১. আপনি তো বাহাদুর লোক দেখছি

মারীচ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

আপনি তো বাহাদুর লোক দেখছি।

কেমন করে দেখলেন?

আপনার বায়োডাটা বলছে আপনি এক সময়ে বোম্বের ফিমে কিছুদিন স্টান্টম্যানের কাজ করেছিলেন।

ওটা বাহাদুরির ব্যাপার নয়। পেটের দায়।

কী ধরনের স্টান্টম্যান ছিলেন আপনি?

মোটরবাইক আর কিছু লাফ ঝাঁপ। টাকার জন্য করতে হত, তবে টাকাও তেমন কিছু রোজগার করতে পারিনি। কিন্তু আমার তো বায়োডাটা নেই। ছিল না, আপনি পেলেন কী করে?

বায়োডাটাটি তৈরি করেছে পুলিশ। বিস্তর খোঁজখবর করে।

তার কি কোনও প্রয়োজন ছিল? আই অ্যাম নট এ ক্রিমিন্যাল।

ক্রিমিন্যাল কিনা সেটা তদন্তের পর বোঝা যাবে। আপনি বোম্বে থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকা। এবং সেটা বোধহয় আইনকে ফাঁকি দিয়েই।

না। আইনকে ফাঁকি দিয়ে নয়। আমি বোম্বেতে থাকার সময় একটা জাহাজের চাকরি পেয়ে যাই। খালাসির কাজ। সেটা আইনসম্মতই ছিল।

কিন্তু আমেরিকার নিউ ইয়র্কে যখন জাহাজটা প্রায় বছরখানেক পরে ভিড়েছিল তখন বোধহয় খুব আইনসম্মত পদ্ধতিতে আপনি জাহাজ থেকে পালাননি।

সেটা বৈধ ছিল না বটে। তাই ওয়াজ এ ডেজার্টার। আমার বহুঁকালের ইচ্ছে ছিল আমেরিকায় গিয়ে সেক্স করব।

আপনি আমেরিকায় বেশ কিছুদিন বড় বড় ট্রাক চালাতেন। তাই না?

হ্যাঁ, আমেরিকায় গিয়ে কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছিল। তখন খুব কষ্ট গেছে। নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়েছিল। শেষে একটা গ্যারাজে জুটে গিয়েছিলাম হেলপার হিসেবে। সেখানেই ওইসব সুপার ট্রাক চালানো শিখে যাই।

অ্যামনেস্টির সুবাদে আপনি মার্কিন নাগরিকত্বও পেয়ে গিয়েছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ। আমার জীবন খুব বিচিত্র।

তাই দেখছি। আমেরিকায় আপনার ক্রিমিন্যাল রেকর্ড ছিল কি?

না।

ঠিক বলছেন?

হ্যাঁ।

সুব্রত বকশি আমাদের জানিয়েছেন আপনি সেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। এবং আপনার বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ ছিল।

চার্জ ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা স্রেফ আমাকে প্যাঁচে ফেলা ছাড়া কিছু নয়।

যে মেয়েটি খুন হয়েছিল তার নাম কি জুলি?

হ্যাঁ, জুলিয়া।

 আপনার স্ত্রী না গার্লফ্রেন্ড?

স্ত্রী নয়, আমি বিয়ে করিনি।

তা হলে গার্লফ্রেন্ড?

বলতে পারেন। তাকে খুন করেছিল একটা একস্ট্রিমিস্ট গ্রুপ। জুলি এক সময়ে ওই গ্রুপের একজন মেম্বার ছিল। তখন বোধহয় টাকাপয়সা নিয়ে কোনও প্রবলেম হয়েছিল।

যাকগে, আমি ওই পয়েন্টে স্টিক করতে চাইছি না।

ধন্যবাদ।

 আপনি বছরখানেক আগে দেশে ফিরে এসেছেন। তাই তো?

হ্যাঁ, এক বছর এক মাস।

কেন বলুন তো? আপনার তো ওখানেই সেক্স করার ইচ্ছে ছিল। এখনও আপনার মার্কিন নাগরিকত্ব বহাল রয়েছে।

সত্যি কথা বললে বলতে হয়, আমেরিকার মোহ আর আমার নেই।

বাঃ, চমৎকার। কিন্তু মোহটা হঠাৎ কেটে গেল কেন?

শুধু টাকা রোজগার করাটা কারও জীবনের লক্ষ হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়।

আপনি কি একজন দার্শনিক?

আজ্ঞে না। আমি দর্শনশাস্ত্র পড়িনি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতাই আমাকে খানিকটা দার্শনিক করেছে।

বাঃ বেশ। কিন্তু এটাও কি সত্যি যে আমেরিকায় আপনি বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি!

এটা কোন সূত্রে জানলেন?

আমাদের মার্কিন সোর্স জানিয়েছেন যে, দীর্ঘদিন ট্রাক চালানো এবং ফিলাডেলফিয়ায় একটা দোকান করার চেষ্টা, এনসাইক্লোপিডিয়া বিক্রি এসব করে আপনাকে পেট চালাতে হয়েছে।

আমি এসব করেছি ঠিকই। তবে অর্ডারটা উলটোপালটা হয়ে গেছে। এনসাইক্লোপিডিয়া বিক্রি ছিল আমার প্রথম দিককার চেষ্টা। তারপর দোকানঘর। তারপর ট্রাক চালানো।

আর কিছু?

হ্যাঁ, আমি মিউজিক গ্রুপে ইনস্ট্রমেন্ট বাজিয়েছি, হোটেলে আসার-এর চাকরি করেছি। শেষ অবধি আমি একটা ব্যাবসা শুরু করি।

সেটা কি একটা জাপানি কোম্পানির সঙ্গে?

