ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

১. অরণ্যগর্ভে অশান্তি

একদা আর্যাবর্তে (উপন্যাস) – ময়ূখ চৌধুরী

১. অরণ্যগর্ভে অশান্তি

বহু বৎসর আগেকার কথা–

ভূমধ্যসাগরের তীরে গ্রীস দ্বীপপুঞ্জের উপর জাগল ঘূর্ণি হাওয়ার আলোড়ন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেই ক্ষুদ্র ঘূর্ণি প্রলয়ংকর ঝটিকার রূপ ধারণ করে পারস্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং রক্ত আর আগুনের বন্যায় পারস্যকে বিধ্বস্ত করে মিশরের বুকের উপর দিয়ে ছুটে এসে আঘাত হানল ভারতের উত্তর-পশ্চিমে সীমান্তে

মহাবীর আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে পারস্য সাম্রাজ্যের গর্ব চূর্ণ করে শরীরী ঝটিকার মতো দুর্জয় গ্রীকবাহিনী ভারত আক্রমণ করল খৃ: পূ: ৩২৭ অব্দে।

খৃ: পূ: ৩২৭ সালে ভারতবর্ষ বা তদানীন্তন আর্যাবর্ত ছিল পরস্পরবিরোধী ছোটো ছোটো রাজ্যে বিভক্ত। ওইসব রাজ্যের অধিপতিদের মধ্যে কেউ কেউ নতজানু হয়ে গ্রীকসম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করলেও কয়েকজন নরপতি মুক্ত তরবারি হাতে গ্রীকবাহিনীর বিরুদ্ধে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। প্রচণ্ড বন্যার মুখে তুচ্ছ বালির বাঁধের মতোই তাঁদের মুষ্টিমেয় সৈন্যদল সুবিশাল গ্রীকবাহিনীরে আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। তবু ছোটো ছোটো যুদ্ধে গ্রীকসৈন্যরা ভারতীয় বীরত্বের যে তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করেছিল, তাতেই তারা বুঝেছিল বৃহৎ ভারতীয় সেনাদলের সম্মুখীন হলে তাদের অবস্থা হবে শোচনীয়। যদি ভারতীয় রাজন্যবর্গ সমবেত ভাবে অস্ত্রধারণ করতেন তাহলে সম্ভবত গ্রীকবাহিনী স্বদেশে প্রত্যার্বন করতে বাধ্য হত। দুর্ভাগ্যের বিষয় ভারতীয়দের মধ্যে বীরত্বের অভাব না থাকলেও সমবেত শক্তির মূল্য তারা বুঝতে পারেন নি। অতএব আলেকজান্ডারের তরবারির নিচে লুটিয়ে পড়ল কয়েকটি ভারতীয় রাজ্য এবং ছোটোখাটো সংঘর্ষের ভিতর দিয়ে তিনি বৃহত্তর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। রক্ত আর আগুনের সেই ভয়ংকর পটভূমিকায় শুরু হচ্ছে আমাদের কাহিনি…।

আর্যাবর্তের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এক অরণ্যসঙ্কুল পর্বতময় প্রদেশ। অরণ্য ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করল এক আর্য যুবক। যুবকের অধমাঙ্গে যোদ্ধৃসুলভ ভঙ্গিতে যে পীতবর্ণ বস্ত্রটি অবস্থান করছে, সেটি মলিন ও ধূলিধূসর-ঊর্ধ্বাঙ্গে ছিন্নভিন্ন নীল আংরাখার ভিতর দিয়ে দেখা যায় পেশিবদ্ধ বলিষ্ঠ দেহ-ললাট, বাহু ও বক্ষের উপর বাঁধা বস্ত্রের আবরণ রক্তরঞ্জিত, অনুমান করা যায় আবরণের অন্তরালে রয়েছে গভীর ক্ষতচিহ্ন। ক্ষতগুলি পুরাতন নয়, কারণ রক্তের ধারা তখনও ক্ষীণভাবে দৃশ্যমান। আচ্ছাদনের বর্ণ নীল, অর্থাৎ উধ্বাঙ্গের ছিন্ন আংরাখার কিছু অংশ দিয়ে যুবক ক্ষতচিহ্নগুলি আবৃত করেছে। যুবকের কটিদেশে বামপার্শ্বে অবস্থান করছে তরবারি, কিন্তু দক্ষিণপার্শ্বে ছুরিকার কোষ শূন্যগর্ভ-কোষ থাকলেও ছুরিকা সেখানে অনুপস্থিত। যুবকের পৃষ্ঠে ধনুর্বাণ, পায়ে বহু ব্যবহারে জীর্ণ চর্মপাদুকা। যুবক উদবিগ্ননেত্রে ইতস্তত দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে।

