১. কর্নেলের জার্নাল থেকে

নীল সারসের পিছনে

(কর্নেলের জার্নাল থেকে)

সকালে ধারিয়া ফলস-এর কাছে একটা শিমুলের ডালে নীল সারস দম্পতিকে দেখেছিলুম। আমার ক্যামেরায় টেলিলেন্স পরানোর সময় দেয়নি ওরা। সহসা ডানা মেলে উত্তর-পূর্ব কোণে একটা টিলার মাথায় ঘন জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল। এই সারস অধুনা দুর্লভ প্রজাতির। অনেক পক্ষিবিশারদ তো ঘোষণাই করে ফেলেছেন, এই প্রজাতির সারস কবে লুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই বাইনোকুলারে ওদের দেখে চমকে উঠেছিলুম। সেটাই সম্ভবত ক্যামেরায় টেলিলেন্স যুক্ত করতে দেরির কারণ। নিঃসংশয় না হয়ে কোনো কাজে পা বাড়ানো আমার স্বভাববিরোধী।

ঘন জঙ্গলে ঢাকা টিলাটা এখন অক্টোবর মাসে অতি দুর্গম। রাস্তার সমান্তরালে উত্তর দিকে এগিয়ে নগ্ন কঠিন গ্রানাইট শিলার খপ্পরে পড়ে গেছে। সেদিক থেকে এই টিলায় উঠে সারস দম্পতির অনুসন্ধান অসম্ভব। সামরিক জীবনের মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং এই বৃদ্ধ সময়ে কাজে লাগানো সম্ভব ছিল কি না বলতে পারছি না। কিন্তু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কোথায় পাব? ফেরার সময় বারবার থেমে বাইনোকুলারে এই বিরল প্রজাতির সারস দম্পতিকে আবিষ্কারের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম। সত্যি বলতে কী, যখন ধরমপুরে আমার হোস্ট এবং বন্ধু অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়িতে ফিরে চলেছি, তখন ব্যর্থতা আর হতাশায় আমি প্রায় বিধ্বস্ত।

লাঞ্চের টেবিলে মিঃ রায়চৌধুরির সঙ্গে দেখা হল। তিনি বাইরে থেকে সদ্য। ফিরেছেন। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে তিনি আস্তে বললেন, কর্নেল সরকার কি অসুস্থ বোধ করছেন?

একটু হেসে বললুম, আপনার উবিগ্ন হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি।

তাহলে অনেক হেঁটেছেন। পাহাড়ি রাস্তার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আসলে পলিটিকাল প্রবলেম এই অঞ্চলের উন্নতিতে বাধা দিচ্ছে।

অরিন্দম রায়চৌধুরী ধরমপুর বাঙালিটোলায় তিন পুরুষের অধিবাসী। রাজনীতি করেন। কাজেই লাঞ্চের সময় ঝাড়খণ্ডিদের রাজনীতির ভালো-মন্দ নিয়ে অনর্গল কথা বলছিলেন। এক ফাঁকে আমি নীল সারস দম্পতির কথা বললুম। ঘটনাটা শুনে তিনি খুব হাসলেন। তারপর বললেন, যৌবনে খুব শিকারের নেশা ছিল। বাঘ-ভালুকও মেরেছি। তবে পাখিই আমার আসল লক্ষ্য ছিল। আপনার মতো ছবি তোলার চেয়ে পাখির মাংসের স্বাদ নিয়ে বিস্তর এক্সপেরিমেন্ট করেছিলুম। আপনি বলছেন নীল সারসের কথা। ধারিয়া নদীর ফলস-এর প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর অববাহিকায় একটা বিশাল জলা আছে। অজস্র জলটুঙ্গি আছে। নৌকোয় চেপে সারস শিকার করেছি প্রচুর। মনে পড়ছে না নীল সারস দেখেছিলুম কি না। শিকারে আমার দুই সঙ্গী ছিল। রিট্রিভার জাতের একটা কুকুর রেক্সি। আর ফাগুলাল।

ফাগুলালের চেহারা শক্তসমর্থ। পাকা গোঁফ। কাঁচাপাকা কদমছাট চুল। তামাটে গায়ের রং। খাড়া নাক। রায়চৌধুরিসায়েবের হুকুমে বিকাল তিনটে নাগাদ সে আমার সঙ্গী হল। বিশেষ কথা, সে নীল সারস দম্পতিকে দেখেছে।

