উঁহু – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
কার্তিক মাসের এই সকালবেলাটায় ঝলমলে রোদ আর মিঠে হাওয়ায় পায়েসপুরের চারদিকেই একটা প্রসন্ন ভাব। সদানন্দ গান গেয়ে ভিক্ষে করতে বেরিয়েছে। তার গলায় সুর নেই বটে, কিন্তু চেষ্টা আছে। কেপুবাবু তাঁর ভোলা বারান্দায় মোড়া পেতে বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছেন, যদিও কাগজখানা সাত দিনের পুরনো। আসলে তিনি পড়ছেন না, ওইভাবে রোজই তিনি চারদিকে নজর রাখেন। রাধাগোবিন্দবাবু তার বাইরের ঘরে জানালার কাছে টেবিলের ধারে চেয়ার পেতে বসে আত্মমগ্ন হয়ে তার আত্মজীবনী লিখছেন। প্রথমে বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘এক বীরের আত্মকথা’। তারপর সতেরোবার নাম বদল করে ইদানীং নাম দিয়েছেন ‘দারোগার দীর্ঘশ্বাস’। এই নামও হয়তো বদলে যাবে। তবে এই বইয়ে নানা দুর্ধর্ষ অভিযান এবং রোমহর্ষক লড়াইয়ের কথা আছে বলে শোনা যায়। বই বেরোলে বনমালীর মোচার চপের মতোই দেখ-না-দেখ বিকিয়ে যাবে বলে তার ধারণা। আজ সকালে হারানবাবু তার চশমা খুঁজে পাচ্ছেন না। গতকাল তার নস্যির ডিবে হারিয়েছিল। পরশু হারিয়েছিল তার হাওয়াই চটির একটা পাটি। তার আগের দিন গায়েব হয়েছিল তার হাতঘড়ি। হারানবাবুর নাম মোটেই হারান নয়। তার নাম হারাধন খাড়া। কিন্তু প্রায়ই জিনিস হারিয়ে ফেলেন বলে লোকে তার নাম রেখেছে হারান।
কদমতলায় বসে মদনপাগলা একটা ঝাটার কাঠি দিয়ে মাটিতে আঁক কাটতে কাটতে বলছে, “দুইয়ে-দুইয়ে চার হয় সে না হয় বুঝলুম, তিনে দুইয়ে পাঁচ হয় এটাও না হয় মেনে লওয়া গেল, কিন্তু চারটে জিলিপির সঙ্গে দু’টো শিঙাড়া যোগ করলে কেমন হয় সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।”
তারক তর্কালঙ্কার বাজার করে ফিরছিল, উলটো দিক থেকে আসছিল সবজান্তা জয়লাল। জয়লালকে দেখেই তারক মুখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি নবীনমাস্টারের বাড়ির ফটকের কাছে গিয়ে হাঁক মারল, “কই হে মাস্টার, এসো তো, আজ রিলেটিভিটি নিয়ে একহাত হয়ে যাক।”
ওদিকে জয়লালও তারককে দেখে বিপরীত দিকে হাঁটা দিয়ে গোপালময়রার দোকানে ঢুকে পড়ে বলতে লাগল, “দেদো সন্দেশ তৈরির কায়দাটা একদিন তোমাকে শিখিয়ে যাব হে গোপাল।”
আসলে তারক আর জয়লালের ইদানীং ঝগড়ার জের চলছে। কেউ কারও মুখদর্শন করে না। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, একদিন মদনপাগলার খুব বাই উঠেছিল, মেঘের খিচুড়ি খাবে। একটা মেটে হাঁড়ি নিয়ে মেঘ ধরার জন্য ইটভাটার মাঠে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। তাই দেখে জয়লাল অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল, “হুঃ, মেঘের খিচুড়ি। এর পর শুনব আকাশের পায়েস, জলের বেগুনি, বাতাসের চচ্চড়ি এসবও হবে। পাগল আর কাকে বলে!”
