১. এই বাটীতে ডাক্তারবাবু আছেন

প্রথম ভাগ
প্রথম পরিচ্ছেদ – বাঙ্গালীবালিকা

এই বাটীতে ডাক্তারবাবু আছেন?

বাহির হইতে একজন এই কথা জিজ্ঞাসা করিল।

এ বাড়ীতে ডাক্তার আছেন?

আগ্রহেব সহিত পুনরায় কে এই কথা জিজ্ঞাসিল। বামা-কন্ঠ বলিয়া বোধ হইল।

রাত্রি তখন প্রায় দশটা বাজিয়াছে। আমার আহারের স্থান হইযাছে। আমি আহার করিতে যাইতেছি।

কে এই কথা জিজ্ঞাসা করিতেছে, তাহা দেখিবার নিমিত্ত লণ্ঠনটি হাতে লইয়া, আমি বাহিরে আসিলাম। দ্বারের নিকট যাই গিয়া উপস্থিত হইয়াছি, আর পুনরায় সেই স্বর অতি আগ্রহ সহকারে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,–মহাশ্য কি ডাক্তার?

লণ্ঠণটি আমি তুলিয়া ধবিলাম। তখন আলোকের সহায়তায় দেখিতে পাইলাম যে, একটি স্ত্রীলোক এই কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিল। স্ত্রীলোক বটে; কিন্তু বয়স্কা নহে। পূর্ণযুবতীও তাহাকে বলিতে পারি না; কারণ, তাহার বয়স ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ বৎসরের অধিক হইবে না।

আমি বিস্মিত হইলাম। একে স্থান কাশী, তাহাতে রাত্রিকাল। রাত্রি দশটার সময় এরূপ অল্পবয়স্কা বাঙ্গালীব মেয়ে ঘর হইতে বাহিব হইয়াছে কেন? বালিকা কি হতভাগিনী? জঘন্য ব্যবসায়-অবলম্বিনী?

এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনস্কভাবে আমি উত্তর করিলাম,–তুমি বোধ হয়, রামকমল ডাক্তারকে খুঁজিতেছ? এ বাড়ী তাহার নহে। আরও একটু আগে গিয়া বামদিকে যাইবে; সেই স্থানে জিজ্ঞাসা কবিলেই রামকমল ডাক্তারের বাড়ী লোকে তোমাকে দেখাইয়া দিবে।

আমার এই কথা শুনিয়া বালিকাটি কাঁদিয়া ফেলিল। চক্ষুর জল মুছিতে মুছিতে সে বলিতে লাগিল,–ও মা! তবে আমি কি কর? রামকমল ডাক্তার রামনগর গিয়াছেন। আজ তিনি ফিরিয়া আসিবেন না। আমি তাহার বাড়ীতে গিয়াছিলাম। তাহার চাকরেরা আমাকে এই কথা বলিল। তাহারা আমাকে বলিয়া দিল যে, এই বাড়ীতেও একজন ডাক্তার সম্প্রতি কলিকাতা হইতে আসিয়াছেন, তাই আমি এখানে আসিয়াছি। ও মা, তবে কি হইবে? বিনা চিকিৎসায় বাবু হয়ত মারা পড়িবেন; তাহা হইলে আমার দশা কি হইবে?

বিদেশে সেই রাত্রিতে সেই বাঙ্গালী কন্যার খেদ শুনিয়া মনে আমার বড় দুঃখ হইল। কুচরিত্রা স্ত্রীলোক বলিয়া পূর্বে যে সন্দেহ হইয়াছিল তাহার কথা শুনিয়া এক্ষণে সে সন্দেহ অনেকটা দূর হইল। এতক্ষণ পর্যন্ত তাহার মুখশ্রী আমি নিরীক্ষণ করিয়া দেখি নাই। আমার খাবার প্রস্তুত ছিল; দুই-চারি কথায় তাহাকে বিদায় করিয়া দিব, কেবল এই ইচ্ছা করিতেছিলাম।

এক্ষণে লণ্ঠনটি পুনরায় তুলিয়া ধরিলাম। লণ্ঠনের আলোক পূর্বাপেক্ষা উজ্জ্বলভাবে বালিকার মুখের উপর পড়িল। বালিকার রূপ ও ভাবভক্তি দেখিয়া আমি চমকিত হইলাম। পূর্বেই বলিয়াছি যে, তাহার বয়স ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ বৎসর। একখানি সামান্য সাদা কালাপেড়ে কাপড় সে পরিধান করিয়াছিল,। কাপখানি সামান্য বটে; কিন্তু পরিষ্কার ছিল। তাহাতে পাছা ছিল না। কাপড়ের ভিতর শেমিজ ছিল; কিন্তু গায়ে জ্যাকেট কিংবা অন্য কোনপ্রকার জামা ছিল না। বালিকার দুই হাতে দুইগাছি সোনার বালা ছিল। কানে দুইটি ইয়ারিং ছিল। শরীরের অন্য কোন স্থানে কোনরূপ গহনা ছিল না। মস্তকের অর্ধেকভাগ সেই কালাপেড়ে শাড়ী দ্বারা আবৃত ছিল। ঝিউড়ি মেয়ে ঘর হইতে বাহির হইলে যেরূপ লজ্জা করা উচিত বোধ করে, অথচ লজ্জা করিতে তাহার লজ্জা হয়, মস্তকের অধভাগ কাপড় দ্বারা আবরণে যেন সেইরূপ ভাব প্রকাশ পাইতেছিল। বালিকার হইয়া সেই কাপড়ের আবরণ যেন সকলকে বলিতেছিল,–লজ্জা করা আমার উচিত বটে; কিন্তু লজ্জা করিতে এখনও আমি শিক্ষা করি নাই, সেজন্য তোমরা সকলে আমার নিন্দা করিও না। বালিকা সেদিন বোধ হয় চুল বাঁধে নাই। সে নিমিত্তর কোকড়া কোঁকড়া কেশরাশি থোলো থোলো হইয়া, তাহার কাঁধের উপব পড়িয়াছিল। শুভ্রবর্ণ গলদেশের উপর সেই কেশরাশি পড়িয়া অপূর্ব শোভার আবির্ভাব হইয়াছিল। বালিকা গৌরবর্ণ, কিন্তু এখন বোধ হয়, অনেক দূর দৌড়িয়া আসিয়া থাকিবে; কারণ সেই গৌরবর্ণের ভিতর হইতে রক্তিম আভা ফুটিয়া বাহির হইতেছিল।