আপনি তো সবই জানেন। হ্যাঁ, একটা জাপানি কোম্পানি আমাকে একটা ফ্রানচাইজি দিয়েছিল। সুব্রত বকশির সঙ্গে আমার সেই সূত্রেই ভাব হয়।

তারপর?

আপনি যখন সবই জানেন তখন আর নতুন করে কী বলব?

মানুষ যত কথা বলে ততই আমাদের কাজের সুবিধে হয়।

তা হয়তো হয়। কিন্তু আমাকে ঝুটমুট হয়রান করছেন। সুব্রত বকশি আমাকে পছন্দ করেন না বলেই তিনি আপনাদের নানারকম ইনফর্মেশন দিয়েছেন হয়তো।

সুব্রত বকশির সঙ্গে কি আপনার এক সময়ে খুব বন্ধুত্ব ছিল?

আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি ওই জাপানি কোম্পানির একজন কর্তাব্যক্তি ছিলেন।

তা হলে উনি তো আপনার উপকারই করেছেন।

আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন।

তারপর কী হল? আপনি ওর সুন্দরী স্ত্রীর প্রেমে পড়ে গেলেন। নয় কি? ব্যা

পারটা ওরকমভাবে বললে আমাকে লম্পট বলে ধরে নিতে কি আপনার সুবিধে হয়?

আপনি কি লম্পট নন বলে দাবি করছেন?

আমি স্বভাবগতভাবে অবশ্যই লম্পট নই।

তা হলে মিসেস অরুণিমা বকশির সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কীরকম ছিল? প্লেটোনিক?

সম্পর্কটার জন্য আমাকে দায়ী করা অন্যায় হবে।

খুলে বলুন।

অরুণিমা বকশি সুন্দরী হলেও তরুণী নন। আমার পক্ষে মেয়েদের বয়স অনুমান করা কঠিন। তবে মনে হয় চল্লিশের কাছাকাছি।

সো হোয়াট?

 আপনাকে এ সম্পর্কটা মনে রাখতে বলছি।

বলতে হবে না। অরুণিমা বকশির ডেট অফ বার্থ আমরা জানি। তার বয়স উনচল্লিশ। আপনার বয়স ত্রিশ। ঠিক তো?

হ্যাঁ।

আপনি কি মনে করেন যে, ত্রিশ বছরের এক যুবকের সঙ্গে উনচল্লিশ বছরের এক মহিলার প্রেম হওয়া সম্ভব নয়?

তা হতেই পারে। আজকাল নানারকম রিলেশন তৈরি হচ্ছে।

আপনার ক্ষেত্রে কী হয়েছিল?

সুব্রত বকশি আমাকে বিজনেসের ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। নিউ ইয়র্কে তিনি আমার অফিসেরও ব্যবস্থা করে দেন। তিনি থাকতেন কুইনসে। আমাকে প্রায়ই বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেন। মিসেস বকশিও আমাকে বেশ পছন্দ করতেন।

কী ধরনের পছন্দ?

আমি গেলে খুশি হতেন, লক্ষ করেছি।

তারপর?

দু-তিন মাসের মাথায় তিনি আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন।

সেটা কীরকম ঘনিষ্ঠতা? ফিজিক্যাল?

হ্যাঁ।

আপনিও রাজি হয়ে গেলেন?

আমার উপায় ছিল না। মিসেস বকশিই আসলে কোম্পানি চালাতেন। তার ইচ্ছেতেই সব হত। সুব্রতবাবু ছিলেন ফ্রন্ট মাত্র।

তার মানে আপনি মিসেস বকশিকে খুশি করার জন্যই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন?

আমেরিকায় ফিজিক্যাল রিলেশনটা জলভাত। মিসেস বকশি বাঙালি হলেও ওঁরা দুই পুরুষের আমেরিকান। উনি মার্কিন মেইনস্ট্রিমের মানুষ। বাংলা ভাল বলতেও পারতেন না। কোনও সংস্কারও মানতেন না।

এ ব্যাখ্যা তো আপনার।

আপনি তো আমার ব্যাখ্যাই শুনতে চাইছেন।

ঠিক কথা। বলুন। আপনার ভার্সানটাই শোনা যাক।

আমি আমার ভার্সানটাই বলতে পারি, তা থেকে ডিডাকশন যা করার তা আপনি করবেন। আমার মনে হয় মিসেস বকশি সেই সময়ে সুব্রতবাবুর ওপর আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমাকে উনি একসঙ্গে থাকার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।

লিভিং টুগেদার?

হ্যাঁ, আমি রাজি হইনি।

রাজি না হওয়ার কারণটা কী?

আমি ওঁর প্রতি আসক্ত ছিলাম না। জীবিকার প্রয়োজনেই ওঁকে খুশি করার চেষ্টা করতাম মাত্র।

আপনাকে তো মোটেই ভাল লোক বলে মনে হচ্ছে না মশাই।

আমি ভাল লোক বলে দাবি করছি না। তবে আমি ভীষণ রকমের খারাপ লোকও নই। প্র্যাকটিক্যাল। জীবন সংগ্রাম করতে গিয়ে আমাকে নানারকম আপসরফা করতে হয়েছে।

তাই দেখছি। তা হলে আপনার ব্যাবসা মিসেস বকশির কল্যাণে বেশ ভালই চলছিল?

মোটামুটি। মিসেস বকশি আমাকে ব্যবহার করতেন বটে, তা বলে উনি খুব দরাজ হাতের মহিলা ছিলেন না। খুব হিসেবিই ছিলেন।

তাতে তো আপনার ক্ষতি হয়নি। কারণ আপনি তো আর ওঁদের কর্মচারী ছিলেন না, কোলাবরেটর ছিলেন মাত্র। মিসেস বকশি কৃপণ হলেই বা আপনার ক্ষতি কী?

