১. কুংফু গাড়ি

এখন তখন মানিক রতন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ প্রথম মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

.

উৎসর্গ
প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ
সালেহা সুলতানা (এমিলি)
দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফিরে আসার পর আমার জীবনে যে কয়টি আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে তার মাঝে একটি হচ্ছে এই দুজন মানুষের সাথে পরিচয়

.

কুংফু গাড়ি

মানিকের সাথে রতনের পরিচয় হয়েছে প্রায় বছরখানেক আগে। মানিক হচ্ছে একজন কবি আর রতন হচ্ছে একজন বিজ্ঞানী, দুইজনের কাজকর্ম একেবারে আলাদা আলাদা জায়গায়। তাদের কখনো দেখা হওয়ার কথা না। মানিক যখন পুরানো বইয়ের দোকানে উইয়ে খাওয়া বই ঘেঁটে বেড়ায় রতন তখন পুরনো ঢাকার ধোলাইখালে ভাঙা যন্ত্রপাতি টানাটানি করে। বৃষ্টির দিনে মানিক যখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ঢুলুঢুলু চোখে কবিতা পড়ে রতন সেই সময় তার ল্যাবরেটরিতে কোনো একটা বিদঘুঁটে যন্ত্রের উপর উবু হয়ে বসে থাকে। গভীর রাতে মানিক যখন নিউজপ্রিন্টের কাগজে বলপয়েন্ট কলম ঘষে ঘষে উত্তর-আধুনিক কবিতা লেখার চেষ্টা করে রতন তখন কম্পিউটারের সামনে বসে জটিল কোনো যন্ত্রের ডিজাইন করে–কাজেই তাদের দুইজনের দেখা হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। তারপরেও মানিক আর–রতনের একদিন দেখা হয়ে গেল আর যেভাবে দেখা হলো সেটা রীতিমতো একটা কাহিনি।

ঘটনাটা ঘটেছে এভাবে–মানিক সিলেটে গিয়েছে “তরুণ কবি সম্মেলনে”, টানা দুইদিন আধাখ্যাপা শ খানেক কবির সাথে সময় কাটিয়ে ঢাকা ফেরত যাবার সময় ভাবল শ্রীমঙ্গলের বন থেকে একটু ঘুরে আসবে। সে যেহেতু একজন কবি মানুষ তাই তার গাছপালা-পাখি-প্রজাপতি-নদী মাঠ-আকাশ-মেঘ এইসব দেখতে খুব ভালো লাগে। বেচারার কপাল খারাপ, থাকে ঢাকা শহরে তাই তাকে দেখতে হয় রাস্তা-ঘাট-বাস-টেম্পো ট্রাফিক-জ্যাম আর বদমেজাজি মানুষ। শ্রীমঙ্গল যাবার জন্যে সে তার শান্তিনিকেতনি ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে বাসস্টেশনে হাজির হলো, রিকশা থেকে নামার আগেই চারদিক থেকে চারজন মানুষ তাকে ঘিরে ফেলে টানাটানি করতে থাকে। যেই মানুষটার গায়ে মোষের মতো জোর সে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে অন্যদের সরিয়ে মানিককে ধরে টেনে হিঁচড়ে এনে জোর করে গাদাগাদি করে বোঝাই একটা বাসে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। মানিক ঘটনাটায় এত ভড়কে গেল যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। একটু পরে একটু শান্ত হয়ে নরম গলায় বলল, “ভাই, আমাকে এই বাসটিতে কেন তুলে দিলেন?” সে কবি মানুষ তাই কখনো গলা উঁচু করে না কখনো রেগে যায় না।

মোষের মতো মানুষটার অবশ্যি কিছুই শোনার সময় নেই, ঠিক তখন স্কুটার থেকে একজন মানুষ নামছিল তাকে ধরে আনার জন্যে সে ছুটে চলে গেল। মানিক তখন আবার অত্যন্ত দ্রভাবে শুদ্ধভাষায় নরম গলায় মিষ্টিভাবে বাসের হেলপারকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, আমাকে কেন এই বাসটিতে জোর করে তুলে দিল?”

হেলপার খুব মনোযাগ দিয়ে তার কেনে আঙুল দিয়ে প্রচণ্ডবেগে কান চুলকাচ্ছিল, সে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “এইটা আবার কেমন প্রশ্ন? আপনি বাসে যাবেন সেই জন্যে বাসে তুলেছে। এরোপ্লেনে গেলে এরোপ্লেনে তুলত, জাহাজে গেলে জাহাজে তুলত–“

মানিক বলল, “কিন্তু আমি কোথায় যাব সেটি তো একবারও জানতে চাইলেন না ভাই।”

“সেইটা জানার দরকার কী? এই দেশে যাওয়ার জায়গা একটাই। ঢাকা। সবাই ঢাকা যায়। সবসময় ঢাকা যায়। সকালবেলা ঢাকা যায়, দুপুরবেলা ঢাকা যায়, সন্ধ্যাবেলা ঢাকা যায় মাঝরাত্রেও ঢাকা যায়।”

“আমি তো ভাই ঢাকা যেতে চাইছি না। আমি যাব শ্রীমঙ্গল।”

“ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আপনারে আমাদের কোম্পানির শ্রীমঙ্গলের বাসে তুলে দিমু। ফার্স্টক্লাস বাস, ওড়ায়া নিয়া যাব।”

মানিক কবি মানুষ তাই রাগ হতে পারল না, মিষ্টি করে বলল, “কিন্তু ভাই সেটা তো উল্টো দিকে যাওয়া হলো। তাছাড়া যে বাস রাস্তা দিয়ে উড়ে যায় আমি তো সেই বাসে উঠতে চাই না। বাস যাবে রাস্তা দিয়ে, উড়ে কেন যাবে?”

হেলপার দ্বিগুণ বেগে তার কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, “নেন, নেন, প্যাচাল পাইরেন না। যাইতে চাইলে যান না চাইলে নাইমা যান।”

মানিক তর্কবিতর্ক না করে নেমে গেল, তাকে নামতে দেখে অন্য বাসের কয়েকজন তাকে টানাটানি করার চেষ্টা করতে চাইছিল কিন্তু মানিক এবারে আগের থেকে সতর্ক ছিল বলে তারা সুবিধা করতে পারল না।

মানিক তখন শ্রীমঙ্গলের বাসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। যে বাসগুলোর রঙ ক্যাটক্যাটে বেগুনি কিংবা বিদঘুঁটে হলুদ সেগুলো সে। বাতিল করে দিল। কোনো বাসের ড্রাইভার কিংবা হেলপারের চেহারা পছন্দ না হলেও সে সেই বাসে উঠল না। শেষ পর্যন্ত সে যে বাসটাতে উঠল সেটা মোটামুটি সুন্দর একটা বাস, ড্রাইভারের চেহারায় এক ধরনের গাম্ভীর্য আছে, বাসের সিটগুলো নরম এবং একটু পা ছড়িয়ে বসার ব্যবস্থা আছে। মানিক জানালার কাছে আরাম করে বসে, বাস যখন চলতে থাকে তখন জানালা দিয়ে বাইরের মাঠঘাট নদী গাছ দুরন্ত কিশোর দেখতে তার খুব ভালো লাগে।

বাসটা ছাড়তে একটু দেরি হলো কিন্তু তাতে মানিকের কোনো সমস্যা হলো না, তার কখনো কোনো কিছুতে তাড়াহুড়া থাকে না। বাস যখন শহরটা পার হয়ে গ্রামীণ এলাকায় চলে এল তখন মানিকের ভেতর এক ধরনের শান্তি শান্তি ভাব চলে এল। কিছুক্ষণ সে মনে মনে জীবনানন্দ পাশের কবিতা আওড়াতে থাকে এবং তখন হঠাৎ করে তার মাথায় একটা কবিতার লাইন চলে আসে–”দেখা হবে ঘুংচিতে বেলা হবে অবেলা” কিন্তু সমস্যা হলো ঘুংচি বলে কোনো শব্দ তার জানা নেই। কিন্তু সেটাকে সে মাথা থেকে দূর করতে পারছিল না। যখন প্রায় একটা নতুন শব্দ মাথায় চলে আসছিলো ঠিক তখন হঠাৎ করে বাসটা রাস্তার পাশে থেমে গেল। হেলপার বাসের গায়ে বাবা মারতে মারতে বলল, “লামেন। লামেন। হলে লামেন।”