এরূপ মুখশ্রী বিশিষ্ট মানুষের চক্ষু কৃষ্ণবর্ণ হইয়া থাকে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এ বালিকার তাহা নহে। ইহার চক্ষুর কিরূপ বর্ণ, তাহা আমি ঠিক প্রকাশ করিয়া বলিতে পারি না। নীলবর্ণ সাগরজলে সূর্যকিরণ মিশ্রিত করিলে যেরূপ এক নূতন প্রকার বর্ণের সৃষ্টি হয়, বালিকার চক্ষুতারা দুইটি সেইরূপ এক অদ্ভূত নূতন বর্ণে রঞ্জিত ছিল। আমার এত বয়স হইল, এরূপ চক্ষু কখন কাহারও দেখি নাই। চক্ষুর পাতাগুলি দীর্ঘ, নিবিড় ও ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। ভুযুগলও সেইরূপ; কিন্তু অধিক ঘন বা স্থূল নহে। ফল কথা, বালিকা বিলক্ষণ সুন্দরী। কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গি দেখিয়া তাহাকে ভদ্রকন্যা বলিয়া বোধ হইল। পাপ, কপটতা বা কুচিন্তা কখনও যে তাহার মনে উদয় হয় নাই, তাহাও সেই ভাবভঙ্গি তে প্রকাশ পাইতেছিল। সত, সরলতা, সাধুতা ও শিশুভাব যেন তাহার মুখশ্রীতে দেদীপ্যমান ছিল। এই অপূর্ব রূপ, এই সরল ভাব দেখিয়া কে না বশ হইয়া পড়ে? তাহার উপর, যখন সে বিমল মুখজ্যোতিঃ মনোদুঃখে মলিনতার আচ্ছাদিত হয়, যখন সেই সূর্যকিরণমিশ্রিত সাগরজল-গঠিত চক্ষু দুইটি হইতে অশ্রুবারি বিগলিত হয়, তখন সেই বালিকার দুঃখ নিবারণের নিমিত্ত লোকে কি না করিতে পারে? ক্ষুধা-তৃষ্ণা আমি সব ভুলিয়া গেলাম। আমার অন্ন প্রস্তুত; তাহা পড়িয়া রহিল।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – আমি বড় বোকা

বালিকার রূপ, বালিকার দুঃখ দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইলাম। আমি বলিলাম, রামকমলবাবু যখন বাড়ী নাই, তখন আমাকে যাইতে হইবে। আমি একজন ডাক্তার বটে; কিন্তু এ স্থানে আমি ডাক্তারি করি না। কলিকাতা হইতে কেবল দুইদিন আমি এ স্থানে আসিয়াছি।

বালিকা চক্ষু মুছিয়া কাতরস্বরে বলিল,–ও মহাশয়! তবে আসুন, তবে শীঘ্র আসুন; বিলম্ব করিলে তিনি মারা পড়িবেন; বিলম্ব করিবেন না, শীঘ্র আসুন।

বালিকার জুলুম দেখিয়া মনে মনে আমি একটু হাসিলাম। কিন্তু যাহার এরূপ দেবদুলভ সৌন্দর্য, পৃথিবীতে সে জুলুম করিবে না ত আর করিবে কে? আমি ত আমি, পৃথিবীর সকল লোককেই সেই অলৌকিক রূপলাবণ্য বিশিষ্ট বালিকার হুকুম যে আজ্ঞা বলিয়া মানিতে হয়। অতি নম্রভাবে আমি বলিলাম,–না, আমি বিলম্ব করিব না, শীঘ্র চাদরখানা লইয়া আসি।

তখন আমি ব্ৰহ্মদেশে কর্ম করিতাম। ছুটি লইয়া দেশে আসিয়াছিলাম। আমার পিতামহী কাশীবাসিনী হইয়াছিলেন। দুই-চারি দিনের নিমিত্ত তাহাকে দেখিতে আসিয়াছিলাম। এক বৃদ্ধ চাকর ব্যতীত অন্য কাহাকেও আমি সঙ্গে আনি নাই। আমি মনে করিলাম যে বালিকার বাটী নিকটেই হইবে। সেজন্য গাড়ি আনিবার নিমিত্ত চেষ্টা করিলাম না। চাদরখানি গায়ে দিয়া আমার ডাক্তারি ব্যাগটি ও লণ্ঠনটি নিজেই হাতে করিয়া ঘর হইতে বাহির হইলাম। রাত্রিকালে আমার সে বৃদ্ধ চাকরকে সঙ্গে লইতে ইচ্ছা করিলাম না। বালিকা দ্রুতবেগে আগে আগে চলিতে লাগিল, আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলাম। তাহার বয়স অল্প; সে প্রায় ছুটিয়া যাইতে লাগিল। আমি যদিও ঠিক বৃদ্ধ নাই, তথাপি আমার বয়ঃক্রম তখন পঞ্চাশের নিকট হইয়াছিল। শীঘ্রই আমার শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম হইল। তাহাতে একহাতে ব্যাগ, অপর হাতে লণ্ঠন,—দুই হাতে দুইটি লইয়া যাইতে আমার কষ্টবোধ হইতে লাগিল। তখন আমি বালিকাকে বলিলাম,—একটু ধীরে ধীরে চল; অতিদ্রুত আমি যাইতে পারিব না।

বালিকা তখন আমার দিকে চাহিয়া দেখিল। আমি যে বালক নই, কি যুবা নই, আমি যে বৃদ্ধ, বালিকা তখন প্রথম যেন তাহা বুঝিতে পারিল। কিন্তু অপ্রতিভ হইয়া সে আমার হাত হইতে লণ্টনটি কাড়িয়া লইল ও ব্যাগটি লইতেও হাত বাড়াইল। তাহাকে আমি ব্যাগ লইতে দিলাম না। তখন হইতে বালিকা একটু ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল।

এতক্ষণ পর্যন্ত কোন কথাই আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে পারি নাই। অবসর পাইয়া এইবার আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–কাহার পীড়া হইয়াছে? কি হইয়াছে?

বালিকা উত্তর করিল,–বাবু বড় পড়িয়া গিয়াছেন; বড় লাগিয়াছে, বড় রক্ত পড়িতেছে।।

বাবু অর্থে অনুমানে স্বামী বলিয়া বুঝিলাম। কিন্তু এরূপ বিপদের সময় বালিকা পাছে লজ্জা পায়, সে নিমিত্ত বিশেষ করিয়া আর সে কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। বাবু অর্থে না হয় স্বামী হইল; কিন্তু ভদ্রঘরের বাঙ্গালী কন্যা এত রাত্রিতে ঘর হইতে একলা ডাক্তার ডাকিতে কেন বাহির হইয়াছে? তাহার বাড়ীর অন্য কোন লোক আসে নাই কেন? অথবা চাকর-বাকর কেহ আসে নাই কেন? ইহার মর্ম আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। অবশেষে আমি মনে মনে ভাবিলাম,–আমি ডাক্তার মানুষ, লোকের রোগ দূর করা, লোকের শারীরিক যাতনা নিবারণ করা আমার কাজ। আমরা সাধু জানি না, পাপী জানি না;—রোগের চিকিৎসা লইয়া আমাদের কথা। লোকের ঘর-সংসারের কথায় আমার প্রয়োজন কি? সে সকল কথা বালিকাকে আমি কিছুমাত্র জিজ্ঞাসা করিব না।

এইরূপ ভাবিয়া আমি তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম,—তোমার বাবু কখ পড়িয়া গিয়াছেন? কোথায় লাগিয়াছে? তাহার জ্ঞান আছে, না তিনি অজ্ঞান হইয়া গিয়াছেন?

