আকাশ ছিল ঘন মেঘে ঢাকা। কিন্তু রবিবারের ছুটিটা উপভোগ করতে অভ্যাসমতো বেরিয়ে পড়েছিলুম। ইলিয়ট রোডে আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের বাড়ির লনে সবে গাড়ি ঢুকিয়েছি, অমনি টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
গাড়ি পার্কিং জোনে রেখে হন্তদন্ত সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলুম। তারপর তিনতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের ডোরবেল টিপলুম। ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে আমাকে দেখে একগাল হেসে চাপা স্বরে বলল, টিকটিকিবাবু চোর ভেবে বাঘ। ধরার গল্প করছেন!
ষষ্ঠীর কথাবার্তা এ রকমই। বুঝলুম, টিকটিকিবাবু–মানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই তাঁর পুলিশজীবনে কোথাও রাতবিরেতে চোর ধরতে গিয়ে বাঘের পাল্লায় পড়েছিলেন, সেই ঘটনা শোনাচ্ছেন।
কর্নেলের ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ সহাস্যে বললেন, আয়েন! আয়েন জয়ন্তবাবু! জাস্ট এইমাত্র কর্নেল স্যারেরে কইতাছিলাম, জয়ন্তবাবু। থাকলে একখান থ্রিলারের মশল্লা পাইতেন।
বললুম, চোর আর বাঘের থ্রিলার?
পুলিশের প্রাক্তন দারোগা গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে বললেন, আঁ? আপনারে কইল কেডা?
বৃদ্ধ প্রকৃতিবিজ্ঞানী অ্যাশট্রেতে চুরুট রেখে বললেন, একটু গোয়েন্দাগিরি করুন হালদারমশাই!
কথাটা শোনামাত্র হালদারমশাই নড়ে বসলেন। হঃ! ডোরবেল বাজল। তারপর জয়ন্তবাবু ঘরে ঢুকলেন। তার মানে– বলে তিনি দ্রুত একটিপ নস্যি নিলেন।
কর্নেল বললেন, তার মানে খুব সোজা!
গোয়েন্দাপ্রবর এবার হেসে উঠলেন। বুঝছি! ষষ্ঠী ওনারে কইয়া দিছে। কী কাণ্ড!
সোফার একপ্রান্তে বসে বললুম, পুরোটা ষষ্ঠী বলেনি। আপনি নাকি চোর ভেবে একটা বাঘকে ধরেছিলেন! তা বাঘটা চুপচাপ ধরা দিয়েছিল কি? তাছাড়া আরও প্রশ্ন আছে। বাঘের চারটে ঠ্যাঙ। হাতকড়া দরকার দুদুটো।
হালদারমশাই একটু গম্ভীর হলেন। জোক না জয়ন্তবাবু! যখনকার কথা কইতাছিলাম, তখন বাঘও পুলিশের ভয় পাইত। আইজকাল ছুঁচাগুলিও পুলিশেরে ল্যাং মারে। কর্নেল স্যারেরে জিগান, ক্যান এ কথা কইতাছি।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত খবরের কাগজের লোক হয়েও কাগজ পড়ে না এটাই সমস্যা!
গোয়েন্দাপ্রবর আজকের একটা কাগজ খুলে বললেন, জয়ন্তবাবুদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার খবর। হেডিং দিছে, চোর বাঘ এবং পুলিশ।
হাত বাড়িয়ে বললুম, দেখি কী খবর?
হালদারমশাই কাগজটা আমাকে দিলেন। সেই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল বললেন, কাগজ পরে পড়বে জয়ন্ত! মনে হচ্ছে, মূর্তিমান খবর এসে গেছে। কাটায় কাটায় আটটা।
ষষ্ঠী এসে বলল, একজন ভদ্রলোক বাবামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এয়েছেন।
কর্নেল যথারীতি চোখ কটমটিয়ে বললেন, নিয়ে আয়। তারপর কফি।
কর্নেলের মুখে মূর্তিমান খবর শুনে একটু অবাক হয়েছিলুম। এবার অবাক হলুম আগন্তুককে দেখে। দশাসই চেহারা। কাঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। পরনে প্যান্ট-স্পোর্টিং গেঞ্জি। আর কাঁধে ঝুলন্ত একটা কিটব্যাগ। তিনি কর্নেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, হ্যাল্লো কর্নেল সরকার! আশা করি আমাকে চিনতে পেরেছেন!