মানিক অশুদ্ধ ভাষা সহ্য করতেই পারে না প্রায় বলেই ফেলছিল “শব্দটা লামেন নয় শব্দটা নামেন এবং হলে নয়–শব্দটা হচ্ছে সকলে” কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেমে গেল কারণ সে দেখতে পেল প্যাসেঞ্জার এবং বাসের হেলপার আর কনডাক্টরের মাঝে একটু উত্তেজনার মতো ভাব হয়েছে। মানিক বাস থেকে নেমে জানতে পারল এই বাসটি আর যাবে না, সবাইকে নেমে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মুড়িরটিন মার্কা লক্কর-ঝক্কর বাসটিতে উঠতে হবে। সেই বাসটি শুধু যে মুড়ির টিন তাই নয় তার রং ক্যাটক্যাটে বেগুনি এবং দগদগে হলুদ। কাছে গিয়ে মানিক দেখল, ড্রাইভারের চেহারা ডাকাতের মতো, গলায় সোনার চেন, চোখ লাল, দাঁত কালো। মানিককে দেখে ড্রাইভার বলল, “উঠেন উঠেন, তাড়াতাড়ি ওঠেন। আরো দুই ট্রিপ মারতে হবে।”

মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “আমি আপনার বাসে উঠব না।” ড্রাইভার তার কালো দাঁত বের করে হাসল, মানিক দেখল ড্রাইভারের শুধু যে দাঁত কালো তা নয় জিবটিও কালো। বলল, “না উঠে আপনার কুনো উপায় নাই। সব প্যাসেঞ্জারদের আমাদের কাছে বিক্রি করেছে।”

“বিক্রি করেছে? প্যাসেঞ্জার বিক্রি হয়?”

“জে বিক্রি হয়। পাইকারি খুচরা দুই রকমই বিক্রি হয়।”

ড্রাইভারের কথা শুনে মানিকের প্রথমবার একটুখানি রাগ উঠে গেল–রেগে গেলে তার কথায় কঠিন কঠিন শব্দ চলে আসে তাই সে বলল, “কিন্তু এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি মানবাধিকার পরিপন্থী কুরুচিপূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত কাজ–”

ড্রাইভার মানিকের কঠিন কঠিন শব্দগুলো না বুঝে মনে করল তাকে। বুঝি গালাগাল করা হচ্ছে তাই সে চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললেন আপনি?”

মানিকের মনে হলো এখন তার এখানে থাকা ঠিক হবে না তাই সে সরে আগের বাসের কাছে চলে এল। তার ধারণা ছিল গিয়ে দেখবে। প্যাসেঞ্জাররা বুঝি ততক্ষণে আরো খেপে উঠেছে, কিন্তু দেখল, ঠিক তার। উলটো, প্যাসেঞ্জাররা নরম হয়ে নিজেদের জিনিসপত্র নামিয়ে লক্কর-ঝক্কর মুড়িরটিন বাসে উঠতে শুরু করেছে। কারণটাও সে অনুমান করতে পারল, বাসের ড্রাইভারের হাতে একটা লোহার রড, হেলপার আর কন্ডাক্টরের হাতে দুইটা চ্যালা কাঠ। শুধু তাই নয়, আশেপাশে আরো কয়েকজন মানুষ নানা সাইজের গাছের ডাল নিয়ে ঘুরোঘুরি করছে।

অন্যেরা ভয় পেতে পারে কিন্তু মানিক কবি মানুষ তাকে তো ভয় পেলে চলবে না। সে গিয়ে গম্ভীর গলায় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, “ড্রাইভার সাহেব কাজটা কি ঠিক হলো?”

ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে বলল, “কোন কাজটা বেঠিক হয়েছে?”

এই ড্রাইভারের সম্রান্ত চেহারা দেখে মানিক বাসে উঠেছিল এখন এই ড্রাইভারকেই কেমন যেন সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী দেখাতে থাকে। মানিক ঢোক গিলে বলল, “এই যে আমাদের সবাইকে বিক্রি করে দিলেন? আমি আপনাদের সুন্দর বাসে উঠেছিলাম–ঐ ভাঙাচোরা বাসে আমি উঠব না।”

ড্রাইভার তার হাতের লোহার রড হাত বদল করে বলল, “কিন্তু আমি তো আমার সুন্দর বাস নিয়া ঐ লাইনে যাইতে পারুম না। গতকাল একটা এসকিডেন্ট হলো।

মানিক প্রায় বলেই ফেলছিল “শব্দটা এসকিডেন্ট নয়, শব্দটা এক্সিডেন্ট” অনেক কষ্ট করে নিজেকে থামাল।

হেলপার তার চ্যালাকাঠ নিয়ে এগিয়ে আসে, “পত্রিকায় দেখেন নাই? একটা টেম্পু ফিনিস?” তার চোখমুখ ভালো একটা এক্সিডেন্ট করার গর্বে ঝলমল করতে থাকে।

ড্রাইভার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এখন ঐ লাইনে গেলে আমার খবর আছে। দুই চারদিন যাক, অবস্থা ঠান্ডা হোক।”

মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “কিন্তু আমি ঐ উৎকট বেগুনি হলুদ রঙের বাসে উঠব না। কিছুতেই উঠব না।”

“না উঠলে নাই। কোম্পানির পলিসি প্যাসেঞ্জারদের জায়গা মতন পৌঁছায়া দেওয়া কিন্তু ভাড়া ফেরত দেওয়ার নিয়ম নাই।”

মানিক গম্ভীর গলায় বলল, “আমি মোটেও ভাড়া ফেরত দিতে বলিনি। আমি শুধু আপনাদের কাছে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে প্রতিবাদ। করলাম।” কথা শেষ করে মানিক চলে এল, সে দেখতে পেল না যে বাসের ড্রাইভার হেলপার আর কন্ডাক্টরের হাত দিয়ে মাথার মাঝে ইঙ্গিত করে একে অন্যকে বোঝাল যে মানিকের মাথায় গোলমাল আছে। তারপর তিনজন মিলে আনন্দে হা হা করে হাসল সেটাও মানিক দেখতে পেল না।

.

বাস দুটো ছেড়ে দেবার পর মানিকের মনে হলো কাজটা বোধ হয় ঠিক হলো না, কষ্ট করে হলেও লালচোখ কালো দাঁত ড্রাইভারের লক্কর-ঝক্কর হলুদ বেগুনি বাসে চলে যাওয়া উচিত ছিল। যেখানে তাদের নামিয়েছে। তার আশেপাশে কিছু নেই, শুধু রাস্তা দিয়ে মাঝে মধ্যে হুশহাশ করে একটা দুইটা বাস ট্রাক গাড়ি চলে যাচ্ছে। মানিক তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করে, আর কিছু না হোক হাঁটতে হাঁটতে ঘুংচির বদলে। একটা অন্য শব্দ নিশ্চয়ই বের হয়ে যাবে।

ঠিক যখন ঘুংচি শব্দটার একটা ভালো প্রতিশব্দ মাথায় প্রায় চলে আসছিল তখন কোথা থেকে একটা গাড়ি হুশ করে এসে ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। গাড়িটার মাঝে কিছু-একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে যেটা সে ঠিক ধরতে পারল না। গাড়িটা ছোটো এবং পুরানো রং-ওঠা এবং বিবর্ণ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি একটা বড়ো সাইজের খেলনা গাড়ি। গাড়িটা ছোটো হলেও সেটা বিকট শব্দ করে এবং পিছন থেকে গলগল করে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হয়। গাড়িটা কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল আর তখন ভেতর থেকে উশকোখুশকো চুলের একজন মানুষ। বের হয়ে এলো। মানুষটার গায়ের রং ফর্সা এবং নাকের নীচে ঝাঁটার মতো গোঁফ। মানিক দুই চোখে গোঁফ দেখতে পারে না, তার অনেকদিন থেকে ইচ্ছা সে গোঁফওয়ালা কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করবে সর্দি হলে তারা কেমন করে নাক ঝাড়ে, নাকের নীচে গোঁফগুলো কোনো ঝামেলা তৈরি করে কি না।

গাড়ি থেকে গোঁফওয়ালা ফর্সামতো উশকোখুশকো চুলের যে মানুষটা বের হয়েছে সেই হচ্ছে রতন কিন্তু মানিক তখনো সেটা জানত না।

রতন গাড়ি থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকাল এবং মনে হলো হঠাৎ করে মানিককে দেখতে পেল, তখন সে মানিকের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কাছে কি চিউইংগাম আছে?”

