মৃত্যুপুরীর অতিথি (উপন্যাস)
[কাল্পনিক কাহিনি নয়। সত্য ঘটনা]
মালিক! আমরা চললাম! তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাদের সঙ্গে আসতে পারো অথবা একলা এখানে থাকতে পারো কিন্তু আমরা আর এগোতে রাজি নই, আমরা ফিরে যাব।
ফ্রাঙ্ক নোভাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রেড-ইন্ডিয়ানদের দলপতির দিকে তাকাল, তারপর সেই ছোটোখাটো লোকটির উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে দলেব বাকি ছয়জন মানুষকে ভালো করে নিরীক্ষণ করলে…
আচ্ছা, এবার আমাদের কাহিনির স্থান, কাল, পাত্রের সঙ্গে পাঠক-পাঠিকাদের পরিচয় করে দিচ্ছি
স্থান-ইকুয়েডরের বনভূমি।
কাল-১৯৫৫ সাল, ডিসেম্বরের কুয়াশা-আচ্ছন্ন প্রভাত। পাত্রদের মধ্যে উপস্থিত আছে কাহিনির নায়ক ফ্রাঙ্ক নোভাক এবং সাতজন কুইচা জাতের রেড-ইন্ডিয়ান মাঝি। কুইচারা এখানে এসেছে নোভাকের সঙ্গে। তারা নোভাকের ভাড়াটে মাঝিও বটে, মোট বহনকারী কুলিও বটে। কিছু অর্থের বিনিময়ে তারা নদীপথে ও বনপথে মালিকের প্রয়োজন অনুযায়ী মাঝি ও কুলির কর্তব্য পালন করতে রাজি হয়েছে। পারিশ্রমিক হিসাবে যে অর্থ তারা দাবি করেছিল তার অঙ্কটা যদিও একটু বেশি তবু ফ্রাঙ্ক নোভাক আপত্তি জানায়নি, হাসি মুখেই কুইচাদের দাবি মেনে নিয়েছিল।
হঠাৎ আজ সকালে কুইচাদের দলপতি মালো বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, মালিক! আমরা চললাম। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাদের সঙ্গে আসতে পারো অথবা একলা এখানে থাকতে পারো কিন্তু আমরা আর এগোতে রাজি নই, আমরা ফিরে যাব।
একটু থেমে মালো আবার বললে, জিভারোরা আমাদের ফিরে যেতে বলেছে।
ফ্রাঙ্ক নোভাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাইল, তারপর পকেট থেক সিগারেট বার করলে। একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে সে প্যাকেটটা সকলের সামনে এগিয়ে ধরলে।
কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেউ কথা কইল না, নিঃশব্দে উড়তে লাগল সিগারেটের ধোঁয়া।
নোভাক ধুমপান করছিল আর চিন্তা করছিল, কি উপায়ে লোকগুলোকে এখন সামলানো যায়। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে তল্পিতল্পা নিয়ে পথ চলা সত্যিই অত্যন্ত কঠিন কাজ।
একটু পরে নোভাক মুখ খুলল, তাহলে জিভারোরা তোমাদের ফিরে যেতে বলেছে?
দলপতি মালো বললে, হ্যাঁ মালিক। যে মানুষের মাথায় ঘিলুর বদলে শুকনো কাঠ আছে, সে ছাড়া আর কেউ জিভারোদের আদেশ অমান্য করতে সাহস পাবে না। কমো সে ডাইস? মালিক, তুমি কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?
জিভারোদের আদেশ তুমি কি করে শুনলে, মালো? তারা বোধহয় স্বপ্নে তোমার সঙ্গে দেখা করে আদেশ জানিয়ে গেছে? অথবা একটা ছোটো বাঁদর কিচমিচ করে গাছের উপর থেকে জানিয়ে দিয়েছে জিভারোদের নির্দেশ? এ পর্যন্ত কোনো জিভারোকে আমরা দেখতে পাইনি, তাই তাদের আদেশটা কি করে তোমার কানে পৌঁছে গেল সেটা আমি জানতে চাই।
মানলা একেবারে অশিক্ষিত নয়।
রেড-ইন্ডিয়ানদের কুসংস্কারকে কটাক্ষ করে তার উপর যে বিদ্রূপ বর্ষিত হল সেটা সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলে।
তার ভ্রু কুঞ্চিত হল, কপালে জাগল সারি সারি কুঞ্চনরেখা।
গম্ভীর স্বরে সে বললে, না, স্বপ্ন কিংবা বাঁদরের চিৎকারের মতো বাজে প্রমাণের উপর নির্ভর করে আমি ফিরে যেতে চাই না। আমার প্রমাণের ভিত্তি খুব মজবুত।
তাই নাকি? তা তোমার মজবুত প্রমাণটা কি? একবার শুনি।
যেসব গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা এসেছি, সেইসব জায়গায় আমাদের চোখে পড়েছে বহু মানুষের মুণ্ডহীন দেহ আর সেই মৃতদেহগুলির কাছে বসে চিৎকার করে কাঁদছিল মেয়েরা। নদীর ধারে বালির উপর বিধেছিল মৃত যোদ্ধাদের বর্শাগুলি। এই সব চিহ্ন দেখেই আমরা বুঝতে পারছি জিভারোরা বেরিয়েছে নরমুণ্ডের সন্ধানে। মালিক, আমাদের মুণ্ডগুলো আমরা ঘাড়ের উপর রাখতে চাই– আমরা ফিরে যাব।
অসহিষ্ণু স্বরে নোভাকে বললে, কি মুশকিল। আমরা এখানে তেলের সন্ধানে এসেছি, জিভারোদের সঙ্গে ঝগড়া করতে আসিনি। আমাদের উপর জিভারোদের রাগের কোনো কারণ থাকতে পারে না। মালো! সত্যি কথাটা বলো তো? চাপ দিয়ে আরও টাকা আদায় করতে চাও এই তো?