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলুম মিঃ সিংহরায়। আপনার সময়জ্ঞান যে ইউরোপিয়ানদের মতো, তা আমার অবশ্য জানা। হা–আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরি। সাংবাদিক। ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে কে হালদার। আমরা এঁকে হালদারমশাই বলে ডাকি। আর জয়ন্ত! ইনি মিঃ সুদর্শন সিংহরায়। আহিরগঞ্জে এঁরই ফার্মের ঘটনা নিয়ে আজকের কাগজে খবর বেরিয়েছে।
মিঃ সিংহরায় একটু হেসে বললেন, দেরিতে পাওয়া খবর। সম্ভবত পুলিশসূত্রে। তো মিঃ হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ জেনে খুশি হলুম। তবে। পুলিশের ডিটেকটিভ যেখানে ব্যর্থ, সেখানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কতটা এগোতে পারবেন জানি না।
হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন, আমি চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে ছিলাম। ইন্সপেক্টর হইয়া রিটায়ার করছিলাম।
মিঃ সিংহরায় হাসিমুখে বললেন, তা হলে আপনার অবশ্য একটা শক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড আছে।
আছে। হালদারমশাই দৃঢ়তার সঙ্গে কথাটা উচ্চারণ করলেন। তারপর বললেন, জানেন? আইজ মর্নিংয়ে খবরটা পড়ামাত্র আমার মনে পড়েছিল রায়পুরের ঘটনা। রোজ রাত্রে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে চোর পড়ত।
ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে আনল। কর্নেল বললেন, গল্পটা পরে শোনাবেন হালদারমশাই! আগে আরেক দফা কফি খাওয়া যাক।
সেই ফাঁকে আমি খবরটাতে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলুম। নিজস্ব সংবাদদাতা সম্ভবত একটু রঙ চড়িয়েই খবরটা লিখে পাঠিয়েছিলেন। আমাদের নিউজরুমে যিনি মফস্বলের খবর এডিট করেন, তিনিও হয়তো আরও একটু রঙ চড়িয়েছেন। কারণ খবরটা বেজায় অদ্ভুত।
সম্প্রতি আহিরগঞ্জে বক্রেশ্বর নদের তীরে একটি ভেষজ উদ্ভিদের ফার্মে প্রতিরাত্রে চোরের উপদ্রব হচ্ছিল। ফার্মের মালিক এবং তাঁর কর্মচারীরা চোর ধরার জন্য ওত পেতে বসে ছিলেন। সে-রাত্রে জ্যোৎস্না ছিল। তারা চোরকে পাঁচিলের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকতে দেখে টর্চ জ্বেলে ছুটে যান। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, তাদের হইহল্লা এবং তাড়া খেয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে এবার একটি বাঘ পালিয়ে যায়। বাঘটি পালানোর আগে ও পরে গর্জন করেছিল। তারা চোরকে কিন্তু খুঁজে পাননি। মালিক ভদ্রলোক বন্দুক থেকে কয়েক রাউন্ড ফায়ারও করেছিলেন। দুদিন পরে আরেক রাত্রেও অবিকল একই আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। এবার মালিক পুলিশের শরণাপন্ন হন। কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল এবং পুলিশের একজন সাবইন্সপেক্টর ফার্মের ভেতর ও বাইরে ঝোপের মধ্যে ওত পেতে বসেছিলেন। চোর চুপিচুপি এসে পাঁচিলে ওঠামাত্র পুলিশ বাহিনী তাকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু অমনই চোর তাদের চোখের সামনে একটি বাঘের রূপ ধরে। বাঘের গর্জনে হতচকিত ও ভীত পুলিশবাহিনীর চোখের সামনে দিয়ে। বাঘটি পালিয়ে যায়।…।
মিঃ সিংহরায় বললেন, বৃষ্টিটা বেড়ে গেল দেখছি। কাজের কথা সেরে নিয়ে শিগগির বেরিয়ে পড়তে চাই কর্নেল সরকার!
