ইলেভেনথ আওয়ার – জেমস হেডলি চেজ
০১.
আঘাত কখন যে কার আসবে কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। রোলো মার্টিনকে প্রথম দেখার পর গোপন মিলিটারী ফাইলে এই মন্তব্যটি লিখেছিলাম।
মার্টিনের দোষের মধ্যে, খুবই পানাসক্ত; ফলে মাঝে মধ্যে সামনে দিয়ে কোন মহিলা গেলে মন্তব্য করতে ছাড়ে না। স্বাভাবিক অবস্থায় তাকে ফুর্তিবাজ বলা যায় না, কিছুটা বোকা ধরণের।
স্বাভাবিক অবস্থায় কথাটা লিখলাম এজন্য যে, হ্যারি লাইমের অন্ত্যেষ্টির সময় যখন তাকে দেখলাম তাই মনে হল।শীতকাল, চারদিকে বরফ পড়েছে, ভিয়েনার কেন্দ্রীয় গোরস্থানে বৈদ্যুতিক যন্ত্র দিয়ে লোকগুলো খুড়ছে। বরফ সরিয়ে দেখে মনে হল প্রকৃতিও হ্যারিকে চায় না। যাইহোক হ্যারিকে কবর দেওয়া শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মার্টিন চলে গেল, যেন পালাল। বছর পঁয়ত্রিশের মার্টিন বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। পরবর্তীকালে এজন্য প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল। কাউকে একথা সে বলেনি, বললে হয়ত ঝামেলা এড়াতে পারত।
তার সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে। তখন ভিয়েনা, রাশিয়া, ব্রিটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্সের মত বৃহৎ শক্তি কবলিত শহরের মাঝে ইনিয়ার স্টার্ডের বাড়ি আছে। এটি একটি সুইশ বাড়ি, তার অসীম ক্ষমতা। এর নির্দেশে এক মাস অন্তর এক একটা শক্তি ক্ষমতায় আসে, সেই মত কাজ করে। আমার কাছে শহরটা গৌরবহীন হয়ত এর পিছনে কোন কারণ আছে যা আমার অজানা। সব সময় বরফে ঢাকা শহর। রাশিয়ার অঞ্চল বরাবর ডানিয়ুব নদী নিশ্চল। জনমানবশূন্য চারিদিক, শুধু থাকার মধ্যে ঝোপঝাড়।
সাতই ফেব্রুয়ারী মার্টিন আমার কাছে এসেছিল, এখন শহরের এরকমই অবস্থা। আমি যতটা জানি আর মার্টিনের থেকে যতটা শুনেছি সেভাবেই ঘটনা সাজিয়েছি। এবার সেই গল্প শুরু করব।
.
০২.
রোলো মার্টিন, বার্ক ডেকস্টারের ছদ্মনামে সস্তার পাশ্চাত্য পকেট বুক লিখত। এটা তার পেশা। একবার অস্ট্রিয়ায় ছুটি কাটানোর জন্য সে হ্যারি লাইমের সাহায্য চাইলে হ্যারি তাকে আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু নিয়ে কিছু লিখতে বলে। মার্টিন এ ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। তবুও শুধু ছুটি কাটাবে বলে হ্যাঁ বলেছিল। মাটিনের মতে হ্যারি ইচ্ছা করলে ব্রিটিশ হোটেল ও ক্লাবের খরচার জন্য স্থানীয় মুদ্রা যোগাতে পারে। সেই আশায় ঠিক পাঁচ পাউন্ড ব্রিটিশ মুদ্রা নিয়ে ভিয়েনার পথে পা বাড়ায়। জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্টে এক ঘণ্টার জন্য প্লেন থামলে একটা আমেরিকান রেস্তোরাঁয় ঢুকে সে হামবুগ অর্ডার দিল। কিছুক্ষণ পরই এক সাংবাদিককে তার দিকে আসতে দেখল, লোকটি তার চেনা।
সাংবাদিকটি এসে মৃদু হেসে বলে–আপনি তো মিঃ ডেকস্টার তাই না? একটু ইতস্ততঃ করলেও সে বলে–হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো?
–আপনাকে ছবিতে যেমন দেখেছি তার থেকেও অনেক কম বয়সী লাগছে।–
–তাই নাকি? ধন্যবাদ।
–আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
আমি এখন একটু ব্যস্ত।
–বেশী সময় নেব না।
–বেশ, বলুন কি জানতে চান?
–ফ্রাঙ্কফুর্ট সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।
–একথা আপনি জানতে চাইছেন কেন?
–আমি এখানকার সংবাদপত্রের পত্রকার।
দয়া করে আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না এখন, কেননা দশ মিনিট হল এখানে এসেছি।
–তাই যথেষ্ট। তা আমেরিকার উপন্যাস সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা?
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দেয় মার্টিন–ওসব আমি পড়ি না।
–পড়েন না? অবাক হয় সাংবাদিকটি।
–না।
ধন্যবাদ।
–আপনার আর কি কোন প্রশ্ন আছে?
–আছে।
তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন।
–আপনাকে তো বেশ রসিক মনে হয়।
–কিসে বুঝলেন? পাল্টা প্রশ্ন মার্টিনের।
নইলে ও কথা বলতে পারতেন না। থাক সে কথা। আচ্ছা, ঐ সামনে ধূসর চুলের, দাঁত উঁচু লোকটি যে খাবার খাচ্ছে তাকে কি আপনার ক্যারী বলে মনে হয়?
ক্যারি? ক্যারির কথা আমায় জিজ্ঞাসা কেন? মুখ কুঁচকে কথাগুলো বলে মার্টিন।
–আমি জে. জি. ক্যারির কথা বলছি।
–জে. জি. ক্যারি?
–হ্যাঁ।
–না, নামতো শুনিনি কখনও।
–শোনেননি?
না।
–অবশ্য সবাইকে সব কিছু শুনতে হবে এমন কথা নেই। আপনারা গল্প লিখিয়েরা কি জগৎ ছাড়া?
-হঠাৎ একথার অর্থ?
সাংবাদিকটি গাড়িতে গিয়ে বলল–আমি কিন্তু লোকটিকে চিনতে পেরেছি।
তা হলে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন কেন? সাংবাদিকটি কোন কথানা বলে তাড়াতাড়ি ঘরটা পার হয়ে ক্যারীর কাছে এগিয়ে গেল। ক্যারী খুশী না হলেও থেমে আহ্বান জানাল।
এদিকে মার্টিন হতাশ হয়ে পড়ল বিমান বন্দরে হ্যারিকে না পেয়ে। এটা তার অচেনা জায়গা, মুদ্রাও নেই। মহা মুশকিলে পড়ে সে, আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে, রাগও হয়। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, খাওয়া মাথায় উঠেছে, বাইরের দিকে চোখ দিয়ে বসে আছে। মনে মনে ভাবল যদি না আসতে পারে তাহলে একটা খবর রেখে যাওয়া উচিত ছিল হ্যারির। এখন মনে হচ্ছে, না এলেই ভাল হত।হ্যারি লোভ দেখাল আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু নিয়ে কিছু লিখতে সেও রাজী হয়ে গেল। এখন ফল এই। মার্টিনের মন অভিমানে ভরে ওঠে। কিন্তু অভিমান পুষে রাখতে পারে, হ্যারির বিপদের কথা ভেবে। কোন বিপদ হল, না কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে! আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে তার সঙ্গে মজা করছে হ্যারি। মার্টিনের পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। তারা দুজনে একই স্কুলে পড়তো, তবে কেউ কাউকে চিনত না। হ্যারি নিজেই যেচে এসে একদিন আলাপ করেছিল-তোমার নাম কি?
আমার নাম?
–হ্যাঁ, তুমি ছাড়া তো এখানে কেউ নেই।
হেসে বলে বলতে পারি একটা শর্তে।
শর্ত!
হ্যাঁ।
– শর্তটা কি?
–তোমায় আমার বন্ধু হতে হবে।
বন্ধু? আমায়?
হুঁ।
–তা হব।
হবে তো?
বললাম তো। আমার কথা, বিশ্বাস হচ্ছে না?
–না, তা নয়।
–তবে?
–তুমি তিন সত্যি করে বল।
বললাম, এতে হবে না, দিব্যি কাটতে হবে?
না না। ঠিক আছে। এবার আমার একটা কথার জবাব দেবে?
নিশ্চয়ই, বল, কি জানতে চাও?
–তুমি অমন করে দিব্যি কাটলে কেন?
–আসলে…মার্টিন চুপ করে থাকে।
–আসলে কী?
–আমার কোন বন্ধু নেই। আমি ভাব করতে চাই, কিন্তু, সবাই আমায় এড়িয়ে চলে, তাই।
–ওঃ, এই কথা।
–হ্যাঁ।
হ্যারি মার্টিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে–আজ থেকে দুজনে বন্ধু। সব সময় এক সঙ্গে থাকব, আলাদা হবনা কখনো।
মার্টিনও খুশী হয়ে বলে–আমি কথা রাখব।
–তা তো হল, কিন্তু তোমার নামটা এখনো আমায় বলনি।
–আমার নাম রোলো মার্টিন।
কিন্তু আমি তোমায় একটা নাম দেব।
–কি নাম?
–শুধু মার্টিন। তা মার্টিন বলে ডাকলে রাগ করবে না তো?
রাগ? তোমার উপর?
–যদি তুমি আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দাও তাই আগেই জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি।
না, না। এসব ভাবার কোন কারণ নেই, তাছাড়া আমার মা-ও কখনো রোলো, কখনন মার্টিন বলে ডাকত।
যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।
–আমার নামটা তো জানলে, তোমার নাম বল এবার।
–সত্যি, অন্যায় হয়ে গেছে।
হ্যারির কথার ধরণ দেখে মার্টিন হেসে ফেলে বলে–খুবই অন্যায় হয়েছে।
–তা কি শাস্তি হবে?
পরে ভেবে বলব। আগে নামটাতো বল।
আমার নাম হ্যারি লাইম।
এত বড় নাম?
