সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে – রহস্য উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
অহং। অহংটা এখনও বেশ আছে। বয়সে একটু স্তিমিত হয়ে এসেছে ঠিকই। সবসময়ে আগের মতো ফণা তুলে দাঁড়ায় না। সংসারের নানা প্রকাশ্য ও চোরা মারে বারবার আহত হয়েছে বটে, কিন্তু এখনও আছে। কে জানে হয়তো অহংকারটুকুই আছে, আর তার কিছু নেই। তার বউ শিখা বলে, এত আমি-আমি করো বলেই আর কারও দিকে তাকিয়ে দেখলে না কখনও। অত অহংকার বলেই ছেলেটা পর হয়ে গেল, জামাই আসা-যাওয়া বন্ধ করল। এখন অহং ধুয়ে জল খাও। এই শিখার সঙ্গে একটা জীবন বনিবনা হল না তার। অন্তত দু’বার তাদের সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ভেঙে যাওয়ার মুখে এসেছিল। টিকে আছে বটে। সম্পর্কটা, তবে ওপর ওপর। ভিতরে কোনও টান নেই, সমবেদনা নেই। দুটো মানুষ এক ছাদের তলায় বাস করেন মাত্র।
আজ ওই অহংবোধই তাকে প্ররোচনা দিয়েছিল হঠকারিতার। সন্ধেবেলা রুটিনমতোই সান্ধ্যভ্রমণ সেরে ফিরে দেখলেন, লিফটটা খোলা। দু’জন মিস্ত্রি গোছের লোক খুটখাট করে কিছু সারাচ্ছেটারাচ্ছে।
বাসুদেব জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে হে?
লিফটের ভিতর থেকে মিস্ত্রিদের একজন বলল, সার্ভিসিং হচ্ছে।
কতক্ষণ লাগবে?
দু-তিন ঘণ্টা। আজ নাও হতে পারে।
বাসুদেব চিন্তিত হলেন। তার ফ্ল্যাট আটতলায়। হার্ট ভাল নয়। উচিত হবে কি সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। এমন অবস্থায় ইচ্ছে করলে তিনি গরচায় মণিময়ের বাড়ি চলে যেতে পারেন। মণিময় অনেক দিনের বন্ধু। কিন্তু শিখাকে জানানো দরকার। কীভাবে জানাবেন? তার ফ্ল্যাটে ফোন নেই।
দারোয়ানকে একটু খুঁজলেন বাসুদেব। সে ব্যাটার টিকিও দেখা গেল না। আসলে ফ্ল্যাটবাড়িটা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। কাজ চলছে। বেশিরভাগ ফ্ল্যাটেই এখনও লোক আসেনি। দশতলার এই বাড়িতে আজ অবধি মাত্র চার-পাঁচটা ফ্ল্যাটে লোক ঢুকেছে। এখনও দারোয়ানদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়নি। মাত্র একজনকে দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। ফ্ল্যাটের মালিকরা সবাই এসে গেলে কমিটিটমিটি হবে, তারপর পুরোদস্তুর দারোয়ানদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার কথা।
বাসুদেব এদিক ওদিক দারোয়ানটাকে একটু খুঁজে হতাশ হলেন। এ ব্যাটা প্রায় : ময়েই ছুতোনাতায় কোথায় যেন চলে যায়। সিঁড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালেন। আধুনিক ফ্ল্যাটগুলোর তলা তেমন উঁচু হয় না। পারবেন কি? যৌবনে ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে ফুটবল এবং ক্রিকেট দুই-ই খেলেছেন। খেলা থেকেই তার জীবনের প্রথম চাকরি। এখনও দেওয়াল আলমারি ভরতি তার খেলার ট্রফি। অহংটা মাথাচাড়া দিল। পারবেন না? তাই কি হয়? মাত্র ছেষট্টি বছর বয়স। এখনও তার সেক্স কার্যকর। এখনও দু’বেলা মাইল দুয়েক করে হাঁটেন। শরীর নিয়ে তার অহংকার আছে। মাস চারেক আগে হার্টের গণ্ডগোল ধরা পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নয়। অন্তত তিনি মনে করেন না।
