১. ঘরের এমন জায়গায়

ঘরের এমন জায়গায় বসে আছে ও যে, ঘরের সামনের ওই টানা লম্বা দালানটার কোনওখান থেকেই দেখা যাচ্ছে না ওকে। যেতে নয়, আসতে নয়।

দেখা যাচ্ছে না, অতএব দেখা যাচ্ছে না কোন মুখ নিয়ে বসে আছে ও। ঘরটা একতলায়, বাগানে নেমে ঘুরে ওই পশ্চিমের জানলার নীচে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যেত, কিন্তু কলঙ্কের কালিমাখা ওই নির্লজ্জ মুখটা দেখতে যাবার রুচিই বা কার হবে? ওকে যে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে, সে কেবল চাকর বাকরদের কৌতূহলী চোখ থেকে আড়াল করতে।

অবশ্য জেনেছে ওরা সবই, বাড়ির চাকরবাকরদের জানতে কিছু বাকি থাকে না। সংসারের সবচেয়ে গোপনতম খবরটি ওরাই সবচেয়ে আগে জানে। রদ করা যায় না। তবে তাদের সেই জানার খবরটা আমরা জেনে ফেলেছি, সেটা না জানানোই প্রেসটিজ। আমরা তোমাদের বলিনি অতএব তোমরা কিছু জানো না। তোমরা অন্ধ, তোমরা কালা এবং তোমরা বোবা হবে, ব্যস!

গরিব গেরস্তরা একটা আধটা লোক পোষে, মানসম্মান বজায় রাখতে পারে না, দাসী চাকরের সামনে সংসারের সুখ দুঃখের কথা কয়। হয়তো বা তাদের সঙ্গেই কয়।

অভিজাতদের ঘরে এ সব চলে না।

অন্তত রত্নাকর চৌধুরীর বাড়িতে তো নয়ই। এ বাড়িতে মালী দারোয়ান জমাদার মিলিয়ে এক ডজনের বেশি লোক, সবাই কালা বোবা অন্ধ। ওরা জানে না হঠাৎ একদিন রাত্রে তাদের মনিব বাড়ির একটা বউ বেমালুম হারিয়ে গিয়েছিল। এদের বিধবা ছোট বউ।

ওই লোকগুলো যদি চক্ষুম্মান হত, কেবলমাত্র ওই হারিয়ে যাওয়ার ছুতোতেই তো দারোয়ানটার ফাঁসির হুকুম হয়ে যেতে পারত। কিন্তু চোখ নেই বলেই দারোয়ানের ফাঁসির হুকুম হয়নি, চাকরি যায়নি, এমনকী একটা ধমক খেতেও হয়নি।

আবার হঠাৎ যে আজকে সেই পালানো বউকে ধরে আনা হয়েছে, সে খবর ওরা জানে না, বোঝেনি, দেখতে পাচ্ছে না। ওগুলো যদি হঠাৎ শিখে ফেলতে যায় ওরা, শিখে ফেলার পরিচয় দিতে যায়, তা হলে কী হবে, বলা বড় মুশকিল! হয়তো ছোট ছেলে মারা যাবার পর থেকে শিকার করবার যে বন্দুকটা রত্নাকরের ভোলা আছে, অব্যবহারে মরচে পড়েছে, সেটা নেমে পড়বে।

যদিও গতকালও নামেনি।

 গতকাল শেষ রাত্রে যখন ওই কুলকলঙ্কিনী বউকে ধরে আনা হয়েছিল উত্তরভারত যাত্রী কোনও একটা ট্রেনের কোনও একটা স্টেশন থেকে, তখন নামতে পারত, নামা উচিত ছিল।

যে সত্যভামা চিরদিন রত্নাকরের শিকারের শখকে ধিক্কার দিয়েছেন, একটা পাখি মারা দেখলে কেঁদেছেন, সেই সত্যভামাই যে বলে উঠেছিলেন, কী হল? স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছ যে? কোথায় গেল তোমার সেই বন্দুক? কাজে লাগাও এবার সেটাকে?

চাপা তীব্র তীক্ষ্ণ সেই চিৎকারটাই যেন বন্দুকের গুলি হয়ে ছুটে যেতে চাইছিল উদ্ধত যৌবনের স্বাক্ষরে কলঙ্কিত একটা দুঃসাহসী বুককে লক্ষ্য করে।

রত্নাকর তবু স্থির হয়েই ছিলেন, কাজে লাগাননি সেই তুলে রাখা বন্দুককে। এ কথাও মনে পড়িয়ে দেননি সত্যভামাকে, ভয়ংকর সেই রাত্রে যখন হিমাকরের রোগজীর্ণ দেহটা সত্যিই হিম হয়ে গিয়েছিল, তখন কোন প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন সত্যভামা রত্নাকরকে? কোন অভিযোগে জর্জরিত করেছিলেন স্বামীকে, কোন ধিক্কারে ধিকৃত?

আর শুধুই কি দুরন্ত শোকের কাণ্ডজ্ঞানহীন, বিচার বিবেচনাহীন, লাজলজ্জাহীন উত্তাল মুহূর্তে? সেই পর্যন্ত এই কথাই কি বিশ্বাস করেন না সত্যভামা, রত্নাকরের পাপেই হিমাকরকে হারিয়েছেন তিনি। করেন, সেই বিশ্বাসই বদ্ধমূল সত্যভামার। সেদিনও তাই এই বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, শুধু শুধু ওই নিষ্ঠুর খেলার উল্লাসে অসহায় পশুপক্ষীর বুক থেকে তাদের বাচ্চা ছিনিয়ে নিয়ে মেরেছ তুমি! বলেছিলেন সত্যভামা গলা মুচড়ে দেওয়া পাখির গলায়, তোমার হবে না পুত্রশোক? তোমার পাপে আমাকেও দগ্ধাতে হবে সারাজীবন!

বলেছিলেন, করো করো, এই মরা ছেলের গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো তুমি, আর কখনও ছোঁবে না ওই পাপ বন্দুক!

কী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন রত্নাকর, আদৌ কোনও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কিনা, তা জানা যায়নি, তবে আস্তে একবার যেন হিমাকরের হিম হয়ে যাওয়া গায়ে একটা হাত রেখেছিলেন।

প্রতিজ্ঞার কথা জানা যায়নি, তবে তদবধি আর দেখাও যায়নি রত্নাকর বলিষ্ঠ ভঙ্গিমায় বন্দুক সাফ করছেন, বীরদর্পে শিকারে যাত্রা করছেন।

কিন্তু সে কথা কাল শেষ রাত্রে স্মরণ করিয়ে দেননি রত্নাকর তাঁর উত্তেজিত ক্ষিপ্ত স্ত্রীকে।

কোনও কথাই বলেননি তাঁর সঙ্গে।

শুধু বড় ছেলে শিলাকরকে বলেছিলেন, যাও, তুমি একটু বিশ্রাম করে নাওগে। রাত এখনও শেষ হয়নি, একটু ঘুমিয়ে নিতে পারবে।

তা নেওয়া দরকারও, শিলাকরই তো বহু চেষ্টায় আর বহু কষ্টে ধরে এনেছে ঊর্মিলাকে। উদ্ধার করেছে পরিবারের হৃত পবিত্রতা। ফিরিয়ে এনেছে হারিয়ে যাওয়া বংশমর্যাদা। এখনও পর্যন্ত কেউ টের পায়নি রত্নাকরের অন্তঃপুর থেকে রত্নাকরের বিধবা পুত্রবধু কদিন আগে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল।

অতএব এও টের পাবে না আবার সেই রাতের অন্ধকারেই জাল পেতে ধরে আনা হয়েছে পিজরে ভাঙা পাখিকে।

টের পেতে হলে বাড়ির চাকরবাকরদের মুখে। বাড়ির যারা নর্দমা, ঘুলঘুলি, চোরা-দরজা! ওই তো পথ। কিন্তু ওইখানেই আভাস দেওয়া আছে রত্নাকরের, শিকারের বন্দুকটা তাঁর এখনও অকেজো হয়ে যায়নি।

পিজরেয় তো ফের পুরে ফেলা হোক, তাড়াতাড়ি রাতারাতি। তারপর বিবেচনা করা যাবে কী করা হবে ওই বেসহবত দুঃসাহসিক পাখিকে নিয়ে।

.

ক্লান্ত শিলাকর সত্যিই এই প্রায় ফরসা হয়ে আসা ভোরে শুয়ে পড়তে গেল। অন্যদিন যে সময়ে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। উঠতে হয়, কারণ এই সময় রত্নাকর বেড়াতে যান ঘোড়ায় চেপে

হ্যাঁ, ঘোড়ায় চেপে বেড়ানোর অভ্যাসটাই বলবৎ আছে রত্নাকরের, পিতা পিতামহের মতো। আগে ছিল বর্ধিষ্ণু গ্রাম, চৌধুরীরা ছিল সে গ্রামের চুঁদে জমিদার। কাছের শহর বাড়তে বাড়তে গ্রাম তার নাম হারিয়ে হয়েছে শহরতলি, জমিদাররা জমিদারি হারিয়ে হয়েছেন শূন্যকলসি। তবু আভিজাত্যের অহংকারটা আছে, দুদে শব্দটার পরিচয় মরেও মরেনি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যার ভয়াবহতার আলোচনা ছড়াত, তার ভয়াবহতা সংকুচিত হতে হতে ক্রমশ গৃহগণ্ডিতে এসে ঠেকেছে।

তবু বাপ ঠাকুরদার আমলের বনেদিয়ানার জের বজায় রেখেছেন রত্নাকর এই প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাসটুকুর মধ্যে।

রত্নাকরের এই ঘোড়ায় চড়ার ব্যাপারে শিলাকরের যে কোনও ভূমিকা আছে তা নয়, রোকর যে কোনওদিন এ সময় শিলাকরের অনুপস্থিতিতে অসন্তোষ অথবা উপস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তাও নয়। রত্নাকর তো তাকিয়েও দেখেন না শিলাকর ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে, গেটে এসে দাঁড়িয়েছে।

তবু শিলাকর উঠে আসে। হয়তো এই পিতৃসম্ভ্রমটাও বনেদিয়ানা।

অলকা বলে, তুমি কি গিয়ে বাবার ঘোড়ার লাগাম ধরো? না আস্তাবল থেকে ঘোড়া বার করে দাও?

শিলাকর হাসে।

অলকা হাসে না। অলকা আরও প্রশ্ন করে, তবে? তবে তুমি এখন উঠবে কেন? নামবে কেন?

বুঝবে না তুমি।

আমি তো কিছুই বুঝি না বলে অলকা আর একবার পাশ ফিরে শোয়। এই ভোর রাত্রের মোহময় আমেজের সময় শয্যার শূন্যতাটা তাকে ক্ষুব্ধ করে। শীত নেই বর্ষা নেই, এ কী একটা অর্থহীন অভ্যাসের দাসত্ব শিলাকরের!

যখন হিমাকর বেঁচে ছিল, তখন অলকা ঊর্মিলার সুখের অবস্থা স্মরণ করে শুধু ক্ষুব্ধই হত না, ক্রুদ্ধও হত। স্বাস্থ্যহীন হিমাকরকে যে কোনও কর্তব্যের দায় পোহাতে হয় না এ ভেবে ঈর্ষাতুর হত। এখন অবশ্য লজ্জিত। ঊর্মিলাকে ঈর্ষা করত মনে করে নিজেকে ভারী ছোট মনে হয় এখন।

তবু এখনও ক্ষুব্ধ না হয়ে পারে না।

পাশ ফিরে আর একপালা ঘুমোবার আগে ভাবে, কোনও মানে হয় না। এটা সম্পূর্ণ দাস মনোভাব। কিন্তু কেন? উনি যদি জমিদার, তো তুমিও জমিদারের ছেলে! অথচ তুমি চাকরের মতো–

.

তা আজ শিলাকরও ঠিক সেই কথাই ভাবছিল, ঠিক চাকরের মতো করলাম আমি! রত্নাকর চৌধুরীর মাইনে করা চাকরের মতো! রত্নাকর চৌধুরী আমাকে প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন, আর তাঁর দামি গাড়িটা ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন তাঁর হারানো কুলমর্যাদাকে খুঁজে এনে দিতে। প্রাণান্ত পরিশ্রম করে সে কাজ করে দিয়েছি আমি। আমি যে একটা মানুষ সে কথা স্মরণ করিনি। ভেবে দেখিনি আমার মধ্যেও হৃদয়বস্তুটা থাকতে পারত। রক্তমাংসের মানুষের মধ্যে যেমন ক্ষুধা তৃষ্ণা লোভ বাসনা থাকে, তেমনি মায়া মমতা সহানুভূতিও থাকে।

কিন্তু আমি সে কথা ভাবিনি।

আমি সত্যনিষ্ঠ হয়েছি, আমি রত্নাকর চৌধুরীর কাছে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছি। আমাকে যখন ওই মেয়েটা বলেছিল–

হ্যাঁ, ঊর্মিলা বলেছিল।

শিলাকরের কাছে প্রায় আছড়ে পড়ে বলেছিল, আপনার পায়ে পড়ি দাদা, আমায় ছেড়ে দিন। বলেছিল, আমি তো আপনাদের সংসারের একটা জঞ্জাল, একখানা ভাঙা কাঁচের বাসন, কী করবেন আমায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে? আমি যদি হারিয়ে যাই, আপনার তো লোকসান নেই

ইতিপূর্বে কখনও হিমাকরের স্ত্রী এমন করে কথা বলেনি শিলাকরের সঙ্গে। হিমাকর থাকতে নয়, হিমাকর মারা গিয়েও নয়। এমন করে গলা ছেড়ে কথাই বলেনি। বাবুডাঙার চৌধুরীদের বাড়িতে ভাশুর ভাদ্রবউয়ে কথা বলার রেওয়াজ এখনও হয়নি। সামনে বেরোনোও সাধ্যপক্ষে নয়।

শিলাকর তাই কদাচিৎ একটি অবগুণ্ঠনবতাঁকে দেখেছে বাড়ির বউ হিসেবে। আগে লাল নীল সবুজ হলদেয় মোড়া, ইদানীং সাদায় মোড়া।

শিলাকরের চার বছরের ছেলেটা মাঝে মাঝে এসে ওই অবগুণ্ঠনে মোড়া বস্তুটায় প্রাণসঞ্চার করত। ছুটে ছুটে এসে বলত, বাবা বাবা, কাকিমা কত গপ্পো জানে জানো? গাদা গাদা! রাজার গপ্পো, ভূতের গপ্পো, দুঃখিনী রাজকন্যার গপ্পো

বলত, বাবা, কাকিমা কী সুন্দর ছবি আঁকতে পারে জানো? আমাদের মাস্টারমশাইয়ের থেকেও ভাল।…বাবা, কাকিমা সন্ধেবেলা ছাতে গিয়ে কী করে জানো? কাঁদে। আবার বলে কিনা তুমি এখন ছাতে যেও না বাবু, আমি পুজো করতে যাচ্ছি! পুজো না হাতি! কী চালাক দেখেছ?.কখনও বলে, দিদি যা বকে কাকিমাকে, কাঁদবেই তো!

