১৯. দুরবিনের ফুটোয় চোখ রেখে

দুরবিনের ফুটোয় চোখ রেখে হঠাৎ একসময়ে কেনেডি চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে! ঐযে, দূরে, কতগুলো ঘোড়সোয়ার ছুটে চলেছে বলে মনে হচ্ছে! অবশ্য ভীষণ ধূলো উড়ছে, তাই ভালো করে সঠিক কিছুই বুঝতে পারছি না।

ফার্গুসন সেদিকে দুরবিন ঘুরিয়ে নিলেন : ঘোড়সোয়ার বলেই তো মনে হচ্ছে। তবে অনেক দূরে রয়েছে বলে ঠিকঠাক চেনা যাচ্ছে না, কেবল কালো কতগুলো চলন্ত ফুটকিই চোখে পড়ছে।

আমি নজর রাখছি। খুব অবাক লাগছে আমার। হয়তো কোনো অশ্বারোহী সেনাবাহিনী চলেছে।

তোমার আন্দাজই সম্ভবত ঠিক। ওরা নির্ঘাৎ কোনো আরব ঘোড়সোয়ার বাহিনী। আমরা যেদিকে যাচ্ছি, ওরাও সেই দিকেই যাচ্ছে। অবশ্য ওদের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি যাচ্ছে আমাদের বেলুন, কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুবো। তখন না-হয় ভেবে দেখা যাবে, আমাদের কী করা উচিত।

ঠিকই ধরেছো তুমি। কেনেডি কিছুক্ষণ ভালো ভাবে দেখে নিয়ে বললেন, আরব সওয়ারদের বাহিনী বলেই মনে হচ্ছে! কী জোরে ছুটছে, দেখেছো? ঠিক তীরের মতো। জনা-পঞ্চাশেক হবে সংখ্যায়। সার বেঁধে চলেছে সবাই মিলে। দলের সর্দারটি প্রায় শো-খানেক গজ আগে-আগে যাচ্ছে।

ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দরকার বুঝলে এখানেই বেলুন নামাবার ব্যবস্থা করবো। তুমি কী বলে?

ভারি আশ্চর্য তো? কেনেডি দুরবিনের ফুটোয় চোখ রেখেই বিস্মিত স্বরে বলে উঠলেন, বড়ো অদ্ভুত লাগছে আমার—ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। ওদের গতিবেগ, চলার ভঙ্গি আর বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে তো নেহাৎ সাধারণ কোনো রুটিন কুচকাওয়াজ বলে মনে হচ্ছে না। এ যেন কাউকে তাড়া করে নিয়ে চলেছে ওরা। ফার্গুসন, আমার কিন্তু কী রকম লাগছে! আরো স্পষ্ট না-দেখে বেলুন নামানো বোধহয় উচিত হবে না।

তুমি ঠিক দেখেছো তো?

নিশ্চয়ই! উঁহু, ফার্গুসন, আমার আন্দাজ মোটেই ভুল হয়নি। সত্যিই কাউকে ভীষণভাবে তাড়া করে যাচ্ছে ওরা। সামনের ঐ লোকটা সর্দার নয়—ওকেই ধরবার জন্যে ছুটেছে। ক্রমেই তার সঙ্গে ওদর দূরত্ব কমে আসছে। একজন লোককে ধরবার জন্যে আস্ত একটা বাহিনী! কী ব্যাপার বুঝতে পারছি না তো! সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার কাছে! খুব রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে!

বেলুন আরো কাছে এগিয়ে এলো। প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে ঘোড়সোয়ারেরা।

হঠাৎ কেনেডি বিস্ময়ের স্বরে চীৎকার করে উঠলেন, ফার্গুসন! এ কী দেখছি।

বন্ধুর গলার স্বর শুনে ফার্গুসন আঁৎকে উঠলেন। কী? কী হলো?

এ কি স্বপ্ন, না মায়া, না মতিভ্রম? কী ব্যাপার?