ঢাকুরিয়ার বাড়িটা নিয়ে গণ্ডগোল করছিল ভাইপোরা। আইন বাসুদেবের পক্ষে ছিল বটে, কারণ বাড়িটা তার নামেই। কিন্তু নৈতিক দিকটা তার দুর্বল ছিল। কারণ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে এজমালি সম্পত্তি বেচা টাকা তার বাবা এবং ভাইরা কিছু কিছু পাঠাত। সেই থেকেই বাড়িটার সূত্রপাত। বাবার ইচ্ছে ছিল বড় বাড়ি করে সব ভাই একসঙ্গে থাকবে, যেমন দেশের বাড়িতে ছিল। কথা ছিল বাড়িটা নিজের নামে করলেও বাসুদেব পরে দলিলে অন্যদেরও নাম ঢোকাবেন।
বাসুদেবেরও তাতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু কালক্রমে দেখা গেল, দেশের বাড়ি থেকে যে টাকা এসেছিল তার চেয়ে বেশি টাকা বাসুদেবের তবিল থেকে বাড়ির পিছনে খরচ হয়েছে। বাবা আর এসে পৌঁছতে পারলেন না, ও দেশেই মারা গেলেন। দাদাদের মধ্যে একজন এলেন। এল ভাইপো-ভাইঝিরা। বাড়িতে এসেই উঠল সবাই। তারপর শুরু হল তাগিদ, বাড়ির ভাগ লিখে দাও।
বাসুদেব সেজদার সামনে হিসেব ফেলে দিয়ে বললেন, আমার আড়াই লাখ টাকা দিয়ে দাও, লিখে দিচ্ছি।
গণ্ডগোলের সূত্রপাত সেখান থেকেই। এত টাকা তিনি খরচ করেছেন এটা কেউ বিশ্বাস করল না! ঝগড়াঝাটি শুরু হল এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটতে লাগল। বাসুদেবের জোর বেশি, কারণ তিনি এখানকার লোক। তিনি হুমকি দেওয়ায় সেজদা রাগ করে ভাড়া বাড়িতে গেলেন। ভাইপোরাও বিদায় নিল। মামলা মোকদ্দমার তোড়জোড় চলতে লাগল। দেশ থেকে বড়দাও কয়েকবার আসা-যাওয়া করতেন। বাসুদেব সাফ জানিয়ে দিলেন আড়াই লাখ টাকা না পেলে তিনি বাড়ির ভাগ কাউবে দেবেন না।
মামলা হলে বাসুদেবের জয় অনিবার্য ছিল। তা ছাড়া এদেশে দেওয়ানি মামলার নিষ্পত্তি হতে এত সময় নেয় যে যুবক বুড়ো হয়ে যায়। এক পুরুষে হয়তো নিষ্পত্তি হয়ও না। এসব ভেবেই বোধহয় ওরা আর মামলা করেনি, কিন্তু দাবিও ছাড়েনি। অন্তত দুটি ভাইপো শিবশঙ্কর আর গোপাল নাগরিক কমিটি, রাজনৈতিক দল আর স্থানীয় মস্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রায়ই ঝামেলা পাকাত। বাসুদেব এক বছর আগে বাড়িটা তাই প্রমোটারকে দিয়ে দিলেন। নিয়মমতো প্রমোটার ফ্ল্যাট তৈরি করে সেখানে তাকে ফ্ল্যাট দেবে। কিন্তু বাসুদেব প্রমোটারকে বললেন, আমি এখানে থাকব না, অন্য জায়গায় আমাকে ফ্ল্যাট দিতে হবে। তবে এ বাড়িতেও আমার এক আত্মীয়ের জন্য একটা ফ্ল্যাট চাই।
