আমি রাত্রির সন্তান!
জীবনের এক নিষ্ঠুর পাঠশালায় কঠিন শিক্ষার পাঠ নিয়েছে অঞ্জন চৌধুরী, দু-চারটে ছুরি-হাতে গুণ্ডাকে সে পরোয়া করে না কিন্তু এই অপরিচিত আগন্তুক তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে অঞ্জন প্রশ্ন করল, আপনার সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে বলে তো মনে হয় না। আপনি আমার গুপ্তকথা জানলেন কেমন করে?
অন্ধকার আকাশের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে আগন্তুক বলল, ওখানে কী দেখছেন?
-ওখানে?… দেখছি, রাতের আকাশে জ্বলছে অসংখ্য তারা।
ওরা তারা নয়। অসংখ্য নক্ষত্রের অগ্নিময় চক্ষু মেলে মায়াবিনী রাত্রি তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে, পাহারা দিচ্ছে তার গোপন রহস্যের রত্নভাণ্ডার। সেই রত্নভাণ্ডারের রহস্য যার জানা আছে, পৃথিবীর কোনো বিষয় তার অজানা নয়। মায়াবিনী রাত্রি তার অসংখ্য নক্ষত্রের জ্বলন্ত চক্ষু মেলে যা দেখতে পায়, আমি মাত্র দুটি চক্ষুর সাহায্যেই তা দেখতে পাই। কারণ?… কারণ, আমি যে রাত্রির সন্তান!…
তারপরই শুরু হল ঘটনার পর ঘটনার আবর্ত… অঞ্জন একদিন সভয়ে দেখল যারা তার একান্ত আপন, তাদের দিকে থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে এক জীবন্ত বিভীষিকা!… সেই বিভীষিকার কবল থেকে অঞ্জন কি পারবে তার প্রিয়জনদের রক্ষা করতে?…
.
“আকাশের বুকে জ্বলছে অসংখ তারা… ওরা তারা নয়..অসংখ্য নক্ষত্রের অগ্নিময় চক্ষু মেলে মায়াবিনী রাত্রি তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে, পাহারা দিচ্ছে তার গোপন রহস্যের রত্নভাণ্ডার। পৃথিবীর মানুষ সেই রত্নভাণ্ডারের সন্ধান জানেনা।কিন্তু আমি জানি। কারণ?…আমি যে বাড়ির সন্তান!”
১৯৮২ সালে শুকতারা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় অলংকরণ সহ আধার গল্পটি। পরবর্তীকালে ১৯৮৭ সালে একই গল্প নির্মল বুক এজেন্সি থেকে প্রকাশিত হয় রাত্রির সন্তান নাম দিয়ে। ওই বই-এর প্রচ্ছদচিত্রে ময়ুখ নিজের মুখের আদলে ছবি এঁকে ছিলেন। শিল্পীর ৫৫ বছর বয়েসে লিখিত আধার কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র অঞ্জন তথা কাজল (ঘোষ) চৌধুরীর সঙ্গে ব্যক্তি ময়ুখ চৌধুরীর তথা (শক্তি)প্রসাদ রায়চৌধুরী-এর অনেক মিল পাওয়া যায়। উভয়েই দক্ষিণ কলকাতার দেবেন্দ্র রোডের বাসিন্দা, ছদ্মনাম ব্যবহারের প্রবণতা, পশুপ্রেমী, মাঝারি চেহারার, দৃঢ় পেশীবদ্ধ নির্মেদ দেহের অধিকারী, কৈশোরে সিনেমাপ্রেমী, বক্সিং ও মার্শাল আর্টের প্রতি অনুরক্ত, স্ট্রিট ফাইট করেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। যদিও বইটিতে ময়ূখ লিখেছেন এই মৌলিক কাহিনির পশু ও মানুষের আত্মার বিনিময়ে আধার তত্ত্বের অংশটি বিদেশি কাহিনি থেকে বাংলা ভাষায় পরিবেশন করা হয়েছে। বাকি অংশটির সঙ্গে কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের সার্কাস জীবনে মিল রয়েছে।
—প্রকাশক
“রাত্রির সন্তান ও অমানুষিক মানুষ দুটি আলাদা গল্প এবং প্রত্যেকটি গল্পই স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রথম কাহিনির সঙ্গে দ্বিতীয় কাহিনির গল্পের সূত্র ধরে যোগাযোগ না থাকলেও তত্ত্বের দিক থেকে সাদৃশ্য আছে। প্রথম গল্পটি মৌলিক, কিন্তু দ্বিতীয় কাহিনি অমানুষিক মানুষ বাস্তবে সংঘটিত ঘটনা, মনগড়া গল্প নয়। প্রথম ঘটনাটি যে-তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে লিখিত, সেটি যে নিতান্তই লেখকের কল্পনা-প্রসূত নয়, দ্বিতীয় কাহিনি তারই প্রমাণ। বলা বাহুল্য হলেও বলছি অমানুষিক মানুষ বিদেশির অভিজ্ঞতার কাহিনিকে বাংলা ভাষায় পরিবেশন করা হয়েছে।
–ভূমিকা, রাত্রির সন্তান
[অমানুষিক মানুষ গল্পটি আত্মা-দুরাত্মা নামে রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ডে অন্তর্গত।]
.