মানিক থতমত খেয়ে গেল, অচেনা জায়গায় বিচিত্র একটা গাড়ি থেকে আজব একটা মানুষ হঠাৎ করে বের হয়ে যদি জিজ্ঞেস করে তার কাছে চিউইংগাম আছে কি না তাহলে থতমত খাওয়ারই কথা। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না। আমার কাছে চিউইংগাম নেই। কখনো থাকে না।”

“ও!” রতন মনে হলো খুবই বিরক্ত হলো। খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তাহলে কি একটা এক টাকার কয়েন হবে?”

মানিক একটু অবাক হয়ে বলল, “না। আমার কাছে পাঁচ টাকার নোট আছে।”

“আমি নোট চাই নাই।” রতন মুখ শক্ত করে বলল, “আমি বলেছি এক টাকার কয়েন। তার কারণ এক টাকার কয়েন মেটালের তৈরি, গোল, আর ইলেকট্রিসিটি কনডাক্ট করে, সিল করার জন্যে পারফেক্ট।”

কথা শেষ করে রতন এমনভাবে মানিকের দিকে তাকাল যেন মানিক। একটা ছাগল কিংবা লাইটপোস্ট। মানিক কবিমানুষ সে সহজে রাগে না, গলার স্বর উঁচু করে না। তারপরেও এই বেয়াদব মানুষটার কথা শুনে তার। একটু রাগ হলো। অনেক কষ্ট করে গলার স্বরটা ঠান্ডা রেখে বলল, “আপনি কি ঘুংচি শব্দটার একটা ভালো প্রতিশব্দ বলতে পারবেন?”

রতন হকচকিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “কী বললেন?”

“বলেছি আপনি কি ঘুংচি শব্দটার একটা ভালো প্রতিশব্দ বলতে পারবেন?”

“ঘুংচি?”

“হ্যাঁ।”

“ঘুংচি মানে কী?”

“কোনো মানে নাই। সেইজন্যেই তো প্রতিশব্দ খুঁজছি।”

রতন এবারে অনেকক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে ভালো করে তাকে লক্ষ করল। উদাস উদাস চেহারা, গায়ে সুন্দর ফতুয়া, চোখে চশমা কাঁধে ঝোলানো বাহারি শান্তিনিকেতনি ঝোলা। দেখে মনে হয় না তার মাথায় গোলমাল আছে কিন্তু কথা শুনে রতনের সেরকমই মনে হচ্ছে। রতন ভুরু কুঁচকে বলল, “আপনি আমার কাছে ঘুংচি শব্দের অর্থ জানতে চাইছেন কেন? আমি কেমন করে জানব?”

“আপনি আমার কাছে চিউইংগাম চাইতে পারেন আর আমি আপনার কাছে ঘুংচির প্রতিশব্দ চাইতে পারব না?”

“চিউইংগাম আর ঘুংচি এক হলো?”

“চিউইংগাম থেকে ঘুংচি একশ গুণ ভালো।” মানিক কষ্ট করে মেজাজ ঠান্ডা রেখে বলল, “চিউইংগাম খায় অমার্জিত বর্বর মানুষেরা। মানব সভ্যতায় দুটি বড়ো বিষফোড়ার একটি হলো টেলিভিশন অন্যটি চিউইংগাম। বুঝেছেন? আর ঘুংচি হচ্ছে একটা নির্দোষ শব্দ।”

রতন তার কোমরে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “আপনি কি কখনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?”

মানিক এবার সত্যি সত্যি রেগে উঠল, বলল, “কী বললেন?”

“আমি জিজ্ঞেস করছি আপনি কি কখনো ডাক্তার দেখিয়েছেন? আমার মনে হয় আপনার ব্লাড প্রেশারের সমস্যা আছে। কিংবা হয়ত ব্রেনে গোলমাল আছে। কিংবা অন্য জেনেটিক সমস্যা আছে। তা না হলে আমার একটা সোজা প্রশ্নের উত্তরে কেউ এত কথা বলে?”

“কী বললেন?” মানিক মেঘের মত গর্জন করে বলল, “আমি বেশি কথা বলি?”

“সবসময়ে বলেন কি না জানি না। কিন্তু এখন বলছেন।”

মানিক কিছুক্ষণ সরুচোখে রতনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমার মনে হয় কী জানেন? আমার মনে হয় আপনারই ব্লাড প্রেশার আছে। শুধু ব্লাড প্রেশার নয় আপনার প্লীহারও প্রেশার আছে।”

রতন থতমত খেয়ে বলল, “প্লীহার প্রেশার?”

“হ্যাঁ।”

“প্লীহা কী?”

“আমি জানি না।”

রতন অবাক হয়ে বলল, “আপনি জানেন না? তাহলে যে বললেন?”

“বলেছি তো কী হয়েছে? একটা জিনিস না জানলে সেটা বলা যাবে না?”

“একটা জিনিস না জানলে কেন সেটা বলবেন?

“আমরা বলি। সবসময় বলি। যে শব্দটা আমি জানি সেটা বলি, যেটা জানি না সেটাও বলি। যে শব্দ পৃথিবীতে নেই আমরা সেই শব্দ তৈরি করে সেটাও বলি।”

রতন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মানিকের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “ঘুংচুর মতন?”

“হ্যাঁ। ঘুংচুর মতন।”

“আপনারা কারা?”

“আমরা কবি।”

“সত্যিকারের কবি?”

মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “কবি কখনো মিথ্যাকারের হয় না। কবি মানেই সত্যিকারের কবি।”

রতন বলল, “আমি এর আগে সামনাসামনি কখনো কোনো কবি দেখি নাই।” চোখ বড়ো বড়ো করে মানিকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “কবিরা তাহলে এরকম হয়? আমি ভেবেছিলাম “ রতন হঠাৎ কথার মাঝখানে থেমে গেল।

মানিক বলল, “কী ভেবেছিলেন?”

“আমি ভেবেছিলাম কবিদের লম্বা লম্বা উশকোখুশকো চুল আর দাড়ি হয়। লাল লাল চোখ হয়। ময়লা পাঞ্জাবি পরে থাকে। মাথার চুলে রতন আবার কথার মাঝখানে থেমে গেল।

মানিক জিজ্ঞেস করল, “মাথার চুলে কী?”

“মাথার চুলে উকুন হয়।”

মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “আপনাদের এটা খুবই ভুল ধারণা। কবিরা মোটেই নোংরা খবিশ না। কবিরা সুন্দরের পূজারি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং পূত পবিত্র। নোংরা খবিশ কারা জানেন?”

“কারা?”

“বৈজ্ঞানিকেরা। তাদের দশ হাতের মাঝে আপনি যেতে পারবেন না। শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হয়।

রতন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “দুর্গন্ধ বের হয়?”

“হ্যাঁ। গোসল করে না তো–দুর্গন্ধ বের হবে না তো কী বের হবে? তার উপর তাদের কথাবার্তা হয় চাছাছোলা কাঠখোট্টা রুক্ষ। তারা অসামাজিক, কারো সাথে মিশতে পারে না। চোখের নীচে থাকে কালি, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, নখের নীচে ময়লা–”

রতন তখন তার হাত মেলে তার নখের নীচে দেখল, কিছু বলল না।

মানিক বলল, “বৈজ্ঞানিকদের বিয়ে হয় না। কোনো মেয়ে বৈজ্ঞানিকদের বিয়ে করতে রাজি হয় না। যদি বা বিয়ে করে, সেই বিয়ে বেশিদিন টেকে না–ডিভোর্স হয়ে যায়।”

রতন দুর্বল গলায় বলল, “আ-আপনি কীভাবে জানেন?”

“না জানার কী আছে? সবাই জানে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে একটা বৈজ্ঞানিক খুঁজে বের করেন।”

রতন নিশ্বাস ফেলে বলল, “খুঁজে বের করতে হবে না।”

“কেন?”

“আমি নিজেই একজন বৈজ্ঞানিক।”

মানিক থতমত খেয়ে বলল, “আ-আপনি বৈজ্ঞানিক?”

“হ্যাঁ। ছোটোখাটো একজন পাতি বৈজ্ঞানিক।”

        “আপনি কী কী আবিষ্কার করেছেন?”