আচম্বিতে অরণ্যের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জাগল অশ্বের তীব্র হ্রেষাধ্বনি। যুবক চমকে উঠল, একী! অশ্বের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর! … আরে! এই কণ্ঠ আমার পরিচিত! ও যে অঞ্জন! কিন্তু ও কার সঙ্গে লড়াই করছে?

যুবক হ্রেষাধ্বনি লক্ষ্য করে তীরবেগে ছুটল…।

ঘন অরণ্যের মাঝখানে প্রান্তরের উপর একটি অশ্বের পৃষ্ঠে আরোহণ করেছে এক গ্রীক সৈনিক, কিন্তু অশ্ব তাকে বহন করতে রাজি নয়, সে ক্রমাগত লাফালাফি করে আরোহীকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আরোহী গ্রীক অশ্বারোহণে দক্ষ সে কিছুতেই স্থানত্যাগ করছে না, সজোরে বগা আঁকড়ে ধরে সে বসে রয়েছে অশ্বপৃষ্ঠে! একটু দূরে দাঁড়িয়ে আর একজন গ্রীক সৈন্য সকৌতুকে ওই দৃশ্য উপভোগ করছে…

হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঝটকায় হাতের বগা সরে গেল, আরোহী অশ্বপৃষ্ঠ থেকে সশব্দে ছিটকে পড়া প্রান্তরের উপর! সঙ্গেসঙ্গে অশ্ব সগর্বে জয় ঘোষণা করল চি-হী-ঈ-ঈ-ঈ!

যে গ্রীক সৈনিকটি দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি উপভোগ করছিল, সে সবিস্ময়ে বলে উঠল, পারডিকাস! ঘোড়াটা তোমাকে ফেলে দিল! তুমি সম্রাটের অশ্বারোহী বাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈনিক ইতিপূর্বে কোনো অশ্ব তোমাকে পৃষ্ঠচ্যুত করতে পারেনি।

পারডিকাস নামক সৈনিকটি উঠে বসেছিল, সে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, হেরস! এটা ঘোড়া নয়, শয়তান! দেখ, দেখ, জন্তুটা ওখানে দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ্য করছে। অন্য কোনো ঘোড়া হলে এতক্ষণে স্থানত্যাগ করতো। ঘোড়াটার সাজপোশাক দেখলে মনে হয় জন্তুটা কোনো ভারতীয় সৈনিকের সম্পত্তি। তবে অশ্বের মলিক যখন এখানে উপস্থিত নেই, তখন আমরাই এই অশ্বের মালিক। হেরস! তুমি একবার জন্তুটার পৃষ্ঠে অরোহণের চেষ্টা করবে নাকি?…

হেরসের চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ হল, সে কঠিন স্বরে বলল, চেষ্টা করতে আপত্তি নেই। তবে জন্তুটা যদি আমাকে ফেলে দেয়, তবে এই তরবারির আঘাতে আমি ওকে বধ করব।

অরণ্যের আড়াল থেকে ভেসে এল বিপতিক্ত কণ্ঠস্বর, ওহে বীরপুরুষ! অশ্বের উপর বীরত্ব প্রদর্শন নাই বা করলে! অযোগ্য ব্যক্তিকে আমার অশ্ব বহন করতে রাজি নয়- হা! হা! হা!