.
রাত্রির সন্তান (উপন্যাস)
০১. অন্ধকারের অতিথি
রাত খুব বেশি হয়নি, কিন্তু লোডশেডিং-এর কল্যাণে গলিটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যেই অস্পষ্টভাবে দেখা যায় একটি খালি রিকশার সামনে একটি তরুণীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি মানুষ– চাপা গলায় বাদানুবাদ, নারীকণ্ঠের করুণ মিনতি আর পুরুষের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসে পথ-চলতি পথিকের কানে।
কলকাতা শহরের বুদ্ধিমান মানুষ এইরকম দৃশ্য দেখলে দেখেও না দেখার ভান করে সরে পড়ে; কিন্তু যে-যুবকটি গলিপথে হেঁটে আসছিল, সে হয় নিতান্ত নির্বোধ আর নয়তো এই শহরে সে নবাগত- বর্তমান কলকাতার পরিস্থিতি সম্পর্কে সে আদৌ অবহিত নয়।
অতএব একটি লোক যখন তরুণীর হাত থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তার পাশের লোকটি মেয়েটির করুণ প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে হাতঘড়িটা নেওয়ার উদ্দেশে তার হাত চেপে ধরেছে, ঠিক সেই সময়ে পথিকটি পাশ কাটিয়ে বুদ্ধিমানের মতো সরে না গিয়ে এগিয়ে এসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করল আপনার ঘড়ির দরকার থাকলে কিনে নেবেন, দোকানে অনেক ঘড়ি পাওয়া যায়। দয়া করে ওঁর হাতটা ছেড়ে দিন।
গুণ্ডাটা চমকে উঠল, কিন্তু অনুরোধ রাখল মেয়েটির হাত ছেড়ে সে পিছিয়ে এল, সঙ্গেসঙ্গে তার ডান হাতে একটা ধারাল ছোরা অন্ধকারেও চকচক করে উঠল।
ছোরাটা উঁচিয়ে ধরে সে কর্কশ স্বরে বলল, তোমাকে দালালি করতে কে ডেকেছে? সোজা চলে যাও এখান থেকে।
পাশে দাঁড়ান দুই স্যাঙ্গাত জামার নিচে হাত দিল বোধহয় লুকানো অস্ত্র বার করার জন্য; কিন্তু তারা অস্ত্র বার করার আগেই ঘটল এক অভাবিত কাণ্ড–
পথিকের ডান হাত বিদ্যুদ্বেগে ছুরিকাধারীর মুখের উপর ছোবল মারল, সঙ্গেসঙ্গে আর্তনাদ করে লোকটা ছিটকে পড়ল রাস্তার উপর! তার সেই দুই সঙ্গী সবিস্ময়ে দেখল তাদের দোস্ত দুই হাতে মুখ চেপে ধরে ছটফট করছে! বলাই বাহুল্য, হাতের ছুরিটা আগেই হস্তচ্যুত হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটির উপর!
