১. কী ভাবছেন ফেলুবাবু

॥ ১ ॥

‘কী ভাবছেন, ফেলুবাবু?’

প্রশ্নটা করলেন রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু। আমরা তিনজনে রবিবারের সকালে আমাদের বালিগঞ্জের বৈঠকখানায় বসে আছি, লালমোহনবাবু যথারীতি তার গড়পারের বাড়ি থেকে চলে এসেছেন গল্পগুজবের জন্য। কিছুক্ষণ হল এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, কিন্তু এখন গন্‌গনে রোদ। রবিবার লোডশেডিং নেই বলে আমাদের পাখাটা খুব দাপটের সঙ্গে ঘুরছে।

ফেলুদা বলল, ‘ভাবছি আপনার সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাসটার কথা।’

পয়লা বৈশাখ জটায়ুর ‘অতলান্তিক আতঙ্ক’ বেরিয়েছে, আর আজ পাঁচই বৈশাখের মধ্যেই নাকি সাড়ে চার হাজার কপি বিক্রী হয়ে গেছে।

লালমোহনবাবু বললেন, ‘ও বইতে যে আপনার মতো লোকের ভাবনার খোরাক ছিল তা তো জানতুম না মশাই।’

‘ঠিক সেরকম ভাবনা নয়।’

‘তবে?’

‘ভাবছিলাম আপনার গল্প যতই গাঁজাখুরি হোক না কেন, স্রেফ মশলা আর পরিপাকের জোরে শুধু যে উৎরে যায় তা নয়, রীতিমতো উপাদেয় হয়।’

লালমোহনবাবু গদগদ ভাব করে কিছু বলার আগেই ফেলুদা বলল, ‘তাই ভাবছিলাম আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোনো গল্প লিখিয়ে-টিখিয়ে ছিলেন কি না।’

সত্যি বলতে কি, আমরা লালমোহনবাবুর পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানি না। উনি বিয়ে করেননি এবং ওঁর বাপ-মা আগেই মারা গেছেন সেটা জানি, কিন্তু তার বেশি উনিও বলেননি, আর আমরাও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

লালমোহনবাবু বললেন, ‘পাঁচ-সাত পুরুষ আগের কথা ত আর বিশেষ জানা যায় না, তাঁদের মধ্যে হয়ত কোনো কথক ঠাকুর-টাকুর থেকে থাকতে পারেন। তবে গত দু-তিন জেনারেশনের মধ্যে ছিল না সেটা বলতে পারি।’

‘আপনার বাবার আর ভাই ছিল না?’

‘থ্রী ব্রাদার্স। উনি ছিলেন মিড্‌ল। জ্যাঠা মোহিনীমোহন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। ছেলেবেলা আরনিকা রাসটকস বেলাডোনা পালসেটিলা যে কত খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। গ্রেট গ্র্যাণ্ডফাদার ললিতমোহন ছিলেন পেপার মার্চেন্ট। এল এম গাঙ্গুলী অ্যাণ্ড সসের দোকান এই সেদিন অবধি ছিল। ভালো ব্যবসা ছিল। গড়পারের বাড়িটা এল-এমই তৈরি করেন। ঠাকুরদাদা, বাবা দুজনেই ব্যবসায় যোগ দেন। বাবা যদ্দিন বেঁচে ছিলেন তদ্দিন ব্যবসা চালান। ফিফটি-টুতে চলে গেলেন। তারপর যা হয় আর কি। এল এম গাঙ্গুলী অ্যাণ্ড সন্‌স-এর নামটা ব্যবহার হয়েছিল কিছুদিন, কিন্তু মালিক বদল হয়ে গেসল।’

‘আপনার ছোটকাকা? তিনি ব্যবসায় যোগ দেন নি?’