ঠিক কথা। আপাত দৃষ্টিতে আমার ওপর ওঁর কোনও ফিনানসিয়াল কন্ট্রোল থাকার কথা নয়। কিন্তু মিসেস বকশিকে চিনলে আপনার ধারণা পালটে যেত। উনি আমার কাছ থেকে নিয়মিত নির্দিষ্ট হারে কমিশন নিতেন।

আমেরিকায় ওসব হয় নাকি?

কেন হবে না? সেটা তো আর সাধুর দেশ নয়।

মিসেস বকশি কি সুন্দরী ছিলেন বলে আপনার মনে হয়?

না। তবে নিয়মিত ব্যায়াম ট্যায়াম করে নিজেকে ট্রিম রাখতেন।

মিসেস বকশির সঙ্গে তার হাজব্যান্ডের রিলেশন কীরকম ছিল?

ঝামেলাহীন। দু’জনেই বেশ কুল কাস্টমার। ওঁদের বাড়িতে বা র‍্যানচে যখন গেছি তখন দু’জনকে বেশ ইন্টিমেট বলেই ধারণা হত। ঝগড়া-টগড়া শুনিনি। সুব্রতবাবু তার স্ত্রীর অনুগত ছিলেন বলেই মনে হত।

সুব্রতবাবুর কি এক্সট্রা ম্যারিটাল কোনও রিলেশন ছিল?

 থাকলেও আমি জানি না। আমি নিজের কাজকারবার নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম।

 মিসেস বকশির সঙ্গে আপনার রিলেশনটা সুব্রতবাবু কি টের পাননি?

টের না পাওয়ার কথা নয়। আমার ধারণা সুব্রতবাবু সবই জানতেন।

কীভাবে বুঝলেন?

অন্তত দু’বার উনি আমাকে ওঁর বাড়িতে খুবই অদ্ভুত সময়ে দেখতে পান। তা ছাড়া মিসেস বকশির সঙ্গে উইক এন্ড কাটাতেও আমি কয়েকবার বাইরে গেছি। সুব্রতদার তখন হয়তো কোনও টুর থাকত। কিন্তু টের না পাওয়ার কথা নয়। ওসব উইক এন্ডেও ওঁদের মধ্যে টেলিফোনে কথা হত।

তা হলে ব্যাপারটা খোলাখুলিই হত বলছেন?

হ্যাঁ, অন্তত আমার তাই ধারণা।

আপনি বেশ ফ্র্যাঙ্ক লোক, তাই না। কোনও লুকোছাপা নেই।

আমার জীবনটাই যে ওরকম। লজ্জাশরমের বালাই নেই।

ভাল কথা। আপনি একসময়ে আমেরিকার জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন, তাই তো।

হ্যাঁ, আমার আর ভাল লাগছিল না।

 এই ভাল না লাগার কারণ কি মিসেস বকশি?

উনিও।

নাকি জনা?

 জনা আর আমাকে নিয়ে যা রটনা হয়েছে তার অর্ধেক সত্য।

অর্ধ সত্য নয় তো!

অর্ধ সত্য মানে হাফ টুথ। না, তা নয়।

খুলে বলুন।

জনা সুব্রতদার ছোট বোন। বয়স কুড়ি টুড়ি হবে। সে পড়াশুনো করতে আমেরিকা গিয়েছিল।

এবং গিয়েই আপনার প্রেমে পড়ে গেল তো!

ঠিক তাই।

আপনি মেয়েদের কি খুব সহজেই অ্যাট্রাক্ট করেন?

 আমি কিন্তু করি না। আমার কী করার আছে বলুন ইফ দে ফল ফর মি।

ঠিক কথা, আপনার চেহারাটা অবশ্য খুবই ভাল, বেশ হি-ম্যানের মতো। জনার সঙ্গেও কি আপনার ফিজিক্যাল

না-না, ছিঃ, ও কথা বলবেন না।

তা হলে?

জনা রোমান্টিক মেয়ে। সেক্সি টাইপের নয়।

আপনারা তা হলে প্রেমে পড়ে গেলেন?

ওই তো বললাম, অর্ধেকটা সত্য। জনা প্রেমে পড়ল, কিন্তু আমার তো এত ভাবাবেগ নেই। আমি পোড়-খাওয়া, কাঠখোট্টা মানুষ। জীবনে মহিলা সঙ্গিনীর অভাব কখনও ঘটেনি। চেহারাটাই সেইজন্য খানিকটা দায়ী। প্রেমে পড়ার মতো মনটাই আর আমার নেই। কিন্তু জনা পড়েছিল, স্বীকার করছি।

তাই নিয়েই কি অশান্তি?

হ্যাঁ। মিসেস বকশি জনাকে অপছন্দ করতে শুরু করেন। এবং আমার ওপরেও আধিপত্য বাড়িয়ে দেন।

সেটা কীরকম?

 আমাকে খুবই চোখে চোখে রাখতেন এবং থ্রেট করতেন।

 জনা কতদূর এগিয়েছিল?

ফোন করত। রোম্যান্টিক কথাবার্তা বলত, প্রেমে পড়লে যেমনটা বলে আর কী?

আপনি কি প্রশ্রয় দিতেন?

দিতাম। মেয়েদের আমি সহজে চটাই না।

আপনি বেশ বুদ্ধিমান মানুষ।

বুদ্ধি না হলে কি আমার চলে?

এবার মিসেস বকশির খুনের ঘটনায় আসি।

আমার যা বলার তো বলেছি।

আবার বলুন।

খুনের দিন সকালে আমি মিসেস বকশির সঙ্গে ওঁর আয়রন সাইড রোডের বাড়িতে দেখা করি। উনিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শনিবার ছিল।

কী কথাবার্তা হয়েছিল?