-না মালিক! আমরা টাকা চাই না, বাঁচতে চাই
মালো, ক্রুদ্ধস্বরে নোভাক বললে, এতগুলো জোয়ান মরদের দলপতি হয়ে তুমি একটা বুড়ি মেয়েমানুষের মতো কথা কইছ? তোমার দেখাদেখি দলের লোকগুলোও মেয়েমানুষের মতো ভয় পাচ্ছে।
মালোর মুখ কালো হয়ে উঠল, মালিক, তোমার কথাটা ঠিক হল না। আগের দিন তোমার সঙ্গে লড়াইতে আমি হেরে গেছি বটে কিন্তু ভয় পেয়ে আমি পরাজয় স্বীকার করেনি তুমি আমার চাইতে অনেক ভালো যোদ্ধা তাই তুমি জয়লাভ করেছ।
তাই নাকি? তাহলে জেনে রাখো আমার কথা না শুনলে আবার আমি তোমার সঙ্গে লড়তে বাধ্য হব।
নোভাকের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। কুইচাদের গায়ে হাত দিতে তার ভালো লাগে না। এই লোকগুলিকে সে সত্যিই পছন্দ করে আর তারাও ভালোবাসে তাদের মালিককে। কিন্তু এখন নোভাক কি করবে? এতদূর এগিয়ে সে ফিরে যেতে রাজি নয়।
সে মালোর দিকে তাকাল।
নিজের দুই কাঁধে ঝকানি দিয়ে মালো বুঝিয়ে দিলে লড়াই করতে তার আপত্তি নেই সে প্রস্তুত।
নোভাক মালোর মাথার দিকে হাত বাড়ালে, চুল ধরে মাথাটাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে সজোরে মুখের উপর হাঁটু তুলে দিতে পারলেই লড়াই ফতে
কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হল না।
মালো সাঁৎ করে একপাশে সরে গেল আর সঙ্গেসঙ্গে একটা কঠিন বস্তু সবেগে আঘাত করলে নোভাকের ঘাড়ে।
নোভাক দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না, হাঁটু পেতে বসে পড়ল হুমড়ি খেয়ে—
একজন কুইচা ম্যাচেটের উলটো দিক দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে।
ম্যাচেট এক ধরনের বড়ো ছোরা।
ছোরা না বলে এই অস্ত্রকে তরবারি বললেই ভালো হয়।
লোকটা ইচ্ছে করলে ম্যাচেটের এককোপে নোভাকের মাথাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে পারত, কিন্তু খুন করার উদ্দেশ্য তার ছিল না– মালিককে সে বাধা দিতে চেয়েছিল।
দারুণ ক্রোধে নোভাকের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল।
সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল মালোর উপর।
আবার দুলে উঠল একটা ম্যাচেট, অস্ত্রের ভোতা দিকটা ঠকাস করে এসে লাগল নোভাকের মাথায়।
আঘাতের বেগ সামলাতে না পেরে সে একটা গাছের শিকড়ের উপর পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে হোঁচট খেয়ে তার দীর্ঘদেহ লম্বমান হল ভূমিশয্যায়। দারুণ যাতনায় তার সর্বাঙ্গ হয়ে এল অবশ, কেবল তীব্র ইচ্ছাশক্তির জোরে নোভাক তার চৈতন্যকে জাগ্রত করে রাখল।
নোভাকের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে মালো বললে, মালিক, আমরা দুঃখিত। তোমার উপর আমাদের একটুও রাগ নেই, তোমাকে আমরা মারতেও চাইনি। কিন্তু কি করব? তুমি আমাদের সবাইকে মৃত্যুর মুখে টেনে নিতে চাও তাই তোমাকে বাধা দিলুম। সামান্য কিছু খাদ্য আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আর সব খাবার, মালপত্র, সাজসরঞ্জাম সবই তোমার জন্য রেখে দিচ্ছি। মনে রেখো মালিক- কুইচারা চোর নয়।
নোভাক বললে, চুলোয় যাও।
মালিক! এখনো বলছি তুমি আমাদের সঙ্গে এসো। জিভারোরা নরমুণ্ড-শিকারে বেরিয়েছে, এখানে থাকলে তুমি মারা পড়বে।
নোভাক বললে, চুলোয় যাও।
