একেই বলে লোনলিনেস। বুঝলে! অ্যাবসোলিউট লোনলিনেস!
একা থাকতে আপনার ভাল লাগে কি?
কখনও লাগে। কখনও লাগে না। এনিওয়ে, আই হ্যাভ টু বিয়ার ইট।
কেন, আপনার তো সবাই আছে?
আছে নাকি?
স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, এমনকী মা অবধি।
সেটা আছে। তবু কেউ নেই।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।
বুঝবার দরকারই বা কী? একজনের ব্যক্তিগত প্রবলেম অন্যে সবসময়ে বুঝতে পারেও না।
প্রবলেমটা কি সর্ট আউট করা যায় না?
যায়। পৃথিবীর সব প্রবলেমেরই সলিউশন আছে হয়তো।
তা হলে?
সলিউশনটা খুঁজে পেলে প্রবলেমটা মিটে যাবে।
মনে হচ্ছে, সলিউশনটা আপনি জানেন।
না, জানলে নির্বাসন নিয়েছি কেন?
এখানে কীভাবে সময় কাটে আপনার? বোরড হন না?
বোরডমও আছে, তবে সকালবেলাটা চমৎকার।
তখন বোর লাগে না বুঝি?
না। সকালে বেড়াতে যাই। ফাঁকা জায়গা। বেড়ানোর পক্ষে চমৎকার।
তারপর?
ফিরে এসে ছবি আঁকি। তখন জ্ঞান থাকে না।
রোজ?
রোজ। ছবিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আগে বছরে আট-দশটা আঁকতেন। এখনও তাই?
না। এখন সংখ্যাটা অনেক বেড়েছে।
বায়াররা কি এখানে আসে?
খুব কম। আমার ছবি এজেন্টের মারফতই বেশি বিক্রি হয়।
আজকাল এগজিবিশন করেন না, না?
না। ছবি বেশিরভাগই বিক্রি হয়ে যায়। এগজিবিশনটন প্রাইমারি স্টেজে হত। এখন ছবি জমে থাকে না তো।
আপনার তো এখন প্রচণ্ড ডিম্যান্ড।
হুজুগই ধরতে পারো। যারা কেনে তারা কি ছবি বোঝে?
তা বটে। যা
রা আঁকে তারাও বোঝে না।
সকালে তা হলে শুধু ছবি আঁকা?
হ্যাঁ। সকালে আলোটা ভাল পাওয়া যায়। মেজাজটাও থাকে ভাল।
দুপুরে ঘুমোন?
না, ঘুমোনোর অভ্যাসটা কম। দুপুরে বই পড়ি।
গল্পের বই?
তাও। তবে ইতিহাস আর বিজ্ঞানই বেশি।
এখানকার লোকজন দেখা করতে আসে না?
আমি তো আনসোশ্যাল। বেশি মিশি না কারও সঙ্গে। তবে দু-চারজনকে চিনি।
কথা বলতে, আড্ডা মারতে আপনার ভাল লাগে না?
না। আগে খুব আড্ডা দিতাম, যখন বয়স কম ছিল।
কফি হাউসে?
কফি হাউস ছিল, বন্ধুদের মেসবাড়ি ছিল, বসন্ত কেবিন ছিল।
সেসব দিনের কথা মনে হয় না?
হয়। তবে খুব সুখস্মৃতি নয়।
তখনকার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই?
ইচ্ছে করেই যোগাযোগ রাখি না। কী হবে?
আড্ডায় তো অনেক ভাব বিনিময় হয়।
হয়তো হয়। তবে আড্ডায় বেশিরভাগই হয় লাইট কথাবার্তা। আমি ওটা আজকাল এনজয় করি না।
বিকেলের দিকটায় বিষণ্ণ লাগে না?
না। ভালই লাগে।
রাতে ছবি আঁকেন?
না না। কোনওদিনই আঁকতাম না। এখানে ভীষণ লোডশেডিং। কারেন্ট থাকলেও ভোল্টেজ খুব কম। রাতে কোনও কাজই করা যায় না। এখানে বাধ্যতামূলক হল আর্লি টু বেড।
এত বড় বাড়ি নিয়ে থাকেন, গা ছমছম করে না?
কেন করবে? আমার তো ভূতের ভয় নেই।
চোর-ডাকাতের ভয়?
তাও নেই। কী নেবে? ভ্যালুয়েব তত কিছু থাকে না।
ছবি তো নিতে পারে।
এখানকার চোর-ডাকাতেরা ততদূর শিক্ষিত নয় যে, ছবি চুরি করবে। ছবির বাজারদরও তারা জানে না।
তবু তারা আছে তো!
তা আছে শুনেছি। এ বাড়িতে এখনও হানা দেয়নি।
ছবি এঁকে যে আপনি প্রভূত টাকা উপার্জন করেন এটা কি তারা জানে না?
তা আমি বলতে পারব না। ছবি এঁকে টাকা রোজগার করার ব্যাপারটা শিক্ষিত সমাজের লোকে জানে। এরা ততটা ওয়াকিবহাল নয় বোধহয়। নগদ টাকা আমি অবশ্য বাড়িতে রাখি না।
সে তো বটেই। কলকাতায় যখন ছিলেন তখন বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী আপনার কাছে আঁকা শিখতে আসত।
হ্যাঁ। শেখাতে আমার ভালও লাগে।
এখানে কি কেউ শেখে?
তেমন নয়। ছবি নিয়ে কে মাথা ঘামায় বলো? এক-আধজন আসে।
আপনি শেখান?
এখানে যারা শিখতে আসে তাদের হাত খুব কাঁচা। শুধু ড্রইং শেখাই। কিন্তু সেটাও খুব ভাল নিতে পারে না।
আপনি এখানে আর কী করেন?