বালিকা একেবারে সকল কথার উত্তর দিল না; ক্রমে ক্রমে একটি একটি করিয়া বলিতে লাগিল,–আজ প্রাতঃকালে বেড়াইতে গিয়াছিলেন। ফিরিয়া আসিলেন। দাঁড়াইতে পারেন না। কথা কহিতে পারেন না। আমি তাহাকে বিছানায় শয়ন করিতে বলিলাম। প্রথম সে কথা তিনি শুনিলেন না। তাহার পর শুইয়া পড়িলেন। চাদর ছিড়িয়া কঁাধে বাঁধিয়াছিলেন। তাহার ভিতর হইতে ক্রমাগত রক্ত পড়িতেছিল। আমি ডাক্তার আনিতে চাহিলাম। তিনি মানা করিলেন। সমস্ত দিন রক্ত পড়িল। মুখ তাহার সাদা হইয়া গেল। দুর্বল হইয়া পড়িলেন। তাহার পর এখন তিনি নিজেই ডাক্তার আনিতে বলিলেন। ডাক্তার আনিবার নিমিত্ত সমস্ত দিন আমি কতবার বলিয়াছিলাম, তিনি আনিতে দেন নাই। এখন ডাক্তারের জন্য নিজেই ব্যস্ত হইয়াছেন। কি যে কপালে আছে। তা বলিতে পারি নাই। আমি এখানে আর কখনও আসি নাই। কাহাকেও আমি জানি না। লোককে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে রামকমল ডাক্তারের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম। রামকমল ডাক্তার বাড়ী নাই। তাহার চাকরেরা আপনার ঠিকানা বলিয়া দিল। সেজন্য আপনার নিকট দৌড়িয়া গেলাম।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—তোমরা এ স্থানে থাক না? কাশীতে তোমরা কবে আসিয়াছ?

বালিকা উত্তর করিল,–না না, আমরা এখানে থাকি না, আমরা এখানে সম্প্রতি আসিয়াছি। এ স্থানে কাহাকেও আমরা, জানি না। ইস! করিলাম কি? আমরা কে, কোথা হইতে আসিয়াছি, এ স পরিচয় দিতে বাবু মানা করিয়াছেন। পাছে কেহ কোন কথা জিজ্ঞাসা করে সেইজন্য বাবু ডাক্তার আনিতে ইচ্ছা করেন নাই। আমি বড় বোকা তাই এত কথা বলিয়া ফেলিলাম।

আমার মনে পুনরায় ঘোরতর সন্দেহ হইল,কাশী স্থান! কুকর্মান্বিত লোক দেশ হইতে পলায়ন করিয়া এইস্থানে আশ্রয় লাভ করে, এ বালিকাও সেইরূপ না কি? আহা তাই হইলে কি দুঃখের বিষয়! বালিকার প্রতি আমার মন এত আকৃষ্ট হইয়াছিল যে, সেই কথা ভাবিয়া আমি ঘোর শোকাকুল হইয়া পড়িলাম। আবার ভাবিলাম, না, না, তাহা কখনই হইতে পারে না। লজ্জাশীলতা, কোমলতা, পতিব্ৰত্য সতী-সাবিত্রী ভাব বালিকার মুখশ্রীতে যেন অঙ্কিত রহিয়াছে। এরূপ লক্ষ্মীস্বরূপা কন্যা দুষ্কর্মান্বিতা হইতে পারে না। ইহারা কে, কি বৃতান্ত,—সে সমুদয় গোপন রাখিবার বোধ হয় কোন কারণ আছে।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – এখন লজ্জা করিতে পারি না

আমি এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় বালিকা পুনরায় বলিল,–বাবু কে, কোথা হইতে আনিয়াছেন, সেসব তাঁহাকে আপনি জিজ্ঞাসা করিবেন না। পাছে সে সব কথা কেহ তাহাকে জিজ্ঞাসা করে, সেই ভযে তিনি এতক্ষণ ডাক্তার আনিতে দেন নাই। বাবু গোপনে আমাকে বিবাহ কবিয়াছেন। আমার মেসোমহাশ্য ও মাসী তাহার সহিত আমার বিবাহ দিয়াছেন। বাবুর পিতা জানিতে পারিলে বড়ই রাগ কবিবেন, সেই জন্য এখন তিনি এ কথা গোপন রাখিতেছেন! এইবার পাশ দিযা বাবু দেশে গিয়া, তাঁহার পিতাকে সকল কথা বলিবেন। তখন আর কোন কথা গোপন করিতে হইবে না। ঐ যা! পুনরায় অনেক কথা বলিয়া ফেলিলাম; কে জানে, লোকে কি করিয়া মনে কথা রাখে, আমি ত তা পারি না।

কথা গোপন রাখিবাব ভাব দেখিয়া আমি মনে মনে একটু হাসিলাম। যাহা হইক, বালিকা যে স্বামীর সহিত কাশী আসিযাছে, ইহার ভিতর যে কোন মন্দ বিষয় নাই, এই কথা শুনিয়া আমি আনন্দিত হইলাম। এই অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই বালিকার প্রতি আমার মনে একপ্রকার স্নেহের উদয় হইয়াছিল।

বালিকা পুনরায় বলিল,–বাবু বড়ই দুর্বল হইয়াছেন। মুখে যেন আর কিছু মাত্র রক্ত নাই। মুখ এমনই সাদা হইয়া গিয়াছে। আমার কপালে যে কি আছে, তা জানি না। আমাদের নূতন বিবাহ হইয়াছে। আমার লজ্জা করা উচিত; কিন্তু এই বিদেশে আমাদের কেউ নাই। তাহার উপর এই ঘোর বিপদ! এ বিপদের সময় আমি লজ্জা করিতে পারি না। তাহাতে আমাকে যে যাই বলুক!