যে নামে ডাকতে ইচ্ছে করবে সেই নামেই ডেকো আমার আপত্তি নেই।
ওদের দুজনের বন্ধুত্ব দেখে অন্য ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও ওদের কিছুই যায় আসেনি। মার্টিনের তোনয়ই, কারণ একরকম বন্ধুত্বের তার বড় অভাব ছিল, এতদিন সেভীষণ কষ্ট করেছে। স্কুলে যেতে ভাল লাগত না, কামাই করত। কিন্তু আজ সে এত খুশী যে আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছিল।
এরপর থেকে সর্বত্র একসঙ্গে দুজনকে দেখা যেত। সত্যি ছেলেবেলার দিনগুলো বেশ ছিল। তখন স্বার্থ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না, তাই সহজেই ঝগড়াও হত ভাবও হত।
আর একদিন, তখন উঁচু ক্লাসে পড়তো, এক ছুটির দিনে হঠাৎহ্যারি মার্টিনের বাড়ি গিয়ে তাকে ডাকতে থাকে। যদিও তার কোন দরকার ছিল না, কেননা সবাই তাকে চেনে। মার্টিন ডাক শুনে বেরতে যাবে তার আগেই হ্যারি তার ঘরে হাজির।
মার্টিন বলে–কী ব্যাপার?
কথা আছে।
–কি কথা?
শিকারে যাবে?
শিকারের নাম শুনে মার্টিনের ভয় হয়, তবুও জিজ্ঞাসা করে, কোথায়?হ্যারি জানে তার স্বভাব, তাই সে আগে জানতে চায় সে রাজী কিনা।মার্টিনআমতা আমতা করে, কিন্তু যেতেই ইচ্ছা করছে, কেননা ক্লাসের ছেলে রবার্ট বাবার সঙ্গে পিকনিকে গিয়ে মুরগি মেরে পরদিন ক্লাসে এসে ফলাও করে সবাইকে গল্প করছিল।
–আরে, যাবে কি না স্পষ্ট করে বল না? তাছাড়া ভয়ের কি আছে, আমি তো থাকছি।
–ঠিক আছে, রাজী।
থ্যাঙ্ক ইউ। হ্যারি খুব খুশী।
কিন্তু শিকারে গেলে তো বন্দুক চাই।
–হ্যাঁ, সেটা আমার ভাবনা।
–তোমার বন্দুক আছে?
হ্যারি মাথা নাড়ে।
আছে? মার্টিন যেন বিশ্বাস করতে পারে না।
–হ্যাঁ। হ্যারি হাসে।
কী শিকার করবে?
যা পাব তাই।
–বাঘ ভাল্লুক যদি আসে?
–আসুক, তাও শিকার করব।
–ইস্! আরে, ওসব ওখানে কিছু নেই।
নেই?
না।
–তবে কি আছে?
–খরগোসই বেশী আছে।
–খরগোস? আমায় মারতে দেবে?
নিশ্চয়ই। শিকারে যাবে আর শিকার করতে দেবনা! সেদিন একটা খরগোসও মার্টিনমারতে পারেনি। টিপই নেই তো মারবেকি।তবু সেদিনের আনন্দের কথা আজও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। এরকম অনেক ব্যাপারে মার্টিন ব্যর্থতার পরিচয় দিলেও হ্যারি তাকে কখনো ত্যাগ করেনি। যার ফল দীর্ঘ কুড়ি বছরের বন্ধুত্বের অস্ফুট বন্ধন। কিন্তু এখনো হ্যারি না আসায় বিমর্ষ, অভিমানী হয়ে বসে আছে মার্টিন। আসলে প্রকৃত ভালবাসার ধর্ম এই। যাকে বেশী ভালবাসি, তার উপর সামান্য কারণেই রাগ অভিমানের পাল্লা ভারী হয়ে ওঠে।
পাশের ফাঁকা চেয়ারে একজন বসতেই চিন্তায় ছেদ পড়ে। তবু ভরসা সহজে যায় না। ওই মধুর স্মৃতি বুকের অতল থেকে উঠে আসে।
মার্টিন রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে বাস-এর জন্য দাঁড়ায়। বাইরে আবহাওয়া ভারী, আকাশ মেঘলা, একটু আগে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে। হলেও বোঝা যাবে না, কেন না গুড়ো গুড়ো বরফ পড়ছে। সেই সঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা হাওয়া।
বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল হ্যারির জন্য, কিন্তু আসেনি দেখেই অগত্যা হোটেল অ্যাস্টেরিয়া। সেখানে হোটেল ম্যানেজারকে নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করল–হ্যারি এসেছে? ম্যানেজার মাথা নাড়ে, না।
–কোন খবর কি রেখে গেছে?
না।
আশ্চর্য তো!
তবে ক্রাবিন এসেছিল।
–কে ক্রাবিন?
–তা তো জানি না। আপনি চেনেন না?
–নামই শুনিনি তো চিনব।
–ও আপনার নামে মেসেজ রেখে গেছে।
মেসেজ? আমার নামে?
হ্যাঁ
–আপনার কোন ভুল হচ্ছে না তো?
এতে ভুল হবার কি আছে?
–মেসেজটা আপনার কাছে আছে?
আছে। এই নিন–বলে বার করে দেয়।
ধন্যবাদ।
খুলে দেখে লেখা আছে–আপনাকে আগামীকালের বিমানে আশা করছি। দয়াকরে বর্তমানে যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। আপনার জন্য হোটেলে ঘর বুক করা আছে। চিন্তার কিছু নেই।
কিন্তু রোলো মার্টিন এক জায়গায় বসে থাকার লোকনয়।হঠাৎতার মনেহল এখানে বেশিক্ষণ থাকলে হয়তো কোন ঘটনায় জড়িয়ে পড়বে,সরে পড়াই ভাল।যা মার্টিন হ্যারির ঠিকানা জানত তাই ক্ৰাবিনের প্রতি কোন আগ্রহই নেই। সেই সময় একটা কথা মনে পড়ে গেল তার। হ্যারিকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল–তোমাদের ওখানে গিয়ে কোথায় উঠব?
–কোথায় আবার উঠবে? আমার ফ্ল্যাটে।
–তোমার ফ্ল্যাটে আমার কোন অসুবিধে নেই। তবে…। ।
তবে কি?
–তোমার কোন অসুবিধে হবে না?
–অসুবিধে? তোমার জন্য?
–না যদি…
–এ কথা ভাবলে কি করে?
–অন্যায় হয়ে গেছে। কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি।
হয়েছে, আর বলতে হবে না।
হ্যারির ফ্ল্যাটটা ভিয়েনার এক প্রান্তে বেশ বড়। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সে রওনা হল, হ্যারি তার ভাড়া মিটিয়ে দেবে তাই ভেবে। ফ্ল্যাটে পৌঁছে তার কেন জানি মনে হল হ্যারির সঙ্গে দেখা হবে না। চারতলায় পৌঁছে দরজার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল কেন হ্যারি বিমান বন্দরে যায়নি। হ্যারি আর নেই। বুকের মধ্যে আঁটা ব্যাথা অনুভব করল মার্টিন। যাকে সে মানত, ভক্তি করত, ভালবাসত, যার সঙ্গে স্কুলে রঙিন দিনগুলো কাটিয়েছিল, সে নেই।
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মার্টিন দরজার সামনে। কিছুক্ষণ পর পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বলে–আপনি হ্যারির ফ্ল্যাটের বেল টিপছিলেন?
–হ্যাঁ?
–বেল বাজিয়ে লাভ নেই।
–এ কথা বলছেন কেন? মার্টিন যেন কুঁকড়ে ওঠে।
–ফ্ল্যাটে কেউ নেই। হ্যারি মারা গেছে।
মার্টিন আর্তনাদ করে ওঠে।
–একটা দুর্ঘটনায়…।
মার্টিন বিস্মিত, ভাবে লোকটি বোধহয় ঠাট্টা করছে। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে কেউ তো ঠাট্টা করবে না। লোকটি বলে বুঝতে পারছি আপনার মেনে নিতে অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু সত্যি কথা।
–তা তো ঠিকই। তবু মানতে পারছি না।
–আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব যদি কিছু মনে না করেন?
-না, না। মার্টিন নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। তার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, মাথায় যেন সহস্র বোলতা দংশন করছে। কাঁদতে চাইছে কিন্তু পারছে না।
–একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
–আঁ! চমকায় মার্টিন।
–নিশ্চয়ই হ্যারি লাইমের কথা ভাবছেন, ভাবাই স্বাভাবিক। আচ্ছা উনি কে হন আপনার?
–ও আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। দীর্ঘ কুড়ি বছরের পরিচয়।
কুড়ি বছর?
–হ্যাঁ।
-তাই আপনি মানতে পারছেন না। হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় বিশেষ করে প্রিয়জনের ক্ষেত্রে তো বটেই।
মার্টিনের মুখ থেকে যেন বেরিয়ে এলেন–আচ্ছা আপনি ঠাট্টা করছেন না তো?
-ঠাট্টা? আমি? আপনার সাথে?
–হ্যাঁ।
হঠাৎ এ কথা ভাবার কারণ? কথার সুরে রাগ বোঝা যাচ্ছে।
–আছে।
সঙ্গত কারণ আছে?
–হ্যাঁ।
–তা কারণটা জানতে পারি কি?
–অবশ্যই। অনেকে বিদেশী পেয়ে পরিহাস করতে চায়। আপনার কাছে যেটা ঠাট্টা সেটা আমার কাছে মৃত্যুর সমান হতে পারে, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন।
–আমি ওসব তত্ত্ব কথা বুঝি না।
–বোঝেন না?
–না।
–তাহলে কিছু বলার নেই।
–আপনি কি একজন বিদেশী?
–হ্যাঁ।
–কোথা থেকে আসছেন?
–আজই ইংল্যান্ড থেকে আসছি।
–আপনি বিদেশীহলেও এ ব্যাপার নিয়ে কেউ ঠাট্টা করে না আমিও করছিনা। বিশ্বাস করতে পারেন।
আপনি কি রেগে গেলেন?
না না। আমিও তো মানুষ। আপনার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছি, এ সময় অনেকেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। আমিও আমার দাদা…। যাক সে কথা।
মার্টিন যেন আর অবিশ্বাস করতে পারল না। তার পা টলছে, শরীরে এক বিন্দু যেন শক্তি নেই। শেষ বারের মত তার সঙ্গে কথাও বলতে পারল না। এভাবে হট করে চলে গেল। যদি জানত অসুস্থ ছিল মারা গেছে তা হলেও কিছুটা সান্ত্বনা পেত কিন্তু এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাত। মার্টিন লোকটাকে বলে–আমায় একটু বসতে দিতে পারেন।
–আপনি এ বেঞ্চটায় বসুন।
ধন্যবাদ।
হঠাৎ মার্টিনের হ্যারির কিছু কথা মনে পড়ে। তখন তারা ক্লাস নাইনে পড়ে। দুজনে শিকারে গিয়েছিল। অনেক খরগোস মেরেছিল হ্যারি। তা দেখে মার্টিন বলেছিল–তোমার বন্দুকের হাত তো দারুন।
–তোমার হাতটাও মন্দ নয়।
–কী যে বলো তার ঠিক নেই।
–একটা খরগোস মার নি?
