা মাঠে নেমে কালুর মুখোমুখি হলেন।
কালু এমনিতেই রাগী। এত লোক দেখে তার মাথা আরও গরম হয়েছে। তার ওপর ভিড়ের মধ্যে সে কাঁঠালের ভুতিটাও খুঁজে পায়নি। তার চোখ লাল, মুখে ফেনা, গলা দিয়ে ঠিক বাঘা গর্জন বেরোচ্ছে। ঠিক এই সময়ে ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা জয়পতাকাবাবুকে সে দেখতে পেল। একেবারে মুখোমুখি। এবং দেখল, তাঁর হাতে লাল সালু।
লাল দেখে আর মাথার ঠিক রাখতে পারল না কালু। সব ভুলে সে তেড়ে এল জয়পতাকাবাবুর দিকে।
কিন্তু অকুতোভয় জয়পতাকা স্যার স্পেনদেশীয় বুল-ফাইটারদের মতোই অনায়াস দক্ষতায় সালুটা একটু পাশ কাটিয়ে ধরলেন। কালু তেড়ে আসতেই চট করে সরিয়ে নিলেন। দিগভ্রান্ত কালু খানিকটা দৌড়ে গিয়ে ভুল বুঝতে পেরে ফিরল। এবং আবার মাথা নিচু করে শিং উচিয়ে তেড়ে এল।
ডাকাবুকো জয়পতাকাবাবু আবার কালুকে দিগভ্রান্ত করে দিলেন।
এই কাণ্ড দেখে পলাতক লোজনেরা আবার ফিরে আসতে লাগল। চারদিকে করতালি ও হর্ষধ্বনিও শোনা যেতে লাগল। এর ফলে জয়পতাকাবাবু খুবই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন। লোকে ফুটবল খেলা ছেড়ে তাঁর সঙ্গে ষাঁড়ের লড়াই দেখছে, এটা কম কথা নয়। তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে কালুর সম্মুখীন হলেন এবং আবার কালুকে লাল সালু দিয়ে একেবারে বোকা বানিয়ে ছাড়লেন।
বারবার তিনবার, জয়পতাকাবাবু রীতিমত চনমনে হয়ে উঠেছেন। বেঁচে থাকার একটা আলাদা স্বাদ পাচ্ছেন। অঙ্ক কষাতে বা ছেলেদের পড়াতে তিনি দারুণ আনন্দ পান, কিন্তু এ-আনন্দ সেই আনন্দের চেয়েও যেন বেশি।
কালু দিগভ্রান্ত হয়ে গোলপোস্ট বরাবর চলে গিয়ে থেমেছে, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের দুপায়ের খুর দিয়ে ক্রুদ্ধ ও ভয়াল ভঙ্গিতে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে, মুখে ফেনা তুলে একটা রণহুঙ্কার দিয়ে তেড়ে আসতে শুরু করেছে।
এদিকে জয়পতাকাবাবুও তৈরি। কিন্তু মুশকিল হয়েছে তাঁর পরনে মাটাভোরের পোশাক নেই। তিনি পরেছেন নিরীহ বাঙালির ঢিলেঢালা পোশাক ধুতি আর পাঞ্জাবি। পায়ের পাম্পশুটাও ষাঁড়ের লড়াইয়ের উপযুক্ত জুতো নয়। ফলে হল কি, তাঁর কাছা খুলে গেল, একপাটি জুতো হল নিরুদ্দেশ।
অকুতোভয় জয়পতাকাবাবু এক হাতে কাছা খুঁজতে খুঁজতে অন্য হাতেই লাল সালু নাড়তে নাড়তে কালুর মুখোমুখি হলেন। আশ্চর্যের বিষয়, এবারও কালু জয়পতাকা-সারকে ছুঁতে পারল না দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
চতুর্দিক থেকে সবাই কালুকে দুয়ো দিল, জয়পতাকা-সারকে জানাল অভিনন্দন।
জয়পতাকাবাবু হঠাৎ বুঝতে পারলেন, তাড়াহুড়োয় তিনি কাছাটা খুঁজেছেন পাঞ্জাবিসমেত। ফলে পাঞ্জাবি গায়ে টাইট হয়ে তাঁকে সামনে ঝুঁকতে দিচ্ছে না। একপায়ে জুতো না থাকাতে শরীরের ভারসাম্য রাখাও কঠিন হয়েছে।
কালু যখন পঞ্চমবার তাঁকে ক্রোধোন্মত্ত আক্রমণ করতে তৈরি হচ্ছে তখনও জয়পতাকাবাবু রণে ভঙ্গে দিলেন না। অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে জামাটা টেনে বের করে কাছাটা ঠিকমতো আঁটতে গেলেন।
