১. কাকে চাই

০১.

 অশনি দরজা খুলে বলল কাকে চাই?

ভদ্রলোক অশনির চেয়ে ঢ্যাঙা। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। পরনে ধুতি পানজাবি আধ ময়লা এবং পায়ের স্লিপার দুটোও ছেঁড়া ও নোংরা। অশনির দিকে একটুখানি তাকিয়ে থেকে বললেন–আপনি অশনিবাবু?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি…..

আমি গার্গীর বাবা।

 অশনি চমকে উঠল। বলল, কী ব্যাপার বলুন তো?

ভদ্রলোককে আরও গম্ভীর দেখাল। বললেন, এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে তো কিছু বলা যাবে না।

অশনি অমনি খুব ভদ্রতা দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি ভেতরে আসুন। কিন্তু তার বুক তখন টিপ টিপ করছে। উরু দুটো অবশ হয়ে উঠেছে। এই সকালবেলা কোন বিপদের ধাক্কা এসে পড়ল সে অনুমান করতে পারছে না।

ভদ্রলোক কোনার দিকের ছোট্ট সোফাসেটের একটা দখল করে এমনভাবে বসলেন, অশনির মনে হল, খুব শিগগির আর উঠবেন না। অশনি দাঁড়িয়ে রইল। তখন ভদ্রলোক অর্থাৎ গার্গীর বাবা যেন নিজের বাড়িতে কাকেও বসতে বলছেন, এভাবে বললেন, দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।

অশনি বসল এবং তার মুখের দিকে উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে রইল। কিছু জিজ্ঞেস করতেও আর সাহস হচ্ছে না তার।

আমি গার্গীর বাবা। আমার নাম তারকনাথ রায়। …একটু কেসে উনি ফের শুরু করলেন। আমার নাম নিশ্চয় গার্গী আপনাকে বলে থাকবে। একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতাম। মাস কয়েক হল রিটায়ার করেছি। ছেলেমেয়ে বলতে ওই গার্গী আর সুদীপ। গার্গী বড়, সুদীপ ছোট। গার্গী তেইশে পা দিয়েছে। সুদীপ ষোলয়। আমার স্ত্রী, মানে গার্গীর মা–গার্গী নিশ্চয় তার মায়ের নামটাও বলেছে আপনাকে?

অধীর অশনি ঘাড় নাড়ল। বলেনি।

বলেছে-ভুলে গেছেন হয়তো। গার্গী–আপনিও নিশ্চয় টের পেয়েছেন, খুব ফ্রাঙ্ক মেয়ে। আমার স্ত্রীর নাম কুমুদিনী। খুলনার সেনহাটির মেয়ে। ওরা কলকাতা আসে সেই নাইনটিন এইটিনে। বউবাজারে ব্যবসাট্যাবসা ছিল। এখন আর…

অশনি এবার রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বাধা দিল। …কিন্তু ব্যাপারটা কী?

তারকবাবু গম্ভীর মুখেই হাত তুলে বললেন, বলছি। আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা ক্লিয়ার না হলে ঠিক বুঝতে পারবেন না সমস্যাটা কী। এখন তাহলে অবস্থাটা, দেখুন। গার্গীর মায়ের তরফেও খুব একটা আশাভরসা করার মতো কিছু নেই। আমার শ্যালকরা চার ভাই। চারজনেই এখানে-ওখানে ছত্রখান হয়ে ছিটকে পড়েছে। এদিকে আমিও রিটায়ার করেছি। সংসার ছোট হলেও যা দিনকাল পড়েছে, সবই বুঝছেন। এখন গার্গীর চাকরিটা যা ভরসা। সুদীপ হায়ার সেকেন্ডারি দেবে এবারে। তার একটা দায়িত্বও বড় কম নয়। এমতাবস্থায় গার্গীর বিয়ে দেবার কথা ভাবতেই ভয় পাচ্ছিলুম।