বিস্ময়ের চমক কাটার আগেই পথিক আবার আক্রমণ করল। যে-গুণ্ডাটা মেয়েটির ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছিল, এবারের শিকার হল সে। দুজনের মাঝখানে প্রায় পাঁচ ছয় হাত রাস্তা পথিক পেরিয়ে গেল চোখের নিমেষে, পরক্ষণেই কি ঘটল বোঝা গেল না। শুধু দেখা গেল, ব্যাগ হাতে গুণ্ডাটা তিন-চার হাত দূরে ছিটকে পড়ে একেবারে স্থির হয়ে গেল! লোকটা আর্তনাদ করারও সময় পায় নি।
পথিক এইবার ঘুরে দাঁড়াল তৃতীয় ব্যক্তির দিকে, ছুরি-ছোরা দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়, বুঝেছ? এবার সোজা কেটে পড় এখান থেকে, না হলে তোমার অবস্থাও হবে তোমার বন্ধুদের মতো।
লোকটা ইতস্তত করছিল, কিন্তু পথিক তার দিকে এগিয়ে আসার উপক্রম করতেই সে তৎক্ষণাৎ দুর্জনের সান্নিধ্য ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল
চোখের পলকে পিছন ফিরে এক দৌড়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল অকুস্থল থেকে! ধরাশায়ী দুই বন্ধুর দিকে একবারও দৃষ্টিপাত করল না!
মাটিতে পড়ে-থাকা ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে পথিক মেয়েটির হাতে দিল, এবার চলুন, এখান থেকে সরে পড়া যাক।
মেয়েটি এদিক-ওদিক দৃষ্টিনিক্ষেপ করল রিকশাওয়ালার উদ্দেশে। কিন্তু তার দেখা পাওয়া গেল না। লোকটা গোলমালের সূত্রপাত দেখে আগেই সরে পড়েছে নিঃশব্দে।
মেয়েটির মনের ভাব বুঝে পথিক বলল, রিকশার আশা করে লাভ নেই। আপনি কোথায় যাবেন?
কম্পিত স্বরে উত্তর এল, দেবেন্দ্র মল্লিক রোড।
-ওঃ! তাহলে তো কাছেই। চলুন, আমিও ওইদিকেই যাব।
সামনের সাদা একতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে তরুণী বলল, এটাই আমার বাড়ি।
-এই বাড়ি?
পথিকের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়ের আভাস পেয়ে তরুণী ফিরে তাকাল হ্যাঁ, এই বাড়ি। কিন্তু আপনি যেন চমকে গেলেন মনে হচ্ছে?
না চমকাই নি তো, পথিক এবার সহজ ভাবেই বলল, চমকানোর কি আছে?
তরুণীর মনে হল তার সঙ্গী যেন কিছু গোপন করতে চাইছে, কিন্তু এই বাড়িটাই তার বাসস্থান জেনে বিস্মিত হওয়ার কি আছে তা ভেবে পেল না। সে আর কোনো কথা না বলে দরজার কড়া নাড়ল।
পথিক বলল, এবার তো আপনি নিরাপদ। আমি এখন যেতে পারি?
সে কি! তরুণী মৃদু হাসল, মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন না?
