পাতালঘর – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
“আচ্ছা, ও বাড়িতে কি ভূত আছে মশাই?”
নরহরিবাবু অবাক হয়ে বললেন, “ভূত! বাড়ির সঙ্গে আবার ভূতও চাই নাকি আপনার? আচ্ছা আবদার তো মশাই! শস্তায় বাড়িটা পাচ্ছেন, সেই ঢের, তার সঙ্গে আবার ভূত চাইলে পারব না মশাই। ভূত চাইলে অন্য বাড়ি দেখুন। ওই নরেন বক্সির বাড়ি কিনুন, মেলা ভূত পাবেন।”
সুবুদ্ধি জিভ কেটে বলল, “আরে ছিঃ ছিঃ, ভূত চাইব কেন? ওটা কি চাইবার জিনিস? বলছিলাম কি পুরনো বাড়ি তো, অনেক সময়ে পুরনো বাড়িতেই তাঁরা থাকেন কিনা।”
নরহরিবাবু এ-কথাটা শুনেও বিশেষ খুশি হলেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন, “পুরনো বাড়ি হলেই ভূত থাকবে এমন কোনও কথা নেই। ভূত অত শস্তা নয়। ভূত যদি থাকত তা হলে আরও লাখদুয়েক টাকা বেশি দর হাঁকতে পারতুম। কপালটাই আমার খারাপ। কলকাতার বিখ্যাত ভূতসন্ধানী ভূতনাথ নন্দী মাত্র ছ’মাস আগে এসে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যদি ভূতের গ্যারান্টি থাকে তবে তিন লক্ষ টাকা দিতে রাজি আছি।’ বুঝলেন মশাই, ভূত থাকলে এত শস্তায় মাত্র এক লাখ টাকায় বাড়িটা আপনি পেতেন না।”
সুবুদ্ধি ঘাড় নেড়ে বলল, “বুঝেছি। ভূতের দাম আছে দেখছি।”
“চড়া দাম মশাই, চড়া দাম। অথচ কপালটা খারাপ না হলে দেড়শো বছরের পুরনো বাড়িতে এক-আধটা ভূত কি থাকতে পারত না? কিন্তু ব্যাটারা যে কোথায় হাওয়া হল কে জানে! বোম্বাইয়ের থিওসফিক্যাল সোসাইটির কিছু আড়কাঠিও এসেছিল ভূতের বাড়ির খোঁজে। তারাও ও-বাড়ি ভাড়া নিয়ে কয়েকদিন ছিল। ভূতের গায়ের আঁশটিও দেখতে পায়নি।”
সুবুদ্ধি হঠাৎ বলল, “ভূতের গায়ে কি আঁশ থাকে নরহরিবাবু?”
নরহরিবাবু উদাস হয়ে বললেন, “কে জানে কী থাকে! আঁশও থাকতে পারে, বড়বড় লোমও থাকতে পারে।”
“নরেন বক্সির বাড়ির কথা কী যেন বলছিলেন!”
নরহরিবাবু গলাটা একটু খাটো করে বললেন, “ওর বাড়িতেও ভূতফুত কিছু নেই মশাই। সব ফকিকারি। ভূতনাথ নন্দীকে ভজিয়ে বাড়িটা দেড় লাখ বেশি দামে গছাল। রাত্রিবেলা মেজো ছেলে গোপালকে ভূত সাজিয়ে পাঠিয়েছিল। গোপাল সাদা চাঁদর চাপা দিয়ে খানিক নাচানাচি করে এল উঠোনে। নাকিগলায় কথাটথাও বলেছিল। তাইতেই ভূতনাথবাবু খুব ইমপ্রেচ্ছ। খুশি হয়ে বাড়িটা কিনে ফেললেন। তবে তিনি ব্যস্ত মানুষ, বিশেষ আসেন না। বাড়িটা পড়েই থাকে।”
সুবুদ্ধি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, “যাক, বাড়িটায় ভূত নেই জেনে ভারী নিশ্চিন্ত হলাম। পুরনো বাড়ি বলে একটু খুঁতখুতুনি ছিল।”
একথায় নরহরিবাবু একেবারেই খুশি হলেন না। একটু যেন চটে উঠেই বললেন, “আপনি তো ভূত নেই বলে খুশি হয়েই খালাস। কিন্তু ভূত না থাকাটা কি ভাল? যত দিন যাচ্ছে ততই ভূতের চাহিদা বাড়ছে। চারদিকে এখন ‘ভূত নেই’, ‘ভগবান নেই’ বলে একটা হাওয়া উঠেছে। যতই হাওয়াটা জোরদার হচ্ছে ততই লোক ভূত দেখার জন্য হামলে পড়ছে। আর যতই হামলে পড়ছে ততই ভূতেরা গা-ঢাকা দিচ্ছে। তাতে লাভটা হচ্ছে কার?”
