নবাবগঞ্জের আগন্তুক – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
ঘরে চোর ঢুকেছে টের পেয়ে মাঝরাতে গবাক্ষবাবু বিছানায় উঠে বসলেন। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কে ঢুকেছিস রে ঘরে? যোগেন নাকি? নাকি পঞ্চানন! চারু নয় তো! হাবুল নাকি তুই?”
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর একটা মোলায়েম গলা বলল, “আমি প্রিয়ংবদ।”
“প্রিয়ং… কী বললি?”
“বদ।”
“বদ তো তুই বটেই। বদের হাঁড়ি। কিন্তু নামটা নতুন হলেও গলাটা যে পুরনো! চেনা-চেনা ঠেকছে। তা নাম পালটালি কী করে?”
“কাছারিতে গিয়ে পয়সা খরচ করে মশাই।”
গবাক্ষবাবু মুখে একটা দুঃখসূচক চুক চুক শব্দ করে বললেন, “পয়সাটা বৃথাই গেল রে। গাঁ-গঞ্জের মানুষ কি আর এত ভাল নামের কদর বুঝবে? উচ্চারণই করতে পারবে না।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মোলায়েম গলাটা বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই বলল, “গাঁয়ের লোকের উশ্চাটনের কথা আর বলবেন না মশাই। উশ্চাটন একেবারে যাচ্ছেতাই। আগে পঞ্চা-পঞ্চা করত, এখন পেড়াপেড়ি করায় বন্দু বন্দু বলে ডাকে। প্রিয়ংবদ উশ্চাটনই করতে পারে না।”
“তাই বল, তুই তা হলে আমাদের পুরনো পঞ্চা চোর! তা আমার বাড়িতে কী মনে করে? আমার বাড়িতে কি তোষাখানা খুলে বসেছি? না কি টাঁকশাল বসিয়েছি?”
“তা জানি মশাই। আপনি হুঁশিয়ার লোক। এ-বাড়িতে চোরের একাদশী।”
গবাক্ষবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তা হলে ঢুকলি যে! কী মতলব তোর?”
“টাকাপয়সার ভরসায় আসিনি। একখানা জিনিস খুঁজতে এসেছি।”
“জিনিস! জিনিসটাই বা কী এমন রেখেছি যে চোর ঢুকবে! তোদের কি ধারণা ঘরে দামি-দামি জিনিস রেখে চোরদের নেমন্তন্নের চিঠি পাঠিয়ে বসে আছি। আমি তেমন বান্দা নই।”
পঞ্চা খুক করে একটু হেসে বলল, “তা আর বলতে! ঘরের যা ছিরি করে রেখেছেন তাতে ঢুকতে লজ্জাই হয়। তক্তাগপাশের তো একখানা পায়াই নেই, ইটের ঠেকনো দিয়ে রেখেছেন। রান্নাঘরে কয়েকখানা মেটে হাঁড়িকুড়ি আর কলাই করা থালাবাটি। না মশাই, চোরেরও মান-সম্মান আছে।”
পঞ্চার এই কথায় গবাক্ষবাবুর একটু প্রেস্টিজে লাগল। তিনি অতিশয় গম্ভীর গলায় বললেন, “তা হলে কি তুই বলতে চাস আমি ছ্যাঁচড়া লোক?”
“বললে ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে। তবে সত্যি কথা বলতে হলে বলতেই হবে যে ছ্যাঁচড়া শব্দটা যেন আপনার জন্যই জন্মেছে। অনেক বাড়িতে ঢুকেছি মশাই, কারও বাড়িতে এমন দুর্দশা দেখিনি। চোরদের জন্য কি আপনার একটু মায়াও হয় না?”
গবাক্ষবাবু বেশ অপমান বোধ করছেন, কিন্তু প্রতিবাদ করারও উপায় নেই। পঞ্চা সত্যি কথাই বলছে। তাই গবাক্ষবাবু গলাটা একটু নামিয়ে বললেন, “ভাল করে খুঁজলে কি আর টাকাটা সিকিটা পেতি না?”