বেশ। যে লোক মরতে চায় তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না। আমরা তোমার কাছে টাকা পয়সা কিছু চাই না কারণ তোমার সঙ্গে যে চুক্তি ছিল তা আমরা রাখতে পারিনি, কাজেই তোমার কাছে আমরা কোনো পারিশ্রমিক দাবি করতে পারি না। তোমার জন্য একটা ক্যানো আমরা রেখে যাচ্ছি।
নোভাক আবার বললে, চুলোয় যাও।
কুইচারা চলে গেল।
একটা ক্যানো নৌকো এবং প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ-বিষুধের বাক্স পড়ে রইল সেখানে। যেটুকু–নিলে নয় শুধু সেই টুকু খাবার দাবার নিয়ে কুইচারা জলপথে অন্তর্ধান করলে।
নোভাক মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে কুইচারা সত্যিই ভালো লোক। মার খেয়ে নোভাক একটুও অসন্তুষ্ট হয়নি, ওদের চলে যাওয়াটাই তার ভীষণ খারাপ লাগছিল। জিভারো সম্বন্ধে মালোর উক্তি সে আদৌ বিশ্বাস করেনি।
নোভাক চিন্তা করে দেখল যে এবার তাকে একাই এগিয়ে যেতে হবে। সেটা একেবারে অসম্ভব না হলেও সে বুঝল ব্যাপারটা অতিশয় কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। এক ঘণ্টার পথ চলতে এখন তার সময় লাগবে তিন ঘণ্টা। যাক, গতস্য শোচনা নাস্তি- সে ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
হোঁচট খেয়ে পড়ে নোভাকের পা মচকে গিয়েছিল কিন্তু পায়ের আঘাত যে কতখানি গুরুতর সেটা সে আগে বুঝতে পারেনি। উঠে দাঁড়াতেই পায়ের গোড়ালি থেকে উরু অবধি অসহ্য যন্ত্রণায় টনটন করে উঠল–
অগত্যা নোভাক আবার মাটির উপর বসে পড়ল ধপাস করে। বুট জুতো খুলে সে দেখল। পায়ের গোড়ালিটা খুব ফুলে উঠেছে আর চামড়ার তলা থেক ঠেলে উঠেছে অনেকগুলি নীল শিরা– পায়ের অবস্থা শোচনীয়!
কুয়াশা সরে যাচ্ছে। ঘন সন্নিবিষ্ট লতাগুল্ম ও সারিবদ্ধ গাছের ফাঁক দিয়ে ছুটে আসছে প্রভাত-সূর্যের আলোকধারা।
নোভাক দেখল উঁচু জমিটা মোটেই সঁতসেঁতে নয়, বেশ শুকনো। একটু দূরেই কলকল শব্দে গান গাইতে গাইতে ছুটে চলেছে নদীর জলধারা। কুইচারা রেখে গেছে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, একটু দূরে বাক্সবন্দি অবস্থায় সেগুলো ছড়িয়ে আছে।
নোভাক নিশ্চিন্ত হল- তাবু খাঁটিয়ে বিশ্রাম নেবার পক্ষে এটি হচ্ছে আদর্শ স্থান…
নোভাকের বঁড়শিতে ধরা পড়ল কয়েকটা নদীর মাছ।
ঘাসপাতা, শুকনো গাছের ডাল প্রভৃতির সাহায্যে আগুন জ্বালিয়ে নোভাক মাছ রান্না করলে। আহার-পর্ব শেষ করে নোভাক বসে রইল নদীর জলে গা ডুবিয়ে কারণ জঙ্গলের মধ্যে পোকার বড়ো উপদ্রব।
ঠান্ডা জলের স্পর্শে ঘাড় এবং পায়ের ব্যথা অনেক কমে গেল। রাত্রিবেলা নৈশভোজন শেষ করে সে তার বাঁশীটাকে বার করে ফুঁ দিলে। যাত্রাপথে নোভাক একটা গান শিখেছিল আর এই গানটাকেই নানারকম করে সে বাজাতে লাগল।
জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডর পাশে বসে ভরা পেটে বাঁশি বাজাতে বাজাতে এক সময় তার চোখ ঘুমে ভারি হয়ে উঠল। বাঁশি রেখে সে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার একবার মনে হল হতভাগা মালো যদি এখানে থাকত তাহলে বুঝতে পারত তার আশঙ্কা কতখানি অমূলক..
.
পরের দিন সকালে নোভাক বুঝল মালো মোটেই ভুল করেনি।
সকালবেলা। একটা গাছের গুঁড়িতে, ঠেস দিয়ে ঢুলছে নোভাক। পায়ের ব্যথা কমে গেলেই সে যাত্রা শুরু করবে এই হচ্ছে তার মনের ইচ্ছা।
হঠাৎ তার তন্দ্রাচ্ছন্ন শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল এক অদ্ভুত শব্দ-তরঙ্গ- ঠিক তার মাথার উপরে গাছের গুঁড়িতে আওয়াজ উঠল ফট। ফট ফট!