কর্নেল বললেন, আপনি কি আজই আহিরগঞ্জে ফিরতে চান?
হ্যাঁ। বুঝতেই পারছেন ওই ভুতুড়ে ঘটনায় আমার ফার্মের লোকেরা ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে গেছে। আমি উপস্থিত না থাকলে ওরা হয়তো ফার্ম ছেড়ে পালিয়ে যাবে।
আমি বললুম খবরে যা লেখা হয়েছে, তা কি সত্যি?
মিঃ সিংহরায় একটু হেসে বললেন, অনেকটা সত্যি। তবে পুলিশ প্রথমে পাঁচিল ডিঙিয়ে চোরকে ঢুকতে দেখেছিল। কিন্তু পুলিশের তাড়া খেয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সত্যিই একটা বাঘ ফার্মের ঝোপঝাড় থেকে এক লাফে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাচ্ছে। যদি বলেন, এটা নিছক কোইনসিডেন্স, তা হলে বলব একই ঘটনা তিন-তিনবার ঘটলে তা কেমন করে কোইনসিডেন্স হয়? তাই ব্যাপারটা ভূতের কীর্তি বলে গুজব রটেছে।
তার মানে ভূতটা চোর হয়ে ঢোকে আর বাঘ হয়ে বেরিয়ে যায়?
আমার কথায় কর্নেল হেসে উঠলেন। মিঃ সিংহরায় বললেন, কতকটা তা-ই তবে ক্রোকাস্ স্যাটিভাস্ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদের ওপরই যেন ভূতটার বড় আক্রোশ। প্রায় এক একর জমিতে ওই গুল্মজাতীয় গাছের চাষ আছে। তিন রাত্রে প্রায় কাঠা পাঁচেক জমির ক্রোকাস্ স্যাটিভাস্ তছনছ!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কফি খেতে খেতে কথা শুনছিলেন। বললেন, কী কইলেন? কী কইলেন?
কর্নেল বললেন, ক্রোকাস স্যাটিভাস। এটা অবশ্য ইংরেজি উচ্চারণ। শব্দদুটো লাতিন ভাষার। তাই শুদ্ধ উচ্চারণ হলো ক্রোকাস্ সাতিবা। এই উদ্ভিদের ফুল থেকে জাফরান তৈরি হয়। বিজ্ঞ হালদারমশাই নিশ্চয় জাফরান রঙ চেনেন?
হালদারমশাই আস্তে বললেন, হঃ!
মিঃ সিংহরায় বললেন, একসময় পাহাড় বা রুক্ষ মাটিতে এই গুল্ম স্বাভাবিকভাবেই জন্মাত। কাশ্মীর, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, ইরাক, ইরান– এমন কি তুরস্কেও আগাছার মতো গজিয়ে থাকত। ফুল ফুটলে ফুলের পরাগ বা গর্ভকেশর ছিঁড়ে ফেলে গর্ভগৃহ সাবধানে বেছে শুকোনো হতো। তারপর গুঁড়ো করলেই গাঢ় কমলা রঙ পাওয়া যেত। পোলাও-বিরিয়ানিতে সেই খাঁটি জাফরান রঙ ব্যবহার করলে সুস্বাদু আর সুগন্ধী হয়ে উঠত। আজকাল খাঁটি জাফরান দুষ্প্রাপ্য বললেই চলে। দুর্মূল্য তো বটেই। দেশবিদেশের ফাইভস্টার হোটেলের বিশেষ-বিশেষ খাদ্যে খাঁটি জাফরান রঙ থাকে।
হালদারমশাই বললেন, আপনি তার চাষ করছেন? বীজ পাইলেন কই?
