হরপ্পার শিলালিপি – একেনবাবু গোয়েন্দা কাহিনী – সুজন দাসগুপ্ত
৷৷ ১ ৷৷
গোয়েন্দা হিসেবে একেনবাবুর দেশে যতটা পরিচিতি থাকা উচিত নিঃসন্দেহে তা নেই। প্রমথ কয়েক বছর আগে কলকাতা গিয়ে একটা র্যান্ডাম স্যামপ্লিং করেছিল। পঞ্চাশ জনকে প্রশ্ন করেছিল, তাদের একজনও একেনবাবুকে চিনতে পারেননি। আগেই বলে রাখি প্রমথর উদ্যোগী হয়ে এই স্যাম্পেল সার্ভে করার উদ্দেশ্য একেনবাবুর পপুলারিটি বিচার নয়। একেনবাবু নিজে প্রচারবিমুখ। একেনবাবুর কীর্তিকলাপ আমিই এক আধ সময়ে পত্রপত্রিকায় লিখেছি। প্রমথর এই উদ্যোগ লেখক হিসেবে আমি কতটা অক্ষম সেটা প্রমাণ করা।
এরপর একেনবাবু সম্পর্কে আমি আর কিছু লিখব না বলে ঠিক করেছিলাম, কিন্তু আবার কলম ধরলাম ভৈরব মিত্রের তাগাদায়। ভৈরববাবু কুইন্সে থাকেন। ম্যানহাটানের ‘রাজা-অ্যাণ্ড-রাণী’ রেস্টুরেন্টের মালিক। যখনই ওঁর সঙ্গে দেখা হয় জিজ্ঞেস করেন, “কী মশাই, একেনবাবুর লেখাটা কদ্দূর এগোল?”
আমার লেখা নিয়ে ভৈরব মিত্রের এই আগ্রহটা অবশ্য একেবারে নিঃস্বার্থ নয়। ওঁর রেস্টুরেন্ট থেকে বেশ কিছুদিন ধরে কাপ-ডিশ, কাঁটা-চামচ এইসব চুরি হচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল রেস্টুরেন্টেরই কেউ এর মধ্যে জড়িত। একেনবাবু ওখানে এক-আধবার খেয়েছেন। ভৈরব মিত্র এসে ধরলেন একেনবাবুকে। দুদিনের মধ্যে বামাল-সমেত চোর গ্রেফতার। ভৈরব মিত্রের খুব ইচ্ছে সেই সম্পর্কে আমি লিখি। ওঁর রেস্টুরেন্টের তাতে একটা পাবলিসিটি হবে। প্রমথর র্যান্ডাম স্যামপ্লিং-এর খবরটা নিশ্চয়ই জানতেন না। সে কথা থাক, ভৈরব মিত্রের ছিঁচকে চুরির গল্প লেখার জন্য আমি কলম ধরিনি। আমার লেখা কেউ পড়ুক না পড়ুক, একেনবাবুর কীর্তিকে আমি কোনোমতেই খাটো করতে চাই না। লিখছি অন্য একটা কাহিনি… গোড়া থেকেই শুরু করি।
.
আমি, একেনবাবু আর প্রমথ ধীরে সুস্থে আয়েস করে শনিবার সকালে ব্রেকফাস্ট শেষ করেছি। কলেজ নেই, তাই কোনো তাড়াও নেই। এমন সময় ডোর বেল। দরজা খুলে দেখি এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে, হাতে একটা হলুদ রঙের খাম। ভদ্রলোক একেনবাবুকে খুঁজছেন। আমি আঙুল দিয়ে একেনবাবুকে দেখিয়ে দিতেই ভদ্রলোক কেমন জানি নিষ্প্রভ হয়ে গেলেন। একেনবাবুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে এরকম রিয়্যাকশন অল্প বিস্তর সবারই হয়। ওঁর পোশাক বা চেহারা কোনোটাই ইম্প্রেসিভ নয়। যাঁরা প্রথম দর্শনের এই ধাক্কা সামলাতে পারেন, আখেরে অবশ্য তাঁরাই লাভবান হন। দ্য নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এর প্রফেসর জন গেরহার্ট যে সেই দলেই পড়বেন বুঝলাম। ভেতরে ভেতরে দমে গিয়ে থাকলেও বাইরে তা মোটেই প্রকাশ পেল না। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “অসময়ে এসে পড়েছি। ফোন নম্বরটা ছিল না, তাই ফোন করতে পারিনি…”
বলতে বলতেই ওঁর নজরে পড়ল ব্রেকফাস্টের কাপডিশগুলো তখনও টেবিলে।
“আপনাদের বোধহয় ব্রেকফাস্ট শেষ হয়নি।”