সঙ্গী হিসাবে তো বটেই, তা ছাড়া পাখি-জন্তু-জানোয়ার সম্পর্কে তার জ্ঞান এবং কৌতূহল থাকায় ফাগুলাল কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ঘনিষ্ঠ অনুচর হয়ে উঠেছিল। তারও তিনপুরুষ বাঙালি বাড়িতে কেটেছে বলে সে বাঙালির মতোই বাংলা বলতে পারে। সে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যে-ভাবে হেঁটে যাচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম, বহুকাল পরে সে তার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিকে যেন ফিরে পেয়েছে।

এবার ফাগুলালের নির্দেশে আমি দক্ষিণ ধারিয়া জলপ্রপাতের দিকে না গিয়ে একেবারে উলটোদিকে অর্থাৎ উত্তরে হেঁটে যাচ্ছিলুম। বহুবছর আগে এই রাস্তায় এলামেলো তাপ্পি দিয়ে ছোটো-বড়ো পাথর ফেলে হয়তো স্টিমরোলারে সমতল করা হয়েছে। এখন বছরের পর বছর বৃষ্টির জল তাপ্পিগুলিকে উঁচু-নিচু করে ফেলেছে। জিপ ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি চলা অসম্ভব। চড়াইয়ে ওঠার সময় মনে পড়ল, মিঃ চৌধুরি আমার প্রয়োজনে তাঁর জিপ গাড়িটা দিতে তৈরি ছিলেন। কিন্তু এখন আর পস্তে লাভ নেই। দুধারে উঁচু গাছের জঙ্গল এবং মাঝে মাঝে ফাগুলাল বাঁদিকে রাস্তার ধারে গিয়ে গাছের ফাঁকে সম্ভবত নীল সারস দম্পতিকে খুঁজছিল। তারপর রাস্তা হঠাৎ পশ্চিমে বাঁক নিল এবং আরও চড়াইয়ে ওঠার পর দেখলুম, আমরা দুটো টিলার মাঝখানে এসে পৌঁছেছি। ডানদিকে আর গাছ নেই। শুধু ঝোপঝাড় আর শীর্ষে নগ্ন গ্রানাইট শিলার স্তূপ। রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা বটগাছ দেখলুম। তার তলায় লম্বা একটা পাথর। পাথরটাতে বসে বিশ্রাম নিতে এবং চুরুট টানতে পেলে খুশি হতুম। কিন্তু সূর্য ঢলে পড়ছে আরও দূরে ঘন নীল শৈলশ্রেণীর দিকে, ওটা ছোটোনাগপুর। পর্বতমালার একটা রেঞ্জ।

ফাগুলাল তখন বাঁদিকের টিলার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার কয়েক পা পিছনে। বাঁদিকের টিলার গায়ে নানা আকার ও আয়তনের পাথর ছড়ানো। সেইসব পাথরের আনাচেকানাচে ঝোপঝাড় অজস্র। ফাগুলালের হাবভাব লক্ষ্য করে বাইনোকুলার তুলে নিলুম। ফাগুলাল আস্তে বলল, ওই যে পিপুলগাছ দেখছেন, হ্যাঁ–একেবারে পাহাড়ের মাথায়, দেখতে পাচ্ছেন তো স্যার?

বাইনোকুলারের ভিউপয়েন্টার নবটাকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে অ্যাডজাস্ট করে নিলুম। দূরত্বের সঙ্গে এবং পিপুলগাছের একটা অংশ চোখে পড়ল। বললুম, পিপুলগাছটার একটা পাশ দেখতে পাচ্ছি।

ফাগুলাল ঘুরে আমাকে দেখে নিয়ে বলল, স্যার! আর একটু বাঁদিকে এই পাথরটার কাছে আসুন।

পাথরটাতে সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার তাগড়াই শরীর, তারও আয়তন কম নয়। সে অগত্যা নেমে আমাকে দাঁড়াবার জায়গা দিয়ে বলল, ধারিয়া ফলস-এর দিকে সারাদিন মানুষজন হইহল্লা করে। পাখিদুটো তাই এই পিপুলগাছে এসে বসে থাকে। একটু খুঁজে দেখুন স্যার।

আমার এই বাইনোকুলার এক কিলোমিটার দূরে কোনো খুদে জিনিস ডিটেলস দেখিয়ে দেয়। এখানে দূরত্ব প্রায় আড়াইশো মিটার। পিপুলগাছটার প্রতিটা পাতার শিরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পাখিদুটোকে দেখতে পাচ্ছি না।

ফাগুলাল জিজ্ঞেস করল, দেখতে পাচ্ছেন?

