কূর্ম পুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)
অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ
উপদেষ্টা– শ্রী নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী
সম্পাদনা • পরিমার্জনা • গ্রন্থনা– পৃথ্বীরাজ সেন
বিষ্ণুকে নমস্কার করে ব্রহ্মার দ্বারা কথিত পুরাণের বিবরণ দেব। নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতাঁকে প্রণাম করে শুরু করছি কুর্ম পুরাণ।
নৈমিষারণ্যবাসী মহর্ষিরা রোমহর্ষণ নামক পূতচরিত্র এক সূতস্তূতি পাঠককে পুরাণ-সংহিতার বিষয় প্রশ্ন করলেন– হে মহাবুদ্ধি সূত, তুমি ইতিহাস ও পুরাণ বিষয়ে জ্ঞান লাভের জন্য ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভগবান ব্যাসকে সেবা করেছ। লোকে রোমহর্ষণ বলে কারণ দ্বৈপায়ন ঋষির বাক্য শুনে তাঁর শরীর রোমঞ্চিত হয়েছিল পুরাণ– সংহিতা বলবার জন্য, ব্রহ্মার যজ্ঞ শেষে পুরুষোত্তমের অংশে উৎপন্ন হয়েছিল। তুমি পুরাণ বিশেষজ্ঞ।
তখন সূত সত্যবতীর পুত্র ব্যাসকে প্রণাম করে বলা শুরু করলেন। তিনি বললে–এই পুরাণ কথা শুনলে সকল পাপ বিনষ্ট হয়। পাপিষ্ঠ পরম গতি লাভ করে, এই পবিত্র কথা নাস্তিকের কাছে বলতে নেই। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বর্ণের মধ্যে যে সমস্ত ব্যক্তির শ্রদ্ধা আছে। যাঁরা শান্তি ও ধার্মিক তাদের কাছেই নারায়ণ মুখনিঃসৃত এই পুরাণ কথা বলতে হয়।
পুরাণ আঠারোটি– ব্ৰহ্মপুরাণ, পদ্ম, বিষ্ণু, শিব, ভাগবত, ভবিষ্য, নারদীয়, মার্কণ্ডেয়, অগ্নি, ব্রহ্মবৈবর্ত, লিঙ্গ, বরাহ, স্কন্দ, বামন, কূর্ম, মৎস্য, গরুড়, বায়ু এবং ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। কিছু উপপুরাণও আছে। প্রথমটি হল সনৎকুমার কথিত আদিপুরাণ, নরসিংহ পুরাণ, কুমার কথিত স্কন্দপুরাণ, শিব কথিত শিবপুরাণ, দুর্বাসা কথিত আশ্চর্য পুরাণ, নারদীয় পুরাণ, এছাড়া আছে কপিল ও বামন পুরাণ। উশান বলেছেন নবম পুরাণটি আর ব্রহ্মাণ্ড বরুণ কালিকা, মহেশ্বত শাম্ব, সবার্থ প্রকাশক সেরে, পরাশর, মারীচ ও ভার্গব পুরাণ, এই উপপুরাণও আঠারোটি।
পবিত্র কূর্মপুরাণ হল পঞ্চদশ পুরাণ। সংহিতার প্রভেদ হেতু এবং চার ভাগ ব্রাহ্মী ভগবতী, গৌরী, বৈষ্ণবী যা ধর্ম, অর্থ কাম ও মোক্ষ চতুর্বর্গ ফল দান করে। এতে ছয় হাজার শ্লোক সংকলিত। এতে আছে সৃষ্টি ও প্রলয়ের কথা, রাজা ও ঋষির বংশাবলী, কাল গণনা, রাজা ও ঋষিদের চরিত্রগাথা, দিব্য, পুণ্য প্রসঙ্গের কথা, এই কথাকে ধার্মিক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণরাই ধারণ করতে পারেন। ব্যস কথিত পুরাকালের কথাই তিনি বললেন।
মন্দর পর্বতকে মন্থন দণ্ডরূপে গ্রহণ করে ক্ষীরসাগর মথিত করা হয়। অমৃত পাবার জন্য দেবতা ও দানবরা মিলিত হলে জনার্দন দেব হিতার্থে মন্দর পর্বতকে ধারণ করেন। এতে দেব ও মহর্ষিরা তুষ্ট হন। এরপর নারায়ণ বল্লভা দেবী উত্থিত হলে বিষ্ণু তাকে গ্রহণ করেন।
তার রূপচ্ছটায় সকলে মুগ্ধ হন। তখন দেবতারা এই বিশালাক্ষ্মী দেবীর পরিচয় জানাতে চাইলেন। তখন বিষ্ণু দেবতাদের জানালেন, এই দেবী তারই এক নিজরূপ। ইনি ব্রহ্ম রূপিণী পরমা শক্তি। ইনি তারই মায়া, প্রিয়া এবং অন্তহীনা। ইনি জগদ্ধাত্রী, এই দেবীর মায়ার সাহায্যেই বিষ্ণু দেবাসুর জগৎকে সংহার করে থাকেন।
এই বিপুল মায়াকে অতিক্রম করা যায় সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় আত্মা, এই সকল জ্ঞানের দ্বারা জেনে. ব্রহ্মা, ঈশাণ সকল দেবতারা শক্তিমান হয়েছেন এই মায়ার অংশে অধিষ্ঠান করে। ইনি সর্বশক্তি ও সর্বজগৎ প্রসূতি। পদ্মালয়া, শঙ্খ, চক্র, পদ্ম, হস্তা, মাল্য শোভিতা, কোটি সূর্যদীপ্তা, কোন দেব তাঁর মায়া অতিক্রমে সমর্থ হন না।
বাসুদেবের কথা শুনে মুনিরা কালক্ষয়ের পরের ঘটনা জানতে চাইলেন। বিষ্ণু তখন বলতে শুরু করলেন–ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক এক বিখ্যাত দ্বিজবর যিনি পূর্বজন্মে রাজা ছিলেন। মহাদেব ও দেবতারাও তাকে পরাজিত করতে পারেননি। তিনি বিষ্ণুর স্মরণ নেন যখন জানতে পারেন সকল দেবতারা তাঁর শক্তিতে সংস্থিত। বিষ্ণু তাঁকে বলেন ব্রাহ্মণ রূপে জন্ম নিতে, ইন্দ্রদ্যুন্ম নিষ্পাপ তাই বিষ্ণু তাকে আদি গুহ্য তত্ত্ব প্রদান করবেন।
যা জেনে মৃত্যুর পর রাজা বিষ্ণুতে লীন হয়ে যাবেন। এরপর তিনি পৃথিবীতে বিষ্ণুর অন্য অংশে অবস্থিত হয়ে সুখে বাস করবেন। এরপর ইন্দ্রদ্যুম্ন কালধর্ম প্রাপ্ত হলেন, এরপর তিনি শ্বেতদ্বীপে বিষ্ণু ভক্তের যোগ্য দেব দুর্লভ বিবিধ সামগ্রী ভোগ করে পৃথিবী পালন করতে লাগলেন এবং ব্রাহ্মণ কুলে। জন্মগ্রহণ করলেন।
তিনি পরমেশ্বরের উপাসনা করতেন। ব্রত, উপবাস, নিয়ম, হোম এবং ব্রাহ্মণ সন্তুষ্টি বিধান করে, তিনি যোগীগণের অন্তরস্থিত মহাদেবের অর্চনা করতেন। পরমা কলা তাঁকে বিষ্ণু থেকে উদ্ভূত দিব্য আত্মরূপ প্রদর্শন করলেন। তিনি বিষ্ণু প্রিয়াকে বললেন–হে বিশালাক্ষ্মী, হে বিষ্ণু চিহ্নযুক্তা শুভময়ী দেবী আপনার প্রকৃত স্বরূপ বলুন। লক্ষ্মী তখন প্রিয় বিষ্ণুকে স্মরণ করে সহাস্যে ব্রাহ্মণকে বললেন– তিনি নারায়ণের সঙ্গে অভিন্না, তারই স্বরূপময়ী, পরমা মায়া। তাঁর সাথে নারায়ণের কোনো প্রভেদ নেই। তিনিই পরমব্রহ্ম ও পরমেশ্বর। তিনি তাদের ওপর প্রভুত্ব করেন না, যারা সংসারে জীবগণের আশ্রয় পুরুষোত্তমকে কর্মযোগ বা জ্ঞানযোগের পথে উপাসনা করেন। ইন্দ্রদ্যুম্ন এই কথা শুনে মাথা নত করে দেবীকে প্রণাম করে বললেন–সেই নিত্য নিষ্ফল, অচ্যুত ভগবান ঈশ্বরকে জানব কী উপায়ে? ব্রাহ্মণের কথায় দেবী বললেন। নারায়ণ স্বয়ং উপদেশ দেবেন। বিষ্ণুকে স্মরণ করবে। সেখান থেকে অদৃশ্য হলেন বিপ্রকে দু’হাতে স্পর্শ করে। ব্রাহ্মণ পরম সমাধি অবলম্বন করে বিষ্ণুর আরাধনা করতে লাগলেন।
জগন্ময় হরি দেখা দিলেন বহুকাল পরে ব্রাহ্মণের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে। তাকে দেখে ইন্দ্রদ্যুম্ন জানুতে বসে তার স্তব করতে লাগলেন। হে যজ্ঞেশ্বর অচ্যুত, গোবিন্দ, মাধব, অনন্ত, কেশব, বিষ্ণু, হৃষীকেশ ও জগতের আত্মা, বিশ্বমূর্তি সনাতন হরি সৃষ্টি, স্থিতি প্রলয়ের বার্তা, ত্রিগুণময়, অখণ্ড স্বরূপ, বিশ্বরূপ, বাসুদেব তুমি জগতের কারণ, তোমার আদি মধ্য ও অন্ত নেই।
তুমি জ্ঞান দ্বারা লব্ধ তোমার বিকার, মায়া, ভেদ ও অভেদ নেই। তুমি আনন্দ স্বরূপ, পরিত্রাতা, শান্ত, অপ্রতিহত আত্মা, অরূপ পরমার্থ, মায়ার অতীত, পরমাত্মা পরমেশ্বর, ব্রহ্মস্বরূপ, তানুতর, মহান দেবতা, মঙ্গলময়, পরযেষ্ঠী পুরুষোত্তম, সৃষ্টির মূল জীবের পরমগতি, সর্বভূতের পিতামাতা, পরমজ্যোতি, চিৎস্বরূপ, অখণ্ড আকাশ, সকলের আশ্রয়, অপ্রকাশ, অন্ধকারের পারাপার অনন্ত, যোগীর জ্ঞানদ্বীপ, পরম পদ রূপ তোমাকে প্রণাম, তুমি সকলের ও আমার আশ্রয়।
তখন স্তুতিকারী ইন্দ্রদ্যুম্নকে দুহাতে স্পর্শ করলেন ভগবান। এবং তাতে সে পরমতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করলেন।
এরপর তিনি হর্ষচিত্তে পীতবাস জনার্দনকে প্রণাম করে বললেন–হে পুরুষোত্তম, তোমার কৃপায় ও অনুগ্রহে আমি গন্ধরূপ জ্ঞান লাভ করেছি, যার একমাত্র বিষয় ব্রহ্ম, তুমি বিধাতা, বাসুদেব ও জগন্ময় আমার কর্তব্য বল।
তাঁর কথায় বিষ্ণু অল্প হেসে বললেন–যে পুরুষরা বর্ণাশ্রম ধর্ম পালন করেন, তারা জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগের পথ ধরে মহাদেবকে অর্চনা করবেন। এর কোন অন্যথা যেন না হয়, মোক্ষলাভকারী ব্যক্তি এই পরম তত্ত্ব জেনে ঈশ্বরের আরাধনা করবেন। মায়াময় জগৎকে মনে করে অদ্বিতীয় আত্মাকেই ধ্যান কর। তবেই সাক্ষাৎ পাবে পরমেশ্বরের। এরপর তিনি তিন ভাবনার কথা বললেন। প্রথমটি হলো তাঁর সম্বন্ধে ভাবনা, দ্বিতীয়টি ব্যক্তি সম্বন্ধে ও তৃতীয়টি ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে। যা সকল গুণের অতীত, জ্ঞানী ব্যক্তি যেকোন একটা ভাবনা অবলম্বন করে ধ্যান করবেন। সমস্ত প্রযত্নে এই বিষয়ে নিষ্ঠাবান হয়ে বিশ্বেশ্বরকে উপাসনা করলে মোক্ষলাভ হয়।
তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন জানতে চাইলেন–পরমতত্ত্ব কী, বিভূতিই কী, কার্য ও কারণ কী?
ভগবান উত্তরে বললেন, এক অবিকার্য ব্রহ্মই পরমতত্ত্ব। তিনি নিত্যানন্দময়, অন্ধকারের অতীত ও পরম জ্যোতিস্বরূপা। তার নিত্য বৈভবকে বিভূতি বলে। জগৎ তার কার্য এবং শুদ্ধ, অক্ষর, অব্যক্তই তার কারণ। তিনি সকল জীবের অন্তর্যামী, তাঁর ইচ্ছাবলে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় হয়। যথাযথ ভাবে তত্ত্ব জেনে শাশ্বত ব্রহ্মকে সম্যকভাবে যেন ইন্দ্রদ্যুম্ন উপাসনা করে। * ইন্দ্রদ্যুম্ন জানতে চাইলেন–পরমব্রহ্মর উপাসনা ও বর্ণাশ্রম ধর্ম কি প্রকার? তিন ভাবনার স্বরূপ কি? পুরাকালে এর সৃষ্টি বা ধ্বংস কিভাবে হয়। বংশ ও মন্বন্তর, কয়টি পবিত্র, ব্রত, তীর্থ সূর্য ইত্যাদি, গ্রহের সন্নিবেশ এবং পৃথিবীর দৈর্ঘ্য বা বিস্তার কী পরিমাণ? দ্বীপ সমুদ্র, পর্বত নদ-নদী–এ সবের সংখ্যা কত?
কূর্ম তখন জানালেন, তিনি অনুকম্পাবশত ভক্তদের কাছে সব কিছুর বর্ণনা দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণের প্রশ্নের উত্তরে তিনি সব ব্যাখ্যা করেন ও অনুগৃহীত করে সেই স্থান থেকে অন্তর্হিত হন। ভক্তি ভরে পবিত্র চিত্তে বিধান অনুসারে পরমেশ্বরের আরধনা করেছিলেন। পুত্রের প্রতি স্নেহ বিসর্জন দিয়ে, সকল স্কন্ধ থেকে নিযুক্ত হয়ে, পরিগ্রহ ত্যাগ করে সকল কর্মকে সমর্পণ করেছিলেন।
তিনি এভাবেই বৈরাগ্য আশ্রয় করেছিলেন। নিজের মধ্যে সকল জগৎকে অনুভব করে তার অক্ষর পূর্বিক ব্রহ্মবিষয়ক চরম উপলব্ধি হল, যার দ্বারা অদ্বিতীয় ব্রহ্মকে আস্বাদ করা যায়। আলস্য ত্যাগ করে কুম্ভক পূরক প্রভৃতি ক্রিয়ার দ্বারা শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর প্রভুত্ব লাভ করে যাঁর দর্শন পাবার জন্য ব্যাকুল হন।
আদিত্যের নির্দেশে মানস সরোবরের উত্তরে এক পর্বতে গমন করলেন যোগীন্দ্র। এক, অনুপম বিমানের আবির্ভাব হল যোগবিভূতির প্রভাবে। তার সূর্যসম দীপ্তি। পথের মাঝে যোগীন্দ্রকে দেখে অনুসরণ করলেন দেব, গন্ধর্ব, অপ্সরা সিদ্ধ আর ব্রহ্মর্ষিরা। এরপর যোগীন্দ্র দেববন্দিত এক স্থানে প্রবেশ করলেন। সেখান পরম পুরুষ স্বয়ং থাকেন। সেই স্থান উদ্ভাসিত অযুত সূর্যের জ্যোতিতে, তিনি দেব দুর্লভ অন্তভবনে প্রবেশ করলেন ও সর্বজীবের পরম আশ্রয় আদি অন্ত-হীন দেবদেব পিতামহকে ধ্যান করতে লাগলেন।
এক পরম অদ্ভুত জ্যোতির অবির্ভাব হল। বিপুল তেজঃরাশি স্বরূপ দেবতা। তাঁকে দেখতে পারেন না ব্রহ্মবিদ্বেষীরা। তার চার মুখ। তার শরীর অতি সুন্দর। তিনি প্রদীপ্ত প্রজ্বলিত অগ্নিশিখায়, দেবতার আলিঙ্গনে আবদ্ধ সেই দ্বিজবরের শরীর থেকে বিপুল জ্যোতি বেরিয়ে এসে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করল। এর নাম হল ঋক, যজুঃ ও সাম।
যা পবিত্র নিষ্কলুষ পাদস্বরূপ, যোগীদের আদি দ্বার হল যেখানে হব্য এবং ভব্য, সেবী হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্ম রয়েছেন সেই স্থান, তা দীপ্তিমান ব্ৰহ্ম তেজে। তা মনীষীদের আশ্রয়স্থল ও মনোরম শোভিত। ভগবান ব্রহ্মা ঐ তেজোময় মুনির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই দেখতে পেলেন সেই ঐশ্বরিক তেজকে শান্ত। সর্বগামী, কল্যাণময়, আত্মস্বরূপ, অক্ষয়, শূন্যময় বিষ্ণুর পরম পদবিদ্যমান, আনন্দময় স্থির যা পরমেশ্বরের ব্রহ্মস্থান।
তিনি সমস্ত জীবের মধ্যস্থিত আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরম ঐশ্বর্য লাভ করেন। আত্মার পরম মুক্তি রূপ অক্ষয়লোক গমন করেন। জ্ঞানী ব্যক্তি সমস্ত প্রযত্নের সঙ্গে বর্ণাশ্রম ধর্ম মেনে অন্তিম ভাবকে আশ্রয় করলে মায়ালক্ষ্মীকে অতিক্রম করতে পারবেন।
পাতালবাসী কূর্মরূপ দেব জনার্দন বিষ্ণু নারদ প্রমুখ মহর্ষিদের জিজ্ঞাসায় দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে সর্বোৎকৃষ্ট যে কূর্মপুরাণ বর্জন করেছিলেন। পুরাণ পাঠ করা ও শ্রবণ করা অতি গৌরবের বিষয়। এর দ্বারা কীর্তিলাভ হয়, মানুষের মুক্তি আসে। পুরাণের এক অধ্যায় বা উপাখ্যান শুনলেও সকল পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়, ব্রহ্মলোকে পূজো পাওয়া যায়। এই পুরাণ বলেছেন কূর্মরূপী দেবাদিদেব যাঁকে ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধা করা উচিত।
২
কূর্ম বললেন, আপনারা যা জিজ্ঞাসা করছেন তার বর্ণনা জগতের পক্ষে হিতকর, অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের ঘটনার দ্বারা এই পুরাণের ঘটনাবলী শ্রবণ মানুষের পক্ষে পুণ্যদায়ক। এতে মোক্ষ ও ধর্মের কথা বলা হয়েছে।
স্বয়ং নারায়ণ পুরাকালে বিপুল নিদ্রা অবলম্বন করে সর্পশয্যায় শয়ান ছিলেন। তিনি সৃষ্টির কথা চিন্তা করলেন রাত্রি শেষে জেগে উঠে, এতে পুলকিত হয়ে জন্ম নিলেন রৌদ্রময়, ক্রোধময়, শূলহস্ত, ত্রিনেত্র, সূর্যের মতো দীপ্তিমান দেব মহেশ্বর। তিনি জন্ম নিলেন ত্রিভুবন দগ্ধ করে। দেবী লক্ষ্মী রূপে জগৎ আলো করে আমার পাশে এসে বসলেন। পদ্মের মতো তার চোখ দুটি সুন্দর তার মায়ায় মুগ্ধ সকল জীব। এই দেবী সুপ্রসন্না, কল্যাণময়ী তার স্বর্গীয় রূপ, এই দেবী মহামায়া অক্ষয়রূপ নারায়ণী।
ব্রহ্মা তাকে দেখে বললেন, সকল জীবের মোহ সৃষ্টির জন্য আত্মস্বরূপিণী দেবীকে নিয়োগ করতে। তার এই বিশাল সৃষ্টির বিস্তার ঘটবে যদি মাধব তা করে তবে। এরপর দেবী লক্ষ্মীকে আদেশ দিলেন দেব অসুর মানব সহ সকল জগৎকে মোহিত করতে জগতের পত্তন ঘটাতে। কিন্তু ব্রাহ্মণদিগের দিকে দৃষ্টি দিও না। যোগকারী আপন ব্রাহ্মণদের বাদ দিও। মহাযজ্ঞকারী ব্রাহ্মণদের দিকে তাকাবে না।
স্পর্শ করো না জপ, হোম, বেদপাঠ আর পূজাদির দ্বারা মহেশ্বরের উপাসনাকারীদের, প্রভাবিত করবেনা, সেইসব মানুষেদের যারা ঈশ্বরে সমর্পিত,প্রাণাময় ক্রিয়া অভ্যাসকারী, রুদ্র নাম জপকারী, তাদের কোন পাপ নেই। তাদের ওপর মোহজাল বিস্তার করো না যারা স্বধর্মের সেবায় ও ঈশ্বরের আরাধনায় রত রয়েছেন।
মহামায়া লক্ষ্মী এভাবে তার নির্দেশমতো কাজ করলেন। ভগবৎ পত্নী লক্ষ্মীর পুজো করলে অতুল বৈভব, ভোগ সামগ্রী, মেধা, যশ ও ফল প্রদান করেন।
লোক পিতামহ ব্রহ্মা তাঁর আজ্ঞায় পূর্বের ন্যায় চরাচর প্রাণী সৃষ্টি করলেন। যোগ বলে জন্ম দিলেন মারীচি, ভৃগু, আঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, দক্ষ, অত্রি ও বশিষ্ঠের। ব্রাহ্মণদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সাধক মরীচি প্রমুখ। পিতামহ তার মুখ থেকে ব্রাহ্মণদের, কাঁধ থেকে ক্ষত্রিয়দের, ঊরু থেকে বৈশ্য ও পা থেকে শূদ্রদের সৃষ্টি করেছিলেন। শূদ্র ভিন্ন অন্য তিন বর্ণ ব্রহ্মার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল, এর জন্যই যজ্ঞ সম্পাদিত হতে পেরেছিল। ব্রহ্মা প্রথমে অনাদি, অনন্ত, বেদময়ী দিব্যবাণী সৃষ্টি করেছিলেন। সমস্ত প্রবৃত্তি উদ্ভূত হল তা থেকে। জ্ঞানী ব্যক্তিদের আসক্তি হয় না কারণ তার অনুশীলন করলে পাষণ্ডী করতে হয়। অনুষ্ঠান করতে হয় বেদজ্ঞ ঋষিরা পুরাকালে যা স্মরণ করেছিলেন। অন্য শাস্ত্রে মনোযোগী হওয়া উচিত নয়, বেদবহির্ভূত যে সকল স্মৃতি রয়েছে, যা কুতর্কপূর্ণ শাস্ত্র আছে, যা সবই পরকালে নিষ্ফল হয়। যা সব অন্ধকারে ভরা। পুরাকালে যে সকল প্রাণী জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাতে কোথাও কোন বাধা ছিল না। তাদের চিত্ত ছিল পবিত্র আর তারা স্বধর্মের অনুষ্ঠান করত। সে সবই পরকালে নিষ্ফল হয়।
পুরাকালে যে সকল প্রাণী জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের কোনও বাধা ছিল না। তাদের চিত্ত ছিল পবিত্র আর তারা স্বধর্মের অনুষ্ঠান করত, তাদের স্বধর্মের বাধাস্বরূপ আসক্তি দ্বেষ প্রভৃতি অধর্ম উৎপন্ন হল। অতি সহজ সিদ্ধি তারা লাভ করতে পারল না। অন্য একরকম এক সিদ্ধি লাভ হয়েছিল পরে সেই সিদ্ধি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে আবার কালক্রমে কর্মজনিত হস্তসিদ্ধির সৃষ্টি করে। সর্বব্যাপী ব্রহ্মা তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করে দেন। প্রজাপতির প্রত্যক্ষ মূর্তিরূপে যে ব্রাহ্মণদের ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছিলেন, সেই ভৃগু প্রমুখ ঋষিরা মনুর মুখ থেকে তা শুনে ধর্মের ব্যাখ্যা করলেন। নির্দিষ্ট হয়েছে ছয়টি কর্ম– যজন, যাজন, দান, পরিগ্রহ, অধ্যাপন ও অধ্যায়ন। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ধর্ম হিসেবে যদিও দান, অধ্যায়ন ও যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে, দণ্ডধারণ এবং যুদ্ধ ক্ষত্রিদের পক্ষে আর কৃষিকার্য বৈশ্যদের পক্ষে প্রশস্ত, শূদ্ররা ধর্মলাভ করবে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের সেবা করে। এছাড়া কারুশিল্প আর পাকযজ্ঞ প্রভৃতি কাজও তারা করতে পারে।
হে মুনিশ্রেষ্ঠগণ, অগ্নিরক্ষা, অতিথিসেবা, যজ্ঞ, দান ও দেবপূজা গৃহস্থের সাধারণ ধর্ম। বনবাসী বা বানপ্রস্থের ধর্ম–হোম, ফলমূল ভক্ষণ, বেদপাঠ, তপস্যা এবং বিধি অনুসারে, সংবিভাগ, ভিক্ষালব্ধ অন্ন ভক্ষণ, মৌনিত্ব, তপস্যা, ধ্যান, সম্যক জ্ঞান ও বৈরাগ্য, ভিক্ষুদান ধর্ম ভিক্ষাচারণ, গুরুর সেব করা, বেদ অধ্যায়ন সন্ধ্যাহ্নিক ও অগ্নিকার্য ব্রহ্মচারীদের ধর্ম। পদ্মসম্ভব ব্রহ্মা ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থী, ভিক্ষা। তিন আশ্ৰমাবলম্বীর সাধারণ ধর্মই ব্রহ্মচর্য। অন্য রমণীর সঙ্গে বর্জন করে, নিজের স্ত্রীর সঙ্গেই পর্বদিন ছাড়া অন্য দিন, ঋতুকালে সহবাস করতে হয়।
গৃহস্থের ব্রহ্মচর্য, গর্ভসঞ্চার না হওয়া পর্যন্ত এই রকম করার বিধান হয়েছে। এই কর্তব্য করতে হয় সাবধানে। তা না হলে স্পর্শ করে জ্বণ হত্যার পাপ। প্রত্যহ বেদাভ্যাস করা পরম ধর্ম, গৃহস্থের অতিথির সেবা ও দেবতার আরাধনা করা উচিত। অগ্নিতে কাষ্ঠ প্রদান করতে হয় প্রতিদিন সন্ধ্যায় ও প্রাতঃকালে। অন্য দেশে গৃহস্থ গেলে তার পুত্র, স্ত্রী অথবা ঋত্বিক এই কাজ করবে।
প্রধান তিন আশ্রমের মধ্যে গৃহস্থাশ্রম এটি বেশি উপজীব্য, বেদেও একেই শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। এটিই ধর্মসাধনের একমাত্র উপায়, পরিত্যাগ করা উচিত অর্থ ও কামহীন ধর্মকে। যে ধর্ম সর্বলোকের বিরুদ্ধে আচরণও করা উচিত না। ধর্মই ইঙ্গিত বস্তু দান করে আর ধর্মই মোক্ষের কারণ, ধর্ম, অর্থ, কাম– এই ত্রিবর্গই সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ তিন গুণ বলে কথিত হয়েছে। সত্ত্বগুণকে অবলম্বন করবেন যে, সকল পুরুষ, তারা গমন করেন ঊর্ধ্বলোকে।
রজোগুণকে আশ্রয় করেন যারা তারা মধ্যস্থানে ও তমোগুণের শরণকারীরা অধোদেশে পতিত হন। তিনি অর্থ ও কামকে ধর্মের সঙ্গে গ্রহণ করেন, তিনি ইহলোকে যেমন সুখী হন পরলোকেও আনন্দ লাভ করেন। অর্থ বাহ্যবস্তু দেয় ও ধর্ম থেকে মোক্ষ, অনন্ত সুখ প্রাপ্ত হন। যিনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের মাহাত্মের কথা জানেন ও তার অনুষ্ঠান করেন; তিনি অর্থ ও কাম ত্যাগ করে ধর্মকে আশ্রয় করবেন।
এই স্থাবর ও জঙ্গম চরাচরকে ধরে আছে ধর্মই। ধর্মই আদি, অনন্ত ব্রহ্ম শক্তি, জ্ঞানমূলক কর্মের দ্বারা ধর্মলাভ হয়। কর্মের অবলম্বন করবে জ্ঞানের সঙ্গেই। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিমূলক দুপ্রকার বৈদিক ধর্ম। নিবৃত্তিমূলক কর্ম হল জ্ঞানপূর্বক কর্ম। প্রবৃত্তিমূলক কর্ম এর বিরুদ্ধ সব কিছু। পরমলোক প্রাপ্ত হল যে নিবৃত্তিমূলক কর্মের আশ্রয়, নিবৃত্তিমূলক কর্মকে অবলম্বন না করলে সংসারে প্রবেশ করতে হয়।