পথে আসতে আসতেই মেয়েটি তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছে বাবার মৃত্যুর পর সে মায়ের সঙ্গে রয়েছে; বি. এ. পাশ করে ভাগ্যক্রমে একটি বিদ্যালয়ে সে শিক্ষিকার কাজ পেয়ে যায়। অবসর সময়ে কয়েকটি ছাত্রীকে পড়ায়। তার উপার্জিত অর্থেই মা আর মেয়ের অন্নবস্ত্রের সংস্থান হয়। বাবা ওই বাড়িটি ছাড়া কিছু রেখে যেতে পারেন নি। সাধারণত রাত আটটার মধ্যেই সে বাড়িতে এসে পড়ে, কিন্তু আজ এক ছাত্রীর বাড়িতে দেরি হয়ে গেছে- পথে এই বিপত্তি।
অবশ্যই নিজের থেকে এত কথা বলতে চায়নি মেয়েটি, কিন্তু পথিক যখন রাতবিরেতে একা ঘুরে বেড়ানোর জন্য তাকে মৃদু তিরস্কার করল এবং নারী স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ পরিণাম দেখিয়ে আধুনিকাদের কটাক্ষ করে মন্তব্য প্রকাশ করল, তখন আর চুপ করে থাকা সম্ভব হল না…
মেয়েটি তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলেও পথিক নিজের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই বলে নি। এদিকে সে কোথায় এসেছে জানতে চাওয়ায় পথিক যেন বিব্রত বোধ করেছে, তারপর বলেছে তার বন্ধুর এক পরিচিত ব্যক্তির সন্ধানেই সে এদিকে এসেছিল। রাস্তার নাম তার মনে আছে, যে কাগজে উক্ত ভদ্রলোকের নাম-ঠিকানা লেখা ছিল, সেটা সে হারিয়ে ফেলেছে। শুধু রাস্তার নাম দেখে কলকাতা শহরে কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যে অতিশয় দুরূহ, মেয়েটির এই মন্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়ে সে বলেছে, পথে বেরুনোর সময়ও কাগজটা তার সঙ্গে ছিল, কিন্তু এখন সে কাগজটা পাচ্ছে না। হয়তো মারামারির সময়ে কাগজটা রাস্তায় পড়ে গেছে। ব্যাপারটা একেবারে অসম্ভব নয়, কিন্তু মনে হল পথিক সত্যি কথা বলছে না– তবু যে-লোক তার অর্থ ও সম্মান বাঁচিয়েছে তাকে আর জেরা করেনি সীমা।
সীমা- সীমা চৌধুরী। পথে আসতে আসতে তার নাম জানিয়েছে সীমা পথিক বন্ধুকে। পথিকের নামটাও সে জেনেছে এর মধ্যে। নিতান্ত সৌজন্যের খাতিরেই অঞ্জন ঘোষ তার নাম জানিয়েছে সঙ্গিনীকে; কিন্তু তার বাসস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই বিব্রত বোধ করেছে। আমতা-আমতা করে অঞ্জন জানিয়েছে কর্মস্থল দিল্লি, সে সেখানেই থাকে। কলকাতার পার্ক সার্কাসে এক বন্ধুর বাড়িতে দুদিন হল এসেছে, তবে ঠিকানাটা তার মনে নেই। তার গন্তব্যস্থল এবং বর্তমান বাসস্থান সম্পর্কে স্মরণশক্তির নিদারুণ দুর্বলতা খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি সীমার কাছে। শোনা যায়, ভাবুক প্রকৃতির কবি কিংবা শিল্পীরা দারুণ আপন-ভোলা হয়, কিন্তু অঞ্জন ঘোষ মানুষটাকে কবি বা শিল্পী বলে ভাবতেই পারে না সীমা। দিল্লিতে সে কি কাজ করে এই প্রশ্নটাও সীমার মনে এসেছিল, কিন্তু যে-লোক নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছুই বলতে চায় না, তাকে আর প্রশ্ন করার প্রবৃত্তি হয়নি সীমার।
কিন্তু নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে যতই অনীহা থাক, সীমার সম্বন্ধে অঞ্জন ঘোষের আগ্রহের অভাব ছিল না। বিশেষ করে সীমার বাবা মহাদেব চৌধুরীর নামটা শোনার পর থেকেই সীমার বিষয়ে তার কৌতূহল যেন হঠাৎ অন্তত তীব্র হয়ে উঠেছে। সত্যি কথা বলতে কি, সীমার পিতৃনাম শোনার আগে পর্যন্ত অঞ্জন ঘোষের আচরণে একটা নির্লিপ্ত সৌজন্যবোধ ছাড়া বিশেষ মনোযোগের আভাস দেখা যায় নি। কিন্তু মহাদেব চৌধুরী নামটা শোনামাত্র তার চমকটা সীমার চোখে পড়েছে এবং তারপর থেকেই অঞ্জন ঘোষ যেন সীমার অস্তিত্ব সম্পর্কে বড়ো বেশি রকম সচেতন হয়ে উঠেছে।
অঞ্জন ঘোষ মানুষটাকে কেমন যেন গোলমেলে মনে হয়েছে সীমার, কিন্তু যে-মানুষটা তাকে এইমাত্র বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, তাকে বাড়ির দরজা থেকে বিদায় দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না– অতএব ভিতরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সীমা। শুধু কৃতজ্ঞতাবোধে নয়, মানুষটাকে এর মধ্যেই তার ভালো লেগে গেছে…