“আজ্ঞে সেকথা ঠিক। খুঁজলে আপনার ঘরে টাকাটা সিকিটা কপালে যে জোটে না তা নয়। বাঁদিকে পায়ের কাছে তোশকের তলায় একখানা সিকি আছে, বালিশের তলায় একটা আধুলি, আলনায় যে ছেঁড়া জামাখানা ঝুলছে তার বাঁ পকেটে একখানা কাঁচা টাকাও আছে বটে, তবে সেটা অচল। আজ বাজারে আলুওলা টাকাটা নিতে চায়নি বলে আপনার খুব মেজাজ চড়ে ছিল।”
“টাকাটা মোটেই অচল নয়। চালালে দিব্যি চলে যাবে।”
“তা যাবে। সাঁঝবাজারে যে-লোকটা ঘানিঘরের পাশে বেগুন বেচতে বসে তার দু চোখে ছানি। তাকে গছাতে পারেন। নইলে ঈশেনপুরের নন্দী মহাজনের হাবাগোবা বাজার সরকার মহেশবাবুকে। নইলে জকপুর বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের অঙ্কের মাস্টার পাগলা কালীবাবুকে। ভারী আনমনা লোক। অঙ্কের পণ্ডিত হলে কী হবে, বাজার করতে গিয়ে সাত টাকা কিলোর সাড়ে তিনশো গ্রাম জিনিসের দাম কষতে গলদঘর্ম হতে হয়।”
ফাঁপরে পড়ে গবাক্ষবাবু বললেন, “এত ফ্যাচফ্যাচ করিস নে তো। টাকাটা অচল হলে কি আমিই নিতুম! বেকুব তো আর নই।”
“নিলেন আবার কোথা, এটা তো পড়ে পাওয়া। কথায় কথায় কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়বে মশাই। কালীর থানের সামনে যখন কাল বিকেলে আপনি টাকাটা কুড়িয়ে পেলেন তখন তো জগা বটতলায় বাঁধানো বেদিতে বসে পা দোলাচ্ছিল। স্বচক্ষে দেখেছে। টাকাটা পড়ে আছে সেটা জগাও জানত। কুড়িয়েছিল, তবে অচল দেখে ফের ফেলে রাখে।”
গবাক্ষবাবু ফের ফাঁপরে পড়ে বললেন, “একখানা টাকার তো মামলা। তা নিয়ে অত কচলাচ্ছিস কেন?না হয় অচলই হল টাকাটা, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হল শুনি।”
“না, টাকাটা সিকিটার কথা বলছিলেন কিনা, তাই বলা। ওসব ছোটখাটো ব্যাপারের জন্য আসা নয় মশাই। অন্য কাজ আছে।”
“সেইটে বলে ফেললেই তো ল্যাটা চুকে যেত। চোরেদের আজকাল যা আস্পর্ধা হয়েছে তা আর কহতব্য নয়। চুরি করতে ঢুকেছিস, কোথায় মিনমিন করবি, ঘাড় হেঁট করে থাকবি, ধরা পড়ে চোখের জল ফেলবি, হাতে পায়ে ধরবি, তা নয় উলটে গলা তুলে ঝগড়া করছিস!”
“ঝগড়া! কস্মিনকালেও কারও সঙ্গে ঝগড়া করিনি মশাই, তবে হ্যাঁ, দরকার হলে উচিত কথা বলতেও ছাড়ি না। আর চোর বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন কেন, চোর কি খেটে খায় না। আপনাদের চেয়ে তাদের খাটুনি বরং অনেক বেশি। আপনারা যখন নাকে তেল দিয়ে রাতে ঘুমোন তখন এই আমাদের রাত জেগে মেহনত করতে হয়। তার ওপর কাজের ঝুঁকিটাই কি কম? ধরা পড়লে গেরস্তের কিল, পুলিশের গুঁতো হজম করতে হয়, বরাত খারাপ হলে কড়া হাকিমের হাতে পড়ে হাজতবাসও আছে। চোর বলে কি মানুষ নই আমরা?”
“তা বটে। কিন্তু আমি তো বাপু তোকে কিলও দিইনি, পুলিশও ডাকার ইচ্ছে নেই। অত চটছিস কেন?”
“আপনি লোক তেমন খারাপ নন জানি। নইলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুখ-দুঃখের কথা কইতুম নাকি? তবে সজনীবাবুর বাড়ির আড্ডায় গিয়ে গিয়ে আপনার স্বভাবটা খারাপ হচ্ছে।”
“কেন, সজনীবাবু কি লোক খারাপ?”
