মিস্টিরিয়াস ইভেন্টস – আগাথা ক্রিস্টি
অন্ধকারে কণ্ঠস্বর
আলোবিহীন একটা অন্ধকার রাত। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে আমাদের জাহাজ ভাসছে। জাহাজের বর্তমান অবস্থা বলা যাচ্ছে না কারণ হালকা কুয়াশার আড়ালে সূর্যদেব লুকিয়ে আছেন। এই কুয়াশা কখনও মাস্তুল ঘিরে, কখনও নিচে নেমে এসে বিস্তৃত সমুদ্রকে আড়াল করছে। বাতাস নেই, তাই হাতলটা স্থির রেখে ডেকের উপর আমি একা ছিলাম, আমাদের নাবিক দল তিনজন–দুজন পুরুষ, একজন কিশোর। তারা তাদের কেবিনে ঘুমোচ্ছিল। আর উইল–আমার বন্ধু এবং এই জলযানের ক্যাপ্টেন, জাহাজের বাঁ দিকে পিছনের অংশে ছোট কেবিনের বাঙ্কে সে শুয়ে আছে।
হঠাৎ চারিদিকের অন্ধকার ভেদ করে একটা চিৎকার ভেসে এল–জাহাজে কেউ আছেন? আমি ভয় পেলাম। আবার কথাটি ভেসে এল। সে বলল যে, সে একজন বৃদ্ধা মানুষ। সে নির্ভয়ের আশ্বাস দিল।
কথার মাঝখানের ছোট্ট বিরতিটা কানে বাজালো, কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ অনেকদিন পর বুঝতে পেরেছিলাম। আমি জানতে চাইলাম যে তাহলে জাহাজের কাছে কেন আসছেন না, সে বলল যে, ভালো হবে। তারপর সব চুপ হয়ে গেল। একমুহূর্ত কান পেতে শুনতে পাওয়া গেল না। আপনি কোথায় জিজ্ঞাসা করতে কোনো উত্তর না পেয়ে সন্দেহ জেগে উঠল তার মনে। একই সঙ্গে পা দিয়ে আঘাত করে নিচের কেবিনে শোওয়া উইলকে জাগাতে চেষ্টা করলাম। তারপর ডেকের কিনারায় ফিরে এলাম। হলদে আলোয় ছড়িয়ে পড়লো বিশালতম নিঃস্তব্ধতা। হঠাৎ ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর অস্ফুট চিৎকার কানে এল, কেউ যেন অন্ধকার সমুদ্রে আচমকা বৈঠা ডুবিয়েছে। যখন আলোর প্রথম ঝলক ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন জলের উপর কিছু ছিল যা এখন নেই। আমি বললাম যে এটা কোন্ ধরনের ঠাট্টা। রাতের অন্ধকারে নৌকার বৈঠা বেয়ে এগিয়ে যাবার অস্পষ্ট শব্দ। শুধু ডেকের পাটাতনের দরজার দিক থেকে কানে এলো উইলের কণ্ঠস্বর যে জর্জ কি হয়েছে, আমি উইলকে ডাকলাম। উইলকে আমি পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম, উইল অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করল এবং বললেন যে নৌকায় কে আছেন। দুবার কথার পর উত্তর এলো।
সে বলল যে, আগে আলোটা সরিয়ে নিন। উইলের নির্দেশে আমি আলোটা সরিয়ে নিলাম। লোকটিকে কাছে আসতে বলল, উত্তরে বৈঠার শব্দ হয়েই চলল। তারপর মোটামুটিভাবে ছ বাঁও দূরে এসে সেই শব্দ আবার থেমে গেলো। উইল বলল যে জাহাজের পাশে আসুন। এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। লোকটি শর্ত দিলেন যে আলো ফেলতে না পারার। আমি তাকে বললাম যে এর কারণ কি? উইল আমার কাঁধে হাত রাখলো, এক মিনিট থেমে চাপাস্বরে উইল বলল,… বলে রেলিং-এর উপর ঝুঁকে পড়লো।
উইল বলল যে, এটা ভারী অদ্ভুত ব্যাপার। আপনি হঠাৎ কোথা থেকে এলেন। আপনার মনের মধ্যে কি আছে সেটা বোঝা যাবে না। আপনি বললেন আপনি একা, সেটা না দেখলে। বিশ্বাসযোগ্য হবে না। আলোটায় আপনার আপত্তি কি?