অমনি বাইনোকুলারের লেন্সে নীল সারস ধরা দিল। আসলে সূর্যের ছটা এবং পাশের একটা উঁচু হয়ে ওঠা পাতাভরা ডাল বাতাসে এপাশে-ওপাশে ঝাঁকুনি খাচ্ছিল বলেই সারসটার পক্ষে চমৎকার ক্যামোফ্লেজ হয়ে উঠেছিল।

খুঁটিয়ে তাকে দেখার পরে তার সঙ্গিনীকে খুঁজলুম। মিনিট পাঁচেক পরে সে আড়াল থেকে প্রকাশ্যে এসে সঙ্গীকে সম্ভবত চুমু দিল। বললুম, ফাগুলাল! দুজনকেই পেয়ে গেছি। কিন্তু ওদের ছবি তুলতে চাই। তুমি এখানেই অপেক্ষা করো।

দ্রুত ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে সাবধানে পা বাড়ালুম। পাহাড়-জঙ্গলে এলে আমি সেকেলে হান্টিং বুটের ধাঁচে তৈরি রবার সোলের বিশেষ ধরনের খাঁজকাটা জুতো পরি। এই জুতো মাউন্টেনিয়াররাও পরে। সূর্য টিলার ওপাশে নেমেছে বটে, কিন্তু পিপুলগাছে যথেষ্ট রোদ আছে। পিচ্ছিল ঢালু পাথরে ঝুঁকে ডানহাত রেখে গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিলুম। একটু পরে পিছনে ফাগুলালের সাড়া পেলুম। কখন সে কোনো গাছ বা ঝোঁপ থেকে একটা লাঠি তৈরি করে নিয়েছে। সে আস্তে বলল, স্যার। এই পাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপ আছে। আমাকে আগে যেতে দিন।

তখন নীল সারস দম্পতি আমাকে প্রায় উন্মাদ করে ফেলেছে। হাউন্মাদ শব্দটা ইচ্ছা করেই বলছি। সামরিক জীবনে বর্মার জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধে শত্রু পক্ষের দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে যাওয়ার সময় একই উন্মাদনা পেয়ে বসত। আর তিরিশ মিটার এগিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে বসলেই আমার ক্যামেরায় সারস দম্পতি পরিষ্কার এসে যাবে। ফাগুলালকে এগোতে দিলুম না। তাকে মাথার টুপি খুলে ধরতে দিলুম।

তারপর সামনের ঝোপটার কাছে গেছি, হঠাৎ দেখি পাথরের উপর খানিকটা লাল ছোপ। বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলুম, এমনই লাল ছোপ নিচের দিক থেকে এগিয়ে এসেছে। ডাইনে একই লাল ছোপ উঠে গেছে চূড়ার দিকে। কোথাও লাল রেখাও চোখে পড়ল। তারপর ঝোপের একপাশে একপাটি স্লিপার। মেয়েদেরই স্লিপার। আর ঝোপের কাটায় আটকে আছে এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে দেখি, খয়েরি রঙের শাড়ির আঁচলের একটা অংশ।

পিছু ফিরে ফাগুলালের দিকে তাকালুম। সে নিষ্পলক চোখে স্লিপারটা দেখছে। আমি ঝোঁপ থেকে ছেঁড়া কাপড়টা খুলে নিয়ে পিঠে আটা কিটব্যাগের পিছনের খোপে ঢুকিয়ে রাখলুম। স্লিপারটাও তুলে নিয়ে সেখানে ঢোকালুম। তারপর ডানদিকে ঘুরে চূড়ার দিকে উঠতে উঠতে মাথার উপর শনশন শব্দ শুনে মুখ তুলেই দেখি, নীল সারস দম্পতি উত্তরে উড়ে চলে যাচ্ছে।

ফাগুলাল প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, স্যার! স্যার!

