সাধুবাবার লাঠি – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
আদায় উসুল সেরে গেজেতে টাকা ভরে কোমরে ভাল করে পেঁচিয়ে বেঁধে যখন নবীন গাঁয়ে ফেরার জন্য রওনা হল, তখন খেয়াল হল, শীতের বেলা ফুরিয়ে এসেছে। সন্ধে হয় হয়। বড্ড দেরি করে ফেলেছে সে। হরিপুর অনেকটা রাস্তা। প্রায় মাইলতিনেক। তার মধ্যে আড়াই মাইল হল গে জনমানবহীন ভুরফুনের মাঠ। ও মাঠে কোথাও বসতি নেই। মাঝে মাঝে জংলা জায়গা, জলা, একটা ভাঙা কেল্লা আর কিছু উদোম নিস্ফলা মাঠ। তার ভিতর দিয়েই এবড়োখেবড়ো মেঠো রাস্তা নানা বাঁক নিয়ে হরিপুর ঘেঁষে নয়াগঞ্জ অবধি চলে গেছে। সাইকেলখানা থাকলেও হত। কিন্তু সেখানা এই কাল রাতেই চুরি হয়ে গেছে ভিতরের বারান্দা থেকে। কাজেই হেঁটে আসতে হয়েছে নবীনকে। হেঁটেই ফিরতে হবে। সঙ্গীসাথী থাকলেও হত। কিন্তু কপাল খারাপ। আজ সঙ্গীসাথীও কেউ নেই। ভুরফুনের মাঠের বদনাম আছে। একসময়ে ঠ্যাঙাড়ে, ঠগিদের অত্যাচার ছিল খুব। এখন সে আমল নেই বটে, কিন্তু খারাপ লোকের তো আর আকাল পড়েনি। তা ছাড়া অন্য সব কথাও শোনা যায়। পারতপক্ষে রাতবিরেতে ও পথে কেউ পা বাড়ায় না।
কিন্তু ভয়ের কথা ভাবলেই ভয় আরও বেশি করে চেপে ধরে। ফিরতে যখন হবেই তখন ঠাকুরের নাম নিয়ে বুক ঠুকে রওনা হওয়াই ভাল।
হরিবোলজ্যাঠা মস্ত মহাজন। তার আড়তেই নবীনদের ধান, চাল, গম, আলুর চালান বেশি। অন্য সব মহাজনও আছে। সব মিলিয়ে
আদায় আজ বড় কম হয়নি। হরিবোলজ্যাঠা হাফ চশমার উপর দিয়ে তলচক্ষুতে চেয়ে বলল, “ওরে নবীন, সন্ধে করে ফেললি বাপ, অতগুলো টাকা নিয়ে রাতবিরেতে যাবি! বরং আজ গদিতেই থেকে যা। ভোর-ভোর রওনা হয়ে পড়বি।”
নবীনের সে উপায় নেই। আজ হরিপুরে মস্ত যাত্রার আসর। ব্যবস্থাপকদের মধ্যে নবীনও আছে। মাথা নেড়ে বলল, “তাড়া আছে জ্যাঠা। নইলে থেকেই যেতাম।”
“তা হলে বরং একটা লাঠিসোটা কিছু সঙ্গে রাখ। বদ বজ্জাতরা হাতে লাঠি দেখলে তফাত যাবে।”
“লাঠিকে আজকাল কেউ ভয় পায় না জ্যাঠা। বিপদে পড়লে বরং দৌড় লাগানো ভাল।”
“দুর বোকা, লাঠিই মানুষের চিরকেলে অস্তর। অন্তত শেয়াল কুকুর তাড়া করলে তো কাজে দেবে। সঙ্গে থাকলে একটা বলভরসা হয়। দাঁড়া, দেখি আমার কাছে কিছু আছে কিনা।”
হরিবোলজ্যাঠার গদির তক্তপোশের তলা থেকে গোটাকয়েক ধুলোমলিন লাঠি টেনে বের করল গদির কর্মচারী জগা। ন্যাকড়া দিয়ে মুছেটুছে হরিবোলজ্যাঠার সামনে রাখল। জ্যাঠা ভাল করে নিরখ পরখ করার পর একখানা লম্বা পাকা বাঁশের লাঠি তুলে নিয়ে বলল, “তুই এইটে নিয়ে যা। কয়েক বছর আগে হিমালয় থেকে এক সাধু এসে দিয়ে গিয়েছিল। পায়ে ঘা হয়ে দিনকতক আমার চণ্ডীমণ্ডপে ছিল বেচারি। রামকবিরাজকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে ঘা সারিয়ে দিয়েছিলাম। সাধু যাওয়ার সময় লাঠিগাছ দিয়ে গিয়েছিল। আমার তো কোনও কাজে লাগে না। তুই-ই নিয়ে যা। তোকে দিলাম।”