নোভাক সচমকে শব্দ লক্ষ্য করে দৃষ্টি সঞ্চালিত করলে
পরক্ষণেই পায়ের যন্ত্রণা ভুলে সে মাটির উপর ঝাঁপ খেল এবং কখনো গড়িয়ে কখনো ছুটে উধ্বশ্বাসে এগিয়ে চলল তাঁবুর দিকে বন্দুকের উদ্দেশ্যে।
–গাছের গুঁড়িটাকে বিদ্ধ করে কেঁপে কেঁপে উঠছে একঝাক তির!
নোভাকের অভিজ্ঞ চক্ষু একনজরেই বুঝল যে তিরগুলো সাধারণ ধনুকের সাহায্যে নিক্ষেপ করা হয়নি। এগুলো ছোঁড়া হয়েছে ব্লো-গান নামক মারাত্মক যন্ত্র থেকে।
ব্লো-গান বা ব্লো-পাইপ এক ধরনের ফাপা নল। এই নলের মধ্যে তির বসিয়ে সজোরে ঠু দিয়ে রেড-ইন্ডিয়ানরা তিরকে লক্ষ্যপথে চালনা করে। এতক্ষণে নোভাকের জ্ঞান-চক্ষু উন্মীলিত হল
কুইচা দলপতি মালো তাকে মিথ্যা কথা বলে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেনি! তিরগুলো যে জিভারো-যোদ্ধাদের ব্লো-গান থেকে উড়ে এসেছে এ বিষয়ে নোভাকের একটুও সন্দেহ রইল না।
তবে জিভারো হোক আর যাই হোক বিনাযুদ্ধে মৃত্যুবরণ করার মানুষ ফ্রাঙ্ক নোভাক নয়
তাবুর ভিতর থেকে বন্দুকটাকে হস্তগত করে সে প্রস্তুত হল।
শু-শু-শুট ট!
আবার ছুটে এল একঝাক তির তাবুর ক্যানভাস ভেদ করে! একটা তির তত আর-একটু হলে তার হাতে লাগত
তিরের চকচকে ফলাটা নোভাকের আঙুল ঘেঁসে মাটিতে কামড় বসাল!
নাঃ! এখানে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য! বন্দুক বাগিয়ে ধরে সে নীচু হয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলল নদীর দিকে, আর একটু পরেই জঙ্গল আর নদীর মাঝখানে একটা মস্ত পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করলে…
অনেকক্ষণ কেটে গেল। নোভাক অপেক্ষা করছে…।
কোথায় কি? জঙ্গলের আড়াল থেকে কোনো সশস্ত্র জিভারো তার দিকে তেড়ে এল না, এমনকী তিরের ছুটোছুটিও হঠাৎ হয়ে গেল বন্ধ।
কিন্তু নোভাক জানত শত্রুপক্ষ আশেপাশে ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেইতির ছুঁড়ে তারা শিকারের প্রাণবধ করবে। শক্ত মুঠিতে বন্দুক বাগিয়ে ধরে সে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইল…
অনেকক্ষণ পরে খুব সাবধানে একটুখানি মুখ বাড়িয়ে সে একবার চারদিকে দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা করেছিল তৎক্ষণাৎ মারাত্মক অভ্যর্থনা জানিয়ে তার দিকে ছুটে এল একঝাক তির!
নোভাক চট করে মাথাটাকে আবার পাথরের আড়ালে টেনে নিলে। এতক্ষণ পরে তার মনে হল মালোর কথা শুনে তার সঙ্গে ফিরে গেলে ভালোই হত; কিন্তু এখন আর অনুতাপ করে লাভ নেই…
সময় এগিয়ে চলেছে।
সকালের সোনালি আলোর পরিবর্তে আকাশে জ্বলছে মধ্যাহ্নসূর্যের রুদ্র দীপ্তি।
ঝলসে যাচ্ছে নোভাকের সর্বাঙ্গ অসহ্য উত্তাপে। কিন্তু স্থান ত্যাগ করে জঙ্গলের ছায়ায় আশ্রয় নেবার উপায় নেই, চতুর্দিকে শরীরী মৃত্যুর মতো হানা দিয়ে বসে আছে জিভাবো-যোদ্ধার দল। সূর্যদেবের জ্বলন্ত আশীবাদ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য নোভাক তার শার্ট খুলে মাথাটা ঢেকে ফেলল। সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল নতুন উপদ্রব!
ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা এসে তার দেহের উপর বসল এবং অনাবৃত ঊ-অঙ্গের নানা জায়গায় হুল ফুটিয়ে রক্তপান করতে লাগল মনের আনন্দে।
অসহ্য যাতনায় সে বালির উপর গড়াগড়ি দিতে শুরু করলে…
পতঙ্গকুলের দংশনে ইতিমধ্যেই নোভাকের দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছে- ক্ষতস্থানগুলি তপ্ত বালুকার স্পর্শে জ্বালা করতে লাগল ভীষণভাবে। তবে একটা উপকার হল। ঘামে-ভেজা দেহের সঙ্গে বালি জড়িয়ে সর্বশরীরে পড়ল বালুকণার নিবিড় প্রলেপ। অজস্র বালুকণার ঘন আবরণ ভেদ করে কীটপতঙ্গরা আর নোভাকের দেহে কামড় বসাতে পারলে না…।
অপেক্ষা করছে নোভাক জিভারোদের জন্য আর জিভাষোরা অপেক্ষা করছে নোভাকের জন্য। দু-পক্ষই জানে যার ধৈর্য বেশি সেই জিতবে।
কিছুক্ষণ পরেই নোভাকের অবস্থা হল শোচনীয়। সে শুয়ে আছে উন্মুক্ত আকাশের নীচে, তার মাথার উপর আগুন ছড়িয়ে হাসছে ইকুয়েডরের মধ্যাহ্ন-সূর্য, কিন্তু জিভাবোরা দাঁড়িয়ে আছে। বনের শীতল ছায়ায়।
একটু পরেই নোভাক পিপাসা বোধ করলে।
ক্রমে ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠল তৃষ্ণার যন্ত্রণা।
জলের জন্য তার প্রাণ ছটফট করতে লাগল।
একটু দূরেই নদীর জল, কিন্তু সেখানে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের উপায় নেই- অরণ্যের অন্তরালে সুযোগের অপেক্ষায় ব্লো-গান বাগিয়ে বসে আছে জিভারো যোদ্ধার দল…
মাটির উপর গাছের ছায়া হল দীর্ঘতর।
আকাশের জ্বলন্ত নীলিমার উপর পড়ল ধূসর অন্ধকারের শীতল প্রলেপ এল সন্ধ্যা।
নোভাকের রৌদ্রদগ্ধ অঙ্গ জুড়িয়ে গেল, কিন্তু সে খুশি হতে পারলে না। জিভারোদের উদ্দেশ্য বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। রাতের অপেক্ষায় বসে আছে জিভারো-যোদ্ধারা। নিবিড় অন্ধকার যখন দৃষ্টিকে করে দেবে অন্ধ, তখনই তারা করবে আক্রমণ।
সব বুঝেও কিছু করার উপায় ছিল না।
সতর্ক ভঙ্গিতে বন্দুকটা চেপে ধরে অর্ধ-শায়িত অবস্থায় সে পাহারা দিতে লাগল…
রৌদ্রদগ্ধ দেহের উপর লাগছে নৈশ-সমীরের স্নিগ্ধ স্পর্শ, গভীর অবসাদে বুজে বুজে আসছে নোভাকের চোখের পাতা। হঠাৎ ডান দিক থেকে ভেসে এল একটা অস্ফুট শব্দ আর সঙ্গেসঙ্গে তার চোখ থেকে পালিয়ে গেল তন্দ্রার আমেজ–
আঙুলের রূঢ় স্পর্শে শব্দ লক্ষ্য করে সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করলে নোভাকের বন্দুক! আগুনের চকিত ঝলকে এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে ধরা পড়ল একটা চতুষ্পদ মূর্তি- শূকর!
জন্তুটা নদীর জলে তৃষ্ণা নিবারণ করতে এসেছিল, তার জলপানের চকচক শব্দেই ঝিমুনি ভেঙে জেগে উঠেছিল নোভাক।
আবার শব্দ হল। এবার বাঁ-দিক থেকে।
নোভাক তাড়াতাড়ি সেদিকে ঘুরল আর হঠাৎ উঁচু পাথরের আড়াল থেকে একটা অদৃশ্য হাত তার বন্দুকের নলটাকে ধরে ফেললে
পরক্ষণেই প্রচণ্ড আকর্ষণে নোভাকের হাতের বন্দুক অন্ধকারের গর্ভে মিলিয়ে গেল।
এতক্ষণ পরে নোভাক হল নিরস্ত্র।
ক্ষোভে, ক্রোধে সে চিৎকার করে উঠল।
অন্ধকারে আন্দাজ করে একমুঠো বালি নিয়ে নোভাক শত্রুর উদ্দেশ্যে ছুড়ল। তার আশা ছিল চোখে বালি লেগে হয়তো আততায়ীর দৃষ্টি অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সে রকম কিছু ঘটল না।
পাথরের বিপরীত দিকে থেকে অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে নোভাকের চোখের সামনে আবির্ভূত হল এক মনুষ্য-মূর্তি- জিভারো!