সুবুদ্ধি একটু হতবুদ্ধি হয়ে বলল, “তা বটে!”
“আপনি তো ‘তা বটে’ বলেই মুখ মুছে ফেললেন, কিন্তু আমার ক্ষতিটা বিবেচনা করেছেন? আমার এ-তল্লাটে সোয়াশো দেড়শো বছরের পুরনো আরও পাঁচখানা বাড়ি আছে। ভূত না থাকলে সেগুলোর দর উঠবে? নোনায় ধরেছে, ঝুরঝুর করে চুনবালি খসে পড়ছে। দেওয়াল ফেটে হাঁ হয়ে তক্ষকের বাসা হয়েছে, অশ্বথ গাছ উঠছে, ওসব বাড়ির দামই বা কী? ওদিকে ভূতনাথ নন্দী বলে রেখেছেন খাঁটি ভূত থাকলে তিনি প্রত্যেকটা বাড়ি আড়াই তিন লাখে কিনে নেবেন। কিন্তু কপালটাই এমন যে, কী বলব। মতি ওঝাকে দিয়ে সবকটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজিয়েছি। সে মেলা মন্ত্রটন্ত্র পড়ে ভাল করে দেখে এসে বলেছে, আপনার নসিবটাই খারাপ। কুনো বাড়িতে ভূতটুত কুছু নাই। সব সাফা কোঠি আছে। আমি তো আর নরেন বক্সি নই যে, ভেজাল ভূত চালিয়ে দেব! আমি হলাম হরি ময়রার প্রপৌত্র। আমাদের বংশে কেউ কখনও দুধে জল বা রসগোল্লায় সুজি মেশায়নি। সেই বংশের ছেলে হয়ে কি আমি ভূতে ভেজাল দিতে পারি?”
সুবুদ্ধি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো মাথা নেড়ে বলল, “তা তো বটেই।”
“তাই বলছিলাম মশাই, ভূত নেই বলে আপনার তো আনন্দই হচ্ছে, কিন্তু আমার তো তা হচ্ছে না। একেই বলে কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।”
সুবুদ্ধি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “যা বলেছেন!”।
নরহরিবাবু কটমট করে সুবুদ্ধির দিকে চেয়ে বললেন, “তা হলে যান, গিয়ে নেই-ভূতের বাড়িতে সুখে থাকুন গে।”
সুবুদ্ধি এতক্ষণ বড় অস্বস্তি বোধ করছিল। ধমক খেয়ে পালিয়ে বাঁচল। সঙ্গে তার ভাগ্নে কার্তিক।
রাস্তায় এসে কার্তিক বলল, “মামা, ভূতের যে এত দাম তা জানতাম না তো!”