রতন বলল, “ছোটোখাটো জিনিসপত্র। যেমন এই হাতঘড়িটা আসলে একই সাথে হাতঘড়ি আর ব্লাডপ্রেশার মাপার যন্ত্র। আমার শার্টটা সোলার সেল, এই যে রোদে দাঁড়িয়ে আছি ব্যাটারি চার্জ হচ্ছে।”

রতন চশমাটা। দেখিয়ে বলল, “এই চশমাটা একইসাথে চশমা আর কম্পিউটার মনিটর। আর এই যে আংটিটা দেখছেন, এটা আসলে আংটি না, কম্পিউটারের মাউস।”

মানিক ঢোক গিলে বলল, “ক-কম্পিউটার কোথায়?”

“ছোটোগুলো শার্টের কলারে। বড়োগুলো গাড়িতে।”

 “বড়োগুলো মানে? কয়টা কম্পিউটার গাড়িতে?”

“প্রত্যেকটা চাকার জন্যে একটা, স্টিয়ারিং হুইলে একটা, কন্ট্রোলের জন্যে একটা।”

মানিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “এই গাড়ি কোথায় পেলেন?”

“কোথায় পাব? আমার কি গাড়ি কেনার পয়সা আছে?”

“তাহলে?”

“বানিয়ে নিয়েছি।”

“গা-গা-গাড়ি বানিয়েছেন?”

“হ্যাঁ। বেশি ভালো হয় নাই কিন্তু কাজ করে।”

মানিক গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, “শব্দ মনে হয় একটু বেশি করে কিন্তু শব্দই যদি না করল তাহলে কীসের গাড়ি?”

রতন মাথা নাড়ল, বলল, “আসলে এই গাড়ি কোনো শব্দ করে না। ইলেকট্রিক গাড়ি তো শব্দ নাই। কিন্তু শব্দ না থাকলে মানুষজন সন্দেহ করে–তাই শব্দের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। শব্দ আর ধোঁয়া।”

“ধোঁয়াটাও বানানো?”

“হ্যাঁ।”

“কী আশ্চর্য!” মানিক এবারে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে রতনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আপনাকে দেখে বৈজ্ঞানিকদের সম্পর্কে আমার ধারণাই পালটে গেল। আমি আরো ভাবতাম বৈজ্ঞানিকেরা খালি কাগজে লম্বা লম্বা সমীকরণ লিখে। আপনি তো দেখি অসাধারণ!”

রতন দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আরে না! অসাধারণ হলো কীভাবে? যদি আবিষ্কার করতাম ই ইকুয়েল টু এম সি স্কয়ারের মতো এক সূত্র তাহলে বলতেন অসাধারণ।

মানিক ভুরু কুঁচকে বলল, “ই ইকুয়েল টু কী?”

“এম সি স্কয়ার।“

“আবিষ্কার হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ। আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছেন।

“তাতে কী হয়েছে! সি শেষ হয়েছে তো কী হয়েছে, ডি তো আছে আপনি আবিষ্কার করবেন ই ইকুয়েল টু এম ডি স্কয়ার!”

রতন খানিকক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে ভাবল, ভাগ্যিস আইনস্টাইন এই কথাগুলো শোনার জন্যে বেঁচে নেই।

মানিক অবশ্যি এতকিছু খেয়াল করল না, সত্যিকারের একজন বৈজ্ঞানিককে দেখে সে মহাখুশি। হাত পা নেড়ে বলল, “আপনি একটু আগে চিউইংগাম খেতে চেয়েছিলেন না? চলেন ঐ দোকানে। যাই–চিউইংগাম না থাকলেও লজেন্স চকলেট কিছু-একটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।”

রতন বলল, “না, না– আমি খাওয়ার জন্যে চিউইংগাম খুঁজছি না।”

“তাহলে?”

“লুব্রিকেশানের ট্যাঙ্কটা লিক করছে। একটা চিউইংগাম থাকলে চিবিয়ে নরম করে টিপে লাগিয়ে দিলে লিকটা বন্ধ হয়ে যেত।”

মানিক মুখ হা করে বলল, “অ! আর এক টাকার কয়েন?”

“ব্যাটারির কন্টাক্টটা ক্ষয়ে গেছে। কয়েনটা ঢুকিয়ে স্কু টাইট দিলেই কাজ কমপ্লিট।”

মানিক বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ঐ দোকান থেকে চিউইংগাম কয়েন সব জোগাড় করে দেব।”

“থ্যাংকু।”

“আসেন আমার সাথে।”

দোকানে চিউইংগাম পাওয়া গেল না কিন্তু রতন চুনের সাথে চিনি মিশিয়ে বিচিত্র এক ধরনের আঠা তৈরি করে তার লুব্রিকেন্ট ট্যাঙ্কের লিক সারিয়ে ফেলল। দোকান থেকে কয়েন ভাঙিয়ে নিয়ে ব্যাটারির কানেকশান লাগিয়ে রতন সেটাও ঠিক করে ফেলল। রতন তার গাড়িতে উঠতে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি কোথায় যাবেন?”

“শ্রীমঙ্গল।”

“আমিও ঐ রাস্তাতেই যাচ্ছি, আপনাকে আমি আমার গাড়িতে তুলে নিতে পারতাম। কিন্তু “ রতন কথা শেষ না করে থেমে গেল।

“কিন্তু কী?”

“আমার মনে হয় সেটা ঠিক হবে না।”

 “কেন?”

“আপনি ভয় পাবেন। এর আগে যাকে তুলেছিলাম তার একটা ছোটো হার্ট এটাকের মতো হয়েছিল।”

“কেন?”

“আমি যেভাবে গাড়ি চালাই সেটা সবাই সহ্য করতে পারে না।”

“কীভাবে গাড়ি চালান?”

“ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। নিজের চোখে দেখলে হয়ত একটু অনুমান করা যায়।”

মানিক বলল, “আমাকে দেখান।”

রতন বলল, “ভয় পাবেন না তো?”

“না পাব না।”

“হার্ট এটাক হবে না তো?”

“না। আমার হৃদয় হচ্ছে কবির হৃদয়। কবির হৃদয় কখনো কাউকে হতাশ করে না। সেটি ফুলের মতো কোমল আবার পাথরের মতো শক্ত।”

“ঠিক আছে, তাহলে ওঠেন।” রতন মানিকের জন্যে দরজা খুলে দিল, বলল, “ভয় পেলে পরে আমাকে দোষ দেবেন না।”

মানিক গাড়ি উঠেই বুঝতে পারল এটা অন্যরকম গাড়ি। ভেতরে নানারকম বিচিত্র যন্ত্রপাতি। ড্যাশবোর্ডে ছোটো ছোটো অনেকগুলো মনিটর। নানারকম সুইচ, নানারকম লিভার। রতন একটা সুইচ টিপে দিতেই বিকট শব্দ করতে শুরু করল, আরেকটা সুইচ টিপে দিতেই পিছন দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। রতন সন্তুষ্টির মতো ভঙ্গি করে বলল,

“শব্দ আর ধোঁয়া দিয়ে দিয়েছি এখন গাড়িটা স্টার্ট করা যায়।”

রতন আরেকটা সুইচ টিপে দিতেই গাড়িটা চলতে শুরু করে, সে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে গাড়িটা রাস্তায় নিয়ে এসে মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভয় পাচ্ছেন না তো?”

“না, না। ভয় পাব কেন?”

“আমার ড্রাইভিং দেখে অনেকে ভয় পায়।”

মানিক রতনের গাড়ি চালানো লক্ষ করতে করতে বলল, “ভয়। পাওয়ার কী আছে? আপনি তো বেশ ভালো গাড়ি চালান।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

“আমার ড্রাইভিংয়ের ওপর কি আপনার বিশ্বাস আছে?”

“থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে।”

“ঠিক আছে। তাহলে দেখা যাক।” বলে রতন এক্সেলেটর চেপে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল, গাড়িটি এত জোরে যাচ্ছে যে এবারে রীতিমতো কাঁপতে থাকে। মানিক দুর্বলভাবে বলল, “একটু বেশি জোরে চালাচ্ছেন না?”

“হ্যাঁ। বেশি স্পিডে এখনো টেস্ট করা হয়নি।”

“কী টেস্ট করা হয়নি?”

