মেমোয়ার্স অফ মিডনাইট (মধ্যরাতের স্মৃতি) — সিডনি সেলডন
গল্প শুরুর আগে
কাউলুন, মে, ১৯৪৯–মনে হবে এটা বুঝি একটা অ্যাকসিডেন্ট। তুমি তার ব্যবস্থা করতে পারবে কী?
কথাগুলো অপমানের মতো বিঁধছে। লোকটা বুঝতে পারল, তাকে রাগিয়ে দেবার জন্য ইচ্ছে করেই কথাগুলো বলা হচ্ছে। রাস্তার যে-কোনো অ্যামেচারের কাছে এই প্রশ্ন করলে সেটা মানানসই হত। সে উত্তর দিতে চাইল হাসতে হাসতো, নিজের ওপর আগাধ আস্থা আছে আমার। আমি এটা ব্যবস্থা করতে পারব। আপনি কী চাইছেন? অ্যাকসিডেন্টটা ঘরের মধ্যে হোক? আমি কি মেয়েটিকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব? নাক ভেঙে দেব তার? সে এখন মারসেইলসে আছে। নাকি তাকে বেশি মদ খাইয়ে মাতালিনী করে দেব। বাথটবে ডুবে মরবে সে। অবশ্য হেরোইনের ওভারডোজ দেওয়া যেতে পারে অথবা মুখে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়বে। কেউ তার মৃত্যুর কারণ জানতে পারবে না। নাকি আপনি চাইছেন, খেলাটা বাইরে হোক? ট্রাফিক অ্যাকসিডেন্ট, বিমান দুর্ঘটনা, সমুদ্রে জাহাজ ডুবে যাওয়া–কোনটা আপনার পছন্দ?
এসবই সে বলতে পারত, কিন্তু বলেনি। তার কারণ হল, উল্টোদিকে বসে থাকা লোকটিকে সে ভয় পায়। ওই লোকটি সম্পর্কে সে অনেক হাড় হিমকরা গল্পকথা শুনেছে। গল্পগুলো বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সে বলল–হ্যাঁ স্যার, আমি দুর্ঘটনার ব্যবস্থা করতে পারি। এবং কেউ সেই রহস্যটা উদঘাটন করতে পারবে না।
কথাগুলো বলে সে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ।
১৮৪০ সালে একদল চিনা ব্রিটিশ আক্রমণকারীদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য এই বাড়িটা তৈরি করেছিল। এই বাড়িটার অবস্থিতি কাউলুন নামে একটি প্রাচীর আচ্ছাদিত শহরের মধ্যে। এই বাড়ির তিনতলাতে চলেছে কথোপকথন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেওয়ালগুলো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বাইরে আর-এক সারি দেওয়াল আছে। কোনো অচেনা আগন্তুক চট করে এখানে ঢুকতে পারে না। এখানে কারা ঘোরাঘুরি করে? দৃবৃত্তের দল, যারা মদ খায়, ধর্ষক এবং ড্রাগ আসক্তরা। চারপাশে সরু অলিন্দ, অন্ধকার সিঁড়ি। বিষণ্ণতার ছাপ। ট্যুরিস্টদের সাবধান করে দেওয়া হয়। পুলিশরাও টু টাউ সিন স্ট্রিটের এই অন্ধকার গলতার ভেতর প্রবেশের ছাড়পত্র পায় না। শহরের উপকণ্ঠে এ এক আশ্চর্য গোলকধাঁধা! জানালায় গেলে শহরের দৃশ্যপট পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। নানা ভাষার কিচিরমিচির শুনতে পাওয়া যায়। এরা সবাই ওই প্রাচীর আচ্ছাদিত শহরের বাসিন্দা।
শেষ অব্দি উনি বললেন ঠিক আছে। তোমাকে আমি বিশ্বাস করছি, কোনটা সহজ পদ্ধতি এবং নিরাপদ–তোমাকেই তা ঠিক করতে হবে।
–স্যার, যাকে সরিয়ে দিতে হবে, সে কি কাউলুনে আছে?
লন্ডনে। তার নাম ক্যাথেরিন, ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার।
.
একটি লিমুজিন, পেছনে পেছনে আর একটি গাড়ি আছে, দুজন সশস্ত্র বডিগার্ড। মানুষটিকে লাস্টকার ওয়েডর হাউসে নিয়ে গেল। জায়গাটা সিম সাঁ সুই অঞ্চলে। বু হাউস খুলে দেওয়া হয় বিশেষ কিছু মানুষের জন্য। রাষ্ট্রপ্রধানরা মাঝে মধ্যে এদেশে ভ্রমণ করতে আসেন। আসেন চলচ্চিত্র জগতের মহানায়কেরা, করপোরেশনের প্রেসিডেন্টরা। প্রশাসক তাদের সেবা করতে পেরে গৌরব এবং আনন্দবোধ করে। ছ বছর আগে একটি তরুণী মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে যায়। সে একজন সংবাদপত্র প্রতিনিধির সাথে তার খদ্দের সম্পর্কে আলোচনা করেছিল। পরদিন সকালে অ্যাবারডিন বন্দরে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। কে বা কারা রহস্যজনকভাবে মেয়েটিকে দু টুকরো করে ফেলেছে। কথায় বলে ৪ হাউসে সবকিছু পাওয়া যায়। অস্পর্শিত কুমারী কন্যা, পুরুষ, সমকামী, তারা মানুষ এবং মনুষ্যতর জীবদের সন্তুষ্টি দিতে পারে। এখানে দশম শতাব্দীর কিছু বিশেষ খেলা এখনও চলে। তার নাম ইশিনপো। ব্লু হাউসকে নিষিদ্ধ উত্তেজনার স্বর্গ বলা যেতে পারে।
লোকটি এক জোড়া যমজ কন্যাকে ডাক দিলেন। আহা, স্বর্গের দুই রুপসী বুঝি। তাদের অসামান্য লাবণ্যবতী শরীরের সুষমা দেখার মতো। কোনো ব্যাপারে ছুতমার্গ নেই। গতবার যখন উনি ৪ হাউসে এসেছিলেন, যে আরাম আর সন্তুষ্টি পেয়েছিলেন। এবার কি তা ছাড়িয়ে যাবে? বাথটবে সুগন্ধিত ঈষদুষ্ণ জল। টাইল ভিজে গেছে। তিনি আনন্দ পেলেন উখিত হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত। তারপর…
তিন ঘণ্টা কেটে গেছে। সন্তুষ্টি এবং আরামের সর্বোচ্চ শিখর অব্দি পৌঁছে গেছেন। এবার ওঁনাকে মডিরোডে যেতে হবে। লিমুজিন এগিয়ে চলেছে। লিমুজিনের বন্ধ জানালা দিয়ে উনি আকাশের দিকে তাকালেন। যে শহর কখনও ঘুমোয় না, তার আলোেগুলো জ্বলছে। চিনারা এই শহরটির নামকরণ করেছে নটি ড্রাগনের শহর বলে। তার মনে হল, তিনি বোধহয় এই শহরের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। কিন্তু এই শহরটাকে দেখলে কেন এত বিষণ্ণ বলে মনে হয়? তার মনে তো বিষণ্ণতার কোনো জায়গা নেই!
.
ওঁনারা মডি রোডে পৌঁছে গেলেন।
তাওবাদী পাদরি অপেক্ষা করছিলেন। তাকে দেখে মনে হয়, তিনি বুঝি পুরোনো পার্চমেন্ট কাগজ দিয়ে তৈরি এক ভৌতিক মূর্তি। তার পরনে বিবর্ণ প্রাচ্যদেশীয় জোব্বা। তার সাদফিনফিনে দাড়ি বাতাসে উড়ছে।
তিনি দুর্বোধ্য ভাষায় কী সব মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করলেন। হাতে হাত রেখে ঝকানি দিলেন। কাঠের তৈরি একটা কাপে কাঠি দিয়ে কীসব করলেন। তারপর নেমে এল নীরবতা। তাওবাদী পাদরি মশাই কারও সাথে আলোচনা করলেন। আগন্তুকের দিকে তাকালেন। থামা থামা ইংরেজিতে বললেন–ঈশ্বরের অনুগ্রহে আপনি আপনার সবথেকে খতরনাক শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পাবেন।
ভদ্রলোকের মনে আনন্দের বিচ্ছুরণ। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি জানেন, এই ব্যাপারের অন্তরালে কোনো সত্য লুকিয়ে নেই। একে উপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সামনে। তিনি কিছু বললেন না। কারণ আজ তার জন্মদিন।
তাওপন্থী ভদ্রলোক বললেন–ফেংশুই আপনাকে আশীর্বাদ করবেন।
শয়তান লোকটি চোখ বন্ধ করলেন। কাজে সফল হতে হলে সকলের আশীর্বাদ দরকার।
পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। তিনি এখন লিমুজিনে বসে আছেন। হংকং এয়ারপোর্ট কাইট্রাকের দিকে এগিয়ে চলেছেন। সেখানে তার নিজস্ব উড়ানপাখি অপেক্ষা করছে, তাকে সাবধানে এবং নিরাপদে এথেন্সে নিয়ে যাবে বলে।
.
০১.
আওয়ানিনা, গ্রিস; জুলাই ১৯৪৮।
প্রতি রাতে এমনই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। মেয়েটির মনে হয়, সে যেন হ্রদের জলে তলিয়ে যাচ্ছে। তীব্র আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসে। ঝড় উঠেছে। একজন পুরুষ এবং একজন নারী তাকে বরফ ঠান্ডা শীতল জলে ডুবিয়ে মারার ষড়যন্ত্র করছে। প্রত্যেক রাতে ঠিক এমন সময়েই শিহরিতা অবস্থায় মেয়েটির ঘুম ভাঙে। নিঃশ্বাস নেবার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তার সমস্ত শরীর ভিজে যায় ঘামে।
সে জানে না, তার অতীত জীবনে এমন কোনো দৃশ্য আছে কিনা। সে ইংরেজি বলতে পারে, কিন্তু সে জানে না তার পরিচয় কী। কোথা থেকে সে গ্রিসে এসেছে, কীভাবে এই ছোট্ট কারমেলাইট কনভেন্টে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
সময় এগিয়ে চলে। আজ তার অস্তিত্বে অতীতের কোনো স্মৃতির বিচ্ছুরণ নেই। নেই কোনো অচেনা অজানা অনুভূতি। কেবল কিছু কিছু ভৌতিক সত্তা মাঝে মধ্যে মিছিল করে এগিয়ে যায়। সে দ্রুত মুখের দিকে তাকায়। শনাক্তকরণের চেষ্টা করে বা পরীক্ষা করে। তারপর? অযাচিত কিছু মুহূর্ত। আবার সেই দ্বিধা দ্বন্দ্বের সমুদ্রে সাঁতার কাট।
প্রথমদিকে সে নিজেকে প্রশ্ন করত। কারমেলাইট সন্ন্যাসিনীদের সাথেও কথা বলত। তারা সর্বত্যাগী, তাঁরা সহনশীলা। তারা নৈঃশব্দ্যের পরিবেশ বজায় রাখতে চাইতেন। শেষ অব্দি মেয়েটিকে শুধুমাত্র সিস্টার থেরেসার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হল। ওই প্রবীণা ভদ্রমহিলা এখানকার মাদার সুপিরিয়র।
–আপনি কি জানেন আমি কে?
না, তোমার আসল পরিচয় আমার জানা নেই। সিস্টার থেরেসা বলেছিলেন। আমি কীভাবে এখানে এসেছি?
আওয়ানিনা নামে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে। সেই গ্রামটির অবস্থান পাহাড়ের সানুদেশে। গতবছর প্রচণ্ড ঝড়ের সময় তোমাকে পাওয়া গেছে একটা ছোট্ট নিমজ্জমান নৌকোতে। নৌকোটা প্রায় ডুবতে বসেছিল। ঈশ্বরের অপার অনুগ্রহে আমাদের দুজন সিস্টারের চোখে তুমি ধরা পড়েছিলে।
–কিন্তু, আমি আগে কোথায় ছিলাম?
–আমি জানি না, এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না। এই উত্তরে মেয়েটি শান্ত হতে পারেনি। বারবার সে মাথা নেড়ে প্রশ্ন করেছে কেউ কি আমার অতীত সম্পর্কে প্রশ্ন করেনি? কেউ কি আমার আসল পরিচয় জানতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেনি?
সিস্টার থেরেসা মাথা নেড়ে বলেছেন, এখনও পর্যন্ত কেউ তোমার সম্পর্কে কিছু জানতে চায়নি।
এই উত্তর শুনে মেয়েটির মনের মধ্যে জেগেছে হতাশা। সে আবার বলেছে- খবরের কাগজের পাতার তারা কি আমার নিরুদ্দেশ হবার ঘটনা ছাপেনি?
–তুমি তো জানো, বাইরের পৃথিবীর সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে দেওয়া হয় না। আমরা ঈশ্বরের কারুণ্যের কথাই মনে রাখি। হে আমার প্রিয় কন্যা, তার করুণা না থাকলে তুমি কি আজ বেঁচে থাকতে?
সংক্ষিপ্ত সংলাপ শেষ হয়ে গেছে। প্রথম দিকে মেয়েটি মাঝে মধ্যেই কেমন অসহায় বোধ করত। নিজেকে নিয়ে বিব্রত থাকত সে। মাস এগিয়ে গেছে। সে তার হারানো আত্ম শক্তি আবার ফেরত পেয়েছে। চেহারাটা হয়ে উঠেছে লাবণ্যবতী।
এখন সে বড়ো বড়ো পা ফেলে এখানে-সেখানে যেতে পারে। অবশ্য কনভেন্টের চার দেওয়ালের মধ্যে পুষ্পিত উদ্যানেই তার বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। কনভেন্টের এই জগৎ বিস্তীর্ণ। এখানে একটা অলৌকিক আভা আছে। বিকেল বেলা সুগন্ধি বাতাস বয়ে যায়, লেবু এবং দ্রাক্ষার গন্ধ নিয়ে।
এখানকার বাতাবরণ শান্ত, স্নিগ্ধ এবং মনোরম। তবে মেয়েটির মনে শান্তি নেই কেন? সে ভাবে আমি হারিয়ে গেছি। কেউ আমাকে ভালোেবসে না। কিন্তু কেন? আমি কি কোনো খারাপ কাজ করেছি? আমি কে? বারবার এই প্রশ্নটা তাকে আঘাত করে।
চোখ বন্ধ করলেই কিছু ছবি সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। ছবিগুলোর অন্তরালে কী আছে, সে জানে না। একদিন সকালে একটা অদ্ভুত দৃশ্যকল্প দেখতে পেল সে। দেখল, একটি ঘরের মধ্যে সে বসে আছে। উলঙ্গ অবস্থায় এক পুরুষ এসে তাকে নগ্ন করার চেষ্টা করছে। এটা কি স্বপ্ন? নাকি এমন একটা ঘটনা, তার হারানো জীবনে ঘটে গিয়েছিল। ওই পুরুষটি কে? ওই পুরুষটির সঙ্গে কি তার বিয়ে হয়েছিল? তার কি স্বামী ছিল? তার হাতে বিয়ের আংটি নেই। আসলে এখানে তার নিজস্ব বলতে কিছুই নেই। সিস্টার থেরেসা তাকে একটি ব্ল্যাক অর্ডার দিয়েছেন। এটি সম্মানের যোগ্য। দিয়েছেন একটি স্মারক, ছোট্ট সোনালি পাখি, চোখ দুটি রক্তরুবির। ডানা দুটি দুপাশে প্রসারিত।
মেয়েটির কেবলই মনে হয়, তার কোনো নাম নেই। সে এই জগতে এক অজানা আগন্তুক। কেউ তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় না। কোনো মনোবিশারদ তার সাথে কথা বলে না। তার মনের এই অশান্ত অবস্থার অবসান কী করে হবে? কী করে সে তার হারানো অতীতের কথা জানতে পারবে?
–তখনও ওই মূর্তিগুলো আসে। অস্পষ্ট ছায়া-ছায়া ছবি। অতি দ্রুত চোখের সামনে দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তার মন শান্ত হল। মনে হল, সে বুঝি বিরাট একটা জিগস ধাঁধার সামনে বসে আছে। খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলোর আলাদা কোনো অনুভূতি নেই। একদিন একটা অদ্ভুত ছবি দেখল সে। অবশ্যই মনে মনে। স্টুডিয়োতে একদল মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সকলের গায়ে সামরিক পোশাক। এটি কি কোনো চলচ্চিত্র? আমি কি একজন অভিনেত্রী ছিলাম? নাকি আমার ওপর কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কী সেই দায়িত্ব?
একজন সৈন্য এসে তার হাতে প্রস্ফুটিত রক্তগোলাপ রেখেছে। সে হেসে বলেছে একদিন এই উপহারের জন্য তোমাকে কড়া মাশুল দিতে হবে।
দু রাত কেটে গেছে। মেয়েটি আবার সেই একই পুরুষকে স্বপ্নে দেখেছে। এয়ারপোর্টে গিয়ে সে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে। পুরুষটির সাথে আর তার দেখা হবে না। বিচ্ছেদের বেদনা করুণ রাগিণীতে বেজে উঠেছে।
এই স্বপ্ন দেখার পর সে সব অর্থে তার মানসিক শান্তি হারিয়েছে। এখন সে আর শুধু স্বপ্ন দেখে না। এখন চারপাশে সে অনেক মানুষকে দেখতে পায়। তার অতীত হাসতে থাকে। আমাকে জানতেই হবে, কী আমার আসল পরিচয়।
একদিন মাঝরাতে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। অবচেতন মন থেকে কে যেন বলে উঠল- হ্যাঁ, আমি আমার আসল নামটা খুঁজে পেয়েছি। আমি হলাম ক্যাথেরিন, আমি হলাম ক্যাথরিন আলেকজান্ডার।
.
০২.
এথেন্স, গ্রিস।
মানচিত্রে চোখ মেলে দিলে আমরা কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের সাম্রাজ্য দেখতে পাব না। তবে মানুষজন বলে থাকে, তিনি এখানকার সবথেকে শক্তিশালী মানুষ। সারা পৃথিবীর দু-তিন জন ধনীর মধ্যে তিনি অন্যতম। তার ক্ষমতার হাত যে কত দূর বিস্তৃত কেউ তা জানে না। তার কোনো রাজকীয় পদক নেই। নেই কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব। তবে তিনি নাকি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কার্ডিনাল, রাষ্ট্রদূত এবং রাজাদের নিয়মিত কেনাবেচা করেন। তার নিজস্ব গুপ্তচর সর্বত্র ছড়ানো আছে। তিনি অন্তত বারোটি দেশকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি হলেন এক শক্তিশালী পুরুষ। মনের ভেতর আকাঙ্ক্ষার তেজ আছে। শরীরটা সুগঠিত। চেহারা খুব দীর্ঘ নয়, কিন্তু প্রসারিত। কাঁধের ওপর পৌরুষের ছাপ আছে। গায়ের রং তামাটে। গ্রিকদেশীয় মানুষদের মতো উন্নত নাক। চোখ দুটিতে অলিভ-কালোর আভা। মুখ দেখলে মনে হয়, তিনি বুঝি তৃষিত বাজপাখি। যখন কোনো সমস্যা হয়, তখন তাকে। সব থেকে বেশি আনন্দিত দেখা যায়। আটটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। বিশ্বের অন্যতম শিল্পসংগ্রাহক। একাধিক নিজস্ব উড়ানপাখি আছে তার। বারোটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক। বিশ্বের নানা প্রান্তে নিজস্ব ভিলা আছে তার। এককথায় তিনি সৌন্দর্যের উপাসক। তিনি জানেন, রূপসী মেয়েদের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। অত্যন্ত অনুগত প্রেমিক হিসেবে তার সুনাম আছে। তাঁর বৈষয়িক অভিযানের মতোই চিত্তাকর্ষক তার প্রেমের উপাখ্যান।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস নিজেকে একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে ভাবতে ভালোবাসেন। কোলোনাকি এবং পাসারাতে তিনি যে ভিলা কিনেছেন, সেখানে সর্বদা সাদা-নীল গ্রিক পতাকা উড়তে দেখা যায়। তার নিজস্ব দ্বীপ আছে। কিন্তু তিনি করে দেন না। তিনি সাধারণ মানুষের উপর প্রযুক্ত আইনের পরোয়া করেন না। কারণ তার রক্তে ঈশ্বরের রক্ত প্রবহমান।
যারা ডেমিরিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন, তাঁরা সকলেই তার সাহায্যপ্রার্থী। কেউ হয়তো একটা ব্যবসা করতে চাইছেন, অর্থ দরকার। কেউ চাইছেন, দান হিসেবে কিছু টাকা। অথবা কেউ তার সাথে বন্ধুত্ব প্রার্থনা করছেন। ডেমিরিস কাউকেই ফেরান না। তিনি মানুষের সাথে কথা বলতে ভালোবাসেন। তাঁর বিশ্লেষণী মন আছে, আছে সন্দিগ্ধ দুটি চোখ। তিনি জানেন, কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। তার জীবনের উদ্দেশ্য হল বন্ধুদের কাছে ডাকবে, শত্রুদের আরও কাছে।
এইভাবেই তিনি জীবনের চলার পথে এতদূর অগ্রসর হতে পেরেছেন। একটা অদ্ভুত সমোহনী ক্ষমতা আছে তার। আছে আভিজাত্য ভরা চাউনি। তিনি পৃথিবীর রাজা–এমন একটি মনোভাব পোষণ করেন। তিনি জানেন, অপরাধীর চোখে অত্যাচারের ছায়া কাঁপে না। তিনি আরও জানেন, সকলের দিকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হয়।
তিনি সমস্ত মানুষকে ক্ষমা করেন। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় একটি শব্দ আছে, যার বাংলায় প্রতিশব্দ হল সকলের প্রতি সমান আচরণ করা। এই শব্দটির কাছাকাছি আর একটি শব্দ আছে। তার অর্থ, সকলকে অবিশ্বাস করা। ডেমিরিস এই দুটি শব্দের প্রতি অগাধ আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। তিনি জানেন, সকলকে ভালোবাসতে হবে। আর ভালোবাসার মানুষ যে কোনো মুহূর্তে শক্ত হতে পারে। তাতে কী? ডেমিরিসের মনে আঙ্কিক বিশুদ্ধতা আছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা ছাড়া তিনি কোনো কিছুকেই গ্রহণ করেন না। ডেমিরিস শান্তভাবে কাজ করতে পারেন। বিরুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে তাঁর প্রতিভার সর্বাত্মক বিকাশ ঘটে যায়। তিনি মাকড়সার মতো জাল বিছাতে পারেন। এইভাবেই তিনি বৈরিতার সম্পর্ক শেষ করেন। শত্রুদের হত্যা করেন, নিঃশব্দে এবং নিপুণভাবে।
ডেমিরিস সময় কাটাতে ভালোবাসেন বন্ধু এবং শত্রুদের মধ্যে। শুভানুধ্যায়ীদের সাহচর্য পছন্দ করেন। তাদের হত্যা করেন। তাদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের ব্যক্তিত্ব, কেমন, সেটা দেখে নেন। তারা কতখানি শক্তিশালী, তার প্রতি দৃকপাত করেন। খুঁজে বার করতে চেষ্টা করেন তাদের দুর্বলতার দিকচিহ্নগুলিকে।
এক সন্ধ্যায় একটি নৈশভোজের আসরে ডেমিরিসের সাথে দেখা হয়ে গেল একজন মোশন-পিকচার-এর প্রোডিউসারের। ভদ্রলোক কথাচ্ছলে তাকে অবজ্ঞা করে সম্বোধন করেন। ডেমিরিস কিন্তু কিছুই বলেননি। ইতিমধ্যে দু-বছর কেটে গেল। ভদ্রলোক তখন । আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এক অভিনেত্রীকে তার পরবর্তী ছবির জন্য সই করিয়েছেন। এই ছবিটা শেষ পর্যন্ত মুক্তিলাভ করল না। কেননা ডেমিরিস এতদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছিলেন। দেখা গেল, ওই সুন্দরী অভিনেত্রী তার প্রমোদ তরণীর বাসিন্দা হয়েছে।
ডেমিরিস হাসতে হাসতে বলেছিলেন, চলো আমরা মধুচন্দ্রিমা যাপন করি।
মেয়েটি রাজি হয়েছিল। মধুচন্দ্রিমায় দিন কাটিয়েছিল। যদিও বিয়ে হয়নি। তাদের শুধু ছবিটি বন্ধ হয়ে গেল। প্রযোজক দেউলিয়া হয়ে গেলেন।
ডেমিরিস এইভাবেই অদ্ভুত খেলা খেলতে ভালোবাসেন। কোনো ব্যাপারে অযথা তাড়াহুড়ো করেন না। অনুমান শক্তি আছে তার। নিখুঁত প্রকল্পনা রচনা করতে পারেন। এবং শেষ অব্দি প্রকল্প শেষ করেন সুন্দরভাবে। মনে হয়, তার বুঝি কোনো শত্রু নেই। কারণ তার শত্রু হবার মতো সাহস কার আছে! তবে জীবনে চলার পথে অনেক মানুষকেই তিনি শত্রু হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সব ব্যাপারে নজর দেবার মতো অদ্ভুত সহজাত ক্ষমতা আছে তার। তিনি কখনও কোনো ক্ষতচিহ্নকে ছোটো করে দেখেন না। কারও কাছে সাহায্য পেলে সেটা মনে রাখেন। এক সময় একজন দরিদ্র মৎস্যজীবী তাকে সাহায্য করেছিল। পরবর্তীকালে সেই মৎস্যজীবীকে তিনি বেশ কটি জাহাজ কিনে দিয়েছিলেন, একদা এক বারাঙ্গনা তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। শেষ অব্দি দেখা গেল সে এক বিরাট অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হয়েছে। বেচারি জানতেও পারেনি, কে এই কাজটি করল।
ডেমিরিসের জীবনকাহিনী শোনার মতো। পিরায়ুসের এক স্টিভোডারের ছেলে হিসেবে পৃথিবীর বুকে তার আগমন ঘটে গিয়েছিল। চোদ্দোজন ভাইবোন ছিলেন তারা সব মিলিয়ে। টেবিলে যথেষ্ট খাবারের দানা থাকত না।
প্রথম চেতন প্রহর থেকেই কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যবসা ছাড়া উন্নতি হবে না। স্কুলের পড়াশোনার পর এটা-সেটা করে টাকা আয় করার চেষ্টা করেন। ষোলো বছর বয়সে যথেষ্ট পয়সা জমিয়ে তিনি একটা খাবারের দোকান খুললেন ডক অঞ্চলে। সঙ্গে নিলেন এক বৃদ্ধ পার্টনারকে। কিছুদিনের মধ্যে ব্যবসাটা ফুলে ফেঁপে আকাশ ছুঁল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক ডেমিরিসের সাথে প্রতারণা করলেন। ডেমিরিস দশ বছর অপেক্ষা করার পর সেই লোকটিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এইভাবে তখন থেকেই ডেমিরিসের মনে ভবিষ্যৎ উচ্চাশার আগুন জ্বলতে থাকে। সমস্ত রাত তিনি দু চোখের পাতা এক করতে পারতেন না। অন্ধকারে তার চোখ দুটি জ্বলে উঠত। মনে মনে তিনি এই শপথবাক্য উচ্চারণ করতেন–আমাকে যথেষ্ট বড়োলোক হতে হবে। আমাকে নাম করতে হবে। একদিন পৃথিবীর সব জায়গায় আমার নাম পৌঁছে যাবে!
ঘুম আসত না। সারা রাত এইভাবেই অনিদ্রার সাথে সহবাস করে কেটে যেত। কিন্তু কীভাবে বড়োলোক হবার দরজাটা খুলে যাবে ডেমিরিস তা জানতেন না। শুধু জানতেন, একদিন স্বপ্ন সফল হবেই!
ডেমিরিসের সতেরোতম জন্মদিন। সৌদি আরবের তৈলখনি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পড়লেন। হঠাৎ ভবিষ্যতের ম্যাজিক দরজাটা তার সামনে খুলে গেল। তিনি সরাসরি বাবার · কাছে গেলেন। বললেন আমি সৌদি আরবে যাব, তেলের খনিতে কাজ করব।
–তেলের খনি সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?
–কিছুই জানি না আমি, ওখানে গিয়ে শিখব।
একমাস কেটে গেল। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস তখন তার লক্ষ্যপথে এগিয়ে চলেছেন।
.
ট্রান্সকনটিনেন্টাল অয়েল করপোরেশন। বিদেশ থেকে যেসব কর্মচারী আসছে, তাদের সাথে দু-বছরের শর্ত করা হচ্ছে। ডেমিরিসকেও এই শর্তে সই করতে হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন সৌদি আরবে বছরের পর বছর কাটাতে। এখানকার বাতাসে টাকা ওড়ে। এখানে বসে একটা সুস্থির ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে হবে। চোখ বন্ধ করলে আরব্য উপন্যাসের গল্পকথা মনে পড়ত তার। আরব দেশ, প্রাচ্য দেশের রহস্য, রোমাঞ্চ আর কুহক মায়ার প্রতীক। এখানে যৌনবতী রমণীদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তাদের সূর্যদীপ্ত তামাটে শরীর, থেকে উঠে আসে ভালোবাসার স্বেদ। তবে বাস্তব কি এতটাই সুন্দর!