ওর কথা শেষ হতেই আবার বৈঠার ছপছপ শুনতে পেলাম তারপর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো এখন অনেক দূর থেকে এবং সে স্বর অত্যন্ত করুণ ও চূড়ান্ত হতাশায় ভরা।
সে বলল যে, সে ভীষণ ক্ষুধার্ত এবং সে ভীষণ দুঃখিত তাদের বিরক্ত করার জন্য।
উইল তাকে বললেন যে, তাকে সে তাড়িয়ে দিতে চায়নি। যখন তিনি চাইছেন তা, তাহলে আমরা আলো লুকিয়ে রাখছি।
উইল বলল, ব্যাপারটা অদ্ভুত তবে মনে হয় ভয় পাওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। আমি বললাম তা নেই। মনে হয়, এই বেচারা লোকটা বোধহয় জাহাজডুবি হয়ে আশেপাশে কোথায় উঠেছে এবং পাগল হয়ে গেছে।
উইলের কথামতো আলোটা লুকিয়ে রাখলাম। তারপর রেলিং-এ ঝুঁকে পড়ে কান পাতলাম। আলোটা রেখে আমি ফিরে এলাম উইলের পাশে। বারো গজ দূরে এসে বৈঠার শব্দ থামল।
লোকটিকে কাছে আসার জন্য অনুরোধ করা হলো। সে বলল যে, তাদের কাছে যে সে খাবার চাইছে তার দাম দেবার ক্ষমতা তার নেই। উইল বলল, যত খুশি খাবার আপনি নিয়ে যান। সে বলল যে, ভগবান আপনাদের এর পুরস্কার দেবেন। উইল বললেন যে, আপনি যার কথা বললেন তিনি কে? সে বলল যে, সে তার প্রেমিকাকে একা দ্বীপে রেখে এসেছে। সে বলল যে, কোন দ্বীপে তার মনে নেই। উইল বলল যে, তার জন্য একটা নৌকা পাঠানো যায় না। সে বলল যে, তার কর্ম চোখে দেখা যায় না, সে অত্যন্ত দায়ে পড়ে এসেছে। তার কারণ সে চোখে দেখতে পাচ্ছে না।
রেলিং-এর কাছে উইল ফিরে এলো। দুহাতই খাবারে পরিপূর্ণ। সে জাহাজের পাশে লোকটিকে আসতে বলল। তার বলার সুরে এক সনির্বন্ধ আকুতি খুঁজে পেলাম, তখন হঠাৎ বিদ্যুতের মতো খেয়াল হলো বেচারী বৃদ্ধ মানুষটা এই ঘন অন্ধকারে যে জিনিষগুলোর অভাবে কষ্ট পাচ্ছে সেগুলো উইলের হাতে ধরা রয়েছে। আর তা হলেও কোন ভয়ে আমাদের জাহাজের পাশে সেগুলো অদম্য ইচ্ছাকে টুটি টিপে সে সংযত করেছে। সেই ব্যক্তি পাগল নয় বরং সে অসহ্য আতঙ্কের মুখোমুখি হয়েছে।
আমি মনে করলাম উইল আবেগে ভাসছে। উইল বলল যে, একটা বাক্স নিয়ে জলে ভাসিয়ে দিতে যাতে সে লোকটার কাছে পৌঁছে যায়। আমি খানিকপর অস্পষ্ট চিৎকার শুনতে পেলাম এবং বুঝলাম বাক্সটা যথাস্থানে পৌঁছেছে, লোকটি আমাদের শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিল, উইল ও আমার মনে হলো লোকটি আবার ফিরে আসবেন। উইল বলল যে, যতদিন মাছ ধরছি এরকম অদ্ভুত ঘটনা আমার কাছে এই প্রথম। সময় বয়ে চলল। আমাদের চোখে একফোঁটা ঘুমের আমেজ নেই।
প্রায় চার ঘণ্টা পর আবার বৈঠার শব্দ শোনা গেল, বোঝা গেল তিনি ফিরে আসছেন। বৈঠায় শব্দ শুনলাম। সেই লোকটি বলল যে, সে আমাদের ছেড়ে চলে যাবার জন্য দুঃখিত। তার প্রেমিকার জন্য তার খুব তাড়া ছিল। সে আমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সে বলে চলল, আমি আর আমার প্রিয়তমা আপনাদের উপকারের কথা নিয়ে আলোচনা করেছি। ভেবেছি– আমাদের হতভাগ্যের কথা। আমরা দুজনে আমাদের জীবনের কথা কারোকে বলতে চাইনি তবু আপনাদের বলছিলাম। এ কাহিনীর শুরু সেদিন যেদিন অ্যালবাট্রস-এর সমুদ্রসমাধি হয়। যে জাহাজটা নিউক্যাসল থেকে সান ফ্রান্সিসকো রওনা হয়ে যায়।