ঠিক তখন সামনের দিক থেকে একটা দৈত্যের মতো ট্রাক আসতে থাকে, ট্রাকটার জন্যে রাস্তা ছেড়ে না দিয়ে রতন তার গাড়িটাকে বরং রাস্তার মাঝখানে নিয়ে আসে। মানিক ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী করছেন? সাইড দেন।”

“মজাটা দেখেন আগে!” বলে রতন স্টিয়ারিং হুইলটা ছেড়ে দিয়ে দুই হাত মাথার উপর তুলে ফেলে। মানিক আতংকে চিৎকার করে বলল, “কী করছেন আপনি?”

রতন বলল, “গাড়ি চালাচ্ছি।”

উলটো দিক থেকে ট্রাকটা বিকট হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে, রাস্তার পাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেবার জন্যে হেডলাইট জ্বালিয়ে নিভিয়ে সিগন্যাল দিতে থাকে কিন্তু মানিকের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে। স্টিয়ারিং হুইল ছেড়ে দিয়ে দুই হাত উপরে তুলে হাত তালি দিতে থাকে। মানিক হঠাৎ করে বুঝতে পারল, না বুঝে সে আসলে একজন বদ্ধ। পাগলের গাড়িতে উঠে পড়েছে। ঠিক যখন মুখোমুখি কলিশন হবে তার আগের মুহূর্তে রতনের গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাম পাশে সরে গিয়ে হুশ করে ট্রাকটাকে বের হয়ে যেতে দিল। মানিকের তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে বেঁচে আছে, তার চাইতে অবাক ব্যাপার রতন এখনো স্টিয়ারিং হুইল। ধরেনি, গাড়িটা নিজে নিজে চলছে।

মানিক দুই হাতে বুক চেপে ধরে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, “কী হচ্ছে এখানে?”

রতন দুই হাত ভাঁজ করে মাথার পিছনে নিয়ে আরাম করে বসে বলল, “কী আবার হবে? গাড়ি চলছে।”

“কেমন করে চলছে?”

“নিজে নিজে চলছে। এটা হচ্ছে আমার সর্বশেষ আবিষ্কার ড্রাইভিং সফটওয়্যার। টেস্ট করার জন্যে গাড়িতে লোড করে বের হয়েছি।”

মানিক বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, “প্লিজ, গাড়িকে নিজে নিজে চলতে দিয়েন না। গাড়ি কখনো নিজে নিজে চলতে পারে না। স্টিয়ারিংটা হাত দিয়ে ধরেন। প্লিজ ধরেন।”

রতন হাসি হাসি মুখ করে বলল, “ধরতে হবে না। আমি যতো ভালো গাড়ি চালাতে পারি, আমার ড্রাইভিং সফটওয়্যার তার থেকে একশগুণ ভালো গাড়ি চালায়?”

মানিক ভাঙা গলায় বলল, “তবুও আপনি স্টিয়ারিংটা ধরেন দোহাই লাগে।”

রতন দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, “আমি বলেছিলাম না আপনি ভয় পাবেন। এখন বিশ্বাস হলো?”

“আপনি আমাকে নিয়ে সুইসাইড করলে আমি ভয় পাব না?”

রতন দূরে তাকিয়ে বলল, “ঐ দেখেন একটা বাস আসছে! বাস ড্রাইভারকে এখন জন্মের মতো শিক্ষা দেয়া হবে!”

“কসম লাগে। আপনার কসম লাগে কাউকে শিক্ষা দিতে হবে না!”

রতন মানিকের কথায় কান দিল না। বলল, “বাস ড্রাইভারগুলো সবচেয়ে বড়ো বেয়াদব, ছোটো গাড়িগুলোকে সাইড দেয় না, রাস্তা থেকে নামিয়ে দেয়। আজকে তার শিক্ষা হবে।”

“কী শিক্ষা হবে?”

“আমার ড্রাইভিং সফটওয়্যার সাইড দেবে না।”

মানিক আর্তনাদ করে বলল, “সর্বনাশ!”

“ব্যাটাকে বাধ্য করা হবে সাইড দিতে!” রতন আনন্দে হা হা করে হাসল।

মানিক দুই হাতে নিজের বুক চেপে ধরে বলল, “প্লিজ, ওটা করবেন। বাস যদি সাইড না দেয় তাহলে? তাহলে কী হবে?”

“একেবারে শেষ মুহূর্তে কলিশনের দুই দশমিক তিন মিলিসেকেন্ড আগে আমার গাড়ি ঝটকা মেরে সরে যাবে।”

“যদি যেতে না পারে?”

“পারবে। নতুন অপারেটিং সিস্টেমে প্রোগ্রাম লোড করেছি–”

মানিক বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, তাদের গাড়িটা সোজা বাসটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে থেকে হর্ন দিতে দিতে বাসটা এগিয়ে আসছে–শুধু হর্ণ দিয়েই থামেনি হেডলাইট জ্বালাচ্ছে নিভাচ্ছে। রতন খিক খিক করে হেসে বলল, “সরে যাও বাছাধন সরে যাও–”

মানিক আতঙ্কে চোখ বন্ধ করল, টের পেল সত্যি সত্যি শেষ মুহূর্তে গাড়িটা ঝটকা মেরে সরে গেছে। রতন আনন্দে হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, “বিশ্বাস হলো?”

মানিক মাথা নাড়ল, “না হয়নি।”

“কেন হয়নি?”

“এটা কোনোদিন বিশ্বাস হবে না।”

“হবে হবে।” রতন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আপনি তো ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ করে ফেললেন তাই দেখতে পেলেন না ব্যাটা ড্রাইভার ভয়ের চোটে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছিল! না দিয়ে যাবে কোথায়?”

মানিক চিঁ চিঁ করে বলল, “আপনি বলেছিলেন না আপনার পরিচিত একজন এই গাড়িতে উঠে হার্ট এটাক হয়েছিল?”

“হ্যাঁ।”

আমারও মনে হয় হার্ট এটাক হচ্ছে। বুকের মাঝে কেমন জানি চাপ লাগছে। শরীরটা মনে হয় ঘামছে।”

রতন মানিকের দিকে একনজর তাকিয়ে বলল, “না। আপনার মোটেও হার্ট এটাক হচ্ছে না।”

“আপনি কেমন করে জানেন? নিশ্চয়ই হচ্ছে।”

রতন হাত দিয়ে ড্যাশবোর্ডের একটা মনিটর দেখিয়ে বলল, “এই দেখেন আপনার ইসিজি। পরিষ্কার সিগন্যাল। আপনার লোহার মতো শক্ত হার্ট।”

“আ-আ-আমার ইসিজি?”

“হ্যাঁ। সিট বেল্টের সাথে অনেক মনিটর লাগানো আছে। আপনার হার্ট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।”

মানিক বলল, “ঠিক আছে। হার্ট এটাক না হলে নাই–আপনি আমাকে নামিয়ে দিন। আমি এই গাড়িতে থাকব না। এক সেকেন্ডও থাকব না।”

“কেন?”

“কেন? এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়? আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? প্লিজ গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দিন। প্লিজ! প্লিজ!”

রতন মাথা চুলকাল, বলল, “আপনাকে নামিয়ে দিতাম কিন্তু আমর ড্রাইভিং সফটওয়্যারে ছোটো একটা বাগ রয়ে গেছে, এখনো ঠিক করা হয়নি!”

“বাঘ? সফটওয়ারে বাঘ?”

“বাঘ না, বাঘ না, বাগ। সফটওয়ারের সমস্যাকে বলে বাগ!”

আপনার সফটওয়্যারে সমস্যা আছে সেই সমস্যাওয়ালা সফটওয়ার দিয়ে আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন? থামান গাড়ি এখনই থামেন।”

“সেটাই তো সমস্যা।”

“মানে?”

“গাড়ি তো থামাতে পারি না।”

মানিক আর্তনাদ করে বলল, “গাড়ি থামাতে পারেন না?”

“উঁহু।”

“তাহলে? বাকি সারাজীবন এই গাড়িতে থাকতে হবে?”

রতন হাসল, বলল, “না, না! বাকি জীবন কেন থাকতে হবে। আমি গন্তব্য লোড করে দিয়েছি, গন্তব্যে পৌঁছে গেলে নিজে থেকে থেমে যাবে।”

“গন্তব্যে কখন পৌঁছাব?”