চতুর্বর্ণের সাধারণ ধর্মগুলি–ক্ষমা, সংযম, দয়া, দান, লোভশূন্যতা, ত্যাগ, সারল্য, ঈর্ষামুক্তি, তীর্থ ভ্রমণ, সত্যকথন, সন্তোষ, অস্তিক্য, শ্রদ্ধা, ইন্দ্রিয়দমন, দেবপূজা, বিশেষত ব্রাহ্মণদের হিংসা না করা, প্রিয় কথা বলা, কপটাচার না করা ও নিষ্পাপ থাকা। পরলোক প্রজাপত্য স্থান রাখা আছে। যাগাদিক্রিয়া সম্পাদনকারী ব্রাহ্মণের জন্য। ঐ স্থান আছে যুদ্ধ বিমুখ ক্ষত্রিয়দের জন্য। মরুস্থান বৈশ্যদের জন্য।
গান্ধর্ব স্থান শূদ্রদের জন্য। উৰ্দ্ধরেতা ঋষি যে স্থানে গমন করেন, গুরুকুলবাসীদের জন্য রাখা সেই স্থান।
সপ্তর্ষিস্থান, মনু বানপ্রস্থদের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। প্রজাপত্য স্থান গৃহস্থদের জন্য সংযতাত্মা সর্বত্যাগী ঊৰ্দ্ধরেতা যোগীরা যেখানে গমন করে সেখানে একবার গেলে আর সংসারে ফিরে আসতে হয় না। পরম অক্ষয় ঐশ্বরিক আনন্দময় লোক লাভ করেন যোগীরা। যা সর্বোত্তম তাই পরমা গতি।
দৈত্যদলন হিরণ্যাক্ষরিপুকে চার আশ্রমের কথা বলা হল। আর পৃথক আশ্রমের কথা বলা হল যোগীদের জন্য কিন্তু এতে কি করে চার আশ্রম হল।
কূর্ম এর উত্তরে বললেন, ধ্রুব সমাধি আশ্রয় করেন সব কর্ম ত্যাগ করে। তিনি যোগী ও পঞ্চত্তমাশ্রমী সন্ন্যাসী বেদে বলা আছে আশ্রম দু’প্রকার। ব্রহ্মচারী দু’প্রকার উপকুলবান ও ব্রহ্মপরায়ণ নৈষ্ঠিক। উপকুলবান হলেন বেদ অধ্যায়ন করে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশকারী। নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী হলেন আমরণ ব্রহ্মচর্য পালনকারীর। এরাও উদাসীন ও সাধক এই দু’প্রকারের। সাধক হলেন আত্মীয় পরিজনদের পালনকারী।
উদাসীন হলেন ধন-সম্পত্তি, স্ত্রী ত্যাগকারী। তাপস বানপ্রস্থকারী হলেন অরণ্যে তপস্যাকারী, অধ্যয়নে নিরত ব্যক্তি। সন্ন্যাসিক বানপ্রস্থকারী হলেন যিনি তীব্র তপস্যায় শীর্ণকায় হয়ে ধ্যানে নিমগ্ন হন। পারমোষ্ঠিক ভিক্ষু হলেন জিতেন্দ্রিয় ও জ্ঞানমার্গ ধরে চলনকারী। যোগী ভিক্ষু হলেন তিনি যিনি আপনাতে আপনি থাকতে ভালোবাসেন, যিনি সদা সন্তুষ্ট, অভ্রান্ত যাঁর দর্শন। তিন প্রকার পারমেষ্ঠিক ভিক্ষু। এঁদের মধ্যে কেউ কর্ম, জ্ঞান, বেদ সন্ন্যাসী। অন্ত্যাশ্রমীরা ভাবনা করেন পরমেশ্বরের চার প্রকার আশ্রমের কথা বলা হয়েছে। বেদশাস্ত্রে পঞ্চম কোনো আশ্রম নেই।
বিশ্বাত্মা দেবদেব নিরঞ্জন স্বরূপ এইরকম বর্ণ ও আশ্রম সৃষ্টি করে দক্ষ প্রমুখ ঋষিদের বললেন, নানারকম জীবের জন্ম দিতে। এভাবে সৃষ্টিকার্যে নিযুক্ত হয়ে ব্রহ্মা বললেন, তিনি পালন করবেন ও সংহার করবেন শঙ্কর।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিব এই তিন হল পরমেশ্বরের রূপ, এই তিন মূর্তি–পরস্পরে অনুরক্ত, আশ্রিত, পরস্পরে প্রণত। রুদ্রের মধ্যে রয়েছে ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী ও অক্ষরা, দেব ব্রহ্মার মধ্যে রয়েছে দ্বিতীয় অক্ষর ভাবনা। স্বেচ্ছায় আত্মাকে বিভক্ত করে তিনি অবস্থান করছেন। দেব, অসুর ও মানব সমেত নিখিল জগৎ পরমাপুরুষ ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। মোক্ষরূপ পরম স্থান লাভ করতে চাইলে সমস্ত প্রযত্নের সঙ্গে এঁদের বন্দনা ও পূজা করতে হবে। ভক্তির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আজীবন পুজো করতে হবে বর্ণ ও ধর্মকে ভালোবেসে। দ্বিজগণের বলা চার আশ্রমের মধ্যে তিন প্রকার ভেদ করা যায়- বৈষ্ণবাশ্রম, ব্রহ্মাশ্রম ও হরাশ্রম।
নারায়ণের পরম পদে যিনি আশ্রয় নিয়েছেন তিনি সুগন্ধি জলের দ্বারা কপালে শূলচিহ্ন ধারণ করবেন। শিবের সমস্ত ভক্তরাই শম্ভর শ্রেষ্ঠ চিহ্ন ত্রিপুণ্ড্রক পবিত্র ভস্মের দ্বারা কপালে অঙ্কিত করবেন। যারা জগৎ কারণ পরলোকবাসী ব্রহ্মার শরণাগত তারা কপালে সর্বদা তিলকচিহ্ন ধারণ করবেন। এতে ধারণ করা হয়ে থাকে অনাদি কালাত্মাকেই উৰ্দ্ধ ও অধোভাবে যোগ থাকাই ত্রিপুণ্ড্রকের চিহ্ন।
কপালে ত্রিশূল চিহ্ন ধারণ করলে ত্রিগুণাত্মক ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবকেই ধারণ করা হয়। তিলক ধারণ করলে সেই ব্রহ্মাতেজোময়, ঐশ্বরিক উজ্জ্বল সূর্যমণ্ডলেই কৃত হয়ে থাকেন। আয়ু বৃদ্ধি হয় মঙ্গলময় তিলক ধারণ করলে, বর্ণ ও আশ্রমের নিয়ম জানা ব্যক্তি ইন্দ্রিয়কে দমন করে, শান্ত সংযত হয়ে, ক্রোধ ত্যাগ করে, পূজা ও হোম জপ করবেন। সারা জীবন সমাহিত চিহ্ন দেবতাদের পূজা করেন যিনি, অচিরেই অক্ষয় দেবস্থান লাভ করতে পারেন।
৩
ভগবানের চার বর্ণ ও আশ্রমের নিয়মগুলি যে ব্যক্তি জানেন, তিনি ইন্দ্রিয়কে দমন করে, শান্ত সংযত হয়ে, ক্রোধ ত্যাগ করে পুজো, হোম ও জপ করবেন। অচিরেই অক্ষয় সেই দেবস্থান লাভ করতে পারেন যারা সারা জীবন সমাহিত চিত্তে দেবতার পূজা করেন। কূর্ম বললেন–অনুকম্পার বশবর্তী হয়েই ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও যতি–যথাক্রমে এই চার আশ্রমের কথা বলেছি। অন্য কারণে নয়। বৈরাগ্য থাকলেই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করবেন। যথানিয়মে যজ্ঞ না করে, পুত্র উৎপাদন না করে, গৃহস্থাশ্রম অবলম্বন না করে বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণ কখনই সন্ন্যাস অবলম্বন করেন না।
ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠর বৈরাগ্যের তীব্রতা বেশি হলে তিনি আর গৃহে থাকতেই পারবেন না, তবে যজ্ঞ না করেই তিনি সন্ন্যাস অবলম্বন করবেন। বাইরে গিয়ে সন্ন্যাস অবলম্বন করবেন, অরণ্যে গমন করে বিধি যজ্ঞ করবেন এবং তপস্যা করে তপো ফলের দ্বারা বৈরাগ্যমুক্ত হবেন। বানপ্রস্থে একবার গমন করলে গৃহে আর ফেরা যায় না। জ্ঞানী গৃহাশ্রমী ব্রাহ্মণ বেদের বিধান অনুসারে প্রজাপত্য অথবা আগ্নেয় যজ্ঞ সম্পাদন করে অরণ্যকে আশ্রয় করবেন, ও প্রজ্যা গ্রহণ করবেন। অন্ধ, পঙ্গু বা দরিদ্র ব্রাহ্মণ প্রবজ্যা গ্রহণ করতে না পারলে হোম ও যজ্ঞ করবেন। তবে সংসারে আসক্তি না থাকলে সন্ন্যাস গ্রহণ করা উচিত। সন্ন্যাস গ্রহণ করা কর্তব্য বৈরাগ্য উপস্থিত হলে। বৈরাগ্য বিনা সন্ন্যাস গ্রহণ করলে পতিত হতে হয়।
মুক্তিলাভ ঘটে তার যে সারাজীবন একটি আশ্রমকে শ্রদ্ধার সাথে অবলম্বন করে থাকে। ন্যায়সঙ্গত উপায়ে ধন উপার্জন করেন ও সংযত ও ব্রহ্মবিদ্যাপরায়ণ হয়ে নিত্য স্বধর্ম প্রতিপালন করেন, তিনি ব্রহ্মলাভ করতে পারেন। পরমপদ লাভের অধিকারী হন তিনি যিনি ব্রাহ্ম সব সমর্পণ করে কামনা বাসনা ত্যাগ করেন। ব্রহ্মতেই সব সমর্পিত এবং তিনিই সব দেন এই চিন্তা করাকে বলে ব্রহ্মপর্ণ। নিত্য ভগবান তুষ্ট হন তত্ত্বদর্শী কর্মের দ্বারা। পরমেশ্বরকে যদি সমস্ত কর্মের ফল উৎসর্গ করা যায়, তাহলে হয় উৎকৃষ্ট ব্রহ্মপর্ণ। মুক্তি প্রদান করে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি যখন কোন কর্মকে কর্তব্য মনে করে কর্ম সম্পাদন করেন তখন সেই ব্যক্তি সর্বতোভাবে কর্ম ত্যাগ করে কর্ম করবেন।
তাহলে বিলম্ব হলেও ব্রহ্মপদ লাভ করতে পারবেন। ইহজন্ম ও পূর্বজন্মের পাপকে ক্ষয় করে কর্ম। এতে মানুষের ব্ৰহ্ম ও জ্ঞান লাভ করে মন প্রসন্ন হয়। কর্ম জ্ঞানের সঙ্গে সম্পাদন করলে সম্যক যোগ উৎপন্ন হয়। দোষ স্পর্শ করে না কর্ম সঞ্চিত জ্ঞানকে। এই সকল প্রযত্নের সঙ্গে যে কোন আশ্রমকে আশ্রয় করে ঈশ্বরের প্রতি উৎপাদনের জন্য কর্ম করবেন এবং নিষ্কর্মর্তা অবলম্বন করবেন। পরম জ্ঞান এবং নৈষ্কর্ম লাভ করে পরমেশ্বরের অনুগ্রহে যদি কেউ একাকী সমত্বশূন্য ও সংযত হয়ে থাকেন তাহলে জীবিত অবস্থাতেই তাঁর মুক্তি লাভ হয়। সদানন্দ, আভাস শূন্য আর নির্মল বুদ্ধি হয়ে সর্বদা পরমেশ্বরের তৃপ্তির জন্য কর্মের অনুষ্ঠান করলে পরমব্রহ্মে বিলীন হওয়া যায়। তবেই লাভ হয় নিত্যপদ।
এই চার আশ্রমের ধর্ম অতিক্ৰমনা করলে মানুষ সিদ্ধিলাভ করতে পারে না।
৪
সূত বললেন, ঋষিরা সকল আশ্রম বিধির বিবরণ শুনে সন্তুষ্ট হয়ে হৃষীকেশকে নমস্কার পূর্বক সকল আশ্রম ধর্ম পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করতে অনুরোধ করলেন। কি করে জগৎ সৃষ্টি হল এ বিষয়ে শুনতে উৎসুক হলেন সকলে।
কূর্মরূপধারী নারায়ণ সারগর্ভ বাক্যে জীবগণের উৎপত্তি ও বিনয়ের তত্ত্ব বলতে শুরু করলেন। সর্বশক্তিমান ও মহান ঈশ্বরই সকলের নিয়ন্তা। তাঁর অন্ত ও পরিমাপ নেই। তিনি নিত্য ও অব্যক্ত। কারণ দার্শনিকদের মতে তিনি প্রকৃতি তিনিই পুরুষ। জগতের কারণ এই ব্রহ্ম বিপুল, সনাতন। পরব্রহ্ম সর্বজীবের শরীর। তিনি মহৎ আত্মাতে অধিষ্ঠিত তার আদি ও অন্ত নেই, জন্ম নেই, তিনি সূক্ষ্ম ও তার তিনটি গুণ রয়েছে। তিনি সবকিছুর উৎস। তিনি অব্যয় আর অসমপ্রত এই ব্রহ্মকে জানা যায় না।
প্রকৃত প্রলয় ঘটবে যখন আত্মা পুরুষে গুণ-সাম্য হবে। এই স্থিতি সৃষ্টির প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত। একে ব্রাহ্মী রাত্রি বলে। এই ব্রহ্মের দিন রাত্রি নেই। রাত্রি শেষে পরমেশ্বর জাগরিত হোন। মহেশ্বর পরম পরমেশ্বর প্রকৃতি এবং পুরুষের মধ্যে প্রবেশ করে তাদের বিক্ষোভিত করেন। যেমন কামাবেশ ঘটে তরুণী নারীর মধ্যে, যেমন বসন্তকাল এলে মলয় বাতাস বইতে থাকে, সেরকম ভাবে সেই যোগমূর্তি ব্রহ্ম প্রকৃতি ও পুরুষকে আলোড়িত করার জন্য তাদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হন। পরমপুরুষ প্রলয় ও সৃষ্টির দ্বারা প্রধান হয়ে অবস্থান করেন। তাঁর ক্ষুব্ধ হওয়ার ফলেই মহাবীজের সৃষ্টি হয়েছিল। যার থেকে উৎপন্ন হয়েছিল মহান, আত্মা, মতি, ব্রহ্মা প্রবুদ্ধি খ্যাতি, ঈশ্বর, প্রজ্ঞা, ধৃতি, স্মৃতি ও সংবিৎ। তিন প্রকার অহংকার আবির্ভূত হয়–বৈকারিক, তৈজস আর তামস। অহংকার সৃষ্টির কারণ তামস, আর অভিমান ও মননের বার্তা পরমাত্মা ও জীবাত্মা অহংকার।
অহংকার থেকে জন্ম নেয় পাঁচ ভূত, পাঁচ তন্মাত্র, ইন্দ্রিয় ও দেবতাদের মন উৎপন্ন হয় অব্যক্ত থেকে। যা সকলের কর্তা ও পর্যবেক্ষণকারী, বৈকারিক সৃষ্টি হয়, তেজস অহংকার থেকে, ইন্দ্রিয় সমূহের জন্ম। ইন্দ্রিয়গুলির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা উৎপন্ন হয় বৈকারক থেকে। উভয়াত্মক একাদশ মন উৎপন্ন হয় স্বকীয় গুণের দ্বারা। ভূত তন্মাত্রের সৃষ্টি হয়েছে ভূতাদি থেকে। শব্দমাত্রের জন্ম দিয়েছে ভূতাদি বিকারপ্রাপ্ত হয়ে। শূন্যময় আকাশের সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে। আকাশ সৃষ্টি করেছে স্পর্শ মাত্রকে। তার থেকে বায়ু তার গুণ স্পর্শ। বায়ু থেকে রূপ তন্মাত্র সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে জ্যোতিঃ যার গুণ রূপ রসতন্মাত্রকে সৃষ্টি করেছে জ্যোতিঃ আর রসের আধার তার থেকে উৎপন্ন জল। জল গন্ধ তন্মাত্রকে সৃষ্টি করেছে। আর সনাতনী পৃথিবী জন্ম নিয়েছে এর থেকেই। গন্ধ। হল পৃথিবীর গুণ।
স্পর্শমাত্রকে আবৃত করে আছে শব্দ মাত্র আকাশ, শব্দ ও স্পর্শ দুটি গুণ যুক্ত বায়ু তার দ্বারা সৃষ্ট। আবার শব্দ ও স্পর্শ এই দুই গুণ-ই রূপে অন্তর্ভুত হয় বলে, শব্দ, স্পর্শ ও রূপ, এই তিনটি গুণ-ই বহ্নির রয়েছে। এই তিন গুণ-ই আবার রসমাত্র প্রবেশ করে বলে রসস্বভাব জলের গুণ চারটি। পৃথিবীর গুণ পাঁচটি, পৃথিবীকে ভূতলের মধ্যে স্থলা নামে চিহ্নিত করা হয়। শান্ত, ঘোর, মূঢ় এবং বিশেষ নামে উক্ত এবং পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে পরস্পরকে ধারণ করে থাকে।
সাত মহাত্মা সমবেত না হলে পরস্পরকে ধারণ করে থাকে। এর সমবেত না হলে, পরস্পরের আধারে জীব সৃষ্টি করতে পারেন না। পুরুষ অধিষ্ঠিত রয়েছেন বলেই অব্যক্তের অনুগ্রহে মহৎ থেকে শুরু করে বিশেষ পর্যন্ত সকলে অন্ত সৃষ্টি করে। বিশেষ থেকে উৎপন্ন জলবুদ্বুদের সঙ্গে একই সময়ে জলে ভাসমান বৃহৎ অন্ত জন্ম নিয়েছিল। প্রাকৃত অন্ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে ব্রহ্মার কার্যের কারণ তার মধ্যে স্বয়ংসিদ্ধ হল। ক্ষেত্রজ্ঞ ব্রহ্মা নাম হল এর। একে প্রথম পুরুষ বলা হয় ইনি প্রথম শরীরধারী বলে সৃষ্টির প্রথমে বর্তমান ছিলেন। জীবগণের আদি স্রষ্টা ব্রহ্মা। একেই পুরুষ, হংস, প্রধানের পরিস্থিতি, হিরণ্যগর্ভ কপিল, দুন্দুভিমূর্তি ও সনাতন বলা হয়। উল্বের সেই পরমাত্মাস্বরূপের সুমের পর্বতগুলি জরায়ুর আর সমুদ্রগুলি গর্ভোদিকের কাজ করেছিল।
বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল সেই অণ্ডে–দেব, অসুর, মানব, চন্দ্র, সূর্য নক্ষত্র, গ্রহ ও বায়ু। অণ্ডের বহির্দেশ আকৃত হয়েছিল দশ গুণ জল। দশ গুণ তেজ, আবার জলের বহির্ভাগকে আবৃত করেছিল দশ গুণ বায়ু তেজের বহির্ভাগকে আবৃত করেছিল। দশগুণ আকাশ বায়ুকে, আকাশকে ভূতাদি, মহৎ ভূতাদিকে এবং অব্যক্ত মহৎকে আবৃত করেছিল। এই সেই লোক যেখানে মহাত্মাগণ আর তত্ত্বদশী পুরুষগণ আপনাতে আপনি যাবেন। তারা প্রভু, যোগধর্ম আর তত্ত্বচিত্তকে, রাজোগুণ নেই তাদের তারা সবাই আনন্দিত।
অণ্ড আবৃত এই প্রাকৃত সাত আবরণে। ভগবানের মায়াকে সহজে জানা যায় না। বীজ প্রধানের কার্য, প্রজাপতির পরমা মূর্তি। স্রষ্টার দ্বিতীয় শরীর সাতলোক বলযুক্ত ব্রহ্মাণ্ড। সুবর্ণ অণ্ড থেকে জাত হিরণ্যগর্ভ ভগবান ব্রহ্মাই ভগবানের তৃতীয় রূপ–এ বেদার্থ দর্শীরা বলে থাকেন। সেই সর্বব্যাপী সত্তার রাজোগুণের আর এক চতুর্মুখ মূর্তি আছে, যিনি জগতের সৃষ্টি কার্যে ব্যাপৃত।
বিশ্বের আত্মা সর্বতোমুখ ভুবনেশ্বর বিষ্ণু স্বয়ং সত্ত্বগুণ যুক্ত হয়ে সৃষ্ট জগৎ পালন করেন। ও প্রলয় কালে সকলের আত্মা ভূত পরমেশ্বর রুদ্রদেব স্বয়ং তমোগুণ আশ্রয় করে জগৎ সংহার করেন। নির্গুন এবং নিরঞ্জন মহাদেব পাল ও সংহাররূপ কর্মদ্বারা তিনটি মুর্তিতে প্রকাশিত। গুণ–ভেদে তার মূর্তি ভেদ আছে। যোগাধীশ ভগবান স্বকীয় লীলার দ্বারা নানা রকম রূপ ও শরীর ধারণ করেন। কখনো শরীরকে বিকৃত করেন। আবার শরীরকে গ্রাসও করেন। তিনি অদ্বিতীয় বলে কথিত হন ত্রিজগতে।
প্রথমে প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন ব্রহ্মা, তিনি আদিদেব, জন্মহীন বলে তিনি অজ। প্রজাপালন হেতু তিনি প্রজাপতি। তিনি মহাদেব বৃহৎ বলে ব্রহ্মা, সকলের পর বলে পরমেশ্বর, বশীভূত হন না বলে তিনি বিশ্রুত।
সর্বগমনকারী বলে ঋষি, সংহারক বলে হরি, উৎপত্তি হীন বলে স্বয়ম্ভু, নরগণের অয়ন বা আশ্রয় বলে নারায়ণ, সর্বজ্ঞাত বলে ভগবান, জ্ঞানের গোচর বলে সর্বজ্ঞ, সবেতে অনুসৃত বলে সর্ব। নির্মল বলে শিব। আর্তিনাশক বলে তারক, সমগ্র জগত ব্রহ্মময় নানা মূর্তি ধারণ করে পরমেশ্বর লীলা করেন।
৫
কূর্ম বললেন, বহু কর্মের দ্বারাও স্বায়ম্ভুব মনুর কাল গণনা করা যায় না। দুটি পরার্ধে পরিকল্পিত সমগ্র কালের সংখ্যা, যা পরকাল। স্বায়ম্ভুব মনুর একশো বছর আয়ু। পনেরো নিমেষে হয় এক কাষ্ঠা, ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মুহূর্ত, ত্রিশ মুহূর্তে মানুষের একটি অহোরাত্র, ত্রিশ অহোরাত্রে দুই পক্ষ বিশিষ্ট মাস আর ছয় মাসে একটি অয়ন। অয়ন আবার দক্ষিণায়ন ও আর উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন দেবতাদের রাত্রি, উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন। বারো হাজার বছর সত্য দিব্য পরিমাণের দ্বারা চারটি যুগ হয়।
সত্যযুগ চার হাজার বছরে, চারশো বছরে সন্ধ্যাংশ ও সত্যযুগের সন্ধ্যা, তিনশো, দুশো এবং একশো বছরে হয় ত্রেতা প্রভৃতি যুগের সন্ধ্যা। সত্যযুগের সন্ধ্যাংশ ছাড়াও সন্ধ্যাংশ কাল ছয়শো। ত্রেতা দ্বাপর, কলিকাল হচ্ছে যথাক্রমে তিন, দুই ও এক হাজার বছর, সর্বমোট বারো হাজার বছর। মন্বন্তর হয় সত্তর গুণের কিছু বেশি কাল। চৌদ্দটি মন্বন্তরের সমান ব্রহ্মার একটি দিন। মনুই আদি স্বয়ম্ভুত্ব। সাবনিক প্রমুখ তার পরে। পর্বতাযুক্তা সপ্তদ্বীপ পৃথিবীকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ পূর্ণ সহস্র যুগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত করবেন। এ বিষয়ে সংশয় নেই। একটি মন্বন্তর কল্পে সকল অন্তর ব্যাঘাত হল।
এক কল্পে ব্রহ্মার এক রাত্রি ও দিন। চার হাজার যুগে হয় এক কল্প। কল্পজ্ঞ ব্যক্তিরা বলে তিনশো ষাট কল্পে ব্রহ্মার এক বছর হয়। পরার্ধ বলা যায় সেই পরিমাণ কালের একশো গুণ কালকে। সকল জীবের স্বকীয় উৎপত্তির কারণ প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। ব্রহ্মা বিষ্ণু–শিব তিনের প্রকৃতিতে লয় হয়। ব্রহ্মা সমস্ত ভূত, বাসুদেব, শঙ্কর সকলেই কালক্রমে সৃষ্টি ও সংহারে বশীভূত হয়ে থাকেন। ভগবান অনাদি, অনন্ত অজর, অমর, কাল সর্বত্রগামী, স্বতন্ত্র এবং সকলের আত্মস্বরূপ। তাই তিনি মহেশ্বর। বেদে বলা আছে পরমেশ্বর কালই বহু ব্রহ্মা, বহু রুদ্র ও বহু নারায়ণ রূপে প্রকাশিত হন, ব্রহ্মার দ্বিতীয় পরার্ধ তার অগ্রজ কল্প। পণ্ডিতরা পাদ্মকল্প বলেন অতীত হওয়াকে।
৬
এক সময় এ সবই ছিল বিপুল সমুদ্র। যা ঢাকা ছিল অন্ধকারে। অস্তিত্ব ছিল না বায়ুরও। পরে এই সমুদ্রের অবিচ্ছিন্নতা নাশ পেলে স্থাবর জঙ্গমাত্মক জগতে জন্ম নিলেন সহস্র নেত্র ও সহস্রপাদ ব্রহ্মা। তার স্বর্ণ বর্ণ, সহস্র মাথা, সেই অতীন্দ্রিয় পুরুষ নারায়ণাখ্য ব্রহ্মা জলরাশিতে শয়ান ছিলেন। জগতের সৃষ্টি ও লয়ের বার্তা ব্রহ্মারূপী নারায়ণ সম্বন্ধে শ্লোকে বলা হয়ে থাকে।
“তপোনারা ইতি
থোক্তা আপো
বৈ নরসূনবঃ
অয়নং তস্য তা যস্মাৎ তেন
নারায়ণঃ স্মৃতিঃ”
নারা নামে খ্যাত অপ বা জল তার অয়ন বা আশ্রয়–
সহস্ৰযুগে নৈশকাল ভোগ করার পর রাত্রি শেষে সৃষ্টির জন্যে ব্রহ্মত্ব লাভ করলেন। পৃথিবী যখন জলমধ্যে নিমগ্ন, তখন তার উদ্ধার সাধনের জন্য প্রস্তুত হলেন। তিনি বরাহ রূপ ধরলেন। বরাহের রূপ জলক্রীড়ায় মনোরম। এর বাঙময় রূপ এর নাম ব্রহ্মা। পৃথিবীর উদ্ধারের জন্য পাতালে প্রবেশ করে দণ্ড দ্বারা ধারিত্রীকে উদ্ধার করলেন। জনলোক স্থিত সিদ্ধ ও ব্রহ্মার্ষিগণ বিশ্রুতকীর্তি হরিকে স্তব করতে লাগলেন– দেবদেব, ব্রাহ্মণ, শশ্বত, অজরকে প্রণাম, স্বয়ম্ভু, সৃষ্টিকর্তা সব তুমি জানো। পঞ্চভূত, মূলপ্রকৃতি, মায়ারূপ, সঙ্কৰ্ষণ, তিন মূর্তি, তিন ধাম, দিব্য তেজা সিদ্ধের আরাধ্য, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, শরণ, তুমিই গতি।
সনক প্রমুখ ঋষিরা প্রভাতে স্তব করলে বিষ্ণু তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করলেন। পৃথিবীকে তিনি সুসামঞ্জস্য ভাবে স্থাপন করলেন ও পূর্বে সৃষ্টির সময়ে যে সমস্ত পর্বত দগ্ধ হয়েছিল, এরপর তিনি মন দিলেন সৃষ্টির কার্যে।
৭
কূর্ম বললেন, তিনি পূর্বকল্পের মতো সৃষ্টি চিন্তা করলে এমন এক অন্ধকারময় সৃষ্টি প্রাদুর্ভূত হল যাকে জানাই যায় না। তম, মোহ, মহামোহ, তামিস্র ও অন্ধতমিস্র এই পাঁচ অবিদ্যা জন্ম নিল সেই মহাত্মা থেকে। সেই অভিমানী পুরুষ ধ্যান করলে অন্ধকারাবৃত বীজকুম্ভের মতো আচ্ছাদিত সৃষ্টি পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। তার বহি ও অভ্যন্তর ভাগে প্রকাশ ছিল না। ছিল শুদ্ধ ও নিঃসঙ্গতার মধ্যে মুখ্য বৃক্ষ ও পর্বত। যখন প্রভু দেখলেন যে এই সৃষ্টি কার্য সাধনের উপকারক নয়, তখন তিনি অন্য সৃষ্টির কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
এর ফলে বয়ে যেতে লাগল আকাবাঁকা স্রোত। একে বলে তির্যক স্রোত। হে দ্বিজগণ, এই সৃষ্টি উৎপথগ্রাহী পশ্যাদি নামে খ্যাতি লাভ করেছে। এই সৃষ্টিতে সুখ আর প্রীতির অভাব নেই। এই সৃষ্টির নাম হল দেব। সত্যচিন্তক ভগবান যখন ধ্যান করলেন তখন সৃষ্টি অধাক স্রোত, সাধক সর্গ। তমোগুণের উদ্ভব হয়েছে। রজোগুণে রয়েছে বহুল পরিমাণে, আর দুঃখ প্রকাশিত হয়েছে উকট ভাবে। আর তাতেই রয়েছে সত্বগুণও যার নাম মানুষ। ভূতাদি সর্গের উদ্ভব হল আজ যখন সৃষ্টির কথা চিন্তা করল তখন সর্বদা বস্তুসমূহ সবলে হরণ করে ভূতগণ নিজেদের মধ্যে বিভেদ করে, তাদের শীল বলে কিছু নেই।