 উনি আমার উপর ভীষণ রেগে ছিলেন।

রাগের কারণ?

সেটাও বলেছি, হঠাৎ আমেরিকা থেকে চলে আসা এবং ওঁদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা হল একটা কারণ। আরও একটা কারণ হল জনা। আমি চলে আসায় জনাও নাকি আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে নিরস্ত করা হয়।

খুনটা হয়েছিল দুপুরে।

খবরের কাগজে তাই তো পড়েছি।

খুনটা আপনি করেননি?

কেন করব সেটা তো বলবেন! মিসেস বকশির সঙ্গে আর আমার বিজনেস রিলেশন

ছিল না। দেশে ফিরে আসি। একে-একে তিনটে ট্রেলার কিনি এবং গত আট মাসে আমার ব্যাবসা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। মিসেস বকশির প্রতি আমার কোনও সেন্টিমেন্টও নেই। খুন করতে যাব কেন?

মিসেস বকশি কি আপনাকে ব্ল্যাকমেল করতে চেষ্টা করেছিলেন?

ব্ল্যাকমেল করার ব্যাপারটা আপনাদের মাথায় কে ঢোকাল কে জানে! আমি তো খোলামেলা মানুষ। যা করেছি তা স্বীকার করি। লুকোনোর তো কিছু নেই আমার। আমাকে ব্ল্যাকমেল করার মতো গুপ্ত কিছুই থাকতে পারে না।

কিন্তু ভাইস ভার্সা। আপনি ওঁকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেননি তো!

আজ্ঞে, সেটাও পুলিশ বলছে। কিন্তু তারা এখনও কোনও সূত্র পাচ্ছে না। আমি বলি কী, একটু স্ট্রং হান ছাড়া আমাকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করাটা কিন্তু হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে।

আপনার পক্ষে মিসেস বকশির গুপ্ত খবর জানা কি অসম্ভব?

 মিসেস বকশি স্ট্রং মাইন্ডেড মহিলা। ওঁর গুপ্ত ব্যাপার বলতে আমার সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশন। তিনি সেটা গোপন করতে যাবেন কোন দুঃখে? সুব্রতদাকে তো ওঁর কোনও ভয় ছিল না। বরং সুব্রতদাই ওঁকে ভয় পেতেন।

আপনার অ্যালিবাই স্ট্রং নয়।

জানি। কিন্তু সেটাই তো কোনও প্রমাণ হতে পারে না।

 মিহিরবাবু, আপনি কিন্তু পুলিশকে যথেষ্ট হেল্প করছেন না।

হেলপ করার দায় কী বলুন। আপনার পুলিশের লোক যদি আমাকে অকারণে হ্যারাস আর থ্রেট না করত তা হলে আমি নিশ্চয়ই হেল্প করতাম। ইন্সপেক্টর নাগ একজন অভদ্র লোক। তিনি আমাকে প্রথম ইন্টেবোগেশনের সময়ে একটা থাপ্পড় মেরেছেন। আর কুৎসিত গালাগালের তো হিসেব নেই। ওঁরা ধরেই নিয়েছেন খুনটা আমিই করেছি, এখন কনফেস করে ফেললেই হয়।

মিস্টার নাগের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি।

কেন, নাগসাহেবের হয়ে আপনি ক্ষমা চাইবেন কেন? আর ক্ষমা চাওয়াটাও অর্থহীন। লোকটাকে দেখেই মনে হয় রাফিয়ান টাইপ। দরকার হলেই ফের চড়-থাপ্পড় মেরে বসবে। আপনি কাজ উদ্ধারের জন্য ক্ষমা চাইছেন বটে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই।

জনাদেবী সম্পর্কে যদি কিছু জিজ্ঞেস করি?

জনা সম্পর্কে যা বলার তো বলেইছি।

আপনি বলেছেন জনাদেবী সম্পর্কে আপনি ইন্টারেস্টেড নন।

হ্যাঁ, এবং সেটা সত্যি কথা। মেয়েদের নিয়ে রোমান্টিক চিন্তা করার সময় আমার হাতে নেই।

জনাদেবী কি এখনও আপনার প্রতি দুর্বল?

 তা জানি না। তবে মাঝে মাঝে চিঠি দেয়, ফোনও করে।

আপনি চিঠির জবাব দেন না?

দিই, দেব না কেন? তবে তাতে ভালবাসার কথা থাকে না।

জনাদেবীর চিঠিতে কি ভালবাসার কথা থাকে?

খুব থাকে। তবে সেসব হচ্ছে শ্যাম্পেনের ফেনার মতো, ওর মধ্যে বস্তু বিশেষ থাকে।

আপনি তো দেখছি নর-নারীর প্রেমে বিশ্বাসী নন।

আপনাকে তো বলেছি, আমি খাটিয়ে পিটিয়ে মানুষ। দেশে ফিরে আসার পর আমাকে নতুন করে আবার জীবন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নেপাল, ভুটান, আসাম, পাঞ্জাব জুড়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।

আপনার ফ্যামিলি সম্পর্কে যদি কিছু জানতে চাই?

 স্বচ্ছন্দে।

আপনার মা-বাবা? বাবা রিটায়ার্ড পোস্টমাস্টার, সামান্য পেনশন পান। মা বরাবর হাউস ওয়াইফ, দু’জনেই নানারকম অসুখে ভুগছেন। আমার দুই দাদা আছেন। একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট–তাঁর প্রচুর পয়সা। তিনি আলাদা হয়ে গেছেন। মেজ দাদাও আলাদা। তিনি চাকরি করেন দিল্লির একটি ইংরেজি পত্রিকায়। মোটামুটি এই হচ্ছে আমার ফ্যামিলি।

মা বাবাকে কে দেখে?