বললুম ফাগুলাল! আমার পিছনে এসো। মনে হচ্ছে, আমরা একটা সাংঘাতিক ঘটনার সামনে এসে গেছি।

চূড়ায় ওঠা কষ্টকর ছিল না। পাথরের খাঁজে পা রেখে মিনিট দশের মধ্যে ঘন ঝোঁপঝাড়ের সামনে পৌঁছে গেলুম। চূড়ার পুরোটাই উঁচু-নিচু গা আর ঝোপে ঢাকা। মাঝে মাঝে পাথর উঁচিয়ে আছে। লাল ছোপটা ঝোপে গিয়ে ঢুকেছে। ফাগুলাল বলল, কোনো জানোয়ার হতে পারে স্যার! এইসব পাহাড়ি জঙ্গলে এখনও বাঘ বা ভালুক আছে। চিতাবাঘও আছে। স্যার! আর এগাবেন না।

ততক্ষণে আমি ঝোপের ওধারে টাটকা খোঁড়া ঘাসের চাপড়া বসানো হাত, তিনেক লম্বা একটা জায়গা আবিষ্কার করে ফেলেছি। ফাগুলাল এসে উঁকি মেরে। দেখে কপাল চাপড়ে বলে উঠল, হায় রাম!

এরপর আমি বাইনোকুলারে টিলাপাহাড়ের নিচে এবং রাস্তার বাঁক খুঁটিয়ে দেখার পর তিনদিকে ঘুরে এলাকাটা দেখে নিলুম। এখান থেকে নিচের রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। কারণ দুধারের গাছপালা এখান থেকে রাস্তাটাকে আড়াল করছে না। কেউ আমাদের লক্ষ করছে না, এতে নিঃসংশয় হওয়ার পর বললুম, ফাগুলাল! চলো! আমরা রক্তের দাগ যেখান থেকে উঠে এসেছে, সেখানে যাই। সাবধান! এখানে নিচে থেকে ওঠার চেয়ে নামা তুত সহজ হবে না। বরং তুমি জুতো খুলে ফেলো!

ফাগুলাল বলল, না স্যার! আমার অসুবিধা হবে না। পাহাড়ি মুলুকের লোক আমি। তাছাড়া আমার সায়েবের সঙ্গে কত উঁচু পাহাড়ে ওঠা-নামা করেছি।

রক্তের দাগ অনুসরণ করে নামছিলুম। কিছুটা নামার পর একটুখানি চাতালমতো জায়গায় পৌঁছুলুম। সেখানে আর একপাটি স্লিপার পড়ে আছে। এটা রক্তমাখা। কিন্তু রক্ত শুকিয়ে গেছে। তারপর চোখে পড়ল, চাতালের উত্তরে ঝুঁকে থাকা ঝোপের ডগায় রক্ত মেখে আছে। তার মানে, চাতালে রক্তাক্ত মৃতদেহটা ওদিক থেকে তোলা হয়েছে বা টেনে আনা হয়েছে।

ওদিকে পাথর আর নেই। ঘাসের জঙ্গল। ফাগুলাল এগিয়ে এসে তার হাতের ডালটা দিয়ে ঘাসের জঙ্গলে আঘাত করতে করতে নেমে গেল। মৃতদেহ এই পথেই আনা হয়েছিল। ঘাস দুমড়ে গেছে। এখানে রক্তে ঘাস লাল হয়ে গেছে।

আমরা ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে উঁচু গাছের ভিতর রক্তের চিহ্ন হারিয়ে ফেললুম। গাছের তলায় ঘনছায়া বলেও নয়, টর্চ জ্বেলে খুঁজেও দেখলুম। কোথাও রক্তের ছোপ নেই। এ তো অদ্ভুত ব্যাপার! ইতস্তত টর্চের আলো ফেলে খুঁজতে খুঁজতে এবার চোখে পড়ল ভিজে মাটিতে লম্বালম্বি দুটো সমন্তরাল দাগ। ফাগুলালের কাছ থেকে এতক্ষণে টুপিটা চেয়ে নিলুম। স্যাঁতসেঁতে মাটি থেকে ঝাঁকে ঝাকে খুদে পোকা আমার টাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। দাড়িতেও যথেষ্ট উপদ্রব। আমি বেশি ঝুঁকেছিলাম মাটির দিকে, এটাই তাদের উপদ্রবের সুযোগ দিয়েছিল। ফাগুলাল বলল, চলুন, স্যার! বড় মশা এখানে।