গরমকালের এক প্রত্যুষে ডেমিরিস ফাদিলিতে এলেন। চারপাশে ধু-ধু মরুপ্রান্তর। ইতস্তত দুএকটা বাড়ি চোখে পড়ছে। দু-একটা ছোটোখাটো পাহাড়। হাজার হাজার নীচু শ্রেণীর মানুষ কাজ করছে। সকলেই আরবদেশীয়। চোখে মুখে কালো কাপড় ঢাকা মেয়েরা হনহনিয়ে এগিয়ে চলেছে রাস্তা দিয়ে। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, সর্বত্র দুর্গন্ধ আর ময়লার হাতছানি।
.
ডেমিরিস একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। এখানে ম্যানেজার জে জে ম্যাকইনটায়ারের অফিস।
ম্যাকইটায়ার ওই যুবা পুরুষটির দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছিলেন। বলেছিলেন শেষ পর্যন্ত তুমিও এখানে এলে?
-হ্যাঁ, স্যার।
–এর আগে তুমি কোনো দিন তেলের খনিতে কাজ করেছ বাবা?
এক মুহূর্তের জন্য কী যেন ভেবে নিলেন ডেমিরিস, মিথ্যে কথা বলতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ অব্দি বললেন–না, স্যার।
ম্যাকইনটায়ার ঢোক গিলে বললেন–তুমি কি এই জায়গাটাকে ভালোবাসতে পারবে? অনেক দূর থেকে এসেছ। খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক নেই। কোনো মহিলার সাথে কথা বলতে পারবে না। কারও দিকে তাকালে তোমার চোখ গেলে দেওয়া হবে। রাতে শুয়ে শুয়ে দুঃস্বপ্ন দেখবে। কিন্তু পয়সাটা ভালোই।
আমি এখানে থাকতে এসেছি। সব কিছু নিজে দেখব। ডেমিরিস বলেছিলেন। উৎকণ্ঠা এবং ব্যগ্রতা ঝরছিল তার কণ্ঠস্বরে।
মনে রেখো, এটি কিন্তু মুসলমানদের দেশ। এখানে অ্যালকোহল পাবে না। চুরি করলে হাত কেটে দেওয়া হবে। প্রথমবার ডান হাত, দ্বিতীয়বার বাঁ হাত। তৃতীয়বার তোমার একটা পা কেটে নেওয়া হবে। কাউকে হত্যা করলে তোমার শিরচ্ছেদ করা হবে।
–আমি কাউকে মারতে আসিনি।
ম্যাকইনটায়ার বললেন ঠিক আছে, চাকরিটা পাকা হল।
.
কম্পাউন্ডটি ছিল টাওয়ার অব ব্যাবেল। বারোটি বিভিন্ন দেশের মানুষ কথা বলছে। যে যার ভাষা বলার চেষ্টা করছে। ডেমিরিস সকলের কথা শোেনার চেষ্টা করলেন। একটির পর একটি ভাষা শিখতে থাকলেন। মনে হত, এই শূন্য দেশে ওরাই তার আপনার লোক। এখানে অনেক কিছু আছে। আবার কিছুই নেই। একটির পর একটি বৈদ্যুতিক কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। বড়ো বড়ো বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। আরও অনেক কিছু লাগবে। টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা। তার জন্য মুটে মজুর এবং আরও লোক। জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা, চিকিৎসা কেন্দ্র। সেদিনের তরুণ ডেমিরিসের মনে হয়েছিল, এখানে একশোটা কাজ আছে। একশ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা। দরদর করে ঘাম হচ্ছে। নানা ধরনের রোগ। মশা মাছির যুগপৎ আক্রমণ। ধুলো ধোয়া আর অন্ধকার। আমাশা, কলেরা আরও কত কী। এখানে সর্বত্র মৃত্যুর হাহাকার, তারই মাঝে বিধাতার অকৃপণ আশীর্বাদ। তরল সোনা! আহা, কেন এই বৈপরীত্য!
কিছু কিছু মানুষ ড্রিলিং-এর কাজে যুক্ত ছিলেন। এসেছেন ভূতত্ত্ববিদেরা। সার্ভেয়ার এবং ইনজিনিয়াররা। ডেকে আনা হয়েছে অয়েল কেমিস্টদের। তারা সকলেই মার্কিন দেশের বাসিন্দা। উঁচুপদে তাদের একাধিপত্য, তবে খাটাখাটনির কাজে স্থানীয় লোকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বেশির ভাগ সময়টাই বাইরে কাটান। হাতে কলমে কাজ শেখার চেষ্টা করেন। প্রশ্ন করতে থাকেন। যদিও উত্তর কোথায় পাবেন, তা জানেন না। গরম বালি জল শুষে নিচ্ছে। ডেমিরিস বুঝতে পারলেন, ড্রিল করার দুটো পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।
কৌতূহল বশে একদিন একজন ড্রিলারের কাছে পৌঁছে গেলেন। বেচারি ড্রিলার, একশো তিরিশ ফুট ডিরিক নিয়ে কাজ করছিল।
ডেমিরিস জানতে চাইলেন- আমি বুঝতে পারছি না, কেন এখানে দু-ধরনের পদ্ধতি চালু আছে?
ড্রিলার জবাব দিয়েছিলেন–একটাকে কেবল টুল বলা হয়, অপরটি রোটারি। আমাকে এখন রোটারি পদ্ধতিতে কাজ করতে হচ্ছে। দুটো পদ্ধতির মধ্যে দারুণ সাদৃশ্য আছে।
–ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবেন কী?
-হ্যাঁ, তোমাকে গর্ত খুঁড়তে হবে। ধীরে ধীরে গর্তের দৈর্ঘ্য বাড়াতে হবে। শেষ অব্দি গর্তটা নীচে অনেক দুর জায়গায় পৌঁছে যাবে। এটাই হল ডিরিক পদ্ধতি। আমি জানি, ডিরিক সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। তাই তো?
না, স্যার।
–সপ্তদশ শতকের এক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম শুনেছ কী?
না।
–চিনারা বহু বছর আগে এইভাবে মাটি খুঁড়ে জল বের করত। তাদের কর্মপদ্ধতি ছিল একেবারে বিজ্ঞানসম্মত। আজকের দিনে পঁচাশিভাগ খননের কাজ তাদেরই পদ্ধতিতে করা হয়।
ব্যাপারটা কী? জানার জন্য ডেমিরিস আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
মানুষটি বলতে থাকেন এখানে ছোট্ট একটি গর্ত করা হয়। অনেকটা এই ধরনের গর্ত। তারপর একটি স্টিলের রডকে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। মেশিনের সাহায্যে রডটিকে আরও নীচে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রডটি ফিরে এলে বুঝতে পারা যায়, ওখানে তরল সোনা আছে কিনা।
ডেমিরিস খুশি হয়েছেন। ব্যাপারটা জলের মতো সহজ হয়ে গেছে। উনি বললেন আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল খুবই শক্ত ব্যাপার। কিন্তু এখন এখানে এসে বুঝতে পারছি, এর মধ্যে জটিল ব্যাপার কিছু নেই। তবে মাথাটা পরিষ্কার রাখতে হবে। মনটাও তরতাজা থাকবে। তা না হলে ঠিক মতো কাজটা হবে না। ড্রিলিং করার সময় রোটারি কী কাজ করে?
প্রত্যেকটি শ্রমিকের সাথে সংযোগ রক্ষা করে। ড্রিল পাইপ ফুটো হয়ে গেছে, সেটিকে সারিয়ে ফেলে, আরও কত হাজার রকমের কাজ!!
–স্যার, মনে হচ্ছে এবার আমাদের ভাগ্যের চাকাটা ঘুরবে। আমরা বোধহয় নিজেরাই একটা তেলের খনি কিনে নেব।
ধন্যবাদ, এবার কি আমি কাজে যেতে পারি?
.
একদিন সকালে ডেমিরিস মন দিয়ে কাজ করছিলেন। তৈলকূপের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তিনি দেখলেন, ড্রিলার মাটিতে গর্ত করছে না। তার বদলে এখানে সেখানে আঁচড় কাটছে।
ডেমিরিস জানতে চেয়ে ছিলেন আমাকে মাফ করবেন, এটা কী ধরনের কাজ হচ্ছে?
এই কথা শুনে ড্রিলারের ভুরু দুটি কুঁচকে দিয়েছিল। এই পদ্ধতিকে বলে কোরিং পদ্ধতি। আমরা পাথরের টুকরোগুলোকে বিশ্লেষণ করব। দেখ, তার মধ্যে তেল থাকার সম্ভবনা কতখানি।
বাঃ, বেশ ভালো পদ্ধতি তো!
.
কাজ এগিয়ে চলেছে সহজ স্বাভাবিকভাবে। ডেমিরিস এখন আরও পাকা-পোক্ত হয়ে উঠেছেন। মাঝে মধ্যেই তিনি ড্রিলারের সঙ্গে সময় কাটান। তিনি জানেন, এই ড্রিলারের হাতে আসল চাবিকাঠি। কোথায় কোথায় গর্ত খোঁড়া হচ্ছে। সে ব্যাপারগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। ড্রিলারদের একটা আশ্চর্য অনুমান শক্তি আছে। ওপর থেকে দাঁড়িয়ে তারা বুঝতে পারে। মাটির নীচে কোথায় তরল সোনা আছে।
–এটা কী ধরনের কাজ, আমায় বুঝিয়ে বলবে?
–একে প্রস্তাবিত ছিদ্র করা বলা হয়। আমরা এই ছিদ্র করি নানা কাজের জন্য। এর মাধ্যমে কোম্পানির অনেক অর্থ বাঁচানো যেতে পারে।
কতকিছু শেখবার আছে, ডেমিরিস ভাবতে থাকেন। সত্যি কথা বলতে কী, এই রহস্যময় জগতে তিনি এক অজানা আগন্তুক।
এভাবেই কথাবার্তা এগিয়ে চলে। প্রশ্নোত্তরের পালা। ডেমিরিসের কেবলই মনে হয়, এত অসংখ্য প্রশ্ন রয়ে গেছে, সব কটির উত্তর তিনি এখনও জানতে পারেননি।
একদিন কথায় কথায় ডেমিরিস জানতে চাইলেন-একটা ব্যাপার বুঝিয়ে বলবে ভাই, তোমরা কী করে বোঝ, কোথায় ড্রিল করতে হবে?
আমাদের সঙ্গে অনেক ভূতাত্ত্বিক আছেন। তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। তারা এই ব্যাপারে যথেষ্ট গবেষণা করেছেন। অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের দিন এগিয়ে চলেছে। সূর্য ওঠার আগেই তিনি খনি অঞ্চলে চলে আসেন। কাজ করতে কখনও ক্লান্তি অনুভব করেন না। সূর্য ডোবা পর্যন্ত একনাগাড়ে তাঁর কাজ চলতে থাকে। কত কিছু করার আছে। ড্রাইভিং তাঁর প্রধান কাজ। এর পাশাপাশি তেল উৎখননের আরও অনেকগুলি কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত আছেন। ভাবতে অবাক লাগে, গনগনে আগুন-আঁচে তার ক্লান্তি আসে না। দিনরাত তাকে বিষাক্ত বিষ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়।
জে জে ম্যাকইনটায়ার ডেমিরিসের কাছে সত্যি কথাই বলেছিলেন- খাবার অত্যন্ত বাজে। থাকার ব্যবস্থাও ভালো নয়। রাত্রিবেলা কিছুই করার থাকে না। ডেমিরিসের কেবলই মনে হয়, কেউ বুঝি তার সমস্ত শরীরে অসংখ্য ফুটো করে দিয়েছে। সেই ফুটোগুলো বালি দিয়ে ভরতি করা হয়েছে। তবে মরুভূমিকে আপাতদৃষ্টিতে নিষ্প্রাণ বলে মনে হলেও তার একটা স্বতন্ত্র প্রাণস্পন্দন আছে। এই প্রাণস্পন্দন আমাদের সকলকে অনুভব করতে হয়। বালি ঢুকে পড়ে তার শরীরের সর্বত্র। জামাকাপড় বালিতে বালিতে কেমন যেন হয়ে যায়। সে সময় অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে।
মাঝে মধ্যে বালির ঝড় ওঠে। দিনের পর দিন একই রকম ঝড় চলতে থাকে। দিন বললে ভুল হবে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে থাকে তার অস্তিত্ব। এই সময় অনেক মানুষ পাগল হয়ে যায়। হয়ে যাওয়ারই কথা। বাতাবরণ এমন হলে মানুষ বেঁচে থাকবে কেমন করে?
ডেমিরিস কিন্তু এর মধ্যেও কাজ করতে থাকেন। এই ব্যাপারে তার অদম্য উৎসাহ। মাঝে মধ্যেই তিনি যেচে গিয়ে প্রশ্ন করেন, আজ কী কাজ করতে হবে?
অফিসাররা তার উৎসাহ দেখে অবাক হয়ে যান। তারা অনেক সময় বারণ করেন। কিন্তু তরুণ ডেমিরিসের হাতে বেশি সময় নেই। তিনি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সৌদি আরবের এই অঞ্চলে এসেছেন। তাকে অল্প সময়ের মধ্যে আরও সচেতন হয়ে উঠতে হবে। আরও কর্তব্যনিষ্ঠ। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যে সম্পর্কে তিনি এখনও শিক্ষানবিশ। তার ইচ্ছা, সব কিছু জেনে তবেই আরব মুলুক ত্যাগ করবেন তিনি।
নানা জায়গাতে নিত্যনতুন তৈলকূপ খননের কাজ দ্রুতবেগে এগিয়ে চলেছে। প্রকৃতির এই অফুরান ভাণ্ডারে কত লক্ষ ডলার লুকিয়ে আছে ভাবতে অবাক লাগে! নতুন করে তৈলখনির সন্ধান পাওয়া গেল আবু হাদরিয়া এবং কাতিফ ও হারাদে। সেখানে শুরু হল কর্মযজ্ঞ। নিস্তব্ধ প্রহর সচকিত হয়ে উঠল। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছে কাজের খোঁজে।
.
সেই সময় দুজন নতুন আগন্তুক এলেন। এক ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ এবং তার স্ত্রী। হেনরি পটার, ষাট বছর বয়স হয়েছে। তার বউ সাইবিল, তিরিশ বছরের এক তরতাজা তরুণী। সাইবিল পটারকে এক অসাধারণ রূপবতী রমণী হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে কী? আপাত দৃষ্টিতে সেখানে মনে হয় তার মধ্যে আকর্ষণীয় কিছু নেই। সবথেকে বিশ্রী তার গলার খরখরে আওয়াজ। ফাদিলিতে থাকার সময় তাকে অনন্যা সুন্দরী বলা হত। হেনরি পটারকে সব সময় নিত্যনতুন তৈল খনি উদ্ভাবনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। বেচারি সাইবিল, তার যৌবন দিন কাটে একা একা। নিদারুণ নিঃসঙ্গতার মধ্যে।
ডেমিরিসের ওপর একটি নতুন কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হল। তাকে এখন মাঝে মধ্যেই পটার দম্পতির কোয়ার্টারে যেতে হচ্ছে। ঘরদোর আগোগাল হয়ে পড়ে আছে। ডেমিরিসকে বলা হয়ছে, সবকিছু গুছিয়ে দিতে।
সাইবিল পটার তার খ্যানখ্যানে গলায় অভিযোগ করলেন, এমন বাজে জায়গা আমি কোথাও দেখিনি। জীবনটা আমার একেবারে নরক হয়ে গেল। হেনরি তো কাজপাগল মানুষ। এইসব পাণ্ডববর্জিত জায়গাগুলো বেছে বেছে নির্বাচন করে। আমি জানি না কীভাবে এখানে থাকব!
ডেমিরিস বলেছিলেন, আপনার স্বামী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। আপনি কি জানেন কোম্পানির কাছে এই কাজটা কতখানি দরকারি?
ডেমিরিসের দিকে তাকিয়ে সাইবিলের চোখ দুটি হঠাৎ জ্বলে উঠল। সাইবিল তীক্ষ্ণ ঝঝালো কণ্ঠস্বরে বললেন আমার স্বামী কিছুই করছেন না। তুমি কি বুঝতে পারছ, আসল কাজে সে কতটা ফাঁকি দেয়?
ঢোঁক গিলে ডেমিরিস জানালেন না, ম্যাডাম, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
কৌতুকের চিহ্ন লেগে আছে সাইবিলের কণ্ঠস্বরে।
সাইবিল জানতে চাইলেন–তোমার নাম কী?
–ডেমিরিস, ম্যাডাম। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস।
বন্ধুরা তোমাকে কী নামে ডাকে? এত বড়ো খটমট নাম। উচ্চারণ করতে গেলে তো চারটে দাঁত ভেঙে যাবে।
আন্তরিক হবার চেষ্টা করছেন সাইবিল। ডেমিরিস তার আচরণে অন্য কিছুর পরশ পাচ্ছেন কী?
কোস্টা।
-ঠিক আছে কোস্টা, মনে হচ্ছে আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু হতে পারব। আমাদের দুজনের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা সাধারণ, তাই নয় কি?
আপনি কী বলতে চাইছেন?
আবার দুষ্টু হাসির চিহ্ন ফুটে ওঠে সাইবিলের ঠোঁটের গোড়ায়। সাইবিল বললেন–পরে তোমাকে সব বুঝিয়ে দেব।
ডেমিরিস আমতা আমতা করতে থাকেন আমাকে কাজে যেতে হবে।
বেশ কয়েকটি সপ্তাহ কেটে গেছে। সাইবিল পটার মাঝে মধ্যেই এই তরুণকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, তিনি বোধহয় ডেমিরিসের কাছে কিছু প্রার্থনা করছেন। কিন্তু কী? নিঃসঙ্গতার সাহচর্য? শারীরিক উত্তাপ? নাকি আরও কিছু?
একদিন সাইবিল বললেন–হেনরি আজ সকালে চলে গেল। কবে যে ড্রিলিং-এর ভূতটা ওর ঘাড় থেকে নামবে? এই করে করে বাড়িতে ড্রিলিং-এর কাজে ফাঁকি দিচ্ছে। লোকটা!
এই অভিযোগের কোনো জবাব ছিল না ডেমিরিসের কাছে। ডেমিরিস জানেন, ওই ভূগোলবিশারদের কাঁধে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোম্পানির কাছে তিনি অপরিহার্য মানুষ। ডেমিরিস তখনও পর্যন্ত পটারের স্ত্রীর সাথে জড়িয়ে পড়তে চাননি। এই কাজে মন দিলে, নিজের আসল কাজটাকে অবহেলা করা হবে। তবে ডেমিরিস জানেন না, কীভাবে তাকে ফাঁদে ফেলা হবে। তিনি তখনও জানেন না, পরবর্তীকালে কোন্ কাজটা তার জীবনের সবথেকে বড়ো কাজ হয়ে দেখা দেবে। তিনি কেবল জানেন, তেলের খনির মধ্যে একটা চমৎকার ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে। ডেমিরিসের আপ্রাণ ইচ্ছে, তিনিও ওই ভবিষ্যৎ দিশারীর অংশীদার হবেন।
.
তখন মধ্যরাত। হঠাৎ সাইবিল পটারের ডাক এল ডেমিরিসের কাছে। ডেমিরিস পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলেন কমপাউন্ডের ধারে। দরজাতে শব্দ করলেন।
সাইবিল পটারের মিষ্টি কন্ঠস্বর শোনা গেল। কাম ইন।
ডেমিরিস ভেতরে প্রবেশ করলেন। সাইবিলকে দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। ভদ্রমহিলার পরনে পাতলা ফিনফিনে রাতপোশাক। দুর্ভাগ্যবশত ওই পোশাক তাঁর উত্থিত যৌবনের কোনো কিছুই আচ্ছাদিত করতে পারেনি।
আমতা আমতা করে ডেমিরিস বলতে থাকেন ম্যাডাম, আপনি কি আমাকে ডেকেছেন? নাকি আমি ভুল শুনেছি?
–ভেতরে এসো কোস্টা। এমন ইতস্তত ভাব করছ কেন? দেখ তো বিছানার ধারের এই আলোটা কাজ করছে না কেন?
ডেমিরিস চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন। ল্যাম্পের কাছে এগিয়ে গেলেন। তিনি সেটা পরীক্ষা করে বললেন–ম্যাডাম, এখানে তো কোনো বালবই নেই।
সহসা তার মনে হল, নরম তুলতুলে দুটি বুক তাকে আদরের আশ্লেষে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। মিসেস পটার… কোনো রকমে সেঁক গিলে ডেমিরিস উচ্চারণ করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু ঠোঁট দুটি তখন বন্দি হয়েছে মিসেস পটারের ঠোঁট দুটির সাথে। পটার উন্মত্ত আক্রোশে ডেমিরিসকে টানতে টানতে বিছানার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। হায় ভাগ্য! ডেমিরিস বুঝতে পারলেন, পৃথিবীতে মাঝে মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে, যার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
অতি দ্রুত ডেমিরিসকে উলঙ্গ করা হল। তখন শ্রীমতী পটারের মুখ থেকে সুখী শিকারের শব্দ বেরিয়ে আসছে।
হায় ঈশ্বর, তোমার এটা কত বড়ো! দেখ, তোমার খোকা আমার মুঠোর মধ্যে কেমন লাফালাফি করতে শুরু করেছে।
একটু বাদে চরম শিহরণের মুহূর্ত এসে গেল। সবকিছু হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সাইবিল বলতে থাকেন, ওঃ ডার্লিং, আমি সত্যি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি!
–ডেমিরিস অনেকক্ষণ সেখানে শুয়েছিলেন। একা একা এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এ আমি কী করলাম? যদি পটার আমার এই গোপন অভিসারের খবর পান, তাহলে কী হবে? তাহলে আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।
মনে মনে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন ডেমিরিস। তাকে এই অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে সাইবিল পটার হিহি করে হেসে উঠেছেন–মনে রেখো সোনা, তোমার আমার এই অভিসারের ব্যাপারটা পৃথিবীর কেউ জানতে পারবে না। দেখো, কী কায়দা করে এটাকে আমি লুকিয়ে রাখব।
.
কয়েক মাস ধরে শরীরের খেলা চলতেই থাকে। ডেমিরিস কিছুতেই সাইবিলকে উপেক্ষা করতে পারছেন না। ভাগ্যটা তার ভালোই বলতে হবে। সাইবিলের স্বামী বেচারাকে বছরের বেশির ভাগ দিন বাইরে বাইরে থাকতে হয়। নতুন নতুন বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। ডেমিরিস সেই সুযোগটাই নিতে চেষ্টা করেন। মাঝে মধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করেন, আমি কি সাইবিলকে প্রতারণা করছি? ব্যাপারটা এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যদি এটা শুধু দেহের সংযোগ হত, তা হলে ভুলে যেতে এক মুহূর্তে লাগত না। কিন্তু সাইবিল সত্যি সত্যি ডেমিরিসকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলেছেন। সাইবিলের নিঃসঙ্গ দাম্পত্য জীবনে। ডেমিরিস তার অদম্য পৌরুষ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
–এখানে তোমার মতো একজন পুরুষের দেখা পাওয়া যাবে, আমি তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি! চলো, তুমি আর আমি ইংল্যান্ডে ফিরে যাই।
একদিন হাসতে হাসতে সাইবিল বলেছিলেন। এই কথা শুনে ডেমিরিসের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তিনি জবাব দিয়ে ছিলেন–ম্যাডাম, আমি তো গ্রিসের বাসিন্দা।
ডেমিরিসের উলঙ্গ শরীরের এখানে-সেখানে হাত চিরুনি চালাতে চালাতে সাইবিল বলেছিলেন- এখন আর নও। তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবে। আমি হেনরিকে ডিভোর্স করব। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
সাইবিলের এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে, ডেমিরিস টোক গিলতে থাকেন। তার মনে সহসা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তিনি কোনোক্রমে বলেন- সাইবিল, আমার হাতে কোনো পয়সা নেই…
এবার সাইবিলের লালাভ দুটি ঠোঁট নেমে এল ডেমিরিসের বুকের ওপর–সেটা কোনো সমস্যা নয় সোনা। আমি জানি, তুমি টাকা আয় করতে পারবে। তুমি হবে আমার প্রিয়তম।
কী করে জানলেন?
সাইবিল বিছানার ওপর বসলেন–গতরাতে হেনরি আমাকে সবকিছু বলেছে। হেনরি একটা বিরাট নতুন তৈলখনি আবিষ্কার করেছে। হেনরি ভীষণ চালাক। এই ব্যাপারে সে খুবই উত্তেজিত। ডাইরিতে সব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে রেখেছে। বলেছে, তার এই রিপোর্টটা সকালবেলায় পোস্ট করতে হবে। আমার হাতে রিপোটটা আছে। তুমি একবার দেখবে নাকি?
এই কথা শুনে ডেমিরিসের হৃৎস্পন্দন অত্যন্ত দ্রুত হয়ে ওঠে। এমনই একটা সোনার সুযোগের সন্ধানে এতদিন তিনি মগ্ন ছিলেন। তিনি বললেন–হ্যাঁ, আমি একবার দেখব।
সাইবিল বিছানা থেকে উঠে গেলেন। টেবিলের কাছে গেলেন। একটা ম্যানিলা এনভেলপ বের করলেন। সেটা হাতে নিয়ে বিছানাতে ফিরে এলেন।
–এটা খোলো।
কিছুক্ষণের জন্য ডেমিরিসের মনে সতোর উদয় হয়েছিল। তিনি ইতস্তত করতে থাকেন। কাঁপা কাঁপা হাতে এনভেলপটা খুলে ফেললেন। ভেতরের কাগজগুলো বাইরে নিয়ে এলেন। ভেতরের এই সাদা কাগজের মধ্যেই হয়তো কালো অক্ষরে লেখা আছে ডেমিরিসের ভবিষ্যৎ সোনালি জীবনের সম্ভাবনা। মোট পাঁচটি পাতা। প্রত্যেকটি পাতার ওপর ডেমিরিস চোখ বোলালেন। প্রত্যেকটি শব্দ আলাদাভাবে পড়তে চেষ্টা করলেন।
–এই খবরগুলো তোমার কাছে দরকারি কী?
কথাগুলো ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল। নতুন একটি তৈলখনি সম্পর্কে এক বিজ্ঞানীর অভিমত। এই খনিটি আবিষ্কৃত হলে মানবসভ্যতার ইতিহাস একেবারে পালটে যাবে।
ডেমিরিস তবুও তার আনন্দ মুখের ভাবে প্রকাশ করলেন না। তখনও পর্যন্ত তিনি সাইবিলকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। আসলে ডেমিরিসের চরিত্রটাই হল এ ধরনের। পৃথিবীর কোনো মানুষকে তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেন না। তার মনের আকাশে সব সময় সন্দেহের মেঘের আনাগোনা।
তিনি আমতা আমতা করে বলতে থাকেন- হতে পারে, হতে পারে…
–তাহলে? তুমি এই প্রকল্পে যোগ দেবে কী? সাইবিল জানতে চাইলেন, তাহলে আমাদের হাতে অপরিমাপ্য অর্থ আসবে। আসবে না?
ডেমিরিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–ব্যাপারটা অত সোজা নয় ম্যাডাম।
-কেন?
ডেমিরিস বোঝাবার চেষ্টা করেন অনেক টাকা লাগবে। ওই জায়গাটা কিনতে হবে। এত টাকা কে দেবে? বলা যেতে পারে, এটা একধরনের জুয়া খেলা।
চকিতে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কথা মনে পড়ে গেল বেচারি ডেমিরিসের। তিনশো ডলার! ফুঃ, এ দিয়ে কোনো কাজ হয় কী?
–তা নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না সোনামণি। আমার স্বামী যথেষ্ট বডোলোক। আমি একটা চেক লিখব। পাঁচ হাজার ডলার হলে কাজ হবে কী?
নিজের কানকেও বুঝি বিশ্বাস করতে পারছেন না কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস! তিনি বললেন- হ্যাঁ, ওই টাকাটা পেলে আপাতত কাজ করা যেতে পারে।
–ভেবে দেখ, এই টাকাটা আমি লগ্নি করতে চাইছি। আমাদের যৌথ জীবনের নিরাপত্তার জন্য। ডার্লিং, তুমি আমার কথার আসল অর্থ কী বুঝতে পারছ তো?
ডেমিরিস অনেকক্ষণ স্থাণুর মতো বসেছিলেন। তারপর তিনি বললেন–সাইবিল, এই রিপোর্টটাকে আপনি দু-একদিন এখানে রাখতে পারবেন কী?
-হ্যাঁ, আমি শুক্রবার পর্যন্ত এটা রেখে দেব। আশা করি, তার মধ্যেই কাজটা তোমার হয়ে যাবে ডার্লিং।
ডেমিরিস মাথা নাড়লেন–হ্যাঁ, শুক্রবার..অনেক সময় আমার হাতে থাকবে।
.
