।। এক ।। – অম্বুজ লাহিড়ির আবির্ভাব
কলকাতায় এসে ওইসব ঘটনা আত্মীয়—বন্ধু কাউকেই বলিনি। কেননা বললে তারা বিশ্বাস করবে না। উলটে ঠাট্টা—মশকরা করবে। তারা বলবে—এই বিজ্ঞানের যুগে এইসব গাঁজাখুরি ঘটনা ঘটে নাকি?
উত্তর দিতে পারব না। তবে কিনা আমিও বিজ্ঞানের যুগের মানুষ। আর আমি কলকাতার একটি থানার দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার। তা ছাড়া সেইসব ঘটনার একজন সাক্ষীও আছে। সে আমারই মতো কলকাতার আর একজন পুলিশ অফিসার এবং আমার বন্ধু প্রণবেশ। সে তো আমার সঙ্গেই ছিল।
কলকাতায় ফিরে আমরা প্রথমে ঠিক করেছিলাম ঘটনাটা কাগজে বার করব। পুলিশ অফিসারদের অভিজ্ঞতা শুনে নিশ্চয়ই ছাপবে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছিলাম তাতে অনেকের অনেক অবান্তর প্রশ্নর উত্তর দিতে হবে। তাই মুখে কুলুপ এঁটে থাকাই স্থির করেছিলাম।
শেষ পর্যন্ত প্রণবেশই ঘটনাটা ফাঁস করে দিল এমন একজনের কাছে যাকে আমি চিনি না, জানি না।
প্রণবেশ একদিন বিকেল বেলায় একজন বেশ ফিটফাট ভদ্রলোককে নিয়ে আমার বাসায় এসে হাজির হল। বয়েস বছর পঞ্চাশ। নেড়া মাথা। লাল টকটকে মুখ। চোখে সোনালি ফ্রেমের হালকা চশমা। পরনে গেরুয়া আলখাল্লা। নাম অম্বুজবরণ লাহিড়ি। থাকেন সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের কাছে রংপোতে।
একজন রীতিমতো বাঙালি, কিন্তু বহুকাল ধরে রংপোর মতো পাহাড়ি জায়গায় থাকেন শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। তারপর যখন শুনলাম তিনি ওইখানে থেকে প্রেততত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন তখন রংপোর মতো জায়গায় থাকার একটা কারণ খুঁজে পেলাম। আমরা জানি আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে থেকেও হিমালয়ের কাছেপিঠে বহু তিব্বতী লামা থাকেন যাঁরা তাঁদের বিশ্বাস আর ধর্মবুদ্ধি দিয়ে প্রেতচর্চা করেন এবং অশুভ আত্মাকে খুবই ভয় করেন। আর এই অশুভ আত্মার হাত থেকে বাঁচার জন্যে নানা পুথিপত্র পড়েন, মন্ত্রতন্ত্র উচ্চারণ করেন। বুঝতে পারলাম অম্বুজবরণ লাহিড়ি সেই কারণেই রংপোর মতো জায়গায় থেকে লামাদের কাছে ওইসব বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করেন।
প্রণবেশ ফট করে আমাকে জিজ্ঞেস না করেই অম্বুজবাবুকে আমাদের অভিজ্ঞতার কথা ফাঁস করে দিয়েছে এটা জেনে আমার মোটেই ভালো লাগেনি। কেননা আমি ভেবে রেখেছিলাম—ওইসব ঘটনা নিয়ে আমিই বই লিখব। এখন যদি অম্বুজবাবু সব জেনে নিয়ে নিজেই আগেভাগে লিখে ফেলেন তাহলে আমার লেখার কোনো দাম থাকবে না।
আশ্চর্য! অম্বুজবাবু আমার মনের কথাটা কেমন করে যেন টের পেয়ে গেলেন। বললেন—সুশান্তবাবু, ঘটনাগুলো আমাকে সবিস্তারে বললে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। কেননা আমার কাজ গোপনে গবেষণা করা। বই ছাপা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার খ্যাতিরও দরকার নেই, টাকারও দরকার নেই।
তাঁর এই কথা শুনে আমি শুধু অবাকই হইনি, লজ্জিতও হয়েছিলাম।
তাঁকে বসতে বলে স্ত্রীকে চা করতে বললাম। ইতিমধ্যে আমি গত জুলাই মাসে কাঠমান্ডুতে আর আমার দেশের বাড়িতে যা যা ঘটেছিল তা বলে গেলাম। দেখলাম তার অনেকটাই তিনি প্রণবেশের কাছে শুনেছেন।
চা আর সুজি নিয়ে আমার স্ত্রী হাসিমুখে এসে দাঁড়ালেন। প্রণবেশ আলাপ করিয়ে দিল।
অম্বুজবাবু হঠাৎ আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, দেশের বাড়িতে আপনাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা আপনার কীরকম মনে হয়?