কালু তেড়ে এল। বিভীষণ বেগেই এল। জয়পতাকাবাবু সালুটা নাড়বার চেষ্টা করতে লাগলেন, কিন্তু তাড়াহুড়োয় এবার কাছার সঙ্গে সালুটা খুঁজে ফেলায় ভারী মুশকিল হল। সালুটা পিছনে গোঁজা থাকায় জয়পতাকাবাবুকে কালুর দিকে পিছন ফিরে সালুটা নাড়তে হচ্ছিল। কালু সোজা এসে গদাম করে গুঁতিয়ে দিল জয়পতাকাবাবুকে।
সবাই হায়-হায় করে উঠল। অঙ্কের এমন মাস্টার যে সাতটা শহর খুঁজলেও মিলবে না। গেল, অমন একজন মাস্টার ষাঁড়ের গুতোয় শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু দিনটা আজ কালুর নয়। আজ জয়পতাকাবাবুরই ছিল।
কালু উঁতো মারল ঠিকই, কিন্তু সঠিক ক্যালকুলেশন করে মারেনি। তোটা যদিও জয়পতাকাবাবুকে শূন্যে তুলে ফেলল, এমনকি তিনি শূন্যে দুটো সামারসল্টও খেলেন, কিন্তু কালুর শেষরক্ষা হল না। ঝড়ের বেগে গুঁতিয়ে যখন শাঁ করে কালু বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন দেখা গেল, শূন্যে ওই ডিগবাজি খেয়েও জয়পতাকা-সার নির্ভুলভাবে কালুর পিঠে সওয়ার হয়ে গেছেন। ঠিক ঘোড়সওয়ারের মতোই। তেমনি বুক ফোলানো দৃপ্ত ভঙ্গি। মেরুদণ্ড সোজা রেখে উপবিষ্ট। হাতে অবশ্য চাবুকের বদলে লাল সালু।
কালুর জীবনেও এই অভিজ্ঞতা প্রথম। এই মফস্বল শহরে সবাই তাকে দারুণ ভয় খায়। কেউ তাকে ঘাঁটায় না, মুখোমুখি লাল কাপড় দেখানো তো দূরস্থান। কিন্তু এই একটা লোক, শুধু তাকে খেপিয়েই তোলেনি, আবার নির্লজ্জের মতো পিঠের ওপরে বসেও আছে!
কালু আর ফিরল না। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কালুর মতো ভয়ঙ্কর ষাঁড়ের এরকম লেজে-গোবরে হওয়া দেখে দর্শকমণ্ডলী তুমুল হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠল। গণ্ডগোল থামলে ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব সকলকে উদ্দেশ করে গদগদ স্বরে বললেন, “পৃথিবীতে মানুষই যে শ্রেষ্ঠ জীব তা আজ আর-একবার প্রমাণিত হল। পশুশক্তি যে মানুষের কাছে চিরকালই পরাজিত হয়ে আসছে তার কারণ মানুষের প্রকৃত শক্তি হচ্ছে মনুষ্যত্ব, তার বীরত্বে। আজ সার্থকনামা জয়পতাকাবাবু মানুষের জয়পতাকাই আবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। ভীরু বাঙালি দুর্বল বাঙালির ভিতরেই লুকিয়ে আছে দুর্জয় বাঙালি। স্পেনদেশীয় বিখ্যাত মাটাডোরদের চেয়ে বাঙালি যে কোনও অংশে কম নয়, তা আবার প্রমাণিত হল। কে বলে বাঙালি হীন? বিজয়সিংহ লঙ্কা জয় করেননি? রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাননি? স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় ঝড় তোলেননি? গোষ্ঠ পাল কি সাহেবদের পা-কে রেয়াত করেছেন? সুভাষ বোস বামা ফ্রন্টে ইংরেজদের তুলোধোনা করেননি?” ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই আবেগপূর্ণ বক্তৃতায় সবাই তুমুল হাততালি ও হর্ষধ্বনি দিল। এরপর নির্বিঘ্নে খেলাও শুরু হয়ে গেল।
শুধু হেডসার শুকনো মুখে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডসারের কানে কানে বললেন, “জয়পতাকাবাবুকে কালু কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলল সেটা একটু খোঁজ করা দরকার। আপনি কয়েকটা ছেলেকে চারদিকে পাঠিয়ে দিন।”