কেউ দেখে না। মা-বাবা দুজনেই এখনও পরস্পরের দেখাশোনা করেন। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর আমি তাঁদের কাছেই থাকি বটে, কিন্তু কাজের চাপে তাদের ওপর বিশেষ নজর দিতে পারি না। কিন্তু এসব জানতে চাইছেন কেন? এগুলো তো আপনার কেসে ইরালেভ্যান্ট।

আমি আসলে আপনাকে অফ গার্ড ধরতে চাইছি। অসতর্ক মনে যদি হঠাৎ কিছু রিল্যাভেন্ট বলে ফেলেন।

মিহির একটু হেসে বলে, আপনার কি এখনও ধারণা যে, আমি সত্য গোপন করছি?

অফ কোর্স! আপনার চোখে-মুখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আপনি সত্যি কথা বলছেন। অন্তত সব সময়ে নয়।

কী যে বলেন শবরবাবু! গোপন করার মতো কিছুই নেই আমার।

এমনও হতে পারে যে, আপনি ইচ্ছে করে গোপন করছেন না। হয়তো যেটা সামান্য কোনও ঘটনা যা হয়তো কোনও একটা কথা বা আচরণ, যেটাকে আপনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না, অথচ সেটা তদন্তের পক্ষে খুবই গুরুতর হয়ে দাঁড়াতে পারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহির বলে, আমি থ্রিলার পড়ি, এক সময়ে আমেরিকায় লং ডিসট্যান্স ড্রাইভের পর মোটেলে সময় কাটানোর জন্য পড়তাম। কাজেই আপনি যা বলছেন তা বুঝতে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু আপাতত কিছুই তেমন মনে পড়ছে না আমার। পড়লে জানাব।

ধন্যবাদ, বাই দি বাই, জনাদেবী দেখতে কেমন তা বলবেন?

অবাক হয়ে মিহির বলে, হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

এমনি, কৌতূহল মাত্র।

মৃদু হেসে মিহির বলল, এ যাবৎ যে কজন পুলিশের লোক দেখেছি তার মধ্যে আপনাকেই ইন্টেলিজেন্ট বলে মনে হয়েছে। ফালতু প্রশ্ন করার লোক আপনি নন। তবে মেয়েদের রূপের ব্যাপারে আমার মতামতকে গুরুত্ব দেবেন না। আমার সৌন্দর্য বিচারের চোখ নেই। আমার একটা খুড়তুতো বোন আছে, তার সঙ্গে আমার খুব ভাব। সে বলে, দুখুদা, তুই কিন্তু তোর পাত্রী দেখতে যাস না, তা হলে একেবারে কেলোর কীর্তি হবে।

শবর মৃদু হেসে বলল, তা হোক। তবু আপনার জাজমেন্টটাই আমি জানতে আগ্রহী।

জনা হল গুঁড়ি গুডি টাইপ। শুনেছি খুব ভাল ছাত্রী। যাদবপুর থেকে এম টেক-এ ফাস্ট ক্লাস পেয়েছিল। ভাল ছাত্রীরা যেমন দেখতে হয় জনা ঠিক তেমনি চোখে ভারী চশমা, মুখ গম্ভীর, হাসিঠাট্টা নেই, কথাবার্তা কম, রং একটু ফ্যাকাশে, স্বাস্থ্য রোগা এবং মুখটা রসকষহীন।

বাঃ, এই তো চমৎকার বিবরণ দিলেন। কে বলল আপনার বিচারকের চোখ নেই?

কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছেন? থ্যাঙ্ক ইউ।

এবার বলি, জনা কেমন টাইপের মেয়ে? ডেসপারেট? রাগী? টেম্পারমেন্টাল? মুডি? না কি ঠান্ডা ভালমানুষ?

বোঝা মুশকিল। ওর এক্সপ্রেশন নেই তেমন। তা ছাড়া আমি ওকে স্টাডি করিনি কখনও। কথাটথা বলতাম ঠিকই, তবে মনোযোগ দিইনি।

সুব্রত বকশি কি তার বোনেরই মতো?

না-না, সুব্রতদা অন্যরকম। দারুণ স্মার্ট, আড্ডাবাজ, বুদ্ধিমান, ডাউন টু আর্থ ম্যান। বেশ ভাল স্কলারও বটে। শুধু ওঁর দাম্পত্য সম্পর্কটাই গোলমেলে।

কীরকম গোলমাল?

সেটাও তো বলেছি আপনাকে।

আবারও না হয় বলুন।

উনি ওঁর স্ত্রীকে খুব তোয়াজ করতেন, খুবই খাতির করতেন, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হত স্ত্রীকে উনি মোটেই ভালবাসেন না।

বিশেষ কোনও লক্ষণ দেখেছেন কি?

ঠিক সেভাবে বলা যায় না। তবে অরুণিমা বকশি যে আমার সঙ্গে ইনভলভড এটা জেনেও ওঁর কোনও ভাবান্তর ছিল না। স্ত্রী ব্যভিচারিণী হলে স্বামীর তো স্বাভাবিকভাবেই রি-অ্যাক্ট করা উচিত, তাই না?

উনি নপুংসক নন তো!

মিহির হেসে ফেলে বলল, তা তো আমার জানা নেই।

 মিসেস বকশি তার স্বামীর সম্পর্কে কোনও মন্তব্য আপনার কাছে করেননি?