বালিগঞ্জ ফাড়ির কাছে এই ফ্ল্যাটটা প্রমোটারই তাকে দিয়েছে। পুরনো বাড়িতে ফ্ল্যাট উঠছে শুনে ভাইপোরা ফের একজোট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর ও প্রমোটারের ওপর। ফ্ল্যাটই যখন হচ্ছে তখন আমাদেরও ফ্ল্যাট দিতে হবে। বাসুদেব গায়ে মাখেননি সেসব কথা। শুধু শিখাই মাঝে মাঝে তাকে বলত, এ কাজটা তুমি ভাল করছ না। বাড়ির ভাগ যদি না দিতে পারো, অন্তত ওদের কিছু টাকা ধরে দাও। প্রমোটার তো তোমাকে সাত লাখ টাকাও দিয়েছে।
বাসুদেব একবার যে সিদ্ধান্ত নেন তা থেকে টলেন না। মাথা নেড়ে বললেন, ওরা আমার সঙ্গে শত্রুতা করার চেষ্টা না করলে দিতাম। এখন এক পয়সাও দেব না।
তার ভাইপো গোপাল তাকে একবার গুন্ডা দিয়ে মারাবে বলে শাসিয়েছিল। সেটা তিনি ভোলননি।
শিখা বলল, ওদের অভিশাপে আমাদের ভাল হবে না।
তিনি যথারীতি শকুনের শাপ ও গোরুর মৃত্যুর কথা বলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পাপ-পুণ্যের ভয় বাসুদেবের নেইও। কারণ ওসব তিনি মানেন না। তিনি মনে করেন জীবনের ক্ষেত্রে একটাই নিয়ম, যার দাঁত নখের জোর বেশি সে-ই টিকে থাকার অধিকারী। তার ভয়-ডর ভাবাবেগ বরাবরই কম। অহংকারী লোকদের ওসব কমই থাকে।
অহংকার কথাটার মানে কী তা বাসুদেব খুব ভাল জানেন না। অহংকার মানে কি নিজেকে ভালবাসা? তা হলে তো সবাই অহংকারী!
তবে কি নিজেকে নিয়ে গৌরববোধ? তাও অল্পবিস্তর সকলেরই আছে। তবে কি অহংকার মানে নিজেকে সর্বদা নির্ভুল এবং অভ্রান্ত মনে করা? নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা? নিজের আরাম-বিলাস-সুখ ছাড়া আর কারও আরাম-বিলাস-সুখের কথা না ভাবা?
যদি এসবই হয়ে থাকে তবে বাসুদেব অহংকারী, সন্দেহ নেই। তিনি কোনওদিনই অন্যের ব্যথা-বেদনা-দুঃখ-অভিমান নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। তার দুই ছেলে এবং মেয়ের নাকি অভিমান আছে যে, বাবা তাদের কখনও ভালবাসেনি। ভালবাসেননি কথাটা ঠিক নয়, তবে ছেলেমেয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা তার ছিল না। ওরা বায়না করলে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটত। ছেলেমেয়েরা তাকে যমের মতো ভয় পেত বরাবর। এখনও হয়তো ঘেন্না করে। কারণ অবিরল ভয় হয়তো কখনও কখনও সমাধান না পেয়ে ঘেন্নায় পর্যবসিত হয়। বাসুদেব ছেলেমেয়ের ঘেন্নার ভাবটা একটু টের পান।
একটা তলা উঠে এলেন বাসুদেব। কোনও অসুবিধে হলনা। আস্তে আস্তে উঠলে অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়। উঠতে উঠতে তিনি নিজের প্রবল অহংকারের কথাই ভাবছিলেন। হ্যাঁ, ঠিক বটে, তিনি অহংকারী, কিন্তু ওই অহংকারই কি তাকে বাঁচার জীবনীশক্তিটা জোগান দেয় না? অহংহীন পুরুষ তো নিবীর্য পুরুষের মতোই। তাই না?