তারকবাবুকে থামতে দেখে অশনি বলল, হু। তা ব্যাপারটা।…

তারকবাবু সেইরকম একঘেয়ে ঢঙে বললেন, সম্প্রতি আমরা বাসায় থাকি, তার ওপরতলায় এক ভদ্রলোক এসেছেন। তার নাম মণিময় দাশগুপ্ত। ভদ্রলোক এনফোর্সমেন্টে বড় অফিসার ছিলেন। রিটায়ার করেছেন। তার তিন মেয়ে এক ছেলে। তিন মেয়েরই বিয়ে দিয়ে গায়ে ফুঁ দিচ্ছেন এখন। জামাইরা সবাই টপ অফিসার। দিল্লি-ম্যাডরাজ-বোম্বেতে থাকে। ছেলের নাম অভ্র। বাপ রটিয়েছে। ছেলে এম.এ.অব্দি পড়েছে। আমার বিশ্বাস হয় না। এসেই তো রকবাজি করে বেড়াচ্ছে। যত সব মস্তানটাইপ ছেলে নিয়ে বেলেল্লাপনা করে দিনরাত। তো গত পরশু সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ লোডশেডিং হল। সেকেলে গড়নের বাড়ি। সদর দরজার পর লম্বা প্যাসেজের শেষে উঠোন আছে। আমরা একতলায় যারা থাকি, তাদের কল-পায়খানা ওই উঠানে এবং বারোয়ারি। তো লোডশেডিংয়ের সময় গার্গী বাড়ি ঢুকছে। অভ্র রোয়াক থেকে উঠে তার পিছু পিছু বাড়ি ঢোকে। তারপর গার্গীর হাত চেপে ধরে। গার্গীর চেঁচামেচিতে সবাই যায়। যাইহোক, সে একটা অবস্থা! একটু পরে কারেন্ট এল। তার খানিকটা পরে অভ্রের বাবা মণিময় এলেন আমার ঘরে। এসে ব্যাপারটার জন্যে ছেলের হয়ে ক্ষমাটমা চেয়ে একটা ভাল প্রস্তাব দিলেন। বুঝলেন তো?

অশনি ঘাড় নেড়ে বলল, গার্গীর সঙ্গে অভ্রের বিয়ের?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা–মানে গার্গীর মা আর আমি শুনে একটু দোনামোনায় পড়ে গেলুম। ওই তো নচ্ছারমার্কা ছেলে, আর গার্গীকে তো চেনেনই কত ভালো মেয়ে! মুখে অবশ্যি খুশির ভাব দেখালুম। বললুম, এ তো খুবই আনন্দের কথা। মণিবাবু আবার আলোচনা করবেন বলে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, গার্গীকে তার খুবই পছন্দ। আর ছেলের যে কতটা পছন্দ, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। যাই হোক, গার্গী ওই সময় ন্যাচারালি চুপচাপ রইল। উনি চলে যেতেই সে ফেটে পড়ল। ওকে অনেক রকম বুঝিয়ে থামালুম। পরের দিনটা–মানে, গতকাল ও নিয়ে আর কথা ওঠেনি। সব স্বাভাবিক ছিল। রাতে গার্গী খেয়ে দেয়ে পাশের ঘরে যেমন একা শোয়, শুতে গেল। সুদীপ ওর মায়ের কাছে খাটে থাকে। আমি ক্যাম্পখাট পেতে বারোয়ারি বারান্দায় শুই। অন্য রাতে আমার একেবারে ঘুম হয় না। চোখ বুজে পড়ে থাকি। গতরাতে কী। যে হল, একেবারে সাউন্ড স্লিপ।

তারকবাবুকে চুপ করতে দেখে অশনি উত্তেজনা চেপে বলল, তারপর?

তারকবাবু আগের মতো শান্ত একঘেয়ে স্বরে বললেন, মণিবাবুকে নেহাত ভদ্রতা করে মুখেই বলেছিলুম বলে কি সত্যি সত্যি অভ্রের সঙ্গে বিয়েতে রাজি ছিলুম আমরা। বিশেষ করে একটু আগের ওই জঘন্য কাণ্ডের পর। গার্গী বরাবর কেমন যেন অবুঝ মেয়ে ছিল। আইনত সাবালিকা, শিক্ষিতা, নিজের পায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা আছে। আমরা কি ওকে কোন ব্যাপারে বাধ্য করতে পারি, বলুন তো? ওর নিজের মতামতকে আমরা বরাবর মূল্য দিয়েছি।

অশনি বলল, কিন্তু তারপর?