জয়লালের মন্তব্যটা তারকের তেমন পছন্দ হল না। সে বরাবর মনে-মনে ধারণা করে এসেছে যে, মদনপাগলা সাধারণ পাগল নয়, জ্ঞানী পাগল। তাই সে বলল, “মেঘের খিচুড়ি হবে না কেন হে! মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, আর বৃষ্টির জল ধরে তাই দিয়ে খিচুড়ি বঁধলেই হল। মদনের কথার ভিতর একটা ডেপথ থাকে, বুঝেছ! তলিয়ে বুঝতে হয়।”
এ কথায় চটে গিয়ে জয়লাল বলল, “তা বৃষ্টির জল তো পুকুরটুকুরেও পড়ছে, সেই জল দিয়ে খিচুড়ি রাঁধলে সেটাও কি তোমার ওই মেঘের খিচুড়ি নয়?”
তারক দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “না, তা নয়! ডাইরেক্ট বৃষ্টির জলের মধ্যে যে ইলেকট্রিসিটি থাকে, তা পুকুরে পড়লে নষ্ট হয়ে যায়। দ্যাখোনি, গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি না হলে লঙ্কার ঝাল কমে যায়। যতই জল ছিটোও না কেন, কিছুতেই ঝাল আসে না। কিন্তু যেই দু’ ফোঁটা বৃষ্টির জল লঙ্কাগাছে পড়ল, অমনি চিড়বিড়িয়ে উঠল তার ঝাল।”
এই নিয়েই দু’জনের ঝগড়া তুঙ্গে উঠে গেল। গত পনেরো দিন তাদের বাক্যালাপ, মুখদর্শন বন্ধ।
‘ইন্ধনহীন রন্ধন’ নামে এক আশ্চর্য উনুন আবিষ্কার করে প্রযুক্তিবিদ হলধর ঘোষ সারা গায়ে হুলস্থুল ফেলে দিয়েছিলেন। কয়লা, কাঠ, গ্যাস বা বিদ্যুৎ, এমনকী, সৌরশক্তি ছাড়াই তাতে রান্না হওয়ার কথা। দুঃখের বিষয়, শেষ অবধি সেই চুল্লিতে অনেক চেষ্টায় একবাটি জল একটুখানি গরম হয়েছিল মাত্র। হলধরের আবিষ্কৃত ‘অটো মিস্তিরি’ নামক আশ্চর্য যন্ত্রের রেডিয়ো, টিভি বা যে-কোনও বস্তু মেরামত করার কথা। কার্যত কী একটা গোলযোগে সেটা আজও চালু করা যায়নি। তাঁর অটো ইস্তিরি যন্ত্র তত আরও সরেস। ধুতি, পাঞ্জাবি, শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি অতি যত্নে ঠিকঠাক ভাজ ও ইস্তিরি করে দিতে পারে। কী একটা সামান্য উপকরণের অভাবে সেটাও এখনও সচল হয়নি। তবে এসব ছাড়াও হলধর বিস্তর জিনিস আবিষ্কার করে থাকেন, কিন্তু সেগুলোর উপযযাগিতা কী তা এখনও ভেবে উঠতে পারেননি।
গত কয়েকদিন একটি আবিষ্কার নিয়ে মগ্ন ছিলেন হলধর। কাল সারারাত জেগে আজ ভোরেই তাঁর কাজ শেষ হয়েছে। আনন্দে ডগমগ করতে-করতে তিনি বাইরের ঘরে ঢুকে হুংকার দিয়ে বললেন, “ইউরেকা! ইউরেকা!”
বাইরের ঘরে খগেন তপাদার, নিমাই বিশ্বাস, ব্ৰজেন বোস, গজপতি রায়, নগেন সর্বাধিকারী প্রমুখ গাঁয়ের মাথা-মাথা লোকেরা বসে গুলতানি করছেন। রোজই করেন। কারণ, হলধরের বাড়িতে রোজই সকালে ফুরফুরে চিড়েভাজা আর সুগন্ধি চায়ের ব্যবস্থা থাকে। ইউরেকা’ শুনে কেউ বিশেষ উদ্বেলিত হলেন না। কারণ, তারা এই ঘোষণা প্রায়ই শুনে থাকেন। গজপতি রায় বললেন, “তা কী জিনিস আবিষ্কার করলে হে?”