পাঁচ হাজার ডলার ডেমিরিসের হাতে এসেছে। না, এটা দান নয়, এটা নেহাতই একটা ঋণ–ডেমিরিস টাকাটা পেয়ে মনে মনে প্রবোধ দিলেন। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের ভাগ্যের চাকা এবার সত্যি সত্যি ঘুরতে শুরু করেছে। যেখানে সম্ভাব্য তৈলখনিটির অবস্থান, ডেমিরিস সেখানে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। তারপর, জায়গাটা কিনেই ফেললেন। কয়েকটা মাস এগিয়ে গেল। কাজ শুরু হল। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস তখন এক কোটিপতিতে পরিণত হয়েছেন।
তিনি কিন্তু কথা রেখেছেন। সাইবিল পটারের হাতে পাঁচ হাজার ডলার তুলে দিয়েছেন। আর সঙ্গে দিয়েছেন একটা নতুন রাতপোশাক। তারপর গ্রিসে ফিরে গেছেন। সাইবিলের সাথে আর কখনও ডেমিরিসের দেখা হয়নি।
.
০৩.
একটা তত্ত্ব আমাদের মানতেই হবে। প্রকৃতি কোনো কিছুই নষ্ট করে না। প্রতিটি শব্দ আমরা উচ্চারণ করি, প্রতিটি কথা আমরা বলি, তারা মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও থেকে যায়। একদিন অবশেষে সবকিছু অবিকৃতভাবে ফিরে আসে।
রেডিয়ো আবিষ্কৃত হবার আগে কী হয়েছে? মানুষ তখন জগৎ সম্পর্কে কী ভাবত? মানুষ কি জানত ইথার নামে কোনো তরঙ্গ আছে? আমরা কি জানতাম, আমাদের গান এবং কবিতা এভাবেই একদিন ফিরে ফিরে আসবে? মানুষ একদিন আরও উন্নত হবে। সে হয়তো সময় ঘোড়ার সওয়ার হয়ে ফিরে যাবে আগের দিনগুলোতে। লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ ভাষণ শুনতে পাবে। সেক্সপিয়ারের গলাও শুনতে পাবে সে, পাহাড়ের ওপর যে তত্ত্বকথা শোনানো হয়েছিল।
.
ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার তার অতীত জীবনের নানা শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু এই শব্দগুলো এমন জড়ানো যে তার আসল অর্থ কী, সেটা সে বুঝতে পারে না। এই শব্দগুলো তার উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা আরও বাড়িয়ে দেয়।
-ক্যাথি, তুমি কি জানো তুমি একজন বিশেষ স্বভাবের মেয়ে। তোমার সাথে আমার যখন প্রথম দেখা হয়েছিল…।
ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে। আমি ডির্ভোস চেয়েছি। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।
-তোমার সাথে যে খারাপ ব্যবহার আমি করেছি, তার জন্য আমি আন্তরিক অনুতপ্ত। ব্যাপারটা তোমাকে বলতে এসেছি…
–সে কিন্তু আমাকে হত্যা করতে চেয়েছে।
–কে তোমাকে মারতে চেয়েছে?
–আমার স্বামী।
এভাবেই শব্দের অন্তহীন মিছিল এগিয়ে চলে। শব্দের ঝড় ওঠে। ক্যাথেরিনের কেবলই মনে হয়, সে বুঝি একটা ক্যালিডোস্কোপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ রেখেছে, একটির পর একটি প্রতিচ্ছবি তৈরি হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। জীবনটা কি এক চলমান ক্যালিডোস্কোপ?
কনভেন্টের পরিবেশ কিন্তু চমৎকার। এককথায় একে এক শান্ত স্নিগ্ধ স্বর্গ বলা যেতে পারে। কিন্তু সহসা ক্যাথেরিনের মনে হল, তাকে বোধহয় কোনো বদ্ধ কামরায় জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। সে কনভেন্টের বাসিন্দা হতে চায়নি। হতে পারে তার একটা বর্ণ উজ্জ্বল অতীত আছে। হতে পারে অতীতটা খুব একটা ভালো নয়। কিন্তু সেখানে ঘটনার প্রবাহ আছে।
ক্যাথেরিন জানে না, সে এখন কী করবে বা কোথায় যাবে।
অদ্ভুত নিয়মে এই কনভেন্টের মধ্যে কোনো আয়না রাখা হয়নি। সন্ন্যাসিনীরা যাতে তাদের রূপ-যৌবন সম্পর্কে অবহিত হতে না পারে, তাই এই কঠিন কঠোর নির্দেশনামা। কিন্তু একটা টলটলে পুকুরের জল আছে বাগানের পাশে। ক্যাথেরিন সেই জলের দিকে সহসা তাকায় না। তাকালে হয়তো অবাক হয়ে যাবে সে। জলে তার মুখের প্রতিচ্ছবি পড়বে। সেই ছবি দেখলে মনটা হু হু করবে।
একদিন সকালবেলা সে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ কী মনে হল তার, জলের কাছে মুখ আনল। আহা, এত সুন্দর একটি মুখ! সূর্যতাপে দৃপ্ত, একরাশ কালো চুলের বন্যা, শরীরের কোথাও খুঁত নেই, উজ্জ্বল দুটি চোখ ধুসরতায় আচ্ছাদিত। কিন্তু সেই চোখে বিষণ্ণতার বেদনা।
একটু বাদে আর একটা মুখ ভেসে উঠল সেখানে। একটা মস্ত বড়ো মুখ। এক সুন্দরী রমণীকে দেখা যাচ্ছে। তখনও তিরিশ বছর বয়স হয়নি তার। এই রমণী কে? তার অতীত নেই এবং ভবিষ্যৎ নেই। সে একজন হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। এই মুখটি কি ক্যাথেরিনের? কাউকে দরকার, যে আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, ক্যাথেরিন চিন্তা করতে থাকে, যার কাছে আমি মনের সব কিছু খুলে বলতে পারব। এই সব কথা ভাবতে ভাবতে ক্যাথেরিন কখন পৌঁছে গেছে সিস্টার থেরেসার অফিসে।
–সিস্টার!
–এসো, এসো। সিস্টারের আন্তরিক সম্ভাষণ।
–আমি…মনে করছি একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেব। হয়তো ডাক্তারই বলতে পারবেন আমার আসল পরিচয়, তাই নয় কি?
সিস্টার থেরেসা ক্যাথেরিনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।
– এখানে বসো।
ক্যাথেরিন শক্ত চেয়ারের ওপর বসতে বাধ্য হল। সামনে পুরোনো দিনের একটা ডেস্ক রয়েছে।
সিস্টার থেরেসা বলতে থাকেন–ভগবানই তোমার চিকিৎসক। ঠিক সময়ে তিনি সব কথা বলবেন। এখানে আমরা তো বাইরের কোনো লোককে আসার অনুমতি দেব না। এটাই এখানকার নিয়ম।
ক্যাথেরিনের মনে হঠাৎ স্মৃতির বিচ্ছুরণ। একটা আবছা মূর্তি চোখে পড়ল। কনভেন্টের ধারে বাগানের পাশ দিয়ে কে এগিয়ে চলেছে!
কে যেন বারবার তাকে বলছে–তুমি এখানকার বাসিন্দা নও। তোমাকে অবিলম্বে এই স্থান ত্যাগ করতে হবে।
সমস্যা হল, সে কোথায় থাকবে?
ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে, ধোঁয়াশায় ভরা।
শেষ পর্যন্ত ক্যাথেরিন মরিয়া হয়ে বলে বসল- সিস্টার থেরেসা, আমাকে ক্ষমা করবেন, মনে হচ্ছে কারোর সাহায্য দরকার। আমি আর পারছি না। কতদিন এইভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় জীবন কাটাব বলতে পারেন?
ক্যাথেরিনের শব্দগুলো সিস্টার থেরেসাকে আঘাত করেছে। তিনি ভালোভাবে ক্যাথেরিনের মুখের দিকে তাকালেন। তার মুখ ভাবনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি বললেন–তুমি কি এই জায়গা থেকে চলে যেতে চাইছ? কিন্তু তুমি যাবে কোথায়?
–আমি জানি না, ভবিষ্যতের কোনো কিছুই আমি জানি না।
–ঠিক আছে, আমি কথা দিচ্ছি, তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আমরা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করব। আমরা এ বিষয়ে আবার কথা বলব।
–অনেক, অনেক ধন্যবাদ সিস্টার।
.
ক্যাথেরিন চলে গেল। সিস্টার থেরেসা তার ডেস্কে এসে বসলেন। এখনও অনেকক্ষণ তাকে ঘাড় গুঁজে কাজ করতে হবে। তবুও মনের মধ্যে ক্যাথেরিনের সমস্যাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব একটা সহজ নয়। শেষ অব্দি তিনি একটুকরো কাগজ নিলেন। কলম নিয়ে খসখস করে লিখতে শুরু করলেন।
তিনি লিখেছিলেন–শ্রদ্ধেয় মহাশয়, এখানে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যা আপনাকে জানানো উচিত বলেই আমি মনে করছি। আমাদের কোনো এক বন্ধু বলছে, মেয়েটি কনভেন্ট ছেড়ে যেতে চাইছে। এই অবস্থায় আমি কী করব, তাড়াতাড়ি আমাকে জানান।–
.
উনি এই নোটটা পড়লেন। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসলেন। এই শব্দগুলোর মধ্যে একটা হারানো সংকেত লুকিয়ে আছে। তা হলে? ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার আবার মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসতে চাইছে? ব্যাপারটা খুবই খারাপ। আমি তো তার কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছি। সাবধানে এবং খুবই সাবধানে।
এখন কী হবে? কনভেন্ট থেকে ক্যাথেরিনকে সরিয়ে ফেলতে হবে। ডেমিরিস সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার সিস্টার থেরেসার সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার।
.
পরদিন সকালবেলা ডেমিরিসের সোফেয়ার তাকে আওয়ানিনাতে নিয়ে গেল। গ্রামের পথ দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার সম্পর্কে অনেক কিছুই ভাবলেন। আহা, যখন প্রথম দেখা হয়েছিল, ক্যাথেরিনের শারীরিক সৌন্দর্য দেখে তিনি বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। ক্যাথেরিনকে তখন খুবই উজ্জ্বল স্বভাবের এক তরুণী বলে মনে হত। সব সময় উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। এত উৎসাহ এল কোথা থেকে? তার মধ্যে সবই ছিল,… ডেমিরিস চিন্তার জগতে ভেসে গেলেন। তারপর? তারপর কী যেন হয়ে গেল। ক্যাথেরিনের সাথে এক পাইলটের বিয়ে হল। এই বিয়েটাই ক্যাথেরিনের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে। একরাতের মধ্যে ক্যাথেরিনের বয়স দশ বছর বেড়ে গেল। সে একটা থলথলে কদর্য মহিলাতে পরিণত হল। ডেমিরিস দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, হায়, এইভাবে একজন মানুষের জীবন নষ্ট হয় কী করে?
.
সিস্টার থেরেসার অফিসে ডেমিরিস প্রবেশ করলেন।
এই ব্যাপারে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করেছি বলে আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু ওই মেয়েটি এখানে আর থাকতে চাইছে না। এমন আচরণ করছে, যাতে অন্য আবাসিকদের অসুবিধা হচ্ছে।
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে সিস্টার থেরেসা বলতে থাকেন।
–আপনি ঠিক কাজই করেছেন, কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বললেন, মেয়েটি কি তার ফেলে আসা দিনযাপনের কথা কিছু বলেছে আপনাকে?
সিস্টার থেরেসা মাথা নাড়লেন। না, এখনও পর্যন্ত কিছু বলেনি। তিনি জানলার কাছে হেঁটে গেলেন। দেখা গেল বাগানে সন্ন্যাসিনীরা কাজ করছেন।
মেয়েটি বোধহয় এখানে কোথাও আছে।..
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসও জানালার কাছে চলে গেলেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। তিনজন সন্ন্যাসিনীকে দেখা গেল। তারা পেছন ফিরে কাজ করছেন। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। একটু বাদেই তার কাঙ্ক্ষিত মুখটা চোখে পড়ল।
নিঃশ্বাস আটকে গেল ডেমিরিসের। আহা, সে এখনও সুন্দরী! কিন্তু কীভাবে এই ঘটনা ঘটল?
–কোথায় সে?
মাঝের মেয়েটি বোধহয়। সিস্টার থেরেসা বললেন।
ডেমিরিস ঘাড় নাড়লেন–হ্যাঁ।
সিস্টার থেরেসার শব্দগুলো তার কান বিদ্ধ করছে।
–আপনি এখন কী সিদ্ধান্ত নেবেন?
ডেমিরিস বললেন আমাকে একটু ভাবতে দিন। আমি আপনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলব।
.
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে এখন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ক্যাথেরিন আলেকজান্ডারকে তিনি দেখতে পেয়েছেন। তার চেহারার মধ্যে এই পরিবর্তন এল কী করে? কেউ ভাবতেই পারবে না, হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি আর এই মেয়েটি একই! ডেমিরিস চিন্তা করলেন। তখনই তার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এসে গেল। এই ব্যাপারটা ঠিক মতো রূপায়িত হবে কি?
সেই সন্ধ্যায় তিনি সিস্টার থেরেসার কাছে একটি গোপন নোট পাঠালেন।
.
এটা একটা অলৌকিক ঘটনা! ক্যাথেরিনের মনে হল। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নটা সফল হতে চলেছে। সিস্টার থেরেসা তাকে ছোট্ট সেলের বাইরে নিয়ে এলেন। বললেন, তোমার জন্য খুশির খবর আছে।
ক্যাথেরিনের চোখ দুটি বড়ো হয়ে উঠেছে অনুগ্রহ করে খবরটা বলবেন কি?
সিস্টার থেরেসা বাছা বাছা শব্দ দিয়ে বললেন–ভালো খবর। আমি তোমার সম্পর্কে আমার এক বন্ধুকে লিখেছিলাম। তিনি তোমাকে সাহায্য করতে চাইছেন।
ক্যাথেরিনের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে সাহায্য? আমাকে? আপনি সত্যি বলছেন?
-হ্যাঁ, তিনি অত্যন্ত ভালো স্বভাবের মানুষ। তার কথা মতো চললে তুমি কনভেন্ট ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতে পারবে। এই শব্দগুলো ক্যাথেরিনের শিরদাঁড়াতে একটা অদ্ভুত শিহরণের জন্ম দিয়েছে। সে আবার বাইরের জগতের পা রাখতে পারবে? কিন্তু সিস্টারের এই বন্ধুটি তাকে সাহায্য করতে চাইছে কেন?
সিস্টার থেরেসা বললেন তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। তার কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সোমবার সকালে তার গাড়ি তোমাকে নিতে আসবে।
পরবর্তী দু-রাত ক্যাথেরিনের চোখের তারায় ঘুম ছিল না। অদম্য উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপেছে সে। সে ভেবেছিল, কনভেন্টের চার দেওয়ালের মধ্যেই তার যৌবন-সূর্য অস্তমিত হবে। এখানেই একদিন মরতে হবে তাকে। বাইরের পৃথিবীর রূপ-স্বাদ-কর্ণ-গন্ধ কোনো কিছুই আর পাবে না সে। এখন সেই পরিবেশটা একেবারে পালটে গেছে। কিন্তু? এই কনভেন্ট ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে পা রাখলে ব্যাপারটা কেমন হবে? অনিশ্চয়তার আবরণ? আরও অন্য কিছু কী? ক্যাথেরিনের মনে হল, সে বুঝি উলঙ্গ হয়েছে। সে জানে না, তার আসল পরিচয় কী? হে ঈশ্বর, তুমি আমার ওপর সর্বক্ষণ কড়া নজর রেখো কিন্তু।
.
সোমবার ঠিক সময়ে কনভেন্ট গেটে লিমুজিন এসে দাঁড়াল। তখন ঢং ঢং করে ঘড়িতে সকাল সাতটা বেজেছে। ক্যাথেরিন সারারাত ঘুমোতে পারেনি। তার অচেনা ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছে। বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে।
সিস্টার থেরেসাকে দেখা গেল। তিনি ক্যাথেরিনের হাতে হাত রেখে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আর তখন? তখন বাইরের পৃথিবী ক্যাথেরিনকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আমরা সকলে তোমার জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব। যদি কখনও মনে হয় এই কনভেন্টে আবার তোমাকে ফিরে আসতে হবে, তাহলে কথা দিচ্ছি, তুমি বিন্দুমাত্র ইতস্তত কোরো না। কনভেন্টের দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা থাকবে।
–আপনাকে অনেক-অনেক ধন্যবাদ, সিস্টার। আপনার কথাগুলো আমি মনে রাখার চেষ্টা করব।
কিন্তু মনে মনে ক্যাথেরিন জানে, আর কোনোদিন সে কনভেন্টের মধ্যে ফিরে আসবে না। সে এখন এক মুক্ত বিহঙ্গী। নীল আকাশে তার দুটি সবল ডানা মেলে দেবে।
.
লিমুজিনে চড়ে শুরু হল যাত্রা। আওয়ানিনা থেকে এথেন্স, ক্যাথেরিনের মনে নানা আবেগের সঞ্চারণ। আহা, কনভেন্টের বাইরে পৃথিবী এত বর্ণময়! কিন্তু এখানে কি কোনো সমস্যা আছে? ভবিষ্যতের কথা সে জানে না। অতীতে কী ঘটেছিল? অতীতটা তার কাছে ফিরে আসছে না কেন? স্বপ্ন এবং তন্দ্রা, আচ্ছন্নতা এবং আবেগ–এই সবের অবসান কখন হবে?
.
বিকালবেলা একটা গ্রামের পাশ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। ছোটো একটা জনবসতি দেখা যাচ্ছে। সুখী সম্পৃক্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত তারা এথেন্স শহরের উপকণ্ঠে একটি জায়গায় পৌঁছে গেল। তারপর ঢুকে পড়ল জনাকীর্ণ শহরের মধ্যে।
ব্যাপারটা ক্যাথেরিনের কাছে খুবই অবাক লাগছে। কিন্তু এই শহরের দৃশ্যাবলি তার এত চেনা লাগছে কেন! ক্যাথেরিনের কেবলই মনে হতে লাগল, সে বোধহয় আগে এই শহরের বাসিন্দা ছিল, অন্তত এই শহরে কিছুদিনের জন্য এসেছিল। তা না হলে এমন মধুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হবে কী করে!
ড্রাইভার পূর্বদিকে এগিয়ে চলেছে। পনেরো মিনিট বাদে তারা একটা পাহাড়ের ওপর উঠে গেল। সেখানে বিরাট একটি বাংলো বাড়ি। তারা লোহার গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে সাজানো গোছানো বাড়িটি। রাস্তা এগিয়ে গেছে। দুপাশে আকাশছোঁয়া সাইপ্রাস গাছের সারি। শেষ অব্দি ভূমধ্যসাগরীয় একটি ভিলার সামনে এসে গাড়িটা থেমে গেল। আশেপাশে অসাধারণ ভাস্কর্যের উপস্থিতি। নগ্ন নারীমূর্তির আহ্বান।
ড্রাইভার এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। ক্যাথেরিন বাইরে পা রাখল। দেখা গেল একজন ভদ্রলোক তার জন্য অপেক্ষা করছেন।
ভদ্রলোক গ্রিক ভাষায় বলল–শুভ সকাল, ক্যালিমেহেরা।
আপনি কি সেই মানুষ যাঁর সঙ্গে আমি দেখা করতে এসেছি?
না-না, আপনার জন্য শ্রীযুক্ত ডেমিরিস লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করছেন।
–ডেমিরিস? ক্যাথেরিনের ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা। না, কোনো দিন এই নামটি সে শোনে নি। ভদ্রলোক খামোখা আমাকে সাহায্য করতে চাইছেন কেন? আচরণের মধ্যে রহস্যের গন্ধ আছে কী?
ক্যাথেরিন ওই আগন্তুকের সঙ্গে বিরাট অলিন্দ পার হল। তারপর বেশ কয়েকটি ঘরও পার হতে হল তাকে। সর্বত্র বৈভবের চিহ্ন। ইতালিয়ান মার্বেলের ছড়াছড়ি।
লিভিং রুমটা বিরাট, সিলিং-এ কারুকাজ। চারদিকে নীচু আরামদায়ক কৌচ পাতা আছে। আছে সুন্দর চেয়ার। একটা বিরাট ক্যানভাসও চোখে পড়ল। গয়্যার আঁকা ছবি। দেওয়ালটা পুরো জুড়ে রেখেছে। তারা লাইব্রেরির দিকে এগিয়ে চলেছে।
লোকটি হঠাৎ বলতে শুরু করে ভেতরে যান, ডেমিরিস আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
লাইব্রেরির সর্বত্র জ্ঞানবিজ্ঞানের চিহ্ন আঁকা। দেখা গেল, মরক্কো চামড়ায় বাঁধাই করা বইয়ের ওপর সোনার জলে নাম লেখা। বিশাল ডেস্কের আড়ালে একজন মানুষ বসে আছে। ক্যাথেরিন প্রবেশ করল। তিনি চোখ তুলে তাকালেন। উঠে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ, ক্যাথেরিনের আচরণের মধ্যে কোনো কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে কি? ক্যাথেরিন কি আমাকে চিনতে পেরেছে? না, পারেনি। যাক, ঈশ্বরের দোহাই, আমার পরিকল্পনা ঠিক মতো এগিয়ে চলেছে।
আসুন, আসুন, আমি কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস। আপনার নাম কী?
ইচ্ছে করেই এই প্রশ্নটা করলেন ডেমিরিস। নামটা কি মনে আছে? ব্যাপারটা জানতে হবে।
ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার।
চমকে উঠেছিলেন ডেমিরিস, কিন্তু তার আচরণের মধ্যে এই চমকানো ভাবটা ছিল না। তিনি বললেন–স্বাগতম, ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার। আপনি আরাম করে বসতে পারেন।
তিনি সামনের চেয়ারে বসলেন। কালো লেদার কৌচের ওপর। আহা মেয়েটি এত কাছে এসে বসেছে! এখনও সে আকর্ষণীয়া। ডেমিনিস ভাবলেন। ক্যাথেরিন কালো পোশাক পরেছে। কিন্তু এই পোশাকও তার সৌন্দর্যের রূপচ্ছাকে আবৃত করতে পারেনি। যাক, শেষ অব্দি ভালোভাবেই মেয়েটির মৃত্যু হবে।
–আপনাকে দেখে আমার কী যে ভালো লাগছে, ক্যাথেরিন আমতা আমতা করে বলতে থাকে, কিন্তু আপনি আমার ব্যাপারে হঠাৎ সদয় হয়ে উঠলেন কেন?
ডেমিরিস হাসলেন। অমায়িক হাসি।
ব্যাপারটা খুবই সহজ। মাঝে মধ্যে আমি সিস্টার থেরেসাকে সাহায্য করি। ওই কনভেন্টে সাহায্য করি। ওই কনভেন্টে কিছু টাকাপয়সা দিই। যখন যতটা পারি আর কি। উনি আপনার সম্বন্ধে আমাকে লিখেছিলেন। উনি অনুরোধ করেছিলেন, যদি আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আমি রাজি হয়েছি, ব্যাপারটা খুবই সহজ। এর মধ্যে আর কিছু নেই।
–ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্য। ক্যাথেরিন বলেছিল। আসলে কীভাবে কথা চালিয়ে যাবে, বুঝতে পারেনি সে।
মিস্টার থেরেসা কি বলেছেন, আমি আমার স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি?
হ্যাঁ, উনি আপনার সম্পর্কে সব কথা বলেছেন।
ডেমিরিস ইতস্তত করলেন। কত দূর পর্যন্ত আপনার মনে আছে?
আমার নামটা মনে পড়েছে। কিন্তু কোথা থেকে আমি এসেছি, তা ভুলে গেছি। আমার আসল পরিচয় কী, তাও মনে পড়ছে না। ক্যাথেরিন আমতা আমতা করতে থাকে। তারপর বলে, এথেন্সে এমন কেউ কি আছে, যে আমার পূর্ব পরিচয় জানে?
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের মনের ভেতর হঠাৎ বিপদঘণ্টা বেজে উঠল। এই শেষ শব্দগুলো ভয়ংকর। তবুও তিনি বলতে থাকেনহতেই পারে, হতেই পারে। ঠিক আছে, কাল সকালে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। আমাকে এখন একটা মিটিং-এ যেতে হবে। আমি আপনার জন্য একটা সুইটের ব্যবস্থা করেছি। আমার মনে হয় সেখানে থাকতে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না।
–আমি জানি না, কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ দেব।
ডেমিরিস হাত নাড়লেন–নানা, ধন্যবাদ দিতে হবে না। আপনি বিশ্রাম নিন। মনে করুন এটা আপনার নিজের বাড়ি। কোনো ব্যাপারে ইতস্তত করবেন না, যা দরকার হবে আপনার, তাই চেয়ে নেবেন। কেমন?
–অনেক, অনেক ধন্যবাদ শ্ৰীযুক্ত…।
বন্ধুরা আমাকে কোস্টা বলে ডাকে।
.
ক্যাথেরিনকে একটা সুন্দর সাজানো বেডরুমে নিয়ে যাওয়া হল। সাদা সিল্কের চাদরে আচ্ছাদিত বিশাল খাটটি। সর্বত্র অহংকারের চিহ্ন। আছে সাদা কৌচ, আমচেয়ার। প্রাচীনকালের টেবিল এবং আলো। দেওয়ালে ইমপ্রেসানিস্ট যুগের ছবি ঝুলছে। আহা, এই ছবিতে সূর্যোদয়ের দৃশ্য! সমুদ্র সৈকতে মানুষের আনন্দ উতরোল! জানালা দিয়ে ক্যাথেরিন তাকাল। দূরে ওই তো সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। তার গর্জন শোনা যাচ্ছে।
হাউস কিপার বলল–মিঃ ডেমিরিস আপনার জন্য কয়েকটা পোশাকের ব্যবস্থা করেছেন। এখুনি পোশাকগুলো নিয়ে আসা হবে। আপনি যেটা পছন্দ করবেন, সেটাই রেখে দেওয়া হবে। অবশ্য আপনি অনেকগুলো পোশাকও পছন্দ করতে পারেন।
ক্যাথেরিন নিজের সম্পর্কে সচেতন। এই প্রথম তার মনে হল, কনভেন্টের পোশাকটাই এখন তার পরনে রয়েছে। ব্যাপারটা ভাবতে খুবই খারাপ লাগে।
ছোট্ট একটা ধন্যবাদ ছুঁড়ে দিয়ে সে নরম বিছানাতে গা এলিয়ে দিল। মনে হল, সব কিছু যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটে চলেছে। এই আগন্তুক কে? কেন তিনি এত সদয় হয়ে উঠেছেন আমার প্রতি? চোখ বন্ধ করার আগে ক্ষণকালের জন্য ক্যাথেরিন এমনটাই ভেবেছিল।
.
এক ঘণ্টা কেটে গেছে। একটি ভ্যান এসে ভিলার প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়াল। ভ্যান ভরতি নানরকমের পোশাক। একজন ক্যাথেরিনের ঘরে ঢুকে পড়েছে।
সে বলল–আমি মাদাম ডিমাস। দেখি কোন পোশাকটা আপনার গায়ে ঠিক মতো ফিট করবে। আপনি কি অনুগ্রহ করে এই পোশাকটা খুলে ফেলবেন ম্যাডাম?
কী বলছেন?
আপনি কি পোশাকটা একবার খুলবেন? আমরা দেখব আপনার শরীরের সাথে কোন পোশাকটা, ঠিকমতো খাপ খায়।
ক্যাথেরিন চোখ বুজে ভাববার চেষ্টা করল। অন্য এক জনের সামনে শেষবারের মতো সে কবে উলঙ্গ হয়েছে?
ক্যাথেরিন ধীরে ধীরে নিজেকে পোশাক বিমুক্ত করতে থাকে। তার গতিতে এখন মন্দাক্রান্তা ছন্দ। নিজের সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন সে। অবশেষে যখন সে মাদাম ডিমাসের–সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়াল, ডিমাস তাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল। এটাই তার পেশা। ক্যাথেরিনকে দেখে সে খুশি হয়েছে। চোখের তারার দ্যুতি সেই গল্পটা বলে দিল।
বাঃ, চমৎকার ম্যাডাম! আপনার শরীর তো খুবই সুন্দর। মনে হচ্ছে, যে-কোনো পোশাকেই আপনাকে ভালো লাগবে।
দুজন মহিলা সহকারিনী এসে গেছে। তাদের হাতে ধরা বাক্স। সেখানে নানা রকমের পোশাক। কত কী আছে! অন্তর্বাস থেকে শুরু করে ব্লাউজ, স্কার্ট এবং পায়ের জুতো পর্যন্ত।
মাদাম বলে উঠল- কী আপনার পছন্দ খোলসা করে বলুন। আমরা সেটাই পরাবার চেষ্ট করব।
ক্যাথেরিন বাধা দেবার চেষ্টা করে আমার কাছে এত টাকা নেই। আমি এত দামি পোশাক কিনতে পারব না।
মাদামের ঠোঁটের কোণে টুকরো হাসি–মনে হয় না টাকাটা কোনো সমস্যা হবে। মিঃ ডেমিরিস সব দায়িত্ব নিয়েছেন।
–কিন্তু কেন? স্বগতোক্তির মতো ক্যাথেরিন বলে ওঠে।
অবশেষে সে ফেব্রিকের তৈরি পোশাক পছন্দ করল। এ জাতীয় পোশাক কি সে একবার পরেছিল? ধূসর স্মৃতির সমুদ্রে আলোড়ন? সিল্কের পোশাকও তার ভারি পছন্দ হয়েছে। এবং সুতির তৈরি ব্লাউজগুলোও চমৎকার। আসলে এই পুরো কালেকশানটা এত সুন্দর যে সব কটা পোশাকই পরে ফেলতে ভীষণ-ভীষণ ইচ্ছে হল তার।
.