–সে তো তিনবারের পর।
–আস্তে আস্তে হবে।
–যার নয়তে হয় না তার নব্বই-তেও হয় না।
বাঃ বেশ বললে তো কথাটা।
–আমার কি মনে হচ্ছে জান?
–কি?
–তুমি বড় হয়ে একজন ইঞ্জিনীয়ার হবে।
ইঞ্জিনীয়ার! হ্যারি হাসে। –
-হ্যাঁ, নয়তো ডাক্তার।
হঠাৎ আমার সম্বন্ধে এরকম ধারণার কারণ?
কারণ না থাকলে কি এমনি বলছি?
–সেটাই তো জানতে চাইছি।
–যার হাত এত ভাল সে এরকম একটা কিছু না হয়ে যায় না।
–কিন্তু বন্ধু একটা কথা ভুল না।
–কি?
–তারজন্য লেখাপড়ায়ও ভাল হওয়া চাই।
–তুমি লেখাপড়ায় এমন কিছু খারাপ নও।
–দেখলে তো? তুমি ঠিক একথা বলতে পারলে না। সত্যি এভাবেই মুখ থেকে বেরিয়ে যায়। আর তুমি তো আমার থেকে লেখাপড়ায় ভাল।
তা অস্বীকার করছি না। তবে তুমি যা আছ তাতেই হবে। তাছাড়া তীক্ষ্ণ বুদ্ধিরও দরকার। সে দিক দিয়ে তুমি এগিয়ে।
–কিন্তু আমার ভাগ্যে ওসব হয়ত কিছু হবে না।
–দেখ, ঠিক হবে।
–কিন্তু…।
কিন্তু কি?
মনে হচ্ছে আমার অপঘাতে মৃত্যু হবে।
অপঘাতে মৃত্যু? তোমার?
হ্যাঁ।
হঠাৎ একথা কেন বলছ?
–জানি না। হঠাৎ মনে হল তাই বললাম।
–ওসব অলক্ষুণে কথা কখনো বলবে না। আর এটা তোমার মনে হলই বা কেন?
–মন তো সব সময় নিজের দখলে থাকে না। তাই ও কখন কি ভাবে তা কি করে বলব?
—তবুও আমার সামনে অন্তত এসব বলবে না।
–তাই হবে।
–মনে থাকবে তো?
–মনে রাখার চেষ্টা করব।
মার্টিন ভাবে শেষে হ্যারির কথাই সত্যি হল। সত্যি দুর্ঘটনায় মারা গেল। কি করে ওর কথা জানল?
এখন একটু মদ পেলে ভাল হত। অন্ততঃ সব কিছু কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকা যেত। কিন্তু পকেট তো খালি। ভগবান সব দিক দিয়ে যেন আজকে পিছনে লেগেছে।
–মিঃ…।
—অ্যাঁ। সম্বিত ফিরে পায় মার্টিন–আমায় কিছু বলছেন?
–কি ভাবছেন?
–কি আর ভাবব? ভাবার কিছু নেই, কবে এই ঘটনা ঘটল?
বৃহস্পতিবার।
–কি করে?
–গাড়ি চাপা পড়ে। আজ সন্ধ্যাবেলা তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। একটু আগে এলে তাদের আপনি দেখতে পেতেন।
তাদের মানে?
–মানে হ্যারির বন্ধু বান্ধবদের কথা বলছি।
–হ্যারিকে হাসপাতালে দেওয়া হয়েছিল?
–না। তাছাড়া কোন লাভ হত না।
-কেন?
কাঁধে জিপ গাড়ির মাডগার্ডের প্রচণ্ড আঘাত লাগায় খরগোসের মত রাস্তায় ছিটকে পড়েছিল। তাতেই মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যু ঘটে।
খরগোস কথাটা এভাবে ব্যবহার করবে ভাবতে পারেনি মার্টিন। সহসা হ্যারি যেন তার কাছে জীবন্ত হয়ে উঠল।
হ্যারিকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে?
-কেন্দ্রীয় কবরস্থানে।
-ঠিক আছে চলি। অনেক ধন্যবাদ–আস্তে আস্তে নিচে নেমে যায় মার্টিন। পয়সা না থাকলেও নীচে দাঁড়ান ট্যাক্সিতে উঠে চালককে কেন্দ্রীয় কবরস্থানে নিয়ে যেতে বলে। সীটের ওপর। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয়, ভাবে কপালে এই ছিল। এখন কি হবে? মাত্র পাঁচটা মুদ্রা নিয়ে ভিয়েনায় কোথায় থাকবে।
কবরখানার চারদিকে উঁচু পাঁচিল। পাশ দিয়ে ট্রাম লাইন গেছে। রাস্তার অন্যদিকে বড় বড় বাড়ি, বাজার। এতবড় কবরখানা সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না তার। সেখানে প্রবেশ করে কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে গেল। কবরখানাতেও চারটে বৃহৎশক্তি অঞ্চল চিহ্নিত। রাশিয়ার অস্ত্রে সজ্জিত মূর্তি, ফ্রান্সের ক্রশ ঘেঁড়া পতাকা। মার্টিনের মনে পড়ে হ্যারি তো ক্যাথলিক। হঠাৎ গাছের তলা দিয়ে তিনজন বেরিয়ে এল। পরনে অষ্টাদশ শতাব্দীর সাজ পোশাক। যীশুর উদ্দেশ্যে ঐশ করতে করতে বেরিয়ে গেল।কিছুক্ষণ পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জায়গা দেখা গেল। একটা বিরাট পার্কের এক জায়গায় বরফ পরিষ্কার করা হয়েছে। চারপাশে লোক, একজন পুরোহিত বিড়বিড় করে কি বলে চলেছে। একটা মেয়ে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে চোখে হাত চাপা দেওয়া। আমি প্রায় কুড়িগজ দূরে দাঁড়িয়ে, মার্টিন আমার দিকে তাকাল ভাবল কোন অপরিচিত, কেননা গায়ে বর্ষাতি। আমায় এসে জিজ্ঞাসা করল–যাকে কবর দেওয়া হল তাকে চেনেন?
-হ্যাঁ।
–ওর নাম কি?
–হ্যারি লাইম।
নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখি চোখ দিয়ে জল পড়ছে। অথচ দেখে মনে হয়েছিল সহজে ভেঙে পড়ার লোক নয়। এখানে একটা কথা বলা অনুচিত তবু বলছি, হ্যারির মত মানুষের জন্য সত্যিকারের শোক করার কোন লোক থাকতে পারে বলে জানা ছিল না।
মার্টিন শেষ পর্যন্ত আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। আমি জিজ্ঞাসা করি–আপনি হ্যারির কে হন?
–বন্ধু।
বন্ধু? অনেকদিনের আলাপ?
–হ্যাঁ, সেই স্কুল থেকে।
–এরা হ্যারির বন্ধু। আপনি এদের সঙ্গে পরিচয় করবেন?
–না, থাক্।
কবর দেওয়া শেষ হলে সে ট্যাক্সির দিকে চলল একটা কথা বোধহয় সকলেই জানেন কোন লোকের ওপর ফাইল লেখা কখনো শেষ করা যায় না। এমনকি মারা গেলেও একশ বছর পরও বন্ধ করা যায় না। সুতরাং আমি মার্টিনকে অনুসরণ করলাম। তিনজনকে চিনতাম, মার্টিন চতুর্থ এবং নতুন। তাই তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে বললাম আমি সঙ্গে গাড়ি আনিনি। আপনি দয়া করে আমায় একটু শহরে পৌঁছে দেবেন?
নিশ্চয়ই।
আমি মার্টিনের সঙ্গে গেলেও আমার গাড়ি পিছনেই আসছে। এটা আমার চালকের জানা। গাড়ি চলতে শুরু করল, কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মার্টিন জিজ্ঞাসা করল না তাকিয়েই আপনার নাম কি জানতে পারি?
–আমার নাম ক্যালাও। এবার আপনার নাম যদি দয়া করে বলেন।
–রোলো মার্টিন।
–আপনি তো হ্যারি লাইমের বন্ধু ছিলেন, না?
–হ্যাঁ।
–অথচ গত সপ্তাহে একথা স্বীকার করতে অনেকে চাইত না।
কেন বলুন তো?
–সে কথায় পরে আসছি, আচ্ছা আপনি কি এখানে অনেকক্ষণ এসেছেন?
–আজ বিকেলে ইংল্যান্ড থেকে এসেছি।
ও।
-হ্যারি আমায় এখানে থাকার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু দেখা পেলাম না।
–সত্যি খুব দুঃখ পেলেন।
–হ্যাঁ, ভীষণ।
এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে–আমায় একটু মদ খাওয়াতে পারেন, আমার কাছে টাকা নেই শুধু পাঁচ পাউন্ড ব্রিটেনের মুদ্রা রয়েছে। আর এখন মদ খুব দরকার, পেলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
নিশ্চয়ই, একটু ভেবে স্ট্রাকের একটি ছোট পানশালায় চালককে যেতে বললাম। এখানে ভীড় কম, শুধু বনেদীরাই আসে কেননা পানীয় মূল্য অনেক। পানশালায় ঢুকে একটি কেবিনে বসলাম। পাশের কেবিনে এক দম্পতি। তাছাড়া কেউ নেই। আমার পরিচিত বেয়ারা এসে কিছু স্যান্ডউইচ আর মদ রেখে চলে গেল। মার্টিন দুটো পেগ শেষ করে বলল-হ্যারি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল। এ দুঃখ সহজে ভুলতে পারবনা।আমি কোন জবাব দিলাম না। ভাবলাম এ মুহূর্তে তাকে খুঁচিয়ে কিছু কথা জানা দরকার তাই বললাম–এ যে সস্তা দরের উপন্যাসের সংলাপ বললেন।
সস্তা দরের উপন্যাসের সংলাপ? ঠিকই বলেছেন।
কারণটা জানতে পারি কি?
–আমি যে ওসবই লিখি।
এবার আপনাকে একটা অনুরোধ করব।
বলুন।
–হ্যারির সম্বন্ধে, আপনার নিজের সম্বন্ধে কিছু বলবেন?
–আমি আরও মদ চাই, আমি ওকে ভুলতে পারছি না। তাছাড়া আপনি অপরিচিত, বেশী বিরক্ত করতে চাই না। শুধু দু এক পাউন্ড ব্রিটিশ মুদ্রা অস্ট্রিয়ান টাকায় ভাঙিয়ে দেবেন?