‘নো স্যার। ছোটকাকা দুর্গামোহনকে দেখি আমার জন্মের অনেক পরে। আমার জন্ম থার্টি সিক্সে। দুর্গামোহন টোয়েন্টি নাইনে সন্ত্রাসবাদীদের দলে যোগ দিয়ে খুলনার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার টার্নবুল সাহেবকে গুলি মেরে তাঁর থুৎনি উড়িয়ে দেন।’

‘তারপর?’

‘তারপর হাওয়া। বেপাত্তা। পুলিশ ধরতে পারেনি ছোটকাকাকে। আমার ধারণা আমার অ্যাডভেঞ্চার প্রতিটা ছোটকাকার কাছ থেকেই পাওয়া।’

‘উনি আর আসেন নি?’

‘এসেছিলেন। একবার। স্বাধীনতার পর ফর্টি নাইনে। তখন আমি থার্ড ক্লাসে পড়ি। সেই প্রথম আর সেই শেষ দেখা ছোটকাকার সঙ্গে। তবে যাঁকে দেখলাম তিনি সেই অগ্নিযুগের ছোটকাকা দুর্গামোহন গাঙ্গুলী নন। কমপ্লীট চেঞ্জ। কোথায় সন্ত্রাস, কোথায় পিস্তল। একেবারে নিরীহ, সাত্ত্বিক পুরুষ। মাসখানেক ছিলেন, তারপর আবার চলে যান।’

‘কোথায়?’

‘যদূর মনে পড়ে কোনো জঙ্গলে কাঠের ব্যবসা করতে যান।’

‘বিয়ে করেননি?’

‘নাঃ।’

‘কিন্তু আপনার আপন বা জ্যাঠতুতো ভাইবোন আছে নিশ্চয়ই।’

‘আপন বোন একটি আছেন, দিদি। স্বামী রেলওয়েতে চাকরি করেন; ধানবাদে পোস্টেড। জ্যাঠার ছেলে নেই, তিন মেয়ে, তিনজনের স্বামীই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বিজয়া দশমীতে একটি করে পোস্টকার্ড—ব্যস্। আসলে রক্তের সম্পর্কটা কিছুই নয়, ফেলুবাবু। এই যে আপনার আর তপেশের সঙ্গে আমার ইয়ে, তার সঙ্গে কি ব্লাড রিলেশনের কোনো—?’

লালমোহনবাবুর কথা থামাতে হল, কারণ দরজায় টোকা পড়েছে। এটা যাকে বলে প্রত্যাশিত, কারণ টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল সাড়ে ন’টার জন্য, এখন বেজেছে ন’টা তেত্রিশ।

ভদ্রলোকের নামটা জানা ছিল টেলিফোনে—উমাশঙ্কর পুরী—এবার চেহারাটা দেখা গেল। মাঝারি হাইট, দোহারা গড়ন, পরনে ঘী রঙের হ্যাণ্ডলুমের সূট। দাড়ি-গোঁফ কামানো। মাথার চুল কাঁচা-পাকা মেশানো, ডান দিকে সিঁথি। এই শেষের ব্যাপারটা দেখলেই কেন জানি আমার অসোয়াস্তি হয়; মনে হয় মুখটা যেন আয়নায় দেখছি। পুরুষদের মধ্যে শতকরা একজনের বেশি ডান দিকে সিঁথি করে কিনা সন্দেহ, যদিও কারণটা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না।

‘আপনাকে খুব তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে?’ ফেলুদা মন্তব্য করল আলাপ পর্বের পর ভদ্রলোক চেয়ারে বসতেই।

‘হ্যাঁ, তা—’ উমাশঙ্করের ভুরু কপালে উঠে গেল—‘কিন্তু সেটা আপনি জানলেন কী করে?’