মিঃ সিংহরায় ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, আমি একসময় মিডল ইস্টে। ছিলুম। একটা মার্কিন কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরি করতুম। জিওলজিতে আমার ডিগ্রি আছে। সয়েল টেস্টের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। ঘটনাচক্রে ইরানের একটা পাহাড়ি এলাকায় একজন জাফরান-চাষীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। যাই হোক, তখনই মাথায় প্ল্যানটা এসেছিল। তা ছাড়া ওইসব দেশে ইউনানি–মানে, হেকিমি চিকিৎসা এখনও চালু আছে। জাফরানচাষীর সূত্রে কয়েকজন হেকিমের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তারা নিজেরা আশ্চর্য সব ভেষজ উদ্ভিদের চাষ করেন। কোম্পানির সঙ্গে আমার চাকরির চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ইরান-ইরাক যুদ্ধ বেধে গেল। ১৯৮০ সালের কথা। বাধ্য হয়ে দেশে ফিরতে হলো। বলে তিনি কর্নেলের দিকে অর্থপূর্ণ কটাক্ষ করলেন। কর্নেল সরকার এসব কথা জানেন। বছর তিনেক আগে উনি আহিরগঞ্জে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখনই ওঁর সঙ্গে আলাপ।
বললুম, খাঁটি জাফরান দুর্মূল্য বললেন। তা হলে আপনার এক একর জমি থেকে যে পরিমাণ জাফরান পাওয়া যায়, তার দাম নিশ্চয় অনেক টাকা?
পুরো জাফরান প্রোডিউস করতে পারলে অন্তত এক কোটি টাকা দাম!
হালদারমশাই চমকে উঠলেন। কন কী!
কর্নেল হাসলেন। ভূতটা চোর আর বাঘের বেশে জাফরানক্ষেতে গড়াগড়ি খেতে আসে। এতে কি কোনো রহস্য টের পাচ্ছেন না হালদারমশাই?
গোয়েন্দাপ্রবরের গোঁফ উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছিল। দ্রুত একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, মিঃ সিংহরায়! এ পর্যন্ত আপনি কয়বার জাফরান প্রোডিউস করছেন?
মিঃ সিংহরায় বললেন, একবারও না। ক্রোকাস্ স্যাটিভাস্ পূর্ণবয়স্ক হলে তবেই ফুল ফোটে। আমার ফার্মের গাছগুলোর বয়স সবে তিন বছর। আরও অন্তত বছর দুই পরে ফুল ফোঁটার আশা আছে।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, ভূত না আপনার কোনো এনিমির কাজ!
কর্নেল বললেন, কিন্তু বাঘ?
মাইনষের চোখের ভুল হয় কর্নেলস্যার!
মিঃ সিংহরায় বললেন, আমার শত্রু থাকতেই পারে। কিন্তু বাঘটাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। তার বিকট গর্জনও শুনেছি।
কাছাকাছি জঙ্গল আছে?
তা আছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সেই জঙ্গলে কেউ বাঘ দেখতে পায়নি বা গর্জনও শোনেনি।
আপনি চোরেরে দ্যাখছেন?
চোরকে অবশ্য আবছা দেখেছি। আমার একটা টেরিয়ার আর একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর আছে। কুকুরদুটো রাত্রে ছাড়া থাকে। তারা গর্জন করলেই বুঝতে পারি, অবাঞ্ছিত কেউ ফার্মে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাঘ এলে তারা একবার ডেকেই চুপ করে যায়। লেজ গুটিয়ে সরে আসে।
হালদারমশাই শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, হেভি মিস্ট্রি।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, মিঃ সিংহরায়! আপনি বরং হালদারমশাইকে সঙ্গে নিয়ে যান। আমি যথাসময়ে পৌঁছুব। আমার সঙ্গে জয়ন্তও যাবে। জয়ন্ত রিপোর্টার। কাজেই তার যাওয়ার একটা উপলক্ষ তো থাকছেই। আমি নেচারোলজিস্ট। আমার যাওয়াও স্বাভাবিক। আর হালদারমশাই– হ্যাঁ, উনি ছদ্মবেশ ধরতে পটু। ওঁকে হেকিমসাহেব সাজিয়ে নিলে সেটা খুব স্বাভাবিক দেখাবে। কী হালদারমশাই?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাসলেন। খু-উব পারব। পুলিশলাইফে এক ডাকাতসর্দার ধরতে মুসলমান ফকির সাজছিলাম।
মিঃ সিংহরায় একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে। মিঃ হালদার তা হলে হেকিম সেজে হাওড়া স্টেশনে আমার সঙ্গে দেখা করুন। ছনম্বর প্ল্যাটফর্মের গেটে আমি দুটো থেকে অপেক্ষা করব। ট্রেন ছাড়বে তিনটে পনেরোতে। মিঃ হালদারকে কিন্তু হেকিমি দাওয়াইয়ের একটা বাকসো সঙ্গে নিতে হবে।
গোয়েন্দাপ্রবর তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অভ্যাসমতো যাই গিয়া বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে বৃষ্টি সমানে ঝরছে। এই বৃষ্টির মধ্যে উনি কীভাবে বাড়ি ফিরবেন এবং বৃষ্টিটা যদি না থামে, কী ভাবে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছুবেন ভেবে পেলুম না।
মিঃ সিংহরায় বললেন, এবার জরুরি কথাটা সেরে নিতে চাই কর্নেল সরকার!