তাঁর খেলোয়াড় জীবনের শেষ দিকে যখন ফর্ম পড়ে যাচ্ছে, যখন দম পান না, যখন ভারী পা আর আগের মতো ডজ বা কারিকুরি দেখাতে পারে না, তখন একটা দুর্মদ অহংকারই তাকে মাঠ ছাড়তে দেয়নি। অনেক গুরুতর খেলায় স্রেফ মনের জোরে তিনি মমতার চেয়ে দশগুণ বেশি দিয়েছেন। টিম থেকে তাকে বাদ দেওয়া হবে–এটা তার সহ্য হওয়ার কথা নয়। একটা সময়ে তিনিই নিজে সরে এলেন। সসম্মানে। খেলার শেষ জীবনে একটা ছেলেকে চিরকালের মতো বসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, সেও ওই অহংকার থেকেই। শুভম মিত্র বলে ছেলেটা তখন লেফট আউটে দারুণ খেলছে। খুব নাম-ডাক। শুভমের দলের সঙ্গে যেদিন খেলা পড়ল, সেদিনকার কথা। বাসুদেব রাইট হাফ-এ। শুভম ছেলেটার পায়ে ছিল হরিণের মতো দৌড়, তেমনি সূক্ষ্ম বল প্লে, তেমনি টার্ন এবং শুটিং। কমপ্লিট প্লেয়ার যাকে বলে। প্রথম হাফে তাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বাসুদেব। শুভম তাকে অনায়াসে টুসকি মেরে কাটিয়ে যাচ্ছে, এবং বাসুদেব বলে যে মাঠে কেউ আছে সেটাই যেন মনে রাখছে না। অবহেলাটা সহ্য হচ্ছিল না বাসুদেবের। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এরকম চললে সেকেন্ড হাফে তাকে বসানো হবে। তার বদলে নামবে সত্য রায়। তাই হাফটাইমের কয়েক মিনিট আগে তিনি পা-টা চালালেন–যেমনটা চালালে বিপক্ষের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। শুভম ভাল খেলোয়াড় ছিল ঠিক, কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা ছিল না। চোরা পায়ের মার খেয়ে ছিটকে পাঁচ হাত গড়িয়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল। তারপর স্ট্রেচারে শুয়ে হাসপাতাল। শুভমের সেই শেষ খেলা। পায়ের হাড় এমনভাবে ভেঙেছিল যে জীবনে আর মাঠে নামতে পারেনি। এই রাফ ট্যাটি নিয়ে কাগজে বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। বাসুদেব কি অনুতপ্ত হয়েছিলেন? হয়তো একটু হয়েছিল অনুতাপ। কিন্তু অহংকারই তবু বরাবর তাকে চালিয়ে এনেছে।
অহংকারীরা একটু স্বার্থপর হয়েই থাকে। এবং তারা অন্যের সম্পর্কে উদাসীন। শিখা এবং আর কেউ বিশেষ করে শিখা যখন তাকে স্বার্থপর বলে তখন খুব ভুল বলে না।
এই স্বার্থপরতা আর উদাসীনতা কত নির্মম হতে পারে তার উদাহরণ রীণা আর শঙ্কর। স্বামী-স্ত্রী। এই দম্পতিকে তিনি ভাল করে দাম্পত্য জীবন যাপন করতেই দেননি।
যে-কোনও ক্ষেত্রে একটু নাম করলে ভক্ত জোটেই। তারও ভক্ত বড় কম ছিল না। ছেলেদের কথা বাদ রাখলেও মেয়ে-ভক্তেরা ছিল অনেক। তাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গেই তার দৈহিক সম্পর্ক হয়েছিল। এরকমও হয়েই থাকে। মনে রাখার মানে হয় না। কিন্তু রীণা অন্যরকম।
রীণা ছোটখাটো, রোগা, মুখখানা ভারী মিষ্টি, মায়াবী চোখ দুখানা ছিল গভীর রহস্যে ভরা। নম্র শরীর আর মাজা রং। রীণা যখন তার প্রেমে পড়ে তখন রীণার বিয়ে হয়ে গেছে, বাসুদেব শুধু বিবাহিতই নন, দুই ছেলেমেয়ের বাবাও। কিন্তু তারা দু’জনে এমনভাবে পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলেন যেন তাদের বয়ঃসন্ধি, দেহ তো ছিলই, দেহ ছাড়িয়েও অনেক দূর গড়াল সম্পর্ক। শঙ্কর এক মস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের সেলস ইঞ্জিনিয়ার। নানা জায়গায় টুর থাকত। কিন্তু তা বলে বাসুদেব যে শঙ্করের অনুপস্থিতির সুযোগ নিতেন তা নয়। বরং রীণার সঙ্গে পরিচয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি শঙ্করকে মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, তুমি ওকে ডিভোর্স করো, ওকে আমার চাই। রীণাও স্পষ্টভাবে ডিভোর্স চেয়েছিল শঙ্করের কাছে।