তিনজন মেয়ে খুব চটপটে এবং পেশাদার। দু ঘণ্টা বাদে ক্যাথেরিনের গায়ে ছ-ছটি পোশাক তুলে দেওয়া হল। আনন্দে ক্যাথেরিন কি পাগল হয়ে যাবে? কিন্তু ক্যাথেরিন, জানে না, এখন তাকে কী করতে হবে।
আমি সব কটা পোশাক পরব? ক্যাথেরিন ভাবল। কিন্তু যাব কোথায়? অথচ কোথাও তো তাকে যেতেই হবে। শহরের মধ্যে এবং সেটা এথেন্সে যখন সে একবার এসেই পড়েছে, অনেক কিছু তাকে জানতে হবে। শেষ অব্দি ক্যাথেরিন ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে উঠে দাঁড়াল, এসো-এসো হে আগন্তুক, দেখাই যাক, তোমার আসল পরিচয়টা আমি উদঘাটন করতে পারি কিনা!
.
ফ্রন্টহলের দিকে ক্যাথেরিন এগিয়ে গেল। একজন বাটলার তাকে এসে বলল, মিস, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
–হ্যাঁ, আমি শহরের মধ্যে যেতে চাই, তুমি কি আমার জন্য একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে আনতে পারবে?
তার আর দরকার হবে না মিস। আপনার ব্যবহারের জন্য একটা লিমুজিন গাড়ি রাখা আছে। আমি এখুনি একজন ড্রাইভারকে ডেকে আনছি।
ক্যাথেরিন ইতস্তত করতে থাকে তোমাকে ধন্যবাদ। শ্রীযুক্ত ডেমিরিস কি রাগ করবেন, ক্যাথেরিন তার অনুমতি না নিয়ে শহর পরিভ্রমণে গেছে বলে? কিন্তু তার হাতে সময় কোথায়?
কিছুক্ষণ বাদে ক্যাথেরিনকে ডিমলার লিমুজিনে বসে থাকতে দেখা গেল। গাড়িটা ধীরে ধীরে এথেন্সের দিকে এগিয়ে চলেছে।
.
ক্যাথেরিন এই জনাকীর্ণ শহরের শব্দঅরণ্যে হারিয়ে গেল। চারপাশে ধ্বংসের অবশেষ, অসংখ্য স্মারক চিহ্ন। মনে হয় এই শহরটা যেন একটা মৃত অতীতকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাইছে।
ড্রাইভার একটির পর একটি গল্প বলে চলেছে। ড্রাইভার বলল দেখুন মিস, এটা হল পারথেলন। এটা হল অ্যাকরোপোলিশের ওপরদিকটা।
ক্যাথেরিন সব দিকে তাকিয়ে দেখছে। সাদা মার্বেল পাথরের বাড়িগুলো যেন কোন অব্যক্ত কথা বলতে চাইছে। তাতে লেখা আছে–জ্ঞান এবং বুদ্ধির দেবী অ্যাথেনার প্রতি উৎসর্গীকৃত। কথাগুলো উচ্চারণ করল ক্যাথেরিন।
ড্রাইভার হেসে ওঠে- আপনি কি গ্রিক ইতিহাসের ছাত্রী মিস?
ক্যাথেরিনের চোখে কৌতুকের দ্যুতি–আমি জানি না। সত্যিই কি জানি আমি?
আর একটা ধ্বংস স্তূপের পাশ দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলেছে।
উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে ড্রাইভারটি। সে গ্রিকদেশের সব কথা শোনাবে ক্যাথেরিনকে। সে বলল, এটা হল হেরোডেস অ্যাটিকাসের থিয়েটার। দেখুন, দেওয়ালগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় এখানে পাঁচ হাজার দর্শক বসে নাটক দেখত।
–৬২৫৭, ক্যাথেরিন ধীরে ধীরে বলল।
অনেক আধুনিক হোটেল চোখে পড়ছে। আকাশছোঁয়া অফিসবাড়ি। চারপাশে ধ্বংস এবং নির্মাণের ছবি পাশাপাশি। অতীত ও বর্তমানের সহাবস্থান। লিমুজিন একটা বিশাল উদ্যানের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল। এই জায়গাটি শহরের কেন্দ্রস্থলে। নৃত্যরত ঝরনার সাথে দেখা হল। সেখানে ইতস্তত চেয়ার টেবিল ছড়ানো আছে। নীল কার্পেট পাতা।
আমি এই জায়গাটায় আগে এসেছি, সহসা ক্যাথেরিনের মনে হল। তার হাত ঠান্ডা হয়ে এল। তখন আমি সত্যি সুখী এবং সম্পৃক্ত ছিলাম।
.
প্রত্যেকটি কাফের ধারে এক-একটি ব্লক। প্রত্যেকটি অঞ্চলে সুখী জীবনের ছবি। সর্বত্র ফুল ফুটেছে। ফুল বিক্রি করছে ফেরিওয়ালারা। কত রকমের ফুল হলদে, সবুজ, নীল, আরও কত কী!
শেষ পর্যন্ত লিমুজিন এসে থামল সিনটাগমা স্কোয়ারে।
হোটেলের পাশ দিয়ে যাবার সময় ক্যাথেরিন বলল–তুমি কি গাড়িটাকে একবার দাঁড় করাবে?
ড্রাইভার গাড়িটা দাঁড় করালো। ক্যাথেরিনের মনে হল, তার নিঃশ্বাস বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে। সে হোটেলটাকে চিনতে পেরেছে। একদা এই হোটেলে সে কয়েকদিন কাটিয়ে গেছে।
সে কথা বলার চেষ্টা করল। তার গলা দিয়ে স্বর বেরিয়ে আসছে ক্ষীণভাবে–আমি এখানে নামব। দু-ঘন্টা বাদে তুমি কি আমাকে নিতে আসবে?
–অবশ্যই মিস। ড্রাইভার তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিল।
ক্যাথেরিন বাইরে এল। বাইরে উষ্ণ বাতাস বইছে। তবুও তার পা কাঁপছে।
–আপনি কি ঠিক আছেন মিস? ড্রাইভার জানতে চাইল।
এ প্রশ্নের জবাব ক্যাথেরিন নিজেই জানে না। তার মনে হল, সে বোধহয় এক অচেনা অজানা জগতে প্রবেশ করতে চলেছে। যেখানে চারদিকে শুধুই আতঙ্ক আর শঙ্কা।
.
জনারণ্যের মধ্যে দিয়ে ক্যাথেরিন হেঁটে চলেছে। হাজার হাজার মানুষ কোথায় চলেছে? মনে হচ্ছে, তাদের কথা বলা বুঝি কোনোদিন শেষ হবে না। কনভেন্টের নৈঃশব্দ ভেঙে গেছে। সবকিছুই অবাস্তব এবং অসম্ভব বলে মনে হয় ক্যাথেরিনের কাছে। ক্যাথেরিন প্ল্যাকার্ড দেখে দেখে এগিয়ে চলেছে। এথেন্সের সেই পুরোনো অঞ্চল, যদিও এটি শহরের কেন্দ্রস্থল। এখানে কী আছে? এখানে আছে পুরোনো দিনের বাড়ি, ছোটো ছোটো কুটির, কফিশপ, আর আছে ভেঙে পড়া এক-একটি স্থাপত্য শিল্প। ক্যাথেরিন জানে না, সে কোথায় যাবে। কোনো এক অনির্দেশের ডাকে তার পা দুটো এগিয়ে চলেছে। সে শহরের দিকে তাকাল। মনে হল, এই হোটেলটা তার অত্যন্ত চেনা! এখানে সে কতদিন থেকেছে! এখানে নানা ধরনের গ্রিক মেনু দেওয়া হয়।
–তুমি কী খাবে? তারা জিজ্ঞাসা করেছিল।
–আমি কী খেতে চাইছি, আমি জানি না।
তারা হেসেছিল।
একজন ওয়েটার এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল–আপনাকে কীভাবে সেবা করতে পারি?
সে কিন্তু বিশুদ্ধ গ্রিক ভাষায় প্রশ্ন করেছে। তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে ক্যাথেরিন। তার মানে? আমাকে দেখেই কি মনে হচ্ছে, আমি গ্রিস দেশের বাসিন্দা?
ক্যাথেরিন অতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কেউ যদি সামনে থাকত তাহলে ভালো হত। সে জানে, তাকে কোথায় যেতে হবে।
সব কিছু ভীষণ চেনা মনে হচ্ছে। হায় ঈশ্বর! আমি এরকম আচরণ করছি কেন? আমি কি স্বপ্ন এবং জাগরণের মধ্যে ভেসে চলেছি?
ক্যাথেরিন একটি কাফের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেল। এই কাফের গায়ে লেখা আছে। ট্রেনিকাস। আবার স্মৃতির সমুদ্রে আলোড়ন। এখানেই কিছু একটা ঘটেছিল, এমন কিছু, যা তার জীবনের গতিপথকে একেবারে পালটে দিয়েছে। কিন্তু সেই ঘটনাটা ক্যাথেরিন মনে করতে পারছে না।
সে আবার জনাকীর্ণ রাস্তায় এসে পড়ল। এখন সে কোথায় যাবে? ক্যাথেরিন একটি শপিংমলে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ, এখানে আমি রোজ বাজার করতাম। ক্যাথেরিন তাকিয়ে থাকল। তার চোখের সামনে নীল পর্দা ভেসে উঠছে। কী যেন সে দেখেও দেখতে পাচ্ছে না!
তার মনের ভেতর একটা কণ্ঠস্বর। গ্রিক দেশের মানুষরা এমন কথাই বলে থাকে। তুমি আরও সাহসী হয়ে ওঠো। পুরোনো গ্রিক ট্রাজিডিগুলোর কথা মনে আছে কি? আমরা কী দেখেছি? দেখেছি আবেগের উতরোল। পরিমাপ করা যাবে না, এমন আনন্দ। দুঃখের পরিপূর্ণ সাগর। আমরা জানি, কীভাবে আরও সুসভ্য হয়ে উঠতে হয়।
ক্যাথেরিন ভাবল, কে বলল এই কথাগুলো? আমি, নাকি আমার বিবেক?
.
রাস্তা দিয়ে একজন মানুষ ব্যস্ত সমস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে কিন্তু ক্যাথেরিনের দিকে এগিয়ে আসছে। তার চোখ দুটি ক্যাথেরিনের দিকে নিবদ্ধ। একটু বাদে বোঝা গেল সে ক্যাথেরিনকে চিনতে পেরেছে। সে বেশ লম্বা এবং তার গায়ের চামড়া বাদামি রঙের। ক্যাথেরিন এই মানুষটিকে আগে দেখেছে কি?
লোকটি বলে ওঠে- হ্যালো!
বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ক্যাথেরিন বলল–হ্যালো। তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?
লোকটা বলে- হ্যাঁ, আমি তোমাকে চিনি।
ক্যাথেরিনের মনে হল তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়েছে। সে বোধ হয় অতীতের সব কথা এবার জানতে পারবে। সে জিজ্ঞাসা করল- সত্যি!
লোকটি বলে- হ্যাঁ। তুমি কি জানো আমি কে?
ক্যাথেরিন ভাবতে থাকে, তার সব কথা লোকটাকে বলবে কিনা।
লোকটি বলে–হ্যাঁ, আমাদের কথা বলা উচিত।
কী আশ্চর্য, লোকটি কি মনের ভাষা পড়তে পারে।
ক্যাথেরিন তখন আতঙ্কের শিখরে পৌঁছে গেছে। এইভাবে বোধহয় তার সত্তার রহস্য উন্মোচন হবে। তখনই তার মনে ভয় জেগেছে। কেউ যদি আমার আসল পরিচয় জেনে ফেলে তাহলে কী হবে? একটা ক্লেদাক্ত অতীত ভেসে উঠবে কী?
লোকটি আরও সামনে এগিয়ে এসেছে। সে বলল–অনেক দিন বাদে তোমার সঙ্গে দেখা হল।
তখন তারা একটা উন্মুক্ত হোটেলের দিকে এগিয়ে চলেছে।
ক্যাথেরিন ঢোঁক গিলে বলে, আমিও খুশি হয়েছি।
একজন ওয়েটার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
–তুমি এখন কী পান করবে? লোকটি জানতে চায়।
ক্যাথেরিন মাথা নেড়ে বলে কিছুই না।
কোথা থেকে প্রশ্ন-উত্তর শুরু হতে পারে, সেটাই খুব সমস্যা।
ভদ্রলোক বলে উঠল–তুমি খুব সুন্দরী, এটাই বোধহয় ভাগ্য। তুমি কি তা মানবে?
ক্যাথেরিন উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাবে। নিঃশ্বাস চেপে সে বলে কোথায় আমাদের দেখা হয়েছিল?
ভদ্রলোক বলল–সেটা কি খুবই গুরুত্বপর্ণ? প্যারিস অথবা রোমে, ঘোড়দৌড়ের আসরে অথবা ডিনার পার্টিতে।
এবার লোকটি এগিয়ে এসে ক্যাথেরিনের হাতে চাপ দিল আমার জীবনে আমি তোমার মতো এত রূপসী মহিলা কোথাও দেখিনি! তোমার দাম কত?
ক্যাথেরিন অগ্নিবর্ষী দৃষ্টিতে লোকটিকে পর্যবেক্ষণ করল। বুঝতে পারল না, লোকটি কী বলতে চাইছে। তারপর সে রেগে গেল। কটমট করে তাকাতে থাকল।
–এত রাগ করছ কেন? তোমার দাম যাই হোক না, আমি মিটিয়ে দেব।
ক্যাথেরিন উঠে দাঁড়াল। রাস্তার দিকে ছুটতে শুরু করেছে সে। একটু বাদে তার চলার গতি থামিয়ে দিল। তার চোখে জল এসেছে। এই জলের অক্ষরে লেখা আছে অপমানের ইতিহাস।
একটা ছোটো টার্নার কাছে গিয়ে সে দাঁড়াল। সেখানে কী লেখা আছে? মাদাম পিরিস–ভবিষ্যৎ বক্তা। ক্যাথেরিন সেখানে থমকে দাঁড়াল। আমি মাদাম পিরিসকে চিনি। এখানে আমি আগে এসেছিলাম। আবার হৃৎস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে সে। তার হারানো চেতনা ফিরে এসেছে।
দরজা খুলে সে ভেতরে প্রবেশ করল। হা ঈশ্বর, এখানে এত অন্ধকার কেন? সে ঠিক বুঝতে পারছে না। কিন্তু কোণে একটা বার দেখা যাচ্ছে। টেবিল চেয়ার সাজানো রয়েছে। এক ওয়েটার এগিয়ে এল, গ্রিক ভাষায় জানতে চাইল–কীভাবে আপনাকে সাহায্য করব?
–ঝরঝরে গ্রিক ভাষায় ক্যাথেরিন জবাব দিল-মাদাম পিরিসের সাথে কোথায় দেখা হবে?
–মাদাম পিরিস?
ওয়েটার একটা খালি টেবিলের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল। ক্যাথেরিন সেখানে এগিয়ে গেল। চেয়ারে বসে পড়ল। সবকিছু, সবকিছু তার মনে পড়েছে।
একটু বাদে কালো পোশাক পরা এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তার মুখে সময় এঁকেছে বলিরেখা।
–আপনাকে আমি…তিনি কথা বললেন, ক্যাথেরিনের মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, কোথায় যেন দেখেছি তোমাকে! তুমি ফিরে এসেছ?
আপনি কি আমাকে চেনেন? ক্যাথেরিন জানতে চাইল।
এবার ওই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন–না না তুমি মারা গেছে। ঈশ্বরের দোহাই, এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও।
এই কথা শুনে ক্যাথেরিন গোঙাতে শুরু করে। উঠে দাঁড়ায়, বাইরে যাবার চেষ্টা করে। তবুও বলে, বলুন না, বলুন না আমাকে কি আপনি….
–যাও, বাইরে যাও, শ্রীমতি ডগলাস!
–আমি জানতে চাইছি…
এবার ওই ভদ্রমহিলা আর কোনো কথা বললেন না। তিনি ক্রুশ চিহ্ন আঁকলেন তার বুকের ওপর। মনে হল পালাতে পারলে বাঁচেন বুঝি!
.
তারপরেও ক্যাথেরিন অনেকক্ষণ সেখানে বসেছিল একা। ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। তারপর বাইরে বেরিয়ে আসে। বৃদ্ধার শেষ সম্বোধনটা তার মনে গেঁথে গেছে শ্রীমতি ডগলাস। তার মানে, এটা আমার আর একটা পরিচয়। কিন্তু এই পরিচয়টার অন্তরালে কী আছে?
মনে হল যেন লকগেট খুলে গেছে। এখুনি বন্যার উন্মত্ত জলরাশি এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন তার চোখের সামনে সব আলোকিত দৃশ্য হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলেছে। আহা, ছোট্টবেলায় দেখা সেই ক্যালিডোস্কোপ। আমি শ্রীমতি ল্যারি ডগলাস। এবার ক্যাথেরিনের মনে পড়ল তার স্বামীর সুন্দর চেহারাটা। এক সময় এই পুরুষটিকে সে ভালোবেসেছিল। কিন্তু কোথায় যেন সব গোলমাল হয়ে গেছে। কোথায়?
আরেকটি ছবি মনে পড়ল তার। ক্যাথেরিন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
ক্যাথেরিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার পা দুটো তখন ঠকঠক করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে, পা দুটি বুঝি দেহের ভার আর বহন করতে পারবে না। মনের মধ্যে জেগেছে উৎকণ্ঠা।
অনেকটা জল খেলো সে। একটু আগে ল্যারিকে সে হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এখন ল্যারি আবার ফিরে এসেছে। ল্যারি বলেছিল–আমি জানি তোমার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছি। ক্যাথি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। বিশ্বাস করো, এখনও। আমি অন্য কাউকে কোনোদিন ভালোবাসিনি। আমি একটা সুযোগ নিতে চেয়েছিলাম। তুমি কি দ্বিতীয়বার মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে যাবে? আমি তোমাকে একটা দারুণ সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাব। তার নাম আওয়ানিনা।
তারপর আতঙ্কের গল্পের সূত্রপাত।
ছবিগুলো কাঁপছে, ছবিগুলো দুলছে, ছবিগুলো একে অপরকে আক্রমণ করতে চাইছে। ল্যারির সাথে একটা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়েছিল সে। দূরে আরো দূরে দেখা যাচ্ছে ধূসর কুয়াশা। আহা, এটাই বোধহয় পৃথিবীর সেরা জায়গা। সে হাত দুটো ছড়িয়ে আছে। তারপর? তাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। কয়েকজন ট্যুরিস্ট এসে তাকে উদ্ধার করে।
তারপর? অন্ধকার গুহা।
হোটেলের ক্লার্ক কী বলেছিল? বলেছিল, যারা মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে চায় তাদের পক্ষে এটাই হল আদর্শ জায়গা।
তারপর? সেই বৃহৎ অন্ধকার। ল্যারির মুখ। মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা।
সে কানে হাত চাপা দিল। কোনো শব্দ এখন সে প্রবেশ করতে দেবে না।
শেষ পর্যন্ত সে কি বেঁচে গিয়েছিল? হোটেলে ফিরে এসেছিল? ডাক্তার তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে যেত কেন? ল্যারি এবং তার উপপত্নী রান্নাঘরে মিলিত হচ্ছে, এমন একটা দৃশ্য, কী কথা বলছে তারা? কীভাবে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে? বাতাস কেটে কেটে সেই শব্দ বয়ে আসছে।
–কেউ জানতে পারবে না?
–ব্যাপারটা আমি দেখব।
–না, এভাবে হবে না।
–ঠিক আছে, ও যখন ঘুমিয়ে পড়বে…।
একটা ভয়, একটা অতিঙ্ক, একটা তীব্র অনুভূতি–সমস্ত রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। তখনই মনে হয়েছিল, সে বুঝি হ্রদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। একজন নারী এবং একজন পুরুষ জোর করে তাকে বরফ শীতল জলের মধ্যে চুবিয়ে দিচ্ছে। ঝড় উঠেছে, উথালপাথাল হাওয়া। হেল্প! হেল্প! বলে সে চিৎকার করেছিল। তারপর? তারপর ঘুমটা ভেঙে যায়। চারদিকে শুরু অমনিশার ঘন অন্ধকার!
ক্যাথেরিন রাস্তার ধারে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। তার সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেছে। দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করছে। নাঃ, দুঃস্বপ্ন নয়, এমন ঘটনা সত্যিই তার জীবনে ঘটেছিল। তার স্বামী এবং উপপত্নী মিলে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে।
তাহলে? এই আগন্তুক কে? কে তাকে কনভেন্টে রেখে এসেছিল? না, সেই সোনালি পাখিটাকে মনে পড়ছে রক্ত রুবির মতো চোখ, দুপাশে দুটি ডানা, যা সে আকাশের বুকে মেলে দেবে।
মুখের কাছে মুখ এনে কে যেন বলল–এখন কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। দুষ্টু লোকেরা মারা গেছে।
ক্যাথেরিনের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। কোনোমতে সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু এবার তাকে সেই জায়গাটাতে পৌঁছোতে হবে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের পাঠানো গাড়িটা বোধহয় এখন এসে গেছে। ক্যাথেরিনের মনে হল, এই জনারণ্যে থাকলে সে আবার হারিয়ে যাবে। এখন ডেমিরিসের ওই প্রাসাদবাড়িটাই হতে পারে তার একমাত্র নিরাপদ আবাসস্থল।
.
০৪.
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস জানতে চাইলেন–তোমার সাহস তো কম নয়! তুমি মেয়েটিকে বাড়ির বাইরে যাবার অনুমতি দিলে কী করে?
ডগলাস আমতা আমতা করে বলতে থাকে–স্যার, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আপনি তো এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশ রেখে যাননি। তাই…
ডেমিরিসের মনে হল, এতটা রাগ না দেখালেও চলবে। তিনি বললেন–ব্যাপারটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মেয়েটা বোধহয় এখনই চলে আসবে, তাই না?
–কোনো সমস্যা হয়েছে কী স্যার?
–না।
ডগলাস চলে গেল। ডেমিরিস জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বাগানের দিকে তাকালেন। ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার যদি এথেন্সের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় তাহলে কী হবে? কেউ হয়তো তাকে দেখে ফেলবে। না ব্যাপারটা কখনোই হতে দেওয়া যাবে না। তাহলে আমার পরিকল্পনাটা একেবারে ভেস্তে যাবে। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাকে প্রতিশোধ নিতে হবে। আমি তাকে ভোগ করব। আমি তাকে এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যাব। কিন্তু সে সম্পূর্ণ আমার অধিকারে থাকবে। মনে হচ্ছে, লন্ডন শহরটা তার পক্ষে নিরাপদ হতে পারে। সেখানে তার ওপর নজর রাখা সম্ভব হবে। আমি আমার অফিসে তার জন্য একটা কাজ ঠিক করব।
***
এক ঘণ্টা কেটে গেছে, ক্যাথেরিন বাড়িতে ফিরে এসেছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বুঝতে পেরেছেন, ক্যাথেরিনের মনোভাবের মধ্যে পরিবর্তন জেগেছে। মনে হচ্ছে, কেউ নিশ্চয়ই কালো পর্দাটা তুলে দিয়েছে। ক্যাথেরিন আবার জাগ্রত সত্তায় ফিরে এসেছে। একটা ভারি সুন্দর সিল্কের পোশাক ক্যাথেরিনের পরনে। সঙ্গে সাদা ব্লাউজ পরেছে মানানসই। ডেমিরিসের মনে হল, তার আচরণের মধ্যে কেমন পরিবর্তন এসেছে। চেহারাটাও পালটে গেছে। তার মানে? এখন ক্যাথেরিনকে কী বলা যেতে পারে? গ্রিক ভাষায় বলে নস্টেমি, ইংরেজি প্রতিশব্দ কী? বাংলাতে আমরা যৌনবতী বলতে পারি।
মিঃ ডেমিরিস…
–কোস্টা।
–আমি জেনে গেছি আমি কে, এবং কী ঘটেছে।
কথা দুটো সাংঘাতিক, কিন্তু ডেমিরিসের মুখে কোনো ছায়া পড়ল না। ডেমিরিস জানতে চাইলেন–সত্যি? বসুন, বসুন, সবটা আমাকে খুলে বলুন।
ক্যাথেরিন ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে উত্তেজনায় ঠক ঠক করে কাঁপছে। সে বসতেও পারছে না, কার্পেটের ওপর দিয়ে পায়চারি করছে। একবার সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, পরক্ষণেই পেছনে সরে আসছে। তারপর বলতে থাকে আমার স্বামী এবং তার আদরিণী রক্ষিতা নোয়েলে, তারা দুজনে মিলে আমাকে মারতে চেয়েছিল। ক্যাথেরিন একমুহূর্ত চুপ করল। ডেমিরিসের মুখের দিকে তাকাল। হ্যাঁ, ব্যাপারটা কেমন যেন শোনাচ্ছে না? আমি কি ঠিক বললাম? আমি জানি না!
ডেমিরিস ভাবলেশহীন–বলতে থাকুন, বলতে থাকুন।
কনভেন্টের কয়েকজন সন্ন্যাসিনী আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁরাই আমাকে উদ্ধার করেন। আমার স্বামী আপনার হয়ে কাজ করেছেন? তাই না?
ক্যাথেরিন সোজাসুজি জানতে চাইল। ডেমিরিস ইতস্তত করতে থাকেন। কী উত্তর দেবেন? কতটা জেনে ফেলেছে এই মেয়েটা!
-হ্যাঁ, সে ছিল আমার একজন পাইলট। তাই আপনার প্রতি আমার কিছু কর্তব্য আছে। এবং সেই কারণেই…
এবার ক্যাথেরিন সবকিছু বুঝতে পেরেছে।
তার মানে আপনি জানতেন আমি কে। তাহলে সকালে আমার আসল পরিচয় বলেননি কেন?
–আমি ভেবেছিলাম একথাটা জানলে আপনি উন্মাদ হয়ে উঠবেন। ডেমিরিস সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন। আমি চেয়েছিলাম ব্যাপারটা আপনি নিজেই উদ্ঘাটন করুন। তাহলে আপনার স্বায়ুর ওপর বেশি চাপ পড়বে না।
–আপনি কি জানেন আমার স্বামী এবং তার আদরিণী রক্ষিতার কী হয়েছে? তারা। কোথায় আছে?
ডেমিরিস ক্যাথেরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন তাদের শাস্তি হয়েছে।
এই কথা শুনে ক্যাথেরিনের মুখে এক ঝলক লজ্জার আলপনা ডেমিরিস সন্তর্পণে লক্ষ্য করলেন। ক্যাথেরিন মুখে একটা শব্দ করল। সে বোধহয় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে চেয়ারের ওপর পড়ে গেল।
–আমি ভাবতে পারছি না…
ক্যাথেরিন, রাষ্ট্র তাদের অপরাধের শাস্তি দিয়েছে। তাদের ফাঁসি হয়েছে। এতে তোমার-আমার কী করার আছে?
কিন্তু কেন?
কারণ তারা তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
ক্যাথেরিন জিজ্ঞাসা করে আমি বুঝতে পারছি না। এর জন্য রাষ্ট্র তাদের ফাঁসি দেবে কেন? এই তো আমি বেঁচে আছি।
এবার ডেমিরিস বলতে শুরু করেন ক্যাথেরিন, গ্রিক দেশের আইনকানুন খুবই কড়া। এখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী তোমার স্বামী এবং নোয়েলে পেজকে সনাক্ত করে। তারা পরিষ্কার বলে, ওরা দুজন তোমাকে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিল। জুরিরা এই কথা বিশ্বাস করেছেন। তারা সকলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ওই দুজনকে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করা হয়েছে।
ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, ক্যাথেরিন বিড় বিড় করে বলতে থাকে সত্যি সত্যিই কি তাই!
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস রেগে গেলেন। তিনি ক্যাথেরিনের কাঁধে হাত রেখে বললেন–অতীতটাকে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করুন ম্যাডাম। অতীতের স্মৃতি নিয়ে আমরা কেউ পথ চলতে পারি কী? ওঁনারা দুজনে মিলে একটা ষড়যন্ত্র করেছিল, আর তাই তার দাম চোকাতে হয়েছে।
ডেমিরিসের কণ্ঠস্বরে বন্ধুত্বের সুর।
–আমি জানি এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনি বিব্রত। কিন্তু আমি আপনার কথা ভাবছি। আপনি আপনার ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে কী ভাবছেন?
ক্যাথেরিনের মনে হল, সে কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। ল্যারির কথা মনে পড়ল, ল্যারির সুন্দর মুখ, ল্যারির হাসি, ল্যারির আলিঙ্গন, ল্যারির চুম্বন।
ক্যাথেরিন…
ক্যাথেরিন বলল–আমি দুঃখিত।
–আপনি নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী পরিকল্পনা করেছেন?
–জানি না। জানি না আমি কী করব! আমি কি এথেন্সেই থাকব?