না। ওই ব্যাপারে উনি খুব রিজার্ভড ছিলেন। ওঁর স্বামী ইমপোটেন্ট কিনা তা আমাকে বলবার লোক উনি নন। আমাদের ইন্টিম্যাসিটা শুধু ফিজিক্যাল লেভেলেই ছিল, হৃদয়ঘটিত নয়।

তা হলে উনি জনাকে হিংসে করতেন কেন?

ফিজিক্যাল পজেশনও তো একটা পজেশন। উনি ওটাও ছাড়তে চাননি।

ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গটা থাক। এবার মিসেস বকশির মৃত্যুর প্রসঙ্গে আসি। উনি মারা যাওয়ায় আপনি কি দুঃখ পেয়েছেন?

যে কারও মৃত্যুই দুঃখজনক।

 আপনি আপনার কথা বলুন।

হ্যাঁ, আই ফেল্ট স্যাড।

 কে ওঁকে খুন করতে পারে বলে মনে হয়?

 নো আইডিয়া। পুলিশ যে কতবার কতভাবে এ প্রশ্ন করেছে তার হিসেব নেই।

জানি, পুলিশকে একই প্রশ্ন বারবার করতেই হয়।

উইথ থার্ড ডিগ্রি?

শবর দাশগুপ্ত ম্লান একটু হেসে বলল, পুলিশের কাজ তো ভাল কাজ নয়। অপরাধী আর অপরাধ যে কত জটিল আর কুটিল তা যদি জানতেন তা হলে রাগ করতেন না।

পুলিশের কাজ কীরকম এবং কাদের নিয়ে তা আমি খানিকটা জানি। কিন্তু ইন্টেলিজেন্ট হতে পুলিশের বাধা কোথায় বলুন তো! আপনাদের ওই মিস্টার নাগের কথাই ধরুন, কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ উনি ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলেন! যেন মারের চোটেই আমি স্বীকারোক্তিটা করে ফেলব। আমি ওঁকে উলটে মারলে কী হত জানেন?

জানি। আপনি ফিজিক্যালি একজন স্ট্রং ম্যান। হয়তো ক্যারাটে জানেন।

ক্যারাটে জানি বলেই রক্ষে। আমরা ক্যারাটের সঙ্গে ধৈর্য ও স্থৈর্যও শিখেছি। কাজেই চরম প্রয়োজন ছাড়া কাউকে মারি না। মার্শাল আর্ট তো মারপিট নয়, ওটা একটা ধরন।

জানি। তবে আমি তো নাগ নই, আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করিনি।

আপনার কথা আলাদা। আপনি শুধু ভাল ব্যবহারই করেননি, অকারণ হাজতবাসের হাত থেকেও মুক্তি দিয়েছেন। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

ধন্যবাদ, আশা করি আপনি কো-অপারেট করবেন।

করব। আপনার মোডাস অপারেন্ডি খুবই বাস্তবসম্মত এবং লজিক্যাল। মিসেস বকশির খুনিকে ধরতে যদি পারেন তা হলে আমি খুশিই হব। কিন্তু মুশকিল হল আমার কাছে তেমন কোনও তথ্য নেই যা আপনার সাহায্যে আসতে পারে।

ধন্যবাদ। মিসেস বকশি কীভাবে খুন হন তা তো আপনি জানেনই।

হ্যাঁ, গলা টিপে ওঁকে খুন করা হয়েছিল।

ওঁর বাড়িতে আপনি গিয়েছিলেন সকাল আটটা বেজে পনেরো মিনিটে। ঠিক তো?

 দু’-এক মিনিট এদিক-সেদিক হতে পারে। তবে মোটামুটি সোয়া আটটাই ধরে নিতে পারেন।

বাড়িতে গিয়ে কী দেখলেন?

 বিশাল বাড়ি, বিরাট কম্পাউন্ডও, মিসেস বকশিদের ফ্যামিলি বনেদি বড়লোক। আয়রন সাইড রোডের মতো ঘ্যাম জায়গায় ওরকম বাড়ির দাম কয়েক কোটি টাকা।

সে তো বটেই।

বাড়ি দেখেই আমি ট্যারা হয়ে গিয়েছিলাম। শুনেছি, একজন দারোয়ান আর একটা চাকর সেই বাড়ি মেনটেন করে।

ঠিকই শুনেছেন। তারপর বলুন, সকাল সোয়া আটটায় পৌঁছে আপনি কী দেখেছিলেন?

নাথিং অফ এনি ইমপর্টেন্স। ফটক দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান আটকাল। তার কাছে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক থাকে। সেটা দেখে ছেড়ে দিল। আমি দু’-এক মিনিট দাঁড়িয়ে বাগানটা দেখলাম। তারপর বৈঠকখানায় ঢুকলাম। একজন চাকর এসে স্লিপ লিখিয়ে নিয়ে ভিতরে গেল। দু’-তিন মিনিটের মধ্যেই মিসেস বকশি এসে ঘরে ঢুকলেন।

ডিসক্রাইব হার। ওঁকে কীরকম মুড আর পোশাকে দেখলেন?

 গায়ে একটা কিমোনো ছিল। গাঢ় বেগুনি রঙের ওপর একটা ড্রাগন আঁকা। মনে হল খটি জাপানি জিনিস। এ তো গেল পোশাক। আর মুড একটু অফ ছিল। আমাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন।

চাকরবাকরদের সামনেই?

চাকরটা বোধহয় তখন বেরিয়ে গিয়েছিল। ঠিক লক্ষ করিনি। তবে কে দেখল না-দেখল উনি তার পরোয়া করতেন না।

আপনার কি মনে হয় না যে উনি আপনার প্রতি ইমোশনালি অ্যাটাচড ছিলেন।

সেদিনই প্রথম মনে হল, মে বি শি ইজ সিরিয়াসলি ইন লাভ উইথ মি।

আগে মনে হয়নি?