তারকবাবু নিজের হাতের আঙুল দেখতে দেখতে বললেন, ভোরবেলা ওর মা প্রতিদিন যেমন চা করে ডাকতে যায়, গেল। কিন্তু কপাট ঠেলতেই দেখলে, ভেজানো। তখন সাড়ে ছটা। গার্গী ল্যাট্রিনে ঢুকেছে ভেবে অপেক্ষা করল। কিন্তু বারোয়ারি ল্যাট্রিন থেকে অন্য কেউ বেরুল। একটু পরে ওর ঘরে ঢুকে ব্যাপারটা টের পেল। তারপর কন্নাকাটি। আমি গিয়ে দেখি, একটা চিঠি। গার্গী লিখেছে, আমার খোঁজ কোরো না। লাভ হবে না। চলে গেলুম।

অশনি চমকে উঠে নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, তার মানে?

তারকবাবু বললেন, মানে–চলে গেছে। কোথায় গেছে, কেনই বা গেছে, কিছু মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিনে। তখন ওর জিনিসপত্তর তন্নতন্ন করে খোঁজা হল, যদি কোন ব্লু পাওয়া যায়। কতকগুলো চিঠিপত্তর পেলুম। কয়েকটা চিঠি দেখলুম, আপনার লেখা। নাম-ঠিকানা দেওয়া ছিল। আপনি ওর আপিসের ঠিকানায় চিঠিগুলো লিখেছিলেন।

অশনি ব্যস্তভাবে বলল, কিন্তু গার্গী তো এখানে আসেনি। ওর সঙ্গে আমার… এক মিনিট, বলছি–দেখা হয়েছে সেই টোয়েন্টি ফিফথ মে। আজ ফাস্ট জুন। বাই চান্স রাস্তায় দেখা। খুব ব্যস্ত ছিলুম বলে বেশিক্ষণ কথা বলিনি।

তারকবাবু ঘরের ভিতরটা দেখতে দেখতে বললেন, আপনার এটা তো সিঙ্গলরুম ফ্ল্যাট!

 অশনি অস্থির হয়ে উঠেছিল। বলল, হ্যাঁ। ইচ্ছে করলে আপনি বাথরুমটা চেক করে নিতে পারেন। গার্গীকে আমি লুকিয়ে রাখিনি।

তারকবাবু ক্লান্তভাবে বললেন, আমি তা বলছিনে বাবা। লুকিয়ে রাখার কী আছে? আমি আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করি। তাই থানা-পুলিশের হ্যাঁঙ্গামাও করতে যাইনি। জাস্ট যতটা সাধ্য খোঁজ-খবর করা ছাড়া আর কী করব? ওর মা ভেঙে পড়েছে। তাই…

অশনি বলল, কিন্তু হঠাৎ গার্গী গেল কেন?

সেটাই বোঝা যাচ্ছে না! এমন নয় যে আমি খুব প্রতাপশালী লোক। ওর

ইচ্ছের বিরুদ্ধে গায়ের জোরে কিছু করে বসব। বরং আমি তো ওর করুণাপ্রত্যাশী হয়ে কাটাচ্ছি। …তারকবাবু নোংরা রুমাল বের করে চোখের কোনা মুছলেন।

অশনি একটু ভেবে উদ্বিগ্ন মুখে বলল, আচ্ছা! সেই যে আপনাদের ওপর তলার ভদ্রলোকের ছেলের কথা বললেন–মানে যে গার্গীকে ইয়ে করেছিল লোডশেডিংয়ের সময়….

তারকবাবু তাকালেন। অসহায় মানুষের চাইনি।

 অশনি বলল, গার্গীকে রাতে জোর করে ধরে নিয়ে যায়নি তো?

অসম্ভব। তারকবাবু দৃঢ় স্বরে বললেন। …তাহলে গার্গী নিজের হাতে অমন করে লিখে যাবে কেন? তাছাড়া আমি তো বারান্দায় ছিলুম। আরও অনেকে ছিল। কেউ খাট-টাট পেতে শুয়ে ছিল। তেমন কিছু হলে গার্গী চেঁচামেচি করত।

অশনি বলল, ধরুন ওর মুখে রুমাল গুঁজে দিয়েছিল।

তারকবাবু মাথা নেড়ে বললেন, অসম্ভব। প্রথম কথা, সে দরজা খুলবে কেন? দ্বিতীয় কথা, ধস্তাধস্তি হবে না? তেমন কোন চিহ্ন নেই ঘরে। সবচেয়ে বড় কথা, গার্গী তার কাপড়চোপড় আর টুকিটাকি জিনিসপত্তরও সঙ্গে নিয়ে গেছে। একটা পলিথিনের বড় ব্যাগ কিনেছিল সম্প্রতি। সেট ঘরে দেখা যাচ্ছে না। কাজেই, সে নিজের ইচ্ছেয় গেছে তাতে কোন ভুল নেই।

অশনি একটু ভেবে বলল, আপনি আর কোথাও খোঁজ নিয়েছেন কি?