-ওসব নিয়ে চিন্তা করবেননা। আমি সেখানে ছুটি কাটাতে গেলে এভাবে শোধ করে দেবেন।
কাজের কথায় চলে আসি, প্রশ্ন করি–হ্যারির সঙ্গে প্রথম পরিচয় কবে?
কথার উত্তর না দিয়ে মদের গ্লাসটা ঘুরেফিরে দেখতে থাকে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে–হ্যারিকে আমি যতটা জানি আর কেউ জানে না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
কতদিন হবে?
দীর্ঘ কুড়ি বছর তো বটেই। স্কুলে একসাথে পড়তাম। সব যেন চোখের সামনে ভাসছে। সহজে ভোলা যায় না। স্কুলের দিনগুলো বড় মধুর দায়দায়িত্বহীন সময়।
একটু থেমে আবার বলে–একথা ঠিক, আমার চেয়ে এক বছরের বড় ছিল হ্যারি। ওর মত বুদ্ধিমান কাউকে দেখিনি, এর জন্য অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচেছি এবং সে জন্য কৃতজ্ঞ। তার মত লোক আমি দেখিনি। হ্যারি হ্যারিই, ওর তুলনা ও নিজেই।
–আচ্ছা, পড়াশুনায় কি খুব ভাল ছিল?
না, তা ঠিক নয়। তবে বুদ্ধি ছিল প্রচণ্ড।
ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে আমায় নাজেহাল হতে হয়েছে অনেকবার।
—আর কি?
–ও নিখুঁত ভাবে বেরিয়ে আসতে পারত, কেননা উপস্থিত বুদ্ধি, যেটা অনেকের থাকে না। এজন্য ওকে আলাদা চোখে দেখতাম, গর্বও বোধ করতাম।
কথা শেষ করে মার্টিন হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে। ভাবলাম হ্যারির শোক কিছুটা কাটিয়ে উঠছে। মার্টিন রসিকতা করে বলে, আমি কিন্তু সব সময়ই ধরা পড়ে যেতাম। ওর তুলনায় বোকাই। আমি বলি–এতে হ্যারির সুবিধে ছিল।
–সুবিধে ছিল?
–হ্যাঁ।
–কী আজে বাজে বকছেন? চেঁচিয়ে ওঠে মার্টিন। পাশের কেবিনের কথা থেমে যায়।
–আমার তো তাই মনে হয়।
–আপনার তো অনেক কিছুই মনে হতে পারে তাতে আমার কিছু আসবে যাবেনা। ও ইচ্ছে করলে আমার থেকে চতুর কাউকে নিতে পারত কিন্তু তা করে নি। আমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিত। আমায় ভীষণ ভালবাসত ও।
–আপনি হ্যারিকে শেষ কবে দেখেছেন?
কবে? দাঁড়ান ভেবে বলছি। কিছুক্ষণ পর বলে চিকিৎসকের সম্মেলনে যোগ দিতে মাস দুয়েক আগে ওখানে গিয়েছিল। জানেন তো ও চিকিৎসক ছিল, তবে আশ্চর্যের বিষয় কখনও প্র্যাকটিস করত না।
–প্র্যাকটিস করতো না?
–না।
–আবার বলছেন চিকিৎসক।
–ওটাই তো মজার ব্যাপার।
–কোন কারণ ছিল কি?
–ছিল তো বটেই। কোন কিছু সম্বন্ধে জানা হয়ে গেলে সে ব্যাপারে একেবারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলত। কেমন যেন নির্লিপ্তভাব।
-কেন বলুন তো?
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
বড় অদ্ভুত মানুষ তো!
–তবে সে প্রায়ই বলত, ডাক্তারিটা মাঝে মধ্যে কাজে লাগে। এর দৌলতে কিছু করা যায়। শুনে আমারও মনে হত কথাটা ঠিক।
আমি মার্টিনের কাছ থেকে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছি। মার্টিন বলে–ও বেশ রসিক মানুষ ছিল। ইচ্ছে করলে এই কাজেও প্রচুর সুনাম অর্জন করতে পারত। অবশ্য এটা আমার ধারণা।
-তাই নাকি?
–হ্যাঁ। হঠাৎ শিস দিয়ে একটা গানের সুর বাজায় মার্টিন। আমার চেনা চেনা লাগে সুরটা। বলে এ সুরটা আমি কখনো ভুলব না।
-কেন?
–এটা হ্যারি সব সময় গাইত। কিন্তু আমি ভাবতে পারছি না ও এভাবে মারা গেল কি করে? একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মার্টিন।
এভাবে মৃত্যু তার পক্ষে ভালই হয়েছে।
–তাই নাকি?
–হ্যাঁ।
তার মানে কোন কষ্ট পায়নি?
-সেদিক দিয়ে তাকে ভাগ্যবান বলতে হবে। মার্টিনকে দেখে মনে হল নেশা হয়েছে। আমার গলার স্বরে সচকিত হয়ে আস্তে আস্তে বলল–আপনি তার সম্বন্ধে কি জানতে চাইছেন?
–কিছুই না।
দেখি তার ডান হাত মুঠো করা,বলি–সব অবস্থায় গায়ের জোর দেখিয়ে লাভ নেই। মার্টিনের হাতের কাছ থেকে আমার চেয়ারটা সরিয়ে নিয়ে বললাম–হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ মত ওর তদন্তের কাজ আমি শেষ করেছি। বলে, প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে থাকি। দেখি হাতটা তখনো বন্ধ।
-কী শেষ করেছেন? ওর মত মানুষ হয়না। ও যে আমার হ্যারি।
–তা হতে পারে। তবে আমি অনেক কিছু জেনেছি।
কী জেনেছেন?
–এই দুর্ঘটনা না ঘটলে ওকে জেলে পচতে হত।
জেলে? পচতে হত? কী বাজে কথা বকছেন?
–আজে বাজে নয়, ঠিকই বলছি।
–ঠিকই বলছেন? তা কারণটা দয়া করে বলবেন কি?
–সে এই শহরের খুব বাজে ধরনের লোক ছিল।
—বাজে লোক? হ্যারি?
-হ্যাঁ।
–আপনার মাথা ঠিক আছে তো?
–তাই তো মনে হচ্ছে।
তবু একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন।
উপদেশের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
–ঠাট্টা করছেন?
ঠাট্টা আপনাকে?
–আমার তো তাই মনে হচ্ছে। না হলে ও কথা বললেন কী করে? মার্টিনের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি।
না না। আপনার সঙ্গে কি আমার সেই সম্পর্ক?
–নেই বলেই তো জানি।
মনে হল মার্টিনকে অস্বাভাবিক, আক্রমণাত্মক। আমি সচকিত হলাম তবে আমাকে কিছু করতে পারবেনা। খুব বেশী হলে পানশালার পরিবেশটা অন্যরকম করে ফেলবে। লজ্জার ব্যাপার হলেও এখানকার ম্যানেজার আমায় ক্ষমা করে দেবে কেন না আমায় চেনে।
মার্টিন প্রশ্ন করে আপনি কি পুলিশের লোক?
–হ্যাঁ। মাথা নেড়ে বললাম।
–আমি ওদের ঘৃণা করি।
–ঘৃণা করেন?
–হ্যাঁ।
কারণটা জানতে পারি কি?
–নিশ্চয়ই। পুলিশরা অত্যাচারী।
–প্রয়োজনে হতে তো হয়ই।
–অপ্রয়োজনেও হয়।
বাজে কথা।
–মোটেই না। আর অভিযোগ করলে আপনারা শোনেন। পুলিশ বলে কথা।
–একথা মানতে পারছি না।
–মানা না মানা, আপনার ব্যাপার। আর বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনারা বোকা।
–বোকা? হঠাৎ এ রকম মন্তব্য?
–অনেক-অনেক কারণ আছে।
–যেমন!
আপনি এ ধরণের বই লেখেন? তাকিয়ে দেখি মার্টিন হিংস্র মুখে চেয়ার দিয়ে আমাকে আগলাতে চেষ্টা করছে। একজন বেয়ারার চোখে চোখ পড়তেই বুঝিয়ে দিই এখন আমার কি ধরণের সাহায্য প্রয়োজন। এই পানশালায় আমার এটাই একটা সুবিধে।
বেয়ারাকে এগিয়ে আসতে দেখে মার্টিন নিজেকে সংযত করে, বলে–আমার বইতে জমিদারের চরিত্র ঠিক এরকম ধরণের।
একথার আমি কোন জবাব না দিয়ে বলি–আপনি কি আমেরিকায় ছিলেন?
না। এটাও কি পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদ।
–উঁহু। শুধু কৌতূহল নিবারণের জন্য।
কিন্তু আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি হ্যারির সঙ্গে আমায় জড়াতে চাইছেন। কিছুতেই হতে দেব না।
–আমার মনে হয়না হ্যারি আপনার মত লোককে দলে টানতে চেয়েছিল।
পেট্রলের চোরা কারবারে কাউকে ধরতে না পেরে হ্যারির ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছে।
যা সাধারণ পুলিশরা করে থাকে।
–আমি কর্নেল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আসছি। মার্টিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি, বেশ উত্তেজিত।
আমি বলি দৃঢ়তার সঙ্গে–কোন পেট্রলের ব্যাপার নয়।
–তাহলে? টায়ারের?
–তাও নয়।
-তবে সাকারিনের ব্যাপার? তা দু একজন নির্দোষীকে ছেড়ে প্রকৃত খুনীকে ধরার চেষ্টা করুন কাজের হবে।
–আপনার কথা মনে রাখব।
ধন্যবাদ।
–কিন্তু একটা কথা কি জানেন?
–কি কথা?
–খুন করাও হ্যারির আওতায় পড়ত।
–খুন জখমও হ্যারি করত।
বলে হঠাৎই মার্টিন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমার ড্রাইভার ছুটে এসে ওকে ধরে ফেলে। দেখে ড্রাইভারকে বললাম, ও একজন লোক। মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে, ও কিছু নয়।
মার্টিন বলে ওঠে-শুনুন মিঃ ক্যালামান…।
–আমি ক্যালামান না, ক্যালাও। কি বলবেন বলুন।
–আপনার দুর্ভাগ্যের শেষ থাকবে না।
–এটা আপনার কোন গল্পের ডায়লগ?
–আমাকে অপরাধী করতে চাইছেন। আমি এবার যেতে চাই মিঃ ক্যালামান।
এখন আপনাকে মেরে কদিন শুইয়ে রাখতে পারতাম জানেন?
চেষ্টা করে দেখবেন নাকি?