এই কথা বলিয়া বালিকা যেন ঈষৎ রুষ্টভাবে আমার দিকে চাহিল। সেই রুষ্টভাবের যেন এইরূপ অর্থ,–তুমি আমাকে বেহায়া ভাবিতেছ! এখন আমার বাবুর প্রাণ লইয়া টানাটানি! তোমার ইচ্ছা যে, এখন আমি একহাত ঘোমটা দিয়া বসিয়া থাকি! বটে।

বালিকা অবশ্য এরূপ কোন কথা প্রকাশ করিয়া বলে নাই। মনে মনে তাহার এরূপ চিন্তা উদয় হইয়াছিল কি না, তাহাও আমি জানি না। প্রকৃত সে কোপাবিষ্টভাবে আমার প্রতি চাহিয়াছিল কি না, তাহাও আমি ঠিক বলিতে পারি না; কিন্তু এই অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহার উপর আমার এরূপ বাৎসল্যভাবের উদয় হইয়াছিল যে পাছে সে রাগ করে, আমার মনে সেই জ্ঞ হইল। আমি যেন কত দোষ করিয়াছি, আমি যেন কত অপরাধে অপরাধী হইয়াছি,সেইরূপ অতি বিনীতভাবে আমি বলিলাম,না, তোমাকে আমি বেহায়া ভাবি নাই। বরং এই বিপদের সময় এত রাত্রিতে অপরিচিত স্থানে তুমি যে সাহস করিয়া ঘর হইতে বাহির হইতে পারিয়াছ, তাহার জন্য তোমার আমি প্রশংসা করি।

বালিকা বলিল,–বিপদের সময় লোকের ভয় থাকে না। তাছাড়া আমি পল্লীগ্রামের মেয়ে। যখন আমি বালিকা ছিলাম, তখন মাঠে-মাঠে আমরা কত বেড়াইতাম। ঐ যা। আবার একটা কথা বলিয়া ফেলিলাম। দূর ছাই! কত সাবধান হইব?

যাইতে যাইতে এইরূপ কথাবার্তা হইতে লাগিল বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে আমরা দুইজনই দ্রুতপদে পথ চলিতেছিলাম। পথ আর ফুরায় না। কিন্তু কতদূর যাইতে হইবে, সে কথা আমি জিজ্ঞাসা করিলাম না। বালিকা কি করিয়া পথ চিনিয়া যাইতে পারিল, তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না। বোধ হয়, আমার মনের ভাব বুঝিয়া সে বলিল,–সন্ধ্যার পর এইসব রাস্তায় বাবু অনেকবার আমাকে বেড়াইতে আনিয়াছিলেন। এই পথ দিয়া মালীর স্ত্রীর সঙ্গে দুই-একবার বিশ্বেশ্বরের আরতি দেখিতে গিয়াছিলাম। কাশীতে কোন দোষ নাই। সেজন্য আমি বাবুর সহিত বেড়াইতে আসিয়াছিলাম।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঘরের কোণে তুমি দাঁড়াও

ক্রমে আমরা সহর পার হইলাম। মাঠ ও বাগান পড়িল। এতক্ষণ বড় রাস্তা দিয়া যাইতেছিলাম। বড় রাস্তার বামপার্শ্বে বৃহৎ একটি বাগান দেখিতে পাইলাম। বালিকা সেই বাগানের ভিতর প্রবেশ করিল। নিকটে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, সে বাগানটি বিলাতী কুলের গাছে পরিপূর্ণ। অন্য কোনপ্রকার গাছ বড় দেখিতে পাইলাম না। জনমানবের সহিত সাক্ষাৎ হইল না। বাগানের মাঝখানে একস্থানে একটি খোলর বাড়ী ছিল। বালিকা সেই খোলার বাড়িতে প্রবেশ করিল। আমার বোধ হইল যে, খোলার বাড়ীটি তিন-চারটি কুঠরীতে বিভক্ত ছিল। তাহার একটি ঘরে বালিকা প্রবেশ করিল। ঘরের একপার্শ্বে একটি ল্যাম্প জ্বলিতেছিল। মেঝেতে বড় একটি চাটাই বিস্তৃত ছিল। ঘরের অন্য এক পার্শ্বে দুইখানি চারপাই ছিল। একখানি চারপাইয়ে একটি গৌরবর্ণ যুবক শয়ন করিয়াছিল। যুবকের বয়ঃক্রম ঊনিশ কি কুড়ি হইবে, তাহার অধিক হইবে না। রক্তস্রাবে মুখ এখন শুষ্ক হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু যুবক যে সুন্দর পুরুষ, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

সেই খাটিয়ার নিকটে দাঁড়াইয়া বালিকা বলিল,–বাবু! ইনি ডাক্তার মহাশয়। ইহাকে আমি আনিয়াছি। ইনি এ স্থানের ডাক্তার নহেন। ইনি কলিকাতার ভাল ডাক্তার। সম্প্রতি ইনি এ স্থানে আসিয়াছেন। ইস্! তোমার মুখে যেন আর একটুও রক্ত নাই।

বাস্তবিক সেই যুবকের মুখ রক্তহীন হইয়াছিল। শরীর হইতে অধিক রক্তস্রাব হইলে মুখ যেরূপ উজ্জ্বল ও চঞ্চল হয়, যুবকের সেইরূপ হইয়াছিল। তাহাকে দেখিয়া আমার ভয় হইল।

যুবক বলিল,–মহাশয়! আসিয়াছেন, ভাল হইয়াছে।

তাহার পর সেই বালিকার দিকে চাহিয়া সে পুনরায় বলিল,–কুসী? তুমি একবার ঘরের বাহিরে যাও।

আমি বুঝিলাম যে, সেই বালিকার নাম কুসী, অন্ততঃ তাহার ডাকনাম কুসী। ভাল নাম কি, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। এই সময়ে বালিকার মুখের দিকে আমার দৃষ্টি পড়িল। আমি দেখিলাম যে, তাহার বাম গালে একটি কৃষ্ণবর্ণের আঁচিল রহিয়াছে। শুভ্র গালের উপর সেই আঁচিলটি থাকায় মুখের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি হইয়াছিল। আঁচিলের উপর কেন আমার দৃষ্টি পড়িল, তাহা আমি জানি না, কিন্তু আঁচিল সংযুক্ত সেই গণ্ডদেশ যেন আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গেল। বালিকা যুবককে বাবু বলিয়া সম্বোধন করিল। এখন হইতে আমিও তাহাকে বাবু বলিব।

বাবু বলিল,–কুসী! তুমি একবার ঘরের বাহিরে যাও ডাক্তারবাবু আমার কাধ পরীক্ষা করিয়া দেখিবেন। রক্ত দেখিলে তোমার ভয় হইবে।।

কুসী উত্তর করিল,–না বাবু! তুমি আর যা বল তাই করিব, তোমাকে একেলা ছাড়িয়া আমি এ ঘরের বাহিরে যাইব না।।