‘আপনার বাঁ হাতের সব নখই পরিষ্কার করে ক্লিপ দিয়ে কাটা, তার একটি নখ এখনো কোটের পকেটের ধারে লেগে আছে, অথচ ডান হাতে দুটো নখের পরে আর বাকিগুলো…’

‘আর বলবেন না!’ বললেন মিঃ পুরী, ঠিক সেই সময় একটা ট্রাঙ্ক কল এসে গেল; কথা শেষ হতে হতে দেখি আপনার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় হয়ে গেছে।’

‘যাক্‌ গে—এবার বলুন আপনাকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি।’

মিঃ পুরী গম্ভীর হয়ে নিজেকে সংযত করে নিলেন। তারপর বললেন, ‘মিঃ মিটার, আমি থাকি ভারতবর্ষের আরেক প্রান্তে। আপনার নাম আমি শুনেছি ভগওয়ানগড়ের রাজার কাছ থেকে। শুধু নাম নয়, প্রশংসা। তাই আমি আপনার কাছে এসেছি।’

‘আমি তাতে গর্ব বোধ করছি।’

‘এখন কথা হচ্ছে কি—’ মিঃ পুরী থামলেন। তাঁর মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব লক্ষ করছিলাম। তিনি আবার বললেন, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে কি—একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে; সেইটে যাতে না ঘটে তাই আমি আপনার সাহায্য চাইছি। সেটা পাওয়া যাবে কি?’

ফেলুদা বলল, ‘আপনি কী ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা বলছেন সেটা না জানা পর্যন্ত আমি মতামত দিতে পারছি না।’

শ্রীনাথ এই সময় চা-চানাচুর-বিস্কুট এনে রাখাতে কথায় একটু বিরতি পড়ল। তারপর মিঃ পুরী একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে বললেন, ‘আপনি রূপনারাণগড় স্টেটের নাম শুনেছেন?’

‘নামটা চেনা-চেনা লাগছে’, বলল ফেলুদা, ‘উত্তর প্রদেশে কি?’

‘ঠিকই বলেছেন,’ বললেন মিঃ পুরী। ‘আলিগড় থেকে ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে। আমি যখনকার কথা বলতে যাচ্ছি সেটা আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। তখন রাজা ছিলেন চন্দ্রদেও সিং। আমি ছিলাম এস্টেটের ম্যানেজার। ভারত স্বাধীন হয়ে গেলেও তখনও এসব নেটিভ স্টেটের উপর তত চাপ পড়েনি; রাজারা রাজাই ছিলেন। চন্দ্ৰদেও-এর বছর চুয়ান্ন বয়স, কিন্তু তখনও সিংহের মতো চেহারা। শিকার করেন, টেনিস খেলেন, পোলো খেলেন, প্রৌঢ়ত্বের কোনো লক্ষণ নেই। একটি ব্যারাম তাঁকে মাঝে মাঝে বিব্রত করত, কিন্তু সেটা যে হঠাৎ এমন আকার ধারণ করবে সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। হাঁপানি। সে যে কী হাঁপানি সে আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। একটা জলজ্যান্ত জোয়ান মানুষকে ছ’ মাসের মধ্যে কঙ্কালে পরিণত হতে এই প্রথম দেখলাম। কোনো ওষুধে কোনো কাজ দিল না। হয়ত দুদিন দেয়, আবার যেই কে সেই।

‘সেই সময় খবর এল, হরিদ্বারে নাকি এক ভদ্রলোক থাকেন, নাম ভবানী উপাধ্যায়, তিনি নাকি হাঁপানির অব্যর্থ ওষুধ জানেন। বহু রুগী তাঁর ওষুধে সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করেছে।

‘আমি নিজেই চলে গেলাম হরিদ্বার। ঠিকানা জানা ছিল না ভদ্রলোকের, কিন্তু খোঁজ পেতে অসুবিধা হল না, কারণ ওঁকে অনেকেই চেনে। সাদাসিধা মানুষ, ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকেন, আমাকে যথেষ্ট খাতির করে তাঁর তক্তপোষে বসালেন। তারপর সব শুনেটুনে বললেন, আমি যাব আপনার সঙ্গে, রাজাকে ওষুধ দেব; সারবার হলে দশদিনের মধ্যে সারবে, নাহলে নয়। সেই দশদিন আমি ওখানে থাকব। ওষুধে কাজ না দিলে আমি কোনো পয়সা নেবো না।