“আমিই কি জানতাম? যাক বাবা, বাড়িটায় ভূত নেই এটাই বাঁচোয়া।”
কার্তিকের বয়স বছর পনেরো। বেশ চালাক-চতুর ছেলে। বলল, “ভূত থাকলেই ভাল হত কিন্তু মামা। ভূত দেখার মজাও হত, আবার ভূতনাথবাবুকে বেশি দামে বেচেও দেওয়া যেত।”
সুবুদ্ধি নরহরিবাবুর মতোই কটমট করে কার্তিকের দিকে চেয়ে বলল, “তোরও ঘাড়ে ভূত চাপল নাকি? ওসব কথা উচ্চারণও করতে নেই।”
সুবুদ্ধি মিলিটারিতে চাকরি করত। চাকরি করতে করতে বেশ কিছু টাকা জমে গিয়েছিল হাতে। মিলিটারিতে খাইখরচ লাগে না, পোশাকআশাকও বিশেষ লাগে না, ইউনিফর্ম তো সরকারই দেয়। দিদি ছাড়া তার তিনকুলে কেউ নেই বলে কাউকে টাকাও পাঠাতে হত না। ফলে সুবুদ্ধির হাতে বেশ কিছু টাকা জমে গেল। মিলিটারিতে রিটায়ার করিয়ে দেয় খুব তাড়াতাড়ি। রিটায়ার হয়ে সুবুদ্ধি ভাবল, এবার নির্জনে কোথাও আস্তানা গেড়ে ছোটমতো একটু দোকান করবে আর একা-একা বেশ থাকবে। এই নন্দপুরের খোঁজ মিলিটারিরই একটা লোক দিয়েছিল। বলেছিল, “হুঁগলি জেলায় ওরকম জায়গা আর পাবে না। জলবায়ু যেমন ভাল, তেমনই গাছপালা আছে, নদী আছে। ব্যবসা করতে চাও তো নন্দপুর হচ্ছে সবচেয়ে ভাল জায়গা। বড় গঞ্জ, মেলা লোকজনের যাতায়াত। নন্দপুরের বাজারের খুব নাম।”
তা নন্দপুর জায়গাটা খারাপ লাগেনি সুবুদ্ধির। বাস্তবিকই জায়গাটা চমৎকার। গাঁ বলতে যা বোঝায় তাও নয়। আধা শহর, আধা গ্রাম। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চাইলেও বাধা নেই।
সুবুদ্ধির দিদি বসুমতীর শ্বশুরবাড়িও কাছাকাছিই, বৈঁচিতে। ঘণ্টাটাকের পথ। দিদি নন্দপুরের নাম শুনে বলল, “ওখানে একটা ভাল ইস্কুল আছে শুনেছি। কার্তিকটার তো এখানে লেখাপড়া তেমন ভাল হচ্ছে না। সারাদিন খেলে বেড়ায়। ওকে বরং ওখানেই তোর কাছে নিয়ে রাখ। তোরও একা লাগবে না, আর ওর ওপরেও নজর রাখতে পারবি।”
দিদির পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে। কাজেই কার্তিককে ছেড়ে দিতে জামাইবাবুরও আপত্তি হল না।
কয়েকদিন হল মামা-ভাগ্নে নন্দপুরে এসে বাজারের কাছে। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। বাড়িটাও কেনা হয়ে গেল। এখন একটু মেরামত করে নিলেই হয়। যে-ঘরটায় তারা আছে সেখানেই দোকান করা যাবে। কিসের দোকান তা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। কার্তিকের ইচ্ছে, একটা রেস্টুরেন্ট বা মিষ্টির দোকান
খোলা হোক, সুবুদ্ধির ইচ্ছে মনোহারি বা মুদির দোকান।
নন্দপুরের নামকরা মিস্তিরি হল হরেন মিস্তিরি। একডাকে সবাই চেনে। বড্ড ব্যস্ত মানুষ। তাকে ধরাই মুশকিল। দু’দিন ঘোরাঘুরির পর তিনদিনের দিন বিকেলে বাজারের পেছন দিকে হরেন মিস্তিরির বাড়িতে তাকে পাওয়া গেল। পাকানো চেহারা, মস্ত গোঁফ, মুখোনা থম-ধরা। সব শুনে-টুনে জিজ্ঞেস করল, “কোন বাড়িটা কিনলেন?”
“ওই যে পাঠকপাড়ায় নরহরিবাবুর বাড়ি।”
শুনে ফিচিক করে একটু হাসল হরেন, “কেনা হয়ে গেছে?”
“আজ্ঞে।”
“ভাল, ভাল।”
ভাল, ভাল-টা এমনভাবে বলল যে, মোটেই সেটা ভাল শোনাল না সুবুদ্ধির কানে। বলল, “কেন, কোনও গোলমাল আছে নাকি?”
“থাকুন, বুঝবেন।”
একথাটাও রহস্যে ভরা। সুবুদ্ধি বলল, “একটু খোলসা করেই বলে ফেলুন না। আমি বাইরের মানুষ, সব জেনে রাখা ভাল।”
হরেন একটা শ্বাস ফেলে বলল, “জানবেন, জানবেন, তার জন্য তাড়া কিসের? থাকতেই তো এসেছেন, থাকতে-থাকতেই জানতে পারবেন।”
সুবুদ্ধির মনে একটা খিচ ধরে গেল। হরেন মিস্তিরি কি কোনও গুহ্য কথা জানে? সে বলল, “বাড়িটা একটু পুরনো।”
হরেন গলা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “পুরনো বললে কিছুই বলা হয় না। ওবাড়ি একেবারে ঝুরঝুরে। তা কত নিল?”