যে পাঁচ সর্গের কথা বলা হল তার মধ্যে প্রথম সর্গটি মহতের। দ্বিতীয়টি ভূতসর্গ। বৈকারিক ঐন্দ্রিয় তৃতীয় সর্গের নাম। প্রাকৃত সর্গ এই অবুদ্ধিপূর্বক সস্তৃত হয়েছে। চতুর্থটি মুখ্যসর্গ যার নাম স্থাবর। যা তির্যক স্রোত ও তির্যক যোনি, পঞ্চম সর্গ, ষষ্ঠ দেবসর্গ নামে উক্ত উর্ধ্বস্রোত, যেটি অবাক স্রোত, সেটি সপ্তম মানুষ সর্গ এবং অষ্টম ভূতাদি হল ভৌতিক সর্গ। নবমটি কৌমার সর্গ যা প্রাকৃত ও বৈকৃত দুপ্রকার, প্রথম তিন প্রসকৃত সর্গ অবুদ্ধি পূর্বক সৃষ্টি হয়েছে। মুখ্য সৃষ্টিগুলি অবুদ্ধি পূর্বক কৃত হয়েছে।
প্রজাপতি ব্রহ্মা পুরাকালে নিজের তুল্য প্রভাবশালী সনক, সনাতন, সনন্দনভা ক্রতু, ও সনৎকুমারকে সৃষ্টি করেছিলেন। বিপ্রগণ পাঁচজনেই যোগী। পরম বৈরাগ্য আশ্রয় করে এঁরা ঈশ্বরেই মনোনিবেশ করলেন। মন দিলেন না সৃষ্টির দিকে। প্রজাপতি পরমেষ্ঠীর মায়ার মোহিত হলেন জগৎ সৃষ্টির বিষয়ে ঔদাসীন্য দেখালেন। জগন্ময় মহামুনি মহাযোগী লোকপ্রিয় নারায়ণ তাকে যথাযথ ভাবে সান্ত্বনা দিলেন। তার উপদেশে বিশ্বাত্মা ব্রহ্মা পরম তপস্যায় নিরত হলেন, কিন্তু কোন ফল লাভ হল না। দীর্ঘকাল কাটার পর চিত্তে ক্রোধ এল ফলে চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ল। ললাট থেকে তখন জন্ম নিলেন শরণাগতের ত্রাণকারী নীললোহিত মহাদেব। সনাতন ঈশ হলেন ভগবান। নিজের মধ্যে পরমেশ্বর রূপে প্রত্যক্ষ করেন জ্ঞানী ব্যক্তিরা। ব্রহ্মা ওঁঙ্কারকে স্মরণ করে প্রজা সৃষ্টি করতে যান বনে। শিব তখন মনে মনে রুদ্রগণকে সৃষ্টি করলেন। তারা হলেন শ্মশ্রুময়, নিরাতঙ্ক, ত্রিনয়ন আর নীললোহিত। ব্রহ্মা তাকে বললেন, জরা মরণশীল জীব সৃষ্টি করুন। ভগবান বললেন, জগৎপতি, জরা মরণশীল অমঙ্গলময় জীব সৃষ্টি করতে পারব না। রুদ্রকে নিষেধ করে পদ্মসম্ভব ব্রহ্মা স্থানাভিমানী ও বাক্য কথনশীল যে, সত্তা সমূহের সৃষ্টি করলেন তাদের কথা শোন।
প্রথমে সৃষ্টি করলেন অগ্নি, অন্তরীক্ষ, স্বর্গ, নদী, সমুদ্র, পর্বত, কালা, কাষ্ঠা, বৎসর, যুগ এবং স্থানাভিমানী পদার্থগুলিকে। তারপর মরীচি, ভৃগু, পুলস্ত্য, পুলহ, দক্ষ, অত্রি, বশিষ্ঠ, ধর্ম, সঙ্কল্প সাধকদের সৃষ্টি করলেন। প্রাণ থেকে দক্ষকে, নেত্রদ্বয় থেকে মরীচিকে, মস্তক থেকে অঙ্গিরাকে, হৃদয় থেকে ভৃগুকে, নেত্র থেকে অত্রিকে। ব্যবসায় থেকে ধর্মকে, সঙ্কল্প থেকে সঙ্কল্পকে, উদান থেকে পুলস্ত্যকে, ব্যান থেকে পুলহকে, সমান থেকে বশিষ্ঠকে সৃষ্টি করেছিলেন ব্রহ্মা। এঁরা ধর্ম প্রবর্তন করেছেন মানুষের রূপ ধরে।
দেব অসুর, পিতৃ ও মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন। আত্মা যোজিত করলে তিনি তাতে তমোগুণের আবির্ভাব হয়েছিল মুক্ত প্রজাপতির মধ্যে, অসুর জন্মায় তার জঘন দেশ থেকে। পুরুষোত্তম অসুর সৃষ্টি করে যে শরীর তা পরিত্যাগ করলেন, সেই পরিত্যাক্ত শরীর তৎক্ষণাৎ রাত্রিতে পরিণত হল। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রিতে জীব ঘন নিদ্রা যায়। সত্ত্বগুণ রয়েছে এমন শরীর ধারণ করলেন প্রজাপতি। দেবগণ জন্ম নিলেন উজ্জ্বল মুখ থেকে। সত্ত্বগুণ দিন সৃষ্টি হল কার থেকে? ধর্মযুক্ত দেবতারা উপাসিত হন দিবাকালে। এরপর তিনি কেবলসত্ত্বগুণ যুক্ত আর এক শরীর ধারণ করলেন।
মাননীয় পিতৃগণ উৎপন্ন হলেন পিতৃবৎ থেকে। ব্রহ্মা শরীর ত্যাগ করলেন। বিশ্বদর্শী পিতৃগণকে সৃষ্টি করে, তৎক্ষণাৎ সন্ধ্যাতে পরিণত হল পরিত্যক্ত শরীর। দেবতাদের দিন ও রাত্রি অসুরদের। তাই দেব, অসুর, সকল মুনি, ও মানবগণ, যোগের সাহায্যে সেই রাত্রি ও দিনের মধ্যে শরীর রূপ সন্ধ্যার সময় উপাসনা করেন। একটি শরীর ধারণ করলেন রজোগুণ বিশিষ্ট প্রজাপতি, শীঘ্র সে শরীরও পরিত্যাগ করলেন।
জ্যোৎস্নাতে পরিণত হল তৎক্ষণাৎ। প্রাতঃ সন্ধ্যা বলা হয় একে। এরপর ভগবান ব্রহ্মা আবার তমোগুণ ও রজোগুণ বিশিষ্ট মূর্তি গ্রহণ করলেন। তা থেকে যে রাক্ষসরা জন্ম নিল তাদের ক্ষুধার উদ্রেক হয় অন্ধকারে। এদের মধ্যে তমোগুণ আর রজোগুণেরই প্রাধান্য। এরা বলশালী আর নিশাচর পুত্র। ব্রহ্মার এরপর জন্ম নিল তমোগুণ আচ্ছন্ন সর্ব, যক্ষ, ভূত ও গন্ধর্বেরা।
প্রভু এরপর সৃষ্টি করলেন পক্ষী, অবি, তাজা, গোল, অশ্ব, গর্দভ, মৃগ, উষ্ট্র, অশ্বতর ও মৃগ। রোম থেকে উৎপন্ন হল ওষধি ও ফলমূল। তার প্রথম মুখ থেকে গায়ত্রী ও অগ্নিস্ত্রোত্রের সৃষ্টি হল। দক্ষিণ ও পশ্চিম মুখ থেকে ত্রিষ্ঠুভ দুন্দ, পঞ্চদশ স্তোত্র, উপমা, সামসকল, জপতী ছন্দ, বৈরূপ ও অতিরাত্র, উত্তর মুখ থেকে সৃষ্টি হল অপ্তোমাস, অনুষ্ঠুভ এবং বৈরাগ ছন্দ।
সৃষ্টির পূর্বের কাজের মতই বারবার সৃষ্ট হয়েও সকল জীব তাদের করণীয় কাজই পেল। এর ফলে তারা বিভিন্ন রিপুর অধীন হয়। যা তাদের কাছে রুচিকর। বিধাতা মহাভূত রূপে নানা মুর্তি ধারণ করে ভূতগণকে নিয়োগ করেন।
৮
এভাবেই সৃষ্ট হল স্থাবর ও জঙ্গম জীব। এই জীবেদের বুদ্ধি না হওয়ায় ব্রহ্মা দুঃখিত হলেন। নিশ্চিত উদ্দেশ্য সাধনের উপযুক্ত বুদ্ধি অবলম্বন করলেন। তখন তিনি সত্ত্ব ও রজোগুণকে অবলম্বন করে তমোগুণকে পরিত্যাগ করলেন। তমঃ ক্ষয় পেলে একটি মিথুন উৎপন্ন হল-অধর্মাচরণ আর হিংসা। ব্রহ্মা তাঁর দেহকে ভাগ করে অর্ধনারীশ্বরের উৎপত্তি করলেন। যার নাম শতরূপা। তিনি সৃষ্ট হয়েই আকাশ ব্যাপ্ত করলেন। সেই সর্বগুণসম্পন্না আর অধর্মের থেকে জন্ম নিলেন বিরাট পুত্র। দেবী শতরূপা দুরূহ তপস্যা করে বিশ্রুতকীর্তি মনুকে স্বামী রূপে লাভ করলেন।
শতরূপার দুই পুত্র হল মনুর ঔরসে, নাম তাদের প্রিয়ব্রত ও জ্ঞানপাদ। তার দুই কন্যার মধ্যে প্রসূতিকে দিলেন দক্ষকে আর রুচি নিলেন আকূতিকে। আকূর্তির গর্ভে রুচির যজ্ঞ ও দক্ষিণা নামক পুত্র ও কন্যা জন্মায়। দক্ষিণার গর্ভে বারোটি পুত্রের জন্ম হয়, যারা বামদেব বলে উল্লেখিত। প্রসূতির গর্ভে শ্রদ্ধা, লক্ষ্মী, কৃতি, তুষ্টি, পুষ্টি, মেধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা, বপুঃ শান্তি, সিদ্ধি, কীর্তি, খ্যাতি, সতী, সভৃতি, স্মৃতি, প্রীতি, ক্ষমা, সমুতি, অনুসূয়া, উজ্জা, স্বাহা ও স্বধা নামক চব্বিশ কন্যা জন্মায়। ধর্ম বিবাহ করেন প্রথম তেরোজনকে। বাকি এগারোজনকে এগারোজন জ্ঞানী ঋষি বিবাহ করেন। শ্রদ্ধার পুত্রের নাম কাম আর লক্ষ্মীর পুত্রের নাম দর্প। ধৃতির নিয়ম, তুষ্টির সন্তোষ, পুষ্টির লাভ, মেধার শম, ক্রিয়ার দণ্ড ও নয় এবং বুদ্ধির বোধ ও অপ্রমাদ নামক পুত্র জন্মায়।
অধর্মের ঔরসজাত নিকৃতি ও অনৃত, তাদের মিলনে উৎপন্ন হয় ভয় ও নরক নামক দুই পুত্র। মায়া ও বেদনা নামক কন্যা। ভয় মায়ার গর্ভে ভূতনাশক মৃত্যু ও নরকের ঔরসে বেদনা দুঃখ নামে পুত্র লাভ করেন। এদের সকলের মধ্যে আছে অধর্মের লক্ষণ। এরা স্ত্রী, পুত্রহীন।
৯
সূতের কথা শুনে নারদ প্রমুখ মহর্ষিরা সংশয়াচ্ছন্ন হলেন তখন তাঁরা সংশয় অবসানকরণের কারণ স্বরূপ জানতে চাইলেন–ব্রহ্মা কি করে পদ্ম থেকে উৎপন্ন হলেন তা আমাদের কাছে ব্যক্ত করুন।
কূর্ম ঋষিদের বললেন–আপনারা সকলে শুনুন কিভাবে অমিতবীর্য বিষ্ণুর পুত্র হয়েছিলেন ব্রহ্মা।
অন্ধকারাচ্ছন্ন স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল এক অতি ভয়ানক অক্ষ সমুদ্রের আকার ধারণ করেছিল। তখন কারোর অস্তিত্ব ছিল না। সেইসময় নারায়ণ সমুদ্র মধ্যে অনন্ত শয্যায় শায়িত ছিলেন। ইনি বিপুল বৈভব, যোগাত্মা, যোগীদের প্রতি অনুগ্রহ পরায়ণ, তার নাভিদেশে ছিল একহাত যোজন বিস্তৃত নবোদিত সূর্য-দীপ্তময় ও সুন্দর গন্ধযুক্ত এক পদ্ম, এর মধ্যে ছিল কর্ণিকা ও কেশর।
হিরণ্যগর্ভ নারায়ণকে জাগ্রত করলেন, তার একাকী শয়নের কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, তিনি সকলের উৎপত্তি ও বিনাশের হেতু। তিনি একথা বলে হিরণ্যগর্ভর পরিচয় জানতে চাইলেন। ব্রহ্মা তখন অতি মধুর ভাবে বললেন–তিনি ধাতা ও বিধাতা, ও স্বয়ম্ভু, প্রপিতামহ, তার মধ্যে অবস্থিত ব্রহ্মাণ্ড।
বিষ্ণু এরপর ব্রহ্মার শরীরে প্রবেশ করলেন। তিনি সেখানে ত্রিভুবন দেখে অভিভূত হলেন। এবং মুখ থেকে নির্গত হয়ে মহাপিতাকে বললেন–তার উদরে প্রবেশ করে একই দৃশ্য দর্শন করতে। ব্রহ্মা তার উদরে ঢুকে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করলেন, তবে তার শেষ পেলেন না। বিষ্ণু শরীরের সকল দ্বার রুদ্ধ করলে ব্রহ্মা তার নাভিদ্বার থেকে নির্গত হয়ে পদ্মের মধ্যে বিরাজ করতে লাগলেন। বিষ্ণুকে জানালেন, তিনি অজেয়, বিষ্ণু তখন বললেন–যে তিনি ইচ্ছাকৃত দ্বার রুদ্ধ করেননি, লীলাচ্ছলে করেছিলেন।
তখন প্রসন্ন হয়ে বললেন, তিনি পরমব্রহ্ম স্বরূপ, সনাতন, সকল, লোকের আত্মা স্বরূপ, তিনিই পরম পুরুষ। এহেন ব্রহ্মার কথায় বিষ্ণু বললেন–যে অহংকার করবে তার বিনাশ নেমে আসবে। তিনি কি প্রধান পুরুষের ঈশ্বর অব্যয় অধিপতি ব্রহ্মাকে দেখতে পাচ্ছেন না।
সংখ্যাশাস্ত্রজ্ঞ শ্রেষ্ঠ যোগীরাও মহেশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন না। ব্রহ্মা তখন বললেন–বিষ্ণুকে কল্যাণময়, মহাত্মার নিন্দা হয় এমন কথা বলবেন না। তিনি সবই জানেন। পরমেশ্বরের মায়ায় তিনি আচ্ছন্ন হয়েছেন। যে গুণেশ্বর বিষ্ণু নিজের আত্মাকে পরম তত্ত্ব বলে জেনেছিলেন তিনি। একথা বলে নীরব হবেন। মহাদেব তখন ব্রহ্মাকে প্রসন্ন করবার জন্য অবির্ভূত হলেন।
তিনি জ্যোতির জ্যোতি। তার গলার মালাটি জ্ঞানের সূতো দিয়ে গাঁথা, চন্দ্র সূর্য তারকায় খচিত, পাদমূল পর্যন্ত লম্বিত আর চমৎকার।
ব্রহ্মা হরিকে বললেন, শূল হস্তে ত্রিনয়ন দীপ্তিমান, নীলবর্ণ পুরুষ কে? বিষ্ণু মহাদেব সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন। তিনি বললেন–ইনি দেবাদিদেব মহাদেব ইনি প্রকৃত পুরুষ ঈশ্বর। এই অদ্বিতীয় অখণ্ড মহাদেবই সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করেন ও পালন করেন, আবার সংহারও করেন। শঙ্করই বেদরাশি দান করেছিলেন। ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে ব্রহ্মা মহাদেবের শরণ নিলেন, ব্রহ্মার স্তুতিতে পরমেশ্বর মহাদেব তুষ্ট হয়ে বললেন, তিনি পুরকালে তোক সৃষ্টির জন্য অব্যয় রূপে তাকে উৎপন্ন করেছিলেন। তিনি তার দেহ সস্তৃত আদি পুরুষ। মহাদেব ব্রহ্মাকে বর চাইতে বললে ব্রহ্মা বললেন, হয় ভগবান তার পুত্র হোক অথবা তার যেন ভগবান সদৃশ এক পুত্র হয়।
ব্রহ্মার কথায় মহাদেব বললেন, তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। ব্রহ্মা আদি কর্তারূপে নিয়োজিত হবেন। আর বিষ্ণু হবেন তার পরমা তনু ও তার যোগক্ষেম বহন করবেন। তখন বিশ্বব্যাপী বিষ্ণু মহাদেবের কথায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন হয়ে বললেন–যেন তিনি পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেন। তার মায়ায় মোহিত করে ভূতভেদকারী অমেয় শক্তি ভগবান অনাদি এই কথা বলে জন্ম বৃদ্ধি বিনাশশূন্য অব্যক্তলোকে ফিরে দেখলেন।
১০
পিতামহ ব্রহ্মা বিষ্ণুর নাভি থেকে উথিত বিশাল পদ্মে অবস্থান করতে লাগলেন। বিষ্ণুর কর্ণ থেকে জন্ম লাভ করে এসে উপস্থিত হল মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুর। ব্রহ্মা তখন বললেন, এই দুই অসুরকে বিনাশ করা নারায়ণের কর্তব্য, ব্রহ্মা তখন জিষ্ণু ও বিষ্ণু নামক দুই পুরুষ সৃষ্টি করে মধু ও কৈটভকে বধ করার আদেশ দিলেন।
সেই দুই পুরুষ, নারায়ণের আদেশে মধু ও কৈটভের সাথে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। স্নেহাবিষ্ট হয়ে ব্রহ্মাকে হরি মধুর বাক্যে বললেন, তিনি ব্রহ্মাকে এতক্ষণ পর্যন্ত বহন করেছেন। আপনি এবার অবতীর্ণ হোন পদ্ম থেকে। আপনার ভার অতি গুরু। ব্রহ্মা তখন পদ্ম থেকে অবতীর্ণ হয়ে হরির দেহে প্রবেশ করলেন। এরপর উভয়ে বৈষ্ণবী নিদ্রায় জলমধ্যে শয়ন করলেন।
ব্রহ্মা দীর্ঘকাল ধরে অনাদি অনন্ত অদ্বৈত, স্বকীয় আত্মস্বরূপে ব্ৰহ্মাৰ্ঘ পরমাত্মার আনন্দ অনুভব করলেন। ব্রহ্মা প্রথমে পূর্বজাত সনন্দ, সনক, ভৃগু, সনৎকুমার সনাতনদের সৃষ্টি করলেন। এদের মোহ ছিল না শীত, গ্রীষ্ম প্রভৃতি বিষয়ে, এঁরা পরম বৈরাগ্যভাব অবলম্বন করেছিলেন। এরা আশ্রয় করলেন জ্ঞান বিষয়িনী বুদ্ধিকে। পিতামহ ব্রহ্মা সনক প্রমুখকে নিরপেক্ষ দেখে পরমেশ্বরীর মায়ার দ্বারা লোক সৃষ্টি করার বিষয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন। ব্রহ্মাকে তখন বিষ্ণু জিজ্ঞেস করলেন তিনি মহাদেবকে ভুলে গেছেন কিনা?
ব্রহ্মা তখন অত্যন্ত দুশ্চর তপস্যা আরম্ভ করলেন প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছায়। তাতে ব্রহ্মার কোন ফল লাভ হল না। এতে ব্রহ্মার ক্রোধ উৎপন্ন হল। ব্রহ্মার চোখ বেয়ে ঝড়ে পড়া অশ্রুবিন্দু থেকে জন্ম দিল ভূত-প্রেতগণ। তাদের দেখে ব্রহ্মা নিজেই নিন্দা করতে লাগলেন এবং প্রাণত্যাগ করলেন, তার মুখ থেকে রুদ্রগণের প্রাদুর্ভাব হল। মহাদেব স্বয়ং তখন উচ্চস্বরে ক্রন্দন করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তখন তাকে কাঁদতে নিষেধ করলেন। তিনি বললেন, রোদন করার জন্য তার নাম হবে রুদ্র। ব্রহ্মার দেওয়া তাঁর আরও সাতটি নাম হল– ভব, সর্ব, ঈশাণ, পশুপতি, ভীম, উগ্র ও মহাদেব। তার আট পত্নীর নাম সুবর্চলা, উমা, বিকেশী, শিবা, স্বাহা, দিক, দীক্ষা আর রোহিণী, আট পুত্র হলেন– শনৈশ্বর, শুক্র, মঙ্গল, মনোজব, স্কন্দ, স্বর্গ, সন্তক আর বুধ।
প্রজা, ধর্ম, কাম ত্যাগ করে মহাদেব বৈরাগ্য আশ্রয় করলেন। তিনি আত্মাতে মুক্ত করে অক্ষর ব্রহ্মরূপ পরম অমৃত পান করে ঈশ্বর ভাব অবলম্বন করেছিলেন। ব্রহ্মা মহাদেবকে জীব সৃষ্টি করতে আদেশ দিলে মহাদেব মনের দ্বারা, নিজেরই মতো জটাজুটধারী, ভয়শূন্য, নীলকণ্ঠ, পিনাকপানি ত্রিশূল হস্ত, উদ্যমমুক্ত, সদানন্দময়, ত্রিনয়ন, অজর, অমর, বন্ধনহীন, মহাবৃষ ভাবন, নিস্পৃহ আর শতকোটি শত রুদ্র সৃষ্টি করলেন। ব্রহ্মা শিবকে বললেন, জরামরণহীন জীব সৃষ্টি না করতে। জন্ম-মৃত্যু যুক্ত জীব সৃষ্টি করতে বললেন। মহাদেব তখন তাকে বললেন, তিনি সেই রকম জীব সৃষ্টি করবেন না।
তিনি তখন পুত্রদের সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। একারণে তার নাম স্থানু। মহাদেবের দশটি বৈশিষ্ট্য হল–জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঐশ্বর্য, তপস্যা, সত্য, ক্ষমা, ধৃতি, দ্রষ্টত্ব, আত্মা, সম্বোধ ও অধিষ্ঠাতৃত্ব। ব্রহ্মা আনন্দিত হলেন মানসপুত্রদের সঙ্গে মহাদেবকে বিদ্যমান দেখে।
মহাদেবের বন্দনা করে ব্রহ্মা বলতে লাগলেন–তুমি পরমেশ্বর, কল্যাণময়, দেব ও ব্রহ্ম স্বরূপ, মহান ঈশ্বর, শান্ত, জগৎকারণ, প্রকৃত পুরুষ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, মহাকাল, রুদ্র, শূলধারী, ত্রিনয়ন, ত্রিমূর্তি, বেদবিদ্যার অধীশ্বর, বেদান্ত মূর্তি ব্রহ্মাধিপতি, আদিদেব, তীর্থ, যোগ সিদ্ধির কারণ, দীপ্তিশূন্য মহেশ্বর, পরমেষ্ঠী, শান্ত, তুমি পুরুষ মহাকাল, অগ্নি বায়ু আকাশ, অহংকার স্বর্গ যার শীর্য পৃথিবী তোমার চরণ, আকাশ তোমার উদর, তুমি সকল জীব ধারণকারী, সকলের ক্রমানুসারে জীব সৃষ্টি করেছ, জ্যোতিঃ স্বরূপ যোগপুরুষ প্রণাম। যার প্রভাব দ্বারা এই অন্ধকারের পরিস্থিতি অদ্বিতীয় সবোকৃষ্টতত্ত্ব প্রকাশিত হচ্ছে, সেই পরমতত্ত্বরূপ পরমেশ্বরের শরণাপন্ন হই।
ব্রহ্মা এভাবে মহাদেবের স্তব করতে লাগলেন। ব্রহ্মাকে তখন মহাদেব দান করলেন দিব্য আর সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশ্বরযোগ, ব্রহ্মসত্ত্বভাব। প্রণত জনের আর্তনাশকারী মহাদেব তার সুন্দর দুটি করতল দিয়ে পিতামহ ব্রহ্মাকে ধারণ করে ঈষৎ হেসে বললেন, ব্রহ্মা তুমি বর চেয়েছিলে যেন আমাকে পুত্ররূপে প্রাপ্ত হও। এখন নানা রূপ জগৎ সৃষ্টি কর। সৃজন, পালন, সংহার–এই তিন গুণের দ্বারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও হর–তিন মূর্তিতে বিভিন্ন হয়েছি। তুমি আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র, আমার দক্ষিণ অঙ্গ থেকে তুমি নির্মিত। বিষ্ণু নির্মিত বাম অঙ্গ থেকে রুদ্র উৎপন্ন হয়েছে।
শম্ভুর হৃদয় থেকে, শ্রেষ্ঠ তনু এটি। অদ্বিতীয় ব্রাহ্মণ শঙ্কর স্বেচ্ছায় সৃষ্টি পালন ও বিনাশের কারণ রূপে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিন মূর্তিতে নিজ শরীর বিভক্ত করেছেন। অন্যান্য সব মূর্তি তার মায়ায় নির্মিত। মহাদেব এই সকল মূর্তির নিয়ন্তা স্বভাবতই অরূপ, অদ্বৈত, ও আত্মস্থ। তিনিই সেই মহেশ্বরী পরমা তনুর শ্রেষ্ঠ মূর্তি। জগৎকে ধ্বংস করেন মহাকাল রূপে। পিতা ব্রহ্মাকে এসব কথা বলে এবং তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে মহাদেব পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে সেই ক্ষণেই অন্তর্হিত হলেন। ভগবান প্রজাপতি যোগবলে পূর্বের মতো বিবিধ জগৎ সৃষ্টি করতে লাগলেন। ব্রহ্মা যোগের সাহায্যে মরীচি, ভৃগু, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, দক্ষ, অত্রি এবং বশিষ্ঠকে সৃজন করেছিলেন।
১১
কূর্ম বললেন, পিতামহ ব্রহ্মা মরীচি প্রমুখ ঋষিদের এইভাবে সৃষ্টি করে সমস্ত মানস পুত্রদের সঙ্গে তীব্র তপস্যায় রত হলেন। ব্রহ্মার মুখ থেকে কালাগ্নি উদ্ভূত, ত্রিশূলধারী, ত্রিনয়ন, অতি ভীষণাকৃতি অর্ধনারীশ্বরের রূপ ধরে রুদ্র প্রাদুর্ভূত হলেন। ব্রহ্মা ভীত হয়ে নিজেকে বিভক্ত করে ফেললেন। তার কথায় রুদ্র নিজেকে স্ত্রী ও পুরুষ রূপে দ্বিধা বিভক্ত করলেন।
রুদ্রকে আবার এগারো ভাগে ভাগ করলেন। যাঁরা একাদশ রুদ্র নামে পরিচিত। তারা নিয়োজিত ত্রিজগতের ঈশ্বর এবং দেবকার্যে নানা ভাগে ভাগ করলেন। প্রভু দেব নিজের সৌম্য অসৌম্য, শান্ত, অশান্ত, সিত, অসিত রূপের সঙ্গে নারী অংশকে। হে বিপ্রগণরুদ্রের অংশ স্বরূপ বিভূতিই লক্ষ্মী প্রভৃতি শক্তি নামে পৃথিবীতে বিখ্যাত। ঈশ্বরী শঙ্করী এই সমস্ত শক্তির সাহায্যে বিশ্বকে ব্যাপ্ত করেছেন।
এভাবে বিভাগের পর ঈশ্বরী নিজের অংশকে পৃথক করলেন এবং মহাদেবের আদেশে মূর্তিকে পিতামহ ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মা তাকে দক্ষের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করতে বললেন।
ব্রহ্মার আদেশে তিনি দক্ষের ঔরসে জন্মালেন। রুদ্র দক্ষকন্যাকে গ্রহণ করলেন। কালক্রমে প্রজাপতির আদেশে হিমালয়ের ঔরসে মেনকার গর্ভে কন্যারূপে পরমেশ্বরীর জন্ম হল। পার্বতীকে রুদ্রের কাছে সমর্পণ করেছিলেন মহাদেব ত্রিভুবন ও নিজের মঙ্গল কামনায়। এই কারণে দেবাসুরের শ্রদ্ধেয়া শঙ্করের অর্ধাঙ্গিনী মহেশ্বরী হৈমবতী বলে খ্যাত।
১২
সূত বলতে লাগলেন, মুনিরা কূর্মরূপী বিষ্ণুর সকল কথা শুনে তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, যে শিবশক্তি প্রথমে দাক্ষায়নী সতী হয়ে পরে হিমালয় কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই দেবীর বিষয়ে কী আর বৃত্তান্ত আমাদের বলুন।
মুনিদের কথা শুনে পুরুষোত্তম নিজ পরমপদ ধ্যান করে নিয়ে বলতে শুরু করলেন পুরাকালে অত্যন্ত মনোরম মেরুপৃষ্ঠে বসে পিতামহ ব্রহ্মা এই বৃত্তান্ত বলেছিলেন। এক অতি গুহ্য রহস্যতত্ত্ব। পরম সাংখ্য সাংখ্যশাস্ত্রাধ্যায়ীদের কাছে পরম সংখ্যা। তত্ত্ব মুক্তি দূত সর্বোৎকৃষ্ট ব্রহ্মজ্ঞান আর সংসারসমুদ্রে নিমগ্ন মানুষের কাছে এ তত্ত্ব মুক্তির দূত, হৈমবতী বলে জেনে জ্ঞান স্বরূপা, অতি লালসা, ব্যেমনাম্নী মাহেশ্বরী শক্তি, মঙ্গলময়ী সকল পদার্থে নিশ্চিতরূপে অনুসূতা, অনন্তা, ত্রিগুণাতীতা, অবয়বরহিতা, অদ্বিতীয়া অথচ তার বহু বিভাগ।
ব্রহ্ম, তেজোরূপে পরমব্রহ্মে সংস্থিতা। সূর্যের ভাস্বর দীপ্তির মতো তার স্বাভাবিক প্রভা। মাহেশ্বরী শক্তি এক হয়েও উপাধিবশত অনেক রূপে মহাদেবের কাছে লীলা করেন। জগৎ তারই কার্য। ঈশ্বরের কার্য-কারণ নেই পণ্ডিতরা বলেন। এই দেবীর চার শক্তিই রয়েছে অধিষ্ঠান বশে। এদের নাম শান্তি, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা ও নিবৃত্তি। চতুর্হ বলা হয় পরমেশ্বরকে। স্বকীয় আত্মানন্দ অনুভবের কারণ পরমেশ্বর এই প্রধানা চার দেবীর সংসর্গেই, চার বেদে মহাদেব চার ভাবে অবস্থিত।