–সেটা করতে চাই না।
–আপনার অসীম করুণা বলতে হবে।
তবে আপনাকে শেষ পর্যন্ত ভিয়েনা ছাড়তে হবে।
মুখ বিকৃত করে মার্টিন বলে–তাই নাকি?
মার্টিনের কথায় কোন আমল না দিয়ে কিছু টাকা ওর পকেটে গুঁজে দিয়ে বললাম–আশা করি আজকের রাতটা কোন অসুবিধে হবে না। তবে কাল ভোরের প্লেনে লন্ডনের জন্য সীট বুক করে রাখার চেষ্টা করব।
মার্টিন এতক্ষণ চুপ ছিল এবার বলে–তাই নাকি?
–হ্যাঁ
—ও ভয় আমাকে দেখাবেন না।
–ভয়? আপনাকে?
আপনার কথা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে।
–এটা আমার মতামত।
–মানতে পারছি না। আমার এখানে আসার যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক আছে।
–ঠিক আছে তাই তো?
–হ্যাঁ।
–ভাল কথা।
–শুনে খুশী হলাম।
–অন্য শহরের মত এখানেও টাকার দরকার হয়।
জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
কালোবাজারে ব্রিটেনের পাউন্ড ভাঙাতে দেখলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে গ্রেপ্তার, করব।
–আমাকে?
–হ্যাঁ।
ড্রাইভারের হাতে ধরা মার্টিনকে এবার ছেড়ে দিতে বললাম। ছাড়া পেয়ে মার্টিন সোজা হয়ে দাঁড়াল পানীয়র জন্য ধন্যবাদ।
–ঠিক আছে।
তবে আমার মনে হয় এ খবর সরকারের আওতায় পড়ে।
–হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।
আশা করছি দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার আমাদের দেখা হবে।
–এত দেরী করে?
—আপাতত তাই।
কাল চলে যাবার সময় দেখা হবে।
চলে যাবার সময়?
–হ্যাঁ।
–শুধু শুধু কষ্ট করে বিমান বন্দরে যাবেন না কেননা কাল আদৌ যাচ্ছি না স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। আমার এখানে অনেক কাজ আছে।
পরের কথা পরে হবে। এখন হোটেলে যান খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করুন।
ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না।
মার্টিনসহসাআমার দিকে ঘুষি চালাল। কোনরকমেমাথাসরিয়ে নিজেকেবাঁচালাম।ড্রাইভারের আঘাতে মার্টিন মেঝেতে ছিটকে পড়ল। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। মার্টিনকে বললাম, একটু আগে বলেছিলেন, কোনরকম মারামারি করবেননা। মার্টিনরাগে গজগজ করতে করতে ক্ষতস্থান মোছে। হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসতে বললাম ড্রাইভারকে, আমি একটু পানীয় নিয়ে বসলাম।
.
০৩.
পেইন অর্থাৎ আমার ড্রাইভার এর কাছ থেকে নয়, পরবর্তী ঘটনা শুনেছি রোলো মার্টিনের থেকেই।
হোটেল পৌঁছে ম্যানেজারকে আমার নাম করে পেইন বলে এই ভদ্রলোককে একটা ঘর দিতে হবে। মার্টিন এলে ম্যানেজার তাকে জানাল তার ঘর বুক হয়ে আছে। ঘরটা কতদিনের জন্য আছে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারে এক সপ্তাহের জন্য। হঠাৎ পাশ থেকে একজন বলে ওঠে বিমান বন্দরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারিনি বলে দুঃখিত। নিশ্চয়ই খুব অসুবিধা হয়েছে।
–তা একটু হয়েছে।
–আমার নাম ক্রাবিন। হেড কোয়ার্টার থেকে ভুল বার্তা এসেছিল। আমার চেনা একজন লোক, আপনি এসেছেন বলতে সঙ্গে সঙ্গে বিমান বন্দরে যাই।
–আপনি গেছিলেন নাকি?
–হ্যাঁ, কিন্তু ততক্ষণে আপনি চলে গেছেন। আচ্ছা খবরটা হোটেল থেকে পেয়েছেন তো?
–হ্যাঁ।
–মিঃ ডেকস্টার, আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুব খুশী আমি।
ধন্যবাদ।
–ছেলেবেলা থেকে আপনাকে শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকের আসনে বসিয়েছি আমি। আফ্রিকার অগণিত পাঠকের কাছে আপনি প্রিয়। তবে বিষাক্ত ছোবল বইটা আমার সব থেকে ভাল লাগে।
মার্টিন অন্য চিন্তা করছিল, বলে–এখানে কি এক সপ্তাহ থাকতে পারব?
–হ্যাঁ পারবেন।
–অনেক ধন্যবাদ।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে মার্টিন বলে–যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
না, না, মনে করার কি আছে? বলুন কি জানতে চান।
–আমার এখানকার খাবার বিল কে দেবে?
–মিঃ স্মিড।
মিঃ স্মিড? ভাল কথা।
আপনার হাত খরচের জন্যও টাকা দরকার।
–ঠিকই ধরেছেন।
–এটা আমিই দেব।
বেশ ভাল।
–মনে হয় কাল একান্তে কাটাবেন।
–হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন।
–কোথাও যদি বেরোবার হয় কাল জানাবেন।
নিশ্চয়ই।
–ও একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।
–কি কথা?
–পরশুদিন এখানকার এক সভায় উপন্যাসিকদের নিয়ে আলোচনাচক্র বসবে। আপনি সভাপতি হলে ভীষণ খুশী হব।
মার্টিন সানন্দে রাজী হয়ে যায়, কেননা তার মুক্তি দরকার।
পরে আমি জানতে পারি, সুরা, নারী, উত্তেজনা এসবের প্রতি তার দুর্বলতা আছে।
প্রথম থেকে মার্টিনের মুখে রুমাল চাপা থাকায় জাবিন কিছুটা বিনয়ের সুরে এবার বলে মিঃ ডেকস্টার আপনার দাঁতে কি ব্যাথা? আমার একজন ভাল দাঁতের ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় আছে।
-না, আঘাত লেগেছে।
–হায় ভগবান। ছিনতাইকারীদের হাতে পড়েছিলেন নাকি?
–না-না।
–তাও ভাল।
–একজন সৈনিকের হাতে পড়েছিলাম।
–সৈনিক? খুব বদরাগী বোধহয়?
—আমি ওর কর্নেলগিরি ঘুচিয়ে দিলাম।
–দেখি কোথায় লেগেছে।
ক্ষতস্থান দেখে ক্ৰাবিন হকচকিয়ে যায়, কিছু বলে না। মার্টিন পরিস্থিতি সহজ করতে চায়, বলে–নির্জন আরোহী বইটা পড়েছেন?
-বোধহয় না।
–নির্জন আরোহীর সবথেকে প্রিয় বন্ধুকে এক জমিদার গুলি করে মেরেছিল, আর সে আইনের সাহায্যে নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছিল। গল্পটা এই।
–আমি ভাবতে পারিনি এধরণের পশ্চিমী উপন্যাসগুলো আপনি পড়েন।
–আমি কর্নেল ক্যালামিনের পিছনে ঠিক এইভাবে লাগব।
–আচ্ছা এই কর্নেল লোকটি কে?
তার আগে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
বলুন।
–হ্যারী লাইমকে চেনেন?
হ্যাঁ। তবে…..।
–তবে কি?
খুব ভাল করে চিনি না।
–সে ছিল সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আমার।
–আমার মনে হয় না সাহিত্যের চরিত্রের সঙ্গে তার মিল থাকবে।
না মিল নেই।
–আপনি একটা কথা জানেন কিনা জানি না হ্যারি লাইমের থিয়েটারের সখ ছিল।
থিয়েটারে ঝোঁক?
–তাই তো মনে হয়।
–কেন?
মাঝে মধ্যে একজন অভিনেত্রী বন্ধুকে নিয়ে আসত সে।
বয়স কত?
বেশ অল্পই।
—তবু।
কুড়ি বাইশ হবে।
–অভিনয় কেমন করে?
— কাঁচা একেবারে।
মার্টিনের হঠাৎ কবরস্থানের মেয়েটির কথা মনে পড়ে।বলে–আমি হ্যারির কোন বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হতে চাই, যদি সাহায্য করেন।
নিশ্চয়ই। তা এই মেয়েটির সঙ্গে পরিচিত হবেন?
–আমার কোন আপত্তি নেই।
–সেই মেয়েটিকে হয়ত সভায় দেখতে পাবেন।
–মেয়েটি কি অস্ট্রিয়ান?
–যদিও নিজেকে তাই বলে, তবে আমার স্থির বিশ্বাস ও অস্ট্রিয়ান নয়।
কি হতে পারে?
—ও হাঙ্গেরীয়ান। হ্যারিই সম্ভবতঃ ওকে কাগজপত্র ঠিক করে দিয়েছিল।
–মেয়েটির নাম কি?
বলছি বলে ভাবতে থাকে ক্রাবিন।
ও নিজেকে আন্না স্মিড বলে।
মার্টিনের মনে হল আর কিছু জানার নেই, তাই বলে–আমি ভীষণ ক্লান্ত, এবার বিশ্রাম করব। কাল ভোরে আপনাকে ফোন করব।
-ঠিক আছে। যাবার আগে কিছু পাউন্ড মার্টিনকে দেয় ক্রাবিন। মার্টিন জানতে চায় কত পাউন্ড। উত্তরে জানায় ক্ৰাবিন,দশ। এরপরে ক্লান্ত মার্টিন কখন ঘুমের মধ্যে ভিয়েনার স্বপ্ন দেখতে থাকে নিজেই জানেনা। দেখে বরফের মধ্যে পা ঢুকিয়ে হাঁটছে। পাচা ডাকছে, হ্যারির মত একজন কাউকে দেখা গেল। আবার প্যাচাটা জোরে ডেকে উঠতে ঘুম ভেঙে যায় মার্টিনের। শুনতে পায় ফোন বেজে চলেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভার তুলে সাড়া দিল। ও প্রান্তে অপরিচিত কণ্ঠস্বর বলে উঠল, আপনি কি রোলো মার্টিন?
–আপনি কে বলছেন?
–আমায় চিনবেন না।
–তবু পরিচয়টা দিলে ভাল হত।
–আমি হ্যারি লাইমের বন্ধু।
–আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে খুশী হব। আপনি কোথায় থাকেন?
–পুরানো ভিয়েনার মোড়ের মাথায়।
—আমাদের সাক্ষাৎটা কাল করলে ভাল হয়। আজ আমি ভীষণ ক্লান্ত।
–ও, আচ্ছা। আচ্ছা। হ্যারি মারা যাবার আগে আমায় অনুরোধ করেছে যেন এখানে আপনার কোন অসুবিধে না হয় তা দেখতে?