“এক লাখ।”
“আপনার অনেক টাকা, না? টাকা চুলকোচ্ছিল বুঝি?” সুবুদ্ধি শুকনো মুখে ঢোক গিলে বলল, “ঠকে গেছি নাকি?”
“এখন আর সেটা জেনে লাভ কী? কিনে তো ফেলেইছেন।”
“যে আজ্ঞে।”
হরেন মিস্তিরি বলল, “ঠিক আছে, কাল আমি লোকজন নিয়ে যাব। তবে বলেই রাখছি মশাই, ওবাড়ি মেরামত করতে বেশ খরচ হবে আপনার।”
সুবুদ্ধি দমে গিয়ে বলল, “তা কত পড়বে?”
“আগে দেখি, তারপর হিসেব।”
নন্দপুরে এসে জায়গাটা দেখে বেশ আনন্দ হয়েছিল সুবুদ্ধির। কিন্তু আনন্দটা এখন ধীরে-ধীরে কমে যাচ্ছে। একটু উদ্বেগ হচ্ছে।
পরদিন হরেন মিস্তিরি বাড়ি মেরামত করতে গেলে একটা বিপত্তি ঘটল। হরেনের এক শাগরেদ পাঁচু কোণের ঘরের ফাটা মেঝেতে একটা আলগা চাঙড় তুলতে যেতেই মেঝে ধসে সে পাঁচ হাত গর্তের মধ্যে পড়ে গেল। হাঁটু ভাঙল, মাজায় চোট।
হরেন মিস্তিরি মাথা নেড়ে বলল, “শুরুতেই এমন অলক্ষুণে কাণ্ড মশাই, আমি এ-বাড়ি মেরামত করতে পারব না। পাঁচুই আমার বল-ভরসা। সে বসে যাওয়াতে আমার ভারী ক্ষতি হল। আর ছোঁড়াটাও বোকা। কতবার শিখিয়ে-পড়িয়ে দিলাম, ওরে ওদিকপানে তাকাসনে, তা হলেই বিপদ। তা ছোঁড়া শুনল সে কথা? ঠিক তাকাল, আর পড়লও বিপদে।”
সুবুদ্ধি শুকনো মুখে বলল, “কোনদিকে তাকানোর কথা বলছেন?”
হরেন নরহরিবাবুর মতোই কটমট করে তাকিয়ে বলল, “সে আমি বলতে পারব না মশাই, নিজেই বুঝবেন।”
হরেন মিস্তিরি দলবল নিয়ে চলে যাওয়ার পর সুবুদ্ধি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, “এখন কী হবে রে কার্তিক?”
কার্তিক বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে বলল, “দেখো মামা, আমি বলি কি, মেরামতের দরকার নেই। একটু ঝটপাট দিয়ে চলো দুটো চৌকি কিনে এনে এমনিই থাকতে শুরু করি। তারপর দুজনে মিলে রংটং করে নেব’খন ধীরেসুস্থে।”
“বলছিস?” “বাড়িখানা আমার দিব্যি পছন্দ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে আজ থেকেই থাকি।”
তা বাড়িটা সুবুদ্ধিরও কিছু খারাপ লাগছে না। পুরনো আমলের ত্রিশ ইঞ্চি মোটা দেওয়াল, পোক্ত গঠন। তিনখানা ঘর, একখানা দরদালান আছে। পেছনে একটু বাগান, তাতে অবশ্য আগাছাই বেশি। সুবুদ্ধি আর কার্তিক বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখল। তিন নম্বর ঘরটা ভেতর দিকে। বেশ বড় ঘর, তারই মেঝেটা এক জায়গায় বসে গেছে।
“ওরে কার্তিক, বাড়ির মেঝে যে ফোঁপরা হয়ে গেছে রে! রাত-বিরেতে আমাদের নিয়ে ধসে পড়বে না তো!”