‘বললে বিশ্বাস করবেন না মিঃ মিটার, দশদিন নয়, সাতদিন নয়, তিনদিনের মধ্যে রাজার হাঁপানি উধাও। এমন যে ঘটতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। উপাধ্যায় বললেন তাঁর ওষুধের দাম পঞ্চাশ টাকা। রাজাকে বলতে তিনি ত কথাটা কানেই তুললেন না। বললেন, আমি মরতে বসেছিলাম, উনি এসে আমাকে নতুন জীবন দান করলেন, আর তার দাম হল কিনা পঞ্চাশ টাকা?

‘এখানে বলে রাখি যে রাজা চন্দ্রদেও মানুষটা একটু খামখেয়ালী ছিলেন। তাছাড়া তাঁর শোক, তাঁর আনন্দ, তাঁর ক্রোধ, তাঁর দয়াদাক্ষিণ্য—সবই সাধারণ মানুষের চেয়ে মাত্রায় অনেকটা বেশি ছিল। পঞ্চাশ টাকার বদলে উনি উপাধ্যায়কে যেটা দিলেন সেটা একটা মণিমুক্তাখচিত সোনার বালগোপাল। জিনিসটা আসলে একটা পেনডেন্ট বা লকেট—লম্বায় ইঞ্চি তিনেক। তখনকার দিনে সেটার দাম পাঁচ-সাত লাখ টাকা।’

একটু ফাঁক পেয়ে ফেলুদা প্রশ্ন করল, ‘উপাধ্যায় নিলেন সেই লকেট?’

‘সেই কথাই ত বলছি,’ বললেন উমাশঙ্কর পুরী। উপাধ্যায় বললেন, আমি সাদাসিধে মানুষ, আমাকে এমন বিপাকে ফেলছেন কেন? এত দামী একটা জিনিস আমার কাছে থাকবে, সেটা লোকে আমার বলে বিশ্বাস করবে কেন? সবাই ভাববে আমি চুরি করেছি।’

‘রাজা বললেন—কারুর ত জানার দরকার নেই। আমরা ত আর খবরটা ঢাক পিটিয়ে জাহির করতে যাচ্ছি না। আর নেহাৎই যদি কেউ জেনে ফেলে, তার জন্য আমি আমার নিজের শীলমোহর দিয়ে লিখে দিচ্ছি যে এটা আমি তোমাকে পারিতোষিক হিসেবে দিলাম। এর পরে ত আর কারুর কিছু বলার নেই।

‘উপাধ্যায় বলল, তাই যদি হয়, তাহলে আমি মাথা পেতে নেবো আপনার এ পারিতোষিক।’

ফেলুদা বলল, ‘আপনি, রাজা,এবং উপাধ্যায়—এই তিনজন ছাড়া আর কেউ কি ঘটনাটা জানত?’

‘আমি সত্যি কথা বলব,’ বললেন উমাশঙ্কর পুরী, ‘রাজা নিজে যদি খেয়ালবশে কাউকে বলে থাকেন ত সে আমি জানি না; ব্যাপারটা জানত রাজা, রাণী এবং দুই রাজকুমার—সূরয ও পবন। বড় কুমার সূরয অতি চমৎকার ছেলে, রাজপরিবারে এমন দেখা যায় না। তার বয়স তখন বাইশ-তেইশ। ছোট কুমারের বয়স পনের। এছাড়া জানতাম আমি, আমার স্ত্রী আর আমার ছেলে দেবীশঙ্কর—তার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। ব্যস্‌, আর কেউ না। আর এটাও আপনি খেয়াল করে দেখুন মিঃ মিটার—এ খবর কিন্তু গত ত্রিশ বছরে কোনো কাগজে বেরোয়নি। আপনি ত সাংবাদিকদের জানেন; তারা এর গন্ধ পেলে কি ছেড়ে দিত?’