কে হাসে? কে? হেরস ও পারডিকাস একযোগে চিৎকার করে উঠল।

 কেউ সাড়া দিল না। দন্ডায়মান অশ্ব হঠাৎ গ্রীবা তুলে অনুচ্চস্বরে হর্ষপ্রকাশ করল।

আড়ালে দাঁড়িয়ে কে হাসে? ধ্বনিত হল হেরসের কর্কশ কণ্ঠস্বর, সাহস থাকে তো হাসিমুখটি একবার দেখাও।

অরণ্যের আড়াল থেকে আমাদের পূর্বপরিচিত যুবকটি আত্মপ্রকাশ করল, আমার মুখ দেখে যদি আনন্দ পাও, তাহলে তোমাদের আনন্দ দিতে আমার আপত্তি নেই। তা, ঘোড়াটাকে কেমন লাগল? নিতান্তই বর্বর পশু-গ্রীক সৈনিককে পৃষ্ঠে স্থান দিয়ে ঘোটকজন্ম সার্থক করতে রাজি নয়। নির্বোধ পশুকে নিজগুণে মার্জনা করে দাও-কী বলো? হা! হা! হা!… ওহে গ্রীক! আমার ঘোড়া চুরি করা সহজ নয়।

কী! আমি চোর! সক্রোধে অসি কোষমুক্ত করল পারডিকাস, উদ্ধত যুবক। আজ তোর মৃত্যু নিশ্চিত।

পারডিকাসের সঙ্গী বাধা দিল, পারডিকাস! লোকটি আহত। ওর মাথা আর দেহের বাঁধনগুলি রক্তাক্ত। বস্ত্রের আবরণ ভেদ করে ক্ষীণ রক্তের ধারা এখনও ঝরে পড়ছে। এই অবস্থায় ওর সঙ্গে যুদ্ধ করা অনুচিত।

স্তব্ধ হও, হেরস! পারডিকাস গর্জন করে উঠল, আহত মানুষ বিদ্রূপ করতে পারে; নিহত মানুষ কথা কয় না।

পরক্ষণেই তরবারি তুলে সে যুবককে আক্রমণ করল। মুহূর্তের মধ্যে কটি থেকে নিজের অসি আকর্ষণ করে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করল যুবক..

সংঘাতে সংঘাতে ঝংকার তুলে দুটি তরবারি পরস্পরকে বারংবার আলিঙ্গন করল, তারপর হঠাৎ যুবকের অসি সজোরে আঘাত হানল পারডিকাসের মস্তকে। তরবারি ইস্পাত-নির্মিত শিরস্ত্রাণ ভেদ করতে পারল না বটে, কিন্তু আঘাতের প্রচণ্ড ধাক্কায় লুপ্ত হল পারডিকাসের চৈতন্য- তার মূচ্ছিত দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর।

ভূপতিত শত্রুর সংজ্ঞাহীন দেহের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে যুবক অশ্বের দিকে ফিরল, আয় অঞ্জন! আমরা এখান থেকে চলে যাই। দুর্জনের সঙ্গ আমাদের পক্ষে শুভ নয়।

কিন্তু অশ্ব এগিয়ে আসার আগেই খোলা তলোয়ার হাতে এগিয়ে এল হেরস, দাঁড়াও! আমার বন্ধুকে তুমি আঘাত করেছ। বিনাযুদ্ধে তোমাকে আমি এখান থেকে যেতে দেব না।

যুবক ভ্রূকুঞ্চিত করল, অনর্থক রক্তপাতে আমার রুচি নেই। আমাকে যেতে দাও। হেরস বাক্যালাপের চেষ্টা করল না, ঝটিতি তলোয়ার তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তীব্র ঝনৎকার-ধ্বনি তুলেপ মিলিত হল দুটি তরবার, পরক্ষণেই যুবকের তরবারি দ্রুত সঞ্চালনে হেরসের অসি করচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ল।

যুবক হাসল, আশা করি এইবার আমি নিরাপদে স্থানত্যাগ করতে পারব। আর যদি এখনও যুদ্ধের ইচ্ছা থাকে, তাহলে তলোয়ার তুলে নাও জীবনের মতো তোমার রণসাধ মিটিয়ে দেব।

হেরস কি করত বলা যায় না। কিন্তু সে কর্তব্যস্থির করার আগেই যোদ্ধাদের পিছন থেকে ভেসে এল সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, এসব কী হচ্ছে?

দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চমকে উঠল– অরণ্যের ভিতর থেকে মুক্ত প্রান্তরের উপর এসে দাঁড়িয়েছে একদল গ্রীকসৈন্য! তাদের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে যে-মানুষটি যুদ্ধ থেকে ক্ষান্ত হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে তার পরিচ্ছদের বৈশিষ্ট এবং ব্যক্তিত্বপূর্ণ মুখাবয়ব দেখলেই বোঝা যায় ওই ব্যক্তি সেনাদলের নায়ক। সেনানায়ক এগিয়ে এসে ভূপতিত পারডিকাসের পাশে দাঁড়ালেন, তারপর জানু পেতে বসে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।

যুবক মৃদুস্বরে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রশ্ন করল, কে এই ব্যক্তি?

তেমনই মৃদুস্বরে উত্তর এল, ইনি একজন গ্রীক সেনাপতি। নাম, সেলুকস।

সেলুকস তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন, পারডিকাসের আঘাত মারাত্মক নয়। ও সাময়িকভাবে জ্ঞান হারিয়েছে। কলহের কারণ আমি জানি না, কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। ছি! ছি! দুজন সৈনিক এক আর্যযযাদ্ধার কাছে পরাজিত! লজ্জার কথা!

সেনাপতি! আমি লজ্জাবোধ করছি না, দৈত্যের ন্যায় বিপুলবপু এক গ্রীক সৈনিক এগিয়ে এল, পারডিকাস ও হেরসের দেহের রক্তের চিহ্ন নেই, কিন্তু গ্রীক সৈনিকের অসি এই আর্যযযাদ্ধার ললাটে ও শরীরে রক্তের আলপনা রচনা করেছে।

যুবক হাসল, গ্রীকের অসি আমার রক্তপান করতে পারে নি। রক্তপাতের কারণ বন্য ব্যাঘ্রের দন্ত ও নখর।

সেলুকসের ভ্রু কুঞ্চিত হল, ব্যাঘ্র?

যুবক বলল, আমার ঘোড়া অঞ্জন, ওকে নিয়েই বিপত্তি। সব কথা খুলে বলছি শুনুন। গতকল্য বনপথে ভ্রমণ করতে করতেই সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হল। রাতের অন্ধকারে পথ চলা সম্ভব হবে

বুঝে একটি বৃক্ষের তলদেশে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে বিশ্রামের উদ্যোগ করলাম। গভীর রাত্রে অকস্মাৎ আমার অশ্ব অঞ্জনের ভয়ার্ত হ্রেষাধ্বনি শুনে নিদ্রাভঙ্গ হল। সচমকে দেখলাম অগ্নিকুণ্ডের অগ্নি প্রায় নির্বাপিত, অনতিদূরে একটি প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র আমায় জ্বলন্ত দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে। আমি ধনুবাৰ্ণ বা তরবারি ব্যবহারের সুযোগ পেলাম না, তার আগেই হিংস্র শাপদ আমার আক্রমণ করল। মুহূর্তের মধ্যে আমি নখদন্তের ভয়াল আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলাম। ব্যাঘ্র আমার কণ্ঠে দংশন করার উদ্যোগ করতেই আমি বামহস্তে তাকে অতিকষ্টে নিরস্ত করলাম, তারপর কটিদেশ থেকে ছুরিকা নিয়ে তার মর্মস্থানে আঘাত হানলাম। ভীষণ গর্জন করে সে আমার দেহের উপর থেকে ছিটকে সরে গেল এবং ধরাশায়ী হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। আমি ব্যাঘ্রের দেহে বিদ্ধ ছুরিকা উদ্ধারের চেষ্টা করি নি, কারণ তাহলে মরণাহত শ্বাপদের দংশনে আমার মৃত্যু ছিল অবধারিত। আমি স্থানত্যাগ করার জন্য আমার অশ্বের সন্ধান করলাম, কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না। বুঝলাম, ব্যাঘ্রের আবির্ভাবে ভীত হয়ে সে অকুস্থল ত্যাগ করে পলায়ন করেছে। অন্ধকারে তার সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয় বুঝে আমি প্রভাতের অপেক্ষায় বনমধ্যে রাত্রিযাপন করতে উদ্যোগী হলাম। বনচারী শ্বাপদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য একটি বৃক্ষের উপর আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

পরের দিন সূর্যোদয়ের পর যখন অশ্বের পদচিহ্ন দেখে তার অনুসন্ধান করছি সেইসময় অকস্মাৎ হেষাধ্বনি শুনে চমকে উঠলাম। অঞ্জন নামক এই অশ্বের কণ্ঠস্বর আমার পরিচিত। আমি শব্দ অনুসরণ করে এইখানে এসে দেখি এই দুজনে গ্রীকসৈন্য আমার অশ্ব চুরি করার চেষ্টা করছে। পরবর্তী ঘটনা আপনি জানেন।

সেলুকস হেরসের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, হেরস! এই যুবকের অভিযোগ সত্য?