“কী যে বলেন স্যার, আসার আবার সময় অসময় কি। তাছাড়া খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।”
ভদ্রলোক আমার আর প্রমথর দিকে তাকালেন বোধহয় কনফার্মেশনের জন্য।
আমি কাপ-ডিশগুলো সরাতে সরাতে বললাম, “হ্যাঁ, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা গল্প করছিলাম। আপনি প্লিজ বসুন।”
“থ্যাঙ্ক ইউ” বলে অধ্যাপক চেয়ারে বসলেন।
আমাদের দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে একেনবাবু সবাইকে যা বলেন সেটাই আওড়ালেন। “আপনার যা বলার স্যার, এঁদের সামনে স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আমরা এক টিমে।”
দুয়েকটা মামুলি কথাবার্তার পর প্রফেসর বললেন, “আসলে কাহিনিটা একটু দীর্ঘ।”
“তাতে কী হয়েছে। বলুন স্যার, আমরা তো বসেই আছি।”
“বেশ, বলছি,” প্রফেসর শুরু করলেন। “কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন স্কোয়ার পার্কে আপনাদের দেশের এক মহিলা দীপা রয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পার্কে যখন হাঁটতাম, দীপাকে দেখতাম একা একা বেঞ্চে বসে আছেন। একদিন নিজেই গিয়ে আলাপ করলাম। আলাপ হয়ে যাবার পর থেকে হাঁটার আগে কিছুক্ষণ ওঁর পাশে গিয়ে বসতাম। সেই ‘কিছুক্ষণ’টা বাড়তে লাগল। একটু একটু করে ওঁর ব্যক্তিগত অনেক কথাই জেনে গেলাম।”
এরপর যা বললেন সেটা সত্যিই দীর্ঘ কাহিনি, সংক্ষেপে লিখছি…
দীপার স্বামী দেবেশ রয় ইণ্ডিয়ান আর্কিওলজিকাল সার্ভেতে কাজ করতেন। রিটায়ার করার কিছুদিন আগে একটা ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকা এসেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ হরপ্পায় গিয়ে রিসার্চ করার একটা সুযোগ এসে যায় বলে ফেলোশিপ শেষ না করেই দেশে ফিরে যান। দেশে কয়েকদিন থেকেই হরপ্পা। হরপ্পা যাবার পর দেবেশের কাছ থেকে শুধু কয়েকটা চিঠি আর একটা ফোন এসেছিল। হরপ্পা-ক্যাম্পসাইটে ফোন না থাকায় চিঠি ছাড়া যোগাযোগ করারও কোনো উপায় ছিল না। বেশ ক’দিন চিঠি আসছে না। হঠাৎ পুলিশ এসে জানাল দেবেশ একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ওঁর ডেডবডি ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। এর থেকে বেশি স্থানীয় পুলিশ জানে না। দীপা নানান জায়গায় চেষ্টা করে শেষে ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনের অফিস থেকে জানতে পারেন যে ক্যাম্পের সিকিউরিটির সঙ্গে ডাকাতের গুলি চালাচালির সময়ে দেবেশের মৃত্যু ঘটেছে। ওঁর জিনিসপত্র লুঠ হয়ে গেছে। পাকিস্তান পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই ধরা পড়েনি।