আবার কখনও সুন্দর একটি জামা, কি চমৎকার একটি সোয়েটার গায়ে দিয়ে এসে গর্বিত ভঙ্গিতে বলে, বলল তো কে করে দিয়েছে? জানো না তো? কাকিমা।

বেছে বেছে শোনাবার লোক পেয়েছে ভাল, অলকা হাসে আর বলে, ভাশুরের কানে রাতদিন ভাদ্রবউয়ের গুণকীর্তন!

শিলাকরও হাসে।

 হেসে বলে, বুদ্ধিমান যে! দেখছে সকলেই তো প্রত্যক্ষদর্শী, শুধু ওর এই অবোধ বাবাটাই–

হ্যাঁ, ঊর্মিলা সম্পর্কে যা কিছু বোধ শিলাকরের, সে ওই ক্ষুদে মধুকরের মারফত।

.

তাই ঊর্মিলা যখন ব্যাকুল আবেদনে ভেঙে পড়েছিল, তখন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল শিলাকর তার দিকে। এই মেয়েটা তাদের বাড়িরই একাংশে ছিল এতদিন?

হিমাকরের হার্টের অসুখ ছিল, তাই হিমাকরের আস্তানা ছিল নীচের তলায়। বাগানের ধারের ওই মহল হিমাকরের জন্যেই নতুন তৈরি হয়েছিল। একটু ভাল থাকলেই বাগানে একটু বেড়াত, অধিক খারাপ থাকলে আর ঘরের বাইরে দেখা যেত না তাকে, তার সঙ্গে সঙ্গেই ছায়ার মতো থাকত তার স্ত্রী, এইটুকুই জানা। সেই ভাইটা ছায়ায় মিলিয়ে গেলে, সেই বিধবা মেয়েটা আড়ালে বসে কোথায় তার ভাশুরের ছেলেকে গল্প বলত, তার জামা সেলাই করে দিত, তাকে গান গেয়ে শোনাত, ছবি এঁকে দান করত, আর কোনও এক সময় ছাতে উঠে যেত কাঁদতে, কে খোঁজ রেখেছে।

আশ্চর্য, সেই কান্নাটাকেও নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা ভেবে উদাসীন থেকেছে শিলাকর, কোনওদিন ভাবেনি ওর মধ্যে এমন ঝড় উঠতে পারে।

ঝড়ই উঠেছিল।

যখন শিলাকর সহসা ওদের কাছে গিয়ে বলেছিল, পালাবার চেষ্টা কোরো না, সঙ্গে পুলিশ আছে। চলে এসো আমার সঙ্গে। …এই যে, আপনাকেও আসতে হবে।

তখন উঠেছিল সেই ঝড়।

সে ঝড় আছড়ে পড়ে বলেছিল, কেন আপনি আমাকে ধরবেন? আমি তো আপনার কোনও ক্ষতি করিনি।

প্ল্যাটফর্ম থেকে অনেকটা দূরে কাঁকর বিছানো আর ইটের টুকরো ছড়ানো একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। ঊর্মিলা আর তার পাপের সঙ্গী! পালাবার চেষ্টা করেনি। বুঝেছিল সে চেষ্টাটা ধাষ্টামো হবে। শিলাকরের ভয় দেখানোটা নিতান্তই ভয় দেখানো নয়। আছে সঙ্গে পুলিশের লোক।

পালাতে চেষ্টা করেনি, মন গলাতে চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, মনে করুন না আপনি আমায় চিনতে পারেননি, বুঝতে পারেননি। এমন তো হতে পারত। আপনি তো কোনওদিন আমার মুখ দেখেননি দাদা!

দাদা!

দাদাই বলেছিল।

সহজেই বলেছিল।

কিন্তু অবাক লেগেছিল শিলাকরের। আর এখনও অবাক হয়ে ভাবছে

না, আমি কোনওদিন ওর মুখ দেখিনি। শুয়ে শুয়ে মনে মনে বলল শিলাকর, কিন্তু আমাকে ওর একটা মস্ত বড় ফটো দেওয়া হয়েছিল। এনলার্জড ফটো, ওর আর ওর স্বামীর একত্রে। হয়তো ওর একা কোনও ছবি ছিল না, আর নয়তো বা ইচ্ছে করেই ওটা দেওয়া হয়েছিল, যাতে সর্বদা সচেতন থাকি আমি, ও কত বড় গর্হিত কাজ করেছে।

কিন্তু ওর মুখের পাশে হিমুর মুখটা কী নিরুত্তাপ কী অনুজ্জ্বলই দেখাচ্ছিল।

 হিমুর বউয়ের মুখটা ছবিতেই প্রথম স্পষ্ট দেখেছি আমি, কিন্তু সেই ছবির মুখটা তো অমন ঝড়ে আন্দোলিত হচ্ছিল না! ছবির মুখটার চারপাশে তো রুক্ষ চুলগুলো উড়ছিল না, আর ছবির মুখটা নির্লজ্জের মতো বলে উঠছিল না, আমায় দয়া করুন, আমায় বাঁচতে দিন, আবার আপনাদের সেই পাথরপুরীতে নিয়ে গিয়ে ফেলবেন না আমায়। আমি এই পৃথিবীর আলোয় হাওয়ায় নতুন করে বাঁচতে চাই।

শিলাকর ভাবতে চেষ্টা করল, কী উত্তর দিয়েছিল তখন শিলাকর। শিলাকর কি এ কথা বলেছিল, চুপ করো। একথা বলতে তোমার লজ্জা করা উচিত। হ্যাঁ, তাই বলেছিল।

হিমুর বউ, এবার তার ভাশুরের মুখের উপর বলেছিল, মানুষ একটা আইডিয়া নয়, সে রক্তমাংসের জীব। মেয়েমানুষও।

হিমুর বউ যার সঙ্গে পালাচ্ছিল, সেই হতভাগা লক্ষ্মীছাড়াটা এতক্ষণ মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে ছিল, এবার হঠাৎ মাথা তুলে বলে উঠল, ছেড়ে দেওয়া কি একেবারেই অসম্ভব?

শিলাকর তার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় কথা বলেছিল। বলেছিল, রত্নাকর চৌধুরীর কাপুরুষ ছেলেটার হাতে ধরা পড়েছ বলেই এতটা পর্যন্ত বলবার সুযোগ আর সময় তোমরা পেলে! রত্নাকর চৌধুরীর হাতে পড়লে পেতে না। বাঘ থেকে বাজপাখি পর্যন্ত নির্বিচারে শিকার করে এসেছেন তিনি এ যাবৎ। তাঁর একটা ছেলে মারা গেছে বলেই যে তিনি চিরতরে শেষ হয়ে গেছেন, তা ভেবো না।

তখন ওই হিমুর বউটা বলে উঠেছিল, আপনি যদি গিয়ে বলেন পাওয়া গেল না, কে বুঝতে পারবে? ইচ্ছে করলেই এইটুকু বলতে পারেন আপনি। আপনি তো এমন নিষ্ঠুর নন!

নিষ্ঠুর নয়! আশ্চর্য তো! এ কথা বলল কেন হিমুর বউ?

কিন্তু এই বিশ্বাসের বাণীতেও মন গলেনি রত্নাকর চৌধুরীর ছেলের। ও প্রমাণ করেছিল ওর নামটা ওর প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়া। ওর নাম আর প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বলেছিল তাই, নিষ্ঠুর নই, হঠাৎ এ বিশ্বাস হতে গেল কেন তোমার? বাবুডাঙার চৌধুরীরা তো নিষ্ঠুরতার জন্যে বিখ্যাত! জানো না?

 হিমুর বউ মাথাটা নিচু করেছিল।

ওর রুক্ষ চুলের মাঝখানে সরুরেখা সিঁথিটা অদ্ভুত রকম সাদা দেখাচ্ছিল। ও বলেছিল, জানি। জানি সে কথা। আপনাদের পূর্বপুরুষরা নরবলি দিতেন, অবাধ্য প্রজাকে মেরে মাটিতে পুঁতে রাখতেন।

তবে? শিলাকরের বেশ মনে পড়ছে পর পর কী কী কথা বলেছিল সে। এরপরই বলেছিল শিলাকর, তবে? আমাদের দেশের জমিদাররা যে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন, বাবুডাঙার চৌধুরীরা তার ব্যতিক্রম নয়। জমিদারিই গেছে, বংশের ধারাটা তো যায়নি? খামোকা তুমি একটা ভুল ধারণা করে বসবে কেন?

হিমুর বউ তবু জবাব দিয়ে বসল।

আশ্চর্য! মেয়েটা এত বাঁচাল আর বেহায়া!

কোথায় লুকিয়ে রাখত ও, ওর ওই বাঁচালতা আর বেহায়ামি? আগে শিলাকর কোনওদিন ওর গলার স্বরের নমুনাও তত শোনেনি। অথচ তখন? যখন ধরা পড়ল? ও সমানে শিলাকরের সঙ্গে কথা বলেছে।

বলেছে, আমাদের দেশের জমিদাররা শুধু নিষ্ঠুরতাতেই বিখ্যাত ছিলেন না, বদান্যতাতেও বিখ্যাত ছিলেন। কত মহানুভব জমিদার কত দয়া, কত মমতা, কত বদান্যতা দেখিয়ে গেছেন! বাবুডাঙার জমিদার বংশেও কি একবার তা হতে পারে না?

বলেছে, সামান্য একটা মেয়ে যদি সামান্য সুখ নিয়ে সামান্যভাবে বাঁচতে চায়, তাকে আপনাদের অসামান্য বংশের শাখার সঙ্গে জড়িয়ে রেখে লাভ কী? সে তো একটা মরা ডাল, তা থেকে তো বাবুডাঙার চৌধুরী বংশের কোনও সমৃদ্ধির আশা নেই, তবে কেন?…

আবার বলেছে, আমায় ছেড়ে দিন আপনার পায়ে পড়ি। আপনি যদি ভুলে যান এখানে এই সামান্য মেয়েটাকে দেখতে পেয়েছিলেন, যদি ভুলে যান তাকে একবিন্দু দয়া দেখিয়েছিলেন আপনি, তাতে আপনার লোকসান কী?

বলেছিল ঝড়ে আন্দোলিত শাখার মর্মরানির স্বরে।

 হয়তো তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে করে দেখছিল।

কিন্তু লাভ হয়নি কিছু।

শিলাকর সে সব ভুলে যেতে রাজি হয়নি, ভুলে যেতে রাজি হয়নি সে এসেছে রত্নাকর চৌধুরীর অর্থ আর আদেশ নিয়ে তাঁর চুরি যাওয়া বংশমর্যাদাকে তোক জানাজানি হবার আগেই উদ্ধার করে নিয়ে যেতে।

তাই বুকের উপর হাত আড়াআড়ি করে দৃপ্ত ভঙ্গিমায় বলেছিল, লোকসান শব্দটার মানে জানো?

মেয়েটা এবার থতমত খেয়েছিল।

আর সেই অবকাশে শিলাকর বলে উঠেছিল, বাবুডাঙার চৌধুরীদের পারিবারিক সুনামে দুর্নামে আমার কোনও লাভ-লোকসান নেই এ কথা ভাবছ কেন?

.

আচ্ছা, অত কথাই বা বলতে গিয়েছিল কেন শিলাকর? অত কথাই বা বলবার সুযোগ দিয়েছিল কেন ওকে?

অনেক তাড়াতাড়িই তো ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে পারত।

 পারত!

অথচ ফেলেনি।

তার মানে ওদের বাড়ির ওই নির্বাক পুতুলটার মুখের ওই তীব্র আর তীক্ষ্ণ কথাগুলো ওকে অভিভূত করেছিল। কীসের জোরে এত সাহস দেখাতে পারছে ও, সেটা ভাবছিল।

তাই কথার পিঠে কথা চলছিল।

শেষ পর্যন্ত যে শিলাকরেরই জয় নিশ্চিত, তা জেনেও যেন ওকে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে দিচ্ছিল।

 শেষ পর্যন্ত ও হার মানল।

মুখ ফিরিয়ে বলল, বেশ চলুন। শুধু এইটুকু দয়া করুন, ওকে ছেড়ে দিন।

শিলাকর ঊর্মিলার সেই ওর দিকে তাকিয়েছিল ঘৃণা আর ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে। মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল যে অদূরে।

শিলাকর সেই ব্যঙ্গ আর ঘৃণার গলায় বলেছিল, শুধু শখ থাকলেই হয় না, বুদ্ধি রাখতে হয়।…এ সব কাজে আরও সাবধান হতে হয়, বুঝলেন? নাম কী?

ও চুপ করেই থেকেছিল, ধমকের জোরে নাম আদায় করেছিল শিলাকর।

 নাম সমুদ্র। সমুদ্র সেন।

একেবারে সমুদ্র!

শিলাকর হেসে উঠেছিল, আমি তো দেখছি একটা পচা ডোবা! কিন্তু একটু আশ্চর্য হচ্ছি আপনার ক্যাপাসিটিতে। রত্নাকর চৌধুরীর ভয়ংকর অন্তঃপুরে মাথা গলালেন কী উপায়ে?

হ্যাঁ, সেটা একটা প্রশ্ন বটে!