অনাদি বলে সিদ্ধ দেবীর মহৎ অনুপম ঐশ্বর্য, তিনি অনন্তা নামে অভিহিত হন পরমাত্মা রুদ্রের সঙ্গে যোগ হলে। সকল জীবের প্রেরণাদাত্রী ও ঈশ্বরী সেই দেবী। মহেশ্বর মহাকাল ও পরিপ্রাণ বশতঃ প্রাণীকুল সৃষ্টি ও সংহার করেন। তাই কালের বশ সকলে। কালই প্রধান তত্ত্ব, পুরুষ, মহত্তত্ত্ব, আত্মা ও অহংকার। অন্য সকল তত্ত্ব অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন যোগী, জগতের ভ্রম উৎপাদন করে চলেছেন পুরুষোত্তম মায়াবী মহাদেব। সনাতনী, মায়ারূপিণী শক্তিই সর্বদা মায়াবী মহেশ্বরের বিশ্বরূপ প্রকাশ করছেন।
জ্ঞান, ক্রিয়া ও প্রাণ শক্তি নামে তিন মুখ্য শক্তি আছে দেবের। অনাদি ও অবিনশ্বর মায়া নিজে। মায়াকে অনিবারণ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এবং তাকে বিনাশ করা যায় না। প্রভু মহাকাল সর্বশক্তি, ঈশ্বর মায়াবী ও প্রলয়কারী। সব কিছু সৃষ্টি করছেন, কালই সব কিছু ধ্বংস করছেন। আর কালই বিশ্বকে পালন করছেন। মায়া যখন অনন্ত জগদীশ্বর কাল স্বরূপ দেবদিদেব পরমেষ্ঠী প্রভু শম্ভর সান্নিধ্যে, আসেন তখনই তাদের প্রকৃতি ও পুরুষ এবং প্রভেদ হয়ে থাকে মায়া ও মায়াবী।
বস্তুত অখণ্ড মঙ্গলময়ী মায়াই অদ্বিতীয় হয়ে সকলের মধ্যে রয়েছেন, অনন্ত শিবই শক্তি, শিবই শক্তিমান বলে কীর্তিত হন। শিব শক্তি থেকেই উদ্ভূত হয়েছেন অন্য সকল শক্তির অধিষ্ঠাতা হিসেবে। পণ্ডিতরা সাধারণভাবে শক্তিমানকে অভিন্নরূপেই অনুভব করে থাকেন। ব্রহ্মবাদীরা পুরাণে বলেছেন যে, গিরিজা দেবী সর্বশক্তিস্বরূপা আর শঙ্কর সেই শক্তির আধার। ভোক্তা বলে কথিত আছে, পতি মহেশ্বরের প্রতি অনন্যচিত্তা বিশ্বেশ্বরী দেবী ভোগ্যা এবং নীললোহিত ভগবান বনে।
আবার ভগবানের মননের বিষয় তিনি সাধুগণের বিচারে, বিপ্রগণ, সর্ববেদেই তত্ত্বদর্শী মুনিদের প্রভাবে নিরুপম, করেছেন যেসব কিছুই শক্তি ও শক্তিমান সমস্ত দর্শনে মুনিরা মাহাত্ম কীর্তন করেন এই দেবীর। সেই পরম পদের সন্ধান পেয়েছেন যোগীরা। দেবীর এই পরম পদকে যোগীরা আনন্দস্বরূপ অক্ষর, ব্রহ্মস্বরূপে, অদ্বিতীয় ও অখণ্ড রূপে দর্শন করেন, যা আত্মজ্ঞানের বিষয়, পরমানন্দের সন্ধান করেন, তিনি ধাত্রী ও বিধাত্রী। ঈশ্বরকে আশ্রয় করে থাকায় সমস্ত সংসারতাপকে বিনষ্ট করেন। বিমুক্তি লাভ করতে উৎসুক ব্যক্তি সর্বভূতাত্মা শিবাত্মিকা পার্বতীকে আশ্রয় করবেন। অতি কঠিন তপশ্চর্যার পর সর্বানীকে কন্যারূপে পেতে ও হিমবান মেনকার সঙ্গে পার্বতীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
যিনি উৎপন্ন হয়েছেন নিজ অভিলাষ থেকে। এই মনোরম পার্বতীকে দেখে হিমবানের পত্নী মেনকা। হিমবানকে বললেন, রাজা আমাদের তপস্যার ফলে সকল জীবের কল্যাণের জন্য উৎপন্ন পদ্মের মতো সুন্দরাননা কন্যাকে দেখুন। তখন হিমবান দেবীকে দেখলেন। নবোদিত সূর্যের মতো তার রূপ, জটামণ্ডিতা। তাঁর তিন চোখ, চার মুখ, স্পৃহা তার তীব্র, আয়তনয়না অষ্টভুজা এ দেবীও চন্দ্রকলায় সজ্জিতা। সকল গুণ থেকে নিমুক্ত, তাকে প্রত্যক্ষ করা যায় সাক্ষাৎ গুণ-ময়ী রূপে। তার মধ্যে প্রকাশ নেই সৎ অথবা অসৎ কোনটিরই।
তাঁকে দেখে ভূমিতে মস্তক স্পর্শ করে হিমবান প্রণাম করলেন এবং তার তেজে অভিভূত ও ভক্তিযুক্ত হয়ে হাত জোড় করে পরমেশ্বরীকে বললেন–বিশালক্ষ্মী, অর্ধেন্দু ভূষিতে দেবী, তিনি কে? হিমবানের কথা শুনে দেবী বললেন, তিনি মহেশ্বরে সমাশ্রিতা পরমাশক্তি অনন্যা, অনশ্বরা, অদ্বিতীয়া, তিনি সর্বজীবের আত্মা, সর্বপ্রকার কল্যাণ তার মধ্যে রয়েছে। নিত্য ঈশ্বর বিষয়ক যে পরমজ্ঞান, আকার রূপ সকল কার্যের প্রেরণাদাত্রী। তার অনন্ত নেই মহিমার সীমা নেই। জীবগণকে তিনি সংসার সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেন। বিভূতিসম্পন্ন রূপ দেখতে বললেন।
হিমবানকে জ্ঞান দান করে দেবী নিজের দিব্যরূপ তাকে দেখালেন। কোনটি সূর্যের মতো সেই রূপের দীপ্তি, তা যেন তেজের বিম্বস্বরূপ। তাতে নিশ্চল হয়ে আছে অসংখ্য অগ্নিশিখা, এই দেবীর হাতে ত্রিশূল আর বরদামুদ্রা। তার মধ্যে আছে অনন্ত বিস্ময়। মস্তকে তার চন্দ্র শোভা পাচ্ছে। তার লাবণ্য চন্দ্র প্রভার মতো। তার পায়ে নূপুর, গলায় দিব্যমালা, পরনে দিব্যবস্ত্র। হিমবান দেবীর যে রূপ দর্শন করলেন তার সমস্ত দিক, হস্ত, পদ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ। দেবী সকল পদার্থ আবৃত করে রয়েছেন। এহেন মাহেশ্বরী রূপ দর্শন করে পর্বতরাজ ভীত পুলকিতচিত্তে পরমাত্মায় আত্মসংযোগ করলেন ও ওঙ্কার উচ্চারণ করে হাজার বছর তার নামে স্তব করতে লাগলেন।
হিমবান বললেন–শিবা, উমা, পরমাশক্তি, অনন্তা, শাশ্বতী, অচিন্ত্যা, অনন্তা, পরমাত্মা, অনাদি, অচ্যুতা, অমোঘা, নন্দা, বালাবারা প্রাণরূপা, সকলা, কার্যনিয়ন্ত্রী, মাতা আত্মসংশয়া, পরমাপনশিলী পুরাণা, চিন্ময়ী ত্রিতত্ত্ব, বক্তা, শুক্লা, ব্রহ্মগর্ভা, পদ্মনাভা, মহারূপা, মহানিদ্রা, অবিদ্যা, অনন্তস্থা। ব্রাহ্মা, মহতী, মানসী, তত্ত্বসম্ভবা, ঈশ্বরাণী, সর্বানী শঙ্করাধশরীরিণী, ভবানী, রুদ্রাণী, মহালক্ষ্মী, অম্বিকা, বিকাশনী, সাবিত্রী, সরোজনিলয়া, গঙ্গা, গুহ্যবিদ্যা, মেধা, স্বধা, ধৃতি, শ্রুতি, নীতি, পুজা, বিভাবতী, রম্য, সুন্দরী, পদ্মমালা, পাপহারা, বৃষাসনগতা, গৌরী, মহাকালী, অদিতি, নিয়তা, রৌদ্রী, পদ্মগর্ভা, বিবাহলা, লেলিহাল, বিভাবরী দ্রব্যা, ভবতা পবিনশিলী, দীক্ষা, নিরাময়া, কামধেনু, গতি, ভারতী, যোগমায়, মহামতী, ক্ষ্যান্তি, প্রজ্ঞা, চিতি, বিকৃতি, শঙ্করী, শিবানদা, দুর্বিনেয়া, গুহান্বিকা, ত্রিনেত্রা।
সংসার তারিণী, বিদ্যা, ভবারণী, শুদ্ধি, সহস্রাক্ষী, ব্যাপ্তা, দৈজসী, নলিনী, পদ্মবাসিনী, সদানন্দা, বাগদেবতা, ব্রহ্মবালা, বালাতীতা, জ্ঞানশক্তি, ভগবৎপত্নী, সবালা, ক্রিয়াশক্তি, জ্ঞানশক্তি, ভগিনী, সর্বদা সর্বতোভা, গুহারণী, যোগমাতা, গঙ্গা, বিশ্বেশ্বরেশ্বরী, বনপিলা, বামালাভা, বালান্তারা, ভূতিভূষণা, ভূতিদা, ধর্মোদয়া, ভানুমতী, যযাগিজ্ঞেয়া, মনোজবা, মনোরমা, মনোরস্কা, তাপসী, দেবশক্তি, মাতা, মহাশক্তি, মনোময়ী, বিদ্যা, নন্দিনী, সুরভী, কিন্নরী, বন্দিবল্লভা, ভারতী, পরমানন্দা, সর্বপ্রহরণা, প্রেতা, কাম্যা, অচিন্ত্যা, ভূলেখা, বালকপ্রভা, কুম্মাণ্ডী, ধনরত্মাঢ্যা, সুগন্ধা, গন্ধদায়িনী, ত্রিবিক্রমপদ্ভুতা।
আদ্যা, গিরীশা, নিত্যাপুষ্টা, পদ্মনন্দা, দ্বষদ্বতী, পুষ্টি, শুদ্ধি, ধুন্বতী, মহেন্দ্ৰভগিনী, সৌম্যা, বরেণ্যা, কল্যাণী, কমলাবাসা, হিতা, ভদ্রকালী, মহাখনা, কামভেদা, বাচ্যা, বালিপ্রিয়া, জয়ন্তী, খ্যাবৃঢ়া, ভুক্তি মুক্তি, শিবা, অমৃতা, লোহিতা, মহাভূতি, পূর্ধ। সুপ্রভা, সৌরী, সরোজনয়না, সমা, অষ্টাদশী, ভূজা, স্থানেশ্বরী, অশেষদেবতামূর্তি, গণাম্বিকা, গুহ্যরূপা, গো, গীঃ, শাস্ত্ৰযোনি, নিরাশ্রয়া নির্বিকারা, দৈত্যদানব নির্মম্মী, কাশ্যপন, বালকনিকা, ক্রিয়ামূর্তি কৌমুদী, শানুকীনি, বলিতাভাবা পরাবরবিভূজিতা, পরাধ জাতমহিমা, বড়বা, বামলোচনা, সুভদ্রা, দেবকী, গীতা, মুন্যমাতা রিনুরন্ধ ও প্রিয়া, হিরণ্যরজনী, হৈমী, হেমাভরণ- ভূষিতা, আদ্রিজা, সত্যদেবতা, দীর্ঘ, বাকদ্মিনী, শান্তিদা, ঐন্দ্রী, পরমেশ্বরী, বৈষ্ণবী, দাত্রী, যুগ্নদৃষ্টি, ত্রিলোচনা, প্রচণ্ডা, বৃষাবেশ, হিমবপেরু নিলয়া, চানুর, হতৃ তনয়া, কামরূপিণী, বেদবিদ্যা, বীরা, বিদ্যাধরী, প্রিয়া সিদ্ধা, আপ্যায়নী, হরী, পাবনী, পোষনীকলা, মাতৃকা, সেবিকা, সেব্যা, মিনীকলী, গুরুন্মতী, অরুন্ধুতি, মগাক্ষী, বসুপ্রদা, ধারা, শ্রীমতী, শ্রীশা, শ্রীনিবাসা, শ্রীধরী, শ্রীবারী, কন্যা, ধাত্রীশাস, ধনদপ্রিষা, মালা, নির্মলা, মাঙ্গলা, মঙল্যা, বর্ণিকার করা, দিবা, শত্ৰুসিনগতা, শার্জী, সধ্যা, বিশিষ্টা, শতরূপা, বিনতা, সুরভি, নিবৃত্তি, পারগা, ধর্মাহনা, ধর্মপূর্বা, কালমুর্তি, কলকলিত বিগ্রহ, ধনাবহা, ধর্মান্তরা,সর্বেশ্বরী, মরহারিণী, রসজ্ঞা, ইষ্টা, সূক্ষ্মজ্ঞান, স্বরূপিণী, কুশলা, বৈদেহী, প্রধান পুরুষেশেশা, শ্রীকলা, মহাদৈবিক, সঙ্গিনী, সদাশিবা, বিষয়মূর্তি, বেদমূর্তি, এবং অমূর্তিকা।
এইভাবে সহস্র নাম দ্বারা স্তব করে দেবীকে কৃতাঞ্জলীপুটে হিমবান বললেন, পরমেশ্বরীর ভয়ানক অপরূপ ঐশ্বর্য রূপ দেখে আমি ত্রস্ত হয়েছি, তুমি আমাকে অন্য রূপে দেখাও। পার্বতী নিজের ভয়ানক রূপ সংহার করলেন। এবং হিমবানকে অন্য এক রূপ দেখালেন। সুগন্ধ নীল পদ্মের মতো। এর দুটি নয়ন ও কৃষ্ণঘন কেশে সঞ্জিত। এর পদ্মের মতো পা দুখানির তলদেশ রক্তবর্ণ, করতলও রক্তবর্ণ। এর ললাটে তিলক উজ্জ্বল, বিচিত্র।
অলংকারে এর দেহবল্লরী অতি পেলব ও সুন্দর অঙ্গ সজ্জিত। নুপূর ঝঙ্কৃত তার পদ্মের মতো সুন্দর চরণে। দেবীর রূপ স্বর্গীয় আর অনন্ত মহিমার আধার।
এই রূপ দেখে শৈলরাজ সকল আতঙ্ক ভুলে পুলকিত হয়ে পরমেশ্বরীকে বললেন, তার জন্ম সার্থক হল, কারণ দেবী অব্যক্ত হয়েও তার দৃষ্টি সম্মুখে দেখা দিলেন। তোমাতে অবস্থিত প্রকৃতি। তুমি পরমা শক্তি, পরম আনন্দ স্বরূপা, আনন্দদায়িনী, মহাকাশ, মহাজ্যোতিঃ–স্বরূপ, গুণাতীত, মঙ্গলময়, পরম ব্ৰহ্ম স্বরূপ, গার্হস্থ্য ও ঈশ্বরের মধ্যে মহেশ্বর, কল্পের সঙ্গে ঈশাণ কল্প, যুগের মধ্যে সত্যযুগ, পক্ষীর মধ্যে গরুড়, জপনীয়ের মধ্যে সাবিত্রী। তোমার রূপকে প্রণাম। প্রণাম তোমার কূটস্থ অপ্রকাশিত শরীর পুরুষ নামক রূপকে, বিচিত্র, বৈরাগ্য ধর্ম রূপকে, সূর্যমণ্ডলে স্থির পরমেষ্ঠীকে।
প্রলয় কালীন অগ্নিস্বরূপ, সহস্ৰপনায় ভূষিত আরূঢ় নিদ্রিত শেষ রূপকে, দেবী তুমি, সকল জগতের মাতা। হে অমর ঈশাণী, মেনকার সঙ্গে আমাকে রক্ষা কর, তুমি মায়াবীর মধ্যে বিষ্ণু, সর্তীর মধ্যে অরুন্ধতি, সুক্তের মধ্যে পুরুষসূক্ত, অদ্বিতীয়া ঐশ্বর্য, জ্ঞানী, বৈরাগ্য,ভবিষ্যৎ, ও বর্তমানের কারণ, যার সহস্র শীর্ষ, যার শক্তির অন্ত নেই, নিদ্রিত, অপ্রতিহত বিভূতি, আনন্দ রসের জ্ঞাতা, স্বর্গে নৃত্যপর, রূপরহিত, মহাদেবী, ভগবতী ঈশাণী তোমাকে প্রণাম। জগতে তোমার সম কেউ নেই। কারণ জগৎ জননী হয়েও তুমি আমার কন্যা রূপে জন্ম গ্রহণ করেছ। তুমি জগৎ মাতা, তোমার পাদপদ্মে প্রণাম আমার, আমি তোমার আশ্রিত, মহাদেবী আমার করণীয় কাজ কি?
হিমবানের কথা শুনে দেবী ঈষৎ হেসে বললেন, যাঁরা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেন সেই ব্রহ্মাবিদগণের দ্বারা আরাধিত, অতিগুহ্য, সকল শক্তির দ্বারা মণ্ডিত, প্রেরয়িতা স্বরূপ অতি আশ্চর্য এবং অনুত্তম রূপ নিজে প্রত্যক্ষ করেছ। শান্ত ও সমাহিত চিত্তে একনিষ্ঠ ও তৎপরায়ণ হয়ে এই রূপের শরণ নাও। তবেই তুমি সংসার পাশ থেকে মুক্ত হবে। গিরিশ্রেষ্ট ধ্যান, কর্মযোগ, ভক্তি ও জ্ঞানের সাহায্যে আমাকে পাবে। ধর্ম থেকে ভক্তি আসে আর ভক্তিই পরমাত্মা তত্ত্বের দিকে নিয়ে যায়।
যজ্ঞ প্রভৃতি কর্ম ধর্মযাজক, এ ভিন্ন আর কোনো কিছুতে ধর্ম নেই। বেদেই প্রকাশ ঘটেছে ধর্মের। বেদকে আশ্রয় করবেন ধর্মকামী ইচ্ছুক ব্যক্তিরা মুক্তিলাভের জন্য। বেদই শ্রেষ্ঠা শক্তি, যা পুরতনী, সেই শক্তিই সৃষ্টির ঊষালগ্নে ঋক্, যজুঃ ও সামরূপে প্রকাশিত হয়েছে। বেদের রক্ষার জন্যই জন্মরহিত ভগবান ব্রাহ্মণ প্রভৃতি বর্ণের সৃষ্টি করে তাদের নিজ কার্যে নিযুক্ত করেছেন। তাদের জন্যই কুৎসিত তামিস্র নরক সৃষ্টি হয়েছে। যারা বেদবিহিত এই ধর্মকে উপেক্ষা করে। বেদ ভিন্ন অন্য কোন শাস্ত্র নেই যেখানে ধর্মের কথা আলোচিত হয়েছে। দ্বিজগণ বাক্যালাপও করেনা তার সাথে যে অন্যশাস্ত্রে মনোযোগ দেয়। কপাল, ভৈরব, দামাল, বাম, আহত, কপিল, পঞ্চরাত্র ও জ্ঞামর শাস্ত্রও মোহ উৎপাদন করে। অসুরদের মেহিত করার জন্য এইসব শাস্ত্র তৈরি হয়েছে।
তারাই প্রিয় হয় যারা বেদাবিদগণের দ্বারা করণীয় সব বৈদিক কর্ম যত্ন সহকারে সাধন করে।
মনু বিরাট পুরুষ স্বয়ং স্বায়ম্ভুব মনু পুরাকালে আমার আদেশেই সকল বর্ণের হিতের জন্য মুনিদের কাছে ধর্মের কথা বলেছিলেন। মহষিরা ব্রহ্মর আদেশে যুগে যুগে সকল ধর্মশাস্ত্র বারবার রচনা করবেন। আঠারোটি পুরাণ লিখেছেন বেদব্যাস ব্রহ্মার কথায়। তাঁর শিষ্যরা অনেক উপপুরাণও লিখেছেন। শাস্ত্রের সংখ্যা চতুর্দশ, যা হল শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, যা হল শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ নিরুক্ত, ছন্দ, জ্যোতিশাস্ত্র, ন্যায়বিদ্যা, মীমাংসা, পুরাণ শাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র এবং চারবেদ, ধর্মের স্বরূপ চিত্রিত হয় না।
এই সকল শাস্ত্র ছাড়া মনু, ব্যাস প্রমুখ মুনিগণ পিতামহের দ্বারা উক্ত উত্তম ধর্মকে মহাপ্রলয় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করে যাবেন। মহাপ্রলয় উপস্থিত হবে ব্রহ্মার পরমায়ু শেষ হয়ে গেলে। আত্ম সাক্ষাৎকারী মুনিরা ব্রহ্মার সঙ্গে পরব্রহ্মে লীন হয়ে যাবেন। তাই বেদকে আশ্রয় করবে যত রকম ভাবে সম্ভব। পরমব্রহ্ম প্রকাশিত হয়ে ধর্মের জ্ঞান মিলিত হলে তবেই আসক্তি যুক্ত ব্যক্তি আমার শরণাপন্ন হবে। সর্বদা কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তির নিকট ঘোর অন্ধকার রূপে উদ্ভূত মায়াকে জ্ঞানের দ্বীপ জ্বেলে অচিরেই বিনাশ করে থাকি।
আমাতেই সমর্পিত প্রাণ, কাল নামক পরম পুরুষের শরণ নাও। ঐশ্বর্য রূপের ধ্যান করতে না পারলে আমার যে রূপ প্রত্যক্ষ হয় তাতে মনপ্রাণ অর্পণ করে সেই রূপের অর্চনা কর। পরমপদ স্বরূপ রূপকে কেবল অতি ক্লেশে লভ্য জ্ঞানের দ্বারা পাওয়া যায়। আমাতে প্রবেশ করতে সমর্থ কেবল আত্মজ্ঞানী ব্যক্তিরা। শ্রেষ্ঠ ও নির্মল মোক্ষ লাভ করা যায় না আমাকে আশ্রয় না করলে। একভাবে বা পৃথক ভাবে আমার উপাসনা করলে পরম পদ লাভ করতে পারে। শুদ্ধস্বরূপ পরমতত্ত্বকে জানতে পারবে না আমাকে আশ্রয় না করলে। ব্রহ্মরূপ বা ঐশ্বর্যরূপের আরাধনা কর যত্ন করে।
অহংকার, মাৎসর্য, কাম, ক্রোধ, দান গ্রহণ এবং অধর্মে মনোযোগ পরিহার করে আর বৈরাগ্য অবলম্বন করে সকল প্রাণীকে নিজের মতো এবং নিজেকে সকল প্রাণীর মতো মনে করতে হয়। পরমব্রহ্মে অবস্থান করা যায় ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে, প্রসন্ন চিত্তে সর্বতোভূতকে অভয় দান করলে অনন্যাভবিনী ঈশ্বর বিজয়িনী পরম ভক্তি লাভ করা যায়। ঈশ্বর সম্বন্ধীয় অখন্ড ব্ৰহ্ম স্বরূপ পরম তত্ত্ব দর্শন হয় এবং সংসারের সকল পাপ থেকে নিমুক্ত হয়ে পরমব্রহ্মে অবস্থান করা যায়। কল্যাণময় মহেশ্বরই পরম ব্রহ্মের চরম পরিণতি। সংসারের সকল বন্ধন ত্যাগ করে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও। হে পর্বতাধিরাজ, তোমার অভিলাষ পূর্ণ কর। আমাকে ঈশ্বরের সন্নিহিতা বলে জেনো, সর্বপ্রকার যত্নের সঙ্গে ঈশাণীকে পূজো করে তার শরণাপন্ন হও।
হিমবান নত মস্তকে দেবীকে প্রণাম করলেন ও পরম আত্মজ্ঞানের উপায় জানতে চাইলেন।
সূত বললেন, এই কথা শুনে দেবী পরমেশ্বরী তাকে সেই পরম জ্ঞানময় উত্তম আত্মযোগ ও তার উপায়গুলির কথা সবিস্তারে যথাযথ ভাবে বললেন। গিরিরাজ লোকমাতার মুখপদ্ম থেকে নিঃসৃত পরম জ্ঞানের কথা শুনে যোগের প্রতি আসক্ত হলেন।
দিব্যযোগ লাভ করে ব্রহ্মলোক পার হয়ে দেবীর পরম স্থান লাভ করে সেই ব্যক্তি যে পবিত্র ও তদগত চিত্তে শিবসন্নিধানে ভক্তির সঙ্গে দেবীর মাহাত্ম কীর্তন নামক অধ্যায় পাঠ করে, সে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত হয়। ভক্তি যোগযুক্ত যে ব্রাহ্মণ দেবীর এক হাজার আট নাম জেনে সূর্যমণ্ডলের মধ্যে স্থিতা দেবীকে আবাহন করে গন্ধপুষ্প দ্বারা পূজা করে সে পরম ব্রহ্মে গমন করে। ব্রাহ্মণের পবিত্ৰকুলে জন্মে পূর্বজন্মের সকল সংস্কারের মাহাত্মে দেববিদ্যা লাভ করে পরমেশ্বর সম্বন্ধীয় দিব্য পরম যোগ প্রাপ্ত হয়, এবং শান্ত সংযত হয়ে শিবের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। মহামারী কৃত দোষ ও গ্রহবৈগুণ্য থেকে মুক্ত হয় সে যে ত্রিসন্ধ্যা পরমেশ্বরীর প্রত্যেক নাম উচ্চারণ করে হোম করে; দ্বিজগণ সকল রকম যত্ন আশ্রয় করে সর্বপাপ নাশের জন্য দেবীর সহস্র নাম জপ করবে।
সূত বললেন–ব্রাহ্মণগণ, দেবীর অনুপম মাহাত্ম্যের কথা আপনাদের কাছে বললাম।
১৩
ভৃগুর স্ত্রী খ্যাতির গর্ভে নারায়ণ বল্লভা লক্ষ্মী জন্ম নিলেন। ধাতা ও বিধাতা মেরুর দুই জামাতা। কন্যা দুটির নাম আয়তি ও নিয়তি। তাদের মধ্যে আয়তির পুত্রের নাম প্রাণ ও নিয়তিটির নাম মৃকুণ্ডু, যার থেকে জন্ম নেয় মার্কণ্ডেয়। প্রাণের ঔরসে বেদশিরা নামক দীপ্তরূপ সম্পন্ন এক পুত্র জন্মায়, মারীচি পত্নী পূর্ণমস নামক এক পুত্র ও চার কন্যার জন্ম দেন। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ হল তুষ্টি। পূর্ণমাসের বিরজা ও পর্বত নামক দুই পুত্র। পুলহ পত্নী ক্ষমার তিন পুত্র-কদম, বরীয়ান ও সহিষ্ণু। সহিষ্ণু কনিষ্ঠ। অত্রি পত্নী অনুসূয়ার গর্ভে তিন পুত্র জন্মায়।
এর হল দুর্বাসা, সোম ও দত্তাত্রেয় অঙ্গিরা পত্নী স্মৃতি চার কন্যা প্রসব করেন- সিনীবালী, কুহু, রাকা ও অনুমতি। পুলস্ত্যের ঔরসে প্রীতির গর্ভে দত্তোলি জন্মায়। ইনি অগস্ত্য নামে পরিচিত ছিলেন। এর দেববাহু নামক এক কন্যা জন্মায়। ক্রতুর পত্নী সম্মতির গর্ভে ষাট হাজার পুত্র জন্মায়। এরা ঊর্ধ্বরতা ও বালখিল্য নামে পরিচিত। ঊর্জার গর্ভে সাত পুত্র ও কন্যা জন্মায়।
রুদ্র বহ্নি নামক খ্যাত ব্রহ্মার পুত্রের ভার্য্যা স্বহা পাবক, পবমান ও শুচি নামক তিন পুত্র প্রসব করেন। পিতৃগণ হলেন ব্রহ্মার পুত্র, এরা অগ্নিদ্বারা ও বহিষদ নামক দুটি ভাগে বিভক্ত। স্বধার গর্ভে এঁদের ঔরসে মেনকা ও ধারিনী নামক দুই কন্যার জন্ম হয়। যারা বেদ অধ্যয়ন ও যোগ আশ্রয় করেছিলেন, মেনকার গর্ভে মৈনাক ও ক্রৌঞ্চ জন্মায়। ত্রিভুবনের মধ্যে অনুপমা, পাবয়িত্রী গঙ্গার জন্ম হয়। হিমবান দেবী মহেশ্বরীকে নিজ কন্যারূপে পান।
এই দেবী মাহাত্ম্যের কথা যথাক্রমে বললাম। দক্ষের কন্যা আর সন্তানদের কথাও শুনলেন। এখন মুনি সৃষ্টির কথা শুনুন।
১৪
স্বায়ম্ভব মনুর স্ত্রী ছিলেন শতরূপা। প্রিয়ব্রত ও জ্ঞানপাদ নামক ঈশ্বরত্ব দুই পুত্রের জন্ম হয় যাঁরা অত্যন্ত ধার্মিক ও বীর্যবান ছিলেন। জ্ঞানপাদের ধ্রুব নামক পুত্র নারায়ণের প্রতি ভক্তির ফলে প্রাপ্ত হয়। উৎকৃষ্ট স্থান লাভ করে। তার আবার শিষ্টি ও ভব্য নামক দুই পুত্র। ভব্য থেকে শম্ভুর জন্ম। সুচ্ছায়া নামক পত্নী ছিল সৃষ্টির, তিনি শালগ্রাম শিলায় বিষ্ণুর আরাধনা করেন বশিষ্ঠের উপদেশে। তিনি পাঁচ পবিত্র পুত্রের জননী হন রিপুজ্ঞয়, বিপ্র, বৃকল ও বৃকতেজা নামে রিপুর মহিষী সর্বতেজোময় পুত্র প্রসব করেন, যার নাম চক্ষু।
সে আবার সুরূপ চাক্ষুষ মনুর জন্মদাতা। বৈরাজ প্রজাপতির কন্যা পড়লার গর্ভে মহাতেজা মনুর অতিবীর্যবান দশ পুত্র হয়। ঊরু পত্নী আগ্নেয়ী বলবান ছয় পুত্র প্রসব করেন। অঙ্গ থেকে বেন এবং বেন থেকে বৈন্য জন্মায়, সেই নৃপতি পৃথু নামে বিখ্যাত। তিনি দেবেন্দ্রের সঙ্গে পুরাকালে প্রজা হিতকামনায় ব্ৰহ্মার আদেশে পৃথিবীকে দোহন করেন। এই মন্বন্তরে পুরাণ পুরু, হরি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের রূপ ধরে প্রসন্ন হয়ে আমাকে শিক্ষা দেন।
নৃপতি পৃথু জিতেন্দ্রিয় ছিলেন। তিনি একান্তভাবে স্বধর্মের অনুশীলন করতেন। বাল্যকাল থেকে নারায়ণের প্রতি পৃথুর ভক্তি ছিল। তিনি গোবর্ধন গিরিতে গিয়ে তপস্যা করেছিলেন। হৃষিকেশ তাতে তুষ্ট হয়ে সর্বশাস্ত্রধারী পুত্রের জনক হবার আশীর্বাদ দিয়ে অন্তর্হিত হন। পৃথুও হরির নাম করে, তাঁর ভজনা করে রাজ্যশাসন করতে থাকেন।
শিখণ্ডী, হবিধান ও অন্তর্ধান নামক পুত্রদের প্রসব করলেন পৃথুর পবিত্র হাসিনী তন্বী স্ত্রী। সুশীল নামে শিখণ্ডীর এক পুত্র জন্মায়। সুশীল হিমালয় পৃষ্ঠে ধর্মপদ নামক এক অরণ্যে মন্দাকিনী নদীর দক্ষিণে যোগীদের আশ্রম দেখে। সেখানে গিয়ে মন্দাকিনীতে স্নান করে স্তব করতে লাগলেন।