এটা প্রায় চার বছর আগের ঘটনা। মাস ছয়েক আগে আরিফ নামে একটি লোক বাড়িতে আসে। সে নাকি হরপ্পায় দেবেশের দেখাশোনা করত! আরিফের কাছ থেকে দীপাদেবী জানতে পারেন, কোনো জরুরি কাজে দেবেশ ওঁর স্যুটকেস নিয়ে স্টেশনে যাচ্ছিলেন, আরিফও সঙ্গে ছিল। দেবেশ গাড়িতে ওঠার সময়ে কেউ ওকে গুলি করে। ড্রাইভার ভয় পেয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়। আরিফ গাড়িতে উঠে পড়েছিল বলে নামতে পারেনি। যাইহোক, আরিফ যখন স্যুটকেস নিয়ে ক্যাম্পসাইটে ফিরে আসছে তখন শোনে দেবেশ মারা গেছেন, পুলিশ আরিফকে খুঁজছে। সেই শুনে আরিফ পালিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে লুকিয়ে থাকে। দেবেশের দিল্লীর ঠিকানা আরিফ জানত না। কিছুদিন আগে কারোর কাছ থেকে পায়। কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলায় আগে আসতে পারেনি। তারপর লোকটি দীপাকে বলে –দেবেশসাব ওকে অনেক সাহায্য করেছেন, সুটকেসটা মেমসাবের কাছে পৌঁছে না দিলে ওর গুণাহ হবে।
স্ট্রেঞ্জ স্টোরি। যাইহোক, সুটকেসটা দেবেশরই। জামাকাপড় আর টুকিটাকি জিনিস ছাড়া আরও দুটি জিনিস সেখানে ছিল, একটা নোটবই আর চিত্রবিচিত্র খোদাই করা চ্যাপ্টা মতো একটা পাথরের টুকরো। নোটবই নানান স্কেচে ভর্তি। এক জায়গায় লেখা, ‘ফাইনালি দ্য মিস্ট্রি উইল বি সলভড়। কিসের মিস্ট্রি তার উল্লেখ অবশ্য নেই। এত বছর বাদে হঠাৎ স্বামীর জিনিসগুলো দেখে দীপা ন্যাচেরালি খুবই আপসেট হয়ে যান। এদেশে ওঁর ছেলেকে ফোন করেন। মায়ের মানসিক অবস্থা বুঝে সেই উদ্যোগ করে মা-কে এখানে নিয়ে আসে।
পাথরটার ব্যাপারে প্রফেসর গেরহার্টের যদিও ঔৎসুক্য ছিল, কিন্তু প্রসঙ্গটা এত ডেলিকেট ওঁদের মধ্যে এ নিয়ে তখন আর কোনো কথা হয় না। কয়েকদিন বাদে দীপা নিজেই প্রফেসরকে জানান উনি স্বামীর স্যুটকেসে পাওয়া পাথরটাকে নিয়ে এসেছেন। শোনামাত্র প্রফেসর বলেন দীপার উচিত কোনো মিউজিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করা। দীপা কাউকেই এদেশে চেনেন না। ওঁর ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তার এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহই নেই। তখন প্রফেসর গেরহার্ট নিজেই উদ্যোগী হয়ে মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট-এ ওঁর এক পুরোনো বন্ধুকে ফোন করেন। বন্ধুটি নিজে এককালে সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। এছাড়া প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসরকে চেনেন যাঁর হরপ্পার ব্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে। বন্ধু পাথরটা দেখতে চাওয়ায় দীপা ওঁদের দু’জনকে বাড়িতে আসতে বলেন। পরের দিন দীপার বাড়িতে গিয়ে ওঁরা দেখেন একটা চৌকো চ্যাপটা পাথর। লম্বায় বড়োজোর আট ইঞ্চি, চওড়া হবে ইঞ্চি চারেক। পাথরটার দু’দিকেই অনেক চিহ খোদাই করা। আঁকিবুকিগুলো দু’রকমের দেখে বন্ধুর মনে হল এটা ‘রোসেটা স্টোন’-এর মতো কিছু হতে পারে। কয়েকটা ছবিও তুললেন, পরে ভালো করে স্টাডি করবেন বলে।
এখানে বলে রাখি ‘রোসেটা স্টোন’ জিনিসটা কী আমার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু প্রফেসর গেরহার্ট এমনভাবে কথাটা বললেন যেন আমাদের সবার সেটা জানা উচিত। আমি আর প্রমথ চুপ করে ছিলাম, একেনবাবু বললেন, “আমি স্যার কনফিউজড়, রোসেটা স্টোন…?”