কিন্তু তাতেও গৌরব অর্জন করতে পারেনি হতভাগাটা, যার নাম নাকি সমুদ্র সেন। শিলাকর হয়তো লক্ষ করেনি, কিন্তু এ বাড়িতে নেহাত নতুন নয় সে। হিমাকরের শালার বন্ধু সে। হিমাকরের শ্বশুরবাড়ির প্রতিবেশী। হিমাকর বেঁচে থাকতে তার শালার সঙ্গে এসেছে দু-একবার।

শিলাকর যেন আমোদ পাচ্ছিল।

শিলাকর বোধ করি ভুলে গিয়েছিল আসামি দুটোর মধ্যে একটা তার ভাদ্রবউ। তার সামনে চপলতা অশোভন। ভুলেই গিয়েছিল, তাই চপল ব্যঙ্গে বলে উঠেছিল, ওঃ, সেই চিরকেলে ব্যাপার! পাশের বাড়ির মেয়ে! যাক আপনাকে ছেড়েই দিচ্ছি আপাতত। কারণটা হচ্ছে, ধরতে গেলে ঘটনাটা দিব্যি প্রচারিত হয়ে যাবে। যেটা চাইছি না। বুঝলেন? দয়া করে নয়, নিজের স্বার্থেই ছেড়ে দিচ্ছি আপনাকে। তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যতে মনে রাখবেন, বাবুডাঙা নামের জায়গাটা চেনেন না আপনি। এখানের নাম শোনেননি কখনও। বুঝতে পারছেন? আর অজানা অচেনা জায়গায় মাথা গলাতে এলে মাথার বিপদ আছে, সেটাও মনে রাখবেন আশা করি।

ও মাথাটা হেঁট করেই দাঁড়িয়ে রইল।

শিলাকর তার বাড়ির পবিত্রতাকে গাড়িতে তুলল, আর তারপর ফের ফিরে গিয়ে সমুদ্র সেনকে বলে এল, হ্যাঁ শুনুন! ভবিষ্যতে যদি আর কখনও কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে বউকে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করেন, একটু সাবধান হবেন।

লোকটা শুধু একটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।

যেটা অক্ষমের সম্বল।

ক্ষমতাবানরা ও দেখে বিচলিত হয় না।

হাসে।

তারপর গাড়িতে উঠে এসেছিল শিলাকর। কিন্তু আশ্চর্য, সেই বাঁচাল মেয়েটা আর একটাও কথা বলেনি। রাত্রির অন্ধকারে দীর্ঘ পথযাত্রায় ও কি সহসা মূক হয়ে গিয়েছিল?

না কি রত্নাকর চৌধুরীর গাড়িতে ওঠার পর মনে পড়ে গিয়েছিল ওর, বাবুডাঙা চৌধুরী বাড়িতে ভাশুর ভাদ্রবউয়ে কথা বলার রেওয়াজ হয়নি এখনও।

.

নিঃশব্দে নিয়ে এসে বাড়িতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল শিলাকর–তার বাড়ির বউকে। তারপর বাবাকে খবর দিয়েছিল।

বাবা ছেলেকে সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যাও, শুয়ে পড়োগে যাও। অনেক ক্লান্তি গেছে। এখনও রাত আছে, একটু ঘুমুতে পারবে।

রত্নাকরের পক্ষে এটুকু স্নেহ প্রকাশও অভাবনীয়।

একটা ছেলেকে হারিয়ে বুঝি আর একটা ছেলের সম্পর্কে সচেতন হয়ে গেছেন আজকাল?

 কিন্তু বাবার সেই স্নেহের দাম কাজে লাগল না। ঘুমুতে পারল না শিলাকর। পারছে না। ওর কেবল মনে হচ্ছে ওই যে কাপড়ে মোড়া বস্তুটা নিঃশব্দে ঘরের ভিতর ঢুকে গেল, ওই কি সেই সুরকি ঢালা ইট-পাটকেল ছড়ানো জায়গায় দাঁড়িয়ে ফেটে পড়া মেয়েটা?

না কি দুটো বিভিন্ন মেয়ে?

ওর গলার স্বরটা এখন শুনতে পেলেও বা বুঝতে পারা যেত–একই, না আলাদা।

সেই স্বর শুনতে পাবার আশা আর নেই।

এখন শুধু রত্নাকর চৌধুরীর ঘোড়ার খুরের শব্দ।

গেট থেকে বেরিয়ে দ্রুত শব্দ ক্রমশ মিলিয়ে যাবার, আর দূর থেকে ক্ষীণ শব্দ ক্রমশ স্পষ্ট হতে হতে গেটে এসে ঢোকার।

শিলাকর কি এরপরও ঘুমের সাধনা করতে থাকবে?

বিছানায় পড়ে পড়ে দ্বিতীয় শব্দটাও শুনবে?

অলকা স্বগতোক্তি করবে, যাক, একটা দিনও তবু ব্যতিক্রম দেখলাম! এদের বাড়িতে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না দেখে দেখে কাঠ পাথর হয়ে গেছি।

অলকা এখনও ভাবছে শিলাকর ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুমুচ্ছে। ও তাই আস্তে আস্তে পাশ থেকে বিছানাটা ঝাড়ছে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে। এরপর ও ঘর থেকে চলে যাবে, স্নান করতে যাবে। তারপর কোথায় যেন হারিয়ে যাবে। সত্যভামার ঠাকুরের ভোগের ঘরে, না কি রত্নাকর চৌধুরীর মুরগি রান্নার ঘরে, কে জানে।

ওকে আর সহজে দেখা যাবে না।

আরও একটা মেয়ে আছে এ বাড়িতে, এখন বসে আছে আসামির কাঠগড়ায়, তাকেও কোনও সময় দেখা যেত না। এ বাড়িতে সারাদিন সারাক্ষণ দেখা যায় শুধু দাসদাসীকে। গুনতিতে যারা এক ডজনেরও বেশি।

ওরা সর্বত্র ঘুরবে।

সিঁদুর পড়লে মুছে তুলবে, শুধু কিছু দেখবে না, কিছু শুনবে না, কিছু বলবে না।

তাই এ বাড়িতে শব্দবলতে যা কিছু সে ওই পাঁচ বছরের মধুকরের কলকণ্ঠের। আর যা কিছু সবই কাজের শব্দ। রত্নাকরের ঘোড়ার খুরের শব্দ, সত্যভামার ঠাকুর আরতির ঘণ্টার শব্দ। রান্নাবাড়ির ছ্যাঁকছোঁক শব্দ, ঘর ধোবার আর ঘর মোছর ঝাঁটা বালতির শব্দ, কাক ওড়ানোর শব্দ, বেড়াল তাড়ানোর শব্দ, চাকি বেলুনের শব্দ, বাটনা বাটার শব্দ, সারাদিনের কর্মপ্রবাহের এক একটি তরঙ্গের এক একটি শব্দ। ওই শব্দরাই বুঝিয়ে দেয়, সংসারের অবস্থাটা এখন কোন পর্যায়ে।

আজও সেই শব্দপ্রবাহ ঠিকভাবেই প্রবাহিত হচ্ছে। সহসা দেখলে বোঝবার উপায় নেই এ বাড়িতে ভয়ানক কোনও ঘটনা ঘটে গেছে। যেমন বুঝতে পারা যায়নি হিমাকরের মৃত্যুর দিন। সেদিনও যথারীতি কাজ হয়েছিল সংসারের। মালী ফুলের তোড়া রেখে গিয়েছিল, শুকদেও গাড়ি ধুয়েছিল, ভটচাষ মশাই আরতি করে গিয়েছিলেন, ঘর ধাওয়া আর মোছা হয়েছিল।

মিল আরও আছে।

 সেদিনও ঊর্মিলা অমনি কাঠের পুতুলের মতো বসে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

আজও বসে আছে।

কে জানে কতক্ষণ বসে থাকবে!

সেদিনের মতো কি আজ কেউ শরবতের গ্লাস নিয়ে এসে একটু খেয়ে নেবার জন্যে পীড়াপীড়ি করবে?

অথচ আজকেই যেন বারবার সেদিনের সেই শরবতের গ্লাসটার কথা মনে পড়ছিল ঊর্মিলার। ঠাণ্ডা কনকনে মিছরির শরবত।

তবে মনে পড়বার এত হেতু তো ছিল না।

ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে যাবার আগে রত্নাকর তো রীতিমত ঠাণ্ডা করে গিয়েছেন তাকে। বলে গেছেন, দেখলেই তো ছোটবউমা, বাবুডাঙার অন্দর থেকে হঠাৎ একবার জাল ছিঁড়ে পালানো যদি বা যায়, আকাশে উড়ে বেড়ানো যায় না। কাজেই বৃথা শ্রম আর করতে যেও না। ওতে শুধু শক্তিক্ষয়েরই ভয় নেই, লোক্ষয়েরও ভয় আছে। না না, চমকে উঠো না, তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি এ বাড়ির বউ, সে কথা তুমি ভুলতে চাইলেও আমি তো ভুলব না! ভয় তোমার নয়, ভয় তোমার সাহায্যকারীর। জানো তো, গল্প শুনেছ নিশ্চয়, বাবুডাঙার বাবুদের কাছে চোরের কী শাস্তি ছিল? বলেনি তোমাকে কোনওদিন কেউ? তা হলে বলি-হঠাৎ কোনও দুঃসাহসিক চোর এ বাড়িতে ঢুকে পড়লে তার শাস্তি ছিল চোরকুঠুরির ঘরের সিলিঙের আংটায় ঝুলিয়ে রাখা। গলায় দড়ি বেঁধে নয়, পায়ে দড়ি বেঁধে। মাথাটা যাতে কোনওদিনই আর সোজা না করতে পারে। ভাবছ ধরা পড়লে তবে তো? ধরা পড়তই। এ বাড়িতে তো চুরি করে কেউ পার পায় না।…বাবুদের বাবুগিরি গেছে ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়াটা খুব বোকামি হবে। আংটাটা এখনও ভেঙে পড়েনি, খুলে পড়েনি, মজবুতই আছে।

ঊর্মিলা সেই ভাবেই বসে ছিল পাথরের পুতুলের মতো। কোনও কথা বলেনি। যদিও শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলার চলন হয়েছে ইদানীং এ বাড়িতে।

বোধ করি রত্নাকরই করেছেন।

রত্নাকরের বাবা তো কখনও সত্যভামাকে ডেকে ডেকে কথা কননি।

 রত্নাকর কইতেন।

যখন তখন এ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেন, ছোটবউমা, হিমুর কি কাল রাত্রে আদৌ ঘুম হয়নি? সারারাত বাগানে পায়চারি করছিল মনে হল…ছোটবউমা, হিমুর টেম্পারেচার উঠছে না তো? দেখছ নিয়মিত?…ছোটবউমা, খাওয়াটা কি আজকাল বড্ড কমে গেছে হিমুর? ডাক্তারকে সেটা বলা দরকার।

ক্রমশই অতএব উত্তর দিতে হয়েছে ছোটবউমাকে।

হিমাকর মারা যেতেও বলেছিলেন কথা রত্নাকর।

ছোটবউমা, কাল যে বইগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তোমার ঘরে, পড়তে শুরু করেছ? পড়বে। ভাল বইয়ের মতো ভাল সঙ্গী আর নেই।…ছোটবউমা, তুমি তোমার দিদির সঙ্গে সঙ্গে কাজটাজ করছ না কেন? কাজ করা দরকার। আমার শোক হয়েছে অতএব আমি শুধু বিছানায় পড়ে পড়ে সেই শোক নিয়ে বিলাস করব, এ চিন্তা ঘৃণ্য চিন্তা! হিমু অবশ্যই আমারও কেউ ছিল, উড়িয়ে দিতে পারবে না সে কথা, কিন্তু আমার সারাদিনের কাজে কোনও ব্যতিক্রম দেখেছ কোনওদিন?

কিন্তু তখন কি কোনওদিন বলে উঠেছিল ঊর্মিলা, মানুষ একটা আইডিয়া নয়, সে রক্তমাংসের জীব! বলেছিল কি, নিজেকেই বা আপনি আদর্শ ভাবেন কেন?

বলে ওঠেনি।

আজ বলেছে। রত্নাকরের ছেলের সামনে রেখেছে এই প্রশ্ন।

তার এই সাহসের জোগানদার কে? সেই একটা ভীরু কাপুরুষ হতভাগা?

সেই কথাই ভাবছে শিলাকর।

কিন্তু ভাবতে প্রবৃত্তি হচ্ছে না।

বরং তার চাইতে ভাবতে ভাল লাগছে, আসলে ওটাই লক্ষ্য নয়, ওটা উপলক্ষ।

ও শুধু বাঁচতে চায়, এই পৃথিবীর আলোয় হাওয়ায় বাঁচতে চায়। কিন্তু সেই চাওয়ার অধিকার ওর নেই।

দেশের আইন নাকি ওকে দিয়ে রেখেছে সে অধিকার, কিন্তু বাবুডাঙার চৌধুরীদের হাতে আলাদা আইন। দেশের ওই সস্তা বাজার-চলতি আধুনিক আইনে ওদের ঘৃণা।

অতএব বাবুডাঙার প্রজাযদি বাঁচবার আবদার করে বসে তো হাস্যকর হবে সেটা। বাঁচতে চাইলে চুরি করে বাঁচতে হবে সেই লোভীকে। লোভী বইকী! জীবনের প্রতি লোভই তো সবচেয়ে তীব্র লোভ। আর বুঝি বা সবচেয়ে নিন্দনীয় লোভ।

সেই নিন্দনীয় লোভ প্রকাশ পেয়েছে এ বাড়ির একটা বউয়ের মধ্যে। লজ্জার কথা!

রত্নাকর যদি সেই লজ্জায় লজ্জা পেয়ে ওর বাঁচবার সাধে চিরতরে যবনিকা টেনে দেন?

 আশ্চর্য নেই।

ভাবল শিলাকর। চৌধুরী বাড়ির উপযুক্ত গিন্নি সেই দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। অথচ কবে যেন একটা হরিণ মারা নিয়ে তিন বচ্ছর স্বামীর সঙ্গে কথা বলেননি সত্যভামা!

তবে সত্যভামার চিন্তায় যুক্তি আছে।

সত্যভামার মতে, অকারণ নিরপরাধ প্রাণীগুলোর প্রাণ নেবার মতো নৃশংসতা আর কী আছে!

কিন্তু অপরাধীর সম্পর্কে আলাদা বিচার সত্যভামার! আর বাঁচতে চাওয়ার মত বড় অপরাধ তাঁর কাছেও নেই। তেতাল্লিশ বছর ধরে বাবুডাঙার ভাত খাচ্ছেন তিনি, বাবুডাঙার বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন, তাদের প্রভাব পড়বে বইকী! তাঁর বৈষ্ণবধর্মের দীক্ষামন্ত্রও রক্ষা করতে পারবে না তাঁকে।

এই শাক্ত বাড়িতে তিনি একা বৈষ্ণব, তবু তেতাল্লিশ বছরের প্রতিক্রিয়াও করবে কিছু কাজ।

অথচ আমি পারতাম বাঁচাতে!