সন্ধের পর মদ খাই। ওটা নিয়মিত। আর বিশেষ কিছু করি বলে তো মনে পড়ছে না।
এবার আপনাকে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন করব। রাগ করবেন না তো!
আরে না। রাগের কী আছে?
আপনার বয়স বোধহয় সাতচল্লিশ।
ওটা সার্টিফিকেট এজ। আসলে উনপঞ্চাশ।
যাই হোক। আপনার একটা সেক্স লাইফ থাকার কথা।
ওঃ!
রাগ করলেন?
আরে না। কথাটা হল, প্রয়োজনই আবিষ্কারের জননী।
তার মানে?
মাঝে মাঝে মেয়েছেলে চলে আসে।
চলে আসে?
আই ডোন্ট ফোর্স দেম। টাকা অফার করি।
চলে আসে কথাটার অর্থ বুঝতে পারলাম না।
আমার একজন হেলপার আছে। অড জব ম্যান। এ ব্যাপারে সে-ই সাহায্য করেছিল।
অনেক মেয়ে আসে নাকি?
না না। একজনই। স্থানীয় একজন গরিব মেয়ে। স্বামী নেয় না।
একজনই?
হ্যাঁ। কিন্তু বেশি নয়। সপ্তাহে একদিন বা বড়জোর দু’দিন।
আপনি কি আবার বিয়ে করার কথা ভাবেন?
পাগল নাকি?
এরকমই তা হলে কাটিয়ে দেবেন?
দেখা যাক। কোথা থেকে কবে কী হবে তা নিয়ে ভেবে কী করব?
কলকাতায় একটা গুজব রটেছে যে আপনি এখানে এসে একটা স্পিরিচুয়াল লাইফ কাটাচ্ছেন। ধর্মকর্ম নিয়ে মেতে আছেন।
মানুষের অনুপস্থিতিতে কত কথাই তো রটে।
আপনি বরাবর নাস্তিক ছিলেন। এখনও তাই?
নয় কেন? আমার নাস্তিক্য ভাঙার মতো কিছু তো ঘটেনি।
অনেক সুময়ে নির্জনে একা বাস করতে করতে ঈশ্বরচিন্তাও আসতে পারে তো!
না। আমার মনে হয় না, ঈশ্বরচিন্তা ওরকম অকারণে আসে। আমার ঈশ্বরকে দরকার হয়। রং, রেখা আর পৃথিবীর রূপ এসবই আমার ঈশ্বর।
সে তো বটেই। আপনার এত যে দেশজোড়া খ্যাতি, এত টাকা এগুলো তো আপনি ভোগও করেন না। এখানে তো দেখছি স্পার্টান লাইফ লিড করছেন। ফ্রিজ বা টিভি আছে কি?
পাগল! ওসব দিয়ে কী হবে? একা মানুষ, ফ্রিজ দিয়ে কী করব? মদ খাওয়ার বরফ আমার চাকর বান্টা এনে দেয়। অবশ্য কিউব নয়, চাঙড়। ওতেই হয়ে যায়।
সিনেমাটিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে না?
কোনওদিনই করত না। সিনেমা আমি খুব কমই দেখেছি। এখন তো আরও ইচ্ছে করে না।
আপনার বাগান করার শখ নেই? সামনের বাগানটা তো দেখছি আগাছায় ভরতি।
ওটাই তো আমার ভাল লাগে। তোমাদের কাছে আগাছা হতে পারে, আমার কাছে নয়। সাজানো বাগানের চেয়ে এই ওয়াইন্ডনেস এবং এই হ্যাপাজার্ড গাছগাছালি আমার বেশি প্রিয়। ওটা অ্যাটিচুডের ওপর নির্ভর করে।
তাই দেখছি। আপনার রং, তুলি, ক্যানভাস সব কলকাতা থেকেই আসে?
হ্যাঁ। আমার এজেন্ট দিয়ে যায়। আমি অবশ্য আজকাল বিদেশ থেকেই রং আনাই। এখানকার রঙের কোয়ালিটি আমার পছন্দ নয়।
হ্যাঁ, অ্যান্ড ইউ ক্যান অ্যাফোর্ড দ্যাট। বাড়িরখবর টবর পান?
বিশেষ নয়। মা বোধহয় তাড়না করে, তাই মাঝে মাঝে আমার মেয়েরা চিঠি লেখে। পোস্টকার্ডে।
আপনি জবাব দেন?
এক লাইন-দু’ লাইনে দিই। আমি ভাল আছি এ খবরটা না পেলে মা হয়তো চলেই আসবে খবর নিতে। মায়েদের তো জানো।
আপনি কি মাকে একটু মিস করেন?
না, মিস করি বলাটা বাড়াবাড়ি। তবে একটু মায়ের কথাই যা মনে হয়।
আপনি নিশ্চয়ই পরিবারকে টাকা পাঠান?
তা পাঠাব না? পাঠাতেও হয় না। আমার স্ত্রীর আর আমার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যায়। ছবির টাকা ছাড়াও আমার স্ত্রীর চাকরির রোজগার আছে। সুতরাং বুঝতেই পারছ–
হ্যাঁ, আমি জানি দে আর ভেরি ওয়েল অফ।
ওদের বড়লোকই বলতে পারো তুমি। বেহালায় অত বড় বাড়ি, গাড়ি, অল সর্টস অব স্ট্যাটাস সিমবলস!
মেয়েদের বা ছেলেকে মিস করেন না?
নাঃ। সবাই তো বড়ই হয়ে গেছে। দে আর বিজি উইথ দেয়ার স্টাডিজ অ্যান্ড ক্যারিয়ারস।
বউদির কী অ্যাটিচুড আপনার প্রতি?