এ-যে জো! দুরবিনে স্থির দৃষ্টি রেখে কেনেডি বলে উঠলেন, জো-কেই এই আরবরা তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে! ক্রমেই ব্যবধান কমে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে!

 

 

দেখি! দেখি! বলে ফার্গুসন দুরবিন তুলে নিলেন।

আরে! সত্যিই তো!

ও আমাদের দেখতে পায়নি।

এক্ষুনি আমি সব ব্যবস্থা করছি। এই বলে ফার্গুসন চুল্লির আগুন কমিয়ে দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা ওর ঠিক মাথার ওপর গিয়ে পৌঁছে যাবো।

বেলুন ক্রমে নিচে নেমে আসছে। আরব-বেদুইনদের বেলেল্লা চীৎকার শোনা যাচ্ছে। বেলুন থেকে। বিকট গলায় চাচাতোচাতে জোর পশ্চাদ্ধাবন করছে তারা, তাদের পিছনে যে বেলুন এসে গেছে তা তাদের নজরে পড়েনি। প্রায় পাঁচশো গজের মধ্যে এসে পড়েছে ভিক্টরিয়া।

আমি বন্দুক তুলে ফাঁকা আওয়াজ করছি, কেনেডি বললেন, তাহলেই ও ফিরে তাকিয়ে আমাদের দেখতে পাবে।

আরবদের সঙ্গে জো-র দুরত্ব আরো অনেক কমে গিয়েছে। ছুটতে ছুটতেই একজন আরব তাকে লক্ষ্য করে বল্লম উঁচোলো। কেনেডি আর দেরি করলেন না। তক্ষুনি তার অবার্থ নিশানায় গুলি ছুঁড়লেন; পলকের মধ্যে আরবটি ঘোড়া থেকে ছিটকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে গেলো। জো কিন্তু বন্দুকের আওয়াজ শুনেও ফিরে তাকালো না, কোনো দৃকপাত না-করেই সামনের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে লাগলো।

কেনেডির বন্দুক অবশ্য আরেকবার অগ্নিবর্ষণ করলো। আরেকজন আরব ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো, আর কয়েকজন আবার হঠাৎ থেমে গিয়ে চটপট মাটিতে নেমে পড়লো-বোধকরি সঙ্গীদের অবস্থা দেখার জন্যে : বাকিরা কোনো দিকে দৃপাত নাকরে সোজা জো-র পেছন পেছন ছুটে গেলো। ব্যাপার কী বলো তো? জো থামছে না কেন?

না-থেমে ভালোই করেছে। ঠিক বেলুনের গতিপথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে ও, নিশ্চয়ই আমাদের ভরসাতেই আছে। শাবাশ জোর দ্যাখোনা, আমি গিয়ে ওকে একেবারে আরবদের নাকের ডগা থেকে তুলে নিয়ে আসবে। আমরা আর অল্পই পেছনে আছি। একটু সবুর।

কিন্তু এই সময়টুকু আমরা কী করবো?

তুমি বরং বন্দুকটা রেখে দিয়ে এক কাজ করো।পাউণ্ড-পঞ্চাশেক ওজনের একটা কোনো বস্ত্র তুলে ধরতে পারবে তুমি?

নিশ্চয়ই। তার চেয়ে ঢের বেশি ওজন তুলতে পারি আমি।

ঠিক আছে। ফাণ্ডসন একটা পাথর-ভরা বস্ত তুলে দিলেন কেনেডির হাতে। এটা নিয়ে তুমি তৈরি হয়ে থাকো। যেই আমি ইঙ্গিত করবে, অমনি ওটাকে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু খুব সাবধান, আমার নির্দেশ না-পাওয়া অব্দি কিছুতেই ফেলে না