আমার হাতে ছিল সেই চাবিকাঠি।

পশ্চাত্তাপ নাকি নির্বোধের আর ভীরুর সম্বল। শিলাকর জানে এই প্রবাদ প্রবচনটা। তবু সেই তাপে তাপিত হচ্ছে শিলাকর। ভয়ানক একটা যন্ত্রণা অনুভব করছে।

কোনও একটা দৈববলে সময়টাকে ঘণ্টা কয়েক পিছিয়ে দেওয়া যায় না? তা হলে শিলাকর তার ভুলটা শুধরে নিতে পারে। উদারের মতো, মহতের মতো, হৃদয়বানের মতো, দেবতার মতো!

নিশ্চয়।

ওরা তা হলে বাকি জীবনটা পুজো করত শিলাকরকে। আর মনে মনে বলত, দেবতা! দেবতা! শিলাকর স্বেচ্ছায় সেই দেবতার আসন টান মেরে ফেলে দিয়েছে।

শিলাকরও ঘোষণা করেছে, তোমার বাঁচার অধিকার নেই।

কারণ শিলাকর নিজেকে একটা বিরাট ঐতিহ্যের ধারক বলে মনে করেছিল। অথচ শিলাকররা আধুনিক যুগের সুখ সুবিধেগুলো যত পেরেছে নিয়ে এসেছে তাদেরই এই ঐতিহ্যের খোলস ঢাকা জীর্ণতার মধ্যে। শহরের যাবতীয় আরাম টেনে এনেছে এই শহরতলির পুরনো প্রাসাদে।

রত্নাকর ভোরবেলা ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের পথ সচকিত করে ঐতিহ্য বজায় রাখেন, সন্ধ্যাবেলায় দামি মোটরে চড়ে শহুরে ধনীদের ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দেন একেবারে শহরের সেরা জায়গায় গিয়ে। রত্নাকর বাবুডাঙার মহিমা বজায় রাখেন, বাড়িতে পঞ্চান্ন ইঞ্চি ধুতির কোঁচা লুটিয়ে আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবির ডানদিকে বোতাম বসিয়ে।

আবার শহুরে ক্লাবের সাজটা যখন সাজেন, দামি বিলেতি পোশাকে টিপ টপ।

এটা কি দুই যুগের মধ্যে আপস? না, দুই যুগের নৈবেদ্যের মণ্ডাটি গ্রহণের দম্ভময় বিকাশ?

 কিন্তু শিলাকর?

 শিলাকর কী?

শিলাকর কি তার বাপের মতো শুধুই একটা দাম্ভিক সত্তা?

না, শিলাকর তার বাপের ওই দাম্ভিক সত্তার ছায়া মাত্র?

 তাই। তা ছাড়া কী?

তা নইলে শিলাকর কেন মহৎ হতে পারল না? কেন উদার হতে পারল না? কেন দেবতা হতে পারল না?

শিলাকর কি সত্যিই বাবুডাঙার জমিদারদের বাসি পচা মৃত ঐতিহ্যে বিশ্বাসী? তা যদি হত, শিলাকর সেদিন শুধু এই কথাটুকু ভাবত না, তা হয় না। রত্নাকর চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে আমাকে!

আর তা হলে এখন কেবলই ইচ্ছে হত না, পায়চারি করতে করতে বাগানের ওই কোণের দিকের ঘরটার জানলার নীচে এগিয়ে যাই। দেখি কালকের সেই ভয়ানক বাঁচাল আর বেহায়া মেয়েটাকে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় কীরকম দেখাচ্ছে!

ও শিলাকরের মৃত ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, তা মনে পড়ছে না শিলাকরের এখন। রেল স্টেশনের সাইডিঙে কাঁকর বিছানো সেই গাছতলাটায় দেখা মেয়েটাকে মনে পড়ছে শুধু।

.

কোনও দৈবমন্ত্রে খানিকটা সময় হঠাৎ মুছে ফেলা যায় না প্রবহমানকাল থেকে?

সময়টাকে আবার ঠেলে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো যায় না সেই রেল স্টেশনটার সাইডিঙে?

 শিলাকর হঠাৎ দেখতে পায় দাঁড় করানো গেছে।

সেই রুক্ষ চুলে উত্তাল, ক্ষুব্ধ প্রশ্নে মর্মরিত, মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়েছে শিলাকর দেবতার মতো, সেই মাথা নিচু করা হতভাগা ছেলেটার দিকে দাক্ষিণ্যের হাত প্রসারিত করে।

আমায় বাঁচতে দিন, আপনার পায়ে পড়ি আমায় বাঁচতে দিন।

শিলাকরের সামনে আছড়ে পড়া এই কাতর প্রার্থনার উত্তরে শিলাকর ব্যঙ্গের ব্যঞ্জনাময় হাসি হেসে বলেছে, তা না হয় দিলাম। কিন্তু ওই হতভাগাটার আছে সেই ক্যাপাসিটি? ঘরে ভাত আছে ওর? মাথার উপর আচ্ছাদন? পায়ের নীচে মাটি? দেখে তো মনে হচ্ছে না আছে।

মেয়েটা থমকেছে, মেয়েটার মুখে আলো আলো হাসি ফুটে উঠেছে, ও বলছে, কিচ্ছু নেই দাদা, সে সব কিছু নেই। শুধু শখ আছে আর বাহাদুরি আছে।

শিলাকর অতএব বলছে, তবে? ওর ভরসায় ভেসে পড়ে তারপর?

ও মুখ তুলে চাইল।

কৃতজ্ঞতায় আর শ্রদ্ধায় ওর চোখমুখ থরথর করে উঠল। ও বলল, আপনি তো আছেন!

আমি?

 শিলাকর অবাক হল, আমি কী করব?

কেন, আশীর্বাদ করবেন।

মুখটা আলো আলো করে হেঁট হয়ে প্রণাম করল দেবতার চরণে।

শিলাকর দেখতে পেল ওর চুলের মধ্যের সূক্ষ্ম রেখাটা অদ্ভুত সাদা। এই কুমারী সিথিটা পেল কোথায়?

শিলাকর সেই সিঁথিটার দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর গাড়িতে উঠে এল। ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ দেখা গেল, যতক্ষণ গাড়ির ধুলো উড়ল।

এই মহিমাটুকু অর্জন করতে পারত শিলাকর।

সেই মহিমায় রত্নাকর চৌধুরীর কাছে একটা মিথ্যা রিপোর্ট দেবার পাপ ধূসর হয়ে যেত।

কিন্তু অর্জন করতে পারেনি সে।

 রত্নাকর চৌধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলা যায়, এ কথা ভাবতে পারেনি ও। তাই বলেছিল, বাবুডাঙার চৌধুরীদের পারিবারিক সুনাম দুর্নামে আমার কোনও লাভ লোকসান নেই, এ ধারণা হল কেন তোমার?

দাম্ভিক রত্নাকর চৌধুরীর ছায়া-পুতুল আর কী বলবে? নিজস্ব কোনও সত্তা থাকলে, নিজের মতো কথা বলত।

তবে আর পায়ে পায়ে এগিয়ে ওই জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার দরকার কী? কেমন দেখাচ্ছে সেই বাঁচাল মেয়েটাকে চুপ করে বসে থেকে, তা দেখে লাভ?

তবু লাভহীন অর্থহীন ওই কাজটাই করতে যাচ্ছিল যেন শিলাকর, কিন্তু ঠিক এই সময়ই যে অলকাকে হঠাৎ তুলসীপাতার দরকারে বাগানে ছুটে আসতে হয়েছে, তাই প্রায় সংঘর্ষ হতে হতে রয়ে গেল। হলে মুশকিল হত। আবার হয়তো স্নান করতে হত অলকাকে, অস্নাত শিলাকরের সঙ্গে ছোঁয়া লেগে।

সত্যভামার নিয়মকানুন কড়া।

তুলসীপাতায় বিশুদ্ধতার হানি হলে চলে না।

.

তুমি এখানে?

 অলকা বলল হাঁপাতে হাঁপাতে।

অলকা কি তিনতলার তার শাশুড়ির ওই ঠাকুরঘরটা থেকে ছুটে ছুটে এসেছে?

 শিলাকর হাঁপাল না।

 শিলাকর বলল, ঠিক ওই প্রশ্নটা আমিও করতে পারি।

 আমি তো তুলসীপাতা নিতে এসেছি।

আমি ধরো গোলাপ পাতা।

গোলাপ পাতা? গোলাপ পাতা মানে?

 মানে কিছু নেই। শুধু তোমার সঙ্গে মিল রাখা। খোকা ফেরেনি এখনও স্কুল থেকে?

এক্ষুনি ফিরবে কেন? এখন কি এগারোটা বেজেছে? তুমি কি স্বপ্ন দেখছ?

বাঃ ঠিক ধরেছ তো!

 অলকা তুলসীপাতা তুলল।

তারপর হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়াল।

মনে হল না ওই পাতাটায় তাড়াতাড়ি কোনও দরকার আছে ওর। অথবা আদৌ আছে কিনা।

স্থির হয়ে বলল, কোথায় পেলে ওকে?এমনিতেই অলকা ঊর্মিলাকে ছোটবউ বলে অথবা ঊর্মিই বলে। কিন্তু এখন ওই ঘৃণ্য জীবটার নাম করতে রুচিতে বাধল বোধ হয়। তাই বলল, ও।

শিলাকর বলল, বলেছি তো!

সে তো একটুখানি বলেছ।

অনেকখানি তো নেই কিছু।

বাঃ তুমি কি জানতে কোন ইস্টিশানে পাওয়া যাবে?

জানলে এত খুঁজতে হবে কেন?

তবু যাই বলল, পাওয়াটা আশ্চয্যি!

 হারানোর চাইতেও?

তার মানে?

তার মানে রত্নাকর চৌধুরীর অন্তঃপুর থেকে আর তোমার এবং তোমার শাশুড়ির তীক্ষ্ণ পাহারা থেকে জলজ্যান্ত একটা মানুষের হারিয়ে যাওয়া ঘোরতর আশ্চর্য! এই কথাই বলছি।

আমরা কি ওকে পাহারা দিতাম?

না দেওয়াটাও আশ্চর্য।

 আমরা জানতাম ও তলে তলে এই মতলব আঁটছে?

 জানা উচিত ছিল। মতলব আঁটাটাই তো স্বাভাবিক।

 স্বাভাবিক?

তাই তো মনে হচ্ছে।

তার মানে হঠাৎ দৃষ্টির বদল হচ্ছে তোমার। আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না, কী করে সম্ভব? ছি ছি! ও ভদ্রঘরের মেয়ে নয়? ভদ্রঘরের বউ নয়? কিন্তু ওকে ফিরিয়ে এনে লাভটা কী হল?

সেই কথাই ভাবছি।

 অথচ নিয়ে এলে! আমারই হয়েছে জ্বালা। কীভাবে যে ওর সঙ্গে এক বাড়িতে থাকব!

শিলাকর হেসে ওঠে, কীভাবে থাকবে? হঠাৎ এ ভাবনা? হিমুর বউ কি হঠাৎ নখী দন্তী শৃঙ্গীর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল?

হ্যাঁ, হঠাৎ হিমুর বউ শব্দটাই ব্যবহার করল শিলাকর। যেন অবহিত করিয়ে দিল অলকাকে, কাকে নিয়ে আলোচনাটা হচ্ছে।

অলকা কিন্তু তা হল না। বলল, বাজে কথা বলছ কেন? আমি যা বলছি বুঝতে পারছ না নাকি? তেমনভাবে গায়ে গায়ে বসতে পারব? মাখামাখি করতে পারব?

পারাটা খুব শক্ত মনে হচ্ছে?

আমি তো ভাবতেই পারছি না। মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে আর কথা কইতেই পারব না কখনও।

 অথচ দেখো কইতে গেলেই সব সোজা হয়ে যাবে, সহজ হয়ে যাবে।

সহজ হয়ে যাবে? কক্ষনো না। ওকে আমার ঘেন্না করছে।

ওটাই যে সবচেয়ে সোজা।

বলল শিলাকর।

 হাসল।

তারপর বলল, তুলসী দেবী তো তোমার হাতের মধ্যে ঘেমে উঠলেন—

অলকা অপ্রতিভ হল।

চলে গেল দ্রুত পায়ে।

শিলাকর ভাবল, হিমুর বউকে এইখানে থাকতে হবে।

 বারবার করে হিমুর বউ শব্দটাই অভ্যাস করছে যেন।

দালান থেকে দেখা যাচ্ছে না, তবু দালান দিয়ে বারবার হাঁটাচলা করবার দরকার পড়ছে সবাইয়ের।

ঝিদের, চাকরদের, বামুনদির, দূর সম্পর্কের পিসি আর দুরতর সম্পর্কের কাকির, তার মেয়ের। যেন নতুন একটা জীব লুকোনো রয়েছে ওই ঘরটায়, তাই কৌতূহল এমন অসীম! অথচ সাহসের অভাব।

ভয়টা এই প্রাণীটাকে নয়, ভয় বাড়ির কর্তাকে।

হঠাৎ এই অশিষ্ট কৌতূহল তাঁর চোখে পড়ে গেলে কী হতে পারে, বলা যায় না।

আশ্চর্য, এ কথা কারও মনে পড়ছে না, বেচারা এখনও অবধি মুখ ঘোয়নি, স্নান করেনি, জলবিন্দু খায়নি।

মনে পড়ছে না, কারণ ওর জন্যে কারও মনে এতটুকু মমতা নেই আর। অথচ এই কদিন আগে পর্যন্ত ছোটবউমা বলতে অজ্ঞান হয়েছে সবাই।

ধন্যি ধন্যি করেছে ওর রূপগুণকে, ধিক্কার দিয়েছে ওর ভাগ্যকে।

ঊর্মিলা কি এসব ভাবছিল?

না, ঊর্মিলার মনের মধ্যে এই বাবুডাঙা নামক জায়গাটা ছিল না। ঊর্মিলা অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।

আর ঊর্মিলাও তার ভাশুরের মতো করেই ভাবছিল কয়েকটা ঘণ্টা সময় যদি সময়ের খাতা থেকে মুছে ফেলা যেত!

ঊর্মিলা তা হলে উত্তর ভারতের এই লাইনটা বাদে অন্য যে কোনও লাইনের টিকিট কাটত। এমন লাইন, যেদিকে কিছুতেই চোখ পড়ত না কারুর।

সমুদ্র বলেছিল।

 সমুদ্রর ভয় হয়েছিল।

 সেই ভয় নিয়ে বলেছিল, খুব বাজে একটা জায়গায় গেলে হয় না? যেখানে কেউ চিনে ফেলবে না!