স্ত্রী বললেন, সাংঘাতিক। বাড়িতে কাজের জন্যে নেপাল থেকে উনি একটি দুর্ভিক্ষপীড়িতর মতো ছেলেকে নিয়ে এলেন আর সেই ছেলেই ভেল্কি দেখাল। আমি অবশ্য কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম, সেই সময়ে খালি বাড়িতে নাকি নানারকম ভয়ের কাণ্ড ঘটেছিল।
ছেলেটার কী যেন নাম ছিল?
আমার স্ত্রী বললেন, রাজু সুব্বা।
আচ্ছা, তার গায়ে কখনো হাত দিয়েছিলেন?
গায়ে হাত দেওয়া মানে মারা বলছেন?
না—না, কখনো ছুঁয়েছিলেন?
ম্যাগো! যা ডিগডিগে চেহারা, ছুঁতে ঘেন্না করত। মনে হত যেন একটা জ্যান্ত কঙ্কাল।
জ্যান্ত কঙ্কাল! অম্বুজবাবু কথাটা নিজের মনে উচ্চারণ করলেন।
ধন্যবাদ। আপনাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।
আমার স্ত্রী ভেতরে চলে গেলেন।
চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে অম্বুজবাবু বললেন, সুশান্তবাবু, ব্যাপারটার ওপর আমার যথেষ্ট কৌতূহল আছে বলেই আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করব।
হ্যাঁ হ্যাঁ, করুন না। তবে ওই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গটা আর মনে আনতেও ইচ্ছে করে না।
অম্বুজবাবু জামার পকেট থেকে মোষের শিঙের তৈরি নস্যির ডিবে বার করে এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, কাঠমান্ডুতে বিষ্ণুমতীর তীরে এক তান্ত্রিক একটি ছেলেকে বলি দিতে যাচ্ছিল, আপনি আর আপনার বন্ধু দুজনে মিলে ছেলেটিকে বাঁচান। বলি দিচ্ছিল ঘণ্টাকর্ণের সামনে। আপনারা কি জানতেন নেপালিদের কাছে ঘণ্টাকর্ণ কী ভয়ংকর দেবতা?
হ্যাঁ, শুনেছিলাম জুলাই—অগস্ট মাসে নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে অশুভ শক্তিরা ঘুরে বেড়ায় দানবের মূর্তি ধরে। তাদের সামনে পড়লে মানুষ, জীবজন্তু কারো রক্ষে থাকে না। তাই সেই দানব—দেবতাদের ভয়ংকর মূর্তি গড়ে তাদের পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করে সসম্মানে বিদেয় করা হয়।
ঠিকই জানেন দেখছি। তাহলে সেই দেবতার কাছ থেকে ছেলেটাকে বাঁচানো মানে দেবতার মুখ থেকে গ্রাস কেড়ে নেওয়া?
বিরক্ত হয়ে বললাম, ওসব আমি জানি না। দেবতার মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়াই হোক আর যাই হোক এ যুগে একটা ছেলেকে বলি দেবে তা আমরা দেখেও এড়িয়ে যাব তা হতে পারে না।
অম্বুজবাবু মৃদু হেসে বললেন, আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি বলছি না ছেলেটাকে বাঁচিয়ে আপনারা অন্যায় করেছেন। আমি বলতে চাইছি ছেলেটাকে বাঁচাতে গিয়ে আপনারা তান্ত্রিকের কোপ—দৃষ্টিতে পড়েছিলেন। তাই কিনা?
হ্যাঁ। সে তো স্বাভাবিক। বলল প্রণবেশ।
সেই ক্রোধটা আপনাদের ওপর কীভাবে এল?