নবীন দেখল, লাঠিটা তার মাথার সমান লম্বা। আর খুব ভারী। লাঠির দুই প্রান্ত লোহায় বাঁধানো। নিরেট, মজবুত লাঠি। হাতে নিলে একটা ভরসা হয়। আরও একটা ভরসার কথা হল, আজ শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী। সুতরাং সন্ধের পর জ্যোৎস্না ফুটবে।
হরিবোলজ্যাঠার আড়ত থেকে বেরিয়ে ভেলুর দোকানে গিয়ে ঢুকল নবীন। এ-দোকানের বিখ্যাত শিঙাড়া আর জিলিপি না খেলে জীবনই বৃথা। ফুলকপি, আলু, কিশমিশ আর বাদাম দিয়ে শিঙাড়াটা যা বানায় ভেলু, তেমনটি এ-তল্লাটে আর কেউ পারে না। জিলিপিটাও সাড়ে সাত প্যাঁচের মধুচক্র। দেরি যখন হয়েই গেছে তখন আর পনেরো মিনিটে কী-ই বা ক্ষতি! খিদেপেটে তিন মাইল হাঁটাও সম্ভব নয়।
ভেলুর দোকানে যেন রাসমেলার ভিড়, গঞ্জে যত ব্যাপারী মাল গন্ত করতে আসে সবাই হামলে পড়ে এই দোকানটাতেই। কাজেই নবীনকে নানা কসরত করে শিঙাড়া, জিলিপি জোগাড় করতে হল। তাতেও গেল মিনিট দশেক। এক কোণে বসে মন দিয়ে খাচ্ছিল সে। উলটো দিকে বসা রোগা সুডুঙ্গে চেহারার খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা একটা লোক বলল, “ভাই, তুমি লেঠেল নাকি?”
নবীন একটু অবাক হয়ে চাইল। তারপর নিজের হাতে ধরা লাঠিটা খেয়াল হল তার। বলল, “তা বলতে পারেন।”
“প্যাঁচপয়জার জানা আছে তা হলে?”
“তা একটু-আধটু জানি বই কী!”কথাটা অবশ্য ডাহা মিথ্যে। নবীন কস্মিনকালেও লাঠি খেলতে জানে না। তবে লাঠিটা হাতে থাকায় তার বেশ একটা বলভরসা হচ্ছে।
ঢ্যাঙা লোকটা একটা কচুরিতে কামড় দিয়ে বলল, “সনাতন ওস্তাদের নাম শুনেছ?”
নবীন নির্বিকার মুখে বলল, “আজ্ঞে না।”
“সেকী হে! লাঠিবাজি করো আর ওস্তাদ সনাতনের নাম জানো?”
“তিনি কে বটেন?”
আলুর ঝোল সাপটানো কচুরিটা মুখে পুরে কাঁধের গামছায় হাত পুঁছে তাড়াতাড়ি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে লোকটা বলল, “নমস্য ব্যক্তি হে, নমস্য ব্যক্তি। আমিও কিছুদিন তাঁর শাগরেদি করেছিলুম। তা পেটের ধান্দায় বেরিয়ে পড়তে হল বলে বিদ্যেটা শেখাই হল না। বলি পটাশপুরের নাম জানা আছে?”
শিঙাড়া চিবোতে-চিবোতে আরামে নিমীলিত চোখে চেয়ে নবীন বলল, “আজ্ঞে না।”
“ভূগোলে তো দেখছি তুমি খুবই কাঁচা হে।”
“আজ্ঞে, বেজায় কাঁচা।”
“এখান থেকে যদি পুবমুখো রাস্তাটা ধরো তা হলে মাইলপাঁচেক গেলে বিষ্ণুপুর গাঁ। সেখান থেকে বাঁ হাতে যে রাস্তাটা গড়সীতারামপুর গেছে সেটা ধরে ক্রোশ দুই গেলে শ্মশানেশ্বরী কালীমন্দির। ভারী জাগ্রত দেবী, একসময়ে নরবলি হত। সেখান থেকে ডানহাতি কাঁচা রাস্তা ধরে আরও ক্রোশ দুই গেলে বাতাসপুর। বলি বাতাসপুরের নাম শুনেছ?”