মার্টিন ভাবল, তার তো কথা বলার মত অবস্থা ছিল না। তাহলে, মনে হল কেউ যেন তাকে, সাবধান করে দিল। তাই প্রসঙ্গ বদলাল মার্টিন।
–আপনার নামটা কিন্তু এখনো জানা হল না।
আমার নাম কার্টস। আমি আপনার কাছে যেতাম কিন্তু ঐ অঞ্চলে অস্ট্রিয়ানদের প্রবেশ নিষেধ।
-তাহলে কাল আমাদের পুরনো ভিয়েনায় দেখা হতে পারে।
— ঠিক আছে। কাল অবধি কোন অসুবিধে হবে না তো?
হঠাৎ এ কথা কেন বলছেন?
–মানে হ্যারি বলেছিল আপনার হাতে টাকা পয়সা নেই, তাই। অন্যকিছু ভেবে জিজ্ঞাসা। করিনি।
এখন আমার কোন রকমে চলে যাবে। হ্যারি ঠিকই বলেছিল, আমার প্রকৃত বন্ধু ছিল ও।
–আমি সে জন্যই…।
–অনেক ধন্যবাদ।
না, না, এতে ধন্যবাদের কি আছে। ফোন রাখি তাহলে।
–ঠিক আছে।
মার্টিন ভাবে ভিয়েনায় আমার এই পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে ইনি তৃতীয় ব্যক্তি যে টাকা দিতে চাইছে। মার্টিন রিসিভারনামায় নি,অপরপক্ষও বোধহয় তাই, নাহলেহঠাৎ শুনলকাল সকালে আমাদের দেখা হবে কি?
–সকালে? কটায়?
–এগারটা।
–কোথায়?
–স্ট্রসের পুরনো ভিয়েনায়।
–আপত্তি নেই। ভাল কথা, আপনাকে চিনব কি করে?
–সে ব্যবস্থা করে রেখেছি।
–যেমন?
বাদামী স্যুট পরে থাকব আমি।
–সে তো অনেকেরই থাকতে পারে।
–তা পারে।
–তাহলে তো বোকা বনে যাব।
–আমার হাতে আপনার লেখা বই থাকবে।
–আমার লেখা বই?
হ্যাঁ।
-কোথায় পেলেন?
হ্যারি দিয়েছিল, তাহলে ঐ কথাই রইল।
মার্টিন কোন উত্তর না দিয়ে ফোন নামিয়ে চিন্তায় ডুবে যায়। মনে পড়ে কর্নেল তাকে বলেছিল হ্যারি দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছিল। সহসা তার মনে হল হ্যারির মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। যা পুলিশও বার করতে পারেনি।
.
০৪.
মার্টিন আমায় বলেছিল কার্টসকে প্রথম দেখে একটা ব্যাপার খারাপ লেগেছিল, সেটা পরচুলা। মাথায় ঠিকমতো লাগান ছিল না। অথচ চুলের রেখাগুলো দেখে মনে হয় একটা খেয়ালী মন ও মুগ্ধ করার মত রূপ তার আছে। যখন কথাগুলো শুনছিলাম সেই সময় একটি মেয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল বরফের মধ্য দিয়ে। তাকে দেখে মার্টিনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে, খুশী করার জন্য বললাম বেশ সুন্দরী মেয়েটি না? চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে-সুন্দরী!
–আমার তো তাই মনে হয়।
মেয়েটার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে–ওসব বাদ দিয়েছি মিঃ ক্যালাও। প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন এর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন হয় না।
আপনার কথা অস্বীকার করছিনা। তবেমনেহল মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিলেন তাই বললাম।
ঠিক বলেছেন। কেন জানি না মেয়েটিকে দেখে একজনের কথা মনে পড়ছিল।
কার কথা?
আন্না স্মিড-এর।
–সে কে? সেও তো মেয়ে।
হ্যাঁ। একভাবে বলতে গেলে তাই হয়।
–একভাবে বলতে কি বোঝাচ্ছেন?
–সে ছিল হ্যারির প্রেমিক।
আপনি এখন ওর দেখাশুনা করবেন?
না মিঃ ক্যালাও। সে অন্য ধরণের মেয়ে, দেখেছেন তো হ্যারির কাজের সময়। তাছাড়া এখন ও সব ব্যাপারে থাকতে চাই না।
যাক। আপনি এতক্ষণ কার্টসের কথা বলছিলেন তার কথা বলুন।
–হ্যাঁ, আমি যখন হোটেলে গেলাম তখন দেখি কার্টস নির্জন আরোহী বইটা পড়ার ভান করছে। আমি সামনে যেতেই বলল রুদ্ধশ্বাস ভাবটা দারুণ টিকিয়ে রেখেছেন।
উত্তেজনা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি।
রহস্য ধরে রাখার এক নিপুণ কারিগর আপনি। বই শেষ না করে ওঠা যায় না।
ধন্যবাদ, এবার কাজের কথায় আসি। আপনি হ্যারি লাইমের বন্ধু ছিলেন না?
–শুধু বন্ধু?
–তাহলে?
–সব থেকে অন্তরঙ্গ, অবশ্য আপনাকে ছাড়া।
–তার মৃত্যু হল কিভাবে একটু বলুন।
কার্টস একটু ভেবে বলল–দুর্ঘটনার সময় আমি হ্যারির সাথে ছিলাম। একসাথে আমরা ফ্ল্যাট থেকে বের হই। তারপর কুলার নামে এক আমেরিকান বন্ধুকে দেখতে পেয়ে ও তাকাল। রাস্তা পার হবার জন্য পা বাড়াতে হঠাৎ একটা জীপ মোড় ঘুরে এসে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিল।
তবে সত্যি বলতে গেলে ওরকম ভাবে রাস্তা পার হওয়া তার উচিত হয়নি।
–হ্যারির একজন প্রতিবেশী যে বলল ওর তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে।
–তাহলে তো ভালই হত।
–কেন?
–অ্যাম্বুলেন্স ডাকা অবধি বেঁচে ছিল।
মার্টিন অবাক–তাহলে সে কথা বলেছিল।
–শেষ সময়ে আপনার সম্বন্ধে কিছু বলেছিল।
আমার সম্বন্ধে!
–হ্যাঁ।
–কি বলেছিল?
এ মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না, তবে অনুরোধ করেছিল আপনি এখানে এলে আপনার দেখাশুনা করার।(একটু থেমে) আমি আপনার ফিরে যাবার বন্দোবস্ত করে রেখেছি।
মার্টিন একথার উত্তর না দিয়ে বলল–হ্যারি মারা যাবার সাথে সাথে আমায় আসতে বারণ করলেন না কেন?
–আমি তার করেছিলাম।
করেছিলেন?
–হ্যাঁ।
–কিন্তু আমি তো পাইনি।
দুর্ভাগ্যবশতঃ আপনার হাতে গিয়ে পৌঁছয়নি।
–তাই হবে। আমারও কপাল, না হলে এ দৃশ্য আমায় দেখতে হয়!
ভিয়েনার এখন যা অবস্থা তার সেলার হতে পাঁচ ছদিন লেগে যায়।
–আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?
–কি কথা?
–হ্যারির সম্বন্ধে।
–স্বচ্ছন্দে।
–আচ্ছা আপনি জানেন, হ্যারিকে পুলিশ সন্দেহকরত কোন বাজে ব্যাপারে জড়িত ছিল বলে।
সবাই জানে আমরা সিগারেট জাতীয় জিনিষ বিক্রি করে রোজগার করি।
তাহলে পুলিশ সন্দেহ করছে কেন?
–তা তো বলতে পারব না। মাঝে মাঝে পুলিশের মাথায় অদ্ভুত তত্ত্ব ফেরে।
আপনাকে একটা কথা বলি নিশ্চয়ই খুশী হবেন।
বলুন কি বলবেন। আমার ভাল লাগছে আপনার কথা শুনতে।
–আপনি আমার যাবার ব্যবস্থা করলেও এখন আমি যাব না।
ভ্রু কুঁচকে বলে কার্টস–যাবেন না?
না।
–কারণটা যদি দয়া করে বলেন।
–আমি, পুলিশের ধারণা যে মিথ্যে তা প্রমাণিত করে তবে যাব।
–তাতে লাভ? আমরা কি হ্যারিকে ফিরিয়ে আনতে পারব?
–তা পারব না ঠিকই…।
কার্টস মার্টিনকে থামিয়ে দিয়ে বলে–ওসব পুলিশী ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াবেন না দয়া করে।
জড়াতে আমি চাই না। আমি দেখতে চাই কর্নেলকে, যে হ্যারিকে দোষী বলছে। ওকে, ভিয়েনা ছাড়া করব আমি।
–আমি বুঝতে পারছি না কি করতে চাইছেন।
–হ্যারির মৃত্যুর রহস্য অনুসন্ধান করব।
অনুসন্ধান? আবার তো পুলিশী ঝামেলা।
এছাড়া কোন উপায় নেই।
–একথা কেন বলছেন?
–হ্যারি আমার প্রিয় বন্ধু, তাকে কেউ বদনাম করবে আমি সহ্য করব না।
–আমি আপনার রাগের কারণটা বুঝছি, তবু যদি…।
–উপায় নেই। আমাকে একটু সাহায্য করবেন?
–কি ব্যাপারে?
কুলারের ঠিকানাটা দেবেন?
নিশ্চয়ই।
–ওর, আর ড্রাইভারেরটাও।
ড্রাইভারের ঠিকানা তো জানি না।
–পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকে জেনে নিতে পারব মনে হয়।
–আচ্ছা।
–হ্যারির সেই প্রেমিকাকে কোথায় পাওয়া যাবে?
–হ্যারির প্রেমিকা?
–হ্যাঁ। তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
কিন্তু…
–কিন্তু কি?
–দেখা না করাই ভাল।
–এ কথা কেন বলছেন?
–হ্যারির ব্যাপারে কথা বললে মেয়েটি দুঃখ পাবে।
দুঃখ পাবে? কিছু করার নেই, আমার হ্যারির বিষয়ে জানা দরকার। একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
নিশ্চয়ই।
–হ্যারিকে পুলিশ কি ব্যাপারে সন্দেহ করছে আপনি জানেন?
না, জানি না।
–অবশ্য অনেক কাজের বন্ধুও জানতে পারে না।
আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
—কি কথা?
–আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে আপনি হ্যারির ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কিছু নোংরা বেরিয়ে পড়ল।
–নোংরা?