মহাপশুপত, সর্বাঙ্গে ভস্ম ও কৌপীন পরিহিত এক মহামুনি তাঁর নজরে পড়ল। তাঁর গলায় রয়েছে। যজ্ঞোপবীত। সুশীল সাম্ভর স্তব শেষ করে আননন্দাপূর্ণ নয়নে মহামুনির চরণে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করলেন। মুনি মহাদেবের ধ্যানে রত হয়ে সর্ব সিদ্ধির জন্য নিয়মানুসারে সর্বপাপনাশক, বেদের পরাভূত, মোক্ষদায়ক, ঋষি প্রবর্তিত পুণ্যজনক অগ্নি মন্ত্রের উপদেশ করলেন।
পৃথুর পুত্র হবির্ধান পত্নী আগ্নেয়ীর গর্ভে প্রাচীন বহিঃ নামে ধনুবিদ্যা পারদর্শী এক পুত্র জন্মায়। সমুদ্র তনয়ার গর্ভের দশ পুত্রকে প্রচেত বল হয়। এরা সকলে বেদ অধ্যায়ন করেছিলেন। দক্ষ প্রজাপতির জন্ম হল পরিষার গর্ভে। যে পূর্ব জন্মে ব্রহ্মার পুত্র ছিলেন।
একদিন ব্রহ্মার পুত্র দক্ষকে তাদের গৃহে সমাগত দেখে স্বয়ং মহাদেব তার পূজো করেছিলেন। তাঁর প্রাপ্যের অধিক পূজা হলেও তাতেও তিনি সন্তুষ্ট হননি। সতী একদিন পিত্রালয়ে এলে দক্ষ সতীর কাছে মহাদেবের নামে নিন্দা করলেন। এবং তাঁর অন্য জামাতাদের শ্রেষ্ঠ বললেন। দেবী তখন পিতৃনিন্দা করলেন। যোগবলে নিজশরীর দগ্ধ করে ফেললেন। এরপই তিনি হিমবানের কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। হর সর্বজ্ঞাত হয়ে দক্ষের গৃহে গমন করে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে শাপ দিলেন ক্ষত্রিয় কুলে জন্মাবার এবং বললেন–তিনি নিজ কন্যার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন। স্বায়ম্ভুব দক্ষ ও প্রাচেতস হয়ে জন্মালেন।
১৫
সূতের কাছে ঋষিরা রাক্ষসদের উৎপত্তির কথা জানতে চাইলেন। দক্ষের পরিণতির কথাও শুনতে চাইলেন।
সূত বললেন, দক্ষ অভিশপ্ত হয়ে হরির যজ্ঞ করতে মনস্থ করলেন। হরির যজ্ঞে মহাদেব ছাড়া অন্য সব দেবতারা উপস্থিত ছিলেন। যারা যজ্ঞ দেখতে এসেছিলেন তারা সকল সূর্য বলে খ্যাত। এরা ছাড়া অন্য সূর্য নেই। সেখানে উপস্থিত মুনিরা কেউ মহাদেবকে দেখতে পেলেন না। দক্ষ ব্রহ্মার অন্তর্হিত হবার পর হরির শরণ নিলেন। দেবী যখন মহাদেবকে জানান যে তার পূর্ব জন্মের পিতা দক্ষ এই যজ্ঞ করছে ও তার রক্ষা করছেন হরি, তখন মহাদেব তা বিনষ্ট করার জন্য বীরভদ্র নামক এক রুদ্রের সৃষ্টি করলেন। যার সহস্র মস্তক, নেত্র, বাহু ও হস্ত। ইনি ধনুর্ধর ও ভস্মভূষিত।
মহেশ্বর তাকে বললেন– হে গণেশ্বর, তুমি দক্ষযজ্ঞ পণ্ড কর। বীরভদ্র তখন যজ্ঞ নাশ করলেন। পার্বতীও ভদ্রকালী নামে এক মহাকালীর সৃষ্টি করলেন। তার সঙ্গে বৃষে আরোহণ করে গমন করলেন বীরভদ্র। বীরভদ্র সৃষ্ট হাজার রুদ্র ও মহাকালী মিলিত হয়ে দক্ষের কাছে যজ্ঞের ভাগ চাইল। কিন্তু দক্ষ যজ্ঞ ভাগ দিতে নারাজ হলে, বীরভদ্র বাহিনী যজ্ঞ মণ্ডপ ছিন্নভিন্ন করতে লাগলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ব্রহ্মা এসে বীরভদ্রকে থামালেন ও তাকে তুষ্ট করলেন।
দক্ষ হাত জোর করে ভগবতীর স্তুতি করতে লাগলেন। তখন দেব তুষ্ট হয়ে দক্ষকে বললেন, দক্ষ যেন তাঁর ভক্তি করে, তবে হরের অনুগ্রহে কল্পের শেষে গণেশ্বর হবে। ব্রহ্মা তখন দক্ষকে আলস্য ত্যাগ করে হরের নির্দেশিত কর্ম করতে বললেন। শিবনিন্দা তোমার বিনাশের কারণ, তাই সযত্নে একে পরিহার কর। তার নিন্দাকারীর সব কার্যই দোষাবহ হয়। তারা অন্তিমকালে নরকে যায়, যারা বিষ্ণুকে মহাদেবের থেকে ভিন্ন বলে মনে করে।
দক্ষ ব্রহ্মার কথায় কৃত্তিবাসের শরণ নিলেন। পরে ব্রহ্ম বাক্যে এবং পূর্ব সংস্কারের মাহাত্মে শাপ মুক্ত হয়ে সূর্য সদৃশ রূপ লাভ পূর্বক ব্রহ্মার অনুমতি পেয়ে জগতের অধীশ্বর পরব্রহ্ম রূপ, মহেশের আরাধনা করে তারই প্রসাদে নিজেদের পূর্ব গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।
এবার দক্ষ কন্যাদের সন্তান সন্ততির কথা বলছি, শোন।
১৬
দক্ষকে পুরাকালে ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টি করতে আদেশ করলে, তিনি ধর্ম সঙ্গত মৈথুন ক্রিয়ার দ্বারা প্রজা সৃষ্টি করতে লাগলেন। বীরণ নামে প্রজাপতির কন্যা ছিল অসিক্লী এক হাজার পুত্রের জন্ম দিল দক্ষ। ধর্মনিরতা কন্যার গর্ভে দক্ষ, বীরন কন্যার গর্ভে ষাট কন্যার জন্ম দিলেন। নারদের মায়ায় পুত্রেরা বিনষ্ট হলে এর মধ্যে ধর্মকে দিলেন দশটি, কাশ্যপকে তেরোটি, চন্দ্রকে সাতাশটি, আরিষ্টমিনেকে বাহু পুত্র ও ধীমান কৃশাশ্বকে ও অঙ্গীরাকে দুটি করে দিলেন।
ধর্মের পত্নীদের নাম ছিল মরুত্বতী, রসু, যামী, লম্বা, ভানু, অরুন্ধতী সঙ্কল্পা, মুহুতা, সাধংসা ও ভামিনীবিশ্বা।
অষ্টবসু হলেন আপ, ক্ব, সোম, ধর, অনিল, অনল, প্রত্যুষ ও প্রভাস। এই আটজন অষ্টবসু নামে বিখ্যাত আপের পুত্র বৈতন্ত্য, শ্রম, শান্ত ও ধ্বনি, ক্রুবের পুত্র ভগবান কাল, সোমের পুত্র বর্চ, ধরের পুত্র দ্রবিণ, অনিলের পুত্র মনোজ ও অবিজ্ঞাত গতি অনলের পুত্র সেনাপতি কুমার দেবল প্রত্যুষের পুত্র, শিল্পকার প্রজাপতি বিশ্বকর্মা প্রভাসের পুত্র।
কাশ্যপপত্নী দক্ষকন্যাদের পুত্রদের নাম হল– অংশ, ধাতা, ভগ, ত্বষ্টা, মিত্র, বরুণ, অর্যমা, বিবস্বনা, সতী, পূষা, অংশুমান ও বিষ্ণু পুরাকালে চাক্ষুস মন্বন্তরে তুষিত দেবতা নামে বিখ্যাত ছিল। পরে এদের নাম হল দ্বাদশ আদিত্য কাশ্যপের ঔরসে দিতির দুই পুত্র জন্মায়, তাঁদের নাম হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ।
হিরণ্যকশিপুর ছিল বিপুল বিক্রম, তিনি ব্রহ্মার তপস্যা করেছিলেন তাঁর বর লাভ করেছিলেন। বিষ্ণুকে দেখে কৃতাঞ্জলি হয়ে তাঁর পাদমূলে মাথা নত করে প্রণাম করলেন এবং বললেন, আপনি সকল ভূতের গতি, আপনি অনন্ত মহাযোগী, সর্বব্যাপী, সনাতন সর্বভূতের আত্মা, পরা প্রকৃতি বৈরাগ্য ও ঐশ্বর্যে নিরত, জগতের স্রষ্টা, ভগবান পীতবসন বিষ্ণু ব্রহ্মার কথায় জাগ্রত হয়ে কমল নয়ন মেলে দেবতাদের কাছে জানতে চাইলেন কেন তারা প্রজাপতিকে নিয়ে এসেছেন। দেবতারা জানাল হিরণ্যকশিপু সকলকে উৎপাত করছে, হরি ছাড়া কেউ তাকে বধ করতে পারবে না। বিষ্ণু তখন এক ভয়ঙ্কর পুরুষের সৃষ্টি করলেন। তাকে বললেন–দৈত্যকে বধ করে ফিরে আসতে।
তাকে দেখে হিরণ্যকশিপু অস্ত্রধারী, প্রহ্লাদ প্রমুখ পুত্র ও দৈত্যদের সঙ্গে স্বয়ং গমন করলেন। সকলে ভাবল হয় এ নারায়ণ নতুবা তার পুত্র। তাকে লক্ষ্য করে দৈত্যরা শর নিক্ষেপ করল। হিরণ্যকশিপুর চারপুত্র তার সাথে যুদ্ধ করতে লাগল, তাকে কোনভাবে বিচলিত করা গেল না। সে দৈতরাজের পুত্রদের পা ধরে ঠেলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। হিরণ্যকশিপু তখন তার বক্ষে পদাঘাত করলেন।
সেই পুরুষ তখন গরুড়ে আরোহণ করে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হলেন। তখন বিষ্ণু অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক সিংহের রূপধারী নৃসিংহ অবতারে দৈত্যর সামনে হাজির হলেন এবং বহ্নির মতো ঘোর এবং করাল দ্রংষ্ট্রারূপ নিয়ে দৈত্য ও দানবদের বিহ্বল করে ফেললেন। হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যেতে বললেন। প্রহ্লাদ যুদ্ধে পরাজিত হল। দৈত্যপতি তখন হিরণ্যাক্ষকে পাঠালেন। পশুপতি অস্ত্রও তার কোনো ক্ষতি করতে পারল না।
প্রহ্লাদ এই কাণ্ড দেখে তাকে বাসুদেব বলে চিনতে পারলেন। তিনি সমস্ত অস্ত্র ত্যাগ করে নারায়ণের স্তব করতে লাগলেন। হিরণ্যকশিপুর দুর্বুদ্ধির কোন অন্ত ছিল না। প্রহ্লাদকে বললেন, যেভাবে হোক একে বধ করতে, প্রহ্লাদ তখন বলল যে, ইনি বিষ্ণু এঁর ক্ষয় নেই। কারো সাধ্য নেই এঁকে বিনাশ করার।
কিন্তু হিরণ্যকশিপু অবুঝের মতো তার সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তখন বিষ্ণু তাকে বিদীর্ণ করলেন নখর দিয়ে। হিরণ্যাক্ষ এই কাণ্ড দেখে পলায়ন করল এবং বিষ্ণু নিজ রূপ ধারণ করলেন।
তখন নারায়ণ প্রহ্লাদকে সিংহাসনে বসালেন। হিরণ্যাক্ষ মহাদেবকে তুষ্ট করে অন্ধক নামক পুত্র লাভ করলেন। সে সকল দেবতাকে জয় করে পৃথিবীকে বন্ধন করল। দেবতারা তখন পাতালে গিয়ে বিষ্ণুকে সবকিছু জানালেন। নারায়ণ তখন তার বধের উপায় রূপে শুভ্র শূকর রূপ ধারণ করলেন এবং হিরণ্যাক্ষ হত্যা করে, পৃথিবীকে দন্ত দিয়ে উদ্ধার করলেন। হিরণ্যাক্ষ নিহত হলে প্রহ্লাদ তার স্বভাব ত্যাগ করে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন। বিষ্ণুর প্রসাদে তার রাজ্য সবরকমভাবে শত্রু শূন্য হয়ে উঠল।
একদিন প্রহ্লাদ কোন এক তপস্বীর পূজা না করলে তিনি অপমানিত হয়ে শাপ দিলেন। বললেন, যে ব্রাহ্মণদের অবমাননা করে তার দিব্য বৈষ্ণবী শক্তি বিনষ্ট হবে। পাপের বলে প্রহ্লাদ নারায়ণের ভক্তি ত্যাগ করে ব্রাহ্মণদের অবমাননা করতে লাগলেন। তখন তাঁর ও বিষ্ণুর রোমহর্ষণ যুদ্ধ হল।
ভগবানের কাছে পরাজিত হয়ে প্রহ্লাদ তাঁরই শরণ নিলেন। এরপর প্রহাদ মহাযোগে নারায়ণপ্রাপ্ত হলেন। বিশাল রাজ্যের অধিকারী হল অন্ধক। সে কামনা করতে লাগল ভগবতী পার্বতীকে। হাজার হাজার গৃহমেধী মুনি পবিত্র দেবদারু বনে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য দুশ্চর তপস্যা করেছিলেন। তারপর অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। এর ফলে প্রাণীদের মৃত্যু হচ্ছিল। ক্ষুধাত মুনিরা গৌতমের কাছে উপস্থিত হলে তিনি তাঁদের অন্ন দেন।
এরপর বারো বছর কেটে গেলে বিপুল বৃষ্টি হল এবং জগৎপূর্বরূপ হয়ে উঠল। মুনিরা সকলে মিলে মহর্ষি গৌতমের কাছে তাঁকে বরণ করলেন। তাতে মুনিরা সকলে এক কৃষ্ণবর্ণ গাভী সৃষ্টি করে মাত্র সে মারা গেল। মুনিরা তখন বললেন, এই গোহত্যার পাপ যতদিন তার শরীরে থাকবে ততদিন তারা আর অস্ত্র গ্রহণ করতে পারবে না। এই বলে তারা পূর্বমত দেবদারু বনে তপস্যা করতে গেলেন।
গৌতম এই ছলনার কথা জানতে পেরে তাদের শাপ দিয়ে বললেন, তারা বেদ বহিষ্কৃত হবেন। বার বার জন্মাতে হবে তাঁদের। তাঁরা মহাদেবের শরণাপন্ন হলে, মহাদেব বিষ্ণুর কাছে জানতে চাইলেন, এঁদের কি গতি করা যায়।
বিষ্ণু বললেন, বেদ বহিষ্কৃত মানুষদের কোন পুণ্য থাকে না। কারণ বেদ বর্ণ থেকেই উৎপন্ন হয়। তথাপি বাৎসল্য বশত এদের রক্ষা করা কর্তব্য তাই তিনি এদের বিমোহিত করার জন্য শাস্ত্র রচনা করবেন। তখন বিষ্ণু শিব একত্রে সোম শাস্ত্র রচনা করলেন। মুনিদের বললেন, এই শাস্ত্রবিহিত কর্ম করতে ও সঙ্গতি লাভ করতে। তখন মুনিরা সকলে মিলে তাদের কথা মতো চলতে লাগলেন।
নিজে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন। ভৈরবকে নিযুক্ত করে নরমুন্ডের মালায় ও প্রেত ভস্মে সজ্জিত হলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ভিক্ষা করেছিলেন। দেবী পার্বতী তখন তাঁর পুত্রকে বিষ্ণুর হাতে সমর্পণ করেছিলেন। এবং দেবগণকে সেখানেই রেখে গিয়েছিলেন। মহাদেবের প্রস্থানের পর দেবতারা রমণীয় স্ত্রীমূর্তি ধারণ করে মহাদেবীকে সেবা করতে লাগলেন। নন্দীশ্বর পূর্বের ন্যায় দ্বার দেশেই অবস্থান করতে লাগলেন।
এই সময় দুর্মতি অন্ধক পার্বতীকে হরণ করার উদ্দেশে মন্দার পর্বতে গেল। শঙ্কর তাকে প্রবেশে বাধা দিলেন। তিনি দৈত্যের বুকে শূল বিদীর্ণ করে দিলেন। অন্ধক, তখন অনেক দৈত্য সৃষ্টি করল। তারা ভৈরবের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধ করতে লাগল। মহাদেব তখন বিষ্ণুর শরণ নিলেন। বিষ্ণু তখন অসুর সংহার কল্পে একশো উত্তম দেবী সৃষ্টি করলেন। বিষ্ণুর মাহাত্ম্যে তারা সহস্র অন্ধককে হত্যা করলেন।
অন্ধক তখন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পলায়ন করল।
বারো বছর লীলা করে হরমন্দর পর্বতে গেলেন। গণেশ্বররা সকলে তাঁর উপাসনা করতে লাগলেন। মহাদেব ভৈরব নন্দী ও কেশবকে দেখতে পেলেন। তিনি নন্দীকে প্রীতি সম্ভাষণ জানালেন। নারায়ণকে আলিঙ্গন করলেন। দেবী শঙ্করকে জয়ের কথা জানালেন। তারপর সকল দেবতারা একত্রে ত্রিলোচনকে দেখবার জন্য মন্দর পর্বত গেলেন।
দেবীরা ভক্তিসহ তাকে প্রণাম করে সাগ্রহে গান করতে লাগলেন। ভগবতী গিরিজা ও দেবাসনে উপবিষ্ট ভগবান নারায়ণকেও তারা প্রণাম করলেন। তাঁরা দেবীকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, সূর্য প্রভাব শালিনী, পদ্মায়তলোচন পুরুষটি কে, তাদের কথা শুনে অব্যয় ভূতেশ্বর বললেন–ইনি জগজ্জননী গৌরী। আর ঐ পুরুষ আত্মা ও ত্রাতা ও পরমপদ গৌরী, নিরঞ্জনা শক্তি এর মধ্যেই বিলীন হয়ে সকল জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। ইনিই সকল প্রাণীর যাবতীয় অবলম্বনের মধ্যে প্রধান।
দেবতা ও গণেশ্বররা সকল ভগবানের কথা শুনে মহাদেব, নারায়ণ ও ভগবতাঁকে প্রণাম করলেন, ও ভক্তি প্রার্থনা করলেন।
তখন সব কিছু ভীষণ অদ্ভুত বলে মনে হল। অন্ধক এই অবসরে মোহবশে পার্বতী হরণে সেখানে আগমন করলে শঙ্কর ও বিষ্ণু একত্রে দৈত্যদের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন। মহাদেব ত্রিশূল নিয়ে আগে যেতে লাগলেন। বিষ্ণু তার অনুগমন করলেন। তারা আকাশ পথে সহস্র আকৃতি ধারণ করলে পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। অন্ধক বাহুবলে সকলকে পরাস্ত করে যুদ্ধ ক্ষেত্রের যে স্থানে অনন্ত জ্যোতি শম্ভু উদ্বিগ্ন চিত্তে সেখানে গমন করলেন।
ভৈরব অন্ধককে আসতে দেখে মহাদেবকে বললেন–তাঁকে হত্যা করতে। বাসুদেবের কথা শুনে হর, অন্ধকের বিনাশ করতে চাইলেন।
সাধুদের শরণ্য ঈশ্বর কালাগ্নির রুদ্র অন্ধককে ত্রিশূলের অগ্রভাগে বিদ্ধ করে নৃত্য করতে লাগলেন। অন্ধককে শূল বিদ্ধ দেখে ঈশ্বর ভৈরব দেবকে প্রণাম করতে লাগলেন। সুন্দরদেহী অপ্সরার আকাশ পথে নৃত্য করতে লাগল।
সমস্ত পাপ বিনষ্ট হল অন্ধকের ভগবানের শূলাগ্রে স্থাপিত হওয়ায়। সে পরমেশ্বরের স্তব করে বলতে লাগল– অনন্ত মূর্তি কালরূপ, পুণ্যস্বরূপ, কবি, জ্বলন্ত, সূর্যসদৃশ, নৃত্যপর রুদ্ররূপ, বিভাগ হীন অমল তত্ত্ব স্বরূপ, সকল জগতের আত্মা, পুরাণ পুরুষ অক্ষর ও পরম পবিত্র ব্রহ্মা, ওঁঙ্কার নির্মুক্তি স্বয়ম্ভুব, নারায়ণ, আদি জগত পিতামহ, বেদান্তগুহ্য, ত্রিশক্তির অতীত, নিরঞ্জনা, ত্রিমূর্তি, জগত আশ্রয়, সহস্র চণ্ডাল, সহস্ৰমূর্তি, পরমতত্ত্ব, চরম সিদ্ধান্ত, জগতের উৎস, অম্বিকাপতি মূঢ়, গুহান্তর ত্রিকালতীত, পুণ্যজ্যোতি, মঙ্গলময়কে নমস্কার।
অন্ধকের স্তবে তুষ্ট হয়ে তাকে শূল মুক্ত করলেন মহেশ। এরপর তারা গণেশ্বরদের অধিপতি করে দিলেন এবং নন্দীশ্বরের অনুচর হয়ে দেবপূজিত হবার কথা বললেন।
অন্ধক দেবতাদের সামনেই ভাস্কর, ত্রিলোচন, নীলকণ্ঠ শূলপানি, গণেশ্বরে পরিণত হন। তাতে দেবতারা তাঁর প্রশংসা করতে লাগলেন। বিষ্ণু তখন বললেন, এই বিপুল, মাহাত্ম্য আপনার উপযুক্ত ভৈরবকে একথা বলে তিনি মহাদেবের কাছে গেলেন। মহাদেবও নিশ্চিন্ত হলেন। মহাদেব হিরণ্যাক্ষ তনয়কে পার্বতী যে বিমানে ছিলেন সেখানে নিয়ে গেলেন।
অন্ধক মাহেশ্বরী ও মহাদেবের চরণ পদে দণ্ডবৎ হয়ে তাঁদের প্রণাম করলেন। এবং স্তব করে বললেন, হিমালয় কন্যা, শিবপ্রিয়া, গিরীশ কন্যা, অজন্মা শৈলজকে প্রণাম এভাবে স্তব করলে দেবী তুষ্ট হয়ে তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। ভৈরব তখন মহাদেবের অনুমতি নিয়ে মাতৃকাদের সঙ্গে পাতালে গমন করলেন। বিষ্ণু সেখানে নরসিংহ মূর্তিতে বিরাজিত।
ভগবান শেষনাগ দ্বারা পূজিত হয়ে নিজ আত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত করলেন। সকল মাতৃকা ক্ষুধায় কাতর হয়ে ত্রিনয়ন মহাদেবকে বললেন–তারা ক্ষুধায় বড় কাতর হয়েছেন। তাঁরা সমগ্র ত্রিভুবন ভক্ষণের অনুমতি চাইলেন। তারা এই কথা বলেই সমগ্র ত্রৈলোক্য ভক্ষণ করতে লাগলেন। ভৈরবদের প্রণত হয়ে নারায়ণের ধ্যান করতে লাগলেন। হরি তার সামনে এলেন। ভৈরব হরিকে মাতৃকাদের কার কথা জানালেন। মাতৃকাদের বিষ্ণু স্মরণ করলে তারা এসে ভৈরবকে নিজেদের সমস্ত শক্তি দিয়ে দিলেন।
হৃষিকেশ এরপর শূলপানিকে বললেন–তার ভক্তদের তিনি সর্বদা রক্ষা করেন। মহেশ্বরের এই অনুপম মূর্তি তারই। এগুলি তার অবস্থাভেদে তামসী মূর্তি লোকমোহিনী নারায়ণী মূর্তি সমস্ত জগৎকে নিয়ত পালন করছে।
মাতৃকাদের এই কথা বুঝিয়ে বললে তারা মহাদেবেরই শরণ নিলেন।
১৭
অন্ধক নিগৃহীত হলে প্রহ্লাদ পুত্র বিরোচন রাজা হয়েছিলেন। তিনি অনেক বছর পর্যন্ত স্থাবর জঙ্গমাত্মক ত্রিভুবন পালন করেছিলেন। একবার সনৎ কুমার বিষ্ণুর আদেশে অসুর রাজ্যের প্রাসাদে এসেছিলেন। তাঁকে আসতে দেখে সিংহাসন ছেড়ে উঠে তার চরণে প্রণাম করে হাত জোড় করে বললেন, আমি ধন্য। কেন ব্রহ্মপুত্র এসেছেন জানতে চাইলেন সনকুমার বললেন, তিনি তাকে দেখতেই এসেছেন। ধর্মপথে চলা দৈত্যদের পক্ষে বেশ কঠিন। অসুররাজ বললেন, পরম ধর্মের কথা কি? দৈত্যপতিকে তখন তিনি গুহ্য ধর্মের উপদেশ দিলেন।
দৈত্যপতি গুরুদক্ষিণা দিলেন। পুত্রের কাছে রাজ্যভার দিয়ে নিজে যোগাভ্যাস করতে লাগলেন।
বিরোচনের পুত্র বলি যে খুব ধার্মিক ব্ৰহ্মনিষ্ঠ ও বুদ্ধিমান। তিনি একসময়, যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন ইন্দ্রের সঙ্গে। ইন্দ্র পরাজিত হলে দেবী অদিতি দুঃখিত হলেন দৈত্য বধ করবে এমন এক পুত্র কামনা করে তপস্যা করতে লাগলেন ও বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। হরি প্রসন্ন হয়ে প্রকট হলেন। অদিতি বললেন, আপনি সকল দুঃখ নাশের হেতু, আপনার আদি, অন্ত নেই, আকাশকল্প আপনি, অমলানন্দ স্বরূপ নরসিংহ, শেষনাগ, সংহার বার্তা কলিরুদ্র বিশ্বমায়া সৃষ্টিকারী অদ্বিতীয় শিব আপনাকে বারংবার প্রণাম করি।
ভগবান দেবমাতার স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রার্থনা করতে বললেন। অদিতি উত্তম বর প্রার্থনা করলেন, এবং তাঁকেই পুত্ররূপে কামনা করলেন। ভগবান বর তথাস্তু বলে দিলেন এবং অন্তর্হিত হলেন। দেবমাতা তাকে গর্ভে ধারণ করলেন। দেবমাতা গর্ভবতী হলে বিরোচন নানা উৎপাত আরম্ভ করল। ভীত হয়ে পিতামহ প্রহ্লাদকে সব জানালেন। বলি বললেন, পিতামহ কেন আমাদের গৃহে এমন উৎপাত আরম্ভ হল।
তখন প্রহ্লাদরাজ বলিকে বললেন–যে দেবমাতা বিষ্ণুকে গর্ভে ধারণ করেছেন দেবতারা যার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না। সেই বিষ্ণু স্বেচ্ছায় অদিতির দেহ আশ্রয় করেছেন। যার থেকে, সকল ভূত সৃষ্টি সেই হরি অদিতি গর্ভে অবতীর্ণ হয়েছেন। বলি প্রহ্লাদের কথায় হরির স্মরণ নিলেন। এবং ধর্মানুসারে রাজ্য পালন করতে লাগলেন।
কাশ্যপের ঔরসে দেবমাতা অদিতি যথাকালে বিষ্ণুকে প্রসব করলেন। শ্রীবৎসচিহ্ন যাঁর বক্ষস্থলে, যাঁর কান্তি নীল মেঘবর্ণ দীপ্তিমান, হরি যথাকালে উপস্থিত হয়ে ভরদ্বাজ মুনির কাছে বেদসমূহ অধ্যায়ন করেছিলেন। এভাবেই সকলকে লৌকিক পথ দেখান প্রভু। তিনি যা করেন তাই লোকে অনুসরণ করে।
বলি কোন এক সময় স্বয়ং যজ্ঞ করে সর্বব্যাপী যজ্ঞাধীশ বিষ্ণুর অর্চনা করেছিলেন। তিনি এই যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের প্রচুর ধন দান করে পূজো করতে লাগলেন। বিষ্ণু ভরদ্বাজের আদেশে বামনরূপে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। তাঁর হস্তে ছিল পলাশ দণ্ড। হরি বেদগান করতে করতে ভিক্ষুক বেশে অসুররাজের কাছে উপস্থিত হয়ে তিন পদক্ষেপ সমান জমি প্রার্থনা করলেন।
সোনার ভৃঙ্গার দিয়ে বিষ্ণুর পাদপ্রক্ষালন করে দিলেন বলি এবং ত্রিপাদ ভূমি দান করলেন এবং. তার করাগ্র পল্লবে সুশীতল জল দান করলেন। তখন ভগবান তিনলোকে তিন পা নিক্ষেপ করলেন। তাঁর পা ব্রহ্মলোক পর্যন্ত চলে গেল সেখানে বাসকারী আদিত্য ও সিদ্ধগণ তার চরণে প্রণত হলেন। ভগবান উপাসনা করে নারায়ণকে প্রসন্ন করতে চাইলেন। কিন্তু সেই চরণ তার কপাল ভেদ করে পবিত্র জল পর্যন্ত চলে গেলেন। সেই জলকে নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গা নামে অভিহিত করা হল, ভগবান বললেন, এই তিন লোক তাঁরই।
প্রহ্লাদ পুত্রের দান গ্রহণ করে হরি তাঁকে পাতালে প্রবেশ করতে বললেন–এবং সর্বদা ধ্যানে নিরত থাকতে বললেন। বিষ্ণু দৈত্যরাজকে একথা বলে ইন্দ্রকে ত্রিভুবন দান করলেন। তখন দেবতারা সকলে বাসুদেবের স্তব করতে লাগলেন। বিষ্ণু এই আশ্চর্য কর্ম সমাধা করে সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন।
বলি প্রহ্লাদের আদেশ নিয়ে অসুরদের সঙ্গে পাতালে প্রবেশ করলেন। বলিরাজ প্রণয়গতি কর্মযোগের সম্বন্ধে জেনে ভক্তির সঙ্গে শঙ্খ, চক্র, গদা, হস্ত, কমল নয়ন ভগবান বিষ্ণুর শরণ করেন।