বিদ্যুৎবেগে লোকটার উদর লক্ষ্য করে নোভাক লাথি ছুড়ল।
আর্তধ্বনি তুলে জিভারো ধরাশায়ী হল আর লম্বমান দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নোভাক। মাটির উপর গড়াগড়ি খেয়ে দুই শত্ৰু পরস্পরকে আঘাত করতে লাগল দারুণ আক্রোশে।
অকস্মাৎ ভূমিপৃষ্ঠে জাগল ঘন ঘন পদশব্দ।
সচমকে নোভাক দেখল অন্ধকারের মধ্যে আরও-অন্ধকার অনেকগুলি ছায়ামূর্তি তাদের দিকে ছুটে আসছে।
একটা মুগুর শূন্যে দুলে উঠল- নোভাক চেষ্টা করেও আত্মরক্ষা করতে পারলে না, ঠকাস করে মুগুরটা এসে পড়ল তার দেহের উপর। পরমুহূর্তেই অনেকগুলো লোক একসঙ্গে তাকে আক্রমণ করলে।
বৃষ্টির মতো নোভাকের সর্বাঙ্গে পড়তে লাগল ঘুসি এবং লাথি। এমনি দারুণ মার খেলে অধিকাংশ লোকই জ্ঞান হারিয়ে ফেলত, কিন্তু নোভাক পোড়-খাওয়া মানুষ– সমস্ত শরীরটাকে গোল করে পাকিয়ে সে মাটির উপর শুয়ে পড়ল এবং নিঃশব্দে সহ্য করতে লাগল সেই অমানুষিক প্রহার…
নোভাকের দুই হাত বেঁধে ফেলা হল।
দুজন জিভারো-যোদ্ধা শুকনো ডালপালা এনে তাতে অগ্নিসংযোগ করলে। অন্ধকারের গর্ভে যাদের দেহগুলি এতক্ষণ প্রায়-অদৃশ্য ছিল, আগুনের আভায় এবার তারা নোভাকের দৃষ্টিপথে ধরা দিলে।
চারপাশের মানুষগুলোর উপর নোভাক দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে
অনেকগুলো অর্ধনগ্ন বলিষ্ঠ মানুষ, কারও হাতে ব্লো-গান আবার কেউ বা বল্লমধারী। অস্পষ্ট আলোতেও বোঝা গেল তাদের চুল কুচকুচে কালো এবং সকলেই দস্তুরমতো সুপুরুষ।
শুধু পুরুষ নয়–জিভারো যোদ্ধাদের সঙ্গে রয়েছে নারীবাহিনী। পুরুষদের মতো মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদও খুব স্বল্প। অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্তাভ আলোকধারা ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েদের শরীরের উপর।
আলোছায়ার খেলায় নেচে নেচে উঠছে কয়েকটা ভুতুড়ে ছায়া তাদের সুগঠিত দেহের অঙ্গে অঙ্গে..
নোভাক লক্ষ করলে নারীবাহিনীর প্রত্যেকটি মেয়ে তাকিয়ে আছে তারই দিকে! পুরুষ-যোদ্ধারা তখন নোভাকের মালপত্র নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। যোদ্ধাদের ভিতর থেকে হঠাৎ একটি লোক নোভাকের দিকে এগিয়ে এল। লোকটিকে দেখে নোভাক বুঝল সে একজন ছোটোখাটো সর্দার।
নোভাকের বন্দুকটা তখন সেই সর্দারের পিঠে ঝুলছে। তার চলাফেরার ধরন দেখে মনে হয় বন্দুকের অধিকারী হয়ে সে বিশেষ গর্ববোধ করছে। আরও একটা বৈশিষ্ট্য নোভাকের চোখে পড়েছিল সর্দারের হাত থেকে ঝুলছে দড়িতে বাঁধা একটা তরমুজ।
লোকটা হঠাৎ আগুনের খুব কাছে এসে দাঁড়াল।
সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠল নোভাক, তার কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল অস্ফুট আর্তধ্বনি!
লোকটির হাতে দড়ি বাঁধা ওটা তরমুজ নয়
অগ্নিকুণ্ডের রক্তিম আলোকে স্পষ্টই হয়ে উঠেছে একটা ছিন্ন নরমুণ্ড! মুণ্ডটার দুই কান ফুটো করে তার ভিতর দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা সরু চামড়ার ফালি এবং সেই চর্মরঙ্কুর বন্ধনে আবদ্ধ নরমুণ্ডটা সর্দারের হাতে দুলে দুলে উঠছে!
নোভাক অনুমান করলে কুইচাদের সঙ্গে আসার পথে গ্রামের ভিতর যে-সব মুণ্ডহীন দেহ তারা দেখেছে, এই মুণ্ডটা নিশ্চয় তাদের মধ্যেই কোনো হতভাগ্যের শরীর থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে।
নোভাকের সর্বাঙ্গে একটা অসুস্থ অনুভূতি পাক দিয়ে উঠল, তিক্তস্বাদে কটু হয়ে উঠল তার কণ্ঠনালী– পরক্ষণেই সে বমি করে ফেললে!
নারী পুরুষের সম্মিলিত জনতা বন্দিকে লক্ষ করে পৈশাচিক উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, ত সানটা! ত সানটা!
নোভাক আবার শিউরে উঠল।
রেড-ইন্ডিয়ানদের ভাষা সে কিছু কিছু বোঝে।
ত, সানটা মানে হল শুষ্ক নরমুণ্ড!