–হ্যাঁ।
ঝুঁকি তো নিতেই হবে।
–আপনি খোঁজ করুন তাতে আমার আপত্তি নেই। তবে একটা কথা ভেবে দেখেছেন?
–কি কথা?
–এতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টাকাও দরকার।
সময় যথেষ্ট আছে, আর টাকার ব্যাপারে আপনি সাহায্য করবেন না?
যদিও ধনীনই, তবু হ্যারিকে কথা দিয়েছিলাম আপনার থাকার ও শোওয়ার ব্যবস্থা করব।
–কিছু একটা ব্যাপারে বাজী ধরতে পারি আপনার সঙ্গে?
–কি ব্যাপারে? আমার স্থির বিশ্বাস হ্যারির মৃত্যুর পিছনে কোন রহস্য আছে।
রহস্য?
–হ্যাঁ।
রহস্য বলতে কি বোঝাতে চাইছেন?
–আমার ধারণা পুলিশের ব্যাপারে হ্যারির মৃতদেহ যতটা সুবিধা করেছিল, আসল ব্যাপারে যারা জড়িত তাদেরও কি ততটা সুবিধে হয়েছিল?
কথাটা শুনে কার্টস মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল–সাহায্যের দরকার হলে আমায় বলবেন।
–সে তো বলবই। এখন কুলারের ঠিকানাটা দিন।
কাগজে ঠিকানাটা লিখে দেয় কার্টস।
–আপনার ঠিকানাটা পেলে ভাল হত।
–আমার ঠিকানা?
–হ্যাঁ বিদেশে আছি তো, কখন কি দরকার লাগে তাই।
–ঠিক আছে।
ধন্যবাদ।
কার্টস উঠে পরচুলা ঠিক করে বলে–আমার সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবেন না। এরপর লেখার প্রশংসা করে চলে যায়। কিন্তু মার্টিনের মনে হল হাসি কৃত্রিমতায় ভরা। সন্দেহের চোখে তার চলে যাওয়া দেখতে লাগল সে।
.
০৫.
যোশেফস্টাডের থিয়েটারে স্টেজের কাছে একটা চেয়ার নিয়ে মার্টিন বসে আছে আন্না স্মিডের অপেক্ষায়। একটা কার্ড পাঠিয়েছে হ্যারির বন্ধু লিখে।
হঠাৎ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে–মিঃ মার্টিন। তাকিয়ে দেখে উপরে পর্দার ফাঁকে আন্না স্মিড দাঁড়িয়ে। দেখতে খুব একটা সুন্দরী নয়। তবে আলগা শ্ৰী আছে। চুল কাল, বাদামী চোখ, চওড়া কপাল।
মেয়েটি বলে–আপনি কি ওপরে আসবেন?
নিশ্চয়ই।
–আমার ঘরটা ডানদিক থেকে দ্বিতীয়টা। একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায় মার্টিন আমায় বলেছিল, এ জগতে কিছু লোক আছে যাদেরকে দেখে মনে হয় নিরীহ। আন্না স্মিড সেই দলের একজন।
মার্টিন আন্নার ঘরের সামনে এসে অনুমতি চায় প্রবেশের জন্য। আন্না মার্টিনকে স্বাগত জানায়। ঘরে ঢুকে মার্টিন লক্ষ্য করল অভিনেত্রীদের ঘরের মত ঘর নয়, পোশাক, প্রসাধন দ্রব্য কিছু নেই, শুধু এক জায়গায় কেটলীতে জল গরম হচ্ছে। আন্না মার্টিনকে প্রশ্ন করেচা খাবেন? চা খেতে ভাল না বাসলেও বলে, হ্যাঁ। মার্টিনকে চা দিয়ে, নিজে নিয়ে দুজনে মুখোমুখি চেয়ারে বসে। মার্টিন তাড়াতাড়ি চাটা খেয়ে নিয়ে কাপটা এগিয়ে রেখে বলে–আপনাকে কটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
বলুন কি জানতে চান?
হ্যারির ব্যাপারে আপনার সঙ্গে দরকার ছিল, তাই না এসে পারলাম না।
অবাক হয়ে আন্না বলে–হ্যারির ব্যাপারে?
–হ্যাঁ।
নিস্পৃহ ভাবে জিজ্ঞাসা করে–কি জিজ্ঞাস্য বলুন?
মার্টিন ভাবল নিজের সম্বন্ধে কিছু জানান ভাল, কেননা সে ছিল তারবন্ধু। তাই বলে আপনি হয়তো জানেন আমাদের পরিচয় দীর্ঘ কুড়ি বছরের। আমরা এক স্কুলে পড়তাম, পরবর্তীকালেও সম্পর্ক নষ্ট হয়নি।
–আপনার কার্ড দেখে আমি না করতে পারিনি, কিন্তু হ্যারির ব্যাপারে কিছু বলার নেই।
–কিন্তু আমি হ্যারির সম্বন্ধে…।
মার্টিনকে কথার সাথে সাথে আন্না বলে হ্যারি আজ মৃত।
–আমরা দুজনেই তো তাকে ভালবাসি।
বাসতাম।
না, এখনো ভালবাসি, আমার হৃদয়ের মধ্যে রয়েছে ও।(একটু থেমে) আপনি কুলার বলে কাউকে চেনেন?
–সেই আমেরিকান ছেলেটা?
–হ্যাঁ।
–হ্যারি মারা যাওয়ার পর আমায় কিছু টাকা দিয়ে বলল এটা হ্যারি দিতে বলেছে।
–হ্যারি মারা যাবার সময়ও তোমার কথা চিন্তা করেছেতাতে মনে হয় খুব একটা যন্ত্রণা পায়নি।
–সে কথাটাই নিজেকে সব সময় বোঝাতে চাই, চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। তবু এক এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
–আচ্ছা হ্যারি মারা যাবার সময় আপনি কি ডাক্তারের কাছে গেছিলেন?
না, তখন যাবার মত মনের অবস্থা ছিল না। অন্যরা গেছিল।
–সেই ড্রাইভারটা কোর্টে কি বলেছিল, মনে আছে?
–হ্যাঁ, তবে…
তবে কি?
ড্রাইভারটা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
–কেন?
–ও হ্যারিকে চিনত।
–তারপর?
–শেষে কুলারের সাক্ষী ওকে বাঁচাল।
হঠাৎ জানালার বাইরে থেকে আমাকে কেউ ডাকতে ইতস্তুতঃ বোধ করল, সে তারপর বলল–এখানে বেশীক্ষণ থাকার নিয়ম নেই। তাই…
মার্টিন তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করে পুলিশ কেন ওকে সন্দেহ করছে, আপনি জানেন?
না।
আমার মনে হয় মারাত্মক কিছুর সঙ্গে সে জড়িয়ে পড়েছিল।
আপনার অনুমান হয়ত সত্যি।
–আচ্ছা কার্টস বলে কাউকে চেনেন?
–ঠিক মনে পড়ছে না।
যদি চিনতে পারেন, লোকটি পরচুলা পরে।
–ও, সেই লোকটার কথা জিজ্ঞাসা করছেন? আচ্ছা, ওরা সবাই মিলে হ্যারিকে খুন করেনি তো? আমার তো ডাক্তারটাকেও সন্দেহ হয়। আর ভেবে কি হবে সবই তো শেষ।
কিন্তু আমি কাউকে ছাড়ছি না।
কী করবেন?
–হ্যারির মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব।
আবার বাইরে থেকে মেয়েটিকে কেউ ডাকল। মার্টিনবলে–আমি চলি, আবার হয়ত আসতে হতে পারে।
–একটু দাঁড়ান। –
-কিছু বলবেন।
-হ্যাঁ।
বলুন।
–আমিও আপনার সঙ্গে যাব।
–ও আচ্ছা। কুয়াশার মধ্য দিয়ে দুজনে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। গুড়ো গুড়ো বরফ পড়ছে সমানে। মার্টিনের বেশ শীত করছে, মনে হল শরীরটাকে চাঙ্গা করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু, মনের যা অবস্থা তাতে কোন ক্লাবে যেতে ইচ্ছা করছে না। অগত্যা একটা সিগারেট ধরাল মার্টিন, আন্নাকেও দিলে আন্না নেয় না। মার্টিনের মাথায় নানা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। সবই বন্ধুকে ঘিরে, তবে একটা ব্যাপার তার আশ্চর্য লাগছে আন্নারকথা হ্যারি তাকে জানায়নি। জানালে তার সঙ্গে রসিকতা করতে পারত।পারত-বিয়ে করেছ নিশ্চয়ই, কেমন দেখতে?সাংঘাতিক সুন্দরী!অভিনেত্রীযখন। আগে বলত–আলাপ না করিয়ে দাও একটা ফটো তো পাঠাও, দেখে চক্ষু সার্থক করি। তারপর উইক এন্ডে প্লেজার ট্রিপে কোথায় যাচ্ছ? আগে থেকে হনিমুনের জায়গা ঠিক আছে তো!
মার্টিন চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে একটা।
–মিঃ মার্টিন কিছু ভাবছেন?
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে লজ্জিত হয়ে পড়ে, বলে কিছু বলছিলেন?
বলছি, কি ভাবছেন?
–তেমন কিছু না।
আমার মন কিন্তু অন্য কথা বলছে।
–কি কথা?
বলব?
নিশ্চয়ই।
–আপনি কিছু লুকোবার চেষ্টা করছেন?
–আমি? আপনাকে লুকোব?
আমার তো তাই মনে হচ্ছে।
–তাহলে সত্যি কথা বলি।
বলবেন বৈ কি?
–কিছু মনে করবেন না তে?
না,না, মনে করার কি আছে!তাছাড়া আপনি আমায় এমন কিছুঅসম্মতিজনক কথা বলবেন না নিশ্চয়ই? বিশেষ করে যখন হ্যারির বন্ধু ছিলেন।
–আসলে, আপনার সঙ্গে হ্যারির যে পরিচয় আছে সেটা আমায় আদৌ জানায় নি ও।
ও।
–অথচ সব কথা বলত ও, আমায় কিছু লুকোত না।
–জানান উচিত ছিল। তবে একটা কথা বলতে পারি।
–কি?
–আপনি যখন হ্যারির বন্ধু তখন আজ থেকে আমার বন্ধু।
মার্টিন খুশী হয়ে বলে-মিস্ স্মিড!