ডেমিরিস বলল–না, এথেন্সে থাকাটা আপনার উচিত হবে না। এখানে থাকলে শুধুই অতীতের স্মৃতি আপনাকে তাড়া করবে। আমার মনে হয় আপনি গ্রিস দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান।
–কিন্তু আমি কোথায় যাব?
ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দেবেন কি? ডেমিরিস বললেন, লন্ডনে আমার অফিস আছে। আপনি ওয়াশিংটনে উইলিয়াম ফ্রেজার নামে এক ভদ্রলোকের কাছে কাজ করেছিলেন। এই ব্যাপারটা কি আপনার মনে আছে?
উইলিয়াম! হঠাৎ ক্যাথেরিনের সব কিছু মনে পড়ল। এটা ছিল তার জীবনের সব থেকে সুখী সময়।
–হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
–আপনি তার প্রশাসনিক সহকারিণী ছিলেন, তাই তো? লন্ডনে আপনি আমার অফিসে একই কাজ করতে পারবেন।
ক্যাথেরিন ইতস্তত করতে থাকেন–জানি না পারব কিনা! তবে আমি অকৃতজ্ঞ হতে পারব না এটাও সত্যি। কিন্তু….
আমি বুঝতে পারছি, আমি বুঝতে পারছি ঘটনাগুলো অত্যন্ত দ্রুত ঘটে চলেছে । ডেমিরিস সহানুভূতিপূর্ণ কণ্ঠস্বরে বলতে থাকেন, বেশ কিছুটা সময় দরকার। তা নাহলে আপনি মনের সাথে লড়াই করবেন কেমন করে? আসুন, আপনার ঘরে একটা সুন্দর সুস্বাদু নৈশভোজ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাল সকালে আমরা দুজনে বসে শান্ত মাথায় সবকিছু আলোচনা করব, কেমন?
এবার কৃতজ্ঞতায় ক্যাথেরিনের চোখে জল এসেছে–আপনি সত্যিই সহৃদয় মানুষ! পোশাকগুলোও চমৎকার হয়েছে।
ডেমিরিস ক্যাথেরিনের হাতে হাত রাখলেন। একটু চাপ দিয়ে বললেন–আপনি যে খুশি হয়েছেন এতে আমি অসীম আনন্দ পাচ্ছি।
**
ক্যাথেরিন বেডরুমে বসে আছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। চতুর্দিকে রঙের খেলা, রঙের সীমাহীন উচ্ছ্বাস। অতীতের কথা বলে কী হবে? ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি না থাকলে কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের সঙ্গে দেখা হত না। ডেমিরিস এখন আমার জীবনরেখা। ডেমিরিসের সাহায্য ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারব না। ডেমিরিস আমাকে একটা চাকরি দিচ্ছেন। লন্ডন শহরে। আমি কি চাকরিটা গ্রহণ করব?
চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেল। দরজায় কার করাঘাত। কে যেন বলল–আমরা আপনার নৈশ আহার নিয়ে এসেছি মিস।
ক্যাথেরিন চলে যাবার পর কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস অনেকক্ষণ একা বসেছিলেন। এইমাত্র যে সংলাপটা শেষ হল তার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ভাবছিলেন। নোয়েলে! আহা একসময় নোয়েলের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ঘটে গিয়েছিল। নোয়েলের হাতে তিনি তার জীবনের সমস্ত আবেগ এবং অভিমান উৎসর্গ করেছিলেন। নোয়েলে পেজকে সত্যি সত্যি তিনি ভালোবাসতেন। কিছুদিনের জন্য নোয়েলে তার রক্ষিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। নোয়েলের মতো সুন্দর স্বভাবের কোনো মহিলার সাথে এর আগে তার দেখা হয়নি। শিল্পকলা, সঙ্গীত এবং ব্যবসা সম্পর্কে মেয়েটির জ্ঞান ছিল প্রশংসা করার মতো। একসময়ে ননায়েলে তার জীবনে অপরিহার্য চরিত্র হয়ে ওঠে। নোয়েলে সম্পর্কে কোনো কথা শোনার জন্য তখন তিনি উদ্গ্রীব চিত্তে অপেক্ষা করতেন। নোয়েলের সব কিছু তখন তার কাছে সীমাহীন বিস্ময়ের আধার বলে মনে হত। একেই বোধহয় আমরা একধরনের তাড়না বলতে পারি। মেয়েটি সুন্দরী এবং রূপবতী, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জীবনে অনেক মেয়ের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে ডেমিরিস এসেছেন, কিন্তু এমন আবেদনময়ী মহিলা খুব বেশি দেখেননি। যে সব মেয়েরা সুন্দরী হয়ে থাকে, তাদের মাথাটা তত কঁকা হয়। কিন্তু নোয়েলে হলেন সেই বিরলাতমাদের একজন যার মধ্যে একই সঙ্গে বুদ্ধি এবং সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে গেছে।
আহা, নোয়েলের সাথে কাটানো কত সম্পৃক্ত প্রহর! নোয়েলের সাথে ভাগ করে নেওয়া কত মুহূর্ত! নোয়েলেকে সব অর্থে আমার প্রেমিকা বলা যেতে পারে কী? নোয়েলের চোখে আমি ছিলাম একজন প্রেমিক এবং পথ প্রদর্শক। ডেমিরিস চোখ বন্ধ করলেন। পুরোনো দিনের অনেক কথাই মনে পড়ে গেল। কিন্তু ল্যারি ডগলাস? এই বিচিত্র চরিত্রের মানুষটিকে তিনি কি কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবেন? একটা ছোট্ট ভুলের মাশুল নোয়েলেকে জীবন দিয়ে দিতে হল। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস সব ব্যাপারটা ঠিক করে দিয়েছিলেন। আহা, তার দেহটা শুইয়ে দেওয়া হয়েছে পাসারাতে, সমাধি স্থলে। এটি হল আদিয়ানে তার ব্যক্তিগত দ্বীপে। সকলে এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কিছুদিন আলোচনা করেছিল। সত্যি কথা বলতে কী, ডেমিরসই কলকাঠি নেড়েছিলেন, যাতে মৃত্যুর পর শান্তিতে থাকতে পারে বেচারা মেয়েটি। মাঝেমধ্যে যাতে সমুদ্রের শান্ত শীতল বাতাস এসে তার কষ্ট উপশম করতে পারে। আহা, ডেমিরিসের নিজস্ব বেডরুমে এখনও নোয়েলের একটি ছবি টাঙানো আছে। নোয়েলে ডেমিরিসের দিকে তাকিয়ে হাসছে, হাসির মধ্যে দুষ্টুমি। সময় স্মৃতিচিহ্ন এঁকেছে, তবুও হাসির তীক্ষ্ণতা নষ্ট করতে পারেনি।
ডেমিরিস এখনও নোয়েলেকে মনে রেখেছেন। কতদিন হয়ে গেল? এক বছরের
কাছাকাছি! তার মানে? স্মৃতি কি চিরদিন বেঁচে থাকে?
নোয়েলে, আমি তো তোমাকে সব কিছু দিতে চেয়েছিলাম। আমি এখনও তোমাকে ভালোবাসি! হে কুকুরীর বাচ্চা, আমি তোমাকে ভালোবাসি!
ল্যারি ডগলাস! ল্যারি ডগলাসকেও জীবন দিয়ে দাম দিতে হল। কিন্তু ব্যাপারটা ডেমিরিসের কাছে অবাক বলে মনে হয় না। প্রতিশোধের নানা কথা তিনি ভেবে রেখেছিলেন। তিনি ডগলাসের স্ত্রীকে অধিকার করতে চেয়েছিলেন, ঠিক যেমনভাবে ডগলাস নোয়েলেকে অধিকার করেছিল। হা ক্যাথেরিন তার অতীত স্মৃতির মধ্যে একমাত্র ক্যাথেরিন বেঁচে আছে। অতএব…
**
-কোস্টা।
কে ডাকছে? গভীর কণ্ঠস্বর। মেলিনা লামব্রো এদিকে এগিয়ে আসছে।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস মেলিনা লামব্রোকে বিয়ে করেছিলেন। এক প্রাচীন অভিজাত গ্রিক পরিবারের কন্যা। দীর্ঘাঙ্গীনী। দেখলে মনে হয় তার মধ্যে রাজকীয় আভিজাত্য আছে। আছে এমন এক ব্যক্তিত্ব সহজে যাকে স্পর্শ করা যায় না।
-কোস্টা, ঘরে যে মেয়েটি আছে সে কে?
মেলিনার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ঝরছে।
–সে হল আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। সে লন্ডনে আমার অফিসে যোগ দেবে।
আমি তাকে দেখেছি, দেখে ভীষণ চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
–সত্যি!
-হ্যাঁ। মেলিনা ইতস্তত করতে থাকে। মনে হচ্ছে, যে পাইলট তোমার হয়ে কাজ করত, এই মেয়েটি হল তার বউ। কিন্তু তা কেমন করে হবে? তারা তো মেয়েটিকে হত্যা করেছিল?
–হ্যাঁ, কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বলতে থাকেন, মেয়েটিকে তারা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।
মেলিনার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন তিনি। তাকে আরও সাবধান হতে হবে। মেলিনাকে বোকা মনে করার মতো কোনো কারণ নেই। মেয়েটিকে বিয়ে করা তাঁর জীবনের সবথেকে বাজে সিদ্ধান্ত। ডেমিরিস ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন।
.
দশ বছর আগে মেলিনা লামব্রো এবং কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের বিয়ে নানা জায়গাতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এরই পাশাপাশি ব্যবসায়িক মহল উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। এথেন্স থেকে রিভেয়ারা, নিউ পোর্ট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল গুজব। কেন তারা এইভাবে বিয়েতে আবদ্ধ হলেন? কী আকর্ষণ? মাত্র এক বছরের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত?
.
ছোট থেকেই মেলিনা তার নিজস্ব ইচ্ছেকে পরিব্যাপ্ত করতে চেয়েছিলেন। দশ বছর বয়সে তিনি নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পরিবারের এক সোফেয়ার তাকে সমুদ্র বন্দরে বসে থাকতে দেখে। শেষে অবধি অনিচ্ছুক মেলিনাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। বারো বছর বয়সে তিনি একটি সার্কাস দলের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালাতে চেয়েছিলেন।
সতেরো বছর বয়সে মেলিনা অসাধারণ রূপবতী হয়ে ওঠেন। হাতে অঢেল পয়সা, কারণ তিনি মিহালিস লামব্রোর কন্যা। মিহালিসের নাম সবাই জানে। শহরের সব থেকে ধনী ব্যক্তি, খবরের কাগজের পাতায় তার নামে নিয়মিত গসিপ প্রকাশিত হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বান্ধবী-বন্ধু পালটাচ্ছেন তিনি, ভাব জমাচ্ছেন যুবরাজ এবং যুবরানিদের সঙ্গে। সব সময় কল্পিত জগতের বাসিন্দা হয়ে বসবাস করতে চাইছেন। তবে মেলিনার চরিত্রে তখনও পর্যন্ত কাদা লাগেনি। অকলঙ্কিতা ছিলেন তিনি। স্পাইরস নামে মেলিনার এক ভাই ছিলেন, মেলিনার থেকে দশ বছরের বড়ো, তারা একে অন্যকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন। মেলিনার তেরো বছর বয়সে, মা-বাবার মৃত্যু হয়, তারা নৌকোডুবিতে মারা গিয়েছিলেন। তখন থেকেই স্পাইরস তার আদরের বোনটিকে বুড়ো করতে থাকেন।
স্পাইরস সব সময় মেলিনার পাশে নিরাপত্তার ব্যুহ রচনা করতেন। মেলিনা তখন উনিশ বছরে পৌঁছে গেছেন, স্পাইরস মেলিনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি মেলিনার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রেখেছিলেন। ভেবেছিলেন, এই মেয়েটিকে ঝড়ঝাঁপটা থেকে রক্ষা করতে হবে।
সব সময় তিনি মেলিনার কানে মন্ত্র দিতেন–তোমাকে আরও সাবধানী হতে হবে। মনে রেখো, পৃথিবীর সর্বত্র শ্বাপদ শয়তানরা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তোমার বয়স কম, তোমার হাতে অপরিমাপ্য অর্থ আছে, তুমি খুবই সুন্দরী, সর্বোপরি তুমি একটা বিরাট বংশের নাম বহন করছ।
-ব্রাভো, আমার প্রিয় দাদা! আমি সব জানি, আশি বছর বয়স হলেও বোধহয় তুমি আমাকে ছোট্ট খুকিটি ভাববে। তাই তো? এইভাবে কুমারী হয়েই আমি চোখ বুজবো নাকি?
–এত চিন্তা কোরো না মেলিনা। ঠিক সময় তোমার জীবনে ঠিক মানুষের আবির্ভাব ঘটবে।
.
তার নাম কাউন্ট ভাসিলিস ম্যানোস। তার বয়স পঁয়তাল্লিশ, তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। একটি পুরোনো অভিজাত গ্রিক পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। মেলিনাকে দেখে উনি প্রেমে পাগল হলেন। কিছুদিন বাদেই বিবাহের কথা বলতে শুরু করলেন।
স্পাইরস বলেছিলেন–আমার মনে হয় মেলিনা, তুমি ম্যানোসকে বিয়ে করো। ম্যানোস মাটির ওপর পা রেখে হাঁটতে জানেন। ম্যানোস সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসেন।
মেলিনার মধ্যে অতটা ঔৎসুক্য জাগেনি। তিনি শুধু বলেছিলেননা, ম্যানোসকে আমি স্বামী হিসেবে মানতে পারছি না। তার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছি, তিনি শুধু ব্যবসার ব্যাপারে বকর বকর করেন। আমি আরও–আরও রোমান্টিক একটা ছেলের সন্ধান করছি।
রেগে গিয়েছিলেন দাদা। বলেছিলেন-বিয়ের মধ্যে বাস্তব আছে, কঠিন কঠোর বাস্তব। রোমান্সের পাখি একদিনে শেকল ছিঁড়ে উড়ে যায়। তুমি এমন একজন স্বামীকে নির্বাচন করবে, যার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হবে সুদৃঢ়, যিনি নিজের শক্তসমর্থ পায়ের ওপর হাঁটার। ভরসা রাখবেন, যিনি তোমার সমস্ত খামখেয়ালিপনাকে মেনে চলবেন।
শেষ পর্যন্ত কাউন্ট ম্যানোসের প্রস্তাবটা মেলিনা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
মেলিনার এই আগ্রহ কাউন্টকে উৎসাহী করে তোলে।
কাউন্ট বলেছিলেন–তুমি আমাকে বিশ্বের সুখীতম সম্রাটে পরিণত করেছ। আমি তোমার সাহচর্যে নতুন জীবন লাভ করলাম। আমি একটা নতুন কোম্পানি তৈরি করতে চলেছি। আমি এর নাম দেব মেলিনা ইন্টারন্যাশনাল।
মেলিনা আরও খুশি হতেন, যদি কাউন্ট এসে তার হাতে বারোটি রক্তাক্ত গোলাপের অভিবাদন রাখতেন।
বিয়ের দিন ঘোষণা করা হল। এক হাজার নিমন্ত্রিতের কাছে কার্ড পাঠানো হল। বিয়েটা কীভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে হতে পারে, তাই নিয়ে নানা পরিকল্পনা গৃহীত হল।
ঠিক এই সময় কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস মেলিনা লামব্রোর জীবনে প্রবেশ করেন।
তারা অনেকবার নানা জায়গাতে মিলিত হন। ক্রমশ, শহরের এখানে-সেখানে এই যুগলকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
কোথায় তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল? মনে হচ্ছে কোনো এক পার্টিতে। পার্টির শক্তি বলেছিলেন ইনি হলেন মেলিনা লামব্রো, আর উনি কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস।
ডেমিরিস তার কালো চোখে মেলিনাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন–আপনি এই পার্টিতে কতক্ষণ থাকবেন?
–কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে আছে।
–মিস, আপনি কি একটু বাইরে যাবেন? আমার মনে প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে, আপনার এই অপরূপ সৌন্দর্য সুধা পান করি।
মেলিনা হেসেছিলেন–মিথ্যে মিথ্যে আমার সম্পর্কে বানানো কথা বলছেন কেন ডেমিরিস? আমি তো অত সুন্দরী নই।
ডেমিরিস মাথা নেড়ে বলেছিলেন- আপনার সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। আমি যা বলেছি, তাতে সামান্য সত্যি আছে, বেশির ভাগটাই বলতে পারিনি।
একটুবাদে কাউন্ট ম্যানোস গভীর কথাবার্তায় জড়িয়ে গেলেন। সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মেলিনা ডেমিরিসের কথাই ভেবে গেলেন। ডেমিরিস সম্পর্কে অনেক কথাই তিনি শুনেছেন। তবে কখনও তাকে জীবনসাথী করার কথা চিন্তা করেননি। তিনি শুনেছেন, ডেমিরিসের হাতে অঢেল অর্থ আছে, তিনি বিপত্নীক এবং একজন মস্তবড়ো ব্যবসাদার হবার সবকটি গুণ ডেমিরিস করায়ত্ত করেছেন। আরও শুনেছেন, নারী সম্পর্কে ডেমিরিসের উৎসাহ অন্তহীন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উনি যে আমার দিকে নজর দিয়েছেন, এতেই আমি খুশি। মেলিনা ভেবেছিলেন।
বিয়ের দেবতা আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে হেসেছিলেন, সেই হাসি শেষ পর্যন্ত সর্বনাশের হয়ে উঠেছিল।
**
পার্টির পরের দিন, বাটলার ব্রেকফাস্ট রুমে এসে বললেন মিস লামব্রো, আপনার জন্য একটি প্যাকেট এসেছে। শ্রীযুক্ত ডেমিরিসের সোফেয়ার এই প্যাকেটটি দিয়ে গেলেন।
–ওটা আমার কাছে নিয়ে এসো।
শেষপর্যন্ত কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস মেলিনার জীবনে প্রবেশ করলেন। হ্যাঁ, কী পাঠিয়েছেন তিনি? কী হতে পারে? মেলিনা ভাবতে থাকেন। দামি অলংকার? দাম দেওয়া যায় না এমন প্রাচীন স্মারক চিহ্ন? আমি কি এটা এখনই ডেমিরিসের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেব?
প্যাকেটটি ছোটো এবং অদ্ভুত আকৃতির। সুন্দরভাবে আচ্ছাদিত। ভারি সুন্দর! মেলিনা খুলেছিলেন। একটা কার্ড, লেখা আছে–মনে হয় এটা আপনার ভালো লাগবে, কনস্ট্যানটিন।
এটা কী? একটা বই, মেলিনার অত্যন্ত প্রিয় সাহিত্যিক, নিকোস কাজনজাকিস-এর টোডরাবা। কিন্তু আমার মনের খবর উনি রাখলেন কী করে?
মেলিনা একটা ছোট্ট ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এর জন্য সেটুকুই যথেষ্ট।
পরদিন সকালে আরেকটা প্যাকেট এল। কী আছে সেখানে? এক বিখ্যাত গীতিকারের গান, উনি হলেন ডেলিয়াস। লেখা আছে–টোডারাবা বইটি পড়তে পড়তে এই গান শুনবেন। তাহলে সময়টা ভালো কেটে যাবে।
তারপর থেকে প্রত্যেকদিন উপহার আসতে থাকে। প্রিয় ফুল, প্রিয় সুগন্ধি, প্রিয় বই, প্রিয় রেকর্ড। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বোধহয় জানতেন, কীভাবে মেলিনাকে খুশি করা যায়। না হলে মেলিনার ব্যক্তিগত আবেগ এবং অনুভূতি সম্পর্কে তিনি এত আগ্রহী হয়ে উঠলেন কী করে?
মেলিনা টেলিফোন করেছিলেন, ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। ডেমিরিস বলেছিলেন, আমি তো কিছুই করতে পারিনি। আপনাকে খুশি করার মতো ক্ষমতা অথবা সাহস কোনো কিছুই আমার নেই।
এর আগে হয়তো অন্য কাউকে উনি একই সংলাপ বলেছিলেন।
–মেলিনা, আপনি কি আমার সাথে লাঞ্চে যাবেন?
এই প্রশ্নের জবাব কী হতে পারে?
মেলিনা ভেবেছিলেন, এই মানুষটিকে দুঃখ দিয়ে কী হবে?
তারপর? শেষ অবধি সব কিছু কেমন ঘটে গেল। কাউন্ট ম্যানোসের কানে সব কথা পৌঁছে গেছে। উনি ভাবীপত্নীর সঙ্গে ডেমিরিসের এই সখ্যতা মোটেই পছন্দ করছেন না। তাই নিয়ে সামান্য মন কষাকষি। কিন্তু কী হবে ভবিষ্যতে!
***
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ফ্লোকা রেস্টুরেন্টটি ভাড়া করেছিলেন। জায়গাটা ভারি সুন্দর! মেলিনার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন তিনি। মেলিনাকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। –শেষ অবধি আপনি এসেছেন, আমি ভেবেছিলাম হয়তো আপনার মনের পরিবর্তন ঘটেছে।
না। আমি কথা রাখার চেষ্টা করি।
মেলিনার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি অপলক চোখে, বলেছিলেন–আমিও কথা রাখব। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি।
মেলিনা মাথা নেড়েছিলেন। অবাক হয়ে গেছেন তিনি। কিছুটা বিরক্ত এবং কিছুটা উল্লসিত।
–ডেমিরিস, আপনি আমাকে জানেন না, আমি অন্য একজনের বাগদত্তা।
–ম্যানোস? হাত নেড়ে ডেমিরিস বলেছিলেন–ম্যানোস আপনার উপযুক্ত পাত্র নয়।
–ঠিক আছে, কিন্তু কেন?
–আমি তার ওপর কড়া নজর রেখেছি। তার বংশের সকলে উন্মাদ। তিনি হেমোফিলিয়াক রুগি। তাঁকে ব্রাসেলসে একবার ধরা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে যৌন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। তিনি টেনিস নিয়ে মৃত্যুর খেলা খেলতেন।
মেলিনা জিজ্ঞাসা করল–আপনি?
–আমি টেনিস খেলি না।
–তাই! তাই বোধহয় আপনাকেই বিয়ে করতে হবে।
–নিশ্চয়ই তা নয়। কারণটা আমি বলছি। আমি আপনাকে বিশ্বের সুখীতমা রমণীতে পরিণত করব। এটাই আমার অঙ্গীকার।
শ্ৰীযুক্ত ডেমিরিস….
ডেমিরিস বলেছিলেন–কোস্টা।
করমর্দন করার ভঙ্গিতে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মেলিনা হাত বাড়িয়ে দেননি। মেলিনা বলেছিলেন–আমি এখানে একটা কথা বলতে এসেছি। প্লিজ কাল থেকে আমাকে আর কোনো উপহার পাঠাবেন না। আমি আপনাকে আর কোনোদিন দেখতে চাই না।
অভাবিত এই আক্রমণে ডেমিরিস অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বেশ কিছুক্ষণ মেলিনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর বলেছিলেন–আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনি এত নির্মম প্রকৃতির।
-তা হয়তো নয়।
–তাহলে? আপনি আমার হৃদয় ভেঙে দিলেন!
–আমার মনে হয় না যে আপনার মনটা কাঁচ দিয়ে তৈরি আর সেটা এত সহজে ভেঙে যাবে। বাজারে আপনার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ও সম্মান আছে।
–হ্যাঁ ছিল, আপনার সঙ্গে দেখা হবার আগে পর্যন্ত। আমি স্বপ্নে আপনাকে দেখেছি, পরে আপনার সঙ্গে সত্যি সত্যি দেখা হয়েছে।
ডেমিরিসের কণ্ঠস্বরে ঝরছে শিশুর উত্তেজনা।
মেলিনা হেসে ফেলেছিলেন।
–আমি কিন্তু এই ব্যাপারটায় খুবই আন্তরিক। অনেক বছর আগে আমি লামব্রো পরিবারের কথা জেনেছিলাম। আপনারা অত্যন্ত ধনী পরিবার। আমরা দরিদ্র ঘরের সন্তান। আমার কিছুই ছিল না। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। আমার বাবা ছিলেন একজন স্টেভেন্ডার, তাঁকে স্পাইরসের কাছে কাজ করতে হত। আমাদের চোদ্দো জনের বিরাট পরিবার। সব সময় সবকিছুর জন্য লড়াই করতে হত।
কিন্তু এখন আপনি তো যথেষ্ট ধনী।
হ্যাঁ, কিন্তু আমি যতটা ধনী হতে চাই ততটা এখনও হতে পারিনি।
কীভাবে আপনি অর্থ সংগ্রহ করলেন?
–ক্ষুধা, আমি সবসময় অত্যন্ত ক্ষুধার্ত, এখনও।
মেলিনা তাকালেন ডেমিরিসের চোখের দিকে। হ্যাঁ, সেখানে যে ভাষা ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে কোনো প্রতারণা নেই।
–আপনার রূপকথার মতো জীবনের গল্পটা আমাকে বলবেন? কীভাবে সবকিছু শুরু হয়েছিল।
–সত্যি সত্যি আপনি সব কিছু জানতে আগ্রহী?
মেলিনা বললেন–হ্যাঁ, আমি সত্যিই জানতে চাইছি।
–তখন আমার সতেরো বছর বয়স। আমি একটা ছোট্ট তেল কোম্পানিতে চাকরি করতাম। মধ্য প্রাচ্যে। কিন্তু আমার কিছুই ছিল না। একদিন এক ভূতত্ত্ব বিশারদের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তিনি একটা বিরাট তেল কোম্পানিতে কাজ করেন। আমি সেই রাতে স্টিক অর্ডার দিয়েছিলাম, তিনি খালি সুপ খাচ্ছিলেন।
আমি জানতে চেয়েছিলাম, এর কারণ কী। উনি বলেছিলেন, ওঁর পেছনের দিকের দাঁত নেই। তিনি নকল দাঁত কিনতে পারছিলেন না, পকেটে পয়সা নেই। আমি নতুন দাঁত কেনার জন্যে ওঁর হাতে পঞ্চাশ ডলার দিয়েছিলাম। একমাস বাদে উনি মাঝরাতে আমাকে ফোন করেছিলেন। উনি বলেছিলেন, একটা নতুন তৈলখনির সন্ধান পাওয়া গেছে। মালিককে তখনও পর্যন্ত কিছু বলেননি। পরদিন সকালে আমি চারপাশ থেকে টাকা ধার করতে শুরু করলাম। সবকিছু বেচে দিলাম। বিকেল বেলা আমার নতুন আবিষ্কারে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে দেখা গেল এটাই পৃথিবীর অন্যতম বড়ো তেলের খনিতে পরিণত হয়েছে।
মেলিনা প্রত্যেকটি কথা শুনছিলেন, ঔৎসুক্য ঝরে পড়ছিল তার অভিব্যক্তির মধ্যে। এ যেন সিনেমার গল্প! মাঝেমধ্যে বাস্তব কত রঙিন হয়ে ওঠে।
–এটাই হল শুরু। এবার ট্যাঙ্কারের দরকার, নাহলে তেল পরিবহন করব কী করে? তখন আমার এসব কিছুই ছিল না। তারপর আমি একটা ফ্লিটের মালিক হলাম। রিফাইনারি স্থাপন করলাম। এয়ারলাইনের অধিকারী হলাম। আরও আরও কত কী!
দেখা গেল, তারা একে অন্যকে আকর্ষণ করছেন। কেন? জীবনটা গল্পের থেকে ভয়ংকর বলেই কী? তাই বোধহয় হবে।
.
মেলিনা লামব্রো কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের সাথে দেখা করার কথা ভাবেননি। কিন্তু এমন কিছু ঘটনা ঘটে গেল যে, সমস্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতি পালটে গেল। ডেমিরিস হয়তো একই পার্টিতে আসছেন। একই থিয়েটারে দেখা হচ্ছে। একই চ্যারিটি শোতে। এটা কি ঈশ্বরের যোগাযোগ? ডেমিরিসের প্রতি মেলিনা একটা অদ্ভুত প্রতিটান অনুভব করছেন। তার কেবলই মনে হচ্ছে ডেমিরিসের চরিত্রে চুম্বক লাগানো আছে। কিন্তু ম্যানোস? নাঃ, ম্যানোসকে আর ভালো লাগছে না। ম্যানোসের সাহচর্য বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছে।
মেলিনা লামব্রো ফ্লেমিশ পেইন্টারদের ছবি ভালোবাসেন, ব্রুজেলসের হান্টার ইন দ্য স্নোতার অত্যন্ত প্রিয় ছবি। ছবিটি বাজারে এল, কনস্টাটানটিন ডেমিরিস এক কপি পাঠিয়ে দিলেন। ঘটনাটা মেলিনাকে অবাক করল।..
মেলিনা তাঁর নিজস্ব পছন্দ সম্পর্কেও হয়তো এত খবর জানতেন না। তবুও তিনি বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। বলেছিলেন–আপনার কাছ থেকে এত দামি উপহার আমি গ্রহণ করব কেন?
-না, এটা তো আমি উপহার হিসাবে দিচ্ছি না। এর জন্য আপনাকে দাম দিতে হবে।
কী দাম?