যেন তাহলে মুশকিল হবে।

ঠিক আছে। তুমি যেমন বলবে, তা-ই হবে। ভিক্টরিয়া ততক্ষণে আরব ঘোড়সায়ারদের মাথার ওপর এসে পড়েছে। ফার্গুসন দোলনার সামনের দিকে এসে দাঁড়ালেন, হাতে তার দড়ির মই, সময়মতো ওটাকে ছুঁড়ে দেবেন জো-র কাছে। জো তখন আরবদের কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফিট দূরে, পুরো কদমে তার ঘোড়া ছুটছে। ধুলো উড়িয়ে, তুমুল টগবগ আওয়াজ করে। ভিক্টরিয়া আরব বেদুইনদের ছাড়িয়ে চলে এলো।

ফার্গুসন তার বন্ধুকে জিগেস করলেন, তৈরি তো?

হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত হয়ে আছি।

জো! জো! ওপরে তাকিয়ে দ্যাখো, এই বলে গলার জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন ফার্গুসন, সেইসঙ্গে দড়ির মইটা তিনি ফেলে দিলেন নিচে, মাটি পর্যন্ত নেমে গেলো সেটা।

ফার্গুসনের গলা শুনে ঘোড়ার গতি না-থামিয়েই পেছন দিকে ফিরে তাকিয়েছিলো জো। দড়ির মইটা কাছে আসতেই চক্ষের পলকে সেটা ধরে সে ঝুলে পড়লো, আর তেমনি ফার্গুসনের নির্দেশ অনুযায়ী পাথরভরা বস্তাটা কেনেডি ফেলে দিলেন। ভার কমে ওয়ায় তৎক্ষণাৎ এক ঝটকায় প্রায় দেড়শো ফিট ওপরে উঠে গেলো ভিক্টরিয়া।

কঠিন, আঁটো হাতে দড়ির মই ধরে ঝুলে রইলো জো। ঝাঁকুনিতে তখন সেটা ভীষণভাবে দুলছিলো, একটু যদি ফসকে যায় বা কোনোরকমে মুঠো আলগা হয়ে যায়, তাহলে,আর রক্ষে নেই। শ্বাস রোধ করে জোর কাণ্ড দেখতে লাগলেন তাঁরা। জোর কপালের শিরাগুলি তখন রক্তচাপে প্রবলভাবে ফুলে উঠেছে, অস্বাভাবিক এক দীপ্তিতে তার চোখ জ্বলে উঠেছে, ক্রমশ যেন ইন্দ্রিয়গুলির ওপর থেকে সে অধিকার হারিয়ে ফেলছে। আর তারই সঙ্গে মানিয়েই যেন নিচের আরবদের চঁচামেচিতে সে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলো না, এমনকী হাওয়ার শব্দও তার কানে পৌঁছুচ্ছিলো না। সার্কাসের ওস্তাদ খেলোয়াড়ের মতো অদ্ভুত কৌশলে তরতর করে সে অল্পক্ষণের মধ্যেই দোলনায় উঠে এলো।

দোলনায় পা দিতেই দুই বন্ধু তাকে জড়িয়ে ধরলেন। নিচে বেদুইনদের ক্রুদ্ধ শোরগোল তখন চরমে পৌঁছেছে, কিন্তু বেলুন যত দূরে সরে যেতে লাগলো–সেই আওয়াজও একটু-একটু করে মিলিয়ে যেতে লাগলো।