বাবু বলিল,–আচ্ছা কুসী! তবে তুমি এক কাজ কর, ঘরের ঐ কোণে দাঁড়াইয়া প্রাচীরের দিকে মুখ করিয়া থাক, আমার দিকে চাহিও না। যদি আবশ্যক হয়, তাহা হইলে তোমাকে আমি ডাকব।

কুসী আস্তে আস্তে ঘরের কোণে গিয়া দাঁড়াইল। প্রাচীরের দিকে মুখ করিয়া রহিল।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ঘোরতর সন্দেহ

বাবু আপনার স্কন্ধের দিকে দৃষ্টি করিয়া, চক্ষু টিপিয়া আমার প্রতি ইসারা করিল। কিন্তু সে ইঙ্গিতের অর্থ কি, তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না। তাহার পর বাবু বলিল,–আমি বড় পড়িয়া গিয়াছি। কাশীর ঘাট উচ্চ। সেই ঘাট হইতে পড়িয়া গিয়াছি। নিম্নে একখণ্ড তীক্ষ্ণ প্রস্তর ছিল। আমার কাঁধে তাহা ফুটিয়া গিয়াছিল। অনেক রক্ত পড়িয়াছে।

এই কথা বলিয়া তাহার গায়ে যে বিছানার মোটা চাদরখানি ছিল, প্রথম সেই চাদরখানি বাবু খুলিয়া ফেলিল; তাহার পর স্কন্ধে আহত স্থানে যে ছিন্ন চাদর বাঁধা ছিল তাহাও খুলিয়া ফেলিল।

আমি দেখিলাম যে, স্কন্ধে একটি গোলাকার ছিদ্র হইয়াছে। প্রস্তরখণ্ড দ্বারা আহত হইলে সেরূপ ক্ষত হয় না; বন্দুক অথবা পিস্তলের গুলি লাগিলে যেরূপ গোলাকার ছিদ্র হয়, তাহাই হইয়াছিল।

বাবু বলিল,–সমস্ত দিন হইতে এরূপ রক্ত পড়ে নাই; অল্পক্ষণ হইল, অধিক শোণিতস্রাব হইতেছে।

এই কথা বলিয়া বাবু পুনরায় চক্ষু টিপিয়া আমার প্রতি ইঙ্গিত করিল। এবার আমি তাহার অর্থ বুঝিলাম। পিস্তলের গুলি দ্বারা সে যে আহত হইয়াছিল, এ কথা সে বালিকার নিকট গোপন করিতেছিল। বাবুর স্কন্ধে গুলির দাগ দেখিয়া পুনরায় আমার বড় সন্দেহ হইল। এই বালিকা প্রকৃত কি ইহার স্ত্রী নহে? অন্য কাহারও স্ত্রী অথবা কাহারও কন্যাকে বাবু কি বাহির করিয়া আনিয়াছে? সে নিমিত্ত কন্যার স্বামী, পিতা, ভ্রাতা অথবা কোন আত্মীয় ইহাকে কি গুলি মারিয়াছে? আমার মনে ঘোরতর সন্দেহ উপস্থিত হইল। আমি ভাবিলাম,—এই পাপিষ্ঠ নরাধম লক্ষ্মীরূপা বালিকার ইহকাল পরকাল নষ্ট করিয়াছে। যাহারা ইহাকে গুলি করিয়াছিল, একবারে তাহারা ইহাকে বধ করে নাই কেন? আমি ইহার চিকিৎসা করিব না। রক্তস্রাব হইয়া এ মৃত্যুমুখে পতিত হউক। তাহার পর, বালিকাকে আমি তাহার পিতার নিকট পাঠাইয়া দিব। এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় বাবুর মুখের দিকে আমার দৃষ্টি পড়িল। তাহার মুখে ভয় অথবা কুর্মজনিত লজ্জার চিহ্ন লেশমাত্র দেখিতে পাইলাম না। কুকর্মন্বিত অপরাধীর মুখে এরূপ শান্তি বিরাজ করে না। বাবুর স্থির শান্ত মুখ দেখিয়াও বালিকার কথা স্মরণ করিয়া আমার ক্রোধের কিছু উপশম হইল। ভালমন্দ আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিতে বালিকা আমাকে নিষেধ করিয়াছিল। আমি ভাবিলাম,—ইহাদেব ভিতর কি গুপ্ত কথা আছে তাহা জানিয়া আমার প্রয়োজন কি? আমি ডাক্তার, ডাক্তারি করিতে আসিয়াছি, ডাক্তাবি করিয়া চলিয়া যাই।

এইরূপ ভাবিয়া আমি বলিলাম,—গুরুতর আঘাত লাগিযাছে বটে। সেটা—সেই বস্তুটা এখনও কি ইহার ভিতর আছে?

আমার প্রশ্নের মর্ম এই যে, গুলিটা বাহির হইয়া গিয়াছে, না এখনও স্কন্ধের ভিতর আছে?

বাবু উত্তর করিল,—পাথবের টুকরো ভিতরে নাই আমি নিজে তাহা বাহির করিয়া ফেলিয়াছি।

এই কথা বলিয়া বালিসের নীচে হইতে যুবক একটি গুলি বাহির করিয়া চুপি চুপি আমাকে দেখাইল।

বন্দুক অথবা পিস্তলের গুলি মানুষের গায়ে লাগিলে এত শোণিস্রাব হয় না। এত রক্ত কেন পড়িল, সেই কথা আমি ভাবিতেছিলাম। ক্ষতস্থানের প্রতি দৃষ্টি করিয়া দেখিতে পাইলাম যে, তাহার একপার্শ্বে কাটা দাগ রহিয়াছে। পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম যে গুলির আঘাত হইতে অধিক শোণিতপাত হয় নাই; সেই কৰ্ত্তিত স্থান হইতেই শোণিতধারা বহিতেছিল।

বাবুকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,—এ কি? এ দাগ কোথা হইতে আসিল?