“এই তো ঘণ্টাখানেকের মাঝে।“

“ঘণ্টাখানেক? ঘণ্টাখানেক?” মানিক হাহাকার করে বলল, “আমি তার আগেই মরে যাব। নির্ঘাত মরে যাব। আর যদি মারা না যাই তাহলে পাগল হয়ে যাব। উন্মাদ হয়ে যাব। স্মৃতি বিভ্রম হয়ে যাবে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হবে।”

“কিছুই হবে না।”

“হবে। আমি জানি।” মানিক আর্তনাদ করে বলল, “হবে। আজকেই হবে। এক্ষুনি হবে।”

রতন কিছুক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি সত্যিই নেমে যেতে চান?”

মানিক দ্রুত মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ।”

“একটা উপায় আছে।”

মানিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “কী উপায়?”

“আমি দরজাটা খুলে গাড়ির হুডের উপর উঠে হুডটা খুলে ব্যাটারির কানেকশানটা যদি খুলে দেই–”

“গাড়ি চলন্ত অবস্থায়?”

“হ্যাঁ। চলন্ত অবস্থায়। সেটা কোনো সমস্যা না। আমার গাড়ির সামনে দুইটা ক্যামেরা তিনটা ছোটো রাডার আছে। দুইটা ইনফ্রারেড লাইটের সোর্স আর ডিটেক্টর সেইসব সিগন্যাল দিয়ে এই গাড়ি পৃথিবীর যে কোনো ড্রাইভার থেকে ভালো গাড়ি চালায়। কাজেই আমি দরজা খুলে হুডের উপর উঠে গেলে কোনো সমস্যা নেই।”

“রাস্তার মানুষজন যখন দেখবে গাড়ির ড্রাইভার হুডের ওপর বসে। আছে তখন কী হবে?”

“কী হবে?”

রতন জিজ্ঞেস করল, “দেখলে কী হবে?”

“তারা অবাক হবে না?”

রতন বলল, “মনে হয় না। এই দেশের মানুষ কোনো কিছুতে অবাক হয় না।” রতন গাড়ির দরজা খুলে বের হওয়ার চেষ্টা করতেই মানিক খপ করে তাকে ধরে ফেলল। রতন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

মানিক কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, “আর কোনো উপায় নেই?”

রতন মাথা চুলকে বলল, “আরেকটা উপায় আছে।”

“সেটা কী?”

“যদি আপনি খুব জোরে চিৎকার করেন তাহলে গাড়িটা থেমে যেতে পারে।”

“চিৎকার করলে?”

“হ্যাঁ। তখন সিকিউরিটি সিস্টেম মনে করবে একটা ইমার্জেন্সি হয়েছে। আর সেইজন্যে গাড়িটা থামাবে।”

“কী বলে চিৎকার করতে হবে?”

রতন বলল, “যা ইচ্ছে বলতে পারেন!”

“যা ইচ্ছে?”

“হ্যাঁ।”

“বাবাগো মাগো বলতে পারি? বাঁচাও বাঁচাও?”

“যা ইচ্ছে। চেষ্টা করেন।”

মানিক তখন “বাবাগো মাগো, মেরে ফেলল গো, বাঁচাও বাঁচাও” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল। রতন মাথা নাড়ল, বলল, “হচ্ছে। হচ্ছে। সিস্টেম পিক আপ করছে। আরেকটু জোরে।”

মানিক তখন আরো জোরে জোরে গগনবিদারী চিৎকার করল, “ও বাবাগো ও মাগো! বাঁচাও আমাকে বাঁচাও। আমাকে মেরে ফেলল গো আমার কী হবে গো! আমার কী সর্বনাশ হলো গো! বাঁচাও বাঁচাও।”

আর গাড়িটা ঠিক তখন থেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। রতন বলল, “আপনি এখন থামতে পারেন।”

মানিক কোনো ঝুঁকি নিল না, আরো জোরে চিৎকার করতে লাগল, “ও বাবাগো! ও মাগো! মেরে ফেললো গো!”

রতন বলল, “থামেন থামেন! এখন চিৎকার করলে বিপদ হয়ে যাবে।”

মানিক থামল, কিন্তু ততক্ষণে বিপদ হয়ে গেছে। গাড়ি যেখানে থেমেছে ঠিক সেইখানে কিছু পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। তারা দৌড়ে এসে গাড়িটা ঘিরে ফেলল। একজন রাইফেল তুলে বলল, “হ্যান্ডস আপ। হাত তুলে গাড়ি থেকে নেমে আস। একটু তেড়িবেড়ি করলেই গুল্লি। সোজা ক্রসফায়ার।”

রতন বলল, “কেন? কী হয়েছে?”

“কী হয়েছে মানে? কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছ–পরিষ্কার চিৎকার শুনেছি আমরা।”

“আসলে সেটা সত্যি সত্যি চিৎকার না–এমনি এমনি”

কালোমতন একজন পুলিশ চিৎকার করে বলল, “আবার কথা বলে? কতো বড়ো সাহস? নাম গাড়ি থেকে।”

মোটামতন একজন পুলিশ বলল, “এত কথার দরকার কী? মাথার মাঝে গুলি করে দাও। সোজা ক্রসফায়ার।”

শুকনোমতন একজন পুলিশ বলল, “কলার ধরে নামাও। নামিয়ে প্রথমে আচ্ছা মতো বানাও।”

মানিক আর রতন বুঝতে পারল অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এখন গাড়ি থেকে নেমে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দুইজন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামল। তখন পুলিশ তাদের টেনে গাড়ির পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। পিঠের মাঝে রাইফেল ঠেকিয়ে কালোমতন পুলিশ হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা কারা? ডাকাত, সন্ত্রাসী নাকি কিডন্যাপার?”

মানিক বলল, “আমরা মোটেও ডাকাত সন্ত্রাসী কিডন্যাপার এরকম কেউ না। আমি একজন কবি, লেখালেখি করি। ইনি হচ্ছেন বৈজ্ঞানিক!”

মোটামতন পুলিশ হা হা করে হাসল। বলল, “আমাদের সঙ্গে মশকরা। তোরা কবি? তোরা বৈজ্ঞানিক? চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোরা হচ্ছিস ক্রিমিনাল। তোদের চেহারার মাঝে ক্রিমিনালের ছাপ।”

মানিক বলল, “দেখেন, আপনাদের সাথে একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমরা মোটেও ক্রিমিনাল না। আপনারা চাইলে প্রমাণ করে দিতে পারব।”

শুকনোমতন পুলিশ বলল, “কথা পরে। আগে আচ্ছামতন একবার বানাই।”

মোটামতন পুলিশ শুকনোমতন পুলিশকে ধমক দিয়ে বলল, “তোমার শুধু বানানো আর বানানো! বানানোর সময় কি চলে গেছে? রাস্তার পাশে মারধোর করলে কোনো একজন সাংবাদিক ছবি তুলে পত্রিকায় ছাপিয়ে দিলে উপায় আছে?”

কালোমতন পুলিশ, “আগে বিজনেস। তারপরে অন্য কথা।”

মোটামতন পুলিশ বলল, “হ্যাঁ আগে বিজনেস।” তারপর মানিক আর রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা এখন বল কত টাকা দিবি?”

রতন অবাক হয়ে বলল, “টাকা? টাকা কেন দেব?”

মোটামতন পুলিশ হা হা করে হাসল, বলল, “টাকা কেন দিবি জানিস? টাকা না দিলে তোদের নামে মামলা করে হাজতে পাঠিয়ে দেব! বাকি জীবন জেলখানায় থাকবি।”

“মামলা?” রতন বলল, “আমাদের নামে কী মামলা করবেন?”

“ব্যাংক ডাকাতি।”

রতন হেসে ফেলল, “আমাদের নামে ব্যাংক ডাকাতির মামলা কেউ বিশ্বাস করবে না!”

কালোমতন পুলিশ হুংকার দিয়ে বলল, “বিশ্বাস করবে না? হাতে নাতে ব্যাংক ডাকাতকে ধরলে কেউ বিশ্বাস করবে না!”

“আমাদেরকে হাতে নাতে ধরেছেন?”

“অবশ্যই, হাতে নাতে ধরেছি। তোদের গাড়ির ভেতর থাকবে অস্ত্র আর টাকা! ব্যাংক থেকে যে টাকা ডাকাতি করে এনেছিস, সেই টাকা তোদের গাড়ি থেকে উদ্ধার করা হবে।”

“আমাদের গাড়িতে কোনো টাকা নেই।”

“দেখতে চাস টাকা আছে কি নেই?”