“কস্মিনকালেও না।”
“সেখানকার যজ্ঞেশ্বরের মন্দিরের লাগোয়া পুকুরে পাঁচশো হাজার বছর বয়সি ইয়া বড় বড় কাছিম গিজগিজ করছে। এক-দেড় মন ওজন, বাতাসপুরের গুড়ের বাতাসা বিখ্যাত জিনিস, আড়ে-দিঘে এক বিঘত করে, ওজনদার জিনিস।”
“কথাটা হচ্ছিল পটাশপুর নিয়ে।”
“আহা বাতাসপুরে পৌঁছেলে, আর পটাশপুর তো এসেই গেল প্রায়।”
“পৌঁছে গেছি! বাঃ।”
“না হে, পৌঁছোওনি। ওখানে একটি বাধক আছে। বাতাসপুরের ধারেই একটা পাজি নদী আছে। ধলেশ্বরী। চোত-বোশেখে তেমন
তেজি নয়, কিন্তু জষ্টি থেকে মাঘ-ফাল্গুন অবধি একেবারে ভৈরবী। খেয়া পার হওয়াই কঠিন। তা ধলেশ্বরী পেরোলেই নয়াগঞ্জ। দিব্যি জায়গা। রোজ বাজার বসে, বুধবারে হাট, পয়সাওলা লোকের অভাব নেই। নয়াগঞ্জের বেগুন খেয়েছ কখনও? মনে হবে বেগুন তো নয়, মাখন। লোকে বলেও তাই, মাখনি বেগুন।”
“তা বেগুনের পরেই কি পটাশপুর?”
“আরে, অত তাড়াহুড়োর কী আছে? চারদিক দেখতে-দেখতে চাখতে-চাখতে যাওয়াই তো ভাল। নয়াগঞ্জে আমার খুড়শ্বশুরের বাড়ি যে হে। বিশাল তেলের কারবার। মাস গেলে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা রোজগার। পেল্লায় দোতলা বাড়ি, সঙ্গে আমবাগান। সেখানে দুদিন বডি ফেলে দিলে দিব্যি তাজা লাগবে। যত্নআত্তি করে খুব। দু’বেলা গরম ভাতে ঘি, শেষপাতে ঘন দুধ আর মর্তমান কলা বাঁধা। নয়াগঞ্জ থেকে তোর-ভোর বেরিয়ে পড়লে দুপুর নাগাদ দুধসাগরে পৌঁছে যাবে। দুধসাগরের রাজবাড়ি তো দ্যাখোনি! দেখার মতোই বাড়ি। সাত-সাতটা মহাল। তবে এখন সবই ভগ্নদশা। বুড়ো রাজা এখনও বেঁচে আছেন। মাথায় একটু গণ্ডগোল, সারাদিন বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ান আর বিড়বিড় করেন। ভাঙা পাঁচিলের ফাঁকফোকর দিয়ে রাজ্যের গোরু-ছাগল ঢুকে রাজবাড়ির বাগানে ঘাস খায়।”
“তা হলে পটাশপুরে আর পৌঁছোনো হল না আজ! আমাকে উঠতে হবে মশাই, একটু তাড়া আছে।”
“আহা, পটাশপুর তো এসেই গেছে হে। দুপুরটা দুধসাগরে জিরিয়ে নাও, তারপর পড়ন্তবেলায় যদি হাঁটা ধরো তা হলে পদ্মপুকুরে পৌঁছোতে সন্ধে। রাতটা জিরেন নাও। পদ্মপুকুর বিরাট গঞ্জ জায়গা। আগরওয়ালাদের ধর্মশালায় দিব্যি ব্যবস্থা। তিন টাকায় শতরঞ্চি আর কম্বল পাওয়া যাবে, সঙ্গে খাঁটিয়া। রাতে তিনটি টাকা ট্যাঁক থেকে খসালে তেওয়ারির হোটেলে চারখানা ঘি মাখানো গরম রুটি আর ঘ্যাঁট পাওয়া যাবে। আর একখানা আধুলি যদি খসাও তা হলে ঘন অড়হরের ডাল। আর চাই কী? তারপর ঘুমখানা যা হবে না, একশো ছারপোকার কামড়ও টের পাবে না।”