বাবু উত্তর করিল,—ঐ দ্রব্যটা (অর্থাৎ গুলিটা) আমার স্কন্ধের ভিতর রহিয়া গিয়াছিল, আমি আপনি ছুরি দিয়া কাটিয়া তাহাকে বাহির করিয়াছি। এই কথা বলিয়া বাবু হাসিয়া উঠিল। হাসি শেষ হইতে সে অজ্ঞান হইয়া পড়িল।

নিজে ছুরি চালনা করিয়া, বাবু বড় অন্যায় কাজ করিয়াছিল। কারণ, সেই ছুরির আঘাত হইতে শোণিস্রাব হইতেছিল; গুলির আঘাত হইতে বড় নয়। ছুরি চালনার রক্তস্রাব হইতে বাবুর চাই কি মৃত্যু ঘটিতে পারিত।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বিপদের সম্ভাবনা আছে

যাই হউক, বাবুর মূৰ্ছায় আমার পক্ষে সুবিধা হইল। মূর্হিত অবস্থা না হইলে আমি ক্ষতস্থান ভাল করিয়া পরীক্ষা করিতে পারিতাম না, অন্ততঃ রোগীর বড় যাতনা হইত। সেই মূচ্ছিত অবস্থায় তাহাকে রাখিয়া, আমি রক্তবন্ধ করিলাম ও আহত স্থান ভাল করিয়া ড্রেস করিলাম। পকেট-কেস হতে ছোট একশিশি ব্র্যাণ্ডি ও চারি-পাঁচটি নিতান্ত প্রয়োজনীয় ঔষধ আমার ব্যাগের ভিতর থাকে। যখন আমি বিদেশে গমন করি, তখন এই ব্যাগটি সর্বদাই আমার কাছে বাখি। বাবুর মুখে একটু ব্রাণ্ডি দিয়া তাহার আমি চৈতন্য উৎপন্ন করিলাম।

বাবু চক্ষু উন্মীলিত করিয়া বলিল,–এ কি! আমি কোথায় আসিয়াছি? এ কাহাদের বাড়ী? কুসী! কুসী কোথায়?

এতক্ষণ ধরিয়া কুসী ঘরের কোণে দাঁড়াইয়া ছিল। বাবু যে অজ্ঞান হইয়া গিয়াছিল সে তাহার বিন্দুবিসর্গ জানিতে পার নাই। কুসী বলিয়া বাবু যাই ডাকিল, আর সে বিছানার ধারে আসিয়া দাঁড়াইল।

কুসী বলিল,–কেন বাবু! আমাকে ডাকিলে কেন? তুমি কেমন আছ?

মৃদুস্বরে বাবু বলিল,–এখন আমার সব মনে পড়িতেছে। আমি বুঝিয়াছি, আমি অনেক ভাল আছি, কুসী!

আমি ভাল আছি এই কথা বলিবার সময় বাবু আমার মুখপানে চাহিল। চক্ষুপলকের সহায়তায় আমাকে যেন জিজ্ঞাসা করিল,সত্য সত্য কি আমি ভাল আছি? না কোন বিপদ ঘটিবার সম্ভাবনা আছে?

তাহার মনের ভাব বুঝিয়া আমি বলিলাম,—এ ঘা শীঘ্রই ভাল হইয়া যাইবে। ইহাতে কোন বিপদের আশঙ্কা নাই! তবে দিনকত তোমাকে স্থিরভাবে শয়ন করিয়া থাকিতে হইবে।

দুইজনেই বালক-বালিকা,সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। এ স্থানে তাহাদের যে কেহ আত্মীয়-স্বজন অথবা বন্ধু-বান্ধব নাই, বালিকার মুখে পূর্বেই তাহা আমি শুনিয়াছিলাম। বালিকার উপর আমার স্নেহ পড়িয়াছিল; তাহার অনুরোধে বাবুর প্রতিও আমার ভালবাসা হইয়াছিল। বাবুর স্কন্ধে আঘাতটি গুরুতর;—যদিও মৃত্যু ঘটিবার সম্ভাবনা ছিল না। যাহা হউক, ইহাদের আত্মীয়-স্বজনের নিকট সংবাদ প্রেরণ করা কর্তব্য। ইহারা প্রকৃত আমার দয়া ও স্নেহের পাত্র কি না, প্রথম তাহা আমাকে জানিতে হইবে।

এইরূপ মনে করিয়া আমি বাবুকে বলিলাম,–দেখ তোমাকে আমি একটা কথা বলি। তোমরা উভয়েই ভদ্রলোকের পুত্র-কন্যা বলিয়া আমার বোধ হইতেছে। কিন্তু তোমরা যে অবস্থায় কাশীর বাহিরে এই বনের ভিতর একাকী রহিয়াছ, তাহা দেখিয়া আমার বড় সন্দেহ হইতেছে। ইহার ভিতর যদি কোন পাপ থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয় আমি তাহার প্রতিবিধান করিব। তোমাকে আমি হাসপাতালে পাঠাইয়া দিব। তারপর এই বালিকার পিতামাতার সন্ধান করিয়া তাহাদিগের নিকটে ইহাকে আমি পাঠাইয়া দিব।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ – অভিভাবকের অভাব

আমার এই কথা শুনিয়া বালিকা মস্তক অবনত করিয়া ঈষৎ হাসিতে লাগিল। বাবু হো হো করিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। তাহার সে হাসি আর থামে না। আমায় ভয় হইল, পুনরায় পাছে রক্তস্রাব আরম্ভ হয়। কিছু রাগত হইয়া আমি বলিলাম,–হাসি তামাসার কথা আমি কিছু বলি নাই। আমি তোমাদের পিতার বয়সের লোক, আমার কথায় এরূপ বিদ্রুপ করা তোমার উচিত নয়।

এই কথা বলিলাম বটে, কিন্তু কুসীর ভাব ও বাবুর হাসি দেখিয়া আমার নিশ্চয় প্রতীতি হইল যে, ইহাদের মধ্যে কোন প্রকার পাপ নাই।

বাবু আমাকে বলিল, মহাশয়! এইরূপ কথা উঠিবে বলিয়াই আমি সমস্ত দিন ডাক্তার আনিতে দিই নাই। যাই হউক, আমি সত্য সত্য আপনাকে বলিতেছি যে, কুসী আমার বিবাহিতা স্ত্রী। বাপ রে! আপনি যা মনে করিতেছেন, কুসী যদি তা হইত, তাহা হইলে এ প্রাণ কি আমি রাখিতে পারিতাম? আমার কুসী পাপিনী। এ কথা ভাবিতে গেলেও আমার বুক ফাটিয়া যায়। ভিতরের কথা এই যে, পিতার অমতে আমি কুসীকে বিবাহ করিয়াছি; অর্থাৎ কি না, আমার পিতা এ কথার বিন্দু বিসর্গ জানেন না। আমার পিতা বড় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তেজস্বী ব্যক্তি। তাঁহাকে না বলিয়া আমি এই কাজ করিয়াছি। তিনি জানিতে পারিলে বোধহয়, আমার বিশেষ ক্ষতি হইবে আমাদের অন্ততঃ। আমার নিবাস বঙ্গদেশে। আমি কলেজে অধ্যয়ন করি! তিনি হয়ত আমার খরচপত্র বন্ধ করিয়া দিবেন। তখন আমি কি করিব? সেইজন্য মনে করিয়াছি যে, এবার বি-এল, পরীক্ষা দিয়ে যখন দেশে যাইব, তখন পিতাকে সকল কথা বলিব। তখন পিতা বাড়ী হইতে দূর করিয়া দেন দিবেন। বি-এল পরীক্ষা দিতে পারিলে ওকালতী করিয়া কি অন্য কাজ করিয়া কোনমতে কুসীকে প্রতিপালন করিতে পারিব। এক্ষণে আপনাকে মিনতি করি যে, আর অধিক কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবেন না। কি করিয়া আমি আঘাতপ্রাপ্ত হইয়াছি, তাহাও জিজ্ঞাসার প্রয়োজন