অঞ্জন ঘোষ খুব লম্বা চওড়া নয়, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে নিতান্তই সাধারণ। তার মতো একটি মানুষ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যেভাবে সশস্ত্র গুণ্ডাদের কাবু করল, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তার বিস্ময়কর কীর্তি আর সংযত ভদ্র ব্যবহার সীমাকে আকৃষ্ট করেছিল, তার উপর কৃতজ্ঞতাবোধ তো ছিলই। অঞ্জন মুখে বিদায় চাইলেও এখনই বোধহয় সীমার সান্নিধ্য ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ছিল না; তাই সীমা যখন মায়ের সঙ্গে দেখা করে যেতে বলল, সে মৃদু হেসে চুপ করে রইল। মনে হয় এই ধরনের অনুরোধই আশা করেছিল সে।
দরজার কড়া ধরে আবার নাড়তে যাচ্ছিল সীমা, কিন্তু তার আগেই দরজা খুলে গেল। খোলা দরজার উপর এসে দাঁড়াল একটি নারীমূর্তি। অঞ্জন বুঝল, ইনিই সীমার মা। মহিলাটির হাতে বা গলায় অলঙ্কারের চিহ্নমাত্র ছিল না, কালো পাড়ের সাদা শাড়িটাও নিতান্তই সাধারণ তবু অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মধ্যেও তার মুখশ্রীতে আভিজাত্যের স্বাক্ষর দেখতে পেয়েছিল অঞ্জন।
হঠাৎ লোডশেডিং-এর অভিশাপমুক্ত হয়ে সারা এলাকাটা আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠল। মুক্তদ্বারপথে এক ঝলক আলো এসে পড়ল অঞ্জনের গায়ের উপর।
মাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল সীমা, কিন্তু তার আগেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, এ কী! এ কী ব্যাপার!
মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে সঙ্গীর দিকে দৃষ্টিপাত করেই চমকে উঠল সীমা, রক্ত! আপনার জামাটা যে রক্তে ভিজে গেছে!
হ্যাঁ, অঞ্জনের হালকা-ধূসর সোয়েটারে বুকের কাছে লাল রক্তের ছাপ হঠাৎ-আলোর ঝলকানিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দ্রুত এগিয়ে এসে দরজার চৌকাঠে পা রেখে সে বলল, চলুন, ভিতরে চলুন।
মহিলা সমানে এসে তাদের একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে এলেন। সোফার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সীমা বলল, অঞ্জনবাবু, বসুন।
তারপর মায়ের দিকে ফিরল, মা, আমি পথে গুণ্ডার খপ্পরে পড়েছিলুম। ইনি আমায় উদ্ধার করেছেন। এঁর নাম অঞ্জন ঘোষ। আর অঞ্জনবাবু বুঝতেই পারছেন, ইনি আমার মা।
অঞ্জনের দিকে অনুযোগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সীমা বলল, অন্ধকারে বুঝতে পারিনি, বুকে ছুরির খোঁচা লেগেছে। কথাটা একবার বলবেন তো? দরজা থেকেই তো বিদায় নিচ্ছিলেন। আমরা কি এতই অকৃতজ্ঞ আর স্বার্থপর যে, ওষুধ-বিষুধ না লাগিয়েই আপনাকে দরজা থেকে বিদায় করে দেবে?
কুণ্ঠিতভাবে হেসে অঞ্জন বলল, না, তা নয়! ছুরির খোঁচা লাগে নি। ওটা গুণ্ডাদের গায়ের রক্ত।
বাজে কথা, সীমা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, অঞ্জনবাবু, লোকটাকে আপনি লোহার রড কিংবা ছুরি দিয়ে মারেননি, হাতেই মেরেছেন। অতটা রক্ত ছিটকে আপনার গায়ে লেগেছে বলতে চান?… জামা খুলুন, আমি দেখব।
হ্যাঁ, জামাটা খুলে ফেল, সীমার মা বললেন, আমিও একবার দেখতে চাই। বিপদের সময় সঙ্কোচ করতে নেই।
আমতা-আমতা করে অঞ্জন বলল, কিন্তু বিপদ তো হয় নি।
সেটা আমি বুঝব, সীমার মা এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন, তুমি বললাম বলে কিছু মনে কোরো না বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, তুমি বলবেন বইকী, দ্বিধাগ্রস্তভাবে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জন বলল, কিন্তু জামাটা কি খুলতেই হবে?