কিন্তু মুশকিল হল, ছেলেরা সব সন্ধেবেলা ফিরে এসে হেডসারকে বলল, কালু বা জয়পতাকাবাবুকে শহরের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে দৃশ্যটা অনেকেই দেখেছে, কালু তীরবেগে রাস্তা ধরে দৌড়ে যাচ্ছে, তার পিঠে অবিচল জয়পতাকাবাবু বসা। হাতে লাল সালু পতাকার মতো উড়ছে। দৃশ্যটা যারা দেখেছে তারাও বুঝতে পারছে না, ভুল দেখেছে কি না।
খবরটা যখন জয়পতাকাবাবুর বাড়িতে পৌঁছল তখন জয়পতাকাবাবুর দাদু জয়ধ্বনি রায় এবং বাবা জয়োল্লাস রায় হাঁ। জয়পতাকা কালুকে ঢিট করেছে এটা তাঁদের বিশ্বাসই হল না।
জয়ধ্বনি বললেন, “যদি এরকম একটা বীরের কাজ জয়পতাকা করেই থাকে, তা হলে ওকে আমি সোনার মেডেল দেব।”
জয়োল্লাসবাবুও বললেন, “আমি কাঁঠাল খেতে বড় ভালবাসি। কিন্তু কালুর ভয়ে বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে আনতে ভরসা হয় না। একদিন পাকা কাঁঠালের গন্ধ পেয়ে আমাকে এমন তাড়া করেছিল যে, আর কহতব্য নয়। কালুকে যদি জয়পতাকা দেশছাড়া করেই থাকে, তবে হরির লুট দেওয়া উচিত।”
ওদিকে সন্ধেবেলা স্কুলেও মিটিং চলছে। জয়পতাকাবাবুর বীরত্বে ভজুরাম স্কুলের সকলেই গর্বিত। ম্যাচে তারা দু’গোলে হারা সত্ত্বেও ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব জয়পতাকাবাবুর সম্মানে আগামীকাল স্কুল ছুটি দিতে অনুরোধ করায় হেডমাস্টারমশাই ছুটি দিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মুখ শুকনো। কালু জয়পতাকাকে কোথায় নিয়ে গেল?
ঘটনার সময় মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ব্যস্তবাগীশ ব্যোমকেশবাবু শহরে ছিলেন না। নিখিল জগদীশপুর মাছধরা প্রতিযোগিতা, উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে গিয়েছিলেন ঈশানগঞ্জ গণ-শৌচাগারের উদ্বোধন করতে। শহরে ফিরে খবরটা পেয়েই একটা রিকশা নিয়ে স্কুলে এসে হাজির।
“এই যে বিষ্টুবাবু, এ সব কী শুনছি? এ তো সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড মশাই। সেই যে বাঘা যতীন হাত দিয়ে বাঘ মেরেছিলেন তারপর থেকে ইনফ্যাক্ট বাঙালির তো আর তেমন বীরত্বের রেকর্ড নেই? অ্য, কী বলেন? ইনফ্যাক্ট আমি তো ভাবছি জয়পরাজয়বাবুকে একটা নাগরিক সংবর্ধনা দেব।”
হেডসার বিষ্ণুবাবু সসম্ভ্রমে বললেন,”দেওয়াই উচিত।”
“ম্যাজিস্ট্রেটসাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি তো জয়পরাজয়বাবুর গুণগানে পঞ্চমুখ। ইনফ্যাক্ট শহরের জগগণও একই কথা বলছে। আঁ, কী বলেন? তবে, হ্যাঁ, ইনফ্যাক্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়াও যে নেই, তাও বলা যায় না। ইনফ্যাক্ট অনেকে তো খুবই চটে গেছে। তাদের বিশ্বাস, কালু হচ্ছে স্বয়ং শিবের প্রতিনিধি, তাকে জনগণের সামনে হেনস্থা করা খুবই অন্যায় হয়েছে। আর যার পিঠে চেপে স্বয়ং শিব ঘুরে বেড়ান, তার পিঠে চাপাটাও জয়পরাজয়বাবুর ঠিক হয়নি।”
বিষ্ণুবাবু সসম্ভ্রমে বললেন, “ওঁর নাম জয়পতাকা, জয়পরাজয় নয়।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ ভুল হয়েছিল। নাগরিক সংবর্ধনটা ওঁকে দেওয়াই স্থির করে ফেলি তা হলে! আঁ, কী বলেন! অবশ্য ইনফ্যাক্ট একইসঙ্গে একটা ধিক্কার সভাও হবে। অনেকে তো সমবেতভাবে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করবে, ইন ফ্যাক্ট আমাকে দুটো সভারই সভাপতি হতে হবে। আফটার অল সকলেই তো ভোটার, আমাকে সকলের দিকই দেখতে হয়।”