‘সে কথা ঠিক,’ বলল ফেলুদা, ‘ব্যাপারটার গোপনীয়তা রক্ষিত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’

যাই হোক, এবার আমি এগিয়ে আসছি বর্তমানের দিকে। রাজা চন্দ্রদেও সিং বেঁচেছিলেন আর বছর বারো। তারপর সূরযদেও রাজা হলেন। রাজা মানে, তখন ত আর রাজা কথাটা ব্যবহার করা চলে না; বলতে পারেন উনিই হলেন কর্তা।’

‘আপনি তখনো ম্যানেজার?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ; এবং আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি যাতে ব্যবসা ইত্যাদির সাহায্যে রূপনারাণগড়ের ভবিষ্যৎকে আরো মজবুত করা যায়। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি, সূরযদেও-এর এসব দিকে কোনো উৎসাহ নেই। তার নেশা হচ্ছে বই। সে দিনের মধ্যে ষোল ঘণ্টা তার লাইব্রেরিতে পড়ে থাকে। সেখানে আমার একার চেষ্টায় আমি কী করতে পারি? ফলে আর্থিক দিক দিয়ে স্টেটের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে আসতে থাকে।’

‘আপনার নিজের ছেলেও ত ততদিনে বড় হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। দেবীকে অবশ্য আমি আগেই আলিগড়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিই। সে আর রূপনারাণগড়ে ফেরেনি। দিল্লী গিয়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করেছে।’

‘আপনার কি ওই একই ছেলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। যাই হোক্‌, আমার নিজের অনেকবার মনে হয়েছে যে ম্যানেজারি ছেড়ে দিয়ে আমার নিজের দেশ মোরাদাবাদে গিয়ে একটা কিছু করি, কিন্তু মায়া কাটাতে পারছিলাম না।’

মিঃ পুরী এবার পকেট থেকে একটা চরুট বার করে ধরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এবার আমি আসল ঘটনায় আসছি; আপনার ধৈর্যচ্যুতি হয়ে থাকলে আমায় মাপ করবেন।

‘সাতদিন আগে, অর্থাৎ ঊনত্রিশে এপ্রিল, শনিবার রূপনারাণগড়ের ছোটকুমার পবনদেও সিং হঠাৎ আমার কাছে এসে হাজির হন। তার প্রথম কথাই হল, “আমার বাবার হাঁপানি যিনি সারিয়েছিলেন তাঁর নাম ও তাঁর হরিদ্বারের ঠিকানাটা আমার চাই।”

‘স্বভাবতই আমি প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম কারুর কোনো অসুখ করেছে কি না। পবন বলল, না, তা নয়; সে একটা টেলিভিশনের ছবি করছে, তার জন্য তার এই ভদ্রলোককে দরকার।

‘পবন যে ক্যামেরা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেটা আমি জানতাম, কিন্তু সেটা যে টেলিভিশন নিয়ে মেতে উঠেছে, সে খবর জানতাম না। আমি বললাম, “তুমি কি তোমার ছবিতে সে ভদ্রলোককে দেখাতে চাও?” সে বললে, “অবশ্যই। শুধু তাই না। বাবা তাকে যে লকেটটা দিয়েছিলেন সেটাও দেখাব। একটা অসুখ সারিয়ে এরকম বকশিস আর কেউ কোথাও পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না।”

‘তখন আমার পবনকে বলতেই হল যে উপাধ্যায় তাঁর এই পারিতোষিকের ব্যাপারটা একেবারেই প্রচার করতে চাননি। পবন বলল, “ত্রিশ বছর আগে একটা লোক যে কথা বলেছে, আজও যে সে তাই বলবে এমন কোনো কথা নেই। সমস্ত পৃথিবীর কাছে নানারকম তথ্য পরিবেশন করা টেলিভিশনের একটা প্রধান কাজ। আপনি আমাকে নাম ঠিকানা দিন। ওঁকে রাজি করাবার ভার আমার।”

