১. অমল সোমের বাড়িতে

বিশল্যকরণী (২০১০) – সমরেশ মজুমদার
অর্জুন সমগ্র ৫ – সমরেশ মজুমদার

সকাল নটায় হাকিমপাড়ায় অমল সোমের বাড়িতে গিয়ে অর্জুন অবাক হল। সুটকেস বন্ধ করে তাতে চাবি ঘুরিয়ে হাবু তাকে দেখে একগাল হাসল।

কী ব্যাপার? সুটকেস নামিয়েছ কেন?

অর্জুন জিজ্ঞেস করতে হাবু আঙুল তুলে ভিতরটা দেখাল। মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। মাঝে মাঝে অর্জুনের মনে হয় হাবু খুব বুদ্ধিমান। ও কথা। বলতে পারে না বলে কোনও আক্ষেপ নেই, উলটে বেশ উপভোগ করে। লোকে যখন ওর ইশারা বুঝতে পারে না, তখন মজা পায়।

অমলদা কোথাও যাচ্ছেন?

ডান হাত ওলটাল হাবু, যার অর্থ সে কিছুই জানে না।

বাড়ির ভিতরের বারান্দায় পৌঁছে অমল সোমকে দেখতে পেল অর্জুন। রোদ্দুরে চেয়ার পেতে চাদরমুড়ি দিয়ে বসে বই পড়ছেন। বারান্দা থেকে সে একটা মোড়া তুলে উঠোনে ওঁর কাছাকাছি বসে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?

ইন্টারেস্টিং! অমল সোম বই বন্ধ করলেন, বুঝলে অর্জুন, একটা লোক দু-দু’বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও তৃতীয়বার উত্তরমেরুতে যাচ্ছে। তৃতীয়বার ভাগ্য তার উপর সদয় না-ও হতে পারে জেনেও যাচ্ছে। কোনও ধনরত্ন পাওয়ার আগ্রহে নয়, শুধু ফোটো তোলার নেশা তাকে ঘরে থাকতে দিচ্ছে না।

অর্জুন কথা বলল না। তার প্রশ্নটা অমল সোমের কানে ঢোকেনি। বইয়ের মধ্যে এখনও ঝুঁদ হয়ে আছেন। অমল সোম বলে চলেছেন, এরকম মানুষ আজও পৃথিবীতে আছেন বলে একটার পর একটা আবিষ্কার হয়ে চলেছে। বইটা পড়ে দেখো।

একটা ইংরেজি পেপারব্যাক এগিয়ে দিলেন অমল সোম। অর্জুন বইটা নিয়ে দেখল মলাটে হিমবাহের ফোটো, উপরে লেখকের নাম রবার্ট মুরহেড, নীচে, পয়জনাস স্নো’, বিষাক্ত বরফ। অর্জুন কল্পনা করল, উত্তরমেরুতে যখন ব্লিজার্ড বইছে, সাপের ছোবলের মতো বরফ ছুটে আসছে,তখন তাকে বিষাক্ত ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?

অমলদা অর্জুনকে দেখলেন, তুমি কি একেবারে তৈরি হয়ে এসেছ? তৈরি হয়ে আসব কেন? অর্জুন চোখ ছোট করল, আপনি তো আমাকে কিছু বলেননি?

বলিনি? ঠিক বলছ তুমি? আমি তোমাকে বাইরে যাওয়ার কথা বলিনি?

না অমলদা। গত পরশু বিকেলে আমি আপনার কাছে এসেছিলাম। আপনি তখন বিশল্যকরণী পাতা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, আমার সঙ্গে ভাল করে কথা বলতে পারেননি।

চোখ বন্ধ করলেন অমল সোম। তারপর বললেন, রোগটা ভালই পাকিয়েছে হে!

কী রোগ?

ভুলে যাওয়ার। আমি তোমাকে বলব বলে ঠিক করেছিলাম। তুমি এসেছিলে, চলেও গেলে। আজ সকালে আমার মনে হল, তোমাকে বলেছি এগারোটার মধ্যে চলে আসতে। আর মনে হওয়ামাত্র নিশ্চিত হয়ে গেলাম। যত দিন যাবে তত এই রোগ শক্তিশালী হবে। ধরো, দুপুরের খাবার খাওয়ার এক ঘণ্টা পরে মনে হবে আমি খাইনি। এখনই বেশ কিছু মানুষের নাম আমি মনে রাখতে পারি না। কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ একটা শঙ্খ বাজাতেন। গতকাল কিছুতেই সেই শঙ্খটার নাম মনে করতে পারছিলাম না। মনে না করতে পারলে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। তখন যে কী ভয়ানক কষ্ট! অমল সোম বললেন।

নামটা মনে করতে পেরেছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ, অদ্ভুতভাবে। যত ভাবছি তত ‘গজদন্ত’ শব্দটা মনে আসছিল। শাঁখটার নাম কখনওই গজদন্ত নয়। ওই গজদন্ত শব্দটা থেকে গজেন নামটা মনে এল। বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত লেখক ছিলেন গজেন্দ্রকুমার

এক ঘণ্টা পারি না। কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ এখলাম না। মনে না মিত্র। ব্যস, পেয়ে গেলাম নামটা।

অবাক হল অর্জুন, কী করে?

গজেন্দ্রকুমারের একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘পাঞ্চজন্য। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের উপর লেখা। শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খটির নামে বইটির নামকরণ করেছিলেন। হাসলেন অমল সোম।

এটা হয়েই থাকে। ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাববেন না। এখন বলুন, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? হাবুকে দেখলাম সুটকেস গুছিয়ে ফেলেছে। অর্জুন বলল।

অনেকদিন উত্তরবাংলার গাছগাছালি দেখিনি। দিনদশেক আগে মেজর ফোন করেছিলেন ফ্লোরিডা থেকে। জিজ্ঞেস করেছিলেন, রামায়ণে হনুমান। গন্ধমাদন পর্বত থেকে যে ভেষজ পাতা আনতে গিয়ে খুঁজে না পেয়ে গোটা পর্বতটাকে তুলে নিয়ে এসেছিল, তার নাম কী? বললাম। শুনে জিজ্ঞেস করলেন, ওই গুল্ম কি এখনও পাওয়া যায়? বললাম, পাওয়া যায় মানে? এই ডুয়ার্সের জঙ্গলে আগাছার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে! শুনে তিনি খুব উত্তেজিত। দুদিন পরে জানালেন, একজন ভেষজবিজ্ঞানীকে নিয়ে কলকাতা হয়ে এখানে আসছেন। ইতিমধ্যে ওঁরা দমদম বিমানবন্দরে নেমে গিয়েছেন। সাড়ে দশটায় বাগডোগরায় নামবেন। আমি ওঁদের নিয়ে আসতে গাড়ি পাঠিয়েছি। নেপালি ড্রাইভারকে মেজরের নাম লিখে প্ল্যাকার্ড করে দিয়েছি। ধরো, এগারোটার একটু পরে ওঁরা চলে আসবেন। এলেই ওঁদের গাড়িতে আমরা উঠে পড়ব। অমল সোম শান্ত গলায় বললেন।

কোথায় যাবেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

আপাতত রাজাভাতখাওয়া। ওখানকার ফরেস্ট বাংলোয় তিনটে ঘরের জন্যে ডি এফ ও সাহেবকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু তুমি কী করবে এখন?

অর্জুন চট করে ভেবে নিল। এখন প্রায় দশটা। সে উঠল, আপনি যখন চাইছেন তখন চেষ্টা করছি ওই সময়ের মধ্যে তৈরি হয়ে আসতে।

এসো!

.

বাড়িতে ঢোকামাত্র মা জিজ্ঞেস করলেন, সাতসকালে কোথায় গিয়েছিলি?

অমলদার বাড়িতে। কেন?

এসব করে বেড়ালে চলবে? কবে থেকে বলছি একটা স্থায়ী চাকরির চেষ্টা কর, তুই কানেই তুলছিস না! কবে কখন একটা কেস পাবি, সেটা করে ঠিকঠাক রোজগারও সবসময় হয় না, এভাবে কতদিন চলবে? মায়ের গলায় তীব্র বিরক্তি।

অর্জুন হাসল, চলে তো যাচ্ছে। যা টাকা পেয়েছি তাতে কোনও অসুবিধে হয়নি।

আমি ওসব জানি না। রায়সাহেব ফোন করেছিলেন, খুব জরুরি, বললেন। দয়া করে আজই ওঁকে ফোন কর। মা বললেন।

রায়সাহেব মানে?