এইখানেই বা কে চিনছে? বক্সারে শিবানী রয়েছে

 শিবানী ঊর্মিলার স্কুলের বন্ধু।

আর অবৈধ প্রেমের ব্যাপারে বন্ধুই তো একমাত্র গতি। এখানে আত্মীয়রা রক্ষা করতে আসে না। বন্ধুর হাতই এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। শিবানী ঊর্মিলার জন্যে বাড়াবে সেই হাত, শিবানী আশ্রয় দেবে ঘর-পালানো মহাপাপী দুটোকে, এ আশ্বাস আছে।

শিবানীর কাছে গিয়ে পড়ব

 বলেছিল ঊর্মিলা।

 সমুদ্র অগত্যা রাজি হয়েছিল।

সমুদ্রর চোখে তাই অন্তহীন ক্ষোভ ফুটে উঠেছিল তখন। ঊর্মিলা সেদিকে চাইতে পারেনি। সময়টা মুছে ফেলতে পারলে ঊর্মিলা বলত, সমুদ্র, তুমি যা করবে করো। আমি আর আমার ভার বইব না।

তারপর সমুদ্র হয়তো তাকে নিয়ে যেত হিমালয়ের উপত্যকায়। হয়তো বাংলা দেশের কোনও গ্রামে।

আশ্চর্য, সমাজ সংসার সব ভাসিয়ে যার কাছে ধরা দিতে গেল ঊর্মিলা, তাকে ভরসা না করে ভরসা করতে গেল ইস্কুলের বন্ধু শিবানীকে!

শিবানী তাকে চিঠি লিখে আশ্রয়ের ভরসা দিয়েছিল বলে? শিবানীই এযাবৎ সমুদ্রপথের সেতু ছিল বলে?

অথচ সেইটাই মৃত্যুবাণ!

সেই চিঠিই সহায়তা করেছে ধরিয়ে দেবার।

 তা সেটা শিলাকরের ভাগ্য!

ও চিঠিখানা তো ফেলে রেখে যাবার কথা নয়। অথচ ফেলে রেখে গিয়েছিল ঊর্মিলা!

ভুল! ভুলই তো মানুষকে ধরিয়ে দেয়।

.

সত্যভামার সারা সকাল পুজোর ঘরে কাটে।

রত্নাকর যখন ঘোড়ায় চড়বার সাজ পরেন, সত্যভামা তখন ঠাকুরের বাসি সাজ বদলাতে বসেন। সেই পুজো চলে বেলা দশটা অবধি। হিমাকর গিয়ে পর্যন্ত যেন আরওই বাড়ছে।

কদিন আগে যেদিন হঠাৎ সকালে উঠে দেখা গেল ঊর্মিলার ঘর খালি, আর বাগানের পিছনের দরজা খোলা, সেদিনই শুধু পুজোয় বসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল সত্যভামার, সেই দিনই শুধু পুজোয় বসে তখুনি উঠে পড়েছিলেন।

ঝড় একটা উঠেছিল বাড়িতে, কিন্তু নিঃশব্দ ঝড়।

রত্নাকর দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন, তুমি না বাড়ির গিন্নি? সব কর্তব্য বিসর্জন দিয়ে পুতুল খেলা করে দিন কাটাতে লজ্জা করে না তোমার?

সত্যভামাও তেমনিভাবেই বলেছিলেন, বলিনি আমি, গুরুদেবকে আনিয়ে তাড়াতাড়ি দীক্ষা দিয়ে দাও ওকে? তখন কানে নিলে না, এখন আমার দোষ দিতে এসেছ?

রত্নাকরের মুখের উপর এভাবে কথা বলা শক্ত বইকী!

সত্যভামাও বহুকালাবধি জানতেন শক্ত, কিন্তু হিমাকর তাঁকে পাসপোর্ট দিয়ে গেছে। হিমাকর মারা যাবার পর থেকে যা খুশি বলছেন, আর আশ্চর্য এই যে, দেখছেন বলাটা চালাতে চালাতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে।

তা সব ক্ষেত্রেই তো তাইই হয়।

প্রথমে এতটুকু চালাতে দ্বিধার শেষ নেই, ভয়ের শেষ নেই, পরিণাম চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু যেই একটু চলল, সেই অনেকখানি চলতে শুরু করল।

কী সমাজে, কী সংসারে, কী শিল্পে, কী সাহিত্যে, ওই তো লীলা!

অনাচার, অবৈধ, অরুচিকর, অভাবনীয়, সব চলে যায় ওই চালানোর সাহসে।

সত্যভামাও সেই সাহসের আশ্রয় নিয়েছেন।

 সত্যভামা রত্নাকরের মুখের উপর কথা বলতে শুরু করেই যা খুশি বলছেন।

আর বলবেন নাই বা কেন?

 সত্যভামার সংসারে যে এই অনাচার ঢুকল, তার জন্যে কাকে দোষ দেবেন?

রত্নাকরের বুদ্ধির দোষেই কি এই সুযোগটা পেয়ে যায়নি ঊর্মিলা?

 হিমাকর মারা যাবার পর সত্যভামা কি বলেননি, আমার হিমুর জন্যে তৈরি, হিমুর জন্যে সাজানো মহলে আর কেউ থাকবে না। হিমুহীন এই ঘরে আমি তার ছবি সাজিয়ে রাখব শুধু।

বলেছিলেন।

এই আড়ম্বর আর ঐশ্বর্যভরা নতুন মহলটা যে একা ঊর্মিলার ভোগে লাগবে, এ চিন্তা অসহ্য হয়েছিল সত্যভামার।

মনে হয়েছিল, ও কেন?…ওর এত কীসের দাবি? হিমু নেই, অথচ হিমুর ঘরের দখলিদার আছে, এর চাইতে অনিয়ম আর কী থাকতে পারে?

সহ্য করতে পারেননি।

তাই বলেছিলেন, হিমুহীন হিমুর ঘরের দৃশ্য আমি দেখতে পারব না ছোটবউমা, ও ঘর বন্ধ করে দাও, চাবি বন্ধ করে দাও। তুমি দোতলায় আমার ঘরে এসে শোও।

ঊর্মিলা আস্তে বলেছিল, এ ঘরটাই অভ্যাস হয়ে গেছে, আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না মা।

ইচ্ছে করছে না!

তার মানে স্বামীর স্মৃতির সৌরভে ভরা ঘরটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।

খুবই স্বাভাবিক।

 সতী মেয়েদের, স্বামীগতপ্রাণা বিধবাদের তাই হয়। তবু সত্যভামা কোমল হতে পারেননি। সত্যভামার ভুরুর রেখা মসৃণ হয়নি। সত্যভামা যেন এই বিনীত প্রার্থনার অন্তরালে দৃঢ়তার সুর শুনতে। পেয়েছিলেন। যে দৃঢ়তা দাবি থেকে আসে।

সত্যভামার কণ্ঠে তাই বিরক্তি গোপন থাকেনি, একা সোমত্ত বিধবা তুমি, নীচের তলায় শোবে?

ঊর্মিলা আরও দৃঢ় হয়েছিল, তাতে কী? একা কোথা? নীচের তলায় কত লোক। লীলা পিসিমা, বিমলা পিসি, নতুন কাকি, রমাদি, সবাই তো নীচতলায় শোন। দালানে ঝিয়েরা, বামুনদি, তা ছাড়া বৈঠকখানা বাড়িতে বাবা থাকেন–

হ্যাঁ, হিমাকর অসুস্থ হওয়া পর্যন্ত, বাগানের দিক ঘেঁষে ওর জন্যে মহল তৈরি হওয়া পর্যন্ত রত্নাকর ওপরতলা ছেড়ে বৈঠকখানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

অতএব ঊর্মিলার ভয় হতে যাবে কেন!

ঊর্মিলার কথায় যুক্তি আছে, কাজেই সেটা আরও বিরক্তিবর্ধক, তাই সত্যভামা তিক্ত গলায় বলেন, আছে, সবাই আছে বুঝলাম। কিন্তু ঘরের মধ্যে তো কেউ আগলাতে আসছে না? অত বড় একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেল– উথলে কেঁদে উঠলেন সত্যভামা, তার আত্মা কি এখুনি ও ঘরের মায়া ত্যাগ করতে পেরেছে? ও ঘরে ভয় করবে না তোমার?

ঊর্মিলা মুখ তুলে তাকিয়েছিল।

 বলেছিল, আত্মা জিনিসটা কী, সত্যিই সে মায়ার বন্ধনে আটকে থাকে কিনা, দেখতেই ইচ্ছে করছে মা!

আর কী বলবেন সত্যভামা?

 কত বড় পাজি দেখ এখন!

ভিতরে ভিতরে কী শয়তানি!

ওই সব বলে মন ভুলিয়ে বাগানের ধারের ঘরে একা থাকাটা কায়েমি করে নিল। যাতে পরপুরুষের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধে হয়।

তখনই যেন এ সন্দেহ হয়েছিল সত্যভামার, তাই তবুও ছাড়েননি। হ্যাঁ, পরে সেই কথাই বলেছিলেন সত্যভামা। সন্দেহ। আর কিছু নয়।–ঈর্ষা শব্দটা কে কবে নিজের সম্পর্কে ব্যবহার করে?

ওই সাজানো গোছানো মহল, শোয়ার ঘর, বসার জন্যে ছোট একটু ঘর, সংলগ্ন স্নানের ঘর, সবই এই পুরনো প্রাসাদের থেকে স্বতন্ত্র সুন্দর।

শৌখিন হিমাকরের পছন্দে আরও সুন্দর হয়ে ওঠা ওই মহল একটা বিধবা বউ একা ভোগদখল করবে, এটা কিছুতেই মনকে মানানো যাচ্ছে না কেন, তার কারণ নির্ণয় করতে, ওইটাই অতএব আবিষ্কার করেছেন সত্যভামা! সন্দেহ।

তখনই এ সন্দেহ হয়েছিল আমার। তাই না নিজেই নিজের সুবিধে অসুবিধে না দেখে, ওকে আগলাতে এসেছিলাম! তা দেখলে তো তোমরা শেষ পর্যন্ত?

তা সত্যি দেখেছে সবাই।

সত্যভামার নির্দেশে দাসী এসে ঊর্মিলার ঘরের মেঝেয় ঢালা একটা বিছানা পেতে রেখেছে শাশুড়ি বউয়ের জন্যে, দেখেছে ওরা।

আর এও দেখেছে সে ব্যবস্থা চালু থাকেনি। ঊর্মিলা নাকি বলেছে খাটের উপর না শুলে ও হাওয়া পায় না। হাওয়ার অভাবে দমবন্ধ হয়ে আসে ওর।

হতে পারে, অসম্ভব নয়, জানলাগুলো তো খাটের উচ্চতায় তৈরি। বাতাস সেখানেই খেলে। কিন্তু সদ্য বিধবার মুখে এই স্বাভাবিক কথাটাই নির্লজ্জ অস্বাভাবিক লেগেছিল সবাইয়ের।

কিন্তু লাগলেই বা কী? রত্নাকরের বাড়ির আশ্রিতাদেরও দাসী চাকরের মতোই কথা বলা নিষেধ। শুধুসত্যভামাই বলেছিলেন, তবে থাকো তুমি পালঙ্কে গা ছড়িয়ে! আমি তো আর তোমাকে আগলাবার দায়ে আমার হিমুর পালঙ্কে উঠে শুতে যাব না! আর রানির ঝিয়ের মতন মেঝেয় পড়ে থাকতেও পারব না!

ঢালা বিছানা অন্তর্হিত হল, মাদুর পড়ল একটা, পুরনো ঝি মানদা শোবে।

 কিন্তু সেই বা ঠাঁই পেল কদিন?

ওর নাক ডাকানোয় নাকি ঘুম আসে না ঊর্মিলার!

 সেই সময় কথাটা রত্নাকরের কানে উঠেছিল। ফোঁটা-চন্দনের ব্যাটা চন্দনবিলাস! হাভাতের ঘরের মেয়েকে এনে রাজতক্তে তুললে এই হয়!

রত্নাকর এ মন্তব্যে বিরক্ত হয়েছিলেন।

বলেছিলেন, বেশ তো, উনি যদি ভয় না পান, তোমাদের এত আগলাবার চিন্তা কেন? খাওয়া শোয়া জিনিসটা মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার! উনি যেভাবে থাকতে চান, থাকতে দাও।

হল তো?

 উদারতার ফল ফল কিনা দেখলে?

হু। নিজেকে ভারী বুদ্ধিমান ভেবে এসেছ চিরকাল, এখন দেখ তোমার বুদ্ধির সীমা কতদূর? ওই একটা এক ফোঁটা ছুঁড়ি বুদ্ধিতে তোমার উপর কী টেক্কা দিল। ঘরে কেউ থাকলে পালাতে পারত বউ?

পারত না–এ কথা বলা বড় শক্ত।

পরকীয়া প্রেমের দায়ে মানুষ পারে না এমন কাজ নেই। বিশেষ করে মেয়েমানুষ। অভিসারিকা রাধাই তার সাক্ষী। চিরকালের রাধারা সেই পথেই চলে।

কিন্তু পারা যে শক্ত হত, এটা তো সত্যি।

 তাই রত্নাকর সংসারে অপদস্থ হয়েছেন।

 সত্যভামা ছাড়া মুখ ফুটে কেউ না বললেও সকলের মুখেই তো ফুটে উঠেছে সেই ব্যঙ্গ। এই তো বোঝা গেল তোমার মহিমা! দুদে বলে বড়াই করা নিজের, রইল সে বড়াই? বাইশ-তেইশ বছরের একটা মেয়ে তোমার নাকে ঝামা ঘষে দিয়ে গেল কিনা বুদ্ধি কাকে বলে!

নাও, এখন কুলমর্যাদা রক্ষা করবে কী করে ভাবো। সেই শিকলিকাটা পাখিকে আবার জাল পেতে ধরে এনে শক্ত শেকলে বেঁধে রেখে? না, তাকে মুছে দিয়ে?

হঠাৎ বাপের বাড়ি গিয়ে মরে গেছে বললেই সমস্যার সমাধান হয়। সেটাই সহজ।

কিন্তু রত্নাকর সহজের পথে গেলেন না।

 রত্নাকর যেন আক্রোশে মরিয়া হয়ে সংকল্প করেছেন, আচ্ছা দেখিয়েই দেব এবার শেকল কাকে বলে। আদর, উদারতা, স্নেহ, সম্মান, এগুলোর যখন কোনও মূল্যই দিলে না তুমি, তখন থাকো জেলের কয়ে দর মতো!