বিষ্ণুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা তো বটেই।”
ব্যোমকেশবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, “একইদিনে শহরের দু’জায়গায় জয়পরাজয়বাবুর নিন্দা এবং প্রশংসা–এ বেশ ভালই হবে। প্রশংসা করতে গিয়ে তো লোকের মাত্রাজ্ঞান থাকে না, বেশি বেশি বলে ফেলে। নিন্দা করতে গিয়েও ইনফ্যাক্ট তাই-ই হয়। এই একসেস ব্যাপারটা নিন্দা ও প্রশংসায় কাটাকাটি হয়ে যাবে। আঁ কী বলেন? তা জয়পরাজয়ঝবুকে একটু ডাকুন, আমি ওঁকে একটু অভিনন্দন জানিয়ে যাই।”
বিষ্ণুবাবু দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “কালু আর জয়পতাকা কারওই তো কোনও খোঁজ নেই।”
ব্যোমকেশবায়ু চমকে উঠে বললেন, “অ্যাঁ, সে কী!”
“সব জায়গায় ছেলেরা খুঁজে এসেছে। কালুও নেই, জয়পতাকাও নেই। জয়পতাকাকে না পেলে স্কুল চলবে কী করে ভেবে পাচ্ছি না। সে আমাদের অঙ্কের জাদুকর, গাধা পিটিয়ে মানুষ করে।”
ব্যোমকেশবাবুকে খুবই চিন্তিত দেখাল। অনেকক্ষণ ভেবে বললেন, “যদি ধরুন, ইনফ্যাক্ট জয়পরাজয়বাবুকে না-ই পাওয়া যায়, তা হলে কী করবেন?”
“আমরা অতটা ভাবছি না। জয়পতাকা যেখানেই যাক ফিরে আসবেই। ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলকে সে বড্ড ভালবাসে।”
ব্যোমকেশবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, “নাগরিক সংবর্ধনা আর ধিক্কার সভা দুটোই যে পরশুদিন। উনি না এলে তো খুবই মুশকিল, তাড়া পিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরশুদিনও যদি জয়পরাজয়বাবুর খোঁজ না-ই পাওয়া যায়, তা হলে কী করবেন?”
“আমরা অতটা ভাবছি না। জয়পতাকা যেখানেই যাক ফিরে আসবেই। ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলকে সে বড্ড ভালবাসে।”
ব্যোমকেশবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, “নাগরিক সংবর্ধনা ধিক্কারসভা দুটোই যে পরশুদিন। উনি না এলে তো খুবই মুশকিল, তাঁড়া পিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরশুদিনও যদি জয়পরাজয়বাবুর খোঁজ পাওয়া না যায় তা হলে…”
“তা হলে আমাদের মুরারীবাবুই অঙ্ক করাবেন। কিন্তু উনি বুড়ো হয়েছেন…”
ব্যোমকেশবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “পরশুদিনও জয়পরাজয়বাবু না ফিরলে আমরা নাগরিক সংবর্ধনাটাকে শোকসভা করে দেব। অ্য, কী বলেন? ধরেই নিতে হবে যে, ইনফ্যাক্ট উনি মারাই গেছেন। কিলড বাই কালু।”
সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেই ব্যোমকেশবাবু তড়িৎ-পায়ে বেরিয়ে গিয়ে রিকশায় চাপলেন। তাঁর মেলা কাজ। আজ রাতে একটা ব্রিজখেলা প্রতিযোগিতা, একটা ব্যায়াম প্রতিযোগিতা, একটা গানের জলসা উদ্বোধন করতে হবে। পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করে এনগেজমেন্টগুলো দেখে নিয়ে আপনমনে বললেন, “উঃ কত কাজ! সকলের মুখেই কেবল ব্যোমকেশ আর ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশ ছাড়া কারও চলে না। হুঁ হুঁ বাবা, শ্যাম লাহিড়ীকে আর কলকে পেতে হচ্ছে না।”