ওঃ। মি. এ পি রায়। কলকাতা থেকে একটু আগে ফোন করেছিলেন। বললেন, তোর সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে। মা চলে গেলেন তাঁর কাজে।

জলপাইগুড়ি শহরের মানুষ এ পি রায়কে প্রথমে চিনত এসপি রায়ের ছেলে হিসেবে। এস পি রায়কে বলা হত ফাদার অফ জলপাইগুড়ি’। বেশ কয়েকটা চা-বাগানের মালিক এস পি রায় শহরের জন্যে, শহরের মানুষের জন্যে সারাজীবন কাজ করে গিয়েছেন। খেলাধুলো ভালবাসতেন ভদ্রলোক। নিজে ফুটবল খেলতেন। বৃদ্ধ বয়সেও তাঁকে মাঠে দেখা যেত। ভাল খেলতে পারলেই যে-কোনও খেলোয়াড়কে চাকরি দিতেন তিনি। কত গরিব মানুষ তাঁর কাছে উপকৃত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই এস পি রায়ের ছেলেও জলপাইগুড়ির খেলার জগতের সঙ্গে জড়িতছিলেন। অর্জুনকেবিশেষ স্নেহকরেন তিনি। তাঁদের চা-বাগানগুলো নানান সমস্যার কারণে হস্তান্তর করতে বাধ্য হওয়ায় তিনি এখন সপরিবার কলকাতায় বাস করছেন। এই মানুষটি হঠাৎ তাকে ফোন করতে গেলেন কেন? ঘড়ি দেখল সে। কথা বলতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ঠিক সময়ে পৌঁছোনো তার অভ্যেস। কিন্তু মায়ের কথা ভেবে টেলিফোনের বই দেখে নাম্বার বের করে ডায়াল করল অর্জুন। একটু পরেই এ পি রায়ের গলা শুনতে পেল সে, হ্যালো!

এ পি-দা, আমি অর্জুন।

ও! শোনো, তুমি আজই ট্রেনে ওঠো। কাল কলকাতায় তোমাকে দরকার।

কেন?

কেন মানে? তোমার যা ট্যালেন্ট তা জলপাইগুড়িতে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে। তা ছাড়া অর্থনৈতিক ব্যাপারটা নিয়ে তুমি মোটেই ভাবছ না। কলকাতার সবচেয়ে বড় বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা ‘থার্ড আই’-এর এম ডি’র সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি তোমার নাম শুনেছেন। ওঁর সংস্থায় তুমি যদি জয়েন করতে চাও তা হলে সানন্দে গ্রহণ করবেন। এ পি রায় বেশ খুশি গলায় কথাগুলো বললেন।

এ পি-দা, আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিতে হবে। আমি এখনই একটা বিশেষ কাজে ডুয়ার্সে যাচ্ছি। ফিরে এসেই আপনাকে ফোন করব।

যাওয়াটা কি খুব জরুরি?

আমি কথা দিয়েছি যে!

ওকে।

ফোন রেখে দিলেন এ পি রায়, কিন্তু অর্জুন বুঝতে পারল ভদ্রলোক বেশ বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু কী করতে পারে সে? আচমকা কোনও সংস্থায় চাকরি নিয়ে সত্যসন্ধান করা কি তার পক্ষে সম্ভব? কোথাও চাকরি করলে নিজের স্বাধীনতা সংকুচিত হবেই। হয়তো প্রতি পদক্ষেপে কৈফিয়ত দিতে হবে। কিন্তু এ পি রায়ের প্রস্তাবে মুখের উপর না বলা যায় না। সে ঠিক করল, ফিরে এসে কলকাতা যাবে।

সে অমল সোম এবং মেজরের সঙ্গে ডুয়ার্সে যাচ্ছে এই খবরটা শুনে মা চট করে রাগারাগি করতে পারলেন না। অর্জুন মাকে আশ্বস্ত করল, ফিরে এসেই সে কলকাতা যাবে। মা শুধু বললেন, এই সুযোগটা হারাস না অর্জুন!

কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে অর্জুন যখন অমল সোমের বাড়িতে ঢুকল তখন ঘড়িতে সওয়া এগারোটা। অমল সোম বারান্দায় চেয়ারে বসে ছিলেন, পাশে হাবু। কাছে যাওয়ামাত্র হাতে ধরা ডালভরা পাতাগুলো এগিয়ে ধরলেন তিনি, আমার বাড়ির বাগানে এগুলো জঙ্গল হয়ে রয়েছে। একেই যে বিশল্যকরণীপাতা বলে, তা তুমি নিশ্চয়ই জানো। কিন্তু লক্ষ করে দ্যাখো, পাতাগুলো খুব ফ্যাকাশে। অর্থাৎ এর রস খুব পাতলা হবে। সেক্ষেত্রে সেটা আদৌ কার্যকর হবে কি না আমি জানি না।

অর্জুন পাতাগুলো হাতে নিল। হ্যাঁ, এগুলো বিশল্যকরণী পাতা। কিন্তু জঙ্গলে যেরকম গাঢ় রঙের পাতা দেখা যায়, এগুলো তেমন নয়।

সে জিজ্ঞেস করল, এগুলো কি ওঁদের দেখাবেন?

ব্যাগে রেখে দাও। পার্থক্য বোঝাতে হলে দেখাব। অমল সোম ঘড়ি দেখলেন, কিন্তু এখনও ওঁরা আসছেন না কেন?

ফ্লাইট ঠিক সময়ে এসেছে কি না কে জানে! বাগডোগরায় নেমেও তো অনেকটা রাস্তা ওঁদের আসতে হবে।

অর্জুন আসার পরে হাবু ভিতরে চলে গিয়েছিল। এবার একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ার আর বাস্কেটের মধ্যে দাঁড় করানো ছ’টা জলের বোতল নিয়ে এল।

আমি বাইরের জল খেতে পারি না। এগুলো ফুরিয়ে গেলে কী হবে কে জানে? সিলকরা বোতলের জল কিনে খেলেও ঠিক ভরসা পাই না। অমল সোম বললেন।

অর্জুন কিছু বলল না। বয়স হয়ে গেলে মানুষের ধ্যানধারণা বদলে যায়। যে অমল সোমের সঙ্গে সে বিভিন্ন অভিযানে গিয়ে দেখেছে, কোনও ব্যাপারেই তাঁর কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য নেই, তিনি এখন ফোঁটানো জল পাবেন না বলে দুশ্চিন্তায় আছেন। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কি এমন একটা বয়স আসে, যখন তার খুঁতখুঁতুনি বেড়ে যায়।

শেষপর্যন্ত গাড়িটা বাড়ির সামনে এল বারোটা তিন মিনিটে। অর্জুন ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল, গাড়ি থেকে নেমে দুটো হাত পাখির ডানার মতো দু’পাশে মেলে চিৎকার করে উঠলেন মেজর, হাই মধ্যম পাণ্ডব। আমি আশা করছিলাম নেমেই তোমাকে দেখতে পাব।

অর্জুন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?

উত্তরটা মুখে না দিয়ে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মেজর। তাঁর গালভরতি দাড়ি অর্জুনের মুখে চেপে ধরে বললেন, লা-টু উপ্পা।

সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ভিতর থেকে স্ত্রীকণ্ঠের হাসি ভেসে এল।

মেজর সেদিকে তাকাতেই অমল সোমের গলা শোনা গেল, দেরি হল কেন?

মেজর বললেন, দমদম থেকে ছাড়তেই দেরি করল। ইন্ডিয়ায় যা খুব স্বাভাবিক।

অমল সোম গম্ভীর গলায় বললেন, মেজর! প্লেনটা দেরি করলেও ছেড়েছে। আমেরিকার এয়ারপোর্টগুলোয় রোজ কত ফ্লাইট ক্যানসেল হয় তা নিশ্চয়ই আপনার জানা নেই। যাকগে, ছেড়েছিল বলে আমাদের দেখা হল।

মেজর অমল সোমের দিকে হাত বাড়ালেন, আপনি আগের মতো আছেন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি।

এসময় উলটো দিকের দরজা খুলে যিনি নেমে এলেন, তিনি ইচ্ছে করলে সিনেমার নায়িকা হতে পারতেন। শুধু লম্বাই নন, বেশ সুন্দরী। পরনে জিন্স আর জ্যাকেট। এগিয়ে এসে অমল সোমের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, স্টেফি মুরহেড।

মেজর আলাপ করিয়ে দিলেন। স্টেফি ভেষজবিজ্ঞানী। মাস্টার্স করার পর রিসার্চ করছেন। থাকেন ফ্লোরিডায়। বয়স জেনে অর্জুন বুঝল, স্টেফি তার চেয়ে এক বছরের ছোট।

মেজরের ইচ্ছে ছিল কিছুক্ষণ অমল সোমের বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে রওনা হওয়ার। কিন্তু অমল সোম বললেন, তাড়াতাড়ি রাজাভাতখাওয়ায়। পৌঁছোনো উচিত।

স্টেফিকে ড্রাইভারের পাশের আসনে বসতে বলা হল। পিছনে ওঁরা তিনজন। অমল সোম ড্রাইভারকে বললেন, ভানুপ্রসাদ, ট্যাঙ্ক ভরে তেল নিয়ে নাও।

জলপাইগুড়ি শহর থেকে বেরিয়ে তিস্তা নদী পেরিয়ে বলেরো গাড়ি ছুটল ডুয়ার্সের দিকে। জানলার কাচ নামিয়ে একবুক শ্বাস নিয়ে মেজর বললেন, আঃ!

অমল সোম মুখ না ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?

বুকের ভিতরটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল! কী বাতাস, একফোঁটা পলিউশন নেই। এখানে এলেই আমার বুকের ভিতরটা নির্মল হয়ে যায়। মেজর বললেন।

তা হলে এখানে না থেকে আমেরিকায় পড়ে আছেন কেন?

অভ্যেস! স্রেফ অভ্যেস। অসুস্থ হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যাবে সরকার, শ্রেষ্ঠ চিকিৎসার সুযোগ পাব। মেজর বললেন, কিন্তু খিদে পেয়ে গেল!