মেয়েমানুষই মেয়েমানুষকে ঠিক বোঝে এই সত্যর কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে রত্নাকরকে, মাথা নোয়াতে হয়েছে সেই সত্যের দর্শিকা চিরপ্রতিপক্ষ সত্যভামার কাছে, এই চাইতে অপমানের আর কী আছে?

সত্যভামাকে এ কথা বলবার সুযোগ দিয়েছে কে?

মুখ বলে তো চিরটাকাল হ্যাঁজ করলে আমাকে, মানুষ বলে গণ্য করোনি কোনওদিন। কই তার জন্যে ঘর ভেঙে বেরিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখেছি কখনও? বয়েসও ছিল এক সময়, রূপও ছিল না তা নয়!

ওই ঊর্মিলাই করে দিয়েছে এ কথা বলার সুযোগ।

 ঊর্মিলাকে তবে আর মমতা করতে যাবেন কেন রত্নাকর?

.

পাঠশালা থেকে এসেই ধুপধাপ বইপত্তর ফেলে বাপের কাছেই ছুটে এল মধুকর। ছলছলে চোখ, লাল লাল মুখ। রোদে না অভিমানে কে জানে!

বাবা, তুমি কাকিমাকে কাকিমার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছ?

কাকিমার অনুপস্থিতির কারণ মধুকরের কাছে ও ছাড়া আর কী দর্শানো হবে? তাই দর্শানো হয়েছিল।

শিলাকর ছেলেকে কাছে টেনে বলে, এনেছি তো! কতদিন আর বাপের বাড়ি থাকবেন? তোমার অসুবিধে হচ্ছে–

হঠাৎ মধুকর কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

 আমার জন্যে আনলে তুমি কাকিমাকে, আর মানদামাসি বলছে কাকিমার ঘরে ঢোকা বারণ, কাকিমার সঙ্গে কথা বলা বারণ–

শিলাকর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকেই হেসে উঠে বলে, দুর! তাই কখনও হয়? মানদা ঠাট্টা করেছে।

ঠাট্টা?

তবে না তো কী!

খোকার ভিজে মুখে হাসি ফুটে ওঠে, কী মজা! কী মজা! তবে যাই

 এই এই এখনই না। শিলার ধরে ফেলে ছেলেকে, এখনও তোমার কাকিমার স্নান হয়নি, খাওয়া হয়নি, পরে যাবে।

বা এখনও হয়নি মানে? তবে যে মানদামাসি বলল রাত্তিরে এসেছেন।

সেটা ঠিকই বলেছে, তবে তোমার কাকিমার যে শরীর খুব খারাপ

 কেন? খারাপ কেন? জ্বর হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে।

আর কী বলা যায়?

আর কোন কথা মুখে জোগায়?

 মধুকর বলে, তা হলে ডাক্তারবাবুকে ডাকো?

 ডাকব। ডাকা হবে।

তাড়াতাড়ি ডাকা হোক না?

আঃ দাঁড়াও দাঁড়াও! ওসব হচ্ছে বড়দের কাজ, বড়রা বুঝবেন।

খোকা বিরক্ত গলায় বলে, বড়রা তো ছাই বোঝে! বড়রা তো বন্ধু নম্বর ওয়ান। বড়রা যদি সব বুঝত! আমি একবারটি যাই বাবা।

শিলাকর ছেলের হাতটা আয়ত্তমুক্ত করে না কিছুতেই। ওর কথার জের টেনে বলে, আর তুমিই বা কী? তোমারও তো নাওয়া খাওয়া হয়নি। আগে করো ওই সব।

বাঃ বলছি তো একবারটি—

শিলাকর অন্য চাল চালে।

শিলাকর ছেলের হাত ছেড়ে দিয়ে উদাসী গলায় বলে, বেশ তবে যাও। দেখো, তোমার কাকিমা নিজেই বকেন কিনা।

এতে কাজ হয়।

মধুকর তার ঘাম ঘাম মুখটা হাত দিয়ে মুছে নিয়ে ছুটে চলে যেতে যেতে বলে, আচ্ছা চান করেই কিন্তু

আচ্ছা শিলাকর কি কোনও কাজ করে না?

শিলাকর কেন যখন তখন বাড়িতে থাকে?

তা সত্যি বাঁধাবদ্ধ কাজ একটা করে না শিলাকর। রত্নাকর ওরকম কাজের বিরোধী।

বাবুডাঙার ছেলেরা কখনও পরের চাকরি করেনি শিলা! ছেলের ইচ্ছের মুখে পাথর চাপা দিয়েছিলেন রত্নাকর, বেনেতি কাজও করেনি। জমিদারি না থাক, এখনও মরা হাতি লাখ টাকা! দেখো সেই সব। গ্রামের স্কুলের সেক্রেটারি হও, অনারারি পোস্টে মাস্টারি করতে ইচ্ছে হয় করো, দিবাকর চৌধুরীর নামের হাসপাতালটা দেখাশোনা করো, গ্রামের উন্নয়নে লাগো। কাজের আবার অভাব আছে?

শিলাকর, তরুণ শিলাকর তবুও আস্তে প্রতিবাদ তুলেছিল, তবু নিজে একটা কিছু উপার্জন করা—

 ওঃ। নিজে উপার্জন? বেশ ঠিক আছে, আমার এস্টেটেই ম্যানেজারির চাকরি নাও। যথারীতি মাইনে পাবে। সেই টাকায় তোমার আর তোমার স্ত্রীর ভরণপোষণ হতে পারবে

তা বলিনি আমি! শুধু

বুঝেছি বুঝেছি–রত্নাকর হেসে উঠেছিলেন। কথাটা ভেবেছি আমি। তবে চট করে রজনীকে বরখাস্ত করতে যেন কেমন যেন

শিলাকর চমকেছিল, সে কী? রজনীবাবুকে বরখাস্ত করবেন কেন?

তা ছাড়া তো আর উপায় দেখি না– রত্নাকর বলে উঠেছিলেনু, রজনীর নীচে তো তোমায় বসাতে পারি না! অথচ অপর কোথাও মাইনে নিয়ে চাকরি করছ তুমি, এটাও ভাবা অসম্ভব।

তা সেই ওই পর্যন্তই।

.

চাকরি আর কোথাও করা হয়ে ওঠেনি শিলাকরের, বাবার সেরেস্তায় নয়, অন্য কোথাও নয়। ওই কিছু কিছু অনাহারি পোস্ট আছে, যেগুলো কোনওমতে বিবেককে ঠাণ্ডা রেখেছে।

রত্নাকরের ইচ্ছের পুতুল, রত্নাকরের দম্ভের ছায়া, ওর বেশি আর কিছু পেরে ওঠেনি।

আর হিমাকর?

সে তো ইচ্ছে করেই কাজ থেকে সরে থাকত। বাবুয়ানা করাই তার কাজ ছিল। সে ভাল খাবে, ভাল পরবে, ভাল করে ঘর সাজাবে, দামি কুকুর, দামি পাখি আর দামি অর্কিডের শখ মেটাবে প্রাণভরে, এবং দামি একটি বিয়ে করে সুখে থাকবে, এই ছিল তার আদর্শ।

তা হয়েছিল সবই। বউ আর কিছুতে না হোক রূপে দামি। শুধু ভাগ্যেই সইল না। অসুখে পড়ে গেল বেচারা!

তখন থেকেই চুপ ঊর্মিলা।

 নইলে বিয়ে হয়ে এসে প্রথম প্রথম বলত, কাকা একটা বিয়ে দিয়েছেন বটে, বেকার কুঁড়ে বর।

হিমাকর বলত, আর এইসব আরাম আয়েসটা কিছু নয়? এই রানির মতো থাকাটা বরবাদ?

এ সব তো দয়ার দান! শশুর ঠাকুরের বদান্যতায় পাচ্ছি।

 কেন, আমরা এ বংশের ছেলে নই? সাতপুরুষের সম্পত্তিতে দাবি নেই?

লজ্জাজনক দাবি।

 সাতপুরুষে চাকরে-ঘরের মেয়েদের মনোভাবের দৌড় আর কী হবে? বসে খেতে পাওয়া ভাগ্যের কথা!

আমি মোটেই ও ভাগ্যে বিশ্বাসী নই। বসে খেলে বাতে ধরে, হার্টের অসুখ।

ফুঃ!

তখন হিমাকরের অটুট স্বাস্থ্য, তাই বলেছিল, ফুঃ! বলেছিল, স্বাস্থ্য রাখতে জানলে, ওসব হয় না। ঘোড়ায় চড়ি কেন তবে?

হ্যাঁ, হিমাকরও ঘোড়ায় চড়ত।

 তার ঘোড়ার কদর ছিল কত!

 কিন্তু তবু পারল না স্বাস্থ্যকে দেহের মধ্যে বন্দি করে রাখতে। হঠাৎ ওই হার্টের অসুখ আক্রমণ করে বসল!

তোমার বাক্যটা যাই বলল বেদবাক্য, বলেছিল হিমাকর।

মরমে মরে গিয়েছিল ঊর্মিলা।

তা এমন মরমে মরার মতো কথা বিছানায় শুয়ে অনেক বলেছে হিমাকর তার আদরিণী আর রূপসী প্রিয়াকে। চলে যেতে হচ্ছে! চলে যেতে হবে আমায়! এই পৃথিবী, এই আকাশ, এই আলো, এই সুখ, সব ছেড়ে চলে যেতে হবে! এ আক্ষেপ নিষ্ঠুর করে তুলেছিল হিমাকরকে।

আমি থাকব না, অথচ ও থাকবে ওর ওই অনবদ্য রূপ, অটুট স্বাস্থ্য আর অফুরন্ত যৌবন নিয়ে!

 কী জ্বালা এই চিন্তায়!

সেই জ্বালা মাঝে মাঝেই ছিটকে উঠত ভিতরের প্রবাহ থেকে!

নইলে আগে নিষ্ঠুর ছিল না হিমাকর।

 স্ত্রীকে মাথায় রাখত কি বুকে রাখত। নিন্দেই ছিল সেজন্যে।

সত্যভামা বলতেন, বাড়িতে তো আরও একটা ছেলে বিয়ে করেছিল, কই বউ নিয়ে এমন বেহায়াপনা তো করেনি তোর মতো?

হিমাকর লজ্জা পেত না।

হাসত। বলত, দাদার কথা বলছ? দাদা যে তোমাদের ভাল ছেলে। গোপাল বড় সুবোধ বালক।

শেষে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলত, সবাইয়ের নজর লাগল আমার সুখে।…মা সুষ্ঠু বাদ গেল না। সবাইকে অভিসম্পাত করে যাব আমি, কেউ যেন না সুখী হয়।

বুকে বালিশ দিয়ে জেগে থাকত সারারাত আর এলোমলো জ্বালা ছড়াত।

ঊর্মিলা প্রথম প্রথম সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করত, উপদেশ দেবার চেষ্টা করত, কিন্তু শেষ অবধি দেখত বিপরীত ফল ফলছে। অতএব চুপ মেরে গেল।

আর হয়তো বা প্রতীক্ষা করতে লাগল, কবে এই যন্ত্রণায় ছটফটানো আত্মাটা মুক্তি পায়। পিঞ্জরের পাখির ডানা ঝটপটানো যন্ত্রণার অনুভূতি যে নিজের পঞ্জরেও অনুভব করে সে।

সারাটা সকাল পুজোর ঘরে কাটিয়ে নেমে এলেন সত্যভামা। ইশারায় জ্ঞাতি-ভাগ্নী রমাকে প্রশ্ন করলেন, কোথায়?

রমাও ইশারায় জবাব দিল, ঘরে।

 সত্যভামা ভ্রূকুটিকুটিল মুখে দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

পুজো করবার সময় যে চন্দনের টিপটি পরেছিলেন, সেটা শুকনো হয়ে এসেছিল, ঝরে পড়ল কিছুটা।

কণ্ঠে যতটা কঠোরতা সম্ভব তা ফুটিয়ে বললেন, বসে আছ? তবু ভাল। আমি ভাবছি, গলায় ফাঁস পরিয়ে ঝুলল, না গায়ে আগুন ধরিয়ে পড়ল।

ঊর্মিলা উঠে দাঁড়াল।

ঊর্মিলা যেন এইটুকুরই প্রতীক্ষা করছিল। তাই ঊর্মিলা বাঁচল।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে খাটের ওধারে সরু একটু জায়গার মধ্যে, ছোট একটা বেতের মোড়ার উপর। পা ধরে গেছে, পিঠ আড়ষ্ট হয়ে গেছে। সমস্ত দেহমন তৃষিত হতে হতে ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ছে হাতের কাছেই ওই দরজাটা খুলে স্নানের ঘরে ঢুকে পড়বার ইচ্ছেয়, শাওয়ারের তলায় মাথাটা পেতে দেবার বাসনায়।

অথচ পারছিল না।

একা বসে থাকতে থাকতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে ফেলে, হঠাৎ এক সময় উঠে গিয়ে নিজস্ব অধিকারে স্নানের ঘরে ঢুকে পড়তে বাধছিল।

এ বাড়ির কোনও কিছুতে কি আর অধিকার আছে তার? আগের মতো স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে আলনা থেকে শাড়ি ব্লাউজ তোয়ালে নিয়ে স্নানের ঘরে ঢুকে পড়তে পারবে?

বাধা যে কোথায় ধরতে পারছিল না, অথচ দুর্লঙ্ঘ্য একটা বাধা যেন পাষাণ হয়ে চেপে বসে রয়েছে।

ঊর্মিলাকে যখন এরা আবার ধরে এনেছে, অবশ্যই নাইতে দেবে, খেতে দেবে, তেষ্টার জল দেবে, তবু বসেই ছিল কাঠ হয়ে। একটু আলোড়ন উঠলেই বুঝি সুরাহা হয়।

কিন্তু আশ্চর্য!

একটা প্রাণী আসছে না এ ঘরে।

এমনকী মধু পর্যন্ত না।

 অথচ মধু ইস্কুল থেকে ফিরেছে, তা টের পাওয়া গেছে তার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের মা ডাকে।

কী প্রাণভরা ওই ডাক!