ভেরি কোন্ড, ভেরি প্যাসিভ। যেমনটা ছিল।
উনি আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি?
হ্যাঁ, দু’বছর আগে আমার এক শালাকে পাঠিয়েছিল। সে মিনমিন করে কী যেন বলছিল। সব সংসারেই অশান্তি হয়েই থাকে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খিটিমিটি হতেই পারে…
আপনি তাকে পাত্তা দিলেন না তো!
পাত্তা দেওয়ার মতো ব্যক্তিত্ববান সে নয়।
কী বললেন তাকে?
বললাম, বাড়ি যাও। দুনিয়াটা গোলগাপ্পা নয়। সবকিছু বুঝবার মতো মাথাও তোমার নেই। ভাগিয়ে দিলাম।
বউদি কি চিঠিপত্র কিছু দেননি কখনও?
না। শি ইজ অলসো এ হার্ড নাট টু ক্র্যাক।
আপনি কি তাকে আর পছন্দ করেন না?
কোনওদিনই করিনি।
অথচ সবাই জানে আপনাদের লাভ ম্যারেজ।
লাভ ম্যারেজ ব্যাপারটাই একটা ধাপ্পা।
কেন?
প্রেম করে যেসব বিয়ে হয় সেই প্রেমগুলো বেশিরভাগই স্কিন ডিপ। আই’ নেভার লাভড হার। সাময়িক একটা মোহ আর জেদ থেকে বিয়েটা হয়েছিল। এনিওয়ে শি হ্যাজ নাথিং টু ল্যামেন্ট ফর। বেশ কয়েক বছর বিবাহিত জীবন যাপন করেছি। নাউ আই ওয়ান্ট মাই ফ্রিডম।
এটাই কি সেই ফ্রিডম?
একরকম ফ্রিডমই। অন্তত বন্ডেড তো নই।
এমন তো হতে পারে যে আপনি একদিন অনুতপ্ত হয়ে ফিরে যাবেন।
তা যাব না। যেতাম, যদি মান-অভিমান থেকে চলে আসতাম। এটা অমন হালকাপলকা ব্যাপার নয়। আমি স্ত্রীর সঙ্গ কখনওই উপভোগ করিনি। কোনও টানও নেই তার প্রতি। ছেলেমেয়েদের প্রতিও নেই। আই নেভার ওয়াজ এ গুড ফাদার। তবে ছেলেমেয়েরা ভাল থাকুক সেটা অবশ্য চাই।
আপনি কি তা হলে এখানে বেশ ভাল আছেন?
দেখতেই তো পাচ্ছ। কিছু খারাপ নেই। ভাল থাকাটা নির্ভর করে কতগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। ভাল স্বাস্থ্য, ভাল অ্যাটিচুড, স্যাটিসফ্যাক্টরি কাজ…
অ্যান্ড সেক্স?
অলসো সেক্স।
আর কিছু নয়? ধরুন গুড কম্পানি?
কম্পানি ছাড়াও চলে। ওটা অ্যাটিচুডের ওপর নির্ভর করে।
তা হলে কি বলব আপনি এখনই প্রকৃতপক্ষে জীবনকে উপভোগ করছেন?
না, তা বললে মিথ্যে বলা হবে। জীবনকে আমি কি আগেও উপভোগ করিনি কখনও কখনও? ভাল একটা ছবি আঁকলে, ভাল একটা গান শুনলে, সুন্দর দৃশ্য দেখলে আমি বেঁচে থাকাটাকে সার্থক বলেই তো ভেবেছি বহুবার। মনে আছে প্যারিসে আমি প্রথম গিয়ে টানা পনেরো দিন ল্যুভ মিউজিয়ামে ঘুরে বেড়িয়েছি। কেমন যেন স্টানড অ্যান্ড হিপনোটাইজড। সেটাও তো উপভোগ!
আর এখন?
এখনও তাই। মাঝে মাঝে উপভোগ করি।
আপনি গানের কথা বললেন। আপনার কি টেপ রেকর্ডার আছে?
না। ক্যাসেট বাজিয়ে গান শুনতে ইচ্ছে করে না।
তা হলে গানটা আর উপভোগ করেন না?
তোমাকে একটা আশ্চর্য কথা বলব?
বলুন না। শুনতেই আসা।
তুমি হয়তো ঠিক বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি।
বলুন শুনি। বিশ্বাস করব না এমন গ্যারান্টি কে দিতে পারে?
এ জায়গাটা তো দেখছ ভীষণ নির্জন।
হ্যাঁ।
এখানে দিনেদুপুরে ঝিঁঝির শব্দ শোনা যায়। সারাদিনে হয়তো একটাও মানুষের গলার স্বর কানে আসে না। এই যে নির্জনতা, মাঝে মাঝে এর শব্দহীনতা আমাকে অভিভূত করে ফেলে।
বুঝতে পারছি।
মাঝে মাঝে কী হয় জানো? গভীর নিস্তব্ধতায় ডুবে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে আমার মনে হয় এই নিস্তব্ধতার ভিতরে যেন একটা সুর লয় খেলা করছে। খুব গভীরে যেন একটা অশ্রুত সংগীত। এ ঠিক বোঝানো যায় না। কানে শোনার জিনিস নয়। কিন্তু অনুভূতিতে যেন ধরা দেয়।
এরকম কি প্রায়ই হয়?
না, খুব কম হয়। অনেকদিন বাদে বাদে।
এরকমটা কিন্তু হতেই পারে। বড় বড় ওস্তাদের নাকি হয়।
আমি ওস্তাদ নই। গান তো আমার সাধনা নয়।
তা হোক। আপনি তো সূক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ। ধ্যানস্থ মানুষ।
ওটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। ওরকম কমপ্লিমেন্ট আমার পাওনা নয় কিন্তু।
এটা কমপ্লিমেন্ট নয়। একটা এক্সপ্ল্যানেশন মাত্র।
থ্যাঙ্ক ইউ।
এখন আপনি কী বিষয় নিয়ে ছবি আঁকছেন?