খিদে? যেন এর চেয়ে শিশুসুলভ শব্দ অমল সোম আগে কখনও শোনেননি।

অফকোর্স খিদে। সেই ভোরে হোটেল থেকে বেরোবার সময় এক কাপ চা ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি। এয়ারপোর্টে বসে থাকতে হল। একটা ভাল রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ল না। প্লেনে তো খাবার দেওয়ার বালাই ছিল না। আফটার অল এই চেহারাটা তো উইদআউট ফুয়েল রান করতে পারে না। বেশ চেঁচিয়ে কথাগুলো বললেন মেজর।

অর্জুন বলল, ডান দিকের বাইপাশ ধরলেই একটা ভাল ধাবা পাওয়া যেতে পারে।

অমল সোম ঠোঁট ওলটালেন, ধাবা! ওখানে খেলে আমাশা অনিবার্য।

মেজর শরীর নাচালেন, উঁহু। আমি বহুবছর আগে ধাবায় খেয়েছিলাম। মাটন চাপ, কী ডিলিসিয়াস! এখনও ভুলতে পারিনি।

মাটন চাপ! মেজর, আপনি এই বয়সে মাটন খাবেন? রেড মিট? আমি ভাবতে পারছি না আপনি আমেরিকায় থেকেও এত অবৈজ্ঞানিক কথা বলছেন কী করে?

অর্জুন অমল সোমকে থামাতে বলল, ওখানে চিকেনও পাওয়া যাবে। চিকেন? মেজর তাঁর কাঁচাপাকা দাঁড়িতে আঙুল চালালেন, ওটা একটা খাদ্যদ্রব্য বলে আমি মনে করি না।

স্টেফি অবাক চোখে চারপাশ দেখছিলেন। ওঁর হাতে এখন ক্যামেরা। জানলা দিয়ে টপাটপ ফোটো তুলে যাচ্ছেন একের পর-এক। ভানুপ্রসাদ সম্ভবত পিছনের আলোচনা শুনছিল। গাড়ির গতি কমিয়ে বলল, ধাবা এসে গিয়েছে, গাড়ি থামাব?

ইয়েস মাই বয়। মিস্টার সোম, এই ধাবায় যে খাবারকে আপনি স্বাস্থ্যসম্মত বলে মনে করেন, তাই আমি হাসিমুখে খেয়ে নেব।

গাড়ি থামতেই একটা ছোকরা ছুটে এল। নামতা পড়ার মতো নানান খাবারের নাম বলে যেতে লাগল। গাড়ি থেকে নেমে অর্জুন তাকে ধমকে চুপ করতে বলে মালিককে ডেকে আনতে বলল। ছেলেটার কথা শুনে একজন বেঁটে সর্দারজি ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। এখন ধাবার সামনে গাড়ির ভিড় হালকা। কয়েকজন খাঁটিয়ায় বসে খাচ্ছে। সর্দারজি সামনে এসে হাসল, আরে বাপু! আপ? বলিয়ে বাবুজি?

নাম মগন সিংহ। এর আগে দু-তিনবার এই ধাবায় নেমেছিল অর্জুন। একবার একটু ঝামেলাও হয়েছিল। দেখা গেল, তাকে মনে রেখেছে। মগন সিংহ।

অর্জুন বলল, ওই দাড়িওয়ালা সাহেব আর মেমসাহেব আজই বিদেশ থেকে এসেছেন। মশলা যতটা কম আর ঝাল একদম নয়, এমন খাবার দিতে পারবেন ওঁদের জন্যে?

জি। কেন পারব না? বসুন, বসুন! এ বাচ্চা, চার কুরশি লাগা জলদি। চিৎকার করল মগন সিংহ। তারপর জিজ্ঞেস করল, চিকেন না মাটন?

অমল সোম খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, চিকেন! কিন্তু খাবারটা কী?

বাবুজি, সুপ দিতে পারি! যদি বলেন স্টু, তাও হবে। সঙ্গে রুটি, গরমাগরম।

আমাকে ভেজিটেবল সুপ দাও। ওদের চিকেন।

মগন সিংহ অর্জুনের দিকে তাকাল, বাবুজি, আপনিও তাই নেবেন?

না। মাটন চাপ আর রুটি। কিন্তু প্লেট চামচ যেন পরিষ্কার থাকে।

মগন সিংহ চলে গেল। ছেলেটা ইতিমধ্যে চেয়ার পেতে দিয়েছিল। হালকা শীত মাখানো রোদ্দুরে এখানে বসতে মন্দ লাগবে না। ওপাশে মেজর স্টেফিকে বোধহয় ডুয়ার্সের ভূগোল সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছিলেন। অর্জুনের ডাকে ওঁরা চলে এলেন। চেয়ারে বসে মেজর বললেন, গ্র্যান্ড! স্টেফি, এটাকে ওপেন এয়ার রেস্টুরেন্ট ভেবে নাও।

কথাগুলো ইংরেজিতে বললেন তিনি। স্টেফি চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কোনও লেডিসরুম নেই?

মেজর চটপট ছেলেটিকে ডেকে বললেন, অ্যাই, তোদের এখানে মেয়েদের টয়লেট আছে? টয়লেট? ওঃ! কী বলে বোঝাই!

অর্জুন হাসল, মেমসাহেবকে বাথরুমে নিয়ে যা।

ছেলেটা মাথা নেড়ে ইশারা করল স্টেফিকে। মেজর বললেন, উঃ, আমাদের কত ভুল কথা শেখানো হয়েছিল। বাথরুম যে স্নানের ঘর, জলবিয়োগের জন্যে নয়, তা কে বলবে?

অমল সোম আরাম করে বসে ছিলেন। বললেন, এত বছর আমেরিকায় থেকেও আপনি বিকল্প বাংলা চমৎকার বলছেন দেখে প্রীত হলাম।

মানে? মেজর তাকালেন।

বুঝে নিন।

এই সময় লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবি পরা একটা স্বাস্থ্যবান লোক ধাবা থেকে বেরিয়ে এল পানীয়ের বোতল হাতে। এসে বোতল উঁচিয়ে ধরে গলায় খানিকটা ঢেলে চিৎকার করল, মুন্না, এ মুন্না! জলদি বাহার আ।

আর-একজন স্বাস্থ্যবান লোক বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। তারও হাতে পানীয়ের বোতল।

প্রথম লোকটি হতাশ গলায় বলল, ফালতু বাত মত করনা।

একদম সাচ বাত। একটু আগে আমি দেখেছি। একজন মেমসাব। ফিল্মস্টার।

তো? হাত ঘুরিয়ে মূকাভিনয় করে জিজ্ঞেস করল লোকটা, কোথায় গেল?

এই সময় দেখা গেল মগন সিংহ বেরিয়ে আসছে। দ্রুত লোকটার কাছে গিয়ে নিচু স্বরে কিছু বলল। লোকটা সেটা শুনে অর্জুনদের দিকে তাকাল। তারপর সঙ্গীকে নিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে গেল। মগন সিংহ ভিতরে চলে যেতে অমল সোম বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখলে! এরকম সাবস্ট্যান্ডার্ড জায়গায় যারা খেতে আসে, তারা আর যাই হোক, ভদ্রলোক নয়। লুম্পেন, গুন্ডাদের জায়গা এটা। খাবার দিতে দেরি হলে আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।

অর্জুন বলল, লোকটা বোধহয় ট্রাক ড্রাইভার। মগন সিংহ যখন কথা বলেছে। তখন আর ওর কিছু করার ক্ষমতা নেই। তা ছাড়া এরকম লোক শুধু ধাবা কেন, অনেক বড় বড় রেস্টুরেন্টেও চলে যায়। আপনি চিন্তা করবেন না।

খাবার এল। একটা ছোট টেবিল পেতে তার ওপর খাবারের পাত্রগুলো রাখা হল। তিনজনের জন্যে পরিষ্কার চকচকে কানাউঁচু বাটিতে স্টু অথবা সুপ, একটা প্লেটে গরম রুটির স্তূপ, অর্জুনের জন্যে খালি প্লেট আর গরগরে মাটন চাপ।

অমল সোম বললেন, দেখে তো শত্রু বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু মহিলাটি কোথায় গেলেন? এত দেরি হওয়ার তো কথা নয়।

অর্জুন উঠে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই ওদের দেখতে পেল। স্টেফির হাতে একটা গাছের ডাল। ছেলেটাও যেন ওকে কিছু পাইয়ে দিয়েছে এমন আনন্দে হাঁটছে। মুখোমুখি হতেই স্টেফি ডালটা দেখিয়ে বললেন, তুমি এই গাছটাকে চেনো?

হ্যাঁ। গাঁদাফুলের গাছ।

দ্যাটস অল? তার বেশি জানো না? অথচ ও জানে। ও বলল যদি অল্প কেটে বা ছড়ে যায়, তা হলে এই গাছের পাতা থেঁতলে রসসুদ্ধ ক্ষতস্থানে চেপে দিলে সেটা খুব তাড়াতাড়ি সেরে যায়। স্টেফি বলল, দ্যাখো, নেচার মানুষের জন্যে কতরকমের ফাস্ট এডের ব্যবস্থা করে রেখেছে।

তা ঠিক। এরকম তুমি অনেক কিছু পাবে। কিন্তু খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ।

অর্জুনের কথায় তেমন কাজ হল না। চেয়ারে ফিরে এসে স্টেফি আবার সবিস্তার মেজরকে বোঝাতে লাগলেন গাঁদাগাছের পাতার কী মহিমা!