প্রভু! মিস্টার কেনেডি! কেবল এই দুটি কথা বলেই জো অজ্ঞান হয়ে পড়লো। তার শরীরে আর একটুও ক্ষমতা ছিলো না। আফ্রিকার উষ্ণ শুকনো হাওয়া সব যেন শুষে নিয়েছে। উত্তেজনা আর অবসাদ যেন পাকে-পাকে পেঁচিয়ে ধরছে তাকে। শরীরের নানা জায়গায় ছোটো-বড়ো কত যে ক্ষত। সে-সব থেকে রক্ত পড়ছে চুঁইয়ে। ফার্গুসন তাড়াতাড়ি তাতে নানারকম ওষুধ লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিলেন। একটু পরেই জ্ঞান ফিরে এলো জো-র, মিনমিনে গলায় সে জল খেতে চাইলো। ঢকঢক কবে বোতন, ভর্তি জল নিঃশেষ খেয়ে সে অবসাদ আর ক্লান্তির ফলে ঘুমিয়ে পড়লো। বেলুন তখন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার পশ্চিমভাগে। সেখানে, নীলগিরি পর্বতমালার একেবারে দুর্ভেদ্যগভীরে উঠেছে এক মস্ত চূড়া—যার নাম গ্রেট আইরি-ঈগলপাখির মস্ত বাসা। তার বিশাল বর্তুল আকৃতিটা কাটাওয়াবা নদীর তীরে ছোট্ট-যে শহর আছে, মরগ্যানটন নাম, সেখান থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে। আরো স্পষ্ট চোখে পড়ে যখন কেউ প্লেজেন্ট গার্ডেন গ্রামটার মধ্য দিয়ে গিয়ে পাহাড়টার দিকে এগিয়ে চলে যায়।

আশপাশের অঞ্চলের লোকে কেন-যে এই পাহাড়চূড়ার নাম দিয়েছিলো গ্রেট আইরি–ঈগলপাখির মস্ত বাসা—তা আমি এখনও জানি না। পাহাড়টা উঠে গেছে পাথুরে, রুগম্ভীর, অগম্য, আর বিশেষ-বিশেষ আবহাওয়ায় তার গায়ে জড়িয়ে থাকে এক গভীরনীল ও অদ্ভুত-সুদূর ভঙ্গি। তবে নামটা শুনে প্রথমেই যে-ভাবনাটা লোকের মাথায় খেলে যাবে, তা হলো নিশ্চয়ই এখানটায় শিকারি পাখিরা এসে বাসা বাঁধে, আস্তানা গাড়ে, তা-ই এই নাম : ঈগল, কর, গৃধিনী; অগুনতি পালকখচিত পাখনাওলা জীবের বসতি, মানুষের নাগালের বাইরে এই দূর-চূড়ার উপর ড়ুকরে ডেকে-উঠে পাক খেয়ে যাচ্ছে তারা। অথচ, এদিকে কিন্তু, এই গ্রেট আইরি পাখিদের যে খুব-একটা আকৃষ্ট করে তা অবশ্য মনে হয় না; বরং তার উলটোটাই সত্যি; আশপাশের এলাকার লোকজন মাঝেমাঝে উলটে বরং এই মন্তব্যই করে যে পাখিরা চুড়োটার দিকে যখন উড়ে যায়, তখন আচমকা দ্রুতগতিতে উঠে যায় আরো-উপরে, চক্কর দেয় শিখরটার ওপর, পাক খায়, তারপর ক্ষিপ্রবেগে দূরে উড়ে যায়, আকাশ-বাতাস ছিঁড়ে দেয় তাদের কর্কশ চীৎকারে।

তাহলে কেন শিখরটার নাম গ্রেট আইরি? তার চেয়ে বরং শিখরটার নাম জ্বালামুখ দিলেই মানাতো বেশি, কারণ এই খাড়া সটান-ওঠা বর্তুল দেয়ালগুলোর মধ্যে হয়তো গভীর-কোনো নয়ানজুলিই আছে। হয়তো ঐ দেয়ালগুলো আড়াল করে রেখেছে কোনো মস্ত পাহাড়ি ঝিল, যেমনটা প্রায়ই দেখা যায় আপালাচিয়ার পর্বতব্যবস্থার অন্যান্য অংশে, এমন-এক লেগুন যাকে অনবরত জল খাইয়ে যায় বৃষ্টিবাদল আর শীতের তুষার।