“না মামা, না। এ-জায়গাটায় বোধ হয় গুপ্তধনটন আছে, তাই ফাঁপা।”
“তোর মাথা। “
সুবুদ্ধি মুখে রাগ দেখালেও মনে-মনে ঠিক করে ফেলল এখানে থাকাই যুক্তিযুক্ত। বাজারে যে-ঘর ভাড়া নিয়েছে সেখানে জায়গা বড় কম, বাথরুমও নেই। এখানে থাকলে সেদিকে সুবিধে।
পরদিন বাজারে গিয়ে তারা দুটো চৌকি কিনে ফেলল। তারপর জিনিসপত্র নিয়ে এসে ঘরদোর সাজিয়ে ফেলল।
কার্তিক হঠাৎ বলল, “আচ্ছা মামা, একটা জিনিস লক্ষ করেছ?”
“কী?”
“এ-পাড়াটা অন্ধদের পাড়া।”
“বলিস কী?”
“একটু আগে সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলুম। দেখলুম সব লোক চোখ বুজে হাতড়ে হাতড়ে হাঁটছে। এমনকী একটা রিকশাওলা পর্যন্ত চোখ বুজে পক-পঁক করে হর্ন দিতে দিতে চলে গেল।”
“ঠিক দেখেছিস?”
“বিশ্বাস না হয় চলো, তুমিও দেখবে।”
বাইরে এসে সুবুদ্ধি দেখল, কথাটা ঠিকই, রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছে কেউ চোখে দেখে না, সবাই সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে পা ঘষটে-ঘষটে হাঁটছে। একটা লোক সাইকেলে করে গেল, তারও চোখ বোজা।
সুবুদ্ধি ফের হতবুদ্ধি হয়ে বলল, “এ কী ব্যাপার রে? এখানে এত অন্ধ মানুষ থাকে নাকি?”
“তাই তো দেখছি।”
“এ তো বড় ভয়ের কথা হল রে কার্তিক। নন্দপুরের এত লোক অন্ধ কেন, তার একটু খোঁজ নিতে হচ্ছে। এখানে নিশ্চয়ই কোনও খারাপ চোখের রোগের প্রকোপ আছে। শেষে যদি আমাদেরও এই দশা হয়?
ঠিক এমন সময় খ্যাঁচ করে একটা হাসির শব্দ হল। সুবুদ্ধি ডান দিকে ফিরে দেখল, পাশের বাড়ির বারান্দায় একটা লোক দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে হাসছে। লোকটার মাথায় টাক, মোটা গোঁফ, রোগা চেহারা। সুবুদ্ধির চোখে চোখ পড়তেই বলল, “ভায়া কি নতুন এলে নাকি?”
“যে আজ্ঞে।”
“নতুন লোক দেখলেই বোঝা যায়, এখনও নন্দপুরের ঘাঁতঘোঁত বুঝে উঠতে পারোনি না?”
“আজ্ঞে না!”
“বাড়িটা কিনলে বুঝি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আচ্ছা মশাই, এখানে কি খুব চোখের রোগ হয়?”
লোকটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “চোখের রোগ? না তো?”
“তা হলে এত অন্ধ কোথা থেকে এল?”
লোকটা ফের খ্যাঁচ করে হাসল, “অন্ধ কে বলল? ওরা তো সব চোখ বুজে হাঁটছে।”
“চোখ বুজে হাঁটছে! কেন মশাই, চোখ বুজে হাঁটছে কেন?”
“বাঃ, আমি দাঁড়িয়ে আছি না?”
সুবুদ্ধির বুদ্ধি গুলিয়ে গেল, সে বলল, “আপনি দাঁড়িয়ে আছেন তো কী!”
“নন্দপুরে নতুন এসেছ, বুঝতে একটু সময় লাগবে।” বলেই লোকটা ফের খ্যাঁচ করে হাসল। হাসিটা মোটেই ভাল ঠেকল না সুবুদ্ধির কাছে। সে কার্তিকের দিকে চেয়ে বলল, “কিছু বুঝছিস?”