“আচ্ছা আচ্ছা মশাই, বাকিটা পরেরবার শুনব’খন। আমাকে এখনই ফিরে যেতে হবে।”
“ওরে বাপু, আমিও কি এই অখদ্দে মাধবগঞ্জে পড়ে থাকব নাকি? আমাকে তো উঠতে হবে হে৷ এখনও তো দেড়খানা জিলিপি তোমার পাতে পড়ে আছে। ওটুকু খেতে-খেতেই আমার কথা ফুরিয়ে যাবে। পদ্মপুকুরের কথা যা বলছিলাম, ওখান থেকে সকালে বেরিয়ে পড়লে পটাশপুর আর কতদূর? মাঝখানে শুধু দোহাটা আর মুগবেড়ে। দোহাটার কথা না হয় আজ থাক। তবে মুগবেড়ে কিন্তু খুব ভূতুড়ে জায়গা। চারদিকে বাঁশবন আর একশো-দেড়শো বছরের বট-অশ্বখ গাছ। দিনের বেলাতেও গা-ছমছম করে। মেলা তান্ত্রিক আর যোগী পুরুষের বাস। যারা ভূতে বিশ্বাস করে না তাদের যদি একবার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারো, তা হলে দেখবে রাম রাম করে পালাবার পথ পাবে না। সন্ধের পর তো ভূতের একেবারে মোচ্ছ লেগে যায়। চারদিকে ভাম-ম গন্ধ, চিমসে গন্ধ, প্রাণ জল করা হি হি হাসি, খখানা সুরের ফিসফাস। বাপ রে, হাজারে বিজারে অশরীরী।”
“আমার জিলিপি কিন্তু আর আধখানা আছে।”
“ওতেই হবে। একটু চিবিয়ে খাও। মুগবেড়েতে রাতে থাকার সুবিধে নেই, দরকারও নেই। বরং একটু জোর পায়ে হেঁটে জায়গাটা পেরিয়ে গিয়ে এক ক্রোশ দক্ষিণে ছোট পিশুনিয়া গ্রামে দিঘির ধারে গোবিন্দর তেলেভাজার দোকানে বসে একপেট মুড়ি-বেগুনি সাঁটিয়ে নাও। ঘুগনিটাও বড্ড ভাল বানায়। ছোট পিশুনিয়ায় যা খাবে নির্ভয়ে খেতে পারো। শুধু খাওয়ার পর একঘটি জল খেয়ে নিয়ো, ঘণ্টাটাক বাদে পেট খিদের চোটে হাঁচোড়পাঁচোড় করবে।”
“এই যে, জিলিপির শেষ টুকরোটা মুখে দিলাম কিন্তু।”
“আহা, গিলে তো খাবে না হে বাপু। চিবোতে একটু সময় তো লাগবে। তারিয়ে-তারিয়ে খাও। বলছিলুম ছোট পিশুনিয়া থেকে চারদিকে চারটে পথ গেছে। পশ্চিমের পথ ধরে নাক বরাবর দু’ক্রোশ গিয়ে লতাবেড়ের জঙ্গল। ঘাবড়িয়ো না, আজকাল আর বাঘ-ভালুক নেই। কয়েকটা শেয়াল আর এক-আধটা নেকড়ে থাকতে পারে। নির্ভয়ে ঢুকে যাও জঙ্গলে। ঘণ্টাদুই হেঁটে জঙ্গল থেকে বেরিয়েই দেখবে পটাশপুর তোমার জন্য কোল পেতে বসে আছে।”
“যাক বাবা, পৌঁছোনো গেল তা হলে।”
“সবুরে মেওয়া ফলে হে বাপু। এই যে পথটা চিনিয়ে দিলুম, এখন চোখ বুজেও যেতে পারবে।”
“চেষ্টা করে দেখব’খন। তা হলে আজ আসি।”
“ওরে বাপু, এত কষ্ট করে পটাশপুরে যে পৌঁছোলে তাতে লাভটা কী হল সেটা তো জানা থাকা চাই।”
“লাভ-লোকসান ঠিক বুঝতে পারছি না। মাথা ঘুরছে।”
“ওহে বাপু, ওখানেই তো সনাতন ওস্তাদের বাস।” নবীন অবাক হয়ে বলল, “সনাতন ওস্তাদ! সে আবার কে?”