কর্নেল বললেন, সব কথা আপনি জয়ন্তের সামনে আমাকে বলতে পারেন। আমার কোনোকিছু ওর কাছে গোপন থাকে না।
মিঃ সিংহরায় আবার ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, গতরাত্রে টেলিফোনে আপনাকে কথাটা বলা ঠিক মনে করিনি। চোর আর বাঘের উপদ্রবের মাস দুই আগে আমি একটা অদ্ভুত উড়ো চিঠি পেয়েছিলুম। কিন্তু সেটা কারও নিছক কৌতুক বলে গ্রাহ্য করিনি। আপনাকে চিঠিটা দেখাতে এনেছি।
বলে তিনি কিটব্যাগের ভেতরকার খোপ থেকে একটা খাম বের করলেন। খামের মুখটা যথারীতি ছেঁড়া। কর্নেল খামটা নিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতস কাঁচ বের করলেন। তারপর খামের ওপর লেখা নাম এবং ডাকঘরের ছাপ খুঁটিয়ে দেখলেন। বললেন, চিঠিটা কলকাতার জিপিও-তে পোস্ট করা হয়েছিল। তারিখ পড়া গেল না।
সুদর্শন সিংহরায় একটু অবাক হয়ে শুধু বললেন, জি পি ও-তে পোস্ট করা?
এবার কর্নেল চিঠিটা বের করে দ্রুত চোখ বুলিয়ে আবার আতস কাঁচে। পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন। তারপর বললেন, আশ্চর্য! খামের ওপর ঠিকানা লিখেছে একজন আর চিঠিটা লিখেছে অন্য জন। চিঠিটার একটা সন্দেহজনক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করছি। চিঠির লেখক সম্ভবত লেট-হ্যান্ডার। সে বাঁহাতে লিখেছে।
সুদর্শন বললেন, বলেন কী! আপনি কেমন করে বুঝলেন?
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, লেটু-হ্যান্ডারদের লেখার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের হাতের লেখা অক্ষর আর শব্দ সবসময় নিচের দিকে একটু বেঁকে যায়। কখনও ডাইনে, কখনও বাঁয়ে। এর কারণ তাদের অবচেতনায় একটা হীনমন্যতা কাজ করে। অক্ষর দিয়ে শব্দ লেখার সময় সেই হীনমন্যতার দরুন তারা হাতের লেখাকে পরিচ্ছন্ন আর স্পষ্ট করতে চায়। তা। করতে গিয়ে অক্ষরগুলো নিচেটা ডাইনে-বাঁয়ে বেঁকে যায়। স্বাভাবিক রাইট হ্যাঁন্ডারদের লেখাতে একলাইনের শব্দগুলো উঁচু-নিচু হতেই পারে, যদি তা লাইনটানা কাগজে না লেখা হয়। কিন্তু এই চিঠিটা লাইনটানা এক্সারসাইজ বুকের পাতা ছিঁড়ে লেখা। তো যাই হোক, আপনার ডাকনাম পল্টু?