‘কী আর করি; বাধ্য হয়ে উপাধ্যায়ের নাম ঠিকানা দিয়ে দিলাম; সে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল।’

‘উপাধ্যায়ের বয়স এখন আন্দাজ কত হবে?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।

‘তা সত্তর-বাহাত্তর ত হবেই। রূপনারায়ণগড়ে যখন এসেছিল তখন তার যৌবন পেরিয়ে গেছে।’

ফেলুদা উমাশঙ্করের দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, আপনি কি শুধু এই ব্যাপাটার গোপনীয়তা রক্ষা হবে না বলে চিন্তিত হচ্ছেন?’

মিঃ পুরী মাথা নাড়লেন।

‘না মিঃ মিটার। আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন। শুধু যদি তাই হত তাহলে আমি আপনার কাছে আসতাম না। আমার ভয় হচ্ছে ওই লকেটটাকে নিয়ে। পবনের নতুন শখ হয়েছে টেলিভিশনের ছবি তোলার। আপনি নিশ্চয় জানেন যে কাজটা খরচ সাপেক্ষ। পবনের নিজের কোনো অর্থ সংগ্রহের রাস্তা আছে কিনা জানি না, কিন্তু এটা জানি যে ওই একটি লকেট ওর সমস্ত অর্থসমস্যা দূর করে দিতে পারে।’

‘কিন্তু ওই লকেটটি হাত করতে হলে ত তাকে অসদুপায় অবলম্বন করতে হতে পারে।’

‘তা ত বটেই।’

‘পবনদেও ছেলে কেমন?’

‘সে বাপের কিছু দোষগুণ দুটোই পেয়েছে। পবনের মধ্যেও একটা বেপরোয়া দিক আছে। ভালো খেলোয়াড়। ছবি ভালো তোলে। আবার জুয়ার নেশাও আছে। অথচ তার দরাজ মনের পরিচয়ও পেয়েছি। ওকে চেনা ভারী শক্ত। যেমন ছিল ওর বাপকে।’

‘তাহলে আপনি আমার কাছে কী চাইছেন?’

‘আমি চাইছি আপনি দেখেন যাতে এই অসদুপায়টি অবলম্বন না করা হয়।’

‘পবনদেও কি হরিদ্বার যাচ্ছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে তাঁর যেতে একটু দেরি হবে—অন্তত পাঁচ-সাতদিন, কারণ এখন উনি প্যালেসের ছবি তুলছেন।’

‘আমাদেরও যেতে গেলে সময় লাগবে, কারণ তার আগে ত ট্রেনে বুকিং পাওয়া যাবে না।’

‘তা বটে।’

‘কিন্তু ধরুন যদি আমি কেসটা নিই, আমি আপনাদের ছোট কুমারকে চিনছি কি করে?’

‘সে ব্যবস্থাও আমি করে এনেছি। দিল্লীর একটি সাপ্তাহিক কাগজে কুমারের এই রঙীন ছবিটা বেরিয়েছিল গত মাসে। একটা বিলিয়ার্ড চ্যামপিয়নশিপে জিতেছিল। এটা আপনি রাখুন। আর ইয়ে, আপনাকে আগাম কিছু…?’

‘আমি হাজার টাকা অ্যাডভান্স নিই,’ বলল ফেলুদা। ‘কেস সফল না হলেও সেটা ফেরত দিই না, কারণ সফল না হওয়াটা অনেক সময় গোয়েন্দার অক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। সফল হলে আমি আরো এক হাজার টাকা নিই।’

‘বেশ। আপনাকে এখনই কিছু বলতে হবে না। আমি পার্ক হোটেলে আছি। আপনি কী স্থির করেন বিকেলে চারটে নাগাদ ফোন করে জানিয়ে দেবেন। হ্যাঁ হলে আমি নিজে এসে আপনাকে আগাম টাকা দিয়ে যাবো।’