১৮
বলিরাজের একশো পুত্র ছিল। তাঁদের মধ্যে মুখ্য দ্যুতিমান বান যিনি শঙ্করের ভক্ত ছিলেন। তিনি রাজ্য শাসনকালে ইন্দ্রের ওপরেও অত্যাচার করেছিলেন। দেবতারা তখন মহাদেবের কাছে গিয়ে বলেন, বান তাদের পীড়ন করছে। মহেশ্বর তখন এক তীরে বানপুরী দগ্ধ করেছিলেন। বান তখন মস্তকে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পুরীর বাইরে গিয়ে মহাদেবের স্তব করতে লাগলেন। শঙ্কর বানের স্তবে প্রসন্ন হয়ে স্নেহ করে গণপতির পদ দান করলেন।
দনুপুত্র প্রমুখও অন্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে শম্বর, কপিল, প্রধান, বলে খ্যাত সহস্র গন্ধর্বের জন্ম হয় সুরসারের গর্ভে। প্রমুখ মহানাগেরা ছিলেন কদ্রুর সন্তান। তামার গর্ভে জাত হয় ছয় কান্তা, গাভী তার মহিষীদের প্রসব করেন সুরভি, ইরা হলেন বৃক্ষ, লতা, পল্লী আর তৃণ– জাতির। গরুড় ও অরুণ নামক পুত্রের জননী বিনতা, অরুণ তপস্যার দ্বারা মহাদেবের আরাধনা করলে মহাদেব প্রসন্ন হয়ে তাকে সূর্যের সারথি পদ দান করেন।
এই সকল স্থাবর ও জঙ্গম কশ্যপ সন্ততিদের বিবরণ শুনলে পাপ নাশ হয়। চন্দ্র সাতাশ জন পত্নীর সাতাশ পুত্র হয়েছিল এবং অরিষ্টনেমির চার পত্নীর গর্ভে পুত্রের জন্ম হয়েছিল। ব্রহ্মাসংকৃত ঋষিরা অঙ্গিরার পুত্র, সহস্র যুগ শেষ হলে মন্বন্তরের সময় এঁরা নিজের নিজের কৃতকর্মের সাদৃশ্য অনুযায়ী নিজ নিজ নাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকেন।
১৯
কাশ্যপমুনি প্রজাবৃদ্ধির জন্য সকল পুত্র উৎপাদন করে ঘোরতর তপস্যা শুরু করলেন। তার ফলে তার বৎসর আর অসিত নামে দুই ব্রহ্মবাদী পুত্রের আবির্ভাব হল। বৈভ্য আর নৈধ্রুপ শ্রেষ্ঠ শুদ্র নামক পুত্ররা রৈভ্য থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। নৈবের পত্নী চ্যবন কন্যা সুমেধার গর্ভে কুন্তপায়ী পুত্রদের জন্ম হয়। অসিত পত্নী একপর্ন জন্ম দিয়েছিলেন মহাতাপ। যোগাচার্য দেবল আর সর্ব শাস্ত্রবেত্তা পবিত্র শ্রীসমন্বিত শাণ্ডিল্য মহাদেবের প্রসাদে উত্তম যোগ লাভ করেছিলেন। কাশ্যপের পক্ষে ছিল শাণ্ডিল্য, নৈধ্রুব আর রৈভ্য।
এবার পুলস্ত্য পক্ষীয় নয়জন প্রধান ব্রাহ্মণ ছিলেন। তৃণ-বিন্দু ঋষির এক কন্যা ছিল। তার নাম ইলাবিলা। তাকে পুলস্ত্য মুনির হাতে সমর্পণ করেছিলেন। তার গর্ভে জন্মায় ঐলবিল বিশ্রবা। ঋষির জন্ম হয়। বিশ্রবার চার পত্নী পুপোকাটা রাকা রৈকসী আর দেববর্ণিনী এরা সকলে রূপ লাবণ্যের অধিকারিণী ছিলেন। পুলস্ত্য বংশ বিস্তৃত করেছিলেন। এবার শুনুন এদের পুত্রের কথা।
সকলের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন দেববর্ণিনী বিশ্রবার ঔরসে জন্মায় কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ, ও শূর্পণখা, মহোদর প্রশস্ত, মহাপার্থ খর এবং কুম্ভীনসী পুষ্পেকাটার সন্তান রাকার গর্ভে জন্ম নেয় ত্রিশিরা, দূষণ ও মহাবল বিদ্যুজিহ্ব পুলস্ত্য বংশীয় রাক্ষস বারণ প্রভৃতি দশজন, এরা রত নিষ্ঠুর কার্যে এরা অতি ভীষণ রুদ্রভক্ত ও উৎকৃষ্ট, তপোবল সম্পন্ন। মৃগ, ব্যাল, দ্রষ্ট্রীভূ, পিশাচ, ঋক্ষ্য, শূকর হল পুলহের পুত্ররা।
ক্রতু নিঃসন্তান ছিলেন। মারীচির পুত্র কশ্যপ মহাতপা বেদাধ্যায়নে এবং যোগে রত, হর ভক্ত, দীপ্তিমান দৈত্যগুরু শুক্র ভৃগুর পুত্র বহ্নি ও তার সহোদর কৃশাশ্ব পত্র নৈধ্রুপ ঘৃতাচীর গর্ভে জন্মেছিলেন। নারদ উদ্ধরেতা হয়েছিলেন দক্ষের শাপে, দেবী অরুন্ধতাঁকে তাই বশিষ্ঠের হাতে তুলে দেন।
নারদের মায়ায় দক্ষের পুত্রেরা বিনষ্ট হলে দক্ষও ক্রোধে তাকে শাপ দেন নির্বংশ হবার। শক্তি নামে। এক পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। বশিষ্ঠ অরুন্ধতীর গর্ভে শক্তির পুত্র সুন্দর পরাশর সর্বজ্ঞ আর তপস্বী শ্রেষ্ঠ ছিলেন। শুক নামে জন্ম নিয়েছিলেন শঙ্কর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন থেকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে যে পরম পদ লাভ করেছিলেন, শুঁকের পাঁচ পুত্রই তপোনিষ্ঠ ছিলেন।
২০
অদিতির গর্ভে কাশ্যপের ঔরসে জন্মায় আদিত্য তাঁর ছিলেন চার ভার্যা। এঁদের পুত্রেরা হলেন তৃষ্টার গর্ভে জন্ম নেন, পুত্ৰ পমু রাজ্ঞীর গর্ভে যম, যমুনা ও রেবন্ত ছায়ার গর্ভে সার্বনি, শনি, তপতী। বিনষ্ট ও প্রভার গর্ভে প্রভাত, মনুর জ্যেষ্ঠা কন্যা ইলার থেকে বিস্তার হয় চন্দ্রবংশের। তিনি চন্দ্রপুত্র বুধের সাথে মিলিত হয়ে তার ঔরসে পুরুবরা নামে এক উত্তম পুত্রের জন্ম দেন। তার আরও তিন পুত্র হয়। বীর, রাজা বিকুক্ষি ছিলেন ঈক্ষাকুর জ্যেষ্ঠ পুত্র।
যুবনাশ্ব পুত্রলাভের আশায় গোকর্ণ তীর্থে গমন করেন। ধার্মিক পুত্র পাওয়া যায় কোন্ কর্মের দ্বারা? তিনি নিজে ছিলেন আদ্রকের পুত্র গৌতম তার উত্তরে বলেন অনাদি অনন্ত অনাময় আদি পুরুষ দেবের আরাধনা করলে ধার্মিক পুত্র লাভ হয়। গৌতমের কথা শুনে রাজা বাসুদেবের উপাসনা করতে লাগলেন ও শ্রাবস্তি নামে এক বিখ্যাত বীর পুত্র লাভ করলেন। শ্রাবস্তির তিন পুত্র- দৃঢ়াশ্ব, দত্তাশ্ব ও কপিলাশ্ব।
দৃঢ়াশ্বর পুত্র প্রমোদ, প্রমোদের পুত্র হর্য, হর্যশ্বের পুত্র নিকুম্ভ এবং তাঁর পুত্র সংহতাশ্ব, তাঁর আবার কৃতাশ্ব ও অরুনাশ্ব নামক দুই পুত্র। এর মধ্যে অরুনাশ্বের পুত্র যুবনাশ্ব। মান্ধাতা যুবনাশ্বের পুত্র মান্ধাতার তিন পুত্র- পুরুকুৎস, অম্বরীষ, মুচকুন্দ। এরা ইন্দ্রতুল্য বীর, এদের মধ্যে অম্বরীষের যুবনাশ্ব নামক পুত্র হয়। তাঁর পুত্র হরিত পুরুকুৎসের সদস্যু নামক পুত্র হয়। তাঁর পুত্র সম্ভুতি, পুত্র আনরন্য। তার পুত্র বৃহদ, তার এক হ্য, তার এক ধার্মিক পুত্র হয় বসুমনা, তার আর ত্রিধা নামক এক পুত্র জন্মায়।
বসুমনা অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। বশিষ্ঠ্য ও কাশ্যপ এসেছিলেন এই যজ্ঞে,বসুমনা তখন ঋষিদের কাছে জানতে চাইলেন, তপস্যা ও সন্ন্যাসের মধ্যে শ্রেয় কোনটি? যজ্ঞের দ্বারা বানপ্রস্থ অবলম্বনই শ্রেয়। পুলস্ত্য বললেন, সন্ন্যাস শ্রেয় পুলহ বললেন–তপস্যার দ্বারা মোক্ষলাভ হয়, জমদগ্নির মতও তাই ভরদ্বাজ বললেন–সর্বদেবের অদ্বিতীয় পরমেশ্বরকে পূজা করবে। কাশ্যপ বললেন, শম্ভু তপস্যার দ্বারা পূজিত হলে প্রসন্ন হন। ক্রতুর মতে বেদ অধ্যয়ন শ্রেয়।
বসুমনা এতে আনন্দিত হলেন। যথাবিধি পূজা করে তাদের বিদায় দিলেন। তারপর পুত্র ত্রিধন্ধাকে বললেন, তপস্যার দ্বারা পূজা করতে। রাজা পুত্রের হাতে রাজ্য সমর্পণ করে শ্রেষ্ঠ তপস্যার জন্য অরণ্যে গমন করলেন।
হিমালয়ের চূড়ায় বসে দেবতাদের আরাধনা করতে লাগলেন। তার পাপ দগ্ধ হল। তিনি গায়ত্রী জপ করতে লাগলেন। এভাবে একশো বছর অতিক্রান্ত হবার পর ব্রহ্মা স্বয়ং এলেন তার কাছে। ব্রহ্মাকে দেখে রাজা প্রণাম করে তাঁকে বললেন, আপনি দেবাদিদেব, পরমাত্মা, সহস্র চক্ষু আপনাকে প্রণাম। আপনি বিজ্ঞান মূর্তি বিধাতা, ধাতা, ত্রিমূর্তি, স্রষ্টা, সার্থকদর্শী পুরাণ পুরুষ। যোগীগুরু ব্রহ্মা তাঁকে বর দিতে চাইলে তিনি বলেন, যে তিনি আরো একশো বছর গায়ত্রী জপ করতে চান। যেন এই সময় অবধি তার আয়ু থাকে। ব্রহ্মা তাকে ‘তথাস্তু’ বলে অন্তর্হিত হলেন। এভাবে অতিক্রান্ত হল একশো বছর। আবার সামনে উপস্থিত হলেন ভগবান। উগ্ররশ্মি ক্ষণিকের মধ্যে, তিনি দেখলেন সেই পরম পুরুষ অর্ধনারীশ্বর মহাদেব রূপে অবির্ভূত হয়েছেন। তখন রাজা তাঁর স্তব করতে আরম্ভ করলেন। তাঁকে নীলকণ্ঠ, কিরণময় পরমেষ্ঠী, ত্রয়ীময়, স্বয়ংরুদ্র ইত্যাদি বলে তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ব্রহ্মচারী, মিতহারী, ভস্মনিষ্ঠ আর সমাহিত চিত্ত হয়ে আমরণ জপ করে, সে পরমপদ লাভ করে। রুদ্র তখন রাজাকে আরো একশো বছর আয়ু দান করলেন ও অন্তর্হিত হলেন।
তপস্যারত অবস্থায় রাজা রুদ্র নাম জপ করতে লাগলেন। শরীরে ভস্ম লেপন করে এভাবে আরো একশো বছর কেটে গেল। এরপর পরমপদ প্রাপ্ত হলেন ও মহেশ্বের তত্ত্ব লাভ করলেন।
২১
রাজপুত্র ত্রিধন্ধা পৃথিবী পালন করছিলেন তাঁরও য্যারুন নামে এক বিদ্বান পুত্র ছিল। তাঁর পুত্র সত্যব্রত তাঁর ঔরসে সত্যধনার গর্ভে জন্মায় হরিশচন্দ্র, তাঁর পুত্র রোহিত ও তাঁর হরিত পুত্র, হরিতের পুত্র ধুন্ধ বিজয় ও বাসুদেব ধুন্ধর পুত্র। বিজয়ের পুত্র কারুক। কারুকের পুত্র বুক, বুকের পুত্র বাহু, বাহুর পুত্র রাজা সগর, প্রভা ও ভানুমতী তার মহিষী। ভানুমতীর অসমজ্ঞার নামক এক পুত্র ও প্রভাব ষাট হাজার পুত্র জন্মায়। অসমজ্ঞার পুত্র অংশুমানের পুত্র ভগীরথ চন্দ্রশেখর মহাদেব ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে গঙ্গাকে নিজের শিরঃস্থিত চন্দ্রের উপরিভাগে ধারণ করেছিলেন।
ভগীরথের পুত্র শ্রুত ও শুতের পুত্র লভাগ, তাঁর পুত্র সিন্ধুদ্বীপ, তার পুত্র অয়ুতায়ু মহাবর ঋতুপর্ণ। তাঁর আবার সুদাস নামক এক ধার্মিক পণ্ডিত পুত্র হয়। সুদাসের পুত্র সৌদাস। যার আরেক নাম কল্মষপাদ। মহাতেজা বশিষ্ঠের ঔরসে এই কল্মষপদ রাজার অশ্বক নামে এক ক্ষেত্রজ পুত্র হয়। ইনি ঈম্বা কুকুলের কেতন স্বরূপ। নকুল অশ্মকের পুত্র। তিনি পরশুরামের ভয়ে ক্লিষ্ট হয়ে বনে গমন করেছিলেন ও নারীরূপ কবচ ধারণ করেছিলেন।
শতরথ তাঁর পুত্র ইলবিলি, তাঁর পুত্র বৃহধ্বর্মা, বৃহধ্বর্মা পুত্র বিশ্বসহ খর্দ্বাঙ্গ, খর্দ্বাঙ্গের পুত্র দীর্ঘবাহু, রঘু দীর্ঘবাহুর পুত্র, রঘুর পুত্র অজ ও অজের পুত্র রাজা দশরথ। দশরথের চার পুত্র রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন। পার্বতী জনকের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ত্রিভুবন বিখ্যাত কন্যা প্রদান করেন। ইনি রূপলাবণ্যময়ী ঔদার্যশীল জনক তনয়া সীতা, রামপত্নী।
করেন ত্রিভুবনে যে এই ধনুকে ছিলা পরাতে পারবে সেই তাঁর জামাই হবে। রাম তা জানতে পেরে জনকের প্রাসাদে গিয়ে সেই ধনুক উত্তোলন করে ভেঙে ফেললেন এবং সীতাকে বিয়ে করলেন।
এরপর রাজা দশরথ রামকে রাজা করতে চাইলেন। দশরথের দ্বিতীয় ভার্য্যা কৈকেয়ী অতীতকালে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে তখন নিজ পুত্র ভরতকে রাজা করতে বললেন। রাজা কৈকেয়ীর কথায় রাজি হলেন ও রাম মেনে নিলেন।
এরপর রাম সীতা ও লক্ষ্মণের সাথে বনে চলে গেলেন। তারা চৌদ্দ বছর বনে কাটান। বনের মধ্যে একদিন লঙ্কারাজ রাবণ ভিক্ষুক বেশে সীতাকে হরণ করেন। এরপর শোকাতুর রামের সাথে সুগ্রীব ও অন্য বানরদের বন্ধুত্ব হল এবং রামের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠলেন হনুমান। তিনি সীতার সন্ধানে আসমুদ্র পৃথিবী ভ্রমণ করতে লাগলেন এবং ক্রমে লঙ্কায় গেলেন। সেখানে রাক্ষসী আবৃত সীতাকে দেখলেন।
হনুমান রামের দেওয়া আংটি তাঁকে দেখালেন, সীতা তা দেখে আনন্দিত হয়ে ভাবলেন রামচন্দ্রই বুঝি এসে গেছেন। হনুমান তখন তাঁকে লঙ্কা থেকে উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেলেন।
এরপর রাম ও লক্ষ্মণ, হনুমান ও অন্য বানররা একত্রিত হয়ে সমুদ্রের ওপর সেতু নির্মাণ করলেন লঙ্কায় যাবার জন্য। এরপর সেতু পার হয়ে রাক্ষস বধ করে সীতাকে নিয়ে এসেছিলেন রাম। এই সেতুর ওপর মহেশের লিঙ্গ স্থাপন করে রাম পুজো করলে মহেশ সেই পূজায় সন্তুষ্ট হন ও বর দেন যতদিন পর্যন্ত পৃথিবী থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই সেতু বর্তমান থাকবে এবং তিনিও এই স্থানে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন।
এরপর ভরত রামকে রাজ্য পালনের দায়িত্ব ফিরিয়ে দিলেন। রাম অশ্বমেধ যজ্ঞ করে শঙ্করের পূজা করেছিলেন। লব, কুশ রামের দুই পুত্র। কুশের পুত্র অতিধি, অতিধির পুত্র নিষক, নিষকের পুত্র নল এবং নলের পুত্র মহস্বান, তাঁর পুত্র চন্দ্রায়লোক, তারাপীড় তাঁর পুত্র চন্দ্রগিরি, ভানুচিত্ত ও ভানুচিত্তর পুত্র শ্রুতায়ু।
২২
ইলা পুত্র রাজ্য পালন করতে লাগলেন। পুরুরবার ঔরসে উর্বশীর গর্ভে তার ইন্দ্রতুল্য তেজস্বী দিব্যপুত্র জন্মায়, আয়ু রাহুকন্যা প্রভার গর্ভে পাঁচ বীর পুত্রের জন্ম দিয়েছিল। এঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নহুষ। বিরজার গর্ভে নহুষের পাঁচটি চন্দ্ৰতুল্য পুত্র হয়। এঁদের মধ্যে যযাতিই মহাবলী ও পরাক্রান্ত। তিনি শুক্রকন্যা দেবযানী ও অসুরপতি বৃষপবার কন্যা শর্মিষ্ঠাকে বিয়ে করেন। দেবযানী ও শর্মিষ্ঠার গর্ভে যদু, তুর্বসু, দ্রুহ্যু, অনু ও পুরুর জন্ম হয়। যযাতি জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, তুবসুকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, দ্রুহু্যকে পশ্চিম ও অনুকে উত্তরের আধিপত্য দেন। এবং তিনি স্ত্রীদের সঙ্গে বনে গমন করেন।
যদুর সহস্ৰজিৎ, ক্রেষ্টু, নীল, জিন ও রঘু নামের পাঁচ পুত্র হয়। সহস্রজিতের তিন পুত্র হয়েছিল। রাজা হৈহয়ের ধর্ম নামে বিখ্যাত এক পুত্র হয়েছিল। আর রাজা ধর্মেরও ধর্মনেত্র নামে এক প্রতাপান্বিত পুত্র হয়েছিল। ধর্মনেত্রের পুত্র কীর্তি, কীর্তির পুত্র সঞ্জিত, সঞ্জিতের পুত্র মহিম্মান, মহিম্মানের পুত্র ভদ্রশ্ৰেন্য, ভদ্ৰশ্রেন্যের পুত্র রাজা দুর্মদ, দুর্মদের পুত্র ধীমান ও বীর্যশালী অন্ধক। অন্ধকের আবার কৃতবীর্য, কৃতাগ্নি, কৃতবর্মা ও কৃতৌজা নামে চার পুত্র হয়। কৃতবীর্যের কার্তবীর্যাজুন নামে এক পুত্র হয়।
এর মৃত্যু হয় ভগবান জমদগ্নিপুত্র পরশুরামের হাতে। তাঁর বহুশত পুত্র ছিল। তাদের মধ্যে শূর, শূরসেন ইত্যাদি। পাঁচ পুত্র ছিল ধার্মিক ও মনস্বী। রাজা জয়ধ্বজ নারায়ণ ভক্ত ছিলেন এবং তার শূরসেন প্রমুখ প্রথিতবীর্য মহাত্মা চারজন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রুদ্রের প্রতি ভক্তিশীল হয়ে মহাদেবের আরাধনা করতেন। জয়ধ্বজ হরির শরণ নিলে কার্তবীর্যাজুনের চারপুত্র তাকে বললেন, হে ভ্রাতা, এমন কাজ তোমার করা উচিত না।
জয়ধ্বজ উত্তর দিলেন, এই তার পরম ধর্ম। যখন বিষ্ণু জগৎ পালক, তখন রাজ্য পালনকারী রাজার পক্ষে বিষ্ণু পূজা করা অবশ্যই উচিত। রজঃগুণাশ্রয়ী ব্রহ্মা তার সৃষ্টি করেন আর তমোগুণাবলম্বী মহাদেব তার সংহার করেন রাজ্য পালনে নিযুক্ত রাজাদের পক্ষে ভগবান কেশি, নিমূদন কেশব বিষ্ণুরই অর্চনা করা কর্তব্য।
মুমূর্ষ পুরুষের পক্ষে সংহারকর্তা রুদ্রের পূজাই বিধেয়, বললেন–মনস্বী ভ্রাতাকারক রুদ্রি এই এই জগৎকে ধ্বংস করবেন। শূলপানি বিদ্যামূর্তির দ্বারা সংসারের লয় সাধন করেন।
জীবগণ মুক্তি পেয়ে থাকে সত্ত্বগুণের প্রভাবেই। সত্ত্বগুণের আধার ভগবান শ্রীহরি। সাত্ত্বিক ভাবে রুদ্রের পূজা করলে মহাদেব নিজে সত্ত্বগুণ যুক্ত হয়ে তাদের মুক্তিদান করেন। রাজপুত্র জয়ধ্বজ বললেন, মানুষ নিজের বিহিত ধর্ম আচরণের দ্বারা মুক্তি পেয়ে থাকে। মুনিরা বলেছেন মুক্তিলাভের আর কোন পথ নির্দিষ্ট নেই। বশিষ্ঠ মুনিরা রাজাদের বললেন, দেবতা যার অভীষ্ঠ, সেই দেবতাকেই তার উপাসনা করা উচিত।
বিষ্ণু ও ইন্দ্র রাজাদের দেবতা, অগ্নি, আদিত্য, ব্রহ্মা ও রুদ্র ব্রাহ্মণদের উপাস্য, বিষ্ণু দেবগণের, মহাদেব দানবদের, চন্দ্র যক্ষ আর গন্ধবদের উপাস্য দেবতা। সরস্বতী বিদ্যাধরদের, ভগবান হরি সিদ্ধাদের, ভগবান রুদ্র রক্ষোগণের, পার্বতী কিন্নরগণের দেবতা। ঋষিদের উপাস্য ভগবান ব্ৰহ্ম ও ত্রিশূলী মহাদেব। সমস্তলোকের আরাধ্য দেবতা ভগবান দেবদেব প্রজাপতি বিষ্ণুর আরাধনা করা কর্তব্য। রুদ্রের সঙ্গে হরিকে অভিন্ন জেনে তাঁর পূজা করা উচিত। হরি রাজাদের শত্রুনাশ করেন না।
ভক্তপ্রেমী ভগবান বাসুদেবের আদেশে অযুত সূর্যের দীপ্তি নিয়ে এক চক্র রাজার সামনে আবির্ভূত হল। সেই চক্র গ্রহণ করলেন নারায়ণকে স্মরণ করে। তারপর চক্র ছুঁড়ে মারলেন রাজার দেহের দিকে, এর ফলে তাঁর শির দেহ থেকে ছিন্ন হয়ে গেল।
বিষ্ণু মহাদেবকে তপস্যা করা আরাধনা করে অসুর বিনাশের জন্য চক্র লাভ করেন। এই চক্র অপ্রতিহত হয় অসুর বংশ নিধনের জন্য।
বিশ্বমিত্র বললেন–যাঁর থেকে সমস্ত ভূত উৎপন্ন হয়েছে সমস্ত পদার্থই যাতে নিহিত রয়েছে এবং ব্রহ্মাণ্ড যার থেকে হয়েছে তিনি সর্বভূতাত্মা বিষ্ণু।
ভগবান মহাতপা বিশ্বামিত্র এই পর্যন্ত বলে শূর প্রমুখ নৃপতিদের পূজা গ্রহণ করে নিজের আশ্রমে গমন করলেন। শূরাদি রাজগণ যজ্ঞের দ্বারা রুদ্রের আরাধনা করলেন। বিশ্বামিত্র ও শত্রু দমনকারী রাজা জয়ধ্বজকে দিয়ে ভূতস্রষ্টা আদিদেব জনার্দনের যজ্ঞ সম্পন্ন করিয়ে ছিলেন। জয়ধ্বজ অচ্যুত বিষ্ণুকে রুদ্রের পরমামূর্তি বলে জেনে সযত্নে তার পূজা করেছিলেন। হরি নিজে সেই পূজাস্থলে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
২৩
জয়ধ্বজের পুত্র আলজঙ্খ। তাঁর আবার একশত পুত্র। তাঁরাও একই নামে বিখ্যাত। জ্যেষ্ঠা মহাতেজা বীতহোত্র রাজা হয়েছিলেন। বৃষ প্রমুখ পুণ্যধর্ম অন্য সব যাদব ছিলেন। বংশরক্ষা করেছিলেন বৃষই। তার এক পুত্র হয় মধু নামে। মধুর একশত পুত্র আছে। মধুর বংশ বজায় রেখেছিলেন বৃষণ। বীতহোত্রের পুত্র বিত, তার পুত্র অনন্ত, অনন্তের পুত্র দুর্জয়, তার পত্নী অত্যন্ত রূপবতী ছিলেন এদিকে দুর্জয় ঊর্বশীকে দেখে বলেন তার সাথে দীর্ঘকাল বিহার করতে। ঊর্বশী দীর্ঘকাল দুর্জয়ের সাথে বিহার করতে গেলেন।
বহুদিন পরে রাজার চৈতন্য ফিরলে তিনি রাজপুরীতে ফিরে যেতে চাইলেন কিন্তু ঊর্বশী তার সাথে আরো এক বছর কাটাতে চাইলেন। রাজা তাঁকে আশ্বস্ত করে চলে গেলেন। নিজ পুরীতে ফিরে পতিব্রতা ভার্যাকে দেখে তিনি ভীত হয়ে উঠলেন। তাকে ভয়ে ভীত দেখে স্ত্রী তার কারণ জানতে চাইলেন এবং জ্ঞানচক্ষে সব অবলোকন করলেন।
তখন রাজা পাপক্ষয় হেতু কথের আশ্রমে এসে প্রায়শ্চিত্ত বিধি জেনে নিয়ে হিমালয় উদ্দেশে যাত্রা করলেন পথে। এক অতিসুন্দর মালা সজ্জিত গান্ধর্ব রাজাকে দেখে তার সাথে যুদ্ধে রত হলেন। তার কাছ থেকে মালা নিয়ে ঊর্বশীকে কালিন্দীর তীরে দিতে গেলেন কিন্তু সেখানে ঊর্বশীকে দেখতে পেলেন না। উর্বশীকে খুঁজতে খুঁজতে হেমকূটে গমন করলেন। সেখানে প্রধান অপ্সরারা রাজাকে দেখে কামার্ত হল, কিন্তু রাজা তাদের সাথে রমণ করলেন না। এরপর ঊর্বশীকে সেখানেও না পেয়ে মহামেরুতে গেলেন এবং ক্রমশ মানস সরোবরে উপস্থিত হলেন। সেখানে ঊর্বশীকে পেয়ে তাকে মালা দিলেন, মালা পরে ঊর্বশী জানতে চাইলেন যে, রাজা রাজ্যে পৌঁছে কি দেখলেন? সমস্ত কিছু শুনে ঊর্বশীকে যেখান থেকে আসা হয়েছিল সেখানেই তাকে ফিরে যেতে বলে। না হলে তাকে কন্বমুনির অভিশাপের কবলে পড়তে হবে। রাজা সে সব কথা গ্রাহ্য না করায় তাঁকে ঊর্বশী এক ভয়াবহ লোমশ শারীরিক চেহারা দর্শায়। রাজার কথের কথা মনে আসে আর তাঁকে মনে করে নিজেকে তিরস্কার করে, তাঁর ধ্যানের মধ্যে দিয়ে তপস্যা শুরু করে। তারপর সে কম্বের আশ্রমে পৌঁছলে মুনি তাকে দেখে খুবই খুশি হন এবং উপদেশ দেন– তাঁর অন্তরের যে পাপবোধ তার অন্ত ঘটাতে বারাণসী যাওয়া প্রয়োজন। সেখানেই শিব শঙ্করের প্রত্যক্ষতায় পাপের নিষ্পত্তি ঘটে আর ফল হিসাবে সুপ্রতীক নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম লাভ হয়। রাজার ঔরসে ঊর্বশী সাত পুত্রের গর্ভ ধারণ করে।
ক্ৰোধী রাজার পুত্রর নাম বৃজিনীবন। বৃজিনীবনের পুত্র খ্যাতি। খ্যাতির ছেলে কুশিক, কুশিকের ছেলে বলবান চিত্ররথ। ক্রমান্বয়ে তার ছেলে শশবিন্দু, শশবিন্দুর ছেলে পৃথুযশা, শৃথুযশার ছেলে পৃথুকার্মা, তার ছেলে পৃথুজয়, তার ছেলে পৃথুকীর্তি, তার ছেলে পুথুদান, তার ছেলে পৃথুবা, তার ছেলে পৃথুসাত্তম ও তার ছেলে উশনা, তার ছেলে শিতেষু, তার ছেলে রুক্সকবচ, তার পুত্র পরাবৃত্ত, তার পুত্র জামঘ, তার পুত্র বিদর্ভ, বিদর্ভের পুত্ৰ ক্ৰথ, কৌশিক আর লোমপাদ তৃতীয় লোমপাদের ছেলে বক্ক, তার ছেলে ধৃতি, ধৃতির পুত্র শ্বেত, শ্বেতের পুত্র বলবান বিশ্বসহ, তার ছেলে মহাবীর্য, মহাবীর্যের কৌশিক আর সুমন্ত, তার পুত্র নল কৌশিকের পুত্রের নাম চেদি। তার আবার চেদ্য নামে বহু সন্তান আসে প্রধান যিনি দ্যুতিমান। দ্যুতিমানের বপুমান নামে এক ছেলের জন্ম হয় তার পুত্র বুহমেধা তার শ্রীদেব তার পুত্র বীতদথ। ক্রথের পুত্র কুন্তি, কুন্তির পুত্র ধৃষ্ঠি। তার নাধৃতি তরপুত্র দশাই তার ব্যোমা, তার পুত্র জীমত, তার পুত্র ভীমরথ, ও তারপুত্র নরম। ভারথ একদিন শিকার করার সুবাদে রাক্ষস রূপ দেখে ভীত স্থির হেসে পলায়ন করে।