হলধর অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “সে আপনারা বুঝবেন না।”
“আহা, আমাদের বুঝবার দরকারটাই বা কী? কথা হল, তুমি নিজে বুঝে উঠতে পেরেছ কিনা।”
হলধর গম্ভীর গলায় বললেন, “বোঝা যাবে মশাই, দু-চার দিনের মধ্যেই বোঝা যাবে। তারপর দেখবেন, দুনিয়ার তাবড় সায়েন্টিস্টরা লাট খেয়ে এসে এই পায়ের উপর পড়বে।”
খগেন তপাদার শঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন, “উঁহু, উঁহু, ওটা মোটেই ঠিক হবে না। অত হোঁতকা, পেল্লায় চেহারার সাহেব এসে তোমার প্যাকাটির মতো পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি খেলে তোমার সুবিধে কী? দু’খানা তো মোটে পা, অত সাহেবের মধ্যে ভাগাভাগি হলে যে ভাগের পা গঙ্গাযাত্রা করবে হে!”
হলধর রোষকষায়িত লোচনে খগেনের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে তাকে ভস্ম করার একটা চেষ্টা করে বললেন, “জানো, আমি একসময় ফাস্ট ডিভিশনের ফুটবল খেলোয়াড় ছিলাম! কোন সাহসে তুমি বললে যে, আমার পা পাকাটির মতো?”
ব্ৰজেন বোস তাড়াতাড়ি মাঝখানে পড়ে বললেন, “আহা, যেতে দাও ভায়া, যেতে দাও! একথা কে না জানে যে, খগেনের চোখে ছানি পড়েছে। আর এও সবাই জানে যে, তুমি একসময় দুর্দান্ত ফুটবল খেলতে। বিজ্ঞানের পায়ে সেই ফুটবলকে উৎসর্গ করেছ বই তো নয়। একসময় ফুটবল নিয়ে তুমি যেমন ছিনিমিনি খেলতে আর অপোনেন্টকে ধোকা দিয়ে বোকা বানাতে, আজও তেমনই বিজ্ঞানকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছ আর পাঁচজনকে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে চলেছ।”
কথাটা শুনে হলধর প্রথমটায় খুশি হয়ে মাথা নাড়ছিলেন, কিন্তু অন্য সকলের খুকখুক হাসির শব্দ পেয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, “ব্ৰজেন, কাল থেকে তোমার চা আর খগেনের চিড়েভাজা বন্ধ।”
ব্ৰজেন দুঃখিত হয়ে বললেন, “কলিকালের সবচেয়ে বড় লক্ষণ কী জানো? লোকে ভাল কথাকেও উলটো করে বোঝে।”
দাড়ি-গোঁফ এবং চিন্তায় সমাচ্ছন্ন হয়ে নগেন সর্বাধিকারী এতক্ষণ এক পাশে চুপ করে বসে ছিলেন। বলতে কী, তিনিই পায়েসপুরের সবচেয়ে বলিয়ে-কইয়ে আর হাসিখুশি লোক। কিন্তু কয়েকদিন হল তার মনটা বিশেষ ভাল নেই। কথা বন্ধ, কপালে চিন্তার ভাঁজ, চোখে অন্যমনস্কতা, মাঝে-মাঝে দীর্ঘশ্বাসও পড়ছে। “কী হয়েছে,” জিজ্ঞেস করলে একটু অবাক হয়ে বলছেন, “কই, কিছু হয়নি তো!” চাপাচাপি করেও লাভ হচ্ছে না।
গাঁয়ের কেউ বলছে, নগেনের ছোট নাতি পান্টু গত পরীক্ষায় ইংরেজিতে ফেল করেছে বলে তাঁর মনখারাপ। পাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি সুবলের ধারণা, শিন্ডের খেলায় মোহনবাগান হেরে যাওয়ায় নগেন ভেঙে পড়েছেন। হারু নস্করের আরও গোপন খবর হল, বাসুচোর নাকি সেদিন রাতে নগেনবাবুর বাড়িতে হানা দিয়ে তন্নতন্ন করে হাতড়েও বাইশ টাকা পঞ্চাশ পয়সার বেশি না