–আজ রাতে আপনি আমার সাথে ডিনার করবেন।
মনের সাথে লড়াই করে মেলিনা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলেন। সত্যি, এই লোকটিকে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না! একটা অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্বের চুম্বক আকর্ষণ আছে তার চরিত্রের মধ্যে।
এক সপ্তাহ বাদে মেলিনা কাউন্ট ম্যানোসের সাথে তার এনগেজমেন্ট ভেঙে দিলেন। অর্থাৎ তখন তিনি স্বাধীন বিহঙ্গী হয়ে গেছেন।
এই খবরটা তিনি দাদাকে জানালেন। দাদা অবাক হয়ে গেলেন। স্পাইরস বললেন কেন কী হয়েছে? তুই এমন করছিস কেন?
–আমি কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে বিয়ে করতে চলেছি।
স্পাইরস আরও অবাক।
–এমন করিস না বোন, লক্ষীটি, তুই ডেটিরিসকে বিয়ে করতে পারিস না! লোকটা একটা দানব, ভদ্রবেশি শয়তান, ও তোর জীবনটাকে ছারখার করে দেবে।
না, দাদা তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। মানুষটা সত্যিই চমৎকার! আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি।
–সে কী? তুই লোকটাকে ভাললাবেসে ফেলেছিস? পরে বুঝতে পারবি, ও ভালোবাসার কিছু বোঝে না। ও তোর মতো বিখ্যাত মেয়ের সান্নিধ্যে আসতে চাইছে।
না, এইসব অতীতের ঘটনা। স্পাইরস, আমি জানি আমি খুব ভালো স্ত্রী হতে পারব।
স্পাইরস বুঝল বোনের সাথে পূর্বেকার সখ্যতা হারিয়ে গেছে। সে এখন সম্পূর্ণভাবে ডেমিরিসের গুণমুগ্ধ। অতএব বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হল। একমাস বাদে মেলিনা লামব্রো এবং কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল।
প্রথমে মনে হয়েছিল এটা একটা সুন্দর বিবাহ ব্যবস্থা। একে অন্যকে উজাড় করে দিচ্ছেন সীমাহীন ভালোবাসা। কনস্ট্যানটিনের চরিত্রের মধ্যে কোনো কলঙ্ক নেই। প্রতিমুহূর্তে স্ত্রীর প্রতি অনুগত তিনি। নিত্যনতুন উপহার দিয়ে স্ত্রীর মন ভরিয়ে দিচ্ছেন।
প্রথম রাত, মধুচন্দ্রিমা, উনি বলেছিলেন–আমার প্রথম স্ত্রী আমাকে সন্তান দিতে, পারেনি। আমি আশীর্বাদ করছি, আমি তোমাকে অনেকগুলো ছেলে উপহার দেব।
মেলিনা বলেছিলেন–মেয়ে নয় কেন?
তুমি যদি চাও তা-ও হবে, কিন্তু প্রথমে আমি ছেলে চাইছি।
যেদিন খবরটা পৌঁছোল, মেলিনা গর্ভবতী কনস্ট্যানটিন হেসে উঠেছিলেন। সেই হাসির মধ্যে অহংকারের ছোঁয়া ছিল, ছিল আত্মতৃপ্তির ছাপ।
–ওই ছোট্ট শিশুটি একদিন আমার বিরাট সাম্রাজ্যের দায়দায়িত্ব নেবে। কনস্ট্যানটিন আনন্দের সঙ্গে বলেছিলেন।
তখন গর্ভের তিনমাস চলেছে। কিন্তু, মেলিনার গর্ভপাত হয়ে গেল। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস তখন বাইরে ছিলেন, এই ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল। তিনি ফিরে এলেন। খবরটা শুনলেন, উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকলেন।
তিনি বিস্ময়ে চিৎকার করে বলেছিলেন কী করে হল? কীভাবে ঘটল?
-কোস্টা…।
–তুমি এত অমনযোগী কেন?
না, আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি…
কনস্ট্যানটিন গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন–ঠিক আছে, যেটা হবার তা তো হয়ে গেছে। কিন্তু আমি একটা পুত্রসন্তান চাইছি।
না, আমি….
মেলিনার দুচোখে তখন লবণাক্ত অঞর ইশারা।
–তুমি কী বলতে চাইছ?।
–ওরা একটা অপারেশন করতে বাধ্য হয়েছে। ওদের আর কিছু করার ছিল না। ভবিষ্যতে আমি কখনও সন্তানের জননী হতে পারব না।
এই কটি কথা বিষতীরের মতো আক্রমণ করেছিল কনস্ট্যানটিনকে। তিনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন পাথরের মূর্তি হয়ে। তারপর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
তখন থেকেই মেলিনা তার জীবনে একটা মূর্তিমান শয়তানি হিসেবে বিরাজ করছেন। মেলিনার সাহচর্যের কথা ভাবলেই নরকের অন্ধকারকে মনে করেন তিনি। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস তার এই স্ত্রীকে আর কতদিন বহন করবেন? তিনি সুনিশ্চিত, ওই শয়তানি ইচ্ছে করেই তার গর্ভের সন্তানকে নষ্ট করেছে। তখন থেকেই ডেমিরিস মেলিনাকে উপেক্ষা করতে শুরু করলেন। অন্যান্য মহিলাদের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠলেন।
মেলিনা সব কিছু বোঝেন। কিন্তু তিনি এটাও জানেন, ব্যাপারটা সর্বসমক্ষে আনলে আরও কষ্ট হবে। অথচ স্বামী এমন বেপরোয়া আচরণ করেন! বান্ধবীদের সাথে সিনেমা দেখতে যান, অপেরা সিঙ্গারদের সঙ্গে আলাপন করেন। এমনকি কয়েকজন বন্ধুর স্ত্রীও তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীতে পরিণত হয়েছেন। পাসারাতে নিজস্ব বাংলো আছে তার। তিনি মাঝেমধ্যে প্রমোদ তরণীতে ভেসে বেড়ান। জনগণের সামনে রক্ষিতাদের নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের এই রোমাঞ্চকর অভিসারের কথা ইনিয়ে বিনিয়ে লেখে। সবই মেলিনার কানে যায়, কিন্তু তিনি নিরুপায়। তিনি জানেন, এই অপরাধের হয়তো কোনো ক্ষমা নেই।
একবার একজন বিখ্যাত ব্যাঙ্কারের বাড়িতে ডিনারের আমন্ত্রণ এসেছে। ব্যাঙ্কার বললেন–আপনাকে আর মেলিনাকে অবশ্যই আসতে হবে। আমি একজন প্রাচ্যদেশীয় শেফকে নিয়ে এসেছি। তার হাতের চাইনিজ রান্না, আহা, খেলে ভুলতে পারবেন না!
অতিথিদের তালিকাটা ছিল দেখার মতো। সেখানে দেশের সেরা শিল্পীরা আসবেন। আসবেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকেরা, শিল্পপতিরা। খাবারটাও সত্যিই চমৎকার! শেফ বানিয়েছিল হাঙরের ফিন সুপ, মো সু শুয়োরের মাংস, হাঁসের মাথা ক্যানটনের ন্যুডলস, আরও কত কী!
মেলিনা ওই গৃহকর্তার পাশেই বসেছিলেন। আর ডেমিরিস ছিলেন গৃহকত্রীর পাশে। ডেমিরিসের পাশে একটা অল্পবয়সী মেয়ে বসেছিল, সম্প্রতি সে ছায়াছবির জগতে পা রেখেছে। ডেমিরিস বারবার ওই অভিনেত্রীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। মেলিনার কঠিন কঠোর চোখের নিষেধ তার উৎসাহে ভাটা আনতে পারেনি।
–ছবিটা শেষ করার পর তুমি অবশ্যই আমার এমোদ তরণীতে একবার আসবে। আমি তোমাকে একটা সুন্দর ছুটি উপহার দেব। আমরা ডালমাটিয়ান উপকূলে ভেসে বেড়াব।…
মেলিনার কানে সব কথা পৌঁছোচ্ছিল। তবু মেলিনা কিছু না-শোনার ভান করছিলেন। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াল। ডেমিরিস তার উচ্চকিত কণ্ঠস্বর নীচু করার চেষ্টা না করে বললেন–তুমি কখনও পাসারাতে গেছ কী? ছোট্ট একটি দ্বীপ, একেবারে ফঁকা, নৈঃশব্দ্যের রাজত্ব। প্রতিটি মুহূর্ত তোমার ভালো লাগবে।
মেলিনা ওই টেবিলে আসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যাপারটা অশোভন হবে ভেবে তা আর করলেন না।
খাওয়া শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, বাটলাররা ব্যস্ত আছে যে যার কাজে।
ওই অভিনেত্রীর সামনে একটি বাটি রাখা হল। ডেমিরিস বললেন, এটা আর তোমাকে ধুতে হবে না। তারপর তিনি অভিনেত্রীর হাতে হাত রাখলেন। তার হাতের কোণে সসের টুকরো লেগেছিল, ডেমিরিস এক অনুগত প্রেমিকের মতো সস পরিষ্কার করতে শুরু করলেন। উপস্থিত অতিথিরা এই বিসদৃশ ছবিটির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আছেন। ডেমিরিসের কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
এবার মেলিনা উঠে দাঁড়ালেন, বললেন–আমাকে ক্ষমা করবেন, হঠাৎ আমার মাথাটা ধরেছে। আমি আর এখানে থাকতে পারছি না।
মেলিনা ছুটে বেরিয়ে গেলেন। অতিথিরা অবাক চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। ডেমিরিস সেই দিন রাতে বাড়িতে আসেননি। পরের দিনও তাকে দেখা গেল না।
**
স্পাইরস এই ঘটনাটার কথা শুনলেন, তিনি বললেন–আমি ওই কুকুরের বাচ্চাটাকে খুন করব, আমি তোকে কথা দিচ্ছি বোন।
মেলিনা বলেছিলেন, এসব করে কিছু হবে না দাদা, লোকটার স্বভাবটাই এমন।
–ওর স্বভাব? ও একটা জন্তু, তুই কেন ওকে ডিভোর্স দিচ্ছিস না?
মেলিনা ডেমিরিস মাঝেমধ্যে এই প্রশ্নটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসেন। কেন? কেন তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? রাতের অন্ধকার যখন ঘনীভূত হয়, একা শয্যায় শুয়ে থাকতে থাকতে এই প্রশ্নটা বারবার তাকে আক্রমণ করে। একটি উত্তর, একটিই উত্তর ভেসে আসে, এখনও, এখনও আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি!
**
সকাল সাড়ে পাঁচটা, ক্যাথেরিনের ঘুম ভেঙে গেল। অবশ্য তার ঘুম ভাঙানো হয়েছে। একজন পরিচারিকা বলছে-শুভ সকাল মিস।
ক্যাথেরিন চোখ খুলল। তাকিয়ে থাকল ঈষৎ বিভ্রান্তির মধ্যে। আহা, কনভেন্টের সেই ছোট্ট সেলটি কোথায় হারিয়ে গেছে। সে একটা বিরাট বেডরুমে শুয়ে আছে। স্মৃতি আবার ফিরে এল। এথেন্সে যাত্রা..তুমি ক্যাথেরিন ডগলাস…তাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
–মিস!
–কী বলছ?
–ডেমিরিস জানতে চাইছেন আপনি টেরাসে গিয়ে তার সাথে ব্রেকফাস্ট খাবেন কিনা। ক্যাথেরিনের চোখে নিদ্রা জড়ানো। কণ্ঠস্বরে তন্দ্রাচ্ছন্নতা। সে চারটে পর্যন্ত জেগেছিল। তার মনে ঝড় উঠেছিল।
ধন্যবাদ, ডেমিরিসকে বলো আমি এখনই সেখানে যাচ্ছি।
**
কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। একজন বাটলার ক্যাথেরিনকে একটা বিরাট টেরেসের সামনে নিয়ে এল। টেরেসের পাশেই সমুদ্র। উঁচু পাথরের পাঁচিল। সুন্দর সাজানো বাগান। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস টেবিলে বসে আছেন, কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি ক্যাথেরিনকে আসতে দেখলেন। আহা, ক্যাথেরিনের চরিত্রের মধ্যে এখনও একটা অদ্ভুত সরলতার ছাপ আছে। ডেমিরিস তার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রেখেছেন। মনে মনে তিনি নগ্না ক্যাথেরিনকে কল্পনা করলেন। তারা বিছানাতে শুয়ে আছেন। নোয়েলে এবং ল্যারিকে শাস্তি দিতে হবে। ডেমিরিস উঠে দাঁড়ালেন।
শুভ সকাল, এত সকালে আপনার ঘুম ভাঙালাম বলে আমাকে ক্ষমা করবেন মিস। আসলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমাকে অফিসে বেরিয়ে যেতে হবে। তার আগে আপনার সাথে কিছু কথা বলার সুযোগ পেলে নিজেকে কৃতার্থ বলে মনে করতাম।
ক্যাথেরিন বলল ঠিক আছে, এত কিন্তু করতে হবে না।
ক্যাথেরিন বিরাট মার্বেল টেবিলের উল্টোদিকে বসে পড়ল। মুখোমুখি সমুদ্র। সূর্য এইমাত্র উঠেছে। আহা, সূর্যের আলো সমুদ্রের ওপর ঝিলিক দিচ্ছে!
–ব্রেকফাস্টে আপনি কী নেবেন?
–আমি খুব একটা ক্ষুধার্ত নই।
–একটু কফি খাবেন তো?
–অনেক ধন্যবাদ।
বাটলার ক্যাথেরিনের বেলেক কাপে কফি ঢালতে থাকল।
ক্যাথেরিন, আমাদের গত রাতের প্রস্তাবের বিষয়ে আপনি কী চিন্তা করলেন?
ডেমিরিস জানতে চাইলেন।
ক্যাথেরিন অবশ্য এই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা বিশেষ কিছু করতে পারেনি। সে বুঝতে পারছে না, এথেন্সে থেকে সে কী করবে? এথেন্সে একটা নগ্ন অতীত বেঁচে আছে, কিন্তু সে যাবে কোথায়? কনভেন্টে আর ফিরে যাবে না। সে শপথ নিয়েছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের কাছে কাজ করবে? ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ নয়। শেষ অবধি ক্যাথেরিন নিজেকে বোঝাতে বাধ্য হল, এই প্রস্তাবের মধ্যে উন্মাদনা আছে। হয়তো এভাবেই আমার জীবনে একটা নতুন দরজা উন্মোচিত হতে পারে।
ক্যাথেরিন বলল–হ্যাঁ, আমি…
–কী চিন্তা করেছেন?
–আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখব।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস তার আনন্দ চেপে রাখার চেষ্টা করলেন ঠিক আছে, আপনার সিদ্ধান্ত শুনে আমি খুশি হয়েছি। আপনি কখনও লন্ডন শহরে গেছেন।
–না, আমি কখনও সেখানে যাইনি।
কিন্তু তার মনে হল, স্মৃতির মধ্যে ওই শহরের ছবি ভাসছে। তার মানে? মনে মনে কখনও কি ক্যাথেরিন ওই শহরের বাসিন্দা হয়েছিল? আর কত, আর কত বিস্ময় আমাকে ক্ষত বিক্ষত করবে!
লন্ডনকে আমরা বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি সুসভ্য শহরের অন্যতম বলতে পারি। আমার মনে হয় সেখানকার বাতাবরণ আপনাকে খুবই উদ্দীপ্ত করবে। লন্ডনবাসীরা চমৎকার সহৃদয় স্বভাবের মানুষ। অজানা আগন্তুকের উদ্দেশে তারা সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেন।
ক্যাথেরিন ইতস্তত করতে থাকে।
–ডেমিরিস, আপনি কেন আমার জন্য এত সমস্যার পাহাড় নিজের কাঁধে তুলে নেবেন?
আপনার প্রতি আমার একটা দায়িত্ববোধ আছে। আমি আপনার স্বামীকে নোয়েলে পেজের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারটা আমার মনকে কষ্ট দেয়। অপরাধ। বোধ আমাকে আক্রান্ত করে।
আঃ, ক্যাথেরিন শান্তভাবে বললেন। নোয়েলে পেজ, এই নামটা এখনও ক্যাথেরিনকে শিহরিত করে। এরা দুজনে মিলে তাকে মৃত্যুর উপত্যকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। ল্যারি নিশ্চয়ই নোয়েলেকে ভালোবাসতো। কী ভালোবাসা!
ক্যাথেরিন একটি প্রশ্ন করার কথা ভাবছিল। একটুক্ষণ ইতস্তত করে সে জানতে চাইল কীভাবে তাদের হত্যা করা হয়?
কিছুক্ষণ নীরবতা
–তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিল। একঝক বুলেট ছুটে আসে এবং তাতেই…
ডেমিরিস ইচ্ছে করেই কথাটা শেষ করলেন না।
হায় ঈশ্বর! ক্যাথেরিন যেন চোখের সামনে দেখতে পেল ল্যারির দেহে বুলেট লেগেছে। আঃ, ল্যারির মাংস, ল্যারির তাজা রক্ত, যে মানুষটিকে সে এত ভালোবাসতো, তার এই অবনতি! তার এই পরিণতি? মনে মনে ভীষণ দুঃখ পেয়েছে ক্যাথেরিন।
–আপনাকে কিছু উপদেশ দিই, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করুন। অতীতের কথা কখনও ভাববেন না। বিশেষ করে আপনার অতীতটা যখন শুধুই অন্ধকারাচ্ছন্ন।
ক্যাথেরিন বলল–ঠিকই বলেছেন, আমি চেষ্টা করব।
–ঠিক আছে, একটু বাদে লন্ডনের দিকে একটা প্লেন উড়ে যাবে। ক্যাথেরিন, আপনি কি এই প্লেনের যাত্রী হবেন?
ক্যাথেরিন ভাবল, এর আগে ল্যারির সাথে সে কত জায়গাতে গেছে। তার জন্য কত প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল, গোছগাছ করা, কী লাগতে পারে তার তালিকা তৈরি করা। প্রতি মুহূর্তে ছিল আনন্দঘন উদ্বেলতা। আর এখন?
কী আর সঙ্গে নেবে সে? সামান্য কিছু নিলেই তো হবে। সে বলল ঠিক আছে আমি এখনই তৈরি হয়ে নেব।
বাঃ! আচ্ছা, আপনার স্মৃতি তো ফিরে এসেছে, আপনি কোনো কিছু সঙ্গে নিতে চাইছেন কী? অথবা কারো সাথে দেখা করতে চাইছেন যিনি আপনার অতীত সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন?
একটি নাম ভেসে এল, উইলিয়াম ফ্রেজার। ক্যাথেরিনের মনে হল এই পৃথিবীতে একমাত্র উইলিয়াম ফ্রেজারের সঙ্গেই তার কিছু পরিচয় বেঁচে আছে। ওই ভদ্রলোককে সে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। কিন্তু তার কাছে গিয়ে কীভাবে দাঁড়াবে সে? বরং কিছুদিন বাদেই ক্যাথেরিন উইলিয়াম ফ্রেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। আগে নিজের পায়ের ওপর পা রেখে দাঁড়াক, তারপর না হয় ফ্রেজারের নাম চিন্তা করবে।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ক্যাথেরিনের মুখের ওপর চোখ রেখেছেন। উত্তরের অপেক্ষা করছেন।
ক্যাথেরিন বলল–না, তেমন কারোর নাম মনে পড়ছে না।
এই ভাবেই ক্যাথেরিন হয়তো নিজের অজান্তে উইলিয়াম ফ্রেজারের জীবন বাঁচিয়ে দিল। যদি একবার ক্যাথেরিন ওই নামটা উচ্চারণ করত তাহলে…? তাহলে ডেমিরিস কি ওই ভদ্রলোককে বাঁচিয়ে রাখতেন?
–আমি আপনার জন্য একটা পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে রাখব। ক্যাথেরিনের হাতে তিনি একটি মুখবন্ধ খাম তুলে দিয়ে বললেন–এখানে আপনার বেতনের অ্যাডভান্স দেওয়া আছে। যেখানে আপনি থাকবেন, সবাই আপনাকে ভালোবাসবে। আমাদের কোম্পানির নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে, আপনি সেই ফ্ল্যাটেই থাকবেন।
ব্যাপারটা অভাবিত। ক্যাথেরিন বলে–শুধু শুধু আমাকে এত ঋণী করছেন কেন?
এবার হাতে হাত রাখা হল।
–শেষ অবধি আপনি দেখবেন আমি…
মনের গোপন কথাটা ডেমিরিস ব্যক্ত করলেন না। গলার স্বরে পরিবর্তন আনলেন। খুব সাবধানে এই ভয়ংকর খেলাটা খেলতে হবে। সামান্য ভুল হলেই সর্বনাশ।
তিনি শুধু বললেন আমি একজন ভালো বন্ধু হতে পারি, এ ব্যাপারটা আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে।
–আপনি এখনই আমার একজন উপকারী বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন।
ডেমিরিস হাসলেন। হাসির মধ্যে একটি শব্দ তার লেখা আছে, তা হল–অপেক্ষা কর, অপেক্ষা কর তাহলেই আমার আসল স্বরূপ বুঝতে পারবে।
**
দু ঘণ্টা কেটে গেছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ক্যাথেরিনকে রোলসরয়েসে করে এয়ারপোর্টে নিয়ে গেছে। তিনি বলেছেন-লন্ডন আপনাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাবে। আমি কিন্তু সবসময় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলব।
পাঁচ মিনিট বাদেই গাড়িটা চলে গেছে। ডেমিরিস লন্ডনে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে–মেয়েটি তাসছে, তার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে।
.
০৫.
হেলেনিকন এয়ারপোর্ট। সকাল নটা। প্লেন ছাড়বে। হকার সিডলে, ক্যাথেরিন, আর কেউ আছে কী? পাইলট, এক সুন্দর মুখের মাঝবয়েসি গ্রিক ভদ্রলোক। নাম প্যান্টেলিস, দেখলেন, ক্যাথেরিন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।
–কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের উড়ান পাখি উড়বে। তিনি বললেন।
ধন্যবাদ।
ক্যাথেরিন ককপিটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। পাইলট এসে গেছেন। কিন্তু, সেই প্লেনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কেন? এই প্লেনেই ল্যারি উঠেছিল। নোয়লে পেজ এই সিটে বসেছিলেন, যেখানে আমি বসে আছি? ক্যাথেরিনের মনে হল, সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করল। গভীরভাবে শ্বাস নিল। তারপর, তারপর ভাবল, ডেমিরিসের কথাই ঠিক। অতীতের কথা ভেবে কী লাভ? যে অতীতটা কবরেই শুয়ে আছে, সেখানেই সে শুয়ে থাক। আমরা শত চেষ্টা করেও তো অতীতের ঘটনাবলিকে পালটাতে পারব না।
ইঞ্জিনের আর্তনাদ শোনা গেল। ক্যাথেরিন চোখ খুলল। প্লেনটা এবারে উড়বে উত্তর পশ্চিম অভিমুখে। লন্ডন শহরের দিকে। কতবার ল্যারি এই প্লেনে চড়ে এখানে-সেখানে গেছে? সমস্ত আবেগ, সমস্ত অনুভূতি, এখন অতীত! আঃ, অতীত–রক্তাক্ত এবং বিষাক্ত!
**
১৯৪০ সালের গরমকাল, আমেরিকার যুদ্ধ শুরু হবার আগের বছর। নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। চেষ্টা করছে চাকরি নিতে, শিকাগো থেকে ওয়াশিংটন, যে-কোনো জায়গায়, তার প্রথম চাকরি।
রুমমেট বলেছিল–আমি তোমার জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারি। পার্টিতে একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সে টেকসাসে ফিরে কথা বলছিল। সে উইলিয়াম ফ্রেজারের অফিসে চাকরি করে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে। গতকাল রাতেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তুমি কি সত্যি সত্যি চাকরি করতে চাও?
জীবনটা একটা বাজি, ক্যাথেরিন জানতো। শেষ অবধি ফ্রেজারের রিসেপশন অফিসটা সে দেখতে পেল। দেখল অনেক মানুষের ভিড়। তবু একটা সুযোগ নিতে দোষ কী? ক্যাথেরিন ভেবেছিল। হঠাৎ ভেতরের অফিসের ঘরের দরজা খুলে গেল। উইলিয়াম ফ্রেজার বেরিয়ে এলেন। লম্বা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কোঁকড়ানো সোনালি চুল মাথায়। উজ্জ্বল নীল দুটি চোখে দীপ্তি। শক্ত সমর্থ পুরুষ।
তিনি রিসেপশনিস্টকে বললেন–লাইফ পত্রিকার একটি কপি দাও তো। তিন অথবা চার সপ্তাহ আগে যে পত্রিকাটা বেরিয়েছে। কভারে স্টালিনের ছবি আছে।
রিসেপশনিস্ট বলল–আমি এটা আনিয়ে দিচ্ছি ফ্রেজার।
স্যালি, সেনেটর বরো লাইনে আছেন। আমি ওই সংখ্যা থেকে ওঁকে একটা নিবন্ধ পড়ে শোনাবো। দু-মিনিটের মধ্যে কপিটা আনতে হবে।
উনি দ্রুত ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
ওঁর এই অভাবিত আচরণে চাকরিপ্রার্থীরা অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ছিল। অনেকে ক্লান্তিতে কাধ ঝেড়েছিল। অনেকের চোখে ফুটে উঠেছিল উত্তেজনা।
ক্যাথেরিনও সেখানে দাঁড়িয়েছিল। সবকিছু শান্তমনে ভাববার চেষ্টা করছিল। সে দ্রুত পায়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। বেরিয়ে আসবার সময় সে শুনতে পেয়েছিল এক ভদ্রমহিলার স্বর ভালো, আর একজন সরে গেল।
তারপর? তিন মিনিট কেটে গেছে, ক্যাথেরিন স্টালিনের ছবি ওয়ালা লাইভ পত্রিকা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। সেটা রিসেপশনিস্টের হাতে দিয়েছে। পাঁচ মিনিট বাদে ক্যাথেরিন নিজেকে দেখল উইলিয়াম ফ্রেজারের পাশে বসে থাকতে।
–স্যালি আমাকে সব বলেছে, তুমি লাইভ ম্যাগজিন নিয়ে এসেছ।
–হ্যাঁ স্যার।
–ভাবতেই পারছি না! তোমার পার্সে তিন সপ্তাহের আগের কাগজ থাকল কী করে?
না, স্যার।
–তুমি এত তাড়াতাড়ি আনলে কী করে?
–আমি সেলুনে গিয়েছিলাম। সেলুনে এবং দাঁতের ডাক্তারের অফিসে এইসব পুরোনো পত্রিকা পড়ে থাকে।
–তুমি বুঝি সব ব্যাপারেই এরকম চালাক চতুর চটপটে?
–না, স্যার।
-ঠিক আছে, তোমাকে আমার কাজে লাগবে। উইলিয়াম ফ্রেজার বলেছিলেন। সেই থেকে ক্যাথেরিনকে কাজে লাগানো হল।
ক্যাথেরিন ফ্রেজারের কাছে কাজ করতে শুরু করলেন। ফ্রেজার তখনও পর্যন্ত বিয়ে করেননি। যথেষ্ট পয়সা আছে তাঁর। সামাজিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কেও তিনি সচেতন। ওয়াশিংটন শহরের অনেকের সাথে তার চেনাজানা। টাইম পত্রিকা তাকে বছরের অন্যতম ব্যাচেলারের আখ্যা দিয়েছে।
ছ-মাস কেটে গেছে। ক্যাথেরিনের কাজ এগিয়ে চলেছে। উইলিয়াম ফ্রেজারকে ভালোবাসতে শুরু করে দিল সে। তাদের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ভালোবাসা, তীব্র আকুতি।
উইলিয়াম ফ্রেজারের শোবার ঘরে শুয়ে ক্যাথেরিন বলেছিল–আমি তোমাকে একটা সত্যি কথা বলতে চাই, এখনও আমি সর্বাংশে কুমারী।
ফ্রেজার মাথা নেড়ে বলেছিলেন–ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য! আমি কী করে জানব, ওয়াশিংটন শহরের একমাত্র কুমারী কন্যার সঙ্গে সঙ্গম করতে চলেছি?
.
একদিন উইলিয়াম ফ্রেজার ক্যাথেরিনকে বললেন–আমাদের অফিস আর্মি এয়ার কর্পস ফি দেখাশোনা করবে। হলিউডের এমজি এম স্টুডিওতে শুটিং শুরু হবে। আমি লন্ডনে থাকব। তুমি আমার অবর্তমানে সব দায়িত্ব নিতে পারবে তো?
আমি? উইল, আমি এত বড়ো কাজ করব কী করে? আমি কি ফিল সম্পর্কে কিছু জানি?
ফ্রেজার বলেছিলেন–সব কিছু তোমাকে জানতে হবে। তুমি মোটেই চিন্তা কোরো না। ওদের একজন ডিরেক্টর আছে, তিনি হলেন অ্যালান বেনজামিন। উনি তোমাকে সব রকম সাহায্য করবেন।
–তুমি আমাকে এত বড়ো দায়িত্ব দিচ্ছ কেন?
–আমার মনে হয় এই কাজটা তুমিই ভালো করতে পারবে।
–ঠিক বলছ?
অতএব, ক্যাথেরিনকে হলিউডে উড়ে যেতে হল। ওই শিক্ষানবীশ ফিল্মটি দেখাশোনা করার জন্য।
**
এক্সট্রারা চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। বেশির ভাগই এলোমেলো ভাবে পোশাক পরেছে।
ক্যাথেরিন জিজ্ঞেস করেছিল–অ্যালান, বেনজামিন কোথায়?