হ্যাঁ। কিন্তু সে তো আমার ছোটবেলার নাম। আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলুম ওটা।
কর্নেল হাসলেন। কিন্তু এই লোকটি ভোলেনি। বলে তিনি আমার দিকে ঘুরলেন। জয়ন্তের কৌতূহল স্বাভাবিক। চিঠিটা পড়ে দেখ।
চিঠিটা নিয়ে দেখলুম, লেখা আছেঃ
পল্টু,
জীবনে অনেক টাকা কামিয়েছ। এবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর। নতুবা তোমার নিয়তি বাঘ হয়ে তোমাকে চিবিয়ে খাবে। আগামী ১৮ই মে রাত্রি ১০ ঘটিকায় তুমি অট্টহাস মন্দিরে আমার সঙ্গে দেখা করবে। সাক্ষাতে দেনাপাওনার কথা হবে। অন্যথায় দেবীর বাহন তোমার মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। সাবধান। ইতি –জনৈক হিতৈষী
চিঠি পড়ে বললুম, আচ্ছা মিঃ সিংহরায়, আপনি কি অট্টহাস মন্দিরে কথামতো গিয়েছিলেন?
সুদর্শন বাঁকা হেসে বললেন, নাহ। অট্টহাস মন্দির গভীর জঙ্গলে একটা ধ্বসংস্কৃপমাত্র। ফার্ম ছেড়ে রাত দশটায় এক কিলোমিটার জঙ্গলের পথে হাঁটার মধ্যে কোনো ফাঁদ ছিল ভেবেছিলুম।
কর্নেল বললেন, কী ফাঁদ?
আমার অনুপস্থিতিতে ফার্মের কোনো দামী ভেষজ গাছগাছড়া চুরি করার মতলব। সুদর্শন একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, পরে অবশ্য মনে হয়েছিল, এই চিঠিটা কারও নিছক কৌতুক।
কেন মনে হয়েছিল?
টেরিয়ার কুকুরটার নাম বুলেট। আর অ্যালসেশিয়ানটার নাম টাইগার। বুলেট আর টাইগার শিক্ষিত কুকুর। রাত্রে আমার ফার্মে অনুপস্থিতির সময় কোনো ভেষজ উদ্ভিদের কাছে কেউ গেলেই ওরা তাকে আক্রমণ করবে।
পাপের প্রায়শ্চিত্ত কথাটার কি কোনো তাৎপর্য আছে? খুলে বললে ভালো হয়।
সুদর্শন সিংহরায় জোর দিয়ে বললেন, জীবনে এ পর্যন্ত জ্ঞাতসারে কোনো পাপ করিনি। কাজেই কথাটা আমার কাছে অর্থহীন।
কিন্তু অবশেষে সত্যি একটা বাঘ আপনার ফার্মে হানা দিচ্ছে।
সেটাই অদ্ভুত। আর বিশেষ করে এজন্যই আপনার সাহায্য আমার দরকার। না–আপনি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার এবং ফায়ার আর্মসের ব্যাপারে আপনি সুদক্ষ মানুষ, সেজন্য নয়। আমার কেন যেন বিশ্বাস জন্মেছে, বাঘটাকে গুলি করে মারা যাবে না। এ এক অদ্ভুত বাঘ।
কর্নেল হাসলেন। আপনি তো সত্যিই বাঘটাকে ভূত ভেবেছেন?
নাহ্। ভূতে আমার বিশ্বাস নেই। সুদর্শন উত্তেজিতভাবে বললেন, আপনি তো জানেন, আমি তরুণ বয়সে নামকরা শিকারি ছিলুম। আমার আঙুল আর চোখ কখনও টার্গেট মিস করে না। অথচ একটা বাঘকে আমি কিছুতেই শায়েস্তা করতে পারছি না। তাই সন্দেহ জেগেছে, ওটা কি সত্যি বাঘ, নাকি অন্য কিছু?
হ্যাঁ। আপনার পয়েন্টটা আমি বুঝতে পেরেছি।
আমি বললুম, আর চোরের ব্যাপারটা?