তারকবাবু বললেন, এখন দশটা বাজে। বেরিয়েছি আটটায়। প্রথমে গেছি। ওর মামাদের বাড়িতে। ট্যাকসি নিয়ে বেরিয়েছি। শ্যামবাজার, পাইকপাড়া, হেদো আর বউবাজার চার মামার বাড়ি ঘুরতে একঘণ্টা লেগেছে। তারপর গেছি পার্কসার্কাসে এক ভদ্রলোকের বাসায়।

অশনি বলল, কী নাম বলুন তো?

তারকবাবু বললেন, সুনীথ ব্যানার্জি। একটা আধাবিলিতি ফার্মের একজিকিউটিভ। গাড়ি আছে। কুকুর পোষার সখ আছে। পেল্লায় কুকুর। বুঝলেন? কেয়ারটেকারের কাছে একশ কৈফিয়ত। তারপর তিনতলায় যেতে দিল। সুনীথবাবু তো আকাশ থেকে পড়লেন! গার্গীর সঙ্গে নাকি একমাস দেখা হয়নি! ওঁর স্ত্রী আবার মেমসাহেব। ইটালিয়ান নাকি। বাংলা তেমন বোঝেন না। সুনীথবাবু সব বুঝিয়ে দিলে খুব অবাক হয়ে গেলেন। তারপর ওনাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হল। ইংরেজিতে। আমি অগত্যা চলে এলুম। ট্যাকসি আগেই ছেড়ে দিয়েছি। ট্রামে চেপে আপনার এখানে এসেছি।

অশনি একটু মনমরা হয়ে বলল, তা ইয়ে–সুনীথবাবুর কাছে গেলেন কেন?

চিঠি। গার্গীর কাছে লেখা ওনার চিঠি!….বলে তারকবাবু একটু কাশলেন। বড় টায়ার্ড হয়ে গেছি। লো প্রেসার আছে। হার্টের অবস্থাও ভাল নয়। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে খালি।

অশনি ব্যস্ত হয়ে একগ্লাস জল এনে দিল। বলল, আমার কাজের লোকটা ছুটি নিয়ে গেছে। হোটেলে খাচ্ছি। বসুন, চা করি।

জলটা একটানে খেয়ে তারকবাবু বললেন, না বাবা থাক,। বাড়িতে আমার জন্যে ওরা পথ তাকাচ্ছে। এবার যাব ভবানীপুরে এক জায়গায়। শেষ চেষ্টা আপাতত।

অশনি আস্তে বলল, কে তিনি?

পকেট থেকে একটা কাগজ বর করে দেখে নিয়ে তারকবাবু বললেন, দীপঙ্কর সেন। সতের আশু ঘোষ স্ট্রিট। গার্গীর কাছে চিঠি লিখতেন ভদ্রলোক।

তারকবাবু উঠে দাঁড়ালেন। অশনির মুখটা গম্ভীর। বলল, গার্গীর কাছে তাহলে এই তিনজনের চিঠি দেখেছেন? নাকি আরও….

তারকবাবু পা বাড়িয়ে বললেন, চিঠি তো অনেকেরই আছে। সে সব ওর নেহার্ত পরিচিত মহিলা বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের লেখা। সব জায়গায় খোঁজ খবর নিশ্চয় নেব। তবে আপনাদের তিনজনের চিঠি বেশ ইমপরট্যান্ট মনে হচ্ছিল।