–হ্যাঁ মিঃ মার্টিন।
–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নানা এতে ধন্যবাদের কি আছে। আর হ্যারির বন্ধু যখন নিশ্চয়ই ওর মত ভাল। তাই এত কথা আপনাকে বললাম। আসলে…।
–থামলেন কেন? বলুন।
–আসলে বড্ড একা হয়ে পড়েছি। নিঃসঙ্গতা কাটাতে আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। একা থাকলে হ্যারি যেন সামনে এসে দাঁড়ায়, ওর নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় আমার পাগলের মত অবস্থা হয়। সহ্য করতে পারি না। মনে হয় সত্যিই পাগল হয়ে যাব।
-না, না ও কথা বলবেন না।
বলতে তো চাই না। কিন্তু, না বলেও থাকতে পারছি না। ওকে বোঝা যায় না।
আন্না যদি এ মুহূর্তে কাঁদতে পারত তাহলে হাল্কা হত। কাঁদতে পারছে না বলে আরও গুমরে রয়েছে, মার্টিন ভাবে।
–আসলে ও ছিল আমার একমাত্র অবলম্বন। সিগারেটটা বিস্বাদ লাগছে এবার মার্টিনের, ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দুজনে বিষণ্ণ ও ভারাক্রান্ত মনে পাশাপাশি চলতে থাকে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর মার্টিন বলে–একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম।
–কি কথা? আন্না যেন স্বস্তি পেল। এতক্ষণ চুপ করে থেকে ভিতরে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল।
না, জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে না। হয়তো আপনি…।
–আমি কি?
দুঃখ পাবেন।
করুন হাসি হেসে বলল-দুঃখ?
-হ্যাঁ।
নতুন করে কি দুঃখ দেবেন। যা পাবার তো পেয়েছি, এখন কোন কিছুতেই কিছু হয় না, সহ্য হয়ে গেছে। বলুন, কি বলবেন?
ইতস্ততঃ করে বলে মার্টিন–আপনি কি হ্যারিকে আগে থাকতেই চিনতেন?
আন্না যদি চেনে তাহলে হ্যারির সম্বন্ধে অনেক খবর হয়ত পাওয়া যাবে, যা তার কাছে অজানা।
অনেক কষ্টে যেন উত্তর দেয়–না।
–প্রথম পরিচয় কিভাবে হল?
আন্না চলা থামিয়ে বলে, আমাদের প্রথম পরিচয়?
মেয়েটিকে ও ভাবে দাঁড়াতে দেখে মার্টিন কুণ্ঠিত হয়, মনে ভাবে না জিজ্ঞাসা করলেই ভাল হত। যদি না জানতে চাইতে এখন, কি ক্ষতি হত। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হয় তার। সঙ্গে সঙ্গে বলে–যদি কোন আপত্তি না থাকে। কথাটা যেন জোলো হয়ে গেছে এই ভেবে আবার বলল–আমার কৌতূহল আপনার দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
-না না, আপনি এত সংকোচ করবেন না, আমি ওর ব্যাপারে সবকিছু আপনাকে বলতে চাই। আর…আবার বলতে শুরু করে আন্না।
–আর কি?
–আপনার মধ্যে দিয়ে ওকে নতুন করে জানছি।
হঠাৎ এ কথা বলছেন কেন?
কথাটা মনে হল, তাই বললাম। আপনার ভয়ের কিছু নেই।
–আমি ভয় পাইনি। মানে আপনার কথাগুলো ঠিক…।
বুঝতে পারছেন না, তাইতো?
–হ্যাঁ।
–আসলে আপনি তো ওর বন্ধু, ওর ব্যাপারে অনেক কথা জানতে পারব।
–অবশ্যই পারবেন।
–যে কথা হচ্ছিল, হ্যারির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ঐ যোশেফস্টাড থিয়েটারে।
থিয়েটারে?
–হ্যাঁ।
–কিন্তু…
–কিন্তু কি?
–ওর সিনেমা থিয়েটারের প্রতি অনুরাগ ছিল, তা তো জানতাম না।
–ছিল কিনা বলতে পারব না।
–তারপর?
–সেদিন বোধহয় ছুটির দিন ছিল। তারিখটা মনে আসছে না, ডায়রী দেখলে জানা যাবে। আমার ঘরে আছে।
ডায়রীতে সব কিছু লেখেন বোধহয়?
–সব কিছু নয়।
–তবে?
–মানে স্মরণীয় কিছু ঘটনা আর কি!
–সেদিন ওর আসাটা আপনার কাছে সেরকম কিছু মনে হয়েছিল।
এখন নাও হতে পারে।
এরপর?
–হা মনে পড়েছে, গুড ফ্রাইডে ছিল সেদিন।
সবে অভিনয় শেষ হয়েছে। খুব ক্লান্ত লাগাতে পোশাক না ছেড়েই শুয়ে পড়েছিলাম। ঘরে অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছিল, দরজা ভেজান। থিয়েটারের একটা কাজের ছেলে এসে বলল-মিস স্মিড, ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি?
আমি চোখ না খুলেই সাড়া দিলাম।
–আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন একজন।
–আমার সঙ্গে?
–হ্যাঁ। উপরে নিয়ে আসব?
এর আগে কোনদিন এসেছিল?
না।
নাম জিজ্ঞাসা করেছ? চিন্তিত হয়ে পড়ে আন্না।
করেছি।
–কি নাম?
–হ্যারি লাইম।
–ও নামে কাউকে আমি চিনি না। অন্য কাউকে ডাকছে দেখ। শুনতে ভুল হয়েছে তোমার।
–কিন্তু নিজের কানে শুনেছি।
–ভুল হয়েছে বলছি তো।
–ভুল।
–হ্যাঁ। আন্না যেমন ছিল সেরকমই থাকে।
–আমি গিয়ে আর একবার জিজ্ঞাসা করব?
যাও।
একটু পরে ছেলেটি ফিরে এসে বলল হ্যাঁ, আপনাকেই ডাকছেন।
–ঠিক আছে নিয়ে এস।
অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠতেই হল। একটু পরে হ্যারি এল। কাজের ছেলেটি চলে যেতে ফুলের তোড়া আমার হাতে দিয়ে হেসে বলল–আজকের অভিনয়ের জন্য ধন্যবাদ।
আনন্দের সঙ্গে ফুলগুলো নিয়ে হ্যারিকে ধন্যবাদ জানাই। খেয়াল হয় ওকে বসতে বলি নি। সোফায় বসতে বলি।
আপনাকে বিরক্ত করছি না তো?
না না। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? –হ্যাঁ বলুন।
একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
–কোন কথা?
–আমার অভিনয় ভাল লেগেছে?
হেসে মাথা নাড়ে হ্যারি।
-ধন্যবাদ!
–আপনি ক্লান্ত জেনেও আলাপ করতে এলাম।
–কিন্তু আমাকে তো সবাই অভিনেত্রী হিসাবে কদর করে না।
–ওটা বাড়াবাড়ি। ভাল অভিনয় করতে না পারলে থিয়েটার গোষ্ঠী কি আপনাকে পুষত?
–একটু কফির ব্যবস্থা করি। কেননা এখন মদ দিতে পারব না।
–ওসব কিছু চাই না। আপনি কথা বলুন তাতেই হবে।
–আমি বড় দরের অভিনেত্রী তো নই, সেজন্য অন্তত একটু কফি হোক।
–অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমার এখন একটু পানীয় দরকার।
হ্যারি কফি শেষ করে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ডায়রী এগিয়ে দেয় আন্নার দিকে। তাকে উঁচু আসনে বসাতে কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে আন্না, তারপর ক্রমশঃ দুজনে দুজনার কাছাকাছি এসেছে। আনন্দের মাঝে হারিয়ে গেছে।
নিঃশব্দে মার্টিন ও আন্না হেঁটে চলেছে। তার নিজের ঘটনা বলা শেষ। হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম স্টপেজে এসে দাঁড়িয়েছে তারা। আন্না বলে-এবার ট্রামে উঠতে হবে।
যাবেন বই কি।
আবার দেখা হলে খুশী হব।
–আমিও।
কিছুটা ইতস্ততঃ করে আবার বলে একটা কথা বলার ছিল আপনাকে।
-হ্যাঁ বলুন। এত সঙ্কোচের কি আছে।
না ঠিক সঙ্কোচ নয়। তবে যদি অভয় দেন তো বলি।
–মানে অনুমতি?
–হ্যাঁ।
কথাটা খুব সাধারণ বলে মনে হচ্ছে না।
না তেমন কিছু নয়।
–তাহলে অনুমতি চাইছেন কেন?
–মানে আপনাকে বলতে ঠিক ভরসা পাচ্ছি না।
–তা কথাটা কি?
–মানে আমি বলছিলাম…
বলুন কি বলবেন। এত ইতস্ততঃ করার কিছু নেই। আর আমি তো আগেই বলেছি, আপনি হ্যারির বন্ধু, কখনো খারাপ ব্যবহার করতে পারেন না আমার সাথে।
-সে তো ঠিকই।
–তাহলে এত দ্বিধা কেন?
আমি বলছিলাম, আপনার ডায়রীতে আজকের কথাগুলো লিখে রাখবেন? না।
–লিখবেন না?
না।
কারণটা যদি বলেন?
–হ্যারি মারা যাবার পর থেকে আর লিখি না। এখন আমার লেখার কি আছে? নিজের জীবন নিজের কাছেই মিথ্যা মনে হচ্ছে।
না-না, একথা বলছেন কেন?
বলতে তো চাই না, কিন্তু চলে আসে। যত রাত বাড়তে থাকে তত হ্যারি যেন সামনে এসে দাঁড়ায়, কথা বলতে চায়। আমি শুধু বোবা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি। কিছু বলতে পারি না। সে কী যন্ত্রণা, বলে বোঝান যাবে না। আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি।
কিন্তু আপনার সামনে সমস্ত জীবন পড়ে আছে। এভাবে ভেঙে পড়লে বাঁচকেন কি করে!
–সে কথা ভাবতে পারছি না।
না ভাবলে তো চলবে না।
আমি সব কিছু ভুলে যেতে চাই।
–মানুষ তো তা পারে না। তার চাহিদা অনেক।
চাহিদা?
–হ্যাঁ।
করুণ মুখ করে বলে আন্না–এখন আর চাহিদা বলে কিছু নেই, সব ফুরিয়ে গেছে।
এখন মন উতলা, তাই এরকম মনে হচ্ছে। একদিন দেখবেন…।
মার্টিনকে থামিয়ে দেয় আমা, আর এসব আলোচনা তার ভাল লাগছে না। মনে হল মার্টিন তার কথায় কিছু মনে করতে পারে। কিন্তু কি করবে? তার মনের কথা সেই জানে।
ট্রাম এসে পড়তে বিদায় নিয়ে চলে যায় আন্না।