নাই।

বাবুর এই সকল কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ দূর হইল। কুসীকে একবার আমি বাহিরে যাইতে বললাম। কুসী অন্তরালে গমন করিলে, আমি বাবুকে পুনরায় বলিলাম,একে বিদেশ, তোমার এ স্থানে পরিচিত লোক কেহ নাই; তাহার উপর তুমি এইরূপ গুরুতর আহত হইয়াছ। যদিও সে ভয় নাই, তথাপি দৈবের কথা কিছুই বলিতে পারা যায় না। যদি কোনরূপ দুর্ঘটনা ঘটে, তাহা হইলে এই বালিকার গতি কি হইবে? এ অবস্থায় হয় তোমার অভিবাবদিগকে, না হয় বালিকার অভিভাবকদিগকে তারযোগে সংবাদ প্রেরণ করা কর্তব্য।

যুবক উত্তর করিল–আমার অভিভাবকবর্গকে সংবাদ দিতে পারি না। কেন পারি না, তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। কুসীর অভিভাবক নাই; একমাত্র মেসোমহাশয় আছেন; তিনি শয্যাধরা পীড়িত। যদি আমার ভালমন্দ হয়, তাহা হইলে মহাশয় অনুগ্রহ করিয়া একখানি টিকিট কিনিয়া, স্ত্রীলোকের গাড়ীতে কুসীকে বসাইয়া দিবেন। কুসী দেশে চলিয়া যাইবে। কোথাকার টিকিট কিনিতে হইবে, কুসী তখন আপনাকে বলিয়া দিবে। কিন্তু বিপদ ঘটিবার কোনরূপ সম্ভাবনা আছে কি?

আমি উত্তর করিলাম,—না, সে ভয় নাই, এরূপ আঘাতে কোন ভয়ের কারণ নাই। তাহার পর আমি বালিকাকে ডাকিয়া বলিলাম,–তোমার স্বামী পীড়িত, এ অবস্থায় তোমার একলা থাকা উচিত নয়; তোমার কাছে থাকে, এমন লোক এখানে কি কেহই নাই?

বালিকা উত্তর করিল,—মালীর স্ত্রী আমার কাজকর্ম করে; কিন্তু সে রাত্রিতে থাকে। তাহার ছোট ছোট ছেলে-পিলে আছে; সন্ধ্যা হলেই সে চলিয়া যায়।

আমি বলিলাম,–আমার একজন বৃদ্ধ চাকর আছে। আমার নিকট সে অনেক দিন আছে; যদি বল ত তাহাকে আমি পাঠাইয়া দিই; কিন্তু পথ চিনিয়া সে আসিবে কি করিয়া, আমি তাই ভাবিতেছি।

বাবু বলিল,–রাত্রিতে এ স্থানে কেহ থাকে, তাহা কি নিতান্ত প্রয়োজন?

আমি উত্তর করিলাম,—নিতান্ত প্রয়োজন নয়, তবে এই অল্পবয়স্কা বালিকা একেলা থাকিবে, তাই বলিতেছি।

বাবু বলিল,–তবে কাজ নাই, কাহাকেও পাঠাইতে হইবে না।

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ – আমি ঘোর অপরাধী

আমি পুনরায় বলিলাম,—আর একটি কথা আছে; রাত্রিতে যাহাতে ভালরূপ তোমার নিদ্রা হয়, আমি সেই প্রকার কোনরূপ ঔষধ তোমাকে দিব। কারণ জুর যাহাতে না হয়, সে বিষয়ে সাবধান হইতে হইবে। আমার ব্যাগে সেরূপ ঔষধ নাই। কোন ডাক্তারখানায় গিয়া সে ঔষধ আনিতে হইবে। কে সে ঔষধ আনিবে? আমি নিজে না হয় ডাক্তারখানা হইতে ঔষধ লইলাম; কিন্তু কাহার দ্বারা পাঠাইয়া দিব? আমার চাকরকে দিয়া পাঠাইতে পারিতাম; কিন্তু সে পথ চিনিয়া আসিতে পারিবে না। আমরাও এখানে কেবল দুইদিন আসিয়াছি। আমার চাকর একে বৃদ্ধ, তাহাতে পথঘাট জানে না। এ রাত্রিকালে কিছুতেই সে এতদূর আসিতে পারিবে না।

এই কথা শুনিয়া কুসী বলিল,–আপনার সঙ্গে আমি না হয় যাই।

বাবু বলিল,–তা কি কখন হয়? এত রাত্রিতে পুনরায় তোমাকে আমি ততদুর পাঠাইতে পারি না। প্রাণের আশঙ্কা হইয়াছিল, তাই একবার পাঠাইয়া ছিলাম! কাশী স্থান! এ রাত্রিতে আবার তোমাকে পাঠাইতে পারি না।।

কুসী আমার পানে চাহিল। তাহার সেই অদ্ভুত নয়নযুগল ছলছল করিয়া আসিল। যেন যত দোষ আমার, এইভাবে কুসী আমাকে বলিল,–ঔষধ না খাইলে বাবুর যদি নিদ্রা না হয়। যদি জ্বর আসে, তাহা হইলে কি হইবে?

কথাগুলিতে যেন আমার প্রতি ভৎসনার ভাব মিশ্রিত ছিল। কিন্তু কুসী যাহা বলে, তাহাই মিষ্ট। কুসীর উপর রাগ করিবার যো নাই। ক্ষুধায় আমি প্রপীড়িত হইয়াছিলাম, রাত্রি অধিক হইয়াছিল। এক ক্রোশের অধিক পথ চলিয়া আমি শ্রান্ত হইয়াছিলাম। কিন্তু কুসীর কাঁদ কাঁদ মুখ ও ছল্‌ছল্‌ চক্ষু দেখিয়া সে সব আমি ভুলিয়া যাইলাম। আমি বলিলাম,–আচ্ছা, তবে আমিই না হয় আর একবার আসিব। ডাক্তারখানা হইতে ঔষধ লইয়া, আমি নিজেই পুনরায় আসিব।।

বাবু বলিল,–তা কি কখন হয়! অনুগ্রহ করিয়া আপনি যে একবার আসিলেন, তাহাই যথেষ্ট। পুনরায় আপনাকে আমি কষ্ট দিতে পারি না।

কুসী বলিল,–ঔষধ না আনিলে চলিবে কেন? যদি তোমার জ্বর হয়, তখন কি হইবে?