পেয়ে রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই ভাষায় কিপটে নগেনবাবুকে খুব অপমান করে যাওয়ায় তিনি গুম মেরে গিয়েছেন। লটারির এজেন্ট বিশ্বপতি দুঃখ করে বলেছে, “না না, ওসব নয়। তিন দুই পাঁচ সাত দুই এক নম্বর টিকিটে পাঁচ লাখ টাকা প্রাইজ পেয়ে কেতনপুর গাঁয়ের নবকুমার ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে চেপে সপরিবার কাশ্মীর বেড়াতে চলে গেল। আর নগেনবাবুর টিকিটের নম্বর হল তিন দুই পাঁচ সাত দুই শূন্য। তাই নগেনবাবু ভারী মনমরা হয়ে পড়েছেন।”
তার পাশের বাড়ির দ্বিজেন সামন্ত অবশ্য অন্য কথা বলে বেড়াচ্ছে, “কয়েকদিন আগে নাকি এক জটাজুটধারী পেল্লায় চেহারার সাধু এসে নগেনকে বলল, ‘তোর ভাগ্য খুলে গেল রে ব্যাটা। ছল্পর ফুড়ে তোর পয়সা আসছে। তার আগে এই সাধুকে একটু ভোজন করা তো ব্যাটা! এই শুনে নগেনবাবু রেগে গিয়ে সাধুকে বাংলা, ইংরিজি এবং হিন্দিতেও খুব গালাগালি করেন, ‘কেটে পড়ো, গেট আউট এবং ভাগো ইহাসে,’ বলে তাড়িয়ে দেন। সাধু তখন ঝোলা থেকে একটা পাথর বের করে বলল, ‘তুই কী জিনিস হারালি তা জানিস না! সারাজীবন বুক চাপড়ে, হা-হুঁতাশ করে মরবি। এই দ্যাখ,’ বলে সাধু পাথরটা ত্রিশূলে ঠেকাতেই নাকি ত্রিশূল সোনা হয়ে যায়। তাই দেখে নগেন মূর্ছা যান। মূর্ছা ভাঙার পর থেকেই তিনি নাকি ভেঙে পড়েছেন। বিস্তর খুঁজেও সাধুর টিকিটিও আর দেখা যায়নি।”
রটনাগুলো যে সব মিথ্যে এমন কথাও বলা যাবে না। নগেনবাবুর ঘোট নাতি পান্টু গত পরীক্ষায় বাস্তবিকই ইংরেজিতে এগারো পেয়েছে। এও সত্যি যে, শিন্ডের খেলায় মোহনবাগান হেরেছে। আর কদিন আগে যে একটা চোর নগেনবাবুর বাড়িতে হানা দিয়েছিল এবং পরদিন ভূপেনদাতোগা কী কী চুরি গিয়েছে তার তালিকা চাওয়ায় নগেনবাবু খুবই অপ্রতিভ মুখে আমতা আমতা করেছিলেন, এও সবাই জানে। নবকুমার যে লটারিতে পাঁচ লাখ জিতেছে এবং নগেনবাবুর ভাগ্যে যে অল্পের জন্য শিকে ছেড়েনি, এটাও কারও অবিদিত নয়। দিনপাঁচেক আগে এক দুপুরে যে পেল্লায় চেহারার এক সাধু নগেনের বাড়িতে হানা দিয়েছিল এটাও ঘটনা। তবে ঠিক কী কারণে নগেনবাবু গুম মেরে গিয়েছেন সেটা এখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
চা আর চিড়েভাজা এসে গিয়েছে। কাজেই সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঠিক এই সময় হঠাৎ মৌনী ভেঙে নগেন সর্বাধিকারী অস্ফুট গলায় কী যেন একটা বলে উঠলেন। চিড়েভাজার দরুন কথাটা ভাল বোঝা গেল না। খগেন তপাদার একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, “কী যেন বললেন নগেনদা? কাবলিওয়ালা না কী যেন!”
নিমাই বিশ্বাস মাথা নেড়ে বললেন, “আরে না, না। নগেনদা বলল, সবরিকলা।”
গজপতি একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “দুর-দুর, নগেনদা স্পষ্ট বলেছেন পালকিওয়ালা।”
ব্ৰজেন বোস বললেন, “আমি যেন ডাল মে কালা শুনলাম।”
হলধর বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহা, আপনাদের সবতাতেই হুড়োহুড়ি। নগেনদা তো আর যোবা নন, নিজেই বলবেন’খন। একটু সবুর করুন।”
নগেনবাবু ভারী বিস্মিত হয়ে সকলের মুখে চোখ বুলিয়ে বললেন, “কিছু বলেছি নাকি?”