সুদর্শন বললেন, হ্যাঁ। চোর সম্পর্কেও আমার সন্দেহ জেগেছে। চোরটা কি সত্যিই মানুষ, নাকি অন্যকিছু? এই যে আমি একরাত্রি ফার্ম ছেড়ে বাইরে কাটাচ্ছি, মনে এতটুকু স্বস্তি নেই। কলকাতার একটা মেডিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট আমার কাছে ভেষজ গাছ-গাছড়া কেনে। এটা মাল্টিন্যাশনাল সংস্থা। তাদের সঙ্গে একটা জরুরি কাজও ছিল। কাল এসে সেই কাজ সেরে রাত্রে আমার মামাতো ভাইয়ের বাড়ি থেকে কর্নেল সরকারকে রিং করেছিলুম। উনি আজ সকাল আটটায় আসতে বলেছেন। নইলে আমি রাতের ট্রেনেই ফিরে যেতুম।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, সকালে আমার মাথা ভালো কাজ করে। আমার ছাদের বাগান পরিচর্যা করতে করতে আমি কোনো ঘটনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করি। এটা বহুদিনের অভ্যাস। তাই কোনো জটিল রহস্যের ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমি তাকে সকালে আসতে বলি। যাই হোক, মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা কমে এসেছে। আপনি এবার আমাকে শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিন।
বলুন?
আপনাদের সাবেক বাড়িতে এখন কে বা কারা থাকেন?
দোতলা অংশটা গতবছর আমি কলেজের জন্য দান করেছিলুম। এখনও কলেজ চালু হয়নি। সরকার থেকে মেরামতের কাজ চলছে। উল্টোদিকের একতলা অংশের অর্ধেকটা ধ্বংসস্তূপ–সে তো আপনি দেখেছিলেন। বাকি অংশটায় তিনটে ঘর। একটা ঘরে থাকেন আমার কাকা শ্যামসুন্দর সিংহরায়। বয়স প্রায় সত্তর বছর। উনি স্বাধীনতা সংগ্রামী। সরকারি পেনশন পান। আমার মতোই বিয়ে করেননি।
আমি তাকে দেখিনি।
হ্যাঁ। উনি খেয়ালি মানুষ। মাঝে মাঝে বেড়াতে যান। আপনি যখন গিয়েছিলেন, তখন উনি পণ্ডিচেরিতে ছিলেন। ঋষি অরবিন্দের ভক্ত। যাই হোক, বাকি দুটো ঘরে থাকেন আমার আশ্রিতা বিধবা মাসি সুনয়নী রায় তার মেয়ে শ্রাবন্তী। শ্রাবন্তী আহিরগঞ্জ গার্লস স্কুলের টিচার হয়েছে এখন। তাই মাসিমা আর আমার আর্থিক সাহায্য নেন না।
শ্রাবন্তী কি বিবাহিতা?
না। সুদর্শন হাসলেন। খুব সাহসী আর তেজস্বিনী মেয়ে। ভুতুড়ে বাঘ আর চোরকে দেখতে তার খুব আগ্রহ। কিন্তু আমি তাকে ফার্মে এসে রাত কাটাতে দিইনি। মাসিমা একলা থাকবেন। তার স্বাস্থ্য ভালো নয়। বয়সও। হয়েছে।
কর্নেল এতক্ষণে চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে বললেন, এটা আমি রাখতে চাই। আপনার আপত্তি আছে?
আপত্তি কিসের? আপনি ওটা রেখে দিন। আর–কী আশ্চর্য! এটার কথা বলতে ভুলেছি। এটা শেষবার চোর আর বাঘের উপদ্রবের পরদিন সকালে পাঁচিলের কাছে কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। বলে সুদর্শন সিংহরায় কিটব্যাগ থেকে একটা ক্ষুদে তামার মাদুলি বের করলেন। মাদুলিতে একটুকরো লাল সুতো ঝুলছে।
কর্নেল মাদুলিটা নিয়ে বললেন, কারও গলা থেকে ছিঁড়ে পড়েছে মনে হচ্ছে।
সুদর্শন উঠে দাঁড়ালেন। আর আপনার সময় নেব না। চলি। আশা করি, শিগগির আপনার দেখা পাব। জয়ন্তবাবু! আপনি গেলে খুব খুশি হব। আমার কারবারের স্বার্থে একটু পাবলিসিটি দরকার।…