–ওই ছোট্ট কলপোরাল? উনি ওখানে ঘুমিয়ে আছেন।
ক্যাথেরিন এগিয়ে গেল। একটা রোগা চেহারার মানুষকে দেখা যাচ্ছে। কলপোরালের পোশাক পরা। সবকিছু তদ্বির করার চেষ্টা করছেন।
নাঃ, এভাবে কাজ হয় না। সবাই মাতব্বরি করছে, কিন্তু কেউ কাজ করতে চাইছে না। সবাই যদি চিফ হয় তবে ইন্ডিয়ান হবে, কে?
ক্যাথেরিন বলেছিল–আমি ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আপনি কাজে যোগ দিয়েছেন! আমার কী কাজ সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। ডিয়ারবোনে আমি একটা ভালো কাজ করতাম, ফার্নিচার ট্রেড ম্যাগাজিন সম্পাদনার। বছরে পঁয়ত্রিশ শো ডলার মাইনে পেতাম। সেখান থেকে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। আমি কি ছাই পরিচালনার কিছু বুঝি! যাক আপনি এসে গেছেন, নিজের কাজ বুঝে নিন।
কথাগুলো বলেই ক্যাথেরিনকে অবাক করে দিয়ে তিনি দ্রুত নিষ্ক্রমণ পথ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
এক পাতলা চেহারার মানুষকে দেখা গেল, সোয়েটার পরে এগিয়ে আসছে ক্যাথেরিনের দিকে। স্মিত হাসি লেগে আছে তার ঠোঁটের কোণে।
কেউ কি আমাকে সাহায্য করতে পারেন?
ক্যাথেরিন আরও বলেছিল, বুঝতে পারছি, এই অবস্থার দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে। আমি তো কিছুই করতে পারব না।
তারপর সেই শুভ সংবাদ।
–হলিউড আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আমি টম ওব্রায়ান। আমি হলাম সহকারী পরিচালক।
আপনি কি মনে করেন আমি এখানে কাজ করতে পারব?
ভদ্রলোকের ঠোঁট কাঁপছে–আপনাকে চেষ্টা করতে হবে, উইলি ওয়াইলারের সাথে আমি ছটি ছবিতে কাজ করেছি। এতটা খারাপ অবস্থা কোথাও দেখিনি। সবকিছু আছে, খালি শৃঙ্খলার অভাব। চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে, সেটও তৈরি হয়েছে।
ক্যাথেরিন চারদিকে তাকিয়ে দেখল।
–কিছু কিছু ইউনিফর্ম খুবই বাজে। দেখা যাক ভালো ইউনিফর্ম পাওয়া যায় কিনা। ওব্রায়ান মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ঠিক আছে।
ক্যাথেরিন এবং ওব্রায়ান এক্সট্রাদের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। অনেককেই সচতুর বলে মনে হল, কেউ কেউ একেবারে বাজে, ফালতু।
ওব্রায়ান বললেন মিস আলেকজান্ডার, আপনার সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দিই। এদের নিয়েই তো আপনাকে চলতে হবে।
ক্যাথেরিন বলেছিল- হ্যাঁ, একটু ভালো চেহারার ছেলেদের বাছুন তো। আখেরে কাজ দেবে।
ওব্রায়ান কাজ করতে শুরু করলেন। ক্যাথেরিন উল্লসিত হাসির চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। কারা যেন কথা বলছে। তার দিকে তাকিয়েও দেখছে না। এক্সট্রা মেয়েদের সাথে গম্বুরি করছে। হি হি হো হো হাসির টুকরো শোনা যাচ্ছে।
বিশেষ করে একটি মানুষ, উদ্ধত স্বভাবের। তার আচরণ ক্যাথেরিনকে দুঃখ দিয়েছে।
–আপনি কি আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন?
লোকটি আলস্য ভাবে বলেছিল- আপনি আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন?
সে সত্যি সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী, তার মাথায় একরাশ লাল-কালো চুলের সমাহার। চোখ দুটিতে ঝড়ের ইশারা। ইউনিফর্মটা তার গায়ে বেশ মাপ মতো হয়েছে। তার কাঁধের ওপর ক্যাপ্টেনের স্মারক চিহ্ন। বুকের ওপর রঙিন রিবন বাঁধা।
ক্যাথেরিন তার দিকে তাকাল। বলল–এই পদকগুলো?
–এগুলো দারুণ সম্মানের, তাই না?
–কিন্তু এগুলো তো খুলে ফেলতে হবে।
–কেন? আমার মনে হয় পদকগুলো থাকলে ছবিটা আরও রঙিন হয়ে উঠবে।
ছেলেটির স্পষ্ট স্বীকারোক্তি।
ক্যাথেরিন কঠিন স্বরে বলতে থাকে আমেরিকাতে কি এখন যুদ্ধ হচ্ছে? এই পদকগুলো পরে অভিনয় করলে ছবিটা কার্নিভালে দেখানো যাবে না।
–আপনি ঠিকই বলেছেন, ছেলেটি তার ভুল স্বীকার করে নিল। আমি অতটা তলিয়ে দেখিনি। ঠিক আছে আমি খুলে ফেলছি।
–সব কটা খুলবেন কিন্তু, মনে থাকে যেন, এটা হল আমার আদেশ।
ক্যাথেরিনের কণ্ঠস্বরে আদেশের সুর ভাসছে।
.
সকালবেলাকার শুটিং শেষ হয়ে গেছে। ক্যাথেরিন কমিসারিতে বসে লাঞ্চ খাচ্ছে। ছেলেটি তার কাছে পৌঁছে গেল। বলল–আজ সকালে আমার শু্যটিং কেমন লেগেছে? তাই জানতে এসেছি।
ছেলেটির ব্যবহার ক্যাথেরিনকে মুগ্ধ করেছে।
ইউনিফর্ম পরে আপনি ভালোই শু্যটিং করেছেন। মেয়েদের মধ্যে আপনাকে বেশ । স্বচ্ছন্দ মনে হয়েছিল। আপনি কি বরাবরের জন্য অভিনয় করতে চাইছেন নাকি?
ছেলেটিকে দেখে মনে হল, কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে সে ভয় পেয়েছে। সে বলতে থাকে ঠিক করে বলুন তো, আপনার চোখে আমার অভিনয় কেমন লেগেছে?
ক্যাথেরিন বলে বসল সত্যি বলছি, আপনাকে উপযুক্ত মনে হয়েছে।
-কেন?
–এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
–আজ রাতে ডিনারের সময় দেখা হবে কি?
-না-না, আপনাকে অত কষ্ট করতে হবে না। ক্যাথেরিন বলল। আমি মিঃ ওব্রায়ানকে বলব, আজ সকালের পারিশ্রমিকটা চেকের মারফত আপনার হাতে পৌঁছে দিতে। আচ্ছা আপনার নাম কী?
ডগলাস, ল্যারি ডগলাস।
***
সেই উৎসাহী তরুণ ভদ্রলোকের সাথে এইভাবেই ক্যাথেরিনের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। একটু বাদেই ক্যাথেরিন ঠিক করল তার মন থেকে ওই ছেলেটির মুখ সে মুছে দেবে। তা না হলে কাজ করবে কী করে? কিন্তু কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে ছেলেটির মুখচ্ছবি তার মনের ক্যানভাসে আঁকা রইল।
***
ক্যাথেরিন ওয়াশিংটনে ফিরে এসেছে। উইলিয়াম ফ্রেজার বললেন কতদিন তোমার সাহচর্য পাইনি। তোমার জন্যে খুব চিন্তা হচ্ছিল, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?
ভীষণ ভীষণ। এ ব্যাপারে তোমার কি সন্দেহ আছে বিল?
–তোমাকেও আমি খুব ভালোবাসি, ক্যাথি। চল না আজ রাতে কোথাও যাই। আর আমাদের এই ভালোবাসাটাকে উদ্যাপিত করি।
ক্যাথেরিন জানে, এই রাত তার জীবনে নতুন কোনো খবর বয়ে আনবে। এই রাতেই হয়তো কেউ তাকে এমন একটা প্রস্তাব করে বসবে, যে প্রস্তাবের উত্তরে তাকে হা বলতেই হবে।
তারা অভিজাত জেফারসন ক্লাবে পৌঁছে গিয়েছিল। ডিনার খেতে খেতে ল্যারি ডগলাসকে দেখা গেল। তখনও আর্মি এয়ারফোর্সের পোশাক তার পরনে। গলায় ঝুলছে একাধিক মেডেল। ক্যাথেরিন তার দিকে তাকিয়ে থাকল। সে টেবিলের কাছে এল। কিন্তু ফ্রেজারকে দেখে মাথাটা সামান্য নীচু করল।
বিল ফ্রেজার উঠে দাঁড়ালেন।
ক্যাথি, এ হল ক্যাপ্টেন লরেন্স ডগলাস। ল্যারি, এ হল মিস আলেকজান্ডার ক্যাথেরিন। ল্যারি আরএএফ-এর সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে হল অ্যামেরিকান স্কোয়াড্রনের লিডার। ভার্জিনিয়াতে একটা ফাইটার বেসে এখন কাজ করছে। আমাদের ছেলেরা সেখানে চমৎকার লড়াই করছে।
মনে ইচ্ছে, এটা বোধহয় একটা পুরোনো মুভি। ক্যাথেরিনের মনে হল, সে কিনা ওই পদকগুলো খুলে ফেলতে বলেছিল। এবং ছেলেটি আনন্দের সঙ্গে তার আদেশ মেনে নিয়েছে। এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় বলে মনে হল ক্যাথেরিনের। ভাবল, হায়, আমি কি কাপুরুষের মতো আচরণ করলাম! ইচ্ছে হচ্ছিল টেবিলের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে মুখ লুকিয়ে বসে থাকবে।
***
পরের দিনই ল্যারি ডগলাস ক্যাথেরিনকে ফোন করেছিল। অফিসের ফোনটা ঝনঝনাৎ শব্দে আর্তনাদ করে উঠল। ক্যাথেরিন কিন্তু টেলিফোনটা ধরতে রাজি হয়নি। অনেক কাজ হাতে ছিল তার। কাজ শেষ হল। দেখা গেল ল্যারি তখনও তার জন্য অপেক্ষা করছে। ইতিমধ্যে ল্যারি তার পদকগুলো খুলে ফেলেছে। রিবনটাও খুলে রেখেছে। কেবল সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের চিহ্ন তার পোশাকের ওপর।
সে এক উজ্জ্বল হাসিতে মুখখানি উদ্ভাস করে বলল–এটাই বোধহয় ভালো, তাই না।
ক্যাথেরিন তার দিকে তাকিয়ে আছে নানা, আমি ঠিক তা ভেবে কথাগুলি বলিনি।
-ঠিক আছে। এত ইতস্তত করার কী আছে?
ক্যাথেরিন ল্যারির চোখের দিকে তাকাল। বুঝতে পারল, সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কিছু কিছু ছেলের চেহারার মধ্যে এমন একটা চুম্বক শক্তি লুকিয়ে থাকে, যার প্রভাব উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
–সত্যি করে বলল তো আমার কাছ থেকে তুমি কী চাইছ?
–সব কিছু, আমি তোমার সবটুকুর ওপর আমার অধিকার কায়েম করতে চাইছি।
ছেলেটির কথা বলার মধ্যে একটা স্পষ্ট সৎ চিন্তার প্রতিফলন।
দেখা গেল, সে তার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে গেছে। ভালোবাসার খেলা শুরু হয়েছে। ক্যাথেরিন এমন আনন্দের কথা স্বপ্নেও ভাবেনি কোনোদিন।
তারা একে অন্যের কাছে এসেছে। বিশ্বজগৎ হারিয়ে গেছে কোথায়! শেষ অব্দি ঘটে গেল সেই বিস্ফোরণ। অনাস্বাদিত আনন্দে পরিপ্লাবিত হল সমস্ত শরীর। অবিশ্বাস্য স্পন্দন উত্তেজনা। এমন একটা অভিযান, যার শেষে আছে শুধু সুখ আর সন্তুষ্টি। এর শুরু এবং শেষ কোথায় আমরা তা বলতে পারব না। সব কিছু হয়ে যাবার পর ক্যাথেরিন বোবা–বনে গিয়েছিল। তখনও সে শক্ত করে বিলকে আঁকড়ে ধরেছিল। কিছুতেই বিলকে ছেড়ে যেতে চাইছে না তার মন।
পাঁচঘণ্টা বাদে মেরিল্যান্ডে গিয়ে তারা বিয়ে করেছিল।
.
এখন, প্লেনে বসে, লন্ডনে যেতে যেতে ক্যাথেরিন একটা নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে। ক্যাথেরিন মনে মনে ভাবতে থাকে আমরা তো আনন্দে মুখরিত ছিলাম। তাহলে
এত সব ঝামেলা কোথা থেকে হল? রোমান্টিক মুভি, ভালোবাসার গান, এসবের কি কোনো । মূল্য নেই? মধ্যযুগীয় নাইট? অস্ত্রের ঝনঝনাত শব্দ? বলা হয়, ভালোবাসার মৃত্যু নেই। আমরা বিশ্বাস করতাম জেমস স্টেয়ার্ট আর ডোনা রিডের মধ্যে একটা সুন্দর বোঝাপড়া আছে। আমরা জানতাম ক্লার্ক গ্যাবেল আর ক্লাউডেট কোসবার্ট পরস্পরকে ভালোবাসে। বিশেষ করে ইট হ্যাঁপেন ওয়ান নাইট ছবিটি দেখার পর এই ধারণা আমাদের মনের মধ্যে চেপে বসেছিল। আমাদের চোখে জল আসত, যখন আমরা ফ্রেডরিক মার্চ আর মিরনা লয়ের অভিনয় দেখতাম। দ্য বেস্ট ইয়ারস অফ আওয়ার লাইফ ছবিতে ফ্রেডরিক যেভাবে মিরনাকে প্রত্যাখান করেছিল, সে ব্যাপারটা মনে হলেই বুকটা কেমন ডুকরে কেঁদে ওঠে। জোয়ান ফনটেন লরেন্স অলিভারের বাহুবন্ধনে ধরা দিয়ে কত না সুখী হয়েছিল। রেবেকা ছবিটির কথা মনে পড়ে। এখন মনে হচ্ছে এসবই মিথ্যে। সেলুলয়েড কখনও সত্যি কথা বলে না। ওই গানগুলো আমি তোমাকে ভালোবাসব, আমি তোমার কথা চিন্তা করব। তুমি কি আমায় ভালোবাসবে? সমুদ্র কত গভীর?… আরভিন বার্লিন এত মিথ্যে কথা লেখে কী করে? সব–সব মিথ্যে!
…ফর ওভার অ্যান্ড এ ডে, আমি ডিভোর্স চাইছি, তবুও তোমাকে আমি ভালোবাসি। এনচ্যানটেড ইভিনিং আমরা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে যাব। ইউ অ্যান্ড দ্য নাইট অ্যান্ড দ্য মিউজিক–হোটেল ম্যানেজার বলেছে, কাছেই: কতগুলো গুহা আছে…আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেন্টিমেন্টাল রিজিনস-এ কেউ জানে না, সে ঘুমিয়ে আছে কি মাই লাভ, আমরা দুজন এক হয়ে শুনব। আমরা দুজন কী করে বিশ্বাস করব–এসবের অন্তরালে কোনো সত্যি লুকিয়ে নেই।
মিস আলেকজান্ডার।
ক্যাথেরিন এতক্ষণ অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল। এবার সে আবার বাস্তবে ফিরে এসেছে।
পাইলট বলছেন আমরা ঠিক জায়গায় অবতারণ করেছি। লন্ডন শহর আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
এয়ারপোর্টে একটা লিমুজিন দাঁড়িয়ে ছিল। ক্যাথেরিনের জন্য অপেক্ষা করছিল। সোফেয়ার বলল, আমি আপনার লাগেজের দায়িত্ব নিচ্ছি মিস আলেকজান্ডার। আমার নাম আলফ্রেড, আপনি কি সোজা আপনার ফ্ল্যাটে যাবেন?
–আমার ফ্ল্যাট! বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটছে না।
–হ্যাঁ, সেটাই তো ভালো হয়।
ক্যাথেরিন তার সিটে বসে পড়ল। এখনও সব কিছু অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস এত কিছু করেছেন? একটা প্রাইভেট প্লেন দিয়েছেন, থাকার জন্য জায়গা! হয় তিনি এই পৃথিবীর সবথেকে সহৃদয় মানুষ, অথবা…কোনো বিকল্প ভাবনা এখন ক্যাথেরিনের মনে আসছে না। না, মনে হচ্ছে, উনি বোধ হয় পৃথিবীর সব থেকে দয়ালু মানুষ। উনি আমাকে পথ দেখিয়েছেন। নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে আমার।
ইটন স্কোয়ারের কাছে এলিজাবেথ স্ট্রিটে সাজানো ফ্ল্যাট। সর্বত্র আভিজাত্যের চিহ্ন। প্রবেশ পথে বিরাট একটা হল আছে। সুন্দর ভাবে সাজানো গোছানো একটি বসার ঘর। সেখানে ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি দুলছে। প্যানেল করা লাইব্রেরি। পর্যাপ্ত খাবার সমেত একটি কিচেন। তিনটি সুন্দর সাজানো বেডরুম। তার পাশাপাশি চাকরদের থাকার কোয়ার্টার।
দরজার মুখে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়েছিল। বছর চল্লিশ বয়স। কালো পোশাক পরেছে। সে বলল–শুভ সন্ধ্যা, মিস আলেকজান্ডার। আমি হলাম অ্যানা। আমি আপনার হাউস কিপার।
–অবশ্যই! আমার হাউস কিপার, ক্যাথেরিন ঢোঁক গিলে বলতে চেষ্টা করে ঠিক আছে। দরকার হলে আমি তোমাকে ডেকে নেব।
সোফেয়ার ক্যাথেরিনের সুটকেসটা নিয়ে এসেছে। সেটিকে তার বেডরুমে পৌঁছে দিল। সে বলল লিমুজিন গাড়িটা আপনার জন্য রাখা আছে। ইচ্ছে হলেই আমাকে ফোন করবেন। কেমন? অথবা অ্যানাকে বললেও হবে। আপনি কখন অফিস যাবেন সেটাও জানাবেন। আমি ঠিক সময়ে আপনাকে পৌঁছে দেব।
লিমুজিন গাড়িটা আমার জন্য রাখা আছে! ক্যাথেরিন বলল ধন্যবাদ।
অ্যানা জানতে চাইল আমি কি আপনার ব্যাগ খুলব? কী কী লাগবে আমাকে জানাবেন। প্রয়োজন হলেই বলবেন, কোনো ব্যাপারে ইতস্তত করবেন না কিন্তু।
–আমি এখন কিছু ভাবতে পারছি না। আগে একটু বিশ্রাম নিই, কেমন।
ক্যাথেরিনের কণ্ঠস্বরে আন্তরিকতার সুর ঝরছে।
যতক্ষণে অ্যানা তার ব্যাগ খুলে দরকারি জিনিস গুলো বের করে, ক্যাথেরিন ফ্ল্যাটের এখানে-সেখানে চোখ মেলে দিল। ক্যাথেরিন বেডরুমে গেল। ডেমিরিস যে সুন্দর পোশাকগুলো পাঠিয়েছেন, সেগুলোর দিকে চোখ মেলে দিল। আহা, সব কিছু একটা সুন্দর স্বপ্নের অংশ বিশেষ। বাস্তব কি এত পরিচ্ছন্ন হতে পারে? আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে সে একটা কনভেন্টের গোলাপকুঞ্জে বসেছিল। গোলাপগুলোকে পরিচর্যা করছিল। এখন মনে হচ্ছে সে যেন এক রূপসী রাজকুমারী হয়ে উঠেছে। কী কাজ করতে হবে সে ব্যাপারে ক্যাথেরিনের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সে জানে, তাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে। কারণ যে ভদ্রলোক অযাচিতভাবে এত সাহায্য করলেন, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা তো জানানো উচিত। সহসা নিজেকে খুবই ক্লান্ত বলে মনে হল ক্যাথেরিনের। সে কোমল আরামপ্রদ বিছানার ওপর শুয়ে পড়ল। তারপর এক মুহূর্তের মধ্যে সে চোখ বন্ধ করল।
ঘুমের অতলে তলিয়ে যাচ্ছিল ক্যাথেরিন। আবার, সেই আর্ত চিৎকার ল্যারি সাঁতার কেটে তার দিকে ছুটে আসছে। ল্যারি তার ঘাড় ধরে জলের ভেতর ডুবিয়ে দিচ্ছে। অন্ধকার একটি গুহার মধ্যে তাকে প্রবেশ করতে হয়েছে। বাদুড়রা উড়তে উড়তে তাকে আক্রমণ করছে। তার চুল ধরে টানাটানি করছে। তার মুখের ওপর বাদুড়দের ডানার ঝটফটানি।
ক্যাথেরিন বিছানাতে উঠে বসল। সমস্ত শরীর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।
বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিল সে, তার পাশে তাকাল। ও, এই দুঃস্বপ্নটা আমি কেন বারবার দেখি? এটা তো গতকালের ঘটনা। আজকের পৃথিবীটা একেবারে পালটে গেছে। অন্তত আমার কাছে। পৃথিবীর কেউ আর আমার ক্ষতি করতে পারবে না। আমার কোনো শত্রু নেই। তা হলে কেন?
ক্যাথেরিনের বেডরুমের বাইরে অ্যানা সেই আর্তনাদের শব্দ শুনতে পেয়েছিল। সে এক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করল। তারপর সবকিছু আবার আগের মতো শান্ত হলে সে চলে গেল হলের কাছে। খবরটা এখনই কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের কানে পৌঁছোতে হবে। অ্যানাকে এই জাতীয় নির্দেশ দেওয়া আছে। নিজের কাজ সম্পর্কে অ্যানা খুবই ওয়াকিবহাল। সে জানে, ক্যাথেরিনের সমস্ত গতিবিধির ওপর নীরব নিঃশব্দ নজর রাখতে হবে তাকে।
হেলেনিক ট্রেড করপোরেশন–২১৭, বন্ড স্ট্রিট; পিকাডিলি সার্কাসের কাছে। একটা পুরোনো সরকারি বাড়ি। কয়েক বছর আগে এটাকে ভেঙেচুড়ে অফিস বিল্ডিং-এ রূপান্তরিত করা হয়েছে। প্রবেশপথের ধারে অসামান্য স্থাপত্য নিদর্শন আছে, রাজকীয় এবং শ্রদ্ধেয়।
ক্যাথরিন নামল। অফিসের কর্মচারীরা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। অন্তত ছজন কর্মচারী তাকে সংবর্ধনা জানাতে এসেছে।
–স্বাগতম মিস আলেকজান্ডার! আমি ইভলিন কেই, এ হল কার্ল, ও হল টাকার, এ ম্যাথু, আর এ জেনি।
নামগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে।
আপনারা সব কেমন আছেন?
–অফিস তৈরি রাখা হয়েছে। আমি কি আপনাকে পথটা দেখাব?
–অনেক ধন্যবাদ।
রিসেপশন রুমটাকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। বিরাট চেস্টারফিল্ড সোফা আছে। দুটো ঘুরন্ত চেয়ার, একটি ট্যাপেসট্রি। তারা কার্পেট আচ্ছাদিত করিডরের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল। কনফারেন্স রুমের ভেতর প্রবেশ করল। পাইন কাঠের প্যানেল রয়েছে চারপাশে। চামড়ায় মোড়া চেয়ার। সুন্দরভাবে পালিশ করা বিরাট একটি ডিম্বাকৃতি টেবিল।
ক্যাথেরিনকে এবার তার অফিস ঘরে পৌঁছে দেওয়া হল। আহা, এত সুন্দর ফার্নিচার, লেদার কৌচ!
–এসবই আপনার ব্যবহারের জন্য মিস।
ভীষণ-ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমার। শিশুর মতো আনন্দে ক্যাথেরিন বলে ওঠে। ডেস্কে তাজা গোলাপ রয়েছে।
–মি. ডেমিরিস পাঠিয়েছেন, আপনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে।
ডেমিরিস এত চিন্তা করেন আমার জন্য! ক্যাথেরিনের চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
ইভলিন কেই–এই মেয়েটি পথ দেখিয়ে আগে আগে এগিয়ে চলেছেন। ইনি মধ্যবয়স্কা এক ভদ্রমহিলা। মুখে লাবণ্য আছে। আচরণ সন্তোষজনক।
–কদিনের মধ্যেই আপনি সব কিছু ব্যবহার করতে শিখে যাবেন। কাজের ধারাটা খুবই সহজ। আমরা ডেমিরিসের বিরাট সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। তবে আমাদের মধ্যে সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে। ওভারসিজ বিভাগ থেকে প্রতি মুহূর্তে রিপোর্ট আসছে। আমরা সব রিপোর্ট এথেন্সের হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি হলাম এই অফিসের ম্যানেজার। আপনি আমার সহকারিণী হিসেবে কাজ করবেন।
–ও, তাহলে আমি অফিস ম্যানেজারের সহকারিণী। ক্যাথেরিন জানে না তাকে ঠিক কী ধরনের কাজ করতে হবে। তাকে কল্পনার জগতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। নিজস্ব উড়ান পাখি, লিমুজিন, সুপার ফ্ল্যাট এবং পরিচারকবৃন্দজীবনে সে আর কী চাইতে পারে?
–উইম ভ্যানডিন হলেন আমাদের রেসিডেন্ট ম্যাথমেটিক্যাল জিনিয়াস। তিনি সমস্ত স্টেটমেন্টগুলোকে কম্পিউটারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। তারপর একটি মাস্টার ফিনানসিয়াল চার্ট তৈরি করেন। মেশিনের থেকেও তার মাথা দ্রুত কাজ করে। আসুন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করুন।
ওরা করিডর দিয়ে হেঁটে গেল। অফিসের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল। দরজায় কোনো শব্দ না করে, ইভলিন দরজাটা খুলে ফেললেন।
–উইম, এই হল আমার নতুন সহকারিণী। ক্যাথেরিন ভেতরে ঢুকে পড়ল। সেখানে দাঁড়াল। উইম ভ্যানডিনকে দেখে মনে হল, তার বয়স খুব বেশি হলে তিরিশ হবে। রোগা পাতলা চেহারা। পাকানো গোঁফ আছে। আর চোখের ভেতর কী অদ্ভুত নিষ্প্রভ চাউনি। তিনি জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলেন।
–উইম, উইম এই মেয়েটি ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার।
তিনি ঘুরে তাকালেন ক্যাথেরিনের প্রথম নাম হল মারটা স্কোরকা। ১৬৮৪ সালে একজন পরিচারিকার কন্যা হিসেবে তার জন্ম হয়েছিল। রাশিয়ানরা তাকে অপহরণ করে। সে প্রথম পিটারকে বিয়ে করেছিল। ১৭২৫ থেকে পরবর্তী দুবছর সে ছিল রাশিয়ার মহারানি। সম্রাজ্ঞীও বলা যায়।
ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট হল এক জার্মান রাজার কন্যা। ১৭২৯ সালে তার জন্ম হয়। সে পিটারকে বিয়ে করে। পরবর্তীকালে এই পিটার তৃতীয় পিটার হিসেবে সিংহাসনে বসে, ১৭৬২ সালে। স্বামীর মৃত্যুর পর ওই ক্যাথেরিন সিংহাসনে বসেছিল। সেই বছরই তাকে হত্যা করা হয়। তার রাজত্বকালে পোল্যান্ডে দুটি ডিভিশন পাঠানো হয়। দুটি যুদ্ধ হয় তুরস্কের বিরুদ্ধে।…
ভদ্রলোক কথা বলেই চলেছেন। তার জ্ঞানের বহর দেখে ক্যাথেরিন অবাক হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে তিনি বুঝি এক ঝরনা। সেখান থেকে জলধারার মতো নির্গত হবে তথ্যের ভাণ্ডার।
ক্যাথেরিন বলল–ভীষণ, ভীষণ ভালো লাগছে!
উইম ভ্যানডিন তার দিকে তাকালেন।
ইভলিন বললেন–উইম লোকের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। ও একা একা একটা জগৎ তৈরি করেছে। ও ভীষণ লাজুক।
কেন? ক্যাথেরিন ভাবল, ছেলেটিকে দেখেই মনে হচ্ছে সে হল ছাইচাপা এক টুকরো আগুন।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস এথেন্সে তার অফিসে বসেছিলেন। লন্ডনের আলফ্রেডের কাছ থেকে একটা টেলিফোন রিপোর্ট এসেছে।
আমি মিস আলেকজান্ডারকে এয়ারপোর্ট থেকে তাঁর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়েছি মিঃ ডেমিরিস। আমি জানতে চেয়েছিলাম, উনি কোথাও যেতে চাইছেন কিনা, আপনি যেমন বলেছিলেন, উনি কোথাও যেতে রাজি হননি।
মেয়েটি কি বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ করেছে?