যে হোটেলে আমরা উঠেছিলাম সেই হোটেলে জং বাহাদুর নামে একটা ‘বয়’ ছিল। সে বলেছিল অনেক নেপালি গরিব ছেলে ইন্ডিয়ায় চলে যায় সামান্য চাকরির লোভে। আমি তখন আমাদের বাড়ির কাজের জন্যে একটি ছেলে চেয়েছিলাম। জং বাহাদুর যে সত্যিই একটা ছেলে এনে দেবে ভাবতে পারিনি। কিন্তু তার কঙ্কালসার চেহারা দেখে মনে হয়েছিল সে কোনো কাজই করতে পারবে না। একথা শুনে ছেলেটা তখনই এমন সব কাজ করতে লাগল যা দেখে আমরা তাজ্জব।
হ্যাঁ, সেসব আমি শুনেছি।
তখনও কি জানতাম মশাই, ওটা একটা শয়তানের বাচ্চা! আর জং বাহাদুরই সেই তান্ত্রিকের কাছ থেকে ওটাকে নিয়ে এসেছিল আমাদের সর্বনাশ করার জন্যে?
আচ্ছা, ছেলেটা কি কখনো হাসত? জোরে না হোক, মুচকে?
হাসি? আমার স্ত্রী বলে উঠলেন, ওই মুখে হাসি ফুটবে? মুখ তো নয় একটুকরো লম্বা পোড়া কাঠ।
আচ্ছা, দৌড়—ঝাঁপ করার পর ওকে কখনও হাঁপাতে দেখেছেন?
না মশাই। ওকে যা মনে হয়েছে তা হচ্ছে ও যেন মান্ধাতার আমলের জংধরা একটা যন্ত্র।
মান্ধাতার আমলের জংধরা একটা যন্ত্র! অম্বুজবাবু নিজের মনেই কথাটা উচ্চারণ করলেন।
আচ্ছা, এর আগে আপনি বলেছিলেন ছেলেটা যেন একটা জীবন্ত কঙ্কাল! তাই না!
আমার স্ত্রী হেসে বললেন, হ্যাঁ।
আচ্ছা, ছেলেটা নানাভাবে ভয় দেখাত না?
ভয় দেখাত কী! আমার স্ত্রী বলে উঠলেন—একদিন সন্ধেবেলায় ও তো পেছন থেকে এসে ওঁর গলা টিপে ধরতে গিয়েছিল। তারপর—
অম্বুজবাবু বাধা দিয়ে বললেন—হ্যাঁ, সেসব প্রণবেশবাবুর কাছ থেকে শুনেছি। আচ্ছা, কাঠমান্ডুতে ওই তান্ত্রিকের ওখানে একটা কঙ্কাল ঝোলানো ছিল। তাই না?
হ্যাঁ।
কীরকম বয়েসের কঙ্কাল?
আন্দাজ চোদ্দো—পনেরো বছর বয়েসের।
এরপর একটু চুপ করে থেকে অম্বুজবাবু বললেন—শেষের দিনের ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে বলুন তো।
আমি সব বললাম। আমার স্ত্রী আর প্রণবেশ আমার কথার ফাঁকগুলো ধরিয়ে দিচ্ছিল।
প্রণবেশ বলল, একটা জিনিস বুঝতে পারছি না মিস্টার লাহিড়ি, ওই কঙ্কালটার সঙ্গে সুব্বার কি কোনো সম্পর্ক ছিল?