এককথায়, এটা কি তবে কোনো প্রাচীন আগ্নেয়গিরিরই আবাস ছিলো না-যে–আগুনের পাহাড় অনেক বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে সত্যি,তবে যার আভ্যন্তর স্তিমিত আগুন আবার যে ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে না, তা-ই বা কে জানে? গ্রেট আইরি কি একদিন আশপাশে সেই বিষম দুর্বিপাকই সৃষ্টি করবে না, যে-দুর্যোগ সৃষ্টি করেছে মাউন্ট ক্রাকাতোয়া কিংবা মাউন্ট পেলে? সত্যি যদি তার মাঝখানে গভীর-কোনো হ্রদ থেকে থাকে, তবে সেই জলের মধ্যে কি সর্বনাশই ওতপ্রােত মিশে নেই, যা একদিন হয়তো পাথুরে স্তরগুলোর ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে গিয়ে পড়বে গভীর নিচে, আর আগ্নেয়গিরির আগুনের কুণ্ডে পড়ে বাষ্প হয়ে পাক খাবে, আর পাথর ফাটিয়ে বার করে নেবে তাদের বাইরে বেরুবার পথ, ভয়ংকর বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে চারপাশ, গলন্ত লাভার প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ক্যারোলাইনার সুন্দর উপত্যকাদেশ, যেমনটা ঘটেছে এই সেদিন, ১৯০২ তে, মার্তিনিক-এ?

সত্যি-বলতে, এই শেষ সম্ভাবনাটা যে মোটেই কোনো অলীক বা অমূলক আশঙ্কা পশ্চিমমুখে উড়ে চলেছে। পথে যখন এক স্থানে রাত্রিবাসের জন্যে বেলুন থামানো হলো, জো তখনও মড়ার মতো নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা পরে বেলুন তখন সুদানের দক্ষিণ সীমান্তে জিণ্ডা শহরের–জিণ্ডার এখনকার নাম নাইজেরিয়া—কাছে। এসে পৌঁছুলো, জো জেগে উঠলো।

ঘুম থেকে উঠে প্রথমটায় সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, যেন তার উপলব্ধির সব ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছে, কিছুই যেন তার মাথায় ঢুকছে না আর। আস্তেআস্তে অবশ্য তার চোখের দীপ্তি সহজ হয়ে এলো। ফার্গুসন তার হাত চেপে ধরে কৃতজ্ঞতা জানালেন : নিজের জীবন তুচ্ছ করে তুমি আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছো, তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো, আমি তার কোনো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছি না।

জো এ-কথা শুনে একটু যেন লজ্জিত হলো আত্মপ্রশংসায় কান না-দিয়ে বললে, অমন কথা বলবেন না! ওভাবে তখন যদি ঝাঁপিয়ে না-পড়তুম, তাহলে সবাই মিলে মরতুম। কাজেই সেদিক দিয়ে আমি কেবল আপনাদেরই বাঁচাইনি, নিজেকেও বাঁচিয়েছি। আত্মরক্ষার জন্যেই আমি ও-কাজ করেছিলুম।