নিমাই বিশ্বাস জোরের সঙ্গে বললেন, “আলবাত বলেছেন। দু’ দিনের মৌনী ভেঙে এই তত প্রথম কথা ফুটল আপনার।”
নগেন চিড়ে চিবোতে-চিবোতে বললেন, “তা হবে হয়তো। কিন্তু কী বলেছি সেটা আমারও আর মনে নেই।”
খগেন তপাদার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “কাবলিওলাটাকে আমিও দেখেছি বটে, তবে অনেকটা দূর থেকে। পরশু সকালের দিকে যখন খেতের কাজ তদারক করে ফিরছিলুম, তখন দূর থেকে যেন দেখলুম, ঝোলা কাঁধে দুলকি চালে ব্যাটা বটতলার মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে গেল। বেশ ময়লা জামাকাপড়, আর তেমন লম্বা-চওড়াও নয়।”
হঠাৎ অস্ফুটস্বরে নগেন সর্বাধিকারী ফের কী একটা বলে উঠলেন।
নিমাই ঝুঁকে পড়ে বললেন, “কে এসে গিয়েছে? কার কথা বলছেন, ও নগেনদা?”
নগেনবাবু তাড়াতাড়ি গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ভারী অবাক হয়ে বললেন, “কই বাপু, কিছু তো বলিনি!”
নিমাই দমে গিয়ে বললেন, “স্পষ্ট শুনলুম যে!”
অন্য সবাইও প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, “আমরাও তো শুনেছি!”
নগেন উদাস হয়ে বললেন, “ওরে বাপু, পঁচাশি বছর বয়স হল, এখন দু-চারটে কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতেই পারে। ও কিছু নয়।”
খগেন তপাদার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “নাঃ, ওই সাধুবাবাই কিছু একটা তুকতাক করে গিয়েছে দেখছি। নইলে নগেনদার মতো একটা হাসিখুশি লোক কী রাতারাতি আঙুর থেকে আমসি হয়ে যেতে পারে?”
হলধর ধমক দিয়ে বললেন, “তোমাদের মতো দুর্বলচিত্ত আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেদের জন্যই আজও বুজরুকরা করে খাচ্ছে, বুঝলে? তুকতাকে যদি কাজ হত তা হলে আর সায়েন্সের দরকারই হত না।”
গজপতি বললেন, “আহা, চটো কেন ভায়া? তুকতাকটা কথার কথা। আমরা কেউ ওসবে মোটেই বিশ্বাস করি না। সায়েন্সেই আমাদের অচলা ভক্তি। নইলে সকাল থেকে এসে তোমার বাড়িতে ধরনা দিই কেন?”
হলধর ফুঁসে উঠে বললেন, “আপনি আর সাধু সাজবেন না। এই তো মাসখানেক আগে বগলামুখী কবচ আর রক্তপ্রবাল ধারণ করলেন, গেলবার শ্মশানকালীর সোনার নথ গড়িয়ে দিয়েছিলেন, গত সপ্তাহেও আপনার বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো হয়েছে।”
গজপতি একগাল হেসে বললেন, “তা ভায়া, সত্যনারায়ণ পুজো না হয় খারাপ, কিন্তু তুমি যে সত্যনারায়ণের একটি সিন্নি বেশ চেটেপুটে খেলে?”
“সিন্নি খেতে অতি চমৎকার, তাই খেয়েছি। সত্যনারায়ণের প্রসাদ বলে তো আর খাইনি।”
ব্ৰজেন বোস বলে উঠলেন, “আমারও সেই কথা। নাস্তিক বলে কি সিন্নি খাব না? গজপতির বাড়ির সিন্নিটা হয়ও ভারী চমৎকার।”
হলধর চোখ রাঙিয়ে বললেন, “আপনি আর বলবেন না তো! আপনি আবার কবে থেকে নাস্তিক হলেন? হরিসভায় বসে কীর্তন শোনেন, শনিমন্দিরে গিয়ে রোজ সন্ধেবেলা নমো ঠোকেন, প্রতি বেস্পতিবার আপনার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়। নাস্তিক হতে বুকের পাটা চাই মশাই। ভণ্ডামি করে নাস্তিক হওয়া যায় না।”
ব্ৰজেন ভারী আহ্লাদের গলায় বললেন, “আহা, আমি তো সেই কথাই বলতে চাইছি। এই হরিসভায় বা শনিমন্দিরে যাওয়া বা বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো করা, এসব হল ভণ্ডামি, ভিতরে-ভিতরে আমি খুব নাস্তিক।”
ঠিক এই সময় নগেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “উঃ, পঁচাত্তর বছর পর!”