জিভারোরা বাক্সের ভিতর থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে এনেছিল, সেগুলোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকরকম করে পরীক্ষা করলে, তারপর আবার মালপত্রগুলিকে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখতে লাগল।
নোভাক বুঝল, জিভারোদের স্বভাব-চরিত্র হিংস্র হলেও তারা বেশ শৃঙ্খলা-প্রিয় জাতি।
হঠাৎ একটি মেয়ে এগিয়ে এল নোভাকের দিকে।
কিছুক্ষণ তার চোখে চোখ রেখে সে ফিরে গেল অগ্নিকুণ্ডের কাছে এবং একখানা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আবার নোভাকের সামনে এসে দাঁড়াল।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে নোভাকের মনে হল, মেয়েটি দেখতে অপূর্ব সুন্দরী হলেও কিন্তু তার উদ্দেশ্য খুব সুন্দর নয়।
নোভাকের সন্দেহ সম্পূর্ণ সত্য মেয়েটা হঠাৎ জ্বলন্ত কাঠ দিয়েই তার বুকে মারলে এক খোঁচা!
নোভাকের হাত-পা বাঁধা। সেই অবস্থাতেই সে কোনোরকমে পশ্চাদদেশে ভর দিয়ে পিছিয়ে গেল এবং রজ্জবদ্ধ হাত তুলে জ্বলন্ত কাঠটাকে ছিটকে ফেলে দেবার চেষ্টা করলে।
তার চেষ্টা সফল হল না মেয়েটি হেসে উঠল, জ্বলন্ত কাঠটা আবার এসে পড়ল নোভাকের বুকে।
যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল নোভাক।
জিভারো রমণীদের মুখ দেখে মনে হল তারা বেশ আনন্দ উপভোগ করছে। কিন্তু জিভারো দলপতি এই নিষ্ঠুর খেলা পছন্দ করলে না।
নোভাকের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে যোদ্ধারা ছুটে এল।
জিভারোদের সর্দার নোভাকের নির্যাতনকারিণীর মুখের উপর করলে এক দারুণ চপেটাঘাত। মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে গেল, তার হাত থেকে খসে পড়ল জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড। সর্দার কাঠটা তুলে নিয়ে মেয়েটির দেহে আঘাত করতে উদ্যত হল।
বাঘিনী পরিণত হল হরিণীতে উধ্বশ্বাসে ছুটল সেই নারী এবং তাকে লক্ষ্য করে সর্দারের হাত থেকে ছুটে এল অগ্নিময় কাষ্ঠখণ্ড।
জ্বলন্ত কাঠের টুকরোটা এসে পড়ল রমণীর পায়ের উপর।
মেয়েটি মাটিতে বসে পড়ল, যাতনা-বিকৃত মুখে আহত পায়ের শুশ্রূষায় মন দিলে। মাঝে মাঝে তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল অস্ফুট আর্তস্বর- নিজের দেহের জ্বলন্ত কাঠের কাষ্ঠ-রসিকতা তার একটুও ভালো লাগেনি…
সকাল হল। জেগে উঠল জিভারোরা।
নোভাক জেগে উঠল না, কারণ সে জেগেই ছিল।
সারারাত তার একটুও ঘুম হয়নি।
যোদ্ধারা সকলেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল, তাই মশারা তাদের উপর বিশেষ উৎপাত করতে পারেনি। কিন্তু নোভাককে কেউ কম্বল দেয়নি, ফলে উপবাসী মশককুলের আক্রমণে তার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। তার উপর হঠাৎ এসেছে বৃষ্টি। প্রহার-জর্জরিত শরীরের উপর অসংখ্য মশকের দংশন এবং ডিসেম্বরের বৃষ্টিসিক্ত রাত্রির হিমশীতল স্পর্শ গ্রহণ করে কোনো মানুষই ঘুমোতে পারে না- নোভাকও পারেনি। নিদ্রাহীন চক্ষু মেলে সারা রাত সে অপেক্ষা করেছে। প্রভাতের আলোর…
জিভাবরা যোদ্ধারা নদী থেকে কয়েকটা মাছ ধরলে। সেই মাছ এবং বনের ফল দিয়ে জিভায়রারা সকাল বেলা উপবাস ভঙ্গ করলে।
নোভাকের ভাগ্যে কিছু জুটল না।
একজন শুধু তৃষ্ণা-নিবারণের জন্য তাকে একপাত্র জল এগিয়ে দিলে।
আহারাদির পর্ব শেষ করে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত বাহিনী বন্দির সামনে এসে দাঁড়াল সারিবদ্ধ হয়ে।
নোভাক দেখল তাদের স্থিরদৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। সে ভয় পেল এবং অসুস্থ বোধ করলে—
গত কাল রাত্রিবেলা নোভাক দেখেছিল মাত্র একটা ছিন্নমুণ্ড, আজ সকালে তার ভীত চক্ষু আবিষ্কার করলে আরও তিন-তিনটে নরমুণ্ড!