“তা আর বলতে! একে তো বাড়িখানাকে দুর্গ বানিয়ে রেখেছেন, তার ওপর পাইক বরকন্দাজ, বাঘা কুকুর মিলিয়ে নিচ্ছিদ্র অবস্থা। মাছিটি গলবার জো নেই। তবে তা সত্ত্বেও আমাদের লক্ষ্মীকান্ত বাজি ফেলে সজনীবাবুর বাড়িতে ঢুকেছিল। যেমন পাকা হাত, তেমনই তার পাকা মাথা। চোরেদের সমাজে তাকে সবাই ওস্তাদ বলে মানত। তা লক্ষ্মীকান্ত পাইক বরকন্দাজকে ধোঁকা দিয়ে, কুকুরগুলোকে ফাঁকি দিয়ে একেবারে সজনীবাবুর শোয়ার ঘর অবধি পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ে যায়। তারপর তার কী দুর্দশা!”
গবাক্ষবাবু সোৎসাহে বললেন, “কচুয়া ধোলাই খেল বুঝি? সজনীবাবুর পাইক বরকন্দাজ গায়ে গতরে খুব জোয়ান। তাদের রদ্দা খেলে আর দেখতে হচ্ছে না।”
“দুর মশাই! কোথায় রদ্দা! চোরেরা রদ্দার পরোয়া থোড়াই করে। আমাদের হাড় হল পাকা হাড়। কিলিয়ে আপনার হাতে ব্যথা হয়ে যাবে। আমাদের কিছুই হবে না।”
“তা হলে আর লক্ষ্মীকান্তর দুর্দশাটা কী হল? পুলিশের হাতে সোপর্দ হল নাকি?”
“তা হলেও অনেক ভাল ছিল। কিছুদিন ঘানি ঘুরিয়ে ছুটি হয়ে যেত। তা নয় মশাই। তার চেয়ে অনেক খারাপ। সজনীবাবু লক্ষ্মীকান্তকে ক্ষমা করে দিলেন।”
“বাঃ, সে তো মহৎ কাজ!”
“সবটা শুনুন, তারপর ফুট কাটবেন। ক্ষমা করে তারপর তাকে এক বাটি দুধ চিড়ে খাইয়ে বসালেন। তারপর সারারাত ধরে উপদেশ দিলেন। উপদেশ শুনতে শুনতে লক্ষ্মীকান্ত বেচারা হেদিয়ে পড়ল। ভোরবেলা পর্যন্ত উপদেশ গেলার পর সে চি চি করতে লাগল।”
গবাক্ষবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আহা বেচারা! সত্যিই উপদেশের চেয়ে খারাপ কিছু হয় না রে!”
“তবেই বুঝুন, উপদেশ শুনলে তো আমার মাথা ঘোরে, শরীর ঝিমঝিম করে।”
“আমারও তাই। তারপর কী হল বল।”
“আজ্ঞে সে বড় দুঃখের উপাখ্যান। লক্ষ্মীকান্তর মতো অত বড় মান্যগণ্য চোর শেষে সজনীবাবুর পা দুটো চেপে ধরে বলল, এবার একটু চুপ দেন কর্তা, যা বলেন করতে রাজি আছি। তারপর কী হল জানেন? সজনীবাবু লক্ষ্মীকান্তকে মা কালীর সামনে দিব্যি দিয়ে চুরি ছাড়ালেন। তারপর নিজের গাঁটের কড়ি দিয়ে তাকে শ্যামপুরের বাজারে দোকান খুলে দিলেন।”
“বাঃ! এ তো মহৎ কাজ!”
