ঘনবাহনের সোমবার ব্রত
কৈলাশ পর্বতের উত্তরে নিষধ পর্বতের উপরে এক বিশালপুরী–নাম স্বয়ংপ্রভা। ইন্দ্রের অমরাবতীর মতই সুন্দর সেই পুরী। ঘনবাহন নামে এক গন্ধর্ব সেখানে বাস করেন। তিনি তার সুন্দরী পত্নীর গর্ভে আটটি পুত্র. ও সবশেষে একটি কন্যা সৃষ্টি করেন। সেই কন্যার রূপের তুলনা হয় না। নাম গন্ধর্বসেনা, যৌবনে সে সখীগণের সঙ্গে বনে বনে ঘুড়ে বেড়ায়, নানান খেলায় মেতে থাকে।
যুবতী কন্যা কুমারী অবস্থা থাকলে বাবা-মার চিন্তার শেষ থাকে না, এমন রূপসী কন্যার আবার রূপবান পাত্রের দরকার। তবু ঘনবাহন ভাবলেন, কন্যাকে ডেকে একবার জিজ্ঞাসা করি, সে কেমন স্বামী চায়?
একদিন কন্যাকে বললেন– সেইকথার উত্তরে গন্ধর্বসেনা নিজ রূপের গর্ব করে বলল –আমার রূপের কোটি অংশের অনুরূপ পুরুষ আছে কি? কন্যার এমন অহঙ্কার পূর্ণ কথা শুনে মা-বাবা সহ সকল বন্ধু-বান্ধবও খুব অবাক হলেন, দুঃখিতও হলেন। একদিন গন্ধর্বসেনা দোলায় চড়ে সখীদের সঙ্গে বনে আনন্দ উপভোগ করছেন। এমন সময় এক গণনায়ক বিমানে চড়ে আকাশ বিচরণ করার সময় গন্ধর্ব সেনাকে দেখতে পেলেন। কুমারীগণ সকলেই নাচ-গানে মত্ত, গণনায়ক সেখানে নামলেন বিমান থেকে।
তখন সেই গণনায়ককে দেখে গন্ধর্বসেনা তার সখীদের বলল– দেবতা, দানব গন্ধর্ব বা মানব কাউকে আমার রূপের কোটি অংশের একাংশেরও যোগ্য দেখতে পাই না।
গন্ধর্বসেনার এমন গর্বিত বাণী শুনে গণনায়ক রেগে গিয়ে পাপ দিলেন- হে সুন্দরী, পদ্মনয়নে তুমি আমাকে দেখে যে রূপ সৌভাগ্য গর্বে দেবতা, গন্ধর্বগণকেও নিন্দা করছ, সেজন্য তোমার সর্বাঙ্গে কুষ্ঠ ব্যাধি হবে।
নিদারুণ শাপ শুনে গন্ধর্বসেনা ভয়ে কাঁপতে লাগল, সেই গণনায়কের পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল– আমাকে ক্ষমা করুন, আমি কখনই এমন কথা আর বলব না। এই দীনার প্রতি কৃপা করে শাপমোচনের ব্যাখ্যা করুন।
তখন গণনয়ক বললেন–দেখ গন্ধর্বসেনা, জাতি, রূপ, বিদ্যা ও সম্পর্কে মধ্যে যে-কোন একটা লাভ করে যে গর্বিত হয়, তার সেটি বিনষ্ট হয়, তাই গর্ব করা উচিত নয়, এখন শাপমোচনের বিষয় বলি শোনো–হিমালয় পর্বতে গোশৃঙ্গে নামে এক ঋষিবর আছেন তিনি তোমাকে এ বিষয়ে উপদেশ দেবেন।
এই কথা বলে গণনায়ক চলে গেলেন। গন্ধর্বসেনাও কাঁদতে কাঁদতে বাবা-মার কাছে সব বলল। কন্যার এমন কথা শুনে গন্ধর্বরাজ ও তার পত্নী ভীষণভাবে শোকাহত হয়ে গোশৃঙ্গ ঋষির আশ্রমে গেলেন। তাঁকে প্রণাম ও তার বহু স্তবস্তুতি করে মেয়ের অভিশপ্তর বিষয় বললেন– হে ঋষি, এই অধীনের প্রতি প্রসন্ন হয়ে যাতে আমার কন্যার কুষ্ঠ মোচন হয় এমন উপায় বলুন।
গোশৃঙ্গ ঋষি বললেন– সমুদ্রের তীরে সোমেশ্বর নামে এক বিখ্যাত শিবলিঙ্গ আছে, সর্বব্যাধি বিনাশ ও সকল সিদ্ধির জন্য নিয়ম করে একাহারে থেকে সোমেশ্বর লিঙ্গের পূজা করে, সসামবার ব্রত করে শিবের আরাধনা কর। তাহলে তোমার পুত্রীর শাপমোচন হবে।
তখন লিঙ্গ আরাধনার ইচ্ছা প্রকাশ করে ঘনবাহন জিজ্ঞাসা করলেন- হে ঋষি, সোমবার ব্রত কেমন করে করতে হয়? এর বিধি কি? কোন্ সময়ে করতে হয়?
গোশৃঙ্গ বললেন– চন্দ্র দক্ষের দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে শম্ভুর আরাধনা নিয়ম করে রোগ মুক্ত হয়ে সোমেশ্বর লিঙ্গের পূজা করেন। এবার পূজার বিধি শোন- যে কোনো মাসের শুক্লপক্ষে সোমবার এই ব্রত করতে হয়। প্রভাতে গাত্রোত্থান করে দন্তমার্জনা ও স্নানে শৌচ করে নিত্যকর্ম সাধন করে সমতল ক্ষেত্রে সুশোভিত কুম্ভ স্থাপন করবে। কুম্ভের উপরে আম্রপল্লব, চন্দন, শ্বেতবস্ত্র ও আভরণ দেবে। অপরদিকে সোমনাথের অষ্টমূর্তির পূজা করবে। নানারকম ভক্ষ ভোজ্য ফলমূলাদি নিবেদন করবে। দিনে ও রাত্রিতে এইভাবে পূজা করে রাত্রিতে ফুলশয্যায়ে শয়ন করে ধ্যান করতে হবে।
তারপর ঋষিবর পূজার মন্ত্রও বলে দিলেন। পরবর্তী সোমবারগুলিতে যা যা করতে হবে তাও বলে দিলেন। ব্রাহ্মণগণকে দান করার বিধিও জানিয়ে দিলেন। তারপর এইভাবে ব্রত করলে অক্ষয়পুণ্য লাভ হয়। ধনধান্য বৃদ্ধি হয়। পুত্র লাভ হয়। অপুত্রক এই ব্রত করলে পুত্র লাভ করে। এই ব্রতে বন্ধ্যারও পুত্র হয়। এই ব্রত সাধক বা সাধিকা দেহত্যাগের পর শিবপদ লাভ করে। এই সোমবার ব্রত বিধি বললাম। এখন যেখানে সোমেশ্বর লিঙ্গ বিরাজ করছে সেখানে যাও। ঋষি গোশৃঙ্গের এমন উপদেশ পেয়ে ঘনবাহন পূজার সকল উপকরণ সংগ্রহ করে শম্ভুর সোমবার ব্রত গ্রহণ করলেন।
গন্ধর্বরাজ ঘনবাহন শিবের কাছে বর লাভ করে ভক্তি করে সোমেশ্বরের উত্তরে দন্তপাণির কাছে শিবলিঙ্গ স্থাপন করলেন। তার নাম হল গন্ধকেশ্বর।