“না মামা।”
“আমিও না।”
তার ঘণ্টাখানেক পরেই পুরোটা না হলেও খানিকটা বুঝল সুবুদ্ধি। বাজারে আজ তার পকেটমার হল। আর ষাঁড় তাড়া করায় পড়ে গিয়ে হাঁটুতে বেশ চোট হল। আর মামা-ভাগ্নে মিলে খাবে বলে যে দুটো মাগুর মাছ কিনেছিল তা চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কার্তিকেরও বড় কম হল না। সুবুদ্ধি বাজারে যাওয়ার পর সে ঝুল-ঝাড়নি দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করতে গিয়ে বে-খেয়ালে একটি বোলতার বাসায় খোঁচা মারতেই গোটা চার-পাঁচ বোলতা রেগেমেগে এসে তার কপালে আর গালে হুল দিয়ে গেল। একটা কুকুর এসে নিয়ে গেল একপাটি চটি। আর কুকুরটাকে তাড়া করতে গিয়ে রাস্তায় একটা চোখ-বোজা লোকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চিতপটাং হতে হল।
হয়রান আর ক্লান্ত হয়ে সুবুদ্ধি যখন বাজার থেকে ফিরল তখন কার্তিক বিরস মুখে বারান্দায় বসে আছে। ভাগ্নেকে দেখে সুবুদ্ধি বলে উঠল, “আর বলিসনি, ষাঁড়ে এমন তাড়া করেছিল…”
“রাখো তোমার ষাঁড়, বোলতার হুল তো খাওনি…”
“বোলতা কোথায় লাগে! কড়কড়ে পাঁচশো বাইশ টাকা চলে গেল পকেট থেকে…”
“আর আমার চটি? তার কথা কে বলবে?”
“দু-দুটো মাগুর মাছ চিলে নিয়ে গেল হাত থেকে জানিস?”
“আর আমার যে মাথায় চোট!”
মামা-ভাগ্নে বারান্দায় পাশাপাশি বসে যখন এসব কথা বলছিল তখন আবার সেই খ্যাঁচ করে হাসির শব্দ! পাশের বাড়ির বারান্দায় সেই গুঁফো, টেকো, রোগা লোকটা দাঁড়িয়ে বড় বড় দাঁত বের করে হাসছে। বলল, “কী ভায়া, বড্ড যে বেজার দেখছি! বলি হলটা কী?”
সুবুদ্ধি মলিন মুখ করে বলল, “বড় বিপদ যাচ্ছে দাদা।”
লোকটা ভারী আহ্বাদের হাসি হেসে বলল, “যাচ্ছে? বাঃ বাঃ! এবার তা হলে দেখলে তো!”
“কী দেখব?”
“কিছু বুঝতে পারোনি?”
“আজ্ঞে না।”
“হেঃ হেঃ, তা হলে তো তোমাকে বেশ বোকাসোকাই বলতে হয়। জলের মতো সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না?”
সুবুদ্ধি মাথা চুলকে বলল, “ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে মাথাটা ভোঁ হয়ে গেছে। বুদ্ধিটা কাজ করছে না।”
“আরে বাবা, সাধে কি আমার এত নামডাক? শুধু এ-তল্লাট নয়, গোটা পরগনা ঘুরে দেখে এসো, এ শর্মাকে সবাই একডাকে চেনে কি না!”
সুবুদ্ধি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তা হলে আপনি একজন কেউকেটা লোকই হবেন বোধ হয়?”
“তা বলতে পারো। আজকাল দু পয়সা বেশ রোজগারও হচ্ছে আমার। রোজ বড় পোনা মাছ রান্না হয় আমার বাড়িতে, ভাতের পাতে ঘি না হলে আমার চলেই না, রাতে মাংস আর ক্ষীর একেবারে বাঁধা। তা কী করে এসব হয়, তা জানো?”
সুবুদ্ধি মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে না।”
“শুনতে চাও?”
“যে আজ্ঞে।” সুবুদ্ধি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল।
লোকটা মুচকি হেসে বলল, “আমি হচ্ছি বিখ্যাত অপয়া গোবিন্দ বিশ্বাস। সকালের দিকে আমার মুখোনা দেখেছ কি সর্বনাশ! ধরো বাজারে বেরোবার মুখে আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ব্যস, আর দেখতে হবে না। সেদিন হয় তোমার পকেটমার হবে, নয়তো পচা মাছ বা কানা বেগুন গছিয়ে দেবে ব্যাপারিরা, নয়তো ষাঁড়ে গুঁতিয়ে দেবে।”
সুবুদ্ধি চোখ গোল-গোল করে বলল, “আজ্ঞে, তাই তো হয়েছে।”
কার্তিক বলল, “আর আমার কিছু কম হয়েছে?”