অমল সোম তখন খাওয়া শুরু করেছেন। বললেন, গুড! ভেরি গুড।

স্টেফি ছোট্ট পাতাভরতি ডাল টেবিলের একপাশে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আমি কি খুব সামান্য ব্যাপার নিয়ে বেশি এক্সসাইটেড হয়েছি?

মেজর খেতে খেতে বললেন, নট দ্যাট। তোমার পক্ষে উত্তেজিত হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এরা এ-সবে এত অভ্যস্ত যে, নতুন করে উত্তেজিত হতে পারে না। একটু চুপ করে তিনি গলার স্বর পালটালেন, অর্জুন!

সবে মাংসের টুকরো রুটিতে জড়িয়ে মুখে পুরেছিল, সেই অবস্থায় তাকাল অর্জুন।

আমি যদি তোমার খাবারটা একটু টেস্ট করতে চাই, জাস্ট একটা ওয়ান ফোর্থ টুকরো, তুমি কি খুব আপত্তি করবে? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।

না, নিন! আপনি তুলে নিন। প্লেট এগিয়ে ধরল অর্জুন। মেজর, আপনি নিজের ক্ষতি করছেন। অর্জুনের যে বয়স তাতে সে রেড মিট, মশলা দেওয়া ঝাল রান্না খেয়ে হজম করতে পারে। আপনার বয়সে তা করা সম্ভব নয়। লোভ সংবরণ করুন যদি আরও কিছুদিন বাঁচতে চান। বেশ

অভিভাবকের গলায় কথাগুলো বললেন অমল সোম।

হতাশ চোখে অমল সোমকে দেখলেন মেজর। তারপর হাত সরিয়ে নিয়ে মাথা নাড়লেন, আপনার অনেক পরিবর্তন হয়েছে মি. সোম।

স্বাভাবিক। প্রাণ থাকলেই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। অমল সোম মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছিলেন।

ভানুপ্রসাদের কথা খেয়াল ছিল না কারও, অমল সোমই মনে করালেন। তাকে ভিতরে খেতে পাঠানো হল। খাওয়া শেষ করে অমল সোম স্টেফিকে জিজ্ঞেস করলেন, মেজর টেলিফোনে তোমার কথা বলছিলেন। এবার বলো, কী উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এসেছ?

স্টেফি খাওয়াটা উপভোগ করছিলেন। কাগজের রুমালে ঠোঁট মুছে বললেন, আমি একজন ভেষজবিজ্ঞানী। মাস্টার্স করার পর কী নিয়ে রিসার্চ করব তা-ই ঠিক করতে পারছিলাম না। বস্টন ইউনিভার্সিটির হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট এডওয়ার্ড স্মিথ-এর সঙ্গে আচমকা পরিচয় হয়ে গেল। উনি আমাকে বললেন, ভারতীয় মহাকাব্যে এমন অনেক উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে, যা মানুষের শরীরে মিরাকলের মতো কাজ করেছে। ছোটখাটো অসুখে তাদের অবদানের কথা এখন অনেকেই জানেন। উনি আমাকে বললেন যে, বুকের গভীর ক্ষত নাকি একটা লতানো গাছের পাতার রসে দ্রুত জুড়ে যায়। আমাকে একটি বই পড়তে দেন এডওয়ার্ড। ডিউরিং দ্য ওয়ার লছমন ওয়াজ অলমোস্ট কিলড বাই মেঘনাদ। সেটা ছিল সাম শর্ট অফ শেলের আঘাত। লছমন ওয়াজ সেন্সলেশ। তার বুক থেকে রক্ত বের হচ্ছিল এবং মৃত্যু যে-কোনও মুহূর্তেই হতে পারত। হিজ এল্ডার ব্রাদার ওয়াজ টোল্ড দ্যাট, লছমনকে বাঁচাতে পারে একটা গাছের পাতার রস, যা গন্ধমাদন। পাহাড়ে পাওয়া যায়। গাছটার নাম বিশল্যকরণী। যাই হোক, সেই পাতার রসে লছমনের উন্ড দ্রুত সেরে গিয়েছিল এবং সে বেঁচে গিয়েছিল। আমি এটাকে রূপকথা ভেবেছিলাম। অনেক অ্যাবসার্ড ব্যাপার রূপকথায় থাকে। কিন্তু এডওয়ার্ড আমাকে বললেন, ওই গাছ নাকি এখনও ইন্ডিয়ায় পাওয়া যায়। শ্বাস নিলেন স্টেফি, আমি আমার ইউনিভার্সিটিতে এটা নিয়ে কথা বললাম। সবাই হেসে উড়িয়ে দিল। একজন বিদ্রূপ করল এই বলে যে, যদি তুমি ওই গাছের পাতার রস ঠিকঠাক প্রিজার্ভ করতে পারো, তা ওপেন হার্ট সার্জারির ক্ষেত্রে দারুণ কাজ দেবে। লোকটি বিদ্রূপ করলেও আমি একটা প্রস্তাব তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিলাম। আর তখনই মি. মেজরের সঙ্গে আমার আলাপ হল। উনি ফোনে জেনে নিলেন যে, এখনও ইন্ডিয়ার এই পার্টে ওই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। আপনারা কেউ দেখেছেন কি?

অমল সোম এবং অর্জুন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।

গাছটা কি খুব দামি?

অমল সোম বললেন, নট অ্যাট অল। যে-কোনও বুনো গাছের মতো এখানে-ওখানে গজিয়ে থাকে। তবে তা দিয়ে ওপেন হার্ট সার্জারির কী কাজে লাগবে তা আমি জানি না।

অর্জুন বলল, ছেলেবেলায় খেলতে গিয়ে কোথাও কেটে গেলে বিশল্যকরণী পাতার রস লাগিয়ে দিলে দেখতাম, পরদিন জায়গাটা জুড়ে গিয়েছে।

তুমি সত্যি বলছ? স্টেফি উত্তেজিত।

অমল সোম বললেন, সেটা তো ওই গাঁদাফুলের পাতার রসেও জুড়ে যায়?

অর্জুন বলল, যায়। তবে বিশল্যকরণী আরও বেশি জোরালো। অর্জুন পকেট থেকে অমল সোমের দেওয়া বিশল্যকরণী গাছের পাতা বের করল। এই ছোট্ট ডালের পাতাগুলো হল বিশল্যকরণী। অমলদার বাড়িতেই এটি পাওয়া যায়।

স্টেফি দ্রুত হাত বাড়িয়ে ওটা নিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন। মেজর বললেন, আমার যতদূর মনে আছে, বিশল্যকরণী পাতা এমন ফ্যাকাশে হয় না। বেশ গাঢ় রং।

অমল সোম বললেন, ঠিক। গন্ধমাদন পাহাড়ে কী ধরনের বিশল্যকরণী গাছ ছিল তা আমি জানি না, কিন্তু এই ডুয়ার্সের জঙ্গলে ওই গাছের যে পাতা দেখেছি, তার রং খুব ডিপ, কালচে-নীল, আর তার পাতার রস খুব গাঢ়।

স্টেফি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি গাছ বললেন, কিন্তু আমি শুনেছি ওটা উদ্ভিদ।

অমল সোম হাসলেন, ঠিকই শুনেছ। আমরা অন্যমনস্কভাবে গাছ শব্দটি ব্যবহার করি। যেমন ধান। ধান একটি উদ্ভিদ। কিন্তু আমরা বলি ধানগাছ। বিশল্যকরণী লম্বায় দেড়-দু’ ফুটের বেশি হয় না।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, স্টেফি, এই পাতার রস কীভাবে ওপেন হার্ট সার্জারিতে কাজে লাগবে?।

ওপেন হার্ট সার্জারির পরে যদি ওই পাতার রস, যেমন শুনেছি তেমন কার্যকর হয়, তা হলে পেশেন্টের ওপেন করা শরীরের অংশ খুব দ্রুত জুড়ে যাবে। এখন চিকিৎসকরা যেভাবে জুড়ছেন তার চেয়ে অনেক কম সময় লাগবে, খরচও কমে যাবে অনেক।

ওই রস কি পরীক্ষার মাধ্যমে অন্য চেহারায় নিয়ে যাওয়া হবে?

অফকোর্স। আমার এই উদ্যোগে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন একটি আন্তর্জাতিক ওষুধ সংস্থা। এই বাবদ যা খরচ হবে তা তারা দিচ্ছেন। যদি সাফল্য পাওয়া যায় তা হলে আমি পেটেন্ট বাবদ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হব। স্টেফি হাসলেন।

.

হাসিমারা হয়ে রাজাভাতখাওয়া পৌঁছোতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। রাজাভাতখাওয়া একটা জায়গার নাম জেনে স্টেফি অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, কথাটার মানে কী?