সে বলল যে, উত্তর দিকে থেকে কয়েক ডিগ্রী দূরে জাহাজটা এক ঝড়ের শিকার হয় এবং তার মাস্তুল ভেঙ্গে পড়ে। যখন ভোর হলো, তখন দেখা গেল জাহাজ ফুটো হয়ে গেছে। ফুটো দিয়ে তোড়ে জল ঢুকছে। চারিদিক ক্ৰমে থমথমে হয়ে এলো। নাবিকরা তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নৌকা ভাসান। ধ্বংসস্তূপে আমাকে ও আমার সঙ্গিনীকে ফেলে গেল। আমরা তখন জিনিষপত্র গোছগাছ করছিলাম। অন্ধ আতঙ্ক তাদের নির্দয় করে তোলে। আমরা ডেকের উপর দেখলাম যে দিগন্ত রেখা যেন কালো ফুটকির মতো লাগছে। আমরা অনেক কষ্টে একটা ভেলা তৈরি করলাম। ভেলায় প্রয়োজনীয় কয়েকটি জিনিষ নিলাম এবং জাহাজের ভাড়ার থেকে বিস্কুট সঙ্গে পানীয় জল এবং ভেলায় চড়ে নিরুদ্দেশে রওনা দিলাম। আমাদের জাহাজ অনেকটা তলিয়ে গেছে।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে আমরা খেয়াল করলাম আমরা স্রোতের মুখে পড়েছি। সেই স্রোত আমাদের জাহাজ থেকে কোণাকুণি করে নিয়ে চলেছে। প্রায় তিনঘণ্টা পর (হাতঘড়ি দেখে বুঝলাম) জাহাজ ডুবে গেলেও মাস্তুল সমুদ্রের উপরে আছে। আরো কয়েক ঘণ্টা পর তাও ডুবে যায় এবং সন্ধ্যা হয়, কুয়াশা ঘিরে ধরে। এইভাবেই রাত কাটে। পরদিন ভোরে কুয়াশা সরেনি তবে আবহাওয়া অনেক ঠান্ডা। অদ্ভুত ধোঁয়াশার মধ্যে আমরা চারদিন ধরে বেড়ালাম, অবশেষে চতুর্থ দিন সধ্যায় দূর থেকে ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস কানে আসে। ক্রমে সেই শব্দ তীব্র হতে শুরু করে এবং মাঝখানের দু-পাশ থেকে সেই শব্দ আরো কাছে আসে। জলের ওপর থেকে ভেসে উঠলো ভেলা তারপর আমরা শান্ত জলে এসে পড়লাম। ঢেউ-এর গুঞ্জন আমাদের পেছনে এল।
ভোর যখন হলো তখন আমরা সমুদ্রে ভাসছি আবিষ্কার করলাম। আমরা কুয়াশা ভেদ করে একটা প্রকাণ্ড জাহাজের ইস্পাত শরীর দেখতে পেলাম। আমরা ভেবেছিলাম এই কালো দিন শেষ হলো। কিন্তু তখনও দুর্দশার অনেক বাকি ছিল।
ভেলাটা জাহাজের কাছে পৌঁছাতে আমরা জাহাজের পাশে একটা দড়ি ঝুলতে দেখলাম, ওটা বেয়ে উঠলাম। সেই জাহাজে ছিল কঙ্কালের সমারোহ। ওপরে পৌঁছে রেলিং ডিঙিয়ে জাহাজের ডেকে নামলাম। আমি সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি, আমার উদ্দেশ্য ছিল জাহাজের লোকেদের ডেকে সাহায্য চাওয়া। অনেক চিৎকারেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন জাহাজের পেছনে উঁচু ডেকের কাছে গেলাম। নিচের দরজাটা খুলে উঁকি মারতে একটা বীভৎস পচা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম ভিতরে সকলে মৃত। নিজেকে হঠাৎ খুব একা বলে মনে হলো।