একটা লোকর হাতে ঝুলছে চামড়ার বন্ধনী।
মুণ্ডগুলোর কান ফুটো করে যে ধরনের ফিতা দিয়ে সেগুলিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এই চর্মবন্ধনীটাও ঠিক সেই রকম।
তবে এটার সঙ্গে কোনো নরমুণ্ড ঝুলছে না।
নোভাক মনে মনে ভাবলে ওই চর্মরঙ্গুর ফাঁসটা বোধ হয় তার জন্যেই আনা হয়েছে। খুব সম্ভব একটু পরেই তার ছিন্নমুণ্ডটা ধরা পড়বে ওই চর্মরঙ্কুর আলিঙ্গনে!
সে মনে মনে ঈশ্বরের নাম নিলে এবার তার পালা।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল দলের সর্দার। যে মেয়েটি আগের রাতে বন্দিকে জ্বলন্ত কাষ্ঠের আপ্যায়ন জানিয়েছিল, সে এবার এগিয়ে এসে নোভাকের চুলের মুঠি ধরে মাথাটাকে পিছন দিকে টেনে ধরলে।
সেই অবস্থায় চোখের দৃষ্টিকে নাক বরাবর চার্লিয়ে নোভাক দেখল দলপতির ডান হাতখানা স্যাৎ করে কোমরের দিকে সরে এল–
পরক্ষণেই তার দক্ষিণ হস্তে আবির্ভূত হল একখানা ঝকঝকে ম্যাচেট!
মেয়েটির হাতের সবল আকর্ষণ নোভাকের মাথাটাকে পিছনে ঠেলে রেখেছে– নোভাক বুঝল তার গলদেশকে শাণিত অস্ত্রের সম্মুখে উন্মুক্ত রাখার জন্যই মেয়েটি তার চুল ধরে টানছে।
জীবনে সর্বপ্রথম সে বুঝতে শিখল যে রমণীর করস্পর্শ সব সময় খুব রমণীয় হয় না।
দারুণ আতঙ্কে এক ঝটকা মেরে নোভাক মাথাটাকে মুক্ত করে নিলে। আবার মেয়েটি চেপে ধরলে নোভাকের চুল, আবার ঝাঁকুনি দিলে নোভাক এবং প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও নোভাকের মুণ্ড রমণীর কবলমুক্ত হয়ে ঘাড়ের উপর সোজা হয়েই থাকল।
মেয়েটি এবার অন্য উপায় অবলম্বন করলে। বন্দির দুই কাঁধের মাঝখানে হাঁটু লাগিয়ে সে দুহাত দিয়ে বাগিয়ে ধরলে চুলের মুঠি– পরক্ষণেই একটানে সে নোভাকের মাথাটাকে পিছন দিকে টেনে আনলে।
প্রাণপণ শক্তিতে টানাটানি করেও নোভাক এবার তার মাথাটাকে মেয়েটির কবল থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারলে না!
অসহায় ভাবে সে সর্দারের দিকে তাকাল।
শাণিত ম্যাচেটটা তখন সর্দারের হাতে বন বন করে ঘুরছে।
হঠাৎ বন্ধ হল ম্যাচেটের ঘন ঘন আন্দোলন- শূন্যে একবার পাক খেয়ে শাণিত অস্ত্র বেগে নেমে এল নোভাকের গলার দিকে।
নোভাক চোখ বুজল। অস্ত্রাঘাতের প্রতীক্ষায় কেটে গেল কয়েকটা নীরব মুহূর্ত… ঠান্ডা বাতাসের আভাস এসে লাগল তার গালে। নেভাক চোখ খুলল না।
চোখ বুজেই মনে মনে ভাবলে মুণ্ডুটা বোধ হয় এতক্ষণ স্কন্ধচ্যুত হয়েছে- আকস্মিক আঘাতে সে যাতনাবোধের সময় পায়নি।
আরও কিছুক্ষণ কাটল, নোভাক কোনো যন্ত্রণা অনুভব করলে না।
ভয়ে ভয়ে সে চোখ খুলে ফেললে।
সর্দার হাসছে। হাসছে জিভারো-যোদ্ধারা। হাসছে মেয়েরা।
নোভাক বুঝল এটা হচ্ছে ঠাট্টা। প্রাণরক্ষার আনন্দে সেও হেসে ফেললে বোকার মতো।
একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হল– তার মুণ্ডটা অন্তত আজকের মতো দেহের উপরেই। অবস্থান করবে।
একটু পরে জিভারোরা ক্যানোতে উঠল।
দুখানা ক্যানো নৌকো। একখানায় শুধু পুরুষ, আর একটিতে রয়েছে মেয়েরা। নোভাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দেখল পুরুষদের ক্যানোতেই তার স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। পূর্বরাত্রের অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝতে পেরেছিল জিভারো-রমণীরা সুন্দরী বটে কিন্তু স্বভাবে তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। জিভারো পুরুষ নরহত্যা করলেও অকারণ নিষ্ঠুরতা পছন্দ করে না।
নদীর বাঁক ধরে বৈঠার আঘাতে দুখানা ক্যানো এগিয়ে চলল…