 ওই ডাকের জন্যে বুঝি সব দেওয়া যায়। সব সময়ে কাকি কাকি, কিন্তু স্কুল থেকে ফিরেই পায়ের জুতো খুলতে খুলতে ডাক দেবে মা! আজও দিয়েছে। কিন্তু ওর মার সাড়া পাওয়া যায়নি। ঠাকুরমারও নয়।

ঠাকুরমার সাড়া এখন পাওয়া গেল।

যাতে ঊর্মিলা বাঁচল।

কী বললেন তিনি, তা মনে রাখল না ঊর্মিলা, তিনি যে এই কবরখানায় ঢুকে ঊর্মিলাকে সম্বোধন করে কথা বললেন, এই অনেক।

এইটুকুর বদলে ঊর্মিলা এখন দাঁড়িয়ে উঠতে পারবে, সরে আসতে পারবে।

ঊর্মিলা দাঁড়িয়ে উঠল।

 ঊর্মিলা সরে এল।

ঊর্মিলা ভাবল যে বলে–তাই যদি করব তো এত কাণ্ড করলাম কেন? তোমাদের এই বাবুডাঙার বাবুদের বাড়িতে কি অভাব ছিল একগাছা দড়ির? না কি কেরোসিন তেলের?

বলল না।

ঊর্মিলা শুধুই দাঁড়াল।

সত্যভামাই আবার বললেন, তা আর মুখে খড়ি উঠিয়ে বসে থেকে কী হবে, গেরস্তর অকল্যাণ বাড়িয়ে? নাওয়া ধোওয়া করোগে!

ঊর্মিলা বেঁচে গেল।

ঊর্মিলা ধীরে ধীরে ওর স্নানের ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। যেটা এই কদিন আগে ছেড়ে গেছে। আর এসে পর্যন্ত যার দিকে ব্যাকুল প্রাণ শতবাহু হয়ে ছুটে যেতে চাইছে।

দরজার কপাটটায় হাত দিয়েছিল, সত্যভামা তীব্র স্বরে বলে উঠলেন, থাক!ওখানে যাবার দরকার নেই।

ঊর্মিলা চমকে উঠল, ঊর্মিলা অবাক হয়ে তাকাল।

সত্যভামা ছুঁড়তে লাগলেন তাঁর জমানো বিষাক্ত তীরগুলো একে একে।

না, ওখানে নয়! আমার হিমুর কোনও কিছুতে আর হাত দেবে না তুমি, কিছু ব্যবহার করবে না।…রমাদের নাইবার ঘরে চলে যাও।

রমাদের!

তার মানে আশ্রিতাদের?

রত্নাকরের সংসারে সবাইয়ের জন্যে ব্যবস্থা আছে, যথাযথ!

অবিশ্যি ওদের চানের ঘরও অব্যবহার্য নয়। পাথর পাতা না থাক, মেঝেয় শান আছে। শাওয়ার না থাকুক, চৌবাচ্চা-ভর্তি জল আছে। আলনা-আরশি এত সৌষ্ঠব না থাক, গামছা ঝোলাবার জন্যে দেয়ালের গায়ে বড় বড় হুক পোঁতা আছে।

সে ঘরে ঊর্মিলা কোনওদিন না ঢুকুক, ওরা ঢুকছে তা দেখেছে। আর ওরা কিছু রাস্তার লোক নয়। ঊর্মিলার বাপের বাড়িতেই বা ওর থেকে কী এমন ব্যবস্থা আছে?

ঊর্মিলা ফিরে দাঁড়িয়ে সত্যভামার মুখের দিকে তাকাল। বলল, আচ্ছা। তাই যাচ্ছি—

সত্যভামা একটু বাহুল্য কথা বললেন।

 তথাপি বললেন, হ্যাঁ তাই যাও।

ঊর্মিলা দু পা এগিয়ে এল, তারপর দাঁড়াল একটু। একটু যেন হেসে বলল, এ ঘরে কিন্তু তোয়ালে ছাড়া কিছু নেই। তাও ভাল ভাল বাহারি

সত্যভামা যেন আছাড় খেলেন।

যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নীচের দিকে পিছলে গড়িয়ে গেলেন। সত্যভামাকে ব্যঙ্গ করল ও?

ক্রুদ্ধ গর্জনে বললেন, তা আর জানি না? কপাল পুড়িয়েও তো বাহার কমেনি! ভাল ভাল বাহারি ছাড়া আর কী থাকবে? নেবে না ওসব। ওদের ঘরে গামছা আছে, তাই নাওগে যাও।

ঊর্মিলা খালি হাতে চলে গেল।

ভাবল, স্নান করতে গামছা তোয়ালে অপরিহার্য, এ কথাই বা কে বলেছে?

কিন্তু সত্যভামাকেই কি খুব ছিছিক্কার করা চলে?

 সত্যভামা কি খুব বেশি করেছেন?

 সত্যভামার ভিতরে যে আগুন জ্বলছে তার পক্ষে তাপটা তো বরং কমই বেরিয়ে এসেছে।

ইচ্ছে করলে তো সত্যভামা এসেই ওর ওই শুকনো হয়ে উঠলেও ধবধবে ফরসা গালে ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতে পারতেন।

ওর ওই তালের মতো খোঁপাটা সমেত মাথাটাকে ধরে ঠাঁই ঠাঁই করে দেয়ালে ঠুকে দিতে পারতেন। আর যদি নিজেকে অমার্জিত করতে পারতেন তো, একগাছা ঝাঁটা এনে লাগাতে পারতেন সপাসপ!

সেটাও অসম্ভব কিছু বেশি হত না।

 যেখানে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে বিদায় করে দেবার কথা, সেখানে এ আর কতটুকু?

 আমি ভাবছি–সত্যভামা ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, ও যতক্ষণে দালান পার হল ততক্ষণে বলে নিলেন, শিলু কেন তোমায় মাথায় করে নিয়ে এল? কোনওখানে জ্যান্ত গোর দিয়ে এল না কেন?

দালানের শেষ প্রান্তে কয়েকটা সিঁড়ি নেমে রমাদের স্নানের ঘর, সিঁড়িটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল ঊর্মিলাকে, সত্যভামা আর একটা বাণ ছুঁড়ে মারলেন, মেয়ে এসে যেন আবার এ ঘরে ঢুকে পালঙ্কে অঙ্গ ঢেল না! রমাদের ঘরেই থাকবে তুমি! এ ঘরে চাবি দিয়ে যাচ্ছি আমি।

দরজাটাকে টেনে বন্ধ করলেন শব্দ করে, তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, বিমলা, এ ঘরের তালাচাবিটা?

তালাচাবি আছে এ ঘরের।

ঊর্মিলা এ ঘরের স্বত্ব ত্যাগ করে চলে যাবার পর তালাচাবি পড়েছিল। সেই চাবি খুলে ওই নোংরা অশুচি ক্লেদাক্ত জীবটাকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে কী বলে, ভেবে অবাক হলেন সত্যভামা!

বাস্তবিক তাঁর স্বামীপুর এক একটি আজব জীব।

এদিকে মনে হয় যেন কতই র্দুদে, কার্যক্ষেত্রে সিংহনয়, মূষিক! এই বাড়ি সুব্ধ লোকের সামনে ওকে ধরে জুতো মারলে তবে না উচিত হত! তা নয়–চুপ চুপ!বউ? বউয়ের মর্যাদা?

ও যখন হিমুর স্মৃতিতে লাথি মেরে, হিমুর মর্যাদায় আগুন ধরিয়ে চলে গেছে, তখন আবার বউ কীসের? তার মর্যাদা কীসের?

ওকে খুঁজে পেতে ধরে আনায় সায় ছিল না সত্যভামার। ওকে নরকের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দিলেই ঠিক কাজ হত ভেবেছেন তা। তবু এখন এও মন্দ লাগছে না। অন্তত প্রাণভরে একবার কটুকাটব্য করে নিতে পারবেন তো?

হিমু চলে যাবার পর থেকেই বাকযন্ত্র তৃষিত হয়ে আছে, একবার প্রাণভরে বলে নেবার জন্যে। সত্যভামার কোলের ছেলে হিমু, সত্যভামার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ও! তার বুকে মাথায় ঠাঁই করে নিয়ে জুড়ে বসেছিল! সত্যভামাকে ক্রমশই দূরে ঠেলে ফেলে দিচ্ছিল।

তাতেই বুক ভেঙে যাচ্ছিল, তার উপর আবার নিজের হতভাগ্যের আগুনে শেষ করে দিল সত্যভামার হিমুকে।

অপরাধের গুরুত্বে মরমে মরে থাক, তা নয়, মহলের বেগমের মতো আলাদা মহলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, দামি তোয়ালে, গন্ধ সাবান নিয়ে, যথারীতি বাহারি বাথরুমে গিয়ে স্নান করছেন, এলো চুল ছড়িয়ে পালঙ্কে শুচ্ছেন। সোফা কৌচে না বসলে ওঁর সেলাই করা হয় না, বই পড়া হয় না!

এই অসহ্যগুলো অবিরত তো সহ্য করতে হয়েছে সত্যভামাকে? আগুন জ্বলছে। সে আগুন বার করবার সুযোগ করে দিয়েছে আজ ও।

মন্দের ভাল এটা।

ঊর্মিলা অবোধ?

ঊর্মিলা জানত না–খাওয়াপরা ছাড়া আরও অনেক কিছুতেই, হয়তো বা সব কিছুতেই, বৈধব্যের স্বাক্ষর রাখতে হয়?

তা যদি হয়ে থাকে, এত অবোধই যদি হয়, তো তার শাস্তি পেতে হবে বইকী!…আর যদি সে এ কথা ভেবে থাকে বৈধব্যকে অত জাহির করে বেড়ানোই লজ্জা, তা হলেও পেতে হবে সেই মুখমির শাস্তি।

হয়তো তাই!

আরাম আয়েসের উপকরণগুলোয় হাত দেবার সময়, ব্যবহার করার সময়, মনে এসেছে এগুলো তার ছাড়াই উচিত, কিন্তু লজ্জা করেছে।

মনে হয়েছে, বৈধব্যটা কি আমার নবলব্ধ একটা ঐশ্বর্য যে, সেটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভোগ করব?

কিন্তু ঊর্মিলার এই ভুল সিদ্ধান্তটা যে প্রতিনিয়ত বিষের জ্বালা ধরাচ্ছিল একটা পুত্র-শোকাতুরার চিত্তে, তার ফল পাবে না ঊর্মিলা?

রমাদের স্নানের ঘরে স্নান করতে যাওয়া কিংবা রমাদের ঘরের এক পাশে থাকা, এটুকুর জন্যে দোষ দিতে পারো না তুমি ঊর্মিলা, তোমার শাসনকর্তীকে! এখনও কত হবে! তিলে তিলে অহরহ! যা গর্হিত কাজ তুমি করেছ, তার গুরুত্ব বোঝো বসে বসে।

.

শিলাকর বাপের দরবারে এল।

নাপিতের কাছে ক্ষৌরী হন রত্নাকর, চাকরের কাছে তেল মাখেন। দুটো কাজে ঘণ্টা দুই যায়। অতএব সকালবেলা রত্নাকরকে নির্জনে পাওয়া শক্ত।

অথচ না পেলেই নয় একবার!

অগত্যাই চাকরটাকে বলতে হল, এই তুই যা।

তার মানে প্রাইভেট কথা।

ওর শোনা চলবে না।

 শিলাকর তাকিয়ে দেখল না বাবার পরনে এখন একটা ছোট ধুতি, বাবার তেল মাখাটা অসমাপ্ত রয়েছে এখনও। অথবা তাকিয়ে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ভাবল, আজও বাবা যথারীতি

কে জানে কী ভাবল, শুধু বিনা ভূমিকায় বলে উঠল, বাবা, মধুকে তার কাকির সঙ্গে কথা কইতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে?

রত্নাকর এই আবেগপূর্ণ অভিযোগের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন, তারপর বললেন, কেন, সেই বারণটা কি খুব অসঙ্গত মনে হচ্ছে তোমার?

শিলাকর আবেগ প্রশমিত করে।

শুধু শান্ত গলায় বলে, হচ্ছে। ও ছোট বাচ্চা, ওর মনে এভাবে একটা ধাঁধা দিয়ে যন্ত্রণা দেওয়া

ওঃ ওর জন্যে বলছ?রকর নির্লিপ্ত গলায় বলেন, ছেলেমানুষ, আর কিছু দিয়ে আটকে রাখলেই দুদিনে ভুলে যাবে। ওর মা রাখুক আটকে।

এরপরেও যে শিলাকর কথা বলবে তা ভাবতে পারেননি রত্নাকর, কিন্তু কথা বলল সে। প্রশ্ন করল, কিন্তু কেন?

কিন্তু কেন!

 রত্নাকর অবাক হলেন।

আশ্চর্য তো! এর আবার কেন কী? ছেলেপুলেকে কুসঙ্গে মিশতে না দেওয়াই তো নিয়ম।

 শিলাকর আরও অবাক করল তার বাপকে। বলল, মধুর কি ক্ষতি করতে পারবেন ছোটবউমা?

কুসঙ্গটাই ক্ষতি শিলা! আচ্ছা ওই চাকরটাকে পাঠিয়ে দাও গে। কাজটা শেষ হয়নি।

বিদায়দানের ইঙ্গিত।

তবু শিলাকর ইতস্তত করে বলে ফেলে, আর শুনলাম ছোটবউমার নাকি নিজের ঘরে ঢোকাও বারণ হয়ে গেছে?

এ খবরটা জানা ছিল না রত্নাকরের।

শুনে হয়তো একটু আশ্চর্যই হলেন।

কিন্তু তার চাইতে বেশি আশ্চর্য হলেন তাঁর বড় ছেলের উত্তেজনায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলেন, কারণটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করলেন, তারপর গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, কোথায় শুনলে? ছোটবউমা কি নিজেই তোমাকে দুঃখ করে জানিয়েছেন?

ছোটবউমা? ছোটবউমা নিজেই আমায় জানিয়েছেন? শিলাকরের মুখটা আরক্ত হয়ে ওঠে, এ আপনি কী বলছেন?

ও কী? উত্তেজিত হচ্ছ কেন? সম্প্রতি ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার প্রয়োজন হয়েছে তোমার, সেই সূত্রে আলাপ হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। ভাশুর ভাদ্রবউয়ের মধ্যে বিভেদ না রাখা তো ফ্যাশান হয়েছে আজকাল।

শিলাকর থমকে দাঁড়ায়।

শিলাকর কখনও যা না করেছে তাই করে।

শিলাকর বাবাকে ধিক্কার দেয়।

আপনার কাছ থেকে ঠিক এ রকম ব্যবহার আশা করিনি বাবা!

রত্নাকর এক মুহূর্তের জন্য বোধ করি বিচলিত হন, তারপরই সামলে নেন, কোন ব্যবহারটার কথা বলছ তুমি, ঠিক বুঝতে পারলাম না তো!