প্রধানত এই জায়গাটা নিয়ে। পাখি, ফুল, কীটপতঙ্গ নিয়েও আঁকি। আবার ভিশন থেকেও আঁকি। একদিন স্বপ্নে একটা জাহাজ দেখলাম। কালো সমুদ্রের ওপর ভাসছে। অদ্ভুত জাহাজ। বিশাল উঁচু, বিরাট বড়। সেই জাহাজটা বড় ক্যানভাসে প্রায় এক মাস ধরে আঁকলাম। কিন্তু মনের মতো হল না।
ছবিটা কি আছে?
না, বিক্রি হয়ে গেছে।
আপনি আগে আপনার ছবিগুলোর ফটো তুলে রাখতেন। আজকাল রাখেন না?
নাঃ। কী হবে রেখে? মনে হয় আমার এজেন্ট রাখে।
একটা রেকর্ড থাকা ভাল।
কম বয়সে আমারও তাই মনে হত। এখন আর মায়া নেই যে। আঁকি, বিক্রি করি, তারপর ভুলে যাই।
আপনি একসময়ে ক্রিটিকদের ওপর খুব খাপ্পা ছিলেন। একবার একজন আর্ট ক্রিটিককে মারধরও করেছিলেন। তার নাম নব দাস, মনে আছে?
খুব আছে। তখন খুব রিঅ্যাকশন হত।
আজকাল হয় না?
হবে কী করে? আমার এখানে পত্র-পত্রিকা আসে না। এলেও পড়ি না। যার যা খুশি লিখুক।
পড়েন না বলেই কি রিঅ্যাক্ট করেন না? পড়লে করতেন?
না, না, পড়লেও করতাম না। আসলে কী জানো, আমি আজ বুঝেছি, আর্ট ক্রিটিকরা ছবি কিস্যু বোঝে না। তার চেয়েও মারাত্মক কথা আর্টিস্ট নিজেও বোঝে না। এই সাংঘাতিক সত্যটা বুঝতে পারার পর আমি সংযত হয়ে গেছি।
সমঝদাররা কি একথা মানবেন? আপনি সর্বজিৎ সরকার–কত নাম-ডাক আপনার!
ওসবও খুব ফুঁকো ব্যাপার। আর্টের জগতে একটা মস্ত ফাঁকিবাজি আছে।
আপনি সেটা জেনেও তা হলে আঁকেন কেন?
আঁকার নেশায়। কিছু তো করছি। ড্রয়িং জানি, তুলি চালাতে পারি, রং বুঝি, প্যাটার্ন বুঝি। এগুলো নিয়ে একটা খেলা।
ছবির কোনও ফিলজফি নেই বলছেন?
সচেতনভাবে নেই। তবে কেউ কোনও অর্থ বার করে নিতে পারলে ভালই।
এটা তো সাংঘাতিক কথা!
খুব সাংঘাতিক কথা। তবু অনেকটাই সত্যি। তবে একটা কথা আছে।
কী কথা?
একজন জাত আর্টিস্ট যাই আঁকুক ছবিটার মধ্যে কিন্তু একটা সৌন্দর্য থাকবেই। থাকবে সূক্ষ্ম সিমেট্রিকাল নকশা। থাকবে কিছু অনুভূতিও। সবটা ফেলে দেওয়া যাবে না। পিকাসো অনেক অর্থহীন, আবোল তাবোল ছবি এঁকেছেন। কিন্তু তার মধ্যেও দেখবে কিছু একটা আছে। যেটা আছে সেটাকে সেই আর্টিস্টও বুঝিয়ে দিতে পারবে না।
বাঃ, এই তো অ্যাপ্রিসিয়েটও করছেন দেখছি।
স্ববিরোধী কথা বললাম নাকি শবর?
একটু কনফ্লিকটিং। কিন্তু আর্ট জিনিসটা বোধহয় ওরকমই। কিছু নেই, না থেকেও আছে।
চা খাবে?
না, আমি চা খাই না।
তাও তো বটে, তোমার তো কোনও নেশাই নেই। ভুলে গিয়েছিলাম।
আপনি ইচ্ছে করলে খেতে পারেন।
না। এখন বেলা এগারোটা বাজে। এ সময়ে চা খাই না।
আমি আপনার আঁকার বাধা সৃষ্টি করছি না তো!
না। আজ রবিবার। রবিবার আমি ছুটি নিই।
আপনার তো রোজই ছুটি।
হ্যাঁ, সেইজন্যই একটা দিন একটু আলাদা ছুটির মেজাজ তৈরি করে নিতে হয়। এবার আসল কথাটা কি বলবে?
আসল কথা! আবার আসল কথা কী?
সর্বজিৎ হাসল। বলল, শবর, তুমি একজন অতি ধূর্ত পুলিশ অফিসার। শুধু আর্ট নিয়ে আলোচনা করতে কলকাতা থেকে এতদূর আসোনি। আমি জানি।
শবর মৃদু হেসে বলল, আমি সমঝদার না হলেও আর্ট নিয়ে আমার কিছু নাড়াচাড়া করার অভ্যাস আছে।
জানি। তোমার আর্ট নিয়ে নাড়াচাড়াও বোধহয় ক্রাইম ডিটেকশনের জন্যই।
তাই নাকি?
তুমি একবার বলেছিলে, একটা কার যেন ছবি দেখে তুমি একটা মার্ডার কেস সলভ করেছিলে।
ঠিক তা নয়। তবে সামটাইমস ইট হেল্পস।
তুমি আমাকে কোনও ক্রাইমের জন্য ধরতে আসোনি তো শবর?