২৪
সেই দৈত্যের সাতে যুদ্ধ করা সহজ নয়। রোজা সরস্বতী দেবীকে দৃশ্যগোচর হলে মাথা নিচু করে প্রণাম করে। দেবীর স্তবের দ্বারা দেবীকে আহ্বান করে দেবীকে রক্ষা করার অনুরোধ করে। বল প্রয়োগের দর্শন করিয়ে রাক্ষসরাজ সেখানে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল তিন লোকের সন্তান সম্ভবা দেবী সরস্বতী সেখানে অবস্থান ঘটে সেই চন্দ্র সূর্য সন্নি জায়গায় রাজার মৃত্যু ঘটাতে ক্রোধভরে শূল হাতে ওঠায় আর প্রবেশ করে বিশালাকার ভূতের হাতে রাক্ষসকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। রেপরই রাজনকে তার ঘরে প্রত্যাবর্তন করতে বলেন। রাজা তার আপন নগরীতে সরস্বতাঁকে প্রতিস্থাপিত করে। নবরথের পুত্র দশরথও সরস্বতী ভক্ত হিসাবে পরিচিত ছিল। শকুনি তার পুত্র, তার পুত্র করম্ভ দেবরাত, এর দেবতত্ত নামে এক পুত্র জন্মায়। দেবতত্তের পুত্র মধু, তার পুত্র কুরু, কুরুর পুত্র সুত্রমা ও অনু। সুত্রমা পুত্র পুরুকুৎস, তার পুত্র অংশু, তার পুত্র সাত্বত। কৌশল্যার গর্ভজাত ছিল সাত্বত, রাজার ধনুর্বেদ তার মাঝে শ্ৰেত্ব ভজমান। অন্ধক মহাভোজ বৃষিও ও রাজ দেবা বৃধ পাঁচ পুত্র জন্মায়। দেববৃধের পুত্র বস্তু ভজমানেরও পুত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বৃষিত্তর তিন পুত্র অনমিত্রের পুত্র নিম্ন পুত্র প্রসেন ও সত্রাজিৎ নামক দুই পুত্রের জন্ম ঘটে। কোনো একদিন সুবাহু নামধারী এক সন্ধর্ব সাক্ষাৎ লক্ষ্মী তুল্যা হীমতাঁকে সাথে করে পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। হীমতীর পুত্র হিসাবে পৃথিবীতে আসেন সুতেজা জন্ধর্বের মুনে, বেন, সুগ্রীব সুভোগ আর নতবাহন নামক পাঁচ পুত্র হিসাবে পাওয়া যায়।
২৫
হৃষীকেশ পুত্র সন্তানের আশায় ভীষণ তপস্যা শুরু করেন। তিনি একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরের ধ্যানে রত হত। উপমন্যুর আশ্রমে সেই তপস্যাকে কার্যকরী করতে উদোগী হন।
বিশ্বের আত্মা মাধব পাপহীন বনের বালকদের দেখে প্রণাম করে তার আরাধনা করে। দেবকী সন্তান যাদব তার ভক্তি মাধ্যমে সকল তীর্থে আচমন করে দেবতা ঋষি ও মুনি সকল লিঙ্গের আরাধনায় রত হয়।
মাধব তার ভক্তি বলে দেবের স্তবের মধ্যে দিয়ে সকল দেবদেবীর নিকট পায়ে নত হয়ে প্রণাম করে। তখন শিব জানতে চেয়েছিলেন, সে কেন তার জন্যে তপস্যা করছে? কৃষ্ণ তখন বৃষধ্বজকে বলেন যে, তিনি দেবাদিদেবের ন্যায় ও তাঁর প্রতি ভক্তিযুক্ত এক পুত্রের আশা করেছেন। দেবাদিদেব তাঁকে আশীর্বাদ দেয় যেন তার আশাপূর্ণ হয়। প্রসন্ন হৃদয়ে পার্বতীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে কেশবকে বুকে জড়িয়ে ধরে। পার্বতী হৃষিকেশকে বলেন, যে দেবগণ কামনা করার ফলে দেবকীর পুত্র হিসাবে তার জন্মলাভ ঘটেছিল। কেশব আর আপনি আমার নিকট সর্বজ্ঞাত তত্ত্ব সম্পদ। পরম ঈশ্বরের সম্পর্কে জ্ঞান ঈশ্বরের প্রতি অটল ভক্তি আর সব শক্তি হল কাম্য আশীর্বাদ গ্রহণ করা। কৃষ্ণ দেবীর সব বক্তব্য শুনে তাঁর আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। মহেশ্বরও আশীর্বাদের বাণী উচ্চারণ করেন। অতঃপর কৃষ্ণের হস্ত নিজের হস্তে নিয়ে দেবীর সাথে কৈলাসের পথে এগিয়ে যান।
২৬
কৈলাসে পৌঁছে ভগবান মহেশ্বর দেবী ভগবতী আর কেশবের সাথে খেলায় যোগদান করেন। সেইসময় কেশবের বক্ষে ছিল এক অন্যান্য সুন্দর বৈজয়ন্তী হার। তাঁকে দেখতে খুবই অপূর্ব। এই যুবা পুরুষের পদযুগল পদ্মের ন্যায়, চক্ষু দুইও পদ্মের ন্যায়। কৃষ্ণ একদিন লীলা করার সুবাদে গিরিগুহায় ভ্রমণ রত ছিলেন। সেখানে অপ্সরা ও গান্ধর্ব কন্যা সকল তাঁকে দেখে খুশিতে উচ্ছাসিত হয়ে ওঠে। তাদের সকলের বস্ত্রাদি ও শরীরের অলংকার সমূহ খসে পড়ে আর সকলে মনে মনে কেশবকে কামনা করে। মুগ্ধ কুরুঙ্গীক্ষ এক ললনা কামনায় আসক্ত হয়ে হরির মুখ চুম্বন করতে দেখা যায়। দ্বারকার অধিবাসী তাঁর বিরহে অত্যন্ত মুষড়ে পড়ে। গরুড়ও হিমালয়ে কৃষ্ণের দর্শন না হওয়ায় উপমন্যুকে মাথা নত করে প্রণামের শেষে দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করে। মধুসূদন গরুড়ের পিঠে আরোহণ করে তার প্রতি নিষ্ঠাভরে পূজায় রত হয়। তারপর শঙ্খদির দ্বারা সজ্জিত হয়ে সুন্দর শুভ্র আসরে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আসনে দেবীদের মাঝে জ্বলজ্বল করতে থাকে। দেবী উমার পাশে উপবিষ্ট দেবাদিদেবকে যেমন দেখা যায় তেমনি, নারায়ণকে দেখে ঐ রকম উপলব্ধি হয়ে থাকে।
এরপর সকলে মহাদেবের গুণগান করতে থাকে, মহাদেব তাতে খুশি হয়ে তাকে সামনে হাজির হয়। তাঁর রূপ তখন ত্রিশূলধারী ও পিনাকপানি রূপে, দুন্দুভির মতো তার গলার স্বর। তিনি তখন আশীর্বাদ দিতে আগত হলে হরি ও ব্রাহ্মণ মহাদেবের পদযুগল স্পর্শ করে প্রণাম জানায়। তাদের ভক্তি মহাদেবের প্রতি যেন অটল থাকে। মহেশ্বর নিজের মনে প্রশ্ন করে, যে বিষ্ণু নিজে মোহ ত্যাগ করে ব্রহ্মার প্রতি একাগ্র থাকে; এই ভগবানই তার পুত্র হিসাবে জন্ম নেবে আর সে নিজে সমস্ত রাগ পুত্ররূপে কল্পনার অন্তে-ঘোড়ার রূপে তার মুখগহ্বর থেকে নির্গত হওয়ার ঘটনা ঘটবে।
হরি বলেন, এরপরই মহেশ্বর অদৃশ্য হন। সেই থেকেই পৃথিবীতে শিবলিঙ্গকে পূজিত হতে দেখা যায়।
২৭
জাম্ববতীর গর্ভজাত সন্তান শাম্ব জন্মান, তিনি পরিচিতি লাভ করেন এক মহাত্মা রূপে। অনিরুদ্ধ নামে মহাবল পুত্র জন্মায় কৃষ্ণ তনয় প্রদ্যুন্মের। নারায়ণ হরি কংস, তারক ও অন্য যে সব অসুররা ছিল তাদের নিধন করেন অক্লেশে। শত্রু আর মহাসুর বান জন্মলাভ করে। সকল জগতের উদ্ধারে রত হয়ে বিশ্বজগতে সনাতন ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে সাফল্য লাভ করে। তাই সকল মহৎ মহর্ষিরা ভৃগু রূপী সনাতনকে দেখার আগ্রহে দ্বারকায় পৌঁছান। ধীমান বলরামের সাথে ঋষিরা যে যার আসন গ্রহণ করলে বিশ্বাত্মা নারায়ণ প্রণাম ও পূজা সম্পন্ন করে জানায়, হে মুনিগণ, বর্তমানে আমি আমার বিষ্ণুধামে প্রত্যাবর্তন করবো। পরাৎপর ব্রহ্ম প্রাপ্তি ঘটে নারায়ণ প্রতি নিষ্ঠাবান ভক্তদের। দক্ষযজ্ঞের সময় শিবের নিন্দা করার ফলে দধীচি মুনির অভিশাপে যারা জগতে জন্ম নেয় তাদের গ্রহণ করা হয় না।
২৮
ঋষিরা এরপর সূতের কাছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগের মহত্বের বাণী শুনতে চান। কৃষ্ণ পরমপদ লাভ হওয়ায় শত্রু সন্তাপকারী পরম ধার্মিক পৃথা পুত্র অর্জুন তাঁর সাকার ঘটায়। সেই শোকে আকুল হয়ে যায়। অর্জুন কোন দিন কৃষ্ণকে দেখে জানতে চান তিনি কিসের কারণে এখানে–কৃষ্ণকে নদীতীরে উপবিষ্ট দেখে অর্জুন জানায় যে বর্তমানে ঘোর কলি। তাই বারাণসীতে গমন ঘটে। এই কালে লোকে বর্ণাশ্রম ধর্ম ত্যাগের মধ্যে দিয়ে কলিতে জীবের বারাণসীতে ছাড়া প্রায়শ্চিত্ত সম্ভব নয়। যাতে পাপের নাশ হয়। বারাণসীর মানুষরা পরম ধর্মের অনুরাগী। এরপর কালের মহত্ব বর্ণনা মধ্যে দিয়ে সত্য যুগে ধ্যান ও তপস্যা ত্রেতা যুগে রবি দ্বাপরে বিষ্ণু ও কলিযুগে মহেশ্বর। সত্যযুগে সমস্ত জীব সম্প্রদায়ের জন্ম ঘটে। মিথুনরূপে কারোর মনে লোভের চিহ্ন দেখা যায় না। মনে শুধু আনন্দ সুখ, কারোর অবশ্য নিজস্ব কোনো বাসগৃহ ছিল না। তাদের বাস ছিল পর্বতে। তারা মনে মনে উৎফুল্ল ছিল।
ত্রেতা যুগে এসে সেই সুখের নাশ ঘটিয়ে অন্যেরা সেই সুখের ভোগী হল। এই যুগে সকলে জীবিকা নির্বাহ করে। এই সময় প্রজাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। তাদের মনে রাগ ও লোভের জন্ম নেয়।
ত্রেতা যুগে বসে প্রজারা সবদিক দিয়ে রাগ ও লোভের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী সমস্ত কিছু অধিকারে নেয়। ব্রহ্মা তখন সকলের আচরণ বিধি নির্দিষ্ট করার মধ্যে দিয়ে ক্ষত্রিয় সৃষ্টি করে। ত্রেতাযুগে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়।
দ্বাপরে চতুষ্পদ বেদ তিনভাগে বিভক্ত হয়। শাস্ত্রজ্ঞাত ঋষিরা স্ব-জ্ঞানের লক্ষণ অনুযায়ী কোন এক স্থলে সাধারণ অংশ রচনা করে ঋক, যজুঃ ও সামের সংহিতা সংকলন করেন। দোষ দেখা দেয় লোকের মধ্যে এবং দোষ দেখার ফলে দ্বাপরে সেই ধর্মের বিশৃঙ্খল দেখা যায় আর কলিযুগে তার নাশ হয়ে যায়।
২৯
কলিতে মানুষ তমো গুণে আবিষ্ট থাকে, তারা ছলনার দ্বারা সবকাজ সম্পদান করেন। কলিতে দেশে বিপ্লব ঘটে। এই যুগে জাতের পার্থক্যের অবসান ঘটে। একই সাথে শূদ্র ও ব্রাহ্মণরা সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে। জনপদে প্রাসাদের ওপর গৃহে শূলবিদ্ধ থাকে। রমণীদের চুলে লৌহ শলাকা বিদ্ধ দেখা যায়। শুদ্রের ওপর নির্ভরশীল ব্রাহ্মণরা বাহনে উপবেশন করে, শূদ্রের চারিপাশে দাঁড়িয়ে স্তব করে, সেবা করে। কলিতে মহাদেব রুদ্র মানুষের প্রধান দেবতা ছিল, অতএব কলিতে দেবতা ও মানুষের আরাধ্য দেবতারই শরণ করে। এই যুগে সকল পাপ ধুয়ে ফেলতে মানুষরা মহাদেবকে স্তব করে বলেহে দেবাদিদের রুদ্র, চন্দ্র, সাদমঙ্গলময়, স্থানু, বিরূপাক্ষ, ব্রহ্মচারী যোগাধিগম, পিনাকপানি, সংহারনাশক অতীত ও অনাগত তোমায় প্রণাম।
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ স্বয়ং বিষ্ণু, তিনি ছাড়া অন্যের দ্বারা পরমেশ্বর রুদ্রের প্রকৃত স্বরূপ জানা অসম্ভব। মুনিরা বেদব্যাসকে প্রণাম করে।
৩০
কৃষ্ণ বারাণসীতে গিয়ে কি করেন, তা শোনা যাক। তিনি সেখানে গিয়ে গঙ্গাস্নান করে মহাদেবের পুজো করেন। আর মহাদেবকে বলেন সকল জীবের ইন্দ্রিয়ের অতীত কামনাশন গভীর ও গভীরতম যে জ্ঞান সব ভক্তের উন্নতির জন্য বলে দিন। সকলে মহাদেবের দয়ায় অতিরিক্ত দ্রুতো লাভ করে। কাশীতে যেমন ভীষণ সুকৃতি লাভ করা সম্ভব, যেভাবে যজ্ঞ আর ব্রহ্ম বিদ্যার সাহায্যে লাভ করা সম্ভব নয়। কাশীই পরম জ্ঞান ও পরমপদ। বহু জগতেই কাশীতে গঙ্গাস্নানের পূর্ণতা লাভ হয় না বারাণসীতে দেবেশের ভক্ত হয়ে বাস করলে সেই মোক্ষ এবং জন্মই লাভ করা যায়, বারানসীকে ছেড়ে অন্য তপোবনে যাওয়া ঠিক নয়। নারায়ণের থেকে পরম দেবতা আর অন্য কেউ নেই। মহাদেব মহেশ্বরের চেয়ে পরম ঈশ্বর আর কেউ নেই। মুমূর্ষ ব্যক্তি বারাণসীতে সবসময়ে বসবাস করবে, তবেই জ্ঞান লাভ করার মধ্যে দিয়ে মুক্ত হবে।
যাদবের যে বুদ্ধি ছিল সেই বুদ্ধিকে কলিযুগের পাপেতে ঢেকে ফেলেছে। তারা দেখতে পায়না পরমেষ্ঠীর পদ। মহাকাল মহেশ্বর এখানে বসবাসকারী পাপীর পাপের নাশ করেন। এখানে মৃত্যু ঘটলে স্বর্ণ লাভ হয়। সংসার নামক সমুদ্রে পাপী ও পুণ্যবান সকলেই কালানুক্রমে এখানে বসবাস করে মানুষের কথায় বাবা মা কারো কথাতেই বারাণসী যাবার প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করা যায় না।
৩১
ধীমান গুরু দ্বৈপায়ণ মুনি শিষ্যদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে মুক্তিদায়ক ওঙ্কার নামে বৃহৎ শিবলিঙ্গের নিকট যান। বেদব্যাস তাঁর শিষ্যদের সহিত উক্ত লিঙ্গের পূজা করেন। বিশ্বেশ্বর রুদ্র ও শিব বলে প্রচারিত যে তারা সবসময়ে এই কৃত্তি বাসেশ্বর লিঙ্গকে ঘিরে আছেন। বারাণসীতে যে শ্রেষ্ঠ মুনিরা থাকেন তাদের আরাধ্য যে শম্ভু এই রুদ্রকে স্তবের দ্বারা পূজা করেন, তাঁকেই তাঁরা প্রণাম জানান। আমি প্রণাম করছি সেই বিমল জ্যোতিকে যে আভাস পাওয়া যায় পুরাণ-পুরুষ স্থাণু গিরিশকে আশ্রয় করে, আর হৃদয় গভীরে যে রুদ্ররূপ আছে তাঁর স্মরণ করে। তিনিই বহুরূপধারণকারী মহাদেব।
৩২
শূলপানির অব্যয় বাপদীশ্বর লিঙ্গ দর্শনের উদ্দেশ্যে ধীমান বেদব্যাস তিনি পিশাচ মোচন তীর্থে স্নানের অতঃপর পিতৃগণের তর্পণ সমাধান ঘটিয়ে মহাদেবের আরাধনা করেন। সেখানে এক হরিণীকে খাদ্য হিসাবে ভোগ করার সুবাদে অতি দ্রুতবেগে আসে আর হত্যা করে। মৃগীকে সে বিদীর্ণ করে দেয়। হরিণী তখন ত্রিয় ধারণে তার আবির্ভাবে তার শক্তি তেজস্বতা প্রচুর আর তার মধ্যে সূর্যের মতো কিরণ ছটা দেখা যায়। রূপ বিশিষ্ট পুরুষরা তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যা গণেশ্বরের পরিণত হতে মুনিরা ব্যাসকে বাপদীশ্বরের মহত্বর কথা জিজ্ঞাসা করে।
ব্যাস তখন বলেন, বারাণসীতে বসবাস করে বাপদীশ্বরকে দর্শন করে আরাধনা করে স্তব করবে। পিশাচ মোচন কুণ্ডতে স্নান করে ব্রহ্ম হত্যার পাপ লয় পায়। তার পূর্বে শম্ভকর্ণ নামে এক তপস্বী মহাদেবের পূজা করেন। তার একদিন চোখে পড়ে একটি প্রেত ক্ষুধায় কাতর হয়ে লম্বা শ্বাস ত্যাগ করে এগিয়ে আসছে। তখন পিশাচ বলে, সে ছিল পূর্বের জন্মক্ষণে এক ব্রাহ্মণ। তার পুত্র পৌত্র ছিল। একদিন বারাণসীতে বিশ্বেশ্বরকে প্রণামে স্পর্শ করেন ও তার কিছু পরেই মারা যান। এখন সে পিশাচী যোনি প্রাপ্ত হয়েছে। খিদে তেষ্টায় আক্রান্ত ও কাতর হয়ে দিকবিদিক্ জ্ঞান হারায়।
মুনি তাকে পুণ্যবান বলেন, তা শুনে সে ত্রিনেত্রকে মনে করে এক মনে স্নান করেন এবং সে রুদ্রের স্তব করে। যে মানুষ প্রত্যেক দিন মহাদেবের স্তব করে সে মহাদেবের সান্নিধ্য প্রাপ্তি ঘটে আর তার মুক্তিও ঘটে।
৩৩
বেদব্যাস বাপদীশ্বরের নিকট বহুদিন অতিবাহিত করে মধ্যমেশ্বর লিঙ্গ দর্শনে যান। সেখানেই মন্দাকিনীকে দেখে অত্যন্ত খুশি হন। সেখানে বাস ছিল কিছু পশুপতির তারা যখন তাকে দেখে মনে মনে উৎফুল্ল হয়। সেই উৎফুল্ল মনে ব্যাসদেবকে বলেন, আপনি পরমেষ্ঠী দেবের সুবাদে মহেশ্বর বিজ্ঞান লাভ করেন। আপনার মুখ থেকে সে কথা শুনে খুব তাড়াতাড়ি দেবকে দর্শন করেন। তিনি ঈশ্বরের ধ্যান ও পূজা করেন। ব্যাসদেব বলেন–যারা মন্দাকিনীতে স্নান করে শ্রেষ্ঠ মধ্যমেশ্বরের পূজা করেন তারা ধন্য বোধ করবে নিজেকে। এখানে কেউ যদি স্নান, দান, তপস্যা ও শ্রাদ্ধ করে তার সপ্তম কুল পর্যন্ত শুদ্ধ হয়। সূর্য রাহুগ্রস্ত হলে মানুষ সন্ধিক্ষণে স্নান করে যে ফল লাভ করে এখানে স্নান করলে তার দশগুণ ফল লাভ হয়। মহাযোগী একথা বলে মধ্যমেশ্বরে পূজা করে সেখানে বহু সময় কাটায়।
৩৪
বেদব্যাস এরপর অজানা, অচেনা তীর্থস্থানগুলিতে গমন করেন। তিনি যেসব তীর্থস্থানগুলিতে যান–সেগুলি হল– কাল তীর্থ, তীর্থ আকাশ, শ্রেষ্ঠ বায়তীর্থ, জ্ঞানতীর্থ, মহাপবিত্র সমতীর্থ, পরমতীর্থ, সংবর্তক। ঘটোৎকচ তীর্থ, শ্রীতীর্থ, ব্রহ্মতীর্থ। ব্রহ্মতীর্থে বিষ্ণু শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরেই ভূতেশ্বর তীর্থ, শুশভ তীর্থ, প্রভাস, ভদ্রবার্ণ বৃষধ্বজ শিব, মহাতীর্থ ত্রিলোচন বেদব্যাস উপবাস করে এই সকল তীর্থে স্নান করে মহাদেবের পূজা করেন। তিনি যখন কাশীতে থাকতেন, সেই সময় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করেন। ভিক্ষে পায় না আর সে বারাণসী নগরীকে পাপ দিতে চায় শিবপত্নী ছদ্মবেশ ধরে তাকে এই কাজে নিরত হতে বলেন। বেদব্যাস তাঁর পরিচয় জানার পর অনুমতি দেন, অষ্টমী ও চতুর্দশী তিথিতে সে যেন বারাণসীতে প্রবেশ করেন। ভগবতী আশীর্বাদ দিয়ে বলে যান। মানুষ মাত্রই প্রথমে বারাণসীতে বাস করা উচিত। যে কালীর মহত্ব শুনে তাকে পাঠ করে সে পরম গতি লাভ করে।
৩৫
এবার ঋষিরা প্রয়াগের মহত্বের কথা শ্রবণে ইচ্ছুক হলেন। সূত বলতে লাগলেন–মার্কণ্ডেয় মুনি মহাত্মা কুন্তী নন্দন যুধিষ্ঠিরকে যেভাবে বলেন সেই ভাবেই বলে থাকবেন। যুধিষ্ঠির তার ভাইদের সাথে মিলে সকল কৌরবদের বিনাশ ঘটায়, মার্কণ্ডেয় মুনি হস্তিনাপুরে আসায় যুধিষ্ঠির তাঁকে আহ্বান জানান। তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে আরতির দ্বারা তাঁর পূজা করেন এবং পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধজনিত পাপ মুক্তির পদ্ধতি জানার আগ্রহ দেখান। তার উত্তরে মুনি বলেন, মানুষের পক্ষে প্রয়াগে যাওয়াই প্রকৃষ্ট পথ। ব্রহ্মা সেখানে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেন। মুনি তখন প্রয়াগ স্নানের ফলাফল কি হয় তা বর্ণনা করেন যা প্রজাপতির ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত। এখানে স্নান করার মধ্যে দিয়ে পাপী ব্যক্তি পাপ নাশ পূর্বক স্বর্গে পৌঁছায়। প্রাণত্যাগের পর পুণর্জন্ম হয় না। প্রয়াগের আয়তন ষাট হাজার ধনু সেখানে গঙ্গা-যমুনা দুই বয়ে চলেছে। এর রক্ষক সপ্তবাহন সবিতা এখানে ইন্দ্র বাস করে থাকেন। প্রয়াগ যারা দর্শন করেন তাদের পাপত্ব স্খলন হয়। গঙ্গা দর্শনে মানুষের মঙ্গল হয়। গঙ্গাস্নান যারা করেন তারা দেবলোকের পূজা পাওয়ার অধিকারী হন। যে ব্যক্তি প্রয়াগ তীর্থ মনের গোচরে আনে তারা সেই স্মরণের মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মলোকে পৌঁছায়। কোন ব্যক্তি প্রয়াগে গলায় চেলি পরিহিত হয়ে তার দ্বারা আবৃত করে কোন দান করে থাকে তবে সেই পুণ্যে সে সহস্র বছর রুদ্র লোকে বসবাস করে।
৩৬
মার্কণ্ডেয় মুনি যুধিষ্ঠিরকে তীর্থযাত্রার নিয়মাবলি বলেন। যদি কোন ব্যক্তি ষাঁড়ের পিঠে উপবিষ্ট হয়ে প্রয়াগের পথে যাত্রা করেন তবে তাকে ভীষণ ভাবে নরকে বাস করতে হয়। পিতৃগণ এই ব্যক্তির জল গ্রহণ করে না, যিনি গঙ্গা যমুনা মিলনস্থলে বৈভব দিয়ে কন্যাকে দান করে থাকেন, তিনি নরক দর্শন থেকে নিজেকে অব্যাহতি দেন। তিনি রুদ্রলোক প্রাপ্ত হন, তিনি প্রয়াগের বটমূলে প্রাণত্যাগ করে থাকেন। যে বিধি অনুযায়ী গঙ্গা যমুনার মিলনস্থলে স্নান করে থাকে তিনি রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল পেয়ে থাকে। যারা প্রয়াগ লাভ করতে পারে তারা তিন লোক থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। প্রয়াগ দর্শন কালে রাহুগ্রাস থেকে চন্দ্রের মতো সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি ঘটে। রমণীয় ঊর্বশী পুলিনে সুবিস্তৃত হংস পাণ্ডুর ক্ষেত্রে যে প্রাণ ত্যাগ করেন সে ষাট হাজার আর ষাট শত বৎসর পিতৃগণের সাথে স্বর্গে বাস করেন। যে কোটি তীর্থে গিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে থাকে সে সহস্র কোটি বছর স্বর্গে বাস করেন। সর্বস্থানে গঙ্গাকে সেবা করবে। বিশেষ করে প্রয়াগে তো করবেই, ঔষধ নেই ভয়ানক কলিযুগের জন্য গঙ্গাতে যার জীবন ত্যাগ হয়। অনিচ্ছা বা ইচ্ছাতেই সে মরণের পর স্বর্গে পৌঁছে যায়। তাকে আর নরক দর্শন করতে হয় না।
৩৭
মার্কণ্ডেয় বলেন, শত সহস্র গাভী দানের মধ্যে দিয়ে যা, ফল লাভ করা যায়, মাঘ মাসের তিনটে দিন প্রয়াগে স্নান করার ভেতর দিয়েও সেই লাভ হয়ে থাকে। যেখানে গঙ্গা যমুনা দুইয়ের মিলন ঘটে সেখানে শীত এড়ানোর জন্য লোকে খুঁটের আগুন জ্বালায় তার দেহে যত লোম আছে তত সহস্র বছর সে স্বর্গলোকে পুজো পেয়ে থাকেন। নিজের শরীরের অঙ্গ পক্ষীদের দান করলে পক্ষীরা তা ভক্ষণ করে থাকে আর তার ফলে সেই ব্যক্তি শত সহস্র বছর চন্দ্রলোকে পুজো পেয়ে থাকে। সেই স্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে ধর্মশীল গুণবান সৌন্দর্যশালী বিদ্বান প্রিয়ভাষী রাজা হন। যমুনা নদীর উত্তর প্রান্তে প্রয়াগের দক্ষিণে ঋণ মুক্ত নামে এক পরম তীর্থের কথা বলা হয়েছে, সেখানে নাকি যে এক রাত বাস করে, স্নান করে, সে তিন ধরনের ঋণ থেকে মুক্তি পেয়ে থাকে আর স্বর্গলোকে পৌঁছে সে ঋণ মুক্ত থাকে সবসময়ে।
৩৮
যমুনা নদী তীরে সূর্যকন্যা ত্রিলোক প্রতিমার আবির্ভাব ঘটেছিল। যার নামেতে সহস্র যোজন জুড়ে পাপের বিনাশ ঘটে। সেই যমুনার সুশীতল সলিলে স্নান করে তার জল পান করার মধ্যে দিয়ে সমস্ত পাপের থেকে মুক্তি হয় সপ্তম কুল পর্যন্ত স্বর্গলাভ হয়ে থাকে। এই গঙ্গাতীর্থেই মহর্ষিদের খুবই গোপন ও পাপ নাশ করার স্থান আছে, কৌরবরা যেন সে সমস্ত তীর্থে স্নান করেন। মার্কণ্ডেয় মুনি একথা বলেন। সূত বলেন, প্রভাতে উঠে গ্রহ ও জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীর কথা জানা হলে, পাঠ করলে সমস্ত পাপের মুক্তি ঘটে, তারপর পাঠক রুদ্রলোক পৌঁছায়।