কুসীর সকলতাতেই আব্দার। তাহার বাবুর অসুখ!—পৃথিবীশুদ্ধ লোকের বাবুর জন্য পরিশ্রম করা উচিত, কুসীর ইচ্ছা এইরূপ। যাহা হউক, ঔষধ লইয়া আমাকে পুনরায় আসিতে হইবে তাহাই স্থির হইল।

আসিবার সময় বাবু আমার হাতে একখানি কুড়ি টাকার নোট পুঁজিয়া দিল। বাবু বলিল—এই রাত্রিতে আপনাকে বড় কষ্ট দিয়াছি। যাহা দিলাম তাহা আপনার উপযুক্ত নহে। কিন্তু অধিক টাকা আমার সঙ্গে নাই, অনুগ্রহ করিয়া ইহাকে গ্রহণ করুন।

আমি টাকা লইলাম না। আমি বলিলাম,–ব্রহ্মদেশে আমি কর্ম করি। সেই স্থানের আমি সরকারী ডাক্তার। সেস্থানে লোকের বাটী গিয়া ভিজিট গ্রহণ করি সত্য; কিন্তু এ স্থানে আমি টাকা লইব না। ছুটি লইয়া আমি দেশে আসিয়াছিলাম। কাৰ্যোপলক্ষ্যে অল্পদিনের নিমিত্ত কাশী আসিয়াছি। এ স্থানে ডাক্তারী করিতে আমি আসি নাই। এ বালিকার অনুরোধে তোমাকে আমি দেখিতে আসিলাম। আমাকে টাকা দিতে হইবে না। তবে দুইদিন পরে আমি দেশে প্রতিগমন করিব। রামকমল ডাক্তারকে তোমার কথা বলিয়া যাইব। তাহাকে বোধ হয়, টাকা দিতে হইবে।

এই কথা বলিয়া আমি সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। টাকা লইলাম না বটে; কিন্তু বাবু যে ধনবান্ লোকের পুত্র, তাহা বুঝিতে পারিলাম। সামান্য লোকে একেবারে কুড়ি টাকা বাহির করিয়া দিতে পারে না। যতক্ষণ কুসীর নিকট ছিলাম, ততক্ষণ আমার মন ঠিক যেন কাদার ন্যায় কোমল ছিল। সেই মন লইয়া কুসী যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতেছিল। কুসী যাহা আজ্ঞা, করিতেছিল, তাহাই আমি স্বীকার করিতেছিলাম। কিন্তু যাই বাহিরে আসিলাম, আর আমার অন্তঃকরণ কঠিন ভাব ধারণ করিল। ক্ষুধায় পেট জুলিয়া উলি। শ্ৰন্তিজনিত দুর্বলতা অনুভব করিতে লাগিলাম। মনে মনে করিলাম,কি পাগল আমি যে, এই রাত্রিতে পুনরায় এতদূর আসিতে অঙ্গীকার করিয়া বসিলাম।।

যাহা হউক, যখন অঙ্গীকার করিয়াছি, তখন তাহা করিতেই হইবে। পথে ডাক্তারখানা হইতে যথা প্রয়োজন ঔষধ লইলাম। তাহার পর আমার বাসায় আসিয়া আহার করিলাম। আহার করিয়া পুনরায় সেই একক্রোশ পথ গিয়া ঔষধ দিয়া আসিলাম। সে রাত্রিতে আর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম না। দ্বারে কুসীকে ডাকিয়া তাহার হস্তে ঔষধ দিয়া চলিয়া আসিলাম।

পরদিন প্রাতঃকালে পুনরায় সেই বাগানে যাইলাম। রাত্রিতে বাবু নিদ্রা গিয়াছিল। তাহার জ্বর হয় নাই। যুবকাল। বাবু যে সত্বর আরোগ্যলাভ করিতে পারিবে সম্পূর্ণ সেই সম্ভাবনা হইল।

আমি আর দুইদিন কাশীতে রহিলাম। বাবু উঠিয়া বসিতে সমর্থ হইল। যাহা হউক, তবুও আমি রামকমল ডাক্তার মহাশয়কে বাবুর জন্য অনেক করিয়া বলিয়া আসিলাম।

বিদায় হইবার সময় বাবু আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল। কুসী আমার জন্য কাঁদিতে লাগিল। আমি বলিলাম,–কুসী! তোমাকে প্রথম দেখিয়াই আমার মনে এক অপূর্ব স্নেহের উদয় হইয়াছিল। সেই অবধি তোমাকে আমি ঠিক আমার কন্যার মত স্নেহ করি। লোকের সহিত কত কি পাতায়, আমি তোমাকে মেয়ে বলিয়া জানিব, তুমি আমাকে পিতা বলিয়া জানিও। কিন্তু দুঃখেব বিষয় এই যে, জীবনে আর বোধ হয় তোমাদের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে না।।

কুসী উত্তর করিল,—আপনি মহাত্মা লোক। আমি আমার নিজের পিতাকে জানি না, তাহাকে কখনও দেখি নাই। আমার বড় ভাগ্য যে, আজ আমি পিতা পাইলাম।

এই কথা বলিয়া কুসী চক্ষু মুছিতে লাগিল। তাহার পর নিতান্ত উৎসুক নেত্রে সে বাবুর পানে চাহিল। আমাকে তাহাদের নাম-ধাম প্রকাশ করিয়া বলে, কুসীর সেইরূপ ইচ্ছ। কিন্তু বাবু তাহাকে নিষেধ করিল। বাবু বলিল,–কুসী! তাড়াতাড়ি করিও না। একটু অপেক্ষা কর। এখন পরিচয় দিয়া লাভ কি? তাহার পর আমার দিকে দৃষ্টি করিয়া বাবু পুনরায় বলিল,–ভগবান যদি দিন দেন, তাহা হইলে আপনাকে শীঘ্রই পত্র লিখিব। মহাশয়ের নাম ও ঠিকানা আমি আমার পুস্তকে লিখিয়া লইতেছি।

আমি বলিলাম,আমার নাম যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী। লোকে আমাকে যাদব ডাক্তার বলিয়া জানে। ব্রহ্মদেশে যে স্থানে আমি কর্ম করিতাম, সেই ঠিকানা আমি বাবুকে বলিলাম। বাবু আপনার পুস্তকে তাহা লিখিয়া লইল।

এইরূপে কুসী ও বাবুর নিকট বিদায় লইয়া আমি চলিয়া আসিলাম। বাঙ্গালা ১৩০২ সালের পূজার সময় কাশীতে কুসী ও বাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়।