বললুম মশা নয়। এগুলো একধরনের পোকা। চলো! রাস্তায় যাই।

রাস্তা এখান থেকে কিছুটা উত্তরে এগিয়ে পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে। ওই বাঁক দিয়ে আমরা দুটো টিলার মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছেছিলুম। এখন সূর্য টিলার পশ্চিমে নেমে গেছে। তাই এদিকে আলোর রং ধূসর। ফাগুলাল বলল, আপনাকে একটা কথা বলি স্যার।

বলো!

যা দেখে এলেন, তা নিয়ে আমার সায়েবের সঙ্গে আগে কথা বলা উচিত কাজ হবে। ধরমপুরে খুনখারাপি নতুন নয়। খামোখা কদিনের জন্য বেড়াতে এসে ঝামেলায় পড়বেন। আমিও পড়ব।

একটু হেসে বললুম, তোমার সায়েব কি এ কথা চেপে যেতে বলবেন?

আমার মনে হয় তা বলবেন। কেন জানেন স্যার? পুলিশ–ফাগুলাল হঠাৎ পিছু ফিরে কেউ আসছে কি না দেখে নিয়ে বলল, ধরমপুরে পুলিশ আমার সায়েবকে তো বটেই, বাঙালিটোলার সব বাঙালিকে ঝাড়খণ্ডিদের সাপোর্টার মনে করে। আপনি আগে তো এসেছেন। তখন বাঙালিটোলার সব হাবেলি বাঙালিদের ছিল। এখন দশটা হাবেলি কিনে নিয়েছে এদিক-সেদিক থেকে আসা বিহারী লোক।

তুমিও তো বিহারী লোক, ফাগুলাল।

ফাগুলাল হাসবার চেষ্টা করে বলল, আমি স্যার বাঙালি হয়ে গেছি।

কিছুক্ষণ পরে বাঙালিটোলার পিচরাস্তায় পৌঁছে ফাগুলাল চাপাস্বরে বলল, ধরমপুরের মেয়ে নয়, বাইরে থেকে আসা কোনো মেয়ে। এখানকার কেউ হলে জানতে পারতাম। কারও মেয়ে বা ওয়াইফ নিখোঁজ হলে হইচই শুরু হত। তাই বলছি, জুতোজড়ো আর ঘেঁড়া কাপড়টা আমাকে দিলে আমি কোথাও পুঁতে রেখে আসব। ধারিয়া নদীতে ফেলে দেওয়ারও ঝামেলা নেই।

তার কথায় কান দিলুম না। অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়ি, ফাগুলালের ভাষায় যা হাবেলি, বাঙালিটোলার শেষপ্রান্তে এবং উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। গেটে নেপালি দারোয়ান আছে। কমন নাম জঙ্গবাহাদুর। তার পরনে খাকি হাফপ্যান্ট-হাফশার্ট এবং কোমরের বেলটে চামড়ার কাপে ভরা কুকরি আছে। সে সেলাম করে গেটের একটা অংশ খুলে দিল। লনের দুপাশে ফুলগাছ, ঝাউ, ক্যাকটাস। মিঃ রায়চৌধুরি দোতলা পুরোনো বাড়ির দক্ষিণে ঘাসে ঢাকা মাটিতে পৌত্রের সঙ্গে রঙিন বল নিয়ে খেলা করছিলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ধরা পড়েছে? পড়া তো উচিত। ফাগুলাল যখন সঙ্গী।

বললুম, না মিঃ রায়চৌধুরি! ফাগুলাল ঠিক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। আমারই দুর্ভাগ্য! কামরায় ওরা ধরা পড়ল না।

মিসেস রায়চৌধুরি পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে মালির সঙ্গে কথা বলছিলেন। মিঃ রায়চৌধুরি তার উদ্দেশে বললেন, তুমি তুতুনকে একটু দেখো। কর্নেলসায়েব ফিরেছেন।