কেন? অশনি ভাঙা গলায় জিগ্যেস করল।

এবার তারকবাবুর মুখটা জ্বলে উঠল যেন। বললেন, আপনারা তিনজনেই তো ওকে সাদাসিধে মেয়ে পেয়ে খেলা করছিলেন। অস্বীকার করতে পারেন? বয়সের একটা ধর্ম থাকে। তার ওপর আজকালকার ছেলেমেয়েদের রীতিনীতিটাই এরকম যেন। এবার আপনাদের সাধ মিটল তো? আমার বোকা মেয়েটাকে আপনারাই তো এভাবে মিসগাইড করে সর্বনাশের পথে ভাসিয়ে ছাড়লেন! …তারকবাবু আবার দ্রুত রুমাল বের করে চোখের কোনা মুছলেন। …ঠিক আছে। যদি গার্গীর সত্যি কোন সর্বনাশ হয়, তাহলে আপনারাই সেজন্যে দায়ী হবেন, মাইন্ড দ্যাট। আপনাদের চিঠিপত্তর সব আমি রেখে দিলুম।

তারকবাবু পর্দা তুলে বেরোলেন। অশনি এগিয়ে বলল, আশ্চর্য! আপনি কি তাহলে আমাকে শাসাতে এসেছিলেন?

তারকবাবু আর কোন কথা বললেন না। অশনি রীতিমতো রেগেছে। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রেখে ফের বলল, আপনি স্বচক্ষেই তো দেখে গেলেন, গার্গী এখানে আসেনি। এলেও লুকিয়ে রাখার কোন ব্যাপার থাকত না–সে তো নিজের মুখেই বললেন। তাহলে কেন আমাকে দায়ী করছেন?

তারকবাবু একথারও কোন জবাব না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলেন। একটু দাঁড়িয়ে থেকে অশনি চলে এল এবং সশব্দে দরজা বন্ধ করল। দরজা বন্ধ করে চুলে হাত রেখে অন্তত এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর অন্য কোণে তার খাটের দিকে দ্রুত চলে গেল। খাটে বসে পড়ল। বিছানায় খবরের কাগজ, কয়েকটা বই আর সিগারেটের বাক্স পড়ে রয়েছে। সারা রাত কেন কে জানে। ঘুম হয়নি। চোখ জ্বালা করছে। অনেক সিগারেট খেয়ে জিভও খসখস করছে। অথচ এখন সিগারেট খাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

সে সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে লাগল।… :

আজ কয়েকটা প্রোগাম ছিল। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল এখানে-সেখানে। সব মাটি হয়ে গেল। আর কিছুতে মন বসবে না তার। গার্গী কোথায় বেপাত্তা হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। গার্গী আরও দুজনকে চিঠিপত্তর লিখত–তার মানে সে আরও দুজনের সঙ্গে একই সময় প্রেম করে যাচ্ছিল, এতেই অশনির মনে জ্বালা ধরে গিয়েছে। ব্যাপারটা ভাবলে খুবই অবাক লাগে তার। গার্গীকে তেমন তুঘোড় মেয়ে বলে ভাবতেই পারছে না। সত্যি খানকটা সাদাসিধে শান্ত ধরনের মেয়ে গার্গী। এই একবছর ধরে তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মেলামেশা করেছে অশনি; অনেক বার তার এই ঘরেও গার্গী এসেছে। এমন শান্ত আর সাদাসিধে মেয়ে যে অশনি এত প্রচণ্ড ধরনের সুযোগ পেয়েও শারীরিক ঘনিষ্ঠতা করতে সংকোচ বোধ করেছে। হয় তো অশনিরই সাহসের অভাব ছিল। তবে এটা ঠিক যে যখনই অশনি আবেগময় কথাবার্তা শুরু করেছে, গার্গী। তখনই হঠাৎ কোন সিরিয়াস আলোচনা পেতে বসেছে। একদিন অশনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল, আজ অন্তত গার্গীকে চুমু না খেয়ে ছাড়বে না। আর সেদিন গার্গী আন্তর্জাতিক মহিলাবর্ষ এবং জরুরি অবস্থা সম্পর্কে অশনির মতামত চেয়ে বসল। মতামত একটা দিতেই হয়। অন্তত গার্গীর মধ্যে নানা ব্যাপারে সিরিয়াস ভাবনাচিন্তা আছে অশনি তা জানে। আর অশনি কি না একজন সাংবাদিক। যাই হোক, এসব ক্ষেত্রে সম্ভবত গায়ের জোরে ইচ্ছা মেটানো ছাড়া উপায় নেই ভেবে অশনি ক্ষান্ত হয়েছে। গার্গীর ওপর গায়ের জোর খাটাবার কথা সে ভাবতেই পারে না।

.