ইমোশনের চেয়ে ওঁর বোধহয় সেক্সয়াল আর্জটাই বেশি ছিল বলে মনে হত।

উনি আপনাকে চিঠিপত্র লিখতেন না?

 হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে লিখতেন।

লাভ লেটার?

ঠিক লাভ লেটার বলা যায় না। আমি হঠাৎ আমেরিকার কারবার গুটিয়ে চলে আসায় উনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ওঁর ধারণা ছিল আমি ওঁকে বিট্রে করেছি।

আপনি হঠাৎ চলে এলেন কেন?

হঠাৎ করে আসিনি। মাস দুই ধরে ধীরে ধীরে কাজকারবার গুটিয়ে তৈরি হয়েই এসেছি। তবে ব্যাপারটা সুব্রতদা বা তার স্ত্রীকে জানাইনি।

জানাননি কেন?

আমার বিশ্বাস ওঁরা বাগড়া দিতেন। বিশেষ করে মিসেস বকশি।

ওঁদের তো সন্তান নেই, না?

না। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

এমনি, হঠাৎ মনে হল।

 ওঁরা অবশ্য অ্যাডপ্ট করার কথা ভাবছিলেন।

অ্যাডপ্ট কি শেষপর্যন্ত করেছেন?

যতদূর জানি, না।

সুব্রতবাবুর বয়স এখন কত? আপনারা তো তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, আপনারাই তো সেটা জানবেন।

 আমি এই কেসটা সদ্য হাতে নিয়েছি। সুব্রতবাবু তার আগেই আমেরিকায় ফিরে গেছেন। ওঁর বায়োডাটা এখনও আমার স্টাডি করা হয়নি।

পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে।

বিয়ে করার বয়স আছে বলছেন।

নিশ্চয়ই। ও দেশে এখনও অনেকে এই বয়সে প্রথম বিয়ে করে।

আপনি কি সত্যিই জানেন না সুব্রতবাবুর কোনও প্রেমিকা বা বান্ধবী আছে কিনা।

সত্যিই জানি না।

 থাকা কি সম্ভব?

 থাকতেই পারে। কোয়াইট নরমাল।

হ্যাঁ, তারপর অরুণিমা বকশির সঙ্গে আপনার দেখা হওয়ার ঘটনাটা বলুন।

 উনি আমাকে এমব্রেস করলেন, বলেছি তো।

 হ্যাঁ।

 কিছুক্ষণ একটু ইমোশনাল কথাবার্তাও বললেন, তার মধ্যে প্রেমের কথাই ছিল, ওঃ আই লাভ ইউ সো মাচ! আই মিস ইউ সো মাচ! ওঃ ডিয়ারেস্ট, ওঃ ডার্লিং, ওঃ সুইটহার্ট! এইসব আর কী।

আপনার রিঅ্যাকশন কী হল?

খুব একটা কিছু নয়। বরং বছরখানেক বাদে ফের এইসব আমার খারাপই লাগছিল। ভদ্রমহিলার জন্য একটু দুঃখও হচ্ছিল।

এনি সেক্স?

বি সেনসিবল মিস্টার দাশগুপ্ত। ইট ওয়াজ আর্লি ইন দি মর্নিং এবং আমাদের আগের রিলেশনটাও তখন ছিল না, অন্তত আমি এখন একদম আলাদা মানুষ।

ওকে, ওকে। ঝগড়া হল কেন?

 ঝগড়া। না ঝগড়া হয়নি। ঝগড়া হতে দুটো পক্ষ লাগে। আমি সম্পূর্ণ প্যাসিভ ছিলাম। উনি একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন।

উত্তেজিত হলেন কেন?

উনি পুরনো কথা তুলে আবার আমাদের আগের সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেন, আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার জন্য ঝোলাঝুলি করতে থাকেন, এমনকী সুব্রতদাকে ডিভোর্স করে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেছিলেন। দেখলাম ভদ্রমহিলা আমার জন্য বেশ পাগল হয়ে উঠেছেন। খুব ডেসপারেট, অথচ আমি ওঁকে কুল ক্যালকুলেটিং অ্যান্ড ক্রুয়েল টাইপের বলে জানতাম। বেহিসেবি হওয়ার মতো মহিলা উনি ছিলেন না।

আপনি ওঁর প্রস্তাবে সায় দেননি বোধহয়?

দেওয়া সম্ভব ছিল না। আমার জীবনের ধারা পালটে গেছে। তা ছাড়া, আপনাকে তো বলেইছি আমি ওঁর প্রতি কখনও অ্যাট্রাকটেড ছিলাম না, উনি আমাকে ব্যবহার করেছেন, আমিও নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছি লাইক এ গিগোলো, তার বেশি কিছু নয়।

সেদিন কি ওঁর প্রস্তাবে আপনি রেগে গিয়েছিলেন?

একটুও না। বলেছি তো, ভদ্রমহিলার জন্য আমার করুণা হচ্ছিল, আমি খুব শান্তভাবে ওঁকে বোঝনোর চেষ্টা করছিলাম, লজিক্যালি, কিন্তু উনি ক্রমশ রেগে উঠছিলেন, ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন।

রেগে গিয়ে উনি কী করলেন?

চেঁচামেচি করলেন, কাঁদলেন, আমাকে যা খুশি বলে অপমান করলেন, আমি কিছুই গায়ে মাখিনি।

বাড়িতে কজন ঝি-চাকর ছিল বলে আপনার অনুমান?

খুব বেশি নয়। দারোয়ান আর একজন চাকরকেই আমি দেখেছি।

কোনও মহিলা?

 না, কারও কোথাও সাড়াশব্দও পাইনি।

বাই দি বাই, আপনি সেদিন কীসে করে ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন?