আমার কাছে এসে তিনি বললেন, চলুন! পোর্টিকোর ছাদে গিয়ে বসি। ফাগুলাল! কর্নেলসায়েবের জন্য কফির ব্যবস্থা করো। আমিও খাব।

ফাগুলাল একটু ইতস্তত করে এগিয়ে গেল। হলঘরের ভিতর ঢুকে আমরা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলুম। সিঁড়িতে বিবর্ণ কার্পেট পাতা। ডাইনে ঘুরে একটা দরজা পেরিয়ে পোর্টিকোর ছাদ। ছাদে বেতের কয়েকটা চেয়ার ও টেবিল ছিল। আগে পিঠে আটা কিটব্যাগ খুলে পায়ের কাছে রাখলুম। তারপর টুপি খুলে টাকে হাত বুলিয়ে দাড়ি ঝাড়লুম। বললুম, জঙ্গলের স্যাঁতসেঁতে মাটিতে পোকার খুব উপদ্রব।

মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, জঙ্গলে ঢুকেছিলেন কেন?

জোড়া টিলার বাঁদিকেরটায় উঠেছিলুম! নামার সময় সোজা নেমে এসেছি।

ডমরুপাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিল ফাগুলাল?

ওটা ডমরুপাহাড় নাকি? 

মিঃ রায়চৌধুরি হাসলেন। নিচে থেকে লক্ষ করলে দুটো পাহাড়ের মাঝখানটায় ভজ বলে লোকে ডমরুপাহাড় বলে। আসলে ব্রিটিশ আমলে লম্বা পাহাড়টার মাঝখানটা কেটে রাস্তা করা হয়েছিল। ওই রাস্তায় পশ্চিমে মাইলপাঁচেক এগিয়ে গিয়ে নদীর অববাহিকায় সেই বিশাল জলা। ও! আপনাকে তো নিয়ে গিয়েছিলুম।

আমি কফির প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমার নার্ভ তখন নিঃসাড় হয়ে গেছে যেন। আমি ভাগ্য মানি না। কিন্তু এটাই আশ্চর্য ব্যাপার, এর আগেও নীল সারস দম্পতি দেখার পর ঠিক এমনি একটা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলুম। তবে মেয়েটাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে জেলেদের জালে তার মৃতদেহ আটকে যায়। এক্ষেত্রে কোনো মেয়েকে মেরে অত উঁচু পাহাড়ের চুড়ায় মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। ফাগুলাল বলেছিল, ওই পাহাড়ে শঙ্খচুড় সাপের উপদ্রব আছে। কে এমন খুনি যে সাংঘাতিক বিষধর শঙ্খচূড় সাপেরও পরোয়া করে না!

কী কর্নেল সরকার? আপনাকে এবেলা ক্লান্ত বলব না, যেন ডিপ্রেসড দেখাচ্ছে। আপনার মতো জলি মানুষকে এমন কখনও দেখিনি। সত্যই কি আপনি নীল সারসের ছবি তুলতে না পেরে তার কথার উপর বললুম, মিঃ রায়চৌধুরি! ধরমপুরের নাড়িনক্ষত্র আপনার জানা। সম্প্রতি কি কোনো মহিলা–এখনও বয়স অনুমান করতে পারিনি, যাইহোক, মহিলাই বলছি, নিখোঁজ হয়েছে বলে জানেন?

অরিন্দম রায়চৌধুরি একটু ঝুঁকে এলেন। মাই গড। আপনি কোনো ডেডবডি আবিষ্কার করেছেন?

ডেডবডি নয়। সম্ভবত তার কবর।

কোথায়? কোথায়?

ডমরুপাহাড়ে বাঁদিকের চূড়ায়। বডি সোজা টেনে তুলে নিয়ে গিয়ে কেউ পুঁতেছে। যে-পথে টেনে তুলেছে, সে পথে রক্তের দাগ স্পষ্ট। কাটাঝোপে খয়েরি রঙের শাড়ির আঁচলের একটু অংশ আর দুপাটি স্লিপার পেয়েছি। পুলিশকে এখনই জানানো দরকার।

মিঃ রায়চৌধুরি চশমা টেবিলে রেখে দুগালে দুটো হাত চেপে ধরে (এটা তাঁর একটা অভ্যাস) আস্তে বললেন, একটু ভাবতে দিন। কফি খাওয়ার পর কথা হবে। হা–ফাগুলাল কি দেখেছে?