অর্জুন বলল, ভারত তখন অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত। এরকম এক রাজ্য কুচবিহার। আমরা যেখান দিয়ে যাচ্ছি তা কুচবিহার রাজার রাজত্ব ছিল। এই রাজার সঙ্গে একসময় পাশের পাহাড়ি রাজ্য ভুটানের রাজার ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। শেষপর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হলে শান্তিচুক্তি তৈরি করতে কুচবিহারের রাজা এবং ভুটানের রাজা অথবা তাঁর কোনও প্রতিনিধি এই জায়গায় মিলিত হয়েছিলেন। সেই দুপুরে রাজা এখানে ভাত খেয়েছিলেন বলে জায়গাটার নাম হয়ে গেল রাজাভাতখাওয়া।

মাথা নাড়লেন স্টেফি, এভাবে যে জায়গার নাম হতে পারে জানতাম ।

সামনেই ট্রেন লাইন। স্টেফির কৌতূহল মেটাতে হল অর্জুনকে, এই লাইন কুচবিহার হয়ে অসমে গিয়েছে। ওপাশে শুরু হয়েছে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে।

লাইন পেরিয়ে ডান দিকে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে তা শেষ হয়েছে জয়ন্তীর জঙ্গলে। বাঁ দিকের সরু পিচের পথটা ঢুকে গিয়েছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের এলাকায়। অমল সোম ভানুপ্রসাদকে সেদিকে যেতে বললেন।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, এখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে?

অমল সোম মাথা নাড়লেন, হুঁ।

বাঃ। বেশ কোয়াইট, যাকে বলে শান্ত নিরিবিলি জায়গা। মেজর বললেন।

আপনি দেখছি নিয়মিত বাংলা বই পড়ছেন। অমল সোম বললেন।

মেজর রেগে গেলেন, দেখুন মি. সোম, আমার বাবা-মা চোদ্দো পুরুষ বাঙালি, আমিও তাই। অনেক অনেক বছর আমেরিকায় আছি বলে চট করে ঠিকঠাক শব্দ মুখে আসে না, কিন্তু একটু ধাক্কা খেলেই গড়গড়িয়ে চলে আসে।

একটি লোক রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ি থামিয়ে অমল সোম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, রেস্ট হাউস কোথায়? আমরা ঘর বুক করে এসেছি।

আপনারা ওই অফিসে যান। ওখান থেকেই চাবি পাবেন। লোকটা যে বাড়িটা দেখাল, সেটা ছাড়িয়ে চলে এসেছিল গাড়ি। অতএব ভানুপ্রসাদকে ব্যাক করতে হল।

আমার নামেই বুকিং আছে। অর্জুন, যাও, চাবি নিয়ে এসো। অমল সোম বললেন।

গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে অফিসঘরে ঢুকল। একজন টেলিফোনে কথা বলছেন, দ্বিতীয়জন মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন।

অর্জুন দ্বিতীয়জনকে বলল, রেস্ট হাউসে বুকিং কে দেখেন?

বলুন। কাগজ সরিয়ে রাখলেন ভদ্রলোক।

মি. অমল সোমের নামে ঘর বুক করা আছে। উনি বাইরে গাড়িতে আছেন। তিনটি ঘরের বুকিং আছে। অর্জুন বলল।

আমি যদ্দুর জানি একটা ঘর খালি আছে, তিনটে তো নেই।

সে কী! উনি ডি এফ ও-কে বলেছিলেন তিনটে ঘরের জন্যে?

স্লিপ দিন। হাত বাড়ালেন ভদ্রলোক।

অর্জুন বাইরে বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার কাছে বুকিং স্লিপ আছে?

অমল সোম জানলায় মুখ এনে বললেন, টেলিফোনে কথা হয়েছে। ওটার দরকার নেই।

ব্যাপারটা ঘরে ঢুকে বলতেই প্রথম লোকটি রিসিভার নামিয়ে খাতা খুলে দেখালেন, সেখানে অমল সোমের নাম নেই।

কিন্তু ডি এফ ও ওঁকে কথা দিয়েছিলেন! অর্জুন কী করবে বুঝতে পারছিল না।

হয়তো, কিন্তু ওঁর অফিস আমাদের কোনও ইমফর্মেশন পাঠায়নি। উনি আমাদের বস। উনি কিছু বললে আমরা শুনতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের উনি কিছু বলেননি। প্রথমজন বললেন।

দ্বিতীয়জন প্রথমজনকে বললেন, একবার বড়বাবুকে ফোন করে দ্যাখো, ওঁকে কিছু বলেছেন কিনা। বললে অবশ্য বড়বাবু আমাদের জানাতেন।

প্রথমজন ফোনের নাম্বার ঘোরালেন। রিসিভার নামিয়ে বললেন, এখানে নাম্বার পাওয়া খুব মুশকিল। আপনারা ক’জন?

চারজন। একজন মহিলা।

দেখুন, দুটো রুম দিতে পারি। একটা এখনই খালি আছে। দ্বিতীয়টা পাওয়া যাবে সন্ধের পরে। পার্টি ঘরে তালা দিয়ে ফরেস্টে বেড়াতে গিয়েছে। সন্ধের আগে ফিরবে না। গতকাল পর্যন্ত ওর বুকিং ছিল। আজ খালি পড়ে থাকায় ওকে দিয়েছিলাম এই শর্তে যে, কারও বুকিং থাকলে ওকে ঘর ছেড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়জন বললেন।

তার মানে দুটো ঘর পাওয়া যেতে পারে, দ্বিতীয়টা সন্ধের পর।

হ্যাঁ। প্রথমজন বললেন, লাইন পেয়েছি, বড়বাবু, চারজনের এক পার্টি এসেছেন, বলছেন, ডি এফ ও সাহেব ওঁদের তিনটে রুম দিয়েছেন। আপনি কিছু জানেন? আরে! এ কথা বলবেন তো! রাখছি। রিসিভার রেখে প্রথমজন বললেন, আজ ওই দুটোতে ম্যানেজ করে নিন, কাল দেখা যাবে।

অর্জুন বলল, আমরা চারজন। মহিলাকে একটা ঘর ছেড়ে দেওয়ার পর এক ঘরে তিনজন কি থাকা সম্ভব? তা ছাড়া আপনি বলছেন, দুটোর একটা ঘর সন্ধের পর পাওয়া যাবে?

একটু কষ্ট করুন। এক্সট্রা বেড দিয়ে দেব সন্ধের পর। আমাদের কাছে। খবর এলে এই সমস্যা হত না। দ্বিতীয়জন বললেন।

কিন্তু টেলিফোনে যাঁর সঙ্গে কথা বললেন তাঁর কাছে তো ইনফর্মেশন ছিল!

তাঁর কাছে থাকলে হবে? ওটা তো এই অফিসে আসতে হবে। আসেনি। তা ছাড়া ডি এফ ও টেলিফোনে বলে দিলেন আর আপনারা কোনওরকম রসিদ হাতে না নিয়ে চলে এলেন? লিখিত অর্ডার ছাড়া আপনি আইনসম্মতভাবে ঘর ক্লেম করতে পারেন না।

মাথা নাড়ল অর্জুন। কথাটা ভুল নয়। তবে এ দেশে সরকারি বড়কর্তাদের মুখের কথায় যত কাজ হয়, লিখিত অর্ডারে তা হয় না বলে সে এতকাল জানত।

বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়ির কাছে দাঁড়াতে মেজর বললেন, উঃ! এত সময় লাগল!

অর্জুন অমল সোমের দিকে তাকিয়ে সমস্যার কথা জানাল। অমল সোম বললেন, অসম্ভব। মেজরের সঙ্গে একঘরে শুলে সারা রাত জেগে থাকতে হবে। পকেট থেকে সেলফোন বের করে নাম্বার টিপলেন তিনি। কানে চেপে বিরক্ত হলেন, যাঃ, বলছে, আউট অফ রিচ।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কোনও হোটেল নেই এখানে?

ইতিমধ্যে অফিস থেকে প্রথমজন বেরিয়ে এসেছিলেন। প্রশ্নটা তাঁকেই করল অর্জুন। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, না।

মেজর বললেন, রাজা এখানে ভাত খেয়েছিলেন অথচ হোটেল নেই?

প্রথমজন কথাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ঠিক করলেন?

অমল সেন বলেন, এভাবে থাকতে আমি অভ্যস্ত নই।

ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করলেন, আপনারা এক কাজ করুন। সোজা জয়ন্তীতে চলে যান। ওখানে সরকারি বাংলো আছে, গেস্ট হাউসও হয়েছে। কয়েকটা, সমস্যা হবে না।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কতদূর?

বেশি সময় লাগবে না। ভদ্রলোক পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলেন, মাঝপথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মাটির রাস্তা ধরে গেলে জৈন্তী নদীর ধারে একটা বাংলো আছে। বেসরকারি। বছরের বেশিরভাগ সময় খালি থাকে। ব্যবস্থা সুন্দর। তবে সেখানে না যাওয়াই ভাল।

মেজর সোজা হলেন, কেন?

একদম নির্জন জায়গা তো। জঙ্গলের মধ্যে! ভদ্রলোক চলে গেলেন।

মেজর বললেন, লেটস গো টু দ্যাট প্লেস।

অমল সোম বললেন, কী দরকার? জয়ন্তীর বাংলোটার খ্যাতি আছে। ওখানেই চলুন।

এতক্ষণ স্টেফি তাঁর ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মেজর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন জায়গায় থাকতে চাও! লোকালয়ে, না জঙ্গলের মধ্যে?