আমি আমার ভেলার কাছে এলাম যেখানে আমার বাগদত্তা চুপ করে বসে আছে। আমাকে ডেকে সে বলল যে, জাহাজে কেউ আছে কিনা, আমি বললাম যে আমার মনে হয় জাহাজে কেউ নেই। যদি ও একটু অপেক্ষা করে তাহলে মই খুঁজতে পারি যাতে ও উপরে উঠে আসতে পারে। একটু পরে ডেকের অন্য প্রান্ত থেকে একটা দড়ির মই খুঁজে পেলাম। ওটা নিচে ঝুলিয়ে দিলাম। মিনিটখানেকের মধ্যে ও আমার পাশে উঠে এলো।
আমরা কেবিন ও অন্যান্য ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু প্রাণের স্পন্দন পাওয়া গেল না। কেবিনের সব জায়গায় ফাংগাসের ঝাড় দেখা গেল। কিন্তু ও বলল এসব পরিষ্কার করা যাবে।
তারপর আমরা জাহাজের পেছনে এলাম। দুজনে মিলে কেবিন ঘসে মেজে পরিষ্কার করে তুললাম। তারপর জাহাজে আমরা খাবার খুঁজলাম এবং তা পেলাম। এবং পানীয় জলের পাম্পটা সারিয়ে তুললাম যাতে পানীয় জলের সমস্যা মিটল তবে স্বাদটা মধুর ছিল না। বেশ কদিন আমরা সেখানে ছিলাম কিন্তু আমরা ভাবতে পারিনি ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি অভিশাপ লুকিয়ে আছে। আমরা কেবিনের দেওয়ালে ও মেঝেতে, জায়গায় জায়গায় গজিয়ে ওঠা ফাংগাসের আগাছাগুলো পরিষ্কার করে ফেলেছিলাম কিন্তু আশ্চর্য যে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টায় সেগুলো আগের অবস্থায় ফিরে আসছে। এটা আমাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করলো। আমরা কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে ওগুলো নির্মূল করে তুললাম। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে তা আগের সঙ্গে অন্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়লো। যেন আমরা হাত দেবার ফলেই ওগুলো থেকে অসংখ্য বীজাণু চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সাতদিন পর দেখা গেল ওর বালিশ, মুখের কাছে জড়িয়ে আছে ফাংগাস। সে আমার কাছে এটা দেখালে আমি ঠিক করলাম যে ঐ মুহূর্তে জাহাজ ছেড়ে চলে যাব যাতে জলের চেয়ে ডাঙায় ভালো করে বাঁচতে পারি।
নিজেদের সামান্য জিনিষ গুছিয়ে নিলাম। আমার সঙ্গিনীর শালের মধ্যে থাকা ফাংগাসগুলো নিজের হাতে সরিয়ে দিলাম।
ভেলাটা জাহাজের গায়ে ভাসছিল, ওটা চালাতে অসুবিধে হতে পারে বলে জাহাজের ডেক থেকে একটা ছোট নৌকো জলে ভাসানো হলো। নৌকা করে আমরা ডাঙার দিকে রওনা হলাম। ডাঙার কাছাকাছি আসতে দেখলাম ফাংগাস দূষিত রাজত্ব অবাধে বিস্তার করেছে, কোনো কোনো জায়গায় ওগুলো বীভৎস অকল্পনীয় টিবির মতো হয়ে আছে। স্থির গাছের পাতা বাতাসে যেমন কেঁপে ওঠে, সেগুলো থরথর করে কাঁপছে। এখানে ওখানে সেগুলোর চেহারা মোটা আঙুলের মতো, কোথাও কোথাও সমতলে মসৃণভাবে বিশ্বাসঘাতী রূপ নিয়ে ওরা ছড়িয়ে পড়েছে, দু-এক জায়গায় ফাংগাসগুলো বেড়ে উঠেছে ও জঘন্য ভাবে কেঁপে উঠছে।