–দেখেছে। সে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে ছিল।

 –সে কী বলল আপনাকে?

চেপে যেতে বলল। অবশ্য আপনার সঙ্গে কথা বলার পর চেপে যেতে বলল।

–হুঁ। আগে কফি খেয়ে নিন। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।….

কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়েছি, অরিন্দম রায়চৌধুরি বললেন, একটা অনুরোধ কর্নেল সরকার!

বলুন!

 ফাগুলালকে আমি মাইনাসে রেখে পুলিশকে খবর দিতে চাই।

 অর্থাৎ ফাগুলাল আমার সঙ্গে ছিল না?

 হ্যাঁ।

 কেন?

সংক্ষেপে বলছি। এখানকার বাঙালিদের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ডি-বিরোধী বিহারীদের বিশেষ করে ব্যবসায়ী আর শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের অন্ধ বিদ্বেষ। আছে। এদিকে ফাগুলাল আমার মতো একজন বাঙালি রাজনীতিকের কর্মচারী বলেও নয়, তার পাহলোয়ান নামে বদনাম আছে। আমরা ঠাট্টা করে পালোয়ান বলি। ধরমপুর এবং সারা এলাকায় পাহলোয়ান বলতে আমরা যাদের দুবৃত্ত মস্তান বলি তা-ই। ফাগুলালের সাঙ্গপাঙ্গ আছে অচ্ছুত বা হরিজনদের মধ্যে। বিহারে জাত-পাতের দ্বন্দ্বের কথা আপনি জানেন। আশাকরি, আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছেন।

পেরেছি। কিন্তু–

আপনার কিন্তু আর আমার কিন্তু এক নয়। ফাগুলাল পাহলোয়ান বাঙালি আর ঝাড়খণ্ডিদের যোগাযোগের মিডিয়া হিসাবে দাগি। অচ্ছুত বলুন, কি হরিজন বলুন, কি দলিত বলুন, তার ঝাড়খণ্ডিদের গোপনে সমর্থন করে। তাই ফাগুলাল তাদের গার্জেন।

আমার ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছিল। বললুম মিঃ রায়চৌধুরি! একটা নিছক হত্যাকাণ্ডকে রাজনীতির আওতায় নিয়ে যাওয়ার অর্থ হয় না। আপনি তো জানেন, আমি

আবার আমার কথা থামিয়ে দিলেন মিঃ রায়চৌধুরি। হ্যাঁ, আপনি একটা হত্যাকাণ্ডের কিছু সূত্র পেয়েছেন। তাই আপনি আপনার মতো করে এগিয়ে যেতে চাইছেন। এতে আমার আপত্তির কী কারণ থাকতে পারে? বরং আমি আপনাকে সবরকম সাহায্য করব। শুধু ফাগুলালকে আমি সরিয়ে নিতে চাইছি। কারণ সে আপনার নিছক সঙ্গী ছিল এবং পাখিদুটোর ঠিকানা জানত, এই ব্যাপারটা তুচ্ছ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এই কথাটা দাঁড়াবে : ফাগুলাল এবং একটি হত্যাকাণ্ড। তাকে পুলিশের সাহায্যে ফাঁসানোর সুযোগ পাবে ওরা।

মিঃ রায়চৌধুরির যুক্তি আমার বোধগম্য হল না, এমন নয়। হয়তো আমি ধরমপুরের সাম্প্রতিক অবস্থা জানি না। এবং এতবছর পরে তো নেহাত বহিরাগত বটেই। এই ভেবে বললুম, ঠিক আছে। বড়ো দেরি হয়ে গেল। সাড়ে ছটা বাজে। চলুন, আপনি পুলিশকে টেলিফোন করবেন। দরকার হলে আমিও কথা বলব।

ফাগুলাল দরজার পাশে বসে কথা শুনছিল। আমাদের দরজায় ঢোকার সময় উঠে দাঁড়াল। তার জোরে শ্বাস ছাড়ার শব্দ কানে এল।

দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে হেঁটে অরিন্দম রায়চৌধুরির স্টাডিতে ঢুকলুম। পাশেই আমার থাকার ঘর। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে ও পাখা চালিয়ে মিঃ রায়চৌধুরি টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে ডায়াল করলেন। এখন ধরমপুরে টেলিফোনের অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ হয়েছে। তিনি রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, এনগেজড। আপনি বসুন। ততক্ষণ আমি পাইপ ধরিয়ে নিই। আপনার চুরুটের গন্ধ মনে পড়িয়ে দিল, এবেলা পাইপ টানার সুযোগ পাই নি। না– ব্যস্ততা নয়। আমার মিসেসের কঠোর নির্দেশ।

সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে বসে মিঃ রায়চৌধুরি তাঁর ধূমপানের ইচ্ছা অনিচ্ছা এবং বাধা নিয়ে কথা বলতে বলতে পাইপ পরিষ্কার করলেন। তারপর তামাক পুরে বললেন, লাইটারটা কোথায় গেল? এই এক বদঅভ্যাস।

আমি লাইটার জ্বেলে ওঁর পাইপ ধরাতে সাহায্য করলুম। আমার ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছিল। মিঃ রায়চৌধুরি কি ইচ্ছা করেই গড়িমসি করছেন? এই ধরনের ঘটনায় বরাবর আমার অভ্যাস সোজা পুলিশের কাছে যাওয়া। কিংবা কাছাকাছি খোঁজ নিয়ে কারও টেলিফোন ব্যবহার। বাঙালিটোলার উত্তরে মিনিট দশেক হাঁটলেই টেলিফোন পেয়ে যেতুম। আসলে ফাগুলালের কথাবার্তা এবং আমার পুরোনো বন্ধুর প্রতি আনুগত্য, বিশেষ করে আমি যখন তার আতিথ্য সেবা-যত্নে আছি, এই সব কারণে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেল। আমার উদবেগ, অক্টোবরের যে কোনো সময় অতর্কিতে শুধু বৃষ্টি বা ঝোড়ো হাওয়া সহ বৃষ্টি এসে যেতে পারে এবং ডমরুপাহাড়ের রক্ত ধুয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। এতে পুলিশের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার তদন্ত পদ্ধতির ক্ষতি হবে।

অরিন্দম রায়চৌধুরি পাইপ কামড়ে ধরে আবার রিসিভার তুললেন। ডায়াল করে এবার সাড়া পেলেন। হিন্দিতে বললেন, ওসি মিঃ সিংহ আছেন?

…………

আমি অরিন্দম রায়চৌধুরি বলছি! দিস ইজ আর্জেন্ট।

…………

মিঃ সিংহ! একটু মন দিয়ে শুনুন। আমার কলকাতার এক বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার গতকাল এখানে বেড়াতে এসেছেন। তিনি একজন অর্নিথোলজিস্ট। আজ বিকালে ডমরুপাহাড়ের দক্ষিণ অংশের চূড়ায় সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন। ফিরে এসে উনি

…………

 ওঁর মনে হয়েছে ওখানে একটা ডেডবডি পোঁতা আছে। আগে শুনুন! দুপাটি স্লিপার, কোনো মেয়েরই। ঝোপে খয়েরি রঙের শাড়ির একটু অংশ। রক্তের দাগ। এইসব দেখেই কর্নেল সরকারের সন্দেহ

…………

মিঃ রায়চৌধুরি মাউথপিসে হাত চাপ দিয়ে আমাকে বললেন, এই নতুন ওসি শ্যামসুন্দর সিংহ বড্ড বাজে লোক। রিসিভার কানে রেখে অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলে। দেখি ও কী করে। আমি বরং সি আইকে রিং করব। নাইস ম্যান। কলকাতায় লেখাপড়া করেছেন। বাড়ি সাহেবগঞ্জে।…হ্যাঁ। বলুন মিঃ সিংহ।

…………

 ঠিক আছে। আমি তাহলে কর্নেলসায়েবকে নিয়ে বেরোচ্ছি। ডমরুপাহাড়ের রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করব।

…………

হ্যাঁ। খোঁড়াখুঁড়ির জন্য লোকজন তো অবশ্যই দরকার। আপনি ব্যাপারটা বুঝেছেন তো? বাঁদিকের পাহাড়ের চূড়ায়–তার মানে একটা সিরিয়াস অ্যাডভেঞ্চার…ইউ আর রাইট মিঃ সিংহ।….।