গোবিন্দ বিশ্বাস বেশ অহঙ্কারের সঙ্গে বলল, “আরে ও তো কিছু নয়, ধরো আজ তোমার একটা গুরুতর মামলার রায় বেরোবে, মামলাটার ধরো, তোমার দিকেই পাল্লা ভারী, জিতবেই কি জিতবে। বেরোবার মুখে আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ব্যস, মামলার রায় ঘুরে যাবেই কি যাবে।”
সুবুদ্ধি আতঙ্কিত হয়ে বলল, “বটে?”
“গ্যারান্টি দিই ভায়া। আর সেইজন্যই তো আজকাল আমাকে হায়ার করতে মেলা দূর-দূর থেকেও লোক আসে। মোটা ফি দিয়ে নিয়ে যায়।”
সুবুদ্ধি ক্যাবলাকান্তের মতো বলল, “হায়ার করে কেন?”
“করবে না? ধরো তোমার কাউকে জব্দ করা দরকার। আমার কাছে এসে টাকা ফেলে তোমার শত্রুর নাম-ঠিকানা দিয়ে যাও। পরদিন সকালে ঠিক আমি তার বাড়ির সামনে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকব। যেই বেরোবে অমনই তার সামনে গিয়ে হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে যাব। আজ অবধি একটাও ফেলিওর নেই। ফিও বাড়িয়ে দিয়েছি। ছোটখাট কাজও আজকাল হাতে নিই না। এই তো রামবাবুর সঙ্গে অবিনাশবাবুর খুব মনকষাকষি। রামবাবুর ছেলে অবনী প্রতি বছর পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। অবিনাশবাবু সেবার অবনীর পরীক্ষার ফল বেরোবার আগের দিন এসে আমাকে হায়ার করার জন্য ঝুলোঝুলি, যেন পরদিন সকালে অবনীকে একটু দেখা দিয়ে আসি। তা আমি রাজি হইনি। বড় ছোট কাজ। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে আছে? অবিনাশ তখন হাতে দু হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এ কাজটা না করলে আমি আত্মহত্যা করব।’ তা কী আর করা। গেলুম। অবনী ইস্কুলে যাওয়ার মুখে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললুম, ‘কী, রেজাল্ট জানতে যাচ্ছ? ভাল, ভাল’।“
সুবুদ্ধি চোখ গোল করে বলল, “তারপর কী হল?”
“বললে বিশ্বাস হবে না ভায়া, যে ছেলে অঙ্কে একশোতে একশো ছাড়া পায় না, সেই ছেলে অঙ্কে পেল আট, ইংরেজিতে একুশ, ভূগোলে এগারো, আর বাংলায় পঁচিশ।”
“বলেন কী?”
“কী বলব ভায়া, নিজের এলেম দেখে আমি নিজেই তাজ্জব!”
“আপনি তো দাদা, সাঙ্ঘাতিক লোক!”
গোবিন্দ বিশ্বাস হঠাৎ মুখোনা গম্ভীর করে বলল, “সাঙ্ঘাতিক বটে, তবে আমার জীবনটা ভারী দুঃখের। সেই ছেলেবেলা থেকে সবাই অপয়া-অপয়া বলে পেছনে লাগত, কেউ মিশতে চাইত না! আমার কোনও বন্ধুও ছিল না। তারপর বড় হলাম, চুঁচুড়ো আদালতে চাকরিও পেলুম, কিন্তু কপালের দোষে সবাই টের পেয়ে গেল যে আমি অপয়া। লোকে ঘেন্নাটেন্নাও করত। তারপর ধীরে ধীরে অপয়ার কদর হতে লাগল। পয়সাকড়ি পেতে শুরু করলুম। তারপর চাকরি ছেড়ে এখন দিব্যি আছি। মুখ দেখালেই পয়সা।”
সুবুদ্ধি অবাক হয়ে বলে, “যত শুনছি তত অবাক হচ্ছি। এরকমও হয় নাকি?”