“না, না, ঠিক রোসেটা স্টোন নয়, আমি বলতে চাইছিলাম বাই-টেক্সট স্টোন।”
এই প্রাঞ্জল ব্যাখ্যাটাও আমার মাথায় ঢুকল না। প্রমথও চুপ। শুধু একেনবাবু বললেন, “তাও বুঝলাম না স্যার।”
প্রফেসর গেরহার্ট তখন ব্যাপারটা বিশদ করলেন। মিশরের লিপির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছিল রোসেটা স্টোন পাবার পর। কারণ পাথরের ওই টুকরোর উপরে মিশরীয় ও গ্রীক ভাষায় একই কথা তিনটি বিভিন্ন লিপি –হাইরোগ্লিফিক, ডেমোনিক ও প্রাচীন গ্রীক ব্যবহার করে লেখা ছিল। যেহেতু গ্রীক লিপিটা পন্ডিতদের জানা ছিল, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মিশরের লিপির পাঠোদ্ধারও সম্ভব হয়। দীপাদেবীর পাথরটা দেখে ওঁর বন্ধুর মনে হয়েছিল একদিকের আঁকিবুকিগুলো সিন্ধুলিপির মতো, অন্যদিকটা মোটেই সেরকম নয়। সুতরাং এটা সম্ভবত বাই-টেক্সট অর্থাৎ দু’রকমের লিপি-যুক্ত পাথর। অন্য লিপিটা জানা থাকলে, সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হতে পারে।
এইবার বুঝলাম। সেইজন্যই মনে হয় দেবেশবাবু নোটবইয়ে লিখেছিলেন, ফাইন্যালি দ্য মিস্ট্রি উইল বি সলভড়। সেকথা থাক, আগে প্রফেসরের কাহিনিটা শেষ করা যাক —
কয়েকদিন আগে প্রফেসর গেরহার্টের বন্ধু ফোন করে জানান তিনি প্রিন্সটনে খোঁজ নিয়েছেন। হরপ্পার সবচেয়ে বড়ো অথরিটি রবার্ট উড বছর পাঁচেক হল রিটায়ার্ড। রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে বছর দেড়েক আগেও ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এখন আর নন। ফোনে যোগাযোগ করার উপায় নেই, পুরোনো নম্বরটা ডিসকানেক্টেড। রবার্ট উডের ঠিকানা অবশ্য পেয়েছেন, নিউজার্সি আর পেনসিলভ্যানিয়ার বর্ডারে ছোট্ট পাহাড়ি শহর পোকোনোর একটা ঠিকানা। তবে যেটা মোস্ট এক্সাইটিং নিউজ, সেটা হল মেট্রোপলিটান মিউসিয়াম অফ আর্ট পাথরটা কিনতে খুবই ইন্টারেস্টেড। এক্সপার্টদের দিয়ে আসল নকল বিচার করার পর এ নিয়ে ফাইনাল কথা হবে। প্রফেসর উডের ঠিকানা আর মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম আর্ট-এর কনট্যাক্ট পার্সনের নাম আর ফোন নম্বর সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিলেন প্রফেসর গেরহার্ট। পরের দিন দীপার সঙ্গে দেখা হতেই সেগুলো দীপাকে দিলেন। দীপা কিন্তু পাথর বিক্রির ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখালেন না। সোজাসুজি
বললেন স্বামীর স্মৃতিচিহ হিসেবে ওটা উনি কাছে রাখতে চান।
এর মধ্যে তিন দিনের জন্য প্রফেসর গেরহার্টকে বাইরে যেতে হল। ফিরে এসে পার্কে কয়েকদিন দীপাকে দেখতে না পেয়ে বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলেন। গিয়ে দেখেন দীপা শারীরিক ও মানসিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত। শুনলেন ওঁর সেই পাথর কেউ চুরি করেছে।
প্রফেসর গেরহার্ট স্তম্ভিত। জিজ্ঞেস করলেন, “কারা ওই পাথরের কথা জানত?”
দীপার উত্তর, শুভ, প্রফেসর গেরহার্ট আর গেরহার্টের বন্ধু ছাড়া আর কেউই না।
প্রফেসর গেরহার্ট জানতে চাইলেন, দীপা পুলিশে খবর দিয়েছেন কিনা।
দেননি।
দীপাদেবীর ছেলে শুভ সেখানে ছিল। তার ধারণা কোনো বড়ো চক্র নিশ্চয় এর পেছনে কাজ করছে। কারণ দেশেও একবার ওটাকে চুরি করার চেষ্টা হয়েছিল।
এই খবরটা অবশ্য গেরহার্ট সাহেব আগে জানতেন না। কিন্তু দীপা বললেন কথাটা সত্যি ।
শুভ বারবার বলছিল, পাথরটা নিশ্চয় খুব মূল্যবান। যদিও সোজাসুজি কিছু বলেনি, কিন্তু মনে হল শুভ বিরক্ত যে অধ্যাপক গেরহার্ট পাথরটার কথা বাইরে প্রচার করেছেন।
দীপা সেটা আঁচ করলেন। প্রফেসরের অস্বস্তি এড়ানোর জন্যই বোধহয় শুভকে বললেন, ‘চুপ কর শুভ, যা গেছে তা গেছে। এখন সব কিছু ভুলে যাওয়াই আমার উচিত।’
প্রফেসর গেরহার্ট ওঁর কাহিনি শেষ করে বললেন, “দেখুন, দীপা কেন পুলিশকে রিপোর্ট করেননি জানি না। কিন্তু আমি এই চুরির মধ্যে জড়িয়ে গেছি। যেহেতু আমিই পাথরটার কথা প্রথম জেনেছি আর আমার জন্য আর কয়েকজন জেনেছেন। বুঝতে পারছেন কি বলছি?”