আমার একটা গাড়ি আছে।

নিজে চালান?

তা তো বটেই।

 কী গাড়ি আপনার?

 হুন্ডাই।

মিসেস বকশি কি আপনাকে মারধর করেছিলেন?

উত্তেজনার বশে উনি আমাকে একটা চড় মারেন এবং গালে খিমচে দেন। পুলিশ সেই দাগ থেকে ধারণা করে নেয় যে, আমি যখন ওঁকে গলা টিপে মারছিলাম তখন নাকি উনি আত্মরক্ষার জন্য আমাকে খিমচে দিয়েছিলেন, পুলিশ খুব সরল পথে চলতে চায়, তাই না?

ব্যাপারটাকে আপনিই বা জটিল ভাবছেন কেন?

আমি জটিল ভাবছি না, আপনারা যত সরল সিদ্ধান্তে আসছেন আমার পক্ষে পরিস্থিতি ততই জটিল হয়ে উঠছে। এই যে আপনি আমাকে তলব করে লালবাজারে টেনে এনেছেন তাতে আমার কত জরুরি কাজ পণ্ড হচ্ছে তা কি জানেন?

কেসটা খুনের, তাই আমাদের একটু সিরিয়াস হতে হয়েছে। তার ওপর সুব্রত বকশির কিছু পাওয়ারফুল কানেকশান আছে বলে আমাদের ওপর প্রেশার আসছে। যদিও আপনার একটু হ্যারাসমেন্ট হচ্ছে তবু একটু বিয়ার করুন, আপনাকে হয়তো আরও ইন্টারোগেট করা হবে। আপনি ওঁর সঙ্গে কতক্ষণ ছিলেন?

খুব বেশি হলে ঘণ্টা খানেক।

 তার বেশি নয়?

না, বরং দু’-চার মিনিট কমই হবে।

যখন আপনি চলে আসেন তখন কি মিসেস বকশি শান্ত ছিলেন? মানে প্যাসিফয়েড হয়েছিলেন কি?

না। উই পার্টেড উইথ এ বিটার নোট। শি ওয়াজ আপসেট।

আর আপনি?

আমি খুবই হেলপলেস ফিল করেছিলাম। মিসেস বকশির মতো কঠিন মানুষ যে এতটা ইমোশনাল হতে পারেন সে ধারণা আমার ছিল না। এ যেন মিসেস বকশি নয়, অন্য কেউ। যেন বয়ঃসন্ধির কিশোরী। সাধারণত কম বয়সে প্রথম প্রেমে দাগা খেয়ে মেয়েরা ওরকম ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু মিসেস বকশির মতো প্র্যাকটিক্যাল ডাউন টু আর্থ সেনসিবল মহিলাদের এরকম হওয়ার কথা নয়।

আপনার কি মনে হয় উনি অভিনয় করছিলেন?

না, একেবারেই না। অভিনয় করবেন কেন?

আপনাকে ইমপ্রেস করার জন্য।

না-না মিস্টার দাশগুপ্ত, অভিনয় হতেই পারে না, অভিনয় হলে ঠিকই ধরতে পারতাম।

তা হলে এই নতুন রূপের মিসেস বকশিকে দেখে আপনি ইমপ্রেসড?

তা এক রকম বলতে পারেন।

আপনি কি একটুও সফট হয়ে পড়েননি?

সফট কথাটার যদি বাঁকা অর্থ না ধরেন তবে বলতে পারি, হ্যাঁ, ওঁর প্রতি সহানুভূতিও হচ্ছিল। কিন্তু আমি একজন ওয়েদারবিটুন ম্যান, বয়স ত্রিশ হলেও অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া মানুষ। সহানুভূতি হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা কোনও দুর্বলতা নয়। ওঁকে আর প্রশ্রয় দেওয়া বা ওঁর কুক্ষিগত হয়ে পড়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

খুনটা কখন হয় তা কি আপনি জানেন?

আপনাদের কাছ থেকেই জেনেছি। দুপুর দুটো-আড়াইটে নাগাদ।

 সে সময়ে আপনি কোথায় ছিলেন?

 সেও পুলিশকে বলেছি, তারা আমার কথা বিশ্বাস করছে না।

তবু আর একবার বলুন। আমি হয়তো বিশ্বাস করতেও পারি।

দুপুর একটা-দেড়টা থেকে বিকেল চারটে অবধি আমি আমার একটা ট্রাকের মধ্যে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলাম।

কোথায়?

বেলতলায় আমার ট্রলারগুলো রাখার জন্য আমি একটা জমি লিজ নিয়েছি। ছোটখাটো সারাইয়ের কাজও হয়। সেদিন আমি নিজেই আমার ট্রাকের একটা জখম চাকা মেরামত করছিলাম। খুব পরিশ্রান্ত হওয়ায় ড্রাইভারের কেবিনে উঠে শুয়ে পড়ি।

কোনও সাক্ষী আছে?

না।

আপনার গ্যারেজ পাহারা দেয় কে?

ওয়াচম্যান আছে।

ওয়াচম্যান আপনাকে দেখেনি?

সেদিন ওয়াচম্যান ছুটি নিয়েছিল। ভোররাতে তার মা মারা যায়। ফলে কেউ ছিল না। ওয়াচম্যানকে পুলিশ জেরাও করেছে।

জানি। মিসেস বকশির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনি কোথায় গেলেন?

ডোভার লেনে আমার অফিসে। সেদিন আমার দম ফেলার সময় ছিল না। সেখান থেকে বেরিয়ে বেলতলায় যাই।

আপনার অ্যালিবাই কিন্তু দুর্বল।

কান্ট হেলপ ইট। এবার কি আমি যেতে পারি?

 পারেন। আসুন।