হেরস বলল, বনের পথে ঘোড়াটাকে যখন আমরা দেখি, তখন ওর মালিক সেখানে উপস্থিত ছিল না। আমরা যখন ঘোড়াটাকে ধরা চেষ্টা করছি, সেই সময় এই যুবক হঠাৎ এসে আমাদের চোর বলে বিদ্রূপ করে। তখনই কলহের শুরু হয় এবং

সেলুকস বাধা দিয়ে বললেন, এবং পারডিকাস যুবকের অসির আঘাতে সংজ্ঞা হারায় আর তোমার অসি করচ্যুত হয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে… হুঁ, মালিকবিহীন অশ্বকে ধরার জন্য তোমাদের চোর বলা যায় না, তবে এই যুবক যথার্থই রণনিপুণ যোদ্ধা।

হ্যাঁ, সেনাপতি! ভূমিপৃষ্ঠ থেকে ভেসে এল পারডিকাসের কণ্ঠ, এই যুবক শুধু রণনিপুণ যোদ্ধা নয়, ওর অন্তঃকরণও মহৎ। আমার শিরস্ত্রাণে আঘাত না করে গ্রীবায় আঘাত করে ইচ্ছা করলেই ও আমার প্রাণবধ করতে পারতো।

সেলুকস যুবকের দিকে ফিরলেন, যুবক! সম্রাট আলেকজান্ডারের সেনাদলে বহু ভারতীয় সেনা রয়েছে। তুমি যদি সম্রাটের সেনাদলে যোগ দাও তাহলে আমি খুশি হব। তোমার বীরত্বে আমি মুগ্ধ হয়েছি।

যুবক সহাস্যে বলল, সম্রাটের সাক্ষাৎ লাভ করার জন্য আমি বহু দূর থেকে আসছি। পথে এই বিপত্তি। সম্রাটের সাক্ষাৎ পেলে আমার সিদ্ধান্ত তাঁকেই জানাব।

সেলুকসের ভ্রূ কুঞ্চিত হল, সম্রাটের সেনাদলে যারা যোগ দেয়, তারা সকলেই সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পায় না।

যুবকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, সেনাপতি! আপনার কি মনে হয় আমি বহুজনের মধ্যে গণ্য? আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে সম্রাট আলেকজান্ডারের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে জানবেন। ভারতবিজয়ের অভিলাষ যদি থাকে, তবে আমার সাহায্য সম্রাটের প্রয়োজন হবে। সেনাপতি সেলুকস! আমাকে কেবল রণদক্ষ যোদ্ধা ভাবলে আপনি ভুল করবেন। আমি বিশেষ প্রয়োজনেই সম্রাটের সাক্ষাৎপ্রার্থী, যদি বিমুখ হই এখান থাকেই প্রস্থান করব। হয়তো তাহলে সম্রাটের কিছু ক্ষতি হতে পারে।

সেলুকসের ললাটে চিন্তার রেখা পড়ল। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই দৈত্যাকৃতি যে গ্রীকসৈনিক ইতিপূর্বে ব্যাঘ্রের নখদন্তের চিহ্নকে গ্রীক তরবারির আঘাতজনিত ক্ষত বলে ভুল করেছিল, সে সামনে এগিয়ে এল, সেনাপতি! আপনি ওর বীরত্বে মুগ্ধ হয়েছেন, আমি হইনি। হেরস আর পারডিকাস লড়াই জানে না আর বাঘটা নিশ্চয়ই রুগ্নে ছিল। হা! হা! হা! সেনাপতি যদি অনুমতি করেন তাহলে এই যুবকের সঙ্গে আমি অসিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে সম্মত আছি।