“সে আপনাদের কাছে। আমাদের কাছে এ হল চূড়ান্ত অধঃপতন। অতবড় ডাকসাইটে চোর এখন নুন, তেল, তেজপাতা, হলুদ, জিরে বিক্রি করে সারাদিন। বসে বসে দু-চার আনা লাভের আঁক কষে। রাত্রিবেলা হাই তুলে তুড়ি মেরে দুর্গা নাম জপ করে পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়। কী সাঙ্ঘাতিক অধঃপতন বলুন তো। মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ করতে গেলে হাতজোড় করে কাঁদো কাঁদো মুখে বলে কী জানেন? বলে ভাই রে, আমাকে আর মানুষ বলে গণ্য করিস না তোরা। আমি উচ্ছন্নে গেছি।”
“বুঝলুম।”
“তাই বলছিলাম, সজনীবাবুর সঙ্গে মেলামেশা করাটা আপনার ঠিক হচ্ছে না। কত বড় একটা প্রতিভাকে উনি নষ্ট করে দিলেন বলুন তো!”
“তা অবশ্য ঠিক। তোর কথা শুনে লক্ষ্মীকান্তের জন্য আমার একটু কষ্টও হচ্ছে। কী আর করবি বল, যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোরা একটু হুঁশিয়ার হয়ে চলিস, তা হলেই হবে। সজনীবাবুর বাড়িতে আর কেউ না ঢুকলেই হল।”
“বলেন কী মশাই! ওবাড়িতে চুরি করার প্রেস্টিজই আলাদা। নিখিল নবাবগঞ্জ দলিত তস্কর সমাজে কেঁড়া দিয়েছে, ও-বাড়িতে যে চুরি করতে পারবে তাকে সোনার মেডেল দেওয়া হবে।
“অ্যাঁ। দলিত কী যেন বললি।”
“নিখিল নবাবগঞ্জ দলিত তস্কর সমাজ।”
“দলিত! দলিত মানে কী?”
“তা কে জানে মশাই। তবে কথাটা নাকি আজকাল খুব চালু। আমাদের ফটিক লেখাপড়া জানা লোক, ময়নাগড় বাসবনলিনী বিদ্যাপীঠে ক্লাস টেন অবধি নাকি পড়েছিল। সে-ই কথাটা জোগাড় করেছে।”
গবাক্ষবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা না হয় হল, কিন্তু সোনার মেডেলের লোভে ফের বিপদে পড়া কি ভাল? সজনীবাবুর তো শুধু পাইকবরকন্দাজই নেই, শ্যামাপদ তান্ত্রিকও আছে। পিশাচসিদ্ধ কাঁপালিক, দিনকে রাত করতে পারে।”
“তা খুব জানি। আমার তো মনে হয় লক্ষ্মীকান্তকে ভেড়া বানানোর মূলে শ্যামা তান্ত্রিকের হাত আছে। তবে আমাদের হাতেও তারা তান্ত্রিক আছে।”
“তারা তান্ত্রিক! সে আবার কে? নামটা শুনিনি তো!”
“শুনবেন কী করে? নতুন এসেছেন। জটেশ্বরের জঙ্গলে একটা পুরনো শ্মশানে আস্তানা। ভারী দুর্গম জায়গা। শ্যামা তান্ত্রিককে গুলে খেতে পারেন উনি।”
“বটে রে?”
“আজ্ঞে খুব বটে। তারা তান্ত্রিক রাতের বেলা বাদুড়ের মতো উড়তে পারে। উড়ে উড়ে কাঁহা কাঁহা মুল্লুক চলে যায়। তার একটা কাজেই তো আপনার বাড়িতে আসা।”
একটু আঁতকে উঠে গবাক্ষবাবু বললেন, “ওরে বাবা, তান্ত্রিকের আবার আমার বাড়িতে কী কাজ?”
“ঘাবড়াবেন না। কাজ সামান্য। উনি একটা জিনিস খুঁজতে পাঠিয়েছেন।”
“ওরে বাবা। আমার বাড়িতে আবার কী জিনিস খুঁজবি? সোনা-দানা-মোহর তো আমার নেই রে বাপু।”
“মোহর কে খুঁজছে? তারাবাবার কি মোহরের অভাব? হাত নেড়ে মোহরের পাহাড় তৈরি করতে পারেন।”
“বটে। তা হলে কী খুঁজছিস?”
“ছুঁচ মশাই, একখানা ছুঁচ।”
“ছুঁচ! ঠিক শুনেছি তো রে! ছুঁচ?”