স্টেফি বললেন, অফকোর্স জঙ্গলের মধ্যে।

অর্জুন বলল, একবার বাংলোটাকে দেখা যেতে পারে। পছন্দ না হলে জয়ন্তীতে চলে যাব। এর জন্যে খুব বেশি হলে মিনিট চল্লিশেক নষ্ট হতে পারে।

গাড়ি ঘোরাল ভানুপ্রসাদ। অমল সোম বললেন, চাল, ডাল, তেল, ডিম, আলু যা যা দরকার তা এখান থেকে কিনে নাও, মোমবাতিও। ওখানে গিয়ে আমি নেই’ শুনতে রাজি নই।

আধঘণ্টা পরে ডিকিতে যাবতীয় জিনিস বোঝাই করে ওঁরা রওনা হলেন। এখানে খুব তাজা সবজি পাওয়া যায়, যা দেখে স্টেফি উচ্ছ্বসিত। মেজর গোটাচারেক মুরগি কিনে তাদের পায়ে দড়ি বেঁধে ডিকিতে রাখলেন।

এখন দুপুর শেষ। কিন্তু সন্ধে হতে ঢের দেরি। বিকেল আসব আসব করছে। সুন্দর পিচের রাস্তাটা সোজা জঙ্গলের বুক চিরে চলে গিয়েছে। একটু একটু করে ছায়া ঘন হচ্ছে। একবুক শ্বাস নিয়ে বাতাস ছাড়লেন মেজর, আঃ। কী নির্মল জায়গা। নো পলিউশন। বুক্টা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

খানিকটা যাওয়ার পর দুটো বনমুরগিকে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে যেতে দেখলেন ওঁরা। স্টেফি যখন জানলেন ওদের জীবনযাপনের সঙ্গে মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই, তখন তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ওদের ধরা যায় না?

অর্জুন মাথা নাড়ল, এই জঙ্গল সংরক্ষিত। কোনও প্রাণীকে ধরলে জেলে যেতে হবে।

স্টেফি গম্ভীর হলেন। তারপর বললেন, রাস্তা আর জঙ্গলের মধ্যে অনেক বুনো গুল্ম রয়েছে। ওদের মধ্যে বিশল্যকরণী দেখতে পেলে গাড়ি থামাতে বলো।

প্রায় কুড়ি মিনিটে ওরা ওপাশ থেকে একটা বাস আর তিনটে প্রাইভেট গাড়িকে এদিকে আসতে দেখল। জঙ্গল যত ঘন হচ্ছিল তত ঝিঁঝির ডাক বাড়ছিল। স্টেফি জিজ্ঞেস করলেন, এই জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী আছে?

সব প্রাণী হিংস্র নয়! পরিস্থিতি তাকে হিংস্র করে দেয়। যেমন হাতি। হাতির মতো নিরীহ প্রাণী খুব কম আছে। কিন্তু খিদে পেলে অথবা আক্রান্ত হচ্ছে ভাবলে, সে এমন হিংস্র হয়ে ওঠে যে, তার মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। জঙ্গলে ঢোকার আগে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বোর্ডে যা দেখলাম, তাতে জানলাম, এই জঙ্গলে হাতি, লেপার্ড, শূকর, বাইসন ছাড়াও গন্ডার মাঝেমধ্যে দেখা যায়। অমল সোম বললেন।

আঃ! ইন্টারেস্টিং।

ভানুপ্রসাদ, দাঁড়াও। বেশ জোরে বললেন অমল সোম।

অর্জুন তাঁর মুখের দিকে তাকাল। অমল সোম বললেন, তোমরা সামনের দিকে তাকিয়ে আছ বলে সম্ভবত সাইনবোর্ডটা মিস করেছ। গাড়িটা ব্যাক করো ভানুপ্রসাদ।

গাড়িটা প্রায় তিরিশগজ পিছিয়ে নিয়ে গেল ভানুপ্রসাদ। তখনই চোখে পড়ল একটা সরু রাস্তা ঢুকে গিয়েছে জঙ্গলের ভিতরে। রাস্তার মুখে গাছের গায়ে একটা কাঠের প্ল্যাকার্ড সাঁটা রয়েছে, যাতে লেখা, রেসটি।

মেজর বললেন, রেসটি! মানে কী?

অমল সোম বললেন, আমার অনুমান যিনি বাংলোটা বানিয়েছিলেন তিনি ‘রেস্ট হাউস’ না বলে আদর করে ‘রেসটি’ বলেছেন।

অর্জুন বলল, কিন্তু যেভাবে এবং যেখানে লিখে রাখা হয়েছে সেখানে কারও নজর তো চট করে যাবে না। তা হলে এভাবে লেখার মানে কী?

অমল সোম বললেন, হয়তো বাংলোটা যাঁর তিনি চান না বাইরের লোক ভিড় জমাক।

অর্জুন মেজরের দিকে তাকাল, তা হলে আমাদের যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

চলো, বাংলোটা চোখে দেখে আসি। লোকটাকে বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস বলে মনে হচ্ছে। নইলে এরকম নির্জন জঙ্গলে বাংলো তৈরি করতেন না। চলো। মেজর বললেন।

অতএব পিচের রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ঢুকল মাটির পথে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি মাঝে মাঝে থার্ড গিয়ারে ছাড়া গতি বাড়াতে পারছে না। অজস্র পাখির ডাক ছাড়া বাঁদরের বাঁদরামিও চোখে পড়ল। সেই স্বল্প আলোতেও ফোটো তুলে যাচ্ছিলেন স্টেফি। আচমকা ব্রেক চাপল ভানুপ্রসাদ। থরথরিয়ে থেমে গেল বড় গাড়িটা। মেজর জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?

ভানুপ্রসাদ ইশারায় সামনের দিকটা দেখাল। গাড়ি থেকে কুড়ি ফুট দূরে, রাস্তার ঠিক মাঝখানে লেজের উপর ভর করে সোজা যে দাঁড়িয়ে আছে, তার উচ্চতা অন্তত সাড়ে পাঁচ ফুট। শরীরটা দুলছে। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাড়িটাকে দেখছে।

বিউটিফুল! চাপা গলায় বলে স্টেফি ক্যামেরা তাক করলেন। তারপর উইন্ডস্ক্রিনের আড়াল থেকে ফোটো তুলে সন্তুষ্ট না হয়ে জানলার বাইরে ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে ফোটো তুলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ভালুপ্রসাদ দ্রুত তাঁকে টেনে নিয়ে এল ভিতরে। ঠিক তখনই সাপটি মুখ খুলে তীব্র গতিতে সামনে ছুঁড়ে ফেলল কিছু তরল পদার্থ। বলেরো গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের উপরও এসে পড়ল কয়েক ফোঁটা। একবার শান্ত না হয়ে পরপর দু’বার তরল পদার্থ ছুঁড়ে যেন একটু হতাশ হল সাপটা।

টেরিবল। ও কি বিষ ছুড়ছে? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।

সাপটা ধীরে ধীরে শরীর নীচে নামিয়ে নিল। তারপর সরসর করে পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল। অমল সোম স্টেফিকে বললেন, স্টেফি, তোমার উচিত ভানুপ্রসাদকে ধন্যবাদ দেওয়া। সাপের থুতু তোমার গায়ে পড়লে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারত!

স্টেফি ভানুপ্রসাদের হাতে আঙুল ছুঁইয়ে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ!

ভানুপ্রসাদ একগাল হেসে গাড়ি চালু করল।

মেজর বললেন, তা হলে বোঝা যাচ্ছে এই জঙ্গলে মারাত্মক সাপ আছে। ঠিক এরকম সাপ আমি দেখেছিলাম আমাজনের ধারে।

আমাজন? অর্জুন তাকাল।

ইয়েস। অ্যানাকোন্ডার খোঁজে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই ব্ল্যাক কোবরাদের জ্বালায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল। আমাদের উচিত ছিল কয়েক বোতল কার্বলিক অ্যাসিড নিয়ে আসা। থেমে গেলেন মেজর।

কাছাকাছি কোথাও শব্দ হচ্ছিল। গাছের ডাল ভাঙার শব্দ। ভানুপ্রসাদ নিচু গলায় বলল, হাতি!

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, এলিফ্যান্ট? কোথায়? আমি অবশ্য আফ্রিকার হাতির সঙ্গে মোকাবিলা করেছি। বিগ বিগ এলিফ্যান্ট। তাদের তুলনায় তো ইন্ডিয়ান হাতি গোরুর মতো। কী বলল অর্জুন?

অর্জুন বলল, ইন্ডিয়ান বলে অবহেলা করবেন না।

একটু পরেই একটা তারের দেওয়াল-ঘেরা জমির উপর দোতলা বাড়ি দেখা গেল জঙ্গলের মধ্যে। বাড়িটা কাঠের। বহুদিন রং না করায় একটু জীর্ণ ভাব এসে গিয়েছে। গেটের সামনে পৌঁছে হর্ন বাজাল ভানুপ্রসাদ।

তার আওয়াজে কিছু পাখি আশপাশের গাছ ছেড়ে প্রতিবাদ করতে করতে ডানা মেলল। অর্জুন গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে তাকাল। হাওয়া বইছে বলে জঙ্গলে অদ্ভুত শব্দ বাজছে। কাঠের বাড়িটা নিঝুম হয়ে রয়েছে। সে দেখল, স্টেফিও গাড়ি থেকে নেমেছেন। পাশে এসে স্টেফি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি সরকারি গেস্ট হাউস?