আমরা তীর ধরে খানিকটা যাবার পরে ফাংগাসের আক্রমণ থেকে যে মুক্ত নই সে ভুল ভাঙে। আমরা খানিকটা যাবার পর যে ছোট জায়গাটা দেখলাম সেটা সূক্ষ্ম সাদা বালিতে ঢাকা। কিন্তু সেটা সঠিক বলি কিনা তা বোঝা যায় না। তবে এখানে ফাংগাস ছিল না। এই বালি জাতীয় জিনষটা যেদিক দিয়ে চলেছে তার দুপাশে ভয়ঙ্কর ফাংগাসের ঝাড়। ওই গোটা দ্বীপে জঘন্য বীভৎস, আগাছার জঙ্গল, রক্তবীজের রাজত্বের বুক চিরে সাদা সাদা পথ ছিল। এই জায়গাতে আমরা সব জিনিষপত্র নামালাম। তারপর কতগুলো প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে পাল খুললাম ও ছোট তাঁবু তৈরি করলাম। সেগুলোর চেহারা ভালো না হলেও উদ্দেশ্য সিদ্ধি হলো। সেখানে আমার চার সপ্তাহ নির্বিঘ্নে কাটাই।
প্রথমে আমার সঙ্গিনীর ডান হাতের মধ্যে একটা ধূসর রঙের মাংসপিণ্ড দেখা যায়। আমি আতঙ্কিত হয়ে কার্বলিক অ্যাসিড ও জল দিয়ে সেটা পরিষ্কার করলাম। সকালে হাত দেখে বেশ ভয় পেলাম কারণ আবার সেখানে আঁচিলের মতো দেখতে পেলাম। হঠাৎ গালের মাঝখানে সোনার মতো ছিল। কানের কাছে, চুলের নিচে স্পর্শ করে ওটা কি আমি অনুধাবন করলাম। আমরা দুজনে আমাদের গালের ওই ক্ষতটা যে কি বুঝতে পারছিলাম। আমরা সেখান থেকে পালাব মনে করেছিলাম। ভাবলাম জিনিষপত্র পানীয় জল নিয়ে আমরা সমুদ্রে পাড়ি দেব। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম আমরা সংক্রমিত হয়ে পড়েছি। সুতরাং আমরা দ্বীপেই থাকব স্থির করলাম।
একমাস থেকে তিন মাস কেটে গেল–এই ফাংগাসের বাড়ি আমাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যে নিঃসীম আতঙ্কের সঙ্গে আমাদের স্নায়ুর লড়াই চলেছে তাতে ফাংগাসের অগ্রগতিকে আর যাইহোক বীর বলে মনে হয় না।
কখন কখন প্রয়োজনীয় জিনিষের খোঁজে গেছি সেই জাহাজে। সেখানে দেখি ফাংগা একঘেয়ে ভাবে বেড়ে চলেছে। ডেকের একটা গাছ প্রায় আমাদের মাথা ছাড়িয়ে গেছে। ছেড়ে যাবার আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছি কারণ আমরা জানি এই অসুখ নিয়ে সুস্থ সমাজে মধ্যে থাকা সম্ভব নয়।
আমরা বুঝতে পারলাম খাবারের রেশন ফুরিয়ে আসছে। তাই খাবার কম করে খরচা করতে হবে। তখন যখন আমরা খাবারের সঞ্চয় শুরু করলাম তখন দেখলাম যে যে রুটির টিনগুলো আমরা ভর্তি ভেবেছিলাম সেগুলো খালি। এছাড়া টুকিটাকি মাংসের টিন, তরিতরকারী ভরসা করার মতো নেই।
পরিস্থিতি জানার পর আমরা সমুদ্রে মাছ ধরলাম। এই ঘটনায় যখন ক্রমশঃ মরিয়া হয়ে উঠেছি, তখন মনে হলো সমুদ্রে মাছ ধরার কথা। মাছ পেলেও আমাদের ক্ষিদের কাছে তা কিছু বোধ হলো না। চার মাস এমনি করে কেটে গেল।