“ঠিকই শুনেছেন। একটা কাঁচের শিশির মধ্যে একটা ছুঁচ। তারা বাবার সেটা খুব দরকার।”
“ছুঁচ। তা ছুঁচের অভাব কী? ছেঁড়া জামাটামা সেলাই করার জন্য আমার কয়েকটা ছুঁচ আছে।”
“আরে না মশাই, যেমন-তেমন ছুঁচ নয়। এ অন্যরকম ছুঁচ।”
“কীরকম?”
“অতশত জানি না। বলেছেন, একখানা বেশ লম্বা নলের মতো শিশিতে পোরা একখানা ছুঁচ আছে। অনেকটা গুনছুঁচের মতোই।”
একগাল হেসে গবাক্ষবাবু বললেন, “গুনষ্ঠুচ খুঁজছিস সেটা বলবি তো। সেও আমার আছে। তবে শিশিটিশি নেই, সেটা তোকে জোগাড় করে নিতে হবে।”
“দুর মশাই, গুনছুঁচ হলে কি আর রাতবিরেতের মশার কামড় খেয়ে আপনার মতো কঞ্জুষের ঘরে ঢুকি! জিনিসটা মোটা ছুঁচের মতো দেখতে হলেও ঠিক ছুঁচ নয়।”
“তা হলে এই যে বললি ছুঁচ! আবার বলছিস ছুঁচ নয়?”
“না মশাই, আপনাকে বোঝানো আমার কর্ম নয়, ছুঁচের ইতিবৃত্তান্তও জানা নেই। তারাবাবা বলেছেন এই নবাবগঞ্জের কারও বাড়িতেই ছুঁচটা আছে। আমরা পাঁচজন ঘরে ঘরে ঢুকে খুঁজে হয়রান হচ্ছি। মেহনতটা জলেই গেল দেখছি।”
“তা ছুঁচটা দিয়ে তারাবাবা কী করবেন তা বলতে পারিস? চট টট সেলাই করবেন নাকি?”
“তা কে জানে! ছুঁচ দিয়ে বাণও মারতে পারেন। অতশত জানি না। খুঁজতে বলেছেন বলে খুঁজে যাচ্ছি। আপনার বাড়িতে নেই তা হলে?”
“না বাপু, অত কেরানির চুঁচ নেই আমার। খুঁজে দেখতে পারিস।”
একটা তাচ্ছিল্যের “হুঁ“ শব্দ করে পঞ্চানন জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, গবাক্ষবাবু দেখলেন। তারপর অন্ধকারেই একটু হাসলেন। ব্যাটা কাঁচা চোর। ভাল করে খুঁজলে পেয়ে যেত। জিনিসটা তেমন লুকিয়েও রাখেননি গবাক্ষবাবু। দিন পাঁচেক আগে ভোরবেলা পায়চারি করতে গিয়ে পথেই শিশিটা কুড়িয়ে পান। শিশিটিশি কাজের জিনিস ভেবে কুড়িয়ে নিয়ে দেখেন, তার মধ্যে একটা ষ্টুও রয়েছে। কাজে লাগতে পারে ভেবে সেটা এনে দেরাজে রেখে দিয়েছিলেন। ছুঁচ খুঁজতে যে চোর আসবে তা কে জানত।
গবাক্ষবাবু উঠলেন। বালিশের পাশ থেকে দেশলাই নিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালালেন। জানলা বন্ধ করে সাবধানে দেরাজ খুলে দেখলেন কাঁচের শিশিটা ঠিকই আছে। কিন্তু এর জন্য যখন চোর এসেছে তখন আর অসাবধানে ফেলে রাখা ঠিক হবে না। গবাক্ষবাবু জিনিসটা হাতে নিয়ে একটু ভাবলেন। তারপর বিছানার চাঁদরটা তুলে তোশকটা দেখলেন। তোশকটা তাঁর খুবই পছন্দ হল। ছেঁড়া তোশকের মধ্যে অজস্র ফুটো। তোশকের এক ধারে একখানা পছন্দসই ফুটো পেয়ে তার মধ্যে জিনিসটা ঢুকিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হলেন। রাতবিরেতে ফের ছুঁচের খোঁজে চোর এলে সুবিধে করতে পারবেনা। তাঁর ঘুম খুব সজাগ। তবে ছুঁচটার গুরুত্ব তিনি বুঝতে পারছিলেন না।