আরে না। কী যে বলেন।
স্ত্রী আর পরিবার ছেড়ে চলে আসা ছাড়া আমার আর তেমন কোনও অপরাধ নেইও। তবে হ্যাঁ, নব দাসকে মেরেছিলাম। সেটাও একটা ক্রিমিন্যাল অ্যাক্ট বটে। তবে নব পুলিশে যায়নি। আমি ওর কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলাম।
সবই জানি।
তা হলে এবার আসল কথাটা বলে ফেলো।
আচ্ছা আপনি কি আজকাল ন্যুড আঁকেন?
ন্যুড? তা আঁকি বোধহয় মাঝে মাঝে। কেন?
ইদানীং কি আপনি পরপর বেশ কয়েকটা ন্যুড এঁকেছেন?
উঁহু। ন্যুড খুব কম আঁকি। ভীষণ রেয়ার। হঠাৎ ন্যুড নিয়ে কথা উঠছে কেন?
আপনি যদি কিছু মনে না করেন এবং প্রশ্নটার জন্য আমার নির্লজ্জতাকে ক্ষমা করেন তা হলে একটা প্রশ্ন করতে পারি কি?
আরে, ফর্মালিটি ছেড়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল। আমি ভোলামেলা মানুষ। নাথিং টু হাইড। একটু আগে তো আমার সেক্স লাইফ নিয়েও প্রশ্ন করেছ, কিছু মনে করেছি কি?
এটা একটু পারসোনাল।
গো অ্যাহেড।
আপনি কখনও আপনার স্ত্রীর ন্যুড এঁকেছেন কি?
এই কথা! হাঃ হাঃ, হ্যাঁ, বিয়ের পর একবার এঁকেছিলাম। খুব ছোট করে।
আপনার স্ত্রী আপত্তি করেননি?
আরে না। ওর কয়েকটা পোট্রেট এঁকেছিলাম। তারপর উনি নিজেই একদিন বললেন, উনি আমার ন্যুড মডেল হতে চান। ব্যাপারটা কী জানো? তখন ইলা নামে একটি মেয়ে আমার মডেল হত। শি ওয়াজ কোয়াইট অ্যাট্রাকটিভ। সম্ভবত আমার স্ত্রী ওঁর সম্পর্কে একটু জেলাস ছিলেন। তাই ওঁকে সরিয়ে নিজে মডেল হতে চেয়েছিলেন।
তার ফল কী হয়েছিল?
খুব খারাপ। যখন আমার স্ত্রীকে মডেল করে ন্যুড ছবিটা আঁকলাম তখন উনি বেঁকে বসলেন। ও ছবি বিক্রি করা চলবে না। এগজিবিট হিসেবেও দেওয়া যাবে না। দি সেন্টিমেন্ট ওয়াজ কোয়াইট লজিক্যাল।
সেই ছবিটার শেষ অবধি কী হল?
ফেসটা বদলে দিতে হল।
এরকম ঘটনা আর কখনও ঘটেনি?
না। ইন ফ্যাক্ট বিয়ের এক বছর পর থেকে আমি আমার স্ত্রীর কোনও ছবিই আঁকিনি। নডের প্রশ্ন তো ওঠেই না। কিন্তু কেন এই প্রশ্ন করছ জানতে পারি কি শবর?
আপনার দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। মেয়েরা এখন একজন যুবতী এবং একজন কিশোরী। ঠিক তো!
হ্যাঁ।
কোনও বাপের পক্ষে তার নিজের যুবতী বা কিশোরী মেয়ের ন্যুড আঁকা কি সম্ভব বলে আপনার মনে হয়?
এ প্রশ্ন কেন করছ জানি না। তবে অনেক আর্টিস্টের ওসব সংস্কার থাকে না। কিন্তু আমার কথা যদি বলো তা হলে বলব আমার ওরকম রুচি কখনও হয়নি, হবেও না।
আপনার মুখ থেকে এ কথাটা শুনবার জন্যই আসা। আপনাকে নিয়ে কলকাতায় এখন একটা বিচ্ছিরি কন্ট্রোভার্সি চলছে।
কী ব্যাপার খুলে বলতে পারো?
রামপ্রসাদ সিংঘানিয়া নামে একজন বড় আর্ট কালেক্টার আছে, জানেন?
চিনি না। আজকাল আর্ট কালেক্টারের অভাব কী?
রামপ্রসাদ সিংঘানিয়া তার কালেকশন অব আর্টসের একটা এগজিবিশন দিয়েছেন।
ও। তা হবে।
সিংঘানিয়ার এই এগজিবিশনে প্রায় আশিটা ছবি ডিসপ্লে করা হয়েছে। তার মধ্যে ত্রিশখানাই আপনার।
বলো কী? একজনের কাছে আমার এত ছবি?
লোকটা শুধু কালেক্টরই নয়, ছবির ব্যাবসাও তার আছে।
হ্যাঁ, ছবি তো এখন ব্যাবসারই জিনিস।
আপনার এই ত্ৰিশখানা ছবির মধ্যে অন্তত দশটা ছবি নিয়ে একটা সিরিজ রয়েছে। সিরিজটার নাম মেনি ফেসেস অব ইভ।
যদূর মনে পড়ে এরকম কোনও সিরিজ আমি আঁকিনি।
ভাল করে ভেবে দেখুন।
ফটোর রেকর্ড না রাখলেও আমার মেমরি খুব ভাল। আর ছবির টাইটেলের একটা বাঁধা লিস্ট আমার ডায়েরিতে লেখা থাকে। ফর রেফারেন্স। কারণ, বুঝতেই পারছ, ছবি একটা হাইলি কমার্শিয়াল কমোডিটি।
বুঝতে পারছি। তা হলে মেনিফেসেস অব ইভ নামে কোনও সিরিজ আপনি আঁকেননি?