অম্বুজ লাহিড়ি আর এক টিপ নস্যি নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, একসময়ে আমাদের দেশের শক্তিমান কাপালিক, তান্ত্রিকরা একের মৃতদেহের মধ্যে অন্যের আত্মা চালনা করতে পারতেন একটা বিশেষ সময়ের জন্যে। আবার এমন তথ্যও পেয়েছি, কেউ কেউ কঙ্কালে একটা বিশেষ সময়ের জন্য মাংস—চামড়া সৃষ্টি করে তার মধ্যে প্রাণসঞ্চার করতে পারতেন। এই কৃত্রিম চামড়া, মাংস কঙ্কালটাকে কোনোরকমে ঢেকে রাখতে পারত কিন্তু শরীরের যে স্বাভাবিক রূপ, লাবণ্য তা দান করতে পারত না।
এই রকম ব্যাপার আমাদের দেশের রূপকথার কোনো কোনো গল্পে আমরা পাই। এইরকম একটা গল্প ছিল, এক ডাকিনী একটা মরা বাঘের হাড়গোড় জড়ো করে মন্ত্র পড়ে প্রথমে বাঘের পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল তৈরি করল। তারপর মন্ত্র পড়ে তার ওপর মাংস, তার ওপর চামড়া বসিয়ে দিল। তারপর করল প্রাণসঞ্চার। সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা ভয়ংকর রূপ ধরে উঠে দাঁড়াল।
রূপকথার গল্প হলেও এর মধ্যে মন্ত্র—তন্ত্র সাধনার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আমার ধারণা এইরকমই কাণ্ড ঘটিয়েছিল কাঠমান্ডুর সেই মহাশক্তিধর তান্ত্রিক। সেই ঝুলনো কঙ্কালটায় প্রাণসঞ্চার করে তাকে—ম্যাজিশিয়ান যেমন কাউকে হিপনোটাইজ করে যেখানে খুশি পাঠাতে পারে, তাকে দিয়ে যা খুশি তাই করাতে পারে, এই তান্ত্রিকও তেমনি ওই কঙ্কালটাকে জীবন্ত করে দূরে পাঠিয়ে তার অভীষ্ট কাজ সম্পন্ন করে। আপনাকে মারার জন্যে তাই সেই তান্ত্রিক কঙ্কালটাকে—যার নাম দেওয়া হয়েছিল রাজু সুব্বা—পাঠিয়েছিল। কঙ্কালের ওপর কৃত্রিম রক্ত, মাংস, চামড়া বসানো হয়েছিল বলে তার মুখটাকে আপনাদের পোড়া কাঠের মতো মনে হত। কৃত্রিম সৃষ্টি বলেই তার মুখে হাসি ফুটত না। একই কারণে আপনার ওকে মনে হয়েছিল একটা ‘মান্ধাতার আমলের জংধরা যন্ত্র’ বলে।
অম্বুজ লাহিড়ি একটু থামলেন। তারপর চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে বললেন, তবে এইরকম জীবন্ত কঙ্কালের শক্তিরও সীমা থাকে। একটা দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারে। তারপর আর পারে না। তাই সেই তান্ত্রিককে দেখা গেছে আপনাকে মারার জন্যে সুদূর নেপাল থেকে আপনাদের বাড়ির বাগান পর্যন্ত ধাওয়া করে আসতো। সে এখানে না এলে অত দূর থেকে ছেলেটাকে চালনা করা সম্ভব হত না।
কিন্তু সুব্বা যে এতদিন আমাদের বাড়ি ছিল, তখন তো তান্ত্রিক আসেনি।
নিশ্চয় এসেছিল। আপনারা জানতে পারেননি।
প্রণবেশ বলল, এই জীবন্ত কঙ্কাল কি যেখানে খুশি, যখন খুশি যেতে পারে?
অম্বুজ লাহিড়ি মাথা নাড়লেন। বললেন, না। সবসময়ে সব জায়গায় যেতে পারে না। তা যদি পারত তা হলে তো ওই তান্ত্রিক অমিত শক্তির অধিকারী হয়ে উঠত। কঙ্কালটাকে দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারত। ঈশ্বর এইখানেই নিরীহ মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
এই বলে একটু থামলেন। তারপর হেসে বললেন, আজ উঠি। কাল দার্জিলিং চলে যাব। একটু কাজ আছে। বলে উঠে পড়লেন।
আমরা ওঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। আমার স্ত্রী হেসে বললেন, যাক ওই আপদটার হাত থেকে যে আমরা ঠিক সময়ে রেহাই পেয়েছি এই আমাদের ভাগ্য। যদি ট্রেনে উঠে কলকাতা পর্যন্ত ধাওয়া করে আসত তাহলে কী হত বলুন তো!
অম্বুজ লাহিড়ি দরজার বাইরে পা রেখেছিলেন, আমার স্ত্রীর এই শেষ কথা শুনে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি আমার স্ত্রীকে বোধহয় কিছু বলার জন্যে মুখটা ফেরালেন। কিন্তু বললেন না। তবে মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর দেখাল। মনে হল যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।