বেচারা শঙ্কর। সে এমনই হদ্দমু ভালবাসত রীণাকে যে প্রস্তাব শুনে প্রথমটায় রেগে গেল। তারপর যখন বুঝল ওদের আটকানোর উপায় নেই, তখন পাগলের মতো হয়ে গেল। তখন সে বাধ্য হয়েই রীণাকে বলেছিল, যা খুশি করো, কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি বাসুদেবদার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক মেনে নিচ্ছি। শুধু কথা দাও, আমাকে ছেড়ে যাবে না।
পৌরুষের এমন অভাব বাসুদেব কদাচিৎ কোনও পুরুষের মধ্যে দেখেছেন। কেউ এরকমভাবে স্ত্রীর জারকে মেনে নিতে পারে? শঙ্করের অহং বলতে কি কিছু ছিল না। শিখা যদি এরকম করত বাসুদেব তো খুন করে ফেলতেন শিখাকে।
বাসুদেব একদিন রীণাকে বলেছিলেন, শঙ্করের তো উচিত ছিল পিস্তল দিয়ে আমাকে খুন করা।
রীণা অবাক হয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, খুন করবে কেন?
কেন করবে না? ওর পৌরুষ নেই?
পৌরুষ কী জিনিস জানি না। কিন্তু জানি ও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। আমি আঘাত পাই এমন কাজ ও করবে না।
বাসুদেব তত্ত্বটা বোঝেননি। ভালবাসে বলেই তো প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দেবে। না হলে কেমন ভালবাসা?
না, শঙ্কর কখনও আর অস্ফুট প্রতিবাদও করেনি। এমনকী রীণা তার সঙ্গে চুক্তি করে নিয়েছিল, তার প্রথম সন্তানটি হবে বাসুদেবের। শঙ্কর মেনে নেয়। মেড়া আর কাকে বলে?
বাসুদেব আর রীণার সন্তান হল অজাতশত্রু। না, অজাতশত্রু জানে না যে, বাসুদেবই তার বাবা। তার বৈধ বাবা শঙ্কর।
বাসুদেব চারতলায় উঠে দেখলেন, একটি পরিবার, স্বামী স্ত্রী এবং দুটি বাচ্চা লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে সুইচ টেপাটেপি করছে। স্বামী-স্ত্রীর বয়স ত্রিশের কিছু ওপরে।
বাসুদেব বললেন, লিফট খারাপ। সার্ভিসিং হচ্ছে।
তাই নাকি? বলে ভদ্রলোক তাকালেন বাসুদেবের দিকে। তারপর স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন, চলো তা হলে সিঁড়ি দিয়ে নামি।
কথা বলতে গিয়েই বাসুদেব টের পেলেন, তার হাঁফ ধরে যাচ্ছে, বড় হাঁফ, জিরোতে হবে।
বাসুদেব জানেন, এ সময়ে হাঁ করে শ্বাস নিতে হয়। তাতে বেশি অক্সিজেন যায় শরীরে। দেয়ালে একটু ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ঘাম হচ্ছে। বরাবরই তিনি খাওয়ার ব্যাপারে কিছু তমোগুণী। ঝাল মশলাদার খাদ্য, বিশেষ করে মাংস তার এখনও প্রিয়। ইদানীং পাঠা খাসি বাদ দিয়ে মুরগি খেতে হচ্ছে ডাক্তারের নির্দেশে। রাত্রিবেলা প্রতি দিনই রুটির সঙ্গে মাংস থাকে। থাকে কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা। বেশি মাংস খাওয়াটা কি খারাপ হচ্ছে? ছেষট্টি বছর বয়সের পাকযন্ত্রকে কি অতিরিক্ত খাটাচ্ছেন তিনি। মনে পড়ল, আজ দুপুরে তিনি শুটকি মাছ খেয়েছেন। সেটা বেশ ঝাল আর গরগরে মশলাদার ছিল। খেয়েছেন পাবদা এবং পোনা মাছের আরও দু’রকম পদ। পেটে গ্যাস হয়ে এত ঘাম হচ্ছে নাকি?