তার পর আমরা ভয়ঙ্কর একটা আবিষ্কার করলাম যেটা ছিল বিস্কুট। কিন্তু ওটা ফাংগাস ছিল। ওটা হাতে নিতে ওর মুখে নেমে এলো মৃতমুখের পাণ্ডুর ছায়া। ওর মুখ গোলাপের মতো লাল হলো। ওর কাছ থেকে সমস্ত ঘটনাটা শুনলাম, যে গতকাল ও নাকি ফাংগাস খেয়ে নিয়েছে এবং ওর ভালো লেগেছে। ওকে আমি বারণ করলাম যে যত খিদেই পাক না কেন ও যেন ফাংগাস স্পর্শ না করে। প্রতিজ্ঞার শেষে সে বললো ওই ফাংগাস খাওয়ার ইচ্ছেটা ওর মনে দমকা হাওয়ার মতো এগোচ্ছিল। অথচ তার মনে এর আগে ওগুলো খাবার কোনো ইচ্ছে জাগেনি। আমি তারপর পথ দিয়ে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ বালি থেকে বিচিত্র শব্দ পেলাম। ফাংগাসের একটা ঝাড় আমার কনুই-এর কাছে নড়াচড়া করছিল। সেদিকে তাকিয়ে মনে হলো ঝাড়টার আকৃতির সঙ্গে কোন বিকৃতদেহ মানুষের মিল রয়েছে। মাথায় এই চিন্তাটা আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশ্রী শব্দ এলো। জিনিষটার মাথা আকারহীন একটা ধূসর বল। বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা ফাংগাসের তাল আঁকড়ে ধরলাম। তারপর কিছুতেই আমার আর তৃপ্তি হয় না। গোগ্রাসে খাওয়ার মাঝখানে সকালের আবিষ্কারের কথাটা আমাকে ভাবল। তারপর নিজের প্রতি ঘৃণায় ফাংগাসের টুকরোটা ফেলে দিলাম। আমাকে দেখে ও সব বুঝলো এবং সে আমাকে নীরব সহানুভূতি জানাল। আমি তাকে সমস্ত ঘটনা বললাম। কিন্তু অদ্ভুত ফাংগাসটার কথা গোপন করে গেলাম। আমি আতঙ্কের বোঝা বাড়ালাম না।
আমি বুঝলাম আমি যা দেখেছি তা ওই সমুদ্রের মধ্যে দাঁড়ানো জীর্ণ জাহাজের যাত্রীদের কোনো একজনের ভয়াবহ পরিণতি, আর একই পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।
এরপর আমরা ঐ জঘণ্য খাদ্য এড়িয়ে চললেও দিনের পর দিন উদ্দাম গতিতে ফাংগাসের পরগাছা দেহটাকে দখল করলো। আমরা বংশবৃদ্ধিতে বাধা দিতে পারলাম না। সুতরাং দেহ দিনে দিনে ফাংগাসে পরিণত হলো। আমরা বুঝতে পারলাম যে পুরুষ-নারী বুঝতে পারলাম।
আর দিনের পর দিন আমাদের লড়াই একটা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। ঐ কালান্তিক ফাংগাস মুখে দেবার কামনা আমরা রুখতে পারবো না।
এক সপ্তাহ আগে আমরা বিস্কুট খেয়েছি এবং তিনটি মাছ ধরেছি। আজ রাতে মাছ ধরতে এসে আপনাদের নৌকা দেখতে পেলাম। তখন আপনাদের ডেকে আপনাদের দেওয়া খাবার খেলাম। পতিত দুই আত্মাকে সহানুভূতি ও দয়া করবার জন্য ভগবান আপনাদের বঞ্চিত করবেন না।
জলে বৈঠা ডোবানোর শব্দ পাওয়া গেল, শেষবারের মতো কণ্ঠস্বর এলো। হালকা কুয়াশা ভেদ করে আসা ভৌতিক স্বরে বিষণ্ণতা এলো–আমি বিদায় নিলাম।
আমি দেখলাম যে ভোর হয়ে এসেছে। চাপা আলোয় নৌকা দূরে যেতে দেখলাম। মনে হলো একটা পাতের ভেলা ভাসছে। বৈঠা দুটো জল ঠেলে চলল। আমার দৃষ্টি পড়ল মাথার উপর। বৈঠা জলে ডুবলো। নৌকাটা আলোর বৃত্তের বাইরে, ঐ জিনিষটা স্পঞ্জের বলের মতো কয়াশায় অদৃশ্য হয়ে গেল।