এ কথাটা সকলেই বেশ স্পষ্ট শুনতে পেলেন। কথাবার্তা থামিয়ে সবাই অবাক হয়ে নগেনবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন। নিমাই বিশ্বাস বলে উঠলেন, “পঁচাত্তর বছর পর কী নগেনা?”
নগেন সর্বাধিকারী ভারী অপ্রতিভ হয়ে চারদিকে মিটমিট করে চেয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “না না, ও কিছু নয়!”
নিমাই বিশ্বাস চেপে ধরলেন, “কিছু নয় বললে তো শুনব না নগেনদা। পঁচাত্তর বছর পর’ কথাটার মানে কী?”
নগেন সর্বাধিকারী ভারী জড়সড় হয়ে চারদিকে টালুমালু করে তাকাতে-তাকাতে বললেন, “না, এই বলছিলাম আর কী যে, পঁচাত্তর বছর বেশ লম্বা সময়। তা নয় কি?”
“তা তো বটেই। কিন্তু আপনার তা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে কেন?”
ভারী অবাক হয়ে নগেনবাবু বললেন, “আমার সমস্যা! না না, আমার সমস্যা কীসের?”
গাঁয়ে গোয়েন্দাগিরিতে খগেন তপাদারের একটু খ্যাতি আছে। কোথাও চুরিটুরি হলে বা কারও বাড়িতে কিছু খোয়া গেলে, গোরু, ছাগল হারালে বা সন্দেহজনক কিছু ঘটলে খগেন তপাদারের খোঁজ পড়ে। বলতে নেই, খগেন তপাদার কিছু চুরি জোচ্চুরির হিল্লে করে দিয়েছেন। অন্তত এক ডজন গোরু এবং গোটা পঁচিশেক ছাগলের হদিশ করে দিয়েছেন। এই তো সেদিন ময়রাগিন্নির হারানো সোনার বালা তাদেরই পুকুর থেকে উদ্ধার করেছিলেন। পায়েসপুরের শালক হোমস তিনিই। খগেন এবার ছোট চোখে নগেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুধু পঁচাত্তর বছর পরই’ বলেননি, তার আগে ‘আপনি এসে গিয়েছে’ কথাটাও ব্যবহার করেছেন। তারও আগে বলেছেন ‘কাবলিওয়ালা বা ‘সবরিকলা বা ওই ধরনের কিছু। তিনটে কথাকে পরপর সাজালে পঁড়াচ্ছে, কাবলিওয়ালা এসে গিয়েছে পঁচাত্তর বছর পর। ঠিক কিনা নগেনা?”
নগেন সর্বাধিকারী খুবই অপ্রস্তুত হয়ে হঠাৎ ব্যস্তসমস্তভাবে কোঁচা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “উঠি হে হলধর, ওদিকে আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
সবাই হইহই করে উঠলেন। নিমাই বিশ্বাস উঠে সদর দরজার ছিটকিনি এঁটে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “উঁহু, অত সহজে ছাড়া পাবেন না নগেনদা! ব্যাপারটা খোলসা করে বলুন। যদি কোনও বিপদআপদ হয়ে থাকে, তো আমরা আছি কী জন্য? সব খুলে বলুন, আমরা জান লড়িয়ে দেব।”
নগেনবাবু খুব অসহায় মুখ করে ফের বসে পড়লেন। নগেনবাবু আমুদে লোক হলেও ভারী নিরীহ আর ভীতু মানুষ। বসে ভারী জলে-পড়া ভাব করে সকলের মুখের দিকে চাইতে লাগলেন। তারপর গলাখাকারি দিয়ে বললেন, “আমার সত্যিই বড় বিপদ।”
“আহা, সেটাই তো সবাই শুনতে চাইছি।”
“কিন্তু বলায় যে বারণ আছে?”
“কার বারণ?”
“তাকে তোমরা চিনবে না। তবে সে বড় ভয়ংকর লোক।” নিমাই বিশ্বাস বললেন, “এ গাঁয়ে বা আশপাশে যারা আছে তাদের নাড়িনক্ষত্র আমি জানি। ষণ্ডা-গুন্ডা নেই তা বলছি না, কিন্তু ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হবে এমন মারকুট্টা তো কাউকে মনে পড়ছে না।”
“না না, সে এদিককার লোকই নয় হে! আজকের লোকও নয়। সে পঁচাত্তর বছর আগে এসেছিল।”
ব্ৰজেন বোস চোখ কপালে তুলে বললেন, “বলো কী হে! পঁচাত্তর বছর আগে এসেছিল। তা হলে তো সে থুথুড়ে বুড়ো মানুষ!”