–না স্যার, তিনি ফ্ল্যাট থেকে কারও কোনো টেলিফোনে কথা বলেননি।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস আর কোনো ব্যাপারে উদ্বিগ্ন নন। অ্যানার ওপর সব দায়িত্ব দেওয়া আছে। অ্যানার কাছ থেকে রিপোর্ট এসেছে। রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ডেমিরিস তাঁর মনের সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। না, এখুনি বিপদের কোনো কারণ নেই। তবে, মেয়েটি এই পৃথিবীর বুকে একদম একা। যে কেউ তার উপকারী বন্ধুর ভূমিকাতে অবতীর্ণ হতে পারে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ভাবতে থাকলেন, আমাকে লন্ডনে যেতে হবে খুবই তাড়াতাড়ি।
***
ক্যাঞ্জেরিন আলেকজান্ডার নতুন কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের বিশাল সাম্রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে খবরের স্রোত আসছে। কত কিছু আছে তাঁর, ভাবলে অবাক হতে হয়! ইন্ডিয়ানাতে আছে একটা ইস্পাত ফ্যাক্টরি। ইটালিতে আছে অটোমোবাইল ফ্যাক্টরি। অস্ট্রেলিয়াতে উনি একটা খবরের কাগজের চেন তৈরি করেছেন। এছাড়াও আছে একটা সোনার খনি আর ইনসিওরেন্স কোম্পানি।
ক্যাথেরিন নানা রিপোর্টের ওপর চোখ বোলায়। কিছু কিছু তথ্য আবার সরাসরি উইম ভ্যানডিনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উইম রিপোর্টগুলোর দিকে একবার নিরাসক্ত চোখ মেলে তাকান। তারপর কম্পিউটারের মতো গতিতে কাজ করতে থাকেন। তার কাজ করার ক্ষিপ্রতা দেখে ক্যাথেরিন অবাক হয়ে যায়। সত্যি, কী অবলীলায় তিনি শতাংশ হিসাব করেন। কতটা লাভ, কতটা ক্ষতি, তা বলে দেন, ক্যাথেরিনের মাথা ঝিমঝিম করে।
নতুন সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হচ্ছে। সত্যি, ছেলে-মেয়েরা সহৃদয় এবং ভালো স্বভাবের।
ইভলিন কেই-এর সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে দেখা হচ্ছে ক্যাথেরিনের। ক্যাথেরিন উইমকে বলেছিল, এই বাড়িটা সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জানাতে।
উইম গড়গড় করে বলে গেছেন–এটা একটা সরকারি কাস্টমস হাউস। স্যার ক্রিস্টোফার রেন ১৭২১ সালে এই বাড়িটার ডিজাইন করেছিলেন। লন্ডনে যেবার ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড হয়ে যায় তখন ক্রিস্টোফার রেন পঞ্চাশটি চার্চকে নতুন করে সাজিয়ে তোলেন। তার মধ্যে আছে সেন্ট পলস, সেন্ট মাইকেলস এবং সেন্ট ব্রাইউসের মতো বিখ্যাত গির্জাগুলি। তিনি রয়াল এক্সচেঞ্জ এবং বাকিংহ্যাম হাউসও তৈরি করেন। ১৭২৩ সালে । তার মৃত্যু হয়। তাকে সেন্ট পলস-এর সমাধিক্ষেত্র সমাহিত করা হয়েছে। ১৯০৭ সালে এই বাড়িটাকে একটা অফিস বিল্ডিং-এ রূপান্তরিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকার এই বাড়িটিকে এয়ার-রেড শেলটার হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
এয়ার-রেড শেলটার মানে হল, যেখানে বোমা আঘাত করতে পারবে না। বেসমেন্টের কাছে এমন একটা ঘর সাজানো আছে। ক্যাথেরিন মাঝে মধ্যে সেদিকে তাকায়। অনেক কিছুই মনে পড়ে যায়। সাহসী ব্রিটিশ নারী এবং পুরুষেরা কীভাবে দীর্ঘদিন এখানে বসবাস করেছে! হিটলারের লুফটওয়াফে তখন ধারাবাহিক বোমাবর্ষণ করে চলেছে। ওই স্বেচ্ছাবন্দি মানুষগুলো কিন্তু মুহূর্তের জন্যও মনোবল হারায়নি।
বেসমেন্টটা বিরাট, মনে হয় গোটা অফিস বাড়িটির মতো তার আয়তন। সেখানে বিরাট বিরাট বয়লার আছে। আছে ইলেকট্রনিক এবং টেলিফোনের যন্ত্রপাতি। বয়লারটি নিয়ে মাঝে মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় ক্যাথেরিনকেও এই সমস্যার সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। যারা বয়লার সারায়, তাদের বেসমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হয়েছে।
–ভয়ংকর-ভয়ংকর ব্যাপার, যে-কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, তাই তো?
ক্যাথেরিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছে।
হৃদস্পন্দনের গতিকে স্তব্ধ করুন। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন। দেখুন এখানে সেফটি ভালভ আছে। বয়লারটা খুব গরম হয়ে গেলে বিস্ফোরিত হতে পারে। তার আগেই সেফটি ভালভটা খুলে গরম হাওয়া বাইরে বের করতে হবে। ঠিক আছে, কোনো সমস্যা হবে না।
এইভাবেই কথা বলেছে মেকানিকরা। তাদের কথা শুনে ক্যাথেরিন শান্ত হয়েছে। দু দিন যেতে না যেতে আবার সেই একই সমস্যা।
.
সারাদিনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। লন্ডন–কত কিছু আছে এখানে! লন্ডন শহরের নৈশ জীবন নানা বিনোদনে ভরা। আছে থিয়েটার, ব্যালেট আর মিউজিক কনসার্ট, পুরনো বইয়ের দোকান আছে। যেমন–হ্যাটচার্ড এবং ফয়লে অসংখ্য। মিউজিয়াম ছড়ানো আছে শহরের নানা প্রান্তে। ছোটো ছোটো অ্যান্টিকের দোকান। সুস্বাদু খাবারের রেস্টুরেন্ট। ক্যাথেরিন একদিন গেল সিসিল কোর্টে। লিখোগ্রাফের দোকানে পা রাখল। হ্যাঁরোডস-এ গিয়ে খুঁজল। কিছু জিনিসপত্র কিনল। ফর্টনাম এবং ম্যাসন খেল। মার্কস ও স্পেনসারের দোকান থেকে ঘুরে এল। স্যাভয়-এ রোববারের চায়ের আসরে বসল।
মাঝে মধ্যে তার মনের মধ্যে অশুভ চিন্তার আগমন ঘটে যায়। কত কথাই মনে পড়ছে। ল্যারি সম্পর্কে। তার কণ্ঠস্বর, কিছু বাক্যবন্ধ, একটি কোলোন, একটি গান। অতীত হারিয়ে গেছে, ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যতের কথাই এখন থেকে তাকে ভাবতে হবে। এই চিন্তা দিনে দিনে তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে।
.
ক্যাথেরিন এবং ইভলিন কেই পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করল। তারা এখন একসঙ্গে বাজার করতে যায়। এক রোববার তারা গেল ওপেন-এয়ারআর্ট এগজিবিশন দেখতে। টেমসের ধারে এই অসাধারণ প্রদর্শনীর আসর বসেছে। কত শিল্পী বসে বসে ছবি আঁকছেন। তরুণ থেকে বয়স্ক সকলে। তাদের সকলের মধ্যে একটা সাদৃশ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের জীবনে বিষণ্ণতা আছে, আছে বিফলতা। তারা কোনো গ্যালারিতে ছবি দেখাতে পারেন না। কিন্তু তাদের সকলেই উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন। ক্যাথেরিন কিছু ছবি কিনল সহানুভতি দেখাবার জন্য।
ইভলিন জানতে চেয়েছিলেন- এই ছবিগুলো কোথায় লাগানো হবে?
ক্যাথেরিন জবাব দেয় কেন, অতবড়ো বয়লার রুমটাতে ফাঁকাই পড়ে আছে।
লন্ডনের পথে প্রান্তরে ঘুরতে ঘুরতে দুজনের মধ্যে কত-না কথা হয়। মাঝে মধ্যে তারা ফুটপাথে বসে থাকা আর্টিস্টদের সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ কেউ চক দিয়ে সুন্দর ছবি আঁকছে, কেউবা পাথরের টুকরো দিয়ে, কারোর আঁকার মধ্যে আন্তরিকতা আছে। পথচলতি মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকছে ওই ক্ষণকালীন শিল্পসুষমার দিকে। শ্রদ্ধা-ভক্তির চিহ্ন ফুটেছে তাদের আচরণের মধ্যে দেখতে পেল। সে চক দিয়ে বিরাট রাস্তায় বসে থাকা শিল্পীর দিকে কয়েকটা কয়েন ছুঁড়ে দিচ্ছে তাচ্ছিল্য ভরে।
একদিন লাঞ্চ শেষ হয়ে গেছে। সন্ধ্যে হব-হব। ক্যাথেরিন দেখল এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটি ল্যান্ডস্কেপ আঁকছে। সেটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হঠাৎ একরাশ বৃষ্টি এল। ভদ্রলোক দেখল, তার এতক্ষণের সব পরিশ্রম ধুয়ে শেষ হয়ে গেল।
অনেকটা আমার হারনো অতীতের মতো, ক্যাথেরিন ভাবল।
.
ইভলিন ক্যাথেরিনকে শেফার্ড মার্কেটে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- এটা হল খুবই মজার জায়গা। শুধু মজা নয়, এই মার্কেটের পরতে পরতে নিষিদ্ধ উত্তেজনার ছাপ আছে।
মার্কেটটা সত্যি বর্ণরঙিন। তিনশো বছরের পুরোনো একটা রেস্টুরেন্ট আছে। তার নাম টিডি ডলস। আছে ম্যাগাজিন স্ট্যান্ড, বাজার, বিউটি পার্লার, বেকারি, অ্যান্টিক জিনিসপত্রের দোকান এবং বেশ কয়েকটা বসতবাড়ি।
মেল বক্সের ওপর যে নাম লেখা আছে সেগুলো পড়তে ভালো লাগে। যেমন হেলেন, নীচে লেখা ফ্রেঞ্জ লেসন, রোসি, নীচে লেখা গ্রিক শেখানো হয় এখানে।
ক্যাথেরিন জানতে চেয়েছিল-এটা কি পড়াশোনার জায়গা?
ইভলিন হেসে বলেছিলেন- না, প্রথমে আমার একই ভুল হয়েছিল। স্কুলে মেয়েদের যেসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় না, এখানে সেসব বিষয়েই পড়াশোনা করানো হয়।
ইভালিন হেসে উঠলেন। ক্যাথেরিনের মুখে লজ্জার লালিমা।
.
বেশির ভাগ সময় ক্যাথেরিনকে একা একা থাকতে হয়। কিন্তু একাকিত্বের যন্ত্রণা কখনও তাকে গ্রাস করতে পারবে না–এমনই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত সে এই মুহূর্তে নিয়ে ফেলেছে। সে তার হারানো দিনের স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসে। তার জীবনে রোমন্থন করার মতো উজ্জ্বল মুহূর্ত কিছু ছিল কী? নাকি সব কিছুই হারিয়ে গেছে। সে ভবিষ্যৎ অথবা অতীতের কথা ভেবে মনটাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করতে চায় না। একদিন ক্যাথেরিন উইন্ডসর ক্যাসেল থেকে ঘুরে এল। গেল ক্যান্টারবেরিতে। আহা, অমন সুন্দর ক্যাথিড্রাল! হ্যাঁম্পটন কোর্টেও একদিন সে পা রাখল। সপ্তাহান্তে সে গিয়েছিল শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে। প্রকৃতি এখানে কত উদার এবং নির্মল। শান্ত একটি সরাইখানাতে বেশ কিছুটা সময় কাটাল। একা একা ঘুরে বেড়ালো প্রকৃতির উদার স্বর্গরাজ্যের মধ্যে দিয়ে।
ভাবল, আমি এখনও জীবিত, ভীষণভাবে জীবিত। সুখী অবস্থায় কেউ জন্মাতে পারে না। প্রত্যেক মানুষকে নিজস্ব সুখের সরণি খুঁজে নিতে হয়। এতদিন বাদে আমি সেই সরল সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমার বয়স এখন খুব একটা বেশি নয়। আমার শরীরে কোনো রোগ বাসা বাধেনি। মনে হচ্ছে, এবার বোধহয় আমার দিন ফিরবে।
সোমবার আবার কাজ শুরু হল। ইভলিনের সঙ্গে দেখা হল, দেখা হল অন্য মেয়েদের সঙ্গে এবং উইম ভ্যানডিন-এর সঙ্গে।
উইম ভ্যানডিনকে দেখে ক্যাথেরিন অবাক হয়ে যায়। ক্যাথেরিন তার কাছে কোনো মানুষকে আসতে দেখেনি। ভদ্রলোক চাপা প্রকৃতির। নিজেই নিজের জগৎ তৈরি করেছেন। এই অফিসে কুড়িজন কাজ করে। সকলকার হিসাব তার নখদর্পণে। কী আশ্চর্য, তিনি কিন্তু কখনও ক্যালকুলেটর ব্যবহার করেন না! চোখ বন্ধ করে তিনি বলতে পারেন, কোন কর্মচারীর কত টাকা বেতন, ইনসিওরেন্সের নাম্বার কত, কত টাকা কাটা হয়–সব কিছু। সব কিছু ফাইলের ভেতর লেখা আছে, কিন্তু ওই ভদ্রলোক ফাইলের তোয়াক্কা করেন না। ওঁর মাথার ভেতর গোপন প্রকোষ্ঠ আছে। সেখানে সব তথ্য ভরা আছে। তিনি জানেন, প্রত্যেকটা ডিভিশন থেকে কত টাকা ক্যাশবাবদ অফিসে আসে। গতমাসের সঙ্গে একটি তুলনা, তাও করতে পারেন যেমন, তেমনি পাঁচ বছর আগের কথাও তার মনে আছে। যখন এই কোম্পানিটি সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছিল।
.
উইম ভ্যানডিন সব কিছু মনে রাখেন। যা কিছু তাকে বলা হয়, তাকে পড়নো হয় অথবা দেখানো হয়। তার জ্ঞানের পরিধিটা আকাশছোঁয়া, অবিশ্বাস্য, যে-কোনো বিষয়ে অত্যন্ত সহজ প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন, আবার কঠিন প্রশ্নের জবাবও তার ঠোঁটের ডগায়। কিন্তু ভদ্রলোক বড্ড বেশি অমিশুকে, অসামাজিক এবং একগুঁয়ে।
ক্যাথেরিন ইভলিনের সঙ্গে আলোচনা করে ওই আশ্চর্য প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটি সম্পর্কে।
ক্যাথেরিন বলে বসে লোকটিকে আমি এখনও পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না।
ইভলিন বলেন- উইমকে আমরা এককেন্দ্রিক মানুষ বলতে পারি। কথা বলে মনে হবে সে বুঝি এক নিরেট, মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি বলে কিছু নেই। সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রতি তার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। আমার মনে হয়, সে বোধহয় কোনো লোকের সাথে ভাব জমাতে চায় না।
–ওঁনার কি কোনো বন্ধু নেই?
–না।
–উনি কি কখনও কোনো মেয়ের সাথে ডেটিং করেন নি?
–না।
ক্যাথেরিনের মনে হল, উইম একেবারে একা এবং নিঃসঙ্গ। আহা, উইমের সাথে অদ্ভুত একাত্মতা অনুভব করল সে।
.
ক্যাথেরিন উইমের জ্ঞানের পরিধি দেখে অবাক হয়ে গেছে। একদিন সকালে তার মনে হল, কানের যন্ত্রণাটা বেশ বেড়েছে। এই নিয়ে. উইমের সাথে কথা বললে কেমন হয়?
কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, উইম শিষ্টাচার হারিয়ে ফেলেছে। তিনি বললেন–আজ আবহাওয়াটা বিচ্ছিরি। আপনি একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
-কেন?
আপনি কি জানেন, আমাদের কানের ভেতর অনেক সংবেদী অংশ আছে। বেশ কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে এই কানটা তৈরি হয়েছে। এখানে আছে অরিকল, অডিটারি টাপস, টাইমফেনিক মেমব্রেম, আরও কত কী! সেই সব অঙ্গগুলো একসঙ্গে কাজ করলে তবেই আমরা শুনতে পাই। কোনো কারণে একটি অঙ্গ বিকল হলে….।
ভদ্রলোক কথা বলে চলেছেন। ক্যাথেরিন বুঝতে পারল, না, বন্ধুত্ব জমবে না।
একদিন ক্যাথেরিন এবং ইভলিন মিলে উইমকে র্যামস হেডে নিয়ে গিয়েছিল। এটা স্থানীয় একটা পাব।
ক্যাথেরিন একদিন জানতে চেয়েছিল–খেলাধুলোতে আপনার কেমন উৎসাহ? আপনি কি কখনও বেসবল খেলা দেখেছেন?
উইম বলতে থাকেন, বেসবলের আকৃতি কেমন বলুন তো? নয় পূর্ণ কোয়াটার ইঞ্চি হল এর পরিধি। এটাকে তৈরি করা হয় পরিষ্কার সুতো দিয়ে। ওপরে সাদা চামদার আচ্ছাদন থাকে। ব্যাটে চামড়ার আচ্ছাদন থাকে। ব্যাট তৈরি করা হয় ছাইয়ের গুঁড়ো দিয়ে। দুই পূর্ণ তিনের দুই ইঞ্চির বেশি ব্যাস থাকে তার। লম্বা চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ ইঞ্চি।
সমস্ত রাশিবিজ্ঞান উহমের নখ দর্পণে, ক্যাথেরিন ভাবল। কিন্তু? এই সব কচকচানি কে শুনবে?
–আপনি কখনও কোনো খেলা খেলেছেন? বাস্কেটবল?
বাস্কেটবল খেলা হয় কাঠ কিংবা কংক্রিট ফ্লোরের ওপর। বলটির পরিসীমা হল একত্রিশ ইঞ্চি। তার ভেতর রবারের ব্লাডার দেওয়া থাকে। তেরো পাউন্ড প্রেসারে বাতাস ভরে দেওয়া হয়। ওজন কুড়ি থেকে বাইশ আউন্সের মতো। জেমস নেসমিথ ১৮৯১ সালে বাস্কেটবল খেলা আবিষ্কার করেছিলেন।
ক্যাথেরিন তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে।
.
কোনো কোনো সময় উইমকে জনসমক্ষে অপদস্ত হতে হয়। এক রোববার সেই বিচ্ছিরি ঘটনাটা ঘটে গেল। সেদিন টেমসের ধারে মেইডেনহেডে গিয়েছিল ক্যাথেরিন, ইভলিন এবং উইম। উইম যেতে চায়নি। ইভলিন তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায়। তারা কমপ্লিট অ্যাঙ্গলারে গিয়েছিল লাঞ্চ খেতে। ওয়েটার এল।
–আজকে আমাদের মেনুতে নতুন নতুন সামুদ্রিক খাদ্য আছে।
ক্যাথেরিন জানতে চাইল- আপনি কি ক্লামের মাংস পছন্দ করেন?
উইম গড়গড় করে বলতে থাকেন–ছ-রকমের ক্লামের মাংস পাওয়া যায়। একটিকে বলে পদ্মরাগ ক্লাম, অন্যটি লাল ক্লাম। এছাড়া সিঙ্গেল শেল, রেজর ক্লাম, রাউন্ড ক্লামও দেখা যায়।
ওয়েটার তার মুখের দিকে তাকিয়ে তোতলাতে থাকে স্যার, আপনি অন্য কিছু খাবেন কী?
উইম বললেন আমি ক্লামের মাংস পছন্দ করি না।
ব্যাপারটা সত্যি অশোভন। কী আর করা যাবে। ক্যাথেরিন আপ্রাণ চেষ্টা করছে উইমকে জনসমক্ষে নিয়ে আসতে। কিন্তু উইম কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না এই প্রস্তাবে। তিনি তার নিজস্ব জগতে বসবাস করতে চাইছেন। সেই জগতে মানুষের প্রবেশ নিষেধ। সেখানে শুধু যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের বিচিত্র খেলা।
একদিন ক্যাথেরিন ইভলিনকে বলল–উইম কি কোনোদিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন না? উনি কি কোনোদিন কোনো মেয়েকে ভালোবাসবেন না? বিয়ে করে সুখী সংসার পাতবেন না?
ইভলিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন–আমি তো আগেই বলেছি, ভদ্রলোকের মনের ভেতর আবেগ নেই। তিনি কখনও কারও সাথে যুক্ত হতে পারবেন না।
এই ব্যাপারটা ক্যাথেরিন বিশ্বাস করতে পারছে না। মাঝে মধ্যে উইমের চোখের তারায় সে কৌতূহল দেখেছে। দেখেছে স্নেহের বিচ্ছুরণ আর আনন্দঘন মুহূর্তের উপস্থিতি। তার মানে? তার মানে উইমের মধ্যে এখনও একটা উচ্ছল প্রাণসত্তা বেঁচে আছে। হয়তো অতীতের কোনো স্মৃতি তাকে এইভাবে আক্রমণ করছে। তাই তিনি চারপাশে প্রাচীর রচনা করেছেন। আরও-আরও চেষ্টা আমাকে করতে হবে। আমি উইমকে প্রাণ প্রাচুর্যে ফিরিয়ে আনবই।
.
একদিন স্যাভয় থেকে একটি আমন্ত্রণপত্র এল। সেখানে চ্যারিটি বল দেখানো হবে।
ক্যাথেরিন সোজাসুজি উইমের অফিসে পৌঁছে গেল–উইম, আপনি কি নাচতে পারেন?
এই অভাবিত প্রশ্ন শুনে উইম অবাক হয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন- নাচের সব ভঙ্গিমা আমি জানি। তবে নাচতে আমি সত্যি জানি না। কিন্তু কোন্ নাচে কোন্ কৃকুশলতা লুকিয়ে আছে আমি এখনই তা বলে দিতে পারি। একচল্লিশ রকমের ফক্সট্রট নাচ আছে। প্রথমেই পুরুষ সঙ্গীটিকে শুরু করতে হয়। তাকে প্রথমে বাঁ পা টা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দুটি স্টেপ সামনের দিকে ফেলতে হবে। সঙ্গিনী ডান পায়ের ওপর ভর রাখবে। দুটো স্টেপ পিছিয়ে যাবে। এইভাবেই একবার এখোনো, একবার পেছোনোর খেলা চলবে। পুরুষসঙ্গী এবার ডান পা-টার ওপর নিজের ভর রাখবে। ধীরে ধীরে শরীরটাকে সামনের দিকে নামিয়ে আনবে। তারপর? তারপর গতি ক্রমশ বাড়বে। একবার ডান একবার বাঁ, এইভাবে নাচটাকে চালিয়ে যেতে হবে।
ক্যাথেরিন পাথরের মূর্তি হয়ে সেখানে দাঁড়িয়েছিল। কী বলবে, ভুলে গেছে সে। কী আশ্চর্য, লোকটা সত্যি একটা পাগল অথবা প্রতিভাবান! উনি সব কিছু জানেন, কিন্তু শব্দের আসল মানে না। ব্যাপারটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।
.
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের ফোন বেজে উঠল। রাত হয়েছে। ক্যাথেরিন তখন ঘুমোতে যাবার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে।
–আমি কোস্টা, আশা করি আমার ফোন পেয়ে আপনি বিরক্ত হননি?
না-না! এতদিন বাদে ফোন…ক্যাথেরিনের মনে আনন্দ। কতদিন বাদে সে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে। অনেক দিন ওই কণ্ঠস্বর শুনতে পায়নি সে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, ডেমিরিস এখানে থাকলে বোধহয় ভালো হত। অন্তত তার উপদেশ কাজে লাগাতে পারত সে। আহা, এই পৃথিবীতে একমাত্র এই মানুষটি ক্যাথেরিনের জন্য আন্তরিকভাবে চিন্তা করেন। ডেমিরিসের কথা মনে হলেই অনেক কিছু ভেবে বসে ক্যাথেরিন।
ক্যাথেরিন, কেন জানি না, সকাল থেকে আপনাকে মনে পড়ছে। লন্ডন শহরটা আপনার কেমন লাগছে? নিজেকে এখনও একা এবং নিঃসঙ্গ বলে মনে হচ্ছে কি? সত্যি কথা বলতে কি, লন্ডনে তলে আপনি এক অজানা আগন্তুক। এই শহরে কারও সঙ্গে তো আপনার বন্ধুত্ব নেই।
হ্যাঁ, কোনো কোনো সময় একা লাগে বৈকি, ক্যাথেরিন স্বীকার করে নেয়। কিন্তু আপনার কথা আমি মনে রেখেছি। অতীতকে ভোলবার চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতের জন্যই আমি বেঁচে আছি।
–ঠিকই করছেন, সব সময় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করবেন। কালকে আমি: লন্ডনে পৌঁছোব। আমি আপনার সাথে ডিনার খেতে পারি কী?
-হ্যাঁ হ্যাঁ, এ তো এক অভাবিত সৌভাগ্য। ক্যাথেরিন উষ্ণ আবেগের সাথে বলে বসে। সামনের দিকে বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে আছে। আহা, ডিনারে বসে সে তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে। সেই সুযোগ আগামীকাল তার মুঠোবন্দি হবে।
কনস্টনটিন ডেমিরিস রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। মনে মনে হাসলেন। তা হলে? অনুসরণ এবার শুরু হল!
.
রিট হোটেলে ডিনারের আসর, ডাইনিং রুমটা আভিজাত্যে ভরা, খাবারটা সত্যি সুস্বাদু। ক্যাথেরিন অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সে কোনো কিছুই খাচ্ছে না। উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটি তার সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আহা, কত কথা বলার আছে। কিন্তু সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে পারছি কই?
–আপনার অফিসের সহকর্মীরা ভারী চমৎকার, এমন সুন্দর স্বভাবের মানুষ আমি খুব একটা বেশি দেখিনি। উইমকে আলাদাভাবে মনে রাখতে হয়েছে। তার মতো একজন মানুষ…
ক্যাথেরিন উৎসাহের আতিশয্যে বলে বসে।
ডেমিরিস কিন্তু কোনো কথা শুনছেন না। তিনি ক্যাথেরিনের হাবভাব লক্ষ করছেন। আহা, এই মেয়েটি এখনও এত সুন্দরী! ওর আচরণের মধ্যে একটা অহংকার লুকিয়ে আছে। কিন্তু আমি এখন কী করব? ডেমিরিস শেষ পর্যন্ত একটা কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। না, খেলাটাকে ধীরে ধীরে খেলতে হবে। তাহলে শেষ পর্যন্ত আমিই জয়যুক্ত হব। আহা, নোয়েলে, তোমার কথা মনে পড়ছে এবং তোমার সেই বোকা হাঁদারাম প্রেমিক পুরুষটির কথা।
–আপনি লন্ডনে কদিন থাকবেন? ক্যাথেরিন জানতে চাইল।
–একদিন বা দুদিন। এখানে ব্যবসার কিছু কাজ আছে।
কথাটা সত্যি, কিন্তু এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। ডেমিরিস কেন লন্ডনে এসেছেন? ক্যাথেরিনকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। দেখতে হবে, ক্যাথেরিন যেন তার প্রতি আবেগি হয়ে উঠতে পারে।
ডেমিরিস টেবিলের ওপর ঝুঁকলেন–ক্যাথেরিন, আমি কি কখনও বলেছি, একসময় সৌদি আরবে আমি তেলের খনিতে কাজ করতাম।
.
পরের দিন রাতে আবার ডেমিরিস ক্যাথেরিনকে নিয়ে ডিনারের টেবিলে বসলেন।
ইভলিন আমাকে সব কথা বলেছে। আমার কর্মচারীরা আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনি চমৎকার কাজ করছেন। মনে হচ্ছে, আপনার মাইনে বাড়াতে হবে। দেখা যাক, আগামী মাস থেকে আপনার পদোন্নতি ঘটাব আমি।
আপনি তো আমার প্রতি অনেক সহৃদয়তা প্রদর্শন করেছেন, আর কেন আমাকে ঋণে জর্জরিত করছেন?
ক্যাথেরিন বলতে থাকে।
ডেমিরিস এক দৃষ্টে ক্যাথেরিনের দিকে তাকিয়ে আছে না, আপনি জানেন না, আমি আরও কত সহৃদয় হতে পারি।
এই কথা শুনে ক্যাথেরিনের কেমন যেন অস্বস্তি হল। ক্যাথেরিন জানে, সত্যি, এই ভদ্রলোকের কোনো তুলনা হয় না।
.
পরের দিন ডেমিরিস লন্ডন শহর ছেড়ে যাবার জন্য তৈরি হলেন।
ক্যাথেরিন, আপনি কি আমার সঙ্গে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আসবেন?
–হ্যাঁ।
আহা, এইভাবে দিন কেটে গেলে কেমন হয়?
এয়ারপোর্ট পৌঁছে একটু ঝুঁকে ডেমিরিস ক্যাথেরিনের গালে একটা চুমু দিলেন।
তার এই আচরণে ক্যাথেরিন খুশি হয়েছে।
ডেমিরিস বললেন–আহা, আপনার সঙ্গে কিছুটা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে পারলাম। এই স্মৃতি আমি কোনদিন ভুলব না।
কোস্টা, আমিও আপনার আচরণে খুবই খুশি হয়েছি। কবে আমাদের আবার দেখা
উড়ানপাখি আকাশের বুকে ডানা মেলে দিয়েছে। আহা, সত্যি ডেমিরিসের কোনো তুলনা হয় না। ক্যাথেরিন ভাবল, প্রতি মুহূর্ত ডেমিরিসের কথাই মনে পড়বে আমার।