“হয় না? এই তো আজই সকালে আমার মুখ দেখে তোমার কেমন হেনস্থাটা হল বলো। বেশি কথা কী। বর্ধমান কর্ড লাইনে বেলমুড়ি বলে একটা স্টেশন আছে। নামটা নিয়েছ কি বিপত্তি একটা হবেই। ও-লাইনের লোকেরা নামটা উচ্চারণও করে না। বলে মাঝের গ্রাম। এমনকী হাওড়ার টিকিটবাবুরা অবধি।”
“আজ্ঞে, আমি এদিককার লোক নই, তাই ও-জায়গার নাম শুনিনি। তবে আপনার ওপর ভারী শ্রদ্ধা হচ্ছে।”
“হতেই হবে। সারা পরগনার লোক আমাকে ভয় খায়। এই যে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যারা যায় তারা চোখ বুজে যায় কেন এবার বুঝলে তো?”
“আজ্ঞে খুব বুঝেছি, জলের মতো পরিষ্কার।”
“তবে কী জানেনা ভায়া, আমার এলেম বেলা বারোটা অবধি। তারপর আর আমার অপয়া ভাবটা থাকে না। আবার ভোর থেকে শুরু হয়। তামাম দিন অপয়া ভাবটা থাকলে আরও মেলা রোজগার করতে পারতুম।”
সুবুদ্ধি খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, “আপনার ওপর ভারী ভক্তি হচ্ছে আমার।”
“হবে না? হওয়ারই কথা কিনা, ভক্তি বলো, ভয় বলো, যা হোক একটা কিছু হলেই হল। মোদ্দা কথা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা চলবে না। সকালবেলাটায় এই বারান্দায় এসে কেন দাঁড়িয়ে থাকি জানো? এটা হল আমার নেট প্র্যাকটিস। লোকেরা আমাকে ঠিকমতো মান্যগণ্য করছে কিনা, যথেষ্ট খাতির দেখাচ্ছে কিনা তা লক্ষ করা। তবে আজকাল অনেকেই এ রাস্তা ছেড়ে খালধার বা বটতলা দিয়ে ঘুরে বাজারে যায়। দিনদিন এ রাস্তায় লোক-চলাচল কমে আসছে। তা সেটাও ভাল লক্ষণ। আমার নামডাক আরও বাড়ছে, কী বলো?”
সুবুদ্ধি খুবই গদগদ হয়ে বলল, “তা তো বটেই!”
লোকটা খ্যাঁচ করে হেসে বলল, “দরকার হলে বোলো ভায়া, তুমি আমার কাছের লোক, কম পয়সায় কাজ উদ্ধার করে দেব। বেলা বারোটা বাজে, আমার চান-খাওয়ার সময় হল। আজ আবার ইলিশ মাছ হয়েছে কিনা। গলদা চিংড়িও আছে। যাই তা হলে?”
“আজ্ঞে আসুন। আলাপ করে বড় ভাল লাগল।”
গোবিন্দ বিশ্বাস ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার পর কার্তিক বলল, “এ তো সাঙ্ঘাতিক লোক মামা! এর পাশে থাকা কি ঠিক হবে? তুমি বাড়ি বেচে দাও।”
সুবুদ্ধি করুণ মুখে বলল, “আমি আহাম্মক বলে কিনেছি। যারা জানে তারা এ বাড়ি কি কস্মিনকালেও কিনবে?”
“তা হলে কী হবে?”
“সকালের দিকটায় সাবধান থাকতে হবে। ওরে, সব জিনিসেরই ভাল আর মন্দ দুটো দিক আছে। মাছের যেমন কাঁটা বেছে খেতে হয়, এও তেমনই। গোবিন্দ বিশ্বাসের মুখোনা বেলা বারোটার আগে না দেখলেই হল।”
“সকালবেলায় আমাকে ইস্কুলে যেতে হবে। তোমাকেও বাজারহাট করতে হবে।”
“আমরাও চোখ বুজে বেরোব।”
“পারব?”
“অভ্যাস করলে সব পারা যায়।”
কার্তিক হঠাৎ বলল, “আচ্ছা মামা, পুরনো বাড়িতে তো অনেক। সময় গুপ্তধন থাকে, তাই না?”
“তা থাকে হয়তো।”
“এ-বাড়িতেও যদি থাকে?”
“দুর পাগলা।” বলে সুবুদ্ধি খুব হাসল।