মৃদু হেসে মা বললেন, হ্যাঁ।
নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই সোয়েটার এবং শার্ট খুলে ফেলল অঞ্জন। তাতেও নিষ্কৃতি নেই, অতএব গেঞ্জিটাও খুলতে হল। না, কোথাও আঘাতের দাগ বা রক্ত দেখা যাচ্ছে না। সত্যি কথাই বলেছে অঞ্জন। কিন্তু অঞ্জনের নিরাবরণ ঊর্ধ্বাঙ্গের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল সীমা-~
দৃঢ় পেশীবদ্ধ দেহ; বুকে, পেটে, কাঁধে কোথাও মেদের অস্তিত্ব নেই, শুধু দেখা যায় ঢেউ-খেলানো মাংসপেশীর বিস্তার! একেই বোধহয় বলে বর্ণচোরা আম! এতক্ষণে সীমা বুঝল, একটু আগে যে ভেলকিটা দেখিয়েছে অঞ্জন, তার উৎস কোথায়!
কিন্তু শুধু পেশীর সৌষ্ঠব নয়, আর একটি বস্তু সীমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল– বুকের নিচে পাঁজরের কাছে তিনটি সমান্তরাল দীর্ঘ ও গভীর ক্ষতিচিহ্ন রয়েছে অঞ্জনের দেহে, মনে হয় ত্রিশূলের মতো কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেউ পাঁজরের উপর ওই ক্ষতচিহ্ন তিনটি এঁকে দিয়েছে।
সীমা বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, কী ভীষণ! এমনভাবে কেটে গিয়েছিল কি করে?
অত্যন্ত বিব্রত হয়ে অঞ্জন বলল, ও কিছু নয়। অনেকদিন আগে একটা বনবেড়াল আঁচড়ে দিয়েছিল।
বনবেড়াল! সীমার দুই চোখে অবিশ্বাস, বনবেড়াল এমন সাংঘাতিক ভাবে আঁচড়ে দিল? তা বনবেড়ালটার কবলে পড়লেন কি করে? খুব বনে বনে ঘুরতেন বুঝি?
ইয়ে, তা একসময় ঘুরেছি বইকী, অঞ্জনের মুখ কাচুমাচু।
কিন্তু বনবেড়াল কি হঠাৎ মানুষকে তেড়ে এসে আঁচড়ে দেয়? সীমার হৃতে কুঞ্চনরেখা, আর বনবেড়ালের নখে এমন সাংঘাতিক ক্ষত হয়?
হয়, হয়, মস্ত বড়ো বনবেড়াল যে! তাড়াতাড়ি গেঞ্জিটা তুলে নেয় সে। কিন্তু গায়ে দেবার আগেই বাধা পড়ল।
তোমার বাঁ হাতের উপর এই লাল জডুলটা ভারি অদ্ভুত, সীমার মা এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি, ক্ষতচিহ্নের পরিবর্তে অঞ্জনের বাহুর উপর লাল চিহ্নটাই যেন তাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে, এটা কি জন্ম থেকেই রয়েছে?
বলতে বলতেই বাহুর উপর জডুল চিহ্নটায় হাত রাখলেন তিনি।
তাই তো শুনেছি– চটপট জামা পরে ফেলে অঞ্জন।
আমি একজনকে জানতাম, অঞ্জনের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাইলেন সীমার মা, তার বাঁ হাতের উপরদিকে ঠিক এই রকম অর্ধচন্দ্রের মতো লাল জড়ুল ছিল। ঠিক এই রকম।
হতে পারে–অঞ্জন অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, দুটো মানুষের মধ্যে সাদৃশ্য থাকা অসম্ভব নয়।