ঢাকুরিয়ায় অশনির মামা থাকেন। মামাতো বোন কৃষ্ণার সূত্রেই তার গার্গীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেদিন ছিল কৃষ্ণার জন্মদিন। মামার আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ব্যাপার হয়েছে। আর ওই একমাত্র মেয়ে। প্রতি জন্মদিনে বিলিতি কেতায় বরাবর পার্টি দেওয়া হয়। গতবছর মার্চে কৃষ্ণার জন্মদিনের পার্টিতে খুব নাচ-গান খাওয়া-দাওয়া হয়। সব ফুরোতে রাত হয়ে যায় এগারোটা। যারা এসেছিল, সবাই গাড়িওয়ালা। শুধু গার্গী বাদে। গোড়া থেকেই অশনির চোখ পড়েছিল মেয়েটির দিকে। অত উজ্জ্বল সাজগোজের মধ্যে একটা সাদাসিধে অথচ পরিচ্ছন্ন চেহারার মোটামুটি ফর্সা মেয়ের দিকে সবারই চোখ পড়ার কথা। অশনি সারাক্ষণ লক্ষ্য রেখেছিল তার দিকে। স্বভাবত একটু আড়ষ্ট দেখাচ্ছিল তাকে। মাঝে মাঝে ব্যালকনিতে একা গিয়ে দাঁড়াচ্ছিল গার্গী। তবু অশনির মধ্যে মুখচোরামি–মেয়েদের ব্যাপারেই, বরাবর প্রবল। যেচে পড়ে আলাপ করার কথা সে ভাবতেও পারেনি। রাত এগারোটায় কৃষা গার্গীকে হন্তদন্ত হয়ে বলল, এই রে! তোমায় আমি পৌঁছে দেবার কথা, বলে আটকে রাখলুম, এদিকে আমাদের গাড়ি শুনছি সন্ধ্যায় গ্যারেজে গেছে। রাতে আর নাকি পাবার আশা নেই। এমন দিনে কী ফানি ব্যাপার দেখ তো!

গার্গী একটু হেসে বলেছিল, তাতে কী! আমি ঠিক চলে যেতে পারব। এখনও বাস পেয়ে যাব!

কৃষ্ণা উদ্বিগ্নমুখে বলেছিল, কিন্তু যদি না পাও! ছি ছি, বড্ড খারাপ লাগছে। একমিনিট–অনিদা আছে! অনিদা, শোন।

অশনি সব টের পেয়ে কপট গাম্ভীর্যে বলেছিল, হুঁ। বলো।

খুব মিনতিপূর্ণ গলায় কৃষ্ণা বুলেছিল, আমার বন্ধু গার্গী–গার্গী রায়। গার্গী, এ আমার পিসতুতো দাদা অশনি দাশগুপ্ত। প্লিজ অনিদা, তুমি তো বালিগঞ্জে যাবে। জাস্ট একটুখানি এগিয়ে…জাস্ট কাছাকাছি…

বাধা দিয়ে অশনি বলেছিল, কোথায়?

 কৈলাস বোস স্ট্রিট। …বলে কৃষ্ণা হেসে ফেলেছিল।

অশনি হাসতে হাসতে বলেছিল, মানে জাস্ট কাছাকাছি। তাই না? ঠিক। আছে, ভেবো না।

গার্গীও হেসেছিল। তারপর আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, না না, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। কোথায় বালিগঞ্জ, কোথায় কৈলাস বোস স্ট্রিট। কোন মানে হয়?

কৃষ্ণা কপট ধমক দিয়ে বলেছিল, তুই থাম তো বাবা! আমার অনিদা কে জানিস তো? খবরের কাগজের রিপোর্টার। সবসময় ওকে পৃথিবী চক্কর দিয়ে বেড়াতে হয়। এই যে তোকে একটা লিফট দেবে, বলা যায় না, যাবার পথে কিংবা ফৈরার সময় হঠাৎ কোন ইনসিডেন্ট চোখে পড়বে। এবং সকালের কাগজে দেখবি বিরাট একটা সেনশেসেনাল স্টোরি বেরিয়েছে। তুই নিশ্চিন্তমনে চলে যা।

অশনি বলেছিল, না। এতটা নিশ্চিন্তমনে উনি আসতে পারবেন না। রাত এগারোটা পনেরো বাজে। এখনও যথেষ্ট শীত রয়েছে। লেকের দিকটা বড্ড নির্জন থাকে।

কৃষ্ণা চোখ পাকিয়ে বলেছিল, বোনের সামনে অসভ্যতা করছ যে?