রতন কোনো কথা না বলে কালোমতন পুলিশটির দিকে তাকিয়ে রইল। পুলিশটি গলা উঁচিয়ে বলল, “গাড়ির ভিতরে পলিথিনের ব্যাগে দুই লাখ টাকা আছে না?”

শুকনোমতন পুলিশটা বলল, “আছে।”

“এই গাড়ির ভেতরে রাখ।”

রতন চিৎকার করে বলল, “আপনি এটা করতে পারেন না। কিছুতেই করতে পারেন না।”

মোটামতন পুলিশ বলল, “দেখা যাক সেটা করা যায় কি না!” তারপর আনন্দে হা হা করে হাসল।

মানিক আর রতন বিস্ফারিত চোখে দেখল তাদের গাড়িতে সিটের। নীচে পলিথিনের ব্যাগে করে অনেকগুলো টাকা ঠেসে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। তারপর একটা জংধরা রিভলবার আর একটা বড়ো চাকু ড্যাশবোর্ডের ভিতর ঢুকিয়ে রাখল। মোটা পুলিশটা বলল, “কাজ কমপ্লিট।”

চিকন পুলিশটা বলল, “এখন বানাই?”

“এখনই না।”

কালোমতন পুলিশ বলল, “এখন স্যারকে খবর দেই। স্যার আসার পর স্যারের সামনে গাড়ি তল্লাশি করে টাকা আর অস্ত্র বের করব। তাহলে আর কেউ সন্দেহ করবে না।”

মোটামতন পুলিশ আনন্দে আবার হা হা করে হাসল। মানিক দুর্বল গলায় বলল, “দেখেন, কাজটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমরা একেবারেই নিরপরাধী মানুষ, কিছুই করি নাই। আমাদেরকে এরকম একটা বিপদের মাঝে ফেলে দেয়া কি ঠিক হচ্ছে?”

শুকনোমতন পুলিশটা বলল, “বিপদের তোরা দেখেছিস কী?” মাত্র তো শুরু হলো! আগে হাজতে নিয়ে যাই তারপরে দেখবি বিপদ কত প্রকার ও কী কী!”

কালোমতন পুলিশ তখন ওয়াকিটকি বের করে কথা বলতে শুরু করেছে। মানিক আর রতন শুনল সে বলছে, “জী স্যার, দুইজন ব্যাংক ডাকাতকে ধরেছি। ব্যাংক থেকে খবর দিয়েছিল। গাড়িটা কেমন বলেছে আর চেহারার বর্ণনা দিয়েছে। আমরা রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে ধরে ফেলেছি। গাড়িটা এখনো সার্চ করি নাই। আপনি আসার পর আপনার সামনে সার্চ করব।… না স্যার… চেহারা দেখে বোঝাই যায় না ব্যাংক ডাকাত। দ্রলোকের মতো চেহারা। কী যে হয়েছে দেশটার বুঝি না, স্যার। মানুষের মাঝে সততা নাই। ঠিক আছে স্যার আমরা অপেক্ষা করছি।”

পুলিশ তিনজন মানিকের ডান হাত আর রতনের বাম হাতের মাঝে একজোড়া হাতকড়া লাগিয়ে তাদেরকে রাস্তার পাশে একটা গাছের নীচে বসিয়ে রাখল। মানিক বিস্ফারিত চোখে হাতে লাগানো হাতকড়াটির দিকে তাকিয়ে নীচু গলায় বলল, “কী বিপদে পড়েছি দেখেছেন! এখন কী হবে!”

“কুংফু।”

মানিক অবাক হয়ে বলল, “কী বললেন?”

“বলেছি কুংফু।”

“কুংফু? কুংফু কেন বলছেন?”

“হ্যাঁ। আপনি ঘুংচুর প্রতিশব্দ চাচ্ছিলেন, কুংফু কি হতে পারে?”

মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “এরকম সময় আপনি ঠাট্টা করতে পারেন? আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আপনি জানেন আমরা কী বিপদে পড়েছি?”

রতন খোলা হাত দিয়ে তার পকেট থেকে টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোলের মতো একটা জিনিস বের করে বলল, “আমরা বেশি বিপদে পড়েছি নাকি এই পুলিশগুলো বেশি বিপদে পড়েছে দেখা যাক।”

“পুলিশগুলো কেন বেশি বিপদে পড়বে?”

রতন রিমোট কন্ট্রোলের মতো জিনিসটা মানিককে দেখিয়ে বলল, “এটা হচ্ছে আমার গাড়িটির রিমোট কন্ট্রোল। দুইটা মোডে কাজ করে, নরমাল আর কুংফু।”

“কুংফু?”

“হ্যাঁ। কুংফু মোডে আগে টেস্ট করি নাই। দেখি কেমন কাজ করে।” বলে রতন রিমোট কন্ট্রোলারে একটা বেতাম টিপে ধরতেই গাড়িটা হঠাৎ যেন কেমন গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল, তারপর নিঃশব্দে পুলিশগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পুলিশ তিনজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন, প্রথমে লক্ষ করেনি হঠাৎ শুকনোমতন পুলিশটা গাড়িটাকে দেখতে পায়, সে চিৎকার করে উটলে, “ইয়া মাবুদ।” গাড়িটা তখন হঠাৎ তাদের দিকে ছুটে গেল এবং কাছাকাছি যেতেই গাড়ির দরজা খুলে যায় আর দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে কালোমতন পুলিশটা রাস্তার উপর ছিটকে পড়ল।

মোটামতন পুলিশটা চিৎকার করে সরে গেল, গাড়িটা তখন হঠাৎ থেমে যায় এবং দরজা দুটি আবার ঝপঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। মানিক অবাক হয়ে দেখল গাড়িটা নিঃশব্দে পিছিয়ে যাচ্ছে, দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে সেটা আবার পুলিশগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। হলোও তাই হঠাৎ করে গাড়িটা পুলিশ তিনজনের দিকে ছুটে এল আর পুলিশ তিনজন “ও বাবাগো ও মাগো” বলে চিৎকার করে ছুটতে থাকে। মোটামতন পুলিশটা রাস্তায় আছাড় খেয়ে পড়ল আর গাড়িটা কাছাকাছি গিয়ে পিছনের দুই চাকার উপর ভর করে সামনের দুই চাকা উপরে তুলে দাঁড়িয়ে গেল।

মোটা পুলিশটা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কোনোমতে সরে যায়, গাড়িটাও ঝপাং করে চাকা নামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আবার নিঃশব্দে পিছনে সরতে থাকে। দেখেই বোঝা যায় গাড়িটা আবার পুলিশ তিনজনকে আক্রমণ করার পাঁয়তারা করছে। পুলিশ তিনজন এবারে একজন আরেকজনের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকায়। তারপর একজন আরেকজনকে ধরে আতঙ্কিত মুখে তাকিয়ে থাকে। মানিক অবাক হয়ে দেখল, গাড়িটা কেমন জানি একবার গা-ঝাড়া দিল, তারপর একবার পিছনের চাকা দুটো উপরে তুলে ছোটো একটা লাফ দিল। তারপর সামনের চাকা দুটো উপরে তুলে পুলিশগুলোকে ধাওয়া করল। পুলিশ তিনজন চিৎকার করতে করতে ছুটতে থাকে, মানিক আর রতন দেখতে পেল তারা রাস্তা থেকে লাফিয়ে পাশের খেতে নেমে পড়ে তারপর ছুটতে ছুটতে ঝপাং ঝপাং করে একটা ডোবায় লাফিয়ে পড়ল।

ঠিক তখন বহুদূর থেকে একটা সাইরেনের শব্দ শোনা যায়। মানিক আর রতন তাকিয়ে দূর থেকে পুলিশের গাড়ির লাল নীল বাতি জ্বলতে আর নিভতে নিভতে এগিয়ে আসতে দেখতে পায়।

রতন মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন গাড়িটাকে কুংফু মোড থেকে নরমাল মোডে নিয়ে যাই। কী বল?”