৩৯
সূত এবার ত্রিভুবনের কথা বললেন। যে সকল সাগরদ্বীপ বর্ষ পর্বত অরণ্য ও নদী রয়েছে, তার মধ্যে প্রভাবশালী অপ্রমেয় দেব বিষ্ণুকে প্রণাম করে তারই বলা সমস্ত কথা বলা হচ্ছে। মনুর প্রিয়ব্রত নামে পুত্র ছিল, তার প্রজাপতি তুল্য দশ পুত্র ছিল অগ্নি, অগ্নিবাহু, বাহুম্মান, দ্যুতিমান, মেধা, মেধাপিঠ, ভব্য, সর্বম পুত্র এই নজন। মহাবল পরাক্রান্ত জ্যোতিষ্মন ছিলেন তাদের মধ্যে দশম। মহাভাগ মেধা অগ্নিবাহু আর পুত্র যোগনিষ্ঠ ও জাতিস্মর ছিলেন। সাত দ্বীপেতে তার সাত পুত্রকে অভিষেক করেন প্রিয়ব্রত। রাজা অগ্নিকে জম্বুদ্বীপে আর বপুষ্মনকে সান্মালি দ্বীপের অধিপতি নিযুক্ত করেন। প্রিয়ব্রত ভব্যকে শাক্যদ্বীপের রাজা করেন। সবনকে পুষ্কর দ্বীপের রাজা নিযুক্ত করেন। ভব্যের সাত পুত্র জন্ম লাভ করে তাঁরা হলেন- জলদ, কুমার, সুকুমার, মনীচক, কুশেশুর, মোদাকি ও মহদ্রুম। ক্রোঞ্চ দ্বীপের রাজা মহামের যে সকল পুত্র জন্ম নেয় তাঁদের মধ্যে প্রথম কুশল, ক্রমানুসারে মনোহর, উষ্ণ, পীবর, অন্ধকার, মুনি আর দুন্দুভি। প্লকদ্বীপের রাজা হলেন মেধাপিঠ, তাঁর সাত পুত্র জন্মলাভ করেন। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ্যের নাম শিশির, অন্যেনা সুখোদয়, আনন্দ, শিব, ক্ষেমক ও ধ্রুব আর অনুজের।
জম্বুদ্বীপকে ন্যায়সঙ্গত ভাবে নয় ভাগে বিভক্ত করে রাজা পুত্রদের দেন। নাভিকে পিতা দক্ষিণ দিকে হিমবর্ষ প্রদান করেন, কিম্পপুরুষকে হেমকূট বর্ষ দিলেন, তৃতীয় নৈষধ বর্ষ দান করেন। হরিকে নীলাচল বৰ্ষ দান করেন। ইলাবৃতকে কুরুকে উত্তরকুরু বর্ষ দান করেন। ভরতের সুমতি নামে এক পরম ধার্মিক পুত্র জন্মায়। সুমতির তৈজস নামে এক পুত্র জন্মায় তাঁর আবার পুত্রের নাম ইন্দ্রদ্যুম্ন। ক্রমানুসারে তার পুত্র পরমেষ্ঠী, তার পুত্র প্রতিহার, তার পুত্র প্রতিহতা, তাঁর পুত্র ভব, তার পুত্র উদজীয়, তাঁর পুত্র প্রস্তাবি, তাঁর পুত্র পৃথু, তাঁর পুত্র নক্ত, তাঁর পুত্র গয়ু, তাঁর পুত্র কিই, তার পুত্র মহাবীর্য, মহাবীর্যের পুত্র ধীমান, তাঁর পুত্র মহান্ত, তার পুত্র শৌবন, তাঁর পুত্র তৃষ্টা, ত্বষ্ঠা বিরাজ, বিরাজের রজ, রজের শতজিৎ, শতজিতের শত পুত্র। বিশ্বজ্যোতি প্রধান যে ব্রহ্মার বরে ক্ষেমক নামে পুত্রের জন্ম দেয়।
৪০
সূত ত্রিভুবন পরিমাণ বর্ণনা করতে চান পুরাণে ভূর্লোক বলে বর্ণিত হয়ে সূর্য ও চন্দ্রে কিরণ জালে যত দূর উদ্ভাসিত হয় সেই সীমা পর্যন্ত ভূর্লোক। স্বর্গ লোকের সীমা সেই পর্যন্ত যেখানে থাকে আকাশ পথে উধ্বদিকে ধ্রুব নক্ষত্র, বায়ুচক্র বিদ্যমান সেখানে। ভূমি থেকে লক্ষ যোজন দূরে সৌরমণ্ডলে তার অবস্থান। চন্দ্রের বিস্তারের ষোলো ভাগের এক ভাগ শুক্রের বিস্তার, বৃহস্পতি বিস্তৃত রয়েছে যা শুক্রের চেয়ে এক চতুর্থাংশ কম। আবার বৃহস্পতির চেয়ে এক চতুর্থাংশ কম হল শনি ও মঙ্গলের বিস্তার। নক্ষত্র মণ্ডল সর্বপেক্ষা ক্ষুদ্র, এর চেয়ে ক্ষুদ্র জ্যোতিষ্ক আর নেই। হাজার যোজন এই রথের অক্ষরা পথ পঞ্চাশ লক্ষ সত্তর হাজার যোজন, তাতে নির্দিষ্ট নিযুক্ত চক্র। যার তিন নাভি পাঁচ আর ছয় নেমি, অক্ষ বা পথের যা পরিমাণ তা দুটি যুগার্ধেরও পরিমাণ। ব্রহ্মা গুরু জ্যোতিশ্চক্র নিয়ে দক্ষিণ দিকের বিচ্ছিন্ন তীরে ভ্রমণ করেন। মাঝ রাতে তিনি সামনের ভাগে অবস্থান করে থাকেন। সমস্ত যে কোন দিকেই সূর্যের উদয় ও অস্ত ঘটে। সূর্যই তিনলোকের পরম শেষ ও মূল দেবতা। গন্ধর্ব যক্ষ নাগ কিন্নর সকলে সহস্রাংশুকে প্রণাম করেন, শ্রেষ্ঠ মুনিরা নানা যজ্ঞ দ্বারা পুরাতন পুরুষ সূর্যের আরাধনা করেন।
৪১
সূর্যের রথে অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে আদিত্য মুনি গন্ধর্ব অঙ্গরা স্বৰ্প আর রাক্ষসরা দ্বাদশ আদিত্যদের সূর্য বসন্ত প্রভৃতি ঋতুতে এদের আশ্রয় করেন। রাক্ষসরা সূর্যের আগে এগিয়ে যায়। বাসুকি, কঙ্গ, নীল, তক্ষক সর্বশ্রেষ্ঠ; এলাপ শঙ্খ পাল, ঐরাবত ধনঞ্জয় দ্বাদশ সূর্যকে বয়ে নিয়ে যান। ঋতুস্থলা, পুঞ্জীকস্থলা মেনকা সহজন্যা প্রম্নোচা বিশ্বাচী উর্বশী–পূর্ণাচিত্তি বসন্ত প্রভৃতি ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের মৃত্যুর দ্বারা মহৎ সূর্যের তুষ্ট করে বিধান করে থাকে। মুনিরা রবির স্তব করে থাকে নিজের রচিত কথায়। রাক্ষসরা বালখিল্য মুনিরা রবিকে ঘিরে তাকে অস্তে গমন করায়। এর থেকে পাওয়া যায় তাপ, বৃষ্টি ও দীপ্তি, এদের দ্বারা সমস্ত প্রাণীকে রক্ষা করে থাকেন। দিবা-রাত্রির বিভাগ হেতু এই প্রজাপতি সূর্য, দেবাদিদেব মহাদেব তার তেজযুক্ত দর্শনে মহেশ্বর নীলগ্রীব সনাতন সূর্যই দীপ্তি পেয়ে থাকেন। বেদজ্ঞরা একথা বলেন। প্রজাপতি আদিত্য মণ্ডলেই অবস্থিতি করেন।
৪২
কিরণ জালই সমস্ত লোককে প্রকাশিত করে থাকে। সম্পূর্ণ, হরিবেশ, বিশ্বকর্মা, বিশ্বশ্রবা, সংসদ বসু, অবাবসু আর স্বরক এই সাত রশ্মির আলো শ্রেষ্ঠ চন্দ্রকে পরিপুষ্ট করে সুষুন্ন নামে রশ্মি যা বক্রভাবে উর্ধ্বে দীপ্ত হন সূর্যকে আদিত্য বলা হয়ে থাকে দিব্য প্রার্থিব নৈশ, তম আর তেজ দান করে থাকে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা এইসব কিছু পাওয়া যায় সহস্র রশ্মি থেকে। বৃষ্টি জন্ম দিয়ে থাকে চন্দ্ৰবা, গাছ কাঞ্চন শতন ও অমৃত নামে নাড়ী, উষ্ণতার সৃষ্টি করে শুক্লা, কুকুমা ও বিশ্বভূত নামে নাড়ী এরা দ্যুতি দ্বারা পালনের মধ্যে দিয়ে দেবলোক পিতৃলোক ও মনুষ্যলোক তিন ধরনের পদার্থ দ্বারা জগৎ রক্ষা করে থাকেন সূর্যদেব। প্রভু সূর্য বসন্তে কপিল গ্রীষ্ম কাঞ্চন বর্ষায় শ্বেত শরৎকালে পাণ্ডু হেমন্তে তামার ও শীতে লোহা রঙের হয়ে থাকে। সূর্য ঔষধিতে রশ্মি দান করে থাকেন। পিতৃলোকে স্বধা আর দেবলোকে কলা অতএব অমৃত বিলিয়ে থাকেন, এভাবে তিন ধরনের পদার্থ দান করেন। বায়ু চক্র দিয়ে পাঠানো হয়ে থাকে। গ্রহগণ চক্রকারে আগুনের চক্রের মতো পৌঁছে থাকে। এদের নাম প্রবাহ, শুক্লপক্ষে সূর্য পরভাগে অতএব আলাদা আলাদা দিকে অবস্থান ঘটে থাকে বলে তার কিরণজালে চন্দ্রের অন্য ভাগে সব সময়ে সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। যা চন্দ্রের জ্যোৎস্না। পূর্ণিমায় সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিগোচর হয়। পূর্ণিমায় চন্দ্রের অমৃতময়ী, পবিত্র শেষ কলাটি স্বধারূপিণী বলে খ্যাত দুই লব পরিমাণ কাল ধরে ভোজন করেন পিতৃগণ। চন্দ্রের বিনাশ হয় না। পান করা হয়ে থাকে তার সুধা।
আট অশ্বযোজিত বুধ গ্রহের রথেতে বৃহস্পতির সোনার দ্বারা নির্মাণ রথের অশ্বের সংখ্যা হল আট। শনির রথের অশ্ব সংখ্যাও আট, রাহু আর কেতুর ক্ষেত্রেও গ্রহের সংখ্যা এক। নক্ষত্র তারা সকলে ধ্রুব তারায় আটকে এইরকম করছেন ও করিয়েও থাকেন।
৪৩
জনলোক থেকে তপোলোক তিন কোটি যোজনের উপরে এই প্রজাপত্য লোক থেকে সত্য লোক ছয় কোটি যোজনেরও উপরে থেকে থাকে। অপুনমারক ব্রহ্মলোক বলা হয়ে থাকে। মায়াময় পরম যোগী হরি। যেখানে শয়নে থাকা অবস্থানে তার দর্শনকে বলে থাকে পুনর্জন্ম নিবারণকারী বিষ্ণুলোক বলে লোকের কাছে বিখ্যাত। মহাদেব ঋষিগণ ও শত সহস্র যোগীর মনের বিষয়বস্তু হয়ে থাকে, দেবীর সাথে বাস করে থাকে। সেই তলাতল সমস্ত শোভার সৌন্দর্যের আধার হিসাবে পরিচিত। সুতলে বাস করে থাকেন গরুড় প্রভৃতি পক্ষী ও কালনেমি প্রভৃতি অসুরগণ। বিতলকে তারক আর অগ্নিমুখ প্রভৃতি যোজন বিস্তৃত লাভ করে থাকে। বিতল, পাতাল, নাগ, জম্ভক প্রভৃতি অসুর প্রহ্লাদ নাগেদের শ্রেষ্ঠ সম্বল বলে থাকেন। সুন্দর গভীর পাতালে বীর মহাজম্ভ, ধীমান হয়গ্রীব, শঙ্ক বার্ণ ও নামুচি নামধারী অসুরগণ এবং এরকমনাগ বাস করে থাকেন। পাতালের নিম্নদেশ শেষ নামক স্থানে বিষ্ণুর মূর্তি আছে, যিনি কালাগ্নি রুদ্র যোগাত্মা নৃসিংহ মাধব, আনন্দদেব, নাগরূপী জনার্দন বলে খ্যাত, সব কিছুর আধার হলেও কালাগ্নিকে আশ্রয় করে অবস্থিত দেখা যায়। তিনি সহস্র মায়াযুক্ত–যার কোনো তুলনা নেই। শঙ্কর ভবই সংহারকর্তা তমোময়ী শম্ভু মূর্তিই কাল, তিনিই লোকের সংহার করে থাকেন।
88
ব্রহ্মাকে চতুর্দশ প্রকারের বলা হয়েছে। ভুলোক, জম্বুদীপ থাকে প্রধানত সাতটি সাগর ঘিরে মহাদ্বীপ, একটা সাগর থেকে অন্যটি বেশি পরিমাণে বিস্তার করে আছে। সমুদ্রের নাম ক্ষীরোদক, ইক্ষুদক, সুরোদক, ঘুরোদক, দধ্যদক, স্বাদুদক, পৃথিবী বিস্তৃতি পঞ্চাশ কোটি। সবার মাঝে জম্বুদ্বীপ মেরুর উত্তরভাগে রক্ষক আর হিরন্ময় বর্ষ। এরা ভারতবর্ষেরই মতো। সুমেরু রূপ বৃত্তের উচ্চতা দশ হাজার যোজন। এই পর্বতগুলিতে ক্রমান্বয়ে কদম্ব পিপুল বটবৃক্ষ আছে আর জম্বুবৃক্ষ জম্বুদ্বীপের নামের জন্যই। এই গাছের যে ফল তার আয়তন এক বৃহৎ হাতির মতো, যার রস থেকে জম্বু নামক খ্যাতপূর্ণ নদীর উৎপত্তি ঘটে থাকে, সেখানকার বসবাসকারী মানুষ নদীর জল পান করে, যার ফলে জল পানকারী মানুষের জরা বা ইন্দ্রিয় ক্ষয় রোধ করা সম্ভব হয়। নদীর তীরবর্তী মৃত্তিকার রস বাতাসের দ্বারা শোষণ করার মধ্যে দিয়ে জাম্বুনদ নামধারী স্বর্ণে পরিণত হয়ে থাকে।
সিদ্ধগণের বাসভূমি বলে পরিচিত এই পর্বত। সরোবর অরুণোদয়-এর আগে যে কেশবাচল আছে, তাদের নাম- ত্রিকূট, শিকর, পতঙ্গ, রুচক, নিশত, বসুধার, কলিঙ্গ, ত্রিশিখ, কৈলাস আর পর্বতশ্রেষ্ঠ হিমবান, সিদ্ধ আর গন্ধর্বেরা বসবাস করে থাকে ঐ সব পর্বতে। আসিগেদ সরোবরের পশ্চিমে যে কেশরাচলগুলি আছে তাদের নাম শঙ্খ, কূট, হংস, নাগ, মাল, কমল, ময়ূর, কপিল।
এখানে যারা বসবাস করে থাকেন, তারা হলেন- দেব, গন্ধর্ব, সিদ্ধ। সুত বলেন, সুমেরুর উপরি ভাগে দেবদেব ব্রহ্মার চৌদ্দ হাজার যোজন বিস্তৃত বৃহৎ পুরী দেখা যায়। সেই স্থানে বিশ্বাত্মা বিশ্ব ভাবনাকারী ব্রহ্মার অধিষ্ঠান। এই যোগ মুক্ত অধিকারী হল ব্রহ্মা, সিদ্ধ, ঋষি, গন্ধর্ব আর দেবতাদের পূজা পেয়ে থাকে। পরম যোগামৃত পান করে অবস্থান করে থাকে। মহাদেব পার্বতীর সাথে শুদ্ধ আত্মা মুনিদের।
৪৫
পূজা মস্তক দ্বারা গ্রহণ করেন। সুমেরুর দক্ষিণে আছে সংযমানী নামে যমপুরী, সেখানে রাক্ষসরা নিঋতিদেবকে উপাসনা করে। পর্বত রাজার পশ্চিমে বিশাল পুরী এখানে থাকেন বরুণ রাজ। এর উত্তরে বায়ুর পবিত্র পুরী যার থেকে নিঃসৃত গঙ্গা চন্দ্রমণ্ডল প্লাবিত করে ব্রহ্মা পুরীর চারিদিকে ঝরে পড়েছে।
গঙ্গা সমগ্র পশ্চিম গিরিচয় অতিক্রম করে পশ্চিম দিকস্থিত কেতু মালবর্ষ দিয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছেন। মাল্যবান ও গন্ধমান পর্বত নীল ও নিষধ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই চরের মাঝে সুমেরু শোভা পাচ্ছে কর্ণিকার আকারে। পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত গন্ধমাদন আর কৈলাস, ত্রিপুষ্ট আর জারুটি নামে দুটি প্রত্যন্ত পর্বত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত হয়ে সমুদ্র পর্যন্ত অবস্থিত।
কেতুমালা বর্ষের অধিবাসীরা কৃষ্ণকায়। এরা ভোজন করে কাঁঠাল, পদ্ম পত্রের মধু। রক্ষক বর্ষে যে সব নারী পুরুষ বিহার করে তাদের গাত্রবর্ণ রজতের মতো। হরিবর্ষে ধূসরবর্ণ নারীগণ ইক্ষুরস পান করে দশ হাজার বছর জীবিত থাকে। সেখানকার পরিজাত বনে বাসুদেবের এক প্রাসাদ আছে। যার সোপানগুলি সোনার, দিব্য সিংহাসন রয়েছে, এখানে শোভিত করে আছে স্বাদু পানীয় জলের সরোবর, ইলাবৃত বর্ষে পদ্মকান্তি নরনারীর জন্ধু ফলের রস পান করে সহস্র বৎসর জীবিত থাকে।
তারা নানা দেবতার পূজা করে। তাদের কর্মও নানা প্রকার। এদের আয়ু একশত বৎসর। এই ভারতবর্ষে কর্মের জন্য জন্ম হয় অধিকারী ব্যক্তিদেরই। এই বর্ষের মধ্যগণে যারা বাস করে তারা যজ্ঞ, সংগ্রাম, বাণিজ্য আর উপজীবিকা ভেদে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র হয়ে থাকে। হিমালয় পাদদেশ থেকে নিঃসৃত হয়েছে শতদ্রু, বিতস্তা, বিপাশা, গোমতী ও লোহিনী, সহ্যাদ্রি পর্বত থেকে নির্গত নদীগুলি স্ববান পর্বতের পাদদেশে থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এই সকল নদী নির্গত শতশত উপনদী আছে। ভারতবর্ষে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি চার যুগের বিভাগ কিম্পুরুষ প্রভৃতি যে আট বর্ষ আছে। তাতে পরিশ্রম ক্ষুধার ভয় নেই।
সূত বললেন, ব্রহ্মার, মহাকূট নামে স্ফটিক নির্মিত এক সুন্দর বিমান আছে। দেব গিরিশ পিনাকী মহেশ্বর ভূতগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে মহাদেবীর সঙ্গে যেখানে মনোরমা মন্দাকিনী প্রবাহিত যার জল পান করে দানব, রাক্ষস ও কিন্নরগণ। সেখানে প্রবাহিত আরও অন্য শত শত নদী দেব ব্রহ্মা ও নারায়ণের স্থান। এদের তীরে বসুধার পর্বতে রত্নমণ্ডিত পবিত্র অষ্টবসুর ভবন আছে। সেখানে দেবর্ষি ব্রহ্মা সিদ্ধ ব্রহ্মর্ষি আর অন্য দেবদেব অঙ্গ পিতামহ ব্রহ্মাকে উপাসনা করেন।
এই পর্বতের শৃঙ্গে আছে এক বিশাল সরোবর, যা বহুল পদ্মে সেবিত। সেখানে আছে ভোগীষব্যের পুণ্যাঞ। সেখানে সহস্র গুণের মতো উজ্জ্বল সুমেঘ নামে বাসবের স্থান আছে। সেখানে ভগবতী অধিষ্ঠান করেন। নানাপ্রকার ঋতু দ্বারা উজ্জ্বল সুশীল নামে গিরিশৃঙ্গে রাক্ষসদের অনেক নগরী আর সরোবর আছে। সেখানে বিশাল পর্বতে যক্ষদের শত শত নগরী আছে। বিচিত্র বৃক্ষশ্রেণীতে শোভিত পাণ্ডুর পর্বতের শিখরে আছে দিব্যাঙ্গ নদের দ্বারা ব্যাপ্ত শতশত গন্ধর্বপুরী। অঙ্গ গিরির শৃঙ্গে আছে একটি সুন্দর সুরম্য নগর সেখানে রতি সুম্ভে বাস করে থাকে রম্ভা প্রমুখ অপ্সরারা। পঞ্চ শৈলর শিখরে দানবদের তিন পুরী আছে। আর অল্পদূরে ধীমান দৈত্যাচার্য শুক্রের পুরী বিদ্যমান। সুগন্ধ পর্বতের শিখরে নদী তরঙ্গে মনোরম পুণ্যাশ্রম আছে। সেখানে ভগবান কর্দম ঋষি থাকেন। মুনিদের স্থাপিত আর সিদ্ধদের চিহ্নিত পুণ্য বনভূমি আর আশ্রমের সংখ্যা গুণে শেষ করা যায় না।
চারদিকে ক্ষীর সাগরকে ঘিরে আছে প্লক্ষ দ্বীপ। এই দ্বীপে সিদ্ধগণের দ্বারা সেবিত সাতকুল পর্বত আছে। সেখানে ঋষি, গন্ধর্ব আর সিদ্ধেরা ব্রহ্মাকে উপাসনা করে থাকেন। এখানে অতি পবিত্র সব জনপদ আছে। এখানকার নরনারীরা পাপকর্ম করেনা। এই সাতবর্ষ পর্বতে সাত নদী আছে সমুদ্রগামিনী। এছাড়া বহু ক্ষুদ্র নদী আর সরোবর আছে। এখানকার নর-নারীরা চিরজীবী। সেখানকার সকল অধিবাসীই ধর্মনিয়ত ও আনন্দচিত্ত।
প্লক্ষ দ্বীপের দ্বিগুণ সাল্মলি দ্বীপ, সেখানে সাত কুল পর্বত ও সাত নদী আছে। এই সকল বর্ষে লোভ, ক্রোধ বা যুগধর্ম নেই। লোক রোগশূন্য শরীরে জীবনযাপন করে। এখানে শূদ্ররা কৃষ্ণবর্ণ হয়। সাল্মলি দ্বীপের দ্বিগুণ হল কুশাদ্বীপ, এটির চারদিকে বেষ্টন করে আছে ক্ষীর সমুদ্রকে। এখানে সাত কুল পর্বত বর্তমান, সাত নদী প্রবাহিত, মণি তুল্য স্বচ্ছতোয়া নদীও প্রবাহিত সেখানে দেবতারা ব্রহ্মা ও ঈশ্বরকে উপাসনা করেন। মর্ত্যলোকে যারা জ্ঞান সম্পন্ন মৈত্রী গুণযুক্ত যারা কর্মানুষ্ঠান করেন সকল প্রাণীরা হিতকার্যে নিরত থাকেন এবং নানাপ্রকার যজ্ঞ দ্বারা পরমেষ্ঠী ব্রহ্মাকে উপাসনা করেন, তাদের ব্রহ্ম সাযুজ্য মুক্তি লাভ হয়।
শাকদ্বীপের বিস্তার ক্রৌঞ্চ দ্বীপের দ্বিগুণ, এটি চারদিকে বেষ্টন করে আছে দধি সমুদ্রকে। এখানেও সাতকুল পর্বত এবং সাত সমুদ্র আছে। এখনকার মানুষরা সূর্যের অর্চনা করে এবং তার প্রসাদে তাদের মুক্তি লাভ হয়ে থাকে। শাকদ্বীপকে বেষ্টন করে আছেন শ্বেত দ্বীপ। এখানে নারায়ণে সমর্পিত চিত্ত বিষ্ণু ভক্ত শ্বেতকায় মানবগুণ জন্মগ্রহণ করে।
এখানকার মানুষরা লালসাহীন সদানন্দময় নারায়ণ তুল্য। কেউ বা নিষ্ঠাসম্পন্ন আশ্রয় শূন্য ও মহাভাগ। সেস্থানের প্রাসাদ মালায় সজ্জিত সুবর্ণ প্রাচীর যুক্ত স্ফটিকময় উজ্জ্বল, নারায়ণ নামক সুন্দর পুরী আছে। নানা রত্ন ও গোপুর এই পুরীর সৌন্দর্যবর্ধন করেছে। তার মধ্যে কোথাও নদী ও সরোবর শোভা পাচ্ছে। সেই অতুল্য পুরীতে নানা সঙ্গীত বিশারদ অপ্সরারা স্থানে স্থানে নৃত্য করছে। এরা নানা প্রকার ভোগে ও রতির বিষয়ে অত্যন্ত অভিলাষী। এখানে ভগবান হরি শেষ নাগ শয্যায় শয়ন করছেন তাঁর পদমূলে অবস্থান করেছেন লক্ষ্মীদেবী। নারায়ণ থেকেই জগৎ উৎপন্ন তার মধ্যে মহাপ্রলয়ের সময় জগৎ প্রবেশ করবে, অতএব ইনিই একমাত্র পরমগতি।
পুস্কর দ্বীপের বিস্তার শাক দ্বীপের বিস্তারের দ্বিগুণ। এই দ্বীপে মানষেও নামে একটি পর্বত আছে পুস্কর দ্বীপকে বেষ্টন করে আছে একটি সুস্বাদু জলের সমুদ্র। দেবতাদের পূজিত একটি বিশাল বটবৃক্ষ আছে। তাতে বাস করেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার তুল্য রূপবান প্রজারা সুস্থ, নীরোগ আর রাগ-দ্বেষ বিহীন।
সাত মহালোক আর পাতালের কথা বলা হল। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে চোদ্দটি করে ভুবন আছে। সাত অপ্সরা ব্রহ্মাণ্ডকে সব দিক থেকে ঘিরে রেখেছে, তিনি সর্বত্রগামী, সকল প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান, তিনি সর্বত্র পূজিত মহেশ্বর।
সূত বললেন, অতীত হয়েছে এ পর্যন্ত দুজন মনুর অধিকার। প্রথমে স্বায়ম্ভুব মনু ও স্বরোচিত উত্তম তামস, রৈবত ও চাক্ষুস এই দুজনে এই সময় কাল ঋষি উর্জ স্তম্ভ, প্রাণ, দম্ভেই বৃষর্ভ তিহির আর অচরীবান।
উত্তম নাম মনুর তৃতীয় মন্বন্তরে এত অশ্রুনাশক সুশনি নামে দেবরাজ পঞ্চম মন্বন্তর মনুর নাম রৈবত দেবরাজের নাম বিভু। রৈবত মন্বন্তরে সাতজন ঋষির নাম হিরণ্যরোণা, উৰ্দ্ধবাহু, বেদবাহু, সুবাহু আর সুপর্দুন্য। এই মন্বন্তরে অতুলনীয় ও সত্ত্ব গুণাবলী বিষ্ণু শক্তি রক্ষার জন্য অবস্থিত। উত্তম মন্বন্তরে শ্রেষ্ঠ দৈব সত্যরূপ জনার্দন বিষ্ণু সতার গর্ভে সত্য নামে উৎপন্ন হন। তামস মন্বন্তর উপস্থিত হলে তিনি আবার হৰ্মার গর্ভে হরিরূপে উৎপন্ন হয়েছিলেন। বৈবস্বত মন্বন্তর উপস্থিত হলে বিষ্ণু কাশ্যপের ঔরসে অদিতির গর্ভে বামনরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাত মন্বন্তরে ভগবান সাতরকম শরীর ধারণ করেছিলেন। বৈষ্ণবী পরমা তনু প্রলয়কালে সকলের নিধন করে থাকে। বাসুদেবের চতুর্থ মূর্তিটি রাজোগুণশ্রিতা। বিষ্ণু নারয়ণ স্বয়ং হরিই স্বেচ্ছায় বিশুদ্ধচিত্ত কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ ব্যাসরূপে জন্মগ্রহণ করেন।
সূত বললেন, এই মন্বন্তর কালে প্রথম দ্বাপর যুগে প্রভু মহাত্মা স্বায়ম্ভুব মনু, ব্যাস হন তিনি বেদকে বহুভাগে বিভক্ত করেন। অষ্টাদির দ্বাপরে কুবত, দ্বৈপায়ণ ব্যাস হয়েছেন। ইনি সবার দেব আর পুরাণ প্রদর্শন করেছেন, যজুর্বেদ এক ছিল তাদের চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তার দ্বারা চাতুহোত্র যজ্ঞ হয়েছে। ঋক মাত্র দ্বারা হয়েছে হোত্র। ব্যাস পুরাণকে ভাগ করলেন আঠাশ ভাগে সনাতন বাসুদেবকে একমাত্র বেদসমূহের দ্বারা জানা যায়। বেদনিষ্ঠ মুনিরা বেদকে বা বেদবিদ্যাকে জানেন। এই বেদবেদ্য ভগবান বেদমূর্তি মহেশ্বরই একমাত্র ধ্যেয় ও বেদস্বরূপ, তাকে আশ্রয় করলেই মুক্তি হয়।
দ্বাপর যুগে বেদব্যাসের অবতারের কথা বলা হল, কলিযুগের মহাদেবের অবতারদের কথা বলি শুনুন। দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ কলি পর্যন্ত যথাক্রমে সুতার, মদন, সুহোত্র, কঙ্কণ যোগীন্দ্র আর লোকক্ষি মহাদেবের অবতার হয়েছিলেন, বৈবস্বত মন্বন্তর শেষ কলিযুগে কায়াক তীর্থে দেবতা নরকাস্বর মহাদেবের অবতার। এই অবতারদের দুন্দুভি, সাতরূপ ঋচীকে কোতুমান, বিজ্ঞান, কুমার, সনক সনন্দ, সনাতন এরা তেজস্বী, গর্গ, ভার্গব, অজ সারস্বত মেঘ ঘমবাহ উগ্ৰাসান, কুমি কুকীরর কশ্যপ, কুমার সকলে নির্মল, ব্রহ্মভূমি স্থিত ও জ্ঞানযোগ পরায়ণ, এঁদের যারা স্মরণ ও নমস্কার করেন তাঁরা ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করবেন। বৈবস্বত মন্বন্তরের কথা সবিস্তারে বললাম, ব্রাহ্মণ্যবর্ণ মন্বন্তর দশম মন্বন্তর এখানে মনুর নাম ভবিষ্যতে যে এই বিবরণ পাঠ করে তার সকল পাপ মুক্ত হয়।