না। এই সিরিজেই কি ন্যুড ছবিগুলো রয়েছে?
হ্যাঁ। শুধু ন্যুড ছবিই নয়। ছবিগুলো আপনার স্ত্রী এবং মেয়েদের নিয়ে আঁকা।
মাই গড! এ তো সাংঘাতিক কথা।
কতটা সাংঘাতিক তা আপনি এখানে বসে ঠিক অনুমান করতে পারবেন না।
তাই নাকি? ছবিগুলো কি খুব অবসিন?
খুব। যাকে রগরগে বলা যায় তাই।
সিংঘানিয়াকে তোমরা অ্যারেস্ট করছ না কেন?
সেটা পরে হবে, আপনি ছবিগুলো আইডেন্টিফাই করার পর। কিন্তু দি ড্যামেজ ইজ অলরেডি ডান।
লোকটা তো ক্রিমিন্যাল দেখছি।
সেটা তো হতেই পারে। কিন্তু এর ফলে আপনার স্ত্রী এবং মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। আপনার স্ত্রী একটা কো-এডুকেশন কলেজের অধ্যাপিকা। তিনি কলেজে যেতে পারছেন না। আপনার বড় মেয়ে কলেজে পড়ে, ছোটটি স্কুলে। তারা স্কুল কলেজ তো দুরের কথা, রাস্তাতেই বেরোতে পারছে না।
ছবিগুলো অতটা পাবলিসিটি পেল কীভাবে?
সিংঘানিয়া ছবিগুলো ডিসপ্লে করার পরই পত্র-পত্রিকায় ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। অনেক কাগজেই ওই সিরিজটার ফটোগ্রাফ ছাপা হয়েছে। ক্রিটিকদের অনেকেই আপনার স্ত্রী ও মেয়েদের চেনে। তারাই প্রথম পয়েন্ট আউট করে যে সর্বজিতের ইভ আসলে তার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে।
নাউ আই অ্যাম ভেরি অ্যাংরি শবর। সিংঘানিয়াকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।
উত্তেজিত হবেন না। আগে শুনুন। আপনার স্ত্রী প্রথমে ছবিগুলো কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সিংঘানিয়া বিক্রি করেনি। কারণ এই এগজিবিশনের কোনও ছবিই বিক্রির জন্য ছিল না। সিংঘানিয়া ক্রিমিন্যাল কি না সেটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি খুব জটিল। ক্রিটিকরা আপনার সম্পর্কে কাগজে বিষোদগার করেছে, আপনার রুচি, বিকৃত যৌনতা, প্রতিহিংসাপ্রবণতা এবং অপ্রকৃতিস্থতার কথা তারা তীক্ষ্ণ ভাষায় লিখেছে।
আমি তো তা জানি না। জানতে পারলে এগজিবিশনটা ইনজাংশন দিয়ে বন্ধ করে দিতাম।
সেটা করা হয়েছে। আপনার স্ত্রী লিগ্যাল অ্যাকশন নিয়েছেন। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপনার স্ত্রী মনে করেন নিজের পরিবারের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই আপনি এ কাজ করেছেন। আপনার মেয়েরা এই ঘটনার পর প্রচণ্ড কান্নাকাটি করেছে। আপনার স্ত্রী আপনার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা আনছেন। সেইসঙ্গে হয়তো ডিভোর্সের মামলাও।
ছবিগুলো যে আমার আঁকা নয় এটা তাদের বোঝা উচিত ছিল। আমার আঁকার কিছু ক্যারেক্টারিস্টিকস আছে।
আমরা সেই অ্যাঙ্গেলটাও দেখেছি।
কী দেখলে? কলকাতায় কোনও ছবি বিশেষজ্ঞ–অর্থাৎ পেশাদার বিশেষজ্ঞ নেই। আমরা তাই ক্রিটিক এবং অন্যান্য আর্টিস্টের মতামত নিই। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, ছবিগুলো সর্বজিৎ সরকারেরই আঁকা। অর্থাৎ আপনি যে ক্যারেক্টারিস্টিকসের কথা বলছিলেন তা সবগুলোতেই আছে। নব দাস একটি বিখ্যাত ইংরিজি কাগজে লিখেছে, সর্বজিৎ সরকার চিরকালই যৌনবিকারের শিকার। সে তার বউ আর মেয়েদের বাজারে নামিয়ে দূষিত আনন্দ পাচ্ছে, এটা তার মতো নিম্নরুচির মানুষের পক্ষে নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার।
হুম, ব্যাপারটা তা হলে জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হ্যাঁ, বেশ জটিল। নইলে আমাকে এতদূর আসতে হত না।
এটা কি তোমার অফিশিয়াল ভিজিট, না ব্যক্তিগত?
ব্যক্তিগত। এটা সেই অর্থে পুলিশ কেস নয়। আমার একটা সন্দেহ ছিল ছবিগুলো নকল।
কেন সন্দেহ হল?
আমি আপনাকে দীর্ঘদিন চিনি বলে।
তুমি কি বিশ্বাস করো যে এ কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়?
মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। তবু আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি। এখন বলুন তো এ কাজ কে করতে পারে এবং কেন?
কী করে বলব বলল তো। আমার কেমন শত্রু থাকতে পারে? আমি রগচটা মানুষ ছিলাম ঠিকই, কিন্তু কারও কোনও গর্হিত ক্ষতি করেছি বলে তো মনে পড়ে না।
আরও একটা কথা।
বলো।
অন্তত চারটি ছবিতে ইভের সঙ্গে আদমকেও দেখা গেছে। কে জানেন?