শিলাকর বাবার দিকে স্পষ্ট চোখে তাকায়।

রত্নাকর একটা ছোট কাপড় পরে আছেন।

 রত্নাকরের দেহের অনেকখানি অংশ অনাবৃত। সেই অংশের সুলতা চোখে পড়ছে। বাপের এই দেহের স্থূলতা আর পরিধেয়র ক্ষুদ্রতাটা দিয়েই কি বাবাকে চিনতে চেষ্টা করছে শিলাকর? না কি চিনতে পেরেই গেছে?

চিনতে পেরে গেছে, তাই ভয় কমে আসছে? অথবা একটা অসহায় মেয়ের দুর্জয় সাহস শিলাকরের ভীরুতাকে ব্যঙ্গ করে করে সাহসী করে তুলেছে শিলাকরকে?

তাই শিলাকর আজ একটা সম্পূর্ণ নতুন প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, একজন মানুষ আর একজন মানুষকে অকারণ ভয় করবে কেন? বাঘের মতো? আগুনের মতো? যমের মতো?

তাই শিলাকর বলে ওঠে, না বোঝবার মতো তো কিছু নেই বাবা! তবে আমি বলব এটা ক্ষুদ্রতা। আপনার প্রতিপক্ষ যে তুচ্ছ একটা অসহায় মেয়ে মাত্র, সেটা ভুলে যাচ্ছেন আপনি।

প্রতিপক্ষ!

 রত্নাকর হেসে ওঠেন, তা হলে তো কাঠগড়ার আসামিকেও জজের প্রতিপক্ষ বলতে হয়। কী হল তোমার? বাংলা নভেল-টভেল পড়ছ বুঝি?

শিলাকর বাবার ওই ব্যঙ্গ তিক্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে, তারপর ধীরে ধীরে সরে আসে।

অলকা ভয়ে কাঁটা হচ্ছিল, ভাবছিল ওকেই বুঝি গিয়ে তার ছোটজাকে খাবার জন্যে ডাকতে যেতে হবে। দেখেছে তো সংসারের যত কিছু গোলমেলে কাজ তাকেই করতে হয়। তার উপরই ভার পড়ে যত শক্ত কাজের।

কিন্তু আজ রক্ষে পেল অলকা।

আজ শুনতে পেল ঊর্মিলার ভার ন্যস্ত হয়েছে রমার উপর। ওদের ঘরেই থাকবে এবার থেকে ঊর্মিলা। তার মানে ঊর্মিলা আর এ বাড়ির বউ থাকল না, আশ্রিতা হয়ে গেল। এদের কাছে থাকবে, নতুন কাকিদের রান্নাঘরে খাবে।

অবশ্য খাওয়াটা বিধবা হয়ে ইস্তক নতুন কাকিদের হেঁসেলেই হচ্ছিল। কারণ ওদেরই বিশুদ্ধ নিরামিষ। তাই বলে সেটা ওদের ঘরে গিয়ে খাওয়া নয়।

নিজের ঘরের মেঝেয় কার্পেটের আসনে বসে, শ্বেত পাথরের থালায় ভাত খেয়েছে ঊর্মিলা, রুপোর বাটিতে দই ক্ষীর। পৌঁছে দিয়ে গেছেন নতুন কাকিরা। কাছে বসে বাতাস করেছে রমা।

যেরমা সধবা হয়েও বিধবা।

 স্বামী যার দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ!

উদ্দেশ যদি না হয়, আর কটা দিন পরেই বিধবাদের দলে ভিড়তে হবে রমাকে। কিন্তু সে কোন দলে? পাখা নেড়ে মাছি ওড়াতে ওড়াতে ভাবত রমা-এও এক রকমের বিধবা।

মাঝখানে কদিন পাখা নাড়ার চাকরিতে ছুটি হয়েছিল। রমা নিশ্বাস ফেলে ভেবেছিল, এই সুখ ঐশ্বর্য আরাম আয়েস মান-সম্মান ছেড়েও মানুষ পালায়? কত পাবে এর বদলে?

আজকে রমার মধ্যেকার প্রশ্নগুলো ধূসর হয়ে যাচ্ছে। আজ রমা শুনতে পাচ্ছে তার ঘরের একধারে যে সরু চৌকিটা পাতা হল, সেটা ছোটবউদির জন্যে।

অসম্ভব বলে শব্দটা তা হলে জগতে নেই?

কিন্তু খুব আশ্চর্যের কথা, ঊর্মিলা আদৌ বিচলিত হচ্ছে না এতে। ঊর্মিলা খুব সহজভাবে বলছে, কেন, এও তো ভালই ব্যবস্থা। বেশ তোমাদের সঙ্গে গল্প করা যাবে রাত্রে শুয়ে শুয়ে।

হয়তো খুব একটা বানিয়ে বানিয়েও বলে না। হয়ত নিজেকে ঊর্মিলা অন্য ছাঁচে ঢালাই করে ফেলবার সংকল্পই করছিল।

মন্দ কি যে রত্নাকর চৌধুরীর বাড়ির আশ্রিতা গোষ্ঠীর দলে মিশে তার চোখের আড়ালে পড়ে থাকে!

নির্দায়ের স্বস্তিটাও পাওয়া যেতে পারে হয়তো! আর বোধ করি–এই এ রকম যা-তা করে থাকাটাই তার আশৈশবের অভ্যাস বলেই জলের মাছ ফের জলে পড়ার মতোই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল!

তাই রমাকেই সান্ত্বনা দিতে পারছে সে।

বলছে ও কী, তুমি অত দুঃখিত হচ্ছ কেন ভাই? আমার বাপের বাড়িটা তো তোমাদের এদিকটার থেকেও কত খারাপ! ভাঙা, বালি-খসা! সেই বাড়িতেই তো মানুষ হয়েছি আমি!

কী করে বলছে কে জানে!

যেন শুধু খারাপ ঘরে থাকবার অসুবিধাটারই প্রশ্ন। যেন মানসম্মানের প্রশ্ন বলে কিছু নেই। কিন্তু সে কথা তো স্পষ্ট করে বলে মনে পড়িয়ে দেওয়া যায় না? তার উপর আবার রমাকেই আদর্শ খাড়া করে দেখানো হয়েছে আজ। সত্যভামা বলে গেছেন, হ্যাঁ, রমার কাছে কাছেই থাকতেই হবে। থাকা উচিত! ওকে দেখে চৈতন্য হোক, শিক্ষা হোক! ষোলো বছর বয়েসে স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, আর আজ ওর এই সাতাশ বছর বয়েস, দেখ কীভাবে কাটিয়ে গেল! পরপুরুষের ছায়া কেমন তা দেখল না কখনও। ওর পথ অনুসরণ করতে চেষ্টা করতে হবে।…তারপর গুরুদীক্ষা! গুরুদীক্ষা না হলে তো শুদ্ধি হবে না? সে যতদিন না হবে, তুমি যেন আমাদের রান্নাবান্নার বা খাবারের জলে হাত দিয়ে বোসো না। কিছু ছোঁবে না, বুঝলে? গুরুদীক্ষা হয়ে গেলে, মহাপ্রসাদ মুখে দিইয়ে গুরুর আদেশ নিয়ে তবে ব্যবস্থা। তবে ঠাকুর দেবতার কাজে কোনওদিনই লাগবে না তুমি, তা জেনে রেখো।

জজের মতো উচ্চারণ করেছেন সত্যভামা, শাস্তির হুকুম।

 কিন্তু চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কেন?

এযাবৎ তো দাসদাসীরা বোবা কালা অন্ধ হয়ে থেকেছে, আর কি থাকবে? সেইটাই ভাবনা। তা থাক, তাই বলে তো আর সেই ভয়ে ফাঁসির আসামির ফাঁসির হুকুম রদ হয় না! আর চুপিচুপিও হয় না সেই হুকুম দেওয়া।

.

ভাদ্দরবউয়ের ব্যাপারে তুমি আর মাথা ঘামাচ্ছ কেন? অলকা লম্বা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলে, মা যা ভাল বুঝেছেন, করেছেন।

শিলাকর ওই মাতৃভক্তিমণ্ডিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, মা যখন যা বোঝেন ভালই বোঝেন, আর যখন যা করেন ভালই করেন, এই তবে তোমার বিশ্বাস?

বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়, মার হুকুম মানতেই হয় দেখে আসছি বরাবর, সেটাই অভ্যাস।

আচ্ছা, তোমার একটুও খারাপ লাগছে না?

লাগছে। লাগবে না কেন? অত আরাম আয়েসে রাজরানির মতো ছিল—

এখন খুঁটেকুড়ুনি হল। শিলাকর বলে, আমি তো ভাবতেই পারছি না। কী করে সহ্য করছ বলো তো?

জগৎ সংসারে চোর-ডাকাতের জেল হচ্ছে, খুনির ফাঁসি হচ্ছে, পাপীর সাজা হচ্ছে–দেখা অভ্যাস, তাই সহ্য হয়ে যাচ্ছে।

চুলের গোড়ায় ফিতে বাঁধে অলকা কষে কষে।

স্বামীর অভিযোগটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। কষ্ট তার হচ্ছে বইকী, ছোটবউয়ের এই দুর্দশা ভেবে খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু তার চাইতেও বিশেষ খারাপ লাগছে শিলাকরের এই ক্ষুব্ধ অভিযোগ, এই যন্ত্রণা, অস্থিরতা। কেন? এ রকম হচ্ছে কেন? কই ইতিপূর্বে তো কখনও ছোটবউমা সম্পর্কে কোনও চেতনা দেখা যায়নি? ছোটবউমার যখন অত বড় দুর্দিন গেল, যখন ভাগ্যের মার খেয়ে সত্যিই রাজরানি থেকে খুঁটেকুড়ুনি হল, তখনও তো শিলাকরের মুখে শোনা যায়নি আহা ছোটবউমার কী হল!

এখন ছোটবউমা যতদূর নয় ততদূর একটা গর্হিত কাজ করে শাস্তি পাচ্ছে, তোমার মায়া উথলে উঠছে কেন? এখন জমিদারের জমিদারি গেছে, বিষদাঁত ভাঙা, নইলে আগের কাল হলে, ওই বউকে হেঁটে কাঁটা ওপরে কাঁটা করত না?

এ তো কিছুই নয়।

তবু অলকার যথেষ্ট দুঃখ হচ্ছে। ছোটবউয়ের ঘরটায় তালা ঝুলছে, আর ছোটবউ রমাদের ওই অন্ধকার অন্ধকার ঘরটায় কোনও এক কোণে বসে আছে, দেখে বুকটা কেমন করে উঠছে।

সেই কষ্ট থেকে যে রাগটা হচ্ছে সেটা আর কারও উপর নয়, ওরই উপর। হতভাগী লক্ষ্মীছড়ি কেন করল অমন কাজ?

স্বামী তোকে অত ভালবাসত, সেই স্বামী যেতে যেতেই ভুলে গেলি? হিন্দু ঘরের মেয়ে, চিরকালই তো জেনে এসেছ বিধবাকে কীভাবে চলতে হয়। অথচ তুমি অসংযমী মেয়ে, চরিত্র খারাপ করলে, কুলত্যাগ করলে!

কেন? কেন?

অলকা তোমার শূন্য হৃদয়ে শান্তি দেবার জন্যে তার একমাত্র ছেলেটাকে তোমায় দিয়ে রেখে দেয়নি? সেই বাৎসল্যরসে মন ভরল না তোমার, তুমি বাঘিনী, তোমার রক্ত চাই, তবে আর তোমার জন্যে দুঃখ করে কী করবে অলকা?

তোমার এই পালানোটা যেন অলকারও কলঙ্ক। যেন বউ জাতটাতেই অবিশ্বাস ধরিয়ে দিলে তুমি! তা ছাড়া সবাই তো ভাববে হয়তো কেউ দেখত না ওকে!

অলকা দেখত না?

সব সময় কাছে কাছে রাখতে চাইত না। সময় পেলেই গল্প করত না? নিজে সব কাজ ঘাড়ে নিয়ে তোমায় আরাম দিত না? শাশুড়ির কোপদৃষ্টি থেকে আড়াল করে আগলে বেড়াত না তোমায়?…কিন্তু সে সব ভস্মে ঘি হয়ে গেছে।

তুমি সে সবের মান রাখলে না!

তবে আবার তোমার দুঃখে গলে কী হবে? ভাবুক শিলাকর অলকা হৃদয়হীন, বয়ে গেছে। অলকা পারবে না শিলাকরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আহা আহা করতে।

বরং লক্ষ রাখবে হঠাৎ এমন আহার উৎপত্তি হল কোথা থেকে।

এদিকে তো গিন্নি চুপচাপ, তবে ছলাকলা জানে ঢের। মাঝে গল্পগাছা করতে করতে দেখেছে হাসিতে উদ্দাম হতে, আবেগে লাল হতে। গান কবিতা জানে তো ঢের। জানি না কোনখান থেকে উদ্ধার করে এনেছে শিলাকর, কীভাবে এক গাড়িতে এসেছে।

হয়তো কথা কয়েছে।

 হয়তো কেঁদে কেঁদে দুঃখ জানিয়েছে।

পুরুষের মন গলাতে কতক্ষণ?

 অলকা তার স্বামীকে অবিশ্বাস করছে না, তবে অবিশ্বাসিনীকে চোখে চোখে রাখতে হবে।

অবিশ্বাসিনী!

অবিশ্বাসিনী!

ওই তো একমাত্র পরিচয় তোর লক্ষ্মীছাড়ি! এ সংসারের সোনার কৌটোটি তোর হাতে ছিল, তুই সে কৌটো কানাকড়িতে বেচে দিলি! ছিঃ!

তোকে আবার মায়া!

অলকা বিদুষী নয়, কিন্তু অলকা পাঁচ লাইব্রেরি নাটক-নভেল শেষ করেছে। শেষ করেছে অবশ্য শ্বশুরশাশুড়ির অসাক্ষাতে, শিলাকরের সহায়তায়।

তা সে যাই হোক, ওই নাটক নভেল থেকেই অনেক বুদ্ধি বেড়েছে তার, দৃষ্টি অনেক স্বচ্ছ হয়েছে। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, বোধ জন্মেছে।

শিলাকরের এই আকুলতা অন্যায় মনে হচ্ছে অলকার। মনে হচ্ছে শিলাকরের ভাব বদলেছে। আজ তো বাবার ঘোড়ায় বেরোবার সময় উঠলই না।

কী এ?

.