নগেন সর্বাধিকারী মাথা নেড়ে বললেন, “না হে ব্ৰজেন, সে মোটেই বুড়ো নয়। বেশ তাগড়াই জোয়ান চেহারা।”
নিমাই বিশ্বাস অবিশ্বাসের হাসি হেসে বললেন, “জোয়ান চেহারা বলছেন। পঁচাত্তর বছর আগে তার কত বয়স ছিল?”
“তা ধরো পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন তো হবেই।”
“তা হলে হিসেবে দাঁড়ায়, তার বয়স এখন একশো পঁচিশ থেকে তিরিশ। বেঁচে থাকারই কথা নয়। আর যদিও-বা বাইচান্স বেঁচে থাকে, তা হলে তার খুনখনে বুড়ো হয়ে যাওয়ার কথা!”
নগেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সেটাই তো চিন্তার কথা!”
“আপনি লোকটাকে ভয় পাচ্ছেন কেন তা বুঝতে পারি না। পঁচাত্তর বছর আগের কোনও লোক কী করে এসে আপনাকে ভয় দেখাচ্ছে?”
“তার আসবার কথাই ছিল। সে বাবাকে বলে গিয়েছিল ঠিক পঁচাত্তর বছর পরে সে এসে জিনিসটা ফেরত নিয়ে যাবে।”
“জিনিস! কী জিনিস বলুন তো?” নগেন সর্বাধিকারী একটু চুপ করে রইলেন। তারপর গলাটা একটু চেপে বললেন, “তা হলে তোমাদের সব খুলেই বলতে হয়। তখন আমার বয়স বছর দশেক। তখন আমরা বড্ড গরিব ছিলুম। সামান্য জমিজমা থেকে যে আয় হত তাতে গ্রাসাচ্ছাদন চলত না। ভাঙা ঘরে বাস, আধপেটা খাওয়া বা উপোস, জামাকাপড়, জুতো, ছাতা সবই অমিল। ঠিক সেই সময় একদিন দুপুরের দিকে এক পেল্লায় চেহারার, জটাজুটধারী, রক্তাম্বর পরা সাধু গোছের লোক এসে হাজির। অভাবে পড়ে তখন আমাদের এমন অবস্থা যে, দৈবের উপর বড় বেশি নির্ভরতা এসে গিয়েছিল। সাধু দাওয়ায় বসে বাবার সঙ্গে কিছু কথাটথা কইল, মনে আছে, একঘটি জলও খেল ঢকঢক করে। তারপর ঝোলা থেকে একটা জিনিস বের করে বাবার হাতে দিয়ে বলল, “তোকে এটা দিয়ে যাচ্ছি। যদি ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারিস, তা হলে বেঁচে যাবি। যদি লোভ করিস, তবে মরবি। আরও একটা কথা, ঠিক পঁচাত্তর বছর পর আমি আমার জিনিস ফেরত নিতে আসব। যদি জিনিসটা বেহাত হয় বা হারিয়ে যায়, তা হলে কিন্তু নির্বংশ করে দিয়ে যাব। তোর ছেলেপুলে বা বংশধরদের হুশিয়ার করে দিস!“
হলধর বললেন, “এ তো হিন্দি ছবির গপ্পো!” গজপতি বলে উঠলেন, “আরে না না, এ হল আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের বৃত্তান্ত। না নগেনদা, এ জিনিস চলবে না।”
নগেন পাংশু মুখে বললেন, “এই জন্যই বলতে চাইছিলাম না। জানি তোমাদের বিশ্বাস হবে না! তা হলে এই পর্যন্তই থাক!”
ব্ৰজেন বললেন, “আরে চটো কেন ভায়া? আমার তো দিব্যি বিশ্বাস হচ্ছে। কেউ কথা কইলেই ওদের ফুট কাটার স্বভাব।”
নিমাই অবাক হয়ে বললেন, “আমি তো হাঁ করে শুনছি। গায়ে কাটাও দিচ্ছে, এই দেখুন!”