 জিভ কেটে অশনি বলেছিল, সরি। ওঁকে মনে মনে সবরকম সিচুয়েশানের জন্যে তৈরি থাকতে বলছি। ঠিক আছে। আসুন।

গার্গী অবশ্য গম্ভীর হয়ে বলেছিল, হয়তো আমি তত নাবালিকা নই।

রেলব্রিজ পেরিয়ে যাবার সময় গাড়ির গতি কমিয়ে অশনি মুখ একটু ঘুরিয়ে বলেছিল, আপনি কি তখন আমার কথায় রাগ করেছিলেন?

গার্গী যেন কী ভাবছিল। একটু চমকে উঠে বলেছিল, না তো। কেন?

কৃষ্ণার সঙ্গে মাঝে মাঝে ফাজলেমি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। …অশনি বলেছিল। আসলে ও ভীষণ মডার্ন টাইপ তো। স্মার্ট। হঠাৎ আলোকপ্রাপ্ত ফ্যামিলিতে আজকাল যা হয়। যেমন ধরুন, এই বার্থডে পার্টি। ভীষণ বোর করে না? আমার তো করে।

গার্গী বলেছিলেন, মন্দ কী! আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্তদের চোখে রঙ ধরে যায়। স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

সর্বনাশ! অশনি জোরে হেসে উঠেছিল। বলেন কী? স্বপ্ন দেখছেন বুঝি? কী স্বপ্ন? পার্টি-ফার্টির তো?

গার্গী ঠোঁটের কোণে হেসে বলেছিল, হুঁ।

অশনি স্টিয়ারিং ছেড়ে ঝট করে সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল, আপনি নিশ্চয় কৃষ্ণার সহপাঠিনী ছিলেন ব্র্যাবোর্নে?

গার্গী বলেছিল, মোটেও না। বেথুনে পড়েছি। ওর সঙ্গে আর একজনের থু দিয়ে আলাপ।

এই যেমন আমার সঙ্গে আপনার। …অশনি হাসতে হাসতে বলেছিল। তবে আমার কোন বার্থডে নেই। থাকলেও খেয়াল নেই। তাই পার্টি-ফার্টির চান্সও নেই। কিন্তু ব্যাপারটা কোন মানে হয় বলুন? খামোকা একগাদা টাকা খরচ করে …ভ্যাটু! আসলে এ সেই মধ্যযুগীয় ব্যাপার। লোককে পয়সা দেখানো। কী বলেন?

গার্গী মুখ টিপে হেসেছিল, আমি কিছু বলি না।

তখন গাড়ি দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। অশনি বলেছিল, কিছু মনে না করলে জিগ্যেস করব, কী করেন?

গার্গী বলেছিল, আপনি কৌতূহলী!

অবশ্যই। শুনেছেন তো আমি রিপোর্টার। আমাদের কৌতূহলী হওয়াই স্বভাব। অবশ্য ইচ্ছে না থাকলে জবাব দেবেন না। একটু পরে গার্গী আস্তে বলেছিল, একটা ছোটখাট চাকরি করি।

আচ্ছা!

কথাবার্তাগুলো ফিরতে ছিল এইরকম। নানা প্রসঙ্গে। কিন্তু অশনিই আসলে চুপচাপ থাকতে পারছিল না। হয়তো ওকে দেখার পর থেকেই আকৃষ্ট হয়েছিল। তাই অনর্গল কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তার। বিধান সরণিতে পৌঁছে সে বলেছিল, আমি হয়তো খুব বেশি কথা বলি! বলে একটু দুষ্টু দুষ্টু হেসে পেছনে গার্গীর দিকে ঘুরে বলেছিল, এমনও হতে পারে–আমি পরোক্ষে সাবকনসাসলি আপনাকে সারাপথ সাহস যুগিয়ে এলুম।