মাথা নাড়ল অর্জুন, না।

আমার মনে হচ্ছে ওখানে কেউ থাকে না।

গাড়ির ভিতর থেকে অমল সোম বললেন, একবার ভিতরে গিয়ে দেখে এসো।

গেট খুলে ভিতরে ঢুকল অর্জুন। বাংলোর লনে এককালে বাগান ছিল, এখন অযত্নে সেগুলো প্রায় বুনো ঝোঁপ হয়ে গিয়েছে। ওপাশে বেশ কিছু কলাগাছে কলা ঝুলছে। পুরুষ্ট, পেকে হলদে হয়ে আসা কলাগুলো কী করে বাঁদরদের খাদ্য হয়নি এখনও কে জানে? হঠাৎ অদ্ভুত শব্দ হতেই অর্জুন দাঁড়িয়ে গেল। শব্দটা সমস্ত লন জুড়ে বাজছে। শব্দের উৎস লক্ষ করতে করতে সে আবিষ্কার করল, প্রায় গোটা আটেক বড় গাছে টিন ঝুলছে। সেই টিনে ঘণ্টা বাঁধা আছে। প্রতিটি ঘণ্টা দড়ির সঙ্গে যুক্ত। সেই দড়ি ধরে টানলেই টিনে আওয়াজ হচ্ছে। যেমন বেজে উঠেছিল তেমন থেমে গেল শব্দ। লোকে কাকপক্ষী তাড়াবার জন্যে এরকম ঘণ্টা গাছে বেঁধে রাখে। ঘণ্টা যখন বাজল তখন নিশ্চয়ই কেউ দড়ি ধরে টেনেছে। যে টেনেছে সেই লোকটা কোথায়?

অর্জুন দুটো হাত মুখের দু’পাশে এনে চিৎকার করল, কেউ আছেন?

কোনও উত্তর এল না। চারদিকে নজর রেখে সে বাড়ির পিছন দিকে আসতেই দুটো ছোট ঘর দেখতে পেল। ঘরের দরজা ভিতর থেকে ভেজানো। মাথার উপর তাকিয়ে অর্জুন দেখতে পেল, ঘণ্টাবাঁধা দড়ি ওই কাঠের ঘরের সিলিং-এর ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। অর্থাৎ যে দড়িটা টেনেছে সে ওই ঘরেই রয়েছে।

অর্জুন দরজা ঠেলতেই কাঁক শব্দ উঠল। ঘরের ভিতরটা প্রায় অন্ধকার। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর লোকটাকে দেখতে পেল অর্জুন। একটা খাঁটিয়ার উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। দড়ির প্রান্ত খাঁটিয়ার পায়ার সঙ্গে বাঁধা।

শুনছেন? অর্জুন ডাকল।

লোকটি মুখ থেকে কম্বলের আড়াল সরাল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসল। অর্জুন দেখল লোকটির মুখে কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দড়ি পাকানো শরীর, গায়ের রং বেশ কালো। মাথার চুলে বোধহয় অনেকদিন কাঁচির ছোঁয়া লাগেনি।

ধীরে ধীরে লোকটি খাঁটিয়া থেকে নামতে চেষ্টা করল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি অসুস্থ?

হ্যাঁ বাবু, বুখার। রোজ দুপুরে আসে, রাতের আগে ছেড়ে যায়। লোকটি একটা লাঠি হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল, আপনি কে বাবু?

আমরা শুনেছিলাম এখানে থাকার জন্যে বাংলো আছে। তাই এসেছি।

মালিকের সঙ্গে কথা বলেছেন?

না। উনি কোথায় থাকেন?

শিলিগুড়িতে। মালিক না বললে দরজা খোলা নিষেধ আছে।

দেখুন, আমরা চারজন আছি। তার মধ্যে দু’জন এসেছেন বিদেশ থেকে। সন্ধেও হয়ে আসছে। এখন কোথায় গিয়ে থাকার জায়গা খুঁজব বলুন?

অর্জুন নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।

মালিক জানলে আমার চাকরি চলে যাবে। তা ছাড়া, তা ছাড়া এখানে না থাকাটা আপনাদের পক্ষে ভাল হবে বাবু! আপনারা জয়ন্তীতে চলে যান।

মালিকের সঙ্গে কথা বলা যায় না। ফোন নাম্বার আছে?

লোকটি ঘরের একটা তাক থেকে খাতা বের করে খুলে এগিয়ে ধরল। অর্জুন পড়ল। ইংরেজিতে লেখা, সুধাংশুশেখর দত্ত, হসপিটাল পাড়া, শিলিগুড়ি। পাশে মোবাইল নাম্বার লেখা। পকেট থেকে সেলফোন বের করে নাম্বারগুলো টিপল সে। প্রথমবারে কোনও শব্দ হল না। দ্বিতীয়বারে পি পি আওয়াজ হতে হতে শেষপর্যন্ত রিং শোনা গেল। একটু পরেই বেশ গম্ভীর গলায় একজন কথা বললেন, কে?

নমস্কার। সুধাংশুশেখর দত্ত বলছেন?

বলছি।

আমার নাম অর্জুন। জলপাইগুড়িতে থাকি। আজ আমরা চারজন বিশেষ কাজে রাজাভাতখাওয়ায় এসেছিলাম। আমাদের দু’জন আমেরিকা থেকে এসেছেন। কিন্তু ওখানে জায়গা না পেয়ে আপনার বাংলোয় পৌঁছেছি। মুশকিল হল, বাংলোর কেয়ারটেকার আপনার অনুমতি ছাড়া জায়গা দিতে পারবে না। আপনি যদি অনুমতি দেন তাই এই ফোন করছি।

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। অর্জুন ভাবল লাইন কেটে গিয়েছে। সে বলল, হ্যালো!

আপনি কী করেন? ভদ্রলোক সরাসরি প্রশ্ন করলেন।

আমার পেশা সত্যসন্ধান করা।

সেটা কী জিনিস? ডিটেকটিভ?

আমি নিজেকে ডিটেকটিভ বলতে রাজি নই।

আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে ফোন করছি। লাইন কেটে দিলেন ভদ্রলোক।

অর্জুন দেখল, লোকটি ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, মালিক কী বললেন বাবু?

এখনও কিছু বলেননি। তবে বলবেন বোধহয়। অর্জুন অমল সোমদের ব্যাপারটা জানাতে এগোল।

লোকটি আসছিল পিছন পিছন, আমার কথা শুনুন। আপনারা এখনই চলে যান জয়ন্তীতে। ওখানে ঘর ঠিক পেয়ে যাবেন।

তোমার মালিক আপত্তি করলে তাই যেতে হবে।

অর্জুন দেখল, ওঁরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে লনের ভিতরে চলে এসেছেন। মেজর মাথার উপর হাত তুলে চিৎকার করলেন, মাই গড! কত পাখি! এখানে পাখিদের পাড়া নিশ্চয়ই আছে। এত পাখি যখন, তখন জল থাকতে বাধ্য।

অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, চলে যেতে হবে?

মালিককে ফোন করেছিলাম। তিনি পাঁচ মিনিটের মধ্যে জানাবেন বলেছেন।

স্টেফি চারপাশে তাকাচ্ছিলেন। অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এখানে কোনও বিশল্যকরণী দেখতে পেয়েছ?

অর্জুন হাসল, আগে থাকার জায়গাটার সমাধান হোক, তারপর তোমার জন্যে সমস্ত জঙ্গলে ওই পাতার খোঁজ করব। চিন্তা কোরো না।

অমল সোম লোকটির দিকে তাকালেন, তুমি কি কেয়ারটেকার?

হ্যাঁ বাবু। আমি এখানে থাকি। মালিকের নাম সুধাংশুশেখর দত্ত। শিলিগুড়িতে থাকেন।

মালিক কি প্রায়ই আসেন?

না। চার মাস আসেননি। এসে আমাকে কয়েক মাসের মাইনে দিয়ে যান। তখনই আলু, পিঁয়াজ, চাল, তেল কিনে রাখি। বাবু, আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে এখানে পড়ে আছি। কিন্তু, ওই বাবুকেও বলেছি,

আপনাদেরও বলি, এখানে না থেকে জয়ন্তীতে চলে যান।

কেন বলছ এ কথা?

লোকটি মুখ নিচু করল, কোনও জবাব দিল না। অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী নাম?

লছমন।

এমন সময় অর্জুনের ফোন বেজে উঠল। সে সেলফোন অন করতেই ওপাশ থেকে গলা ভেসে এল, দেখুন ভাই, আমি অজানা লোককে ওই বাংলোয় থাকতে দিই না। আপনার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানলাম, জলপাইগুড়িতে বেশ পরিচিত আপনি। কিন্তু আপনিই যে সেই অর্জুন তার প্রমাণ কী?

কী প্রমাণ চান?

সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়ালেন অমল সোম, আমাকে দাও।

সেলফোন হাতে নিয়ে অমল সোম বললেন, সুধাংশু, আমি অমল সোম বলছি। পঁচিশ বছর আগে তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।

ওপাশের কথা শুনে অমল সোম হাসলেন, আরে ভাই, ডি এফ ও-র কথা যে নীচের তলার মানুষের কাছে ঠিকঠাক পৌঁছোয় না, তা জানতাম না। তা অর্জুন সম্পর্কে কী প্রমাণ চাইছ?