“তুমি দেখছি বড্ড আহাম্মক হে! সনাতন লেঠেলের কথাতেই তো পটাশপুরের কথা উঠল।”
“তা বটে। কিন্তু কথাটা উঠছে কেন?”
“উঠবে না! যেখানেই লাঠি সেখানেই সনাতন ওস্তাদের কথা। ভূ-ভারতে ওরকম লাঠিয়াল পাবে না। যদি লাঠিবাজিই করতে চাও তবে একবার পটাশপুরে গিয়ে সনাতন ওস্তাদের আখড়ায় তালিম নিয়ে এসো। লাঠি কীভাবে ধরতে হয়, সেটা শিখতেই ছ’মাস লাগে। লাঠি দেখতে নিরীহ ঠ্যাঙা, কিন্তু ওনার হাতে পড়লে বন্দুকের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। তাই বলছিলুম–”
নবীন উঠে পড়ল। বলল, “কে বলেছে মশাই, যে আমি লাঠিখেলা শিখতে চাই? আমার পটাশপুরে যাওয়ারও ইচ্ছে নেই, সনাতন ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়ারও দরকার নেই। বুঠমুট আমার খানিকটা সময় নষ্ট করলেন।”
লোকটা সরু চোখে চেয়ে বলল, “তোমার ভালর জন্যই বলছিলাম বাপু। ট্যাঁকে না তোক হাজারত্রিশেক টাকা নিয়ে রাতবিরেতে ভুরফুনের মাঠ পেরোতে হলে শুধু ভগবানের ভরসা না রাখাই ভাল। তা হাতের লাঠিখানা যদি চালানোর বিদ্যে জানা থাকত তা হলে খারাপটা কী হত শুনি!”
নবীন হাঁ। বাস্তবিক আজ তার গেজেতে ত্রিশ হাজার টাকার মতোই আছে। যে খবর এ লোকটার জানার কথা নয়। তার উপর সে যে ভুরফুনের মাঠ পেরোবে সে খবরই বা এ রাখে কোন সুবাদে! চোর ডাকাত নয় তো!
লোকটা যেন তার মনের কথা শুনতে পেয়ে বলল, “না হে বাপু, আমি চোর-ডাকাতও নই, তাদের আড়কাঠিও নই। তবে কিনা তাদের খুব চিনি। চারদিকেই আড়ে-আড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সব। চেনার জো নেই। দেখার চোখ থাকলে অবশ্য ঠিকই দেখতে পেতে।”
নবীন একটু ভড়কে গিয়েছিল। গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “আ আপনি কে বলুন তো!”
লোকটা চারখানা জিলিপির ফরমাশ দিয়ে নবীনের দিকে চেয়ে নিমীলিত নয়নে নরম গলায় বলল, “সে খতেনে বাপু তোমার কাজ কী? আমি হলুম গে ভবঘুরে মানুষ। মানুষজন দেখে বেড়ানোই কাজ। ওই যে সবুজ জামা পরা লোকটা তোমার পিছনের টেবিলে বসে চপ খাচ্ছিল তাকে লক্ষ করেছ?”
“আজ্ঞে না।”
“তবে তো তোমার চোখ থেকেও নেই। অমন দিনকানারাতকানা হলে গাঁট তো যাবেই, প্রাণটা নিয়েও টানাটানি হতে পারে। শুধু লাঠি চমকালেই তো হবে না। চোখ, মগজ, হুশ এগুলো যদি কুলুপ এঁটে রাখো, তবে লড়বে কীসের জোরে? মানুষের আসল অস্তরই তো ওগুলো। বলে রাখলুম, সবুজ জামা কিন্তু তোক ভাল নয়। তোমার উপর নজর রাখছে।”
নবীন শুকনো মুখে ফের ধপাস করে বসে পড়ে বলল, “তা হলে কী করা যায় বলুন তো!”
“দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। জিলিপিটা আগে শেষ করি, তারপর ভেবে বলব।”
“কিন্তু আমার যে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে! হরিপুরে আজ যাত্রার আসর কিনা! আমিই যে ক্লাবের সেক্রেটারি।”
লোকটা সরু চোখে চেয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “যাত্রা! তা কী পালা হচ্ছে?”