না, বলো।
একজন আপনার বন্ধু সুধাময় ঘোষ।
সে কী?
দুটো ছবিতে সুধাময় ঘোষ এবং আপনার স্ত্রীকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আঁকা হয়েছে।
আর?
আপনার দুই মেয়ের সঙ্গে আরও দুটি আদমকে আমরা পাচ্ছি। একজন আপনার বড় মেয়ের বন্ধু বান্টু সিং। অন্যজন ছোট মেয়ের বন্ধু ডেভিড।
এদের তো আমি চিনিই না!
আপনি না চিনলেও যে এঁকেছে সে চেনে।
এটা কি একটা ষড়যন্ত্র বলে তোমার মনে হয় শবর?
সে তো বটেই।
সিংঘানিয়াকে তোমরা ক্রস করোনি?
করেছি। সে পরিষ্কার বলেছে আপনার এজেন্টের মাধ্যমে সে ছবি কিনেছে। আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে সে চেনে না।
আমার এজেন্ট কী বলে?
আপনার এজেন্ট রতন শেঠ হার্টের ট্রিটমেন্ট করতে আমেরিকায় গেছে। তার ছেলেরা বলছে, ছবিগুলি ওরিজিন্যাল।
বলল?
হ্যাঁ, তারা বলছে এখান থেকেই তারা প্যাক করে ছবিগুলো প্রায় ছয় মাস আগে নিয়ে যায়।
ব্যাপারটা যে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
মুশকিল হল, শুধু ওই ইভ সিরিজের ছবিগুলির জন্য আপনার পাওনা দশ লাখ টাকা তারা ব্যাঙ্কে আপনার অ্যাকাউন্টে জমাও দিয়েছে।
টাকা জমা দেওয়াটা বড় কথা নয়, প্রমাণও নয়। ওরা সবসময়েই আমার ছবি নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন সময়ে ব্যাঙ্কে টাকা জমা করে।
সেটা ঠিক কথা। আমি জানতে চাই ওরা কি মিথ্যে কথা বলছে?
হ্যাঁ শবর! এটা একটা চক্রান্ত। তা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনি সোনার ডিম-পাড়া হাঁস। অন্তত ওদের কাছে। আপনাকে ফাঁসিয়ে ওদের লাভ কী?
ওরা আর কারও কাছে টাকা খেয়ে এটা করেছে।
না, আমার তা মনে হয় না।
তোমার কী মনে হয়?
আপনার ছবি ট্রান্সপোর্ট করার সময় বা এজেন্টের গোডাউনে বা কোথাও ছবিগুলো সুইচ করা হয়েছে।
মাই গড!
কারণ আপনার এজেন্ট বা সিংঘানিয়া কেউ খুব একটা মিথ্যে কথা বলছে বলে মনে হয় না। আপনি চক্রান্ত বলে সন্দেহ করছেন। আমিও তাই করি। আপনি কবে কলকাতা যেতে পারবেন?
যাওয়া তো ইমিডিয়েটলি দরকার শবর।
মেক ইট টুডে অর টুমরো।
গিয়ে কী করতে হবে বলো তো!
একটা প্রেস কনফারেন্স ডাকুন। ছবিগুলো যে আপনার নয় তা স্ট্রংলি বলুন।
ছবিগুলো আমি দেখতে চাই।
সেটা অ্যারেঞ্জ করা যাবে। আমি আপনার জন্য ছবিগুলোর ফটোপ্রিন্ট নিয়ে এসেছি। দেখুন।
সর্বজিৎ দেখল। বারো বাই আট ইঞ্চির পরিষ্কার রঙিন প্রিন্ট। কোনও সন্দেহ নেই যে ছবিগুলি যে এঁকেছে সে সর্বজিতের আঁকার শৈলী জানে। অতিশয় নিপুণ এই চাতুরী সে নিজে ছাড়া আর কারও ক্ষেই ধরা সম্ভব নয়। দুটো ছবিতে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সুধাময়
এবং তার স্ত্রী ইরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে আছে।
নিজের দুই মেয়ে নিনা আর টিনার ছবিগুলোর দিকে চেয়ে লজ্জায় ঘেন্নায় গা রিরি করছিল সর্বজিতের। এক-আধবার চোখ বুলিয়েই সে ছবিগুলি শবর দাশগুপ্তকে ফেরত দিল।
ছবিগুলো কেমন দেখলেন?
কেমন আর দেখব? নকল।
কলকাতার কিছু কাগজ কিন্তু ব্যক্তিগত অ্যাঙ্গেলটা অ্যাভয়েড করে ছবিগুলোর খুব প্রশংসাও করেছে।
তাই নাকি?
কিছু মনে করবেন না, আপনার স্ত্রীর এখন বয়স কত?
হিসেবমতো আটত্রিশ।
শি লু ইয়ং।
হ্যাঁ। শি হ্যাজ গুড লুকস।
সুধাময় ঘোষের সঙ্গে আপনাদের পারিবারিক রিলেশন কেমন?
সর্বজিৎ একটু চিন্তিত হল। ভেবে বলল, ইরার সঙ্গে প্রেম আছে কি না জানতে চাইছ?
যদি বলি চাইছি?
আই ক্যান্ট হেল্প ইউ। কারণ আমি জানি না। বিয়ের চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই ইরার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এমন খারাপ হয়ে যায় যে, আমি ওর কোনও কিছুই লক্ষ করতাম না। বেশিরভাগ সময়েই তো পড়ে থাকতাম বন্ডেল রোডের স্টুডিয়োতে। প্রেম হলেও আমার কিছু করার ছিল না।
ছবিগুলোতে আপনার স্ত্রীর কন্টেম্পোরারি চেহারা রয়েছে, নাকি অল্প বয়সের?