কেন? গার্গী অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করেছিল।

বুঝলেন না? আমি চুপচাপ গম্ভীর হয়ে এলে আপনি মনে মনে আশঙ্কা করতেন–ভাবতেন, নির্ঘাৎ লোকটা কোন মতলব ভাঁজছে…অশনি আবার হেসে উঠেছিল।

গার্গী বলেছিল, মেয়েদের সম্পর্কে আপনার সব ধারণাই যে ঠিক হবে তার মানে নেই। হ্যাঁ, এখানেই রাখুন। আমি এবার যেতে পারব।

না, না। চলুন বাড়ি অব্দি যাই।

না। ওই তো কাছেই।

আচ্ছা!…

আজকাল কতভাবে যে প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রথম চেনাজানা হয়ে যায়! .চেনাজানার সময় হয়তো তথাকথিত কিউপিডের দুষ্টুমি নামে সেকেলে ব্যাপারটা ঘটে যায়। অশনি সেই রাতেই গার্গীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে কী যে একলা লাগছিল তার। আবার মনের তলায় চাপা একটা সুখও টের পেয়েছিল–নতুন দিগন্ত আবিষ্কারের সুখ, যে নাবিক হাল ভেঙে হারিয়েছে দিশা, তার যেমন হয়। তবে চেষ্টা করে লেগে থাকলে কাম্যবস্তু মিলে যায় বইকি। অশনি চেষ্টা করেছিল। শেষ অবধি ব্যর্থ হতে হয়নি। গার্গী খানিকটা ওপর-ওপর ধরা দিয়েছিল। বলেছিল–সে-রাতে অশনিকে তারও ভিড়ের মধ্যে আলাদা মনে হয়েছিল, তার প্রতি কৌতূহল জেগেছিল। মনে মনে ছটফট করেছিল, কেউ আলাপ করিয়ে দিচ্ছে না কেন ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে?…

অশনির মধ্যে তোলপাড় জাগছিল। খুব চেনা জিনিসের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল আর এতটুকু থাকার কথা নয়। গার্গীর ব্যাপারেও তার এরকম হয়েছিল। কিন্তু এখন গার্গী তাকে শুধু কৌতূহলী নয়, দারুণ অবাকও করেছে। এভাবে বেপাত্তা হয়ে যেন নিজের দাম হঠাৎ চড়িয়ে আকাশছোঁয়া করে। ফেলেছে। অশনি দেখল এখন গার্গীর সম্বন্ধে যত বেশি ভাববে, তত সে বিপদে পড়ে যাবে। নিজেকে পরাজিত মানুষ বলে মনে হবে। গার্গী কি সেই গার্গী হতে পারে, যে বলেছিল, যাতে অমৃত নেই তা আমি কী করব? তারকবাবুর মেয়ে গার্গী আর যাই করুক, অমৃতের সন্ধানে পাহাড়পর্বতের গুহায় তপস্যা করতে ছোটেনি! ভিড় লোভ বদমাইশিতে ভরা জটিল এই ব্যুহ কিংবা ভাগাড়ের মধ্যেই কোথাও ঢুকে রয়েছে।

কিন্তু কী এসে-যায় তাতে অশনির? কেনই বা সে গার্গীর জন্যে এই চমৎকার দিনটা মাটি করবে? অনেকগুলো সিগারেট খেয়েও এইসব প্রশ্নের তীব্রতা জিইয়ে রাখতে পারল না সে। টের পেল, ক্রমশ নিজের জীবনের ব্যর্থতাগুলোর যে পাহাড় জমে আছে পিছনে, তার ওপর আরো একটা বড় ব্যর্থতা এসে জমেছে।

আর তার চেয়েও বড় কথা, গার্গীর দামটা অনেক বেশি বেড়ে গেছে জনৈক সুনীথ ব্যানার্জি–যার একটি ইটালিয়ান বউ আছে এবং জনৈক দীপঙ্কর সেন, গার্গীর এই দুই প্রেমিক আচমকা অশনির চেতনায় ঢুকেই যত গণ্ডগোল শুরু হয়েছে।

অশনি কিছু ঠিক করতে না পেরে বেরিয়ে পড়ল। নিচের গ্যারাজ থেকে ফিয়েট গাড়িটা বের করে রাস্তায় নামল। তারপর লক্ষ্যহীনভাবে চলতে লাগল।