“আজ্ঞে, নতুন একটা সামাজিক পালা, “ওগো বধূ সুন্দরী।”
“দুর দুর, ওসব ম্যাদামারা পালা দেখে জুত নেই।”
“আজ্ঞে, পালাটা খুব নাম করেছে। চিতপুরের দল। অনেক টাকার বায়না।”
লোকটা দ্বিতীয় জিলিপিটায় কামড় বসিয়ে বলল, “ভাল পালা বলছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব নাম। বায়না নিতেই চায় না।”
“বলি তলোয়ার খেলা টেলা আছে?”
“তা আছে বোধহয়। আজকাল ঝাড়পিট না হলে লোকে তেমন নেয় না।”
“তা না হয় হল। কিন্তু রাতে খ্যাটনের কী ব্যবস্থা?”
“সে হয়ে যাবে’খন। যাবেন?”
“দাঁড়াও, আগে সব জেনেবুঝে নিই। শোওয়ার ব্যবস্থা কেমন?”
“সেও হয়ে যাবে’খন।”
“আমি ভবঘুরে বটে, কিন্তু গায়ে বনেদি রক্তটা তো আছে। মোটা চালের ভাত, পাশবালিশ ছাড়া ঘুম, ওসব আমার চলবে না।”
“সেসব ব্যবস্থাও হবে। ভাববেন না।”
“তা হলে লাঠিগাছ আমার হাতে দাও। তোমাকে দেখেই বুঝেছি যে তুমি আনাড়ি।”
নবীন মনে একটু জোর পেল। লোকটা রোগাপটকা বটে, কিন্তু পাকানো শক্ত চেহারা। হুঁশিয়ার, পোড়-খাওয়া লোক। চল্লিশ বিয়াল্লিশের মতো বয়স। পরনে খাটো ধুতি, গায়ে সবুজ শার্ট, তার উপর একটা খয়েরি রঙের হাফ সোয়েটার। নবীন লাঠিখানা এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার নামটা?”
“নিমাই রায়। তুমি নিমাইদা বলেই ডেকো।”
“আমি হলুম নবীন সাহা।”
“আর বলতে হবে না। জটেশ্বর সাহার ছেলে তো? তোমাদের বিস্তর ধানজমি, চাল আর তেলের কল আছে। একটা মুদিখানাও।”
নবীন অবাক হল না। লোকটা হয়তো অন্তর্যামী, সাধক-টাধকদের ওসব গুণ থাকে।
লোকটা ফের যেন তার মনের কথা টের পেয়ে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না রে বাপু। আমি অন্তর্যামী-টামি নই। তবে আমার বাতিক হল, মানুষের খবর-টবর রাখা। এই গঞ্জের বাজারে যত লোক আনাগোনা করে তাদের প্রায় সবার নাড়িনক্ষত্র আমার নখদর্পণে।”
নবীন নিজের আর নিমাইয়ের খাবারের দামটাও মিটিয়ে দিল। নিমাই বিশেষ আপত্তি করল না।
গঞ্জের সাঁকোটা পেরিয়ে নির্জন মাঠের রাস্তায় পড়েই নবীন হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলে নিমাই বলল, “উঁহু, অত জোরে হেঁটো না। লোকে সন্দেহ করবে। দুলকি চালে হাঁটো, বদমাশরা যাতে বুঝতে না পারে যে ভয় পেয়েছ। ভয় হল মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুর।”
শীতের সন্ধে। চারদিকে একটা ভূতুড়ে কুয়াশা পাকিয়ে উঠছে। আবছায়ায় যতদূর চোখ যায়, মাঠঘাট শুনশান। জনমনিষ্যি নেই। চারদিকটা থমথম করছে।
খানিকক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর নিমাই হঠাৎ চাপা গলায় বলে উঠল, “একটা কথা বলে রাখছি তোকে।”
নবীন তটস্থ হয়ে বলে, “কী কথা নিমাইদা?”
“এই শীতকালে ফুলকপির পোরের ভাজা তোর কেমন লাগে?”
“খুব ভাল।”
“আমারও।”
“সে হয়ে যাবে, ভাববেন না।”
“আর কড়াইশুটি দিয়ে সোনা মুগের ডাল?”
“তাও হবে।”
“ভাল ঘি আছে বাড়িতে?”
“খাঁটি সরবাটা ঘি।
“গরম ভাতে এক খাবলা ঘি হলে কাঁচালঙ্কা দিয়ে মন্দ লাগে না। কী বলিস? মাছ-মাংসের উপর আমার তেমন টান নেই, তবে রুই মাছের কালিয়াটা খারাপ নয়।”
“ধরে নিন হয়েই গেছে।”