“হ্যাঁ। নিয়ে যাও।”

মানিক আর রতন যে একজন আরেকজনকে তুমি করে বলতে শুরু করেছে সেটা তারা দুজনের কেউই লক্ষ করল না।

রতন বলল, “গাড়িটাকে কাছাকাছি রাখা ঠিক হবে না। দূরে পাঠিয়ে দিই, সেখানে অপেক্ষা করুক।”

মানিক বলল, “হ্যাঁ, দূরে পাঠিয়ে দাও।”

রতন তার রিমোট কন্ট্রোলের কোথায় যানি চেপে ধরল, সাথে সাথে গাড়িটা গর্জন করে ধোয়া ছেড়ে সামনের দিকে ছুটে যেতে লাগল, কিছুক্ষণের মাঝেই চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অন্যদিক থেকে তখন পুলিশের গাড়িটা লাল নীল আলো জ্বালাতে জ্বালাতে এবং নিভাতে নিভাতে সাইরেন বাজিয়ে চলে আসতে থাকে। গাড়িটা চলে গেছে দেখে পুলিশ তিনজন ডোবা থেকে উঠে মাঠ ধরে হেঁটে আসতে থাকে। ভিজে চুপচুপে, সারা শরীরে কাদা। মোটা পুলিশটার মাথায় কিছু কচুরিপানা, কালো পুলিশের গলায় একটা জোঁক।

পুলিশের গাড়িটার দিকে চোখ রেখে রতন মানিককে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হয়েছে তুমি কি সেটা সম্পর্কে কিছু জানো?”

মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না।“

“কুংফু গাড়ি?”

“কুংফু গাড়ি? সেটা আবার কী? আমি কিছু জানি না।”

রতন মানিকের দিকে চোখ টিপে বলল, “আমিও জানি না!”

ঠিক এ রকম সময় তাদের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থামে–সেখান থেকে একজন পুলিশ অফিসার নেমে এদিক সেদিক তাকিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমার পুলিশ ফোর্স কই?”

মানিক খোলা হাতটি দিয়ে মাঠের দিকে দেখাল, বলল, “ঐ যে আসছে।” পুলিশ অফিসার সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল, মাটি কাদা মেখে ভিজে জবুথবু হয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে তিনজন আসছে। পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বললেন, “এ কী অবস্থা তোমাদের? কী হয়েছে?”

কালোমতন পুলিশটা বলল, “আপনি বিশ্বাস করবেন না স্যার। গাড়িটা নিজে থেকে আমাদের ধাওয়া করল–”

“কে তোমাদের ধাওয়া করল?”

“গাড়ি স্যার।”

“গাড়িতে কে ছিল?”

“কেউ না স্যার। খালি গাড়ি।”

পুলিশ অফিসার ভুরু কুঁচকে তাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে রইল,

তারপর মেঘস্বরে বলল, “ঠিক করে বল কী হয়েছে?”

“সত্যি কথা বলছি স্যার। খোদার কসম–“

পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “খবরদার, মুখে আল্লাহ খোদার নাম নিবে না। কী হয়েছে বল।”

“সত্যি কথা বলছি স্যার। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ওদের জিজ্ঞেস করেন।”

মোটা পুলিশ হড়বড় করে বলল, “সত্যি কথা স্যার। পুরোপুরি সত্যি। গাড়িটা এসে দরজাটা খুলে ওরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে আমার দিকে ছুটে আসতে শুরু করল। কাছে এসে পিছনের দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সামনের দুই পা–”

“পা? গাড়ির পা ছিল?”

“মানে চাকা স্যার। এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যে মনে হলো চাকা না পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছে। আরেকটু হলে জানে মেরে ফেলেছিল, কোনোমতে পালিয়ে রক্ষা পেয়েছি।”

“সেই গাড়ি কোথায়?”

“নিজে নিজে চলে গেল।”

“নিজে নিজে চলে গেল মানে?” পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলল, “গাড়ি নিজে নিজে চলে যায় শুনেছ কখনন? শুনেছ?”

“কিন্তু স্যার গিয়েছে। ওদের জিজ্ঞেস করেন।”

শুকনো পুলিশটা বলল, “জি স্যার গিয়েছে। সত্যি কথা স্যার।”

“তুমি বলবে আর আমি বিশ্বাস করব?”

মানিক একটু গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, “আমি বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করি?”

“আপনি?”

“জি, আমি। এই তিনজন আমাদের দুইজনকে ধরে ব্যাংক ডাকাতির মামলা দেবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন।”

“এবং টর্চার করবে–” রতন মনে করিয়ে দিল।

মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। এবং টর্চার করার ভয় দেখাচ্ছে। শব্দটা অবশ্যি টর্চার ব্যবহার করেনি, ওরা বলেছে, বানাবে।”

শুকনো পুলিশটা দুর্বল গলায় বলল, “বলি নাই। আমি—“

পুলিশ অফিসার তাকে প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বলল, “তুমি চুপ কর।”

শুকনো পুলিশটা চুপ করে গেল। মানিক আবার শুরু করল, “যাই হোক, আমাদের হাতকড়া লাগিয়ে এখানে দাঁড় করিয়ে কার সাথে জানি কথা বলল–”

“আমার সাথে।”

“তারপর ঐখানে দাঁড়িয়ে কিছু-একটা খেলো–“

মোটামতন পুলিশটা বলল, “খাই নাই।”

“সিগারেটের মতো কিন্তু সিগারেট না ড্রাগ বোঝা গেল না। খাওয়ার পরই তিনজনই কেমন জানি অন্যরকম হয়ে গেল। এক ধরনের হেলুসিনেশান বলতে পারেন। অদৃশ্য কিছু-একটা দেখিয়ে চিৎকার করে বলে, গাড়ি আসছে! বাঁচাও বাঁচাও! লাফ দেয়, দৌড়ায়, চিৎকার করে। তারপর দেখলাম চিৎকার করতে করতে পানিতে লাফিয়ে পড়ল। তখন। মনে হলো তিনজনই একটু শান্ত হলো।”

পুলিশ অফিসার সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “ও! তাহলে এই ব্যাপার। ডিউটিতে ড্রাগস খাওয়া হচ্ছে?”

কালোমতন পুলিশটা বলল, “বিশ্বাস করেন স্যার, কিছু খাই নাই। আল্লাহর কসম!”

“কিছু না খেলে কেউ কখনো গাড়িকে লাফাতে দেখে? গাড়িকে দুই চাকার উপর দাঁড়িয়ে নাচানাচি করতে দেখে? দেখে?”

পুলিশ তিনটি কী করবে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। পুলিশ অফিসার অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “কী লজ্জা! কী লজ্জা! তোমাদের মতো মানুষের জন্যে আমাদের এত বদনাম। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!”

পুলিশ অফিসার এবারে মানিক আর রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি খুবই দুঃখিত, আপনাদের মিছিমিছি হয়রানি করার জন্যে। ক্ষমা চাচ্ছি আপনাদের কাছে।”

রতন হাতকড়াটা দেখিয়ে বলল, “এবারে তাহলে এটা খুলে দেন। খুব চুলকাচ্ছে হাত।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ খুলে দিচ্ছি। চাবিটা কার কাছে?”

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের হাত থেকে হাতকড়া খুলে দেয়া হলো। পুলিশ অফিসার অনেকবার ক্ষমা চাইলেন, পুরো ব্যাপারটা ভুলে যেতে বললেন, মানিক আর রতন বলল তারা চেষ্টা করবে ভুলে যেতে।

কালোমতন, মোটামতন এবং শুকনোমতন পুলিশকে গাড়ির পিছনে তোলা হলো, তাদেরকে নিয়ে এখন ডাক্তারি পরীক্ষা করা হবে। মানিক আর রতন লক্ষ করল তারা বিড়বিড় করে বলেছে, “একেবারে স্পষ্ট দেখেছি আমরা বিশ্বাস করেন! কী আজিব ব্যাপার! বাপের জন্মে এরকম দেখি নাই–”

.

পুলিশের দলটি সবাইকে নিয়ে চলে যাবার পর মানিক আর রতন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর জোরে জোরে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে হঠাৎ করে মানিক থেমে গেল, বলল, “একটা জিনিস লক্ষ করেছ?”

“কী?”

“তোমার নামটাই এখনো জানা হয়নি! আমার নাম মানিক। আজিজ মার্কেটে গিয়ে যে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করো কবি মানিক কোথায়, সাথে সাথে তারা আমাকে খুঁজে বের করে দিবে। তোমার নাম?”

রতন বলতে শুরু করল, “আমার নাম—“

মানিক হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলর, “দাঁড়াও! দাঁড়াও! আগেই বলে দিও না। আমি অনুমান করার চেষ্টা করি। তোমার নাম হচ্ছে বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ, অনিরুদ্ধ অনুরণন–”

রতন মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমার নাম রতন।”

এইভাবে মানিক আর রতনের পরিচয় হলো।