ওপাশ থেকে কিছু বলার পর অমল সোম লছমনকে ডাকলেন, তোমার মালিক কথা বলবেন। ফোনটা নাও।

লছমন সেলফোন কানে চেপে, জি সাব, জি সাব, বলে আবার ফেরত দিল অমল সোমকে। সুধাংশুবাবুর কথা শুনে বললেন, ও ব্যাপারে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমরা সব কিনে এনেছি। শুধু তোমার লোক যদি বেঁধে দেয়। না পারলে উনুন আর বাসনকোসন দিলেই চলবে। ঠিক আছে, রাখছি।

কোমর থেকে চাবি বের করে লছমন ধীরে ধীরে দোতলায় উঠে ঘরের দরজা খুলতে লাগল। তিনটে শোওয়ার ঘর, একটা বসার। প্রতিটি ঘরের সঙ্গে বাথরুম রয়েছে। অর্জুন দেখে নিয়ে বলল, বাথরুমের জল কি নীচ থেকে আনতে হয়?

না বাবু। লছমন মাথা নাড়ল, পাম্প আছে। চালু করে দিচ্ছি। তারপর বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল, বাবু, আমার শরীর এখনও ঠিক হয়নি। যা পারি তা রান্না করে দেব। আপনারা আটটার মধ্যে খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়বেন।

রান্নাঘর কোথায়?

ওই ওপাশে। গ্যাস আছে। থালা, কড়াই ধোওয়া আছে।

অর্জুন বারান্দায় চলে এসে চেঁচিয়ে ডাকল, ভানুপ্রসাদ!

গাড়ি থেকে নেমে এল ভানুপ্রসাদ, বলুন!

গাড়ি ভিতরে ঢোকাও। সব জিনিসপত্র উপরে নিয়ে এসো। আচ্ছা, তুমি রাঁধতে জানো?

ওই, একরকম পারি।

ব্যস। তা হলেই হবে। লেগে পড়ো।

এই সময় মেজরের উত্তেজিত চিৎকার কানে এল। অর্জুন দ্বিতীয় ঘরটিতে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল, দু’হাত মাথার উপর তুলে ভারী শরীর নিয়েও লাফাচ্ছেন মেজর, হেভেন, হেভেন যদি কোথাও থাকে তা হলে তা এখানেই।

কোথায়? অর্জুন জিজ্ঞেস করার আগেই পিছন থেকে এসে অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন। মেজর খোলা জানলার বাইরে আঙুল নির্দেশ করে বললেন, লুক।

ওঁরা জানলার বাইরে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। নীচে জঙ্গলের আড়াল থাকায় অর্জুন টের পায়নি। এখন দোতলার জানলা থেকে নদীটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চওড়ায় প্রায় একশো গজে জল বয়ে যাচ্ছে তরতরিয়ে। তারপর নুড়ি আর নুড়ি। শেষ হয়েছে একটা ছোট পাহাড়ের নীচে। বর্ষায় পুরোটাই যে ঢেকে যায় তাতে সন্দেহ নেই। এখন জল নিশ্চয়ই কম, হাঁটুর সামান্য উপরে গভীরতা। সেই জলে শেষ সূর্যের রোদ পড়ায় মায়াবী বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে।

অর্জুন বলল, নিশ্চয়ই এই নদীর নাম জৈন্তী।

জয়ন্তী? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।

স্থানীয় মানুষ বলে জৈন্তী। জয়ন্তীতে এই নদী অনেক চওড়া।

লেট্‌স গো। চলো, নদীর কাছে যাই। মেজর উৎসাহী।

অর্জুন বলল, রাত নামছে। এখন না বের হওয়াই ভাল। কাল সকালে বরং যাওয়া যেতে পারে। আর কিছুনা হোক, যে সাপটাকে আসার সময় দেখলেন, তার আত্মীয়দের মুখোমুখি এখন হওয়া কি ঠিক হবে?

জানলাটা তা হলে বন্ধ করে দিই?

নীচে পাম্প চালু হল। তার আওয়াজ খুবই কর্কশ। ভানুপ্রসাদ প্রত্যেকের লাগেজ উপরে রেখে গেল। একটু পরেই সে কিচেনের দায়িত্ব নিয়ে নিল। অর্জুন চারটে ঘরে মোমবাতি জ্বেলে দিল।

ঠিক হল, একেবারে বাঁ দিকের শেষ ঘরে অমল সোম এবং অর্জুন রাত্রে থাকবেন। তাঁদের পাশের ঘরটি, স্টেফির জন্যে। স্টেফির পাশের ঘরটি ড্রয়িংরুম। সেখানে রাত্রে থাকবে ভানুপ্রসাদ। ডান দিকের ঘরটিতে মেজর থাকবেন। তাঁর নাসিকাগর্জনের কারণেই একা থাকার ব্যবস্থা।

পোশাক পালটে বসার ঘরে এসে চারজন বসলেন। স্টেফি জিজ্ঞেস করলেন, এখানে হিংস্র জন্তুরা উঠে আসতে পারে?

অমল সোম বললেন, সাধারণত ওরা উপরে ওঠে না। গেট বন্ধ থাকলে ভিতরে ঢোকাও তো সম্ভব নয়। অবশ্য সাপ কী করবে তা বলতে পারছি না।

ওই লছমনকে জিজ্ঞেস করতে হবে কার্বলিক অ্যাসিড আছে কি না! আচ্ছা, লোকটি যে সেই চলে গেল, আর উপরে এল না তো! মনে হচ্ছে, আমরা আসায় ও খুশি নয়।

স্টেফি দ্রুত মাথা নাড়লেন, ঈশ্বর যেন এরকম ঘটনা না ঘটতে দেন।

অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, স্টেফি, তুমি কীভাবে রিসার্চটা শুরু করতে চাইছ?

স্টেফি সোজা হলেন, প্রথমত, আমাকে জানতে হবে ওই গাছের পাতার রসে সত্যি কোনও কাজ হয় কি না। যদি হয়, স্থানীয় মানুষরা নিশ্চয়ই প্রয়োজনে ব্যবহার করে। আপনাদের দেখানো পাতা থেকে আন্দাজ করতে পারছি, ওই একই গাছের পাতা নানান রকমের হয়। হয়তো সবচেয়ে ঘন রস যা থেকে বের হয় তার কার্যকর শক্তি অনেক বেশি হবে। তা হলে সেই বিশেষ গাছ কোন মাটিতে জন্মায়, কী আবহাওয়া পছন্দ করে, তা জানতে হবে। ওই রসের স্যাম্পেল ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখব, কী কী উপাদান ওর মধ্যে আছে। সেসব উপাদানগুলো জানতে পারলে আমার পক্ষে আরও এগোনো সম্ভব হবে।

অমল সোম বললেন, ধরো, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে তুমি জানতে পারলে, ওর মধ্যে এমন উপাদান আছে যা ডেভেলপ করলে চিকিৎসাশাস্ত্রে বিপ্লব ঘটতে পারে। তুমি যদি তার পেটেন্ট নিয়ে নাও, তা হলে ওষুধ কোম্পানিগুলো তোমাকে কোটি কোটি ডলার অফার করবে। তাই না?

স্টেফি হেসে উঠলেন, ওসব নিয়ে আমি ভাবছি না। আমার প্রথম কাজ ওই গাছের ঠিকঠাক পাতাগুলো খুঁজে বের করা।

তোমার ইউনিভার্সিটি এই রিসার্চের ব্যাপারটাকে অ্যাপ্রুভ করেছে? মাথা নাড়লেন স্টেফি, নো। এই ধরনের প্রপোজাল তখনই অ্যাপ্রুভাল পায়, যখন উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে গবেষণা করার জন্যে অ্যাপ্লিকেশন ফাইল করা হয়।

মেজর আচমকা বলে উঠলেন, ওটা কী পাখির ডাক?

বাইরে তখন অন্ধকার নেমে গিয়েছে। মাঝে মাঝেই ঘরে-ফেরা পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছিল। এইমাত্র যে ডাকটা কানে এল সেটা বেশ কর্কশ। মাথা নাড়লেন অমল সোম, পরিচিত পাখি নয়। এইরকম জঙ্গলে কতরকমের পাখি আছে তার সার্ভে ঠিকঠাক হয়েছে কি না জানি না।

অর্জুন উঠে দাঁড়াল, দেখি, ভানুপ্ৰসাদ কী করছে?

মেজর তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে নিজেও উঠলেন, একটু দেখে আসি!

কী? অমল সোম তাকালেন।

ওই লইমন লোকটিকে আমার খুব সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে। যে অত অসুস্থ, লাঠি হাতে হাঁটছে, সে দিব্যি সিঁড়ি ভেঙে উপরে এসে দরজা খুলে দিল! আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন, আমরা যাতে এখানে না থাকি তার চেষ্টা করছিল। সেই যে পাম্প চালাতে নীচে গিয়েছে আর পাত্তা নেই। মেজরের কথা শেষ হওয়ামাত্র পাম্পের শব্দ থেমে গেল। মেজর দরজার দিকে এগোলেন।

অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, টর্চ আছে? ওটা সঙ্গে নিয়ে নীচে যান।

মেজর হাসলেন, ডুয়ার্সে আসছি বলে ওসব ব্যাপারে তৈরি হয়ে এসেছি। আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরে ওটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।

মেজর বেরিয়ে যেতে অমল সোম স্টেফির সঙ্গে গল্প করছিলেন। এই সময় ভানুপ্রসাদ তিনকাপ কফি নিয়ে এল।

অমল সোম হাসলেন, বাঃ, গুড। বিস্কুট দিয়ে তো। কিন্তু মেজর নীচে যাবেন বললেন। ওঁর কফিটা নিয়ে যাও।