এই অভাবিত প্রস্তাবে গ্রীক সেনাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। আর্যযুবক কথা কইল না, কেবল সেনাপতির চোখের দিকে তাকিয়ে তার ওষ্ঠাধরে ফুটল মৃদু হাসির রেখা– অর্থাৎ, অসিযুদ্ধের প্রস্তাবে তার আপত্তি নেই।

কিন্তু সেলুকসের আপত্তি ছিল। দানবাকৃতি সৈনিকটির চরিত্র তিনি জানতেন; সম্মুখে দন্ডায়মান যুবকটির চোখে মুহূর্তের জন্য যে হিংস্র রোষের দীপ্তি চমকে উঠেই মিলিয়ে গিয়েছিল, সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে তার বিলম্ব হয়নি- অসিহস্তে শক্তি পরীক্ষার অনুমতি পেলে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যে মৃত্যুপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে সেবিষয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র। অতএব দানবাকৃতি সৈনিককে উদ্দেশ করে তিনি কঠোরস্বরে বললেন, আজাক্স! আমি এই বনাঞ্চল পরিদর্শন করতে বেরিয়েছি। গ্রীক শিবিরের অদুরে অবস্থিত এই অরণ্যের ভিতর থেকে গুপ্তশত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা আছে কি না জানা দরকার। সমগ্র অঞ্চল উত্তমরূপে পরিদর্শন করে আমার শিবিরে ফিরতে বিলম্ব হতে পারে- তুমি এখনই এই যুবককে সম্রাটের কাছে নিয়ে যাও। সম্রাটের বিজয়-অভিযানে স্থানীয় মানুষের সাহায্য অপরিহার্য। মনে রেখো, এই যুবকের নিরাপত্তার জন্য তুমি দায়ী থাকবে। যদি এই ব্যক্তি অক্ষতশরীরে নিরাপদে সম্রাটের কাছে না পৌঁছায় তাহলে আমি তোমায় কঠিন শাস্তি দেব।

নতমস্তকে অভিবাদন জানিয়ে আজাক্স নামক দৈত্যটি বলল, সেনাপতির আদেশ শিরোধার্য।

যুবক, এইবার মৌনভঙ্গ করল, মহামান্য গ্রীক সেনাপতি আমার ন্যায় তুচ্ছ ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য উদবেগ বোধ করছেন দেখে আমি গর্বিত, কিন্তু সেনাপতির অবগতির জন্য জানাচ্ছি আমার নিরাপত্তার ভার গ্রহণ করেছে আমার বিশ্বস্ত তরবারি এবং পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত ধনুর্বাণ। অপরের সাহায্য অনাবশ্যক।

সেলুকস তীব্রদৃষ্টিতে যুবককে একবার নিরীক্ষণ করলেন তারপর সৈন্যদের নিয়ে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তাঁর গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আজাক্স তার সঙ্গীর দিকে ফিরল, নীরস স্বরে বলল, আমাকে অনুসরণ করো।

পিছন ফিরে যুবক আহ্বান জানাল, আয়, অঞ্জন, আয়। প্রভুভক্ত অশ্ব গ্রীকসৈনিক ও যুবকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অগ্রসর হল।

অকস্মাৎ নিম্নভূমি থেকে ভেসে এল বহুকণ্ঠের উল্লাসধ্বনি, পরক্ষণেই সেই কোলাহলকে ডুবিয়ে জেগে উঠল মরণাহত মানুষের তীব্র আর্তনাদ– সঙ্গেসঙ্গে নারীকণ্ঠের দৃপ্ত ঘোষণা, ওরে কুকুরের দল! আমাকে হত্যা করা সহজ নয়। মরার আগে কয়েকটা মূর্তিমান পাপকে আমি পৃথিবী থেকে নরকে পাঠিয়ে দেব একথা জেনে রাখিস।

কয়েকটি স্তব্ধ মুহূর্ত– তারপরই আবার একাধিক মনুষ্যকণ্ঠের হিংস্র চিৎকার এবং অস্ত্রের ঝনকার!

যুবক ও আজাক্স পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় করল, পরক্ষণেই তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল শব্দ লক্ষ্য করে…