“বোধহয় পারছি স্যার,” একেনবাবু মাথা চুলকে বললেন। আপনি হয়তো ভাবছেন দীপাদেবী আপনাকে সন্দেহ করেন আর সেই কারণেই থানা-পুলিশ করছেন না।”
“হয়তো। কিন্তু উনি হলেন খাঁটি ভদ্রমহিলা। সন্দেহ করলেও সেটা জানতে পারব না। যাইহোক ব্যাপারটা নিয়ে অত্যন্ত ডিসট্রেসড হয়ে আছি। কালকে মেট্রোপলিটাম মিউজিয়াম অফ আর্ট-এর সেই বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। ওই বলল নিউ ইয়র্ক পুলিশের ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট নাকি আপনার গুণমুগ্ধ। আপনার এই বাড়িটা ও চিনত। কিন্তু ফোন নম্বর জানত না। মিস্টার সেন, ওটা প্লিজ খুঁজে দিন, একটা বিরাট বোঝা বুক থেকে নেমে যাবে।”
একেনবাবু বললেন, “তা তো বুঝতে পারছি স্যার, কিন্তু ম্যাডাম যদি ইন্টারেস্টেড না হন।”
প্রফেসরের মুখে একটা বিস্ময় লক্ষ্য করে আমি বললাম, “উনি দীপা রয়ের কথা বলছেন।”
“না, না, দীপা পুলিশের কাছে যেতে চান না, কিন্তু আপনি এ নিয়ে খোঁজখবর করলে ওঁর কোনো আপত্তি নেই। আমি সকালে ওঁর সঙ্গে কথা বলেই আপনার কাছে এসেছি।” তারপর একটু চুপ করে বললেন, “দেখুন আমি মাস্টারি করি, বড়োলোক নই। আপনার ফি আমি যতটা সম্ভব মেটাবার চেষ্টা করব। কিন্তু আমার সামর্থ অল্প।”
“ছি ছি স্যার, টাকাকড়ি নিয়ে ভাবছেন কেন। আমাদের দেশের লেডি বিপদে পড়েছেন, এটা তো আমাদের কর্তব্য স্যার। ভালোকথা, আপনার কাছে পাথরটার কোনো ছবি আছে কি?”
“আছে। আমার বন্ধু যে ছবিগুলো তুলেছিল তার একটা করে কপি।” হাতে ধরা হলুদ খামটা খুলে প্রফেসর কয়েকটা ছবি বার করলেন। সেইসঙ্গে একটা কাগজ যেখানে নিজের, ওঁর মিউজিয়ামের বন্ধু, প্রিন্সটনের রিটায়ারড প্রফেসর উড, দীপাদেবীর বাড়ির ঠিকানা –সবকিছুই গুছিয়ে লেখা রয়েছে। “আর এইটাও আপনি রাখুন বলে এক হাজারের ডলারের একটা চেক একেনবাবুর হাতে দিলেন। কিছু খরচাপাতি তো হবে আপনার।”
“এটা না দিলেই চলত স্যার।”
“আমার চলত না, ওটা দয়া করে রাখুন। আরেকটা কথা, দীপা জানেন যে আপনি এ ব্যাপারে খোঁজখবর করবেন। কিন্তু উনি নিজে এর মধ্যে জড়াতে চান না। স্বভাবতই একটু ভয় পাচ্ছেন। তাই আমার অনুরোধ যতটা সম্ভব দূরত্ব বাঁচিয়ে কাজটা আপনি করবেন।”
“তা করব, কিন্তু একবার ওঁর সঙ্গে আমার কথা বলা প্রয়োজন। এখানে আসতে পারলে ভালো হয়। অবশ্য আমরাও যেতে পারি ওঁর কাছে।”
“ঠিক আছে, আজ বিকেলে উনি পার্কে এলে ওঁকে বলব এখানে আমার সঙ্গে একবার আসতে। মনে হয় না ওঁর আপত্তি হবে বলে।”
“শুধু আরেকটা প্রশ্ন স্যার, কাদের সঙ্গে ওঁর স্বামী হরপ্পায় গিয়েছিলেন?”
“সেই প্রশ্নটা আমি প্রথমেই করেছিলাম। কিন্তু উনি স্বামীর কাজকর্মের খবর একেবারেই রাখতেন না। শুধু জানতেন মাস তিনেকের প্রজেক্ট, কিন্তু দু’মাস যেতে না যেতেই সব শেষ।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”