মিনিট পাঁচেক নির্জন সিঁড়ির চাতালটায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আস্তে আস্তে হাঁফ ধরা ভাবটা কমে গেল। কমল, কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হল না ফুসফুস। শ্বাসের মৃদু একটু কষ্ট রয়েই গেল। রাতে আজ আর কিছু না খেলেই হল। খেতে তিনি ভালবাসেন। অনেক দিন আগেই ডাক্তাররা তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল, খাওয়া যেন মাত্রাছাড়া না হয়। মাত্রা একটু আধটু না ছাড়ালে বেঁচে থাকার আনন্দটাই বা কোথায়?
আরও চারটে তলা বাকি। বাসুদেব খুব ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন। পারবেন। এর চেয়ে অনেক কঠিন কাজ তো তিনি করেছেন। মাত্র আটতলা উঠতে পারবেন না, তাই কি হয়। বয়স? বয়সটা একটা ধারণা মাত্র। ছেষট্টি বছর বয়সেও তিনি তো এক সক্ষম পুরুষ।
ঠিক কথা, এখন রীণার সঙ্গে তাঁর আর সম্পর্ক নেই। থাকার কথাও নয়। অজাতশত্রুর পর রীণার আরও একটি সন্তান হয়েছে। একটি মেয়ে। নাম পরমা। মেয়েটি শঙ্করের। বছর দশেক আগে এই মেয়েটি জন্মানোর পর থেকেই রীণা সরে যেতে লাগল। বাসুদেবকে ঠিক আগের মতো কাছে টানা বন্ধ করে দিল। একদিন সন্ধেবেলা ব্যালকনিতে পাশাপাশি বসে রীণা বলল, ছেলে আজকাল তোমাকে নিয়ে নানা প্রশ্ন করে। আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ হওয়া দরকার।
বাসুদেবের তাতে খুব একটা আপত্তি হল না। কারণ বেশ দীর্ঘদিনই তিনি রীণাকে ভোগ করেছেন। তবু বললেন, এখনই?
হ্যাঁ। শঙ্করকেও তো কিছু দিতে হবে। অন্তত অর্ধেক জীবনটা। এত ভালবাসে আমাকে ও যে, তোমাকে অবধি মেনে নিয়েছে। এখন ওর এই ত্যাগের মূল্যটা আমাদের দেওয়া উচিত।
বাসুদেবের বয়স তখন মধ্য পঞ্চাশ। ভোগ যথেষ্ট হয়েছে। আপত্তির কারণ ছিল না। তিনি সামান্য একটু অপমানও বোধ করলেন। অহং ফণা তুলেছিল। তিনি উঠে নিঃশব্দেই চলে এলেন। আর কখনও যাননি।
পাঁচতলা পেরোবার আগেই বাসুদেবকে আবার থামতে হল। ফের খাসটায় টান পড়ছে। বড্ড ঘাম। সারা গায়ে কেঁচোর মতো ঘামের ধারা নামছে। পাঞ্জাবির নীচে গেঞ্জি ভিজে যাচ্ছে ঘামে।
বাসুদেব দাঁড়ালেন, হাঁপ ছাড়তে লাগলেন, চোখটায় কি একটু ঘোলাটে দেখছেন?