তারপর সে ধীরে-ধীরে তার কাহিনী খুলে বললে। চাড হ্রদে পড়ে কিছুদূর সাঁৎরে যাবার পর এক বিস্তৃত জলাভূমির মধ্যে এসে পড়ে সে; সেখানে হঠাৎ একটা দড়ি দেখে সে অবাক হয়, দড়ি ধরে তক্ষনি সে তীরে চলে আসে। তীরে এসে দ্যাখে দড়ির শেষ প্রান্ত মাটিতে তাদেরই বেলুনের নোঙর পোঁতা আছে। তা-ই দেখেই সে মোটামুটি একটা আঁচ করে নেয় বেলুন কোন দিকে গেছে। হ্রদের তীর থেকে ডাঙার একটু ভেতরে এসে প্রবেশ করে সে। সেখানে এসে দ্যাখে, একটা ঘেরাও-করা জায়গায় কতগুলো আরবি ঘোড়া নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খাচ্ছে। সে ভেবে, দেখলে যে, পায়ে হেঁটে এই অজানা দেশে যাওয়ার চাইতে ঘোড়াটার পিঠ করে সওয়ার হয়ে যাওয়া তার পক্ষে অনেক বেশি নিরাপদ হবে; তৎক্ষণাৎ সে একটি ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে চড়ে বসে দ্রুত তাকে ছুটিয়ে দেয়। লোকালয় ছাড়িয়ে সে তখন মরুভূমির দিকে এগোয় : এটাই তার পক্ষে সুবিধাজনক বলে মনে হয়। প্রতিমুহূর্তেই সে আশা করেছিলো এই বুঝি বেলুনটাকে দেখা গেলো, কিন্তু প্রতিবারই তাকে হতাশ হয়ে পড়তে হয়। আর তাতেই কি পার পাওয়া গেছে? দুর্ভাগ্য যখন আসে, তখন পেছনে-পেছনে একপাল শাগরেদ নিয়ে আসে। হঠৎ এক বেদুইনদের ঘোড়সোয়ার বাহিনীর সামনে পড়ে যায় সে–দস্যুতাই তাদের প্রধান বৃত্তি, পথে লোকজন দেখলে তাকে মেরে ফেলে তার সব জিনিশপত্র লুঠপাট করে নেয়াই তাদের পেশা। তারা যখন তুমুল চ্যাঁচামেচি করে তার পেছনে নিলে, প্রাণের ভয়ে কোনোদিকে দৃকপাত না-করে সোজা সামনের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় সে। এই হলো তার কাহিনীর সারমর্ম। পরের ঘটনা তো আপনারাই ভালো জানেন, বলে সে থামলে।

জো যে অকুতোভয় এবং দুঃসাহসী, বহু অভিযানে তাকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন বলে যাণ্ডসন তা ভালো করেই জানতেন। কিন্তু এখন জো তাদের জন্যে যা করেছে, ফার্গুসন তার কোনো তুলনা খুঁজে পেলেন না।

বেলুন তখন বিস্তীর্ণ এক মাঠের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে। নিচে দেখা যাচ্ছে। আফ্রিকার নানারকম জীব-জন্তু-জিরাফ, জিব্রা, উটপাখি, হরিণ এবং আরো কত-কী। ধীরে-ধীরে রক্তিম মরুপ্রান্তর পেরিয়ে শস্যশ্যামল স্নিগ্ধ বনভূমি উন্মোচিত হয়ে পড়লো তাদের চোখের সামনে।

রাত দশটার সময় আড়াইশো মাইল অতিক্রম করার পর ভিক্টরিয়া যেখানে এসে থামলো, এককালে সেখানে প্রসিদ্ধ এক শহর ছিলো। চাঁদের আলোয় তার ঝাঁপসা মসজিদ, গোল মিনার আর ঝোলানো অলিন্দের ধ্বংসাবশেষ অতীতের সমৃদ্ধির স্মৃতি নিয়ে বিষণ্ণভাবে পড়ে আছে। শহরের বাড়ি মিনার মসজিদ সবই এখন ভাঙাচোরা ও পরিত্যক্ত; অথচ এককালে এখানে প্রাচীন এক সভ্যতার সোনার যুগ কেটেছে লোকজনের উচ্চকিত ভিড়ে, হামামের গন্ধভরা পরিমলে, আর মিনারের বুরুজের সোনালি আলোর ঝলমলানিতে।

অস্পষ্ট উষাকালেই আবার ভিক্টরিয়ার যাত্রা শুরু হলো। কাজ রয়েছে তার। কাজ, দায়িত্ব, বাধ্যতা; কাজেই প্রচীন সেই শহরে ঘুরে বেড়িয়ে নষ্ট করার মতো সময় আছে নাকি তাদের?