খগেন বললেন, “আমারও তো বাপু মোটেই অবিশ্বাস হচ্ছে না।”
নগেন ফের একটা বড় শ্বাস মোচন করে বললেন, “বিশ্বাস করা না-করা তোমাদের ইচ্ছে। যা ঘটেছিল তাই বলছি।”
সবাই সমস্বরে সম্মতি জানালে নগেন বললেন, “গজপতি ঠাট্টা করলেও কথাটা ভুল বলেনি। সাধুবাবা একটা প্রদীপই দিয়েছিল বাবাকে, ছোট্ট, এই আমার মুঠোর সমান মাপের একটা পেতল বা ওই ধরনের ধাতুর প্রদীপ।”
নিমাই সাগ্রহে বললেন, “সোনার নয় তো?”
“তাও হতে পারে। যাচাই করে দেখা হয়নি। কারও হাতে দেওয়া বারণ ছিল। শুধু বাবাই ওটা নিয়ে ঘর বন্ধ করে কী সব প্রক্রিয়া করতেন। আগেই বলে রাখি, আমরা প্রদীপ থেকে কোনও দৈত্যদানো বেরিয়ে আসতে দেখিনি, রাতারাতি বড়লোকও হয়ে যাইনি। প্রদীপটা বাবার হাতে আসার পর কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। খাওয়া-পরার এত কষ্ট আর ছিল না। বাবা পুরনো ভদ্রাসন ছেড়ে নতুন পাকাবাড়ি করে উঠে এলেন।”
হলধর বিরক্ত হয়ে বললেন, “বোগাস ব্যাপার। প্রদীপের সঙ্গে আর্থিক উন্নতির সম্পর্কটা কী? এসব তো রূপকথার গল্প।”
নগেন মিইয়ে গিয়ে বললেন, “ওই জন্যই তো বলতে চাইনি। তোমাদের চাপাচাপিতে বলতে হল। এ গপ্পো বিশ্বাস না করো ক্ষতি নেই, কিন্তু একথা অতি নির্জলা সত্যি যে, সেই সাধুবাবা ঠিক পঁচাত্তর বছর পর ফিরে এসেছে।”
গজপতি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, “প্রায় দেড়শো বছর বয়সে?”
“হ্যাঁ। সে কী চেহারা রে বাবা, যেন বাঘ! চোখ দুখানা দিয়ে যেন আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। দুপুরবেলা এসে বজ্রগম্ভীর স্বরে আমার নাম ধরে ডাকল। সেই সাধু যে সত্যিই তার জিনিস ফেরত নিতে পঁচাত্তর বছর পর হাজির হবে, একথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ভেবেছিলাম, গুল মেরে গিয়েছে। কিন্তু সে আমার বাবার নাম করে আদ্যোপান্ত ঘটনাটা বলে যখন প্রদীপটা ফেরত চাইল, তখন অবিশ্বাস করি কী করে? আমি ছাড়া সেই ঘটনার তো আর সাক্ষী নেই!”
খগেন বললেন, “তা প্রদীপটা দিয়ে দিলেন নাকি তাকে?” নগেন প্রবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “পারলাম কই? প্রদীপ বের করতে গিয়ে দেখি, ঠাকুরের সিংহাসনের তলায় তালা দেওয়া যে ভারী কাঠের বাক্সে তা ছিল, সেটা ফাঁকা। প্রদীপের চিহ্নমাত্র নেই। প্রদীপ পাওয়া যাচ্ছে না শুনে সাধুর কী রাগ। শরীরটা যেন দু’নো হয়ে উঠল, চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। বলল, ‘সাত দিনের মধ্যে যদি প্রদীপ না দিস, তা হলে ঝাড়েবংশে মারা যাবি।’ এই বলে সাধু চলে গেল। সেই থেকেই আমি বড় ভেঙে পড়েছি ভাই!”
হলধর উঠে পায়চারি করতে করতে হাত নেড়ে বললেন, “বোগাস বোগাস, অল বোগাস। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন নগেনদা, বায়োলজিক্যাল নিয়মেই আপনার সেই সাধুবাবা অনেক আগেই কেঁসে গিয়েছে। এখন কোনও একটা ইম্পস্টার এসে আপনাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। আপনি পুলিশে খবর দিন এবং ক্লাবের ছেলেদের অ্যালার্ট করুন। বেগতিক বুঝলেই সাধু পালাবার পথ পাবে না।”
এ কথায় নগেন বিশেষ ভরসা পেলেন বলে মনে হল না।