কন্টেম্পোরারি। ছবিগুলো রিয়ালিস্টিক ধরনে আঁকা। মুখ এবং অবয়ব খুব প্রমিনেন্ট। ইরার বাঁদিকের বুকে একটা জডুল আছে। সেটাও এঁকেছে। ইট মিনস দি বাস্টার্ড নোজ হার ওয়েল।
সুধাময় ঘোষ সম্পর্কে একটু বলুন।
কী বলব? সুধাময় ইজ এ নাইস ফেলল। বিগ শট ইন দি ইলেকট্রনিক বিজনেস। কোটিপতি।
আপনার স্ত্রীর প্রতি তার কোনও ক্রাশ ছিল কি?
কী করে বলব বলল তো! সুধাময় আমার বন্ধু ছিল। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও ছিল গভীর। আমার দুঃখের দিনে, ইন মাই আর্লি ডেজ হি হেল্পড এ লট। বিয়ের পর তো আমার মাথা গোঁজবার জায়গা ছিল না। সুধাময় আমাকে তার একটা বাড়িতে সস্ত্রীক থাকতে দেয়। নাইস ম্যান, নাইস ফ্রেন্ড। ওর রি-অ্যাকশন কী?
উনি টোকিওতে রয়েছেন। বিজনেস টুর। তারপর যাবেন রাশিয়া এবং ইউরোপ। হয়তো চিন এবং তাইওয়ানও। ফিরতে দেরি হবে। ওঁর বয়স কত?
হার্ডলি ফর্টি ফাইভ।
তা হলে কোয়াইট ইয়ং।
হ্যাঁ, আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট।
উনি তো বিয়ে করেছেন?
আলবাত। ওর বউ সোনালি খুব ভাল মেয়ে। এই ঘটনাটা মেয়েটাকে দুঃখ দেবে।
উনি আপাতত স্বামীর সঙ্গে বাইরে।
বাঁচা গেল।
আপনি রিলিফ ফিল করছেন, কিন্তু আমি তা করছি না। ওঁরা থাকলে আমার কাজের সুবিধে হত।
তুমি কি ভাবছ যে, ইরার সঙ্গে যদি সুধাময়ের অ্যাডাল্টারির সম্পর্ক থেকেও থাকে তা হলে তা জেরা করে বের করতে পারতে?
কনফেশন আদায় করা সহজ নয়। কিন্তু রিঅ্যাকশন দেখে অনুমান করা সম্ভব।
সেক্ষেত্রে ইরাকেই তো প্রশ্ন করতে পারতে। তার রিঅ্যাকশন দেখে অনুমান করো।
ইরাদেবীর মানসিক অবস্থা এখন ভারসাম্যহীন। তিনি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন আপনার ওপর। এ অবস্থায় ওঁকে ওসব সেনসিটিভ ব্যাপারে প্রশ্ন করাটা ঠিক নয়।
তুমি এই তদন্তের কাজ কি প্রাইভেটলি করছ? নিজের গরজে? নাকি অফিশিয়ালি?
অফিশিয়ালি। ইরাদেবী আপনার নামে এফআইআর করেছেন। পুলিশের বড় কর্তারা তদন্তের ভার আমাকে দিয়েছেন।
কিন্তু একটু আগেই তো তুমি বলেছ যে, এটা তোমার ব্যক্তিগত সফর।
সেটাও সত্য। আমি ঠিক পুলিশ হিসেবে আপনার কাছে আসিনি। এসেছি ব্যক্তিগত উদ্যোগে। পুলিশ কেসটা খুব সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। তাই তাদের এ ব্যাপারে একটা গয়ংগচ্ছ ভাব আছে। সিরিয়াস ক্রাইম সামাল দিতে তাদের হিমশিম খেতে হয়, পারিবারিক কেচ্ছা নিয়ে তদন্তে সময় দেওয়ার উপায় নেই।
তুমি একজন অত্যন্ত নামকরা গোয়েন্দা। লালবাজারের প্রায় মাথার মণি। এরকম একটা কেসে তোমার মতো উঁদে অফিসারকে লাগানোর মানে কী?
শবর একটু হাসল, আপনিও গোয়েন্দাগিরিতে কম যান না দেখছি। কথাটা ঠিকই। আপনাদের কাছে ব্যাপারটা সিরিয়াস হলেও পুলিশের চোখে এটা মাইনর পেটি কেস। আপনার অনুমানও যথার্থ। পুলিশ আমাকে নিয়োগ করেনি। আমি স্বেচ্ছায় তদন্তটা করতে চেয়েছিলাম। কর্তারা আমাকে অনুমতি দিয়েছেন।
নাউ ইউ আর টকিং সেন্স।
সিংঘানিয়ার এগজিবিশন এখানে বন্ধ করা গেলেও দিল্লি বোম্বাই বা বিদেশে বন্ধ করা যাবে না। ছবিগুলি যে নকল এটা প্রমাণ করাটা খুবই জরুরি। আপনি কি সেটা পারবেন?
কেন পারব না? ছবির ক্যারেক্টারই বলে দেবে যে ওগুলো আমার আঁকা নয়।
তা হলে আপনি কবে কলকাতা যাচ্ছেন?
আজ হবে না। কাল যাব।
গিয়ে কোথায় উঠবেন?
আমি তো বন্ডেল রোডের স্টুডিয়োতেই থাকি কলকাতায় গেলে। অনেকদিন অবশ্য যাওয়া যায়নি।
ওটা কি ভাড়ার ফ্ল্যাট?
ভাড়াই ছিল। পরে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে কিনে নিয়েছি।
আপনার বাড়ির লোক কি স্টুডিয়োটা চেনে?
বোধহয়। তবে কেউ কখনও যায়নি।