এবার হাঁপটা সামলাতে বেশ সময় লাগল, ধীরে ধীরে বুকের কষ্টটা কমল বটে, কিন্তু শরীরটা দুর্বল লাগছে। বেশ দুর্বল। পায়ে একটা মৃদু থরথরানি।
কিন্তু আধিব্যাধির অনেকটাই মানসিক ব্যাধির ভয়ই অনেক সময় ব্যাধিকে ডেকে আনে। মনের জোর থাকলে অনেক ব্যাধিকেই ঠেকানো যায়। বাসুদেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল আর ঘাড় মুছলেন। রুমালটা ভিজে নেতিয়ে গেল। নিংড়োলে জল পড়বে।
ছ’তলায় এসে বাসুদেব বুকের মাঝখানে ব্যথাটা টের পাচ্ছিলেন। মৃদু কিন্তু নিশ্চিত। বুকে দূরাগত দামামার মতো একটা আওয়াজ।
এবং আচমকাই চোখে একটা অন্ধকার পরদার মতো কিছু ড্রপসিনের মতো পড়েই উঠে গেল। সমস্ত বুদ্ধি, বৃত্তি, যুক্তি, সাহস ভেদ করে একটা ভয় বাসুদেবকে ভালুকের মতো জাপটে ধরল। তার কিছু হচ্ছে? সময় এসে গেল নাকি?
সামনে যে দরজাটা পেলেন তারই ডোরবেল চেপে ধরলেন তিনি। ভিতরে ডিংডং আওয়াজ হল। বারবার বেল টিপলেন তিনি। বারবার আওয়াজ হল। বৃথা। কেউ নেই। প্রতি তলায় তিনটে করে ফ্ল্যাট। তিনটে দরজারই বেল টিপলেন বাসুদেব। তার তেষ্টা পাচ্ছে। তাঁর এখনই শুয়ে পড়া দরকার।
মেঝেতেই শুয়ে পড়বেন কি? ডাক্তার তাকে বলেছিল, হার্ট অ্যাটাক টের পেলেই শুয়ে পড়তে। যখন যে-কোনও অবস্থাতেই শুয়ে পড়াই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পন্থা।
কিন্তু বাসুদেব তা পারলেন না। মেঝেয় শোবেন? বাসুদেব সেনগুপ্ত কি তা পারেন? অহং যে এখনও মরেনি। তিনি অসহায়ের মতো সিঁড়ির চাতালে শুয়ে পড়লে যে লোকে। হাসবে।
ছ’টা তলা পেরিয়ে এসেছেন। সাত পেরিয়ে আটে উঠে যেতে পারলে আর ভাবনা কী?
কিন্তু আরও দুটো তলা যেন এভারেস্টের মতো উঁচু মনে হচ্ছে এখন।
বাসুদেব বারবার চোখে আলো আর অন্ধকার দেখছেন। বুকে মাদল বাজছে। ক্রমে ক্রমে পুঞ্জীভূত হচ্ছে বুকের ব্যথা। বাসুদেব রেলিং আঁকড়ে ধরে দুটো সিঁড়ি ভাঙতেই ককিয়ে উঠলেন ব্যথায়। তার কষে ফেনার মতো কী যেন বুজকুড়ি কাটছে। মাথা টলে যাচ্ছে। হাত ও পা শিথিল আর শীতল হয়ে যাচ্ছে যে! তিনি প্রাণপণে ডাকতে চেষ্টা করলেন, শিখা! শিখা। শিখা…
সিঁড়ি দিয়ে কে নেমে আসছিল। খোলা চোখে চেয়ে ধীরে ধীরে বাসুদেব সিঁড়িতে পড়ে যাচ্ছেন। চেঁচিয়ে বললেন, বাঁচাও….
যে নেমে এল তার মুখটা চিনতে পারলেন বাসুদেব। তার দিকে চেয়ে আছে। বাসুদেব হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। ধরো আমাকে ধরো। সে ধরল না। ধীর পায়ে নেমে গেল পাশ কাটিয়ে। বাসুদেব গড়িয়ে পড়লেন সিঁড়িতে। চোখে যবনিকা নেমে এল।